৩.১৪ উত্তরার্চিক — চতুর্দশ অধ্যায়

উত্তরার্চিক — চতুর্দশ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে)– ১।২।৫।৮।৯ ইন্দ্র; ৩।৭ পবমান সোম; ৪।১০-১৬ অগ্নি; ৬ বিশ্বদেবগণ।
ছন্দ—১।৪।৫।১২-১৬ গায়ত্রী, ২।১০ প্রগাথ বার্হত; ৩।৭।১১ বৃহতী; ৬ অনুষ্টুপ; ৮ উষ্ণিক; ৯ নিচক উষ্ণিক।
 ঋষি প্রতিটি সূক্তের শেষে যথাযথ উল্লেখিত।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– অভি প্র গোপতিং গিরেন্দ্রমর্চ যথা বিদে। সূ নুং সত্যস্য সৎপতি৷৷ ১৷৷ আ হরয়ঃ সসৃজিরেহরুষীরধি বর্হিষি। যত্রাভি সং নবা মহে৷৷ ২ ইন্দ্রায় গাব আশিরং দুদুত্বে বর্জিণে মধু। যৎ সীমুপহুরে বিদৎ ৷৷ ৩৷

সূক্ত ২– আনো বিশ্বাসু হব্যমিং সমৎসু ভূষত। উপ ব্ৰহ্মাণি সবনানি বৃত্ৰহন পরমজ্যা ঋচীষম। ১। ত্বং দাতা প্রথমো রাধসমস্যসিসত্য ঈশানকৃৎ। তুবিদ্যুম্নস্য যুজ্যা বৃণীমহে পুত্রস্য শবসোঁ মহঃ। ২।

সূক্ত ৩– প্রত্নং পীযুষং পূর্বং যদুথ্যাং মহো গাহাদ দিব আনিধুক্ষত। ইন্দ্রমভি জায়মানং সমস্বর৷৷৷ আদীং কে চিৎ পশ্যমানাস আপ্যং বসুরুচো দিব্যা অভ্যন্ত। দিবোন বারং সবিতা ব্যর্ণতে ॥ ২॥ অধ যদিমে পবমান রোদসী ইমা চ বিশ্বা ভুবনাভিমনা। যুথে ন নিষ্ঠা বৃষভো বি রাজসি৷৷ ৩৷

সূক্ত ৪– ইমমূ ধূ ত্বমস্মাকং সনিং গায়ত্ৰং নব্যাংস। অয়ে দেবেষু প্ৰ বোচঃ৷৷ ১। বিভক্তাসি চিত্রভানো সিন্ধোরুমা উপাক আ। সদ্যো দাশুয়ে ক্ষরসি৷৷ ২। আ নো ভজ প্রমো বাজেযু মধ্যমে। শিক্ষা বম্বো অমস্য৷৷ ৩৷

সূক্ত ৫– অহমিদ্ধি পিতুঃ পরি মেধামৃতস্য জগ্রহ। অহং সূর্য ইবাজনি৷ ১৷ অহং প্রত্নেন জন্মনা গিরঃ শুন্তামি করৎ। যেনেঃ শুমি দধে৷৷ ২ যে ত্বামিন্দ্র ন তৃবৃঋষয়ো যে চ তুষ্টবু। মমেদ বর্ধর্ষ সুষ্ঠুতঃ৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– হে আমার মন! তুমি সেই পৃথ্বীপতি (অথবা জ্ঞানকিরণসমূহের পালক বা রক্ষক), সত্য হতে উৎপন্ন (সত্যের অঙ্গীভূত অথবা সৎকর্মের দ্বারা জাত)সৎ-জনগণের পালক, ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে লক্ষ্য করে, স্তুতির দ্বারা প্রকৃষ্টরূপে অর্চনা করো; এবং তার প্রকৃত স্বরূপ অবগত হও; অথবা, যে রকমে তিনি জানতে পারেন, সেইমতো পূজা করো। (ভগবানের স্বরূপ অবগত হয়ে প্রকৃষ্টরূপে তাঁর পূজায় ব্রতী হও– মন্ত্রে এমনই আত্ম-উদ্বোধনা প্রকাশ হয়েছে)। [গোপতিং পদের সাধারণ প্রচলিত অর্থ গোসমূহের স্বামী। সত্যস্য পদ দুটিতে গোসমূহের স্বামী ইন্দ্রদেবকে যজ্ঞের পুত্র (যজ্ঞস্য পুত্রং), আর সৎপতিং অর্থাৎ সাধু যজমানদের পালক বলে অভিহিত করা। হয়েছে। ফলে প্রচলিত অর্থে সমগ্র মন্ত্রটির ভাব দাঁড়িয়ে গেছে, -হে যজমান বা ঋত্বিক! তুমি সেই গোসমূহের অধিপতি, যজ্ঞের পুত্র, সাধু যজমানদের পালক, ইন্দ্রের প্রতি স্তুতির দ্বারা পূজা করো; সে পূজা যেন যথা বিদে হয় অর্থাৎ তিনি যেন জানতে পারেন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রার্থে শব্দসমূহের পরিগৃহীত অর্থ সঙ্গত কারণেই ভিন্নতর। গো শব্দে বেদে প্রায়ই জ্ঞানকিরণ বা পৃথিবী অর্থ পরিগৃহীত হয়। যাঁকে ভগবান বলে অভিহিত করা হয়, তাঁকে গোটাকতক গরুর অধিস্বামী বলে ভাবার চেয়ে জ্ঞানকিরণের অধিপতি কিম্বা পৃথিবীর পতি ভাবাই সমীচীন। এইভাবে সত্যস্য সূনুং পদ দুটিতেও অভিন্ন ভাবমূলক নানা অর্থই গ্রহণযোগ্য। তিনি সত্যের অঙ্গীভূত, সত্য থেকেই তার বিকাশ, সৎ-স্বরূপত্বই তাঁর পরিচায়ক। সুতরাং এইরকম অর্থে দেবতাকে ভগবানের অংশ, অঙ্গীভূত, অথবা বিভূতিরূপেই গণ্য করা যায়; এবং সেটাই সঙ্গতিপূর্ণ। আবার আর এক অর্থ– সৎকর্মের দ্বারা তিনি উৎপন্ন অর্থাৎ মানুষের নিকটে প্রকাশমান। এটাও সঙ্গত]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ ৬দ-৪সা) দ্রষ্টব্য]।

১/২– আমাদের হৃদয়ে জ্যোতির্ময় পাপহারক জ্ঞানভক্তি ইত্যাদি যেন সর্বতোভাবে উৎপাদন করতে পারি; আমাদের হৃদয়ে প্রাপ্তির জন্য আমরা ভগবানকে আরাধনা করছি। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন হৃদয়ে জ্ঞানভক্তি লাভ করতে পারি, এবং ভগবানকে যেন প্রাপ্ত হই)।

১/৩– সাধক যে অমৃত সৎকর্মসাধনের দ্বারা লাভ করেন, রক্ষাস্ত্রধারী ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য সেই অমৃত জ্ঞান হতে সাধক লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, – সাধকেরা জ্ঞান ও কর্মের দ্বারা অমৃত লাভ করেন)। [জ্ঞানমার্গের দ্বারা যেমন মোক্ষলাভ করা যায়, কর্মমার্গের অনুসরণেও সেই ফললাভই হয়ে থাকে। জ্ঞান ও কর্ম উভয়ই ভিন্নপথে একস্থানে উপনীত হয়। শুধু তাই নয়, জ্ঞান ও কর্ম পরস্পর পরস্পরের সাথে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ। একটির সমাগমে অন্যটিও উপস্থিত হয়। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– ইন্দ্র যখন চারদিক হতে সমীপস্থিত মধু লাভ করেন, তখন। গোসমূহ সেই বজ্রযুক্ত ইন্দ্রের উদ্দেশে সোমের সাথে মিশ্রিত করবার উপযুক্ত মধু দোহন করেন। আমাদের মন্ত্রার্থে মধু অর্থ অমৃত। গাবঃ অর্থ জ্ঞানকিরণান, জ্ঞানাৎ ইত্যাদি। দুদুহে অর্থ। লভতে-দোহন করা নয়]। [এই সূক্তের ঋষি প্রিয়মেধ আঙ্গিরস]।

২/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহু! তোমরা কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুসমূহের সাথে সকলরকম। যুদ্ধে, সাধকগণ কর্তৃক আত্মরক্ষার্থে আহ্বানযোগ্য বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেবকে উদ্দেশ করে, আমাদের হৃদয়প্রদেশে শুদ্ধসত্ত্বভাবসকলকে সঞ্চয় করো। হে স্তবনীয়, হে শত্রুঘাতক, হে পাপবিধ্বংসি! আপনি আমাদের ত্ৰৈকালিক কর্মসমুদয়কে সত্ত্বসমন্বিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের অনুষ্ঠেয় কর্মসমুদয়কে দোষশূন্য করুন)। [ভগবান বল ও ঐশ্বর্যের একমাত্র নায়ক এবং অতিশয় যুদ্ধনিপুণ (অর্থাৎ মানুষের রিপুশত্রুদের ধ্বংসসাধনক্ষম)। তাকে আহ্বান করতে হলে, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব উপচিত করতে হবে। তার অর্চনার জন্য শুদ্ধসত্ত্বচন্দনমিশ্রিত ভাবকুসুমরাশি আহরণ করো। তাহলেই তিনি আসবেন। তোমরা ধন্য হবে। –এরপরই ঈশ্বরের বল ও ঐশ্বর্যের বিভূতিধারী ইন্দ্রকে উদ্দেশ করে প্রার্থনা। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-৪দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২/২– হে দেব! আপনি পরমধনের শ্রেষ্ঠতম দাতা হন, সত্যস্বরূপ সাধকদের পরমধনদাতা হন; প্রভূত ঐশ্বর্যসম্পন্ন সর্বশক্তিময় মহান দেবতার প্রার্থনীয় ধন আমরা যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই পরমদাতা হন; আমরা যেন তার এ পরম আকাক্ষণীয় ধন লাভ করতে পারি)। [এই সূক্তের ঋষি-নৃমেধ ও পুরুষমেধ আঙ্গিরস। এ সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– শৈত্যম ও সদোবিশীয়ম্]।

৩/১– দুলোকের অমৃত, নিত্য, আকাক্ষণীয় অপূর্ব যে শুদ্ধসত্ত্বকে সাধকগণ লাভ করেন, ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য মহান্ দ্যুলোক হতে উৎপন্ন সেই শুদ্ধসত্ত্বকে প্রকৃষ্টরূপে আমরা যেন দিব্য অমৃত শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি। [শুদ্ধসত্ত্ব প্রত্নং– পুরাতন অর্থাৎ নিত্য। ভগবৎ-শক্তি অক্ষয় অব্যয়, চিরবর্তমান। সেই স্বর্গের ধন লাভ করতে, মোক্ষমার্গে অগ্রসর হবার উপায়লাভ করতে, কে না আগ্রহান্বিত হয়? পীযুষঃ শব্দের স্বাভাবিক অর্থ অমৃতই সঙ্গত। নিরধুক্ষত পদের অর্থ দুহন্তি। তা থেকে লাভ বা প্রাপ্তির ভাবই অধ্যাহৃত হয়। অথচ একটি প্রচলিত মতানুবলম্বী অনুবাদ লক্ষণীয়– প্রশংসিত সোম প্রাচীনকাল হতে দেবতাদের পেয় বস্তু হয়েছেন। ইন্দ্রের উদ্দেশে তিনি প্রস্তুত হলেন তখন তাঁকে স্তব করতে লাগল। অনুবাদকার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একটি টীকা সংযোজিত করে দিয়েছেন– সোমরস দেবগণের প্রাচীন পানীয় জল। স্বর্গধামের নিগূঢ় স্থান থেকে সোমকে দোহন করা হয়েছে, ইত্যাদি বৈদিক বর্ণনা থেকে পৌরাণিক অমৃতের উপাখ্যান উৎপন্ন হয়েছে। ঋগ্বেদে আকাশকে জলীয় বলে বিশ্বাস করা হতো এবং অনেক সময় সমুদ্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং সমুদ্র থেকে অমৃতমন্থনরূপ পৌরাণিক গল্প অনায়াসে উৎপন্ন হলো। এখানে এই ব্যাখ্যা সম্বন্ধে কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবে বৈদিক গবেষণার এই নমুনা গ্রহণযোগ্য নয়; কারণ বৈদিক যুগে আকাশকে সমুদ্র মনে করার কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে ব্যাখ্যাকাররা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই একটা কথা স্বীকার করে ফেলেছেন যে, সোম ও অমৃত অভিন্ন পদার্থ। পূর্বাপরই আমাদের মন্ত্রার্থে অমৃতময় ভগবানের শক্তিস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বকে অমৃততুল্য বলা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যাতাও প্রকারান্তরে তা-ই বলছেন]।

৩/২– -বিশ্বের সৎকর্মপ্রেরক দেবতা যখন স্বর্গের জ্যোতিঃ প্রদান করেন তখন জ্ঞানবান্ সকল জ্যোতিঃধনসম্পন্ন দিব্যভাবযুক্ত সাধকগণ বন্ধুভূত (অথবা, অমৃততুল্য) পরমধন প্রার্থনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবনকৃপায় দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন সাধকগণ পরমধন লাভ করেন)। [সিবিতৃ শব্দ প্রসবার্থক সূ ধাতু থেকে উৎপন্ন। যিনি বিশ্বকে প্রসব করেন, তিনিই সবিতা। তার সহজ ও স্বাভাবিক অর্থ এই যে, যাঁর থেকে বিশ্ব উৎপন্ন হয়েছে। তাই সবিতা পদের অর্থ করা হয়েছে– সর্বলোক প্রসবের জন্য তাকে সবিতা বলা হয়। এটাই স্বাভাবিক অর্থ। কিন্তু ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে তার একটি দূরার্থ কল্পনা করা হয়েছে। সেই অর্থে বলা হয়েছে যে, সূর্য তার আলোকের দ্বারা জগৎকে প্রসব করেন অর্থাৎ সূর্যালোকে অন্ধকার দূরীভূত হলে জগৎ দৃষ্টিপথে আসে। এই দৃষ্টিপথে প্রকাশিত হওয়াকেই ব্যাখ্যাকারগণ প্রসবের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু এটা যে কষ্টকল্পনামূলক তাতে আর সন্দেহ নেই। অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, এই সূর্যার্থই অনেক স্থলে প্রাধান্য লাভ করেছে এবং গায়ত্রী মন্ত্রের দেবতাকে সূর্য বলেই গ্রহণ করা হয়। তাই পাশ্চাত্য অনেক পণ্ডিতের মতে গায়ত্রী মন্ত্রে উপাসনাকারীগণ জড় সূর্যোপাসক বলে অভিহিত হন। এই জন্য আমরাও অনেক পরিমাণে দায়ী; কারণ আমরাই বেদমন্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যা করে এই অনর্থ ঘটিয়েছি। বর্তমান মন্ত্রেও (আমাদের মন্ত্রার্থে) সূর্য অর্থ গৃহীত হয়েছে। আমাদের মন্ত্রার্থে, কিন্তু আমাদের পরিগৃহীত ভগবৎ অর্থেই মন্ত্রার্থের সৌষ্ঠব সাধিত হয়, ভাবের সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়– তা একটু অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে]।

৩/৩– পবিত্রকারক হে দেব! সর্বভূতে অভীষ্টবর্ষক দেব যেমন অধিষ্ঠিত হন, তেমন আপনি যখন পরিদৃশ্যমান দ্যুলোকভূলোক এবং এই সকল ভুবনকে আপন শক্তিতে অভিভূত করেন, তখন আপনি বিশ্বে দিব্যজ্যোতিঃ বিতরণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ বিশ্বাধিপতি হন, এবং বিশ্ববাসীকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করেন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটিকে যথাপূর্বং সোমার্থকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। অথচ এ-কথা মনে করা ভুল নয় যে, মন্ত্রে সোমের কোন উল্লেখই নেই। পবমান শব্দে পবিত্রকারক দেবতাকে বোঝায়। যিনি সমগ্র বিশ্বের পবিত্রতা সম্পাদন করেন, যিনি বিশ্বের উপর আধিপত্য করেন, তিনি কি সোমনামক মাদকদ্রব্য? সুতরাং এখানে, এই মন্ত্রে, এই নিত্যসত্যই বোধগম্য হওয়া উচিত যে, বিশ্বাধিপতি ভগবানই জ্ঞানজ্যোতিঃর আধার ও উৎপত্তিস্থল। তিনি যখন বিশ্বে প্রাদুর্ভূত হন, প্রকাশিত হন, তখন বিশ্ববাসী পবিত্র হয় দিব্যজ্ঞান লাভ করে ধন্য ও কৃতার্থ হয়]। [এই সূক্তের ঋষি-ত্রারুণ ত্রৈধৃষ্ণ পৌরুকুৎস সদস্যু। সূক্তান্তৰ্গত মন্ত্র তিনটির একত্রগ্রথিত ছটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– যৌধাজম, অমহীয়বম, ঐড়সৌপর্ণম, সত্ৰাসাহীয়ম সদোবিশীয়ম এবং উৎসেধম]।

৪/১– হে অগ্নিদেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের আহরণীয় (পূজা) এবং চিরনূতন গায়ত্রী স্তোত্র, সকল দেবতার নিকট আমাদের সুমঙ্গলের জন্য প্রাপ্ত করান। (আমাদের অভীষ্টপূরণের জন্য আমাদের পূজা সকল দেবতার নিকট পৌঁছিয়ে দিন– এটাই প্রার্থনা)।

৪/২– বিচিত্র-রশ্মিযুত হে দেব! তরঙ্গের মধ্যে যেমন অর্ণবের বিস্তার, বিভিন্ন দেহে আপনি (তেমনই বিস্তৃত বিভক্ত হয়ে আছেন। প্রার্থনাকারীকে অবিলম্বে করুণাধারা বর্ষণ করেন। (আপনিই অর্ণব, জীবই তরঙ্গ; আমি করুণা যাচ্ঞা করছি। আমার প্রতি সদয় হোন, ত্বরায় কৃপা করুন এটাই প্রার্থনা)। [সিন্ধুতে ও ঊর্মিতে যে সম্বন্ধ, জ্ঞানদেবরূপী জগদীশ্বরে ও জীবে সেই সম্বন্ধ। ব্রহ্মরূপ মহাসমুদ্রে অগণিত জীবসঙ্ঘ তরঙ্গ মাত্র। মন্ত্রের প্রথমাংশে পরিব্যক্ত এই তত্ত্বে ভগবানের মহিমা পরিজ্ঞাপিত হয়েছে। শেষাংশ ভগবানের করুণা-কণার প্রার্থনা। বিচিত্ররশ্মি অর্থে বিচিত্র জ্ঞান]।

৪/৩– হে দেব! আমাদের পরমার্থ-সম্বন্ধীয় মোক্ষরূপ ধন সম্যকরূপে প্রদান করুন; স্বর্গ ইত্যাদি লাভরূপ যজ্ঞে যেন প্রাপ্ত করান; ইহসংসার-সম্বন্ধী সৎকর্মসহযুত জ্ঞানস্বরূপ ধন সর্বতোভাবে আপনি আমাদের প্রদান করুন। (আমাদের সৎকর্মসহযুত করুন, আমাদের স্বর্গ ইত্যাদি সুখকামনা এবং যজ্ঞপ্রবৃত্তি দান করুন, অন্তিমে মোক্ষ প্রদান করুন– এটাই প্রার্থনার ভাব)। [এই মন্ত্রে মানুষের। তিনরকম আকাঙ্ক্ষার বিষয় প্রকাটিত দেখা যায়। মানুষ ইহসংসারে সুখ-সম্পদ কামনা করে। সৎকর্মসহযুত জ্ঞানরূপ ধন সে সুখের শ্রেষ্ঠ-সুখ। স্বর্গ ইত্যাদি কামনায় প্রধানতঃ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। স্বর্গসুখ মানুষের দ্বিতীয় আকাঙ্ক্ষার বিষয়। সে সুখলাভকে মধ্যম সুখলাভ বলা যায়। সেই সুখলাভের পথে অগ্রসর হতে হতে, মোক্ষের প্রতি মানুষের দৃষ্টি সঞ্চালিত হয়। মোক্ষই উৎকৃষ্ট। তাই পরমেষু বাজে বলা হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি– শুনঃশেফ আজিগর্তি]।

৫/১– লোকসমূহের পালক বা রক্ষক সৎস্বরূপ ভগবানের প্রজ্ঞানরূপ স্বরূপশক্তিকে আমি হৃদয়ে পোষণ করি; তাহলে, হৃদয়ে সত্যভাব-পোষণকারী আমি সূর্যের ন্যায় প্রকাশমান হতে পারি। (ভাব এই যে, ভগবানের স্বরূপশক্তির ধারণার সঙ্গে সঙ্গে ভগবৎ-বিভূতি লাভের দ্বারা আত্মপ্রকাশ হয়)। [মন্ত্রটিকে আত্ম-উদ্বোধক বলা যায়। ভগবানের স্বরূপ-শক্তি (মেধা) লাভের জন্য এখানে সাধকের এ প্রচেষ্টার বিষয় প্রখ্যাত হয়েছে। সাধক বুঝেছেন, সত্যের মেধা লাভ করতে পারলেই নিজেও সত্যের স্বরূপ প্রাপ্ত হবেন, সত্যের সাথে মিলিত হলেই সৎস্বরূপত্ব অধিগত হয়]। [ঋগ্বেদে জগ্রহ স্থলে জগ্রত পাঠ দেখা যায়। এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ-৪দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৫/২– হীনশক্তি প্রার্থনাকারী আমি যেন নিত্যকাল বাক্যসমূহকে প্রার্থনাযুত করি; সেই প্রার্থনাদ্বারা প্রীত হয়ে, বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা রিপুনাশক বল এবং পরাজ্ঞান আমাকে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমি যেন নিত্যকাল প্রার্থনাপরায়ণ হই; ভগবান্ আমাকে দিব্যশক্তি এবং দিব্যজ্ঞান প্রদান করুন)। [কথ অর্থাৎ কঞ্চনামক ব্যক্তি নয়; কথ অর্থ ক্ষুদ্র, হীন]।

৫/৩–- বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যে সকল ব্যক্তি আপনাকে আরাধনা না করে তারা বিনষ্ট হয়, এবং যে সকল জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে আরাধনা করেন তারা মুক্তি (অথবা, পরাজ্ঞান) লাভ করেন; হে দেব! আমা কর্তৃক আরাধিত হয়ে আমার জ্ঞানকে প্রবৃদ্ধ করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — ভগবৎ-পরায়ণ ব্যক্তিগণ মোক্ষলাভ করেন, সাধনহীনগণ বিনাশ, প্রাপ্ত হয়। হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [ভগবান মানুষের পূজার জন্য লালায়িত নন যে, যে তার উপাসনা না করবে তিনি তাকে ধ্বংস করবেন। মানুষের আরাধনা পাওয়া ভগবানের ব্যবসা নয়। আসলে মানুষই স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। মায়ার ঘোরে, অবিদ্যার প্রেরণায় সে নিজেকে সসীম ক্ষুদ্র বলে মনে করে। এগুলি অজ্ঞানতার ফল। কিন্তু জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বুঝতে পারে যে, সে সেই ব্রহ্মেরই অংশভূত। এই জ্ঞান লাভ করতে হলে সৎকর্ম সাধন করতে হয়, হৃদয় শুদ্ধসত্ত্বের আলয়রূপে প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যের অনুসরণ করতে হয়। তাই যিনি সৌভাগ্যবশতঃ সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করেন, অর্থাৎ ভগবৎ-আরাধনায় রত থাকেন, তিনি ক্রমশঃ নিজের অভীষ্টসাধনের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। এর অন্যথায় মানুষ ক্রমশঃ অধঃপতনের দিকেই অগ্রসর হতে থাকে। মন্ত্রের প্রথম দুই অংশের এটাই সারমর্ম। শেষাংশে আছে ভগবানের কাছে পরাজ্ঞান লাভের প্রার্থনা]। [সূক্তটির ঋষি-বৎস কাণ্ব]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৬– অগ্নে বিশেভিরগিভির্জোষি ব্ৰহ্ম সহস্কৃত। যে দেবত্ৰা যে আয়ুযু তেভির্নো মহয়া গিরঃ ১। প্র স বিশ্বেভিগ্নিভি রগ্নিঃ সঃ যস্য বাজিনঃ। তনয়ে তোকে অস্মদা সম্য বাজৈঃ পরীবৃতঃ। ২৷৷ ত্বং নো অগ্নে অগ্নিজ্বিহ্ম যজ্ঞং চ বর্ধয়। ত্বং নো দেবতাতয়ে রায়ে দানায় চোদ্দয়৷৷ ৩৷৷

 সূক্ত ৭– ত্বে সোম প্রথমা বৃক্তবহিষো মহে বাজায় বসে ধিয়ং দধুঃ। স ত্বং নো বীর বীর্যায় চোদ্দয়৷৷ ১৷ অভ্যভি হি শ্ৰবসা ততর্দিাৎসং ন কঞ্চিজ্জন পানমক্ষিত। শর্ষাভিন ভরমাণে গভস্ত্যোঃ । ২৷৷ অজীজনো অমৃত মর্তায় কমৃতস্য ধর্মমৃতস্য চারুণঃ। সদা সরো বাজমচ্ছা সনিষ্যদৎ৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ৮– এমিন্দ্রায় সিঞ্চত পিবাতি সোম্যং মধু। প্র রাধাংসি চোদ্দয়তে মহিত্বনা৷৷ ১৷৷ উপো হরীণং পতিং রাধঃ পৃঞ্চমব্ৰব৷ নূনং শ্রুধি স্তুবতো অশ্যস্য। ২৷৷ : ন হ্যংগ পুরা চ ন জজ্ঞে বীরতরৎ। ন কী রায়া নৈব ন ভন্দনা। ৩৷৷

 সূক্ত ৯– নদংব ওদতীনাং নদং যোযুবতীনা৷ পতিং বো অয়নাং ধেনু নামিষুধ্যসি৷৷ ১৷

মন্ত্ৰার্থ— ৬সূক্ত/১সাম– আত্মশক্তির দ্বারা উৎপন্ন, আমাদের হৃদয়ে নিহিত হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! আপনি পরমব্রহ্মকে প্রাপ্ত হোন; হে আমাদের মন! যে জ্ঞানকিরণ দেবতায় বর্তমান এবং যে জ্ঞানকিরণ মনুষ্যে বর্তমান সেই সকল জ্ঞানকিরণের দ্বারা তুমি আমাদের স্তোত্রসমূহকে সমলস্কৃত করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। আর এই যে, জ্ঞানযুত স্তোত্রের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [জ্ঞানকিরণ যে বিশ্বের সর্বত্র বর্তমান আছে, তা মন্ত্রের শেষাংশ থেকে স্পষ্টই উপলব্ধ হয়। যে দেবত্ৰা, যে আয়ুযু পদগুলিতে বিশ্বব্যাপক জ্ঞানেরই পরিচয় পাওয়া যায়]।

৬/২– আমরা পরমশাক্তসম্পন্ন যে দেবতার পূজাপরায়ণ, প্রসিদ্ধ সেই জ্ঞানদেব আত্মশক্তির সাথে প্রকৃষ্টরূপে আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন; অপিচ, ভগবান্ সকল জ্ঞানকিরণের সাথে সম্যক্রপে আমাদের পুত্রপৌত্র ইত্যাদি সকলের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি; ভগবান্ আমাদের সকলের মধ্যে আবির্ভূত হোন)। [প্রার্থনার বিশেষত্ব এই যে, তাতে কেবলমাত্র নিজের জন্য প্রার্থনা করা হয়নি– প্রার্থনাকারীর, পুত্রপৌত্র ইত্যাদিক্রমে বংশের সকলে যাতে ভগবৎ-পরায়ণ হয়, সকলে যাতে ভগবৎ-কৃপা লাভ করতে পারে, মন্ত্রে তার জন্যও প্রার্থনা করা হয়েছে]।

৬/৩– জ্ঞানস্বরূপ হে পরমব্রহ্ম! আপনি আপনার পরাজ্ঞানের দ্বারা আমাদের সৎকর্মকে সমলস্কৃত করুন; দেবভাবপ্রাপ্তির জন্য এবং আমাদের পরমধনপ্রাপ্তির জন্য আপনি আমাদের উদ্বুদ্ধ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন জ্ঞানের বলে সৎকর্ম সম্পাদন করি; পরমধন প্রাপ্তির জন্য যেন উদ্বুদ্ধ হই)। [সূক্তটির ঋষির নাম– অগ্নি তাপস]।

৭/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! শ্রেষ্ঠ, ভগবানে সমর্পিতহৃদয় সাধকগণ পরমমঙ্গল ও শক্তিলাভের জন্য আপনাতে বুদ্ধি ন্যস্ত করেন। শক্তিসম্পন্ন হে দেব! যাঁতে সকল সাধকন্যস্তহৃদয় হন, এমন যে আপনি, আত্মশক্তি লাভের জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সর্বলোকের আশ্রয়ভূত সর্বশক্তিমান্ ভগবান্ আমাদের আত্মশক্তিসম্পন্ন করুন)।

৭/২– হে ভগবন! আপনি যেমন কোনও সাধককে অক্ষয় অমৃত প্রদান করেন, তেমনভাবে মঙ্গলের সাথে অমৃতপ্রবাহ নিত্যকাল নিশ্চিতভাবে আমাদের প্রদান করুন; জ্ঞানকিরণসমূহ যেমন সৎকর্মের দ্বারা পূর্ণ হয়, তেমনইভাবে আপনি আমাদের পরমমঙ্গলের দ্বারা পূর্ণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের পরমধন অমৃত প্রদান করুন)।

৭/৩– অমৃতস্বরূপ হে দেব! আপনি পরমমঙ্গলস্বরূপ অমৃতদায়ক সত্যের ধারক, অর্থাৎ প্রাপক পরাজ্ঞানকে আমাদের কল্যাণের জন্য উৎপাদন করেন; দেবত্বপ্রাপক শক্তিপ্রাপ্তির জন্য আপনি আমাদের নিত্যকাল উদ্বুদ্ধ করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ লোকহিতের জন্য তাদের পরাজ্ঞান প্রদান করেন; সেই পরমদেবতা আমাদের শক্তিলাভের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন)। [এই সূক্তটির ঋষি– ত্রারুণ ত্ৰৈকৃষ্ণ পৌরুকুৎস সদস্যু। এই তিনটি মন্ত্রের দুটি গেয়গানের নাম– যৌধাজয়ম এবং দৈর্ঘশ্ৰবসম্]।

৮/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাব হৃদয়ে উপজন করো; তিনি সেই অমৃতোপম শুদ্ধসত্ত্বভার গ্রহণ করুন এবং কৃপা করে তোমাদের পরমধন প্রকৃষ্টরূপে প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -ভগবান্ কৃপা করে আমাকে পরমধন প্রদান করুন)। [মোক্ষ বা মুক্তি লাভের অর্থই স্বরূপ অবস্থায় ফিরে আসা। যে শুদ্ধসত্ত্বভাব থেকে মানুষ এসেছে, সেই পূর্বভাবে ফিরে যাওয়াতেই তার মুক্তি। মুক্তি বললেই বন্ধনের অবস্থা মনে আসে। সেই বন্ধন, মায়া মোহ অজ্ঞানতা ইত্যাদি– যা মানুষকে আত্মবিস্মৃত করে রেখেছে। সেই সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে শুদ্ধ বুদ্ধপূর্ণ অবস্থায় ফিরে যাওয়াই মুক্তি। মুক্তিলাভের উপায়-স্বরূপ সেই সত্ত্বভাব যাতে লাভ করতে পারেন, সেই জন্য সাধক নিজেকে সচেষ্ট করতে যত্ন করছেন। আমাদের মন্ত্রার্থে ইন্দুং সোম্যং মধু শব্দ তিনটির অর্থ যথাক্রমে সত্ত্বভাব শুদ্ধসত্ত্বভাব ও অমৃত গৃহীত হয়েছে। ভাষ্যে ঐ তিনটি শব্দে মাদকতার গুণবিশিষ্ট সোমরস অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে)। [এই সামমন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৪দ-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– পাপহারক জ্ঞান-ভক্তি ইত্যাদির স্বামী, স্তোতাদের পরমধনদাতা ভগবানকে আমি যেন আরাধনা করি; হে ভগবনন্পরাজ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনাকারী আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন, গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎ-পরায়ণ হই; ভগবান্ কৃপাপূর্বক হে আমাদের সাধন-শক্তি প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত অনুবাদ– হরিগণের অধিপতি ইন্দ্রের স্তব করি। তিনি নিজের বল অন্যকে প্রদান করেন, তুমি স্তোত্রকারী ব্যশ্ব.ঋষির পুত্রের স্তুতি শ্রবণ করো। বলা বাহুল্য, ব্যাখ্যাকার কোথা থেকে ব্যশ্ব ঋষির পুত্র-কে পেলেন তা তিনিই জানেন। আমরা মন্ত্রের। মধ্যে এমন ঋষিপুত্রকে খুঁজে পাইনি। আমরা হিরণাং পতিংবলতে জ্ঞানভক্তি ইত্যাদির স্বামী বুঝি। অশ্বস্য পদের অর্থ গৃহীত হয়েছে অশ্বায়, ব্যাপকজ্ঞানায়, পরাজ্ঞান প্রাপ্তয়ে ইত্যাদি। এবং এগুলি যে কত সঙ্গত তা এই অনুবাদের সাথে মিলিয়ে, আমাদের মন্ত্রার্থে দেখলেই বোঝা যায়]।

৮/৩– পরমশক্তিসম্পন্ন হে দেব! আপনার হতে অধিক শক্তিসম্পন্ন কেউই বর্তমান নেই এবং অতীতেও ছিল না; আপনার হতে পরমধনদাতা কেউই বর্তমান নেই, স্তোতৃদের রক্ষকও কেউ নেই, আরাধনীয়ও. কেউ নেই। (মন্ত্রটি ভগবৎ-মাহাত্ম্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানই ত্রিকালাতীত, পরমধনদাতা, সকলের আরাধনীয়, সর্বশ্রেষ্ঠ হন)। [ভগবানই বিশ্বের জনিয়তা, সুতরাং তিনি আদি। তিনিই বিশ্বকে নিজেতে ফিরিয়ে নেন, সুতরাং তিনি অন্ত। তিনি বিশ্বের অধিপতি, বিশ্বের অক্ষয় ভাণ্ডার তারই চরণতলে ন্যস্ত, সুতরাং তার চেয়ে পরমদাতাও আর কেউ ছিল না, নেই এবং থাকবেও না। জগতের পালক, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বা একতম বরেণ্য তিনি, তাঁর চরণেই মানব নিজের হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করে]। [এই সূক্তের ঋষি– বিশ্বমনা বৈয়শ্ব। সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। তার নাম—মারুতম]।

৯/১– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! জ্ঞান-উন্মেষিকাবৃত্তিসমূহের উৎপাদক এবং শান্ত-স্নিগ্ধ জ্যোতিঃসমূহের মূলীভূতকারণ ভগবানকে তোমরা আরাধনা করো; তোমরা অমৃতস্বরূপ জ্ঞানকিরণসমূহের অধীশ্বর ভগবানকে আরাধনা করো; হে আমার মন! তুমি পরাশক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞানদায়ক অমৃতাধিপতি, ভগবানকে আরাধনা করি)। [মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ লক্ষণীয়– ঊষাগণের উৎপাদক, নদীগণের শব্দ উৎপাদক, গোসমূহের পতি (ইন্দ্রকে আহ্বান করো), যেহেতুক তিনি ক্ষীরপ্রদ (গাভী হতে উৎপন্ন অন্ন) ইচ্ছা করছেন। মন্ত্রের ওদতীনাং পদটির ভাষ্যার্থ ঊষাগণের। ঊষা বহু নয়, ঐ পদে প্রভাতের পূর্বসময়কে নির্দেশ করা হলে ওটি এক বচনান্তরূপেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু তা হয়নি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ঐ পদে ঊষা ব্যতীত অন্য কোনও বস্তুকে বোঝাচ্ছে। সেই বস্তু জ্ঞান-উন্মোষিকা সৎবৃত্তিরাজী। ঊষার অরুণ আলোকে যেমন জগতের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায় এবং জগৎ এক মনোহর নূতন মূর্তি ধারণ করে, জ্ঞান-উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে তেমনই মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনের মূলে আছেন– সেই পরমপুরুষ। তাই তাকে ওদতীনাং নদংবলা হয়েছে। এই কিরণ, এই জ্যোতিঃ শুধু পাপ তাপ দগ্ধ করে না, মানুষের হৃদয়কে শান্তস্নিগ্ধও করে। যার হৃদয়ে জ্ঞানের এই বিমল জ্যোতিঃর উন্মেষ হয়, তিনি পরাশান্তি লাভ করেন। তাই যাতে সেই শান্তিদাতার কৃপালাভ করতে পারা যায় সেইজন্যই মন্ত্রে আত্ম-উদ্বোধনা রয়েছে। অঘ্যানাং পদে ভাষ্য ইত্যাদিতে গরু অর্থ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের ধারণা, — মরণধর্মরহিত, অমৃতদায়ক, অমৃতস্বরূপ অর্থে জ্ঞানের বিশেষণরূপে তা ব্যবহৃত হয়েছে। [একটিমাত্র মন্ত্র-সম্বলিত এই সূক্তটির ঋষি– বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি। এর গেয়গানটির নাম—শ্রুধ্যম]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ১০– দেবো বো দ্রবিণোদাঃ পূর্ণং বিবষ্ট্যাসিচম্। উদ্বা সিঞ্চধ্বমুপ বা পৃণধ্বমাদিছো দেব ওহতে৷ ১. তং হোতার মধ্বস্য প্রচেতসং বহ্নিং দেবা অকৃত। দধাতি রত্নং বিধতে সূবীর্যমগির্জনায় দাশুষে৷ ২৷৷

সূক্ত ১১– অদর্শি গাতুবিত্তমো যস্মিন্ ব্ৰতান্যাদধুঃ। উপ মু জাতমাস্য বর্ধনমগিং নক্ষন্তু নো গিরঃ ১। যম্মাদ রেজস্ত কৃষ্টয়শ্চকৃত্যানি কৃতঃ। সহস্রসাং মেধসাতাবিব নাগ্নিং ধীভিমস্যত৷ ২৷ প্র দৈবদাসো অগ্নিঃ-৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১২– অগ্ন আয়ুংষি পবসে-৷৷ ১৷ অগ্নিঋষিঃ পবমানঃ পাঞ্চজন্যঃ পুরোহিতঃ। তমীমহে মহাগয়৷ ২৷৷ অগ্নে পবস্ব সপা অম্মে বর্চঃ সুবীর্য। দধ রয়িং ময়িং পোষ৷৷ ৩৷

সূক্ত ১৩– অগ্নে পাবক রোচি মন্দ্রয়া দেব জিয়া। আ দেবান বক্ষি যুক্ষি চ৷৷ ১। তং ত্বা ঘৃতবীমহে চিত্রভানো স্বশম্। দেবাং আ বীতয়ে বহ৷৷ ২. বীতিহোত্রং ত্বা কবে দ্যুমন্তং সমিধীমহি। অগ্নে বৃহত্তমধ্বরে৷৷ ৩৷৷

মন্ত্রার্থ— ১০সূক্ত/১সাম– হে চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমাদের নিবাসস্থানভূত, সৎ-ভাবপূর্ণ ও ভক্তিরসাপ্লুত (আমার) হৃদয়প্রদেশকে, ধনপ্রদ দ্যোতমান জ্ঞানাগ্নি (জ্ঞানদেব) কামনা করুন; তোমরা সেই জ্ঞানস্বরূপ দেবতাকে ভক্তিরসের দ্বারা সম্যক্‌রূপে সিঞ্চন করো এবং সৎ-ভাবের দ্বারা সম্যক রূপে পূর্ণ করো; তারপর (তা হলে) এই দ্যোতমান জ্ঞানাগ্নি তোমাদের অভিলষিত স্থান মোক্ষ প্রদান করবেন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয় সৎ-ভার সমন্বিত ভক্তিপ্লুত হোক; তার দ্বারাই আমরা আকাঙিক্ষত সামগ্রী বা মোক্ষ যেন প্রাপ্ত হতে পারি)। [মন্ত্রের মধ্যে কোন স্থানেই সুক এবং সোমরস-এর জ্ঞাপক কোনও শব্দ দৃষ্ট হয় না। একমাত্র পূর্ণাং এই স্ত্রীলিঙ্গের বিশেষণ পদটি দেখে সুক শব্দ ভাষ্যে অধ্যাহৃত হয়েছে। সুক থাকলেই হবনীয়ের প্রয়োজন; তাই ভাষ্যে সোমরস হবনীয়ের অবতারণা। আমরা কিন্তু মন্ত্রের মধ্যে সোমরস ইত্যাদির প্রসঙ্গ দেখি না]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-৬দ-১সা) পাওয়া যায়]।

১০/২– দেবভাবসমূহ সৎকর্মপ্রাপক, ভগবনপ্রাপক, প্রসিদ্ধ প্রজ্ঞান-স্বরূপ দেবতকে প্রাপ্ত হয়; জ্ঞানদেব পূজাপরায়ণ প্রার্থনাকারী সাধককে আত্মশক্তিদায়ক পরমধন প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -দেবভাবের দ্বারা সাধকেরা পরাজ্ঞান এবং পরাজ্ঞানের দ্বারা পরমধন লাভ করেন)। [হৃদয়ে যখন জ্ঞানরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সাধক জ্ঞানালোকের প্রভাবে নিজের অভীষ্ট গন্তব্য পথ নির্দেশ করতে পারেন এবং সৎকর্মজনিত শক্তির প্রভাবে সেই পথ অনুসরণে চলতেও সমর্থ হন। অবশেষে সেই শ্রেয়ঃমার্গ অবলম্বন করে সাধক নিজের জীবনের চরম অভীষ্ট মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হন– এটাই মন্ত্রের সারমর্ম]। [এই সূক্তটির ঋষিবসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি। এর অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম– যজ্ঞাযজ্ঞীয়ম এবং কণ্বরথন্তরম]।

১১/১– যে জ্ঞানাগ্নি সঞ্জাত হলে, (সাধকগণ) সৎকর্মসমূহ সাধন করতে সমর্থ হন; সৎকর্মবিদ সেই জ্ঞানাগ্নি, সাধকগণ কর্তৃক দৃষ্ট হন (অর্থাৎ সাধকদের হৃদয়ে প্রাদুর্ভূত হন); এইরকম সুষ্ঠুরূপে প্রাদুর্ভূত, সত্ত্বভাবের বর্ধক, জ্ঞানাগ্নিকে আমাদের স্তুতিরূপ বাক্যসমূহ প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, জ্ঞান সৎকর্মের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট। সাধকগণ তা বুঝতে পারেন। সেই জ্ঞানকে আমাদের স্তোত্রকর্মগুলি প্রাপ্ত হোক)। [এখানে সাধক সুদৃঢ় আশাতে আশ্বস্ত হয়েছেন। তিনি মন্ত্রে উপদেশ পাচ্ছেন– জ্ঞানাগ্নি সাধকদের হৃদয়প্রদেশে দৃষ্ট হন। তুমি সাধনা করো, তাঁকে প্রাপ্ত হবে। দৃঢ়-প্রযত্ন। হও তার আরাধনায়; অবশ্যই তিনি তোমার অন্ধতমসাচ্ছন্ন হৃদয়ে তার পুণ্যজ্যোতিঃ বিকীরণ করবেন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-৫দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১১/২-যেহেতু সৎকর্মসাধনকারী আত্ম-উৎকর্ষশালী সাধকগণ ঊর্ধ্বগমন প্রাপ্ত হন; সেইজন্য হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা সৎকর্ম সাধনের জন্য স্বয়ংই সৎ-বৃত্তির দ্বারা (অথবা, সৎকর্ম সাধনের দ্বারা) প্রভূতধনদাতা জ্ঞানদেবকে আরাধনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মসাধনের দ্বারা পরমধনদাতা জ্ঞানস্বরূপ ভগবানকে আরাধনা করি)।

১১/৩– দেবভাবপোষক দানশীল জ্ঞানদেব আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — জ্ঞানদেবৈর কৃপায় আমরা যেন পরমধন লাভ করি)। [এটি যে মন্ত্রের অংশবিশেষ সেই মূলমন্ত্রের অর্থ-দেবভাবের পোষক, দানশীল, দ্যোতমান এবং পরমৈশ্বর্যশালী ও ইন্দ্রের ন্যায় (এই) জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব, মাতৃস্থানীয়– অনন্তের আস্পদ বলে অতিবিস্তৃত সাধকের হৃৎ-স্বরূপ ভূমিতে, অর্চনাকারিগণের হিতসাধনে, বিশেষভাবে প্রবর্তিত করেন। এই জ্ঞানাগ্নি, সত্ত্বভাবের দ্বারা পরিবর্ধিত হয়ে, স্বর্গসম্বন্ধীয় কল্যাণে অবস্থিত হন (অর্থাৎ সাধকের পরমকল্যাণ সংসাধিত করেন)। (ভাব এই যে, জ্ঞানদেবতার প্রভাবে মানুষ সৎকর্মে প্রবুদ্ধ হয়। তাতে তার নিজের এবং সকল জীবের শেয়ঃ সাধিত হয়ে থাকে)। [কিন্তু ভাষ্যকার এই মন্ত্রের দৈবোদাসো পদে দিবোদাস নামক ঋষির সম্বন্ধ সূচনা করে, এবং ইন্দ্র পদটিকে অগ্নিদেবের বিশেষণ বলে স্বীকার ইত্যাদি করে সমগ্র মন্ত্রটির ভিন্ন অর্থ সংস্থাপিত করেছেন। আমাদের বিশ্লেষণে দেখান হয়েছে– জ্ঞানাগ্নি যে ভগবানের প্রতিকৃতি তা এই মন্ত্রে জাজ্বল্যমান রয়েছে। (দৈবঃ অর্থে দেবভাবপোষক; দাসঃ অর্থে দানশীল; অগ্নি অর্থে জ্ঞানদেব ইত্যাদি নির্ধারণ করে) আমরা সঙ্গত মন্ত্ৰার্থই নিবেদন করেছি]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-৫-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]। [সূক্তটির ঋষি– সৌভরি কাণ্ব। এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– যজ্ঞাযজ্ঞীয়, অভিনিধনংকাণ্ব ইত্যাদি]।

১২/১– হে জ্ঞানদেব! সৎকর্মসাধনশক্তি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সৎকর্মসাধনসমর্থ করুন। [এটিও একটি মূলমন্ত্রের অংশবিশেষ। মন্ত্রে সাধনশক্তিলাভ ও রিপুজয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। — ছন্দ আর্চিকে (৬অ ৫দ-১সা) দ্রষ্টব্য। উত্তরার্চিকেও (১৩অ-৪খ-১২সূ-১সা) এটি প্রাপ্তব্য]।

১২/২– যে জ্ঞানদেব পবিত্রকারক সর্বলোকের কল্যাণদায়ক, সকলের হিতসাধক এবং পরাজ্ঞানদায়ক হন, আমাদের হৃদয়ে আবির্ভাবের জন্য সাধকগণ কর্তৃক আরাধনীয় প্রসিদ্ধ সেই দেবতাকে প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সেই জ্ঞানস্বরূপ পরমদেব কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [এই মন্ত্রের পাঞ্চজন্যঃ পদটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সায়ণাচার্যের প্রথম মত– ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও নিষাদ– এই পাঁচ শ্রেণীর মানুষকে পঞ্চজনশব্দে বোঝাচ্ছে। তার দ্বিতীয় মত– গন্ধর্ব, পিতৃগণ, দেবগণ, অসুর ও রাক্ষস এই পঞ্চজন। তৃতীয় মত– দেবতা, মানুষ, গন্ধর্ব-অপ্সরা, সর্প ও পিতৃগণ। এভাবে গণনা করলে অসংখ্য পঞ্চজন পাওয়া যেতে পারে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা আবার এই পদে পাঁচ দেশান্তরগত পাঁচটি জাতিকে বুঝিয়েছেন। আবার এই পাঁচটি জাতির নাম ও পরিচয় সম্বন্ধে অনেক মতভেদও আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পঞ্চজনাঃ পদে সকল মানুষকেই বোঝায়; অর্থাৎ আর্য হিন্দু-ধর্মান্তৰ্গত চতুর্বর্ণের সকল মানুষ এবং তার বহির্ভূত (অপর ধর্মের অন্তর্গত) সকল মানুষ নিয়েই পঞ্চজনাঃ। সুতরাং পাঞ্চজন্যঃপদের অর্থ-যে দেবতা পঞ্চজনের অভীষ্ট সাধন করেন। অগ্নি এই পাঁচজাতীয় প্রাণীর উপকার করেন, অর্থাৎ জ্ঞানাগ্নি সমগ্র মানবজাতির হিতসাধন করেন। ভগবানই মানুষের পরম মঙ্গলদাতা, তিনিই মানুষকে চরম কল্যাণের পথে নিয়ে যান, তাঁর চরণেই প্রার্থনা নিবেদন করা হয়েছে। তিনি যেন আমাদের সকলের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের অভীষ্টপথে মোক্ষমার্গে অগ্রসর করিয়ে দেন, এটাই প্রার্থনার সার মর্ম]।

১২/৩– হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! সৎকর্মের সাধক আপনি আমাদের আত্মশক্তি এবং পরাজ্ঞান প্রদান করুন; আমার হৃদয়ে আত্মপোষক পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের আত্মশক্তিদায়ক পরাজ্ঞান পরমধন প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অগ্নি! তোমার কার্য অতি সুন্দর। তুমি আমাদের তেজস্বী ও বীর্যবান করো। ৪ তুমি আমাকে হৃষ্টপুষ্ট গোধন বিতরণ করো। — পোষং পদের ভাষ্যার্থ গরুর পুষ্টি অথবা গবাদি পশু। কিন্তু এই অর্থ কোন্ যুক্তিতে গ্রহণ করা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই। প্রকৃতপক্ষে পোষং পদে পুষ্টি– আত্মপুষ্টিই অথবা আত্মপোষক অর্থ প্রকাশ পায়। যার দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধিত হয়, তাই আত্মপোষক। আত্ম-উন্নতি-বিধায়ক সেই পরমধনের জন্য মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষি বৈখানসগণ]।

১৩/১– পবিত্রকারক হে জ্ঞানদেব! আপন : তেজে পরমানন্দদায়ক জ্যোতিঃর দ্বারা দেবভাবসমূহকে আমাদের হৃদয়ে সমুৎপাদিত করুন এবং সেই দেবভাবসমূহকে যত্নের সাথে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! আমরা যেন জ্ঞানের প্রভাবে হৃদয়ে দেবভাবসমূহকে লাভ করি)।

১৩/২– অমৃতদায়ক বিচিত্রজ্ঞানসম্পন্ন হে দেব! সর্বজ্ঞ প্রসিদ্ধ আপনাকে আমরা আরাধনা করছি। আপনি পূজাপরায়ণ আমাদের জন্য অর্থাৎ আমাদের কল্যাণের জন্য দেবভাবসমূহকে প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে অমৃতপ্রাপক পরমদেব! আমাদের কল্যাণের জন্য দেবভাব প্রদান করুন)।

১৩/৩– সর্বজ্ঞ হে জ্ঞানদেব! আমরা যেন সৎকর্মসাধক, জ্যোতির্ময়, মহান, আপনাকে সৎকর্মসাধনে সমিদ্ধ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাবার্থ-হে ভগবন! আমরা যেন সৎকর্মের সাধনের দ্বারা আমাদের হৃদয়ে পরাজ্ঞানকে পূর্ণরূপে লাভ করতে পারি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় প্রজ্বলিত অগ্নিকে উদ্দেশ্য করে তুমি জ্ঞানসম্পন্ন হব্যভোজী ইত্যাদি বলা হয়েছে। কিন্তু সেই অগ্নি জ্ঞানসম্পন্ন হয় কেমন করে? আমরা মনে করি, জ্ঞানাগ্নিই মন্ত্রের লক্ষ্যস্থল। তা-ই বীতিহোত্রং অর্থাৎসৎকর্মসাধক। জ্ঞান না থাকলে প্রকৃতপক্ষে সৎকর্মসাধন সম্ভবপর হয় না]। [এই সূক্তের ঋষি বসূয়ব আত্রেয়গণ]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ১৪– অবা নো অগ্নে উতিভিৰ্গায়ত্রস্য প্রভমণি। বিশ্বাসূ ধীষু বন্দ্য৷৷ ১। আ নো অগ্নে রয়িং ভর সত্ৰাসাহং বরেণ্য। বিশ্বাসু পৃৎসু দুষ্টরম৷৷ ২৷৷– আ নো অগ্নে সুচেতুনা রয়িং বিশ্বায়ু পোস। মাৰ্ভীকং ধেহি জীবসে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৫– অগ্নিং হিবন্তু নো ধিয়ঃ সপ্তমাশুমিবাজিযু। তেন জেম্ম ধনং ধন৷ ১। যয়া গা আকরামহে সেনষাগ্নে তবোত্যা। তাং নো হিমঘওয়ে৷৷ ২ আগ্নে স্থূরং রয়িং ভর পৃথুং গোমস্ততমনি। অঙঘি খং বর্তয়া পণি৷৷ ৩৷৷ অগ্নে নক্ষত্রমজরমা সূর্যং রোহয়ো দিবি। দুধজ্জোতিৰ্জনেভ্য ৷৷ ৪৷৷ অগ্নে কেতুর্বিশামসি প্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ উপস্থসৎ৷৷ বোধা স্তোত্রে বয়ো দধৎ৷৷ ৫৷৷

সূক্ত ১৬– অগ্নিমূর্ধা দিবঃ ককুৎপতিঃ পৃথিব্যা. অয়ম অপাং রেংসি জিম্বতি। ১। ঈশিষে বাস্য হি দাস্যাগ্নে স্বঃপতিঃ। স্তোতা স্যাং তব শর্মাণ৷ ২৷৷ উদগ্নে শুচয়স্তব শুক্রা ভ্রান্ত ঈরতে। তব জ্যোতিংষ্যৰ্চয়ঃ ॥ ৩

মন্ত্রার্থ— ১৪সূক্ত/১সাম-সকল কর্মসমূহের মধ্যে হয়ে (অথবা জ্ঞানিগণের অনুসরণীয়) হে জ্ঞানদেব! গায়ত্রীছন্দোযুক্ত মন্ত্রের সম্পাদনে বা প্রযুক্তিতে নিমিত্তভূত হয়ে, আপনার রক্ষণের বা পালনের দ্বারা আমাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে দেব! আমাদের উচ্চারিত মন্ত্রের সাথে মিলিত হয়ে আমাদের রক্ষা করুন)। [আমরা যেন জ্ঞানের সাথে সম্মিলিত হয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারি; আমরা যেন অজ্ঞানের মতো অযথাভাবে মন্ত্রের প্রয়োগ না করি। আমাদের কর্ম যেন জ্ঞানসমম্বিত হয়; আমরা যেন অজ্ঞানোচিত কোনও কার্যে প্রবৃত্ত না হই। এই মন্ত্রের প্রার্থনায় এমন ভাবেরই দ্যোতনা আছে]।

১৪/২– হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! আমাদের দারিদ্রনাশক (সৎকর্ম প্রবর্তক) বরণীয়, রিপুগণের প্রলোভনরূপ বা প্রাধান্যভূত সকল সংগ্রামে অনুতিক্রম্য অর্থাৎ অজেয় পরমার্থ রূপ ধন সম্পূর্ণরূপে প্রদান করুন। (ভাব এই যে, জ্ঞানদেবতার কৃপায় আমাদের মধ্যে পরমার্থের সমাবেশ হোক)। [এই মন্ত্রের সত্ৰাসাহং পদে যাগ ইত্যাদি সৎকর্মের প্রবর্তনার ভাব আসে। জ্ঞানের অধিকারী হলে, মানুষ সৎকর্মে প্রবৃত্ত হয়। সে ভাবও এখানে গ্রহণীয়। কিন্তু ঐ পদের ভাষ্যানুসারী অর্থ– দারিদ্র-নাশক]। তাতেও সঙ্গতি রয়েছে। এরপর বিশ্বাসু পৃৎসু পদ দুটির ভাব অনুধাবনীয়। যে অর্থ এখন প্রচলিত আছে, তার ভাবে ঐ পদে পারিপার্শ্বিক যজ্ঞবিঘ্নকারী দস্যুগণকে বা মানুষের শত্রুগণকে বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মতে, হৃদয়ের মধ্যে কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুদের যে সংগ্রাম অহরহঃ চলছে, এখানে সেই সংগ্রামের প্রতিই লক্ষ্য আছে। এবার বুঝতে হবে, সেই রয়িং বা ধন কি রকমের? উত্তর বিশ্বাসু পৃৎসু দুস্তরং, অর্থাৎ বিশ্বের সকল সংগ্রামে অজেয়– সকল শত্রুকর্তৃক অনতিক্ৰমণীয়। ভাব এই যে, — সেই ধনের অধিকারী হতে পারলে, কোনও শত্রুই হিংসা করতে পারে না। রয়িং পদে যে পরমার্থ-রূপ ধনের প্রতি লক্ষ্য আসে, তা বারংবার বলা হয়েছে। জ্ঞানের সাহায্যে যে, সে ধন পাওয়া যায়, তাই এখানে প্রখ্যাত হয়েছে। সুতরাং অগ্নে অর্থে হে জ্ঞানদেব-ই সম্পূর্ণ সঙ্গত]।

১৪/৩– হে জ্ঞানদেব! আমাদের জীবনের বা রক্ষণের জন্য শোভনজ্ঞানযুত অর্থাৎ চৈতন্যময়ের সম্বন্ধবিশিষ্ট, সর্বপ্রাণীর প্রতিপালক (জগত্ৰহ্ম– এমন ভাবজ্ঞাপক), পরমসুখকর, পরমার্থরূপ ধন আমাদের মধ্যে স্থাপন করুন– আমাদের প্রদান করুন। (ভাব এই যে, — সেই ভগবানের অনুকম্পায় চৈতন্যসম্বন্ধযুত সর্বত্র ব্রহ্মজ্ঞানরূপ পরমসুখকর ধন আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হোক– এই প্রার্থনা)। [চৈতন্যময়ের সম্বন্ধযুত হয়ে, জগৎব্রহ্মময় জ্ঞান করে, জনসেবায় আত্মনিয়োগপূর্বক, অশেষ সুখের হেতুভূত পরমার্থরূপ ধনকে যেন আমরা প্রাপ্ত হই। আমাদের জ্ঞানের প্রভাবে আমরা যেন তেমন ধনকে (রয়িং) লাভ করতে পারি– এমন আকাঙ্ক্ষাই এখানে পরিব্যক্ত। আমরা জানি না জ্বলন্ত অগ্নির অতীত অগ্নে সম্বোধনে সম্বোধন না করলে, ঐরকম আকাঙ্ক্ষা বা প্রার্থনা করা যায় কি না] [এই সূক্তের ঋষি-গোতম রাহুগণ]।

১৫/১– যোদ্ধাগণ যেমন সংগ্রামে যুদ্ধজয়ের জন্য শীঘ্রগামী যুদ্ধাশ্ব প্রেরণ করেন, সেইরকমভাবে আমাদের কর্মসমূহ (অথবা, সৎবৃত্তিসমূহ) পরাজ্ঞানকে প্রেরণ করুক; অর্থাৎ হৃদয়ে উদ্বোধিত করুক; সেই পরাজ্ঞানের দ্বারা আমরা যেন পরমধন– মোক্ষলাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা সৎকর্মের সাধনের দ্বারা যেন পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি; তার পর পরাজ্ঞানর দ্বারা যেন মোক্ষ প্রাপ্ত হই)।

১৫/২– হে জ্ঞানদেব! রিপুসংগ্রামে সহায়ভূত আপনার প্রসিদ্ধ যে রক্ষাশক্তির দ্বারা আমরা পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি, পরমধন প্রাপ্তির জন্য সেই রক্ষাশক্তি আমাদের প্রদান করুন অর্থাৎ আমাদের সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -ভগবান আমাদের পরমধন প্রদান করুন এবং সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করুন)। [মানুষ চারিদিকে দুর্দান্ত রিপুদের দ্বারা বেষ্টিত এবং তাদের আক্রমণে বিব্রত, বিপর্যস্ত। মানুষের অন্তস্থিত রিপুগণই সৎকর্মসাধনের সর্বপ্রধান বিঘ্ন। তবে কি এ থেকে নিস্তারের কোন উপায় নেই? আছে। চিরমঙ্গলময় ভগবানের রাজ্যে পাপের আধিপত্য চিরন্তন হতে পারে না তিনি তার শক্তির দ্বারা তার ভক্ত সন্তানদের রক্ষা করছেন। বর্তমান মন্ত্রে ভগবানের কাছে সেই রক্ষাশক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।

১৫/৩– হে জ্ঞানদেব! আমাদের সমৃদ্ধিদায়ক পরাজ্ঞানযুত ব্যাপকজ্ঞানোপেত প্রভূতপরিমাণ পরমধন প্রদান করুন; অপিচ, আপন তেজে স্বর্গপ্রাপক পবিত্রকারক ধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞানযুত পরমধন প্রদান করুন)। [ভাষ্যকার গোমন্তং এবং অশ্বিনং পদদুটিতে যথাক্রমে গোভিযুক্তং এবং অশ্বোপেতং অর্থ গ্রহণ করেছেন। তাতে প্রার্থনার ভাব দাঁড়িয়েছে– হে ভগবন! আমাদের গরু দাও, ঘোড়া দাও। এটা প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে প্রায়ই দেখা যায়। এটি থেকে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা প্রশ্ন তোলেন– প্রাচীনকালে আর্যহিন্দুরা সবাই নিশ্চয়ই কৃষক এবং যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন। কারণ কৃষির জন্য গরু এবং যুদ্ধের জন্য ঘোড়াই তাদের প্রার্থনীয়। (প্রাচীন হিন্দুরা যে মদ্যপ ছিলেন, তা তো প্রচলিত ব্যাখ্যাকাররা সোম-এর মাধ্যমেই পরিবেশন করেছেন)। প্রকৃত অর্থে, আমাদের মন্ত্রার্থে গোমন্তং ও অশ্বিনং পদ দুটিতে যথাক্রমে পরাজ্ঞানযুতং এবং ব্যাপকজ্ঞানোপেতং অর্থ সঙ্গতভাবেই গৃহীত হয়েছে]।

১৫/৪– হে জ্ঞানদেব! আপনি সর্বলোকের জ্যোতিঃদায়ক, ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক, নিত্যতরুণ, দ্যুলোকে বর্তমান জ্ঞানালোককে আমাদের হৃদয়ে স্থাপন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের বিশ্ববাসী সকলকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [প্রার্থনার ভাবটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিশ্ববাসী সকলের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। সকল লোক যাতে পরাজ্ঞান, লাভ করতে পারে, মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে বিশ্বজনীন্ এই ভাবই প্রার্থনার বিশেষত্ব]।

১৫/৫– হে জ্ঞানদেব! আপনি সর্বলোকের জ্ঞানদায়ক হন; অপিচ, শ্রেষ্ঠতম প্রিয়তম হন; আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের পূজা গ্রহণ করুন এবং প্রার্থনাকারী আমাদের দিব্যশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে প্রিয়তম পরাজ্ঞানদায়ক দেব! কৃপাপূর্বক আমাদের দিব্যশক্তি প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে অগ্নি! তুমি প্রজাদের অস্তিত্ব জানিয়ে দাও। অর্থাৎ তোমাকে দেখলেই সেখানে লোকালয় আছে এমন অনুমান হয়। তুমি প্রিয়তম; তুমি শ্রেষ্ঠ। তুমি যজ্ঞধামে উপবেশন করো, স্তবের প্রতি কর্ণপাত করো; অন্ন এনে দাও। মূলে আছে বিশাং কেতুঃঅর্থাৎ লোকগণের জ্ঞানবিধাতা। কিন্তু অনুবাদকার কেতুঃ পদের যে অর্থ করেছেন তা অনুবাদের প্রথম অংশ থেকেই উপলব্ধ করে সেখানে মানুষ আছে। এ বাক্যের সার্থকতা আমাদের বোধাতীত। কেতুঃ পদের ভাষ্যার্থ জ্ঞাপয়িতা, যিনি জ্ঞান দান করেন। আমাদের মন্ত্রার্থেও তাই ঐ পদে জ্ঞানদায়ক অর্থ গৃহীত হয়েছে। [এই সূক্তটির ঋষিকেতু আগ্নেয়]।

১৬/১– দ্যুলোকের মধ্যে মস্তকস্বরূপ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সত্ত্বগুণের পালক এই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব, জগতের স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূতবর্গকে প্রীত করেন। (ভাব এই যে, — এই দেব জ্ঞানরূপে সকলের প্রীতিদায়ক হন)। [এই মন্ত্রে জ্ঞানশক্তির গুণ পরিবর্ণিত আছে। সাধক শুদ্ধসত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হয়ে ঐভাবে জ্ঞানাগ্নির গুণকীর্তন করছেন। সেই জ্ঞান কেমন? না তিনি দিবো মূর্ধা। অর্থাৎ তিনি দ্যুলোকের মস্তকস্থানীয়। এতে স্পষ্টই প্রতীত হয়, তার স্বরূপ-বিজ্ঞান ব্যতীত হৃদয়ে কোনও দেবভাবই অনুভব করা যায় না]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-৩দ-৭সা) প্রাপ্তব্য]।

 ১৬/২– হে জ্ঞানদেব! স্বর্গাধিপতি আপনিই বরণীয় পরমধনের ঈশ্বর হন; হে দেব! আপনার আরাধনাপরায়ণ আমি যেন পরমকল্যাণে থাকি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে পরমদাতা দেব! আমাকে পরমকল্যাণে স্থাপন করুন)। [তিনি কেবলমাত্র স্বর্গের অধিপতি নন, অক্ষয়কল্যাণরূপ পরমধনভাণ্ডারও, তার করতলগত। তিনি বাস্য দাত্রস্য ঈশিষে-বরণীয় পরমধনের দাতা। তার কল্যাণেই মানুষ পরমধন লাভ করতে সমর্থ হয়। তাই তার কাছেই প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১৬/৩– হে জ্ঞানদেব! আপনার পবিত্র নির্মল দীপ্যমানন্ প্রভা আপনার জ্ঞানকিরণসমূহ আমাদের প্রদান করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন বিশুদ্ধ পরাজ্ঞান লাভ করি)। ৫ [মন্ত্রটির সাধারণ অর্থ সরল হলেও, আপাতঃদৃষ্টিতে একটু জটিল বলে মনে হয়। মন্ত্রে অগ্নি অথবা জ্ঞানদেব-এর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। কিসের জন্য প্রার্থনা? জ্ঞানকিরণ অথবা পরাজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য। কে সেই প্রার্থনা পূরণ করবে?– অগ্নিদেব। কিভাবে তা পূর্ণ হবে? জ্ঞানদেবের শক্তি আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করবে, তাতেই অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। এই বিশ্লেষণের শেষের অংশই জটিলতার কারণ। জ্ঞানদেবের জ্যোতিঃ আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করবে। কিন্তু একটু অনুধাবন করে দেখলেই বোঝা যাবে যে, প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রে কোন জটিলতা নেই। শক্তি ও শক্তিমান্ অভেদ। সুতরাং শক্তি যা প্রদান করবে, তা প্রকৃতপক্ষে শক্তিধরেরই দান। জ্ঞানশক্তির অধিপতি পরমদেবতা আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করবেন– এটাই প্রার্থনার সারমর্ম। প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারেও এই জটিলতা দূরীভূত হয়নি। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অগ্নি! তোমার নির্মল, শুভ্রবর্ণ উজ্জ্বল দীপ্তিসকল জ্যোতিঃ প্রকাশ করছে। এখানে ভাবও একই। দীপ্তিসকল জ্যোতিঃ প্রকাশ করছে। কিন্তু এস্থলেও যে সত্যিকার জটিলতা নেই তা-ও পূর্বে উক্ত উপায়ে বোঝা যায়]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– বিরূপ আঙ্গিরস। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম যথা– সত্ৰাসাহায়ম]।

— চতুর্দশ অধ্যায় সমাপ্ত —

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *