৩.১৬ উত্তরার্চিক — ষোড়শ অধ্যায়

উত্তরার্চিক — ষোড়শ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে)– ১।৩।৪।৭।৮।১৫।১৭-১৯ ইন্দ্র; ২ ইন্দ্রাগ্নী; ৫১৬ অগ্নি; ৬ বরুণ; ৯ বিশ্বকর্মা;১০।২০।২১ পবমান সোম; ১১ পূষা; ১২ মরুৎগণ; ১৩ বিশ্বদেবগণ; ১৪ দ্যাবাপৃথিবী।
ছন্দ—১।৩-৫।৮।১৭-১৯ প্রগাথ; ২।৬।৭।১১
১৬ গায়ত্রী; ৯ ত্রিষ্টুপ; ১০ অত্যষ্টি; ২০ উষ্ণিক; ২১ জগতী।
ঋষি- প্রতিটি সূক্তের শেষে যথাযথ উল্লেখিত।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– অভি ত্বা পূর্বপীয় ইন্দ্র স্তোমেভিরায়বঃ। সমীচীনাস ঋভবঃ সমস্বরন রুদ্রা গণন্ত পূর্ব৷৷৷৷৷ অস্যেদিন্দ্রো বাধে বৃষ্ণং শবো মদে সুতস্য বিষ্ণবি। অদ্যা তমস্য মহিমানমায়বোহনু বন্তি পূর্বথা৷ ২৷৷

সূক্ত ২– প্র বামচন্তুথিনো নীথাবিদো জরিতারঃ। ইন্দ্রাগ্নী ইষ আ বৃণে। ১। ইন্দ্রাগী নবতিং পুরো দাসপত্নীরধুনুতম্। সাকমেকেন কমণা। ২৷৷ ইন্দ্রাগ্নী অপসম্পর্যপ প্র যন্তি ধীতয়ঃ। ঋতস্য পথ্যা৩অনু৷ ৩৷৷.. ইন্দ্রাগ্নী তবিষাণি বাং সধস্থানি প্রয়াংসি চ। যুবোরপ্তং হিত৷৷ ৪৷৷

সূক্ত ৩– শগ্ধ৩ শচীপত ইন্দ্রং বিশ্বাভিরুতিভিঃ। ভগং ন হি ত্বা যশসং বসুবিদমনু শূর চরামসি৷৷৷৷ পৌরো অশ্বস্য পুরু গবামস্যুৎসো দেব হিরণ্যয়ঃ। ন কিৰ্হি দানং পার মর্দিষৎ ত্বে যদ্য দ্যামি তদাভর৷ ২৷৷

সূক্ত ৪– ত্বং হেহি চেরবে বিদা ভগং বসুয়ে। উদ বাবৃষস্ব মঘব গবিষ্টয়ে উদিশ্বমিষ্টয়ে॥১॥ ত্বং পুরু সহস্রাণি শতানি চ যূথা দানায় মংহসে। আ পুরন্দরং চকৃম বিপ্রবচস ইন্দ্রং গায়ন্তোহবসে ॥২

সূক্ত ৫– যো বিশ্বা দয়তে বসু হোতা মন্দ্রো জনানাম্‌। মঘোর্ন পাত্ৰা প্ৰথমা ন্যস্মৈ প্র স্তোমা যন্ত্রগুয়ে। ১। অশ্বং ন গীভী রথ্যং সুদানবো মর্ত্যন্তে দেবয়ব। উভে তোকে তনয়ে দস্ম বিল্পতে পর্ষি রাধো মঘঘানাম্ ৷ ২৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– হে প্রমৈশ্বর্যশালী ভগবন ইন্দ্রদেব! শ্রেয়ঃকামী অর্থাৎ দেবত্ব অভিলাষী সাধুগণ চিরকাল ভক্তিসুধা গ্রহণের জন্য স্তোত্রের দ্বারা আপনাকে অনুসরণ করছেন; সম্যক জ্ঞানবান্ অর্থাৎ আত্মতত্ত্বদর্শী মেধাবিগণ অর্থাৎ সংসার-সাগর-উত্তীর্ণ নরদেবগণ সম্যকরূপে আপনার স্তুতি করেছেন– অনুসরণ করেছেন; রৌদ্রভাবাপন্ন দেবগণ অর্থাৎ বিবেকরূপী দেবগণ (বিবেক অনুসারী জনগণ) আদি-অন্তরহিত চিরনূতন আপনাকে স্তব করছেন। অতএব হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরাও ভগবৎপরায়ণ হও। এটাই মন্ত্ৰার্থ। (ভাব এই যে, ভগবৎ-আরাধনা সকলেরই সুখদায়ক। অজ্ঞানতার দূরীকরণে জ্ঞানীকে, সৎপদ প্রদর্শনে ধর্মমার্গের অনুসারিগণকে, করুণা-বিতরণে নিরহঙ্কার জনগণকে এবং কর্মসামর্থ্যহীন জনের পরিচালনায়, ভগবান্ সর্বদা নিরত আছেন। অতএব যে জীব! শ্রেয়ঃলাভের জন্য সদাই ভগবানের আরাধনাপরায়ণ হও। মন্ত্রটি এমনই আত্ম-উদ্বোধনমূলক)। [ঋভুগণ বা ঋভুদেবগণ মেধাবিগণ। এঁরা প্রকৃতপক্ষে নরদেব; অর্থাৎ মানুষরূপেই মর্তে জন্মগ্রহণ করেন। পরে আপন সৎকর্মের ফলে দেবত্ব লাভ করেন। এঁদের সম্বন্ধে নানা উপাখ্যান প্রচলিত আছে। একটি পৌরাণিক উপাখ্যান, – অঙ্গিরোবংশীয় সুধম্বার তিনটি পুত্র ছিল। সেই তিন পুত্রের নাম, ঋভু, বিভু ও বাজ। জ্যেষ্ঠের নাম অনুসারে তারা একযোগে ঋভুগণ নামে পরিচিত হন। ইন্দ্রের তুষ্টির জন্য তারা বহুশ্রমসাধ্য কর্মসম্পাদন করেছিলেন। তারই ফলে তারা পূজাৰ্হ হন। কথিত আছে– এখন তারা তিনজন সূর্যলোকে বসতি করছেন। সূর্যের রশ্মির মধ্যে তাদের, অস্ফুট পরিচয়-চিহ্ন বিদ্যমান। ঋভুগণ ইন্দ্রের ঘোটকদের ইন্দ্রের জন্য শিক্ষিত করেছিলেন; অর্থাৎ ঋভুগণ ইন্দ্রের ঘোটকের শিক্ষক বা তত্ত্ববধায়ক ছিলেন। আর, তারা চমস ইত্যাদি যজ্ঞীয় পাত্র নির্মাণ করতেন এবং সেইজন্য যজ্ঞীয়ত্ব (দেবত্ব) প্রাপ্ত হন। এই মন্ত্রার্থে রুদ্রাঃ পদের অর্থ রৌদ্রভাবাপন্নাঃ দেবাঃ, বিবেকরূপিণঃ দেবাঃ ইত্যাদি। — রুদ্র বলতে প্রধানতঃ শিবকে বোঝায়। একাদশ গণদেবতাও রুদ্র নামে অভিহিত হন। তাদের নাম– অজ, একপাদ, অহিব্ৰধু, পিণাকী, অপরাজিত, এ্যম্বক, মহেশ্বর, বৃষাকপি, শম্ভু, হর ও ঈশ্বর। মতান্তরে, রুদ্র বলতে অজৈকপাদ, অহিত্ৰধ, বিরূপাক্ষ, সুরেশ্বর, জয়ন্ত, বহুরূপ, ত্র্যম্বক ইত্যাদি। সায়ণাচার্য রুদ্রা পদের অর্থ করেছেন এইভাবে– রুদ্রপুত্ৰা মরুতশ্চ। এমন অর্থ থেকেও এক উপাখ্যানের অবতারণা হয়। সেখানে বলা হয়েছে বৃত্রাসুর বধের সময় মরুৎ-দেবগণ ব্যতীত সকল দেবতাই ইন্দ্রকে পরিত্যাগ করে পলায়ন করেন। সেই থেকে তারা ইন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হন; এবং সোমপানে ইন্দ্রের সহকারিত্ব লাভ করেন। রুদ্রাঃ পদে আরও নানা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়ে থাকে। তাতে বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনেক স্থলেই নানারকম জটিলতার সৃষ্টি করে। এই মন্ত্রার্থে এই পদে যাঁরা কঠোর তপঃ রূপ রৌদ্রভাবের দ্বারা নিজেদের অন্তরস্থ শত্রুদের বিনাশ সাধন করতে পেরেছেন, যাঁরা নির্মল হৃদয়, ভগবৎ-পরায়ণ, তাঁদের অভিহিত করা হয়েছে। এই মানুষই যে, কর্মের প্রভাবে দেবতা হতে পারে, ভগবান্ রুদ্রের মতো জীবন্মুক্ত হতে পারে; তাদেরই লক্ষ্য করা হয়েছে। ঋভবঃ এবং রুদ্রাঃ সদাকাল ভগবানের আরাধনা করেন। এইভাবে বিশ্লেষণে দেখা যায়– ভগবানের আরাধনায় মনোনিবেশ করলে, তার পূজাপরায়ণ হলে অর্থাৎ সৎকর্মে জীবন-মন উৎসর্গ করলে যে শ্রেয়ঃলাভ অবশ্যম্ভাবী, মন্ত্র আদর্শ সেই উপদেশ বক্ষে ধারণ করে আছে]।

১/২– ভগবান্ ইন্দ্রদেব প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বের পরমানন্দ দানের জন্য সাধকের আত্মপোষণ-সমর্থ বল প্রবর্ধিত করেন; সাধকগণ নিত্যকাল ভগবানের প্রসিদ্ধ সেই মাহাত্ম্য আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ সাধকবর্গকে পরাশক্তি প্রদান করেন; সাধকগণ নিত্যকাল ভগবৎ-মাহাত্ম্য কীর্তন করেন। [এই সূক্তের ঋষি– মেধ্যাতিথি কাণ্ব। এই সূক্তটির অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম—বষটকারনিধনম এবং কণ্বরথন্তরম]।  

২/১– হে বলাধিপতি ( ইন্দ্র) এবং জ্ঞানদেব (অগ্নি)! বেদজ্ঞ মন্ত্রাভিজ্ঞ প্রার্থনাপরায়ণ সাধকগণ আপনাদের আরাধনা করেন; আত্মশক্তিলাভের জন্য আমি আপনাদের আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। প্রার্থনামূলকও বটে। এর ভাব এই যে, সাধকগণ ভগবানকে আরাধনা করেন; আমরাও যেন ভগবৎ-পরায়ণ হই)।

২/২– হে বলাধিপতি এবং জ্ঞানদেব! আপনারা রিপুগণের রক্ষক, (অথবা সাহায্যকারী) অসংখ্য আশ্রয়স্থান (অথবা প্রভূতশক্তি) যুগপৎ অবহেলায় বিনাশ করেন। (নিত্যসত্যমূলক মন্ত্রটির ভাব এই যে, ভগবানই লোকবর্গের রিপুনাশক হন)।

২/৩– হে বলাধিপতি এবং জ্ঞানদেব! আপনাদের কৃপায় আমাদের চিত্তবৃত্তিসমূহ সত্যের পথ লক্ষ্য করে সৎকর্মের অভিমুখে গমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — ভগবানের কৃপায় আমরা যেন সত্যপরায়ণ সৎকর্মসাধক হই)। [সত্যের আলোকরেখাকে লক্ষ্য করে যদি চলতে পারি, তবে আমাদের সম্মুখস্থ অন্ধকাররাশিকেও ভয় নেই। সেই ধ্রুবজ্যোতিঃ ধ্রুবতারা এ সত্য, অনন্ত অবিনশ্বর সত্য। যিনি সেই সত্যের পথে চলতে সমর্থ হন, তাঁর আর অধঃপতনের ভয় থাকে না। তাই সেই সত্যের পথে চলবার শক্তি লাভ করবার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হচ্ছে]।

২/৪– হে বলাধিপতি ও জ্ঞানদেব! আপনাদের শক্তি ইত্যাদি এবং ঊর্ধ্বগমনদায়ক পরমাশ্রয় একত্র নিবাস করে; আপনাদের অমৃতদানের শক্তি আমাদের পরমমঙ্গলদায়িকা হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই কেবলমাত্র লোকবর্গের পরমাশ্রয় হন। তিনি আমাদের পরমমঙ্গল সাধন করুন)। [মন্ত্রের প্রথমাংশের মর্ম এই যে, ভগবানই মানুষকে পরমধন-পরমাশ্রয় প্রদান করেন। প্রয়াংসি পদ গমনার্থক যা ধাতুমূলক। প্রকৃষ্টরূপে যাতে গমন করা যায়, বা গমন করে যাতে প্রকৃষ্টরূপে স্থিতি লাভ করা যায়– প্রয়াংসি পদে তা-ই বোঝায়। সেই বস্তু কি?– পরমপদ ভগবৎ-আশ্রয়। সেই পরমাশ্রয় ও ভগবৎশক্তি একত্র অবস্থিতি করে অর্থাৎ ভগবৎশক্তিই সেই আশ্রয়ের কারণ। দ্বিতীয়াংশের প্রার্থনার মর্ম এই যে, ভগবৎশক্তি, তার অমৃতদায়িকা শক্তি আমাদের চরম ও পরমমঙ্গল সাধন করুক। অপ্র্যং  পদের অর্থ– অমৃতদায়কঃ। ভগবানের সেই শক্তিই আমাদের মঙ্গলের পথে নিয়ে যাক। আমাদের বাক্য, চিন্তা, কর্ম মঙ্গলময় হোক– এটাই প্রার্থনার ভাবার্থ প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটির ভাব কেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তা বোঝাবার জন্য একটি বঙ্গানুবাদ উদ্ধৃত হলো– হে ইন্দ্রাগ্নি! তোমাদের বল ও অন্ন তোমাদের দুজনের মধ্যে অবিযুক্তভাবে আছে, এবং বৃষ্টি-প্রেরণরূপ কার্য তোমাদের দুজনেতেই নিহিত আছে। [এই সূক্তের ঋষি– বিশ্বামিত্র গাথিন]।

৩/১– নিখিল কর্মাধার হে পরমৈশ্বর্যশালিন ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি সবরকম রক্ষার সাথে অভীষ্টফল পরমার্থরূপ ধন প্রদান করুন। হে সর্বশক্তির আধার ইন্দ্রদেব! ধনের ন্যায় অর্থাৎ রজত কাঞ্চন ইত্যাদি ধনসমূহ যেমন লোকের অতি প্রিয়তম এবং কামনার সামগ্রী, অপিচ, লোকে সেই রজতকাণ্বন ইত্যাদি যেমন ভজনা করে– তেমনই, অশেষমহিমান্বিত অর্থাৎ সকলরকম যশের আধার এবং নিখিল ধনের প্রাপক আপনাকে যেন পরিচর‍্যা করি অনুসরণ করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক, আত্ম-উদ্বোধক ও প্রার্থনাজ্ঞাপক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে দেব! আমাদের রক্ষা করুন, আমাদের পরমমঙ্গল বিধান করুন, এবং আমাদের পরমার্থ ধন প্রদান করুন)। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৩দ ২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৩/২– পরমমঙ্গলদায়ক হে দেব! আপনি ব্যাপকজ্ঞানের পূরয়িতা, জ্ঞানকিরণসমূহের প্রবর্ধয়িতা এবং মূলকারণ হন; আপনার কল্যাণদানকে কোনও রিপু বিনাশ করতে পারে না; হে দেব! যে পরমধন আমি প্রার্থনা করছি, সেই ধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি.নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে দেব! আপনিই পরাজ্ঞানদায়ক হন; কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন — মোক্ষ প্রদান করুন)। [হিরণ্যয়ঃ পদে ভগবানের মঙ্গলস্বরূপকে বোঝায়। তিনি পরমমঙ্গলের আধার জ্ঞানের উৎস। তিনি অশ্বস্য পৌরঃ, গবাং উৎসঃ জ্ঞান তার থেকে উৎপন্ন বা তিনিই জ্ঞানের আধার। মানুষের হৃদয়ে তার শক্তি বর্তমান থেকে মানুষকে জ্ঞানের পথে নিয়ে যায়। তার শক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কোন অমঙ্গল, অকল্যাণই তাঁর মঙ্গলময় প্রভাবে জগতে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। যৎ যৎ যামি তৎ আভর– আমরা যা প্রার্থনা করছি, আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করো। — অশ্ব পদের অর্থ, আমাদের মন্ত্রার্থে, ব্যাপকজ্ঞান; গবাং পদে জ্ঞানকিরণ। কিন্তু প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ লক্ষণীয়- হে ইন্দ্র! তুমি অশ্বের পোষক, তুমি গোসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি করো, তুমি হিরন্ময়শরীর এ ও উৎসসদৃশ। তুমি আমাদের যা দান করতে বাসনা করো, তা কেউই হিংসা করতে পারে না। অতএব যা যাচ্ঞা করি, তা আহরণ করো। অর্থাৎ এই অনুবাদক অশ্ব অর্থে ঘোড়া ও গাবং অর্থে গরু ধরেছেন]। [এই সূক্তের ঋষি ভর্গ প্রাগাথ। এই দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান। আছে। সেগুলির নাম– হারায়ণম, অভীবর্তম এবং মানবম]।

৪/১– হে ইন্দ্র! আপনি (আমাদের অনুষ্ঠিত এই সৎকর্মে অথবা হৃদয়ে) আগমন করুন; এবং মোক্ষকামী সৎ-অসৎ কর্মপরায়ণ অর্চনাকারী আমার জন্য পরমধন প্রদান করুন। হে ভগবন ইন্দ্র! প্রজ্ঞানকামী আমাকে প্রজ্ঞান প্রদান করুন। হে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবন ইন্দ্রদেব! অশ্বের ন্যায় ত্বরিতগতিবিশিষ্ট সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য– কাময়মান অথবা সর্বব্যাপক ভগবানকে প্রাপ্তকামী আমাকে সৎকৰ্ম-সাধন-সামর্থ্যকে এবং ভগবানকে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এই মন্ত্রে সাধক পরমধন ও প্রজ্ঞান এবং সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য ও ভগবৎ-সম্মিলন লাভের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের সৎকর্মপরায়ণ করুন; দিব্যজ্ঞান এবং পরমধন প্রদান করুন)। [প্রচলিত অর্থে এবং ভাষ্যমতে এই মন্ত্রে গরু, ঘোড়া প্রভৃতি পাবার প্রার্থনা জানান হয়েছে। মূলতঃ গবিষ্টয়ে এবং অশ্বমিষ্টয়ে পদ দুটি থেকেই ঐরকম অর্থ আনা হয়েছে। ঐ দুটি চতুর্থী বিভক্তির পদ, বিশেষণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের মন্ত্রার্থে গবিষ্টয়ে পদের অর্থ প্রজ্ঞানং কাময়তে; গো শব্দে জ্ঞানরশ্মি বোঝায়। আবার অশ্ব শব্দ অশ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। ঐ ধাতুর অর্থ– ব্যাপ্ত করা বা ব্যেপে থাকা। যা ভগবানকে ব্যাপ্ত বা আয়ত্ত করতে সমর্থ হয়, এখানে অশ্ব পদে সেই ভাব আছে। তাতে সর্বব্যাপক সৎকর্মের বা প্রজ্ঞানের প্রতিই লক্ষ্য আছে বলে মনে করাই সঙ্গত। মোক্ষকামী জনের, ভগবৎ-বিষয়ক শ্রেষ্ঠ জ্ঞান লাভ এবং সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্যলাভই কামনার সামগ্রী। ভগবানের কাছে গরু-ঘোড়া লাভের কামনা তাঁর পক্ষে অতি তুচ্ছ.]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৪/২– হে দেব! আপনি প্রভূতপরিমাণ শ্রেষ্ঠ পরমধন ইত্যাদি সাধকদের প্রদান করেন; রক্ষাপ্রাপ্তির জন্য ভগবৎ-মাহাত্ম্য-কীর্তনকারী প্রার্থনাকারী আমরা যেন রিপুনাশক ভগবান্ ইন্দ্রকে প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! পরমধনদায়ক আপনাকে প্রার্থনাকারী আমরা যেন প্রাপ্ত হই)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! পরমমঙ্গলদায়ক আপনাকে প্রার্থনাকারী আমরা যেন প্রাপ্ত হই)। [এই সূক্তের ঋষি ভর্গ প্রাগাথ। সূক্তান্তৰ্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– কৌল্মল হিষম এবং কণ্ববৃহৎ]।

৫/১– দেবভাবসমূহের আহ্বানকর্তা, সাধকদের আনন্দদায়ক যে জ্ঞানাগ্নি, সকল রকম ধন (চতুর্বর্গধন) অর্চনাকারীকে প্রদান করেন; অমৃতের (শুদ্ধসত্ত্বের) মুখ্যপাত্রের (শ্রেষ্ঠ আধার-স্বরূপ হৃদয় প্রদেশের) ন্যায়, এই স্তোত্রসমূহ সেই অগ্নিদেবকে প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বপূর্ণ হৃদয়প্রদেশ যেমন জ্ঞানাগ্নির প্রতিদায়ক হয়, তেমনই এই স্তোত্ৰসমূহও তার প্রীতির কারণ হোক)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ — দেবগণের আহ্বানকর্তা হর্ষদ যে অগ্নিদেব, মনুষ্যদের সকল প্রকার ধন প্রদান করেন, সেই এই অগ্নিকে উদ্দেশ করে মদকর সোমের ন্যায় মুখ্য পাত্রসমূহ ও মুখ্য স্তোত্রসমূহ গমন করছে। ভাষ্যের প্রতি দৃষ্টি করলেই এ মন্ত্রটির এমনই অর্থ অবগত হওয়া যায়। বলা বাহুল্য — ভাষ্যকার, এ মন্ত্রের অন্তর্গত মধো পদের মদকরস্য সোমস্য অর্থ এনেছেন। তাতেই এমন অর্থ অবভাসিত হয়েছে। এই অর্থে অগ্নিদেব অতিশয় মদ্যপায়ী এবং মদকর সোম তার এ অতীব প্রিয়বস্তু, এমন ভাব আপনা-আপনিই মনের মধ্যে জাগ্রত হয়। কিন্তু মধো পদের মদকর সোম অর্থ আনবার কোন কারণই দেখা যায় না। বেদের মধ্যে মধু পদ বহু স্থানে প্রযুক্ত দেখতে পাওয়া যায়। তার অনেক স্থলেই ঐ মধু পদের সুসঙ্গত অর্থ– অমৃত, শুদ্ধসত্ত্ব। এই মন্ত্রার্থেও ও তা-ই স্বীকৃত হয়েছে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-৪দ-১০স) পরিদৃষ্ট হয়]।

৫/২- সর্বলোকবরণীয় লোকবর্গের অধীশ্বর হে পরমদেব! ভগবানে আত্ম-উৎসর্গকারী দেবভাবপ্রার্থী সাধকবর্গ সৎ-মার্গ-প্রাপক জ্ঞানস্বরূপ আপনাকে স্তোত্রের দ্বারা, আরাধনা করেন। হে দেব! আমাদের পুত্রপৌত্র প্রভৃতি সকল জনে পরমধনবান আপনার পরমধন প্রদান করুন। (নিত্যসত্যমূলক এবং প্রার্থনামূলক মন্ত্রটির ভাব এই যে, সাধকগণ জ্ঞানস্বরূপ ভগবানকে আরাধনা করেন; ভগবান্ আমাদের এবং আমাদের পুত্রপৌত্র ইত্যাদি সকলকে পরমধন প্রদান করুন)। [পরমধন অর্থাৎ মোক্ষলাভের প্রার্থনা। শুধু আমরা নই আমাদের ভাবী বংশধরেরাও যেন মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হয়। প্রার্থনা, কার কাছে? জ্ঞানদেবতার কাছে। অশ্বং ন পদে ভগবানের জ্ঞানস্বরূপেরই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে কোন উপমার ভাব নেই]। [এই সূক্তের ঋষি সোভরি কাথ। সূত্তান্তৰ্গত দুটি, মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত গেয়গানটির নাম দৈর্ঘপ্রবসম]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৬– ইমং মে বরুণ সুধী হবদ্যা চ মূড়য় ভ্রামবস্যুরা চকে। ১৷৷

সূক্ত ৭– কয়া ত্বং ন উত্যাভি প্র মন্দসে বৃষ। কয়া স্তোতৃভ্য আ ভর৷ ২৷৷

সূক্ত ৮– ইন্দ্ৰমিদ দেবতাতয় ইন্দ্রং প্রত্যধরে। ইন্দ্ৰং সমীকে বনিনো হবামহ ইন্দ্রং ধনস্য সাতয়ে। ১৷৷ ইন্দ্রো মহা রোদসী পথচ্ছব ইন্দ্রঃ সূর্যমোয়ৎ। ইন্দ্রে হ বিশ্ব ভুবনানি যেমির ইন্দ্রে স্বানাস ইন্দবঃ৷৷ ২৷

সূক্ত ৯– বিশ্বকর্ম হবিষা বাবৃধানঃ স্বয়ং যজস্ব তন্বতং স্বা হি তে। মুহ্যন্যে অভিহতা জনাস ইহাস্মাকং মঘবা সূরিরস্তু৷৷৷৷৷

সূক্ত ১০– অয়া রুচা হরিণ্যা পুনাননা বিশ্বা ঘোষাংসি তরতি সযুগ্মভিঃ সুরোন সযুগ্মভিঃ। ধারা পৃষ্ঠস্য রোচতে পুনাননা অরুষো হরিঃ। বিশ্ব যদ রূপা পরিয়াস্যকভিঃ ঝকৃভিঃ ৷৷ ১৷৷ প্রাচীমনু প্ৰদিশং যাতি চেকিতৎ স রশ্মিভির্যততে দর্শতে রথো দৈব্যো দর্শতে রথঃ। অগমুথানি পৌংস্যেন্দ্ৰং জৈত্রায় হয় বজ্রশ্চ য ভবথো অনপচ্যুতা সমস্বনপচ্যুতা৷ ২। ত্বং ই ত্যৎ পণীনাং বিদো বসু সং মাতৃভিমর্জয়সি স্ব আদম ঋতস্য ধীতিভিৰ্দমে। পরাবনে সামত যত্ৰা রণতি ধীতয়ঃ ত্রিধাতুভিরশীভিয়োদধে রোমানোবয়োদধে৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৬সূক্ত/১সাম– হেঅভীষ্টবর্ষক (বরুণ) দেব! আমার উচ্চারিত এই প্রার্থনা শ্রবণ করুন এবং আমার সুখসাধন করুন। পরিত্রাণকামী আমি আমাদের উদ্দেশে এই স্তব (প্রার্থনা) করছি। (ভাব এই যে, হে দেব! পরিত্রাণকামনার জন্য আমি আপনাকে প্রার্থনা করছি; সেই প্রার্থনা শ্রবণ করুন, এবং সুখবিধান করুন)। .[একটি মন্ত্র-সম্বলিত এই সূক্তটির ঋষি– শুনঃশেফ আজীগর্তি]।

৭/১– অভীষ্টদায়ক হে দেব! আপনি কোন্ রক্ষাশক্তির বলে আমাদের পরমানন্দ প্রদান করেন? কোন্ শক্তির দ্বারা প্রার্থনাকারী আমাদের পরমধন প্রদান করেন? অর্থাৎ ভগবানের মহিমা আমার ন্যায় ক্ষুদ্রজনের বুদ্ধির অতীত। (মন্ত্রটি আত্মদৈন্য-নিবেদনমূলক ও নিত্যসত্য-প্রকাশক। ভাব এই যে, ভগবানই লোকবৰ্গকে পরমানন্দ এবং পরমধন প্রদান করেন; তাঁর মহিমা লোকসমূহের ধারণাতীত)। [শুধু রক্ষাকার্য নয়, ভগবান্ মানুষকে পরমধন মোক্ষ প্রদান করেন; কিন্তু কি সে অসীম ভাণ্ডার, যা থেকে জনগণ অনন্তকাল অবধি নিজেদের অভীষ্ট রত্ন সংগ্রহ করছে? বিস্ময়ের সাথে সাধক সেই রত্নভাণ্ডারের পরিচয় লাভেরও চেষ্টা করেছেন]-[একটি মন্ত্র-সম্বলিত এই সূক্তের ঋষি- সুকক্ষ আঙ্গিরস]।

৮/১– দেবপূজনের জন্য অর্থাৎ সকল সকর্মে, অদ্বিতীয় ভগবানকে আহ্বান করি; এবং সৎ অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে অর্থাৎ সৎকর্মসাধনের কল্পনায় ভগবানকে আহ্বান করি; অপিচ, সৎ-অসৎবৃত্তির পরস্পর সংঘর্ষে অথবা কর্ম-সম্পূর্ণ সৎকর্মে ব্ৰতী আমরা ভগবানকে আহ্বান করি (হৃদয়ে ধারণ করি); এবং সৎকর্মের ফল চতুর্বর্গরূপ পরমধন লাভের নিমিত্ত ভগবানকে আহ্বান করি। (মন্ত্রটি, সঙ্কল্পজ্ঞাপক এবং প্রার্থনামূলক। সকল কার্যে– কর্মের প্রারম্ভে, কর্মসম্পাদনকালে এবং কর্মসমূহের সর্ণে — সকল সময়ে ভগবানের অনুসরণ অবশ্য কর্তব্য। ভগবানে সংন্যস্তচিত্ত হলে সুফললাভ অবশ্যম্ভাবী। আমাদের অনুষ্ঠিত সকল কর্মে আমরা ভগবানের প্রতি যেন সংন্যস্তচিত্ত হতে পারি– এমন সঙ্কল্প এখানে বিদ্যমান আছে)। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-২দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– ভগবান্ ইন্দ্রদেব আত্মশক্তির মাহাত্মের দ্বারা দ্যুলোক-ভূলোককে ধারণ করেন; ভগবান্ ইন্দ্রদেব জ্ঞান প্রকাশিত করেন; ভগবানে সকল ভূতজাত বর্তমান আছে এবং ভগবানেরই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব বর্তমান আছে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানে বিশ্ব বর্তমান আছে;  তার হতে সবই আগত হয়েছে, তাঁতেই সব প্ৰলীন হয়। ভগবানই শুদ্ধসত্ত্বের আধার হন)। [এই সূক্তের ঋষি– মেধ্যাতিথি কাণ্ব। এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম — যৌক্তস্রুচম এবং নৈপাতিথম]।

৯/১– বিশ্বাধিপতি হে দেব! আপনি নিজেকে আহুতি দিয়ে নিজেই যজ্ঞ-সম্পাদন করেন; যজ্ঞে প্রদত্ত হবিঃ দ্বারা আপনিই প্রবর্ধিত হন; সত্যতত্ত্বে অনভিজ্ঞ জনসমূহ সর্বতোভাবে মোহপ্রাপ্ত হয়; পরমধনদাতা সেই দেবতা ইহলোকে প্রার্থনাকারী আমাদের জ্ঞানদায়ক (অথবা স্বর্গপ্রাপক) হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই বিশ্বে প্রকাশিত হন, তিনিই সর্বময়; সেই দেবতা আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন)। [পূর্বাপর বিশ্লেষিত হয়েছে মানুষ স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। সুতরাং মানুষ যা করে, একদিক দিয়ে তা ভগবানের কার্যও বলা যায়। বর্তমান মন্ত্রে এই ভাবই গৃহীত হয়েছে। তাই বলা হয়েছে– ত স্বয়ং যজস্ব। আবার হবিষা বাবৃধানঃ- সেই যজ্ঞের ফলও তিনিই ভোগ করেন। হোতাও তিনি, যজমানও তিনি, হব্যও তিনি– কারণ তিনি ব্যতীত প্রকৃতপক্ষে জগতে আর কিছুই নেই]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– বিশ্বকর্মা ভৌবন]।

১০/১– সূর্য যেমন আপন কিরণের দ্বারা আবরক অন্ধকারসমূহ নাশ করেন, তেমনই পবিত্রতাপ্রাপ্ত শুদ্ধসত্ত্ব তেজঃ প্রদীপ্ত ও দীপ্তিমন্ত তেজপূর্ণ শক্তির দ্বারা এবং আত্মজ্ঞান উন্মেষণের দ্বারা বিশ্বের সকল শত্রুকে নাশ করেন। (ভাবার্থ সূর্য যেমন রশ্মির দ্বারা অন্ধকারসমূহ নাশ করেন, তেমনই শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ আপন প্রভাবের দ্বারা আত্মজ্ঞান উন্মেষ করে সাধকের অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করেন)। তারপর (শুদ্ধসত্ত্ব প্রদীপ্ত হলে) পবিত্রকারক সেই ভগবানের তেজোরাশি অর্থাৎ করুণাধারা সাধকদের উদ্ভাসিত অর্থাৎ অভিসিঞ্চিত করে; (ভাব এই যে, হৃদয়ে সৎ-ভাব সঞ্জাত হলে ভগবানের করুণাধারা আপনিই বিগলিত হয়)। আরও, ভগবান্ যখন দেহ ইত্যাদি সপ্তসংজ্ঞক সৎকর্ম-সাধনের উপাদান সমন্বিত তেজঃসমূহের দ্বারা বিশ্বের ভূতজাতসমূহকে সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত করেন, তখন শুদ্ধসত্ত্বগ্রাহক পবিত্রকারক ভগবান্ আপন তেজের দ্বারা আপনা-আপনিই প্রকাশমান। হন। (ভাব এই যে, সূর্যরশ্মিসমূহ যেমন সপ্তকিরণের দ্বারা জগৎকে সূর্যসম্বন্ধ প্রদান করে, সত্ত্বভাবসমূহ তেমনই দেহ-ইন্দ্রিয় প্রভৃতির দ্বারা হৃদয়ে ভগবানকে প্রতিষ্ঠিত করে)। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-১২দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১০/২– বরণীয় জ্ঞানসমন্বিত সৎকর্মরূপ যান সাধক-হৃদয়কে প্রাপ্ত হয়; পরম আকাঙক্ষণীয় স্বর্গীয় সৎকর্মরূপ যান জ্ঞান-কিরণের সাথে মিলিত হয়; সাধকদের শক্তিদায়ক স্তোত্র-সমূহ ভগবানকে প্রীত করে রিপুসংগ্রামে জয়লাভের জন্য তাকে প্রাপ্ত হয়; হে দেব! আপনি এবং আপনার রক্ষাস্ত্র অপরাজেয় হন; যেহেতু রিপুসংগ্রামে আপনারা অপরাজেয় হন, সেই হেতু আমরা রক্ষালাভের জন্য আপনার শরণ প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — জ্ঞান কর্মের সাথে সম্মিলিত হয়; সাধকগণ প্রার্থনাপরায়ণ হন)।

১০/৩- হে ভগবন! আপনিই স্তুতিকারক উপাসকদের মুক্তিদায়ক প্রার্থনীয় পরমধন অবগত আছেন; সৎকর্মসাধনরত সাধকদের আপনি মাতৃভূত শক্তির দ্বারা পরিশুদ্ধ করেন; তাদের আপন অনুষ্ঠিত সৎকর্মে সত্যের ধারণশক্তি (অর্থাৎ সৎ-বুদ্ধি) দ্বারা তাদের সম্যক্সপে পরিশুদ্ধ করেন; এ যে পরাজ্ঞানে সৎ-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ পরমানন্দ লাভ করেন, সেই প্রসিদ্ধ পরাজ্ঞান স্বর্গেও এ পরমানন্দ প্রদান করে; জ্যোতির্ময় দেব ত্রিলোকধারণ সমর্থ পরাজ্ঞানের সাথে শক্তি প্রদান করুন; কৃপাপূর্বক আমাদের পরাশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সকলের শক্তিসঞ্চারক, পবিত্রকারক এবং জ্ঞানদায়ক হন; সেই দেবতা আমাদের পরাশক্তি প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে সোম! পণিগণ (পাণি নামক দস্যুগণ) যে গোন অপহরণ করেছিল, তা কোথায় ছিল, তুমি তা জানতে। তুমি যজ্ঞস্থানে স্তুতিবাক্য লাভ করতে করতে জলের দ্বারা শোধিত হও। যেমন দূর হতে সামধ্বনি শোনা যায়, তেমন সেখানে তোমার শব্দ শোনা যায়। তিন আধারে স্থাপিত মূর্তি দ্বারা তুমি অন্ন দান করো, এবং ঔজ্জ্বল্য ধারণ করো। কেবলমাত্র পণানাং পদটির জন্যই ভাষ্যের সাথে আমাদের মন্ত্রার্থের সম্পূর্ণ ভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে। ভাষ্যকার ঐ পদের অর্থ প্রদান করেননি; শুধু বসু পদের ব্যাখ্যায় বলেছেন– পণিগণ কর্তৃক অপহৃত গবাদি ধন। বসু পদের মধ্যে এ দূরার্থ কল্পনার কোন প্রয়োজনীয়তাও নেই। এটির সাধারণ এবং স্বাভাবিক অর্থ- ধন অথবা পরমধন। এটিই আমাদের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। পণি শব্দ সম্পর্কেও বহুবার আলোচনা করা হয়েছে। এই শব্দের অর্থ-সম্বন্ধেও ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে নানা মতভেদ দেখা যায়। কারো কারো মতে এরা একশ্রেণীর দস্যু ছিল, যারা আর্যদের গরু ইত্যাদি হরণ করে নিয়ে যেত এবং এই উপলক্ষে আর্যদের সঙ্গে তাদের প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। কেউ কেউ গ্রীক ভাষায় রচিত ইলিয়ড কাব্যের উৎসরূপে বেদের পণির উপাখ্যানকে সূচিত করেন। কেউ কেউ অবশ্য এই পণির উপাখ্যানকে রূপক বলে চিহ্নিত করেছেন। ইত্যাদি। এই মন্ত্রার্থে আমরা পূর্বাপর সঙ্গত অর্থেই পণীনাং বলতে স্তুতিকারকাণাং, উপাসকানাং বুঝেছি এবং প্রয়োগ করেছি। [এই সূক্তের ঋষি– অনানত পারুচ্ছেপি। এই দুটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– গায়ত্ৰপার্শ্বম]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ১১– উত নো গোষণিং ধিয়মশ্বসাং বাজসামুত। নৃবৎ কৃত্যুতয়ে৷৷৷৷

সূক্ত ১২– শশমানস্য বা নরঃ স্বেদস্য সত্যশবসঃ। বিদা কামস্য বেনতঃ ॥১॥

সূক্ত ১৩– উপ নঃ সূনবো গিরঃ শৃথমৃতস্য যে। সূমড়ীকা ভবন্তু নঃ ॥১॥

 সূক্ত ১৪– প্র বাং মহি দ্যবী অভ্যুপস্তুতিং ভরামহে। শুচী উপ প্রশস্তয়ে৷৷৷ পুনানে তন্বা মিথঃ স্বেন দক্ষেণ রাজথঃ। উহ্যাথে সনাদঋতম৷ ২। মহী মিত্রস্য সাধয়স্তরন্তী পিপ্ৰতী ঋতম। পরি যজ্ঞং নি যেদথুঃ॥৩॥

সূক্ত ১৫– অয়মু তে সমতসি কপোত ইব গর্ভধি। বচস্তন্নি ওহসে৷ ১৷ স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহো বীর যস্য তে। বিভূতিরস্তু সুনৃতা৷৷ ২ উধ্বস্তিষ্ঠা ন উতয়েহস্মিন্ বাজে শতক্রতো। . সমন্যে ব্ৰবাবহৈ৷৩৷৷

সূক্ত ১৬– গাব উপবটাবট মহী যজ্ঞস্য রসুদা। উভা কর্ণা হিরণ্যয়া ৷৷ ১৷৷ অভ্যারমিদদ্রয়ো নিষিক্তং পুষ্করে মধু। অবস্য বিসর্জনে৷ ২৷৷ সিঞ্চন্তি নমসাবটমুচ্চাচক্রং পরিজমান। নীচীনবারমক্ষিত৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১১সূক্ত/১সাম– হে ভগবন! রিপুকবল হতে রক্ষালাভের জন্য আমাদের বুদ্ধিকে (অথবা কর্মকে) পরাজ্ঞানদায়িকা, ব্যাপকজ্ঞানদায়িকা এবং শক্তিদায়িকা অপিচ, ভগবৎ-ভক্তিসম্পন্ন। পুত্ৰদাত্রী করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, – হে ভগবন! আমাদের সৎবুদ্ধিসম্পন্ন করুন এবং আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [প্রচলিত বঙ্গানুবাদ হে পূষা! তুমি আমাদের উপভোগের জন্য আমাদের যাগকার্যকে গো, অশ্ব, অন্ন ও পরিচারকবর্গের উৎপাদক করো। গোষণিং পদের ভাষ্যার্থের অনুবাদ গো প্রদানকারী। অশ্বসাং পদেও অশ্ব বা ঘোড়া অর্থ গৃহীত হয়েছে। সেইজন্যই মন্ত্রের প্রচলিত অনুবাদে গরু ঘোড়া ইত্যাদির প্রার্থনা। আমাদের মন্ত্রার্থে উত শব্দে সূক্ত-দেবতা পূষা উপলক্ষে ভগবানকে তথা ভগবৎ-বিভূতিকে লক্ষ্য করা হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য]।

১২/১– অবিতথবল (সত্যপরিজ্ঞাপক) সৎপথে পরিচালক হে দেবগণ! এই স্তুতিপরায়ণ, ভগবানের কর্মে অথবা ঐহিকের কর্মে পরিশ্রান্ত, কামনাপর অথবা ভগবৎ-প্রাপ্তির অভিলাষী জনের কামনাকে অথবা ভগবৎ-প্রাপ্তি-রূপ অভিলাষকে সর্বথা পূরণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবগণ! আমাদের আপনাদের স্তুতিপরায়ণ সৎকর্মসমন্বিত এবং দেবত্ব-প্রাপ্তির অভিলাষী করে আমাদের কামনাকে পূর্ণ করুন)। [এই মন্ত্রের প্রার্থনায়, দুরকম ভাব গ্রহণ করা যায়। প্রথমতঃ ভাব গ্রহণ করতে পারি– আমরা সংসারকীট, সাংসারিক কর্মে পরিশ্রান্ত ও অভিভূত হয়ে আছি, এবং আমাদের কামনারও অন্ত নেই। সেই আমরা, এখন স্তুতিপরায়ণ হয়ে কামনাপূরণের জন্য প্রার্থনা করছি। অন্য ভাব গ্রহণ করতে পারি– আমরা স্তুতিপরায়ণ হয়ে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করে যেন, ভগবৎ-প্রাপ্তির অভিলাষী হই। প্রথম পক্ষে দীনতা এবং দ্বিতীয় পক্ষে নিজের মঙ্গল-অভিলাষ প্রকাশ পেয়েছে। প্রার্থনা-পক্ষে এই মন্ত্রের ভাব এই যে, এই শশমানের (শশমানস), স্কেদের (স্বেদস্য) এবং বেনতের (বেনতঃ) প্রার্থনা দেবগণ পূরণ করুন। এটাই এই মন্ত্রের নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা]। [এই সূক্তের ঋষি- গোতম রাহূগণ]।

১৩/১– অমৃতস্বরূপ দেবতার পুত্রভূত যে দেবগণ, তারা আমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করুন; তারা আমাদের পরমসুখদাতা হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন)। [মন্ত্রে মানুষের চিরন্তন প্রার্থনাই ফুটে উঠেছে। অমৃতস্য পদে তার সত্যস্বরূপই প্রকাশ পায়। তিনি অনাদি অনন্ত তিনি নিত্য শাশ্বত। মানুষ নিজের অনিত্যতা বিনশ্বরত্ব উপলব্ধি করে, সেই নিত্য সনাতন দেবতার শরণাপন্ন হয়। অমৃতস্য সূনবঃ পদেও দেবতার অথবা দেবভাবের নিত্যত্বই প্রকাশিত হয়েছে। তারা আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করুন আমাদের পূজা গ্রহণ করুন। সেই প্রার্থনা কেন- কিসের জন্য? প্রার্থনার উদ্দেশ্য পরমসুখ- চরমানন্দ প্রাপ্তি। নঃ সুমৃড়ীকাঃ ভবন্তু সেই দেবতা (অথবা দেবতাগণ) আমাদের পরমসুখদায়ক হোন। ভগবানের কৃপায় আমরা যেন পরমানন্দের অধিকারী হতে পারি- এটাই প্রার্থনার সারমর্ম]। [এই সূক্তের ঋষি ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ]।

১৪/১- পবিত্র জ্যোতির্ময় হে দেবদ্বয়! আপনাদের প্রীতির জন্য মহতী প্রার্থনা প্রকৃষ্টরূপে ঐকান্তিকতার সাথে যেন উচ্চারণ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ জ্যোতির্ময় পরমদেবকে আরাধনা করি)। [মন্ত্রে বাং দ্যবী প্রভৃতি দ্বিবচনান্ত পদ ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে মন্ত্রের উপাস্য দেবতার দ্বিত্ব প্রতিপন্ন করা হয়। ভাষ্য ইত্যাদিতে এই দুই দেবতা দ্যাবাপৃথিবী অর্থাৎ দ্যুলোক এবং ভূলোক। অবশ্য এই স্থানকেই দেবতা বলে গ্রহণ করা হয়নি। এটির প্রকৃত অর্থ দুরকমে গৃহীত হয়। এক– দ্যুলোক ও ভূলোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। দুই দ্যুলোকে ও ভূলোকে অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বে যে সমস্ত দেবতা আছেন, তাঁরা। যদিও এই বহুর পশ্চাতে সেই একং বর্তমান আছেন। বহুর দ্বারা সেই এক পরমদেবতাকেই লক্ষ্য করা হয়। আমাদের মন্ত্রার্থে ঐ দ্বিতীয় ভাবটিই গৃহীত]।

১৪/২– হে দেবদ্বয়! আপনার আপনাপন প্রকাশের দ্বারা, আবির্ভাবের দ্বারা, প্রত্যেককে শোধন করে আপন শক্তিতে বিরাজ করেন; এবং নিত্যকাল আমাদের সত্য প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই পবিত্রকারক এবং সত্যপ্রাপক হন)।

১৪/৩– মহান্ হে দেবদ্বয়! আপনারা মিত্রভূত জনের অর্থাৎ সাধকের অভীষ্ট সম্পাদন করেন; পরিত্রাণকারক সত্যপ্ৰাপক আপনারা আমাদের সৎকর্মসাধনে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সাধকদের অভীষ্টপূরক হন। তিনি আমাদের পরিত্রাণকারক হোন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে মহতী (দ্যাবাপৃথিবী)! তোমাদের মিত্রের (স্তোত্রের) অভীষ্ট সাধন করো এবং অন্নবিভাগও পূর্ণ করতঃ যজ্ঞোপরি উপবেশন করো। মন্ত্রের অন্তর্গত মিত্রস্য ইত্যাদি পদগুলির অর্থ ভাষ্যে এবং এই মন্ত্রার্থে কেমন ভিন্ন হয়েছে, লক্ষণীয়। সঙ্গত বা অসঙ্গত পাঠকেরই বিচার্য]। [এই সূক্তটির ঋষি- বামদেব গৌতম]।

১৫/১– হে দেব! আপনার উদ্দেশে সম্পাদিত জ্ঞানোৎপন্ন শুদ্ধসত্ত্বভাব যার সাথে আপনার কপোত-কপোতীর ন্যায় সম্মিলন হয়, সেই ভাবসহযুত আমাদের স্তোত্র (সৎকর্ম) আপনি নিশ্চিতই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। (ভাব এই যে, জ্ঞানসহযুত সৎকর্ম ও স্তোত্র নিশ্চয়ই ভগবানের সামীপ্য লাভ করে)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা অত্সারে এই মন্ত্রের অন্তর্গত অয়মুপদে সাধারণতঃ সোমরসের সম্বন্ধ সূচনা করা হয়। সে পক্ষে কপোত কপোতীর দৃষ্টান্ত, তথাকথিত ব্যাখ্যাকারদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির সহায়ক হয়ে যায়। অর্থাৎ সোমরস-রূপ মাদকদ্রব্যের প্রতি ইন্দ্রদেবের এতই আসক্তি যে, তিনি কপোর্তীর অনুসরণে কপোতের মতে ভ্রাম্যমাণ থাকেন। কিন্তু একটু বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায় ঐ অয়মুপদ পূর্ব-মন্ত্রের সাথেই সম্বন্ধ খ্যাপন করছে। পূর্ব-মন্ত্রে যে জ্ঞান-উন্মেষের বিষয় বিবৃত হয়েছে, ভগবানের যে প্রভাবের বিষয় খ্যাপন করা হয়েছে তা থেকে ভগবান্ যে কোথায় অবস্থিতি করেন, তা বোঝা যায়। সভাবের শুদ্ধসত্ত্বের সাথে তার অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ। এখানে তার প্রতিই লক্ষ্য আসে। সকল শাস্ত্রে সর্বত্রই এ তত্ত্ব বিবৃত আছে। এ পক্ষে কপোত-কপোতীর মিলনের তুলনা অতি সঙ্গত বলেই মনে হয়]।

১৫/২– উপাস্যগণের শ্রেষ্ঠ, দুষ্পবৃত্তি দমনকারী, স্তুতিমন্ত্রের প্রাপক হে দেব! সত্ত্বভাবসম্বন্ধযুত আমাদের স্তোত্র আপনাকেই প্রাপ্ত হয়। আপনার ঐশ্বর্যবিভূতি আমাদের পক্ষে অক্ষয় হোক। (ভাব এই যে, — আমার স্তোত্র সত্ত্বভাবসম্পন্ন হোক; তার দ্বারাই আমার অভ্যুদয় হয়)। [এই মন্ত্রের যস্য পদ পূর্ব-মন্ত্রের সম্বন্ধ খ্যাপন করছে। মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বভাবের সাথে ভগবানের যে অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ, এখানে সেই উক্তিরই প্রতিধ্বনি দেখতে পাওয়া যায়]।

১৫/৩– পরমপ্রজ্ঞাসম্পন্ন হে দেব! এই পরিদৃশ্যমান্ (নিত্যসংঘটিত) সংগ্রামে (সবৃত্তির সাথে অসম্পৃত্তির দ্বন্দ্বে) আমাদের রক্ষার জন্য আপনি মুধিদেশে (জ্ঞানস্বরূপে) অবস্থিতি করুন। তাহলে অন্য উন্নত স্তরে (আপনার সামীপ্য লাভের পরে, তার ফলে) আমরা উভয়ে সংলাপ করতে সমর্থ হবো (অর্থাৎ, আপনার সাথে আমাদের সম্মিলন সংঘটিত হবে)। (ভাব এই যে, হে ভগবন! যখন আপনি জ্ঞানরূপে মূরিদেশে অবস্থান করেন, তখন আমাদের মোক্ষপথ প্রশস্ত হয়)। [পূর্ববর্তী মন্ত্র দুটির সাথে সম্বন্ধ লক্ষ্য না করাতেই প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে এ মন্ত্রের এক হাস্যকর অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে। তাতে দেবতা ও মানুষ একই স্তরের জীববিশেষ বলে প্রতিপন্ন হয়। সে অর্থে আর্যদের সাথে অনার্যদের যুদ্ধবিষয়ক কথোপকথনের প্রসঙ্গও অধ্যাহৃত হতে পারে। ফলতঃ মানুষের সাথে মানুষের ব্যবহার-বিষয়ক ব্যাপার যে ঐ মন্ত্রে বর্ণিত আছে, ব্যাখ্যা-বিবৃতি দেখে সাধারণতঃ তা-ই মনে হয়। কিন্তু বাস্তব তা নয়। বিভিন্ন স্তর থেকে লক্ষ্য করলে, মন্ত্রের বিভিন্ন ভাব অবভাসিত হয়। পূর্ব মন্ত্রে ভগবানের একটি বিশেষণ আছে– বীর। তার অর্থে– দুষ্টপ্রবৃত্তির দমনকারী ভাব গৃহীত হয়েছে। সেখানে প্রার্থনা জানান হয়েছে আপনার বিভূতি আমার পক্ষে অক্ষয় হোক। এইভাবে ভগবৎ বিভূতি সত্ত্বগুণ ইত্যাদি মানুষের পক্ষে অক্ষয় হতে গেলে, ভগবৎ-বিভূতিতে নিজেকে মণ্ডিত করতে হলে, কত রকম বিঘ্নবিপত্তি উপস্থিত হয়, কতরকম প্রতিবন্ধকতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। এখানে অস্মিন্ বাজে পদ দুটিতে সেই প্রতিবন্ধকতার বিষয় খ্যাপিত হচ্ছে। সত্ত্বভাবের অধিকারী হতে হলে, অসতের সাথে দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। অস্মিন বাজেবাক্যে সৎ ও অসৎ বৃত্তির সেই দ্বন্দ্বই নির্দেশ করে। তারপর, উঃ তিষ্ঠ পদ দুটি কি বোঝায়, অনুধাবনীয়। যুদ্ধের সময় ঊর্ধ্বে অবস্থান করুন — এমন বাক্যে কি কোন অর্থ প্রকাশ করে? উধ্ব পদের অতি সঙ্গত অর্থ– মূর্ধিস্থিত জ্ঞান, সহস্রারে অবস্থিত শিব-শক্তি। সেই জ্ঞান উদিত হলে, সেই শক্তি জেগে উঠলে, আর কোনও কামনাই স্থান পায় না। তখন, যে ভাব– যে অবস্থা.আসে, অন্যেষু পদে তার প্রতি লক্ষ্য আনছে। সে ভাব– সে অবস্থাই সামীপ্যলাভের অবস্থা। সেই ভাবে সেই অবস্থায় উপনীত হতে পারলেই, পরস্পর কথোপকথনের অবস্থা আসবে; অর্থাৎ, সামীপ্য সম্মিলনের আশা সফল হবে]। [এই সূক্তের ঋষি শুনঃশেপ আজীগর্তি]।

১৬/১– হে আমার জ্ঞানকিরণনিবহ (অথবা, বাগরূপ স্তোত্রমন্ত্র সমূহ)! তোমরা সৎকর্মের আধারভূত সেই ভগবানে গিয়ে উপনীত হও; (আতে) এই পৃথিবীই সৎকর্মসমূহের সুফল প্রদানে সমর্থ হবে; ভক্তি ও কর্মরূপ (সংসার-সাগর-পরিত্রাণকারক) ক্ষেপণীদ্বয় তোমাদের আকাঙক্ষণীয় হোক! (ভাব এই যে, — আমাদের জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম সহ মিলিত হোক; তাতে জন্মজরামরণধর্মী এই পৃথিবীই ইষ্টফল প্রদান করবেন)। অথবা- হে আমার জ্ঞানসমূহ (জ্ঞানরূপ কিরণ-সমূহ)! তোমরা রক্ষক সেই মহাপুরুষ ভগবানে উপগত হও, অর্থাৎ তাকে লাভ করো। সেই ভগবান সৎকর্মসমূহের ফলপ্রদ পাত্রবিশেষ (অর্থাৎ তিনিই সৎকর্মের ফলদানকারী)। হে জ্ঞান! তুমি এবং সৎকর্ম উভয়েই ক্ষেপণীরূপ কর্ণের ন্যায়; অতএব, তোমরা উভয়েই স্বর্ণতুল্য অর্থাৎ স্বর্ণের মতো আমাদের আকাঙক্ষণীয়। (ভাব এই যে, ক্ষেপণী (অর্থাৎ হাল এবং দাঁড়) যেমন নৌকাকে তার লক্ষ্যস্থান প্রাপ্ত করায়, তেমনই তোমরা উভয়েই ভগবানকে পাইয়ে দাও; সুতরাং তোমরা আমাদের আকাঙক্ষণীয় হও)। [ভাষ্যে এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই সামের যে অর্থ দেখতে পাওয়া যায়, তাতে বোধ হয়, কেউ (যজমান বা পুরোহিত) যেন প্রাণি-বিশেষকে (গরুকে বা ছাগকে) লক্ষ্য করে বলছেন– হে গোসকল (অথবা হে ছাগসকল)! তোমরা মহাবীরকে প্রাপ্ত হও; কেননা, তাদের ধর্মযাগের অর্থাৎ আরব্ধকার্যের ফলদানকারী ও সাধনভূত তোমাদের দুগ্ধ বহু পরিমাণে আবশ্যক হবে। অতএব তোমরা উপগত হও। অপিচ, সেই মহাবীরের দুটি কর্ণ, একটি স্বর্ণময়, অপরটি রজতময়। এরকম অর্থে, বেদের কোন নিগূঢ় তত্ত্ব নিষ্কাশিত হয়েছে বলে বুঝতে পারা যায় না। আমাদের মন্ত্রার্থে। দুরকমে মন্ত্রটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দুই ব্যাখ্যার মধ্যেই প্রায় অভিন্ন ভাব লক্ষ্য করা যায়]। [মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি প্রগাথের পুত্র হত বলে প্রসিদ্ধ। বিবরণকারের মতে হয়তস্যাষ। মতান্তরে প্রগথনং প্রগাথঃ। ঋগ্বেদে মন্ত্রটি অগ্নিদেব সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখানে এটি ইন্দ্রদেবের উপলক্ষে প্রবর্তিত]। [ছন্দার্চিক (২অ-১দ-৩সা) দ্রষ্টব্য]।

১৬/২– বিপদে রক্ষাকারী দেবতার দান-হেতু অনুগ্রহে কঠোরসাধনপরায়ণ সাধকগণ সেই ৫ বিশ্বপালক দেবতাতে অবস্থিত অমৃত প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধনাপরায়ণ ব্যক্তিগণ ভগবৎ-প্রদত্ত অমৃত-লাভ করেন)।

১৬/৩– সাধকগণ ঐকান্তিক ভক্তির দ্বারা ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক, সর্বদেবভাবপ্রদাতা, অকিঞ্চনদের হৃদয়েও সঞ্চরণশীল, শ্রেষ্ঠ রক্ষাকারী জ্ঞানদেবকে হৃদয়ে উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকগণ ঐকান্তিক ভক্তির দ্বারা পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– উপরিভাগে চক্রবিশিষ্ট, পরিণতদীপ্তি, নিম্নমুখদ্বারবিশিষ্ট, অক্ষীণ, রক্ষাকারী অগ্নির উপরে অবনত হয়ে তাকে সিক্ত করছেন। ভাষ্যকার যে অর্থ নির্দেশ করেছেন উপরোক্ত অনুবাদটি তারই অনুসারী। এই মন্ত্রে এবং পূর্বের মন্ত্রে আমরা অবট অর্থেরক্ষক, বিপদে রক্ষাকারীঅর্থ গ্রহণ করেছি। এখানে উচ্চচক্রং বলতে যা মানুষকে উধ্বমার্গে নিয়ে যায়, তা-ই, বোঝায়। নীচীনবারং পদের অর্থ অধোমুখং। নীচীন শব্দের দ্বারা অবধাদিক বোঝায়। সেই অর্ধেদিকেও যাঁর দৃষ্টি আছে, অর্থাৎ যিনি হীন পতিতকেও অবহেলা করেন না, তিনিই নীচীনবারং। পতিতপাবন ভগবানের জ্ঞানশক্তি, অজ্ঞান অকিঞ্চনের হৃদয়কেও সমুদ্ভাসিত করে, তাই তাঁকে নীচীনবারং বলা হয়েছে। অক্ষিতংপদের অর্থ অক্ষীণঃ। যা ক্ষীণ নয়, যা শ্রেষ্ঠ, যা পরমমঙ্গলপ্রদ, যার কল্যাণে মানুষ ক্ষীণতা দীনতা প্রাপ্ত হয় না, তা-ই অক্ষীণঃ। সাধকেরা ভক্তির দ্বারা সেই পরমমঙ্গলদায়ক পরাজ্ঞান লাভ করেন- মন্ত্রে প্রকৃতপক্ষে এই সত্যই বিবৃত হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– হর্যত প্রাগাথ]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১৭– মা ভেম মা শ্রমিন্মোগ্রস্য সখ্যে তব। মহং তে বৃষ্ণো অভিচক্ষ্যং কৃতং পশ্যেম তুবশং যদুম্৷১। সব্যামনু স্ফিগ্যং বাবসে বৃষা ন দানো অস্য রোষতি। মধা সম্পৃক্তাঃ সারঘেণ ধেনবস্তুয়মেহি দ্ৰবা পিব। ২।

সূক্ত ১৮– ইমা উ জ্বা পুরুবসো গিরো বর্ধন্তু যা মম। পাবকবর্ণাঃ শুয়ো বিপশ্চিতোহভি স্তোমৈরনূষতঃ ॥১৷৷ অয়ং সহস্ৰমৃষিভিঃ সহস্কৃতঃ সমুদ্র ইব পথে। সত্যঃ সো অস্য মহিমা গৃণে শবো যজ্ঞেযু বিরাজ্যে৷৷ ২৷৷

সূক্ত ১৯– যস্যায়ং বিশ্ব আৰ্যো দাসঃ শেবধিপা অরিঃ। তিরশ্চিদর্যে রুশমে পবীরবি তুভ্যেৎ সো অজ্যতে রবিঃ ॥১৷৷ তুরণ্যবো মধুমন্তং ঘৃতশ্রুতং বিপ্রাসে অর্কমান্চুঃ। অস্মে রয়িঃ পথে বৃষ্ণং শবোহস্মৈ স্বানাস ইন্দবঃ ৷৷ ২…

সূক্ত ২০– গোমন্ন ইন্দো অশ্ববৎ সুতঃ সুদক্ষ ধনিব। শুচিৎ চ বর্ণমপি গোষু ধারয়৷৷৷৷ স নো হরীণাং পত ইন্দো দেবপস্তমঃ সখেব সখ্যে নৰ্যো রুচে ভব৷ ২। সনেমি ত্বমস্মদা অদেবং কঞ্চিত্রিণম্। সাং ইন্দো পরি বাধো অপ দ্বমুম্ ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ২১– অঞ্জতে ব্যঞ্জতে সমঞ্জতে কতুং রিহন্তি মধাভ্যঞ্জতে। সিন্ধোরুচ্ছ্বাসেপতয়মুক্ষণং হিরণ্যপাবাঃ পশুমসু গৃভণতে৷৷৷৷ বিপশ্চিতে পবমানায় গায়ত মহী ন ধারাত্যন্ধো অৰ্ষতি। অহির্ন জুর্ণামতি সর্পতি ত্বমতো ন ক্রীড়ন্নসরদ বৃষা হরিঃ ॥২৷৷ অগ্রেগো রাজাপ্যস্তবিষ্যতে বিমাননা অদ্ভুবনেষুর্পিতঃ হরিঘৃতঃ সুদৃশীকো অর্ণবো জ্যোতীরথঃ পবতে রায়ওকাঃ ৷৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৭সূক্ত/১সাম– হেভগবন! আমরা যেন পরমশক্তিসম্পন্ন আপনার সখিত্বপ্রাপ্ত হয়ে কোথা হতেও ভীত না হই, হীনবল না হই; অভীষ্টবর্ষক আপনার মহৎ কর্ম, পতিত-উদ্ধার কর্ম পরিকীর্তনযোগ্য। ক্ষিপ্ত ভগবৎ-আশ্রয়প্রাপ্ত জন এবং অমিতসাধনসম্পন্ন সাধককে দর্শন করি, অর্থাৎ তারা, পরমানন্দে বর্তমান থাকেন, তা আমরা জানি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক প্রার্থনার ভাব এই যে, সর্ববিপদভয়বারক, পতিত-উদ্ধারক, অভীষ্টবর্ষক ভগবান্ আমাদের শক্তিদাতা সখা হোন) [[প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে যদুং এবং তুবশং শব্দ দুটিতে দুজন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করা হয়েছে। কিন্তু একথা পুনঃপুনঃ উল্লেখিত হয়েছে যে, বেদে কোন ব্যক্তিবিশেষের স্থান নেই, স্থানের নাম নেই, রাজা রাজ্যের কোনও ইতিহাস বিধৃত নেই। এখানে তুর্বশং পদে ক্ষিপ্রং ভগবৎ-আশ্রয়প্রাপ্তং জনং এবং যদুং পদে অমিতসাধনসম্পন্নং সাধকং অর্থই সঙ্গত হয়েছে]।

১৭/২– অভীষ্টবর্ষক ভগবান্ শরীরের একাংশের দ্বারা সর্বভূতজাতকে আচ্ছাদন করেন, অর্থাৎ স্বয়ং সমগ্র জগৎ-অতীতরূপে বর্তমান আছেন, আত্ম-উৎসর্গকারী সাধক ভগবানের ক্রোধ উৎপাদন করেন না, অর্থাৎ তাঁকে প্রীত করেন; অমৃতাভিলাষী সাধকের দ্বারা অমৃতযুত জ্ঞানকিরণ লব্ধ হয়; হে দেব! নিত্যকাল আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন; এবং আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -ভগবান্ জগরূপে বিরাজ করেন এবং জগতের অতীতও হন; সেই দেবতা কৃপাপূর্বক আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [বেদ এই মন্ত্রে প্রচার করছেন যে, এই বিশ্ব ভগবানের একাংশে অবস্থিত আছে। বিশ্ব তার থেকে পৃথক নয়, অথচ তিনি বিশ্বেরও : অতীত। তিনি বিশ্বের মধ্যে আছেন অথচ বিশ্বেই তিনি পর্যবসিত নন। এটাই পাশ্চাত্যদর্শনশাস্ত্রের পেনেনথিজম নামক সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক মতবাদের ভিত্তি]। [এই সূক্তের ঋষি– দেবাতিথি কাণ্ব]।

১৮/১– হে পরমেশ্বর্যশালি, হে বহুজনের আশ্রয়স্থল ভগবন! আমার (উচ্চারিত) এই প্রসিদ্ধ বেদমন্ত্ররূপ বাক্যসকল আপনাকে তৃপ্ত করুক, অর্থাৎ আমার হৃদয়ে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করুক। আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনের দ্বারা অগ্নির ন্যায় তেজোযুক্ত শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত জ্ঞানিগণ স্তুতিরূপ বাক্যের দ্বারা আপনার স্তব করে থাকেন অর্থাৎ কোন্ কর্মের দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তার উপদেশ প্রদান করেন। (মন্ত্রের ভাব এই যে, বিশুদ্ধভাবে অথবা সৎকর্মের অনুষ্ঠানের সাথে উচ্চারিত বেদ মন্ত্ৰসমূহই ভগবানকে প্রাপ্ত হয়। অতএব প্রার্থনা, হে ভগবন! আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করুন এবং সৎ-বৃত্তির উৎকর্ষ-সাধনের দ্বারা আমাদের আপনাতে সম্মিলিত করুন)। [মন্ত্রের প্রার্থনার তাৎপর্য এই যে, সেই ভগবান্ যেন আমাদের পূজা গ্রহণ করেন, আমাদের কর্ম তার সাথে যেন যুক্ত হয়; আর সেই কর্মরূপ যানে সংবাহিত হয়ে তিনি আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত. হোন। আমরা যেন সাধু-সৎ-জনের ক্রিয়াকলাপে অনুপ্রাণিত হয়ে, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে ভগবানের পূজায় সমর্থ হই]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-২দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৮/২– সকল জ্ঞানী ব্যক্তিগণ কর্তৃক আত্মশক্তিলাভের জন্য আরাধিত প্রসিদ্ধ এই দেবতা সমুদ্রের ন্যায় অসীম হন; সেই পরমদেবতা সত্যস্বরূপ হন; জ্ঞানরাজ্যে সৎকর্মসাধনে ভগবানের মাহাত্ম্য এবং শক্তি প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, সাধকগণ ভগবানের আরাধনাপরায়ণ হন; আমরা সত্যস্বরূপ দেবতার শক্তি প্রার্থনা করছি)। [তিনি– সত্য, অসীম। তিনি সত্যস্বরূপ, তার চেয়ে বড় সত্য আর কিছুই নেই। তিনি অসীম, অনন্ত। সেই অনন্তের শক্তি যেন আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়, মন্ত্রে এই প্রার্থনাই পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সূক্তের ঋষি মেধাতিথি কাণ্ব। সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম শ্যৈতম্ এবং নৌৎসম]।

১৯/১– সকল জ্ঞানী ব্যক্তি এবং রিপুশত্রুও (অথবা অসৎ লোকসমূহও) যে দেবতার ধনের অধিকারী হয়, প্রসিদ্ধ সেই দেবতা ঊর্ধ্বগমনশীল জ্যোতির্ময় জ্ঞানসাধককে– জ্ঞানীজনে পরমধন প্রদান করেন; হে দেব! আপনাকে পাবার জন্য জ্ঞানীজন আরাধনাপরায়ণ হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ সকল লোককেই পরমধন পরাজ্ঞান প্রদান করেন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যার দ্বারা কোনও ভাব তো পরিস্ফুট করেনই নি, বরং মূল অর্থ জটিলতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদের ব্যাখ্যা ভাষ্যের চেয়ে পরিষ্কার বলে মনে হয়। যথা, –এই সমস্ত আর্য ও দাসগণ যার ধনপালক ও হোতা, যিনি আর্য শ্বেতবর্ণ পবীরুর সম্মুখে উপস্থিত হন, সেই ধনদাতা তোমার সাথে মিলিত হন। তবু এই ব্যাখ্যায় অসঙ্গতি আছে। এখানে তোমার সাথে মিলিত হন এই বাক্যাংশের দ্বারা কি অর্থ প্রকাশিত হয়? তোমার পদে কাকে লক্ষ্য করা হয়েছে? আবার পবীরবি পদেই বা কি বোঝায়? বাংলা ব্যাখ্যাকার এর সাথে একটি টিপ্পনী। সংযোজিত করেছেন, তা এই যে, আর্য ও অনার্যগণের উল্লেখে বোঝা যায় অনার্য আর্যদের দ্বারা ক্রমে বশীভূত বা শিক্ষিত হয়ে আর্যধর্ম ও রীতিনীতি গ্রহণ করেছিল ও ইন্দ্র ইত্যাদিকে স্তুতি করত। আমাদের মন্ত্রার্থে পবীরবি অর্থে জ্ঞানসাধকে গৃহীত]।

১৯/২– আশুমুক্তিকামী সাধক জ্ঞানিগণ অমৃতস্বরূপ, অমৃতদায়ক, জ্যোতির্ময় দেবতাকে আরাধনা করেন; সেই দেবতা আমাদের অভীষ্টপূরক পরমধন প্রদান করুন; পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের আত্মশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — জ্ঞানিগণ ভগবৎপরায়ণ হন। আমরা যেন আত্মশক্তি এবং পরমধন লাভ করি)। [এই সূক্তের ঋষি ষ্টিগু কাথ। এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত গেয়গানের নাম কালেয়ম্]।

২০/১– মহাশক্তিসম্পন্ন হে সত্ত্বভাব! বিশুদ্ধ আপনি আমাদের ব্যাপকজ্ঞানযুক্ত পরাজ্ঞানরূপ ধন প্রদান করুন; তারপর আমাদের জ্ঞানযুক্ত হৃদয়ে পবিত্র অমৃত প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের অমৃতত্ব প্রাপ্ত করান)। [ইন্দো– হে সত্ত্বভাব। অশ্ববৎ– ব্যাপকজ্ঞানযুত। গোমৎ- পরাজ্ঞানযুত, পরাজ্ঞানরূপ ধন। গোষু– জ্ঞানযুক্ত হৃদয়ে। আমাদের। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যানুসারে ইন্দোঅর্থে সোম, গো, অর্থে গরু, অশ্ব অর্থে ঘোড়া ইত্যাদি গৃহীত হওয়ায় এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ এই দাঁড়িয়েছে হে সোম! তোমার শুভ্রবর্ণ রস আমি দুগ্ধের সাথে মিশ্রিত করছি, তোমার বর্ণ অতি চমৎকার; তোমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে; তুমি আগমন করো এবং গো অশ্ব সঙ্গে নিয়ে এস। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১০দ-৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২০/২– শ্রেষ্ঠতম পাপনাশক সত্ত্বস্বরূপ হে দেব! সখা যেমন সখার মঙ্গল সাধন করেন, তেমনই জ্যোতির্ময় পরমমঙ্গলসাধক সেই আপনি আমাদের জ্ঞানদায়ক হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সেই পাপনাশক পরমদেবতা আমাদের পরমজ্যোতিঃ পরাজ্ঞান প্রদান করুন)-[তিনি সখার ন্যায়, বন্ধুর ন্যায় মানুষকে (সৎকর্মের সাধককে) নিজের স্নেহময় ক্রোড়ে ধারণ করেন। তিনি জ্যোতিঃর জ্যোতিঃ, অনন্ত জ্ঞানজ্যোতিঃর আধার, তাই সেই পরমজ্যোতির্ময়ের চরণেই, পরাজ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

২০/৩– হে ভগবন! আপনি আমাদের সম্যকরূপে আপনার বন্ধুভূত করুন; দেবভাববিরোধী সমস্ত রিপুকুল বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনি আমাদের মিত্রভূত হোন; আমাদের সকল রিপুকে বিনাশ করুন। [একটি ভাষ্যানুসারী বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তুমি পূর্বের ন্যায় আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করে; যে কোন দেবশূন্য মায়াবী রাক্ষস আমাদের অনিষ্ট করে তুমি বল প্রকাশপূর্বক তাকে পরাভব কর। আমাদের মন্ত্রার্থে আমরা মন্ত্রটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথম অংশ অস্মাৎ সনেমি– আমাদের আপনার বন্ধুভূত করুন। আমরা যেন আপনার পরম সুহৃদের মতো নিরুপদ্রবে সাধনমার্গে অগ্রসর হতে পারি। আপনার বন্ধুত্বলাভ করলে আমাদের আর কোন ভয় থাকবে না। এর অন্তর্নিহিত সত্য এই যে, ভগবান্ সর্বশক্তিমান্ রিপুনাশকারী। সুতরাং তার কৃপা লাভ করলে মানুষ রিপুদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে। দ্বিতীয় প্রার্থনা আমাদের রিপুকুল যেন বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অদেবং পদের ভাষ্যানুসারী অর্থই অদেবনশীলং– যা এ এই দেবভাববিরোধী, যা দেবত্ব-বিকাশের পথে বিঘ্ন। আবার দ্বয়ুং বাধঃ পদদুটিতে এই রিপুগণের প্রকৃতি আরও পরিস্ফুট হয়েছে। দ্বয়ং পদে রিপুদের দুটি ভাব প্রকাশিত হয়েছে। সেই দুই দিক– অন্তর ও বাহির। অন্তরের শত্রু ও বাহিরের শত্রু– এই দুই রকমের শত্রুরই বিনাশের প্রার্থনা এই মন্ত্রে পরিস্ফুট। কেবলমাত্র ভাষ্যকার যেখানে এই মন্ত্রে ইন্দোপদে সোমকে সম্বোধন করেছেন, আমাদের মন্ত্রার্থে সেখানে ভগবানকে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বকে উদ্দেশ করা হয়েছে। বিশেষ এবং প্রধান পার্থক্য এখানেই]। (এই সূক্তের ঋষি-পর্বতও নারদ। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম ধ্য, ত্ৰৈতম্ এবং পৌষ্কল]।

২১/১– সাধকগণ সত্ত্বসমুদ্রতরঙ্গে পতনকালে অর্থাৎ সত্ত্বভাবপ্রাপক, অভীষ্টবর্ষক সৎকর্ম সম্যকপ্রকারে সাধন করেন, অমৃতের সাথে মিশ্রিত করেন। (ভাব এই যে, -সাধকগণ সত্ত্বভাবপ্রাপক অমৃতময় সৎকর্ম সাধন করেন)। পবিত্রহৃদয় সাধকগণ অজ্ঞানতাকে অমৃতপ্রবাহে নিয়ে যান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকগণ অমৃতের দ্বারা অজ্ঞানতা দূর করেন)। [সাধকেরা সৎকর্ম সম্পাদন করেন। সাধনার ঐকান্তিকতা বোঝাবার জন্য একার্থবাচক অঞ্জতে ব্যঞ্জতে সমঞ্জতে প্রভৃতি পদগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। সাধকেরা শুধু বাহ্য আড়ম্বরের জন্য সৎকর্মসাধনে ব্যাপৃত হন না, পরন্তু তাদের হৃদয়-মন তাতে ঢেলে দেন। তাদের প্রত্যেক নিশ্বাসেও সৎকর্মের চিন্তা মনে জাগরুক থাকে। সেই সৎকর্মের স্বরূপ বোঝাবার জন্য কয়েকটি বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে। সিন্ধোরুচ্ছ্বাসে পতয়ন্তং– সমুদ্রতরঙ্গে পতনশীল অর্থাৎ সত্ত্বভাবের প্রাপক। সৎকর্ম স্বভাবতঃই সত্ত্বভাবের সাথে মিলিত হয়। যাঁদের হৃদয় পবিত্র, তাদের কাছে অজ্ঞানতা থাকতে পারে না। অজ্ঞানতা তাদের হৃদয়ে অমৃতময় পবিত্রতায় ডুবে যায়, অজ্ঞানতার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। মানুষের হৃদয়ে যে পশুত্ব, অজ্ঞানতা আছে, তা সাধকের সাধনার অগ্নিতে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়; তাদের কোন অনিষ্ট করতে পারে না। — – প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে এই মন্ত্রের অর্থ সম্পূর্ণ অন্যরূপ পরিগ্রহ করেছে। উদাহরণ-(পুরোহিতগণ) তাঁকে (সোমরসকে) মাখছেন ও সেই প্রতিভাবে মাখছেন, যেহেতু সেই সোম ক্রতু অর্থাৎ কার্যকুশল। যখন সিন্ধু অর্থাৎ তার রস উচ্ছ্বসিত হয়, তখন তিনি নিজে পতিত হন, তিনি রস সেচন করতে থাকেন। তখনই সুবর্ণ-আভরণধারী পুরোহিতগণ তাঁকে জলে নিয়ে যান, যেমন লোকে পশুকে (স্নানের জন্য) জলে নিয়ে যায়। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্জিকেও (৫অ-৯দ-১১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২১/২– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! জ্ঞানস্বরূপ পবিত্রকারক দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য আরাধনা করো; মহতী অমৃতধারাতুল্য শক্তিপ্রবাহ (অথবা শুদ্ধসত্ত্ব) সেই দেবতা প্রদান করেন; তার কৃপায় সর্পের ন্যায় ক্রজনও মালিন্যদোষযুত কর্ম পরিহার করে; ব্যাপকজ্ঞান যেমন শীঘ্র সাধককে উদ্ধার করে, তেমনভাবে অভীষ্টবর্ষক পাপহারক দেবতা অনায়াসেই সাধকদের প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের আরাধনাপরায়ণ হই; সেই পরম দেবতা সাধকদের অমৃত প্রদান করেন)। [সাধক নিজের চিত্তবৃত্তিকে ভগবানের আরাধনায় বিনিযুক্ত করতে প্রয়াস পাচ্ছেন]।

২১/৩– সর্বশ্রেষ্ঠ লোকাধীশ অমৃতদায়ক সেই দেবতা সকল সাধকগণ কর্তৃক স্তুত হন; সর্বলোকে বিরাজিত সেই দেবতা কালাধীশ হন; তিনি পাহারক, অমৃতস্বরূপ, পরমকল্যাণময়, এ অসীম, জ্যোতির্ময়, পরমাশ্রয়স্বরূপ, পরমধনদাতা আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি এ নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সর্বলোকাধীশ কল্যাণদায়ক ভগবান্ আমাদের পরমধনপ্রাপক হোন)। [এখানে আলোচনার সুবিধার্থে.প্রথমেই এই প্রচলিত অনুবাদটি লক্ষ্যণীয়– এই সোম রাজার ন্যায় অগ্রে অগ্রে চলছেন; তিনি জলের স্রোতের ন্যায় সতেজে যাচ্ছেন। সংসারে দিন পরিমাণ করবার জন্য তিনি নিযুক্ত আছেন। তিনি হরিতবর্ণ, (তিনি জলে স্নান করেছেন, তিনি দেখতে এমনি সুশ্রী, যেন তার শরীরে ঘৃত গড়িয়ে পড়ছে। তিনি ধুনের ভাণ্ডার-স্বরূপ। তিনি উজ্জ্বল রথে আরোহণ পূর্বক ক্ষরিত হচ্ছেন। মন্ত্রের পদগুলির ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার যা বলেছেন, তাতে প্রচলিত একটা মত গড়ে উঠেছে যে, চন্দ্র ও সোম একই বস্তু। অন্ততঃ বৈদিকযুগের শেষভাগে চন্দ্রকেই সোমের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারূপে গ্রহণ করা হয়েছিল, এবং পরিশেষে চন্দ্র ও সোম অভিন্নরূপ ধারণ করেছেন। সোমকেই অনেক স্থলে অমৃত বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং চন্দ্রের সাথে সোমের অভিন্নতা গৃহীত হবার পর। চন্দ্রও সুধার অধীশ্বর বলে গৃহীত হলেন। চন্দ্রকে সুধাকর বলার এটাও একটা কারণ। যাঁরা এই মত সমর্থন করেন, তারা এই মন্ত্রের ভাষ্যে এই মতবাদের বীজ দেখতে পান। প্রচলিত মত অনুসারে এই মন্ত্রটির দেবতা সোম, বিমানঃ পদ তারই বিশেষণ। সুতরাং মন্ত্রের এই পদের ব্যাখ্যায় চন্দ্রেরই মাহাত্ম্যঃ কীর্তিত হয়েছে। এইভাবে সোম চন্দ্রে পরিবর্তিত হয়েছেন। এই গবেষণা সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করা থেকে আমরা বিরত থাকছি। কারণ বর্তমান-মন্ত্রে আমরা সোমের কোনও প্রসঙ্গই পাচ্ছি না। এখানে ভগবৎ-মাহাত্ম্যই কীর্তিত হয়েছে, সুতরাং চন্দ্র বা সোমের সম্পর্কে কিছুরই উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি না। এখানে অহ্নাং বিমানঃপদ দুটির অর্থ গৃহীত হয়েছে– কালাধীশঃঅর্থাৎ যিনি কালের নিয়ন্তা। যিনি কালকে নিয়মিত করেন। স্থান ও কাল প্রভৃতি সমস্ত তাতেই বর্তমান। তিনি কালাতীত। অথবা অন্য মত অনুসারে কালও অনন্ত এবং কাল ভগবানের বিভূতিরই অংশ মাত্র। সুতরাং এই দিক দিয়েও কালকে ভগবানের বিভূতি বললে ভগবানকে কালাধীশ বলা যায়। অন্য একটা দিকও আছে। মানুষ যে সমস্ত কর্ম করে, তার সমস্তই কালসাপেক্ষ। কালের দ্বারা অনেক সময় তাদের কর্ম অথবা কর্মশক্তি নিয়মিত হয়। সুতরাং মানুষের সবরকম কর্মাকর্মের নিয়ন্তা বলেও ভগবানকে কালাধীশ বলা যায়। তাছাড়া কালাধীশ শব্দের অন্য একটা লৌকিক অর্থও আছে। মানুষের আয়ুষ্কাল ভগবানের কৃপার উপর নির্ভর করে। সুতরাং মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে, তা ভগবানের কৃপার দান মাত্র। সুতরাং এই দিক দিয়েও ভগবানকে কালাধীশ বলা যায়। যাই হোক, মন্ত্রে চন্দ্রের কোন উল্লেখ নেই, এটাই ঠিক। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রের প্রথম অংশে ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। সাধকেরা তাকে আরাধনা করেন। সেই পরম দেবতা আমাদের সর্বাভীষ্টপূরক পরমধন (পরাজ্ঞান বা মুক্তি বা মোক্ষ) প্রদান করুন– এটাই প্রার্থনার সারমর্ম]। [-এই সূক্তের ঋষি– অত্রি ভৌম। সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম কাবম]।

— ষোড়শ অধ্যায় সমাপ্ত —

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *