৩.১৩ উত্তরার্চিক — ত্রয়োদশ অধ্যায়

উত্তরার্চিক — ত্রয়োদশ অধ্যায়

এই অধ্যায়ের দেবতা (সূক্তানুসারে)-১।৩।১৫ পবমান সোম; ২।৪।৬।৭।১৪।১৯।২০ ইন্দ্র; ৫ সূর্য; ৮ সরস্বান; ৯ সরস্বতী; ১০ সবিতা; ১১ ব্ৰহ্মণম্পতি; ১২।১৬।১৭ অগ্নি; ১৩ মিত্র ও বরুণ; ১৮ অগ্নি বা হবি।
ছন্দ– গায়ত্রী, অনুষ্টুপ বৃহতী, প্রগাথ, ত্রিষ্টুপ, বর্ধমানা গায়ত্রী, অষ্টি, অতি শক্করী, ইত্যাদি বিভিন্ন মন্ত্রানুসারে নির্ধারিত।
ঋষি– প্রতিটি সূক্তের শেষে উল্লিখিত।

প্রথম খণ্ড

সূক্ত ১– পবস্ব বৃষ্টিমা সু নোহপামূর্মিং দিবম্পরি। অযক্ষ্মা বৃহীরিষঃ ১। তয়া পবস্ব ধারয়া যয়া গাব ইহাগমন্। জন্যাস উপ নো গৃহ৷৷ ২৷৷ ঘৃতং পবস্ব ধারয়া মজ্ঞেযু দেববীতমঃ। অস্মভ্যং বৃষ্টিমা পব৷ ৩৷ স উ উজং ব্যতব্যয়ং পবিত্রং ধব ধারয়া। দেবাসঃ শৃণবন্ হি কম্৷৷ ৪৷ পবমাননা অসিষ্যদদ রক্ষাংস্যপজঘনৎ। প্রত্নয রোচয়ন্ রুচঃ৷৷ ৫৷৷

সূক্ত ২– প্রত্যস্মৈ পিপীষতে বিশ্বানি বিদুষে ভর। অরঙ্গমায় জন্ময়েহপশ্চাদধ্বনে নরঃ ৷৷ ১। এমেনং প্রত্যেন সোমেভিঃ সোমপাতমম্। অমত্রেভিঋজীষিণমিন্দ্র সুতেভিরিন্দুভিঃ৷৷ ২৷৷ যদী সুতেভিরিন্দুভিঃ সোমেভিঃ প্রতিভুষথ। বেদা বিশ্বস্য মেধিরো ধৃষৎ তং তমিদেষতে৷৷ ৩৷৷ অম্মা অম্মা ইদন্ধসোহব্বর্যো প্র ভরা সুত৷। কুবিৎ সমস্য জেন্যস্য শর্ধতোহভিশস্তেরবসরৎ৷৷ ৪৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– হে দেব! স্বর্গলোক থেকে সুষ্ঠুভাবে অমৃতধারা বর্ষণ করুন এবং আমাদের অমৃতপ্রবাহ প্রদান করুন; অপিচ, আধিব্যাধিবিরহিত মহতী পরাসিদ্ধি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃতযুত পরাসিদ্ধি প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত অনুবাদ– হে সোম! চতুর্দিকে বৃষ্টিবারি বর্ষণ করো। নভোমণ্ডলের সর্বত্র জলের তরঙ্গ আনয়ন করো। অক্ষয় অন্নের মহাভাণ্ডার উপস্থিত করো। মন্ত্রের পদগুলির যে অর্থ গৃহীত হয়েছে, তাতে ভাবসঙ্গতি রক্ষিত হয়নি। সোম কিভাবে বৃষ্টিবারি বর্ষণ করবে? সোমের নিকট অক্ষয় অন্নের প্রার্থনাও বাতুলতা। এখানে সোমকে অধ্যাহার করবার কোন সার্থকতাই দেখা যায় না। অপং ঊর্মিং পদ দুটির ভাষ্যানুসারী অর্থ জলের তরঙ্গ। এই মন্ত্রার্থে এবং পূর্বাপর স্থানেও এই দুই পদের অর্থ অমৃতের প্রবাহই সঙ্গত]।

১/২–- হে শুদ্ধসত্ত্ব! যে রকমে জগতে বিদ্যমান জ্ঞান আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হয়, সেই রকমে প্রভূতপরিমাণে আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞানদায়ক, শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)।

১/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎকর্মসাধনে দেবত্বপ্রাপক আপনি প্রভূতপরিমাণে অমৃতবর্ষণ করুন; আমাদের অমৃতের ধারা প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [সাধনভজনের মূলবস্তু হৃদয়ের পবিত্রতা ও ঐকান্তিকতা। এই মন্ত্রেও তাই বলা হচ্ছে– শুদ্ধসত্ত্ব অর্থাৎ হৃদয়ের বিশুদ্ধতম পবিত্র ভাবই সৎকর্মে মানুষকে দেবত্ব প্রদান করে। যজ্ঞেষু দেববীতমঃ মন্ত্রের এটাই সারমর্ম]।

১/৪– হে শুদ্ধসত্ত্ব! প্রসিদ্ধ আপনি আমাদের আত্মশক্তি লাভের জন্য বিশুদ্ধ নিত্যজ্ঞান প্রভূতপরিমাণে আমাদের প্রাপ্ত করান; সকল দেবতা নিশ্চিতভাবে আপনার প্রদত্ত জ্ঞান গ্রহণ করুক)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি; শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমরা যে জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হই, সেই জ্ঞানের দ্বারা আমরা যেন দেবভাবসমূহ লাভ করি)। [জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষ অধিগত হয়, জ্ঞানের বলেই রিপুগণ বিধ্বস্ত হয়। জ্ঞানলাভ করলে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি আপনা-আপনিই ঘূৰ্তিলাভ করে। তাই আত্মশক্তি লাভের জন্য জ্ঞানপ্রাপ্তির প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১/৫– পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব রিপুগণকে বিনাশ করেন; চিরবর্তমান, নিত্য জ্যোতিঃ প্রদান করে তিনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -শুদ্ধসত্ত্ব রিপুনাশক হয়; জ্যোতির্ময় সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [নিত্যসত্যের মূলভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা, রিপুনাশ হয়। দ্বিতীয় অংশে আছে প্রার্থনা। শুদ্ধসত্ত্ব, নিত্যজ্ঞানের, দিব্যজ্যোতিঃব আধার। আমরা যেন তার সাহায্যে দিব্যজ্যোতিঃ লাভ করে ধন্য হই]। [এই সূক্তের ঋষি কবি ভার্গব]।

২/১– হে আমার মন! সত্ত্বভাবের সাথে মিলতে ইচ্ছুক, সর্বজ্ঞ, মোক্ষপ্রাপক, সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্ৰদাতা, সর্বশ্রেষ্ঠ, সৎকর্মের নেতৃস্থানীয় সেই দেবতার জন্য হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চার করো। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন ভগবানে অনুসারী হই)। [ভগবান্ সৎস্বরূপ। সেই সৎস্বরূপকে যদি পেতে চাও, তোমরাও সত্ত্বসম্পন্ন হও। শুধু মানুষই যে তাকে পাবার জন্য প্রার্থনা করে তা নয়, তিনিও মানুষকে পেতে ইচ্ছুক। পাপী হোক, পুণ্যাত্মা তোক, মানুষকে তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন না। বৎসই শুধু মায়ের দিকে ধাবিত হয় না, মাও তার সন্তানকে বুকে নেবার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। এই বাণীর মধ্যেই মহান্ সত্য নিহিত আছে। দ্বৈতের মধ্যে যে অদ্বৈতের সাড়া পাওয়া যায়, সসীমের মধ্যে যে অসীমের স্পন্দন অনুভূত হয়, তা-ই আমাদের গৌরবময় অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি যে আমাকে চান, এই সত্যই আমাদের কর্ণে গুঞ্জরিত হয়। এই মহতী আশার বাণীই আমরা এই মন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাই]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-১দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

  ২/২– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বের অধিপতিকে আরাধনা করো; প্রভূতপরিমাণে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের দ্বারা সর্বশক্তিমান প্রসিদ্ধ বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে সর্বতো ভাবে আরাধনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত হয়ে ভগবানকে আরাধনা করতে পারি)।

২/৩– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! যদি তোমরা.বিশুদ্ধ পবিত্র সত্ত্বভাবের দ্বারা ভগবানকে আরাধনা করো, তাহলে প্রাজ্ঞ, সর্বজ্ঞ, রিপুনাশক সেই দেবতা তোমাদের সেই সকল অভীষ্ট প্রদান করবেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ আরাধনাপরায়ণ সাধকের সর্বাভীষ্ট পূরণ করেন)। [এই সূক্তের প্রথমেই ভগবানকে সর্বজ্ঞ বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি জ্ঞানস্বরূপ, তিনিই সকল জ্ঞানের স্রষ্টা; সুতরাং তিনি প্রাজ্ঞ, সর্বজ্ঞ। ভগবানের আরাধনা অর্থে জ্ঞানের আরাধনা, জ্ঞানলাভের একনিষ্ঠ সাধনা। পূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্থাৎ পরিণামে দেবত্বপ্রাপ্তির বাসনা থাকলে জ্ঞানের সাধনা অপরিহার্য]।

২/৪– হে সৎকর্মসাধনে সহায়ভূত আমার মন! তুমি ভগবৎ-লাভের নিমিত্তই শুদ্ধসত্ত্বের বিশুদ্ধরস সেই দেবতাকে প্রদান করো; সকল জেতব্য শত্রুর বিনাশ করে সর্বজ্ঞ সেই দেবতা আমাদের পালন করুন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবৎপরায়ণ হই; সেই পরমদেব আমাদের রিপুকবল থেকে রক্ষা করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় অধ্বর্যো পদের অর্থ ধরা হয়েছে– ঋত্বিক, যিনি যাগযজ্ঞ ইত্যাদি সম্পাদন করেন। এই মন্ত্রার্থে কিন্তু সৎকর্মসাধনে সহায় মন-কেই ঐ পদে লক্ষ্য করা হয়েছে। নতুবা ঋত্বিককে উদ্বোধনা দেবে কে? — মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের মূলভাব রিপুনাশের জন্যই প্রার্থনা]। [এই সূক্তের ঋষি-ভরদ্বাজ বাৰ্হস্পত্য। সূক্তের অন্তর্গত চারটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– নানদ এবং গৌরীবিত]

.

দ্বিতীয় খণ্ড  

সূক্ত ৩– ববে নু স্বতবসেহরুণায় দিবিশে। সোমায় গাথমৰ্চত৷৷ ১। হস্তচুতেভিরদ্রিভিঃ সুতং সোমং পুনীতন। মধাবা ধাবতা মধু। ২৷৷ নমসেদুপসীদত দম্নেদভি শ্ৰণীতন। ইন্দুমিন্দ্রে দধতান৷৷ ৩৷৷ অমিত্ৰহা বিচৰ্ষণিঃ পবস্ব কোমশং গরে দেবেভ্যো অনুকাকৃৎ৷৷ ৪৷৷ ইন্দ্রায় সোম পাতবে মদায় পরিষিচ্যসে। মনশ্চিন মনসম্পতিঃ ৷৷ ৫৷ পবমান সুবীর্যং রয়িং সোম রিরীহি ণঃ। ইন্দ্রবিন্দ্ৰেণ নো যুজা। ৬।

সূক্ত ৪– উদ্ধেদভি এমঘং বৃষভং নর্যাপস। অস্তারমেষি সূর্য। ১৷ নব যো নবতিং পুরো বিভেদ বাহোজসা। অহিং চ বৃত্ৰহাবধীৎ। ২৷৷ স ন ইন্দ্রঃ সখাশ্ববদ গোমদ যমৎ। উরুধারে দোহতে। ৩।

মন্ত্রার্থ— ৩সূক্ত/১সাম– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা রিপুর কবল হতে রক্ষাকারী, পরমশক্তিশালী, জ্যোতির্ময়, মোক্ষদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্তির জন্য নিত্যকাল প্রার্থনা উচ্চারণ করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভের জন্য প্রার্থনাপরায়ণ হই)।

৩/২– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা পাষাণকঠোর সৎকর্ম সাধনের দ্বারা বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবকে পবিত্র করে অর্থাৎ তারপর, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করো; পরমানন্দদায়ক দেবতার হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে তার এ সাহায্যে পরমানন্দদায়ক ভগবানকে আরাধনা করতে পারি)।

৩/৩– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা ভক্তির সাথে ভগবানকে আরাধনা করো এবং আত্মসমর্পণের দ্বারাই তাকে পূজা করো (অথবা তার সাথে সম্মিলিত হও); ভগবানকে শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভক্তিসাধনের দ্বারা ভগবানে আত্মলীন হতে পারি)। [মানুষ যখন নিজের সমস্ত ভগবানে সমর্পণ করে, যখন তার আর নিজের বলতে কিছুই থাকে না, তখন ভগবানই তাকে কোলে তুলে নেন। এটাই মোক্ষ, এটাই নির্বাণ, এটাই জন্মজরামরণজনিত দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। সেই পরমধামে শোক নেই, দুঃখ নেই পাপজ্বালাসন্তাপ নেই। মানুষ তাই সেই নিত্যানন্দময় অবস্থা লাভ করবার জন্য ব্যাকুল। মন্ত্রের আত্ম-উদ্বোধনের মধ্যে এই আত্মলীন হওয়ার ভাবই পরিব্যক্ত]।

৩/৪– হে শুদ্ধসত্ত্ব! রিপুনাশক, সর্বজ্ঞ, অভীষ্টপ্রাপক আপনি দেবভাব প্রাপ্তির জন্য, পরাজ্ঞান লাভের জন্য পরমধন আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সেই ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের মোক্ষপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব এবং পরর্মমঙ্গল প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রচলিত ব্যাখ্যায়, সোমকে উদ্দেশ করা হয়েছে। সোম নাকি রিপুবিনাশক, সর্বদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। সোমের বিশেষণগুলি দেখলেই বোঝা যায়, বেদের সোম অর্থে সাধারণ মদ্য নয়—শুদ্ধসত্ত্ব]।

৩/৫– হে শুদ্ধসত্ত্ব! অন্তর্যামী হৃদয়াধীশ আপনি ভগবানের গ্রহণের জন্য এবং আমাদের পরমানন্দলাভের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা ভগবৎ-আরাধনার জন্য এবং পরমানন্দলাভের জন্য যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় মদায় পদের লক্ষ্য যেন ইন্দ্রদেব। কিন্তু মদায় পদের অর্থ পরমানন্দদানের জন্য। যিনি আনন্দময়, তাকে কে আনন্দ দিতে পারে? ব্যাখ্যাকারবৃন্দ এই অর্থ গ্রহণ না করে প্রমত্ত করা অর্থই গ্রহণ করেছেন। কারণ তাদের দৃষ্টি সোম নামক মাদকদ্রব্যের উপর]।

৩/৬– পবিত্রকারক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমাদের আত্মশক্তিদায়ক পরমধন প্রদান করুন; হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের ভগবানের সাথে সম্মিলিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা যেন ভগবানে আত্মলীন হতে পারি)। [মন্ত্রটিতে নির্বাণলাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। এই নির্বাণ বা মোক্ষপ্রাপ্তিই মানুষের চরম ও পরম লক্ষ্য]। [এই সুক্তের ঋষি অসিত কাশ্যপ বা দেবল]।

৪/১– হে জ্ঞানাধার স্বপ্ৰকাশ দেব! বিখ্যাতধনযুক্ত (অর্থাৎ সত্ত্বভাবরূপ পরমধনযুক্ত) যাচ্ঞাকারীদের প্রতি ধনবর্ষণকারী (অর্থাৎ সদা-দানধর্মপরায়ণ), জনহিতরত ও ঔদার্যগুণবিশিষ্ট সৎকর্মকারীর প্রতি (তাদের হৃদয়ে) আপনি উদিত হন। (ভাব এই যে, সৎকর্মশীল জনের হৃদয়ে আপনি উদিত হবেন, এ আর আশ্চর্য কি? আমাদের ন্যায় অকৃতী জনগণের অন্তরে যদি আপনি স্বপ্রকাশ হয়ে অবস্থান করতে পারেন, তবেই আপনার মহিমা বুঝব। অতএব প্রার্থনা– হে দেব! এই পাপাত্মা আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাকে উদ্ধার করুন)। অথবা– হে তেজোময় দেব! শ্রুতিসম্মত বাক্য-নিক্ষেপকারী অর্থাৎ লঙ্ঘনকারী, (সেইজন্য) নরের হিতকর কর্মের বিনাশক, অতএব পাপী এবং বৃষতুল্য (অর্থাৎ অজ্ঞান ও ক্রোধান্ধ), এমন যে আমি, আমার প্রতি (আমার হৃদয়ে) উদিত হয়ে অর্থাৎ জ্ঞানালোক দান করে আমাকে উদ্ধার করুন। (মন্ত্রের ভাব এই যে, হে তেজোময় দেব! শ্রুতিবাক্য-লঙ্ঘনে ও পরের এ অপকার সাধন করে, পাপের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ক্ৰোধান্ধ ও অজ্ঞান হয়েছি, আমাকে জ্ঞানের আলোক, – দান করে সৎপথ প্রদর্শন করুন)। [দুরকম অন্বয়ে মন্ত্রে একই প্রার্থনার ভাব প্রকাশ পেয়েদ্বে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ-২দ-১সা), প্রাপ্তব্য]।

৪/২– যে পরমদেব স্ববলে অসংখ্য রিপুদের আশ্রয়স্থান ভেদ করেন– ধ্বংস করেন অর্থাৎ সকল রিপু বিনাশ করেন এবং অজ্ঞানতানাশক যে দেবতা দুর্দান্ত রিপুকে বিনাশ করেন, সেই দেবতা আমাদের, রিপুগণকে বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি, প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের অজ্ঞানতা ইত্যাদি রিপুগণকে বিনাশ করুন)। [এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার যে আখ্যায়িকার অবতারণা করেছেন, তা ইতিপূর্বে অন্য মন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। তথাপি স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইন্দ্রদেব দিবোদাসনামক রাজার কল্যাণের জন্য শম্বর নামক অসুরের নিরানব্বইসংখ্যক পুরী বিনাশ করেছিলেন। এই মন্ত্রে কিন্তু শুম্বর বা দিবোদাসের কোন উল্লেখ নেই। ভাষ্যকার অন্য একটি মন্ত্রের সাহায্যে ঐ আখ্যায়িকার বিষয় প্রতিপন্ন করেছেন। এই ব্যাখ্যা দৃষ্টে কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, মন্ত্রে একটি প্রাচীন ভারতের যুদ্ধ বর্ণিত হয়েছে। নবনবতিং পদ আমরা পূর্বেও পেয়েছি। এই পদে যে কোনও নির্দিষ্ট সংখ্যা বোঝায় না, তা-ও দেখেছি। এমন সংখ্যাবাচক শব্দ বহু অর্থে প্রয়োগ হয়ে থাকে, নবনবতিং পদের অসংখ্য অর্থই এখানে সঙ্গত]।

৪/৩– মঙ্গলস্বরূপ বন্ধুভূত প্রসিদ্ধ সেই বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা আমাদের ব্যাপকজ্ঞানযুত, আত্মশক্তিদায়ক, পরাজ্ঞানযুত পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা এই– হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরমজ্ঞানযুত পরমধন প্রদান করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই কল্যাণকর বন্ধু ইন্দ্র, আমাদের উদ্দেশে অশ্বযুক্ত গোযুক্ত যবযুক্ত ধন প্রভূত পয়োবিশিষ্ট গাভীর ন্যায় দোহন করুন। আসলে গো ও অশ্ব শব্দ দুটিতে যথাক্রমে জ্ঞান ও ব্যাপকজ্ঞান বোঝায়। যব শব্দ অন্নার্থক, অর্থাৎ শক্তিবাচক; তাই যবমৎ পদে আত্মশক্তিদায়কঅর্থই সঙ্গত। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে গরু ঘোড়া ও ধান যব অর্থই গৃহীত হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি– সুকক্ষ আঙ্গিরস। এই তিনটি মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত গেয়গানের নাম—স্বারসৌপর্ণম]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৫– বিভ্রা বৃহৎ পিবতু সোম্যং মধ্বায়ুদধ যজ্ঞপতাববিহ্রত। বাতজুতো যো অভিরক্ষতি না প্রজাঃ পিপৰ্ত্তি বহুধা বি রাজতি৷১। বিভ্রাড বহুৎ সুভতং বাজসাতমং ধর্মং দিবো ধরুণে সত্যমর্পিতম। অমিত্ৰহা বৃত্ৰহা দস্যুহমং জ্যোতিৰ্জজ্ঞে অসুরহা সপত্নহা৷২। ইদং শ্রেষ্ঠং জ্যোতিষাং জ্যোতিরুত্তমং বিশ্বজিদ ধনজিদুচ্যতে বৃহৎ। বিশ্বভ্রাড ভ্রাজো মহি সূযো দৃশ ঊরু পথে সহ ওজো অচ্যুত৷৩৷৷

সূক্ত ৬– ইন্দ্র তুং ন আ ভর পিতা পুত্রেভ্যো যথা। শিক্ষা লো অস্মিন পুরুত যামনি জীবা জ্যোতির শীমহি। ১। মা নো অজ্ঞাতা বৃজনা দুরাধ্যোতমাশিবাসোহবক্রমুঃ। ত্বয়া বয়ং প্রবতঃ শশ্বতীরপোহতি শুর তরামসি৷ ২৷

সূক্ত ৭– অদ্যাদ্যা শ শ ইন্দ্ৰ ত্ৰাস্ব পরে চ নঃ। বিশ্বা চ নো চরিতুনসপত অহা দিবা নক্তং চ রক্ষিঃ । ১৷৷ প্ৰ ভঙ্গী শূরো মঘবা তুবীমঘঃ সম্মিশ্লো বীর্যায় কম। উভা তে বাহু বৃষণা শতক্রতো নি যা বজ্রং মিমিতুঃ৷৷ ২।

মন্ত্ৰার্থ— ৫সূক্ত/১সাম– পরমজ্যোতির্ময় দেব সৎকর্মসাধককে নিষ্কণ্টকে সৎকর্মসাধনশক্তি প্রদান করেন; তিনি আমাদের হৃদয়স্থিত মহান্ সত্ত্বভাবময় অমৃত গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদন করে তা গ্রহণ করুন)। আশুমুক্তিদায়ক ভগবান আত্মশক্তির দ্বারা লোকদের রক্ষা করেন এবং পালন করেন; অপিচ, তিনি বিশেষরূপে লোকবর্গকে জ্ঞানের জ্যোতিঃ প্রদান করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানই লোকগণের রক্ষক এবং পালক হন)। [মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ৫মী দশতির ২য় সামরূপে প্রাপ্তব্য]।

৫/২– হে ভগবন! আপনার কৃপায় আমাদের হৃদয়ে যেন জ্যোতির্ময়, মহৎ, আত্ম-উন্নতি বিধায়ক, আত্মশক্তিদায়ক, পাপ হতে রক্ষাকারী, দুলোকের আশ্রয়ে স্থাপিত অর্থাৎ স্বর্গজাত, সত্যস্বরূপ, রিপুনাশক, অজ্ঞানতানাশক, পরাজ্ঞান উৎপন্ন হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমমঙ্গলদায়ক পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [এখানে জ্ঞানের স্বরূপ প্রকটিত করা হয়েছে। পরাজ্ঞান– আত্ম-উন্নতি-বিধায়ক এবং আত্মশক্তিদায়ক। মানুষ জ্ঞানের বলেই যেমন আপন গন্তব্যপথ দেখতে পায়, ঠিক তেমনই ভাবে নিজের দুর্বলতা ত্রুটি-বিচ্যুতিও দেখতে পায়। জ্ঞানের সঙ্গে তার মধ্যে শক্তিরও সঞ্চার হয়, সুতরাং অনায়াসেই সে নিজের দুর্বলতা পরিহার করে মোক্ষমার্গে অগ্রসর হতে পারে। অপিচ, মানুষের প্রকৃত উন্নতিলাভের, জীবনের চরম পরিণতিলাভের জন্য যা কিছু প্রয়োজন পরাজ্ঞানের প্রভাবে মানুষ তার সবই লাভ করতে পারে। পরাজ্ঞান শত্রুবিনাশক। যিনি দিব্যজ্ঞানলাভে সমর্থ হয়েছেন, অজ্ঞানতামোহ ইত্যাদি রিপুগণ তার কাছ থেকে পলায়ন করে। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে জ্যোতিঃ পদের অর্থ করা হয়েছে– সূর্য; সুতরাং সেখানে সমগ্র মন্ত্রের ভাবই পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা জ্যোতিঃঅর্থে পরাজ্ঞানং এবং জজ্ঞে অর্থে উৎপন্না ভবতু গ্রহণ করে সমীচীন কর্মই করেছি]।

৫/৩– উত্তম মহৎ এই পরাজ্ঞান, মঙ্গলদায়ক বিশ্বাধিপতি পরমধনদাতা এবং সর্বজ্যোতিঃর ও আশ্রয়ভূত প্রকাশক (বলে) অভিহিত হন; জ্যোতির্ময়, বিশ্বের প্রকাশক, অজ্ঞানতানাশক, মহান জ্ঞানদেব আমাদের দিব্যদৃষ্টি লাভের জন্য নিত্যশক্তি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান এবং দিব্যশক্তি প্রদান করুন)। [জ্ঞানই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতিঃ। তাই বেদ বলছেন– ইদং জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ। অর্থাৎ জ্ঞান থেকেই সকল রকম জ্যোতিঃর উৎপত্তি। সেই জ্ঞানজ্যোতিঃ কেমন?– বিশ্বজিৎ, ধনজিৎ। জ্ঞানের প্রভাবে বিশ্ব জয় করা যায, পরমধন অধিগত হয়]। [এই সূক্তের ঋষি-বিভ্রাট সৌর্য]।

৬/১– হে পরম ঐশ্বর্যশালিন্ ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি আমাদের প্রকৃষ্ট জ্ঞান অথবা সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন; অপিচ, যে রকমে পিতা পুত্রগণের নিমিত্ত অর্থাৎ তাদের মঙ্গলের জন্য বিদ্যা এবং ধন প্রদান করেন, সেই রকমভাবে আপনি আমাদের সৎপথ প্রদর্শনের দ্বারা পরমধন ও পরাজ্ঞান প্রদান করুন। হে সকলের আকাঙ্ক্ষণীয় ইন্দ্রদেব! আপনার উদ্দেশে অনুষ্ঠিত সৎকর্মে প্রাণশক্তির অভিলাষী আমরা যেন প্রাণশক্তি-স্বরূপ জ্ঞানকিরণকে প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! পিতার মতো আপনি আমাদের সৎপথে নিয়ে চলুন। প্রজ্ঞানের দ্বারা উদ্ভাসিত সম্ভব-মণ্ডিত চিত্তের দ্বারা যাতে আমরা পরমধন লাভ করতে পারি, আপনি তা বিধান করুন)। অথবা– হে ভূতগণের প্রকাশক, সর্বভূতাত্ম ভগবন ইন্দদেব! পিতা যেমন নিজের সন্তানদের মঙ্গলকামনায় তাদের সৎপথ প্রদর্শন করেন, বিদ্যা এবং ধন প্রদান করেন, তেমনই আপনি আমাদের মঙ্গলের জন্য আমাদের পরমজ্ঞান প্রদান করুন এবং আমাদের সৎপথে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করুন। সকলের পূজনীয় বা সকলের আকাঙ্ক্ষণীয় হে ভগবন ইন্দদেব! সকলের অভিলষিত বা প্রাপ্তব্য প্রকৃতিতে– ব্রহ্মে অর্থাৎ আপনাতে স্থিত জীবনীশক্তির অভিলাষী আমরা যেন অহরহ প্রজ্ঞানরশ্মি অর্থাৎ পরমজ্যোতি সেবা করি অর্থাৎ প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এখানে পরমাত্মায় আত্ম-সম্মিলনের জন্য সাধক উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। যে কর্মের দ্বারা, যে জ্ঞানের দ্বারা, আত্মতত্ত্ব ভগবৎ তত্ত্ব অধিগত হয়, সেই পরাজ্ঞান ও পরাতত্ত্ব লাভের জন্য সাধক প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই। যে, হে সর্বভূতের আত্মস্বরূপ ভগবন! আপনি পিতার মতো পুত্ররূপী আমাকে সৎপথে নিয়ে চলুন এবং আমাকে আত্মজ্ঞান পরাজ্ঞান প্রদান করুন। তাহলেই আমি পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনে সমর্থ হবো)। [পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ ভাবের মধ্য দিয়ে, ভগবানকে দর্শন– এ এক উচ্চ আদর্শ– এ অতি মহান্ লক্ষ্য]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-৩দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৬/২– হে ভগবন! লুক্কায়িত অন্তর্নিহিত হিংসক দুষ্ট-অভিসন্ধিসম্পন্ন অমঙ্গলসাধক রিপুগণ আমাদের যেন পরাজয় না করে। হে সর্বশক্তিমন্ দেব! প্রার্থনাকারী আমরা আপনার কৃপায় রক্ষিত হয়ে যেন প্রভূত-পরিমাণ (অথবা নিত্য) অমৃতপ্রবাহ লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমরা যেন রিপুজয়ী হই; আপনার কৃপায় অমৃত লাভ করি)। [মন্ত্রের প্রথম অংশে রিপুকবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। রিপুগণের একটি বিশেষণ অজ্ঞাতাঃঅর্থাৎ লুক্কায়িত। প্রকাশ্য শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মানুষ সতর্ক হতে পারে, কিন্তু এ গোপন-শই সবচেয়ে ভীষণ। মানুষ তাদের শত্রু বলে জানতে পারে না, কখনও বা তারা মিত্ররূপে, কাছে থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি না থাকায় সে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পেরে মানুষ পরাজিত হয়, তাদের কবলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আবার, এমনই একদল গোপনশত্রু আমাদের হৃদয়েই বাস করে, তাদের দুরাধ্যঃ অর্থাৎ দুষ্ট-অভিপ্রায়-সম্পন্ন বলা হয়েছে। অমঙ্গলসাধক এই শত্রুর অনুচরগণ মানুষের অনিষ্ট করতে সদাই তৎপর। কেউ বলেন– শয়তান, কেউ বলেন– মার। প্রত্যেক সাধককেই কোন না কোনও সময়ে এদের সম্মুখীন হতে হয়। যিনি জ্ঞানী, যিনি ভগবৎপরায়ণ, তিনি তাদের স্বরূপ অবগত হয়ে তাদের পরিহার করেন এবং জ্ঞানবলে দিব্যশক্তিবলে এই রিপুবর্গকে পরাজিত করতে সমর্থ হন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের স্বরূপ জানতে পারে না; অনেক সময় তাদের কবলে আত্মবিসর্জন দেয়। যাতে সেই রিপুদের আক্রমণ থেকে উদ্ধারলাভ করা যায় সেই জন্যই মন্ত্রের প্রথমাংশে প্রার্থনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে আছে অমৃতলাভের প্রার্থনা। ভগবানের দ্বারা রক্ষিত হয়ে যেন আমরা অমৃতলাভে সমর্থ হই। [এই সূক্তের ঋষির নাম– বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি। এই সূক্তান্তৰ্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত ছটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম-মহাবৈষ্টভম, শ্যতম্‌, নৌধসম্, পৌরুমীঢ়ম, মানবাদ্যম এবং ভারদ্বাজম]।

৭/১– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! নিত্যকাল আপনি আমাদের পরিত্রাণ করুন; এবং সকল দিনে, রাত্রিদিনে অর্থাৎ সর্বকাল প্রার্থনাকারী আমাদের সকল বিপদ হতে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সকল বিপদ হতে সর্বকাল পরিত্রাণ করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে ইন্দ্র! অদ্য ও কল্য এবং পরেও আমাদের ত্রাণ করো। হে সাধুগণের পালক! আমরা তোমার স্তোতা, সকল দিন আমাদের রক্ষা করো। এই অনুবাদে একটু ত্রুটি আছে। বিশ্বা দিবা নক্তং চ পদগুলির মধ্যে নং পদের অর্থ অনুবাদে দেওয়া হয়নি। নক্তং শব্দের অর্থ রাত্রি। সুতরাং দিবা নক্তং পদদ্বয়ে রাত্রিদিন বোঝায়। তার সঙ্গে বিশ্বা বিশেষণ সংযোজিত হওয়ায় তার অর্থ দাঁড়িয়েছে সকল দিন রাত্রি অর্থাৎ সর্বকাল, নিত্যকাল। আবার মন্ত্রের প্রথম পাদে যে কয়েকটি কালবাচক পদ রয়েছে, তাদের অর্থও নিত্যকালেই পর্যবসিত হয়। যেমন– অদ্য অদ্য শ্বঃ স্বঃ পরে চ পদগুলির অর্থ আজ কাল পরশু প্রভৃতি দিনে। পরে চ পদে সীমাবিহীন কাল বোঝায়। সুতরাং বিছিন্ন কালবাচক পদগুলি একত্রে অনন্তকালকেই লক্ষ্য করছে]।

৭/২– শত্রুনাশক, সর্বশক্তিমান্, প্রভূতধনসম্পন্ন, পরমধনদায়ক পরমদেব শক্তিপ্রদানের জন্য আমাদের সাথে সম্মিলিত হোন; হে সৎকর্মশক্তিদাতা দেব! আপনার যে হস্তদ্বয় অভীষ্টবর্ষক, সেই উভয় হস্ত রিপুনাশক রক্ষাস্ত্র পরিগ্রহণ করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ শক্তিদানের জন্য আমাদের সাথে সম্মিলিত হোন, আমাদের সর্ববিপদ হতে রক্ষা করুন)। [এই সূক্তের ঋষি-ভর্গ প্রাগাথ]।

 .

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ৮– জনীযন্তো গ্ৰবঃ পুত্ৰীয়ন্তঃ সুদানবঃ। সরস্বন্তং হবামহে৷ ১।

সূক্ত ৯– উত নঃ প্রিয়া প্রিয়াসু সপ্তসা সুজুষ্টা। সরস্বতী স্তোম্যা ভূৎ৷৷ ১।

সূক্ত ১০– তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদ্দয়াৎ৷৷ ১৷ সোমানং স্বরণং কৃণুহি৷৷২৷৷ অগ্ন আয়ুংষি পবসে৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৩– তা নঃ শক্তং পার্থিবস্য। ১। ঋতমৃতেন সপন্তেষিরংক্ষমাশাতে। অহা দেবৌ বর্ধেতে৷৷ ২। বৃষ্টিদ্যাবা রীত্যাপেষম্পতী দানুমত্যাঃ। বৃহস্তং গর্তমাশাতে৷৷ ৩৷

সূক্ত ১৪– যুঞ্জন্তি ব্ৰধমরুষং চরন্তং পরি তন্তুষঃ। নোচন্তে নোচনা দিবি। ১। যুঞ্জন্ত্যস্য কাম্যা হরী বিপক্ষসা রথে। শোণা ধৃষ্ণু নৃবাহসা। ২৷৷ কেতুং কৃথন্নকেতবে পেশো মর‍্যা অপেশসে। সমুষট্টিরজয়থাঃ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৮সূক্ত/১সাম– শক্তিকামী ভগবৎ-আশ্রয়প্রার্থী সৎকর্মসাধক পুত্র কামনাকারী (অথবা মোক্ষকামী) আত্ম-উৎসর্গকারী আমরা জ্ঞানের অধিষ্ঠাতা দেবতাকে নিত্যকাল যেন আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আত্মশক্তি এবং ভগবৎ-আশ্রয় প্রাপ্তির জন্য আমরা যেন প্রার্থনাপরায়ণ হই)। [সূক্তটি একটি মন্ত্রে গ্রথিত। এটির ঋষির নাম– বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি]।

৯/১– সপ্তভগিনীরূপ গায়ত্রী ইত্যাদি সপ্তছন্দের দ্বারা সম্যকরূপে সাধকগণকর্তৃক আরাধিতা; অপিচ, আমাদের সর্বপ্রিয়ের মধ্যেও প্রিয়তমা জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবী আমাদের কর্তৃক আরাধিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরমকল্যাণদায়িকা জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবীকে আরাধনা করি)। [মন্ত্রটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা-(সপ্তনদীরূপ) সপ্তভগিনীসম্পন্না (প্রাচীন ঋষিগণ কর্তৃক) সম্যকরূপে সেবিতা, আমাদের প্রিয়তমা সরস্বতী দেবী যেন নিয়ত আমাদের স্তুতিভাজন হন। বন্ধনীর মধ্যস্থিত অংশও ব্যাখ্যাকারগণ কর্তৃক সংযোজিত। সপ্তস্বসা পদে ভাষ্যকার গায়ত্রী ইত্যাদি সপ্তছন্দকে লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে আবার নদীর সাথে তার তুলনাও করেছেন। ফলে মন্ত্রটি জটিল হয়ে উঠেছে। সরস্বতী পদ নিয়েও গবেষণার অন্ত নেই। কেউ বলেন এটি নদীবিশেষ, কেউ বলেন দেবী। আবার অন্য এক শ্রেণীর প্রত্নতাত্বিকেরা মনে করেন– সরস্বতী প্রথমে পাঞ্জাবের নদীর নাম ছিল বটে, পরে অর্থান্তর ঘটে দেবীতে পরিণত হয়েছেন। আমাদের মন্ত্রার্থে সরস্বতীজ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই গৃহীতা]। [এই সূক্তের ঋষি– ভরদ্বাজ বাৰ্হস্পত্য]।

১০/১– যিনি (জ্ঞানের উন্মেষকারী যে সবিতৃদেব) আমাদের বুদ্ধিকে সৎকর্মানুষ্ঠানে প্রকৃষ্টরূপে নিয়োগ করেন, সেই দ্যোতমান্ জ্ঞানপ্রেরক সবিতৃদেবের (পরব্রহ্মের) শ্রেষ্ঠ সর্বপাপনাশক জ্যোতিঃকে আমরা যেন ধ্যান করি। (ব্রহ্মের অনুচিন্তনে যেন আমাদের চিত্ত নিয়ত নিরত হয়)। (সর্বপাপের নাশক সৎবুদ্ধিপ্ৰদাতা সৎকর্মে প্রবৃত্তিবর্ধক যে সবিতৃদেব, তার পরম তেজ আমরা যেন সদা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত রাখি। মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক)। [এই মন্ত্রটি আর্যহিন্দুর অবশ্য নিত্যপাঠ্য, ধ্যেয়, প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্র। এটি গায়ত্রী ছন্দে গ্রথিত বলে গায়ত্রী আখ্যায় ভূষিত। আবার এর দেবতা সবিতা (সবিতৃ) বলে এটি সাবিত্রী মন্ত্র বলেও পরিচিত। গায়ত্রী নামের অন্য কারণও আছে, যথা– গায়ন্তং ত্রায়তে যস্মাৎ গায়ত্রী ত্বং ততঃ স্মৃতা। অর্থাৎ (মন্ত্র) গানকারীকে ত্রাণ করেন বলে আপনি গায়ত্রী নামে প্রসিদ্ধ– ইত্যাদি। কোনও কোনও পৌরাণিক ব্যাখ্যা এই যে, গায়ত্রী মন্ত্র সবিতৃ(সূর্য) দেবতার শক্তি বলেই এটি সাবিত্রী মন্ত্র নামে অভিহিত। ব্রাহ্মণকে যে প্রত্যহ এই মন্ত্রটি পাঠ বা উচ্চারণ করতেই হয়, তা-ই নয়, এই মন্ত্রের বিষয় সম্বন্ধে ধ্যানও করতে হয়। মন্ত্রের অন্তর্গত ধীমহি ক্রিয়া পদের দ্বারাই ধ্যানের বিষয় পরিস্ফুট হয়েছে। মন্ত্রার্থের একাংশেই বলা হয়েছে– জ্যোতিঃকে ধ্যান করি। ধ্যান না করলে বিষয়ের স্বরূপ উপলব্ধ হয় না। মন্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু পরমব্রহ্ম অথবা পরমব্রহ্মের জ্যোতিঃ। তার ধ্যানের দ্বারাই মানুষ তার প্রকৃতস্বরূপ অবগত হতে পারে। শঙ্করাচার্যের মতে-প্রণব ইত্যাদি সপ্তব্যাহৃতিযুক্ত গায়ত্ৰী সকল বেদের সার। যোগী যাজ্ঞবন্ধ্যের ব্যাখ্যা– পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ার্থ, পঞ্চ মহাভূত, মন বুদ্ধি আত্মা আর অব্যক্ত– এই চব্বিশটিই গায়ত্রীর অক্ষর। পরমপুরুষ প্রণব নিয়ে পঁচিশটি। তন্ত্রের মতে– গায়ত্রীর প্রথম অক্ষর অগ্নিদেবতা, দ্বিতীয় অক্ষর বায়ুদেবতা, তৃতীয় অক্ষর সূর্যদেবতা, চতুর্থ অক্ষর বিদ্যুৎদেবতা, পঞ্চম অক্ষর যমদেবতা, ষষ্ঠ অক্ষর বরুণদেবতা, সপ্তম অক্ষর বৃহস্পতিদেবতা, অষ্টম অক্ষর পর্জন্যদেবতা, নবম অক্ষর ইন্দ্রদেবতা, দশম অক্ষর গন্ধর্বদেবতা, একাদশ অক্ষর পূষাদেবতা, দ্বাদশ অক্ষর মিত্রাবরুণদেবতা, — এবং-ত্রয়োদশ থেকে চতুর্বিংশতি (চব্বিশ) পর্যন্ত অক্ষর যথাক্রমে ত্বষ্টা, বাসব, মরুৎ, সোম, আঙ্গিরস, বিশ্বদেব, অশ্বিনীকুমার, প্রজাপতি, সর্বদেবতা, রুদ্র, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুদেব। — এইভাবে স্বয়ং বিষ্ণুকর্তৃক গায়ত্রীর গুণব্যাখ্যা, তন্ত্রসম্মত অপর ব্যাখ্যা, মহানির্বাণ-তন্ত্রের ব্যাখ্যা, স্মার্ত ভট্টাচার্য রঘুনন্দনের ব্যাখ্যা, সায়ণাচার্যের ভাষ্য ইত্যাদিও পাওয়া যায়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাও অনেকরকমভাবে এই মন্ত্রটি ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলাতেও এই মন্ত্র সম্বন্ধে বহু পণ্ডিতের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন– (১) আমরা সবিতৃ দেবতার সেই বরণীয়, তেজ ধ্যান করি, যার প্রভাবে আমরা আপন আপন কর্তব্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হতে সমর্থ হই– সত্যব্রত সামশ্রমী। (২) সবিতৃদেবের বরণীয় তেজ আমরা ধ্যান করি, যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রেরণ করেন-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। (৩) যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সেই সবিতা দেবের সেই বরণীয় তেজ ধ্যান করি রমেশচন্দ্র দও। সবিতৃদেবতার বরণীয় তেজ আমরা ধ্যান করি, যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রেরণ করেনরমানাথ সরস্বতী। এত সব ব্যাখ্যা সত্ত্বেও প্রশ্ন ওঠে– যিনি অবামনসোগোচরঃ, যিনি বাক্যের অতীত, মনের অগোচর, ভাষায় কি তার পরিচয় দেওয়া যায়? সুতরাং সবিতা দেবতা বলতে, কার প্রতি লক্ষ্য আছে– তা ই বোঝাতে গিয়ে, সকল ব্যাখ্যাকারেরই গবেষণা পর্যদস্ত হয়েছে। যিনি নামরূপের অতীত, অথচ যাঁর নাম-রূপে বিশ্ব ব্যেপে আছে, সবিতা দেবতা নামে এখানে তিনিই নির্দিষ্ট হয়েছেন। তাকে পরব্রহ্মই বলা যাক, হিরণ্যগর্ভই বলা থাক, আর সবিতা দেবতাই বলা হোক– বিশ্বরূপে বিদ্যমান্ বিশ্বনাথই এখানকার লক্ষ]। [এই সূক্তটির ঋষি– বিশ্বামিত্র গার্থি]। [শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের পঞ্চত্রিংশী (৩৫) কণ্ডিকায় মন্ত্রটি পাওয়া যায়]।

১১/১– হে ভগবন! প্রার্থনাকারী আমাকে আপনার অনুগ্রহ লাভে সমর্থ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক প্রার্থনাকারী আমাকে উদ্ধার করুন)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকের ঐন্দ্ৰপর্বের অন্তর্গত (২অ-৩দ-৫সা) একটি মন্ত্রের প্রথম পাদমাত্র। এটি যজুর্বেদের তৃতীয় অধ্যায়ে ২৮ কণ্ডিকাতেও দ্রষ্টব্য]। [এই একটি মন্ত্রসমন্বিত সূক্তের ঋষি মেধাতিথি কাণ্ব]।

১২/১– হে জ্ঞানদেব! সৎকর্মসাধনশক্তি আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সৎকর্মসাধনসমর্থ করুন)। [মন্ত্রটি উত্তরার্চিকে (১৪অ-৩খ-১২-১সা) এবং ছন্দ আর্চিকেও (৬অ-৫দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]। [একটি মন্ত্রসম্বলিত এই সূক্তটির ঋষি– শত বৈখানস।

১৩/১– জ্ঞানভক্তিস্বরূপ সেই দেবদ্বয় আমাদের সৎকর্মসম্বন্ধিনী আত্মশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যজ্ঞাপক ও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের জ্ঞানভক্তিযুত আত্মশক্তি প্রদান করুন)। [এটি উত্তর আর্চিকেও (৮অ-৩খ-৪সূ-৩সা) প্রাপ্তব্য]।

১৩/২– সত্যের দ্বারা (অথবা, সৎকর্মের দ্বারা) সত্যকে (অথবা, সৎকর্মকে) মিলনকারী দেবদ্বয় শক্তিকামনাকারী সাধককে প্রাপ্ত হন; মঙ্গলসাধক হে দেবদ্বয়! আপনারা আমাদের প্রবর্ধিত করুন। আর (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! সত্যপ্ৰাপক আপনি আমাদের প্রবর্ধিত না এ করুন; জ্ঞান ভক্তি ইত্যাদি শক্তিসমন্বিত করুন)। [সত্যের দ্বারা সত্যকে মিলিত করার অর্থ এই যে, যিনি সত্য-অনুসন্ধিৎসু, তিনি ভগবানের কৃপায় সত্যকে লাভ করেন। তেমনইভাবে যিনি সৎকর্ম সাধনের ঐকান্তিক ইচ্ছা পোষণ করেন, ভগবান্ তার সেই সৎসঙ্কল্প পূর্ণ করেন]।

১৩/৩– অমৃতবর্ষী দ্যুলোকপ্রাপক, অভিমতফলদাতা পরমশক্তির অধিপতি দেবদ্বয় মহান গ্রহণীয় পরমধন সাধকদের প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — অভীষ্টবর্ষক, অমৃতপ্রাপক ভগবান্ সাধকদের পরমধন প্রদান করেন)। [এই সূক্তের ঋষি-যজত আত্রেয়]।

১৪/১– হে ভগবন! আপনি মহান্ সূর্যরূপে প্রকাশমান রয়েছেন; আপনি অগ্নিরূপে দীপ্তিমান্ আছেন; আপনি বায়ুরূপে বিশ্বভুবন ব্যেপে রয়েছেন, সেই আপনাকে স্বর্গমর্ত্য ইত্যাদি সৰ্বলোক অৰ্চনা করেন। দ্যুলোকে নক্ষত্রগণ প্রকাশমান হয়ে আপনারই মহিমা প্রকাশ করে থাকে। (ভাব এই যে, অগ্নি-বায়ুসূর্য ইত্যাদিরূপে ভগবান্ সর্বত্র সম্পূজিত হন। নক্ষত্রগণ তার মহিমা প্রকাশ করে)। [প্রচলিত বহু ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অভিনব মত প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সূর্য এবং নক্ষত্রপুঞ্জ নিশ্চল জড় পদার্থ বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। সূর্য ঘোটক-আরোহণে ভ্রমণ করেন, তাকালিক জনসাধারণের তেমন ধারণা ছিল, ব্যাখ্যায় সে ভাবও প্রকাশ পেয়েছে। জনৈক ব্যাখ্যাকারীর ব্যাখ্যা থেকে প্রতিপন্ন হয়, আদিত্য অগ্নি বায়ু নক্ষত্রপুঞ্জ সকলকেই দেবতার আসনে বসিয়ে স্তাবকেরা তাদের পূজা উপাসনা করতেন। ফলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে, বৈদিক মন্ত্র-সমূহ চাষার গানেঅর্থাৎ অসভ্য বর্বর জাতির জড়োপাসনায় পরিগণিত হয়েছে। -যতকিছু গণ্ডগোল– অরুষ শব্দ নিয়ে। ব্যাখ্যাকারেরা অরুষ শব্দের অর্থ করেছেন– ঘোটক। কিন্তু হিংসাৰ্থ রুষ ধাতু থেকে অরুষ শব্দ সিদ্ধ হয়েছে। যাঁর হিংসা নেই, অথবা যাঁর হিংসক নেই, তিনিই অরুষ ধাতু-অর্থ ধরে অর্থ গ্রহণ করলে, অরুষ শব্দে ঘোটক অর্থ নিষ্পন্ন হতে পারে না। সব গণ্ডগোল মিটে যায়। সূর্য অশ্বে আরোহণ করে ভ্রমণ করেন– এ বাক্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করা সুকঠিন। কিন্তু অরুষ শব্দে হিংসকরহিত বা হিংসারহিত অগ্নিদেবরূপে সেই ব্রহ্মের অন্যতম অভিব্যক্তির বিষয় উপলব্ধি করলে, মন্ত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব হৃদয়ঙ্গম হয়। সেই অর্থই সমীচীন, — সেই অর্থই শাস্ত্রসম্মত। এ মন্ত্রে, একের সেই বহু রূপের– সেই বিশ্বরূপের বিষয় উল্লেখিত হয়েছে। ইন্দ্রদেবের সম্বোধনে মন্ত্রটি প্রযুক্ত। সুতরাং এখানে ইন্দ্রদেব বলতে পরমেশ্বরকেই দ্যোতনা করছে। সূর্যরূপে, অগ্নিরূপে, বায়ুরূপে যিনি সর্বত্র বিরাজিত, তিনি অবশ্যই ইন্দ্রদেবনামে পরিচিত সেই পরমব্রহ্মই। এই মন্ত্র সেই পরব্রহ্মের রূপ-গুণেরই ব্যাখ্যান]।

১৪/২– (সাধুগণ) সেই ভগবানের আগমন উপযোগী রথে (নিজেদের মনোরথে) দুই পার্শ্বে (সৎ-অসৎ দুরকম কর্মে) কামনার উপযোগী, দমনশীল, ক্ষিপ্রগামী (বিচিত্রবর্ণ, জনবাহক, জ্ঞান ভক্তিরূপ অশ্বদ্বয়কে (জ্ঞানভক্তির জ্যোতিঃ) যোজনা করেন। (জ্ঞানভক্তির প্রভাবেই সাধুগণ ভগবানকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন– এই-ই তাৎপর্য)। [আসলে, এই মন্ত্রে বলা হচ্ছে– তোমার সৎকর্মনিবহ রূপ সারথিগণের দ্বারা তোমার মনোরথের উভয় পার্শ্বে জ্ঞান ও ভক্তিরূপ হরিদ্বয় (অশ্বদ্বয়) সংযোজিত করো। তার দ্বারা তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে, শত্রু বিমর্দিত হবে, তুমি ভগবানের পাদপদ্মে সংবাহিত (উপনীত) হবে। এটাই মন্ত্রের আধ্যাত্মিক অর্থ]।

১৪/৩– হে জ্যোতির্ময় ইন্দ্রদেব! আপনি অন্ধতমসাচ্ছন্ন জনের জ্ঞান দান করে, অরূপে রূপের বিকাশ দেখিয়ে, প্রতি ঊষায় প্রকাশমান হন। অথবা– হে ভগবন! অজ্ঞানতানিবন্ধন আমরা জন্মজরামরণের অধীন হয়ে আছি; আমাদের এই অজ্ঞানাবস্থায় প্রজ্ঞান দান করে মায়াবিম্ভিত আমাদের এই বিকৃতরূপকে সত্ত্বভাবযুত করে, আমাদের জ্ঞান-উন্মেষের সাথে আপনি আমাদের মধ্যে সম্যকরূপে অধিষ্ঠিত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! অজ্ঞানতার কারণে আমরা জন্মজরামরণের মধ্যগত এবং মায়ার দ্বারা বিকৃতভাবাপন্ন হয়ে আছি; সৎ-জ্ঞান বিতরণের দ্বারা আপনি আমাদের পরিত্রাণ করুন)। [এই মন্ত্রের দুরকম অর্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম প্রকারের অর্থই সাধারণতঃ প্রচলিত। কিন্তু শেষোক্ত প্রকারের অর্থই অধিকতর সঙ্গত ও সমীচীন বলে মনে করা যায়। প্রচলিত অর্থে প্রকাশ, — এই মন্ত্র যেন মনুষ্যগণকে (মর্যা) সম্বোধন করে প্রযুক্ত। মন্ত্রে যেন বলা হচ্ছে, হে মনুষ্যগণ এই আদিত্য অর্থাৎ সূর্যরূপ ইন্দ্রদেব, রাত্রির অন্ধকার দূর করে, নিদ্রায় সংজ্ঞা দান করে, অন্ধকারাবৃত অদৃশ্য সুতরাং রূপরহিত পদার্থে রূপ দান করে প্রতি ঊষাকালে রশ্মিমান হয়ে উদিত হন। এ অর্থে ভগবান্ রাত্রির অন্ধকার দূর করায়, তার জগৎপ্রকাশ ভাব দর্শনে স্তবকর্তা যেন বিস্ময় প্রকাশ করছেন। আর এক ব্যাখ্যায় ইন্দ্রদেবকে একজন যোদ্ধপুরুষরূপে কল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে এ মন্ত্রের ভাব অতি উচ্চ। এখানে কঠোপনিষদের সেই অমূল্য বাণী শ্রুতিপথে জাগ্রত হয়ে ওঠে– এই বিশ্ব তারই প্রকাশে প্রকাশমান হচ্ছে; তারই জ্যোতিঃ সকলকে জ্যোতিষ্মান্ রেখেছে। [এই সূক্তের ঋষি-মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ১৫– অয়ং সোম ইন্দ্র তুভ্যং সুম্বে তুভ্যং পবতে ত্বমস্য পাহি। ত্বং হ যং চকৃষে ত্বং ববৃষে ইন্দুং মদায় যুজ্যায় সোম৷ ১৷৷ স ঈং রথো ন ভূরিষাডযোজি মহঃ পুরূণি সাতয়ে বসূনি। আদীং বিশ্বা নহুষ্যাণি জাতা স্বর্ষা বন ঊর্ধ্বানবন্ত৷৷ ২. শুষ্মীশর্ধো ন মারুতং পবস্বানভিশস্তা দিব্যা যথা বিট। আপো ন ম সুমতিৰ্ভবা নঃ সহস্রাসাঃ পৃতনাষাণ ন যজ্ঞঃ ৷৷ ৩৷

সূক্ত ১৬– ত্বমগ্নে যজ্ঞানাং হোতা বিশ্বেষাং হিতঃ। দেবেভিমানুষে জমে। ১৷৷ স নো মন্দ্রাভিরধ্বরে জিহ্বাভির্যজা মহঃ। আ দেবান্ বক্ষি যক্ষি চ৷৷ ২৷৷ বেখা হি বেধো অধ্বনঃ পথশ্চ দেবাঞ্জসা। অগ্নে যজ্ঞেষু সুক্ৰতো৷৷ ৩৷৷

সূক্ত ১৭– হোতা দেবো অমর্ত্যঃ পুরস্তদেতি মায়য়া। বিদথানি প্রচোদ্দয়৷৷ ১৷৷ বাজী বাজে ধীয়তেইধ্বরেষ প্ৰণীয়তে। পো যজ্ঞস্য সাধনঃ৷ ২৷৷ ধিয়া চক্রে বরেণ্যো ভূতানাং গর্ভমা দধে। দস্য পিতরং তনা৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৫সূক্ত/১সামবলাধিপতি হে দেব! প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব আপনাকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে বিশুদ্ধ হোক; আপনাকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক; আপনি আমাদের হৃদয়স্থিত এই শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন; আপনি যে শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করেন সেই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের পরমানন্দপ্রাপ্তির জন্য এবং মোক্ষপ্রাপ্তির সহায়ের জন্য আপনিই গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনার প্রদত্ত আমাদের হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব আপনিই গ্রহণ করুন, অকিঞ্চন আমাদের অন্য কোনও পূজোপকরণ নেই)।

১৫/২– প্রভূতপরিমাণে পরমধন আমাদের দান করবার জন্য বহুপাপনাশক মহান্ প্রসিদ্ধ এই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সকলের সাথে মিলিত হোন; তারপর অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে উৎপন্ন অর্থাৎ ইহজগতে বর্তমান সকল মনুষ্য জ্যোতির্ময় মোক্ষপ্রাপক রিপুসংগ্রামে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্তির জন্য গমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — আমরা সকলে যেন পাপনাশক শুদ্ধসত্ত্বকে লাভ করি; বিশ্ববাসী সকল লোক শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে মোক্ষলাভ করুন)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– যেমন বিস্তরভারবহনক্ষম রথকে লোকে যোজনা করে, তেমনই সোমকে (সোমরসমাদকদ্রব্যকে) যোজনা করা হলো, কেননা তিনি প্রভূত ধন দেবেন। পরে তাবৎ ব্যক্তি ব্যস্তসমস্ত হয়ে স্বর্গলাভের দ্বারস্বরূপ সংগ্রামের মধ্যে প্রবিষ্ট হোক। এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যের পার্থক্য আছে। আমাদের মতের সাথেও ঐক্য নেই। বিস্তরভারবহনক্ষম রথের সাথে সোমের কি সাদৃশ্য আছে? কিম্বা তিনি প্রভূত ধন দেবেন-এর সাথে ভারবহনের কি সাদৃশ্য আছে, বোঝা যায় না। ভূরিষাট পদে প্রভূতভারবহনক্ষমঃঅর্থই প্রকাশ করে সত্য, কিন্তু সেই ভার কি? আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মধ্যে যে আবর্জনা মলিনতা ও পাপ রয়েছে, তা-ই এই ভার। আমাদের জীবনকে দুর্বিষহকারী এই পাপভার বহন করতে পারে, আমাদের পাপরাশি দূরীভূতকারী, আমাদের মোক্ষমার্গে– মুক্তির চরম সীমায় নিয়ে যায় যে বস্তু, তাকেই ভূরিষাট পদে লক্ষ্য করা হয়েছে। সেই বস্তু কি? মন্ত্রেই আছে সেই বস্তু রথঃঅর্থাৎ মোক্ষপ্রাপক স্বর্গে বহন করে নিয়ে যাবার উপযুক্ত যান– সৎকর্ম। — মন্ত্রটির দ্বিতীয় অংশে একটি বিশ্বজনীন প্রার্থনা আছে]।

১৫/৩– হে দেব! মুমুক্ষু সাধকগণ যেমন সৎ-ভাব-সমন্বিত হন, তেমনই সৎ-ভাব সমন্বিতদিব্যশক্তিসম্পন্ন আপনি বিবেকশক্তি তুল্য দিব্যশক্তি আমাদের প্রদান করুন; নিত্যকাল অমৃততুল্য অর্থাৎঅমৃতদায়ক সৎ-প্রবৃত্তি আমাদের হোক; বিশ্বরূপতুল্য শত্রুনাশক আপনি আরাধনীয় হন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সেই ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের দিব্যশক্তি প্রদান করুন; আমরা যেন সৎবৃত্তি-সম্পন্ন হই)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তুমি বায়ুর ন্যায় প্রবলবেগে বহমান হও; স্বর্গের অতি সুন্দর প্রজার ন্যায় (অর্থাৎ বায়ুর ন্যায়) বহমান হও। জলের ন্যায় বেগে ক্ষরিত হও। আমাদের সুমতি দাও। বহুসৈন্য বিজয়ী ইন্দ্রের ন্যায় তুমি আমাদের যজ্ঞভাগের অধিকারী। সহস্রদিক্‌ দিয়ে তোমার গতি। এই ব্যাখ্যাতে এবং ভাষ্যেও সোমকে প্রথমে বায়ুর সাথে এবং পরে ইন্দ্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যে বস্তু বায়ু ও ইন্দ্রের সাথে তুলনীয়, যে বস্তু মানুষের যজ্ঞভাগের অধিকারী, সেই বস্তু কি মানুষের সর্বনাশকারী মদ্য হতে পারে? আবার তার কাছে সুমতির প্রার্থনা! বর্তমান মন্ত্রে সোম শব্দই নেই, ভাষ্য ইত্যাদিতে তা অধ্যাহৃত হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষি উশনা কাব্য। এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম—ইহবদ্বাসিষ্ঠম]।

১৬/১– হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! আপনিই সকল সৰ্কর্মের প্রবর্তক হন; এই জন্মজরামরণশীল লোকে, প্রার্থনাকারী আমাদের পক্ষে সকল দেবভাবের সাথে এসে অর্থাৎ আমাদের সকল দেবভাবের অধিকারী করে, আপনি আমাদের হিতসাধক মঙ্গলপ্রদ হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, জ্ঞানের প্রভাবে আমাদের সকলরকমের মঙ্গল সর্বথা সাধিত হোক)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকে (১অ-১-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৬/২– হে জ্ঞানদেব! প্রসিদ্ধ আপনি আমাদের সৎকর্মে আপনার পরমানন্দদায়ক জ্যোতিঃদ্বারা মহৎ-ভাবসমূহকে আমাদের হৃদয়ে সমুৎপাদন করুন; এবং দেবভাবসমূহকে আহ্বান করুন ও আমাদের হৃদয়ে সমুৎপাদিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! জ্ঞানের দ্বারা আমরা যেন পরমানন্দদায়ক দেবভাবসমূহ লাভ করি)। [মন্ত্রে জ্ঞানাগ্নির প্রতিই লক্ষ্য রয়েছে। আমাদের অন্তরে যে জ্ঞানবীজ আছে, তা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলে মানুষ দেবত্বের অধিকারী হয়, আবার দেবত্ব এলে জ্ঞানের পূর্ণবিকাশ আপনা-আপনিই সাধিত হয়। এখানে জ্ঞানের সাহায্যে দেবভাব প্রাপ্তির প্রার্থনার মধ্যে জ্ঞানবিকাশের প্রার্থনাও নিহিত আছে। মোটের উপর, জ্ঞানাগ্নির সাহায্যে হৃদয় পবিত্র করে দেবত্বলাভই প্রার্থনার মুখ্য উদ্দেশ্য]।

১৬/৩– হে বিধাতঃ (বেধঃ)! (অথবা সর্বজ্ঞ) সৎকর্মসাধক দ্যুতিমন, হে জ্ঞানদেব! আপনিই আপন শক্তির দ্বারা আমাদের ভগবৎসাধনে জ্ঞানকর্মভক্তি ইত্যাদি সর্বসাধনমার্গ আমাদের জ্ঞাপন করুন। (মন্ত্রটি, প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের জ্ঞানকর্মভক্তিযুক্তকরুন)। [যজ্ঞেষু পদে একটা বিশিষ্টভাবের দ্যোতনা আছে। মানুষ যখন ভগবানের সাধনায় প্রবৃত্ত এ হতে চায়, যখন সে ভগবানের চরণে নিজের সমস্ত সমর্পণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়, তখন প্রকৃত সাধনমার্গে নিজেকে পরিচালিত করা প্রয়োজন। জ্ঞান মানুষকে সাধনার সেই বিচ্ছিন্ন পন্থা প্রদর্শন করে, অর্থাৎ জ্ঞানদেবতার কৃপায় মানুষ সেই সকল সাধনমার্গের পরিচয় লাভ করে। তাই বলা হয়েছে অগ্নে! অধ্বনঃ পথশ্চ বেত্থা– হে জ্ঞানদেব! আমাদের সকলরকম সাধনমার্গ পরিজ্ঞাপন করো]। [এই সূক্তটির ঋষি– ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য]।

১৭/১– সৎকর্মনিষ্পদক অমৃতস্বরূপ দেব, পরাজ্ঞান প্রদান করে আপন শক্তির সাথে আমাদের প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক পরাজ্ঞান প্রদান পূর্বক আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [মন্ত্রের প্রথম পদ হোতা। প্রচলিত মত এই যে, প্রজ্বলন্ত অগ্নিকে লক্ষ্য করেই এই পদ ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে অর্থ দাঁড়ায়– অগ্নিই যজ্ঞসম্পাদক, অথবা অগ্নি না হলে যজ্ঞসম্পন্ন হয় না। ঋত্বিক যখন যজ্ঞ করেন তখন দেব-উদ্দেশে হব্য ইত্যাদি প্রচলিত অগ্নিতেই প্রদত্ত হয়। অগ্নি সেই হব্য দেবতাদের নিকট বহন করে নিয়ে যান, তাই তিনি যজ্ঞের হোতা যজ্ঞনিম্পাদক। এটা হলো প্রচলিত মত। কিন্তু যদি মন্ত্রের লক্ষ্য অগ্নি-ই হয় তাহলে এই বাহ্য জগতে প্রকাশমান জ্যোতিঃর পশ্চাতে যে অনন্ত জ্যোতিঃ আছেন, তাঁর প্রতিই লক্ষ্য আসে না কি? যাঁর প্রভাব কণিকামাত্র লাভ করে পার্থিব অগ্নি জ্যোতিষ্মন, সেই পরমজ্যোতিঃস্বরূপের চিন্তা মনে আসেনা কি? তারপর অগ্নি বলতে যদি প্রজ্বলিত অগ্নিকেই মাত্র লক্ষ্য করা যায়, তাহলে প্রার্থনার সার্থকতা থাকে কি? এই অগ্নি কি আমাদের বিদথানি– পরাজ্ঞান দান করতে পারে? সুতরাং একথা মনে করা অসঙ্গত নয় যে, — অগ্নি শব্দে পরম অগ্নি, সেই দিব্যজ্যোতিঃ জ্ঞানকেই লক্ষ্য করা হয়। কিন্তু আলোচ্য মন্ত্রে অগ্নির কোন উল্লেখই নেই। জ্ঞানাগ্নি অর্থে যদিও মন্ত্রের অর্থ সম্পাদিত হতে পারে, তথাপি এটি ধারণা করাই সঙ্গত যে, ভগবৎ অর্থেই মন্ত্ৰাৰ্থ, মন্ত্রের অন্তর্গত প্রার্থনা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ভগবান্ মানুষকে সৎকৰ্ম-সাধনের শক্তি প্রদান করেন। তিনিই মানুষের হৃদয়ে বিবেকরূপে, জ্ঞানরূপে বর্তমান থেকে মানুষকে সৎকর্মসাধনে প্রবর্তিত করেন। এই সৎকর্মসাধনই তো যজ্ঞ। সুতরাং এই দিক দিয়ে ভগবানকেই হোতা বলা যায়]।

১৭/২– পরাজ্ঞানদায়ক সৎকর্মের উপায়স্বরূপ আত্মশক্তিদায়ক জ্ঞানদেব, রিপুসংগ্রামে সাধকগণকর্তৃক তাদের হৃদয়ে স্থাপিত হন, এবং সৎকর্মসাধনে হৃদয়ে উৎপাদিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সৎকর্মসাধকগণ পরাজ্ঞানের দ্বারা রিপুজয়ী হন)। [দুটি প্রধান বিষয়ের জন্য সাধকেরা জ্ঞানের সাহায্যলাভ প্রার্থনীয় মনে করেন। প্রথম রিপুজয়ের জন্য। যখন জ্ঞানের জ্যোতিঃ হৃদয়কে আলোকিত করে, তখন সেই জ্ঞানালোকের তেজ সহ্য করতে না পেরে রিপুগণ পলায়ন করে। দ্বিতীয়– সৎকর্মসাধন। জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হলে মানুষের প্রবৃত্তি সৎ হয়, কর্মপ্রচেষ্টা পবিত্র হয়। সাধকেরা তা অবগত আছেন বলেই সৎকর্মসাধনের জন্য জ্ঞানের সাহায্য লাভ প্রার্থনীয় মনে করেন]।

১৭/৩– সকলের প্রার্থনীয় যে জ্ঞানদেব সবৃত্তির (অথবা, সৎকর্মসাধনের) দ্বারা সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন, সর্বজীবের বীজশক্তিরূপ সেই বিশ্বপোষক জ্ঞানদেবকে সৎকর্মসাধকের আত্মশক্তি ধারণ করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মসাধক ধীশক্তির দ্বারা বিশ্বপালক পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [সমগ্র মন্ত্রের ভাব থেকে এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, মন্ত্রের লক্ষ্য এ জ্ঞানদেব। সুতরাং ধিয়া চক্রে পদ দুটির ভাব এই যে, সাধকেরা সৎ-বুদ্ধির দ্বারা, সৎকর্মের দ্বারা এ পরাজ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হন। এই দুই পদই মন্ত্রের মূলভাব প্রকাশ করছে। সেই জ্ঞান কেমন? বরণীয়ঃ অর্থাৎ সকলের প্রার্থনীয়। সেই জ্ঞান ভূতানাং গর্ভং, পিতরংঅর্থাৎ জ্ঞানদেব সকল প্রাণীর ও অন্তরেই বীজশক্তিরূপে বর্তমান আছেন, সর্বভূতের পালক ও রক্ষক তিনি। আবার কে এই পরমমঙ্গলদায়ক বস্তু লাভ করতে পারে? উত্তরে বলা হলো– দস্য তনা– সৎকর্মসাধকের আত্মশক্তি। অর্থাৎ আত্মশক্তিসম্পন্ন সাধকই পরাজ্ঞান লাভে সমর্থ হন। ভাষ্যকার এখানে কিন্তু দস্য তনা পদের এক পৌরাণিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে দক্ষ শব্দে দক্ষ প্রজাপতিকে বোঝাচ্ছে। না শব্দের অর্থ তনয়া অর্থাৎ আত্ম-উদ্ভূত শক্তি। কিন্তু ভাষ্যকারের মতে ঐ দুই পদে দক্ষ প্রজাপতির পুত্রী দেবীরূপা ভূমি। কিন্তু একথা আমরা পূর্বাপর উল্লেখ করেছি যে, অপৌরুষেয় বেদে কোন ব্যক্তিবিশেষের আখ্যায়িকার স্থান নেই]। [এই সূক্তের ঋষি– বিশ্বামিত্র গাথিন]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ১৮– আ সুতে সিঞ্চত শ্রিয়ং রোদস্যোরভিশ্রিয়। রসা দধীত বৃষভম্ ॥১॥ তে জানত স্বমোক্যং৩ সং বৎসাসো ন মাতৃভিঃ। মিথথা নসন্ত জামিভিঃ ॥২৷৷ উপ কেসু বঙ্গতঃ কৃথতে ধরুণং দিবি। ইন্দ্রে অগ্না নমঃ স্বঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ১৯– তদিদাস ভুবনেষু জ্যেষ্ঠং যততা জজ্ঞ উগ্রহ্রেষণঃ। সদ্যো জনো নি রিণাতি শৰ্জননু যং বিশ্বে মদ্যমাঃ ॥১॥ বাবৃধানঃ শবসা ভূর্যোজাঃ শৰ্দাসায় ভিয়সং দধাতি।

অব্যনচ্চ ব্যনচ্চ সমি সং তে নবন্ত প্রভৃতা মদেষু ॥২॥ ত্বে ক্রতুমপি বৃঞ্জন্তি বিশ্বে দ্বির্যদেতে ত্ৰিভব্যুমাঃ। স্বাদোঃ স্বাদীয়ঃ স্বাদুনা সৃজা সমদঃ সুমধু মধুমাভি যোধীঃ, ॥৩৷৷

সূক্ত ২০– ব্রিককেষু মহিষো যবাশিরং তুবিশুম্মস্তুম্পৎ সোমমপিব বিষ্ণুনা সুতং যধাবশ। সঈংমমাদ মহিকর্মকর্তবে মহামরুং সৈনং সশ্চদেব দেবং সত্য ইন্দুঃ সত্যমিম্ ॥১। সাকং জাতঃ তুনা সাকমোসা ববক্ষিথ সাকং বৃদ্ধা বীর্যেঃ সাসহিমৃধো বিচৰ্ষণিঃ। দাতা রাধঃ স্তুবতে কাম্যংবসু প্রচেতন সৈনং সশ্চদ দেবো দেবং সত্য ইন্দুঃ সত্যমিম্ ॥২॥ অধ ত্বিষীমা অভ্যাজমা ক্রিবিং যুধাভবদা রোদসী অপৃণদস্য মজমনা প্রবাধে। অধত্তান্যংজঠরে প্রেমরিচ্যত প্র চেতয় সৈনং সশ্চদ দেবো দেবংসত্য ইন্দুঃ সত্যমিম্ ॥৩।

মন্ত্রার্থ— ১৮সূক্ত/১সাম– হে বিশ্বদেবগণ! আপনারা আমাদের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে আমাদের মধ্যে পরমমঙ্গল অভিষিঞ্চন করুন; দ্যুলোকের অমৃতের সাথে অভীষ্টবর্ষক পরমমঙ্গল আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃতদায়ক পরমমঙ্গল প্রদান করুন)। [বিশ্বের সর্বদেবতাকে অর্থাৎ বিশ্বে অনুষ্যত ভগবানের বিভূতিকে লক্ষ্য করেই প্রার্থনাটি উচ্চারিত হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত আসিঞ্চত ও দধীত ক্রিয়াপদের দ্বারাও তা সমর্থিত হচ্ছে।

১৮/২– সাধকগণ তাদের আপন আশ্রয়স্থান জানেন; বৎস যেমন তাদের জননীকে প্রাপ্ত হয়, তেমনভাবে সেই সাধকগণ বন্ধুভূত সৎ-প্রবৃত্তির দ্বারা আপন পরমাশ্রয় প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা আপনা-আপনিই সৎ-বৃত্তির প্রভাবে ভগবানকে প্রাপ্ত হন)। [বৎস ও জননীর উপমার দ্বারা সাধকের স্বাভাবিক পরিণতি প্রদর্শিত হয়েছে]।

১৮/৩– জ্যোতিঃর দ্বারা পাপদহনকারী জ্ঞানাগ্নির রক্ষাশক্তি সাধকদের দ্যুলোক প্রাপ্ত করায়; হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা বলাধিপতি দেবতাতে এবং জ্ঞানদেবে ভক্তিযুত আরাধনা প্রেরণ করো। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের আরাধনাপরায়ণ হই; জ্ঞানদেব সাধকদের স্বর্গ প্রাপ্ত করান)। [এই সূক্তটির ঋষি-হর্ষথ প্রাগাথ]।

১৯/১– যাঁর হতে প্রভূতশক্তিসম্পন্ন, জ্যোতির্ময় দেবভাবসমূহ উৎপন্ন, সেই পরমদেবই সমগ্র বিশ্বে আবির্ভূত হন; সকল সাধক যে দেবতাকে আরাধনা করেন, সেই দেবতা বিশ্বে প্রাদুর্ভূত হয়েই রিপুদের বিনাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ থেকেই নিখিল চরাচর উৎপন্ন, সেই পরমদেবতা সর্বলোকের রিপুনাশক হন)। [মন্ত্রটিতে সৃষ্টিতত্ত্ব বিবৃত হয়েছে। ভগবান্ থেকেই নিখিল বিশ্ব, দেবগণ ইত্যাদি সবই সৃষ্ট হয়েছে। ভগবানই জগতের আদিভূত কারণ। তিনিই মানুষের (সৃষ্টিধ্বংসী) শত্ৰুকূল ধ্বংস করেন। — ভাষ্যে এই মন্ত্রে সূর্যাত্মক ইন্দ্রের উল্লেখ আছে, কিন্তু মূলে তা নেই। তবে সর্বদেবতা যে একাত্মক, তা প্রদর্শিত হয়েছে]।

১৯/২– বলের দ্বারা প্রবৃদ্ধ অর্থাৎ মহাশক্তিসম্পন্ন, দুর্ধর্ষ রিপুনাশক মদেব শত্রুদের ভীতি উৎপাদন করেন; হে দেব! স্থাবরজঙ্গমাত্মক সর্বভূতজাত আপনার কৃপায় পবিত্র হয়ে আপনার ১ পরমানন্দ প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ ৯ লোকদের রিপুনাশক হন; সকল লোক পরমানন্দ লাভ করুক)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সেই অতি শর্জনিধনকারী ইন্দ্র বিশিষ্ট বলে বলী হয়ে দাসজাতির হৃদয়ে ভয় সঞ্চার করে দেন। স্থাবরজঙ্গম সবর্ভূতকে তুমি সোমপানের আনন্দে সুখী করো, তাদের শোধন করো; তখন তারা তোমাকে স্তব। করে। এখানে ব্যাখ্যাকার সোমরসের কথা উত্থাপন করেছেন বটে, কিন্তু মূলে সোমরসের কোনও প্রসঙ্গ নেই। মদেষু সংনবন্তে পদ দুটি থেকে সোমরসের কথা আসতে পারে না, ভাষ্যকারও সোমরসের কোন কথা (এই মন্ত্রে) উত্থাপন করেন নি; এটি অনুবাদকারের উদ্ভাবন। দাসায় পদে ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার লিখেছেন-উপক্ষয়কাঁরিণে শত্ৰবে; এখানে দাস বা দস্যজাতির উল্লেখ নেই। এই মন্ত্রার্থে দাস পদে রিপুশত্রুদের লক্ষ্য করাই সঙ্গত হয়েছে। যারা আমাদের (রিপুর) দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে, যারা আমাদের মুক্তিলাভের অন্তরায় সেই রিপুদেরই দাস শব্দে লক্ষ্য করে। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে বিশ্বজনীন প্রার্থনার ভাব নিহিত আছে]।

১৯/৩– হে দেব। যাঁর হতে পরিদৃশ্যমান সকল লোক উৎপাদিত হয়, সেই আপনাকে সকল লোক সর্ব-সৎকর্মই সমর্পণ করে; হে দেব! আপনি মধুর হতে মধুর অর্থাৎ মধুরতম অভীষ্ট অমৃতের সাথে সংযযাজিত করুন; এবং পরমকাক্ষণীয় অমৃত অমৃতের সাথে সুষ্ঠুভাবে সম্মিলিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের অমৃত প্রদান করুন)। [যেহেতু মানুষ প্রভৃতি সমস্ত সৃষ্ট বস্তুই ভগবান থেকে এসেছে, সুতরাং তাতেই সাধকেরা নিজেদের কর্মাকর্মের পাপপুণ্যের ভার তারই চরণে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হন। এই মন্ত্রাংশে কর্মযোগের একটি কৌশল বিবৃত হয়েছে। মানুষ যে পর্যন্ত কর্মফলের অধীন থাকবে, সে-পর্যন্ত তার মুক্তিলাভ অসম্ভব। অথচ মানুষের পক্ষে কায়-মন-বাক্যে নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বনও অসম্ভব। মানুষকে কর্ম করতেই হবে এবং সেই কর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। কিন্তু এ থেকে কি মুক্তি লাভের উপায় নেই? আছে;মন্ত্রাংশেই তা প্রখ্যাপিত আছে। কর্ম করো, কিন্তু ফলাকাঙ্ক্ষা করো না। ভগবানের যন্ত্ররূপে কর্ম করে যাও। মেনে নাও, তুমিও তার, তোমার কর্মও তার, এই কর্মের ফলও তার। তখন কর্মফল তোমাকে আবদ্ধ করতে পারবে না। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে প্রার্থনা। ভগবান্ যেন আমাদের পরমধন অমৃত প্রদান করেন। অমৃতের সাথে অমৃতের সংযোগ হোক, আমাদের পরম প্রার্থনীয় অমৃততুল্য অভীষ্ট ভগবানের অমৃতময় করুণায় মিলিত হোক– আমাদের জীবন অমৃতময় ধন্য হোক, — এটাই প্রার্থনার সারমর্ম। [এই সুক্তের ঋষিবৃহন্দিব আথবণ। এই সূক্তটির অন্তর্গত মন্ত্র নিটির একত্রে যে গেয়গানটি আছে, সেটির নাম—শৈত্যম]।

২০/১– কর্মভক্তিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করবার জন্য, মহিমান্বিত সর্বশক্তিমান্ আত্মতৃপ্ত ভগবান সাধকের হৃদয়স্থিত বিশুদ্ধ অর্থাৎ সুসংস্কৃত পোষণশক্তিসম্পন্ন সত্ত্বভাব যথানুক্রমে (যথাযথভাবে) গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে তার সাথে সম্মিলিত হন)। আর সেই ভগবান্ মহৎ, সাধকের মঙ্গল সাধনভূত, প্রসিদ্ধ পতিত উদ্ধাররূপকর্ম করতে আনন্দ লাভ করেন; (তাই) সত্যপ্ৰাপক দীপ্তিযুক্ত সেই সত্ত্বভাব সত্যস্বরূপ দীপ্তিমন্ত মহত্বসম্পন্ন সর্বত্র প্রকাশমান পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে ব্যাপ্ত করে আছে। (ভাব এই যে, -ভগবান্ সত্যস্বরূপ সত্ত্বভাবময়)। [ভগবান্ সত্য ও সত্ত্বভাবের মধ্য দিয়ে সাধকের সাথে মিলিত হন। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ ১২দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

২০/২– হে দেব। সর্বজ্ঞ আপনি সৎকর্মের (অথবা প্রজ্ঞার) সাথে প্রাদুর্ভূত হন, দিব্যশক্তির সাথে বিশ্বকে ধারণ করেন, আত্মশক্তির সাথে প্রবৃদ্ধ হন, রিপুদের বিনাশক হন; প্রজ্ঞানস্বরূপ হে দেব! আপনি প্রার্থনাকারীর প্রতি ইষ্টসাধক ধনের, প্রার্থনীয় পরমধনের দাতা হন; আমাদের হৃদয়নিহিত সত্যভূত জ্যোতির্ময় শুদ্ধসত্ত্ব, প্রসিদ্ধ সত্যস্বরূপ জ্যোতির্ময় ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — দিব্যশক্তিসম্পন্ন সর্বজ্ঞ দেব সাধকদের রিপুবিনাশ পূর্বক তাদের পরমধন প্রদান করেন; সেই দেবতা আমাদের হৃদয়ে নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজোপচার গ্রহণ করুন]।

২০/৩– জ্যোতির্ময় দেব যুদ্ধের দ্বারা পাপকে বিনাশ করেন। তারপর আপন শক্তিতে দ্যুলোকভূলোক ব্যাপ্ত করেন; ভগবানের শক্তিতে বিশ্ব প্রবর্ধিত হয়; সেই দেবতা জ্ঞানকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করুন এবং শুদ্ধসত্ত্বও প্রদান করুন; হে দেব! আপনি আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন; আমাদের হৃদয়নিহিত দ্যোতমান সত্যভূত শুদ্ধসত্ত্ব, প্রসিদ্ধ জ্যোতির্ময় ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানই লোকবর্গকে পাপ থেকে ত্রাণ করেন, অর্থাৎ তিনিই লোকবর্গের পাপনাশক হন; সেই পরমদেবতা আমাদের রাজ্ঞান প্রদান করুন, আমাদের পূজোপহার গ্রহণ করুন)। [এই মন্ত্রটিও অনেকগুলি অংশে বিভক্ত। প্রথম তিনটি অংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভগবানই মানুষের রিপুবিনাশ করেন। তিনিই বিশ্বকে ধারণ করেন। তিনি বিশ্বব্যেপে বিরাজ করছেন। শেষাংশের প্রার্থনাটির মর্মপরাজ্ঞান ও শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্তি। শুদ্ধসত্ত্বই ভগবৎ-আরাধনার শ্রেষ্ঠ উপকরণ। সেই পূজোপকরণ লাভের জন্যই ভগবানের কাছে প্রার্থনা। এই মন্ত্রটির সৈনং সশ্চদ্দেবঃ দেবং সত্যঃ ইন্দুঃসত্যমিংঅংশটি পূর্ববর্তী দুটি মন্ত্রেও রয়েছে। এর ভাবার্থ-ভগবান্ সত্যস্বরূপ সত্ত্বভাবময় ইন। — একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– পরে দীপ্তিমান্ ইন্দ্র নিজের বলে ক্রিবিকে (অর্থাৎ ক্রিবিনামক অসুরকে) যুদ্ধের দ্বারা অভিভব করেছিলেন, তিনি নিজের তেজের দ্বারা দ্যাবাপৃথিবীকে সমন্তাৎ পূর্ণ করেছিলেন। সোমের বলে বিশেষভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ইন্দ্র একভাগ নিজের জঠরে ধারণ করে অন্যভাগ (দেবগণকে) প্রদান করলেন, সত্য ও দীপ্যমান সোম, সত্য ও দ্যোতমান ইন্দ্রকে ব্যাপ্ত করুক। ভাষ্যকার ক্রিবিবলতে ক্রিবিনামক অসুর উল্লেখ করেছেন। এই মন্ত্রার্থে পাপ ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। ইন্দুঃ– সোম নয়, শুদ্ধসত্ত্ব। [এই সূক্তের ঋষি– গৃৎসমদ শৌনক]।

ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত —

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *