৩.১৬ মুসাইলামার হাত কাটা

॥ ষোল ॥

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এত জলদি পরাজয় স্বীকার করার মত লোক ছিলেন না। নষ্ট করার মত একটি মুহূর্তও তার ছিল না। তিনি সেনাপতি এবং কমান্ডারদের সমবেত করে পিছপা হওয়ার উপর চরম শরম দেন। ইত্যবসরে এক অশ্বারোহী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে সেনাপতিদের আলোচনা স্থলে এসে থামে। তিনি হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ভাই হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন।

“খোদার কসম ইবনে ওলীদ!” হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে—“আমি মুসাইলামার ডান হাত কেটে দিয়েছি।… আমি নাহারুর রিযালকে নিজ হাতে হত্যা করেছি। আমাদের বিজয়ের উপর এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক জ্বলন্ত ইশারা বৈ নয়।”

নাহারুর রিযালের মৃত্যু মুসাইলামার জন্য সাধারণ চোট ছিল না। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সে মুসাইলামার প্রধান উপদেষ্টা, একান্ত বিশ্বাসভাজন এবং সঠিক অর্থে তার ডানহস্ত ছিল। এ তাজা খবরে হযরত খালিদ এবং তার অন্যান্য সেনাপতির চেহারায় নতুন আলোর ঝলক দেখা দেয়। তাদের রক্ত নয়া প্রেরণায় টগবগ করে ওঠে।

“তোমরা জান, এটা কোন্ পাপের সাজা?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাগতস্বরে বলেন—“আমি সংবাদ পেয়েছি, আমাদের সৈন্যদের অন্তরে অহংকার চলে এসেছিল। লড়াইয়ের পূর্বেই আমাদের মুজাহিদ সাথীরা বলেছিল, বাহাদুরী পরীক্ষায় আনসার আর বেদুঈনরা মিলে তাদের মোকাবিলা করতে পারবে না। আনসাররা দাবী করে যে, মুসলমানদের মধ্যে তাদের মত বাহাদুর কেউ নয়। বেদুঈনরাও কম যায় না। তারা বলে, মক্কা এবং মদীনার লোক এখনও জানেই না যে, যুদ্ধ কাকে বলে।…তোমাদের জানা আছে, আমাদের মধ্যে মক্কার মুহাজিররাও আছেন, মদীনার আনসারও আছেন এবং আশে-পাশের অঞ্চল হতে আগত বিপুল সংখ্যক বেদুঈনরাও আছে। তারা পরস্পর একে অপরের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল।”

“এর প্রতিষেধক আমাদের কাছে নেই”—এক সেনাপতি বলে।

“আমার কাছে এর প্রতিষেধক আছে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আমরা তিন ধরনের সৈন্যদের সবাইকে একসাথে রেখেছি। বেশী সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। তোমরা এখনই যাও এবং তিন শ্রেণীর লোকদের পৃথক করে ফেল।”

মুহূর্তে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশ পালিত হয়। মুসলমানরা এখন তিন কাতারে বিভক্ত। (১) মুহাজির (২) আনসার (৩) বেদুঈন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান।

“আল্লাহর সৈনিকগণ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চকণ্ঠে বলেন—“আমরা রণাঙ্গনে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে শত্রুদের জন্য হাসি আর বিদ্রূপের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। তোমাদের মধ্যে কে বীরত্বের সাথে লড়েছে আর কে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে—কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে?…মুহাজির? আনসার? বেদুঈন? এখন আমি তোমাদের এ জন্য পৃথক করেছি যে, এখনই আমরা শত্রুর উপর জওয়াবী হামলা চালাব। এখন দেখব, কে কত বীরত্বের পরিচয় দিতে পারে। বীরত্ব আর কাপুরুষতা সমালোচনার দ্বারা নির্ণীত হয় না; রণাঙ্গনে কিছু করে দেখাও। কিন্তু সাবধান! ঐক্য যেন হাতছাড়া না হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের শিক্ষা দিয়েছেন তা ভুলে যেও না। তোমাদের কোন বাহিনী শত্রুর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে থাকলে আরেক বাহিনী তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাও। আমাদেরকে অবশ্যই প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে, মুসাইলামা ভণ্ড, তার নবুওয়াতের দাবী মিথ্যা বৈ নয়। আমরা পরাজিত হলে তার মিথ্যা নবুওয়াত আমাদের উপর চেপে বসবে। আমরা মুসাইলামার গোলাম এবং আমাদের স্ত্রীরা মুরতাদদের বাঁদীতে পরিণত হবে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তেজোদ্দীপ্ত ভাষণ ঐ তীরের স্থান দখল করে যা টার্গেটে গিয়ে বিদ্ধ হয়। সৈন্যদের মাঝে নয়া প্রেরণা এবং নব শক্তি সৃষ্টি হয়। তাদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। রক্ত পিপাসু হায়েনার ন্যায় তাদের চোখ প্রতিশোধ গ্রহণের জ্বলজ্বল করে ওঠে। শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা অস্থির হয়ে পড়ে। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই বিজলির গতিতে ছুটে চলে মুজাহিদ বাহিনী মুরতাদ বাহিনীর মুণ্ডপাত করতে।

ইতোমধ্যে মুসাইলামাও স্বীয় বাহিনীকে পুনরায় আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে। মুজাহিদ বাহিনী রণাঙ্গনে পৌঁছতেই হযরত সাবেত বিন কায়েস নামক এক আনসার সর্দার ঘোড়া দ্রুতগতিতে ছুটিয়ে সৈন্যদের একেবারে সামনে চলে আসেন।

প্রিয় মদীনাবাসী!” তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেন—“তোমরা ইতোমধ্যে এক লজ্জাষ্কর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছ।” হযরত সাবেত বিন কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুদের দিকে ইশারা করে বলেন—“হে আমার প্রভু! এরা যার ইবাদত করে আমি তার উপর অভিসম্পাত দিচ্ছি।” অতঃপর তিনি মুজাহিদ বাহিনীর দিকে ফিরে বলেন—“যে মন্দ দৃষ্টান্ত আমার এই বাহিনী কায়েম করেছে আমি তার উপরও অভিশাপ দিচ্ছি।”

এতটুকু বলেই হযরত সাবেত বিন কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু খাঁপ থেকে তরবারী উন্মুক্ত করেন এবং ঘোড়ার গতি শত্রুদের দিকে করে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। তাঁর শেষ বাক্য এই ছিল—“অবশ্যই আমার তলোয়ার শত্রুদের মৃত্যু উপহার দিবে এবং তোমাদেরকে হিম্মত ও দৃঢ়তার অনুপম দৃষ্টান্ত দেখাবে।”

হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়া ছুটিয়ে দিতেই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। ঐতিহাসিকরা লেখেন, হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তরবারী এমন ক্ষিপ্র ও দক্ষতার সাথে চলতে থাকে যে, যেই তার সামনে এসেছে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। সম্ভবত তার শরীরের এমন কোন স্থান ছিল না যেখানে তলোয়ার বা বর্শার আঘাত লাগেনি। দুশমনের সারি কচুকাটা কাটতে কাটতে তিনি অনেক গভীরে গিয়ে ঢলে পড়েন এবং শহীদ হয়ে যান। নিজ বাহিনীর জন্য তিনি বাস্তবিকই অমিত সাহস এবং পাহাড়সম দৃঢ়তার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত পেশ করে যান।

মুহাম্মাদ হুসাইন হাইকল কতিপয় ঐতিহাসিকের বরাত দিয়ে লিখেছেন, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী দ্বিতীয়বার এই কসম করে যুদ্ধে নামে যে, এবার ময়দান থেকে তাদের লাশ আসবে। জীবিত ফিরবে না। জনৈক ঐতিহাসিক লেখেন, তারা এবার এ শপথে উজ্জিবীত হন যে, হাতের তলোয়ার ভেঙ্গে গেলে, তুণীরের তীর শেষ হয়ে গেলে প্রয়োজনে দাঁত দিয়ে লড়ে যাব; তবুও ময়দান হতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করব না।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নতুন এক দৃষ্টান্ত কায়েম করেন। তিনি কতক জানবাজ মুজাহিদ বাছাই করে নিজের সাথে রাখেন। যাতে যুদ্ধ যেখানেই বেগতিক আকার ধারণ করে, সেখানে এই রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে লাফিয়ে পড়া যায়। তিনি এই বাছাই করা জানবাজদের বলেন—“তোমরা আমার পিছে পিছে থাকবে। তিনি নিজে সম্মুখে থাকতে চাইতেন।

দ্বিতীয়বার যুদ্ধ শুরু হলে এক নতুন বিপদ এসে পতিত হয়। বিরাট ঘূর্ণিঝড় ওঠে। যা মুজাহিদদের দিকেই ধেয়ে আসে। কোন কোন ঐতিহাসিকের অভিমত, এটা মরুঝড় ছিল না; বরং তীব্র উৎক্ষিপ্ত ধুলো ছিল মাত্র। রণাঙ্গনে উভয় পক্ষের অসংখ্যক ঘোড়া আর পদাতিক বাহিনীর বিচরণে সৃষ্ট ধুলোর পরিবেশটা ভূপৃষ্ট হতে উৎক্ষিপ্ত ধুলোর মত ছিল। প্রচণ্ড এ ধুলোর গতি মুজাহিদদের দিকে থাকায় উড়ন্ত ধুলা-বালি মুসলমানদের চোখে গিয়ে পড়ছিল। বদরে কাফেরদের সাথে এমন ঘটনাই ঘটেছিল। ধুলোর তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

কতক মুজাহিদ হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে জানতে চান যে, তারা এ মুহূর্তে কি করবে।

“খোদার কসম!” হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গর্জনের স্বরে বলেন—“আল্লাহর কাছে দু’আ করি, শত্রুকে পরাস্ত করা পর্যন্ত তিনি যেন আমাকে জীবিত রাখেন।…প্রিয় মক্কা ও মদীনাবাসী! ধুলিঝড়ে ভীত হয়ো না। মাথা একটু নীচু রাখ। মাটি এবং বালু তোমাদের চোখে পড়বে না। যে কোন পরিস্থিতিতে পিছু হটবে না। অসীম সাহস রাখবে। দৃঢ়তা হস্তচ্যুত হতে দিবে না। ধুলিঝড় তোমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।”

হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতি ছিলেন। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর সামনে এই দৃষ্টান্ত রেখে যান যে, তলোয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার অধীনস্ত বাহিনীও তার অনুসরণে পিছে পিছে যায়। হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বীর-বিক্রমে তলোয়ার চালাতে চালাতে সামনে এগিয়ে যান এবং শাহাদাত বরণ করেন।

আরেক সেনাপতি আবু হুজায়ফাও একই দৃষ্টান্ত কায়েম করেন। তিনি এই নারাধ্বনি দিতে দিতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন—“হে কুরআনের ধারক-বাহক। স্বীয় কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালনের মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের ইজ্জত রক্ষা কর।” তিনিও বিপুল বিক্রমে সৈন্যের সারি ভেদ করে সামনে এগিয়ে চলেন। ক্রমে আহত হতে থাকেন এবং এক সময় শহীদ হয়ে যান।

এ সকল পদস্থ সেনাপতি নিজ জীবন বিসর্জন দিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর দৃঢ়তায় প্রাণ সঞ্চার করেন। তারা হঠাৎ খোদায়ী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে এবং বিদ্যুৎগতিতে শত্রুর শাহরগ গিয়ে স্পর্শ করে। মুহুর্মুহু তীব্র আক্রমণ সত্ত্বেও মুসাইলামার সৈন্যরা যেই সেই রয়ে যায়। কোন কিছুই তাদের বিচলিত কিংবা কোণঠাসা করতে পারে না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পুরো রণাঙ্গনের উপর হাল্কা জরীপ চালান। এটা এমন ঘোরতর যুদ্ধ ছিল যেখানে কোন চালের আদৌ সুযোগ ছিল না। এটা ছিল রীতিমত সম্মুখযুদ্ধ। ব্যক্তিগত বাহুবল এবং বীরত্বেরই জয়জয়কার ছিল এখানে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রণাঙ্গনের অবস্থা পর্যবেক্ষণকালে তাঁর দৃষ্টি মুসাইলামার নিরাপত্তা বাহিনীর উপর পড়ে। তারা ভণ্ড নবীর জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়ে চলছিল। বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতিতে বাজি জিততে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাথায় মাত্র একটি পন্থাই কেবল ঘুরে-ফিরে আসতে থাকে। আর তা হলো মুসাইলামার হত্যা। তাকে হত্যা করতে পারলে মুসলমান বিজয় লাভ করতে পারে। অন্যথা যুদ্ধ যে কোন মুহূর্তে বেগতিক দিকে মোড় নিতে পারে। কিন্তু মুসাইলামার হত্যার ব্যাপারটি এতটুকু সহজ নয়, যত সহজে সেটা মাথায় ঢুকতে পেরেছে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার জন্য এমনভাবে তার দিকে অগ্রসর হয় যে, বাছাইকৃত সৈন্যরা তার চতুর্দিকে ছিল। নিকটে পৌঁছলে মুসাইলামার নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদের উপর একযোগে চড়াও হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে যে আসে, সে আস্ত ফেরত যায় না। কিন্তু তারপরেও মুসাইলামা পর্যন্ত পৌঁছার কোন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় না।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জানবাজ সৈনিকরা নিজেদের ডিসিপ্লিন ঠিক রাখে। ফাটল সৃষ্টি হতে দেয় না। একটি মোক্ষম সুযোগ দেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদেরকে একযোগে হামলার নির্দেশ দেন। তিনি নিজেও দাপটে তরবারী চালান। মুসাইলামার কতক নিরাপত্তাকর্মী আগেই মারা গিয়েছিল বা আহত হয়ে মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল। খালিদ বাহিনীর শার্দুলদের হামলা এত ক্ষিপ্রগতির ও মারাত্মক ছিল যে, নিরাপত্তাকর্মীরা দিশেহারা হয়ে যায়। পুরো ময়দানে মুজাহিদ বাহিনী নাটকীয়ভাবে ফিরে আসে। চালকের আসন এখন তাদের দখলে। যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তাদের হাতে চলে আসে। জয় অথবা লয়ের যে দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে মুজাহিদ বাহিনী যুদ্ধে নেমেছিল তার কারণে তারা মুরতাদ বাহিনীর জন্য এক ভয়ঙ্কর দানবে পরিণত হয়েছিল। নিরাপত্তাকর্মী বৃদ্ধির কোন সুযোগ মুসাইলামার ছিল না।

একদিকে মুসলমানদের গগনভেদী নারাধ্বনি আর অপরদিকে ঘূর্ণিঝড়ের শো শো আওয়াজ রণাঙ্গনের পরিবেশকে আরো ভয়াবহ করে তুলছিল। মুসাইলামার একান্ত বডিগার্ডদেরও হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জানবাজ সৈন্যরা স্পেশাল বডিগার্ড বাহিনীর বৃত্তকেও ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়।

“নবীজী!” এক বডিগার্ড ভাঙ্গাসুরে বলে—কোন মোজেজা দেখান।”

“আপনার প্রতিশ্রুতি পূরণ করুন শ্রদ্ধেয় নবী!” আরেক বডিগার্ড বলে— “একমাত্র বিজয় ছিল আপনার প্রতিশ্রুতি।”

মূসাইলামা মৃত্যুকে তার দিকে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসতে দেখে উচ্চকণ্ঠে নিরাপত্তাকর্মীদের লক্ষ্য করে বলে—“নিজেদের মান-মর্যাদা এবং ইজ্জত-আবরু রক্ষায় প্রাণপণ লড়ে যাও”—এরপর সে নিজস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়।

সতের

শত্রুর সম্মুখ সাড়ি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। পতাকা স্বস্থানে ছিল না। এতে ময়দানব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে যে, “নবী ময়দানে নেই… রাসূল পালিয়ে গেছে। এ ঘোষণা মুরতাদদের অবশিষ্ট শক্তিটুকুও লোপ করে দেয়। তারা মনোবল হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিতে থাকে।

অল্প সময়ের মধ্যে ময়দান মুরতাদশূন্য হয়ে যায়। কিন্তু রণাঙ্গনের দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক। স্রোতের গতিতে মানব খুন নদী সৃষ্টি করে বেয়ে যেতে থাকে। যেখানে মূল যুদ্ধ হয় তা একটি সংকীর্ণ ঘাঁটির মত স্থান ছিল। ইতোপূর্বে এর কোন নাম ছিল না। এই যুদ্ধ তাকে একটি নতুন নাম উপহার দেয়। ‘শায়িবুদ্‌দাম’ অর্থাৎ রক্তাক্ত প্রান্তর। এখানে উভয় পক্ষের এত প্রাণহানি ঘটে যে, ময়দানে লাশের উপর লাশ পড়ে লাশের স্তুপ হয়ে যায়। আহতের সংখ্যা ছিল হাজার-হাজার। মুসাইলামার সৈন্যসংখ্যা বেশী থাকায় প্রাণহানির ঘটনাও তাদের মধ্যে বেশীঘটে। মুসলমানদের প্রাণহানির সংখ্যাও কম ছিল না। কতক ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আহত-নিহতদের পিষ্ট করে ফিরছিল। অনেক সুস্থ লোকও তাদের পদতলে পিষ্ট হতে থাকে।

মুসাইলামার সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে পালিয়ে গেলে মুজাহিদ বাহিনী তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। মুহকাম বিন তুফাইল নামক মুসাইলামার এক সেনাপতি সৈন্যদেরকে আহ্বান করে বলছিল—“বনূ হানীফা! বাগিচায় গিয়ে আশ্রয় নাও।”

একমাত্র বাগিচাই ছিল তাদের আশ্রয়স্থল। এই বাগিচার নাম ছিল হাদীকাতুর রহমান। বাগিচাটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অত্যন্ত প্রশস্ত ছিল। চতুর্দিক দিয়ে উঁচু প্রাচীর ছিল। মুসাইলামা রণাঙ্গন ছেড়ে এখানে এসে ওঠে। বাগিচাটি রণাঙ্গনের সন্নিকটেই ছিল। মুসাইলামার স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনেক সৈন্য বাগিচায় ঢুকে গিয়েছিল। মুজাহিদরা মুরতাদদের তাড়িয়ে বাগিচার কাছে এলে ততক্ষণে অপর প্রান্ত হতে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের বর্ণনামতে মুসাইলামার সাথে বাগিচায় আশ্রয়গ্রহণকারী সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৭ হাজারের মত।

বাগিচার ফটক বন্ধ দেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাউন্ডারীর চতুর্দিক দিয়ে প্রদক্ষিণ করেন। ভিতরে প্রবেশের কোন উপায় তিনি বের করতে পারেন না। এ মুহূর্তে ভিতরে প্রবেশ অপরিহার্য ছিল। মুসাইলামাকে হত্যার মাধ্যমে উত্থিত ফিৎনার চির অবসান ঘটানো অত্যন্ত জরুরী ছিল।

হযরত বারা বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু নামক এক মুজাহিদ দৃঢ়পদে এগিয়ে এসে বলে—“আমাকে কয়েকজন ধরে উঁচিয়ে বাগিচার ওপাশে ছুড়ে দাও। খোদার কসম! আমি দরজা খুলে দিব।”

সাহাবায়ে কেরামের মাঝে হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। বাগিচার ওপাশে তাকে একাকী ছাড়ার প্রস্তাবে কেউ সাড়া দেয় না। কিন্তু তিনি নিজেও নাছোড় বান্দা। বারংবার অনুরোধ জানাতে থাকেন। তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে দু’তিনজন সৈন্য তাকে নিজেদের কাঁধে উঠিয়ে দাঁড় করায়। তিনি এভাবে দেয়ালের উপরিভাগে পৌঁছে দেয়াল টপকিয়ে বাগিচার অভ্যন্তরে লাফিয়ে পড়েন। বাগিচার অভ্যন্তরে এখন মুসাইলামার ৭ হাজার সশস্ত্র সৈন্য পক্ষান্তরে একমাত্র মুসলমান হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু।

৭ হাজার সশস্ত্র কাফেরের মাঝে একজন মুসলমানের লাফিয়ে পড়া জলন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে লাফিয়ে পড়ারই নামান্তর। হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু এক দুর্বার আকর্ষণে এভাবে অগ্নিকুণ্ডের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাগিচার অভ্যন্তরে গিয়ে দরজা খোলার সীমাহীন ঝুকি তিনি কারো নির্দেশ ছাড়াই নিজে নিজে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দরজার নিকটবর্তী স্থান থেকে দেয়াল টপকিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন। ৭ হাজার সৈন্য বাগিচায় ঢুকে তখনও পর্যন্ত এলোপাথাড়ি ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। তারা টের পেয়েছিল যে, মুসলমানরা তাদের পশ্চাদ্ধাবনে এখানে এসে পৌঁছেছে এবং বর্তমানে তারা বাগিচা অবরোধ করে আছে। কিন্তু তারা ভাবতেই পারে নাই যে, কোন মুসলমান একাকী দেয়াল টপকিয়ে ভিতরে আসার সাহস করতে পারে।

“কে ও?” একজন চেঁচিয়ে ওঠে—“লোকটি দরজা খুলছে।”

হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একজন দেখে ফেলে এবং আরেকজন চিনতে পেরে চিৎকার করে ওঠে—“মুসলমান! মুসলমান!!”

“কেটে ফেল ওকে”—জনৈক মুরতাদ চেঁচিয়ে বলে।

“মস্তক উড়িয়ে দাও” আরেকজন বলে।

“বন্দী কর…হত্যা কর”—শতকণ্ঠের গুঞ্জন ওঠে।

অসংখ্য মুরতাদ তলোয়ার ও বর্শা উঁচিয়ে হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বধ করতে ছুটে আসে। হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহুও তখন পর্যন্ত দরজা খুলতে সক্ষম হন না। শত্রুদের এগিয়ে আসতে দেখে তিনি তলোয়ার কোষমুক্ত করেন এবং বনূ হানীফার পক্ষ হতে যে লোকটি সর্বাগ্রে তার নিকটে পৌঁছে হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মারাত্মক কোপ তাকে স্বস্থানে থামিয়ে দেয়। আঘাত খেয়ে লোকটি শক পাবার মত কয়েক পা পিছনে হটে যায়। তিনি এ সুযোগে আবার দরজা খোলার চেষ্টা করেন। তিনি বারবার স্থান পরিবর্তন করে দরজা খুলছিলেন। একই সাথে দু’ব্যক্তি তার লক্ষ্যে বর্শা ছুড়ে মারে। তিনি দক্ষতার সাথে একদিকে সরে যান। বর্শার ফলা হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীরে বিদ্ধ না হয়ে দরজার পাল্লায় গিয়ে আঘাত করে। তারা যে মুহূর্তে ব্যর্থ বর্শা দরজা হতে ছাড়াবার চেষ্টায় রত তখন হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু চোখের পলকে তরবারী চালিয়ে তাদের ঘায়েল করে দেন।

এবার কয়েকজন মিলে একযোগে হামলা চালাতে থাকে। হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু দরজায় পিঠ লাগিয়ে অতি দক্ষতার সাথে তাদের হামলা প্রতিহত করতে থাকেন। এ সময় দুটি শ্লোগান তার জবানে জারী ছিল—“আল্লাহু আকবার…মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” —তিনি একসাথে তিন কাজ করতে থাকেন। (১) আক্রমণ প্রতিহত (২) আক্রমণ চালানো এবং (৩) দরজা খোলার চেষ্টা।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু সেদিন অবিশ্বাস্যভাবে প্রচুর সংখ্যক মুরতাদকে নিহত ও আহত করে অবশেষে দরজা খুলে দিতে সক্ষম হন। কোন কোন ঐতিহাসিক অবশ্য এটাও লেখেন যে, হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুকরণে আরো কতিপয় মুজাহিদ দেয়াল টপকিয়ে বাগিচায় ঢুকে পড়েছিলেন। তারা তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে মুরতাদদের দূরে ভাগিয়ে দেয় এবং হযরত বারা রাযিয়াল্লাহু আনহু দরজা খুলে দেন। এ ব্যাপারে সকল ঐতিহাসিক একমত যে, হযরত বারা বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহুই সর্বপ্রথম দেয়াল টপকিয়ে বাগিচার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন।

দরজা খুলতেই মুজাহিদ বাহিনী বাধভাঙ্গা স্রোতের মত ভিতরে প্রবেশ করে। অনেক মুজাহিদ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে প্রাচীরে উঠে পড়ে। তারা শত্রুদের উপর তীর বর্ষণ শুরু করে। যাতে তারা মুজাহিদদের অনুপ্রবেশে বিঘ্নতা সৃষ্টি করার সুযোগ না পায়। মুজাহিদরা অনায়াসে ভিতরে প্রবেশ করে বনূ হানীফার উপর বজ্রের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুরতাদরা পাইকারী হারে হত্যা হতে থাকে। তাদের পলায়নের পথ ছিল রুদ্ধ। তারা এখন প্রাণ বাঁচাতে লড়ে চলে। যদিও মিথ্যা নবী তবুও সে এখন তাদের সাথে। সে সৈন্যদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করে চলছিল আর সৈন্যরা প্রাণপণে লড়ছিল।

মুরতাদদের সংখ্যা প্রচুর হলেও দ্রুত সে সংখ্যা কমে আসতে থাকে। বাগিচা খুনের দরিয়ায় ভেসে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাথায় একটি চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, কিভাবে মুসাইলামাকে হত্যা করা যাবে। কারণ, সে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত লড়াই বন্ধ হবে না। কিন্তু মুসাইলামার কোন পাত্তা ছিল না। তার দৃষ্টি মুসাইলামাকে খুঁজে পায় না।

মুসাইলামা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পারলেও আরেক মুজাহিদের দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পারে না। তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি মুসাইলামাকে ঠিকই খুঁজে বের করে। তিনি ছিলেন হাবশী গোলাম হযরত ওয়াহশী বিন হারব রাযিয়াল্লাহু আনহু। টার্গেটে বর্শা ছোঁয়াতে হযরত ওয়াহশীর সমকক্ষ সে যুগে আরবে কেউ ছিল না। তিনি ইতোপূর্বে তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এক নর্তকীর মাথায় একবার মিডিয়াম সাইজের একটি কড়া চুলের সাথে এমনভাবে বেঁধে দেয়া হয় যে, কড়াটি তার মাথার উপরে সোজা স্থাপিত থাকে। নর্তকী নাচতে থাকে আর হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু কয়েক কদম দূরে বর্শা হাতে নিয়ে দাঁড়ান।

তিনি হাতে বর্শা উঁচিয়ে পজিশন ঠিক করেন। নর্তকী নিজস্ব ভঙ্গিমায় নাচতে থাকে। নর্তকী নাচতে নাচতে যখনই পজিশন বরাবর আসে ঠিক তখনই তিনি কড়া লক্ষ্যে বর্শা ছুড়ে মারেন। বর্শা নর্তকীর মাথায় স্থাপিত কড়ার মধ্য দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

উহুদ যুদ্ধে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ঠিক এমনিভাবে বর্শার আঘাতে শহীদ করেছিলেন। তিনি বাজি জিতে হযরত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হযরত হিন্দা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর থেকে পুরস্কার লাভ করেছিলেন। অবশ্য ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন মুসলমান ছিলেন না। মক্কা বিজয়ের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

মুসাইলামার বিপক্ষে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম সৈন্যদের অন্তর্গত ছিলেন। বাগিচায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলাকালে তিনি মুসাইলামাকে দেখে ফেলেন। তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মুখে শুনেছিলেন যে, মুসাইলামাকে হত্যা করা ছাড়া এ যুদ্ধ থামবে না। তিনি মুসাইলামার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। শত্রুর তলোয়ার-বর্শা, সাথীদের নিক্ষিপ্ত তীর এড়িয়ে এবং নিহত-আহতদের শরীরের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে তিনি সমস্ত বাগিচা পায়চারী করতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুসাইলামা তাঁর চোখে পড়ে যায়। সে নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্ভেদ্য বেষ্টনির মধ্যে ছিল এবং নিরাপত্তা কর্মীরা এমন বীরত্ব প্রদর্শন করতে থাকে যে, তারা কোন মুসলমানকে ধারে-কাছে পর্যন্ত আসতে দিচ্ছিল না।

ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য মুসাইলামার নিকটে যাবার প্রয়োজন ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী মুসাইলামার নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। এদিকে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসাইলামার প্রতি বর্শা নিক্ষেপের মোক্ষম সুযোগ বের করতে সংঘর্ষরত সৈনিকদের চারদিকে ঘুরছিলেন। তিনি একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু উম্মে আম্মারা নামক এক মুসলিম মহিলার দরুণ সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যায়। মহিলা নিজেও মুসাইলামা পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করছিলেন। তিনি স্বীয় পুত্রের সাথে সাথে ছিলেন। তিনি মুসাইলামার নিরাপত্তার দেয়াল ভাঙতে চেষ্টা করলে এক মুরতাদের তলোয়ার তার গতিরোধ করে। উম্মে আম্মারা নিজের তলোয়ার দ্বারা তাকে ধরাশায়ী করার প্রাণান্তক চেষ্টা করেন কিন্তু মুরতাদের হঠাৎ এক আক্রমণে তার হাত সম্পূর্ণ কেটে যায়। তাঁর পুত্র তলোয়ারের এক কোপে ঐ মুরতাদকে জাহান্নামে পাঠায়। অতঃপর তিনি মাতাকে সাথে নিয়ে সেখান থেকে সরে যান।

হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু আরেকটি সুযোগ পেয়ে যান। তিনি সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজি নন। বর্শা হাতে তুলে নেন এবং পজিশন ঠিক করে টার্গেটে পূর্ণশক্তিতে বর্শা ছুড়ে মারেন। অব্যর্থ নিশানা। কেল্লা ফতে। বর্শা মূসাইলামার ইয়ামোটা ভূড়িতে গিয়ে আমূল বিদ্ধ হয়। সে দ্রুত বর্শা ধরে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে বর্শা তার কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছিল।

বর্শার আঘাত এত মারাত্মক ছিল যে, পেট থেকে বর্শা বের করার শক্তি পর্যন্ত মুসাইলামার হাতে ছিল না। রক্তঝরা গভীর বর্শাঘাতে সে জমিনে লুটিয়ে পড়ে। এ আঘাতেই সে মারা যেত। কিন্তু হযরত আবু দাযানা রাযিয়াল্লাহু আনহু এর তলোয়ারের আঘাত তাকে ধুকে ধুকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। তিনি মুসাইলামাকে জমিনে লুটিয়ে ছটফট করতে দেখে ঘাড়ে তলোয়ারের এমন এক আঘাত হানেন যে, এক আঘাতে তার মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

হযরত আবু দাযানা রাযিয়াল্লাহু আনহু মস্তক বিচ্ছিন্ন লাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে মুসাইলামার এক বডিগার্ড পশ্চাত হতে হযরত আবু দাযানার উপর এত জোরে আঘাত করে যে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং শাহাদাত বরণ করেন।

“বনূ হানীফা!” এক মুরতাদ চিৎকার করে বলে—“আমাদের নবীকে জনৈক কালো মোটা হাবশী হত্যা করেছে।”

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লেখেন, বাগিচার অভ্যন্তরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাঝে এই আওয়াজ প্রতিধ্বনি হতে থাকে—“নবী নিহত…মুসাইলামা মারা গেছে।”

আঠার

মুসাইলামা কাজ্জাবের হত্যার সমুদয় কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর। তিনি এর কাঙ্ক্ষিত হত্যার মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবন বড় বৈচিত্র্যময়। পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, তিনি মুসাইলামাকে যে অপূর্ব কৌশল ও দক্ষতার মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে উহুদ যুদ্ধে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শহীদ করেছিলেন। মক্কা বিজয় হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও কয়েকজন নর-নারীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতাবহির্ভূত রাখেন। যুদ্ধাপরাধীদের লিস্টে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নামও ছিল। তিনি বিশেষ কোন সূত্রে টের পেয়েছিলেন যে, মুসলমানরা তাকে কিছুতেই জীবিত রাখবে না। তিনি প্রাণভয়ে তায়েফ গিয়ে সাকীফ গোত্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে মুসলিম বাহিনী সাকীফ গোত্রকে যে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল তার বিবরণ পাঠকবর্গ ইতোপূর্বে অবগত হয়েছেন। সাকীফ গোত্র পরাজিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলে সেখানে আশ্রয়রত হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহুও ইসলামের সত্যতা মেনে নেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি বাইয়াত হতে এবং প্রাণভিক্ষা চাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কয়েক বছর পূর্বে দেখেছিলেন বিধায় সম্ভবত ভালভাবে চিনতে পারেন না। “তুমি সেই ওয়াহশী!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন।

“জী হুজর! আমি সেই ওয়াহশী” —তিনি জবাবে বলেন—“এখন আমি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করি।”

“ওহ্, ওয়াহশী!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চান—বলতো তুমি কিভাবে হামযাকে হত্যা করেছিলে?

ঐতিহাসিকরা লেখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুরোধে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হত্যার পুরো বিবরণ এমনভাষা ও ভঙ্গিতে বর্ণনা করেন, যেন তিনি শ্রোতাদের অন্তরে নিজের বীরত্ব আর রণদক্ষতার গভীর প্রভাব বিস্তার করছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণের সুবাদে তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু ইবনে হিশামের এক ভাষ্যে জানা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন, তিনি যেন কখনো তার সামনে না আসেন। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কেবল চাচাই ছিলেন না; উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে তিনি বিরাট মর্যাদার অধিকারী এবং সামাজিক পর্যায়েও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মহৎপ্রাণ এবং ক্ষমার আধার হওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ক্ষমা করে দিলেও অন্তরের অন্তঃস্থলে গভীর ক্ষত ঠিকই বিদ্যমান ছিল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি যে ধরনের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন, ঠিক তেমনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন ঐ হিন্দার প্রতিও, যার ইঙ্গিতে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু রক্তঝরা গভীর বর্শাঘাতে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শহীদ করেছিলেন। এরপরে গিয়ে হিন্দা ঐ লাশের সাথে অমানবিক আচরণ করেছিল। তাদের দু’জনের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসন্তুষ্টি ব্যক্তি বিদ্বেষ কিংবা শত্রুতার কারণে ছিল না; আর তা তার মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীলও নয়; বরং একজন মর্যাদাবান মুসলমানের মরদেহের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করাই ছিল তার সমস্ত বেদনা ও অসন্তুষ্টির মূল কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত হিন্দা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে বলেছিলেন, তোমরা আমার সামনে আসবে না। কারণ তোমাদের দেখলে আমার প্রিয় চাচা ও তার লাশের সাথে তোমাদের দুর্ব্যবহারের কথা মনে পড়ে যায়। মোটকথা, হৃদয়ের গহীনে ব্যথা থাকলেও তিনি হযরত ওয়াহশী ও হযরত হিন্দা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাঁটি অনুরাগী ও ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যথা মুছে তার হৃদয় জয় করতে পারেন নি। এতে তিনি চরম মর্মাহত ও আত্মবিদগ্ধ হন। সারা জীবন তিনি এই দুঃখের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়ান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিস্পৃহ আচরণ তাঁকে মর্মে মর্মে পুড়িয়ে মারে। তিনি সহ্য করতে পারেন না। মক্কা ছেড়ে চলে যান এবং দীর্ঘ দুই বছর পর্যন্ত তায়েফের এখানে-ওখানে কাটান। এ সময় নিরবতা তাকে গ্রাস করে নেয়। সর্বদা গভীর চিন্তায় ডুবে থাকেন। তিনি আন্তরিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। শত বেদনার মাঝেও তিনি ঈমান আঁকড়ে থাকেন।

দু’বছর পর অশান্ত হৃদয় শান্ত করতে তিনি মুসলিম বাহিনীতে শামিল হয়ে যান। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। ইয়ামামা যুদ্ধ চলাকালে তিনি জানতে পারেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসাইলামাকে হত্যার চেষ্টায় রত। তিনি সেনাধ্যক্ষের ইচ্ছাকে নিজের কর্তব্য নির্ধারিত করেন এবং আল্লাহর ফজলে সে কর্তব্য যথাযথ পালন করে দেখান।

এরপর হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীতে নিয়মিত থাকেন এবং পরপর কয়েকটি রণাঙ্গনে অভূতপূর্ব শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করেন। সিরিয়া বিজয়ের পর তিনি ইসলামী বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে হিমসে গিয়ে কোলাহলমুক্ত জীবন-যাপন করতে শুরু করেন। ঐতিহাসিকগণ তার এ হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ সম্বন্ধে লেখেন যে, হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হত্যার অপরাধ পাহাড়ের মত রূপ ধারণ করে তাঁর অন্তরে চেপে বসেছিল। তিনি শরাব পান করতে শুরু করেন। কিন্তু তা বিলাসিতার কারণে ছিল না; বরং নিজেকে ভুলে যেতেই তিনি এ পন্থা বেছে নেন। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজ শাসনামলে শরাব পানের অপরাধে তাকে ৮০ দোররা মেরে ছিলেন। কিন্তু এতে তার মাঝে কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। তিনি রীতিমত শরাব পান করতে থাকেন।

জীবনের শেষের দিকে এসে তার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ দলে দলে শ্রদ্ধাভরে তার সাক্ষাতে আসতে থাকে। কিন্তু তিনি বেশিরভাগ সময় অস্বাভাবিক থাকতেন। স্বাভাবিক হলে মানুষকে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং মুসাইলামার হত্যার কিস্‌সা শোনাতেন। মানুষ দলে দলে এই কিস্‌সা শুনতেই তার কাছে ভীড় জমাত। তিনি অনেকবার বর্শা হাতে নিয়ে বলেন—“অমুসলিম থাকা অবস্থায় এই বর্শাঘাতে আমি এক সর্বোত্তম ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম। অতঃপর মুসলমান হয়ে এই বর্শাঘাতেই এক সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তিকে জাহান্নামে পাঠিয়েছি।”

উনিশ

এক বিশিষ্ট ভদ্র মহিলার নাম উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা। উহুদ যুদ্ধে তিনি ঐ মুসলিম নারীদের একজন ছিলেন, যারা আহতদের সেবা-শুশ্রূষার উদ্দেশ্যে সৈন্যদের সাথে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ এক পর্যায়ে কুরাইশদের অনুকূলে চলে গিয়েছিল। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে লক্ষ্য করে প্রবল বেগে হামলা করে বসে। সাহাবায়ে কেরাম মানববর্ম রচনা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঘিরে রেখেছিলেন। কিন্তু শত্রুর আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিরাপত্তা বাহিনীর বৃত্ত ভেঙ্গে যায়। ইবনে কুময়া নামক এক কুরাইশ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ডানে হযরত মুছআব রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন। এ সময় হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা নিকটে কোথাও ছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিপদের মুখে দেখে আহতদের সেবা ও পানি পান ছেড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পানে দৌড়ে আসেন। তিনি যাবার পথে কোন লাশ বা মারাত্মক আহত কোন ব্যক্তির হাত হতে তলোয়ার উঠিয়ে নিয়ে যান।

ইবনে কুময়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আক্রমণ করার পরিবর্তে তার দেহরক্ষী হযরত মুছআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে ধাবিত হয়। হযরত মুছআব রাযিয়াল্লাহু আনহু বীরত্বের সাথে তার মোকাবিলা করেন। উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা ইবনে কুময়ার কাঁধ লক্ষ্য করে তরবারীর আঘাত হানেন। কিন্তু সে বর্মাচ্ছাদিত থাকায় তরবারীর আঘাত ব্যর্থ হয়। ইবনে কুময়া ঘুরে পাল্টা হামলা চালায়। আঘাত এত জোরাল ছিল যে, তা হযরত উম্মে আম্মারার কাঁধে গিয়ে লাগলে তিনি মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান। ইবনে কুময়া দ্বিতীয় আঘাত করে না। কেননা তার লক্ষ্য ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আক্রমণ করে তাকে ধরাশায়ী করা।

উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা নিজ পুত্রের সাথে ইয়ামামা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আসেন। এ যুদ্ধেও তিনি দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন যে, নারী হয়েও তিনি মুসাইলামাকে হত্যার মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এতে তিনি মারাত্মক আহত হন। তার একটি হাত কাটা যায়।

৬৩২ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ লগ্ন। অন্যান্য বছর এ সময় ‘হাদীকাতুর রহমান’ সবুজ-শ্যামলিমা ও রঙ-বেরঙের মাঝে সুসজ্জিত একটি মায়াকানন থাকত। অকৃপণ হাতে সে এ সময় লোকদেরকে ফল-মূল উপহার দিত। ক্লান্ত পথিকবর এখানে এসে নির্ভয়ে বিশ্রাম নিত। নানা ফুলের সুগন্ধে কাননটি মুখরিত ও সুরভিত ছিল। কিন্তু এতদিনের সে জীবন্ত কাননটি এখন মৃত্যুকাননে পরিণত। তার সৌন্দর্যচ্ছটা আর রূপের বাহার মানুষের তাজা রক্তে ডুবে গিয়েছিল। তার লাবণ্য লাশের নীচে চাপা পড়েছিল। মোহিনী সৌরভ রক্ত আর ছিন্ন-ভিন্ন গোশতের উৎকট গন্ধে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। যেখানে পাখিরা কিচির-মিচির ধ্বনি তুলে গান করত সেখানে আজ আহতদের আর্তচিৎকার। আহত ঘোড়াগুলো বল্গাহীন হয়ে উদভ্রান্তভাবে দৌড়ে ফিরছিল। তাদের ব্যথাদীর্ণ হ্রেষারব ছিল মৃত্যুর ভয়ঙ্কর অট্টহাসির মত।

মুসাইলামার নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুরতাদ বাহিনী প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নের পথ খোঁজে। তারা ইতোপূর্বেও পালিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথম থেকেই মুসলমানরা তাদের কাছে ভয়ংকর দানব ছিল। বাগিচায় এসে আরো এক হাজার মুরতাদ প্রাণ হারায়। তারা এখানে এসে এমনভাবে যুদ্ধ করে যেন পূর্ব থেকেই হেরে বসে আছে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও তারা শেষ রক্তবিন্দু উজাড় করে লড়াই জারী রাখে। কিন্তু নবী নিহত হওয়ার সংবাদ কানে গেলে তাদের সর্বশেষ শক্তিটুকুও লোপ পেয়ে যায়। হাতে অস্ত্র থাকলেও বাহুর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। তারপরেও অনেকে পলায়নের পথ পরিষ্কার করতে তরবারী হেলাতে-দুলাতে থাকে। পরাজয় তাদের দেমাগে এঁটে গিয়েছিল।

রণাঙ্গনের অনতিদূরে মুসলমানদের লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রায় ছাউনীর মাঝে মাত্র একটি তাঁবু বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে ছিল। যেন একটি পরিচিত ঝড় এসে সেনাপতি ব্যতীত বাকী ছাউনীতে ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। অক্ষত তাবুটি ছিল সেনাপতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর। বনূ হানীফা প্রথম দিকে জয়লাভ করে মুসলিম সেনাছাউনীতে এভাবে টর্নেডোর মত আঘাত হেনে সব চুরমার করে দিয়েছিল। তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাঁবুতেও গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাদের সর্দার মুযাআ লোহার বেড়ি পরিহিত অবস্থায় বন্দী ছিল। তাঁবুতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্ত্রী লায়লাও ছিল। সৈন্যরা লায়লাকে হত্যা করতে কিংবা ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মুযাআ তাদেরকে এই বলে ক্ষান্ত করেছিল যে, আগে পুরুষদের দিকে ধাবিত হও। নারীদের প্রতি চোখ তুলে তাকাবার সময় এখনও আসেনি। তারা সর্দারের নির্দেশে তাবু ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এভাবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাবু অক্ষত থেকে যায়।

হযরত খালিদ পত্নী লায়লা তাঁবুর বাইরে একটি উটে বসা ছিলেন। কোথাও যাবার ইচ্ছা তার ছিল না। তিনি উঁচু হয়ে রণাঙ্গনের অবস্থা নিরীক্ষণ করছিলেন। ময়দান ছিল জনশূন্য। বাগিচার উঁচু প্রাচীর আর গগনমুখী বৃক্ষের অগ্রভাগ তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন কিন্তু বাগিচার অভ্যন্তরের দৃশ্য ছিল তার দৃষ্টির বাইরে। তিনি উট থেকে নেমে আসেন এবং সোজা তাঁবুর ভিতরে চলে যান।

“ইবনে মুরারাহ!” লায়লা মুযাআকে বলেন—তোমাদের নবী রণাঙ্গন ফেলে চলে গেছে। খোদার কসম। বনু হানীফা পলায়ন করেছে।”

“আমি কোনদিন শুনিনি যে ১৩ হাজার সৈন্য ৪০ হাজার সৈন্যকে পরাস্ত করেছে।” মুযাআ বলে, “রণাঙ্গণ ছেড়ে যাওয়াটা মুসাইলামার নয়া কৌশল হতে পারে, পিছপা নয়।”

“উভয় পক্ষ এখন বাগিচার অভ্যন্তরে।” লায়লা মুযাআকে জানান—“সবাই বাগিচায় ঢুকে থাকলে সেখান থেকে বনূ হানীফাই কেবল প্রাণ নিয়ে বের হবে।” মুযাআ বিন মুরারাহ আশ্চর্যের ভঙ্গিতে বলে—“আমার গোত্রের পিছু পিছু মুসলমানরা সত্যই যদি বাগিচায় ঢুকে থাকে, তাহলে নিশ্চিত মনে রেখ, মৃত্যুই তাদেরকে ওখানে টেনে নিয়ে গেছে। বনূ হানীফা জয়ের ঊর্ধ্বে।

“আজ চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যাবে”—লায়লা বলে—অপেক্ষা কর…ঘোড়ার ঘণ্টাধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি। আমার স্বামীর দূতই হবে”—এই বলে লায়লা তাবু হতে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় এবং একটু পরে আনন্দচিত্তে বলেন—“দূত নিশ্চয় বিজয়ের খবর আনছে…এই তো সে এলো!”

বিশ

ঘোড়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে একেবারে লায়লার নিকটে এসে দাঁড়ায়। ঘোড়া থামতেই আরোহী লাফিয়ে নীচে নেমে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই ছিলেন এই আরোহী। লায়লা তাকে একা দেখে প্রথমত খুব ঘাবড়ে যান। কারণ, সেনাপতির এভাবে ফিরে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, তার অধীনস্ত সৈন্যরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে হারিয়ে পালিয়ে গেছে।

“রণাঙ্গনের কি খবর?” লায়লা উদ্বেগের সাথে জানতে চায়—আপনি একা এসেছেন কেন?”

“খোদার কসম! আমি বনূ হানীফাকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছি।” হযরত খালিদ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন—মুসাইলামা কাজ্জাব মারা গেছে।…সে কয়েদী কোথায়?”

লায়লা বিজয়ের সুসংবাদে হস্তদ্বয় উপরে তুলে আকাশ পানে তাকায় এবং প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন—“মুযাআ বলছিল, বনূ হানীফা না-কি জয়ের ঊর্ধ্বে।”

“আমি জানতে চাচ্ছি সে এখন কোথায়? হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাফ ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞাসা করেন—তারা তাকে মুক্ত করে নিয়ে গেছে।”

“আমি এখানে ওলীদ পুত্র!” তাঁবুর অভ্যন্তর হতে মুযাআর কণ্ঠ ভেসে আসে—“আমি আপনার এ দাবী সত্য বলে বিশ্বাস করি না যে, মুসাইলামা নিহত হয়েছে।”

“আমার সাথে চল মুযাআ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করে বলেন—“তোমার কথা সত্যও হতে পারে। আমি মুসাইলামাকে চিনি না। তোমার গোত্রই এই চিৎকার করতে করতে পালিয়ে গেছে যে, মুসাইলামা মারা গেছে। আমার সাথে এস। অসংখ্য লাশের মাঝে তার লাশ চিহ্নিত করে আমাকে বল যে, এটা তার লাশ।

তার কি হবে? মুযাআ জিজ্ঞাসা করে—“আমাকে মুক্ত করে দিবেন?”

“খোদার কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আমি ঐ গোত্রের এক নেতাকে স্বাধীন ছেড়ে দিব না, যে আমার দ্বীনের দুশমন। রেসালাতের মধ্যে অংশীর দাবীদার এবং এ দাবী সমর্থনকারীকে আমি কিভাবে ক্ষমা করতে পারি? আল্লাহ ছাড়া কেউ তোমাকে ক্ষমা করতে পারে না।”

“ওহ্, ওলীদের পুত্র।” মুযাআ বিন মুরারাহ বলে—“আমি মুসাইলামার নবুওয়াতকে আন্তরিকভাবে কখনো স্বীকৃতি দিই নি। সে বাকশক্তির জোর এবং যাদুর কারসাজি ও ভেল্কিবাজি দেখিয়ে নবী হয়ে গিয়েছিল। আপনি তার মুরীদ ও ভক্তবৃন্দের সংখ্যাও দেখেছেন। আমি তাকে নবী বলে মেনে না নিলে সে আমার পুরো গোত্রকে জীবন্ত পুড়ে মারত। গোত্র থেকে আমি নিজেকে বিচ্ছিন্নও করতে চাইনি। এখন যদি আপনি আমাকে হত্যার নির্দেশ দেন, তবে এটা সম্পূর্ণ অন্যায় হত্যা হবে।”

“যারা আমাদের তাঁবু লুটতে এবং ধ্বংস করতে এসেছিল এ লোকটি তাদের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে”—লায়লা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জানান—“লোকটি লুটেরাদের এই বলে নিবৃত্ত করেছিল যে, আগে পুরুষদের পশ্চাদ্ধাবন কর…। তারা চলে যায়। লোকটি তাদেরকে এ কথাও বলে না যে, আমার পায়ের বেড়ি খুলে দাও।”

“এ নারীর প্রতি তোমার অনুগ্রহের কারণ কি মুযাআ?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করেন।

“কারণ, আমার গোত্র আমাকে যে সম্মান করে একজন যুদ্ধবন্দী হওয়া সত্ত্বেও ইনি আমার সাথে তদ্রূপ সম্মানজনক আচরণ করেছেন।” মুযাআ বলে—“তিনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন আমি তার বদলা দিতে চেষ্টা করেছি মাত্র।…আমি চাইলে এমনটি করতে পারতাম যে, আমার লোকদেরকে পায়ের বেড়ি খুলে দিতে বলতাম অতঃপর আপনার এই অপরূপ সুন্দর স্ত্রীকে নিয়ে নিজের বাঁদী করে রাখতাম?”

“নিঃসন্দেহে তুমি সম্মানের উপযুক্ত মুযাআ।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কৃতজ্ঞতার স্বরে বলেন—“আমি নিজেই তোমার পায়ের বেড়ি খুলে দিচ্ছি। তুমি আমার সাথে যাবে এবং মুসাইলামার লাশ শনাক্ত করে আমাকে দেখাবে।”

একুশ

মুযাআ বিন মুরারাহ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তাবু হতে বের হওয়ার সময় তার পায়ে বেড়ি ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাইরে এসে দেখেন যে, তার দুই নিরাপত্তা কর্মী দাঁড়ানো। তিনি তাঁবুতে আসার সময় তাদের অবগত করানোর সুযোগ পান নাই। এদিকে নিরাপত্তাকর্মীরা শুধু এতটুকুই জানতেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এদিকে কোথাও এসেছেন। কিছুক্ষণ পর নিরাপত্তা বাহিনী জানতে পারে যে, সেনাপতি এদিকে নেই। তিনি অন্য পথে কোথায় যেন চলে গেছেন। তারা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুই নিরাপত্তাকর্মী এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে তার তাবু পর্যন্ত এসে পৌঁছান। তাঁবুর অভ্যন্তরে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আওয়াজ শুনে তারা নিশ্চিত হয় যে, তিনি এখানেই আছেন। ফলে তারা তাঁবুর বাইরে অবস্থান গ্রহণ করে। সেনাপতিকে শত্রু সমৃদ্ধ এলাকায় এভাবে একাকী ছাড়ার পক্ষপাতী তারা ছিল না।

মুযাআ স্বচক্ষে রণাঙ্গনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। তারই গোত্রের সারি সারি লাশ ছাড়া তার চোখে আর কিছু পড়ে না।

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না”—মুযাআ বিস্ময়কর কণ্ঠে বলে—“চাক্ষুষ দেখেও আমার বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না।…মুষ্টিমেয় মুসলমান এক বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে?”

“এটা মানুষের বিজয় নয়”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“এটা সত্য আকীদা-বিশ্বাস এবং আল্লাহ্‌র সত্য রাসূলের বিজয়। বনূ হানীফা ভ্রান্ত বিশ্বাস লালন করে ময়দানে নেমেছিল। আমাদের তরবারী ঐ ভ্রান্ত আকীদাকে কেটে কুচিকুচি করেছে। ফলে সংখ্যায় তারা বিশাল হওয়া সত্ত্বেও পালিয়ে গেছে।”

তারা লাশের স্তুপ এবং অসংখ্য আহতদের ডিঙিয়ে বাগিচায় গিয়ে পৌঁছে। ভেতরে ঢুকলে সেখানেও লাশের পর লাশ পড়ে ছিল। মুসলমানরা নিহতদের অস্ত্র জমা করছিল। বনূ হানীফার মধ্য হতে যারা জীবিত ছিল তারা এদিক-ওদিক পালিয়ে গিয়েছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত ওয়াহশী বিন হারব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন যে, মুসাইলামা মনে করে যাকে সে ঘায়েল করেছে তার লাশ কোথায়? হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। মুসাইলামার লাশের কাছে গিয়ে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু ইশারা করে দেখান।

“না”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেন—“এই খর্বাকৃতির এবং কুৎসিত লোক কখনো মুসাইলামা হতে পারে না। এর চেহারা বড়ই কদর্য।”

“এটাই”—মুযাআ বলে—“এটাই মুসাইলামার লাশ।”

“যে ব্যক্তি হাজার হাজার লোককে ভ্রষ্টতার গোলক ধাঁধায় নিক্ষিপ্ত করেছে এটা তারই লাশ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“লোকটি আপাদ-মস্তক এক ফেৎনাই ছিল।”

“ইবনে ওলীদ!” মুযাআ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সম্বোধন করে বলে—“বিজয় লাভে আত্মতুষ্ট হবেন না। আপনার জন্য আসল মোকাবিলা সামনে অপেক্ষমাণ।”

“কার সাথে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করেন।

“বনূ হানীফার সাথে”—মুযাআ জবাবে বলে—“যারা ময়দানে এসে লড়াই করেছে তারা বনূ হানীফার এক ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। আরো বিশাল বাহিনী ইয়ামামায় কেল্লার অভ্যন্তরে প্রস্তুত হয়ে আছে। নিজেদের প্রাণহানি দেখুন এবং চিন্তা করুন যে, আপনার এই মুষ্টিমেয় সৈন্য কি কেল্লার তেজোদ্যম বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে? তদুপরি আপনার সৈন্য ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লাশে আটা পূর্ণ বাগিচায় নজর ফিরান। তার সৈন্যরা বাস্তবেই লড়ার উপযোগী ছিল না। জানবাজি রাখার মত পরিস্থিতি বর্তমানে ছিল না বললেই চলে। আহত সৈন্যের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। যারা অক্ষত ছিল তারাও এমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে, যেখানেই খালি জায়গা পায় সেখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তিনগুণ বেশী সৈন্যের সাথে তারা সারাদিন বীর-বিক্রমে লড়েছে। তাদের রেস্টের খুবই প্রয়োজন ছিল।

“আপনি আমার একটি প্রস্তাব মেনে নিলে আমি কেল্লায় গিয়ে সন্ধির আলোচনা করতে পারি”—মুযাআ বলে—“আশা করি আমার গোত্র আমার কথা ফেলবে না।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যোগ্য সেনাপতি ছিলেন। সমর নেতৃত্বে তার উপমা তিনি নিজেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি আবেগ দ্বারা পরিচালিত হতেন না। বড়ই চৌকস এবং বাস্তববাদী লোক ছিলেন। দুশমনকে কেবল ময়দানে হারিয়ে দেয়াকেই তিনি বিজয় মনে করতেন না, বরং পলায়নপর শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের এলাকা করায়ত্ত করতে পারাই ছিল বিজয়ের পূর্ণাঙ্গতা। তার নীতি ছিল, দুশমনকে জ্যান্ত সাপ মনে কর। তার মস্তক পিষ্ট করেও একবার চেয়ে দেখ যে, মৃদু নড়াচড়াও সে করে কি-না।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাঝে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা ছিল স্বভাবজাত। কিভাবে দক্ষ হাতে সৈন্য পরিচালনা করতে হয় তা তিনি ভাল করেই বুঝতেন। নিয়মতান্ত্রিকতায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত কট্টর। এতদসত্ত্বেও কোন জটিল পরিস্থিতি সামনে এলে তিনি সহ সেনাপতিদের ডেকে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। মুযাআ বিন মুরারাহ সন্ধির প্রস্তাব তুললে তিনি একদিকে শত্রুদের পিছুহটা এবং অপরদিকে মুজাহিদদের লড়াইয়ের অনুপযুক্ততার বিষয়টি সামনে রেখে বাস্তবসম্মত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নায়েব সালারদের ডেকে পাঠান। তারা জমা হলে তাদের সামনে উদ্ভূত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং সকলকে জানান যে, বনূ হানীফার এক সর্দার-মুযাআ বিন মুরারাহ-সন্ধির প্রস্তাব পেশ করছে।

“আসল ফিৎনা শেষ”—হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন— “মুসাইলামার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বনূ হানীফার মনোবল ভেঙ্গে গেছে। দুশমনকে কোন প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ না দিয়ে এখনই ইয়ামামার কেল্লা অবরোধ করাকে আমি ভাল মনে করছি।”

“কেবল ইয়ামামা নয়”—হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“বনূ হানীফা যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ছোট ছোট কেল্লায় আত্মগোপন করেছে। প্রথমে তাদের বন্দী করা জরুরী। এরপরে সন্ধির আলোচনায় বসা যেতে পারে।”

“সন্ধির শর্তাবলী অবশ্যই আমাদের হতে হবে”—হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।

‘সৈন্যদের দৈহিক নাজুক অবস্থার কথা তোমরা ভেবেছ কি?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“শহীদ এবং আহত সৈন্যের গণনা এখনও চলছে। খোদার কসম! এ পর্যন্ত কোন যুদ্ধ আমাদের এত রক্ত পান করেনি, এ যুদ্ধ পান করল এবং হয়ত সামনে আরও রক্ত দিতে হতে পারে।…এটা কি ভাল হয় না যে, পরাজিত শত্রুরা যারা এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে তাদের খুঁজে বন্দী করা হোক, যাতে তারা ইয়ামামার কেল্লায় গিয়ে আমাদের মোকাবিলা করার সুযোগ না পায়?”

“অবশ্যই এটা যথোচিত প্রস্তাব”—হযরত আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তাদের বন্দী করতে পারলে সন্ধিরও বিশেষ কোন যৌক্তিকতা থাকবে না।”

“মুযাআ দাবী করছে যে, যাদের সাথে আমাদের লড়াই হয়েছে তাদের চেয়ে আরো বেশী সৈন্য নাকি ইয়ামামার অভ্যন্তরে বিদ্যমান।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তোমরা আমার এই কথা সত্য বলে মনে কর যে, আমাদের সৈন্যরা ক্লান্ত-শ্রান্ত; লড়াইয়ের উপযুক্ত নেই। তোমরা আরো দেখেছ, আমাদের মুজাহিদরা ক্লান্তিতে এতই ভেঙ্গে পড়েছে যে, তারা যেখানেই জায়গা পাচ্ছে সেখানেই বসে পড়ছে এবং গভীর নিদ্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের রিজার্ভ কোন বাহিনীও নেই। সৈন্য চেয়ে পাঠালেও তাদের আসতে অনেক দিন লেগে যাবে। ইতোমধ্যে শত্রুপক্ষ পুরোদমে সুসংগঠিত ও ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। ফলে তাদের মানসিকতায় আমরা যে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি তা আর বাকী থাকবে না। তারা নয়া শক্তিতে ঘুড়ে দাঁড়াতে পারে।”

“ইবনে ওলীদ!” হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আপনি নিজেও হয়ত এ ব্যাপারে কিছু চিন্তাভাবনা করেছেন।”

“হ্যাঁ, ইবনে উমর।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন—“আমার পরিকল্পনা ছিল প্রথমে এখানে ওখানে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের বন্দী করা হবে এরপর গিয়ে আমরা ইয়ামামা কেল্লা অবরোধ করব। এর মধ্যে মুযাআ ইয়ামামায় গিয়ে অন্যান্য নেতাদের সাথে সন্ধির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করবে। সন্ধির মধ্যে এই শর্ত অবশ্যই থাকবে যে, বনূ হানীফা পরাজয় স্বীকার করে আমাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করবে।”

“এটাই ভালো।” হযরত আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।

“আমার কাছেও এ প্রস্তাব যথোচিত মনে হয়।” হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তাহলে এ পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ এখনই শুরু করে দাও।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“সৈন্যদের এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দিয়ে বল, বনু হানীফার পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা যাকেই যেখানে দেখবে বন্দী করে নিয়ে আসবে।”

বিভিন্ন প্লাটুন চতুর্দিকে পাঠিয়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুযাআকে নিজের সামনে এনে বসান।

“ইবনে মুরারাহ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুযাআকে বলেন—“তোমার উপর আমার আস্থা আছে। আর আমি তোমাকে এ কাজের যোগ্যও মনে করি। যাও, অন্যান্য নেতাদের গিয়ে বল, আমরা সন্ধির জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শর্ত হলো, তোমাদের হাতিয়ার পূর্ণ সমর্পণ করতে হবে।”

“আমি এই শর্তের উপর সন্ধির করাতে চেষ্টা করব।” মুযাআ বলে—কিন্তু ইবনে ওলীদ। নিজের বাহিনীর নাজুক অবস্থার কথা চিন্তা করুন।”

“অতিরিক্ত রক্তপাত থেকে আমি দূরে থাকতে চাই।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তুমি কি চাওনা, আমাদের এবং তোমাদের যারা এখনও জীবিত আছে তারা জীবিত থাকুক। নিজ গোত্রে গিয়ে দেখ, আজ কত হাজার বধূ বিধবা এবং কত হাজার সন্তান ইয়াতিম হয়েছে এবং এটাও মাথায় রেখ যে, বনূ হানীফার কত মহিলা আমাদের বাঁদী হতে চলেছে।”

সে যুগের পাণ্ডুলিপি হতে জানা যায় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই কথা শুনে মুযাআর ঠোঁটে এমন মুচকি হাসি খেলে যায়, যার মধ্যে ঠাট্টা কিংবা বিদ্রূপের আভাস ছিল। সে আর কথা বাড়ায় না। ইয়ামামায় যেতে উঠে দাঁড়ায়।

মুযাআ বলে—“আমি তাহলে চলি। ইবনে ওলীদ! আপনার অভিলাষ পূরণ করতে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুযাআকে বিদায় দিয়ে নিজের তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তিনি পথিমধ্যে লাশ এবং তাঁবু নিরীক্ষণ করতে করতে চলছেন। লায়লা দূর থেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একা দেখে দৌড়ে চলে আসেন।

“আপনি তাকে ছেড়ে দিয়েছেন?” লায়লা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে জানতে চান।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, তিনি কোন উদ্দেশ্যে মুযাআকে ছেড়ে দিয়েছেন।

লায়লা বলেন—“ইবনে ওলীদ! এত মানুষের হত্যার দায়-দায়িত্ব কার উপর বর্তাবে? একসাথে এত লাশ আমি ইতোপূর্বে দেখিনি।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন—“পৃথিবীতে যতদিন পর্যন্ত মানুষের মাঝে ব্যক্তি হীনস্বার্থ হাসিলের মানসিকতা বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত মানুষের রক্ত এভাবে ঝরতেই থাকবে। আমি নিজেও একত্রে এত লাশ দেখিনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর চেয়েও অধিক লাশ দেখবে। সত্য মিথ্যার সংঘর্ষ চলতেই থাকবে।…আমি এ জন্যই সন্ধির চেষ্টা করছি। যেন আর রক্তপাতের ঘটনা না ঘটে।…তুমি আর সামনে এগিয়ো না। সামনের দৃশ্য তুমি বরদাশত করতে পারবে না।”

ইতোমধ্যে আকাশের বুক চিরে শকুনের পাল বিমানের মত নেমে এসে লাশের দেহ খাবলি দিয়ে খেতে শুরু করে। কতক মুসলমান লাশের স্তূপের মাঝে আহত সাথীদের তল্লাশী ও উদ্ধার কাজ করছিল। আহতদের উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাকী সৈন্যরা বনূ হানীফার লুকানো লোকদের গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল।

রাতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সংবাদ পেতে থাকেন যে, বনূ হানীফার লোকদের আনা হচ্ছে। অনেকের সাথে স্ত্রী-সন্তানও ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মহিলা এবং বাচ্চাদেরকে ঠাণ্ডা ও ক্ষুধা হতে রক্ষা করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু পূর্বেই তাঁবু লুণ্ঠনের শিকার হওয়ায় সেখানে খাদ্যের মারাত্মক সংকট ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বন্দী নারী ও শিশুদের উদরপুর্তি করার এবং নিজেদের উপবাস থাকার নির্দেশ দেন।

খাদ্য সংকট সাময়িকভাবে কাটিয়ে উঠতে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় যে, শহীদ মুজাহিদদের দেহের সাথে বাঁধা খেজুর ইত্যাদির থলে খুলে এনে তা দ্বারা বন্দী নারী-শিশুদের আপ্যায়ন করবে। যুদ্ধের সময় প্রত্যেক সৈন্য পানাহারের হাল্কা ব্যবস্থা সাথে রাখতেন।

পর প্রভাতে মুযাআ ইয়ামামা থেকে ফিরে আসে এবং সোজা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাবুতে গিয়ে হাজির হয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান, “কি সংবাদ নিয়ে এলে ইবনে মুরারাহ।”

মুযাআ জবাবে বলে, “খবর মন্দ নয়। কিন্তু তা হয়ত আপনার মনঃপুত হবে না।…বনূ হানীফা পূর্বোক্ত শর্তে সন্ধি করতে প্রস্তুত নয়। তারা আপনাদের গোলামী করতে রাজি নয়।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “খোদার কসম! আমি তাদেরকে আমার গোলাম বানাতে চাই না। আমরা সবাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারী। আমি তাদেরকে এই সত্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আকীদা-বিশ্বাসের গোলাম বানাতে চাই।”

মুযাআ বলে, “তারা এ শর্তও মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এ কথাও বিবেচনায় রাখবেন যে, আপনার সৈন্য মুষ্টিমেয় বৈ নয়। আমি ইয়ামামায় ঢুকে সুসজ্জিত একটি বাহিনী দেখেছি, যারা আপনার এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে রক্তের সাগরে ভাসিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে আছে। ইয়ামামায় গিয়ে অবরোধ করার মত বোকামী করবেন না। তাহলে আস্ত ফিরবেন না। আবেগ ছেড়ে বাস্তবে আসুন। বিচক্ষণতার পরিচয় দিন। শর্ত নমনীয় করুন। আমি বনূ হানীফাকে অনেকটা ম্যানেজ করে ফেলেছি। সেখানকার প্রতিটি সৈন্যের চোখে প্রতিশোধের রক্ত টগবগ করছে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গভীর চিন্তায় ডুবে যান। মুযাআ তাকে নতুন কোন কথা বলে না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও দেখেছিলেন যে, তার বাহিনীর যারা বর্তমানে বেঁচে আছে তারা যুদ্ধের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। তাদের যথেষ্ট আরামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা রাতভর লুকিয়ে থাকা শত্রুদের অনুসন্ধান এবং বন্দী করতে থাকে। দীর্ঘ পরিশ্রম আর অনিদ্রায় রাত যাপনের দরুণ সকালে মুজাহিদদের মাথা রীতিমত ঢুলতে থাকে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গভীর চিন্তা হতে মাথা উঠিয়ে বলেন—“ইবনে মুরারাহ” তোমার হয়ত জানা নেই, যে সমস্ত নেতা এই যুদ্ধে শরীক ছিল তাদের কাছ থেকে জেনে নিও যে, বনূ হানীফার কত অর্থ-সম্পদ আমাদের হস্তগত হয়েছে এবং কত বাগ-বাগিচা ও কয়েদী আমাদের হাতে বন্দী। ফিরে যাও এবং ঐ নেতাদের গিয়ে বল, মুসলমানরা অর্ধেক মালে গনিমত, অর্ধেক বাগ-বাগিচা এবং অর্ধেক বন্দী ফিরিয়ে দিবে। তাদেরকে বুঝাবে, গোয়ার্তুমি করে যেন ইয়ামামা ও তার আশপাশের অঞ্চলকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দেয়।”

ইবনে মুরারাহ চলে যায়। এরই মধ্যে ধৃত কয়েদীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়।

মুযাআ সন্ধ্যার কিছু পূর্বে ফিরে এসে জানায় যে, বনূ হানীফার কোন সর্দার মুসলমানদের শর্ত মানতে রাজি নয়। মুযাআ এটাও উল্লেখ করে যে, বনূ হানীফা তাদের পরাজয় ও হাজার হাজার নিহতের প্রতিশোধ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলেন—“আমার কথা কান খুলে শোন ইবনে মুরারাহ। যদি বনূ হানীফা এটা মনে করে থাকে যে, সংখ্যায় স্বল্পতার কারণে আমরা ভীত হয়ে পড়ব, তবে তাদের গিয়ে বল, মুসলমান জানের বাজী দিবে তবুও তোমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ দিবে না।”

মুযাআ বলে—“ক্রোধে ফেটে পড়বেন না। জনাব! আমাদের থেকে লব্ধ মালে গনিমত, বাগ-বাগিচা এবং কয়েদীদের এক-তৃতীয়াংশ আপনারা রাখুন আর বাদ বাকী আমাদের ফিরিয়ে দিয়ে সন্ধি করে ফেলুন। সন্ধিপত্র অবশ্যই লিখিত হতে হবে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পুনরায় চিন্তার জগতে চলে যান।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গভীর চিন্তামগ্ন দেখে তাকে আরো প্রভাবিত করতে মুযাআ নড়েচড়ে বসে এবং সন্ধির পেছনে তার অবদানের কথা তুলে ধরে।

মুযাআ বলে—“আমি আপনাকে আরেকবার সতর্ক করছি ওলীদের পুত্র। এটা বলতে আপত্তি নেই যে, বনূ হানীফাকে সন্ধিতে রাজী করানোর কৃতিত্ব আমারই। এর জন্য তাদের অগণিত অভিসম্পাত আর অভিশাপ আমাকে মাথা পেতে নিতে হয়েছে। তারা আমাকে গাদ্দারও বলেছে। তারা বলছে, তুমি মুসলমানদের থেকে অর্থ খেয়ে আমাদেরকে তাদের গোলাম বানাতে চাও। তারা আরও বলে, আমাদের সংখ্যা কম হলেও আমরা সন্ধি করতাম না। যুদ্ধ সামগ্রী, খাদ্য কোন কিছুরই আমাদের কমতি নেই। কমতি থেকে থাকলে তা মুসলমানদেরই আছে। তারা বলছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মাঝে মুসলমানরা কতদিন পর্যন্ত অবরোধ করে বসে থাকবে? রাতের বরফ পড়া শীতে তারা খোলা আকাশের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারবে না। তারা এটাও জানে যে, আপনার ক্ষুদ্র বাহিনীর নিকট রাত যাপনের তাঁবুও নেই।…ভাবুন, গভীরভাবে বুঝার চেষ্টা করুন। আমার কথায় আপনার সন্দেহ হলে একটু এগিয়ে গিয়ে ইয়ামামার প্রাচীরের উপর দিয়ে একটিবার নজর বুলান। সেখানে দু’টি দুর্ভেদ্য প্রাচীর দেখতে পাবেন। একটি হলো কেল্লার প্রাচীর। আর দ্বিতীয়টি হলো ঐ প্রাচীরের উপরে মানব দেহের তৈরী আরেকটি প্রাচীর।”

এটা ঠিক যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে পুরো অবগত ছিলেন। কিন্তু তাই বলে শত্রুর প্রতিটি শর্ত তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি তাবু হতে বাইরে বেরিয়ে আসেন। সহ সেনাপতিগণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। অত্যন্ত অস্থিরচিত্তে তারা জানতে চান যে, সন্ধির আলোচনা কতদূর গড়ালো!

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমার সাথে এস।”

সেনাপতিগণ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে রওয়ানা হন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে ব্রিফিং দিতে থাকেন এবং মুযাআ সর্বশেষে সন্ধির যে শর্ত উল্লেখ করেছে তাও তাদেরকে অবহিত করেন। তারা ইয়ামামা অভিমুখে চলতে থাকেন। এমন স্থানে গিয়ে তারা দাড়িয়ে পড়েন যেখান থেকে ইয়ামামা শহরের প্রাচীর দেখা যাচ্ছিল। তারা দেখতে পান যে, সমগ্র প্রাচীর সৈন্যে সুসজ্জিত। তারা নিশ্চিত হয়ে যান যে, শহর প্রাচীরের উপরে আরেকটি মানব প্রাচীর আছে বলে মুযাআ যে তথ্য দিয়েছে তা সম্পূর্ণ সত্য। প্রাচীরের এই অবস্থা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, শহরের অভ্যন্তরে বিপুল সৈন্য রয়েছে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্যান্য সেনাপতিদের লক্ষ্য করে বলেন—“আমার ধারণা, এমতাবস্থায় শহর অবরোধ করলে আমরা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হব। প্রাচীরের উপরে যাদের দেখলাম তাদের তীর আমাদেরকে প্রাচীরের ধারে-কাছে পৌঁছতে দিবে না। ব্যাপক মৃত্যুর হাতে সঁপে দেয়ার জন্য এত লোক আমাদের নেই।”

এক সেনাপতি বলেন—“আমি সন্ধির পক্ষেই রায় দিব।”

আরেক সেনাপতি বলেন, “যে ফিৎনার মূলোৎপাটন করতে আমরা এসেছিলাম তা চিরতরে খতম হয়ে গেছে। এখন আমরা সন্ধি করলে কে আমাদের সম্মুখে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলবে?

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে মতবিনিময় করে নিজের তাঁবুতে ফিরে আসেন এবং মুযাআকে জানান যে, তিনি সন্ধির জন্য প্রস্তুত। তৎক্ষণাৎ সন্ধিনামা লেখা হয়। এতে বনূ হানীফার পক্ষ হতে মুযাআ বিন মুরারাহ এবং খেলাফতের পক্ষ হতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সই করেন। এ সন্ধির একটি পয়েন্ট এই ছিল যে, ইয়ামামায় কোন লোককে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়ে মুসলমানরা তাকে হত্যা করতে পারবে না।

মুযাআ সন্ধিপত্র চূড়ান্ত করে ফিরে যায়। ঐ দিনই মুযাআ ইয়ামামার দরজা খুলে দেয় এবং হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শহরের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অধীনস্ত সেনাপতি ও কমান্ডারদের নিয়ে ইয়ামামার নগর প্রাচীরের প্রধান ফটকের সামনে এসে পৌঁছান। তারা প্রাচীরের উপরে নজর বুলান। সেখানে একটি সৈন্যও ছিল না। কেল্লাও ছিল জনশূন্য। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ধারণা করছিলেন, মুযাআ তাদেরকে যে সৈন্যের ভয় বারবার দেখায়, তারা হয়ত কেল্লার অভ্যন্তরে আছে। কিন্তু কেল্লায় পা দিয়ে তিনি অবাক হয়ে যান। সেখানে সৈন্যের কোন নাম-নিশানা ছিল না। ইতস্তত মহিলা, বাচ্চা এবং বৃদ্ধরা ছিল মাত্র। একজন যুবককেও দেখতে পাওয়া যায় না। মহিলারা নিজ নিজ বাড়ীর সামনে দাড়িয়ে ছিল। কতক আশে-পাশের বাজারে বসা ছিল। অধিকাংশ মহিলা কাঁদছিল। তাদের কারো পিতা, কারো ভাই, কারো পুত্র, কারো স্বামী যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুযাআকে জিজ্ঞাসা করেন—“সৈন্যরা কোথায় গেল?”

বিভিন্ন দরজা ও ঘরের ছাদে অসহায়ভাবে দাঁড়ানো মহিলাদের প্রতি ইশারা করে মুযাআ বলে—“আপনি সৈন্যদের দেখতে পারছেন জনাব খালিদ! এই ঐ সৈন্য যারা তীর-কামান আর বর্শায় সুসজ্জিত হয়ে প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়েছিল।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিস্মিত হয়ে বলেন—“এই নারীরা?”

মুযাআ বলে—“হ্যাঁ, জনাব খালিদ। শহরে সৈন্য বলতে কেউ নেই। এখানে কেবল যুদ্ধাক্ষম বৃদ্ধ, নারী আর শিশু রয়েছে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান—“এরা আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারত?” নারীরা প্রতিরোধে নেমে আসত?”

মুযাআ বলে—“না ইবনে ওলীদ! এটা আমার একটি চাল ছিল মাত্র। শহরের সকল পুরুষ মূল লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে চলে গিয়েছিল। শহরে যুবক বলতে কেউ ছিল না। আমি নিজের গোত্রকে কৌশলে বাঁচাতে চেয়েছি মাত্র। আমিই সকল নারী, বৃদ্ধ এবং বালকদের বর্মাচ্ছাদিত এবং মাথায় শিরস্ত্রাণ পরিয়েছিলাম। অতঃপর তাদের হাতে তীর-তূণীর এবং বর্শা দিয়ে প্রাচীরের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজে বাইরে গিয়ে তাদের কৃত্রিম সৈন্যের অভিনয় দেখেছিলাম। খোদার কসম ইবনে ওলীদ। আমি নিজেও ধরতে পারছিলাম না যে, এরা নারী, বৃদ্ধ এবং বালকের সমন্বয়ে গঠিত কৃত্রিম বাহিনী; বরং আমার চোখেও এদেরকে নিয়মিত সৈন্যের মত মনে হয়েছে। আমি এদের এভাবে প্রস্তুত করে আপনাকে এক নজর দেখার জন্য সুযোগ দিয়েছিলাম। যাতে আপনি আমার ফাঁদে পা দেন এবং আপনার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, ইয়ামামায় বাস্তবেই অনেক সৈন্য রয়েছে।…এরপর আমার পরিকল্পনা মত সবকিছু চলে। আপনি দেখে শুনে এবং যাচাই করে আমার ফাঁদে পা দিলেন।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তিনি মুযাআকে এই চরম প্রতারণার সমুচিত শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু যে চুক্তিপত্রে তিনি একবার স্বাক্ষর করেছেন তার কোন শর্ত ভঙ্গ করতে তিনি রাজি ছিলেন না।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুযাআকে বলেন—“খোদার কসম! তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছ।”

মুযাআ বলে—“আমি আপনাকে ধোঁকা দিতে পারি কিন্তু আমার গোত্রের সাথে গাদ্দারী করতে পারি না। আপনার তলোয়ার থেকে তাদের বাঁচানই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আমি তাদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তোমার কপাল ভাল যে আমি মুসলমান। ইসলাম কৃত চুক্তি ভঙ্গের অনুমতি দেয় না। সন্ধিপত্রে আমার স্বাক্ষর হয়ে গেছে। নতুবা আমি তোমার গোত্রের এই সকল নারীকে বাঁদীতে পরিণত করতাম।”

মুযাআ বলে—“আমার জানা ছিল যে, সন্ধিপত্রে স্বাক্ষরের পর আপনি এমনটি করবেন না।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“কিন্তু একটি কথা মনে রেখ ইবনে মুরারাহ। আমার সন্ধি কেবল ইয়ামামা শহরবাসীদের জন্য। আশ-পাশের অঞ্চলের লোক এর আওতাধীন নয়। ইয়ামামা শহরের কোন ব্যক্তিকে আমি যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়ে হত্যা করব না ঠিকই কিন্তু ইয়ামামার বাইরে যাকে আমি হত্যার যোগ্য বলে মনে করব তার মস্তক ধরায় লুটাতে আমি সন্ধিপত্রের তোয়াক্কা করব না।

বাইশ

ধর্মান্তরিতের হেড কোয়ার্টার ছিল ইয়ামামায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুজাহিদ বাহিনীর বুলডোজার দিয়ে তা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ধুলিস্যাৎ করে দেন। ভণ্ড নবীকে নিপাত করে তার মরদেহ শহরের অলি-গলিতে প্রদর্শন করা হয়। মুসাইলামার ভক্তদের বলা হয়, সত্যিকার অর্থে তোমাদের নবীর কাছে অলৌকিক শক্তি কিংবা মোজিযা থাকলে ৪০ হাজারেরও বেশী সৈন্যের এমন শোচনীয় পরাজয় মাত্র ১০ হাজার সৈন্যের হাতে হত না।

মুসলমানরা ইয়ামামার অলি-গলিতে ঘোষণা করতে থাকে—“বনূ হানীফা। নারীদের ভয় নেই। তাদেরকে বাঁদী বানানো হবে না। শহরের অভ্যন্তরের কোন পুরুষ, শিশু কিংবা নারীর উপর হাত তোলা হবে না। মুসাইলামা আস্ত ভণ্ড এবং প্রতারক ছিল। সে তোমাদেরকে ধোঁকার জালে বন্দী করে তোমাদের ঘর-বাড়ী আজ বিরান করে গেছে।”

ভয়, আতংক আর মৃত্যু ইয়ামামাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। মহিলারা শহর থেকে বাইরে বের হতে রীতিমত ভয় পাচ্ছিল। এ ভয় ও আতংক মুসলমানদের কারণে ছিল না। স্বজনদের বিভৎস লাশ চোখে পড়ার ভয়ে তারা আতংকিত ছিল। নগর প্রাচীরে দাঁড়িয়ে তারা শহরের বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছিল। চিল, শকুন আর নেকড়ে বাঘের ভয়ংকর আওয়াজ তারা শুনতে পাচ্ছিল। হিংস্র ও বন্যপ্রাণীগুলো রণাঙ্গনে পড়ে থাকা মৃত সৈন্যদের লাশ খাচ্ছিল।

ইয়ামামা ও তার আশে-পাশের অঞ্চলের লোকেরা এত বিপুল প্রাণহানির কথা ইতোপূর্বে কখনো শুনেনি এবং দেখেনি। এটা গযব নাযিল হওয়ার মত ছিল। ঘরে ঘরে শোক আর মাতম চলে। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে মানুষ সেই অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশে সেজদাবনত হতে আকুলি-বিকুলি করছিল যিনি তাদের উপর এভাবে গযব নাযিল করেছেন। মুসলিম বাহিনীর মাঝে তখনও অনেক হাফেজ ও কারী সাহাবা ছিলেন। তারা লোকদেরকে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে বুঝিয়ে দিতে থাকেন যে, তাদের বিনাশকারী গায়েবী শক্তির উৎস কি বা কোথায়?

ঐতিহাসিকদের অভিমত, বনূ হানীফার যারা যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পলায়ন করেছিল তাদের সংখ্যা ২০ হাজারের মত ছিল। তারা এদিক-ওদিক আত্মগোপন করার মাধ্যমে লাপাত্তা হয়ে যায়। মুসলমানরা খুঁজে খুঁজে তাদের ধরে আনতে থাকে। তারাও ছিল রীতিমত ভীত ও আতংকিত। অনেকে অনুতাপ এবং অনুশোচনায় দগ্ধও হতে থাকে। কেননা তারা এমন এক ভণ্ড নবীর হাতে বাইয়াত হয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যে তাদেরকে এই কথা বলে প্রতারিত করেছিল যে, খোদা তাকে এমন এক শক্তি দান করেছেন যার ফলে বিজয় তাদেরই হবে আর মুসলমানরা নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বীনের তাবলীগ এবং ইসলামের ব্যাপক পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন হয় না তাদের। অধিকাংশই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।

বনূ হানীফার নেতৃত্বের প্রশ্নে মুযাআ বিন মুরারা মুসাইলামার স্থলাভিষিক্ত ছিল। গোত্রের লোকদের গণহারে মুসলমান হতে দেখে সে এটা ভেবে আশ্বস্ত হয় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অন্তরে তার প্রতি যে অসন্তুষ্টি রয়েছে এতে নিশ্চয় তার অবসান হবে।

বনূ হানীফার লোকেরা বানের ঢলের মত হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে বাইয়াত হতে আসতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের মধ্য হতে নেতৃস্থানীয় কিছু লোকের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল গঠন করেন এবং খলিফাতুল মুসলিমীনের হাতে বাইয়াত হওয়ার জন্য তাদের মদীনায় প্রেরণ করেন।

এ যুদ্ধে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে চড়া মূল্য দিতে হয়। প্রাচীন নথিপত্র এবং অন্যান্য সূত্রের বরাতে অনুমিত হয় যে, বিশাল এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের আশা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অত্যন্ত ক্ষীণ ছিল। তিনি সম্পূর্ণ আল্লাহ তা’আলার উপর আস্থা এবং নিজের সমর যোগ্যতার বলে লড়েছিলেন। তার মেরুদণ্ড ক্লান্তিতে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল।

ইয়ামামা যুদ্ধের ভয়াবহতার অনুমান এভাবে করা যেতে পারে যে, এ যুদ্ধে বনূ হানীফার ২১ হাজার সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আহতদের সংখ্যা ছিল গণনার বাইরে। এর বিপরীতে মুজাহিদ বাহিনীর শহীদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২ শত। শহীদদের মধ্যে ৩০০ ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেয।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইয়ামামা যুদ্ধে ৩০০ হাফেযে কুরআন সাহাবীর শহীদ হওয়ার সংবাদ শুনে খলিফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রতি রণাঙ্গনে এভাবে হাফেয সাহাবা শহীদ হতে থাকলে পবিত্র কুরআনের ভবিষ্যৎ কি হবে—এই প্রশ্ন তাকে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। তিনি লিখিত আকারে কুরআন সংরক্ষণের প্রতি মনোযোগী হন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে কাতেবে ওহী হযরত যায়েদ বিন সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাঁধে এ গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন যে, তিনি পবিত্র কুরআনের অরক্ষিত ও বিক্ষিপ্ত মূল কপি এক ফাইলে জমা করে সংরক্ষণ করবেন। ভলিউম আকারে আজ যে কুরআন আমাদের কাছে শোভা পাচ্ছে, তা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঐ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ও পরবর্তিতে হযরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কৃতিত্ব ও অবদানের ফল।

ইয়ামামা যুদ্ধের পর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন। তার দৈহিক ও মানসিক শক্তি লোপ পেয়েছিল প্রায়। লায়লা তাঁর অবসন্ন শরীরে শক্তি যোগাতে চেষ্টা করেন। তাকে প্রবোধ দেন। ভেঙ্গে পড়তে দেন না। তার মানসিক শক্তি জাগিয়ে তোলেন। অকল্পনীয় প্রাণহানিতে তিনি সাময়িকভাবে মুষড়ে পড়লেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেন। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, ইতিপূর্বের কোন যুদ্ধে মুসলমানদের এত প্রাণহানি ঘটেনি। কেবল এই একটি যুদ্ধই তাদের ১ হাজার ২ শত সাথীকে কেড়ে নেয়। সাথীদের এহেন ব্যাপক শাহাদাতে অবশিষ্ট মুজাহিদগণের উপর দুঃখের পাহাড় নেমে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শোকাহত হলেও দ্রুত সে শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। অন্যদের মত শোকে পাথর হয়ে গেলে কিংবা বিলাপচারিতায় নিজেকে হারিয়ে ফেললে নেতৃত্ব দান অব্যাহত রাখতে পারতেন না। অথচ তাঁর সামনে ইরাক এবং সিরিয়া বিজয়ের হাতছানি ছিল। ধর্মান্তরিতের ফিৎনার মূলোৎপাটন করে দূর দিগন্তে ইসলামের ঝাণ্ডা উড়াতে কুদরত তাঁকে আহ্বান করছিল। ফলে তিনি নিজেকে শোকে পাথর হতে দেননি। দুঃখ-বেদনা হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

একদিন লায়লা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন—“ওলীদের পুত্র! এই মহান বিজয়ে আমি আপনাকে একটি উপঢৌকন দিতে চাই।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আল্লাহর সন্তুষ্টিই কি আমার জন্য যথেষ্ট নয়?”

লায়লা বলেন—“সেটা তো আপনি পেয়েই গেছেন। আপনি আল্লাহ্‌র তরবারী। আমি পার্থিব একটি উপঢৌকনের কথা বলছিলাম। আপনি আসলে ভীষণ ক্লান্ত।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করেন—“তা সে উপঢৌকন কি জানতে পারি?”

লায়লা বলেন—“মুযাআ বিন মুরারার কন্যা। আপনি তাকে দেখেননি। আমি তাদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। অপূর্ব সুন্দরী। ইয়ামামার হীরা। সে আপনাকে ভালবাসে। সে আপনার প্রশংসা করে বলে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু একজন বড় মাপের মানুষ। তিনি আমাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েও ঘোষণা করেছেন যে, কোন নারীকে বাঁদী বানানো হবে না। অথচ এই নারীরাই তাকে ধোঁকা দিয়েছিল।”

তৎকালীন আরবে সতীন কালচার ছিল না। একজন পুরুষের জন্য একাধিক স্ত্রী রাখা গর্বের বিষয় ছিল। স্ত্রীরাও স্বামীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে নিজেরাই সুন্দরী-রূপসী পাত্রী খুঁজে বিবাহ করিয়ে দিত। তাদের মধ্যে বর্তমানের সংকীর্ণতার নাম-গন্ধও ছিল না। লায়লার প্ররোচনা ও পীড়াপীড়িতে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিবাহ করতে রাজী হন। তিনি মুযাআ বিন মুরারার কাছে গিয়ে সরাসরি প্রস্তাব পেশ করেন যে, তিনি তার কন্যার পাণিপ্রার্থী। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অতর্কিত এ প্রস্তাবে মুযাআ এত বিস্মিত হয় যে, সে নিজের কানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করাতে পারে না। সে এটাকে কর্ণভ্রম কিংবা দিবাস্বপ্ন বলে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু পরক্ষণে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর উপর চোখ পড়তে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে লক্ষ্য করে কি যেন বলছেন। কিন্তু কি বলছেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায় সে।

মুযাআ জিজ্ঞাসা করে—“কি বললেন জনাব খালিদ!”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্বের প্রস্তাব আওড়ান—“তোমার কন্যাকে আমি বিবাহ করতে চাই।”

মুযাআ বলে—“এতে খলিফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু আমাদের উভয়ের প্রতি রুষ্ট হবেন না?”

মুযাআ প্রথমে আপত্তি করলেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আগ্রহ দেখে তিনি রাজি হয়ে যান। অতঃপর এক শুভক্ষণে মুযাআর যুবতী রূপসী কন্যার সাথে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শুভ পরিণয় হয়ে যায়। এই নতুন বিবাহের খবর মদীনায় পৌঁছলে খলিফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর পত্র লিখেন”

“উহ্ ওলীদের পুত্র! তোমার হলোটা কি? তুমি এ কি শুরু করলে? একের পর এক বিবাহ করে যাচ্ছ। অথচ তোমার তাঁবুর বাইরেই তো বারশ মুসলমানের রক্ত ঝরেছে। শহীদদের রক্তও তুমি শুকাতে দিলে না।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পত্র পড়েই মন্তব্য করেন—এটা হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাজ।”

মোটকথা, ব্যাপারটা বেশী দূর গড়ায় না। পত্রযোগে ভর্ৎসনার মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায়। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এ পয়গামও প্রেরণ করেছিলেন যে, তিনি ইয়ামামাতেই অবস্থান করবেন এবং হেড কোয়ার্টার থেকে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করবেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খলিফার নির্দেশ মোতাবেক মুযাআর কন্যা এবং লায়লাকে নিয়ে ইয়ামামার নিকটবর্তী ওবার উপত্যকায় যান এবং সেখানে তাঁবু স্থাপন করে অবস্থান করতে থাকেন। দীর্ঘ দু’মাস পরে তিনি পরবর্তী নির্দেশ পান।

৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ। ১১ হিজরীর জিলক্বদ মাসের শেষ লগ্ন। এ সময়ে খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে এক বিশেষ সাক্ষাতে মদীনায় এক ব্যক্তির আগমন হয়। তিনি নিজেকে মুসান্না বিন হারেস নামে পরিচয় প্রদান করেন। খোদ খলীফা এবং মদীনাবাসীর নিকট তিনি অতি সাধারণ বরং একজন অপরিচিত বলে প্রতিপন্ন হন। এ জাতীয় লোক কোন বাদশাহর দরবারে গেলে নিঃসন্দেহে তাকে সেখান থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হত। কিন্তু মহামতি হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সাধারণ বাদশা ছিলেন না, বরং তিনি দোজাহানের সম্রাট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খলীফা ছিলেন, যার দ্বার যে কোন ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত থাকত।

খলীফার দরবারে প্রবেশের সময় আগন্তুকের চেহারায় ক্লান্তি আর বিনিদ্র রজনীর গভীর ছাঁপ ছিল। পোষাক-পরিচ্ছদ ধুলিময় এবং তিনি নিজ শক্তিতে কথাও বলতে পারছিলেন না।

হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন—“এই ভিনদেশী অতিথির পরিচয় কেউ বলতে পারে কি?”

“মুসান্না বিন হারেস নামে নিজেকে পরিচয় দানকারী কোন সাধারণ ব্যক্তিত্ব নন”—হযরত কায়েস বিন আসেম আল মুনকিরী রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন—“আমিরুল মু‘মিনীন! লোকটির এখানে আসার পেছনে কোন দুরভিসন্ধি নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে সে ইতোমধ্যে যে খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছে তা রীতিমত ঈর্ষণীয়। ইরাকের পারস্য সেনাপতি হুরমুজ এবং সর্বত্র খ্যাতি অর্জনকারী তার সৈন্যরা পর্যন্ত এই মুসান্না ইবনুল হারিস এর নাম শুনে কেঁপে ওঠে।”

আরেকজন বলেন—“আমীরুল মু‘মিনীন! আপনার ভিনদেশী মেহমান বাহরাইনের বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের একজন সম্মানিত সদস্য। যারা ইসলাম গ্রহণ করে কুফর ও মুরতাদের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের মাঝেও ইসলামের চেরাগ জ্বালিয়ে রেখেছেন ইনি তাদের অন্যতম। আমাদের সেনাপতি হযরত আলা ইবনে হাযরমী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি ইরাকের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুরতাদদের বিরুদ্ধে অসংখ্য রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন।”

আগন্তুকের উচ্চ পরিচয় পেয়ে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চেহারা আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। এবার তিনি হযরত মুসান্না বিন হারেস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকান। এ দৃষ্টি ছিল সম্মান নিংড়িত শ্রদ্ধা বিজড়িত। সাথে সাথে তার চোখে ভেসে ওঠে আরব মুসলমানের ঐ সমস্ত গোত্র যারা এক সময় ইরানীদের প্রজা ছিল। ইরাক অঞ্চল জুড়ে ছিল এদের আবাদ-বসতি। বনূ লাখাম, বনূ তাগাল্লুব, বনূ আয়াদ, বনূ নাম্বার এবং বনূ শায়বান ছিল তাদের অন্যতম। এক তথ্য অনুযায়ী তারা আদি আরব ছিল। এক যুদ্ধে ইরানীরা তাদেরকে যুদ্ধবন্দী করে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে দজলা এবং ফোরাতের মোহনাবর্তী এলাকায় পুনর্বাসিত করে।

তারা ইরানীদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হলেও নিজেদের সনাতন আকীদা-বিশ্বাস এই নতুন আবাসেও আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। আরব ভুখণ্ডে ইসলামের জাগরণ শুরু হলে তারাও ইসলামে দীক্ষিত হয়ে যায়। ইরাক থেকে সায্‌যাহ এর মত লোক নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী তুললে এই আরব প্রজারা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তারা এ ফিৎনার মোকাবিলায় সোচ্চার হয়ে ওঠে। ইসলাম রক্ষায় তারা নিজ উদ্যোগে পৃথক রণাঙ্গন সৃষ্টি করে।

এদিকে ক্রমে মুসলিম বাহিনী এমন এক সমর শক্তিতে রূপ নেয় যে, তাদের সামনে মুরতাদ এবং কুফরীবাদের সম্মিলিত শক্তিও টিকে থাকতে পারে না। রণাঙ্গনের বাইরেও মুসলমানরা যে অমায়িক আচরণ ও কালজয়ী আদর্শ পেশ করত তা যে কোন ব্যক্তির অন্তরে রেখাপাত এবং গভীর প্রভাব সৃষ্টি করত। এভাবে মুসলমানরা দিকে দিকে সমর ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাব বিস্তার করে চলছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তারা অগ্নিপূজারী তৎকালীন পরাশক্তি ইরানীদের বিরুদ্ধে লড়ার উপযুক্ত হয়েছিল না। তৎকালীন বিশ্বের শীর্ষ শক্তিধর এক বিশাল সাম্রাজ্য ছিল ইরান। এ সাম্রাজ্য এতই বিস্তীর্ণ ছিল যে, তার আয়তন বা সীমানার কোন হিসাব ছিল না। সেনা সংখ্যা এবং অস্ত্র-শস্ত্রের আধিক্যে তারা সমকালীন পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত ছিল। ইরান শক্তির মোকাবিলা করার মত তৎকালে কেবল রোম শক্তিই ছিল। রোম শক্তির সাথে নিয়মিত সংঘর্ষের ফলে শেষের দিকে এসে ইরান শক্তি কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।

বিপুল সমর শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ইরান সাম্রাজ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পয়গাম পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ইরানীরা ইসলাম গ্রহণে কেবল অপ্রস্তুতই ছিল না; বরং তারা ইসলাম নিয়ে রীতিমত ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। মুসলিম কোন দূত তাদের শাসনাধীন কোন এলাকার গভর্নরের কার্যালয়ে প্রবেশ করলে তাকে অপমান করত এবং কাউকে বন্দী করে রাখত।

রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তাধারাই ভিন্ন প্রকৃতির। বড় বৈচিত্র্যময় তাদের স্বভাব। তাদের চিন্তা-ভাবনার গতি সমঝোতা ও পরিস্থিতি কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। যে কোন মুহুর্তে তারা সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে। কিন্তু আপামর জনতার চিন্তাজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের জযবা-অনুপ্রেরণা। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির বিরুদ্ধেও তারা বুক টান-টান করে দাঁড়িয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *