উত্তরার্চিক — অষ্টাদশ অধ্যায়
এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে)– ১।২।৪।৬।৭।৯।১০।১৩।১৫ ইন্দ্র; ৩।১১।১৮।১৯ অগ্নি; ৫ অশ্বিদ্বয় দেবতা (মতান্তরে বিষ্ণু).; ৮।১২।১৬ পবমান সোম; ১৪।১৭ ইন্দ্রাগ্নী।
ছন্দ– ১-৫।১৪।১৬-১৮।১৯ গায়ত্রী; ৬।৭।৯।১২।১৩ প্রগাথ বার্হত; ৮ অনুষ্টুপ; ১০ উষ্ণিক; ১১ প্রাগাথ কাকুভ, ১৫ বৃহতী।
ঋষি– ১ মেগাতিথি কাণ্ব ও প্রিয়মেধ আঙ্গিরস; ২ শ্রুতকক্ষ বা সুকক্ষ আঙ্গিরস; ৩ শুনঃ শেপ আজীগর্তি; ৪ শংযু বার্হস্পত্য; ৫ মেগাতিথি কাণ্ব; ৬।৯ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ৭ বালখিল্য (আয়ু কাণ্ব); ৮ অম্বরীষ বার্ষাভিঃ; ১০ বিশ্বমনা বৈয়শ্ব; ১১ সোভরি কাণ্ব; ১২ সপ্ত ঋষি (পূর্বে উল্লেখিত); ১৩ কলি প্রাগাথ; ১৪।১৭ বিশ্বামিত্র গাথিন; ১৫ প্রিয়মেধ কাণ্ব; ১৬ নিধ্রুবি; ১৮ ভারদ্বাজ বার্হস্পত্য; ১৯ বামদেব।
প্রথম খণ্ড
সূক্ত ১– পন্যং পন্যমিৎ সোতার আ ধাবত মদ্যায়। সোমং বীরায় শুরায়। ১। এহ হরী ব্রহ্মযুজা শশ্মা বক্ষতঃ সখায় ইন্দ্রং গীর্ভিৰ্গিবণ৷৷২৷৷ পাতা বৃত্ৰহা সুতমা ঘা গমন্নারে অস্মৎ। নি যমতে শতমূতিঃ ৷ ৩৷৷
সূক্ত ২– আত্বা বিশবিঃ সমুদ্রমিব সিন্ধবঃ। ন ত্বামিন্দ্রাতি রিচ্যতে। ১৷৷ বিব্যৰ্থ মহিনা বৃষ ভক্ষং সসামস্য জাগৃবে। য ইন্দ্র জঠরেষু তে। ২৷৷ উত্তরার্চিক অরং ত ইন্দ্র কুক্ষয়ে সোমমা ভবতু বৃত্রহ। অরং ধামভ্য ইন্দবঃ ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ৩– জরাবোধ তদ বিবিড়টি বিশেবিশে যজ্ঞিয়ায়। স্তোমং রুদ্রায় দৃশীক৷১৷৷ স নো মহা অনিমাননা ধূমকেতুঃ পুরুশ্চন্তু। ধিয়ে বাজায় হিন্বতু৷৷ ২৷৷ স রেবো ইব বিপতি-দৈবঃ কেতুঃ শৃণোতু নঃ। উথৈরগ্নিবৃহদ্ভানুঃ ॥৩৷৷
সূক্ত ৪– তদ বো গায় সুতে সচা পুরুহুতায় সত্বনে। শং যদ গবে ন শাকিনে৷৷৷৷ ন ঘা বসুনিযমতে দানং বাজস্য গোমতঃ। যৎ সীমুপশ্রব গিরঃ ॥ ২॥ কুবিৎ সস্য প্র হি ব্ৰজং গোমতং দস্যুহা গমৎ। শচীভিরপ নো বরৎ ॥৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– আত্মার উদ্বোধন-যজ্ঞে অভিষবকারী হে প্রাণসমূহ (অথবা, হে চিত্তবৃত্তিনিবহ)! ব্যবহার্য (ব্যবহারিক অর্থাৎ অতাত্ত্বিক) অনিত্য ধন ইত্যাদি এবং প্রশংসনীয় (অর্থাৎ বাস্তব. নিত্যসত্য) সোম (অমৃত অর্থাৎ অমৃতের মতো ভগবানের তৃপ্তিপ্রদ হৃৎ-গত সত্ত্বভাব বা ভক্তিসুধা সকলই) সেই বীর (অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে বিক্রমকারী) শূর (অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতি-বিলয়ের বিষয়ে শৌর্যসম্পন্ন) ভগবানকে প্রাপ্ত করো (অর্থাৎ প্রদান করো)। (ভাবার্থ, হে চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা যদি আত্ম-উদ্বোধন-যজ্ঞে অভিনব করতে ইচ্ছা করো, তাহলে তোমাদের বাহ্যধন ইত্যাদি আর আন্তর সত্ত্বভাব ইত্যাদি ভগবানে অর্পণ করো)। [মন্ত্রে বলা হচ্ছে– হে চিত্তবৃত্তিনিবহ অথবা প্রাণসকল! আর কেন মোহের পঙ্কে ডুবে আছ? একবার জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত করো। চেয়ে দেখো, দৃশ্যমান এ সবই অনিত্য। কিছুই তো তোমার নয়। এর সবকিছুই এখন আছে, পরক্ষণে নেই। জীবনাবসানে তারা তো কেউই সঙ্গে যায় না। তাই বলি, ভেবে দেখো– এ সব কিছুই তোমার নয়- সবই ভগবানের। তার জিনিষ, সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক, তাকেই অর্পণ করো। শুধু এই বাহ্যবস্তুই বা কেন! তোমার অন্তরেও যা আছে– জ্ঞান ভক্তি সুখ বা আনন্দ (সত্ত্বভাব-রূপ) এ সবও তো সেই ভগবানেরই প্রদত্ত। সুতরাং তার বস্তু তাকেই অর্পণ করো। তাহলে তোমার আত্ম, উদ্বোধনের যজ্ঞ সুসম্পন্ন হবে। আর ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করো। তিনি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই তিন ভুবনকে ব্যেপে আছেন; অর্থাৎ তিনি বিশ্বব্যাপী বিভু। আর কেমন? না– এই ত্রিভুবনের সৃষ্টি স্থিতি-প্রলয়ের কর্তা। লীলাময় ইচ্ছাময় তিনি; যখন যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবেই লীলা করেন। সর্বশক্তিমান্ তিনি; তার সেই লীলায় বাধা দেবার শক্তি কারো নেই। বিভিন্ন পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই, সঙ্গত অর্থে মন্ত্রের এই ভাবই গ্রহণ করা হয়েছে]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-১দ ৯সা) দ্রষ্টব্য]।
১/২– ব্রহ্মপ্রাপক, কল্যাণদায়ক, পাপহারক ভক্তি ও জ্ঞান– স্তোত্রের দ্বারা আরাধনীয়, মিত্রস্বরূপ, ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে আমাদের হৃদয়ে আনয়ন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানভক্তি সাধনার দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [জ্ঞান ও ভক্তির সাধনার দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি– এটাই প্রার্থনার মর্ম। কিন্তু মন্ত্রের যে প্রচলিত ব্যাখ্যা আছে, তার মধ্যে একটি বঙ্গানুবাদ এই স্তোত্রযুক্ত সুখকর অশ্বদ্বয় এই যজ্ঞে স্তুতি দ্বারা বিশ্রুত এবং সম্ভজনীয় সখা ইন্দ্রকে আনয়ন করুন। এখানে অশ্বের প্রসঙ্গ কেন এল, বোঝা যায় না। মূলে আছে হরী। ভাষ্যকার তার অর্থ করেছেন অশ্বে। একজন হিন্দী ব্যাখ্যাকার লিখেছেন– পাপনাশক ইন্দ্রকে ঘোড়ে। আমরা বলেছি– পাপহারকে ভক্তিজ্ঞানে। ব্রহ্মযুজা পদের ভাষ্যকার অর্থ করেছেন– ব্রহ্মেণ মন্ত্রেণ স্তোত্রেণ হবিষা বা যুজামানৌ। এই অর্থ যে অসঙ্গত, আমরা তা বলছি না। কিন্তু বর্তমান স্থলে আমাদের গৃহীত ব্রহ্মপ্রাপকেঅর্থই অধিকতরসঙ্গত মনে হয়। জ্ঞান-ভক্তিই ভগবৎপ্রাপ্তির উপায়, মন্ত্রের শেষাংশের দ্বারাও এই মত সমর্থিত হচ্ছে]।
১/৩– আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপকরণ গ্রহণকারী অজ্ঞানতানাশক পরমদেবতা নিশ্চিতভাবে আমাদের প্রাপ্ত হোন; আমাদের নিকট হতে যেন দূরে না থাকেন; পরমরক্ষক সেই দেবতা আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, অজ্ঞানতা নাশক, বিপদ থেকে রক্ষাকারী ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [ইতিপূর্বেও আমরা একটি মন্ত্রের ব্যাখ্যায় দেখেছি যে, ভগবান্ বিশ্বব্যাপী। সুতরাং তার দূরে থাকার ব্যাপারটা স্থান ও কালের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নয়। তিনি ভগবৎপরায়ণের কাছেঅর্থাৎ অন্তরে এবং অভক্তদের দূরেঅর্থাৎ ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। — বক্ষ্যমাণ এই মন্ত্রের যে সব ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটি — সোমপানশীল বৃহন্তা ইন্দ্র আগমন করুন, আমাদের দূরবর্তী যেন না হন। বহুকম রক্ষাবিশিষ্ট ইন্দ্র (শত্রুগণকে) নিহত করুন। – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন)। [এই সুক্তের অন্তর্গত মন্ত্র তিনটির একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম শ্রৌতকক্ষং]।
২/১– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আমাদের শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ, অর্থাৎ আমাদের সকল কর্ম, নদীসকল যেমন সমুদ্রে প্রবেশ করে অর্থাৎ সাগরগামিনী নদী সকলের মতো, আপনাতে সম্মিলিত হোক। (ভাব এই যে, নদী যেমন আপনা-আপনিই সাগরসঙ্গম-অভিলাষিনী, আমার কর্মসমূহও তেমন ভগবৎপরায়ণ হোক, এটাই আকাঙ্ক্ষা)। যেহেতু হে ভগবন! আপনাকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না। (ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনিই শ্রেষ্ঠ; আপনার সমকক্ষ কেউই নেই; অতএব আপনারই শরণ নিচ্ছি)। [এই মন্ত্রের ইন্দবঃ পদ উপলক্ষে, ভাষ্য অনুসারে যথাপূর্বং, সোমরসকে এ আকর্ষণ করে আনা হয়। সেই অনুসারে মন্ত্রের ভাব দাঁড়িয়েছে স্যন্দনশীলা নদীসমূহ যেমন। এ সর্বতোভাবে জলাশয়ে প্রবেশ করে, আমাদের প্রদত্ত সোমরস-সকল তেমনই আপনাকে প্রাপ্ত হোক। যেহেতু আপনার চেয়ে ধনে বা বলে কারও আধিক্য নেই। অর্থাৎ ধনে বলে আপনি শ্রেষ্ঠ বলে, আমাদের প্রদত্ত সোমরস সকল আপনার উদ্দেশে উৎসৃষ্ট হচ্ছে। আপনি সেগুলির সবই গ্রহণ করুন। কিন্তু ইন্দবঃ পদে কেন সোমলতার রস অর্থ গ্রহণ করব? যা অমৃতের ন্যায় অনাবিল, যা জ্যোতির্ময়, তা-ই তো ইন্দবঃ। এ পক্ষে সৎকর্ম শুদ্ধসত্ত্ব প্রভৃতিই ইন্দবঃ পদের তাৎপর্য পাওয়া যায়। বেদমন্ত্রের বহু স্থলে ইন্দবঃ পদ ঐ অর্থেই প্রযুক্ত হতে দেখা গেছে]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-৯দ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
২/২– অভীষ্টবর্ষক চিরজাগরণশীল চৈতন্যস্বরূপ পরমৈশ্বর্যশালী হে দেব! আপনাতে বা আপনার অনুগ্রহে যে সাধক বর্তমান থাকেন, অর্থাৎ সে সাধক ভগবৎ-গতপ্রাণ হন, তার শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপচার গ্রহণ করে স্বমহিমায় সেই সাধককে আপনি প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ পূজাপরায়ণ সাধককে প্রাপ্ত হন)। [ভগবান্ জাগৃবে চিরজাগরণশীল। তিনি চৈতন্যস্বরূপ। তিনি বিশ্বচৈতন্য। বৃষ পদেও ভগবানের করুণার নিদর্শন পাওয়া যায়। তিনি অভীষ্টবর্ষক। এমনকি তিনি মানুষের শ্রেষ্ঠ অভীষ্টবস্তু মোক্ষও দান করেন]।
২/৩– অজ্ঞানতানাশক (অথবা পাপনাশক) বলাধিপতি হে দেব! আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপচার আপনার তৃপ্তির জন্য পর্যাপ্ত থোক। হে দেব! শুদ্ধসত্ত্ব পরমাশ্রয় প্রাপ্তির জন্য পর্যাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় আমরা যেন পরমাশ্রয় লাভ করি)। [আবার বৃত্র-বৃহন। ভাষ্যকার বৃত্র পদের দুটি অর্থ দিয়েছেন-জলাবরক মেঘ এবং পাপ। আমরা সর্বত্রই বৃত্র শব্দে পাপ– অজ্ঞানতা প্রভৃতি অর্থ গ্রহণ করে আসছি। অবশ্য অন্যত্র তিনি (ভাষ্যকার) বৃত্র পদে কোনও নির্দিষ্ট হস্তপদ ইত্যাদি বিশিষ্ট অসুর অর্থই গ্রহণ করেছেন। যাই হোক, ভাষ্যকারের এখানকার ব্যাখ্যা অনুসারে (জলাবরক মেঘরূপ অসুর) অর্থ করে অনেক পণ্ডিত বৃত্র ও ইন্দ্র সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করেছেন। তাদের মতে ইন্দ্র মধ্য আকাশের দেবতা, বৃষ্টি প্রভৃতি তারই কার্য। ইত্যাদি। আবার সব কিছু ব্যাখ্যাকে অতিক্রম করে প্রচলিত বঙ্গানুবাদ দাঁড়িয়েছে হে বৃত্ৰহা ইন্দ্র! সোম তোমার কুক্ষির পক্ষে পর্যাপ্ত হোক, ক্ষরণশীল সোম তোমার শরীরে পর্যাপ্ত হোক। বলা বাহুল্য, এখানেও সোমের চিন্তার উৎস সেই ইন্দবঃ]। [এই সুক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– আষ্টাদংষ্ট্রম এবং উদ্বংশীয়ম]।
৩/১– সাধনপ্রভাবে উদ্বুদ্ধমান হে দেব! পাপ হতে মনুষ্যগণকে পরিত্রাণের জন্য আপনি সর্বলোকে অধিষ্ঠিত (অনুপ্রবিষ্ট) আছেন। আমাদের যজ্ঞ ইত্যাদি কর্মের অনুষ্ঠান-সিদ্ধির জন্য, সেই যে মহৎ আপনার উদ্দেশে প্রদত্ত আমাদের স্তোত্র (পূজা) আপনি গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, — জনহিতসাধক ভগবান্ জনহিতসাধনের জন্য সর্বলোকে অবস্থিত আছেন। তিনি আমাদের পূজা গ্রহণ করুন- মন্ত্রের এটাই প্রার্থনা)। [মন্ত্রের জটিল শব্দ– জরাবোধ। সায়ণের ভাষ্যে ঐ শব্দ স্তুতির দ্বারা উদ্বুদ্ধমান অগ্নিকে বোঝাচ্ছে। এক ব্যাখ্যাকার ঐ শব্দে যাজ্ঞিক বিপ্রঅর্থ এনেছেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গ প্রায়ই ঐ শব্দকে ব্যক্তিবিশেষের বা দেবতাবিশেষের নামমাত্র বলে কল্পনা করে নিয়েছেন। বলা বাহুল্য, আমরা এ পক্ষে সায়ণেরই অনুসরণ করেছি]।
৩/২– মহান, অতুলনীয়, অন্ধকারমধ্যগত আলোকরশ্মিপ্রভ, পূর্ণদীপ্যমানন্ সেই অগ্নিদেব, জ্ঞানে এবং পরমার্থরূপ ধনে (জ্ঞান ও পরমার্থ প্রদান করে) আমাদের প্রবর্ধিত করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের জ্ঞান এবং পরমার্থধন প্রদান করুন)। [.দেবতাকে ধূমকেতু বলার অর্থ– ধূমের মধ্যে যেমন অগ্নির বিকাশ সম্ভবপর, তেমনই পাপান্ধকারের মধ্যেও পুণ্যের জ্যোতিঃ প্রকাশ পেতে পারে। পাপি! তুমি কেন হতাশে অবসন্ন হচ্ছ? তোমার দেবতা– ধূমকেতু; তাঁর শরণাপন্ন হও। গ্রহ-পক্ষেও ধূমকেতুর উপমা এখানে অপ্রাসঙ্গিক নয়। ধূমকেতুর উদয় দেখে এক সম্প্রদায়ের লোক ভীত হয়। কিন্তু যাঁরা জ্যোতিষতত্ত্ব অবগত আছেন, তাঁরা এর উদয় বিষয়ে আতঙ্কিত নন। তেমনই, পাপী যারা দেবতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ নয়, তাদের কাছে দেবতা ধূমকেতুর, মতো ভীতিপ্রদ; বিজ্ঞজন তার উদয় কারণ, অনুসন্ধানে অবগত হয়ে আনন্দ লাভ করেন। পূর্ণ দীপ্তিমান্ সেই দেবতার কাছে জ্ঞান ও পরমার্থরূপ ধন প্রার্থনাই এ মন্ত্রের লক্ষ্য]।
৩/৩– বিশ্বপাতা, দেবগণের দূতস্থানীয়, পরমদীপ্তিমান্ সেই অগ্নিদেব, আমাদের উচ্চারিত উক্ত স্তুতি মন্ত্রে (সন্তুষ্ট হয়ে), দাতাদের মতে, আমাদের অনুগ্রহ করুন। (ভাব এই যে, দাতা যেমন প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা শ্রবণ করে দয়ার্দ্র হন, তেমনই হে দেব! আপনি আমাদের প্রতি সদয় হোন)। [এ মন্ত্রের প্রধান বিতর্কমূলক পদ-রেবান্ ইব। তার অর্থ বড়লোকের ন্যায়– সাধারণভাবে এমন নিষ্পন্ন হয়ে আসছে। তাতে ভাব দাঁড়ায় এই যে, রাজার বা বড়লোকের কাছে বন্দিগণ স্তব-স্তুতি করে যেমন কিছু ধন প্রাপ্ত হয়, এখানেও তেমন প্রার্থনা করা হয়েছে। কারো কারো মতে, ঋষিকুমার শুনঃশেফ এই মন্ত্রের উচ্চারণকারী। এই মতের যাঁরা পরিপোষক, তারা ভুলে যান যে, শুনঃশেফ অর্থের ভিখারী হতে পারেন না;- যাঁর প্রাণ নিয়ে টানাটানি, তিনি বধ্যভূমে বলিদানের জন্য নীত, অর্থ প্রার্থনা তিনি কেন করবেন? অতএব স্তুতিবাদকদের উপমা এখানে অবান্তর। আমরা রেবান্ ইব অর্থে প্রকৃত দাতার ন্যায় অর্থ পরিগ্রহ করেছি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম জরাবোধীয়ম্]।
৪/১– যে স্তোত্র (অথবা, যে কর্ম) জ্ঞানীর এবং পরমৈশ্বর্যশালী দেবতার যুগপৎ প্রীতিপ্রদ হয়; হে আমার মনোবৃত্তিনিবহ! তোমরা বিশুদ্ধসত্ত্বভাবসম্পন্ন হয়ে, তেমন স্তোত্রের সাথে (অথবা, তেমনই কর্মের দ্বারা) সর্বজনের নমস্য, শত্রুগণের অভিভবকারী (অথবা, পরমধনপ্রদাতা) দেবতাকে আরাধনা করো। (ভাব এই যে, সৎকর্মের দ্বারা যেমন জ্ঞানী পরিতুষ্ট হন, তেমন পরমেশ্বর্যসম্পন্ন দেবতাও তৃপ্তিলাভ করেন; অতএব, বিশুদ্ধসত্ত্বভাবাপন্ন হয়ে, সৎকর্মের সাথে আমরা যেন দেবতার আরাধনায় প্রবৃত্ত হই, এটাই সঙ্কল্প)। [ভাষ্যে এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই সামের অর্থ দেখতে পাওয়া যায়, তাতে মনে হয়, কেউ (ঋত্বিকই হোন, আর পুরোহিতই হোন, অর্থাৎ স্তোতৃবর্গের দলের কেউ) যেন স্তোতৃগণকে সম্বোধন করে বলছেন, এস, সকলে সমস্বরে মিলে স্তোত্র গান করো। গাভী যেমন যবের ভূসি বা ঘাস পেলে পরিতৃপ্ত হয়, বহু যজমানের আহ্বাণীয়, শত্রুবিমর্দক অথবা ধনদাতা ইন্দ্ৰ তেমনই ঐ রকম স্তোত্ৰগানে সুখলাভ করেন। বঙ্গভাষায় একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে স্তোতৃবর্গ! ঘাস যেমন ধেনুর সুখকর হয়, তেমনই সোমরস অভিযুত হলে পর ইন্দ্রের সুখদায়ক স্তোত্র বহুলোকের বন্দনীয়, শত্রুবিজয়ী ইন্দ্রের নিকট তোমরা সমবেত হয়ে গান করো। হিন্দী এবং ৫ ইংরাজী অনুবাদগুলিও ঐ একইরকম উপমায় বেদের মাহাত্ম্য কতদূর রক্ষা করতে পারে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। যৎপদে ভাষ্যকার প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছেন স্তোত্রং আমরা এর অর্থ স্তোত্র ও কর্ম দুই-ই গ্রহণ করতে পারি। তারপর গবে ন; প্রচলিত অর্থ– গরু যেমন ঘাস খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়। কিন্তু গো শব্দমূলক গবে প্রভৃতি পদের বিষয় বহুস্থলে আমরা আলোচনা করেছি। ঐ শব্দে প্রধানতঃ জ্ঞানকিরণ অর্থই প্রকাশ করে। তাতে গবে ন এই উপমায় জ্ঞানকিরণসমন্বিত জন বা জ্ঞানীজন যেন এই ভাব আসাই সঙ্গত। তারপর সম্বোধন। ভাষ্যের এবং তার অনুবর্তী ব্যাখ্যাকারবৃন্দের অভিমত এই যে, স্তোতৃগণকে সম্বোধন করে ঐ পদ প্রযুক্ত হয়েছে। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ স্তোতৃগণকে সম্বোধনের কারণ কি? বেদের কোনও মন্ত্রই কোথাও ব্যক্তিবিশেষের। সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়নি। আমরা দেখেছি বেদমন্ত্রগুলি তিনরকম উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত আছে। প্রথম প্রার্থনা; দ্বিতীয় ভগবৎ-মহিমার প্রকাশ; তৃতীয়– আত্ম-উদ্বোধন। সুতরাং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে এই মন্ত্রটিকে আত্ম-উদ্বোধন-মূলক মন্ত্র বলে মনে করাই সঙ্গত। গায় পদের প্রতিবাক্যে পূজয়ত পদ ব্যবহার করে আমরা উচিত কমই করেছি। এমন ক্ষেত্রে গায় পদে পূজা আরাধনার ভাবই প্রকাশ করে। ভগবানের আরাধনা কেবল তোতা পাখীর মতো স্তোত্র উচ্চারণ করে সম্পন্ন হয়, তা আমরা মনে করি না]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (২অ-১দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৪/২– যখন পরমধনদাতা সকলের নিধানভূত দেবতা আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা গ্রহণ করেন, তখন সেই দেবতা জ্ঞানযুত আত্মশক্তির দান নিশ্চয়ই সংযমিত করেন না। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ প্রার্থনার দ্বারা প্রীত হয়ে লোকবর্গকে পরমধন পরাজ্ঞান প্রদান করেন)। [আলোচ্য মন্ত্রে ভগবানের করুণা এবং সাধকের সাধনা এই উভয় বিষয় বিবৃত হয়েছে। মানুষ যখন ভগবানের চরণে প্রণত হয়, ঐকান্তিকতার সাথে নিজের দৈন্য নিবেদন করে, তখন তিনিও সাধকের মনোবাসনা পূর্ণ করেন। তাঁর চরণেই মানুষ পরমশান্তি লাভ করে। আবার আমাদের গৃহীত অর্থের দিক দিয়েও বাসয়িতা অর্থ সিদ্ধ হয়। বসু পদে আমরা পরমধনদাতা অর্থ গ্রহণ করেছি। পরমধন– মোক্ষধন। যিনি মোক্ষদাতা, তিনিই জগতের পরমাশ্রয়। মানুষ মোক্ষলাভ করে তাকেই পরমআশ্রয় অভিন্ন ভাবই প্রকাশ করছে]।
৪/৩– রিপুনাশদেবতা সর্বলোকবর্গকে জ্ঞানযুত ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত করান; সেই দেবতা সল্কর্মসাধনসামর্থ্যের সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবান সর্বলোকের মোক্ষদায়ক হন; তিনি আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [মানুষ মোক্ষলাভের প্রার্থনা করে বটে, কিন্তু তা পূর্ণ করবার অধিকারী ভগবান্ নিজে। অপারকরুণাময় ভগবান্ মানুষকে রিপুর কবল থেকে উদ্ধার করে তাকে মোক্ষ প্রদান করেন। — ব্রজং পদে ভাষ্য ইত্যাদিতে গরুর গোষ্ঠ অর্থ গৃহীত হয়েছে। গোমন্তং পদ থাকায় ভাষ্য ইত্যাদিতে এই ভাবই প্রাধান্য লাভ করেছে। আমরা গোমন্তং পদের যেমন অর্থ করেছি– জ্ঞানযুতং, তেমনই ব্রজং পদ গত্যৰ্থক, পদের ব্রজ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হওয়ায় তার অর্থ গমন সাধকের ঊর্ধ্বগমন বুঝেছি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম– মার্গীয়বাদ্যম]।
.
দ্বিতীয় খণ্ড
সূক্ত ৫– ইদং বিষ্ণুবিক্রমে ত্রেধা নি দধে পদ। সমূঢ়মস্য পাংসুরে৷১৷৷ ত্রাণ পদা বিচক্ৰমে বিষ্ণুগোপা অদাভ্যঃ। অতো ধর্মানি ধারয়৷ ২৷৷ বিষ্ণোঃ কর্মাণি পশ্যত যততা ব্ৰতানি পম্পশে। ইন্দ্রস্য যুজ্যঃ সখা। ৩ ত বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাতত৷৷ ৪৷ তদ বিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংসঃ সমিন্ধতে। বিষ্ণোর্ষৎ পরমং পদ৷৷ ৫৷ অতো দেবা অবস্তু নো যতো বিষ্ণুর্বিচক্রমে। পৃথিব্যা অধি সানবি৷৷৬৷৷
সূক্ত ৬– মো জ্বা বাঘতশ্চ নারে অস্মন্ নি বীরমন। আরাত্তা দ্বা সধমাদং ন আ গহীহ বা সমুপ শুধি ॥১৷৷ ইমে হি তে ব্রহ্মকৃতঃ সু তে সচা মধৌ ন ম আসতে। ইন্দ্রে কামং জরিতারো বসূয়বো রথে ন পাদমাধুঃ ॥২॥
সূক্ত ৭– অস্তাবি মন্ম পূর্বং ব্রহ্মেন্দ্রায় বোত। পূর্বীতস্য বৃহতীরন্ষত স্তোতুর্মেধা অসৃক্ষত৷১৷৷ সমিন্দ্রো রায়ো বৃহতীরধুনুত সংক্ষোণীঃ সমু সূর্যম্। সং শুক্রাসঃ শুচয়ঃ সং গবাশিরঃ সোমা ইন্দ্রমমন্দিষুঃ ॥২॥
সূক্ত ৮– ইন্দ্রায় সোমপাতবে বৃত্রঘে পরি যিচ্যসে। নরে চ দক্ষিণাবতে বীরায় সদসদে৷৷৷৷ তং সখায়ঃ পুরুচং বয়ং শূয়ং চ সূরয়ঃ। অশ্যাম বাজগন্ধং সনেম বাজপস্ত্যম্ । ২। পরিত্যং হর্ষতং হরি….॥৩৷৷
সূক্ত ৯– কন্তমিন্দ্র ত্বা বসো৷৷৷৷৷ মঘোনঃ স্ম বৃদ্ৰহত্যে চোদ্দয় যে দদতি প্রিয়া বসু। তব প্রণীতী হর্ষ সূরিভির্বিশ্ব তরেম দুরিতা। ২।
মন্ত্ৰার্থ— ৫সূক্ত/১সাম– পরমেশ্বর বিষ্ণু এই সমগ্র জগৎকে বিশেষভাবে ব্যেপে আছেন। অতীত। অনাগত বর্তমান– তিন কালেই তার ঐশ্বর্য-মহিমা নিরন্তর ধৃত (অক্ষুণ্ণ) রয়েছে; সেই বিষ্ণুর জ্যোতির্ময় পদে (প্রভুত্বে) এই নিখিল জগৎ সম্যকভাবে অবস্থিত আছে। (মন্ত্রটি বিষ্ণুর স্বরূপ বর্ণনা করছে। ভাব এই যে, বিশ্বব্যাপক বিষ্ণুর প্রভুত্বে এই নিখিল জগৎ সর্বদা অবস্থিত। বিষ্ণুই বিভূতিরূপে অণুপরমাণুক্রমে সকলকে অধিকার করে অবস্থিত আছে)। [ত্রেধা বিচক্ৰমে, পদং নিদধে এবং পাংসুলে সমূঢ়ং– এই বাক্য তিনটির জন্য মন্ত্রটি বিভিন্ন পণ্ডিতদের দ্বারা বিভিন্নরকম অর্থ পরিগ্রহ করেছে। ত্রেধা শব্দে তিন বার এবং বিচক্ৰমে শব্দে ভ্রমণ করেছিলেন। পদং শব্দে পা এবং নিদধে পদে ধারণ বা রক্ষা করেছিলেন। তারপর পাংসুলেশব্দে ধূলিকণায়এবং সমূঢ়ং পদে সমাবৃত হয়েছে– এমন অর্থ স্থির হয়ে যায়। তাতে মন্ত্রের ভাব দাঁড়ায় এই যে, বিষ্ণু যখন মধ্য এসিয়া থেকে দলবলসহ এ দেশে আসছিলেন, তখন পথে তিন স্থানে বিশ্রাম করেছিলেন এবং তার চরণধূলিতে জগৎ পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। কেউ বা বিষ্ণুর পদধূলিতে জগৎ আচ্ছন্ন– এমন উক্তি থেকে জগতে বিষ্ণুর আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল বলে মনে করেন। কেউ বা বিষ্ণুকে সূর্য জ্ঞান করে সূর্যরশ্মির বিষয় ধূলি-বিস্তৃতির উপমায় ব্যক্ত হয়েছে সিদ্ধান্ত করে নেন। আমাদের ব্যাখ্যা স্বতন্ত্র। আমরা বিষ্ণু অর্থে পরমেশ্বর, সর্বব্যাপ্ত দেবতা বুঝি। বি চক্রমে অর্থে বিশিষ্টভাবে ব্যাপ্ত বুঝি। ত্রেধা শব্দে বুঝি– অতীত অনাগত বর্তমান.তিন কাল, অর্থাৎ তিন কালে তার বিদ্যমানতা সমভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ঐ শব্দে আরও এক ভাব আসতে পারে- সত্ত্ব রজঃ তমঃ। এ পক্ষে ত্রিগুণের সাম্যাবস্থায় তার স্থিতিশীলতার ভাব মনে আসে। আমরা মনে করি পদং শব্দে আধিপত্য, ঐশ্বর্য, জ্যোতিঃ প্রভৃতি বোঝায়। আমরা মনে করি নিদধে পদে চিরপ্ত অর্থাৎ চির অক্ষুণ্ণ ভাব ব্যক্ত হয়। মন্ত্রের পাংসুলে শব্দে ধূলি নয়; অণু বা সূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ করে; অর্থাৎ অণুপরমাণুময় জ্ঞানস্বরূপ (জ্ঞানরশ্মিরূপে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে তিনি চিরবিদ্যমান রয়েছেন। পরিশেষে– সমূঢ়ং। ঐ এ শব্দে, এই জগৎ সম্যকরূপে তাহায় অবস্থিত রয়েছে–এ ভাবই দ্যোতনা করছে]। [মন্ত্রটি শুক্ল এ যজুর্বেদ সংহিতায় এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতাতেও পরিদৃষ্ট হয়]।
৫/২– সকলের অজেয়, সকল জগতের রক্ষক, সর্বব্যাপী ভগবান্ বিষ্ণুও এই লোকসমূহে ৬ ধর্মসমূহে (সৎকর্মসকলকে। পোষণ করে ত্রিকাল-ত্রিগুণাদিস্বরূপ স্থানসমূহকে (আপন আধিপত্যকে) বিশিষ্টরূপে ব্যেপে আছেন? (ভাব এই যে, — বিশ্বপালক বিষ্ণু চিরকাল অপ্রতিহতপ্রভাবে ধর্মকর্ম পোষণ করছেন)। [ভগবান বিষ্ণু বিশ্বের পালক। তার প্রভাব অপ্রতিহত। তিনি বিশুদ্ধ ধর্মকে রক্ষা করে থাকেন। ধার্মিক মাত্রেই তার আশ্রয়ে সুখশান্তি প্রাপ্ত হয়। তিনি সর্বকাল সর্বত্র অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান রয়েছেন। মন্ত্রে এমন ভাব ব্যক্ত রয়েছে। এর দ্বারা মানুষকে যেন ধর্মপরায়ণ হয়ে শ্ৰেয়োলাভে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রার্থনা পক্ষেও এ মন্ত্রটিকে আত্ম-সম্বোধনমূলক বলে মনে করা যেতে পারে]।
৫/৩– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! বিশ্বব্যাপী ভগবান বিষ্ণুর যে পালন ইত্যাদি কর্ম হতে পুণ্য অনুষ্ঠানসমূহে মানুষ প্রবৃত্ত হয়, সেই লোক-পরিত্রাণকারী কর্মসকল তোমরা প্রত্যক্ষ করো অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। সেই বিষ্ণু ইন্দ্রদেবের অভিন্ন সখা, অর্থাৎ একাত্মক। (ভাব এই যে, ভগবান বিষ্ণুর অনুগ্রহে হে মনুষ্যগণ! তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হও; দেবগণ যে অভিন্ন, তা স্মরণ রেখো)। [আমরা মনে করি, মন্ত্রটি ঋত্বিকদের আহ্বান করে উক্ত বা রচিত হয়নি। মন্ত্রটি নত্য আত্ম-উদ্বোধনমূলক; যাজ্ঞিক সাধক আপন মনোবৃত্তিগুলিকে সম্বোধন করে পুণ্য-অনুষ্ঠানে উদবুদ্ধ করছেন। তিনিই বিষ্ণু, তিনিই ইন্দ্র, তিনিই সব। তাঁর অনুগ্রহপ্রার্থী হলে সৎকর্মপরায়ণ হতে পারবে। সৎকর্মপর হলে তাকে জানতে সামর্থ্য আসবে। ইন্দ্ররূপেই হোন, আর বিষ্ণুরূপেই হোন, যেরূপেই হোন, তিনি এসে তোমাদের অভীষ্টপূরণ– শ্রেয়ঃসাধন করবেন]।
৫/৪– আকাশে নিরাবরণে সূর্যালোকলাভে চক্ষু যেমন অবাধে সমস্ত দৃষ্টি করে, তেমনই জ্ঞানিগণ পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন সর্বব্যাপক ভগবান্ বিষ্ণুর পরমপদ (শ্রেষ্ঠ স্বরূপ) সদাকাল প্রত্যক্ষ করে থাকেন। (ভাব এই যে, সূর্যের আলোকের সাহায্যে বাধাবিরহিত আকাশে চক্ষু যেমন প্রকৃতিপুঞ্জকে পর্যবেক্ষণ করে, জ্ঞানিগণ, তেমনই জ্ঞানের প্রভাবে সকল কালেই ভগবানের তত্ত্ব জেনে থাকেন)। [এমন উদার উচ্চ-প্রার্থনামূলক যে মন্ত্র প্রতিদিন প্রতি দেবকার্যের প্রারম্ভে উচ্চার্য এমন যে মহান মন্ত্র, এরও কি আবার অন্য অর্থ আছে? যত বড় পণ্ডিতই এ মন্ত্রে যত উচ্চ অর্থ আনয়ন করুন না কেন, যত বড় প্রত্নতাত্ত্বিক এ মন্ত্রের সাথে যত গভীর প্রত্নতত্ত্বের সামগ্রীই প্রাপ্ত হোন না কেন, আমরা মনে করি, এ মন্ত্র আত্ম উৎকর্ষের পরম সাধক এবং প্রার্থনামূলক। পতি দৈবকর্মের প্রারম্ভ-মন্ত্র হেতু মনীষিগণ যে এ মন্ত্রে অর্থ ঐভাবেই গ্রহণ করেছিলেন, তা-ই বোধগম্য হয়। কর্মারম্ভের সূচনায় বলা হচ্ছে– যেন আমি তোমার স্বরূপ জানতে পারি; যেন আমার দৃষ্টি-পথের বাধা বিদূরিত হয়; যেন আমি অবাধে তোমার প্রতি চিত্ত ন্যস্ত করতে পারি। এটাই এ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ]।
৫/৫– ভগবান্ বিষ্ণুর যে পরম পদ (শ্রেষ্ঠ বিভূতি), ভগবৎ-একচিত প্রমাদশূন্য সাধু জ্ঞানী পুরুষগণ তা (সর্বতোভাবে) প্রকাশ করেন, – হৃদয় হতে হৃদয়ে জ্ঞানালোক প্রদীপ্ত রাখেন। (ভাব এই যে, অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানিগণের ভগবৎ-বিভূতিসমূহ হৃদয় থেকে হৃদয়ে প্রদীপ্ত হয়)। [ভগবৎ ভক্ত জ্ঞানী সাধক বিপ্রগণ (বিপ্রাসঃ) ভগবানের সম্বন্ধে যে জ্ঞান বিস্তার করেন, আমাদের হৃদয় যেন সেই জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়। অর্থাৎ, আমরাও যেন সেই জ্ঞানে জ্ঞানী হতে পারি, জ্ঞানময়ের সান্নিধ্য লাভ করতে সমর্থ হই। আমাদের আদর্শ সেই জ্ঞানিগণ কি ভাবে ভাবান্বিত? না– । বিপন্যবঃঅর্থাৎ সর্বতোভাবে স্তুতিপরায়ণ, একনিষ্ঠ পরমভক্ত। তারা কেমন? না– জাগৃবাংসঃ– এ অর্থাৎ চিরসতর্ক, সদা-জাগরূক, প্রমাদপরিশূন্য। ফলতঃ বিপন্যবঃ, জাগৃবাংসঃ ও বিপ্রাসঃ পদ তিনটিতে যথাক্রমে ভক্তি কর্ম ও জ্ঞানের সমবায় হয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে]।
৫/৬– যে পৃথিবী হতে আরম্ভ করে স্বর্গলোকের (অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের) সাথে ভগবান্ বিষ্ণু পরিব্যাপ্ত; সেই (এই) পৃথিবী-লোক হতে দেবগণ আমাদের রক্ষা করুন। (ভাব এই যে, -পরমেশ্বর সর্বব্যাপী; সকলোকে তার বিভূতি অবিচ্ছিন্ন অবস্থিত; সেই বিভূতিগুলি (পৃথিবীস্থ দেবগণ) আমাদের রক্ষা করুন– এই প্রার্থনা)। [ভাষ্যকার ও অন্যান্য ব্যাখ্যাকার কত দিক থেকে কতরকমভাবে যে এই এবং এর পূর্ববর্তী মন্ত্রগুলির অর্থ পরিগ্রহ করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সেই সকল ব্যাখ্যা ও বিষয় বিশেষভাবে আলোচনা করে, পূর্বাপর সকল দিকের সঙ্গতি রক্ষা পক্ষে দৃষ্টি রেখে, বেদের নিত্যত্ব ও অপৌরুষেয়ত্ব প্রভৃতি সাধু-বিষয়-সকল স্মরণ করে, মন্ত্রের অর্থ স্থিরীকৃত হলো যে, যে ভগবান্ বিষ্ণুর বিভূতিগুলি পৃথিবী ইত্যাদি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপক, (অর্থাৎ যে বিষ্ণু ব্রহ্মাণ্ড ব্যেপে আছেন) তার গুণ-বিভূতির অংশ-স্বরূপ পার্থিব দেবগণ (দেবভাবগুলি) আমাদের প্রাপ্ত হোক। পূর্ব মন্ত্রে (ঋগ্বেদে) পৃথিবী দেবীকে উদ্দেশ করে যে প্রার্থনা করা হয়েছে, এ প্রার্থনা তারই দ্যোতক। পৃথিবীদেবী কি রকম? তিনি এই বিষ্ণুশক্তিসম্পন্ন দেবভাববিভূষিতা, এখানে তা-ই প্রকাশ পেয়েছে। [এই সূক্তের অন্তর্গত ছটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– মার্গীয়বোত্তরম]।
৬/১– হে ভগবন! আপনার উপাসকগণও যেন আমাদের কাছে সুষ্ঠুভাবে আনন্দ উপভোগ করেন। (ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করি); এবং দূর স্বর্গলোক হতে আপনি আমাদের হৃদয়-রূপ যজ্ঞস্থলে আগমন করুন, এবং আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে প্রার্থনা বিশেষভাবে শ্রবণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের প্রার্থনা পূরণ করুন)। [ভক্ত সখেদে বলেছেন– যে যাহারে ভালবাসে, বাঁধা তার প্রেমপাশে। আমি যদি বাসতেম ভাল, জানতেম না আর তোমা বই। প্রভো! তোমায় ভালবাসি কই?– আর এই মন্ত্রে সাধক-গায়ক প্রার্থনা করছেন– প্রভো আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হও, তোমাকে যাঁরা ভালবাসেন তারাও যেন আমা থেকে দূরে সরে না যান। আমি যেন ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিদের সন্নিকটে থাকবার সৌভাগ্য লাভ করি। যারা তোমাকে ভালবাসেন, তোমার প্রতি যাঁরা ভক্তিযুত, তাঁদের চরণরেণুর স্পর্শও যে পবিত্র! আমি পাপী, আমি তোমার মাহাত্ম্য জানি না। যদি ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থেকে মুক্তিলাভের উপায়ভূত সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারি– এই মাত্র ভরসা। ভক্ত ভগবৎপরায়ণা রাধিকার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, – কৃষ্ণ কালো, তমাল কালো, তাইতো তমাল ভালবাসি। এখানেও সাধক বলছেন– মো যু ত্বা বাঘতশ্চনারে অস্ফুন্নিরীরম তুমি যাঁদের প্রিয়, তারাও যেন আমার নিকটে থাকেন– আমি যেন তাদের সঙ্গলাভ করে ধন্য হই]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৬দ-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৬/২– অমৃতকামী সাধকগণ যেমন অমৃতে সর্বতোভাবে বর্তমান থাকেন অর্থাৎ অমৃত প্রাপ্ত হন, তেমনই আপনার প্রার্থনাপরায়ণ সাধকগণ বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবে বর্তমান থাকেন, অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন; অভীষ্টস্থানে গমনের জন্য মানুষ যেমন যানে পদস্থাপন করে, তেমনভাবে পরমধনকামী স্তোতাগণ ভগবান্ ইন্দ্রদেবে কামনা সমর্পণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানে না সমর্পিতপ্রাণ প্রার্থনাপরায়ণ সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন]। [মন্ত্রটিতে একটি মহান সত্য বিধৃত আছে। যিনি ভগবানে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, যিনি নিজের সর্বস্ব তাঁর চরণে নিবেদন করতে পারেন, তিনি মুক্তি বা মোক্ষলাভের অধিকারী হন। সাধুকের যে পর্যন্ত অহং জ্ঞান থাকে, সে পর্যন্ত মোক্ষলাভ অসম্ভব। এই মোক্ষ কি? পৃথিবীর বিভিন্ন দার্শনিকবৃন্দ মোক্ষ বা মুক্তির নানারকম অর্থ করেছেন। ভারতীয় দার্শনিকেরাও মুক্তির নানারকম স্বরূপ নির্ণয় করেছেন। কিন্তু সকলেরই ব্যাখ্যার মূলভিত্তি এক সেই ভিত্তি অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্তিলাভ। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ অহং বুদ্ধিতে কর্ম করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বদ্ধ। কিন্তু তার মন থেকে যখন অহংবুদ্ধি চলে যায়, তখনই তিনি প্রকৃতপক্ষে মুক্ত বা মোক্ষলাভের অধিকারী হন। তার পূর্বের অসম্পূর্ণতাজনিত (বা অহংবুদ্ধিজনিত) ত্রুটিবিচ্যুতি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। সমস্ত ভগবানে সমর্পিত হওয়ায়, তিনি তাঁর কৃতকর্মের ফলও ভোগ করেন না। সুতরাং অনায়াসেই মোক্ষলাভ করতে পারেন। মন্ত্রে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– যেমন মধুতে মধুমক্ষিকা উপবেশন করে, তেমন স্তোত্ৰকারিগণ তোমার জন্য সোম অভিযুত হলে উপবেশন করে। রথে যেমন পদক্ষেপ করে, ধনকাম স্তোতাগণ তেমনই ইন্দ্রে স্তুতি সমর্পণ করে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।
৭/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! ভগবান্ আরাধনীয় হন; সেইজন্য তোমরা ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য প্রকৃষ্ট সনাতন স্তোত্র উচ্চারণ করো। সত্যসম্বন্ধীয় (অথবা সৎকর্মসম্বন্ধীয়) নিত্যা মহতী স্তুতি উচ্চারণ করো। প্রার্থনাকারী আমার ধীশক্তি ভগবৎকৃপায় প্রবর্ধিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করবার জন্য উদ্বুদ্ধ হই। ভগবান্ আমাদের সূত্ৰুদ্ধি প্রদান করুন)। [সাধক নিজের চিত্তবৃত্তিগুলিকে ভগবানের মহিমা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তিনি অসাবি– পরম আরাধনীয় দেবতা। তুমিও তার আরাধনায় রত হও। — এই আত্ম-উদ্বোধনার পরই প্রার্থনা। আমরা হীনবল, কেবলমাত্র সেই ভগবানের কৃপা লাভ করতে পারলেই আমরা তার আরাধনায় প্রবৃত্ত হতে সমর্থ হই। তাই তার কাছে সেই সাধনশক্তি, মেধাশক্তি লাভের জন্যই প্রার্থনা। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও অনেকাংশে এই ভাব রক্ষিত হয়েছে। যেমন, ইন্দ্রের উদ্দেশে প্রাচীন স্তোত্র পাঠ করো, এবং স্তোত্র উচ্চারণ করো, যজ্ঞের পূর্বকালীন মহতী স্তুতি উচ্চারণ করো এবং স্তোতার মেধা বর্ধিত করো। — ভাষ্যকার এখানে ইন্দ্র অর্থে ভগবান্ স্বীকার করেছেন]।
৭/২–- বলাধিপতি দেবতা অর্থাৎ ভগবান আমাদের মহা পরমধন প্রকৃষ্টরূপে প্রাপ্ত করান; জগতের সর্বশ্রেষ্ঠধন সম্যকরূপে প্রাপ্ত করান; অপিচ, পরাজ্ঞান প্রাপ্ত করান, সেই পরমদেবতা নির্মল জ্যোতিঃকে সম্যকরূপে প্রদান করুন; জ্ঞানসমন্বিত আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে প্রীত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন এবং পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [যে জ্ঞানের বলে মানুষ নিজের জীবনের চরম লক্ষ্য সাধনে সমর্থ হয়, তাও ভগবানের দান। তাই সাধক মন্ত্রে ভগবানের কাছে পরমধন (সর্বাভীষ্ট পূরণ) ও পরাজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করছেন। আমাদের হৃদয়ে ভগবৎ-দত্ত শুদ্ধসত্ত্বের বীজ নিহিত আছে, সাধনার দ্বারা তাকে বিকশিত করতে পারলে, মানুষ সেই শক্তিবলেই ভগবৎ-চরণে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। এখানে মন্ত্রের শেষ অংশের প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন আমাদের অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে লাভ করতে সমর্থ হই]। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– সন্তনি]।
৮/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! শত্রুনাশক ভগবানের গ্রহণের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; এবং দয়াকারুণ্য ইত্যাদি ভূষিত শক্তিসম্পন্ন সৎকর্মসাধক ব্যক্তির জন্য আপনি ক্ষরিত হন; অর্থাৎ তাঁদের এ হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। প্রার্থনামূলকও বটে। ভাব এই যে, শক্তি সম্পন্ন সৎকর্মসাধক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন; আমরাও যেন ভগবৎকৃপায় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। [দুর্বল মানুষ সদা রিপুদের আক্রমণে বিব্রত হয়ে পরিত্রাহি ডাকে, সর্বনিসূদন সেই পমপ্রভুর চরণে নিজের দুর্দশা জ্ঞাপন করতে চেষ্টা করে; মন্ত্রের প্রথমাংশে বৃত্রঘ্নে পদে সেই পরমদেবতাকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। সেই পরমদেবতাকে লাভ করবার জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উপজন করতে হবে। তাই শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করেই প্রার্থনা করা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎ-শক্তি, সুতরাং পরোক্ষভাবে শক্তির অধিকারী, সেই পরমপুরুষের কাছেই প্রার্থনা নিবেদিত হয়েছে। মন্ত্রের অপরাংশের নিত্যসত্য প্রখ্যাপনে বলা হয়েছে সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে ধন্য হন। কিন্তু কেমন সাধক তা লাভ করেন? এই প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ বলা হয়েছে– দক্ষিণাবতে বীরায় সদনাসদে– অর্থাৎ দয়াদাক্ষিণ্য ইত্যাদি গুণসম্পন্ন, আত্মশক্তিসম্পন্ন সৎকর্মসাধক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে সমর্থ হন। — প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ –হে সোম! বৃত্রের নিধনকারী ইন্দ্রের জন্য তোমাকে সেচন করা যাচ্ছে; যে ব্যক্তি দক্ষিণা দিয়ে যজ্ঞ করছে, তার গৃহে যে দেবতা আসছেন, তারও জন্য তোমাকে সেচন করা যাচ্ছে। সোম। অর্থে শুদ্ধসত্ত্ব কিছুতেই তথাকথিত ব্যাখ্যাকারদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনি]। [এই মন্ত্রটি উত্তরার্চিকের অন্যত্রও (১০অ-১১খ-১৩সূ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৮/২– সখিভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! অর্থাৎ জ্ঞানাকাঙ্ক্ষী আমরা যেন জ্যোতির্ময় বলকর প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হই; এবং শক্তিদায়ক পরাজ্ঞান যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন আত্মশক্তিদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব এবং পরাজ্ঞান লাভ করি)। [সৎকর্ম ও অসৎকর্মের বিচারে মানুষের মনই যথাক্রমে মানুষের পরম বন্ধু ও পরম শত্রু হয়। এখানে সাধক জ্ঞানাকাঙ্ক্ষী হয়ে (জ্ঞানের সহায়তায় সৎকর্মে নিষ্ঠাবান্ হয়ে) নিজের চিত্তবৃত্তিগুলিকেই সখিত্ব কামনা করছেন। তাই সখায়ঃ পদে সেই চিত্তবৃত্তিগুলিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে]।
৮/৩– সাধকগণ প্রসিদ্ধ সৰ্বলোকশৃহণীয় পাপহারক শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকবর্গ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [মন্ত্রের মধ্যে একটি নিত্যসত্য প্রকাশিত হয়েছে। সতের সঙ্গেই সতের মিলন হয়, সমধর্মী সমধর্মীকেই চায়। তাই সত্ত্বভাব ও দেবভাব অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ। এই উভয়ের মিলনে, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সাথে দেবভাব সম্মিলিত হলে সাধক পরমানন্দ অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন। মন্ত্রে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে]। [উত্তরার্চিকের অন্যত্রও (১০অ-১১-১৭সূ ২সা) এই মন্ত্রটি প্রাপ্তব্য। ছন্দার্চিকেও (৫অ-৮দ-৮সা) মন্ত্রটি পাওয়া যায়]।
৯/১– সকলের আধারভূত সর্বশক্তিমান্ হে ভগবন! আপনাকে যে জন উপাসনা করে অর্থাৎ শরণ গ্রহণ করে, আপনার শরণাগত সেই ব্যক্তিকে কেউই অভিভূত করতে সমর্থ হয় না। [পূর্বের মন্ত্রটির মতো এটিও ছন্দ আর্চিকের একটি মন্ত্রের অংশবিশেষ মাত্র। মন্ত্রের ভাব এই যে, ভগবানের শরণ গ্রহণ করতে পারলে, সকল বিপদের শান্তি হয়। ভগবান্ রক্ষা করলে, কেউই বিনাশ করতে পারে না। — ভগবানের এই মহিমা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উপদেশ — যদি সংসার-সমুদ্র উত্তরণে প্রয়াসী হও, ভগবানের শরণ গ্রহণ করো; তিনি তোমার সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। [মন্ত্রটি এ ছন্দার্চিকেও (৩অ-৫-৮সা) প্রাপ্তব্য]। এ ৯/২– হে ভগবন! পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন আপনার প্রীতির নিমিত্ত যে জন আপনার প্রীতিকর শুদ্ধসত্ত্বরূপ উপকরণসমূহ উৎসর্গ করে, আপনি অনুগ্রহ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে সেই জনকে রিপুসহ সংগ্রামে শত্রুনাশসামর্থ্যদানে প্রবর্ধিত করেন। অতএব, প্রভূতজ্ঞানসম্পন্ন হে ভগবন! আপনার প্রেরণায় অর্থাৎ আপনার অনুগ্রহে সকর্মে এবং সৎপথে প্রতিষ্ঠাপিত হয়ে, বিশুদ্ধজ্ঞানলাভে এবং সৎ-ভাব সঞ্চয়ে, যেন সমুদয় পাপকলুষ থেকে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটির প্রথমাংশে নিত্যসত্য এবং দ্বিতীয়। অংশে সঙ্কল্প বর্তমান। ভক্তিসহকারে যিনি ভগবানে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, ভগবান তাঁকে রক্ষা করেন। অতএব সঙ্কল্প সংসার তাপ-নাশের জন্য আমরা যেন করুণাময় ভগবানকে আত্মনিবেদন করতে পারি)। [মন্ত্রের প্রথমাংশ শিক্ষা দিচ্ছে– সেই ভক্তিই ভক্তি, সেই জ্ঞানই জ্ঞান, অনন্যচিত্তে যার দ্বারা ভগবানের তৃপ্তিসাধনে নিযুক্ত হতে পারা যায়। জ্ঞানভক্তির সেই পবিত্র বন্ধনে ভগবানকে বন্ধন করো। তিনি তোমায় চিদানন্দ প্রদান করবেন। দ্বিতীয় অংশের উদ্বোধনায় প্রার্থনাকারী ভাবছেন– আমি জ্ঞানী নই, ভক্ত নই, সাধক নই। তাই বলে কি আমি ভগবানের করুণালাভ করতে পারব না? তাই তাঁর জ্ঞানী হবার, ভক্ত হবার সঙ্কল্প। — এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ; যথা হে ইন্দ্র! তুমি মঘবান। যারা তোমায় প্রিয় ধন প্রদান করে, তাদের সংগ্রামে প্রেরণ করো। হে হর্যশ্ব! তোমার উপদেশমতো স্তোতৃগণের সাথে সমস্ত দূরিত হতে উত্তীর্ণ হবো। — আমাদের মতে হরি শব্দের রশ্মি (জ্ঞানরশ্মি) অর্থই সর্বথা সঙ্গত হয়]।
.
তৃতীয় খণ্ড
সূক্ত ১০– এদু মথোর্মদিন্তরং সিঞ্চাধূৰ্যো অন্ধসঃ। এবা হি বীর স্তবতে সদাবৃধঃ ১। ইন্দ্র স্থাতরীণাং নকিষ্টে পূৰ্য্যস্তুতি। ঊদানংশ শবসা ন ভন্দনা। ২৷৷ তং বো বাজানাং পতিমহুমহি শ্ৰবস্যবঃ। অপ্ৰায়ুভির্যজ্ঞেভির্বাবৃধেন্য৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১১– তং গৃধয়া স্বর্ণরং দেবাসো দেবমরতিং দধন্বিরে। দেবত্ৰা হব্যমূহিষে৷ ১৷৷ বিভূতাতিং বিচিত্ৰশোচিষমগ্নিমীডি যন্তুর। অস্য মেধস্য সোম্যস্য সোভরে প্রেমধরায় পূৰ্য৷৷ ২৷৷
সূক্ত ১২– আসোম স্বানো অদ্রিভিস্তিয়ো বারাণ্যব্যয়া। জনো ন পুরি চম্বোর্বিশদ্ধরিঃ সদো বনেষু খ্রিষে৷৷৷৷ স মামৃজে তিরো অম্বানি মেষ্যো মীঢ়বাৎসপ্তি বাজয়ুঃ। অনুমাদ্যঃ পবমাননা মনীষিভিঃ সোয়মা বিপ্রেভিঋকৃভিঃ। ২৷৷
সূক্ত ১৩– বয়মেনমিদাহ্যোপীপেমেহ বর্জিণ। তম্মা উ অদ্য সবনে সুতং ভরা নূনং ভূষত শুতেঃ ॥১৷৷ বৃশ্চিদস্য বারণ উরামথিরা বয়ুনেষু ভূষতি। সেমং ন স্তোমং জুজুষাণ আ গহীন্দ্র প্র চিত্রয়া ধিয়া ॥ ২॥
সূক্ত ১৪– ইন্দ্রাগ্নী রোচনা দিবঃ পরি বাজেষু ভূষথঃ। তদ্বাং চেতি প্ৰ বীর্য। ১৷৷ ইন্দ্রাগ্নী অপসম্পরি৷৷ ২৷৷ ইন্দ্রাগ্নী তবিষাণি বাং…. ॥৩৷৷
সূক্ত ১৫– ক ঈং বেদ সুতে সচা…॥১॥ দানা মৃগো ন বারণঃ পুরুত্ৰা চরথং দধে। ন কি নি যমদা সুতে গমো মহাঁশ্চিরস্যোজসা৷ ২৷৷ য উগ্রঃ সন্ননিতঃ স্থিরা রণায় সংস্কৃতঃ। যদি স্তোতুর্মঘবা শৃণবদ্ধবং নেত্রো যোষত্যা গমৎ৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১০সূক্ত/১সাম– সৎকর্মের নেতা হে আমার মন! তুমি সত্ত্বভাব-জনিত পরমানন্দদায়ক মোক্ষপ্রাপক বিশুদ্ধ জ্ঞান হৃদয়ে সঞ্চয় করো। সত্ত্ব ইত্যাদির দ্বারা চিরবর্ধনশীল আত্মশক্তিসম্পন্ন সাধকই কেবল ভগবানের পূজায় সমর্থ হন। (ভাব এই যে, মোক্ষলাভের জন্য আমি যেন ভগবানের আরাধনা করি)। [যিনি মোক্ষলাভে অভিলাষী তিনিই ভগবানের উপাসনায় রত হন। তিনি সদাবৃধসত্ত্ব ইত্যাদির দ্বারা চিরবর্ধনশীল। যিনি ভগবানের উপাসনায় আত্মনিয়োগ করেন, অথবা যিনি মোক্ষলাভের জন্য তার উপায়সাধনভূত সৎকর্মে রত থাকেন, তিনি ক্রমশঃই উচ্চ থেকে উচ্চতর সাধনরাজ্যে প্রবেশ করেন, অবশেষে ভগবৎ-পদে আত্মলীন হয়ে যান। এই মন্ত্রেরও প্রচলিত ভাষ্য– ইত্যাদিতে সোমরসের উল্লেখ আছে]। [ছন্দার্চিকেও (৪অ-৪দ-৫সা) এ মন্ত্র পরিদৃষ্ট হয়]।
১০/২– জ্ঞানরশ্মিসমূহে অথবা জ্ঞানরশ্মিসমূহের অধিষ্ঠাতা অথবা পরাজ্ঞানদায়ক পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! আপনার সম্বন্ধী চিরনবীন অর্থাৎ আপনার অনন্ত মহিমা কেউই বর্ণন করতে সমর্থ হয় না। আরও, বলের ও মহিমার দ্বারা কেউই আপনাকে অতিক্রম করতে পারে না। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনিই অদ্বিতীয় শক্তিসম্পন্ন এবং সকলের বন্দনীয়। আপনার অপেক্ষা শক্তিশালী এবং স্তুত্য অপর কেউই নেই)। [যাঁর চিন্তায় যাঁর অনুধ্যানে আমি নিরত আছি, তার স্বরূপ কি, কি গুণ তাঁর, তিনি কেমন মূর্তি ধারণ করেন, আমি যদি তা জানতে না পারি, কিভাবে তার প্রতি অগ্রসর হবো? ফলতঃ, অন্তর জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হলে, জ্ঞান রশ্মিসম্পাতে অন্তরের আবিলতা দূর না হলে, সে হৃদয়ে ভগবানের অধিষ্ঠান সম্ভবপর নয়। তাই মন্ত্রের সম্বোধনে জ্ঞানজ্যোতিঃ-লাভে স্বরূপ উপলব্ধির উপদেশ আছে। তিনি যেমন প্রজ্ঞানের আধার, তেমনই জ্ঞানধনে ধনী হতে না পারলে, তেমন গুণ-বিশেষণে ভূষিত না হলে, তাকে পাওয়া যায় না। পূৰ্য্যস্তুতিং পদের অন্তর্গত পূর্ব পদে যে পূর্বকে বোঝাচ্ছে, সে পূর্ব ধ্যানধারণা কল্পনার অতীত। এখন যেমন আমি বলছি-পূর্বং, তেমনি আমার পিতৃপিতামহগণ বলেছেন– পূর্ব, তাদের পূর্ববর্তীগণও বলেছিলেন– পূর্ব। এইভাবে সকলেই সর্বকালে পূর্ব বলে আসছেন। সে যে কোন পূর্ব, কত পূর্ব, কে তা নির্ধারণ করবে? সুতরাং পূর্বস্তুতিংপদে চিরকালের, চিরনূতন স্তুতি ভাবার্থ গৃহীত হয়েছে। এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে হরিগণের (হরি নামক অশ্বদ্বয়ের) অধিষ্ঠাতা ইন্দ্র! তোমার পূর্বকালীন স্তুতি সকলকেই বলদ্বারা এবং ধন আছে বলে অতিক্রম করতে পারে না। বলা বাহুল্য, এ অর্থ সর্বতোভাবে ভাষ্যের অনুসারী নয়]।
১০/৩– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! কর্মসমূহের প্রকৃষ্টসম্পাদক অর্থাৎ সৎকর্মসাধকদের প্রমাদরহিত সৎকর্মের দ্বারা বর্ধনীয়, সৎভাবসমূহের অর্থাৎ চতুর্বর্গধনের অধিপতি, সৎকর্মের নেতা সেই ভগবানকে তোমাদের রক্ষণের জন্য অর্থাৎ পরমার্থলাভের জন্য (যেন) হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করি। [মানুষ কিভাবে অপ্রায়ুঃ অর্থাৎ প্রমাদরহিত হয়? অন্তর যখন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়, অজ্ঞানকিরণ যখন অপসৃত হয়ে যায়, কর্মের স্বরূপ বিষয়ে যখন জ্ঞান জন্মে, তখনই মানুষ। প্রমাদরহিত হয়, তখনই তার কর্ম প্রত্যবায় ইত্যাদি দোষ রহিত হয়ে থাকে। ফলতঃ জ্ঞানই মূলীভূত, জ্ঞান ভিন্ন কিছুই সম্ভবপর নয়। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– আমরা অন্নাভিলাষী হয়ে যে সকল যজ্ঞের ঋত্বিকগণ প্রমাদগ্রস্ত হয় না, সেই সকল যজ্ঞের দ্বারা দর্শনীয় অন্নপতি ইন্দ্রকে আহ্বান করছি]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম– বামদেব্যম্]।
১১/১– হে মন! সকলের নেতা সেই জ্ঞানদেবতাকে তুমি স্তুতি করো। (উদ্বোধনার ভাব এই যে, হে মন! তুমি জ্ঞানের অনুসারী হও)। দেবভাব-সমন্বিত ভগবৎপরায়ণ জনগণ, দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত, পরমৈশ্বর্যশালী, সকলের প্রভু, নির্বিকার ভগবানকে প্রাপ্ত হন। হে মন! তুমি তাঁদের অনুসারী হয়ে তোমার পূজাকে (বিহিত কর্মকে) সকল দেবগণকে প্রাপ্ত করাও। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক। আমার মন কর্ম যেন দেবত্বের অনুসারী হয়– এটাই সঙ্কল্প)। [ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ হয়– হে স্তোতা! সেই প্রসিদ্ধ অগ্নিকে স্তুতি করো। কেমন অগ্নি?– তিনি স্বর্ণরং অর্থাৎ সকলের নেতা, কর্মের প্রারম্ভে যজমানগণের স্তোতব্য, অথবা স্বর্গলোকে দেবগণের সমীপে হবিঃ ইত্যাদির নয়নকর্তা। ঋত্বিকগণ দান ইত্যাদি গুণযুক্ত স্বামী অগ্নির অভিমুখে গমন করেন (তাকে প্রাপ্ত হন)। হে স্তোতা! , এ সেই অগ্নিকে প্রাপ্ত হয়ে তার দ্বারা দেবগণকে হবিঃ প্রাপ্ত করাও। আমাদের মতে, অগ্নি অর্থে, জ্ঞানদেবতা এবং বিশেষ বিশেষণগুলি জ্ঞানদেবতাতেই প্রযোজ্য। প্রথম– স্বর্ণরং। সকলের নেতা। এ জ্ঞানই তো সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয় বিশেষণ– দেবং। তিনি দেবতা। তিনি পরমৈশ্বর্যশালী। তাঁর দাতৃত্বশক্তির পরিচয় তত্ত্বজ্ঞানী ও কর্মজ্ঞানী উভয়ের কার্যকলাপেই প্রকটিত। তিনি মোক্ষদান করেন। তাতে নিখিল ঐশ্বর্যের সমাবেশ– তিনি স্বর্গাপবর্গ-প্রদানকর্তা। তিনি অরতিং অর্থাৎ তিনি সকলের স্বামী, তিনি নির্বিকার, বিকাররহিত। জ্ঞান বিকারহীন, শ্রেষ্ঠ অর্থে তার প্রভুত্ব সর্বজনস্বীকৃত। ভগবান্ এবং তাঁর বিভূতি (এখানে জ্ঞানরূপ বিভূতি) অভিন্ন। অগ্নিদেবের সাথে দেবগণকে হবিঃ প্রাপ্ত করাও বাক্যের তাৎপর্য এই যে, এমনভাবে তাঁর পূজায় প্রবৃত্ত হও, – এমন কর্মের অনুষ্ঠান করো, যাতে বিভূতিগণসহ ভগবান্ (জ্ঞানদেবতা) পরিতৃপ্ত হন। শেষপর্যন্ত অগ্নিরূপী জ্ঞানদেব ও ভগবান্ একীভূত হয়ে গেছেন]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-১২দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১১/২– বিশিষ্ট-প্রজ্ঞান-অভিলাষিন, শোভন পূজা-সম্পাদন-প্রয়াসী, হে জীব (আত্মসম্বোধন)! তুমি প্রকৃষ্ট কর্মসাধনের জন্য (ভগবৎ-কর্ম সম্পাদনের জন্য) পরমদাতা, বিচিত্র দীপ্তিবিশিষ্ট পরম প্রজ্ঞানসম্পন্ন, হৃদয়সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা সম্পাদনীয় সৎকর্মের পূরণকারী, চিরনবীন– সনাতন সেই জ্ঞানদেবতাকে প্রকৃষ্টরূপে পূজা করে। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। পরাজ্ঞানেই পরমার্থতত্ত্ব অধিগত হয়। অতএব পরাজ্ঞানলাভের জন্য মন্ত্রে উদ্বোধনা বর্তমান)। [মন্ত্রটির একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে মেধাবী সোভরি! বিভূতি-দানবিশিষ্ট, বিচিত্র দীপ্তিমান, সোমসাধ্য এই যজ্ঞের নিয়ন্তা এই পুরাতন অগ্নিকে যাগ করবার জন্য স্তুতি করি। বলা বাহুল্য আমরা ব্যাখ্যাকারের এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করিনি। তবে লক্ষ্য করার বিষয়, ভাষ্যকার এই মন্ত্রে পূর্বং পদের ব্যাখ্যায় চিরন্তনং অর্থ গ্রহণ করেছেন। আগের মন্ত্রে (১০সূ/২সা) কিন্তু তা করেননি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম– সৌভরম্]।
১২/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! কঠোর সৎকর্মের দ্বারা বিশুদ্ধ, অমৃতযুক্ত, অবিনাশী তুমি আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হও; লোক যেমন নরকে প্রবেশ করে সেইরকম দ্যুলোকভূলোকস্থিত পাপহারক তুমি জ্ঞানালোকিত করে আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করো। (ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত পাপনাশক সত্ত্বভাব লাভ করি)। [এই মন্ত্রের কয়েকটি পদের ব্যাখ্যা-উপলক্ষে প্রচলিত ব্যাখ্যার সাথে আমাদের মতদ্বৈধ ঘটেছে। ভাষ্য এবং নিম্নে উদ্ধৃত একটি বঙ্গানুবাদ থেকে তা উপলব্ধ হবে। বঙ্গানুবাদটি এই, — হে সোম! প্রস্তরের দ্বারা তুমি নিপীড়িত হতে হতে মেষের লোমকে আচ্ছাদন করছ। দুই ফলকের উপরিস্থিত কলসের মধ্যে সোম প্রবেশ করছেন। পরে উজ্জ্বল হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাষ্ঠনির্মিত পাত্রে স্থান গ্রহণ করছেন। আমাদের ব্যাখ্যা আগের আগের মন্ত্রের শব্দগুলির মধ্যে দেওয়া হয়েছে। এখানেও মন্ত্রার্থের মধ্যে তা প্রকাশিত]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৫অ-৫-৩সা রূপেও পাওয়া যায়]।
১২/২– সৎ-ভাবকামী জনের হৃদয়ে অণুপরমাণুক্রমে বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রবাহ জন্মিয়ে, অভিসেচনসমর্থ আদিত্যের মতো অর্থাৎ আদিত্য যেমন আপন সপ্তকিরণের দ্বারা ভূতসমূহের চেতনা দান করেন, তেমনভাবে, পরমানন্দদায়ক পবিত্রতাসাধক পরমার্থদায়ক সেই শুদ্ধসত্ত্ব, সৎ-ভাবকামী সেই জনের উৎকর্ষ সাধন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যজ্ঞাপক ও আত্ম-উদ্বোধক। শুদ্ধসত্ত্বের মহিমার বা পার নেই। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই মানুষ পরমানন্দলাভে সমর্থ হয়)। [কি কুহেলিকা-জালেই মন্ত্রটিকে আচ্ছন্ন করে আছে। ভাষ্যকারের ব্যাখ্যাই সে জটিলতার মূল। মন্ত্রে মেষ্যঃ মীদ্বান্ সপ্তিঃ ন প্রভৃতি পদে সেই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। মেষের লোমে সোমরস পতিত হয়ে শোধিত হয়, তখন সে সোম ও যুদ্ধার্থ সজ্জিত অশ্বের ন্যায় শোভান্বিত হয়, এই ভাবই ভাষ্যকারের অর্থে পাওয়া যায়। ভাষ্যে সঃ পদ আছে; সোম শব্দ প্রযুক্ত হয়নি। মেষ্যঃ পদ দেখেই ভাষ্যকার বোধ হয় সঃ পদ থেকে সোমশব্দ টেনে এনেছেন। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রের সাথে অশ্ব প্রভৃতির বা সোমরসের কোনই সম্বন্ধ নেই। মন্ত্রের অদ্যানি ও মেষ্যঃ পদ দুটির অর্থ (ভাষ্যমতেই) সূক্ষ্ম মেষরোম। আমরা বলেছি অণুপরমাণুক্রমে। মেষ্যঃ পদের অর্থ হয়েছে বিশুদ্ধ জ্ঞানপ্রবাহ। জ্ঞানের বিচিত্র জ্যোতিঃ অন্তরের সমুদয় ক্লেদরাশি বিদূরিত করে অন্তরের পবিত্রতাসাধন করে। পূর্ণজ্ঞান একেবারেই জন্মে না; অণুপরমাণুক্রমে অঙ্কুর থেকে বিশাল মহীরুহের উদ্ভবের মতো ক্রমে ক্রমে উৎপন্ন হয়। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সেই অবস্থার উন্মেষ হয়, –এটাই অথানি মেষ্যপদ দুটির লক্ষ্য তারপর সপ্তিঃ ন উপমাটি লক্ষ্য করবার বিষয়। সপ্তিঃ পদের ভাষ্যকার অর্থ করেছেন অশ্ব ইব। তার অর্থই যদি অনুসরণ করা যায় তো তাতেও অর্থ সঙ্গত হয়। সূর্যের সপ্ত-রশ্মিকে সপ্ত অশ্ব বলা হয়। সপ্তিঃ পদে সেই সপ্ত অশ্বের বা সপ্তরশ্মি অর্থ থেকে আমরা আদিত্য অর্থ আনয়ন করেছি। সূর্যের আলোকরশ্মি সম্পাতে সংসারের ক্লেদরাশি ভস্মীভূত হয়ে সূক্ষ্ম বাষ্পকারে আকাশে সঞ্চিত হয়। — ইত্যাদি। জ্ঞানসম্বন্ধেও সেই উপমা সঙ্গত হয়। সূর্যের প্রভাবান্বিত বাষ্পরাশি যেমন ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়ে একসময়ে বৃষ্টিরূপে সংসারে শান্তি-শীতলতা আনয়ন করে, জ্ঞানও ক্রমে ক্রমে, অনুপরমাণুক্রমে সাধকের হৃদয়াকাশে সঞ্চিত হতে হতে মহাজ্ঞানে পরিণতি লাভ করে। সেই জ্ঞানের প্রভাবে মানুষ ভগবানের সাথে সম্মিলিত হতে সমর্থ হয়]।
১৩/১– প্রার্থনাকারী আমরা, শনাশের জন্য বজ্রধারী এই প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠ দেবতাকে, ইদানীং অর্থাৎ তার মাহাত্ম্য অবগত হয়ে, এই যজ্ঞে (সকল কর্মে) নিশ্চয়ই যেন আপ্যায়ন করি– অনুসরণ করি। হে আমার মন! সেই দেবতার জন্য, এই যজ্ঞে নিত্য অনুষ্ঠিত সৎকর্মে, সর্বতোভাবে সত্ত্বভাবকে সঞ্চয় করো; আর হে আমার কর্মনিবহ! তোমরা অধুনা, দেবতত্ত্ব পরিজ্ঞাত হয়ে, বিখ্যাত সেই দেবতার উদ্দেশে-দেবতার অনুগ্রহলাভের জন্য, সত্ত্বভাবের দ্বারা নিজেদের অলঙ্কৃত করো। (এই মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক; এই মন্ত্রে উপাসক নিজেকে ভগবৎ-অনুসারী সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করছেন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৪দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১৩/২– হিংসাপ্রত্যবায় ইত্যাদির বারয়িতা, অসত্মার্গগামিগণকে সৎপথে স্থাপয়িতা ভগবান, শরণাগতদের সত্যাগে প্রতিষ্ঠাপিত করেন। অথবা, হিংসক, সৎকর্মবিরোধী উন্মার্গগামী ও পরমকারুণিক ভগবানের প্রেরণায় সৎ-মার্গে বা প্রজ্ঞানে জন্মজন্ম পরিচালিত হয়। (ভাব এই যে, শত্রুও ভগবানের আনুকূল্য লাভে সমর্থ হয়)। পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! সেই করুণাধার আপনি আমাদের হৃদয়গত সভাব গ্রহণ করে নানারকম বিচিত্র ফলসম্পন্ন অনুগ্রহবুদ্ধির দ্বারা যুক্ত হয়ে আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। [মন্ত্রটি বিশেষ সমস্যামূলক। ভাষ্য এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা সেই জটিলতার উৎপাদক। মন্ত্রের সঙ্গে চোরের সম্বন্ধ খ্যাপিত হয়েছে। ইন্দ্রের সামগ্রী চোরে চুরি করতে পারে না– এমন কত ভাবের কত কথা ব্যাখ্যায় ও ভাষ্যে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। যেমন, প্রচলিত একটি অনুবাদ– চোর যদিও সকলের নিবারণকারী এবং পথগামীবর্গের বিনাশক, তথাপি সে ইন্দ্রের কার্যে ব্যাঘাত করতে পারে না; হে ইন্দ্র! সেই তুমি প্রীত হয়ে আগমন করো। হে ইন্দ্র! বিচিত্র কর্মবলে? বিশেষভাবে আগমন করো। বলা বাহুল্য, ভাষ্যের অধ্যাহৃত বৃকশ্চিৎপদের স্তেনোহপিঅর্থে মন্ত্রের সাথে চোরের সম্বন্ধ টেনে আনা হয়েছে। কিন্তু এতে ইন্দ্রের যে কি মহিমা প্রকাশ পায়, আর মন্ত্রের বা কি উচ্চভাব সূচিত হয়? এইরকম অর্থের জন্যই বেদমন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমরা যে ভাবে মন্ত্রের অর্থ নিষ্পন্ন করেছি তার যৌক্তিকতা লক্ষণীয়। শত্রুভাবেও যে ভগবানের করুণা প্রাপ্ত হওয়া যায়– মন্ত্র সেই সত্য প্রচার করছে। মন্ত্রের অন্তর্গত বৃকশ্চিৎবারণঃ উরামথি প্রভৃতি পদ তিনটির বিশ্লেষণে আমরা এই ভাবই প্রাপ্ত হই। ঐ সব পদের দুরকম অর্থ। নিষ্পন্ন হতে পারে। আর সেই দুরকম অর্থেই মন্ত্রের সুষ্ঠু সঙ্গত ভাব পরিব্যক্ত হয়। প্রথম প্রকার অর্থে বৃকশ্চিৎ বারণঃ পদের অর্থ হয়– অসৎমার্গগামীদের সৎপথে প্রতিষ্ঠাপয়িতা। এই দুটিকে অস্য পদের বিভক্তি ব্যত্যয়ে ভগবানের গুণ-বিশেষণরূপে পরিগ্রহণ করা হয়েছে। আবার, অন্যরকম অর্থের তাৎপর্যও অনুধাবনীয়। স্তেন পদের অর্থ চৌর বা চোর; ভাষ্যও তা গ্রহণ করেছে। কিন্তু যদি চোর অর্থই গ্রহণ করতে হয়, তাহলে বাইরের চোরের সন্ধানে কেন ফিরব? নিজের গৃহের মধ্যে যে চোর নিত্য বর্তমান রয়েছে, অন্তরে থেকে যে চোর সর্বস্ব অপহরণ করতে উদ্যত হয়েছে, সেই চোরকে পরিত্যাগ করে, অন্তরের বহির্ভাগে মানুষ চোরের সন্ধান করে কি ফললাভ হবে? অজ্ঞানতার সূচীভেদ্য অন্ধকাররূপ প্রাচীর-বেষ্টনে, অন্তরের চৌর দৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করে রয়েছে, তাদের দুর্ভেদ্য ব্যুহ বারণঃ অর্থাৎ আমার জ্ঞানকে সর্বদা প্রতিহত করছে, তখন অন্যত্র আবার আমি চোরের সন্ধানে ফিরব কেন? প্রথমে সেই শত্রুর বা চোরের দুর্ভেদ্য দুর্গদ্বার উদ্ভিন্ন করো, হৃদয়ের অন্ধকার অপসারণে উদ্বুদ্ধ হও, তবে তো হৃদয়ে ভগবানের অধিষ্ঠান হবে। অন্য ভাবের তাৎপর্য এই যে, ভক্ত যিনি, শরণাগত যিনি, তিনি তো ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করেই আছেন। কিন্তু যারা আজন্ম পাপপরায়ণ, উৎ-মার্গগামী– এককথায় যারা ভগবানের শত্রু, তারা কি তবে তার করুণালাভে কখনও সমর্থ হবে না? হবে। কারণ, শত্রুভাবে শ্রীভগবানকে স্মরণ করেও মুক্তিলাভ করা যায়। (যেমন, – হিরণ্যকশিপু, হিরণ্যাক্ষ, রাবণ, কংস ইত্যাদি)। মন্ত্রের অন্যান্য অংশ সরল ও সহজবোধ্য। মন্ত্রের অন্তর্গত চিত্রয়া, পদের আমরা বিবিধবিচিত্রফলযুক্তয়া অর্থ পরিগ্রহণ করেছি। ভগবান্ কর্মফলবিধাতা, চতুর্বর্গফল মোক্ষফলদাতা। মোক্ষফল চতুর্বর্গফল অপেক্ষা বিচিত্র আর কি হতে পারে? তার চেয়ে রমণীয় প্রিয়দর্শন অন্য কিছু আছে বলে মনে হয় না। এই ভাবেই চিত্রয়া পদের সার্থকতা]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম যথা, -বাসিষ্ঠ]।
১৪/১– আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত যে ইন্দ্রাগ্নিদেবতা, অথবা সর্বশক্তিমান জ্ঞানময় হে দেবদ্বয়! হৃদয়রূল্প দ্যুলোকে জ্ঞানজ্যোতিঃপ্রকাশক আপনার সৎ-ভাবজনক সৎকর্মের দ্বারা প্রকৃষ্টরূপে অলঙ্কৃত হন। (ভাব এই যে, জ্ঞানজ্যোতিঃ-প্রভাবে ভগবান্ হৃদয়ে স্বপ্রকাশ হন)। অথবা– আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হে ইন্দ্রাগ্নিদেবতা, অথবা প্রজ্ঞানময় হে দেবদ্বয়! আপনারা হৃদয়রূপ দ্যুলোকে জ্ঞানজ্যোতিঃরূপে প্রকাশিত হয়ে, শসহ সংগ্রামে প্রকৃষ্টভাবে আমাদের বিজয়যুক্ত করুন। হে দেবদ্বয়! আপনাদের সামর্থ্য, আপনাদের অদ্বিতীয় শক্তির মাহাত্ম্য প্রকৃষ্টভাবে বিঘোষিত করে অর্থাৎ আপনাদের মহিমা বিজ্ঞাপিত করে। [সর্বশক্তিমান্ ভগবান্ জ্ঞানজ্যোতিঃরূপে হৃদয়ে আবির্ভূত হন, জ্ঞানের মধ্য দিয়েই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। প্রথম অন্বয়ে মন্ত্র এই একভাবই প্রকাশ করছে। দ্বিতীয় অন্বয়েও প্রায় একই ভাবের অধ্যাস হয়। সেখানেও জ্ঞানের প্রভাব বিদ্যমান। অজ্ঞানতারূপ অন্তঃ শত্রু জ্ঞানের প্রভাবে অপসারিত হয়, অন্তরে পূর্ণজ্ঞানের উদয় হয়, দ্বিতীয় অন্বয়ে এই ভাবেরই বিকাশ এ দেখি। ফলতঃ জ্ঞানই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষদাতা, জ্ঞানই জ্ঞানস্বরূপকে প্রাপ্তির একমাত্র উপায়]।
১৪/২–- বলৈশ্বর্যাধিপতে হে ভগবন জ্ঞানদেব! আমাদের সৎকর্ম-অভিমুখে প্রেরণ করুন। অথবা হে ভগবন! আমাদের অজ্ঞান-আবরণ সর্বতোভাবে নাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনি আমাদের অজ্ঞানতা নাশ করে সৎকর্মপরায়ণ করুন)। [মন্ত্রটি ১৬শ অধ্যায়ের ১ম খণ্ডের ২য় সূক্তের ৩য় সামের অংশবিশেষ। এটি সরল প্রার্থনামূলক। সত্যের আলোকরৈখাকে লক্ষ্য করে যদি চলতে পারি, তবে আপাততঃ আমাদের সম্মুখে নিবিড় অন্ধকাররাশি বর্তমান থাকলেও আমাদের ভয়ের কারণ থাকে না। সেই ধ্রুবতারাকে লক্ষ্য করে সংসার-সমুদ্রে আমাদের জীবন-তরণী নির্ভয়ে পরিচালনা করতে পারি। সেই ধ্রুবতারা, ধ্রুবজ্যোতিঃ– সত্য, অনন্ত অবিনশ্বর সত্য। যিনি সেই সত্যের পথে চলতে সমর্থ হন, তার আর অধঃপতনের ভয় থাকে না। তাই সেই সত্যমার্গে চলবার শক্তি লাভ করবার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে]। [মন্ত্রটি উত্তরার্চিকের অন্যত্রও (১৬অ-১খ-২সূ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১৪/৩– বলৈশ্বর্যাধার হে ভগবন জ্ঞানদেব! আপনাদের সম্বন্ধি শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য আমাদের প্রদান করুন। [পূর্ব-মন্ত্রে অজ্ঞানতানাশে সৎকর্মপরায়ণ হবার প্রার্থনা বিজ্ঞাপিত হয়েছে। এই মন্ত্রে সৎকর্মসাধন-সামর্থ্যের প্রার্থনা রয়েছে। সামর্থ্য না জন্মালে, শক্তি সঞ্চার না হলে কিভাবে সৎকর্ম সাধন করা যেতে পারে? মন্ত্র তাই উপদেশ দিচ্ছেন– যদি ভগবানের প্রীতিকর কর্মসম্পাদনে তার অনুগ্রহভাজন হতে চাও, কর্মশক্তির উন্মেষ করো। কিভাবে সে কর্মশক্তির বিকাশ হয়? প্রথমে কর্মের স্বরূপ-বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে হবে, প্রকৃত কর্মের অনুসন্ধান করতে হবে, তারপর কর্মে প্রবৃত্ত হতে হবে। সে কর্ম হবে– নিষ্কাম কর্ম]। [এই মন্ত্রটি উত্তরার্চিকেও (১৬অ-১খ-২সূ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১৫/১– সৎকর্মে নিত্যবর্তমান সেই ভগবানকে কে জানতে সমর্থ হয়? ভাব এই যে, — কেউই ভগবৎ-তত্ত্ব অবগত নয়। [মানুষের হৃদয়ের চিরন্তনী অনুসন্ধিৎসা বৃত্তি এখানে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে মানুষের জ্ঞানেরও সসীমতা প্রদর্শিত হয়েছে। মানুষের প্রকৃত মনুষ্যত্ব যা দেবত্ব লাভের প্রধান কারণ– ঐ অনুসন্ধিৎসা। মানুষের মধ্যে ভগবান্ জ্ঞানের যে বীজ দিয়েছেন, তার থেকেই ঐ অনুসন্ধিৎসার জন্ম। মানুষের মনে প্রশ্ন আসে আমি কে? কোথা থেকে এলাম, যাব কোথায়? আমার পরিণাম কি? আমাকে কে সৃষ্টি করল? এই জগৎ কি? এই জগতের সঙ্গে আমার এবং স্রষ্টার কি সম্বন্ধ? এই আত্ম-জিজ্ঞাসাই ধূর্মলাভের প্রথম সোপান। এই অনুসন্ধিৎসার ফলেই এই প্রশ্ন-কঃ বেদ?– তাকে কে জানতে পারে? অন্যত্র আরও একটু অগ্রসর হয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে- কস্মৈ দেরায় হবিষা বিধেম? তিনি কে? কাকে পূজা করব? তিনি কেমন?– এ সমস্ত প্রশ্ন থেকে পরাজ্ঞানের আরম্ভ। এখানে আপত্তিকারিগণ বলবেন- মন্ত্রে কঃ বেদ বলেই পরক্ষণেই আবার সেই জ্ঞেয়বস্তুর সম্বন্ধে নানা বিশেষণ প্রয়োগের ফলে অজ্ঞেয়কে জ্ঞেয়ত্বের মধ্যে এনে আবার তাকে অজ্ঞেয়রূপে কল্পনায়-স্ববিরোধিতা দোষ লক্ষিত হচ্ছে। আমাদের মত এই যে, এখানে স্ব-বিরোধিতাদোষ কল্পনার কোনও কারণ নেই। এখানে এই জিজ্ঞাসার অর্থ এই যে, সে সেই অনন্ত বিরাট পুরুষ পরমব্রহ্মকে পূর্ণরূপে জানতে পারে? অর্থাৎ কেউই পারে না যে পর্যন্ত না জ্ঞাতা সেই জ্ঞেয়ের সমভাবাপন্ন হয়েছেন, যে পর্যন্ত না তিনি নিজের অসীমত্বের ও অনন্তত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করেছেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৭দ-৫সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১৫/২– মদাবী মত্তবারণ যেমন স্ববিরোধিদের ধর্ষক, তেমন শত্রুদের সম্বন্ধে মত্তবারণের মতো ভীষণ, অথবা পাপ-সম্বন্ধনাশক, পাপাত্মগণের ভীতিজনক ও পরমানন্দদায়ক, সৎকর্মসমূহে শত্রুগণের ধর্ষণকারী আপনি (হে ভগবন! ) আপনার সমীপে সংবাহনযোগ্য পরমানন্দ, আপনার অনুগ্রহপ্রার্থী আমাকে প্রদান করুন। হে ভগবন! আপনাকে কেউই প্রতিরোধ (অতিক্রম) করতে পারে না। সোম অভিযুত বিশুদ্ধ হলে অর্থাৎ অন্তরে সৎ-ভাব জন্মিয়ে আপনি আগমন করুন (অধিষ্ঠিত হোন)। সকলের পূজ্য আপনি আপন প্রভাবে সর্বত্র বিরাজ করছেন। (অতএব প্রার্থনা– আপনি আমার হৃদয়েও বিরাজমান হোন)। [যখন সংসারে ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয়, ধর্মনিষ্ঠ বেদবিহিত কর্মপরায়ণ সাধুপুরুষদের দুর্দশার অবধি থাকে না, তখন তাদের রক্ষার জন্য এবং বিরুদ্ধকৰ্মনিরত পাপিগণের দণ্ডদান-উদ্দেশ্যে ভগবান্ কঠোর রূপ ধারণ করেন। আর তখনই দানা মৃগো ন ধারণঃ রূপে তার মত্ততা প্রকটিত হয়। মৃগঃ পদের ধাতু অর্থ গ্রহণ করলেও আমাদের পরিগৃহীত অর্থের সার্থকতা প্রতিপন্ন হতে পারে। মৃ ধাতুর অর্থ শুদ্ধ (পরিশোধিত করা)। তিনি (ভগবান) প্রাণিদের পরিশোধিত করেন। পাপকষে কলঙ্কিত মানুষ পাপসম্বন্ধ পরিচ্ছিন্ন হলেই– অন্তরে ভগবৎ-অনুষ্ঠান হলেই বিশুদ্ধ হয়। সেই জন্যই তিনি মৃগঃ অর্থাৎ পাপসম্বন্ধ বিচ্ছিন্নকারী পাপাত্মাগণের পরিশোধক। ভগবান্ পাপসম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করেন বলেই, তিনি প্রথমতঃ পাপীদের কাছে ভীমঃ অর্থাৎ ভীতি উৎপাদক এবং ভয়প্রদ। আবার অন্তরের পাপকলুষ বিদূরিত হয়ে শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবে সঞ্চার হলেই মানুষ পরমানন্দ লাভ করে। সে আনন্দ কেমন?রথংঅর্থাৎ রথ যেমন অভীষ্টস্থান প্রাপ্ত করায়। তেমনই সে আনন্দ– সে শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎকামী জনকে ভগবানের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। -ভগবানকে কেউই প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয় না; অর্থাৎ তিনি সর্বশক্তিমান্ সকল শক্তির আধার-স্বরূপ। তিনি সকলের পূজনীয়–ন কিষ্টা নিয়মত মন্ত্রাংশের এটাই অর্থ]।
১৫/৩– শনাশে উগ্রমূর্তিধারী, শত্রুকর্তৃক অনভিভাব্য যে ভগবান্ শক্ৰসংগ্রামে অবিচলিত ও জয়যুক্ত হন, পরমধনদাতা পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন সর্বশক্তিমান্ সেই ভগবান, শরণাগত জনের করুণ আহ্বান শ্রবণ করে, সেই শরণাগত ব্যক্তিকে রক্ষার নিমিত্ত আগমন করেন, অপিচ, তাকে পরিত্যাগ করেন না। [বড় সার সত্য, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার শরণ গ্রহণ করা তো সহজ নয়। তার শরণ গ্রহণ করতে হলে কি করতে হবে? — সব রকম আসক্তিপরিশূন্য হয়ে অবিচ্ছেদে তার অনুরক্ত হতে হবে। এর ফলে ব্ৰহ্ম ও আত্মা বিষয়ে ভেদজ্ঞান তিরোহিত হবে। এই ভগবৎ-তত্ত্ব অধিগত হলেই তার শরণ গ্রহণ করতে পারবে। একবার প্রাণ ভরে ডাক। ডাকার মতো ডেকে তাতে আত্মসমর্পণ করো। কিন্তু সে প্রাণ তো আসে না। পাপমোহ যে অন্তরায় হয়। তাহলে কিভাবে তার শরণ নিতে পারবে? তাই মন্ত্রে ভগবানের একটি বিশেষণ– উগ্রঃ। সংসারবন্ধনকারক শত্রুদের নাশে তিনি কঠোর মূর্তি। পরিগ্রহণ করেন বলেই তিনি উগ্রঃ। তিনি সে সংসার-মোহ নাশ করে তার শরণ গ্রহণের পথ প্রশস্ত করে দেন। তিনি স্থিরঃ অর্থাৎ অবিচলিত। তিনিই মহাস্থৈর্যসাধন করেন। তিনি রিপুসংগ্রামে অর্থাৎ অন্তঃশনাশে মানুষকে বিজয়যুক্ত করেন বলে তার এক বিশেষণ– সংস্কৃতঃ। ফলতঃ কায়মনোবাক্যে তাকে আশ্রয় করতে পারলে ভগবান্ সে আশ্রিতকে রক্ষা করেন। এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ –ইন্দ্র উগ্র হলে (শত্রুরা) তাকে আচ্ছাদিত করে রাখতে পারে না, তিনি অচল, তিনি যুদ্ধে অলঙ্কৃত হন। ধনবান ইন্দ্র যদি স্তোতার আহ্বান শ্রবণ করেন, (অন্যত্র) গমন করেন না, কেবল (তথায়) আগমন করুন। এমন অর্থে ইন্দ্রকে একজন্ বিশেষ শক্তিসম্পন্ন, ধনী মানুষ বলেই। তা মনে হয়। দেবতার ভাব আদৌ উপলব্ধ হয় না! একে কুব্যাখই আখ্যা দেওয়া যায়]। [এই সূক্তের, এ অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। (সংলির গম– বার্ত্রম্ এবং আঙ্কারণিধনম]।
.
চতুর্থ খণ্ড
সূক্ত ১৬– পবমানা অসৃক্ষত সোমাঃ শুকাস ইবঃ। অভি বিশ্বানি কাব্যা৷ ১। পবমানা দিবস্পর্যন্তরিক্ষাদক্ষত। পৃথিব্যা অধি সানবি৷ ২৷৷ পরমানাস আশবঃ শুভ্রা অগ্রমিন্দবঃ। ঘন্তো বিশ্বা অপ দ্বিষঃ ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১৭– তোশা বৃত্ৰহণা হবে সজিনাপরাজিতা। ইন্দ্রাগ্নী বাজসাতমা। ১৷৷ প্র বামৰ্চন্তুথিনঃ॥ ২॥ ইন্দ্রাগ্নী নবতিং পুরঃ… ॥৩৷৷
সূক্ত ১৮– উপ ত্বা রসদৃশং প্রযস্বন্তঃ সহস্কৃত। অগ্নে সসৃজমহে গিরঃ ॥১॥ উপচ্ছায়ামিব ঘৃণেরগ্ম শৰ্ম তে বয়ম্। অগ্নে হিরণ্যসদৃশঃ ॥ ২॥ য উগ্র ইব শৰ্যহ তিগ্মশৃঙ্গো ন বংসগঃ। অগ্নে পুরো রুরোজিথ৷৩৷৷
সূক্ত ১৯– ঋতা বানং বৈশ্বানরমৃতস্য জ্যোতিষম্পতি। অজস্রং ঘর্মমীমহে॥১৷৷ য ইদং প্রতিপথে যজ্ঞস্য স্বরুত্তির। ঋন্নুৎসৃজতে বশী৷৷২৷৷ অগ্নিঃ প্রিয়েযু ধামসু কামো ভূতস্য ভব্যস্য। সম্রাড়েকো বিরাজতি৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১৬সূক্ত/১সাম– পরমজ্যোতিঃসম্পন্ন পরমপবিত্রতাসাধক পরমানন্দদায়ক ভক্তিসুধাসমূহ (শুদ্ধসত্ত্বসমূহ) নিখিল সৎকর্ম সম্পাদন করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎ-ভাবেই সৎকর্ম সম্পূর্ণ হয়; আর ভগবানও তাতে পরিতুষ্ট ও অনুগ্রহবুদ্ধিযুক্ত হন)। [ইন্দবঃ পদের অর্থে ভাষ্যকার সায়ণ লিখেছেন, — দীপ্তাঃ। তার অধ্যাহার করেছেন– সোমঃ। কিন্তু সোম শব্দ মন্ত্রের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় না। আমরা মনে করি এই পদের সঙ্গত অর্থ ভক্তিসুধা, শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি। যখনই ভক্তি সর্বতোভাবে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়েছে, যখনই ভক্তি ভগবৎ-সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছে, তখনই আনন্দে আনন্দ মিলে গেছে। ভক্তির প্রবল অবস্থায় মৎসরতারূপ আনন্দ সঞ্জাত হয়; দ্বিতীয় অবস্থায় আনন্দের মাদকতায় সাধক বিহ্বল হয়ে পড়েন; তৃতীয় অবস্থায় বিন্দু বিন্দু ধারায় চিদানন্দে আত্মানন্দ মিলিত হয়ে যান। পরিশেষে মিলনের মধুরতা জীবন জনম মধুময় করে তোলে। অন্তর তখন বিশুদ্ধ ভক্তির আধারে পরিণত হয়। ইন্দবঃ– হবনীয় দ্রব্য ইত্যাদি তখনই সুধামৃতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। সকল আনন্দের হেতুভূত তৃপ্তিপ্রদ হর্ষবৃদ্ধিকর মধুর ইন্দবঃ (উপচার) তখনই ভগবানের উদ্দেশে প্রযুক্ত বা প্রস্তুত হয়েছে বলতে পারা যায়। ভক্তির এই যে তৃতীয় অবস্থা– এটাই শুক্রাসঃ। এই অবস্থায়েই জ্ঞানময়কে হৃদয়সিংহাসনে বসাতে পারা যায়]।
১৬/২– পবিত্রতাসাধক পরমানন্দদায়ক ভক্তিসুধা বা শুদ্ধসত্ত্বসমূহ, দ্যুলোকের উপরিভাগে অবস্থিত অন্তরিক্ষলোক হতে, অর্থাৎ সহস্রারে অবস্থিত সহস্রদলকমল হতে পৃথিবীকে অর্থাৎ হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্রে ক্ষরিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক ও আত্ম উদ্বোধক। প্রার্থনার ভাবও মন্ত্রের অন্তর্নিহিত)। [মন্ত্রটি নিত্য-সত্যমূলক। কিন্তু ভাষ্যের ও ব্যাখ্যার ভাবে মন্ত্রের অর্থ একটু জটিলতাসম্পন্ন হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– ক্ষরিত সোমরসগুলি স্বর্গলোক ও নভোমণ্ডল হতে (আনীত হয়ে) পৃথিবীর উন্নত প্রদেশে উৎসাদিত হলেন। এখানে পর্বতগাত্রে সোমলতার কাল্পনিক উৎপত্তি এবং তা থেকে রসগ্রহণের ভাবই মনে আসে। তবে সোমরসগুলি আনীত হয়ে পৃথিবীর উন্নত প্রদেশে উৎপাদিত হলেন, এ ভাষা ও এ ভাব বোধগম্য হওয়া নিতান্ত দুরূহ। ভাষ্যের ভাবও প্রায় একই। বলা বাহুল্য, আমরা ভাষ্যকারের ও ব্যাখ্যাকারের এ ভাব গ্রহণ করতে পারিনি]।
১৬/৩– আশুমুক্তিদায়ক দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন নিত্যশুদ্ধিদায়ক– পরমানন্দস্বরূপ ভক্তিসুধা বা শুদ্ধসত্ত্ব সকল শত্রুকে বিদূরিত করে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভক্তিসুধা ও শুদ্ধসত্ত্ব প্রভৃতি গতিমুক্তিদায়ক। অতএব যদি মুক্তির অভিলাষী হও, সভার সঞ্চয়ে এবং ভক্তিসুধা আহরণে প্রবুদ্ধ হও)। [মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাষণে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ মতান্তর ঘটেনি। তবে এই মন্ত্রের যে একটি অনুবাদ প্রচলিত আছে, তা এই, — দ্রুতগামী শুভ্রবর্ণ সোমরসগুলি তাবৎ শত্ৰু সংহার করতে করতে ক্ষরিত হলেন এবং উৎপাদিত হলেন। রস কিভাবে শত্রুকে সংহার করে বোধগম্য হয় না। মন্ত্রের অন্তর্গত ইন্দবঃ পদের আলোচনা পূর্ববর্তী মন্ত্রে পরিদ্রষ্টব্য]।
১৭/১– দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন পাপশত্রুগণের বিনাশকারী, সর্বত্র বিজয়যুক্ত সকলের অতিরস্কৃত, পরমধনের বিধানকারী অর্থাৎ চতুর্বর্গফলদাতা হে সর্বশক্তিমান্ দিব্যজ্ঞানাধার ইন্দ্রাগ্নী দেবদ্বয়! তোমাদের হৃদয়ে এবং সৎকর্মে যেন প্রতিষ্ঠিত করি। [মন্ত্রে ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করবার সরল এ সঙ্কল্প বর্তমান। অন্তরে ভগবানের অধিষ্ঠান হলে অন্তঃশত্রু বিনষ্ট হয়, মানুষ পরমধনের অধিকারী হতে পারে, — মন্ত্র এই ভাবই প্রকাশ করছে। মন্ত্রের যে একটি বঙ্গানুবাদ প্রচলিত আছে, তা এই– আমি শত্রুনাশক, বৃহন্তা জয়শীল, অপরাজিত ও প্রচুর পরিমাণে অন্নদাতা ইন্দ্রাগ্নীকে আহ্বান করছি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।
১৭/২– হে পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন জ্ঞানাধিপতি দেবদ্বয়! আত্মজ্ঞানসম্পন্ন সাধকগণই আপনাদের অর্চনা করতে সমর্থ হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক)। [যাঁরা আত্মজ্ঞানসম্পন্ন, যাঁরা ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন, পরমার্থতত্ত্ব যাঁদের অধিগম্য হয়েছে, তারাই সেই ভগবানের অর্চনায় সমর্থ হন। এই নিত্যসত্য প্রকটনের সঙ্গে সঙ্গে উপদেশ দিচ্ছেন, — যদি ভগবানের পূজা করতে চাও, আত্মজ্ঞানসঞ্চয়ে পরমার্থ-নৃত্বে অভিজ্ঞ হতে প্রযত্নপর হও। নচেৎ গতিমুক্তিলাভ সুদূরপরাহত। তিনি যে বিশ্বরূপ! তার স্বরূপ যদি উপলব্ধ না হলো, কিভাবে কোন্ রূপে তার অর্চনা করবে? — মূল মন্ত্রে শেষাংশে প্রার্থনা আছে]। [মূল মন্ত্রটি উত্তরার্চিকে ১৬শ অধ্যায়ে ১ম খণ্ডে ২সূক্তের ১ম সামরূপেও দেখা যায়]।
১৭/৩– জ্ঞানশক্তিপ্রদায়ক হে দেবদ্বয়! আপনারা বহুসংখ্যক শত্রুগৃহকে বিনাশ করেন; অথবা নবদ্বারবিশিষ্ট অসংখ্য শত্ৰুপরিবৃত আমাদের দেহরূপ গৃহকে, অর্থাৎ সকল শত্রুকে বিনাশ করে নবদ্বারবিশিষ্ট দেহরূপ গৃহকে রক্ষণ ও পালন করেন। [মূল মন্ত্রটি উত্তরার্চিকের ১৬শ অধ্যায়ে (১৬অ ১খ-২সূ-২সা) সন্নিবিষ্ট আছে। এটি কৃষ্ণ যজুর্বেদেও পরিদৃষ্ট হয়]
১৮/১– সাধনার দ্বারা উৎপন্ন হে জ্ঞানদেব! পূজাপরায়ণ আমরা পরমরমণীয় আপনাকে অভিলক্ষ্য করে প্রার্থনা যেন উচ্চারণ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন প্রার্থনাপরায়ণ হই)। [ভগবানের জ্ঞানবিভূতির প্রতি লক্ষ্য করে প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে। জ্ঞানের একটি বিশেষণ সহস্কৃতঅর্থাৎ বলের দ্বারা, শক্তির দ্বারা উৎপন্ন। সাধনার প্রভাবেই মানুষ জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হয়। প্রতি মানুষের অন্তরে ভগবানদত্ত জ্ঞানবীজ আছে বটে, কিন্তু তাকে সাধনার দ্বারা পরিস্ফুট করতে হয়। তাই জ্ঞান-সহস্কৃত]।
১৮/২– হে জ্ঞানদেব! পরমমঙ্গলদায়ক জ্যোতির্ময় আপনার পরমশক্তিদায়ক কল্যাণ (অথবা আশ্রয়) যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের জ্ঞানশক্তির আশ্রয় লাভ করি)। [মন্ত্রের মধ্যস্থ উপমা ছায়ামিব। এর মধ্যে মন্ত্রটির সার অংশ নিহিত আছে। ছায়ামিব শর্ম– পরমশান্তিদায়ক কল্যাণ বা আশ্রয়। একটি বাংলা অনুবাদ– হে অগ্নি! তুমি, রমণীয় তেজঃসম্পন্ন ও দীপ্তিশালী, তোমার আশ্রয় আমরা ছায়ার ন্যায় গ্রহণ করছি। — এই অনুবাদের ভাব আমাদের অনেক কাছাকাছি]।
১৮/৩– যে দেবতা প্রভূতশক্তিসম্পন্ন যোদ্ধাতুল্য রিপুনাশক এবং রক্ষাস্ত্রধারী ঊর্ধ্বগতিদায়ক অভীষ্টবর্ষক তুল্য, হে জ্ঞানদেব! সেই আপনি শত্রুদের আশ্রয়স্থান বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরমশক্তিসম্পন্ন ভগবান্ আমাদের রিপুনাশক হোন)। [ভগবানের কৃপায় যেন আমাদের রিপুবিনাশ হয়, এটাই মন্ত্রের প্রার্থনার সার মর্ম। এই প্রার্থনার দ্বারা ভগবানের মহিমাও প্রখ্যাপিত হয়েছে। একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে অগ্নি! তুমি বাণদ্বারা শনিহন্তা, প্রচণ্ড বলশালী, ধানুঙ্কের ন্যায় এবং তীক্ষ্ণশৃঙ্গ বৃষভের ন্যায় পুরী সকল নষ্ট করেছ। কিন্তু এই অনুবাদ ভাষ্যেরও ভাব প্রকাশ করতে পারেনি]।
১৯/১– হে দেব! সত্যস্বরূপ, বিশ্বে লোকসমূহের হিতকারী, সত্যজ্যোতিঃর অধিপতি, অনন্তজ্যোতিঃস্বরূপ আপনাকে আমরা যেন আরাধনা করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্যোতিঃস্বরূপ পরমদেবতাকে আরাধনা করি)। [আমাদের আরাধনা যাঁর চরণতলে নিবেদিত, তিনি কেমন? তিনি ঋতাবানং– সত্যের আকর, সত্যস্বরূপ। আরও তিনি বৈশ্বানরং– বিশ্বের লোকসমূহের হিতকারক। তিনি অজস্রং ঘর্মং অর্থাৎ অনন্তজ্যোতিঃ। তিনিই জ্যোতিঃর আধার, তার থেকেই জগতে আলোকের আবির্ভাব হয়। মানুষ যদি তাঁর চরণে নিজের অর্ঘ্য নিবেদন করতে পারে, তবেই মানুষের জীবন সার্থক হয়। তাই মন্ত্রে সেই চরম সার্থকতা লাভের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে]।
১৯/২– যে পরমদেব পরিদৃশ্যমান এই জগৎকে সৎকর্মের স্বর্গপ্রাপক মহাফল প্রদান করে সর্বত্র– প্রখ্যাত হন, জগৎপতি সেই দেব কালাধীশ হন। [মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সর্বাধিপতি হন]। [জগতের সকল জীব তারই কৃপায় মুক্তিলাভ করতে সমর্থ হয়, তিনিই জগৎকে শান্তিবারি বিতরণ করেন। যজ্ঞস্য স্ব উত্তিরণ– যজ্ঞের, সৎকর্মের মহাফল তিনিই বিতরণ করেন। মানুষ কর্মের অধিকারী, কিন্তু ফলদান ঈশ্বরের অধিকার কর্মের ফললাভ ভগবানের কৃপার উপর নির্ভর করে। যিনি এই সত্য অবগত আছেন, যিনি এই সত্যের সাধনা করেন, তিনি আশানিরাশাজনিত দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেন। এই মহান্ সত্য জগৎকে জ্ঞাপন করবার জন্যই বেদ বলছেন– ইদং যজ্ঞস্য স্বঃ উত্তিরন। বিশ্ববাসীকে স্বর্গপ্রাপক মহাফল প্রদান করে প্রতি পথে সর্বত্র ব্যাপ্ত হন, প্রকাশিত হন। জগত্বাসী তার মহিমা অবগত হবার সুযোগ লাভ করে। মন্ত্রে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে]।
১৯/৩– সমস্ত ভূতজাতের আকাঙক্ষণীয় জ্ঞানদেব সর্বলোকে অদ্বিতীয় অধীশ্বর হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানস্বরূপ ভগবানই বিশ্বের অধিপতি হন)। [সমগ্র জগৎ বিশ্বের অধিপতি, পালক ও রক্ষক ভগবানকেই লাভ করতে চায়। বিশ্বের সেই অধীশ্বর থেকে জগৎ এসেছে, তাতেই বিলীন হবে, আবার তার থেকেই সৃষ্ট হবে। এটাই জগতের চরম গতি। মানুষ স্বাভাবিক প্রেরণাবশে তাঁর সেই পরম ও চরম লক্ষ্যের দিকেই অগ্রসর হতে চায়। নানারকম বাধাবিপদের জন্য সে অগ্রসর হতে পারে না বটে, কিন্তু তার লক্ষ্য সেই এক পরম ধাম। -ভাষ্যকারের সাথে আমাদের মতের অনেকাংশেই ঐক্য পরিলক্ষিত হবে। ভূতস্য ভব্যস্য পদের অর্থ করেছেন, অতীতকালীনস্য ভূতজাতস্য আগামিনঃ ভবিষ্যৎকালীনস্য অর্থাৎ সর্বলোকের। সর্বলোকের কি হন? উত্তরে বলা হচ্ছে– কামঃ। সকলের কামনার সামগ্রী। শুধু তাই নয়। তিনি সমগ্র বিশ্বের অধিপতি একঃ সম্রাট (সম্রাডেকো)। তিনি অদ্বিতীয়, একমেবাদ্বিতীয়। তিনিই জগতের কর্তা, সর্বলোকে সর্বকালে, তারই মহিমা প্ৰখ্যাপিত হয়। সেই জগৎপতি পরমদেবতার মহিমাই এই বেদমন্ত্রে প্রখ্যাপিত হয়েছে]।
— অষ্টাদশ অধ্যায় সমাপ্ত —