কুঁড়ের বাদশার কাহিনী
শাহরাজাদ বলে, জাঁহাপনা যদি অনুমতি করেন এর পর তোমাদের সেই ‘কুড়ের বাদশাহ’ কিত্সা শোনাতে পারি।
সুলতান শাহরিয়ার বলে, স্বচ্ছন্দে। তাছাড়া গল্পটা আমার অজানা।
একদিন খলিফা হারুন অল রসিদ তার উজির আমির অমাত্য পরিবেষ্টিত হয়ে দরবারে কর্ম-নিরত ছিলেন। এমন সময় মহামূল্যবান মণি-রত্ন খচিত একটি সোনার কারুকার্য করা রক্তবর্ণের রত্নমুকুট হাতে নিয়ে হারেমের একটি ছোট্ট খোজা এসে দাঁড়ালো।
খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, কী সংবাদ, কে পাঠালো?
খুদে খোজাটা কুর্নিশ জানিয়ে বললো, ধর্মাবতার জুবেদা বেগমসাহেবা এটা পাঠিয়ে দিলেন আপনার কাছে। এই মুকুটের মাথায় একটা খালি জায়গা দেখছেন—এখানে বসানো ছিলো এক অমূল্য রত্ন। আকারে এত বড় রত্ন সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু এমনই দূর্ভাগ্য, রত্নটি খোয়া গেছে। কিন্তু কী ভাবে গেছে তা খোঁজখবর করেও হদিশ পাওয়া যায়নি। বেগমসাহেবা এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য শহরের তাবৎ জহুরীদের দোকানে খোঁজ করেছেন। কিন্তু তেমনটি পাওয়া যায়নি। তাই শেষে নিরুপায় হয়ে তিনি এটি আপনার কাছে পাঠালেন। আপনি যদি চেষ্টা করে এর জুড়ি কোনও মণি-রত্ন সংগ্রহ করে বসিয়ে দিতে পারেন, তিনি খুব খুশি হবেন।
খলিফা বললেন, সর্বনাশ, জুবেদার ঘরে চুরি! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!
উজির-আমির ওমরাহদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, তোমরা মুকুটটা ভালোর করে পরীক্ষা করে দেখে যাও। দেখ, যদি তোমাদের কারো ঘরে থেকে থাকে এর জুড়ি কোনও রত্ন, তবে যে দামেই হোক আমি কিনে নিতে চাই।
আমির ওমরাহরা নিজেদের প্রাসাদে গিয়ে অনেক খুঁজে-পেতে দেখলো। কিন্তু না, কারো প্রাসাদেই ঐ ধরনের কোনও রত্নের সন্ধান পাওয়া গেলো না।
খলিফা উজিরকে বললেন, শহরের সব ধনী সওদাগরদের বাড়ি তল্লাশ করে দেখ, যদি মেলানো যায়।
কিন্তু না, উজিরের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলো। অত দামী এবং অত বড় রত্ন কারো কাছেই পাওয়া গেলো না।
খলিফা চিন্তিত, ঈষৎ বিরক্ত হলেন, আমি তামাম দুনিয়ার মালিক, আর আমার বেগমের সামান্য এই সাধ পূরণ করতে পারবো না আমি?
এমন সময় এক বণিক এসে বললো, ধর্মাবতার, এই রকম একখানা মহামূল্য রত্ন বসরাহর এক যুবকের কাছে আছে।
খলিফা জিজ্ঞেস করেন, তার নাম?
তার নাম কুড়ের বাদশা আবুমহম্মদ। লোকে তাকে শুধু কুড়ের বাদশা বলেই জানে। তবে অন্য কারো কাছে সে বিক্রী করবে না সে রত্ন। একমাত্র মহামান্য ধর্মাবতার চেষ্টা করলেই তা পেতে পারেন।
তখুনি খলিফা উজিরকে বললেন, তাহলে আর বিলম্ব নয়, জাফর। তুমি বসরাহর সুবাদারকে চিঠি পাঠাও। যে ভাবেই হোক, ঐ রত্নটি আমার চাই।
এই সময় প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো সাতষট্টিতম রজনী?
আবার সে বলতে শুরু করে :
বসরাহর সুবাদার জুবাইদি। জাফর তাকে চিঠি লিখে মাসরুরের হাতে পাঠিয়ে দিলো।
আবু মহম্মদের প্রাসাদে পৌঁছে মাসরুর দ্বাররক্ষীকে বললো, তোমার মালিককে খবর দাও, বাগদাদ থেকে খলিফার দূত এসেছে। এখনি তাকে বাগদাদে যেতে হবে। খলিফা তাকে তলব করেছেন।
দ্বাররক্ষী অন্দরে চলে গেলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলা যায়, স্বয়ং আবু মহম্মদ বাইরে বেরিয়ে এসে সালাম জানিয়ে স্বাগত অভ্যর্থনা করলো, মহামান্য ধর্মাবতারের দূত, আপনি মেহেরবানী করে এক পলকের জন্য ভেতরে এসে ধন্য করুন।
মাসরুর বলে, না না, সে সম্ভব নয়। আর এক মুহূর্ত দেরি করতে পারবো না, ধর্মাবতার আপনাকে তলব করেছেন! এখুনি যেতে হবে। তৈরি হয়ে নিন।
আবু মহম্মদ বিনয়াবনত হয়ে বলে, শাহেনশাহর আদেশ আমার শিরোধার্য।
আমি এখুনি রওনা হবো। কিন্তু তার জন্যে তো কিছু গোছগাছ করে নিতে ই হবে আমাকে। সেইটুকু সময় আপনি আমার এই গরীবখানায় একটু পায়ের ধুলো দিন।
মাসরুর আর না করতে পারে না। সদলে অন্দরে প্রবেশ করে। বৈঠকখানায় ঢুকেই মাসরুরের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। একি কাণ্ড! এত জাঁকজমক, এমন মহামূল্যবান পর্দা গালিচা, আসবাবপত্র সে তার খলিফার প্রাসাদেও দেখেনি কখনও। চারদিকে সুন্দর সুন্দর শৌখিন জিনিসপত্র ছবির মতো করে সাজানো গোছানো। টেবিলের ওপর রাখা ছিলো দুষ্প্রাপ্য অমূল্য মণিরত্নের হার এবং অন্যান্য রত্নভরণ।
আবু মহম্মদ বললো, আপনি পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। যদি কিছু মনে ক না করেন হামামে চলুন। গোসলাদি করে শরীরটাকে একটু ঝরঝরে করে নিন।
মাসরুর ভাবে, কথাটা মন্দ বলেনি। সারা পথের ধুলোবালিতে গা-হাত-পা কিচ কিচ করছে। একটু গোসল করে নিলে মন্দ হয় না।
হামামে ঢুকে মাসরুরের তাক লেগে যায়। হামাম না বেহেস্ত, ঠিক বুঝতে পারে না সে। স্বপ্নেও এ দৃশ্য কল্পনা করা যায় না। সব মিলে সুললিত কাব্যের মতো মনে হয় তার কাছে।
হামাম থেকে ফিরে মাসুরুর দেখে, একখানা বড় টেবিলে খানাপিনা সাজানো হয়েছে। অসংখ্য অগণিত রেকাবী ভর্তি জানা-অজানা নানারকমের নানা স্বাদের খানা।
আবু মহম্মদ হাত জোড় করে বলে, মেহেরবানী করে যদি কিছু গ্রহণ করেন, আনন্দিত হবো। মাসরুর সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে করে পেটপুরে খেলো।
এরপর পাঁচটি কিশোর পাঁচখানা সোনার থালায় করে নিয়ে এলো পাঁচটি মোহরের তোড়া। প্রতিটি এক হাজারের। আবু মহম্মদ বলে, আমার এই সামান্য উপহার গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন, ধর্মাবতারের বান্দা।
এছাড়াও সূক্ষ্ম কারুকার্য করা নানা রত্নখচিত একটি সাজ-পোশাক তুলে দিলো সে মাসরুরের হাতে।
—গরীবের এই সামান্য দানটুকু প্রত্যাখ্যান করবেন না, এই আমার একান্ত অনুরোধ। মাসরুর খুব খুশি মনে নিলো।
এর পর ওরা বাগদাদ অভিমুখে যাত্রা করে।
খলিফা সাদরে কাছে বসালেন আবু মহম্মদকে। বললেন, আমি শুনেছি, তামাম আরব দুনিয়ার আমির বাদশাহের কাছে যে রত্ন-মণি-মাণিক্য নাই, তা তোমার কাছে আছে।
মহম্মদ সবিনয়ে বলে, ধর্মাবতার ঠিকই শুনেছেন। যদিও আপনার দূত আমাকে কোনও আভাষ দেয়নি তবু আমি বুঝেছিলাম, কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। হয়তো আপনি কোনও দুষ্প্রাপ্য রত্নের সন্ধান করছেন। কিন্তু আমার কাছে যে সব অমূল্য মণিরত্ন আছে, পয়সার বিনিময়ে তা আমি কোনও জহুরী বা ব্যবসাদারের কাছে বিক্রি করি না। তবে জাঁহাপনার যদি কোনও কাজে লাগে, সাগ্রহে আমি দিয়ে যাবো। এই কারণে, আমি নিজে থেকেই দুটি বাক্স করে। কিছু মণিরত্ন নিয়ে এসেছি আপনার জন্য। আপনার পছন্দ মতো বেছে নিয়ে আমাকে ধন্য করুন ধর্মাবতার।
এই বলে আবু মহম্মদ একটি থলে থেকে সোনার একটি বাক্স বার করে তার ডালা খুলে ধরলো।
খলিফা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, হীরে চুনী, পান্না মুক্তো, রক্তরাগমণি, পদ্মরাগমণি প্রভৃতি নানারকম বহু বিচিত্র বর্ণের মণি-মাণিক্য ঝকমক করছে। আবু মহম্মদ বললো, ধর্মাবতার এগুলোর আকার এবং প্রকৃতি প্রত্যক্ষ করুন। এবং আপনার সংগ্রহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন সুলতান বাদশাহদের সংগৃহীত রত্নাবলীর সঙ্গে এর ফারাক কোথায়। আমি বাজি রেখে বলতে পারি জাঁহাপনা, এই বাক্সে যা দেখছেন তার সমতুল্য আর একটিও কোথাও খুঁজে পাবেন না। এবং সবিনয়ে বলছি, এ সবই আপনার জন্য এনেছি, গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন।
আবু মহম্মদ এর পর একটি বাক্স বের করে। সে বাক্সের ডালা তুলতেই দেখা গেলো, একটি সোনার গাছ। তার কাণ্ড শাখা সব সোনার। পাতাগুলো পান্নার আর ফলগুলো সব হীরে রক্তরাগমণি নীলকান্তমণি বৈদুর্যমণি প্রভৃতি নানা অমূল্য রত্নের তৈরি। গাছের শাখায় অনেক পাখি। সবই সোনার। ঠোঁট এবং চোখগুলোয় রত্ন বসানো।
খলিফা এবং তার পরিষদরা হাঁ হয়ে দেখতে থাকেন। এমন অদ্ভুত বস্তু তারা কেউ কখনও দেখেনি। আবু মহম্মদ বললো, ধর্মাবতার খুবই অবাক হচ্ছেন, মনে হচ্ছে। কিন্তু আরও অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার আছে।
এই বলে সে বাক্সটার মধ্যে হাত রেখে গাছটিকে মৃদুনাড়া দিতেই পাখিগুলো গান গেয়ে শিস দিয়ে নাচতে থাকলো। নাচতে নাচতে তারা এ ডাল থেকে সে ডাল, সে ডাল থেকে আবার অন্য ডালে হুটোপুটি করতে থাকলো।
খলিফা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হতবাক হয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। সভাসদরাও বিস্ময়ে স্তব্ধ। সারা দরবারকক্ষে নেমে আসে গভীর নিস্তব্ধতা। বাস্তবে ভাবা দূরে থাক, এযাবৎ কেউ কখনও এ বস্তু স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না।
খলিফা বললেন আচ্ছা আহম্মদ, তোমার সম্বন্ধে যা খোঁজখবর সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে তো পৈতৃক সূত্রে এসব তুমি পাওনি। তোমার বাবা বসরাহর এক হামামের অতি সাধারণ ভিস্তিওলা ছিলো মাত্র। সে যা রোজগার করতে পারে তাতে পরিবার প্রতিপালন করে তেমন কিছুই সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তোমার বাবার বাবাও নিতান্তই সাধারণ গরীব-সরীব মানুষ ছিলো। সুতরাং এই অমূল্য সম্পদ বংশগতভাবে তুমি পাওনি, এ আমি সুনিশ্চিত। এরপর আরও মজার কথা, সারা বসরাহতে তুমি কুড়ের বাদশাহ নামে বিখ্যাত। ওখানকার মানুষ তোমাকে কখনও পথে ঘাটে বেরোতে বা কোন কাজ কাম কি ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনও ধান্দা করতে দেখেনি কখনও। এমতাবস্থায় এই বিশাল ধনরত্নের মালিক তুমি হলে কী করে?
আবু মহম্মদ বলে, আপনার সব জানাই সত্যি, ধর্মাবতার। আমরা বংশানুক্রমে ভীষণ গরীব ছিলাম। আমার বাবা হামামে জল দেবার কাজ করে যে সামান্য পয়সা রোজগার করতো তাতে দুবেলায় নুন-রুটির সংস্থানও হতো না সব দিন। আমার বাবা যখন মারা যায় সে সময় আমি নিতান্তই শিশু। পেটের দায়ে মা অন্য বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে আমাকে প্রতিপালন করতে।
জন্মাবধি আমি কুড়ে। সারা দিন-রাত শুয়ে শুয়ে কাটাই। এমনকি মা আমাকে খাইয়ে না দিলে উঠে বসে খানাপিনা করারও কোনও স্পৃহা হতো না আমার। এমনও দিন গেছে, আমি হয়তো বাড়ির দাওয়ায় শুয়ে আছি। বেলা বেড়েছে, সুর্যের খরতাপ আমার গায়ে লেগে দগ্ধ করছে। সামান্য একটু পাশ ফিরে শুতে পারলে সূর্য-তাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু আমার এমন কোনও শক্তি বা ইচ্ছা নাই যাতে একটু পাশ ফিরে শুতে পারি।
এই রকম আরও অনেক কাহিনী আপনাকে শোনাতে পারি, ধর্মাবতার। এবং সে সব অবিশ্বাস্য কুড়েমির কাহিনী শুনে আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন। সে কথা থাক। মোটের পর, আমার মতো কুড়ে অকর্মা বোধ করি সারা দুনিয়ায় দুটি ছিলো না।
অন্যের বাড়িতে কাজ সেরে একদিন দুপুরে ফিরে এসে মা আমাকে বললেন বাবা মহম্মদ, ও -পাড়ার মুজাফফর শেখ আজ বাণিজ্যে যাচ্ছে। শুনলাম, চীন দেশে যাবে। অনেক লোক অনেক কিছু আনার জন্য পয়সা কড়ি দিচ্ছে। তা আমার কাছে মাত্র পাঁচটা দিরহাম আছে। তুই শেখ সাহেবকে এই দিরহাম কটা দিয়ে বলে আয় বাবা, সে যেন চীন দেশ থেকে যা হোক কিছু একটা জিনিস কিনে আনে আমাদের জন্য। আল্লাহ যদি দেন তা থেকেই দু পয়সা নাফা হতে পারবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি কী যে বলো মা, এখন আমার দারুণ ঘুম পেয়েছে। ফিরে শুতে পারছি না, তা আবার মুজাফফর শেখের বাড়ি যাবো, না, না, ওসব আমার দ্বারা হবে না।
মা কিন্তু নাছোড়বান্দা। বললো, না করিস নে বাবা, শুনেছি, চীন দেশ থেকে যারাই ফিরেছে বিরাট বড় লোক হয়ে গেছে। কে জানে, আমাদের বরাত খুলে যেতে পারে।
আমি বললাম, তোমার যেমন কথা, ঐ সামান্য পাঁচটা দিরহামের সওদায় তুমি কী এমন হাতী ঘোড়া লাভ করতে পারবে। বাণিজ্য করতে হলে মূলধন দরকার, বুঝলে? ওসব ফালতু আকাশ-কুসুম আশার চিন্তা মাথা থেকে সরাও তো মা। যাও, এখন আর বিরক্ত করো না। আমাকে শান্তিতে একটু ঘুমাতে দাও।
মা এবার কড়া হলেন। দেখ আবু, পরের বাড়িতে এইভাবে ঝি-গিরি আর করতে পারি না। বয়স হয়েছে, সোমত্ত ছেলে, একটা রোজগার-পাতির ধান্দা দেখ। এইভাবে তোমাকে আর আমি শুইয়ে শুইয়ে খাওয়াতে পারবো না।
আমি প্রমাদ গুণলাম। মা যদি সত্যি সত্যিই আমাকে খেতে না দেয়, আমি অনাহারে উপোস করে মরবো। কারণ, কাজ করা অনেক দূরের কথা, পাশ ফিরে আমি নড়তে পারি না। ভয়ে ভয়ে বললাম, তা কতদূর-কোথায় যেতে হবে?
মা হাসিতে ঝলমল করে উঠলো, এই কাছেই, বাবা। শেখ সাহেব জাহাজে মালপত্র তুলছে—একটু পরেই ছেড়ে চলে যাবে। এই তো সামান্য পথ-বাজারের পাশেই বন্দর।
আমি বললাম, তাহলে আমার হাতখানা একবার ধরে তুলে বসাও, দেখি।
মা আমার শরীরটাকে খাটের ওপর বসিয়ে দিলো। বললো, চলো, বাবা চলে।
আমি বললাম, আরে, বলছি তো যাবো। কিন্তু আমার চটি জোড়া কোথায়?
-এই তো পায়ের নিচেই রয়েছে। নে পরে নে।
-বাঃ রে, আমি পরতে পারি নাকি। তুমি আমাকে পরিয়ে দেবে তো!
মা নিজে হাতে আমার চটি জোড়া ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি চলো। শেখ সাহেব জাহাজ ছেড়ে চলে গেলে সব মাটি হয়ে যাবে।
আমি বললাম, হুঁ, কী আমার লাখ-পঞ্চাশের সওদার ওয়াদা। তা আবার মাটি হয়ে যাবে।
মা এবার ক্ষুব্ধ হন, দেখ মহম্মদ, না হয় আমরা গরীব, তা বলে কোনও আশাই ছোটো নয় রে। আল্লাহ যদি এই পাঁচ দিরহামের বদলে আমাকে সাত দিরহামও ফিরিয়ে দেন—আমার মন ভরে যাবে।
আমি বললাম, তা তো হলো, এখন মাটিতে পা রাখবো কী করে?
মা বললো, আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়া, বাবা। আমি তোকে ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছি।
বন্দরের পথে যেতে যেতে অনেকে আমায় দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, কী ব্যাপার আবু মহম্মদ তুমি?
আমি বলি, আর বললো কেন, পাগল মা-এর আব্দার এড়াতে পারলাম না।
বন্দরে এসে দেখলাম, সব ঠিকঠাক। জাহাজ ছাড়বো ছাড়বো করছে। মুজাফফর শেখকে ঘিরে পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবরা শেষ বিদায় জানাতে ব্যস্ত। আমাকে দেখে শেখ সাহেব বললো, আরে, মহম্মদ না! কত কাল তোমাকে দেখিনি বাবা। তা কী খবর বলো।
আমি সেই পাঁচটা দিরহাম ওর হাতে দিয়ে বললাম, আপনি চীন দেশে যাচ্ছেন মা আপনাকে এই দিরহাম কটা দিয়ে বলেছে, আপনার পছন্দ মতো যাহোক কিছু একটা জিনিস নিয়ে আসবেন আমাদের জন্য। অবশ্য আপনার যদি কোনও অসুবিধা না হয়।
শেখ মুজাফফর বললো, অসুবিধা হলেও তা করবো, বাবা। তোমার বাবা আমার অন্তরঙ্গ দোস্ত ছিলেন। তার মতো সাচ্চা মানুষ বড়ো একটা হয় না। যাই হোক, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক, আমার পছন্দ মতোই নিয়ে আসবো একটা জিনিস।
জাহাজ ছেড়ে চলে গেলো।
এর পরের কাহিনী বড় মজার। মুজাফফর সাহেব তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সারা চীন দেশ ঘুরে নানারকম, ব্যবসা-বাণিজ্য করে অনেক লাভের টাকা থলেয় ভরে আবার একদিন জাহাজে উঠে বসলো। জাহাজ চলতে থাকলো বসরাহর দিকে।
হঠাৎমুজাফফর সাহেবের খেয়াল হলো, আমার জন্যে কিছু কেনা হয়নি।রুমালের খুঁটে সেই পাঁচটা দিরহাম যেমন বাঁধা ছিলো, তেমনি বাঁধা পড়ে আছে। শেখ সাহেব কপাল চাপড়াতে লাগলেন, ইয়া আল্লাহ! একী করলাম! আমার এত কালের প্রাণের দোস্ত—তার ছেলে বৌকে আমি কথা দিয়ে এসেছি। সেই কথার খেলাপ হয়ে যাবে। না না, সে হয় না। তোমরা জাহাজ ফেরাও। আমি আবার চীনের বন্দরে নামবো। মহম্মদের জন্যে সওদা আমাকে করতেই হবে।
সঙ্গীরা অনেক বোঝালো, পাঁচটা তো মোটে দিরহাম, ওতে কী বা সওদা হবে, আর তা থেকে নাফাই বা কী হতে পারবে? এর জন্যে আপনি আবার এতটা পথ ফেরত যাবেন?কতদিন আমরা দেশ ছাড়া, মন আকুল হয়ে উঠেছে। এই সময় আরও দেরি হয়ে যাবে না?
শেখ বললেন, কিন্তু কী করা যাবে। আমি ওয়াদা করে এসেছি তাদের কাছে। তোমরা কী চাও, আমি মিথ্যেবাদী হই?
একজন বলে, মিথ্যেবাদী হওয়ার কথা উঠছে কেন? সে তো দিরহাম কটা দিয়েছিলো, কিছু সওদা করে আনতে। এবং সে সওদা বসরাহয় বিক্রি করে দু পয়সা নাফা করতে। তা আমরা যদি ঐ পাঁচ দিরহামের বদলে ওকে পুরো পাঁচটা দিনারই দিয়ে দিই—তাতেও কি সে খুশি হবে না? আপনি কি বলতে চান শেখ সাহেব, পাঁচটা দিরহাম খাটিয়ে সে পাঁচ দিনার নাফা করতে পারবে কখনও?
শেখ বললেন, তা হয়তো পারবে না। কিন্তু আমি তো মিথ্যেবাদী হয়ে থাকবো। সওদা কিছু না করেই যদি তাকে লাভের পয়সা হিসাবে পাঁচটা মোহর গুণে দিই তবে কী ইনসাফের দিক থেকে তা ঠিক হবে?
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো আটষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
এ কথার পর আর কেউ কথা বলতে পারে না। আবার জাহাজ ফিরে চলে চীন-বন্দরের দিকে।
কয়েকদিন পরে চীনের বন্দরে জাহাজখানা আবার গিয়ে ভিড়লো। শেখ মুজাফ্ফর বললো, তোমরা সকলে জাহাজেই অপেক্ষা করো। আমি সওদাটা সেরে আসি।
জাহাজ থেকে সবে শেখ সাহেব মাটিতে পা দিয়েছে ঠিক সেই সময় এক থুরথুরে বুড়ি একটা বুড়ো হ্যাংলা বাঁদরকে পেটাতে পেটাতে নিয়ে এলো তার কাছে।
-হ্যাঁ-গা পরদেশি, কিনবে এই বাঁদরটা? একেবারে জলের দামে দিয়ে দেব?
বুড়িটার প্রস্তাব শুনে মুজাফফর একটুক্ষণ চিন্তা করে বলে, কিন্তু মাত্র পাঁচটা দিরহামের সওদা আমার বাকী। আর সব হয়ে গেছে। তা পাঁচ দিরহামে দেবে কী তোমার এই বাঁদর?
বুড়িটা গদ গদ হয়ে বলে, খুব দেব, খুব দেব। তা পাঁচ দিরহামই আমার লাভ। এই নাও বাঁদর।
ব্যস, আর বেশি দূরে যেতে হলো না। শেখ মুজাফফর বাঁদরটাকে নিয়ে জাহাজে এসে উঠলো।
আবার জাহাজের মুখ ফেরানো হলো। এবারে আর কোথাও থামা নয়। সোজা বসরাহ।
কিন্তু এক জায়গায় এসে অল্পক্ষণের জন্যেও থামতে হলো।
একটা ছোট্ট দ্বীপ। চার পাশে সমুদ্র। সেই দ্বীপের কিনারে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে জাল ফেলছিলো। এক সময়ে সে একবার মাছের সঙ্গে একটা মুখ বাঁধা থলে তুললো। থলেটার মুখ খুলে মাটির ওপরে উপুড় করে ঢালতেই দেখা গেলো রাশি রাশি হরেক রকমের সব পাথর।
বাঁদরটা সব লক্ষ্য করলো। তারপরে আকারে ইঙ্গিতে কী যেন বোঝাতে চাইলো শেখ সাহেবকে। শেখ সাহেব ইঙ্গিত ইশারায় বলতে চাইলো—সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তখন বাঁদরটা বিরাট একটা লাফ দিয়ে পড়লো সমুদ্রের জলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেলো নিচে।
শেখ ভাবলো, বাঁদরটার মাথায় ছিট আছে। না হলে এই গহিন দরিয়ায় ঝাপ দেয় কখনও?
কিন্তু একটু পরেই সে উঠে এলো। হাতে একটা মুখ-বাঁধা থলে। বাঁধন খুলে থলেটা উপুড় করে দিলো। তাজ্জব ব্যাপার! নানারকম হীরে জহরতের একটা স্তুপ জমে উঠলো।
বাঁদরটা আবার ঝাপ দিলো জলে। আবার সে তুলে আনলো আর একটা থলে। সে থলেও হীরে চুনী পান্না মুক্তো এবং অমূল্য সব মণি-মাণিক্যে ভরা।
এইভাবে সে পর পর অনেকবার ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেকগুলো থলে তুলে নিয়ে আসে।
বসরাহর বন্দরে জাহাজ ভিড়লো। সারা শহরের লোক ভেঙ্গে পড়লো। চীন থেকে কি বাণিজ্য করে নিয়ে এসেছে শেখ মুজাফফর। দেখার জন্য দলে দলে মানুষ এসে ভীড় করতে লাগলো বন্দরে।
কিন্তু আমি গেলাম না। মা বললো, খবর পেলাম, শেখ সাহেবের জাহাজ ভিড়েছে। তা যা না বাবা। তার সঙ্গে দেখা করে আয়। দেখ গে, আমাদের জন্য কী সওদা সে এনেছে।
আমি বললাম, তোমার আর ধৈর্য মানছে না, মা। দিয়েছো তো ভারি পাঁচটা দিরহাম। তাতে কী এমন হাতী ঘোড়া আনবে সে? ঠিক আছে, নিজের কাজে যাও। যদি কিছু এনে থাকে, বহুত শেরিফ আদমী সে, নিশ্চয়ই তোমার ঘরেই পৌঁছে দেবে।
মা মুখ বেজার করে বক বক করতে চলে যায়। একেবারে কুড়ের বাদশা–
একটু পরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সর্বনাশ, মা বাড়িতে নাই। এখন কী উপায়? দরজা খুলে দেবে কে? আমি তো উঠতে পারবো না।
আরও জোরে জোরে নাড়তে থাকে কড়া।বাইরে থেকে কে যেন বেশ গলা চড়িয়েই হাঁকছে, কই গো, আবু আহম্মদ, শিগ্নির দরজা খোল, আমি মুজাফফর—তোমার চাচা। দেখ, তোমার জন্য কী এনেছি।
আমি কান পেতে উন্মুখ হয়ে শুনি! আরে চাচা মুজাফফরের গলা না? হঠাৎ আমার জড়তা কেটে যায়। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াই। প্রায় ছুটে গিয়েই দরজা খুলে দিই।
চাচা মুখ ভরা হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলো, তা তোমরা সব ভালো আছ বাবা?
–ভালোই আছি চাচা। আপনি কেমন ছিলেন?
-ভালো-খুব ভালো। তা শোনো, তোমার জন্যে এই বাঁদরটা এনেছি। পাঁচ দিরহাম দাম নিয়েছে।
মেজাজটা কেমন খিচড়ে গেলো আমার। শেষ পর্যন্ত একটা বাঁদর! নিজেদের খেতে জোটে —তার মধ্যে আর এক ভাগীদার? মনে মনে মা-এর উপর ভীষণ চটে উঠি।
এমন সময় জাহাজের খালাসীরা কতকগুলো মাল বোঝাই বস্তা এনে রাখলো আমার ঘরের সামনে। মুজফ্ফর সাহেব আমার নির্বোধ মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এসবও তোমার?
—আমার? তবে যে আপনি বললেন চাচা, বাঁদরটার দামই পাঁচ দিরহাম লেগেছে?
-হ্যাঁ বাবা, তা তো বলেছি। এবং সত্যিই পাঁচ দিরহাম দাম নিয়েছে ওর আগের মালকিন সেই চীনা বুড়িটা।
আমি আরও অবাক হই, তবে এই বস্তার মালগুলো কিনলেন কী দিয়ে?
—ওগুলো তো কিনিনি, বাবা!
-তবে?
—ওগুলো এই বাঁদর রোজগার করেছে বাবা।
-রোজগার করেছে? ঐ বাঁদরটা?
আমার আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না।
তখন মুজাফফর চাচা সব বৃত্তান্ত আমাকে খুলে বললো।
—এ সবই তোমার হকের ধন। নাও ভালো করে যত্ন করে তুলে রাখ। জীবনে সৎপথে থেকে তোমার বাবা অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করে গেছে। তোমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। তোমাকে পালন করছে। অথচ কত লোক তোক ঠকিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে আছে।
তবে এও ঠিক বাবা, সৎপথে অবিচল থাকা বড়ো কঠিন, কিন্তু কষ্ট করে চলতে পারলে আল্লাহ তার ইনাম দেন।
আমাদের দিন ফিরে গেলো।
সামান্য দুএকখানা জহরত বিক্রি করে আমি প্রভূত অর্থ পেলাম। সেই অর্থে বসরাহর সম্রান্ত এলাকায় একখানা প্রাসাদ এবং অন্যান্য আসবাবপত্র কিনলাম। আমার প্রাসাদে যাঁরা পায়ের ধুলো দেন, তারা সবাই অবাক হয়ে যান। অত দুষ্প্রাপ্য পর্দা গালিচা আসবাব এবং বিলাসের সামগ্রী নাকি কোনও সুলতান বাদশাহর প্রাসাদেও নাই। তবে বিশ্বাস করুন ধর্মাবতার, সে সব সংগ্রহ করতে এই ধরনের একটি দুটি মাত্র মণি-রত্ন আমাকে বিক্রি করতে হয়েছিলো। তারপর থেকে ঠিক করেছি আর একটিও বেচবো না। সারা দুনিয়ার জহুরী বণিকরা আমার প্রাসাদে নিত্য ধর্ণা দেয়। এক একটা রত্নের জন্য এমন এমন সব দামের লোভ দেখায়—যে-কোনও লোকই প্রলুব্ধ হয়ে পড়বে। কিন্তুআমার নগদ অর্থের কোনও প্রয়োজন নাই। যারা আসে, এক কথায় তাদের বিদায় করে দিই—না বিক্রি করবো না। কিন্তু ধর্মাবতার, আপনি আমাদের মালিক। আপনি যদি এগুলো গ্রহণ করেন, আমি ধন্য হবো। তবে সবিনয়ে বলছি, কোনও মূল্যের বিনিময়ে আমি এর একটিও বিক্রি করবো না। মেহেরবানী করে আমাকে কোনও ইনাম দিতে চাইবেন না।
খলিফা বললেন, বেশ, তাই হবে। কিন্তু সেই বাঁদরটা কোথায়, সে এখন তোমার কাছে আছে?
—না ধর্মাবতার। তাহলে বাকীটুকুও বলি শুনুন। মুজাফফর চাচা বাঁদরটা আমার হাতে দিয়ে বলে গিয়েছিলো, বেটা, এই জানোয়ারটা বড় পয়মন্ত—কোনও অনাদর বা অত্যাচার করো না একে।
আমি বললাম, আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে মানববা চাচা। আমারও মনে হয়েছে, এ সাধারণ কোনও বাঁদর নয়।
পরের বাড়ির কাজ সেরে মা ফিরে এলে জড়িয়ে ধরে বললাম, মা, তুমি দিন রাত আমাকে কত গঞ্জনা দিয়েছো—কেন কাজ-কর্ম করি না, কেন কুড়ের বাদশা হয়ে শুয়ে শুয়ে দিন কাটাই। কিন্তু আমি তোমাকে কী কথা বলতাম, মা? বলতাম, জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। তবে একনিষ্ঠ মন নিয়ে সেই আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেই চলতে হবে। তা দেখ, আমার কথা তো ফলে গেলো?
মা বললো, তুই ঠিক কথাই বলিছিলি বাবা, সত্যিই আল্লাহ যাকে দেন ছল্পর ফুঁড়েই দেন। তা হলে এই জিনিস আমরা পাই কখনও?
যাই হোক, দারুণ ভোগ-বিলাসের মধ্যে দিন কাটতে লাগলো। বাঁদরটাকে আমি একটা সোনার সিংহাসনে বসিয়ে রাখি। তার চার পাশে চারজন বাঁদী সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে তার হুকুম তামিল করার জন্য।
আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, ধর্মাবতার, এই বাঁদরটা আসার পর থেকে আমার সব কুড়েমি এক নিমেষে কেটে গিয়েছিলো। নতুন কর্মোদ্যমে মেতে উঠলাম আমি। বসরাহর বাজারে দোকান কিনলাম। বাগ-বাগিচা জমিজমা যেখানে যা ভালো কিছু পেলাম সব এক এক করে কিনে নিতে থাকলাম। এখন আমি ব্যস্তবাগীশ মানুষ। এত কাজের চাপ, নাওয়া-খাওয়ার সময় পাই না।
প্রায়।
যাই হোক, বাঁদরটার প্রতি আমার প্রখর দৃষ্টি ছিলো সদা সর্বদা। যেখানেই যাই, ওকে সঙ্গ ছাড়া করি না। আমি যা খাই ওকেও তাই খেতে দিই। এইভাবে দারুণ সখ্য গড়ে উঠেছিলো ওর
সঙ্গে। যদিও মুখে কথা বলতে পারতো না, কিন্তু কাগজ কলম দিলে সে তার মনের কথা লিখে। জানাতে পারতো।
একদিন আমরা দুজনে প্রাসাদে বসে আছি, এমন সময় বাঁদরটা আমাকে ইশারায় জানালো কাগজ কলম দিতে। আমি কাগজ কলম ও দোয়াত এনে দিলাম। সে লিখলো, আবু মহম্মদ, বাজার থেকে একটা সফেদ রঙের মোরগ কিনে এনে দাও আমাকে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বাজারে গেলাম। কী আশ্চর্য, সারা বাজার ছুঁড়ে একটি মাত্রই সাদা মোরগ পেলাম। যে দাম চাইলো, সেই দামেই কিনে নিয়ে এলাম। ঐ সময় বাঁদরটা আমার ফুলবাগিচার মধ্যে বসেছিলো। দেখলাম ওর থাবায় ধরা একটা সাপ।
আমার হাত থেকে মোরগটা নিয়ে সে সাপের সামনে ছেড়ে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বেঁধে গেলো তুমুল লড়াই। সে যে কী লড়াই, কেমন করে বোঝাই আপনাকে। সাপটা চেষ্টা করলো লেজটা জড়িয়ে মোরগটাকে আছড়ে মেরে ফেলতে আর মোরগটা চেষ্টা করতে লাগলো ওর গলাটা খামচে ধরতে। শেষ পর্যন্ত মোরগেরই জিত হলো। এক সময় সাপের গলাটা খামচে ধরে ঘায়েল করে ফেললো সে।
সাপটা মরে গেলো। কিন্তু মোরগরা সাপ খায় না।
এরপর বাঁদরটা মোরগটাকে দু’হাতে ধরে ডানা দুখানা ছিড়ে ফেললো। পালকগুলো একটা একটা করে বাগানের চারপাশে পুঁতে দিলো। এবং মোরগের ছাল ছাড়ানো দেহটা বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা গর্ত খুঁড়ে কবর দিয়ে রাখলো।
ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো একাত্তরতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে
এরপর বাঁদরটা বিরাট এক চিৎকার তুলে লাফ দিয়ে ওপরে ওঠে গিয়ে আকাশ পথে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আর কখনও ফিরে আসেনি।
কিন্তু বাঁদরটা শূন্যপথে মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগানের চারপাশে পুঁতে রাখা সেই পালকগুলোর প্রত্যেকটি এক একটা এই রকম সোনার ডালপালাওলা গাছ হয়ে গেলো। তাদের পাতাগুলো এই রকম পান্নার এবং ফলগুলো সব একই রকমই হীরে-মুক্তো মণি মাণিক্যের।
বাগানের মাঝখানে যেখানে মোরগের দেহটা কবর দেওয়া হয়েছিলো, সেখানে গজিয়ে উঠলো এক বিশাল মহীরূহ। এবং তারও কাণ্ড ডালপালা সোনার। পাতা পান্নার। ফলগুলো এইরকম হীরে জহরতের। কিন্তু সে তো অনেক বড়ো বৃক্ষ। সামান্য বাক্সে ভরে আনা সম্ভব নয়। ধর্মাবতার যদি ইচ্ছা করেন, ওটাও আপনাকে দিতে পারি আমি।
খলিফা বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হলেন। জাফরকে বললেন, জাফর এ কাহিনী আগামী দিনের মানুষের জন্য সোনার অক্ষরে লিখে রাখা দরকার।
জাফর বললো, ধর্মাবতারের যেরূপ অভিরুচি।
শাহরাজাদ গল্প শেষ করে থামে। সুলতান শারিয়ার বললো, এ বাহিনীর সার কথা বড়ো সুন্দর।