উত্তরার্চিক — পঞ্চদশ অধ্যায়
এই অধ্যায়টির সকল সূক্তেরই দেবতা– অগ্নিদেব।
ছন্দ– (সূক্তানুসারে) ১২। ৩৬৯। ১৪ গায়ত্রী; ৪৭৮ প্রগাথ; ৫ ত্রিষ্টুপ; ১০ কাকুভ প্রগাথ ১১ উষ্ণিক; ১২ (১) অনুষ্টুপ; ১২ (২-৩) গায়ত্রী; ১৩ জগতী।
ঋষিপ্রতিটি সূক্তের শেষে যথাযথ উল্লেখিত।
প্রথম খণ্ড
সূক্ত ১– কস্তে জামির্জনানামগ্নে কো দাশ্বব্বরঃ। কো হ কস্মিন্নসি শ্রিতঃ ॥১॥ ত্বং জামির্জনানামগ্নে মিত্রো অসি প্রিয়। সখা সখিভ্য ঈড্যঃ। ২৷৷ যজা নো মিত্রাবরুণা যজা দেবাং ঋতং বৃহৎ। অগ্নে যক্ষি স্বং দম৷৩৷
সূক্ত ২– ঈডেনন্যা নমস্যরিমাংসি দর্শতঃ। সমগিরিধ্যতে বৃষা৷ ১। বৃষো অগ্নিঃ সমিধ্যতেহশ্বে ন দেববাহনঃ। তং হবিষ্মন্ত ঈড়তে৷৷ ২৷৷– বৃষণং ত্বা বয়ং বৃন্ বৃষণঃ সমিধীমহি। অগ্নে দীদ্যতং বৃহৎ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ৩– উৎ তে বৃহন্তা অৰ্চয়ঃ সমিধানস্য দীদিবঃ। অগ্নে শুক্রাস ঈরতে ॥১॥ উপ কা জুয়েমম ঘৃতাচীর্যন্ত হত। অগ্নে হবা জুষস্ব নঃ ॥ ২॥ মন্দ্ৰং হোতারমৃত্বিজং চিত্রভানুং বিভাবসু। অগ্নিমীডে স উ শ্রবৎ ৷৩৷
সূক্ত ৪– পাহি নো অগ্ন একয়া পাহুত দ্বিতীয়য়া। পাহি গার্ভিস্তিসৃভিরূৰ্জাম্পতে পাহি চতসৃভিবসো৷৷৷৷৷ পাহি বিশ্বম্মাদ্রসো অরাণঃ প্র স্ম বাজেযু নোহব। দ্বামিদ্ধি নেদিষ্ঠং দেবতাতয় আপিং নক্ষামহে বৃধে৷ ২৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– হে জ্ঞানদেব! মনুষ্যগণের মধ্যে আপনার শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী কে আছে? (ভাব এই যে, — জ্ঞানের প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগী কেউই নেই); আর, আপনার ন্যায় সৎকর্মপ্রাপকই বা কে আছে? (ভাব এই যে, — জ্ঞান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সৎকর্মপ্রাপক কেউই নেই); আর আপনার হন্তা বা স্বরূপশক্তিসম্পন্নই বা কে আছে? (ভাব এই যে, — জ্ঞানের হন্তা সমশক্তিসম্পন্ন কেউই নেই); অতএব, কোন্ স্থানে বা কোন্ কর্মে আপনি অবস্থিত আছেন, তা অনুসরণ করা আবশ্যক। (ভাব এই যে, জ্ঞানের প্রভাব অনুভব করে জ্ঞানের অনুসরণে সকলের অনুরাগ উপজনন কর্তব্য)। [পূর্বে ভাষ্যকার জামিঃ পদে ভগ্নী অর্থ গ্রহণ করে গিয়েছেন। সে দৃষ্টিতে ভগ্নী বা সহজাতা থেকে জ্ঞান যে পৃথক নয়, এই ভাবই মানে আসে। কেননা, জ্ঞানের ভগ্নী বা সহজাতা বলতে ভক্তির প্রতিই দৃষ্টি পড়ে। কিন্তু তাতে ক পদের ভাব সঙ্গতি রক্ষা করা যায় না। সুতরাং জামিঃ পদের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থই এখানে সঙ্গত বলে মনে করাই উচিত]।
১/২– হে জ্ঞানদেব! পূর্বোক্ত গুণশক্তিসম্পন্ন আপনি মনুষ্যগণের অর্থাৎ বিষয়ী কুটিলগণের শত্রু। এবং সরলচিত্ত সাধুগণের প্রিয় মিত্র হন; আর অনুরাগসম্পন্ন জনগণের পূজ্য সখা অর্থাৎ অত্যন্ত প্রিয় হন। (ভাব এই যে, — যাঁরা জ্ঞানের অনুসারী, জ্ঞান তাদের হিতসাধন করেন, এবং জ্ঞান-উন্মেষের সাথে পাপিগণ অনুতপ্ত হয়)। [জ্ঞান কাদের পক্ষে শত্রু আর কাদের পক্ষে মিত্র তা বুঝতে গেলে পাপী। কুটিলগণের প্রতি এবং সরল সাধুগণের প্রতি দৃষ্টি পড়ে। জ্ঞানের সান্নিধ্যে এসে কুটিল পাপিগণের যে অনুতাপ, একদৃষ্টিতে তা জামির (শত্রুর) কার্য বলা যেতে পারে; অন্য দৃষ্টিতে আবার বিকৃত পথে পরিচালিত হয়ে জ্ঞান (বিকৃত জ্ঞান) যে অনিষ্ট সাধন করে, তাতেও জামির কার্য বলে লক্ষ্য করতে পারি। সৎ-জ্ঞানের প্রভাবে সাধুগণ যে আনন্দ লাভ করেন, তা-ই মিত্রের কার্য। যখন সরল সাধুগণের হৃদয়ে তার বিকাশ দেখতে পাই, জ্ঞানকে তখনই প্রিয়ঃ মিত্রঃ বলে অভিহিত করা যায়]।
১/৩– হে জ্ঞানদেব হে আমার জ্ঞান)! আপনি আমাদের হিতসাধনের জন্য, মিত্র ও বরুণ দেবতা দুজনকে (অর্থাৎ মিত্রস্বরূপ হিতসাধক এবং অভীষ্টবষকরূপ মঙ্গল বিধায়ক দেবদ্বয়কে) পূজা করুন অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত করুন; এবং দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণসমূহকে অর্থাৎ সকল দেবভাবকে পূজা করুন অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত করুন; এবং শ্রেষ্ঠ সত্যকে বা সৎকর্মকে আর আপনার আবাসস্থানকে (অথবা শাসনকে কুকর্ম হতে মনের নিবৃত্তিকে) পূজা করুন অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত করুন। (ভাব এই যে, আমাদের জ্ঞান আমাদের দেবভাব-প্রদানে, সৎকর্মের অনুষ্ঠানে ও কুকর্মের নিবৃত্তিতে আমাদের নিয়োজিত করুক)। [এই মন্ত্রে সাধক-গায়ক নিজেকে দেবভাব-সমন্বিত করবার এবং কুকর্মে প্রতিনিবৃত্ত করাবার কামনা প্রকাশ করছেন। জ্ঞানের সাহায্যে দেবত্ব-প্রাপ্তিই মন্ত্রের সঙ্কল্প]। [এই সূক্তের ঋষি-গোতম রাহ্গণ]।
২/১– স্তোতাগণের দ্বারা আরাধিত পূজনীয় অজ্ঞানতানাশক সর্বজ্ঞ অভীষ্টবর্ষক জ্ঞানদেব বিশ্বকে জ্ঞানের দ্বারা আলোকিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবনক্তৃপায় তার জ্ঞানালোকের দ্বারা জগতেব অজ্ঞানতার তমঃ দূরীভূত হয়)। [তিনি তমাংসি তিরঃ অর্থাৎ অন্ধকার নাশ করেন। জ্যোতিঃস্বরূপ তিনি। তার জ্যোতিঃর প্রভাবেই জগৎ জ্ঞানের আলোক লাভ করে। তিনি দর্শতঃ– সকলের দ্রষ্টা, তাঁর দিব্যদৃষ্টিতেই জগৎ ভাসমান রয়েছে]।
২/২– ব্যাপকজ্ঞান যেমন দেবত্বপ্রাপক, তেমন দেবত্বপ্রাপক অভীষ্টবর্ষক জ্ঞানদেব নিশ্চিতভাবে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সাধকগণ সেই প্রসিদ্ধ জ্ঞানদেবতাকে আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ ভগবৎপরায়ণ হন। আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি)। [এখানেও, পূর্বাপর মন্ত্রার্থের মতোই, অগ্নি ও অশ্ব পদদুটিতে যথাক্রমে জ্ঞানদেবঃও ব্যাপকজ্ঞানংঅর্থ সঙ্গতভারেই গৃহীত হয়েছে। অগ্নি বলতে কাষ্ঠ ইত্যাদি দাহনশীল অগ্নিকে এবং অশ্ব বলতে ঘোড়াকে লক্ষ্য করা হয়নি]।
২/৩– অভীষ্টবর্ষক হে জ্ঞানদেব! প্রার্থনাপরায়ণ আমরা অভীষ্টবর্ষক জ্যোতির্ময় মহান্ আপনাকে আমাদের হৃদয়ে যেন প্রোজ্জ্বল করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা হৃদয়ে যেন পরাজ্ঞান সমুৎপাদিত করতে সমর্থ হই)। [এই সূক্তটির ঋষি– বিশ্বামিত্র গাথিন]।
৩/১– দীপ্যমানন্ হে জ্ঞানদেব! জ্যোতির্ময় আপনার মহান্ নির্মল জ্ঞানকিরণসমূহ আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনার কৃপায় আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি)।
৩/২– পাপহারক (অথবা কামনাপূরক) হে জ্ঞানদেব! প্রার্থনাকারী আমার অমৃতকামী আরাধনা আপনাকে প্রাপ্ত হোক; আমাদের প্রার্থনা প্রভৃতি গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! আমরা যেন আপনার আরাধনাপরায়ণ হই; অকিঞ্চন আমাদের পূজা কৃপাপূর্বক গ্রহণ করুন)।
৩/৩– পরমানন্দদায়ক, দেবভাবপ্রাপক, সর্বজ্ঞানময়, সৎকর্মসাধক জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেবকে আরাধনা করছি; সেই পরমদেবতা নিশ্চিতভাবে আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি জ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করছি; ভগবান কৃপাপূর্বক আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [এই সূক্তের ঋষি-বিরূপ আঙ্গিরস। মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– অমহীয়বম এবং জরাবোধীয়ম্]
৪/১– হে জ্ঞানস্বরূপ দেবতা! আপনি প্রথম কর্মমূর্তির দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন; এবং দ্বিতীয়– জ্ঞানমূর্তির দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন; বলপালক হে দেব! আপনি আমাদের স্তুতি দ্বারা স্তুত হয়ে, কর্মজ্ঞানভক্তিরূপ মূৰ্তিত্রয় দ্বারা আমাদের পালন করুন। নিবাসস্থানীয় হে দেব! আপনি কর্ম-জ্ঞান-ভক্তি-মোক্ষ-রূপ মূর্তি চতুষ্টয়ের দ্বারাও আমাদের রক্ষা করুন। (এখানে সাধনমার্গের স্তর পর্যায় বিবৃত হয়েছে। ভাব এই যে, — সাধক যথাক্রমে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমবায়ে মোক্ষরূপ চতুর্থ অবস্থা লাভ করেন)। [নিগূঢ়-তত্ত্বমূলক এই মন্ত্রের অন্তর্গত একয়া দ্বিতীয়য়া প্রভৃতি পদ কয়েকটি নিয়ে ব্যাখ্যাকারেরা বিষম সমস্যায় পড়েছেন। শেষপর্যন্ত এই মন্ত্রের ভাষ্য-অনুমোদিত অর্থ দাঁড়িয়েছে– হে অগ্নিদেব! আপনি একটি ঋকের দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন; অপিচ, দ্বিতীয় ঋকের দ্বারা (আমাদের) পালন করুন। অন্ন অথবা স্বামী হে দেব! আপনি তিনটি স্তুতির দ্বারা তেমন রক্ষা করুন। বালক (গার্হপত্য-নামক), হে অগ্নি! চারটি বাক্যের দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন। কিন্তু মন্ত্রের প্রার্থনার বিষয়টি একটু বিশদভাবে বোঝবার চেষ্টা করা যেতে পারে। সে পক্ষে, রসায়ন বিজ্ঞানের রাসায়নিক বিমিশ্রণের প্রক্রিয়া-পরিণতির ঔরপর্যায় অনুধাবনীয়। একের সাথে অন্যের সংমিশ্রণে একটি নূতন অবস্থার উৎপত্তি হয়। সে অবস্থায় সেই দুই মূল বস্তুর সত্ত্বা বিদ্যমান থাকে; অথচ আর এক নূতন বস্তুর উদ্ভব হতে পারে। তার সাথে যদি অপর কোনও সামগ্রীর মিশ্রণ ঘটে, তাতে অপর এক রূপান্তর উপস্থিত হয়। এতে তিন অবস্থার মধ্যে আবার এক চতুর্থ অবস্থা এসে পড়ে। এখানে সেই মিশ্রণের ভাব ব্যক্ত আছে। প্রথম ছিল কর্ম; তারপর এলো– জ্ঞান তারপর এলো– ভক্তি। তখন আর তিনের মধ্যে পার্থক্য রইল না। সেই তিন যখন এক হয়ে রইল অথবা একাধারে তিনই হয়ে রইল, তখনই তাদের সম্মিলন-সংমিশ্রণ-জনিত চতুর্থ অবস্থা উপস্থিত হলো। সেই অবস্থাকেই মুক্তি বা মোক্ষ বলে অভিহিত করা যায়। সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখতে গেলে, সে অবস্থায় তিন থেকে চারের উৎপত্তি বুঝতে পারা যায়। মন্ত্রের চারটি পাদের (চতসৃভিঃর সার্থকতা এই অনুভাবনাতেই প্রতিভাত হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-৪দ-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৪/২– হে দেব! সকল অসৎকর্মে নিয়োজক রিপুগণ হতে আমাদের রক্ষা করুন; রিপুসংগ্রামে আমাদের প্রকৃষ্টরূপে রক্ষা করুন; দেবত্বলাভ ও উৎকর্ষপ্রাপ্তির জন্য নিকটতম– শ্রেষ্ঠতম বন্ধুভূত আপনাকেই যেন লাভ করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের সর্বরিপুর কবল হতে রক্ষা করুন; যেভাবে আমরা আপনাকে প্রাপ্ত হই, তা করুন)। [এই সূক্তটির ঋষি-ভর্গ প্রাগাথ। এর অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম-রৌরবম, দৈর্ঘশ্ৰবসম, সম্মতম এবং যৌধাজয়ম]।
.
দ্বিতীয় খণ্ড
সূক্ত ৫– ইনো রাজন্নরতিঃ সমিদ্ধো রৌদ্রো দক্ষায় সুষুমাঁ অদর্শি। চিকিদবিভাতি ভাসা বৃহতাসিক্রীমেতি রুশতীমপাজ৷৷ ১৷৷ কৃষ্ণাং যদেনীমভি বসাভূজ্জনয়ন্ যোষাং বৃহতঃ পিতুর্জা। উং ভানুং সূর্যস্য স্তভায় দিবো বসুভিররতির্বি ভাতি৷২৷৷ ভদ্ৰো ভদ্রয়া সচমন আগাৎ স্বসারং জারো অভ্যেতি পশ্চাৎ। সুপ্রকেতৈভিরগ্নির্বিতিষ্ঠশাঙিবর্ণৈরভি রামমস্থাৎ ৷ ৩৷৷
সূক্ত ৬– কয়া তে অগ্নে অঙ্গির উর্জোনপাদুপস্তুতি। বরায় দেব মন্যবে॥১॥ দাশেম কস্য মনসা যজ্ঞস্য সহসো যহো। কদু বোচ ইদং নমঃ ॥ ২॥ অধা ত্বং হি নস্করা বিশ্ব্য অস্মভ্যং সক্ষিতীঃ। বাজদ্রবিণসো গিরঃ ॥৩৷৷
সূক্ত ৭– অগ্নে আয়াহ্যগ্নিভিহোতারং ত্বা বৃণীমহে। আ ত্বমনজু প্ৰযতা হবিষ্মতী যজিং বহিরাসদে৷৷৷৷৷ অচ্ছা হি ত্বা সহসঃ সূনো অঙ্গিরঃ সুবশ্চরন্ত্যধরে। উর্জো নপাতং ধৃতকেশমীমহেহগ্নিং যজ্ঞেযু পূর্ব ২
সূক্ত ৮– অচ্ছা নঃ শীরশোচিং গিয়ো যন্তু দর্শত। অচ্ছা যজ্ঞামো নমসা পুরবসুং পুরুপ্রশস্তমূতয়ে॥১॥ অগ্নিং সূনুং সহসো জাতবেদসং দানায় বার্যাণাম। দ্বিতা যো ভূমৃতো মর্তো হোতা মন্দ্রতমো বিশি৷৷ ২৷৷
.
মন্ত্ৰার্থ— ৫সূক্ত/১সাম– হে জ্যোতির্ময় প্রভো! আপনি বিশ্বাধিপতি হন; উজ্জ্বল, মঙ্গলদায়ক দেবারাধনায় প্রযোজক রিপুনাশক সেই দেবতা সাধকদের সৎকর্মসাধনের জন্য তাঁদের দিব্যদৃষ্টি প্রদান করেন। সর্বজ্ঞ তিনি জ্যোতিঃর সাথে বিশ্বে জ্ঞানালোক বিতরণ করেন; তার অনুগ্রহে অন্ধকার দূর করে উজ্জ্বল দীপ্তি আমাদের হৃদয়ে আগমন করুক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — বিশ্বাধিপতি পরমদেব সাধকদের রিপুনাশ করে তাদের পরাজ্ঞান প্রদান করেন; তিনি আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)।
৫/২– দেবারাধনায় প্রযোজক দেবতা যখন মহান্ জগৎপালক দেবতার (অর্থাৎ ভগবানের) জায়মান শক্তিকে বিকাশ করে আপন তেজে অজ্ঞানান্ধকারকে অভিভূত করেন, তখন জ্ঞানদেবের জ্যোতিঃ সাধকের হৃদয়ে প্রকাশিত হয়; এবং সেই পরমদেবতা দ্যুলোকের পরমধন সহ সাধককে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ জগতের অজ্ঞান-অন্ধকার আপন জ্যোতিতে নিবারণ করে সাধকদের প্রদান করেন)। [চন্দ্রসূর্য, অগ্নি প্রভৃতি যে সমস্ত পার্থিব পদার্থ জ্যোতিষ্মন বলে পরিচিত তা সমস্তই সেই এক পরমজ্যোতির্ময়ের জ্যোতিঃর কণিকাবিকাশ মাত্র। সুতরাং সূর্য অগ্নি প্রভৃতি পদের প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করলেও তাদের স্বরূপতঃ অভেদত্ব প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু এখানে সূর্য অগ্নি প্রভৃতি শব্দে যে বস্তুর দ্যোতনা করে, তা পার্থিব পদার্থের অতীত সেই পরম জ্যোতিঃর সন্ধানই দেয়। সুতরাং মন্ত্রে সেই এক পরম জ্যোতির্ময়ের মহিমাই কীর্তিত হয়েছে। তিনিই জগতের তমঃ বিনাশ করেন, তিনি মানুষের অন্তরে জ্ঞানরূপে বিবেকশক্তিরূপে বিরাজমান থেকে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করছেন]।
৫/৩– পরম আরাধনীয় কল্যাণদায়ক দেবতা পরম কল্যাণের সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন; তারপর রিপুনাশক সেই দেবতা ভগিনীভূত জ্ঞানশক্তি আমাদের প্রাপ্ত করান; জ্ঞানদেব পরাজ্ঞানের সাথে, জ্যোতিঃর সাথে, সর্বত্র বর্তমান হন; সেই দেবতা নির্মল জ্যোতিঃর সাথে, পরম রমণীয় ধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে পরমদেবতা! আমাদের পরাজ্ঞান এবং পরমধন প্রদান করুন) [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– অগ্নি নিজে সুরূপ, সুরূপা দীপ্তির সাথে সমাগত হয়ে আসছেন, তিনি উপপতির ন্যায় ঊষার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাচ্ছেন। উজ্জ্বল আলোকে পরিপূর্ণ হয়ে তিনি নিজের শ্বেতবর্ণ কিরণসহকারে কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকারকে পরাভব করছেন। এই সঙ্গে এই মন্ত্রের ঠিক পূর্বমন্ত্রের বঙ্গানুবাদের একাংশ লক্ষণীয়– এই অগ্নি সূর্যের পত্নী ঊষাদেবীকে জন্মদান করলেন। এইভাবে সূর্য, অগ্নি, ও ঊষাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ উপন্যাস সৃষ্টিও করলেন যেমন ঊষার পশ্চাতে সূর্য ধাবমান হন বলে সূর্যের কন্যাবলাৎকার অপবাদ আছে। আবার অন্যত্র সূর্য ও ঊষার মধ্যে প্রণয়সম্বন্ধ সূচনারও অভাব ঘটেনি। যাই হোক, পূর্ব মন্ত্রের ও বর্তমান মন্ত্রের অনুবাদ বা মন্ত্রের ব্যাখ্যা একসঙ্গে পাঠ করলে আমরা কি বুঝতে পারি? আগের মন্ত্রে দেখলাম যে, অগ্নি ঊষার পিতা, আবার এখানে তিনি ঊষার উপপতির মতো পিছনে পিছনে যাচ্ছেন। কি অপূর্ব সামঞ্জস্য! পিতা ও উপপতি একই! এমন অদ্ভুত ব্যাখ্যা দেখে যদি কেউ বেদের প্রতি কোনরকম অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন, সেজন্য এই মহা-মহা ব্যাখ্যাকারগণই দায়ী। এই বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে এ মন্ত্ৰান্তৰ্গত জার পদ। অনুবাদকার ঐ পদের উপপতি অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ভাষ্যে এটির অর্থ শণাং জারয়িতা অর্থাৎ শত্রুদের যিনি বিনাশ করেন। এটাই সঙ্গত অর্থ। অনুবাদকার তা গ্রহণ না। করে একটা বিকৃত অর্থ করে বসলেন। বিশেষতঃ উপমাবাচক উপপতির ন্যায় অর্থ কোথা থেকে এলো, তা বোঝা যায় না। কারণ, মন্ত্রে উপমাবাচক কোন পদ নেই]। এই সূক্তের ঋষি– ত্রিত আপ্তা। সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– ঔশনম]।
৬/১– জ্ঞানিগণের আরাধনীয় আত্মশক্তিদায়ক হে জ্ঞানদেব! বরণীয় রিপুদমন আপনাকে প্রাপ্তির জন্য আপনার মহিমাকীর্তন কোন্ বাক্যের দ্বারা সম্পাদন করব? (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক ভাব এই যে, বাক্যমনের অগোচর পরমদেবতার মহিমাকীর্তন আমাদের মতো লোকের সাধ্যাতীত; সেই দেবতা কৃপাপূর্বক আমাদের তাঁর আরাধনা করতে সমর্থ করুন)। [ভগবান্ অবামনসোগোচরং– বাক্যমনের অতীত। সসীম মানুষ তার সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও কর্মশক্তি নিয়ে সেই অসীম অনন্তকে বুঝতে পারে না। মানুষ তাঁকে জানতে পারে না — যদি তিনি নিজে তার নিকট নিজেকে ধরা না দেন। শ্রুতিও বলেছেন, আত্মা (অর্থাৎ বিশ্বাত্মা ভগবান) যাকে বরণ করেন, তিনিই তাঁকে প্রাপ্ত হন। তাই সেই পরমদেবতাকে জিজ্ঞাসা– আমি তো জানি না কি উপায়ে কি উপচারে তোমার পূজা করতে হয়, কোন্ মন্ত্রে তোমার আরাধনা করতে হয়। ওগো আমায় বলে দাও কিভাবে তোমার পূজা করব। — নপাৎ পদের অর্থ যার হতে বা যার দ্বারা পতন হয় না, অর্থাৎ যা রক্ষা করে। তাই ঊর্জঃ নপাৎ পদে আত্মশক্তিদায়ক অর্থ গৃহীত হয়েছে]
৬/২– আত্মশক্তি এবং সৎকর্মের পুত্র অর্থাৎ আত্মশক্তি এবং সৎকর্ম হতে উৎপন্ন হে জ্ঞানদেব! আমরা কোন দেবতার মননশক্তির সাথে যুক্ত হয়ে পূজা প্রদান করব? কখন আমাদের হৃদয়নিহিত ভক্তি ইত্যাদি নমস্কার অর্থাৎ প্রার্থনা উচ্চারণ করব? (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রের অন্তর্নিহিত ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের আপনাকে আরাধনা করবার শক্তি প্রদান করুন)। [পূর্বের মন্ত্রটির মতোই সাধক এখানেও ভগবানের কাছে নিজের দুর্বলতা ও দৈন্য নিবেদন করছেন। অবশ্য ভগবানের আরাধনাতে, তাঁর চরণে আত্মনিবেদনই যে মানুষের পরম পুরুষার্থ সে সম্বন্ধে ধারণাও তার আছে। সাধক ভগবানের কাছে শুধু জানতে চায়– কদু ইদং নমঃ বোচে– কখন আমি তোমার চরণে প্রণত হবো, তোমার আরাধনায় আত্মনিয়োগ করতে সমর্থ হবো? — একটি প্রচলিত হিন্দী অনুবাদ– হে বলসে উৎপন্ন হুএ অগ্নিদেব! কৌন সে দেবযজন করনেওয়ালে যজমানকে মনসে যুক্ত হু হাম তুহ্মৈ হবি অর্পণ করে। যহ হবি বা নমস্কার কব উচ্চারণ করু?– মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।
৬/৩– হে দেব! আপিনই আমাদের সকল প্রার্থনাকে আত্মশক্তিদায়িকা করুন। তারপর আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের প্রার্থনার দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন)। [এই সূক্তটির ঋষি-উশনা কাব্য। এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম যথা, -মহাবমদেব্যম]।
৭/১– হে জ্ঞানদেব! দেবভাবপ্রদানকারী আপনাকে আরাধনা করছি; আপনি জ্ঞানকিরণসমূহের সাথে আগমন করুন– আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; এই পূজাপরায়ণ জন অতিযত্নের সাথে আরাধনীয় আপনাকে প্রাপ্ত হোক। হে দেব! আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)।
৭/২– আত্মশক্তির পুত্র অর্থাৎ আত্মশক্তি হতে উৎপন্ন, জ্ঞানিগণের বরণীয় হে জ্ঞানদেব! সৎকর্মের সাধনে আপনাকেই সম্যকরূপে পাবার জন্য আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা উগমন করুন; সৎকর্মসাধনে আত্মশক্তির রক্ষক (অথবা আত্মশক্তিদায়ক) অমৃতদায়ক নিত্য জ্ঞানদেবতাকে আমরা যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আমরা যেন প্রার্থনাপরায়ণ হই; আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি)। [ইতিপূর্বেও বলা হয়েছে, এই মন্ত্রেও বলা হচ্ছে, জ্ঞান বা জ্ঞানদেব আত্মশক্তির পুত্র। সহসঃ সূনো বাক্যের ভাষ্যার্থ বিলস্য পুত্র অর্থাৎ শক্তির দ্বারা বা শক্তি হতে উৎপন্ন। আত্মশক্তি থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সাধনায় আত্মনিয়োগের ফলে সাধকের হৃদয় বিশুদ্ধ হয়, চিত্ত নির্মল হয়। সুতরাং সেই পবিত্র হৃদয়ে জ্ঞানের জ্যোতিঃ বিকশিত হয়। তাই জ্ঞানকে সহসঃ সূনো বলা হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি– ভর্গ প্রাগাথ। এর দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– নৌধসম্ এবং নৈপাতিথম]।
৮/১– আমাদের প্রাথনা জ্যোতির্ময় সর্বজ্ঞ দেবতার অভিমুখে গমন করুক; রিপুকবল হতে রক্ষালাভের জন্য আমাদের সৎকর্মসমূহ ঐকান্তিক ভক্তির সাথে প্রভূতধনসম্পন্ন সকল লোককর্তৃক আরাধনীয় জ্ঞানদেবতার আভমুখে গমন করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ঐকান্তিক প্রার্থনার দ্বারা পরাজ্ঞান লাভ করি। আমরা যেন ভগবানে সর্বকর্মের ফল অর্পণ করতে সমর্থ হই)। [এই মন্ত্রেও নিষ্কামভাবে কর্মসাধনসামর্থ্য লাভের জন্য প্রার্থনা আছে। যজ্ঞাসঃ পুরূবসুং অচ্ছা– আমাদের কর্মসমূহ সেই পরমধনদাতার প্রতি ভগবানের প্রতি গমন করুক, আমরা যেন আমাদের সর্বকার্যের পাপপুণ্যের বোঝা তারই চরণে নিবেদন করতে পারি]।
৮/২– অমৃতস্বরূপ যে জ্ঞানদেব লোকবর্গের মধ্যে পরা ও অপরা এই দুই রূপে বর্তমান আছেন, দেবভাবপ্রাপক এবং পরমানন্দদায়ক যে দেবতা সাধকবর্গের মধ্যে বিরাজ করেন, আত্মশক্তি হতে উৎপন্ন সর্বজ্ঞ সেই জ্ঞানদেবতাকে পরমধন প্রাপ্তির জন্য আমরা প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যাচ্ঞা করছি; অমৃতস্বরূপ ভগবান্ আমাদের তা প্রদান করুন। [দ্বিতা পদে অগ্নির দুই স্বরূপের পরিচয় পাওয়া যায়; অর্থাৎ জ্ঞান সাধারণতঃ দুভাগে বিভক্ত। পরা ও অপরা। অপরাজ্ঞান মোক্ষলাভের প্রকৃষ্ট উপায় না হলেও, জাগতিক জ্ঞান– এই অপরাজ্ঞান মোক্ষপথের প্রথম অবস্থায় সাহায্য করে। কারণ জগৎ-বিশ্ব, সেই পরমপুরুষ থেকে ভিন্ন নয়। যদিও পরাজ্ঞান লাভ করলে অপরাজ্ঞানের কোনও প্রয়োজন থাকে না, তথাপি প্রথমে অপরাজ্ঞান সাধকের সহায়তা করে। এই পরিদৃশ্যমান বিশ্ব এবং তার জ্ঞান ও জ্ঞানপ্রণালীর মধ্য দিয়েই মানুষকে অগ্রসর হতে হয়। একটি সাধারণ বস্তুর (পরিবর্তনশীল) পরিচায়ক জ্ঞান অপরাজ্ঞান। সেই বস্তুকে কেন্দ্র করে, তার সৃষ্টি অর্থাৎ মূল সম্পর্কিত তত্ত্ব তথা তার আদিমতম অষ্টাসম্পর্কিত জ্ঞানই পরাজ্ঞান। প্রথমে অপরাজ্ঞানকে অবলম্বন না করলে পরাজ্ঞান লাভ সম্ভব হয় না। তাই সাধনায় পরা এবং অপরা এই দুই জ্ঞানেরই স্থান আছে। মন্ত্রে এই দুইরকম জ্ঞানের কথা উল্লেখিত আছে]। [এই সূক্তটির ঋষি– সুদীতি ও পুরুমীঢ়। সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্রদুটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম — সালেয়ম্ এবং শ্রায়ন্তীয়ম]।
.
তৃতীয় খন্ড
সূক্ত ৯– অদাভ্যঃ পুরত্ৰতা বিশামগ্নির্মানুষীণা। তূর্ণী রথঃ সদা নবঃ ॥১॥ অভি প্রয়াংসি বাহসা দার্শ্ব অশ্নোতি মর্তঃ। ক্ষয়ং পাবকশোচিষঃ। ২৷৷ সাহা বিশ্বা অভিযুজঃ ক্রতুর্দোনামমৃক্তঃ। অগ্নিস্তুবিশ্রবস্তমঃ ॥৩॥
সূক্ত ১০– ভদ্রো নো অগ্নিবাহুতো ভদ্রা রাতিঃ সুভগ ভদ্রো অধূরঃ। ভদ্রা উত প্রশস্তয়ঃ ॥১॥ • • ভদ্রং মনঃ কৃণুষ বৃত্ৰতৃর্ষে যেনা সমৎসু সাসহিঃ। অব স্থিরা তনুহি ভূরি শর্ধতাং বনেমা তে অভিষ্টয়ে৷৷ ২৷৷
সূক্ত ১১– অগ্নে বাজস্য গোমতঃ ঈষানঃ সহসো যহো। অস্মে ধেহি জাতবেদো মহি শ্ৰবঃ ১। . স ইধানো বসুন্ধবিরগ্নিরীডেন্যো গিরা। রেবদম্মুভ্যং পূর্বণীক দীদিহি৷৷ ২৷৷; ক্ষপো রাজনুত অনাগ্নে বস্তোরুতোষসঃ। স তিন্মজন্তু রক্ষসো দহ প্রতি৷৷৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ৯সূক্ত/১সাম– মনুষ্যলোকদের অর্থাৎ সকল জনের সৎমার্গ প্রদর্শক আশুমুক্তিদায়ক সৎকর্মপ্রাপক নিত্যতরুণ জ্ঞানদেব অজাতশত্রু হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, নিত্যজ্ঞানই লোকবর্গের মোক্ষপ্রাপক হয়)। [মানুষের মধ্যে থেকে জ্ঞানই মানুষকে উধ্বর্মর্গে পরিচালিত করে– সৎ-মার্গে নিয়ে যায়। মানুষীণাং বিশাং পদ দুটিতে সমগ্র মানবজাতিকে বোঝাচ্ছে। জ্ঞানবলেই মানুষ আশুমুক্তিলাভে সমর্থ হয়; তূর্ণী পদে তা-ই বোঝাচ্ছে। জ্ঞানের অন্য এ বিশেষণ– রথঃ। জ্ঞান (রথের মতোই) মানুষকে সৎকর্মে প্রবর্তিত করে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেয়। সদা নবঃ পদেও জ্ঞানের একটি বিশেষত্ব প্রকটিত হয়েছে। এর অর্থ চিরনূতন নিত্যতরুণ। জ্ঞান অনাদি অনন্ত হলেও প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নবনবরূপে দেখা দেয়]।
৯/২– সাধক মনুষ্য আরাধনার সাধনভৃত জ্ঞানের দ্বারা শক্তি ইত্যাদি প্রাপ্ত হন; এবং পবিত্রতাসাধক পরাজ্ঞান হতে পরমপদ লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধক পরাজ্ঞানের দ্বারা সর্বাভীষ্ট পরমপদ মোক্ষ প্রাপ্ত হন)।
৯/৩– সকল রিপুদের অভিভবকারী দেবভাবপ্রাপক শত্রুগণকর্তৃক অহিংসিত অর্থাৎ অপরাজেয় জ্ঞানদেব পরমধনদায়ক হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানের দ্বারাই পরমধন লাভ হয়। [জ্ঞানের দ্বারা যে কেবল রিপুনাশ হয়, তা-ই নয়, জ্ঞান মানুষের মধ্যে দেবভাবেরও সঞ্চার করেন। তিনি দেবানাং ক্রতুঃ অর্থাৎ দেবভাবসমূহের কর্তা, দেবভাবের প্রাপক। জ্ঞানের সাথে দেবভাবের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ জ্ঞানের সাধনায় মানুষ দেবত্বের পথে অগ্রসর হয়, দেবত্বলাভ করে। এটাই দেবানাং ক্রতুঃ পদ দুটির অর্থ]। [এই সূক্তটির ঋষি– বিশ্বামিত্র গাথিন। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– সংহিতম]।
১০/১– আহুত অর্থাৎ আমাদের মানস যজ্ঞে সত্ত্বভাব ইত্যাদির দ্বারা প্রবৃদ্ধ, জ্ঞানদেব, আমাদের কল্যাণবিধায়ক হোন। হে শোভনদানসমর্থ অর্থাৎ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-রূপ চতুর্বর্গের ফলদাতা জ্ঞানদেব! আপনার দান আমাদের কল্যাণপ্রদ হোক; আর আমাদের যজ্ঞ (সৎকর্ম-অনুষ্ঠান) আমাদের কল্যাণপ্রদ হোক; এবং আমাদের স্তুতিসমূহ আমাদের কল্যাণদায়িকা হোক। (ভাব এই যে, জ্ঞানদেব সকল কল্যাণের নিলয়। তিনি আমাদের অশেষ-কল্যাণহেতুভূত হোন, এবং মোক্ষের বিধান করুন)। [মন্ত্রের শেষ প্রার্থনা– আমাদের স্তুতিসমূহ মঙ্গলপ্রদ তোক। ভাব এই যে, আমরা যেন একমনে একসাথে তাকে ডাকতে সমর্থ হই। ডাকার মতো ডাকতে পারলে, ভগবান্ নিজেই এসে উপস্থিত হন। আমরা যেন তাকে ডাকার মতো ডাকতে পারি। আমাদের স্তবস্তুতিতে যেন কোনরকম কপটতা না থাকে। আর আমরা সেই উপলক্ষে যে সব কর্মের অনুষ্ঠান করব, তা যেন সৎসংশ্রবযুক্ত হয়। সক্কর্মের প্রভাবে আমরা নিশ্চয়ই তাকে পেতে সমর্থ হবো]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ ১২দ-৫সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১০/২– হে দেব! রিপুসংগ্রামে পাপনাশের জন্য আমাদের মনকে কল্যাণকামী করুন; যেভাবে রিপুসংগ্রামে আমরা শত্ৰুজয়ী হই, তেমন করুন; রিপুদের প্রভূতপরিমাণ দৃঢ়বল বিনাশ করুন; অভীষ্টপ্রাপ্তির জন্য আপনার কৃপা প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমমঙ্গল প্রদান করুন এবং আমাদের রিপুজয়ী করুন)। [দুটি উপায়ে রিপুর কবল থেকে উদ্ধার লাভ করা যায়। প্রথম উপায়– নিজে শক্তিলাভ করে। দ্বিতীয় উপায় রিপুদের হীনশক্তি করে। মন্ত্রের মধ্যে এক অংশে মঙ্গলজনক শক্তিলাভের প্রার্থনা রিপুজয়ের প্রার্থনা আছে। অপর উপায় অর্থাৎ রিপুদের হীনশক্তি করবার জন্যও অপর অংশে প্রার্থনা আছে। শর্ধতাং ভূরি স্থিরা অবতনুহিশত্রুদের অভেদ শক্তিকে বিনাশ করুন। সবশেষে অভীষ্ট প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা– হে অগ্নি! সংগ্রামে মন কল্যাণকর করো, গ. তুমি. এই মনের দ্বারা সংগ্রামে শত্রুগণকে পরাজিত করো, অভিভবকারী শত্রুদের প্রভূত ও স্থির বল পরাজিত করো, আমরা অভিগমনসাধন হব্যের দ্বারা তোমার ভজনা করব। একমাত্র প্রজ্বলন্ত সি অগ্নিকেই উদ্দেশ করে এমন প্রার্থনা সমীচীন কিনা বিচার্য। জ্ঞানদেবের কাছেই এমন প্রার্থনার সঙ্গতি নির্দ্বিধায় মান্য]। [এই সুক্তের ঋষি– সোভরি কাণ্ব]।
১১/১– শক্তির আশ্রয় অর্থাৎ সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্যের জনয়িতা হে জ্ঞানদেব! আপনি জ্ঞানসহযুত সৎকর্মের পালক হন; অতএব হে সর্বতত্ত্বজ্ঞ! আমাদের মধ্যে মহৎ বা প্রভূত মঙ্গল স্থাপন করুন। (সৎকর্মসমুদ্ভূত জ্ঞানের প্রভাব এখানে পরিবর্ণিত আছে; তার দ্বারা মহতী সিদ্ধি হয়– এটাই ভাবার্থ)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায়, এই মন্ত্রে, বলের পুত্র অগ্নিকে সম্বোধন করে গরু ইত্যাদি পশুসহ ধন বা অন্ন প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, এই মন্ত্রে সেই শক্তির আশ্রয় সৎকর্মের প্রজনক জ্ঞানদেবতাকেই সম্বোধন করে, তিনি যে জ্ঞানসহযুত সৎকর্মের পালক অথবা তিনি যে স্তুতিমন্ত্র নিষেবিত ভগবৎ-উপাসনারূপ সৎকর্মের ঈশ্বর তা-ই বলা হয়েছে; এবং তার কাছে পরমমঙ্গল প্রার্থনা করা হয়েছে]।
১১/২– প্রসিদ্ধ লোকহিতসাধক সেই জ্ঞানদেবতা– দীপনশীল অর্থাৎ দৃষ্টিশক্তিপ্ৰদাতা, নিবাসয়িতা অর্থাৎ মোক্ষদাতা, সর্বদর্শী এবং স্তোত্রের দ্বারা (অনুশীলনের দ্বারা) স্তোতব্য অর্থাৎ অনুসরণীয় হন; বহুমুখপ্রসারিত অর্থাৎ সর্বত্র ক্রিয়াশীল হে দেব! উপাসক আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (জ্ঞানের প্রভাব অনুধ্যান করে উপাসক পরমধন প্রার্থনা করছেন– এটাই তাৎপর্য)।
১১/৩– স্বপ্রকাশশীল হে জ্ঞানদেব! আমাদের মধ্যে পরমধন প্রেরণ করুন; এবং আপনার সাথে তা আগমন করুক; এবং সকল দিবসে ও সকল রাত্রিতে আমাদের মধ্যে তা বিরজামা থাকুক। (প্রার্থনা এই যে, — জ্ঞানের সাথে সদাকাল শুদ্ধসত্ত্বরূপ পরমধন আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হোক)। তীক্ষ্ণদ্যুতিসম্পন্ন হে দেব! লোকহিতসাধক সেই প্রসিদ্ধ আপনি শত্রুগণকে (রিপুদের) নাশ করুন। (প্রার্থনা এই যে, — জ্ঞানের প্রভাবে রিপুসমূহের প্রাধান্য সকল রকমে খর্ব হোক)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত পদসমূহের প্রতিবাক্য ইত্যাদি গ্রহণের বিষয়ে এই মন্ত্রার্থে ভাষ্যের অনুসরণ করা হলেও মূল প্রার্থনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব অন্তরে পোষণ করা হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি –গোতম রাহুগণ। সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম—পৌষ্কলম এবং শ্রুধ্যম]।
.
চতুর্থ খন্ড
সূক্ত ১২– বিশো বিশশা বো অতিথিং বাজয়ন্তঃ পুরুপ্রিয়। অগ্নিং বো দুর্যং বচঃ স্তুষে শুষস্য মন্মভিঃ৷১৷ যং জনাসসা হবিষ্মন্তো মিত্রং ন সর্পিরাসুতিম্। প্রশংসন্তি প্রশস্তিভিঃ ॥ ২ পন্যাংসং জাতবেদসং যো দেবতাত্যুদতা। হব্যান্যৈরয় দিবি৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১৩– সমিদ্ধমগ্নিং সমিধা গিরাগৃণে শুচিং পাবকং পুরো অধরে ধ্রুব। বিপ্রং হোতারং পুরুবারমঞ্জুহং কবিং সুরৈীমহে জাতবেদসম্৷৷৷৷৷ ত্বং দূতমগ্নে অমৃতং যুগেযুগে হব্যবাহং দধিরে পায়ুমীড্য। দেবাসশ্চ মর্তাসশ্চ জাগৃবিং বিভুং বিপতিং নমসা নি ত্বেদিরে। ২৷৷ বিভূষন্নঃ উভয় অনুব্রতা দূতো দেবানাং রজসী সমীয়সে। যৎ তে ধীতিং সুমতি মাৰ্বণীমহেহধ স্মা নস্ত্রিবরূথঃ শিবো ভব৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১৪– উপ ত্বা জাময়ো গিরো দেদিশতীৰ্হবিষ্কৃতঃ। বায়োরনীকে অস্থির৷১। যস্য ত্রিত্ববৃতং বহিস্তস্থাবসন্দিন। আপশ্চিন্নি দধাপদ৷৷ ২৷৷ পদং দেবস্য মীচ্যাহনাধৃষ্টাভিরুতিভিঃ। ভদ্রা সূর্য ইবোপ৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১২সূক্ত/১সাম- হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা যদি ভগবানকে পাবার কামনা করো, তাহলে তোমাদের এবং নিখিল জনগণের অতিপ্রিয় অতিথির ন্যায় পূজ্য (মিত্রের ন্যায় সহজপ্রাপ্য), অগ্নিদেবকে (জ্ঞানাগ্নিকে) ভক্তিসহযুত স্তোত্রের দ্বারা আহ্বান (হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত) করো। তোমাদের শান্তিকামনায় সকল সুখের নিদান, শ্রেষ্ঠনিবাসস্থল, অগ্নিদেবকে (স্বপ্রকাশ জ্ঞানদেবতাকে) স্তুতির দ্বারা (ভক্তিসহযুত অর্চনাকারী) আমি স্তব করি (হৃদয়ে উদ্দীপিত করি)। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, — মুক্তি-ইচ্ছাকারী জনগণ যেন ভক্তির সাথে ভগবানকে অর্চনা করেন। অতএব আমিও. যেন হৃদয়ে তাঁকে উদ্বোধন করি)। [মন্ত্রটির প্রচলিত অর্থ এই যে, তোমরা অন্নাভিলাষী, সমস্ত প্রজাগণের অতিথি ও অনেকেরও প্রিয় অগ্নির স্তুতি সম্পাদন করো, আমি তোমাদের সুখের জন্য স্তোত্রের দ্বারা গুঢ়বাক্য উচ্চারণ করছি। ভাষ্যকারের মতে, এ মন্ত্রটি ঋত্বিক যজমানদের সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। কিন্তু সম্বোধনকারী যে কে, তা ভাষ্যে উল্লেখিত নেই]।
১২/২– সাধনাপরায়ণ জনসমূহ মিত্রতুল্য অমৃতদায়ক যে দেবতাকে স্তুতির দ্বারা আরাধনা করেন, সেই দেবতাকে আমরা আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের আরাধনাপরায়ণ হই)। [মানুষ অনেক সময় ভগবৎ-পূজায় আত্মনিয়োগ করতে চায় বটে, কিন্তু সামর্থ্যের অভাববশতঃ পূজা করতে পারে না। ইচ্ছা থাকলেই কোন কার্যে সফলতা লাভ হয় না, ইচ্ছার সঙ্গে কর্মসামর্থ্যও থাকা চাই। এই মন্ত্রে সেই পূজাশক্তি লাভ করবার জন্যই প্রার্থনা। রয়েছে। এই মন্ত্রটির যে সব ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটি ব্যাখ্যা– যাঁর উদ্দেশে ঘৃত হোম করা হয়, এবং লোকে যাঁর উদ্দেশে হব্য দান করে স্তুতির দ্বারা প্রশংসা করে। এ থেকেই প্রচলিত অর্থের ভাব অধিগত হয়]।
১২/৩– সৎকর্মের সাধনে উচ্চারিত স্তোত্র-সমূহ যে দেবতা ভগবৎ-সমীপে প্রেরণ করেন, সাধকদের উৎসাহবর্ধক জ্ঞাত-প্রজ্ঞ সেই জ্ঞানদেবতাকে আমরা আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎ-প্রাপক নিত্যজ্ঞান লাভ করি)। [পূর্ব-মন্ত্রের মতো বর্তমান মন্ত্রের ব্যাখ্যায় প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদিতে অসম্পূর্ণভাব গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, — যিনি (স্তোতার) প্রশংসা করেন, যিনি জাবেদা এবং যিনি যজ্ঞে প্রদত্ত হব্য-সমূহ দুলোকে প্রেরণ করেন। এই ব্যাখ্যার দ্বারা মন্ত্রের মধ্যে কি ভাব আছে, তা বোঝা অসম্ভব]। [এই সূক্তের ঋষি গোপবন আত্রেয়। সূত্তান্তৰ্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– শ্যাবাশ্বম, আন্ধীগবম, যজ্ঞাযজ্ঞীয়ম এবং গৌরীবিতম]।
১৩/১– ঐকান্তিক প্রার্থনার দ্বারা দীপ্ত জ্ঞানদেবকে আমি স্তুতি করছি; পবিত্র, পবিত্রকারক নিত্যজ্ঞানকে সৎকর্মসাধনে যেন অগ্রে স্থাপন করি, অর্থাৎ সকল কর্মে যেন জ্ঞানপ্রদর্শিত মার্গ গ্রহণ করি; জ্ঞানদায়ক দেবভাবপ্রাপক সকলের বরণীয় সাহায্যকারক সর্বদর্শী সর্বজ্ঞ জ্ঞানদেবকে আমরা যেন পরমধনপ্রাপ্তির জন্য আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানমার্গের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সৎকর্মসাধন করি; ভগবান্ আমাদের পরাজ্ঞান পরমধন প্রদান করুন)। [এই অগ্নি সর্বার্থেই জ্ঞানাগ্নি– জ্ঞানদেব। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যায় প্রজ্বলন্ত অগ্নিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে; যেমন– আমি ইন্ধন দ্বারা প্রদীপ্ত অগ্নির স্তুতির দ্বারা স্তব করি। আমি স্বভাববিশুদ্ধ, পবিত্রতাবিধায়ক ধ্রুব অগ্নিকে যজ্ঞে অগ্রে স্থাপন করি। আমরা জ্ঞানসম্পন্ন দেবগণের আহ্বায়ক, বহুলোকের বরণীয়, সদাশয়, সর্বদর্শী ও সর্বভৃতজ্ঞ অগ্নির নিকট ধন প্রার্থনা করি। একটু অনুধাবন করলেই বোঝা যায় যে, কাষ্ঠ ইত্যাদি দাহনশীল অগ্নির প্রতি এই স্তুতি উচ্চারিত হতে পারে না]।
১৩/২- হে জ্ঞানদেব! সকল লোক অমৃতস্বরূপ, নিত্যকাল ভগবৎসমীপে পূজোপচারপ্রাপক, সাধকদের পালক আরাধনীয় আপনাকে ভগবানের সাথে মিলনসাধক করেন; চিরজাগরণশীল, সর্বব্যাপক, লোকবর্গের অধিপতি আপনাকে সাধকগণ ভক্তির সাথে হৃদয়ে সংস্থাপন করেন (অথবা আরাধনা করেন)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সকল লোক ভগবৎপ্রাপক জ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য আরাধনা করেন)।
১৩/৩– হে জ্ঞানদেব! স্বর্গমর্তবাসী সকল লোককে দিব্যজ্যোতিঃ প্রদান করে সৎকর্মে দেবভাবের মিলনসাধক আপনি দ্যুলোক-ভূলোক বিচরণ করেন; যেহেতু আপনার প্রজ্ঞা এবং সৎ বৃত্তি সম্যকরূপে প্রার্থনা করছি, সেইজন্য সর্বত্রব্যাপক আপনি আমাদের প্রতি মঙ্গলপ্রদ হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন দেবভাবপ্রাপক মঙ্গলদায়ক পরাজ্ঞান লাভ করি)। [জ্ঞানই দেবানাং দূতঃ– দেবভাবের সাথে মিলনসাধক। জ্ঞানী ব্যক্তি দেবভাবের অধিকারী হন। এ এটাই পদ দুটির তাৎপর্য। তাই প্রার্থনা করা হয়েছে– তে ধীতিং সুমতিং বৃণীমহে– আমরা যেন। এ জ্ঞানজনিত প্রজ্ঞা ও সবৃত্তি লাভ করি। ত্রিবরূথঃপদের দ্বারা ত্রিলোকের ত্রিকালস্থ ইত্যাদি বোঝায়। অর্থাৎ জ্ঞান সর্বত্র সর্বকালে বর্তমান আছে। জ্ঞান ভগবৎশক্তি। সুতরাং তা বিশ্বের সর্বত্র অনুষ্যত হয়ে আছে। সেই জ্ঞান যেন আমাদের পরমমঙ্গল বিধান করে, জ্ঞানের বলে যেন আমরা পরাশক্তির অধিকারী হতে পারি– এটাই মন্ত্রের শেষাংশের মর্ম]। [এই সুক্তের ঋষি– ভরদ্বাজ বাৰ্হস্পত্য বা বীতহব্য। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সেগুলি নাম, যথা;-যজ্ঞাযজ্ঞীয়ম এবং কাবম]।
১৪/১– হে জ্ঞানস্বরূপ দেব। পুনঃপুনঃ আপনার গুণানুকীর্তনকারী, সাধনার্থী আমার এই বাক্যসমুহ আপনাকে (আমার) প্রাণবায়ুর সমীপে উদবুদ্ধ করছে। (অর্থাৎ প্রাণবায়ুর সাথে আপনার নিত্যসম্বন্ধ লাভের কামনায় আমি আপনার স্তব করছি। অথবা, এই স্তুতিসকল আপনাকে সর্বত্র প্রাপ্ত হোক)। [সাধারণতঃ এই মন্ত্রটির অর্থ করা হয়– হে অগ্নিদেব! যজমানের জন্য, ভগিনীগণের ন্যায় তোমার গুণসমূহের বর্ণনকারী স্তুতিসকল, তোমার নিকটে উপস্থিত হচ্ছে এবং তারা বায়ুর সমীপে তোমাকে পরিবর্ধিত করে স্থিতি করছে। ব্যাখ্যাকার মন্ত্রের অন্তর্গত জাময়ঃ পদের অর্থ করেছেন, স্বসার ইব অর্থাৎ ভগিনীগণের মতো। তাতে ভাবার্থ দাঁড়ায় এই যে, ভ্রাতার স্বল্পমাত্র গুণ থাকলেও ভগিনীগণ যেমন তা দর্শনে সহস্ৰমুখিনী হয়, তেমনই এই স্তুতিসকল আপনার গুণসমূহের বর্ণনাকারী হয়ে আপনার নিকট সমুপস্থিত হচ্ছে। জানি না; এ অর্থ কতদূর সৎ-ভাবমূলক। এই মন্ত্রার্থে কিন্তু ধাতু-অর্থের অনুসরণে ঐ জাময়ঃ পদে উৎপন্ন অর্থ গৃহীত হয়েছে। তাতে ঐ পদ গিরঃ (বাচঃ) পদের বিশেষণরূপে গৃহীত হয়েছে। নিত্যসত্যসনাতন বেদে অনিত্য ভ্রাতা-ভগিনীর উপমা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না]। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-২দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১৪/২- যে জ্ঞানদেবের ত্রিলোক অবারিত অর্থাৎ যে জ্ঞানদেব ত্রিলোকের সর্বময়প্রভু, যিনি সাধকদের মুক্ত হৃদয়ে নিবাস করেন, সেই জ্ঞানদেবে অমৃত নিশ্চয়ই আশ্রয় গ্রহণ করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সর্বলোকের অধিপতি জ্ঞানের সাথে অমৃত সম্মিলিত হয়)।
১৪/৩– প্রকৃষ্ট রক্ষাশক্তির দ্বারা রক্ষিত হয়ে আমরা যেন অভীষ্টবর্ষক দেবতার পরমাশ্রয় লাভ করি; সেই পরমদেবতার কৃপাদৃষ্টি জ্ঞানদেবতুল্য মঙ্গলপ্রদ হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের পরমাশ্রয় লাভ করি; পরাজ্ঞান আমাদের মঙ্গলপ্রদ হোক)। [মন্ত্রে ভগবানের আশ্রয়লাভের প্রার্থনা আছে। অভীষ্টবর্ষক পরমদেবত তার রক্ষাশক্তির দ্বারা আমাদের সর্ববিপদ থেকে উদ্ধার করেন, তাঁর কৃপাতেই মানুষ রিপুদের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। তাঁর মঙ্গলশক্তি আমাদের ঘিরে আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি; তার অনুকম্পাতেই আমরা তার চরণে পৌঁছাতে পারি। তাঁর কৃপাদৃষ্টিই আমাদের পরম মঙ্গলসাধক]। [এই সূক্তের ঋষি– ভার্গব অগ্নি বা পাবক বাৰ্হস্পত্য। এই মন্ত্র তিনটির একত্র-গ্রথিত গেয়গানের নাম– বারবন্তীয়োত্তর]।
— পঞ্চদশ অধ্যায় সমাপ্ত–