৩.১২ দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ মঙ্গলবোধ
দ্বন্দ্ব এক জিনিস, বিদ্বেষ অন্য।
দ্বন্দ্ব শব্দটির দুটি বিপরীত অর্থ আছে।
দ্বন্দ্ব মানে সংঘাত; যেমন, স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আবার দ্বন্দ্ব মানে মিলন বা সমবায়; যেমন, দ্বন্দ্বসমাস।
স্বার্থের দ্বন্দ্ব ব্যাপারটা আরও একটু তলিয়ে ভাবা যাক। যে-বস্তু নিয়ে দ্বন্দ্ব একপক্ষ তার বেশি পেলে অন্যপক্ষের ভাগে কম পড়বে। দৃপক্ষই সেটা চায়। অতএব দ্বন্দ্ব। যে-সব বস্তুর বেলায় এই নিয়মটা খাটে না, সেই সব বস্তু দ্বন্দ্বের বিষয় হয় না। আসন নিয়ে কলহ হয়, যেহেতু আসনের সংখ্যা সীমাবদ্ধ; কিন্তু খোলা হাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণ। নেই। অপরিমেয় বস্তু সংঘাতের বিষয় হয় না। যে-সব বস্তুর পরিমাণ সীমাবদ্ধ, সেই সব নিয়েই কলহ।
পরিমেয় বস্তুর ভিতরও একটা অবস্থাভেদ লক্ষণীয়। এমন জিনিস আছে যার পরিমাণ, অবস্থাবিশেষে, বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার এমন বস্তুও সদা সর্বদাই চোখে পড়ে যার পরিমাণ সীমাবদ্ধ বটে, তবু পক্ষ বিপক্ষের সহযোগিতার ফলে সেটা বাড়ানো সম্ভব। মরুভূমিতে যদি শুধু একভাণ্ড জলই দুজনকে ভাগ করে নিতে হয়, তবে একজন বেশি পেলে অন্যে কম পাবেই। কিন্তু শিকার কিংবা ফলসংগ্রহ করতে গিয়ে দুজনের সহযোগিতায় সংগ্রহের মোট পরিমাণ বাড়তে পারে।
অবস্থাভেদটা শুধু বস্তুভেদের ওপর নির্ভর করে না, অনেকক্ষেত্রেই নির্ভর করে দৃষ্টি অথবা সময়ের প্রসারের ওপর। এই মুহূর্তে প্রত্যেকটি জিনিসের পরিমাণ নির্দিষ্ট। কিন্তু আরও একটু বেশি সময় যদি চিন্তার পরিধির ভিতর আনা যায়, তবে অধিকাংশ বস্তুর পরিমাণ আর কঠিনভাবে নির্দিষ্ট থাকে না। আবারও সহযোগিতার ভিতর দিয়ে পরিমাণ বাড়াবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। অর্থাৎ যে-সব জিনিস নিয়ে দ্বন্দ্ব তাদের পরিমাণ তাৎক্ষণিক কিংবা সাময়িক দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট, কিন্তু দূরদৃষ্টিতে সম্ভাব্যতার সীমা আরও বিস্তৃত।
বাঞ্ছিত বস্তুর পরিমাণ যেখানে অনড়ভাবে নির্দিষ্ট এবং প্রার্থীর সংখ্যা একাধিক, সেখানে সংঘাতের বিকল্প সহজে চোখে পড়ে না। তবে সেখানেও একটা কথা আছে। যে বস্তুর পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়, তারও রক্ষা প্রয়োজন। কলহের ফলে সবই নষ্ট হতে পারে। একে বলা যেতে পারে, সর্বনাশ। এই সর্বনাশের সম্ভাবনাটা যদি বিবেচনার ভিতর থাকে তবে দ্বন্দ্ব আবারও অবস্থাবিশেষে সংঘাতের সীমা ছাড়িয়ে রূপ নিতে পারে সমবায়ে।
অতএব স্বার্থবুদ্ধি অবস্থা ও দৃষ্টিভেদে কখনও আমাদের এক পথে চালিত করে, কখনও অন্য পথে। স্বার্থের দিগন্ত যদিও সীমাবদ্ধ, তবু স্বার্থবুদ্ধি কিছুটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। নয়তো। ওটা বুদ্ধিই নয়। স্বার্থকামনা আর স্বার্থবুদ্ধি এক বস্তু নয়। স্বার্থের সঙ্গে বুদ্ধি যোগ হলে তবেই সেটা স্বার্থবুদ্ধি হয়ে ওঠে। স্বার্থবুদ্ধি কিছুটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলেই একান্তভাবে। সংঘাতমুখী নয়, বরং সংঘাত ও সহযোগের চিন্তা তাতে একই সঙ্গে বর্তমান।
অপর পক্ষে বিদ্বেষ নর্থক; তাতে সহযোগের চিন্তা নেই। বিদ্বেষে কোনো আলোকিত স্বার্থবুদ্ধি নেই। দ্বন্দ্বে একটা সমম্বয়ের আভাস আছে, বিদ্বেষে কোনো সমম্বয়ী বুদ্ধি নেই। অবশ্য বিদ্বেষের পিছনেও একটা প্রবলভাবে অস্বীকৃত গোপন অনুরাগ থাকে। কিন্তু অন্ধ কর্তৃত্বের শক্তি নিয়ে অস্বীকারের জোরটাই সেখানে প্রধান।
.
২
দ্বন্দ্বের নানা রূপ। এক, উপজাতীয় অথবা বিরোধী আত্মীয়গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব। ধর্মযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ এই সব কিছুতে উপজাতীয় দ্বন্দ্বের ছায়া পড়েছে। দুই, ব্যবসায়িক অথবা আর্থিক দ্বন্দ্ব। এর আধুনিক উদাহরণ, ব্যবসায়িক সংস্থার ভিতর বাজার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই দুই প্রকার দ্বন্দ্বের মিশ্রণ ঘটে যেমন, জমি নিয়ে প্রাচীন কলহে। তুলনায় ক্রেতা ও বিক্রেতার কলহ ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের পরিচ্ছন্ন দৃষ্টান্ত। অর্থই অনর্থের একমাত্র কারণ নয়। আরও আছে পদাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা নিয়ে লড়াই। দ্বন্দ্ব চলে কখনও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, কখনও গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে।
ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব গোষ্ঠীবদ্ধ হলেও সেখানে স্বার্থটা প্রাথমিক; আর উপজাতীয় দ্বন্দ্বে, আত্মীয়তার বন্ধনটা প্রাথমিক। কখনও আবার গোষ্ঠীতে সংঘবদ্ধ স্বার্থের সংঘাতও, উত্তেজক অথবা বিদ্বেষযুক্ত মতাদর্শের প্রভাবে, ধর্মযুদ্ধের সাদৃশ্য লাভ করে। দ্বন্দ্বের এই আরও একটি বিশেষ রূপ। এই বৈচিত্র্যই সত্য; দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বিভিন্ন রূপের পিছনে কোনো অদ্বিতীয় মৌল পদার্থের সন্ধান করা বৃথা।
যুক্তিধর্মিতায় অভ্যস্ত এ যুগে অনেকে ভেবে থাকেন যে, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব মূলত স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে চালিত। মানুষের চেতনার একটি বিশেষ স্তরকে এঁরা সম্পূর্ণ চেতনার প্রতিনিধি বলে ধরে নেন। তারপরও যদি মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ থেকে যায়, সেটাকে নানাভাবে দূরে ঠেলে দেবার যুক্তি উদ্ভাবন করা কঠিন হয় না। যথা, চিন্তায় খানিকটা সরলীকরণ অপরিহার্য; যেটা মৌল অথবা প্রধান সেটাকে গৌণ থেকে পৃথক করতেই হবে; স্বার্থবুদ্ধিই হল মৌল অথবা প্রধান। এইরকম একটা যুক্তি তখন সমর্থনযোগ্য মনে হয়।
কিন্তু মানুষ বস্তুত একমাত্র স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে চালিত হয় না। চৈতন্যের আরও একটা অধঃস্তর আছে, আরও একটা উধ্বস্তর আছে। নাগর ও সংস্কৃত চেতনার প্রভাবে আমরা বিদ্বেষকে যথাসম্ভব যুক্তি ও স্বার্থবুদ্ধির পোশাক পরিয়ে শুধু অপরের সমক্ষেই নয়, নিজের কাছেও উপস্থিত করি বটে। তবু, বিদ্বেষ ও স্বার্থবুদ্ধি এক বস্তু নয়। আবার মঙ্গলবোধ স্বার্থবুদ্ধির অধিক কিছু। অবশ্য মিশ্রণ সর্বত্র। মূর্তি নির্মাণে যেমন নতুন উপাদান মিলিত হয়, মূর্ত জীবনে তেমনি চেতনার বিভিন্ন উপাদান মিলে মিশে এক হয়ে যায়। তবু সব উপাদান সর্বত্র একভাবে মেশে না; মিশ্রণের তারতম্যে মিশ্র বস্তুর গুণভেদ ঘটে।
এই মিশ্রণের উদাহরণ দেওয়া সহজ। তার আগে বিদ্বেষের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ। উল্লেখ করা যাক। বিদ্বেষদৃষ্টিতে একের অস্তিত্বই অন্যের অস্তিত্বের ওপর একটি আক্রমণস্বরূপ মনে হয়। বিদ্বেষ্টা ও বিদ্বিষ্টের সংঘাতের ফলে সাংসারিক অর্থে হয়ত উভয়ের সমূহ ক্ষতি। দুয়ের সহযোগিতায় দুয়েরই স্বার্থরক্ষার পথ তুলনায় প্রশস্ততর। কিন্তু একের অস্তিত্বই যখন মূলত অন্যের কাছে অসহ্য, সহযোগিতার চিন্তার দ্বার তখন স্বভাবত রুদ্ধ। বিদ্বেষ স্বার্থবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে। স্বার্থবুদ্ধি সর্বনাশ চায় না, সর্বপ্রকারে অন্যের ধ্বংসও কামনা করে না। স্বার্থবুদ্ধি অপর ব্যক্তিকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। স্বার্থদৃষ্টিতে অপরের একটি উপকরণমূল্য আছে। তার বেশি নেই। মঙ্গলবাধে তারও বেশি আছে। বিদ্বেষের আন্তরিক কামনা অপরের অস্তিত্ব নাশ করা অথবা তাকে নিজের অস্তিত্বের অংশ করে নেওয়া। একই কারণে বিদ্বেষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশের পথে অন্তরায়। যে-সব গোষ্ঠীর ভিতর বিদ্বেষভাবের প্রাধান্য, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবুদ্ধি সেখানে দুর্বল। গোষ্ঠীর সঙ্গে একটা অন্ধ একাত্মতা সেখানে প্রবল।
সম্প্রদায় অথবা গোষ্ঠীতে সংহত সামাজিক বিদ্বেষের উদাহরণ হিসেবে জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ ও ধর্মবিদ্বেষের নাম সহজেই মনে আসে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের দেশবিভাগের পিছনে এই রকম একটা বিদ্বেষভাব ছিল। হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে অবশ্য হিন্দু ও মুসলমানের আর্থিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখাবার চেষ্টা হয়েছে। যেখানেই দুই সম্প্রদায় আছে, সেখানেই তাদের। ভিতর স্বার্থের সংঘাত দেখানো যায়। আবার সহযোগিতার ভিতর দিয়ে উভয়ের উন্নতির পথও খুঁজে নেওয়া সম্ভব। বিদ্বেষের দৃষ্টিতে প্রথমটি প্রকাণ্ড আকার ধারণ করে, দ্বিতীয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। দেশবিভাগের আন্দোলনে স্বার্থ অবশ্যই ছিল, কিন্তু তাকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। নয় তো অল্প কিছু লোকের স্বার্থের পিছনে এতো মানুষের ব্যক্তিবুদ্ধিবিধ্বংসী এমন অন্ধ সংহতি সেদিন সম্ভব হত না। দেশবিভাগের বিভীষিকাময় দিনগুলির রক্তপাত এবং উন্মত্ততারও অন্য কোনো ব্যাখ্যা হয় না। সম্প্রদায় হিসেবে একের অস্তিত্বই সেদিন অন্যের চোখে যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল।
আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষেও এই রকম একটা বিদ্বেষের শক্তি অনুভব করা যায়। নয়তো সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করা কঠিন হত না। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা এদেশে যে ঘৃণ্যরূপে দেখা দিয়েছে, তার পিছনে আমরা যতই স্বার্থের দ্বন্দ্ব খুঁজি না কেন, সামান্যমাত্র দূরদৃষ্টিতে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, ওটা কারো পক্ষেই আজ স্বার্থসিদ্ধির পথ নয়, বরং দেশময় সর্বনাশের পথ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গকে একসঙ্গে বাস করতেই হবে। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষ এই সহাবস্থানের ওপর একটা কালো ছায়ার মতো নেমে এসেছে। এটা শুধু ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানের ব্যাপার নয়। ধনী ও নির্ধন শ্বেতাঙ্গের ভিতর এই তিক্ত ব্যবধান নেই; নির্ধন কৃষ্ণাঙ্গ ও দরিদ্র শ্বেতাঙ্গের ভিতরও ভ্রাতৃত্ব অনুপস্থিত। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের পাশের দেশ মেক্সিকোতে বর্ণবিদ্বেষের সেই করাল মূর্তি নেই। নেই পেলের লাতিন আমেরিকায়, যেখানে তাঁকে নাম দেওয়া হয়েছে কালো মুক্তো বা কালোমণি।
ধনিকের সঙ্গে শ্রমিকের যে সম্পর্ক, তার মূলে আছে স্বার্থ। আর বর্ণবিদ্বেষের মূলে আছে বিদ্বেষ। এ দুটোকে প্রায় মিলিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এরা অভিন্ন নয়। আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশ স্পেন। শোষণের হিংস্রতায় সে অন্য কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশ থেকে পিছিয়ে ছিল না। অথচ সেখানে বর্ণবিদ্বেষ তুলনায় কম। এর একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে। তাতে প্রবেশ না করেও মূল কথাটা মেনে নেওয়া যায়। শোষণ ব্যাপারটাতে স্বার্থের গণনা প্রধান। সমবর্ণের মানুষের ভিতরও শোষণ সম্ভব, যার উদাহরণ পাওয়া যাবে এদেশেই। বর্ণবিদ্বেষটা আছে রক্তে এবং সংস্কারে। অবস্থার চাপে এ দুটো অল্প বেশি মিশে যায়। তখন মানুষে মানুষে সম্পর্কের সমস্যা হয়ে ওঠে আরও তিক্ত এবং জটিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর সংগ্রামটা ছিল বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে। সেই বিদ্বেষের রক্তচক্ষুতে তিনি সেদিখেছিলেন মানবতার সর্বনাশ।
চার্চিল ভারত ছাড়তে চান নি। সাম্রাজ্য অটুট রাখতে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনিই তো বলেছিলেন, সাম্রাজ্যের শ্রাদ্ধে পৌরোহিত্য করবার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিনি। অথচ যুদ্ধের পর ব্রিটিশ শ্রমিক সরকারের কাছ থেকে এলো ভারতের স্বাধীনতা। তবে কি জাতীয় স্বার্থবুদ্ধি শ্রমিক দলের নেতাদের কম ছিল? হয়তো তা নয়, অন্তত সেটা প্রধান কথা নয়। হয়তো জাতীয় স্বার্থটা শ্রমিক দলের নেতারাই আরও পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন। চার্চিলের ভাষায় ছিল সেই আভিজাত্যের ঔদ্ধত্য যেটা স্বার্থবুদ্ধিকেও অন্তত আংশিকভাবে আচ্ছন্ন করে, যার সঙ্গে মিল আছে বর্ণবিদ্বেষের। উগ্র দক্ষিণপন্থী নেতারা ঝুঁকেছিলেন এমন একটা সংঘাতের দিকে যেখানে স্বার্থবুদ্ধির চেয়েও বিদ্বেষটা বড়। শ্রমিক নেতারা সেই বিপত্তি থেকে দেশকে পরিত্রাণ করলেন। হিটলারের। নেতৃত্বে কিন্তু জামার্নিতে বিদ্বেষের শক্তিটাই বড় হয়ে উঠেছিল।
এই রকমই ঘটে থাকে। বিদ্বেষ আসে স্বার্থবুদ্ধির মুখোশ পরে, তারপর সর্বনাশ ঘটায়। আমাদের ইতিহাসে কুরুক্ষেত্র সেই বিপর্যয়ের প্রতীক। কৌরব পক্ষের নেতা যদিও বলেছিলেন, যুদ্ধ বিনা সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে তিনি সম্মত নন, তবু ঐ ঘোষণায় জমিজমা সংক্রান্ত স্বার্থবুদ্ধির প্রাধান্য খুঁজতে যাওয়া ভুল। বংশগত কলহে চিরকালই বিদ্বেষের প্রাধান্য, আর বণিকবুদ্ধিতে প্রাধান্য স্বার্থের। আধুনিক যুগে যদিও ব্যবসায়ী বুদ্ধি প্রবল তবু এ যুগেও সেই বুদ্ধি শুধু অংশত জয়ী। প্রথম মহাযুদ্ধের পিছনে কোনো সুচিন্তিত স্বার্থবুদ্ধি ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পিছনেও নয়। সমগ্র মেদিনী জয়ের হুংকারকে স্বার্থবুদ্ধি মনে করা ভুল। আর্থিক অথবা কোনো প্রকার স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিয়েই ইতিহাসের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না। গৃহকলহ, জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।
.
৩
স্বার্থের দ্বন্দ্বের সঙ্গে গৃহকলহের সুর মিশে এযুগের রাজনীতি একটা বিশেষ রূপ পেয়েছে। এ বিষয়ে আলোচনার গোড়াতেই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্বন্ধে কয়েকটি কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া প্রয়োজন।
কোনো এক যুগে, অন্তত পশ্চিমী দেশগুলিতে, মধ্যবিত্তশ্রেণীর একটি প্রধান অবলম্বন ছিল বাণিজ্য। আজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চেহারা পালটে যাচ্ছে। নতুন মধ্যবিত্তের অন্যতম প্রধান অবলম্বন, আমলাতন্ত্র তথা শাসনযন্ত্র। এই ঝোঁকটা আজ বিশ্বব্যাপী। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোনো সরল বর্ণনা আর বাস্তবানুগ নয়। এই শ্রেণীতে একদিকে যেমন আছেন ছোট দোকানদার থেকে শিল্পপতি পর্যন্ত, যাঁদের অবলম্বন ব্যবসায়, অন্যদিকে তেমনি আছেন শাসনযন্ত্রে নিযুক্ত ছোট করণিক থেকে বড় আমলাগণ, যাঁরা সবাই বাঁধা চাকুরীজীবী। তাছাড়া আছেন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন কাজে অধিষ্ঠিত কর্মী, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা অধ্যাপক এবং এই রকম অন্যান্য চাকুরীজীবী। আরও আছেন আইনজীবী ও চিকিৎসাজীবীর মতো বিশেষ সম্প্রদায়, যাঁরা প্রচলিত অর্থে ব্যবসায়ী নন, আবার পুরোপুরি চাকুরীজীবীও নন। আমলারা এদেশে সবযুগেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক প্রধান অঙ্গ ছিলেন। আজ রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর কি-ধনতান্ত্রিক কি-সাম্যবাদী সবদে শামলা সম্প্রদায় নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচেয়ে পরিচিত অংশ।
বাণিজ্যে দ্বন্দ্ব অর্থ নিয়ে; রাজনীতিতে ক্ষমতা নিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব যে-ক্ষমতার ভিত্তি। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা ও কয়েকটি বড় বড় যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে এই শতকে রাষ্ট্রযন্ত্র ক্রমশ আরও শক্তিশালী, আরও ব্যাপক ও সংগঠিত হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য মনে হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী হিংসাত্মক আন্দোলনের ফলেও মোটের ওপর রাষ্ট্রের শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াই আরও গুরুত্ব লাভ করেছে। এই ক্ষমতার লড়াইয়ে দুপক্ষেরই নেতারা আসেন প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর থেকে। অর্থাৎ, আজকের রাজনীতি প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিতর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
এই দ্বন্দ্বে ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধি আছে, আবার তারও অতিরিক্ত কিছু আছে। ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধির দিক থেকে এর মিল ব্যবসায়ী বুদ্ধির সঙ্গে। ব্যবসায়ী বুদ্ধির বিবর্তন আছে, রূপভেদ আছে। আজকের রাজনীতিতে তার নতুন রূপ! রাজনীতির বুদ্ধির এই ব্যবসায়িক দিকটা নমনীয়, চতুর ও স্বার্থসন্ধানী। এর দীর্ঘ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। উদাহরণ হাতের কাছে। রাজনীতিতে ঘনঘন দল পরিবর্তন এদেশে আজ সাধারণ ঘটনা। যিনি কাল ছিলেন নব কংগ্রেসে, তিনি আজ জনতা দলে। আগামী কাল সম্ভবত আবারও কংগ্রেসে। যিনি একদা ছিলেন কম্যুনিস্ট দলে, অতঃপর নব কংগ্রেসে, তিনি অদ্য জনতা। অথবা মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট দলে, হয়তো একাধিক দলে। দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নির্বুদ্ধিতা মতবাদ বাহ্য এবং প্রয়োজনে জীর্ণবস্ত্রের মতো পরিত্যাজ্য; যেমন ব্যবসায়ে তেমনি রাজনীতিতে, স্বার্থের গণনাই মৌল পদার্থ।
কিন্তু রাজনীতির আরও একটা দিক আছে, যেটা মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে, ঊর্ধ্বে। অথবা অধঃস্তরে টেনে নিয়ে যায়। যাকে আমরা বলি ভাবাদর্শ অথবা আইডিঅলজি, সেই বিশ্বপ্রতিভাস এবং আদর্শ কল্পনারও রাজনীতির ওপর একটা প্রভাব আছে। এই প্রভাবের দুই ভিন্ন দিক সংক্ষেপে আলোচনা করব।
জাতীয়তাবাদের মন্ত্রদাতারা দেশের একটা আদর্শরূপ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। তাতে একই সঙ্গে ছিল প্রাকৃতপ্রেম এবং কর্তব্যের আহ্বান। জাতীয়তাবাদ আমাদের স্বাভাবিক মমতার পরিধিকে ক্ষুদ্র পারিবারিক প্রাঙ্গণ থেকে তুলে স্বদেশ ও সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে স্থাপন করতে চেয়েছে। সেই বৃহত্তর মমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের মাতৃমূর্তি। শৈশবের মুগ্ধ স্মৃতি ও যৌবনের প্রাণচঞ্চল কমেন্মুখ আদর্শচিন্তার উপাদানে সেই মূর্তি নির্মিত। এই স্বদেশ প্রেম একদা রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। ঐ পর্যায়ের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ গানের জন্য তাঁর কাছে আমরা ঋণী। কিন্তু রাজনীতির আবর্তে ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জাতীয়তাবাদের যে রূপান্তর তিনি লক্ষ করেন জাপানে, তাতে তিনি শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের রচিত গানই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। তবু মনে রাখা ভালো যে, কোনো পার্থিব নেতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য ঐ। গানটি রচিত হয়নি, বরং জনগণমঙ্গলদায়ক কোনো ‘চিরসারথি’ই ঐ গানে বন্দিত।
রাজনীতির সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সংযোগে দুটি বিপরীত প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়। একদিকে এতে রাজনীতিতে একটা আদর্শনিষ্ঠার সঞ্চার হয়। অন্যদিকে আবার ক্ষমতার উন্মাদনায় এবং যুথবদ্ধ স্বার্থের আকর্ষণে জাতীয়তাবাদ নিম্নস্তরে নেমে আসে। দেশপ্রেমের নামে তখন জন্মলাভ করে এক নতুন অসহিষ্ণুতা, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশে যেটাকে রবীন্দ্রনাথ পরিপন্থী বলে জানতেন। এদেশে জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে যে-পরিমাণে জাতিপাঁতির সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত একটি বৃহত্তর কর্মভিত্তিক নীতিবোধ সৃষ্টি করা যাবে সেই পরিমাণেই তার সার্থকতা। সংঘবদ্ধ স্বার্থের দ্বন্দ্বে যে-জাতীয়তাবাদ আবদ্ধ নয়, বরং নিজেকে যে বার বার অতিক্রম করে যায় জনগণমঙ্গলদায়ক চিন্তায় ও কর্মে, তাকে নিয়েই দেশের মুক্তি।
এ যুগের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ভাবাদর্শ সাম্যবাদ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সমিতির যে আন্দোলন, স্বার্থের দ্বন্দ্বই তাতে স্বাভাবিকভাবে প্রধান। মজুরী বৃদ্ধি, কর্মীদের অবস্থার উন্নতি, এই সব ঐ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। কিন্তু সাম্যবাদী আদর্শকল্পনা শ্রমিক আন্দোলনকে ঐ সীমাবদ্ধ স্বার্থের দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে একটা মহত্তর প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছে। এক শোষণমুক্ত সমাজের কল্পনা সাম্যবাদী চিন্তায় স্থান পেয়েছে এবং শ্রমিক শ্রেণীকে সেই সমাজের পথিকৃৎ ও বিপ্লবী অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধনিক শ্রেণীর। বিনাশের পথেই নতুন সমাজের জন্ম এবং মনুষ্যজাতির মুক্তি। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সঙ্গে সাম্যবাদের সংযোগে আবারও শুভাশুভ দুটি বিপরীত ফল দেখা গেছে। নতুন মতাদর্শের প্রভাবে বহু মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেছেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মতো সাম্যবাদী সংগ্রামেও শহীদের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বের অনিবার্য ফল হিসেবে একটা প্রবল বিদ্বেষের শক্তিও এই আন্দোলনে জমা হয়েছে। জাতীয়তাবাদীর থাকে স্বাজাত্যাভিমান, সাম্যবাদীর আছে শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান। শ্রেণী-শ্রেষ্ঠত্বের এই প্রত্যয় কার্যত দলীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রত্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে। শ্রেণী বিদ্বেষের ঐতিহাসিক অনিবার্যত পরিণত হয়েছে দলীয় বিদ্বেষে। এইভাবে গড়ে উঠেছে অসহিষ্ণুতার এক নতুন তাত্ত্বিক ভিত্তি।
তত্ত্বের চোখে সাম্যবাদী স্বদেশপ্রেম আর আন্তজাতিকতার মধ্যে বিরোধ নেই, থাকতে পারে না। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সেই তত্ত্বকথা মানা হয়নি। সোভিয়েত দেশ আজ চীনের চোখে হিংসার আগুন দেখছে, চীন দেখছে সোভিয়েতের চোখে। এই হিংসার উৎস কোথায়? চীন ও সোবিয়ে দেশের ভিতর কোনো কোনো ব্যাপারে বাস্তব স্বার্থের সংঘাত আছে ঠিকই। কিন্তু বহু ব্যাপারে সাম্যবাদী সহযোগিতার সুযোগও কম নেই। তবু সংঘাতটা হয়ে উঠেছে বড়, সহযোগিতার সুযোগ উপেক্ষিত। বিদ্বেষ আবারও যুক্তির। মুখোশ পরে এসেছে। উভয় পক্ষেই তর্কের সুরটা কর্কশ, অসহিষ্ণু! স্বার্থবুদ্ধিই হয়তো এই কলহের রাশ টেনে আছে, দু’পক্ষকেই সর্বনাশ থেকে সংযত করছে। এই রকমই। ঘটেছে সোবিয়েত ও মার্কিন দেশের দ্বন্দ্বে। তবু স্থায়ী শান্তির জন্য স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু প্রয়োজন।
রাজনীতির একটা ক্ষেত্র আছে, থাকবে, যেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব অনিবার্য। কিন্তু যুক্তি এবং অভিজ্ঞতা আমাদের আরও একটা কথা ধীরে ধীরে জানিয়ে দিয়ে যায়। বৃহত্তর মঙ্গলবোধের একটা সীমার ভিতর দ্বন্দ্বকে আবদ্ধ রাখতে না পারলে, শেষ অবধি মানবতার সর্বনাশ।
অতএব দ্বন্দ্বের তিনটি স্তর। প্রথম স্তরে আধিপত্য বিদ্বেষের। দ্বিতীয় স্তরে, যুক্তি ও স্বার্থের। কিন্তু যুক্তির অবলম্বন যদি হয় শুধুই স্বার্থ, ব্যক্তিগত অথবা দলীয়, তবে সেই যুক্তিও সুর হারিয়ে বারে বারে নেমে আসে বিদ্বেষে। অবশেষে মঙ্গলবাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবেই সে রক্ষা পেতে পারে। ইতিহাসে এই রকমই ঘটেছে বারে বারে। শুভবুদ্ধির ভিত্তিতে ছোট বান্ধব সমিতি রূপে যার জন্ম, ক্রমে তারও বাইরের চেহারা এবং ভিতরের চরিত্র দুয়েরই পরিবর্তন ঘটেছে। আকার ও ক্ষমতাবৃদ্ধিরও সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনের দিক থেকে রূপ নিয়েছে এক আধাআমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। তার চরিত্রে এসেছে সেই সঙ্ঘবদ্ধ লোভ, দম্ভ এবং নীতিজ্ঞানশূন্যতা, বিদ্বেষে আক্রান্ত আত্মীয়বুদ্ধির বিকার, সুস্থ মানবিকতার যেটা ভিত্তি হতে পারে না। সেই বিকৃতিকে ঠেকাতে প্রয়োজন হয়, যুক্তি এবং মঙ্গলবোধের সম্মিলিত শক্তি।
এইখানেই দ্বন্দ্বের তৃতীয় স্তর। এই শেষ স্তরে দ্বন্দ্ব কেবল বাইরের ক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তির অন্তরেও। বাইরের আন্দোলনে একে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন গান্ধী, অহিংসার ভাষায়। কেউ বলেন, তিনি মাত্রা রক্ষা করেননি, তাঁর যুক্তিতে ছিল সংস্কারের খাদ। তবু তিনি পথিকৃৎ। যুক্তিকে বিদ্বেষের কবল থেকে রক্ষা করবার সংগ্রামে তিনি পথপ্রদর্শক।
ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)