৩.১৩ সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধানে
সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, এ সব কথা আজ আমরা সবাই মানি। যেহেতু এই পরিবর্তনের ভালোমন্দ যা কিছু ফল মানুষকেই ভোগ করতে হবে, অতএব এ ব্যাপারটায় আমাদের একটা আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কীভাবে, কোন পথে পরিবর্তন ঘটলে তার পরিণাম শুভ হয়, কেনই বা বিপত্তি আসে, এই সব প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই মনে মাঝে মাঝে ছায়া ফেলে যায়। এই রকম বড় প্রশ্নের কোনো শেষ উত্তর হয়তো আশা করাই ভুল। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষ চিন্তা করবে এতেই তো তার মনুষ্যত্বের পরিচয়। আমরা অবশ্য এই বড় প্রশ্নের সীমাবদ্ধ দুয়েকটি দিক নিয়েই এখানে আলোচনা করব।
সামাজিক পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলবার আগে সমাজ সংগঠনের কাঠামো অথবা বিন্যাস নিয়ে খানিকটা চিন্তা করে নেওয়া দরকার। বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে যেসব গোষ্ঠী ও সংগঠন গড়ে উঠেছে তাদের দুটি মৌলরূপের কথা প্রথমেই বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। একটিকে বলব আত্মীয়গোষ্ঠী, অন্যটিকে ব্যবসায়িক সংগঠন। আত্মীয়গোষ্ঠীতে আমরা অল্পবেশি নিজেকে অন্যের ভিতর এবং অন্যকে নিজের ভিতর। স্থাপন করে দেখি; অন্যের সুখে সুখ, অন্যের দুঃখে দুঃখ অনুভব করি; অন্যের গর্বে নিজে গর্বিত, অন্যের অসম্মানে নিজে অসম্মানিত বোধ করি। ব্যবসায়িক সংগঠনে প্রত্যেকের পৃথক স্বার্থ, লাভক্ষতির পৃথক হিসেব সেখানে সাময়িক স্বার্থে, সীমাবদ্ধ প্রয়োজনে, বিভিন্ন মানুষ-পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, আবার সেই কারণেই কখনও সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
বলা বাহুল্য, এই দুটি মৌলরূপের পাশে পাশে কিছু মিশ্ররূপও দেখা যায়। যেমন ব্যবসায়িক বা বৃত্তিমূলক কারণে কিছু মানুষ একত্র হয়, তারপর বৈবাহিক ও অন্যান্য সূত্রে। আবদ্ধ হয়ে আত্মীয়গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
আদিম আত্মীয়গোষ্ঠীতে রক্তের সম্পর্কটা প্রধান। কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর গোষ্ঠী স্থাপিত হয় ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে। একটা সম্প্রসারিত আত্মীয়ভাব সেখানে স্পষ্ট, রক্তের সম্পর্কটা তেমন প্রত্যক্ষ নয়। তবু সুখে দুঃখে, উল্লাসে বিষাদে, উৎসবে অনুষ্ঠানে সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থের অধিক একটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করা যায়। সংস্কৃতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের সেই ঐক্যবদ্ধ রূপকে এই কারণেই আত্মীয়ধর্মী বলা চলে।
সামাজিক ইতিহাস ও বিবর্তনের সম্বন্ধে খুব মোটা তুলিতে আঁকা দুটি ছবি এখানে পাশাপাশি রাখা যেতে পারে। প্রথমটিতে মূল কথা এই যে, মানুষের ছোট ছোট বৃত্ত অথবা গোষ্ঠীকে নানাভাবে বৃহত্তর বৃত্তে যুক্ত করে উত্থান পতনের ভিতর দিয়ে সমাজ এগিয়ে চলেছে। কয়েকটি পরিবার মিলে একটি উপজাতি, বিভিন্ন উপজাতি একত্র হয়ে জাতি, জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব মিলনের বন্ধুর পথ ধরে এক মহাজাতির অভিমুখে যাত্রা। এই বৃহত্তর মানবসংহতি গঠনের ধারায় ভাষা ও ধর্ম তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা নির্বাহ করে চলেছে, সাম্রাজ্যের উত্থান পতন ঘটছে, জাতীয় দ্বন্দ্ব কলহের মীমাংসার জন্য কতরকম প্রণালী ও সংগঠন উদ্ভাবিত হচ্ছে। এইসব মিলিয়ে মানবজাতি ও সমাজের ক্রমবিবর্তনের একটি ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত। ভারতের ইতিহাসের যে দিকটা রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ কবিতায় স্মরণীয় হয়ে উঠেছে অথবা মানুষের ধর্ম বক্তৃতায় দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে, তার সঙ্গে এই ধারণার অনেকখানি মিল আছে।
অর্থাৎ, মানুষের গোষ্ঠীজীবনের মূলে যে-আত্মীয়ধর্মিতা, সংস্কৃতির অভিব্যক্তিতে যে-বহুত্ব ও বৈচিত্র্যে আবার সেই সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়াস ও ঐক্যমুখিতা, এই সব আশ্রয় করে মানুষের বৃহত্তর সমাজজীবন গঠনের পথে যে পরীক্ষা নিরীক্ষা, ইতিহাস বিষয়ে একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে এসবই প্রাধান্য পেয়েছে। অন্য ধারণাটিতে প্রধান করে তুলে ধরা হয়েছে সমাজের ভিতর ধনী দরিদ্রের বৈষম্যকে এবং আরো বিশেষভাবে শ্রেণীবিভাগ ও শ্রেণীদ্বন্দ্বের ঘটনাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একটা দৃঢ়বদ্ধ সূত্রাকারে লক্ষ করা যায় মার্ক্সবাদী চিন্তাধারায়। অপেক্ষাকৃত শিথিল আকারে এই ধরনের চিন্তা অথবা অনুভব বহু সংস্কারপন্থী এমনকি রক্ষণশীল ব্যক্তির বক্তব্যেও ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। উদাহরণত। উল্লেখ করা যেতে পারে উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনায়ক ডিজরেলির সেই বিখ্যাত উক্তি, ধনী ও দরিদ্র এই দুই জাতিতে বিভক্ত ব্রিটিশ সমাজ। বস্তুত উনিশ শতকের অনেক লেখক,সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজসংস্কারকের চিন্তাভাবনাতেই শ্রেণীস্বার্থের সংঘাতের কথা খুঁজে পাওয়া যায়। তবু ইতিহাসের ব্যাখ্যার ভিত্তি ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব নিঃসন্দেহে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে মার্ক্সীয় সমাজ দর্শনেই।
এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটিই সম্পূর্ণ ভুল নয়। কোনো একটিকে সমগ্র সত্য বলে মনে করাটাই ভুল। ইহুদীদের ভিতর ধনী দরিদ্রের বৈষম্য আছে। কিন্তু এই বৈষম্যকে। অতিক্রম করে ধর্মের ভিত্তিতে বিশ্বজোড়া ইহুদীর ভিতর একটা আত্মীয়ভাবও আছে। ব্রিটিশ সমাজ শ্রেণীতে বিভক্ত। আবার শ্রেণীবিভাগ সত্ত্বেও ইংরেজের ভিতর ভাষা ও জাতীয়তাবাদের আধারে একটা ঐক্যের বন্ধনও আছে। উনিশ শতকের শেষভাগে ও বিশ শতকের গোড়াতে ইংল্যান্ডে ও জার্মানিতে শ্রমিক আন্দোলন দ্রুত বৃদ্ধিলাভ করে। ঐ সময়ে আন্তজাতিক শ্রমিক ও সাম্যবাদী সংগঠনও দেখা দেয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে কোনো কোনো সাম্যবাদী নেতার মনে আশা ছিল যে, ইংরেজ ও জার্মান শ্রমিক ঐ যুদ্ধকে ধনিক শ্রেণীর চক্রান্ত বলে চিনে নেবে এবং শ্রেণীগত ঐক্যচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমভাবে নিজ নিজ দেশে শাসকশ্রেণীর বিরোধিতা করবে। সেই আশা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সংকটের মুহূর্তে ধনী ও দরিদ্র ইংরেজ একই পতাকার নীচে দাঁড়িয়েছে সমান ঐক্যবদ্ধ জার্মান জাতির বিরুদ্ধে।
যুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্যবোধে একটা উত্তেজনা এবং মাদকতা কে, যাকে সব সময় স্বাস্থ্যকর বলা চলে না। কিন্তু এটাই সব নয়। এই সব উত্তেজনার বাইরেও জাতি ও গোষ্ঠীর জীবনে একটা স্বাভাবিক আত্মীয়ভাব আছে, মানব প্রকৃতির সম্পূর্ণতার জন্য যেটা প্রয়োজন। জার্মানিতে ভ্রমণকালে রেলগাড়ির এক কামরায় বসে কোনো বাঙ্গালী যখন অন্য কামরা থেকে হঠাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধ্বনি শুনতে পায়, অথবা বিদেশে কোনো স্বদেশবাদীর সঙ্গে যদি সহসা সাক্ষাৎ ঘটে, তখন যে-যোগাযোগের আনন্দ উৎপন্ন হয় সেটা আত্মিক মিলনেরই আনন্দ। সেই অপ্রত্যাশিত যোগে আমাদের হৃদয়ের একটা প্রচ্ছন্ন অথচ স্থায়ী আকাঙ্ক্ষাই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। ব্যবসায়ী বুদ্ধি এবং আত্মীয়ভাবের বিচিত্র মিশ্রণে সমাজের ছোট বড় নানা কাজ চলে। এরই গুণে প্রতিদিনের নানা কলহ উত্তীর্ণ হয়ে যৌথ জীবনের সংহতি এবং ব্যক্তির জীবনে একটা ন্যূনতম সাম্য রক্ষা পায়।
অথচ মাত্রা রক্ষা যে পাবেই এমন কোনো নিশ্চিন্ত আশাবাদে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রাবল্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়ভাব যখন তার প্রাণশক্তি হারায় অথবা যখন গোষ্ঠীগত সংহতির ভিতর বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি হিংসার ভাবটাই প্রধান। হয়ে ওঠে, তখন সেটা ব্যক্তি ও সমাজ দুয়েরই পক্ষে অস্বাস্থ্যের লক্ষণ! দুরকম বিপত্তিই আধুনিক সমাজে বার বার দেখা দিয়েছে। এই দুই ব্যাধির প্রকোপ থেকে রক্ষা করে মানুষের যৌথ জীবন কী করে গড়ে তোলা যায় সেটাই আজ সমাজ সংগঠনের একটা মূল প্রশ্ন। এযুগের দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী আন্দোলন কোনোটিই এই ব্যাধির আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকেনি। নতুন সমাজ সংগঠনের উপায় নিয়ে অতএব পুনরায় চিন্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
মানুষের বুদ্ধি, চিন্তা অথবা পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাজকে পরিবর্তিত ও সংগঠিত করা যায় এমন কথা অতীতে বড় শোনা যেত না। ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য সাধনা ও সন্ন্যাসের পথ প্রচলিত ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সমাজের কোনো ব্যাপক ও পরিকল্পিত পরিবর্তন সম্ভব নয়, এই রকম ধারণাই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। আঠারো শতক থেকে একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্ত্য দেশে প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকে। এদেশেও উনিশ শতকে। নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত এই চিন্তাধারা ক্রমে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মানুষই সেই অদ্বিতীয় জীব যে নিজের সামাজিক জীবন ও ইতিহাস নিজে সচেতনভাবে রচনা করে এগিয়ে যেতে পারে, এই চিন্তায় অনেকটা নতুনত্ব আছে।
আঠারো ও উনিশ শতকে সমাজকে নতুনভাবে সংগঠিত করবার কথা যাঁরা বলেছিলেন তাঁরা অনেকেই ছিলেন যুক্তিবাদী। মানুষের যুক্তি অথবা বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত করা, চিন্তাকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা, এসব ছিল তাঁদের মতে উন্নত সমাজসংগঠনের জন্য প্রাথমিক কাজ। সমাজে যেমন একদিকে অসাম্য ও অন্যায় জমে ওঠে তেমনি অন্যদিকে মানুষের ধ্যানধারণায়ও একটা বিকৃতি ঘটে। সত্যের এই-যে বিকৃতি, সমাজের মনে যখন সেটা সাধারণভাবে ব্যাপ্তি লাভ করে, তখন সেই গৃহীত অসত্যকেই বলা যেতে পারে কুসংস্কার। অন্যায়ের সঙ্গে কুসংস্কারের একটা অঙ্গাঙ্গি যোগ আছে, একে অন্যের কাছে। আশ্রয় লাভ করে, একে অন্যকে পুষ্টকে করে। কাজেই সমাজের শোধনের জন্য সত্যেরও নির্ভীক অম্বেষণ প্রয়োজন। মানুষের মন থেকে কুসংস্কার টলাতে না পারলে অন্যায়কে দূর করা যাবে না।
এই রকম একটা প্রত্যয় থেকে উনিশ শতকের মধ্যভাগে মহারাষ্ট্রের মহান চিন্তানায়ক জ্যোতিবা গোবিন্দরাও ফুলে সত্যশোধক সমাজ গঠন করেন। এই সত্যশোধক আন্দোলন ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মআশ্রিত সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বদ্ধসংকল্প। যে-সংস্কার হিন্দু সাধারণকে শেখায় যে, গোমূত্র পানে পবিত্রতা লাভ হয় কিন্তু শূদ্রের হাত থেকে পানীয় জল গ্রহণ করলে উচ্চবর্ণের মানুষ অপবিত্র হয়, সেই সংস্কারকে মহাত্মা ফুলে সামাজিক অসাম্যের ধারক বলে জানতেন। এই আন্দোলনেরই পরবর্তী পর্যায়ের নেতা সুপণ্ডিত আম্বেডকর। তিনি দেখেছিলেন যে, শতাব্দীসঞ্চিত কুসংস্কারের প্রভাবে হিন্দু সমাজের বিবেক অসাড় হয়ে গেছে। নিম্নবর্ণের প্রতি সব রকমের অন্যায় ও অপমানই ঐতিহ্যের নামে গ্রহণীয় ও সহনীয় হয়ে উঠেছে। আম্বেডকর ভারতীয় রাজনীতির এক বিরাট পুরুষ। কিন্তু তিনি একথা জানতেন যে, শুধু রাজনীতির দ্বারা সমাজকে শুদ্ধ ও মুক্ত করা যায় না। সমাজের চিত্ত ও বিবেককে জাগাতে হলে একটা বৌদ্ধিক আন্দোলনেরও অত্যন্ত প্রয়োজন। জাগ্রত বিবেকই মানুষের মৌল অধিকারকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রক্ষা করতে পারে, আইন হতে পারে শুধু তার সহায়ক। আমাদের ধর্মে চিত্তশুদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সেখানে জোর পড়েছে চিত্তকে বাসনা কামনা থেকে মুক্ত করবার ওপর। এরও প্রয়োজন স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু এযুগে ফুলে অথবা আম্বেডকর যে আন্দোলনের নেতা ও পথিকৃৎ তাতে চিন্তার আলোক পড়েছে ভিন্নস্থানে। সামাজিক বিচারবুদ্ধি অথবা বিবেকের শোধনই এঁদের চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছে। আম্বেডকর সংবিধান বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু তিনি একথা জানতেন যে, সংবিধানের। জোরে অন্যায়কে দূর করা যাবে না। তাই তিনি বলেছিলেন, “rights are protected not by law but by the social and moral conscience of society. Social concience.. is the only safeguard of all rights fundamental or non-fundamental.” (১৯৪৩ সালের রানডের জন্মদিবসে পুণায় প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃত।)
চিন্তাকে স্বাধীন ও সামাজিক বিচারবুদ্ধিকে ন্যায়নিষ্ঠ করবার জন্য হিন্দুসমাজের অভ্যন্তর থেকে যেমন সত্যশোধক আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটে মুসলমান সমাজের ভিতর থেকেও তেমনি অনুরূপ কিছু আন্দোলন দেখা দেয়। উদাহরণত এই শতকের বিশের দশকে ঢাকার কয়েকজন চিন্তানায়কের উদ্যোগে বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন নামে পরিচিত ভাবধারার উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানেও উদ্দেশ্য ছিল মোল্লা মৌলবাদীদের আধিপত্য থেকে উদ্ধার করে মুসলমান মানসে নতুন চিন্তার উন্মোচন এবং সেই মুক্ত বিচারধারায় বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়ের অনুকূল ক্ষেত্র রচনা।
উনিশ শতকের দূরদর্শী নেতারা সমাজের অগ্রগতির জন্য সাংস্কৃতিক রূপান্তর ও নবজাগরণের ওপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন। বিশ শতকে দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তন দেখা যায়। রাজনীতিকেই যেন নতুন যুগের নেতারা সমাজ পরিবর্তনের প্রধান সহায় বলে মেনে নিয়েছেন। জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বিদেশী শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া স্বদেশী নেতাদের কাছে সেদিন সবচেয়ে জরুরী কাজ বলে মনে হয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি যতদিন বিদেশীর হাতে আছে ততদিন দেশের কোনো স্থায়ী উন্নতি সম্ভব নয়। আর রাষ্ট্রশক্তি দখলের জন্য যে কর্মপন্থা ও আন্দোলন তারই নাম তো রাজনীতি। কাজেই স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে, অন্তত বিশ শতকে, এদেশে এবং অন্যান্য পরাধীন দেশে রাজনীতিকেই অনেকে বেছে নিয়েছেন জাতীয় উন্নতির প্রধান উপায় হিসেবে।
বলা বাহুল্য, এই চিন্তাধারা সকলে গ্রহণ করেনি। আম্বেডকরের কথা এইমাত্র বলা হয়েছে। পুণায় প্রদত্ত যে-বক্তৃতা থেকে ওপরে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে সেই ভাষণে তিনি। রাজনীতিসর্বস্বতার খোলা সমালোচনা করেছেন। ইংরেজের হাত থেকে হিন্দু উচ্চবর্ণের কিছু নেতার হাতে ক্ষমতা এলেই দেশের কোনো মৌল উন্নতি ঘটবে একথা আম্বেডকরের মনে হয়নি। তাই সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন তাঁর কাছে প্রকৃত স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বলে মনে হয়েছে। এদিক থেকে বামপন্থী সাম্যবাদী নেতাদের সঙ্গে আম্বেডকরের মতামতের মিল ও অমিল দুই-ই লক্ষ করবার যোগ্য।
সাম্যবাদী নেতারাও বিশ্বাস করেন যে, এদেশীয় মধ্যবিত্তের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটলেই তাতে সমাজের কোনো বড় পরিবর্তন সাধিত হবে না। অন্তত মার্ক্সসীয় দৃষ্টিতে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে ক্ষমতার হস্তান্তরই সমাজে অধিকাংশ মানুষের মুক্তির পূর্বশর্ত। কিন্তু আজকের দিনে মার্ক্সসবাদীও কার্যত রাজনীতিকে প্রাথমিকতা দিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাটাই প্রধান কথা। শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিস্থানীয় সাম্যবাদী দলকে প্রথমেই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে এই ক্ষমতা দখলের কাজে { রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে এলে তবেই সাংস্কৃতিক অথবা বৌদ্ধিক রূপান্তরের কাজ সফল হতে পারে।
যিনি প্রকৃতই মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অথবা শাস্ত্রের সমালোচনা অথবা জাতিভেদের বিরোধিতায় এদেশে সাম্যবাদী দল আপাতত তেমন সক্রিয় ও উৎসাহী নয়। অপসংস্কৃতিবিরোধী আন্দোলনেও আজ বামপন্থীদের সঙ্গে ঐতিহ্যপন্থীদের মতের অনেকটা মিল চোখে পড়ে। লোকসংস্কৃতির যে-দিকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন তার কঠোর সমালোচনা উনিশ শতকী প্রগতিপন্থীদের চোখে যেমন গুরুত্ব পেয়েছিল আজ আর তেমন নয়। জনগণের সংস্কার অথবা কুসংস্কারের আমূল বিরোধিতা করতে গেলে জনসাধারণের সমর্থন হারাবার ভয় আছে। রাজনীতির কৌশলের দিক থেকে এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে জনগণকে যথাসম্ভব সঙ্গে রাখাই বেশী জরুরী। এই রকম একটা চিন্তাধারা যেমন জাতীয়তাবাদী তেমনি সাম্যবাদী রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছে। রাজনীতির প্রাথমিকতা এযুগে বামপন্থী আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ বিপ্লবী অথবা প্রগতিবাদী কিনা সেই বিচারে আমরা আজ তাঁর সামাজিক আচরণ অথবা সাংস্কৃতিক বিচারবুদ্ধির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া তেমন প্রয়োজন মনে করি না, বরং তাঁর রাজনীতির উগ্রতাকেই প্রধান মানদণ্ড বলে মানি। ভবিষ্যতের সমাজ সংগঠনের পথ হিসেবে এই রাজনীতিসর্বতা কতটা উপযুক্ত অথবা হিতকর সেটাই আমাদের সামনে আজ প্রশ্নের আকারে আবারও দেখা দিয়েছে।
রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করবার দুটি উপায়ের কথা বলা যায়। একটি সশস্ত্র বিপ্লবের পথ, অন্যটি দলীয়রাজনীতির সংবিধানসম্মত পথ! গান্ধীজি অবশ্য একটি তৃতীয় পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করা তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর কথা পরে আলোচনা করা যাবে। যে সব দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ খোলা নেই সেখানে সশস্ত্র বিপ্লবের আবেদন সহজে স্বীকার্য। রুশবিপ্লবের পটভূমিতে আছে জারের স্বৈরতন্ত্র। ঐ বিপ্লবের ফলে ইয়োরোপ আজ দুভাগে বিভক্ত। এই দুই ব্যবস্থার তুলনামূলক বিচার আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ক্ষমতা দখলের রাজনীতি এবং তার কিছু ফলাফলই এখানে আলোচ্য। বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে যে-দল গড়ে উঠেছে তার কিছু নিজস্ব গুণাগুণ দেখা গেছে। এই সব দলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয়তা এবং আত্মসমালোচনার। রীতি আছে। কিন্তু নেতৃত্বের প্রতি কুণ্ঠাহীন আনুগত্য, কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধতা এবং গোপনীয়তা রক্ষা স্বাভাবিক কারণেই বিপ্লবীদলের পক্ষে অনিবার্য; যেহেতু বিপ্লবীদল প্রতিপক্ষকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধসংকল্প, অতএব প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি অথবা বিবেচনা আশা করতেও সে অভ্যস্ত নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পক্ষ ও দ্বিপক্ষ উভয় দলই কিছুটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা রক্ষা করবে, এই রকম আশা করা হয়। বিপ্লবের রাজনীতিতে সেই প্রত্যাশার ভিত্তি নেই। বরং প্রতিপক্ষকে প্রতি পদে সন্দেহ এবং সর্তকতার সঙ্গে দেখাই সহিংস বিপ্লবীর পক্ষে স্বাভাবিক। কখনও আবার বিপ্লবী আন্দোলনেরই একভাগ অন্যভাগের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। দলের একাংশ যখন বিপ্লবে আস্থা রক্ষা করে শ্রেণীশত্রুর উচ্ছেদের জন্য অনুপ্রাণিত, অন্য অংশ হয়তো তখনই আপসের রাজনীতিকে ক্ষমতালাভের আশায় কৌশল হিসেবে বেছে নেয়। এই দুই গোষ্ঠীর অতি নির্মম ভ্রাতৃকলহ তখন রাজনীতিকে বিষাক্ত করে তোলে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, এই সব অবস্থার ভিতর দিয়ে যে বিপ্লবী দলটি গড়ে ওঠে ক্ষমতা হস্তগত হবার পর সেই দলই মহান আদর্শের নামে অত্যাচারের একটি নতুন নির্দয় যন্ত্রবিশেষ পরিণতি লাভ করে।
কিন্তু আজকের সমস্যা শুধু বৈপ্লবিক হিংসায় বিশ্বাসী দলকে নিয়েই নয়। সংবিধানশাসিত সমাজের অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিবেশেও দলীয় রাজনীতির যে অবনতি ঘটে সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার সাক্ষ্য সুস্পষ্ট। ক্ষমতার লড়াই যখন রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে তখন সুনীতির সঙ্গে রাজনীতির একটা বিরোধী সম্পর্ক দেখা দেয়। যে-কোনো উপায়ে, নীতির বালাই না রেখে, ক্ষমতা দখল করবার জন্য দু’পক্ষই সচেষ্ট। হয়ে ওঠে। এদেশে গত কয়েক বছরে ব্যাপারটা নাটকীয় আকার ধারণ করেছে নীতিহীন দলত্যাগের ভিতর দিয়ে। কিন্তু দল থেকে দলে সুযোগসন্ধানী আবর্তন প্রত্যাবর্তন শুধু বাইরের দৃশ্য। তারও পিছনে টাকার খেলা, গুপ্ত হত্যা, চরিত্রহননের মিথ্যা চক্রান্ত, অজস্র কাপট্য এবং সমাজ জীবনে দাঙ্গা-ও-কলহ-সৃষ্টিকারী উস্কানি ও প্ররোচনা নিয়ত চলতে থাকে। মূল্যবোধের ধ্বংসস্তৃপের ওপর দলীয় রাজনীতির প্রাসাদ গড়ে ওঠে। দলীয় রাজনীতির একটা অপেক্ষাকৃত সদর্থক দিকও নিশ্চয়ই ছিল, এখনও আছে। সেটা উপেক্ষণীয় নয়। তবু সমস্যার জটিল দিকটাই এখানে তুলে ধরা প্রয়োজনীয়। সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। রাজনীতির পরিপূরক স্বতন্ত্র ও বহুমুখী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন যখন সবল থাকে তখন পরিস্থিতির চেহারা একরকম। রাজনীতি যখন সব কিছু গ্রাস করতে উদ্যত হয় তখন পরিস্থিতি অন্যরকম। এই নতুন পরিস্থিতিতে সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষেরা সঙ্গত কারণেই চিন্তিত হয়ে ওঠেন।
মূল প্রশ্নে আবারও ফিরে আসা প্রয়োজন। কিছু মূল্যবোধের আশ্রয়েই সুস্থ সমাজ রক্ষা পেতে পারে। সেই মূল্যবোধকে কে রক্ষা করবে? রাজনীতি কি তার রক্ষক হতে পারে? আজকের রাজনীতি দেখে তো তা মনে হয় না। রাজনীতির কদর্যতায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা উৎকণ্ঠিত। তারই আক্রমণে মূল্যবোধ আজ বিপন্ন। উত্তরে বলা হবে যে, দোষটা রাজনীতির একার নয়, দোষটা সামগ্রিক সামাজিক পরিস্থিতির। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়। এই পরিস্থিতি থেকে রাজনীতি একা কি সমাজকে রক্ষা করতে। পারে? গান্ধী রাজনীতির সঙ্গে সুনীতি অথবা ন্যায়বোধের যোগসাধন করতে চেয়েছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় শেষ বয়সে রাজনীতির নৈতিক শোধনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এই শোধন তখনই সম্ভব যখন রাজনীতিকে চারদিক থেকে ঘিরে থাকে। একটা বৃহত্তর নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মানুষের অনুভবকে এবং সেই সঙ্গে জনমতকে যে-আন্দোলন সক্রিয়ভাবে গঠন করে। সেই শক্তি থাকে সাহিত্যিকের, শ্রেষ্ঠ। শিক্ষকের, প্রকৃত চিন্তানায়কের, সকল মহৎ সাধকের। এঁরা রাজনীতির ভৃত্য হবেন না। সারা দেশের বিবেক এবং চিত্তকে ঐরা প্রভাবিত করবেন। সেই জাগ্রত বিবেকের প্রভাব পড়বে রাজনীতির ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ, একটা সদর্থক সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনীতির শোধনের পূর্বশর্ত, যদিও বলা প্রয়োজন যে, রাজনীতির শোধনই তার লক্ষ্য নয়। মনুষ্যত্বের গঠন তার মূল লক্ষ্য।
মূল্যবোধের দুটি আধার এক, ব্যক্তি; দ্বিতীয়, প্রতিষ্ঠান। গান্ধী অথবা রবীন্দ্রনাথের জীবনই ছিল এক একটি শিল্পকর্ম, যার ভিতর দিয়ে কিছু মূল্যবোধকে আমরা চিনে নিতে পারি। কিন্তু এই সব মূল্যকে এঁরা শুধু এঁদের ব্যক্তিগত জীবনে ও বাণীতে নয়, কিছু প্রতিষ্ঠানের ও গঠনমূলক কাজের ভিতর দিয়েও সাকার করতে চেয়েছিলেন। গান্ধীর গঠনমূলক কাজের কথা সবাই জানেন। রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতিতে তাঁর গঠনমূলক প্রচেষ্টা কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে। অথচ তিনি নিজে বলেছিলেন “শিক্ষাসংস্কার এবং পল্লীসঞ্জীবনই আমার জীবনের প্রধান কাজ।” (অমিয় চক্রবর্তীকে লিখিত চিঠি, ১৫ নভেম্বর ১৯৩৪।) অন্তত একথা স্বীকার্য যে, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সাধনাকে বুঝবার চেষ্টা মর্মান্তিক ভ্রম। যে-সব মূল্যে এঁরা বিশ্বাসী। ছিলেন, গঠনমূলক কাজের ভিতর দিয়ে তাদের রূপায়িত করতে চেয়েছেন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ। সেই প্রচেষ্টা আজ মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করা প্রয়োজন। গান্ধীর সাংগঠনিক কাজের ক্ষেত্র ছিল আরো বৃহৎ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেও কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। শিক্ষা, সমবায় এবং পল্লী সংগঠনের ক্ষেত্রে কর্মের সঙ্গে যুক্ত করে নিজস্ব চিন্তা তিনি আশ্চর্য যত্নের সঙ্গে আগ্রহী দেশবাসীর জন্য লিখে রেখে গেছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে যে গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করা আবশাক, তাঁর এই বিশ্বাসকে রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের ভিতর দিয়ে প্রচার করে গেছেন।
গঠনমূলক কাজের ক্ষেত্রে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ভিতর অনেকটা মিল ছিল। পল্লীকে সমাজ সংগঠনের ভিত্তি বলে মেনে নিয়েছিলেন দুজনেই। এর মূল কারণ শুধু এই নয় যে, ভারতের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। এর অতিরিক্ত একটা আদর্শগত কারণ দুজনের চিন্তাতেই খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের মনের একটা দিক আছে যেটা আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে আশ্রয় করেই বাঁচতে চায়। পল্লী হল এই আত্মীয়ধর্মী গোষ্ঠীজীবনের প্রতীক। বাস্তব পল্লীতে ভালো মন্দ অনেক কিছুই আছে; কিন্তু গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শচিন্তায় পল্লীর এই প্রতীকী তাৎপর্যটি বুঝে নিতে হবে। স্বদেশী সমাজ’ (১৯০৪) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়সম্বন্ধ স্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল।” তিনি জানতেন যে, মনের কোনো। এক স্তরে মানুষকে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, তা যদি হতে না পারে তবে সে অচরিতার্থ। কিন্তু একই সঙ্গে সেই বিশ্বকে আবার মানুষ পেতে চায় ধরাছোঁয়ার পরিধির ভিতর ছোটো এক পল্লীতে। শান্তিনিকেতনে এই আদর্শটি রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই বিশ্বভারতীর মূলভাবটি প্রকাশ পেয়েছে সেই বিখ্যাত বাক্যে, ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম। বিশ্বকে চাই, কিন্তু তাকে একটি নীড়ের ভিতরও চাই। পল্লী সেই নীড়।
মানুষের অন্তর্গত আত্মীয়চেতনা যে ছোট বৃত্তের ভিতর প্রত্যক্ষ আকার ধারণ করে। তারই নাম পল্লী। এইখানে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার আরম্ভ। এখানেই সমবায়ের ভিত্তি। এই সহযোগিতায় তিনটি স্তর একই সঙ্গে বর্তমান। এর কেন্দ্রে আছে ব্যক্তিমানুষ। জীবনধারণের ব্যবহারিক প্রয়োজনে ব্যক্তিমানুষ অপরের সঙ্গে সহযোগিতায় আবদ্ধ হয়, অর্থাৎ দেহের পোষণ এই সহযোগিতার প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি নিজে যেমন কিছু লাভ করে তেমনি প্রতিবেশী সহযোগীকে কিছু দান করে। এরই ভিতর দিয়ে ঘটে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ। যাদের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ সহযোগ তাদের ভিতর দিয়ে উপরন্তু বিশ্বের উদ্দেশ্যেও আমরা কিছু তর্পণ করি। সহযোগের। প্রতিটি বৃত্তই কোনো বৃহত্তর বৃত্তের সঙ্গে যোগাযোগের সেতুবিশেষ। সমাজ গঠনের এটাই স্বাভাবিক নীতি। অসংখ্য পল্লী নিয়ে ক্রমসম্প্রসারিত বৃত্তে গঠিত এক যুক্তরাজ্য মানুষের এই বৃহৎ সমাজ। অন্তত সমাজের একটি আদর্শ রূপের সন্ধান পাই এখানে। অর্থনীতি হোক, রাজনীতি হোক, সংস্কৃতি হোক, আদর্শ সমাজ সংগঠনের এই মৌল নীতি।
তাঁর কাম্য মানবসমাজের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘oceanic circle’ শব্দটি গান্ধী ব্যবহার করেছেন। মহামানবের সাগরতীর কথাটি রবীন্দ্রনাথের। পল্লীর নীড় থেকে মহামানবের সাগরতীর পর্যন্ত সমাজগঠনের একটি ছবি মনে মনে রচনা করে নেওয়া যায়। গান্ধীর ভাষায় চিত্রটি এই রকম। গান্ধী লিখেছেন “In this structure composed of innumerable villages, there will be ever-widening, never ascending circles. It will be an oceanic circle whose centre will be the individual.” এখানে ‘never ascending’ কথাটির ব্যবহার লক্ষণীয়। বৃহত্তর সংগঠন। পল্লীর কাঁধে চেপে বসবে না। আবারও গান্ধীর ভাষায় ফিরে আসা যাক। গান্ধী। 161634 “The outermost circumference will not wield power to crush the inner circle, but will give strength 10 all within and derive its own strength from it.” মানুষের এই যুক্তরাজ্যে প্রতিটি পল্লী এবং আত্মীয়গোষ্ঠী যেমন বৃহত্তর রাজ্যকে শক্তি দান করবে তেমনি তা থেকে শক্তি আহরণ করবে।
এর সঙ্গে সংগতি রেখে গান্ধী তাঁর প্রতিরোধ আন্দোলনের চরিত্র ও সংগঠন উদ্ভাবন করতে চেষ্টা করেছেন। মানুষের সমাজকে যখন আমরা মূলত শ্রেণীবিভক্ত রূপে দেখি তখন বলা যায় যে শত্রুশ্রেণীর ধ্বংসই আমাদের কাম্য। কিন্তু সমাজকে যখন আমরা অসংখ্য আত্মীয়গোষ্ঠীর যুক্তরাজ্য বলে অনুভব করি তখন বৈরী গোষ্ঠীর উৎখাতের চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া শুভবুদ্ধির পরিচয় বলে মেনে নেওয়া যায় না। অথচ সমাজে অন্যায় আছে, অবিচার আছে, তার প্রতিরোধের প্রয়োজনও আছে। গান্ধী প্রতিরোধের সেই পদ্ধতিই খুঁজেছেন যাতে মানুষের মৌল আত্মীয়বোধকে অক্ষুণ্ণ রেখেই অন্যায়ের অটল বিরোধিতা করা যায় এবং সাম্যের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতিরও পরিবর্তন অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু যে মূল সমস্যাটির সমাধান গান্ধী খুঁজেছেন সেটি ক্ষুদ্র স্থানে কালে আবদ্ধ নয়। নতুন সমাজ সংগঠনের পথে এটি এমন একটি মৌল প্রশ্ন যার উত্তর ভবিষ্যতের মানুষকেও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে ক্রমাগত অন্বেষণ করতে হবে।
ব্যবহারিক প্রয়োজনে চিহ্নিত ন্যায় অন্যায় বিচারকে অতিক্রম করেও মানুষের ভিতর একটা সংবেদনশীল ঐক্যবোধ আছে। দূরের দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের প্রাণনাশ হলে আমরা স্বাভাবিক বেদনা অনুভব করি, মৃতদের ভিতর কে সাধু কে চোর এই চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত হই না। পরিবারে কারো আচরণে আমরা ক্ষুণ্ণ অথবা বিরক্ত হলেও সেই। বিরক্তিকে অতিক্রম করে একটা আত্মীয়তাবোধ এবং সদ্ভাব অব্যাহত থাকে; তাতেই আমরা মনের স্বাস্থ্যেরও পরিচয় পাই। সাংসারিক কারণে দূরে সরে গেলেও মন থেকে সেই সম্ভাবকে অমরা সহসা বিতাড়িত করতে চাই না। বস্তুত এই সদ্ভাব অথবা শুভবুদ্ধিই নৈতিক মূল্যবোধের আশ্রয়। গান্ধী এমন একটি সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন যেখানে সমাজের মূল প্রতিষ্ঠানগুলি এই শুভবুদ্ধিকে আশ্রয় দেবে, শক্তিশালী করবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনকেও তিনি এমন পদ্ধতির ওপর স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। যাতে পদে পদে যুদ্ধের প্রয়েসজনে মানবিক শুভবুদ্ধি ও মূল্যবোধকে স্থগিত রেখে চলতে হয় না। আমাদের যুগের ইতিহাস অন্তত আপাতদৃষ্টিতে এই সব ধারণার বিরুদ্ধধারায় প্রবাহিত হয়েছে। সমাজে ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা এমনভাবে সংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত হয়েছে যাতে মানুষের স্বাভাবিক সংবেদনশীলতার অবক্ষয় ও বিকৃতি ঘটে। প্রতিরোধ আন্দোলনও এমন রূপ গ্রহণ করেছে যাতে সংঘবদ্ধ হিংসার শক্তি কপট নৈতিকতার সমর্থনে ভয়াবহ হয়ে ওঠে। যুগের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে গান্ধীকে তাঁর কর্মের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। সভ্যতার সমকালীন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতেই গান্ধীচিন্তার বিচার প্রয়োজন।
সমাজ সংগঠনের জথে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সার্থকতা নিয়ে এই আলোচনা শুরু হয়েছিল। সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেখানে গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত সেখানে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় দুয়ের ভিতরই একটা বেগ সঞ্চারিত হয়। যখন এরা বিচ্ছিন্ন ভাবে চলে তখন দুয়ের ভিতরই একটা দুর্বলতা এবং পরিণামে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। তেমনি আবার রাজনীতি যখন গঠনমূলক কাজ এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন তার বিকার রোধ করা যায় না। গত দুই শতকের অভিজ্ঞতা থেকে একটা সমন্বয়ের পথের সন্ধান বোধ করি পাওয়া যায়। এদেশে উনিশ শতকে সংস্কৃতির রূপান্তরের চিন্তা এক রকমের প্রাধান্য পেয়েছিল। শুধু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আশ্রয়ে কি সমাজের সুষ্ঠু পুনর্গঠন সম্ভব, প্রশ্নটা যখন এইভাবে আসে তখন তার আশাব্যঞ্জক উত্তর পাওয়া কঠিন হয়। গঠনমূলক কাজে অনেকে আত্মনিয়োগ করেছেন। শুধু গঠনমূলক কাজের ভিতর দিয়ে কি সমাজের কোনো স্থায়ী এবং বড় পরিবর্তন আনা যাবে, এ প্রশ্নের কোনো উৎসাহব্যঞ্জক উত্তর আশা করা যায় না। শুধু রাজনীতির ওপর নির্ভর করে যে-পথ, তার পরিণতি ঘটেছে ‘রাজনীতি প্রমত্ততায়। আসলে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও গঠনমূলক কাজের একটা সংযোগ প্রয়োজন। তার মানে এই নয় যে, সংস্কৃতি রাজনীতির প্রতিধ্বনি হবে, অথবা এ দুয়ের কোনোটি গঠনমূলক কাজের মধ্যেই প্রধানত সীমাবদ্ধ হবে। এদের প্রত্যেকেরই একটা আত্মস্বতন্ত্র চসই, এমনকি এদের ভিতর কিছু বিরোধ থাকাটাও আশ্চর্য নয়। তারই ভিতর দিয়ে প্রস্তুত হবে সমম্বয়ের প্রশস্ত পথ। বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রত্যেকটিই যেখানে দুর্বল এবং অসম্পূর্ণ, সংযোগের ভিতর দিয়ে সেখানে তারা সদর্থে বলশালী এবং ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাব্যঞ্জক।
জয়প্রকাশ নারায়ণ রাজনীতি ও সবোদয়ের কর্মপন্থা অতিক্রম করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘total revolution অথবা সম্পূর্ণ ক্রান্তির কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে বহু বাদবিসংবাদ হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। ক্রান্তি অথবা বিপ্লব শব্দটার ভিতর বিরাট ভানের পথে হঠাৎ অন্ধকার পেরিয়ে সূযোদয়ে পৌঁছবার একটা প্রতিশ্রুতি আছে, যেটা কারো কাছে যেমন আকর্ষক আবার কারো কাছে তেমনি প্রবঞ্চক মনে হতে পারে। কিন্তু জয়প্রকাশের প্রধান কথাটা ছিল ভিন্ন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, শুধু রাজনীতির দ্বারা বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে না, সমাজের সার্থক রূপান্তর সম্ভব হবে না; শুধু অর্থনৈতিক অথবা গঠনমূলক কাজের সাহায্যেও সেটা সম্ভব নয়; আবার শুধু সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক আন্দোলনের পথেও নয়। এ সবই বিচ্ছিন্নভাবে অপূর্ণ; এদের যুক্ত করতে পারলে তবেই সম্পূর্ণতা। তাঁর বিচিত্র ও ঘটনাবহুল জীবন ও অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জয়প্রকাশ এই যে-সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছিলেন সেটা শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনার যোগ্য। মার্ক্সবাদ অতিক্রম করে তিনি এসেছিলেন গান্ধীবাদে। গান্ধীবাদীদের ভিতরও তিনি গতানুগতিক ছিলেন না, বরং তাঁকে ব্যতিক্রমী বললেই উপযুক্ত হবে। বস্তুত তিনি এই বিশ্বাসেই উপনীত হয়েছিলেন যে, বিশেষ কোনো দল অথবা মতবাদের কাছেই বিবেকবান মানুষের শেষ আনুগত্য অর্পিত নয়। তাঁর আনুগত্য সেই মূল্যবোধের কাছে, বিশেষ দল অথবা সম্প্রদায় অথবা আনুষ্ঠানিক মতবাদের উর্ধ্বে যার স্থান। আধুনিক মন এই রকম একটা কথা ধর্মের ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছে। একথা যদি ধর্মপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সত্য হয় তবে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির ক্ষেত্রেও সত্য না হবার কারণ নেই।
সমাজ সংগঠনের একটি মূল নীতি আগে আলোচিত হয়েছে। বৃহত্তর সমাজের ভিত্তিতে থাকবে আত্মীয়সমাজ, প্রতিবেশীসমাজ, বান্ধবসমিতি। এই প্রতিবেশীসমাজের উদ্দেশ্য একদিকে যেমন পারস্পরিক সহযোগিতার ভিতর দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় বস্তুর উৎপাদন, অন্যদিকে তেমনি মনের সঙ্গে মনের যোগের সাহায্যে আনন্দের ক্ষেত্র। রচনা। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সমবায়ের সাহায্যে এই সব মৌল সমিতিকে শক্তিশালী করা গঠনমূলক কাজের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের ঐতিহ্যের ভিতর এই সব কাজের যেমন। সহায়ক শক্তি আছে, তেমনি প্রতিবন্ধক শক্তিও আছে। এ দেশের পল্লী জাতিতে জাতিতে বিভক্ত। জাতিপাঁতিকে অতিক্রম করে আমাদের কল্যাণমূলক চিন্তা ও প্রচেষ্টা বেশী দূর অগ্রসর হয় না। একে ভাঙবার জন্য প্রয়োজন নতুন সংস্কৃতি, সামাজিক সমালোচনার দিগদর্শী আন্দোলন। এটা অবশ্য উদাহরণমাত্র। গঠনমূলক কাজ আর সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ভিতর যোগের কথাটাই আসল। এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে প্রধানত শহরে। আজ দেশময় গ্রামে গ্রামে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের নির্দয় সংঘর্ষ। এই খর্বতাকে অতিক্রম করে পল্লীতে এক অখণ্ড প্রতিবেশীসমাজ সৃষ্টি করা আবশ্যক; কিন্তু সেটা সম্ভব নয় গঠনমূলক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নবদিগন্ত উন্মোচনকারী প্রচেষ্টা ছাড়া। এরই সঙ্গে রাজনীতিও এসে যায়। সমাজে ক্ষমতার একটা বিভাগ ও বিন্যাস আছে। সমাজ সংগঠনের পরিবর্তন ঘটাতে গেলে ক্ষমতার এই বিন্যাসেরও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আজ যারা ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত, কাল তারাই যখন সমাজের পরিচালনায় অংশ নিতে চায় তখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পক্ষ থেকে বাধা আসে। সত্যাগ্রহ ছাড়া সবোদয় সম্পূর্ণ হয় না। এমনি করে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও গঠনমূলক কাজ পরস্পর যুক্ত হয়ে পড়ে। এখানেই একটা সমগ্রতা ও সামঞ্জস্য প্রয়োজন, যার অভাবে আমাদের প্রতিটি খণ্ড প্রচেষ্টা দুর্বল ও অবসন্ন হতে বাধ্য।
আমরা সবাই সব কাজে থাকব এমন নয়। কিন্তু সমাজের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সব এসে যুক্ত হয়। আমরা যে যেখানে আছি সেখানেই নিজ নিজ সীমাবদ্ধ ভূমিকা রচনা করে নিতে পারি। তবু মননের ধর্ম এই যে, সমগ্রের সঙ্গে যুক্ত করে খণ্ড খণ্ড প্রয়াসেরও সে অর্থ খুঁজে নেয়, অসম্পূর্ণতা আবিষ্কার করে, সংশোধক নবচিন্তার জন্ম দেয়। শুধু রাজনীতি দিয়ে দেশকে হঠাৎ উদ্ধার করা যাবে, এটা একরকম জাদুতে বিশ্বাস, এতে মননের শক্তি নেই। সাংস্কৃতিক ও গঠনমূলক কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো বৈজ্ঞানিক অথবা নৈতিক রাজনীতি সম্ভব নয়। সমাজ সংগঠনের কার্যক্রম পদে পদে বদলে চলে; কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা আগে থেকে রচনা করা যায় না। ____ একটা দিশাবোধ ও সামঞ্জস্যচেতনা সব সময়েই প্রয়োজন।
নির্মলকুমার বসু স্মারক বক্তৃতা, ১৯৮২
কমলা বক্তৃতা ও অন্যান্য ভাষণ (১৯৮৪)