মধুমতী – কৃষণ চন্দর
১
প্রথম থেকেই আমার মনটা ছিল রোমান্টিক এবং সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল। উড়ন্ত পাখি, উন্মুক্ত নীল আকাশ, রামধনুর প্রস্ফুটিত রং আমি পছন্দ করতাম। আর পছন্দ করতাম যে-মেয়ে হাসলে গালে টোল পড়ে এবং যে নদী পাথরের সাথে হুমড়ি খেয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু আমার পিতৃদেব আমার সব আকাঙ্ক্ষায় বাধা দান করলেন। (তাঁর নাম গোবিন্দ রাম) তিনি বললেন, ‘বাবা শ্রীরাম, এ পৃথিবীটা রং-তামাশার ওপর নির্ভর করে চলে না। এটা হচ্ছে বিজ্ঞানের যুগ, এ পৃথিবীটা এখন বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে চলে। তাই তোমাকে কবি নয়, বরং ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে।’
অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি বরাবরই আমার বিমুখতা ছিল। প্রায়শ আমি ভাবতাম– হা খোদা, এই দুই আর দুইয়ে চার কেন হয়! পাঁচ কেন হয় না? তিন অথবা আড়াই হয় না কেন? এক হয়ে যায় না কেন? যেরকম কখনো কখনো মানুষ জীবনে এক হয়ে যায়। কিন্তু অঙ্কশাস্ত্রে তা হয় না। কখনো হয় না। আপনি হাজার বার চেষ্টা করে দেখুন, হবে না। কিন্তু যেহেতু আমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে সুতরাং আমি অঙ্ক শিখতে আমার জীবনের সর্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করলাম। ডিপ্লোমা উপাধি নেয়ার সময় আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টও হলাম। এ খবরে সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছিল সারদা– যার সাথে শৈশবে বাগদান হয়েছিল, এবং যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমরা একসাথে খেলতাম, একসাথে পড়তাম এবং সাথে সাথে আমরা এ সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়েছিলাম যে, আমরা ঘর গড়ব– যেখানে শুধু আমরাই থাকব। সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কত হবে এবং তাদের কী কী খাওয়ানো যাবে এবং কী করে গড়ে তোলা যাবে তারও একটা হিসাব ঠিক করে রেখেছিলাম।
কিন্তু যখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডিপ্লোমা পেলাম তখন একদিন আমার বাবার ডাক পড়ল লালা বিহারীলালের চেম্বারে। তাঁর ফার্মেই বাবা একাউন্টেন্টের পদে বহাল ছিলেন। এঁদের উভয়ের মধ্যেই যেসব কথাবার্তা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমার বিয়ে সারদার সাথে নয় বরং মধুমতীর সাথেই হবে– যে লালা বিহারীলালের একমাত্র মেয়ে এবং সে বড় সুন্দরীও। এখন আমাকে মধুমতীর হৃদয় জয় করতে নৈনিতালে যেতে হবে। যদি মধুমতীর হৃদয় জয় করতে পারি বা নিদেনপক্ষে মধুমতী আমার বিরোধিতা না করে তাহলে লালা বিহারীলাল আমাকে তাঁর জামাতা বানিয়ে নেবেন।
‘কিন্তু সে হিসাব কষা আমাদের পক্ষে ঠিক হবে না।’ আমি আপত্তি করলাম। আমি আপত্তি করতাম না, কিন্তু সে সময় আমার মানসপটে সারদার লাজনম্র মুখমণ্ডল বারবার উদিত হচ্ছিল। যেন অশ্রুতে তার চোখের কোণ সিক্ত হয়ে গেছে। আমি যে কী বলব– তখন আমরা আমাদের ঘরের পর্দার রং পর্যন্ত প্রায় পছন্দ করে রেখেছিলাম।
তাই আমি জোর দিয়ে বললাম ‘দেখুন বাবা, লালা বিহারীলাল কোটিপতি। তাঁর শান-শওকত এবং তাঁর পদমর্যাদার সাথে খাপ খাইয়ে তিনি আর একজন কোটিপতি বর ঠিক পেয়েই যাবেন। এতে কোনো কষ্ট হবে না তাঁর।’
‘তিনি এরকম জামাতা চান না যার পিতা কোটিপতি।’ বাবা বলতে থাকলেন- ‘অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে কোটিপতি ছেলে শ্বশুরের টাকা বাবার ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলে। এতে ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যায়। সম্পর্ক, সদ্ভাব নষ্ট হয়। এক বাক্সের টাকা অন্য বাক্সে গিয়ে পৌঁছয়। প্রাণের যে একটা আকর্ষণ থাকে তা জটিল আকার ধারণ করে। লালা বিহারীলাল এরকম জটিলতা চান না। তাই তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন যেন তুমি আজই নৈনিতাল যাত্রা কর এবং মধুমতীর হৃদয়মন জয় করতে চেষ্টা কর। অবশ্য তোমাকে বেশি চেষ্টা করতে হবে না। লালা বিহারীলাল নিজেও যথেষ্ট চেষ্টা করবেন। এদিকে আবার তিনি আজকাল কনস্ট্রাকশন লাইনেও যাতায়াত করছেন। যদি ঘরের জামাতা ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে দেখ তো ঠিকাদারিতে কত টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যাবে? একটু চিন্তা কর বাবা, এরপর তুমি কী থেকে কী হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার বৃদ্ধ অবস্থার দিকেও একটু লক্ষ কর, তোমার মা’র ভগ্ন চেহারাখানার দিকেও একটু তাকাও। আর সে যৌতুকও হিসাব কর– যে যৌতুক তোমার তিনজন অবিবাহিতা বোনকে বিয়ে দিতে খরচ হবে। আর সে মোটা অঙ্কও আনা পাইয়ে হিসাবে কর– যে অঙ্ক তোমার ছোট চার ভাইকে পড়ালেখার বাবদ তোমাকেই খরচ করতে হবে। ঠিকমতো হিসাব মিলিয়ে দেখ বাবা।
আমি ঠিকমতোই হিসাব মিলিয়ে দেখলাম অর্থাৎ নৈতিতালে যাব বলেই স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমার সিদ্ধান্ত শুনে সারদা অশ্রু বিসর্জন দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আমাকে জিগ্যেস করল সে, রামজি, এটা কীরকম হিসাব?’
আমি বললাম– ‘এটাকে হায়ার মেথামেটিক্স (Higher Mathematics) বলে।’
২
সারদার শ্যামল লাজনম্র মুখমণ্ডল মধুমতীর তুলনায় কিছুই না। মধুমতী মালার মতো উজ্জ্বল তেজোদীপ্ত সুন্দর হীরার মতো জ্বলজ্বল করছিল এবং হীরার মতো শক্তও ছিল। তার ঠোঁট যেন পদ্মারাগমণি, চক্ষু নীল, কপোল রক্তিম এবং দাঁত মোতিমালার মতো। সে হাসবার সময় মনে হত বুঝি মুখের চালুনি থেকে পরিষ্কার পুষ্পরাগমণির দানা ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ছে। একদিন সে হাসার সময় আমার ইচ্ছে হল তার মুখের কাছে রুমাল বিছিয়ে দিই এবং পুষ্পরাগমণির সব দানা কুড়িয়ে নিই। কিন্তু পরে এই ভেবে বিরত থাকলাম যে পাছে সে আপত্তি করে এবং আমার হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে যায়।
মধুমতাঁকে কলেজজীবন থেকেই চিনতাম আমি। সে রুক্ষ মেজাজ এবং হাকিমানা স্বভাবের ছিল। কখনো কাজ-কাম করত না, পড়ালেখাও তেমন করত না সে। অথচ প্রতি বছর পাস করে যেত। কারণ এ কলেজ তার বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথায় কথায় অধ্যাপকদের সে হাসি-ঠাট্টা করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। একদিন কেমিস্ট্রির এক অধ্যাপক তাকে জিগ্যেস করলেন (তিনি এ কলেজে নতুন যোগ দিয়েছিলেন তাই মধুমতাঁকে চিনতেন না। না হয় তিনি জিগ্যেসও করতেন না।)–
‘ইস্পাত কী দিয়ে তৈরি করে?’
‘লোহা দিয়ে তৈরি করে।’ মধুমতী বলল।
‘হাঁ হাঁ, লোহা দিয়েই তৈরি করে কিন্তু কীভাবে তৈরি করে?’
‘ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে।’
‘ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে কিন্তু কীভাবে তৈরি করে?
‘কারখানায় তৈরি করে।’ মধুমতী দুর্বল কণ্ঠে বলল।
‘আর তা তো বুঝলাম, কিন্তু তৈরি কীভাবে করে।’ অধ্যাপক রাগতস্বরে বলে উঠলেন– ‘ কীভাবে?’ জোর দিয়ে জিগ্যেস করলেন।
‘এটা বড় খারাপ কথা অধ্যাপক সাহেব’– মধুমতী বলতে থাকল– ‘আপনার সব প্রশ্নের জবাব এভাবে কেবল আমি দিতেই থাকব? কেমিস্ট্রির অধ্যাপক আপনি, আমি নই।’
কিন্তু তখন আমি মধুমতাঁকে দেখতাম কেবল দূর থেকেই আর এখন তার সাথেই চলাফেরা করছি হাতে হাত মিলিয়ে। দেয়ালের পার্শ্বে ছোট পাহাড়ি রাস্তার উপর চন্দ্রালোক অন্ধকার ছায়ার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। পরিবেশ তখন একটা কঠিন প্রশ্নের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। এ-সময় মধুমতীর কটিদেশ আমার সঙ্কোচহস্তের নিষ্পেষণে রত। তখন আমাদের যেন এক অদৃশ্য হস্ত চোখের নিমিষে একবিন্দুতে পরিণত করে ফেলেছে।
নৈনিতাল আসার প্রাক্কালে আমি অনেক বছরের পুরনো কীটে-খাওয়া বইগুলো খুললাম এবং শেলি, কিট্স, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন এবং ফেলোর কবিতাগুলো জিওমিট্রির মতো মুখস্থ করলাম। প্রেমের ব্যাপারে কোন কবিতার কখন প্রয়োজন হয় তা স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার, না হয় প্রেমের সব স্বাদই যে বিগড়ে যাবে। আজ অন্ধকার রাতের দীর্ঘ ভ্রমণে মধুমতীর মন-মেজাজের পরিবর্তন দেখে সব কবির কবিতা থেকে এক-একটা করে কবিতা পড়লাম– পড়লাম নয়, যেন একত্রিত করলাম। মানুষ যখন এক-একটা সংখ্যাকে নিয়ে একত্রিত করে তখন মনের ভেতর তার একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সব সংখ্যা একত্রিত হয়ে তার একটা শেষ ফলও সংকলিত হয়। তা আমিও যখন এত কবিতার সমাবেশ করলাম তার একটা প্রতিক্রিয়া কেন হবে না! তার একটা শেষ ফল নিশ্চয়ই দেখা দেবে।
কবিতা একত্রিত করার প্রতিক্রিয়া, না লালা বিহারীলালের সুবিস্তৃত চিঠির প্রতিক্রিয়া তা আমি জানি না। তবে এটা ঠিক যে, আজ মধুমতীর অহঙ্কার, অভিমান এবং তার মন-মেজাজ মধুর মতো গলে অতিমাত্রায় তরল হয়ে গেছে। সে বারবার দীর্ঘনিশ্বাস নিচ্ছে, চলার সময় থেমে থেমে আমার কাঁধে হাত রাখছে এবং চলতে চলতে অকস্মাৎ যেন চমকে চমকে উঠছে। তখন আমার মনে হত দেয়ালের অস্পষ্ট ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার ছায়ার মধ্যে কে যেন আমার পিছু নিয়েছে। মনে হত বুঝি অন্ধকার ছায়ার ভেতর সে অশ্রুসিক্ত দুটো চোখ আমাকে অনুসরণ করছে এবং শ্যামল লাজনম্র চেহারার কেউ আমার কাছে কোনো অভিযোগ করছে।
চলতে চলতে আমি দু-তিনবার মাথাটা ঝাড়া দিলাম। সে ছায়া আমার মন থেকে দূর করতেই হবে– যাকে আমি দূর করে দিয়েছি। এখন আমার দৃষ্টি এ ছায়ার প্রতিই নিবিষ্ট– যে ছায়ার সাথে আমার ছায়া গ্রথিত হতে পারে।
আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণের সময় মধুমতী অনুভব করল যে, সে আসলে আমাকে পছন্দ করে। প্রথমবার সে আমাকে এমন দৃষ্টিতে দেখল, যেন কোনো সুন্দরী যুবতী তার আঙুলের হীরার আংটি গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখছে। আমার ওজন কতদূর আছে সে পরিমাণ করে নিয়েছে তার গভীর দৃষ্টি দিয়ে, তার নতুন দৃষ্টি দিয়ে।
এরপরই সে আমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল যে, সে কালকেই আমার সাথে একা ‘চায়নাপিকে’ যাবে।
কাল অতি প্রত্যূষেই তার বাংলোতে পৌঁছতে হবে। সে একটা ঘোড়া এবং সহিসও ঠিক করে রাখবে।
‘রাস্তার যদি আমরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি তাই ঘোড়ার প্রয়োজন হতে পারে। না হয় আমরা তো হেঁটেই যাব।’ সে আমাকে বলল এবং আমার হাতে জোরে একটা চাপ দিল। সে রাতেই আমি বাবার কাছে একখানা চিঠি লিখলাম। শুধু তিনটা অক্ষরই তাতে লিখেছিলাম,– ‘Q. E. I’
পৃথিবীতে যদি অঙ্কই সব হয়ে থাকে, তাহলে আমার বিশ্বাস বাবা এ চিঠিখানা পেয়ে খুব খুশি হবেন।
৩
দ্বিতীয়দিন তার মুড বড় খারাপ ছিল। তাকে চিন্তান্বিত চেহারায় দেখলাম।
‘আমি আজ তোমার সাথে ‘চায়নাপিকে’ যেতে পারব না।’
‘কেন?’
‘এবং তুমিও যেতে পারবে না।’ সে আমাকে আদেশ করল।
‘কেন!’ আমি পুনরুক্তি করলাম।
কিছুক্ষণ পর জানলাম মধুমতীর এলসেসিয়ান কুকুর বড় মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। সকালে আয়া তাকে ভ্রমণ করাতে নিয়ে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পাহাড়ি রাস্তা থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিল। তার পেছনের হাঁটুর একটা হাড় ভেঙে গেছে। মধুমতী তাকে বারবার আদর করতে থাকল। কিন্তু কুকুর শেষ পর্যন্ত কুকুরই। প্রভুভক্তির পরও শরীর বলতে একটা জিনিস তার আছে। সে শরীরে যদি শক্ত ব্যথা পায়, তখন আদর-সোহাগ দেখানো কুকুরও শেষ পর্যন্ত আদর দেখানোর পরিবর্তে দংশন করতে দৌড়ে আসে।
‘তুমি তাকে ঘোড়ায় উঠিয়ে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাও এবং ডাক্তারকে বল তাড়াতাড়ি তার চিকিৎসা করতে।’
নৈনিতালে পশু চিকিৎসালয় কোথায় তা তো আমি জানি না!’ নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
‘আরে পশু চিকিৎসালয়ে কে যেতে বলছে তোমাকে। নৈনিতাল হাসপাতালে যাও। মানুষের হাসপাতাল।’
‘ডাক্তার তার চিকিৎসা করতে যদি অস্বীকার করে?’
‘কী করে অস্বীকার করবে?’ সে গর্জন করে উঠল, ‘এ হাসপাতাল আমার বাবা প্রতিষ্ঠা করেছে, তুমি যাও। আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোনে বলছি।
যে ঘোড়ায় করে মধুমতী আমার সাথে ‘চায়নাপিকে’ যাবার কথা ছিল, সে ঘোড়ার পিঠে এখন আমি তার কুকুরকে তুলে নিলাম। নিজেও একটায় উঠে বসলাম। হাসপাতালের বাইরে বাহকরা কুকুরকে রাখল এবং আমি হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ত্রিকোণ বিশিষ্ট এক বারান্দার মধ্যে একটা লম্বা করিডোর। খানকতক টুলে বিমর্ষ রুগী এবং তাদের সাথি– কেউ-বা রুগীর আত্মীয়, কেউ-বা বন্ধুবান্ধব– বড় অস্থির, বড় অধৈর্যচিত্তে হাসপাতাল খোলার অপেক্ষায় বসে আছে।
‘এখানে অর্ধেক সময় বাকি আছে।’ একজন আর্দালি আমাকে বলল।
‘বড় ডাক্তার কি এখানে নেই?’ সামনের ময়লাযুক্ত দেয়ালের দিকে মালিকসুলভ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমি জিগ্যেস করলাম। তখন আমার গলার স্বর স্বভাবতই চড়া ছিল। তা এ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা যখন মধুমতীর বাবা অর্থাৎ আমার ভাবী শ্বশুর।
আর্দালি আমার গলার স্বর শুনে চমকে উঠল এবং তৎক্ষণাৎ তার বলার ধরন পরিবর্তন করে ঝুঁকে নম্রভাবে বলল– ‘বড় ডাক্তার সাহেব তাঁর কামরায় আছে।’
‘যাও, তাঁকে বলোগে, মধুমতী মেমসাহেবের কুকুরও এসেছে।’
আর্দালি অদৃশ্য হলে আমি করিডোরে পায়চারি করতে করতে রুগীদের অবস্থা পরিদর্শন করতে থাকলাম। দুজন বৃদ্ধ থেমে থেমে পালাক্রমে কাশতে লাগল। একজনের কাশি বন্ধ হলেই অন্য জনের শুরু হয়। তাদের উভয়ের মধ্যে কেমন যেন একটা সমঝোতা মনে হচ্ছিল। ছিপছিপে ধনুকের মতো একটা শিশু মা-র কোলে বসে এক নাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন এ শিশু পৃথিবীতে পদার্পণ করার পর থেকে কিছুই খায়নি। আর বেচারি মা-ও যেন তার ক্ষুধার ওষুধ করতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। একজন লোক পুরো বেঞ্চের উপর শুয়ে বেদনার জ্বালায় বারবার কেবল ঝাঁকিয়ে উঠছে। তিনজন লোক তাকে সান্ত্বনা দিতে লেগে আছে। তাদের জিগ্যেস করে জানতে পেলাম রাত থেকে লোকটার বেদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সামনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম একটা যুবকের ক্ষত-বিক্ষত দেহ পড়ে আছে। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। খাটের নিচে রক্ত জমে শক্ত হয়ে গেছে। তাকে জংলি বাঘে আক্রমণ করেছে বলে মনে হল। কাঁচা মাংসপিণ্ড– এবং পায়ের হাঁটু থেকে চামড়া খসে পড়ে গেছে। তার চেহারার রং নীল হয়ে গেছে, চক্ষু মুদ্রিত ছিল। তার স্ত্রী এবং বাবা হতবুদ্ধি হয়ে কখনো এ আর্দালির কাছে কখনো ও আর্দালির কাছে গিয়ে হাতজোড় করতে লাগল। ডাক্তারকে দ্রুত খবর দিতে বারবার অনুনয়-বিনয় করতে লাগল।
এ-সময় হঠাৎ বড় ডাক্তার তাঁর প্রকোষ্ঠ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। দুজন আর্দালি বিনীত চরণে তাঁর পেছনে এল। আর্দালি হাতের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলে ডাক্তার তাড়াতাড়ি আমার কাছে এলেন।
‘কই, সমুদ্র কোথায়?’ তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন।
‘সমুদ্র তো বোম্বাইতে।’ আমি জবাব দিলাম– ‘পাহাড়ের উপর হ্রদ হয়, সমুদ্র হয় না।’
পরের বুঝলাম সমুদ্র আসলে মধুমতীর কুকুরের নাম। কুকুরের নামের দিকে এতদিন লক্ষ করিনি বলে আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য লজ্জিত হতে হল। এরপর আমি ডাক্তারকে বললাম– ‘সমুদ্র বাইরে আছে। তার দেহের ওজন খুব বেশি। কোলে করে এখানে আনা সম্ভব নয় বলে ওখানে আছে। তাছাড়া বাহকরাও অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।’
‘কোনো চিন্তা নেই।’ ডাক্তার সাহেব জোরে আর্দালিকে হুকুম করলেন– ‘স্ট্রেচার বাইরে নিয়ে যাও এবং মধুমতী মেমসাহেবের কুকুরকে এক্ষুনি ভেতরে নিয়ে এস।’
দুজন আর্দালি তখনি স্ট্রেচার নিয়ে বাইরে পা বাড়াল।
বৃদ্ধ বাবার ঠোঁট-জোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তার উত্তোলিত হস্তদ্বয় ভয়-ভীতিতে কাঁপছিল। বৃদ্ধ প্রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল– ‘ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেকে বাঁচান। তাকে বাঘে আক্রমণ করেছে।
‘এক্ষুনি দেখছি।’ ডাক্তার সাহেব তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন এবং সামনে কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে করিডোরের বাইরে যেতে লাগলেন। তখন আর্দালিদের সাবধানতার সাথে স্ট্রেচারে করে কুকুরকে আনতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন কয়েক মুহূর্ত এবং পরে ক্ষিপ্রগতিতে ডাক্তার সাহেব স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে কুকুরের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন।
‘হ্যালো সমুদ্র–পুয়র ডাগি, You have been hurt. What a shame! বটে, ডন্ট ওরি… You. We will set. Right in a minute ‘ এবং পরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– ‘Brave dog! Heirsa!‘
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কুকুর তার মাতৃভাষা বোঝে না?’
ডাক্তার সাহেব গর্বের সাথে বললেন, ‘শুধু ইংরেজি বোঝে।’ তিনি এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি দু-পা বিশিষ্ট কোনো এক নীচু বংশের কুকুর আর কি।
কুকুরের স্ট্রেচার বাঘে আক্রমণ-করা যুবকের খাটের পাশ দিয়ে নিয়ে যাবার সময় যুবকের স্ত্রী ডাক্তারের পা জোড়া ছুঁয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শুধু এক পলক তাকে দেখুন ডাক্তার সাহেব, ভগবানের দোহাই! শুধু এক পলক।’
‘এক্ষুনি আসছি, এক্ষুনি আসছি।’ ডাক্তার সাহেব ঘাবড়ে গিয়ে পা সরিয়ে নিলেন এবং স্ট্রেচারের সাথে সাথে অপারেশন রুমে প্রবেশ করলেন।
প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা অপারেশন রুম থেকে বেরুলাম। সমুদ্রের সব ক্ষতস্থানে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। পায়ের হাড় জোড়া লাগিয়ে প্লাস্টার করে দেয়া হয়েছে।
‘আর কোনো ভয় নেই।’ ডাক্তার সাহেব আমাকে বললেন। পরে তিনি সমুদ্রের থুতনিতে হাত দিয়ে আদরের সাথে বললেন– ‘Brave dog. ‘ .
কুকুর খুব কষ্টে দম ফেলল এবং চোখ মুদে শুয়ে থাকল।
আর্দালিরা আবার কুকুরকে স্ট্রেচারে তুলে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করে নিয়ে যেতে লাগল। দ্বিতীয়বার আমরা করিডোর দিয়ে গমন করার প্রাক্কালে ডাক্তার সাহেব আমাকে বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে যুবকের খাটের দিকে চলে যেতে লাগলেন। আমি আর স্ট্রেচারের সাথে যেতে পারলাম না। ডাক্তারের পেছনে পেছনেই হাঁটতে শুরু করলাম। ডাক্তার সাহেব যুবকের নাড়ি পরীক্ষা করতে লেগে গেলেন।
‘ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলে’– বৃদ্ধ বাবা ঝাঁকিয়ে উঠল– ‘যে-কোনোরকমেই হোক আমার বাদলের প্রাণ বাঁচিয়ে দিন।’
‘কিন্তু এ তো মরে গেছে!’ ডাক্তার সাহেব মাথা ঝুঁকিয়ে মৃদৃকণ্ঠে বললেন।
যতদিন আমি এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকব সে বৃদ্ধের চেহারা ভুলতে পারব না। বৃদ্ধ একবার আমার দিকে একবার ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকাতে লাগল। তখন তার চোখ থেকে অশ্রুর প্লাবন বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে বড় কষ্ট করে অশ্রু রোধ করতে চেষ্টা করল। তার চেহারায় কয়েক দিনের গজিয়ে ওঠা দাড়ি এবং তার চেহারায় এত ফাটল ছিল, যেরকম চাষ করা জমিতে থাকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেসব ফাটল দিয়ে ঘামের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। ঝড়ে পাওয়া পাতার মতো তার চেহারা কাঁপতে লাগল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত তার কণ্ঠ থেকে কোনো আওয়াজই বেরুল না। কিছুক্ষণ পরে তার কণ্ঠ থেকে এক আওয়াজ বেরুল– সে আওয়াজ বজ্রের মতো ফেটে পড়ল। সে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘কিন্তু একটু আগেও সে জীবিত ছিল ডাক্তার সাহেব! আমার বাদল…।’
ডাক্তার সাহেব কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে থাকলেন। পরে নিঃশব্দ চরণে তাঁর কামরায় গিয়ে ঢুকলেন।
8
বাসায় প্রত্যাবর্তনের সময় আমি সারা পথ নিশ্চুপ ছিলাম। ঘোড়া সহিসদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ ডাক্তার সাহেব সহৃদয় হয়ে কুকুরকে স্ট্রেচারে করেই নিয়ে যেতে হুকুম দিয়েছেন। দুটো আর্দালিও সাথে করে দিলেন। আর্দালিগুলো বড় আমুদে ছিল। সারাপথ নানারকমের গান গেয়ে তারা আমার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি সারা পথ নিশ্চুপ ছিলাম।
মধুমতী খুব খুশি হল। সে আর্দালিদের বিশ টাকা বখশিশ দিয়েছে। আর্দালিরা চলে গেলে সে আমার কপোলে তার কপোল সংযুক্ত করে আমাকে পুরস্কার দিল। পরে সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার কুকুরের প্রতি মনোযোগ রাখল। আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, তখন আমার মনের ভেতর তুমুল ঝড় বইছিল।
সে আমাকে উদাস দেখে বলল, ‘তুমি তো এমন গুম হয়ে আছ, যেন আমার সমুদ্র বেঁচে যাওয়াতে তুমি একটুও খুশি হওনি।’
‘না, তা নয়।’ আমি মৃদুস্বরে বললাম।
‘তো কী!’ সে ভয় পেয়ে গেল।
আমি তাকে হাসপাতালের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম।
ঘটনা শুনে সে হঠাৎ মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘উন্মাদ হলে নাকি! এ জংলিরা তো হর হামেশা ব্যাঘ্রের শিকারেই পতিত হচ্ছে এবং আরও কত হবে। অতীতে এরকম আরও কত
কেস হয়েছে এবং কত হাজার হাজার লোক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করছে। আর এখন, আমরা কথা বলার এ মুহূর্তেও না জানি এক মিনিটে কত হাজার লোকের মৃত্যু হচ্ছে। এরকম যদি হিসাবই করতে থাক তাহলে পৃথিবীতে কোনোকিছুই করতে পারবে না শ্রীরাম।
এরপর সে আমার হাত ধরে বাইরে বাংলোর বারান্দায় নিয়ে এল। চোখ-জোড়া বিস্ফারিত করে বলল– ‘এস এখানে বসি। এ ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে চা পান করতে করতে তোমার কণ্ঠ থেকে কিটসের প্রেমের কবিতা শুনি। আহ্! কিটসের প্রেমের কবিতা কী নরম আর মোলায়েম। ঠিক আমার কুকুরের লোমের মতো।
আমার মন প্রফুল্ল রাখার জন্য সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত একথা সেকথা অনেক কথা বলল। কিন্তু আমার মন তবুও সারাক্ষণ বিষণ্ন হয়েই রইল। মনকে স্বাভাবিক রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করলাম। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে, অবশেষে আমি নিশ্চুপ নির্লিপ্ত অবস্থায় বসে ছিলাম। সে এক আশ্চর্য জড় পদার্থের মতো নীরব, নিথর। সে আমার সমস্ত অনুভূতি শক্তিকে পুরো নিজের আয়ত্তাধীন করে নিয়েছে। আমি না কিছু বলতে পারছি, না কিছু চিন্তা করতে পারছি।
চা এলে সে নিজ হাতে আমার জন্য চা তৈরি করল এবং বিস্কিটের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল– ‘নাও, খাও।’
আমি নীরবে প্রত্যাখ্যান করলাম। সে জোর করে একখানা বিস্কিট আমার মুখে পুরে দিল। বলল, ‘খেতে হবে। খাও।’
অগত্যা বিস্কিট খেতে শুরু করলাম। এ-সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমি আপন মনেই বিস্কিট খেয়ে যাচ্ছি। আমার চোয়ালও স্বাভাবিকভাবে নড়ছে। বিস্কিট খেতে খেতে হঠাৎ আমার অনুভব হল, যেটা আমি খাচ্ছি সেটা না পানসে, না মিষ্টি। বরং সে বিস্কিট নোনতা বলেও মনে হল না। মনে হল যেন সেটা খসখসে একখণ্ড মাংসের টুকরো।
হঠাৎ জোরে আমার বমি এল এবং আমি ওখান থেকে দ্রুত উঠে চলে এলাম। পেছন থেকে মধুমতী আমাকে শুধু ডাকতেই থাকল।
৫
না না, আপনারা ভুল বুঝেছেন। আমি সারদাকে বিয়ে করিনি, আমি মধুমতাঁকেই বিয়ে করেছি।
এটা তো কত আনন্দের কথা। তখন আমি ছিলাম একজন অনভিজ্ঞ অপরিণামদর্শী যুবক মাত্র। জীবনের হিসাব-নিকাশের খাতায় তখন আমি পাকাপোক্ত ছিলাম না। এখন আমি একজন সাফল্যবান পুরুষ। একজন বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক। এখন যত লোক যেভাবেই মারা যাক-না কেন, আমার বিস্কিটের স্বাদ কিন্তু পরিবর্তন হয় না।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী