এবার আমরা সেই মূর যাদুকর বুড়োটার দিকে চোখ ফেরাচ্ছি–
লোকটা সেই পর্বত গুহায় আলাদিনকে আটক করে স্বদেশে মরোক্কোয় প্রস্থান করলো। আলাদিন তখন খিদে তেষ্টায় প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় সেই পাহাড় তলদেশের অন্ধকূপ গুহায় মৃত্যুর মুহূর্ত গুণতে থাকে। বুড়োটা খুব ভালো করেই জানতো, না খেতে পেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে মরবে আলাদিন। একটি অবোধ অসহায় শিশুকে ঐ ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দিয়ে সে সচ্ছন্দে স্বগৃহে ফিরে আসতে পারলো। তার নিষ্ঠুর কসাই প্রাণে এতোটুকু মমতা সে কখনও পালন করেনি জীবনে। আলাদিনের জীবন-মৃত্যু নিয়ে আদৌ চিন্তিত বা বিচলিত বোধ করেনি। তার মনে তখন হাহাকার উঠেছে—যাদুচিরাগটি কজায় না পাওয়ার শোকে।
দিন যায়। মূরের মনের খেদ আর মেটে না। ইস, হাতের মুঠোয় পেয়েও সে হারিয়েছে। আর একটু হলেই সে আলাদিনের কাছ থেকে চিরাগটা ছিনিয়ে নিতে পারতো। সে চেয়েছিলো গুহার নিচে থাকতে থাকতে আলাদিনের কাছ থেকে চিরাগটা ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে পাথর-বন্দী করে মেরে ফেলবে। সেইজন্যে সে তাকে দু একটা চড়-চাপড় দিয়ে একটু ভয় দেখিয়ে বাতিটা হাতের মুঠোয় করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফল বিপরীত দাঁড়িয়ে গেলো। কে জানে মার খেয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে একেবারে নিচে গুহাগৃহের দরজার চৌকাঠে গিয়ে পড়ে যাবে। সিঁড়ির নিচে নামার তো তার এক্তিয়ার নাই। এবং এও বুঝতে পেরেছিলো, আলাদিন একবার ওপরে উঠতে পারলে আর তাকে পাত্তা দিত না। কারণ চিরাগ সম্বন্ধে তার মাত্রাধিক আগ্রহ দেখে সে সন্দেহ করেছিলো নিতান্তই তার মধ্যে কোনও রহস্য জড়িয়ে আছে। তা না হলে কালি-ঝুলি মাখা একটা তামার প্রদীপ নিয়ে এতো ঝামেলা করছে কেন সে।
বুড়ো যাদুকর তার নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেরই কপাল চাপড়ায়। কিন্তু চিরকালের মতো চিরাগটা পাওয়ার আশা অন্তর্হিত হওয়া সত্ত্বেও তার শোক আর সে কাটাতে পারে না। কিছুতেই।
বেশ কিছুদিন পরে বুড়ো মুর তার যাদুদণ্ড আর বালীর ঝুলিটা নামিয়ে নিয়ে টেবিলে বসে। বালীগুলো টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিয়ে দণ্ডটা দিয়ে মন্তর-তন্তর আওড়াতে আওড়াতে আঁকিবুকি কাটতে থাকে। উদ্দেশ্য, আলাদিন কী ভাবে সেই পর্বত-গুহায় প্রাণ ত্যাগ করেছে, এবং যাদুচিরাগটাই বা এখন কোথায় পড়ে আছে তা নিরূপণ করা।
বার বার আঁকিবুকি কেটে কেটে সে হুঙ্কার ছাড়তে থাকে, বল, জলদি করে বল লাঠি, আলাদিন কবে মরেছে আর চিরাগটাই বা কোথায় পড়ে আছে?
কিন্তু লাঠিখানা বার বার ছিটকে বেরিয়ে যেতে থাকে। যাদুকরের কথার কোনও জবাব দিতে পারে না।
মুরের মনে সন্দেহের কালো ছায়া নেমে আসে। তবে কী গণনায় ভুল হচ্ছে। তবে কী আলাদিন এখনও জীবিত?
যাদুদণ্ড ইঙ্গিতে সব পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলো, আলাদিন মরেনি। সে এখন বহাল তবিয়তে, চীন সুলতানের কন্যাকে শাদী করে, সুখ-বিলাসের মধ্যে কাল কাটাচ্ছে। আর যাদু-চিরাগ? সে তো তারই দখলে আছে এখন। তার দৌলতে এখন সে সুলতানের প্রাসাদের পাশে পেল্লাই একখানা চমৎকার চোখ ঝলসানো প্রাসাদ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে এখন সুলতান-জামাতা। শুধু তাই নয়, তার দান-ধ্যানে দেশের মানুষ তাকে মহাজন বলে সন্মান করে।সে আর এখন দীন ভিখারী আলাদিন নয়। তাকে এখন আমির আলাদিন বলে লোকে। সে এখন দীনদয়াল আলাদিন। লোকে তাকে অনাথের নাথ অগতির গতি একমাত্র ত্রাণকর্তা বলে মনে করে। সে সবই তার এখন ঐ চিরাগের কল্যাণে।
হুম বুঝলাম, শয়তান বদমাইশটা আমারই অস্ত্রে আমাকে ঘায়েল করেছে। আমার হকের ধন আমাকে ফাঁকি দিয়ে বাদশাহী সুখ-বিলাসে সে বিভোর হয়ে দিন কাটাচ্ছে। ঠিক আছে, আমি শয়তানের শয়তান-মূর যাদুকর। তুমি কত সেয়ানা হয়েছ আলাদিন, আমিও তা দেখবো। তোমাকে আমি কী করে খতম করি একবার দেখ।
আর ক্ষণমাত্র মরোক্কোয় অপেক্ষা না করে সে চীনের উদ্দেশে পথে বেরিয়ে পড়লো। মন্ত্রবলেই তার বাহুতে বোধহয় ডানা গজিয়েছিলো, তা না হলে মরোক্কো থেকে চীন তো কম দূরের পথ নয়, সে এতো তাড়াতাড়ি এসে পৌঁছলই বা কী করে?
আলাদিনের সুরম্য প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে তার বুকের জ্বালা আরও বেড়ে যায়। ভাবে, এই প্রাসাদ ঐশ্বর্য সুখ-বিলাস উপকরণাদি সবই তার হকের সম্পত্তি। আলাদিন শয়তান বেল্লিকটা তাকে ঠকিয়ে আজ সে তার ভুয়ো মালিক হয়েছে। এর উপযুক্ত সাজা তাকে দেবই দেব আমি।
শহরের একপ্রান্তে একটা সরাইখানায় উঠেছে সে। সেদিনের মতো সরাইখানা ফিরে গিয়ে মাথায় ফন্দী আটতে লাগলো-কী ভাবে শয়তানটাকে শায়েস্তা করা যায়। কিন্তু অনেক ভেবেও কোনও মতলবই সে আঁটতে পারলো না। পরদিন আবার গেলো সে আলাদিনের প্রাসাদের সামনে। কিন্তু অতবড় প্রাসাদে তার কোন্ কামরায় আলাদিন থাকে এবং সে কামরার কোথায় কোন বাক্সে তোরঙ্গে চিরাগটিকে সে লুকিয়ে রাখে তাই বা কে বলে দেবে তাকে। আর বললেই বা কী? ঐ প্রাসাদের কড়া প্রহরা ভেদ করে অন্দরেই বা প্রবেশ করতে পারবে কে?
সেদিনও সে ব্যর্থ মন নিয়ে সরাইখানায় ফিরে আসে। যাদুদণ্ড আর বালীর ঝোলাটা বের করে টেবিলের ওপরে বালীগুলো ছড়িয়ে দেয়। কাঠিকে দিয়ে আঁকি-বুকি কাটতে কাটতে মন্ত্র আওড়ায়। দণ্ডকে প্রশ্ন করে, বল বেটা, আলাদিন কোথায় কোন্ ঘরে শুয়ে থাকে। এখন সে কোথায়? চিরাগটা কী তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে না? না, প্রাসাদেই কোথাও লুকিয়ে রাখে?
বালীর লিখন পড়ে বুড়ো শয়তানটার চোখ নেচে ওঠে। আকর্ণ বিস্তৃত দাঁত বের করে এ বিকটভাবে হাসতে থাকে—হা হা হা। এবার বাছাধন, যাবে কোথায়?
আলাদিন সেদিন শিকারে চলে গেছে। যাবার সময় সে চিরাগটা দেরাজে তালা বন্ধ করে যেতে ভুলে গেছে। টেবিলের ওপর রেখেই খেয়ালের ঝোকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।
আলাদিন প্রায়ই সদলবলে শিকারে যায়। বুদুরকেও সে সঙ্গে নিতে চেয়েছে প্রতিবার। কিন্তু শান্ত নিরীহ প্রকৃতির বুদুর শিকারে কোনও মজা পায় না। তাই সে প্রাসাদেই থেকে যায়। প্রতিবারই। আলাদিন অবশ্য দিন সাতেকের বেশি দেরি করে না। এই ক’টা দিন স্বামী-চিন্তায় বিভোর থাকে সে। দিন কাটাতে তার খুব একটা খারাপও লাগে না। সব সময় যে কাছে কাছে। থাকে সে যদি কখনও-সখনও চোখের আড়াল হয় তবে আরও মধুর বলে মনে হয় তাকে।
মূর যাদুকর গণনায় বুঝতে পেরেছিলো, আলাদিন শিকারে গেছে। ফিরতে দিনকয়েক দেরী হবে। এবং চিরাগটা সে তার শোবার ঘরের টেবিলেই রেখে গেছে ভুল করে।
এই মওকা। শয়তানটা প্রায় ছুটতে ছুটতে বাজারে যায়। চিরাগের দোকানে ঢুকে বলে বশে ঝকঝকে সুন্দর সুন্দর তামার চিরাগ দাও এক কুড়ি।
দোকানি তাকে নানা আকারের নানা বাহারের চিরাগ দেখায়। বুড়োটা বলে, ঠিক আছে সবগুলোই আমার এই ঝুলিতে ভরে দাও। কত দাম?
দোকানির সঙ্গে সে আর দাম নিয়ে দরাদরি করে না। যা সে চায় তাই গুণে দিয়ে রাস্তায় নেমে হন হন করে হাঁটতে থাকে আলাদিনের প্রাসাদের দিকে। আর মাঝে মাঝে হাঁক ছাড়ে, চিরাগ চা-ই, চি-রা-গ নেবে গো?নতুন চিরাগের বদলে পুরানো দিলে বদল হবে
পাড়ার ছেলেরা বুড়োর অদ্ভুত ধরনের সুর করে হাঁক ডাকে মজা পেয়ে তার পেছনে লাগে। পাগল পাগল বলে ক্ষেপায়। কিন্তু ধূর্ত যাদুকর বালকদের নেবে গো, চি-রা-গ-পুরানো চিরাগের বদলা নতুন চিরাগ মিলবে—চিরাগ নেবে, চিরাগ চা-ই—
শাহজাদী শূন্য প্রাসাদের বাতায়ন-পাশে বসে বাইরের পথচারীদের যাওয়া আসা লক্ষ্য করছিলো। এমন সময় একটা জগঝম্পের আলখাল্লা পরা একটা কোথাকার কুৎসিত লোলচর্ম বুড়ো ফিরিওয়ালার পিছনে পিছনে এক দঙ্গল ছেলে-ছোকরাকে হুটোপুটি করতে দেখে বুদুরের অন্তরের কিশোর, প্রাণ নেচে ওঠে। বড় মজা পায়।
লোকটার কিন্তু কোনও দিকে ক্রুক্ষেপ নাই। কাঁধে একটা বিরাট ঝোলা। একহাতে একখানা ত্রিভঙ্গাকৃতির ষষ্ঠি, ও অন্য হাতে একটি ঝকমকে তামার নতুন চিরাগবাতি। সুর করে হাঁক ছাড়ে, চি-রা-গ নেবে গো—চিরাগ। পুরানো চিরাগ বদল করে নতুন চিরাগ দেবো।
বুদুরের পাশে সখীরাও খিল খিল করে হাসে। মজা পায়, ওমা লোকটা বলে কী? পুরানো চিরাগ বদল করে নতুন চিরাগ দেবে?
বুদুর বলে, ঐ জন্যেই তো ছেলেগুলো ওর পেছনে লেগেছে। লোকটার বোধ হয় সত্যিই মাথা খারাপ, না হলে নতুন জিনিস দিয়ে কেউ পুরানো জিনিস দিতে চায়।
একজন সহচরী বলে, ওঃ, তাই বুঝি ছেলেগুলো পাগল পাগল বলে বুড়োটাকে ক্ষেপাচ্ছে।
আর একজন পরিচারিকা বলে, আমাদের মালিকের ঘরের টেবিলে একটা কালিঝুলিমাখা পুরানো চিরাগ দেখেছি আজ। তা শাহজাদী, ওটাকে পালটে নিলে কেমন হয়?
বুদুর বলে, তাই নাকি? তোমাদের মালিকের টেবিলে আছে? কই, নিয়ে আয় দেখি।
মেয়েটি ছুটে গিয়ে চিরাগটা নিয়ে আসে। বুদুর হাতে নিতে চায় না। দূর দূর, ওদিকে রাখ, আমার পোশাকে তেলকালি লেগে যাবে। উফ কী নোংরা! যা ওটাকে খোজার হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দে বুড়োটার কাছে! এই রকম একটা জবরজং পুরানো চিরাগের বদলে যদি একটা নতুন পাওয়া যায়-ক্ষতি কী?
মেয়েটি এক খোজার হাতে দিয়ে বুড়োর কাছে পাঠায়। খোজাটা বাম হাতের দুটি আঙ্গুল দিয়ে আলগোছে ধরে বাতিটাকে নিয়ে যেতে যেতে বলে যত্তো সব বিদঘুটে কাণ্ড!
এই রকম একটা পোড়-খাওয়া পুরানো নোংরা পিদিমের বদলে একটা আস্ত আনকোরা বাতি দেবে নাকি সে। সব বুজরুকি! খালি খালি হয়রানি করছে তোমরা, দেখো, লোকটার অন্য ধান্দা আছে। বাতিটা হাতিয়ে নিয়ে তখন নতুন বায়না ধরবে। বলবে সঙ্গে কিছু নগদ ছাড়ো, না হলে নতুন মাল পাওয়া যায় নাকি?
পরিচারিকাটি বলে, তোমার অত বকবক করার কী আছে, যা হুকুম করছি তামিল কর।
খোজা পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, কী? কী বললে? তুমি আমায় হুকুম করছ? তুমি কি আমার মালকিন নাকি? এই রইলো তোমার চিরাগ। ওরে আমায় হুকুমদার রে! তুইও যেমন এক বাদী আমিও তেমনি বান্দা। আমাকে তুই হুকুম করিস কিসের জোরে রে।
মেয়েটি সুযোগ পেলেই এই খোজাটিকে চটায়। বেশ মজা পায়। মুখে ভীষণ গাম্ভীর্য টেনে বলে, দেখ নফর, বাতি ওঠা, যা বলছি শোনো, তা না হলে তোর আজ গর্দান নেব।
-কী? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? তুই আমার গর্দান নেবার কে? আমি পারবো না
—কী, পারবি না? তবে শাহজাদীকে গিয়ে বলি, নফর আপনার হুকুম তামিল করতে চাইছে না
খোজাটা মুহূর্তে কেঁচোর মতো গুটিয়ে যায়, অ, তাই বলো। স্বয়ং শাহজাদীর হুকুম। তা এতক্ষণ ন্যাকরা করছিলি কেন রে মুখপুড়ি।
এই বলে সে ছো মেরে চিরাগটা তুলে নিয়ে ছুটতে ছুটতে বুড়োটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
—এটার বদলে দেবে একটা?
বুড়োটা হতবাক হয়ে জুল জুল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে যাদুচিরাগটা। হ্যাঁ, সেই চিরাগ—তার সারাজীবনের স্বপ্নের ধন। অবশেষে এতদিন পরে তার হাতের নাগালের মধ্যে এসেছে। কি এক অপূর্ব শিহরণে তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকে। তখনও তার মনে পাওয়া না পাওয়ার সংশয় দুলছে। যদি এইমাত্র লোকটা বলে, না থাক তোমার চিরাগটা পছন্দসই মনে হচ্ছে না, নেব না। অথবা, আলাদিন যদি ধূমকেতুর মতো এই মুহূর্তে এসে হাজির হয় এখানে। যদি কোনও কারণে তার শিকার অভিযান বাতিল করে প্রাসাদে ফিরে আসে? ওরে সর্বনাশ তা হলে তো সে ধনে-প্রাণে মারা যাবে! চিলের মতো ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নেয় সে চিরাগ। খোজাটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাপারটা কী কিছুই অনুধাবন করতে পারে না। লোকটা কী একটা ঠগ? এইভাবে লুব্ধ করে লোকের জিনিসপত্র ঘর থেকে বের করে আনিয়ে ছেনতাই করে? কিন্তু না, তা নয়। পরমুহূর্তেই সে তার ভুল বুঝতে পারলো। বুড়োটা তার ঝোলা থেকে আরও ঝকঝকে একটা চিরাগ বের করে খোজার হাতে গুঁজে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে রাস্তার বাঁকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। ছেলেগুলো আর তাকে ধাওয়া করে সুবিধে করতে পারে না। বুদুর আর তার সহচরীরা এই দৃশ্য দেখে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকে।
একটানা ছুটতে ছুটতে যাদুকর বুড়োটা সোজা চলে আসে তার সরাইখানার ঘরে। যাদুচিরাগটাকে বের করে ঘষতেই সেই আফ্রিদি দৈত্যটা এসে হাজির হয় সামনে। বলে, আমি ত্রিভুবনের অধিপতি। আমার তুল্য শক্তিধর আর কেউ নাই। একমাত্র আপনার হাতের এই চিরাগ ছাড়া কেউ আমার প্রভু নয়। এই চিরাগ এখন আপনার কজায়। সুতরাং এখন আপনিই আমার একমাত্র মালিক, হুকুম করুন, হুজুর কী করতে হবে। বান্দা প্রস্তুত।
যাদুকর বললো, ওরে বাবা, অত বকিসনে, সব আমি জানি! নে এখন চটপট যা বলি করে ফেলো দেখি!
—আজ্ঞা করুন, মালিক।
—শোন বান্দা, এর আগে তোর মালিক ছিলো আলাদিন।
–যথার্থ বলেছেন, হুজুর।
—তার হুকুমে এক বিশাল প্রাসাদ এনে বসিয়ে দিয়েছিস সুলতানের প্রাসাদের পাশে।
—বিলকুল সাচ্ বাত।
-এখন আমার হুকম, ঐ প্রাসাদটা যেমন আছে ঠিক তেমনি ভাবে আলতো করে তুলে নিয়ে গিয়ে আমার স্বদেশ মরোক্কোর এক নির্জন বনাঞ্চলে স্থাপন করে রেখে আয়। তারপর আমাকেও নিয়ে যাবি সেখানে।
—জো হুকুম মালিক, আমি এখুনি করে দিচ্ছি। বুড়োটা বলে, তা কতক্ষণ সময় লাগবে তোর?
আপনার চোখ দুটো একবার বন্ধ করে আবার খুলতে যতটুকু সময় লাগবে তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে না, হুজুর।
–ঠিক আছে।
এক পলকের মধ্যে ফিরে এসে আফ্রিদি। জানালো, আপনার হুকুম তামিল করেছি মালিক। এবার আমার পিঠে চেপে বসুন। আপনাকে এখুনি পৌঁছে দিচ্ছি সে প্রাসাদে।
আফ্রিদি হামাগুড়ি দিয়ে বসতে যাদুকরটা তার পিঠে চেপে বসলো এবং পলকের মধ্যে সে তাকে নিয়ে গিয়ে মরক্কোর এক নির্জন জঙ্গলের এক প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাসাদ প্রাঙ্গণে নামিয়ে দিলো।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো ছেষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
পরদিন সকালে সুলতান কন্যার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বুদুরের প্রাসাদে আসেন। কিন্তু কী আশ্চর্য প্রাসাদ কোথায়? এ তো তার সেই ফাকা ময়দান।ঠিক আগে যেমনটি ছিলো তেমনি খালি পড়ে আছে। কে বলবে গতকাল সন্ধ্যাতেও এক বিশাল গগনচুম্বী ইমারত মাথা তুলে সদর্পে দাঁড়িয়েছিলো।
সুলতান নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারে না। দু’হাতে তিনি চোখ রগড়াতে থাকেন। কিন্তু না, এ তার ভ্রম নয়। সত্যিই সেখানে প্রাসাদ বলে কিছু নাই। ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি। সর্বনাশ, তার বুকের কলিজা নয়নের মণি বুদুর। সে কোথায় গেলো? তার কী হলো?
এবারে আর তার বুঝতে বাকী থাকে ন, সবই সেই শয়তান যাদুকর আলাদিনের ভেঙ্কী। সুলতান ছুটে ফিরে আসেন তার নিজের প্রাসাদে। ছাদের ওপরে উঠে আবার ভালো করে দেখতে থাকেন। কিন্তু না, তার দেখার কোনও ভুল নয়। পাশে ময়দান, সেখানে প্রাসাদ বলে। কিছুই নাই। কখনও যে ছিলো তারও কোনও চিহ্নমাত্র নাই।
কন্যার শোকে পাগলপ্রায় সুলতান নিজের চুল দাড়ি ছিড়তে থাকেন, ইয়া আল্লাহ, এ কী করলে তুমি?কী এমন পাপ আমি করেছিলাম, আমার একমাত্র চোখের মণি মেয়েকে তুমি কেড়ে নিলে?
একটি ছোট শিশুর মতো তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। উজির এসে পাশে দাঁড়ায়। সুলতান এবার হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন, আমার সর্বনাশ হয়েছে উজির। আলাদিন শয়তানটা সত্যিই একটা যাদুকর ছিলো। সে আমাকে ধোকা দিয়ে শাহজাদীকে শাদী করে উধাও হয়েছে।
উজির মনে মনে হাসে। মুখে বলে, আল্লাহর অপার লীলা। তিনি যা করবেন তা তো কেউ এড়াতে পারবে না, জাঁহাপনা। কিন্তু আমি তো শুনেছি আলাদিন দলবল নিয়ে শিকারে গেছে।
সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়েন, এখুনি সেপাই পেয়াদা পাঠাও। যেখানে পাও তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে এসো আমার সামনে। আমি তার গর্দান চাই।
উজির এবার সাহস করে বলতে পারে, জাঁহাপনাকে আমি অনেক আগেই সতর্ক করে বলেছিলাম, ছেলেটি এক ধূর্ত ঠগ যাদুকর। কিন্তু সেদিন ধর্মাবতার পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে আমাকে ভৎসনা করেছিলেন।
একথার কোনও জবাব দিতে পারেন না সুলতান। মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে উজিরের কথায় সায় জানান শুধু।
উজির বলে, ঠিক আছে আমি এখুনি সিপাই সান্ত্রী পাঠাচ্ছি। যদি সে সত্যিই শিকারে গিয়ে থাকে পাকড়াও করে নিয়ে আসবে।
রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো সাতষট্টিতম রজনী :
আবার গল্প শুরু হয় :
উজিরের আদেশে সিপাই সর্দার শখানেক সিপাই নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় শহর ছেড়ে। বেশি দূর তাদের যেতে হয় না। শহর ছাড়িয়ে একটা প্রান্তর, সেটা পার হলে এক গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গলেই তাবু খাটিয়ে শিকার করতে আসে আলাদিন।
সিপাই সর্দার আলাদিনের সামনে পৌঁছে যথা মর্যাদায় কুর্নিশাদি জানিয়ে সুলতানের ফরমাস জানায়।
—আপনি আমার গোস্তাকি মাফ করবেন, মালিক। আপনার বদান্যতা দেশের কোনও মানুষই ভুলবে না কোনও দিন। আপনি ধনী দরিদ্র সকলের প্রাণের দোস্ত। আপনার মতো দরদী বন্ধু এ জগতে হয় না। কিন্তু আমরা সুলতানের নফর, হুকুমের দাস। তার আদেশ অমান্য করার শক্তি আমাদের নাই।
আলাদিন হাসে, বেশ তো কী তার আদেশ বললো, শুনি।
সর্দার ইতস্ততঃ করে, সে আদেশ কী করে আপনাকে শোনাবো, মালিক। সে যে মুখে আনতেও জিভ আড়ষ্ট হয়ে যায়।
–বুঝতে পারছি, তোমরা বড়ই বিব্রত বোধ করছ। কিন্তু তার কোনও প্রয়োজন নাই। দ্বিধাহীন চিত্তে অসঙ্কোচে বলল, কী তার হুকুম। সুলতানের আদেশ তোমাদের যেমন আমারও তেমনি শিরোধার্য। আর কুষ্ঠিত হয়ো না বন্ধু, বলল, কী তাঁর আদেশ।
সিপাই সর্দার কোনও রকমে বলতে পারে, কী কারণে জানি না, সুলতান আপনার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তার কুম, আপনাকে, কোমরে দড়ি বেঁধে, টানতে টানতে তার সামনে হাজির করতে হবে। আপনি মহামান্য আমির, সুলতানের জামাতা—এ কী কাজ আমাদেব ঘাড়ে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন, বলুন মালিক। এখন আমি কী করি।
আলাদিন বলে, কী আবার করবে? সুলতানের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই প্রভুভক্ত নফরের একমাত্র কাজ—তাই তোমরা করবে। এসো আমার কোমরে দড়ি বাঁধ, আমি প্রস্তুত।
আলাদিন তার ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ালো। সিপাইরা তার কোমরে দড়ি বেঁধে প্রাসাদে এনে হাজির করলো। আসার পথে আলাদিনের এই বন্দীদশা দেখে শহরবাসীরা আহত হলে সবাই, চোখের জল ফেললো অনেকে। কিন্তু সুলতানের হুকুম, মুখে কেউ কোনও প্রতিবাদ করতে সাহস করলো না। কী কারণে জামাতার এই সাজা, জানবার জন্য সারা শহর ভেঙ্গে পড়লো প্রাসাদের চারপাশে। লোকে লোকারণ্য। কেউ কিছু বলতে পারে না, সুলতান জামাতার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।
সেপাইরা আলাদিনকে টানতে টানতে প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। বাইরে তখন উত্তাল জনসমুদ্র। একটা চাপা গর্জন, বেশ বুঝতে পারা যায়, জনতা রোষে ফেটে পড়তে চাইছে।
আলাদিন প্রাসাদের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেলেও একটি মানুষও প্রাসাদের সামনে থেকে নড়ে না। বরং ক্রমশঃ ভিড় বাড়তে থাকে।
ধীরে ধীরে জনতা সোচ্চার হয়ে ওঠে। তারা জিগির তোলে, দীন-দয়াল মালিক, আলাদিনের মুক্তি চাই। সাচ্চা হীরা আলাদিনকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।
সুলতান রাগে ফুঁসছিলেন। আলাদিনকে দেখামাত্র তিনি কোনও রকম জিজ্ঞাসাবাদ না করেই হুকুম দিলেন, কোতল কর। আর একমুহূর্ত আমি এই শয়তান ঠগের মুখ দর্শন করতে চাই না।
জল্লাদ দোতলার ছাদে নিয়ে গেলো আলাদিনকে। কারণ জনতা তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। বাগানের বাইরে ছাদের ওপরে নিয়ে গিয়ে আলাদিনকে সে হাঁটু গেড়ে বসতে বললো। আলাদিন এতোটুকু বিচলিত নয়। সে জানে সে কোনও অপরাধ করেনি, বিনা দোষে যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড মাথা পেতে নিতে হয় সে নেবে। তারপর পাপের ফল দণ্ডদাতা ভোগ করবে-এও সুনিশ্চিত।
হাঁটু গেড়ে বসে সে ঘাতকের খাড়ার আঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়। জল্লাদ তার চোখে কাল কাপড় বেঁধে দিয়ে খাঁড়া উঁচিয়ে ধরে। কিন্তু নিচে থেকে হাজার হাজার কষ্ঠে এক সঙ্গে ধ্বনিত হয়ে ওঠে, বন্ধ কর, রুখ যাও।
ঘাতক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আবার সে খাড়া বাগিয়ে ধরে। কারণ সুলতানের হুকুম তাকে তামিল করতেই হবে। নিচে থেকে জনতা মারমুখী হয়ে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে ঘাতককে লক্ষ্য করে, মালিক আলাদিনের গর্দান নিলে রক্তের নদী বয়ে যাবে। বন্ধ কর, খাড়া পেলে দাও ঘাতক।
আবার জল্লাদ উদ্যত খাড়া নামিয়ে নিয়ে সুলতানের দিকে তাকায়। সুলতান তখনও তার গোঁ-তে অটল, হুকুম তামিল কর, বেতমিজ।
এবার মারমুখী জনতাকে আর বাগে রাখতে পারলো না সিপাই পেয়াদারা।
সুলতান প্রমাদ গণলেন। এ জনতার রোষ শান্ত হবার নয়। জল্লাদকে তিনি নিরস্ত হতে হুকুম দিলেন, ঠিক আছে, শহরবাসীর অনুরোধে, এ যাত্রায় আমি ওর প্রাণভিক্ষা দিলাম।
এবার জনতা শান্ত হলো খানিকটা।
সুলতানের সামনে আলাদিনকে হাজির করা হলো। তিনি বললেন, জনতার দাবীতে তুমি এবারের মতো প্রাণে রক্ষা পেলে। কিন্তু আমার আদরের দুলালী বুদুরকে যদি ফিরিয়ে না দাও আমি তোমাকে রেয়াৎ করবো না।
আলাদিন বুঝতে পারে না, বুদুরকে ফিরিয়ে দেবার প্রশ্ন উঠছে কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, শাহজাদী বেগম হলেও সে আপনারই কন্যা আছে। আপনি যেমন নিত্য দু’বেলা তাকে দেখতে যান তেমনি যাবেন। আপনার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে কী করবেন? আর কেনই বা। নেবেন? আমার কী গোস্তাকি, জাঁহাপনা?
সুলতান বলে, কেন, তুমি কিছুই কি জান না?
-না, হুজুর।
সুলতান বলেন, ওপাশের জানলার পর্দা সরিয়ে দেখ, তোমার প্রাসাদ কোথায় গেলো?
আলাদিন দেখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। সত্যিই সেই আফ্রিদির তৈরি করা প্রাসাদটার কোনও চিহ্নমাত্র নাই। তৎক্ষণাৎ সে বুঝতে পারে, এ সেই মরক্কো যাদুকরটার শয়তানী। সে ছাড়া এ
অঘটন আর কেউ ঘটাতে পারে না।
সুলতান বললেন, শোনো আলাদিন, তোমার প্রাসাদ-টাসাদ চুলোয় যাক। আমার মেয়েকে তুমি ফেরত এনে দাও। তা না হলে এ যাত্রা তোমার গর্দান বাঁচলেও আখেরে তোমাকে আমি ছাড়বো না।
আলাদিন বলে, জাঁহাপনা, কেউই কার ভাগ্য এড়াতে পারে না। সুতরাং এও আমি জানি আমার নসীবে যা লেখা আছে তা কখনই খণ্ডন করতে পারবো না। আর মৃত্যুর কথা বলছেন? ও ভয়ে আমি ভীত নই কখনোই। তবে শাহজাদী বুদুর যেমন আপনার প্রাণাধিকা কন্যা আমারও তেমনি বুকের কলিজা। তাকে ছাড়া আমিও প্রাণে বাঁচতে পারবো না। যেভাবেই হোক, তার সন্ধান আমাকে করতেই হবে।
সুলতান বলেন, ওসব ঘেঁদো কথা রাখ। আমি তোমাকে চল্লিশ দিন সময় দিলাম। তার মধ্যে শাহজাদীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে তুমি—এই আমার হুকুম। তা না হলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই তুমি পালিয়ে থাক, আমার প্রহরীরা তোমাকে পাকড়াও করে আনবেই।
আলাদিন বললো, আমি জ্ঞানত কোনও পাপ করিনি। জানি না, কার চক্রান্তে অথবা কোন্ অভিশাপে এমন দুর্ভাগ্য আমার ঘটেছে, যাই হোক, আমি পথে বেরুচ্ছি। বুদুরকে যদি ফিরিয়ে আনতে না পারি, তবে এ জীবন আমি রাখবো না।
আর ক্ষণকাল বিলম্ব না করে তখুনি আলাদিন নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়ে।
সারাদিন ধরে একটানা পথ চলে চলে এক সময় যখন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে তখন কোনও গাছতলায় বসে একটু জিরিয়ে নেয়। নদীর জল আর গাছের ফল খেয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটায়। তারপর আবার চলতে শুরু করে। কত গ্রাম গঞ্জ শহরে পৌঁছয়। সেখানে জনে জনে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কেউ একটা বুড়ো যাদুকরকে দেখেছ? সে আমার বিবিকে নিয়ে পালিয়েছে।
কেউই আলাদিনকে কোনও আলোর নিশানা বলতে পারে না। এই ভাবে দিনের পর দিন অতিক্রান্ত হতে থাকে। হতাশায় সে ভেঙ্গে পড়ে। যাদুকর মহাধূর্ত। সে যে কোথায় নিয়ে চলে গেছে বুদুরকে—কেউ কী তার হদিশ বলতে পারবে? শুধু এইভাবে দেশে-দেশে ঘুরে বেড়ালে কী কোনও ফয়দা হবে?
একদিন এক বিশাল বিস্তৃত নদীর সামনে এসে আলাদিনের গতি রুদ্ধ হয়ে গেলো। ওপারে যাওয়ার কোনও যানবাহন নাই। অথচ নদী পেরোতে না পারলে সামনে চলার পথও নাই। কূলে বসে বসে সে ভাবতে থাকে, এ পোড়া জীবন রেখে আর কী লাভ? বুদুরকেই যদি সে না ফিরে পেলো, কী হবে এ জীবনে বেঁচে থেকে?
সামনে স্রোতস্বিনীর কালো জল। সে তাকে হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে। আর কেন আলাদিন, তোমার ইহজগতের লীলা সাঙ্গ হয়েছে, এবার আমার কোলে এসে দেহ রক্ষা কর।
আলাদিন আর স্থির থাকতে পারে না। কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় সে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে, আল্লাহ, এই কী তোমার বিচার? কী এমন পাপ আমি করেছি তোমার দরবারে-যার সাজা এইভাবে আমাকে দিলে খোদা?
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আলাদিন। সেই নদী উপকূলে ঘাসের শয্যায় গড়াগড়ি যায় তার সুকুমার সুন্দর দেহখানা। হাত পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করতে থাকে। মাথার চুল ছিড়ে, জামা কাপড় ফালা ফালা করে ফেলে। প্রায় উন্মাদের দশা! দু হাতের তালু দিয়ে থুতনি গাল ঘষতে থাকে।
হঠাৎ এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেলো। আলাদিনের ডান হাতের তর্জনীতে সেই যাদুকরের দেওয়া আংটিটা পরা ছিলো। পাহাড়-গুহার নিচে নামার আগে শয়তান বুড়োটা এই আংটিটা আলাদিনকে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, যদি কখনও চরম র বিপদ ঘনিয়ে আসে তবে এই আংটি ঘষবে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এক দৈত্য » এসে দাঁড়াবে তোমার সামনে। তাকে যা করতে বলবে, সে করে দেবে।
এই আংটির দৌলতে একদিন সে সেই পাহাড়ের মৃত্যু-গুহার ফাদ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছিলো। আজ এতদিন আংটিটা তার হাতেই আছে। কিন্তু সে-কথা সে একেবারেই বিস্মৃত হয়েছিলো। আজ গালের সঙ্গে হাতের তালু ঘষতে ঘষতে আংটিটাও ঘর্ষিত হয়েছিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটে গেলো। দৈত্য-প্রবর আবির্ভূত হলো তার সম্মুখে। আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, আমি আংটির গোলাম। আমার অসাধ্য কিছুই নাই। আপনি এখন আংটির মালিক। সেই কারণে আমার প্রভু। স্কুম করুন মালিক, কী করতে হবে, বান্দা প্রস্তুত।
আলাদিনের চোখ আশার আনন্দে নেচে উঠলো, শোনও বান্দা, আমি সেই মরক্কোর বুড়ো যাদুকরের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি। পাহাড় গুহা থেকে আশ্চর্য যাদু-চিরাগ উদ্ধার করে এনেছিলাম আমি। সেই চিরাগের বান্দা আফ্রিদি দৈত্য আমার নফর ছিলো। তাকে দিয়ে আমি এক সুরম্য প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলাম। চীন সুলতানের কন্যা শাহজাদী বুদুরকে শাদী করে পরমান্দে বসবাস করছিলাম সেখানে। কিন্তু আমার অসতর্কতার দোষেই ঐ শয়তানটা আমার চিরাগটা হাতিয়ে নিয়েছে। এবং তারই ফলে সে আমার বিবিকে সুদ্ধ প্রাসাদটা তুলে নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে, আমি কিছুই হদিস করতে পারছি না। এখন তুমিই একমাত্র ভরসা। আমার বিবি আর প্রাসাদটাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, এই আমি চাই।
আলাদিনের কথা শুনে আফ্রিদি দৈত্য মাথা নিচু করে বললো, আপনার সব হুকুম আমি তামিল করতে পারি, কিন্তু এই হুকুম আপনি করবেন না মালিক। একাজ আমি করতে পারবো না।
আলাদিন অবাক হয়ে বলে, কেন? তুমি যে বললে, কোনও কাজই তোমার অসাধ্য নয়?
দৈত্য বললো, মর্ত্যলোকের কোনও কাজই আমার অসাধ্য নয়, কিন্তু চিরাগের মালিক আফ্রিদি দৈত্য আমার ওস্তাদ। তার কোনও কাজ আমি ভুল করতে পারি না।
দৈত্যের কথা শুনে আলাদিনের মন আবার হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। তবে, তবে কী উপায় হবে? প্রাসাদটা যদি সেনা নিয়ে আসতে পারে তবে আর শাহজাদী বুদুরকে উদ্ধার করা যাবে কী করে?
দৈত্যটা বললো, আপনি যদি হুকুম করেন, আমি আপনাকে আপনার ঐ প্রাসাদের সামনে পৌঁছে দিতে পারি। তারপর যদি পারেন, আপনি উপায় করে নেবেন।
আলাদিন এবার একটু আশার আলো দেখতে পায়। বলে, ঠিক আছে, তাই কর। সেই প্রাসাদের সামনেই আমাকে পৌঁছে দাও।
দৈত্য ওকে পিঠে তুলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উড়ে এসে মরোক্কোর সেই নির্জন জঙ্গল প্রান্তরে রক্ষিত প্রাসাদের পশচাৎ দিকে নামিয়ে দিলো।
আলাদিন দেখামাত্র চিনতে পারে, এই তার প্রাসাদ। বুঝতে অসুবিধে হলো না কোন্ জানালাটা তার নিজের, এবং কোন্ জানালাটা শাহজাদী বুদুরের শয়নকক্ষের! একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে অধীর হয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো বুদুরের কামরার দিকে। কিন্তু অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলো জানালায় কারো ছায়াও দেখতে পেলো না আলাদিন। তবে কী, শয়তান যাদুকরটা বুদুরকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছে?অতি সন্তর্পণে সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে। এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে নেয়, কেউ কোথাও তাকে লক্ষ্য করছে না। অন্য কোনও লোকের দৃষ্টিতে পড়লে আশাঙ্কার কিছু নাই, কিন্তু ঐ বদমাইশটার নজরে পড়লে নসীবে অনেক দুঃখ আছে। কিন্তু চারিদিক নিথর নিষ্পন্দ। জনমানবের কোনও সাড়া শব্দ পায় না সে। মাঝে মাঝে মৃদুমন্দ মলয় বাতাসে আন্দোলিত তরুশাখার পত্র মর্মর শোনা যায়।
আলাদিন দুঃসহ আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। ভেড়ার মগজ রসুইখানায় পাকাবার জন্য পাঠিয়ে এক ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন অস্থির প্রত্যাশায় প্রতীক্ষা করে, এ তেমনি এক প্রতীক্ষা।
যাদুকরটা প্রাসাদসুদ্ধ বুদুরকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকে শাহজাদী আলাদিনের শোকে দুঃখে কাতর হয়ে শয্যা গ্রহণ করেছে। সে আর পালঙ্ক ছেড়ে ওঠে না, খায় না ঘুমায় না। তার একমাত্র চিন্তা কী করে আবার সে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবে। আশঙ্কায় তার বুক কাঁপে, শয়তান বুড়োটা প্রতিদিনই একবার করে তার ঘরে আসে। অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মন ভেজাবার চেষ্টা করে। বুদুর বুড়োটার দিকে ফিরেও তাকায় না। ঘৃণায় তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়! কিন্তু এও বুঝতে পারে, বদমাইশটা তাকে সহজে নিস্তার দেবে না। এখন সে মুখে মধু ঢেলে কথা বললেও কিছুদিন বাদেই তার আসল চেহারা মেলে ধরবে সে। তার পাশবিক অত্যাচারের লোলুপতা
থেকে কী করে সে নিজেকে রক্ষা করবে ভাবতে পারে না।
সূর্য ঢলে পড়ে। একটু পরেই রাত্রির কালো অন্ধকার নেমে আসে। এখনও জানালায় এসে দাঁড়ালো না শাহজাদী। তবে কী সে এ ঘরে নাই?আংটিটা ঘষতেই আবার এসেদাঁড়ালো দৈত্যটা। আলাদিন বললো, আমি তো সারাদিন শাহজাদীর ঘরের জানালায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সে তো জানালার ধারে কাছে এলো না। এখন খোঁজ নিয়ে বলল, সে কোথায়? এই প্রাসাদে কী নাই?
দৈত্যটা পলকে অদৃশ হয়ে পলকেই আবার ফিরে এসে বললো, না হুজুর, তিনি এই ঘরেই শুয়ে আছেন। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছেন। শয্যা ছেড়ে বড় একটা ওঠেন না।
আলাদিন বললো, তুমি এক কাজ কর। এক খোজা নফরের বেশে তাকে গিয়ে গেলো, সে যেন একবার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।
–জো হুকুম, মালিক!
দৈত্য অদৃশ্য হয়ে গেলো। এক নফরের রূপ ধরে সে শাহজাদীর কামরায় ঢুকে বললো, শাহজাদী, একবার মেহেরবানী করে জানালার পাশে এসে দাঁড়ান, দেখুন বাগানে কী সুন্দর সব ফুল ফুটে আছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহজাদী উঠে এসে জানালার পাশে দাঁড়ায়। এবং আলাদিনকে দেখতে পেয়ে এক অব্যক্ত আনন্দে অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। ওঃ, তুমি সোনামণি, তুমি এসেছ?
রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো ঊনসত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
এদিকে আরও আরও কাছে জানালার সামনে এসে দাঁড়াও সোনা, কোনও ডর নাই, ছুঁচোটা এখন প্রাসাদে নাই। কোথায় কার সর্বনাশ করতে বেরিয়েছে। সেই রাতে খানা-পিনার আগে ফিরবে না। আলাদিন জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বুদুর হাত বাড়িয়ে আলাদিনের চিবুক অধর স্পর্শ করে। আদর জানায়। বলে, আমি আল্লাহর কাছে অহরহ মোনাজাত করছি, জানতাম আমার মিনতি তিনি ঠেলতে পারবেন না। কিন্তু আজই যে তোমার দেখো পাবো তাও ভাবতে পারিনি।
বুদুরের ইশারায় নফর প্রাসাদের ফটক উন্মুক্ত করে দিলো, শাহজাদী বললো, আর দেরি না করে চটপট ভিতরে চলে এসো।
আলাদিন ঘরে আসতেই বুদুর দরজা বন্ধ করে দিয়ে স্বামীর বুকে ঢলে পড়ে। কান্নায় সে ভাসিয়ে দেয় ওর বুক। আলাদিন ওকে সান্তনা দিতে থাকে, কেঁদ না। মেরিজান, আমি যখন একবার এসে পড়েছি, ঐ শয়তান যাদুকরটাকে আমি? একবার দেখে নেব। তুমি কিচ্ছু ভেব না। এখন বলল, তোমার ঘরে লুকাবার জায়গা আছে কোথাও?
বুদুর বলে, খুব আছে। ঐ যে দেখছো, মেহগনি কাঠের পেল্লাই আলমারীটা-ওটায় আমার সাজ-পোশাক থাকে। ওর মধ্যে দিব্যি তুমি শুয়ে। ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে।
আলাদিন বলে, আরে না ঘুমাবার দরকার নাই, আজ রাতেই কেল্লা ফতে করে তোমাকে নিয়ে আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। আচ্ছা হা, যাদু-চিরাগের কথা বুড়ো তোমাকে বলেছে কিছু? ওটা কোথায় আছে জান?
বুদুর বলে, হ্যাঁ, বলেছে, ঐ চিরাগের যাদুতেই নাকি তুমি এই প্রাসাদ বানিয়েছিলে। আমার পোড়াকপাল, ঐ শয়তানটার ধোঁকায় ভুলে তোমার ঐ চিরাগটা আমি লোকটার কাছে পালটি করে নতুন একটা চিরাগ নিয়েছিলাম। তখন কী জানতাম ও চিরাগবাতি আলো জ্বালাবার নয়। ওর মধ্যে এমন যাদু আছে, যা দিয়ে তামাম বিশ্ব-সংসার পায়ের তলায় রাখা যায়? আমি বুঝবো কী করে? আমাকে তো তুমি বলনি কোনও দিন। বুড়োটা আমাকে সব বলেছে। এও বলেছে, ঐ চিরাগের মায়াবলে দুনিয়ার সব সুখ বিলাস সে আমার পায়ে এনে নিবেদন করতে পারে। শুধু একবার তার কথায় রাজি হলেই হলো।শয়তানটা কত রকম লোভ দেখায় জান? বলে, চাও তো যে কোনও দেশের শাহেনশাহর বেগমকে এনে তোমার বাঁদী করে রাখতে পারি।
আলাদিন হাসে, তা মিথ্যে বলেনি। ও এমনই চিরাগ, ওর যাদুতে অসাধ্য সাধন করা যায়। সে তো তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। এই যে ইমারত এর একটা জানালার কারুকার্য সাত সুলতানের ধন-সম্পত্তির চাইতেও অনেক বেশি দামি। এ সব কী কোনও মর্ত্যলোকের মানুষের চেষ্টায় সংগ্রহ হতে পারে? থাক ওসব কথা। এখন বলো দেখি, ঐ চিরাগটা কোথায়? বুড়োটা কী কোথাও লুকিয়ে রেখে যায়, না সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে? : বুদুর বলে, আমিও অনেক কোসিস করেছি, হাতাবার, কিন্তু বুড়োটা মহা ধূর্ত ধড়িবাজ। ও বস্তু সে নিজের কাছছাড়া করে না। কামিজের তলায় তলপেটে গুঁজে রাখে, সব সময়। দরজা বন্ধ করে রাতে ঘুমায়! কিন্তু তখনও ওটা ওর তলপেটেই গোঁজা থাকে।
আলাদিন বলে, ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নাই। তোমাকে আজ খানিকটা ঢং করে অভিনয় করতে হবে।
–কী রকম?
—লোকটা রাতে ফিরে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে তো?
–ও বাবা, তা আর আসবে না। রোজই তো ও মনে বড় আশা নিয়ে আমার ঘরে আসে। নানা প্রলোভনে ভুলিয়ে আমাকে শয্যা-সঙ্গিনী করতে চায়। কিন্তু আমি যখন ওর দিকে বিষনজর হেনে বলি, জানে যদি বাঁচতে চাও, আমার ঘর ছেড়ে সিধে বেরিয়ে যাও, তখন আর একটি কথা বলতে পারে না। ভীতু পেঁচার মত পালিয়ে যায়।
আলাদিন বলে, বহুত আচ্ছা। কিন্তু আজ তোমাকে অন্য চালে চলতে হবে। চুল টুল বেঁধে, প্রসাধন প্রলেপ লাগিয়ে খুব দামী দামী গহনা পরে এবং জমকালো সাজ-পোশাক পরে একেবারে কামাতুরা পটের বিবিটি সেজে বসে থাকবে। লোকটা ঘরে ঢোকা মাত্র উঠে গিয়ে ওর হাত ধরে পালঙ্কে এনে বসাবে, ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, তোমার মত বদলেছে। মনে আর কোনও খেদনাই। এখন তার অঙ্কশায়িনী হতে তোমার আর কোনও বাধা নাই।
বুদুর আলাদিনের মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরে, কী যে আজে বাজে অলুক্ষণে কথা সব বল তার ঠিক নাই।
—আহা-হা, এতে ঘাবড়াচ্ছো কেন, আগে পুরোটা শোনো, তারপর যা বলার বলবে।
—বেশ বলল কিন্তু বাপু, তোমাকে আগেই বলে রাখছি, ওই শয়তানটাকে নিয়ে আমি শুতে পারবো না। তুমি হয়তো মতলব এঁটেছে, বুড়োটা ঘুমিয়ে পড়লে, ওর তলপেট থেকে চিরাগটা বের করে নিতে পারবো। কিন্তু অত সহজ ভেবো না। বুড়োর ঘুম খুব পাতলা! খুট করে ছোট্ট একটা আওয়াজ শুনলে শুয়ে শুয়েই সে গোঙায়-এ্যাঁই কে র্যা?
আলাদিন বলে, তুমি আমাকে অত মাঠো ভাবলে কী করে, সোনা। বুড়ো-হাবড়াদের নিদ খুব পাতলা হয়, আমি জানি। ও পাশে যাবো না আমি। বুড়োটাকে এমন দাওয়াই দিতে হবে যাতে
আর ইহজীবনে ওর ঘুম না ভাঙে।
—বিষ?
বুদুরের চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। আলাদিন বলে, হ্যাঁ বিষ।
—কিন্তু এখানে কোথায় পাবে বিষ। একেবারে জনমানব শূন্য জঙ্গল জায়। দু’চার দশ দিনের পথ হাঁটলেও কোনও গ্রাম গঞ্জ বা দোকান-পাট মিলবে না। বিষ কোথায় পাবে?
আলাদিন বলে, তুমি সেজে-গুজে তৈরি হও। সে ব্যবস্থা আমি করবো। শুধু কায়দা করে খাবারের সময় সরবত বা মদের পেয়ালায় মিশিয়ে দিতে হয়ে তোমাকে।
বুদুর গোসল করতে হামামে ঢোকে। আলাদিন হাতের আংটি ঘষে। দৈত্য এসে হাজির হয়। আলাদিন হুকুম করে, জহর ঠোঁটে লাগানো মাত্র ঢলে পড়বে এমন জহর চাই খানিকটা। এখুনি।
দৈত্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার আবির্ভূত হয়ে আলাদিনের হাতে একটা পুরিয়া তুলে দিয়ে বলে, এর মধ্যে যে বিষ আছে তাতে লক্ষ্য মানুষকে মারার পক্ষে যথেষ্ট।
হামাম থেকে ফিরে এলে আলাদিন বিষের পুরিয়াটা বুদুরের হাতে দিয়ে বলে, খুব সাবধান, ভুলেও কখনও না ধুয়ে হাত মুখে লাগাবে না। এর এক কণামাত্র বিষ বুড়োকে মারার পক্ষে যথেষ্ট। কায়দা করে যাদুকরটার পেয়ালায় মিশিয়ে দিতে হবে খানিকটা। কিন্তু কী করে দেবে? লোকটা যদি তোমার হাতে কিছু একটা আছে বুঝতে পেরে সন্দেহ করে?
বুদুর বলে, সে ভাবে হাতে আমি ধরবো না। তুমি বলছো, এতো মারাত্মক বিষ। কণামাত্র জিভে ঠেকলে অক্কা পাবে। তাহলে পুরিয়াটা খুলে, আমার ডান হাতের তর্জনীর ডগায় খানিকটা মাখিয়ে নিই। সরবতই খাক আর সরারই খাক, সে পেয়ালায় আঙ্গুলটা আলতো করে ডুবিয়ে দিতে অসুবিধে হবে না আমার।
আলাদিন বলে, আর, ধরো যদি বুড়োটা বলে, তবিয়ত ভালো নাই, আজ কিছু খাবো না —তখন?
বুদুর বলে, তাতেও ঘাবড়াবার কিছু নাই। আমি নিজে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে সোহাগের ঢং করবো। তাতে তো চনমন করে উঠবে বাঁদরটা! আমার মুখের কাছে এগিয়ে আনতে যাবে ওর ঠোঁট, ঝুলে-পড়া তোবড়ানো ফোকলা বদনখানা। তখনি আমি চোখের বান হেনে এর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলবো, আহা অত তাড়া কিসের, সারা রাতই পড়ে আছে, মালিক। আমি তো তোমারই। ব্যস কাজ হাসিল হয়ে যাবে।
আলাদিন বুদুরকে বুকে টেনে উল্লাসে ফেটে পড়ে, সাবাস।
যথাসময়ে বুড়ো যাদুকর প্রাসাদে ফিরে আসে। খবর পেয়ে বুদুর আলাদিনকে তার সাজ-পোশাকের আলমারীতে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখে। পরে আশ্চর্য কুশলতায় বুড়ো এবং বুদুর দুজনে এক সঙ্গে খানাপিনার টেবিলে গিয়ে বসে। এর একটু পরে সরবতের পেয়ালায় চুমুক দিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বুড়োটা।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে আলমারী খুলে আলাদিনকে বাইরে বের করে বুদুর।
—খতম হয়ে গেছে।
আলাদিন বুড়োর কাছে গিয়ে কামিজের তলায় হাত ঢুকিয়ে তলপেট থেকে চিরাগটা বের করে নেয়। অল্প একটু ঘষতেই চিরাগ-দৈত্য আফ্রিদি এসে হাজির হয়ে সালাম ঠুকে বলে, ত্রিভুবনের অধিপতি আমি, আমার অসাধ্য কিছুই নাই। একমাত্র এই চিরাগ ছাড়া আমি কারো দাসত্ব করি না। চিরাগ এখন আপনার হাতে। সুতরাং আপনিই আমার একমাত্র প্রভু। এখন আদেশ করুন, মালিক, কী করতে হবে।
আলাদিন বলে, শোনো চিরাগের বান্দা। প্রাসাদ যেমন আছে তেমনি অবস্থায় আলতোভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে আগে যেখানে ছিলো সেখানে বসিয়ে দাও। দেখো, আমাদের বিশেষ করে শাহজাদী বুদুরের যেন কোনও ঝাকানী না লাগে।
জো হুকুম, বলে আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরক্ষণেই আলাদিন বুঝতে পারলো, গোটা প্রাসাদটা মহা শূন্যে উঠে যাচ্ছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলো তার স্বদেশে চীনের সেই সুলতান-প্রাসাদের পাশে এসে গেছে তারা।
তখন নিশুতি রাত। কেউ কিছু টের পেলো না। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই সুলতান তার শয়নকক্ষের জানালা দিয়ে দেখলেন, আলাদিনের সেই প্রাসাদটা আগে যেখানে যেমনটি ছিল ঠিক সেখানে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না। অভূতপূর্ব বিস্ময়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজের বাদশাহী কায়দা কে ভুলে রাত্রিবাস পরেই খালি পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
সুলতানকে স্বাগত জানাতে আলাদিন সদরে বেরিয়ে এলো।
—একি আপনি এভাবে না এসে শমন পাঠালেই তো পারতেন, জাঁহাপনা। বান্দা হাজির হতো।
সুলতান তখন কন্যা সন্দর্শনে উন্মুখ, আলাদিনের কোনও কথাই তার কানে ঢুকলো না বোধ হয়। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, শাহজাদী বুদুর কোথায়?
আলাদিন বলে, আপনি ভিতরে আসুন। সে এখনও ঘুমুচ্ছে। আমি ডেকে দিচ্ছি, ভিতরে আসুন আপনি।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো একাত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
কন্যাকে ফিরে পেয়ে সুলতান আনন্দে কেঁদে ফেলেন।বুদুর বলে, আব্বাজান তোমার একি। চেহারা হয়েছে?
সুলতান কন্যাকে আদর করতে করতে বলেন, তোর শোকে জানে যে বেঁচে আছি এই ঢের মা। তুই আমার একমাত্র সন্তান, চোখের মণি, তোর অদর্শন কী আমি সইতে পারি?কী হয়েছিলো তোর, কী করে কে তোকে এই প্রাসাদ সুদ্ধ কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো আমি তো ভাবতেই পারছি না, মা।
বুদুর তখন সেই শয়তান মূর যাদুকরের সব কাহিনী সুলতানকে খুলে বললো।
—জান আব্বাজান, আমি তো দিন রাত কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছিলাম, বুড়ো শয়তানটা বুঝি আর আমাকে আস্ত রাখবে না। কিন্তু ওপরে আল্লাহ আছেন, এতো পাপ অনাচার তিনি সহ্য করবেন কেন? তাই দেখ, তার সমুচিত সাজা সে পেলো।
সুলতান বুঝতে পারলেন, আলাদিন নির্দোষ। জামাইকে বুকে টেনে নিয়ে তিনি আদর করে বললেন, সন্তান-স্নেহে অন্ধ হয়ে সবকিছু না জেনে তোমাকে অনেক কষ্ট লাঞ্ছনা দিয়েছি বাবা। কিছু মনে রেখ না। তুমি তো জান বাবা, আমি আমার সলনিয়ত খোয়তে রাজি আছি, কিন্তু আমার প্রাণাধিক বুদুরের কেশাগ্র ছুঁতে দিতে দেবো না কোনও শয়তানকে।
আলাদিন বলে, আমি আপনার সে-সময়ে মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলাম আব্বাজান। যাক, যা হয়ে গেছে তা আর মনে পুষে রেখে লাভ নাই। আপনার কন্যাকে ফিরে পেয়ে আবার আপনি আনন্দমুখর হতে পেরেছেন এই আমার পরম ভাগ্য।
আলাদিন তার নফরদের বললো, ঐ বুড়ো মুরটার লাশটা নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আয়। শিয়াল শকুনে ছিড়ে ছিড়ে খাক-এর দেহের মাংস। সেই হবে তার যোগ্য পুরস্কার।
সুলতানের প্রাসাদে ও সারা শহরে উৎসবের বাদ্যি বেজে উঠলো। সুলতান ঘোষণা করলেন, শাহজাদীর ফিরে আসার আনন্দে ফাটকের কয়েদীদের ছেড়ে দেওয়া হলো। যে যেখানে আছ, আনন্দকর, নাচো গাও, পিও জিও। দলে দলে হাজার হাজার মানুষজন এসে প্রাসাদে পাত পেড়ে পরিতৃপ্তি করে খেয়ে যেতে লাগলো। সুলতান কোষাগার উন্মুক্ত করে দিলেন। দু’হাতে ধররত্ন বিতরণ করা হতে লাগলো।
এরপর আলাদিন বুদুরকে নিয়ে অপর্যাপ্ত সুখ-সম্ভোগের মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। দিনে দিনে মাস অতিক্রান্ত হয়। মাসে মাসে বছরও ঘুরে আসে। কিন্তু বুদুর সেই পরম সংবাদটি আর শোনাতে পারে না কাউকে। বিবাহিত জীবনের শ্রেষ্ঠ ফল সন্তান। সেই সন্তানের আগমন-বার্তা এসে পৌঁছলো না দেখে সুলতান বেগম এবং অপরাপর আত্মীয়-পরিজন সকলেই উদ্বিগ্ন হলেন। তবে কি শাহজাদী বুদুর বন্ধ্যা? একটি সন্তানও এলো না তার গর্ভে।
বুদুর বিষণ্ণ বদনে একা একা বসে ভাবে। একটি সন্তানই যদি কোলে না এলো তবে এ জীবনে কীসের সুখ, কীসের আনন্দ?
চেনা জানা যে যা বলে পালন করতে কসুর করে না বুদুর। কত জলপড়া ঝাড় ফুঁক টোটকা তো করা হলো, কিন্তু ফল নৈব নৈব চ।
আলাদিন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়, অত ভাবো কেন, সোনা, আমরা কী এখনই বুড়ো হয়ে গেছি। অঢেল যৌবন তো পড়ে রয়েছে! আজ হয়নি, কাল হবে। ও নিয়ে অত মন খারাপ করতে নাই।
আমরা কোনো পাপ করিনি, দেখো, আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে চাইবেন। কিন্তু আলাদিনের এই সান্ত্বনা বাক্যে বুদুরের খাঁ খাঁ করা শূন্য হৃদয় পূর্ণ হতে পারে না। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস কোন রকমে চেপেবলতে পারে না না, ওসব আমি ভাবি না। তুমি আছ আমি আছি আমার আর ভাবাটা কী? তুমিই তো আমার সকল চিত্ত জুড়ে রয়েছ, সোনা।
একটু থেমে আলাদিনের বুকে মাথা রেখে বুদুর বলে, একটা কথা বলবো, জান? আলাদিন অবাক হয়। এমন কী কথা, যার জন্য বুদুর এতো দ্বিধা সঙ্কোচে ভণিতা করছে!
-কী ব্যাপার, অমন কিন্তু কিন্তু করছো কেন, চটপট বলেই ফেলো না?
বুদুর বলে, শহরে এক গুণী সন্ত বৃদ্ধা এসেছেন। শুনলাম তিনি নাকি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। যে-সব মেয়েদের সন্তান হয় না, তাকে দর্শন করলেই নাকি গর্ভবতী হয়। তুমি এ সবে মত দেবে কিনা জানি না, তবে একবার চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়।
আলাদিন হো হো করে হেসে ওঠে, ও, তাই বলো। তা—আমার অমত হবে কেন। বেশ তাকে এখুনি ডেকে পাঠাচ্ছি।
চারজন খোজা নফরকে ডেকে পাঠিয়ে দিলো সে বৃদ্ধাকে নিয়ে আসার জন্য।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই সন্ত বৃদ্ধা আলাদিনের প্রাসাদে এসে পৌঁছলো। সর্বাঙ্গ মোটা কাপড়ের বোরখায় ঢাকা। গলায় দোদুল্যমান আজানুলম্বিত বহু বিচিত্র এক মালা। সারা অঙ্গে নানারকম পাথর, ধাতুর চাকতি, পশুপাখির হাড্ডি এবং অনেক রকমের গাছের মূল ইত্যাদি দিয়ে বানানো এক ভয়ঙ্কর বস্তু। হাতে একখানা আঁকাবাঁকা লাঠি। এক হাতে একটা পিতলের ধূপদানী।
খোজারা ওকে হারেমে শাহজাদী বুদুরের সামনে হাজির করলো। বৃদ্ধা আশীর্বাদের ভঙ্গী করে বুদুরকে দোয়া জানালো। বুদুর ওকে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করে বললো, শুনেছি, আপনি সাক্ষাৎ আল্লাহর পয়গম্বর। আপনার অসাধ্য নাকি কিছুই নাই। আপনি যখন মেহেরবানী করে আমার গরীবখানায় চরণ ধুলো দিয়েছেন তবে একটুখানি করুণা করে আমার ক্ষুদ্র একটি মনস্কামনা পূর্ণ করুন, এই আমার ইচ্ছা।
বৃদ্ধা বলে, আমি বুঝেছি বেটা, তোমার মনের বাসনা আমি জ্ঞাত হয়েছি। ঠিক আছে, যা বলছি মন দিয়ে শোনো। যদি ঠিক ঠিক করতে পার, তবে নির্ঘাৎ পুত্রলাভ হবে তোমার।
বুদুর চমকে ওঠে, পুত্র লাভ! আনন্দে শিহরিত হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গ।
-বলুন মা, যত দুঃসাধ্যই হোক, আমি তা করবোই। বোরখাবেশি সন্ত বলে, বলবো, অবশ্যই বলবো, মা। কিন্তু সে বস্তু কী তুমি সংগ্রহ করতে পারবে?
বুদুরের আর বাঁধ মানে না। বৃদ্ধার পায়ের কাছে সে হাঁটু গেড়ে বসে পা-দুটো চেপে বলে, খুব পারবো, আপনি আদেশ করে দেখুন। আমার স্বামী আলাদিন, এ দুনিয়ার অসাধ্য কাজ তার কিছুই নাই।
সন্ত বলে, ঠিক আছে তাকে বললো, সে যেন একটি রকপাখির ডিম সংগ্রহ করে এনে তোমার শোবার ঘরের মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখে। বাস আর কিছুই করতে হবে না। দশমাস দশদিন পরে দেখবে, তুমি পুত্রবতী হয়েছে। এই রকপাখির ডিম কোথায় পাওয়া যায় তাও তোমাকে বলে দিচ্ছি। ককেসাস পর্বতমালার নাম শুনেছ তো, সেই পর্বতের অত্যুচ্চ শিখরে রকরা ডিম পাড়ে। সেখান থেকে সে-ডিম বহন করে নামিয়ে আনা সহজ কর্ম নয়।
বুদুর বলে, ও-নিয়ে আপনি কিছু ভাববেন না, আমার স্বামীর কাছে কোনও কাজই কঠিন নয়। অনায়াসে সে এনে দিতে পারবে। এ ছাড়া আর যদি কোনও আজ্ঞা থাকে করুন, মা, আমি পুত্রলাভের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
বৃদ্ধা বলে, মা আর কিছুর প্রয়োজন নাই। সন্তান লাভের পক্ষে এই-ই যথেষ্ট। এই ডিমটার গুণে তোমার মাতৃত্বের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে জেগে উঠবে। এখন সে মরার মতো অসাড় হয়ে আছে তোমার দেহের ভিতর। ঠিক আছে বেটা, আজ তাহলে আমি আসি। আমার জন্যে আরও অনেকে এসে অপেক্ষা করছে হয়তো। সকলের দুঃখের লাঘব করাই তো আমার এক মস্ত ধর্ম।
বুদুর নানা ধনরত্নে বৃদ্ধার ঝুলি পূর্ণ করে দিলো। প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে সে বললো, দেখি, যদি সময় পাই, কাল আর একবার আসবো তোমার কাছে। আজ রাতে আল্লাহর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ হবে। তখন তোমার কথা বলবো তাকে। যদি তিনি প্রসন্ন হয়ে কোনও বাণী দেন আমি তোমাকে জানিয়ে যাব, মা।
বৃদ্ধা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলাদিন বুদুর্বের কক্ষে যা প্রবেশ করে।
-কী, কী বলে গেলেন উনি? বুদুর বিষণ্ণ মনে বলে, সে প্রায় অসাধ্য ব্যাপার।
—আরে বলই না, আমি আলাদিন, ত্রিভুবনে অসাধ্য বলে কোন কিছু নাই আমার কাছে। বলো তো পুরো হিমালয় পাহাড়টিকে তুলে অন্য কোথাও বসিয়ে দিতে পারি। এর চেয়ে বড়ো কঠিন কী কাজ থাকতে পারে।
বুদুরের মুখে হাসি ফোটে, না অত বড় কাজ নয়, তবে খুব সহজও নয়। ককেসাস পাহাড়ের মাথায় রকপাখিরা ডিম পাড়ে। সেই ডিম একটা আমার চাই।
–কেন কী হবে তা দিয়ে।
—সন্ত বলে গেলো আমার শোবার ঘরের মাঝখানে একটা রকপাখির ডিম ঝুলিয়ে রাখলে আমি পুত্র-সন্তানের মা হবে।
বহুত আচ্ছা, আলাদিন বলে, এ আর কী কঠিন কাজ। দাঁড়াও এখুনি আফ্রিদি দৈত্যকে ফরমাশ করছি, চোখের পলকে সে এনে হাজির করবে। তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমি আসছি।
রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
সাতশো তিয়াত্তরতম রজনী :
আবার সে বলতে থাকে?
এই বলে আলাদিন বুদুরকে ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যায়! চিরাগবাতিটা হাতে নিয়ে আলতোভাবে ঘষতেই আফ্রিদি এসে হাজির হয়। যথাবিহিত কুর্নিশ করে আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। আলাদিন আফ্রিদিকে বলে, জান বান্দা আজ এক কাণ্ড করেছে আমার বিবি। এতকাল আমাদের শাদী হয়েছে। কিন্তু বালবাচ্চা কিছু হয় নি বলে শাহজাদীর খুব মন খারাপ। তাই সে আজ এক বৃদ্ধা সন্তের সঙ্গে দেখা করবে বলে আমার কাছে বায়না ধরেছিলো। আমি সেই ফকির সন্তকে প্রাসাদে এনে তার সামনে হাজির করেছিলাম। সে ফরমাশ করে গেছে আমাদের শোবার ঘরের মাঝখানে একটি রকপাকির ডিম ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সে ডিম নাকি ককেসাস পর্বত-শিখরে পাওয়া যায়। তা বাপু, একটু কষ্ট করে একটা ডিম এনে দাও তুমি।
আলাদিনের মুখের কথা শেষ হতে না হতে বিকট এক আর্তনাদ করে ওঠে আফ্রিদি দৈত্য। আলাদিন চোখ তুলে তার ভয়াল ভয়ঙ্কর মুখাকৃতি দেখে শিউরে ওঠে। দু’হাতে ঢেকে ফেলে নিজের মুখ। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না দৈত্যটা এতকাল বাদে আজ হঠাৎ এমন চণ্ডাল মূর্তি ধারণ করলো কেন। উফ! কী ভীষণ তার মুখব্যাদন। জ্বলন্ত ভাটার মতো তার গোলাকৃতি চোখ দুটো দেখে হৃদপিণ্ডের কাঁপুনি ধরে গেছে আলাদিনের। সাহস করে আর তাকাতে পারে না। হাতে মুখখানা ঢেকে রেখেই ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, কী হলো চিরাগের বান্দা, এতো গোসা হলো কেন তোমার? আমি কী তোমাকে মন্দ বলেছি কিছু?
এ কি কথা বলেছেন, মালিক! এর চেয়ে খারাপ কথা আর কী হতে পারে বলুন। আপনি আমাকে দু’চার ঘা মারতে চাইতেন, পিঠ পেতে দিতাম, কিন্তু এ কি সাংঘাতিক কথা আপনি বললেন। নেহাত আপনার সঙ্গে আমার এতদিনে অনেকটা মায়া-মমতা গড়ে উঠেছে। অন্য মালিকদের মতো আপনি কখনও মুখ গোমড়া করে ফাই-ফরমাশ করেন না। আমি বান্দা, নফর। কিন্তু আপনার কাছ থেকে সব সময়ই আমি বড়ো ভালো ব্যবহার পেয়েছি। সেই কারণে আপনার সম্বন্ধে আমার একটা দুর্বলতাও জন্মে উঠেছে। তাই আপনি রক্ষা পেয়ে গেলেন আজ। তা না হলে যে কথা আপনি উচ্চারণ করেছেন, তা শোনার পর আপনাকে টুটি টিপে আমি মেরে ফেলতাম।
আলাদিন আতঙ্কিত হয়ে বলে, কিন্তু বিশ্বাস কর বান্দা, এখনও আমি বুঝতে পারছি না, আমি খারাপ কী বলেছি।
আফ্রিদি খানিকটা শান্ত হয়ে বলে, তবে শুনুন মালিক, বুঝতে পারছি, সজ্ঞানে আপনি ও কথাটা বলেননি। সেই বৃদ্ধাটা আপনার অনিষ্ট করার জন্য আপনার বিবিকে ওই সর্বনাশা কুপরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলো। আপনি হয়তো জানেন না, আমাদের জীন দৈত্যদের সবার উপাস্য ঈশ্বর হচ্ছে পরমপিতা রক।
এই বলে আফ্রিদি দুই কাঁধে, কর্ণমূলে এবং নাকে হাত রেখে শ্রদ্ধা জানিয়ে বললো, আপনার হাতে যে চিরাগ সে আমার প্রভু, মালিক। কিন্তু রক আমাদের সমগ্র জীন দৈত্যকুলের ঈশ্বর। তার চেয়ে বড়ো আর কেউ নাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। সুতরাং তার ডিম আপনি আমাকে চুরি করে আনতে বলে কী সাংঘাতিক গর্হিত কাজ করেছেন, একবার ভেবে দেখুন।
আলাদিন বলে, বিশ্বাস কর বান্দা, তোমাদের ঈশ্বরকে একবিন্দু খাটো করার অভিপ্রায় নিয়ে একথা আমি বলিনি।
আফ্রিদি বলে, আমি বুঝতে পেরেছি মালিক, আপনি এক দুষ্ট দুরাচারের পাল্লায় পড়েছেন। আপনার বা আপনার বিবির কোন গুনাহ নাই, মালিক।
আলাদিন বলে, আচ্ছা বান্দা বলো দেখি, ওই বৃদ্ধার অন্তরে এমন অনিষ্ট করার প্রবৃত্তি হলো কেন? আমি তো তার কোনও ক্ষতি করিনি।
—কে বললো আপনি তার ক্ষতি করেন নি, মালিক! তার বড় ভাই সেই বুড়ো যাদুকর মূরকে আপনারা বিষ-প্রয়োগে হত্যা করেছেন। এ তারই প্রতিহিংসা। বৃদ্ধা সন্তের বেশে যে এসেছিলো আসলে সে কোন নারী নয়। সেই মূর যাদুকরের সহোদর ভাই। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সে এ শহরে এসেছে। নিজের কোনও বিদ্যা জানা নেই, যা দিয়ে সে আপনাকে ঘায়েল করতে পারে। তাই চক্রান্ত করে কলা-কৌশলে আমার হাতে আপনাকে নিধন করাতে চেয়েছিলো। কারণ সে জানতো, রকপাখীর ডিমের কথা শোনামাত্র আমি আর পলকমাত্র অপেক্ষা করবো না। আপনার ঘাড় মটকে দেব। কিন্তু লোকটার চাল ঠিকমতো খাটলো না। আমি সব বুঝতে পারলাম। তবে এও ঠিক অন্য সব মালিকের মতো আপনি যদি চিরাগ ঘষেই শুধুমাত্র বলতেন, একটা রকপাখির ডিম নিয়ে এসো’ তাহলে মৃত্যু আপনার অবধারিত ছিলো। কিন্তু, আমি প্রতিক্ষেত্রেই দেখেছি, আমাকে দিয়ে কোনও একটা কাজ করাবার জন্য আপনি বিস্তারিত ভূমিকা করে কার্য কারণ খুলে বলেন। এতে অবশ্য আমি অনেক সময় মনে মনে ঈষৎ বিরক্তি বোধ করেছি, কিন্তু আজ শুধু সেই কারণেই আপনার প্রাণ রক্ষা হয়ে গেলো, মালিক। না হলে আপনার লাসটা পড়ে থাকতে এই মেঝেয়।
আলাদিন কেঁপে ওঠে। যাক, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
আফ্রিদি বলে, আমাদের শাস্ত্রের একটা উপদেশ আছে, ধাড়ি কুত্তার চেয়ে ছোট কুত্তাগুলো আরও বেশি পাজি হয়। বুড়ো মুর যাদুকরের চেয়ে তার এই ছোটো ভাইটা আরও মারাত্মক শয়তান। সে আপনাকে নিধন করতে ক্ষেপে উঠেছে। একটু সাবধানে থাকবেন, মালিক। এই আমার নিবেদন। যাই হোক, আমি আপনাকে সর্বদা পাহারা দিয়ে রাখবো, আপনার কোনও চিন্তা নাই।
এই বলে আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো।
বুদুরের কাছে ফিরে এলো আলাদিন। বললো, শোনো, মণি, আমি নিজে কানে ঐ বৃদ্ধার কথা শুনতে চাই। কী ভাবে কী করতে হবে, নিজে কানে শোনার পর আমি তোমাকে ঐ রকপাখির ডিম আনিয়ে দেব।
বুদুর বলে বেশ তো, কাল সকালেই সে আবার আসবে এখানে। তুমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানে সব শুনে নিও।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সাতশো চুয়াত্তরতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
পরদিন সকালে মুর যাদুকরের কনিষ্ঠ সহোদর বৃদ্ধা সন্তের ছদ্মবেশে আবার এসে হাজির হয় আলাদিনের প্রাসাদে। খোজারা সমাদর করে নিয়ে যায় তাকে শাহজাদী বুদুরের কক্ষে।
আলাদিন আগে থেকেই পর্দার আড়ালে অপেক্ষমান ছিলো। তার এক হাতে দড়ির ফঁস, অন্য হাতে রজত শুভ্র চকচকে ধারালো তলোয়ার। ছদ্মবেশী বুদুরের সামনে এসে দাঁড়াতেই আলাদিন পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষিপ্র হাতে দড়ির ফাঁস পরিয়ে দেয় তার গলায়।
বুদুর হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে, একি! একি করছো তুমি? কিন্তু আলাদিন ততক্ষণে তলোয়ারের এক কোপে লোকটার ধর মুণ্ডু আলাদা করে ফেলেছে।
বুদুরের চোখে ক্রোধের বহ্নি, একি করলে তুমি? এ যে মহাপাতকের কাজ হলো। এ পাপ আমরা রাখবো কোথায়?
আলাদিন হাসতে হাসতে বললে, এই লোকটার আসল পরিচয় তুমি কিছুই জান না, সোনা। এই দেখ—
আলাদিন তলোয়ারের ডগা দিয়ে বোরখাখানা চিরে ফালা ফালা করে সরিয়ে দিলো!
বুদুর তো হাঁ হয়ে গেছে। এমন অবাক কাণ্ড কেউ ভাবতে পারে?
আলাদিন বলে, লোকটা যে আসলে কোনও বৃদ্ধা সন্ত ফকির নয়, সে তো দেখতে পাচ্ছো! এর প্রকৃত পরিচয় কী জান? ঐ ঘাটের মড়া শয়তান যাদুকর মুরটার এ ছোট ভাই। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সে এ শহরে এসে আস্তানা গেড়েছিলো। ওর একটাই মতলব ছিলো, আমাকে এবং তোমাকে নিহত করা। কাজ প্রায় হাসিল করেও ফেলেছিলো, কিন্তু উপরে আল্লাহ অসীম করুণাময়। তাঁর দরবারে আমাদের কোনও অপরাধ নাই। তাই সোনা, তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন।
বুদুর তখনও থর থর করে কাঁপছে। আলাদিনকে জড়িয়ে ধরে সে বলে আমি তো বুঝতে পারিনি, কিন্তু তুমি কী করে জানতে পারলে লোকটার এই অভিসন্ধি।
আলাদিন বললো, আমার চিরাগের বান্দা আফ্রিদি দৈত্যই আমাকে সব বলেছে, মণি। সেই আমাকে জানিয়েছে লোকটা মূর যাদুকরের সহোদর ভাই। প্রতিহিংসার আগুনে সে জ্বলছে। আমায় মারার ফন্দী এঁটে সে এ প্রাসাদে বৃদ্ধা ফকিরের ছদ্মবেশে প্রবেশ করেছিলো।
তারপর আলাদিন আফ্রিদি দৈত্যের সব বৃত্তান্ত খুলে বললো বুদুরকে। বুদুর বললো, দৈত্যটা খুবই ভালো, তাই আমরা রক্ষা পেলাম, না?
আলাদিন বলে, সবই খোদাতালার খিদমদ। তিনি রাখলে কী কেউ মারতে পারে?
এরপর আলাদিন আর বুদুর জীবনের ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রেমের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখ-সম্ভোগের মধ্যে বহু বৎসর অতিবাহিত করে গিয়েছিলো এবং এও জেনে আপনারা খুশি হবেন, শাহজাদী বুদুর আদৌ বন্ধ্যা নারী ছিলো না। একাধিক সন্তানের আদর্শ জননী হওয়ার পরম সৌভাগ্য তার জীবনেও ঘটেছিল।
শাহরাজাদ বললো, এই হলো আলাদিন এবং তার আশ্চর্য যাদুচিরাগের কাহিনী।
সুলতান শারিয়ার বললো, খুব সুন্দর, বড় চমৎকার। এমন কাহিনী বহুকাল মনে থাকবে।