৩.১১ গ্রামের নাম বাতাহ

॥ এগার ॥

মদীনা হতে প্রায় ২৭৫ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম বাতাহ। এখানে কয়েকটি বেদুঈন পরিবার বসবাস করত। এটা উল্লেখযোগ্য কোন গ্রাম ছিল না। সন্ধানী দৃষ্টিতে নজর বুলালে কতিপয় এমন আলামত পাওয়া গেল—যা প্রমাণ করে যে, এখানে কোন এক নগরী গড়ে উঠেছিল।

১৪ শতাব্দী পূর্বে বাস্তবেই এ গ্রামে একটি শহর ছিল। শহরের নাম ছিল বাতাহ। নামসহ শহরটি আজও আছে। তবে শহরের সীমানা ছোট এবং সংকীর্ণ হতে হতে তা এক সময় গ্রামে পরিণত হয়। শহরের বাসিন্দারা সুদর্শন, বীর এবং নির্ভীক ছিল। কথা বলত কবিতার ছন্দে। মহিলারা অত্যন্ত রূপবতী এবং পুরুষেরা কমনীয় ছিল। এটি ছিল একটি শক্তিশালী গোত্র। বনূ তামীম নামে তারা পরিচিত ছিল।

বনূ ইয়ারবূও একটি গোত্র ছিল। কিন্তু স্বতন্ত্র কোন গোত্র না বরং বনূ তামীমেরই এক বৃহদাংশ। এ গোত্রের সর্দার মালিক বিন নাবীরা। বনূ তামীমের সকলের মাজহাব এক ছিল না। বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদে বিশ্বাসী ছিল তারা। কতক আগুন পূজা আর কতক কবর পূজারী ছিল। তবে অধিকাংশই ছিল মূর্তিপূজক। অনেকে আবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। দানশীল, অতিথিপরায়ণ এবং বীর হিসেবে এ গোত্রের প্রচুর সুনাম ছিল। যে সমস্ত গোত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের পয়গাম পাঠান তাদের মধ্যে বনূ তামীম ছিল উল্লেখযোগ্য। ইসলামের সুসংগঠিত ও তার বহুল প্রচার-প্রসারের স্বার্থে বনূ তামীমের মত শক্তিধর ও প্রভাবশালী গোত্রকে ইসলামের আওতাধীন করা অতীব জরুরী ছিল।

বনূ তামীমের ইসলাম গ্রহণের পটভূমি যেমনি ঘটনানির্ভর তেমনি চমকপ্রদ। এখানে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, দীর্ঘ মেহনতের পর বনূ তামীমের অধিকাংশই ইসলামের ছায়ায় চলে আসে। মালিক বিন নাবীরা ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। এত সহজে নিজের ধর্মমত পরিহারের পাত্র সে ছিল না। কিন্তু বনূ তামীমের অধিকাংশ লোক মুসলমান হয়ে যাওয়ায় সে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও নেতৃত্ব ধরে রাখতে ইসলাম গ্রহণ করে। বড় প্রভাবশালী ও বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বাতাহের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এলাকার যাকাত, উশরসহ অন্যান্য কর, ভ্যাট ইত্যাদি আদায় করে মদীনায় প্রেরণ করা ছিল তার অন্যতম দায়িত্ব।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বালাজুরি এবং মুহাম্মাদ হুসাইন হাইকাল লেখেন, মালিক বিন নাবীরা বড়ই সুদর্শন ও ঈর্ষণীয় চেহারার অধিকারী ছিল। গঠনশৈলী অপর্ব আকর্ষণীয়। মাথার চুল লম্বা, নয়নাভিরাম। দুর্ধর্ষ যোদ্ধারাও তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হত। তিনি ছিলেন স্বনামধন্য কবি, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ও হৃদয়স্পর্শী সুরের অধিকারী। তার সবচেয়ে বড় গুণ এই ছিল যে, সদা হাস্যোজ্জ্বল ও সপ্রতিভ থাকত। হৃদয়কাড়া স্মিত হাসি ছিল তার অপূর্ব। চরম শোকাহতকেও সে মুহুর্তে হাসাতে পারত। দোষ বলতে যা তার মধ্যে ছিল তা হলো, চরম আত্মগৌরব ও অহংকার বোধ। নিজ গোত্রসহ পুরো বনূ তামীমে তার বিরাট মর্যাদা আর ব্যক্তিত্বই ছিল এর একটি কারণ। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ছিল, ব্যতিক্রমধর্মী পুরুষসুলভ সৌন্দর্য ও অন্যান্য গুণাবলী। এ গুলোর যাদুই অন্যদের গভীর প্রভাবিত ও মোহিত করত।

অসংখ্য নারীর সাথে ছিল তার প্রগাঢ় সম্পর্ক। যুবতী নারীরা তার সান্নিধ্য ও একটু ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল ও আকুলি-বিকুলি করত। বড়ই ধূর্ত ছিল সে। নারীদের কাছে টানত কিন্তু বিবাহের বন্ধনে কাউকে জড়াত না। সাময়িক সম্পর্কে তাদের মন ভরাত। সে তাদের এই বলে আশ্বস্ত করত যে, সাময়িক সম্পর্কতেই তারা বিরাট মর্যাদার অধিকারিণী হয়ে যাবে। গোত্রের এমন কোন নারী ছিল না, যার অন্তরে তার ভালবাসা ও কামনা ছিল না। যে কোন নারী-হৃদয় সে অনায়াসে জয় করে নিতে পারত। আধা পলক চাহনী আর এক ফালি হাসিই ছিল এর জন্য যথেষ্ট।

বনূ তামীমের জনৈক ব্যক্তির নাম আল-মিনহাল। মানুষের কাছে সে নামেমাত্র পরিচিত ছিল। সামাজিক মর্যাদা বা প্রতিপত্তি বলতে তার কিছুই ছিল না। তার এক কন্যা ষোল বছরে পদার্পণ করে। স্বাস্থ্য নিটোল ও ভরাট। সারা অঙ্গে সৌন্দর্যের বাহার। পরিপূর্ণ তরুণী। নাম লায়লা। যুবতী এ কন্যার বদৌলতে আল-মিনহাল জিরো থেকে হিরো বনে যায়। সমাজে আল-মিনহালের কদর ও মর্যাদা বেড়ে যায়। মানুষ শ্রদ্ধার সাথে তার কথা স্মরণ করতে থাকে। যৌবনের চৌহদ্দী না পেরোতেই লায়লার সৌন্দর্য অঙ্গ থেকে ঝরে পড়তে থাকে। মানুষ চলা থামিয়ে চোখ কপালে তুলে অবাক বিস্ময়ে তার রূপের ঝলক দেখতে থাকে। নিকট থেকে এক পলক দেখার জন্য উৎসুক জনতা অধীর হয়ে রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকে। সৃষ্টি হয় যানজট। সেই সাথে জনজট। দূর-দূরান্ত হতে লোক এসে সমবেত হয় লায়লার বাড়ির আঙ্গিনায় ও আশে পাশের রাস্তায়। উদ্দেশ্য, লায়লার উপচে পড়া সৌন্দর্য ও রূপ এক নজর দেখে চোখের তৃষ্ণা নিবারণ করা।

জনাব ইস্পাহানী বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও তৎযুগের প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপির বরাত দিয়ে লেখেন, আল্লাহ্তা’আলা লায়লাকে অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছিলেন। তার হরিণ-আখি এত আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী ছিল যে, কারো প্রতি চাইলেই সে বিমোহিত হয়ে যেত। হাঁটুর নিচের অংশ খোলা থাকত এমন পোশাক সে পরত। ঐতিহাসিকগণ বলেন, তার পায়ের নলায় অস্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। তার বাহুও ছিল চমৎকার। সুঢৌল গোল এবং দীর্ঘ লম্বা। কেশদান উড়িয়ে রাখত। স্বর্ণালী চুল এবং তার উজ্জ্বল চমকে যাদু জড়িয়ে ছিল।

চোখ তুলে কেউ একজন তাকে দেখে না, সে ছিল একমাত্র মালিক বিন নাবীরা। একবার এমন ঘটনা ঘটেছে যে, সে মালিকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু মালিক চোখ তুলে তাকে দেখেনি আর লায়লাও মালিকের দিকে তাকায়নি।

একদিনের ঘটনা। লায়লা তার উটনীকে পানি পান করিয়ে আনছিল পথিমধ্যে এক মহিলার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। মহিলাটি লায়লার পূর্ব পরিচিত মালিক বিন নাবীরার একান্ত পরিচারিকা। সে লায়লার গতিরোধ করে দাঁড়ায়।

“লায়লা!” পরিচারিকা তাকে বলে—“নিঃসন্দেহে তুমি আরো গর্ব করতে পার। এমন কোন লোক আছে যে তোমার পায়ের নখ পর্যন্ত চুমো দিতে প্রস্তুত নয়?”

“তোমার মনিব কি তোমাকে কোন কবিতা মুখস্থ করে প্রেরণ করেনি?” লায়লা মুচকি হেসে বলে—“মালিক বিন নাবীরা কবি না? আমার ধারণা সত্য নয় কি যে, তোমার মনিব তোমাকে আমার জন্য কোন পয়গাম দিয়ে পাঠিয়েছে। আমি পুরুষের চোখের ভাষায় তার হৃদয়ের কথা পড়ে নিতে পারি।”

“খোদার কসম!” মধ্যবয়সী পরিচারিকা বিস্মিত হয়ে বলে—“তুমি অল্প বয়সেই বিচক্ষণ হয়ে গেছ। জ্ঞানীর মত কথা বলছ। যদি তুমি বাস্তবেই আমার চোখে আমার মনিবের পয়গাম দেখতে পেয়ে থাক, তবে বল তোমার জবাব কি? সে তোমার জন্য উন্মুখ ও পাগলপারা।”

“অত্র এলাকায় এমন কোন পুরুষের নাম বলতে পার, যে আমার জন্য ব্যাকুল নয়?” লায়লা গম্ভীর কণ্ঠে বলে।

“কিন্তু আমার মনিবের ব্যাপারটি একটু ভিন্ন”—পরিচারিকা বলে।

“পার্থক্য বলতে যেটা আছে তা হলো সে অন্যদের মত আমার দিকে তাকায় না”—লায়লা বলে—“আর আমার জানা আছে, সে কেন তাকায় না। সে চায়, আমি তার দিকে তাকাই। সে নেতা বলে নিজেকে খুব সুদর্শন মনে করে। তাকে বলে দিও, আপনার আশা কোনদিন সফল হবে না। লায়লা, আপনার দিকে কখনও তাকাবে না।”

“এমন জবাবে তিনি নিরাশ হবেন না।”—পরিচারিকা বলে—“এটা কি তোমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার নয় যে, মালিক বিন নাবীরার মত লোক তোমার পাণিপ্রার্থী? তিনি তোমার পদতলে স্বর্ণের স্তুপ জমা করে দিবেন?”

“তাকে বলো, স্বর্ণ নয়; আমার পায়ে এসে মাথা রাখতে”—লায়লা বলে—“কিসের বলে সে এভাবে পয়গাম পাঠাতে সাহস করল তুমি জান?…কারণ সে সর্দার। আমার পিতা তার মোকাবিলায় কিছুই নয়। সে এভাবে প্রস্তাব দিয়ে আমাকে অপমান করেছে।”

“তবে তুমি অন্য কাউকে ভালবাস?” পরিচারিকা জিজ্ঞাসা করে।

লায়লা জোরে হেসে ওঠে। মুখে কিছু বলে না।

“তাহলে তাকে আমি কি জানাব?” পরিচারিকা নিরুত্তাপ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে।

“যা কিছু বলার তা আমি বলেছি”—লায়লা বলে—“সাথে এটুকুও তাকে বলবে যে, আমি এক রাতের জ্বলন্ত মশাল নই। আমি কেবল তার হব, যে সারাজীবন আমাকে তার প্রদীপ হিসেবে রাখবে।”

মালিক বিন নাবীরার কানে লায়লার এহেন তীর্যক জবাব গেলে তার এতদিনের দম্ভ-অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।

“মনিব!” পরিচারিকা তার অস্থিরতা দেখে সান্ত্বনার সুরে বলে—“লায়লা আর এত কি?…একটি সাধারণ মেয়ে মাত্র। শাহজাদী নয়। তার বিবাহের সিদ্ধান্ত তার পিতা নিবে। তার পিতাকে বলুন…।”

“আমি দেহ নয়, লায়লার মন চাই”—মালিক বিন নাবীরা বলে।

আরেক দিন মালিক নিজেই লায়লার কাছে গিয়ে তার প্রেম ভিক্ষা চায়।

“আমি আপনাকে হুমকি কিংবা অপমান করিনি”—লায়লা তাকে জানায়—“আমি শুধু একথা বলতে বা বুঝাতে চেয়েছি যে, আমি ঐ ফুল নই যা এক রাতের জন্য ফুটে পরের দিন ম্রিয়মাণ হয়ে ঝরে পড়ে।”

আগেই লায়লা মালিকের দম্ভ-চূঁড়ায় আঘাত হেনেছিল। এবার সে অহমিকার চূঁড়া লায়লার পদাঘাতে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। লায়লা তার আত্মগৌরব দু’পায়ে দলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অতঃপর এক সময় তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বনূ তামীম লায়লাকে ‘উম্মে তামীম’ উপাধিতে ভূষিত করে।

বার

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের খবর পেয়েই মালিক বিন নাবীরা মদীনা হতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। সে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় যে, সে পরিস্থিতির চাপে ইসলামের স্বীকৃতি দিয়েছিল মাত্র; ঈমান আনয়ন করেনি। এলাকা হতে যাকাত, কর, ট্যাক্স, উশর ইত্যাদি আদায় করে সে নিজগৃহে জমা করে রেখেছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই তা কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সে তা মদীনায় না পাঠিয়ে এলাকার লোকজন জমা করে সংগৃহীত অর্থ-সম্পদ নিজ নিজ মালিককে ফিরিয়ে দেয়। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করারও স্পষ্ট ঘোষণা দেয়।

“এখন থেকে তোমরা স্বাধীন”—মালিক সমবেত জনতাকে বলে—“আমি মদীনার গোলামীর জিঞ্জির গলা থেকে নামিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলেছি। এখন যা কিছু উপার্জন করবে সব নিজেরাই ভোগ করবে। কোন কর দেয়া লাগবে না।”

সমবেত জনতা মাল-সম্পদ ফিরে পেয়ে এবং ভবিষ্যতে তাদের ট্যাক্স মওকুফের আনন্দে তারা গগনবিদারী শ্লোগান তোলে।

মদীনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পুনরায় গোত্রের স্বাধীন অধিপতি হওয়ায় মালিক বেজায় খুশী। কিন্তু এ খুশী বেশীদিন স্থায়ী হয় না। পার্শ্ববর্তী দু’তিন গোত্রের নেতারা মালিককে জানিয়ে দেয় যে, সে মদীনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি। মালিক তাদের কথায় কান না দিয়ে বরং উল্টো তাদেরকে নিজের সমমনা ও মদীনা বিরোধী করতে জোর প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তার ভাষার যাদু এখানে চরম মার খায়। তাদেরকে সে কিছুতেই নিজ দলে ভিড়াতে পারে না। তারা তাকে নৈতিক সমর্থন জানাতে মোটেও রাজি হয় না।

যাকাত ও অন্যান্য কর আদায়ের প্রশ্নে বনূ তামীম প্রকাশ্যভাবে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। (১) যাকাতসহ অন্যান্য কর রীতিমত আদায়ে আগ্রহী। (২) মদীনার সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন করতে ইচ্ছুক। (৩) কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও সিদ্ধান্তহীনতার শিকার।

তাদের পারস্পরিক মতভেদ ও ঘরোয়া বিবাদ ভীষণ গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে। এমনি এক টানটান উত্তেজনাকর মুহূর্তে সায্‌যাহ স্ব-সৈন্যে এসে উপস্থিত হয়। সায্‌যাহ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, সে নবুওয়াত দাবী করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক বিরাট সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। সায্‌যাহ মদীনার বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় ও সৈন্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মালিক বিন নাবীরার গোত্র বনূ ইয়ারবু অধ্যুষিত এলাকায় স্ব-সৈন্যে এসে ছাউনি ফেলে। সায্‌যাহ গোত্র প্রধান মালিক বিন নাবীরাকে ডেকে তার আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়ে দেয় যে, সে মদীনা আক্রমণ করতে ইচ্ছুক।

“আমার সৈন্যদের সাথে আপনার গোত্রের সামরিক বাহিনী যুক্ত করে দিলে সম্মিলিতভাবে আমরা মুসলমানদেরকে চিরতরে উৎখাত করতে পারব”—সায্‌যাহ অভিমত ব্যক্ত করে—“বনূ ইয়ারবুর সাথে আমার সম্পর্কের কথাও আপনার অজানা নয়।”

“খোদার কসম!” মালিক বিন নাবীরা গদগদ কণ্ঠে বলে—“আমি আপনাকে পূর্ণ সমর্থন এবং সার্বিক সহায়তা করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার একটি পূর্বশর্ত আছে। আসলে এটি কোন শর্ত নয়; বরং আমাদেরই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি জরুরী বিষয়।…আপনি হয়ত ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছেন যে, বনূ তামীমের বিভিন্ন গোত্রে শত্রুতাভাব সৃষ্টি হয়েছে। তাদেরকে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে একটি ঐক্যফ্রন্ট তৈরী করতে হবে। অতঃপর সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মদীনা আক্রমণ করতে হবে। যদি তারা আমাদের সমঝোতা প্রস্তাবে সাড়া না দেয় তবে তাদেরকে উচ্ছেদ ও নিশ্চিহ্ন করতে হবে। কারণ তাদের হত্যা না করলে তারা এখানেই আমাদের বিরোধী হয়ে উঠবে। তাদের মাঝে মদীনার প্রতি অনুগত আছে অনেকে। তারা খাঁটি মুসলমান। আন্তরিক ও সত্যিকার অর্থেই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তার উপর যে কোন মূল্যে তারা টিকে থাকবে। ফলে তাদেরকে জীবিত রেখে আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়া আত্মহত্যারই শামিল হবে।”

মদীনা পরাস্ত হল কিনা—এটা মালিকের উদ্দেশ্য ছিল না; তার লক্ষ্য ছিল মদীনাকে ইস্যু করে সায্‌যাহ বাহিনী দ্বারা বনূ তামীমের মুসলমান এবং অপর বিরুদ্ধবাদীদের সমূলে বিনাশ করে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব নিশ্চিত করা। ঐতিহাসিকরা লেখেন, সায্‌যাহ মালিক বিন নাবীরার পুরুষ সুলভ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ ও তার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বে দারুণ প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সে মালিকের প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ সমর্থন করে। নিজেদের স্বাক্ষর সম্বলিত সন্ধিপত্র সকল গোত্র প্রধান বরাবর তারা প্রেরণ করে। মদীনা হামলাকে সামনে রেখেই যে এ সন্ধি প্রস্তাব তা বড় হরফে উল্লেখ করে দেয়া হয়।

মাত্র এক গোত্র প্রধান—ওকী ইবনে মালিক—এ সন্ধি প্রস্তাবে সাড়া দেয়। অন্যরা তাদের সাথে সমঝোতায় আসতে অস্বীকার করে। ফলে সায্‌যাহ; মালিক এবং ওকী-এর সম্মিলিত বাহিনী অন্যান্য গোত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়। দানশীলতা, আতিথেয়তা এবং সুরসিক গোত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ বনূ তামীম পরস্পরের মোকাবিলায় বন্য, হিংস্র ও ভয়ঙ্কর রক্তখেকো দানবে পরিণত হয়। যুদ্ধের দাবানলে বসতি উজাড় হয়ে যায়। খুনের দরিয়া সৃষ্টি হয়। লাশভূমিতে পরিণত হয় মরুভূমি।

লায়লা সদর দরজায় মহিলাদের আহাজারি এবং কাতরধ্বনি শুনতে পায়। সে ঘরের কাজ ফেলে দৌড়ে ছুটে আসে। দুরু দুরু বুক, উৎকীর্ণ কান, পাংশুবর্ণ মুখ, বিস্ফোরিত চোখ আর উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে সে কম্পিত হাতে গেট খুলে। সেখানে কিছু মহিলা শোকাহত হয়ে করুণ সুরে কাঁদছিল।

“তবে কি আমি বিধবা হয়ে গেলাম।” লায়লা উদ্বেগের সাথে জানতে চায়— “তোমরা মালিক বিন নাবীরার লাশ আননি তো?”

লায়লাকে দেখে মহিলাদের কান্নার আওয়াজ আরো বেড়ে যায়। তারা চিৎকার করে করে বুক চাপড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তিন মহিলার কোলে কচি শিশুর লাশ ছিল। শিশুদের লাশ যে কাপড়ে ঢাকা ছিল তাও রক্তরাঙা ছিল।

লায়লা! তুমি নারী নও?” এক মহিলা কোলের রক্তস্নাত লাশ লায়লার সামনে এগিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে—“তুমি নারী হলে স্বামীর হাত এঁটে ধরতে। যেন তার হাত কোন শিশুর রক্তে রঞ্জিত না হয়।”

“এই দেখ”—আরেক মহিলা কোলে ধরা শিশুর লাশ লায়লার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে।

“আরও দেখ” আরেকটি বাচ্চার লাশ লায়লার সামনে এনে রাখা হয়।

“আমার এই সন্তানের দিকে তাকাও”—আরেক মহিলা তার দুটি সন্তান লায়লার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে—“এরা চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে গেছে।”

লায়লা কিংবাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু ফ্যাল ফ্যাল নজরে চেয়ে থাকে। তার মুখ হয়ে যায় মূক। নৃশংস এ দৃশ্য দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। চোখের সামনে এভাবে একাধিক শিশুর লাশ দেখে তার মাথা ঘুরে ওঠে। ওদিকে লায়লাকে নিরব-নিস্তব্ধ দেখে মহিলারা আরো ক্ষেপে যায়। তারা চতুর্দিক দিয়ে লায়লাকে ঘিরে নেয় এবং ক্রুদ্ধ সিংহীর মত গর্জন করে বলতে থাকে।

“তুমি আস্ত ডাইনী।”

তোর স্বামী নিরেট জল্লাদ।”

“সায্‌যাহ তোর স্বামীর প্রেমিকা।”

“সায্‌যাহ তোর সতীন।”

তোর ঘরে আমাদের ঘরের লুণ্ঠিত মাল আসছে।”

“মালিক বিন নাবীরা তোকে আমাদের বাচ্চার কাঁচা রক্ত পান করাচ্ছে।”

“আমাদের সমস্ত সন্তান কেটে টুকরো টুকরো করে নিক্ষেপ করলেও আমরা সায্‌যার নবুওয়াত মেনে নিব না।”

“আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুহাম্মদ আল্লাহ্‌র রাসূল।”

মহিলাদের এহেন চিৎকারে অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে এলাকার অন্যান্য লোকও এসে জমা হয়। মহিলাদের সংখ্যাই ছিল বেশী। লায়লা লজ্জা-অনুতাপে তার সুন্দর চেহারা দু’হাতে ঢেকে ফেলে। তার শরীর হেলতে থাকে। দু’মহিলা তাকে ধরে ফেলে। কিন্তু সে নিজেকে মূর্ছা যেতে দেয় না। মাথা এদিক-ওদিক ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। আস্তে আস্তে শোক সন্তপ্ত মহিলাদের দিকে অশ্রুস্নাত চোখে তাকায়।

“তোমাদের সন্তানদের রক্তের বদলা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই”—লায়লা বলে—“আমার সন্তান নিয়ে যাও; তাকে কেটে টুকরো টুকরো কর।”

“আমরা হিংস্র নরখাদক নই”—একটি কলরব ওঠে—“আমরা ডাইনী নই। যুদ্ধ খেলা বন্ধ করাও। হত্যা-লুটতরাজ রোধ করাও। তোমার স্বামী ওকী এবং সায্‌যাহ-এর সাথে মিলে এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ চালাচ্ছে।”

“যুদ্ধ শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে”—লায়লা বলে—বাচ্চাদের লাশ ভিতরে আন।”

শোকাহত মায়েরা নিজ নিজ সন্তানের লাশ ভিতরে নিয়ে যায়। লায়লা লাশ তিনটি ঐ পালঙ্কে যত্নের সাথে শুইয়ে রাখে যেখানে সে আর মালিক বিন নাবীরা শয্যাযাপন করে। সে লাশগুলো এমনভাবে ঢেকে রাখে যে, বাইরে থেকে বুঝার কোন উপায়ই ছিল না যে, তিন তিনটি লাশ এখানে শায়িত।

মালিক বিন নাবীরা লায়লা বলতে পাগল ছিল। সে ছিল রীতিমত লায়লার পূজারী। লায়লার সৌন্দর্য তার উপর যাদুর মত আচ্ছন্ন রাখত। কিন্তু এটা এমন এক যুদ্ধ ছিল সেখানে লায়লাকে সাথে রাখা মালিকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এদিকে লায়লার দুর্বার আকর্ষণ তাকে লায়লা হতে বেশীক্ষণ দূরে থাকতে দেয় না। যুদ্ধ নিকটবর্তী কোথাও হলে সে রাতে লায়লার সান্নিধ্যে চলে আসত। ঘটনাক্রমে ঐ দিন রাতে মালিক ঘরে ফেরে। লায়লাকে দেখামাত্রই তার শরীরে শরাবের মত নেশার উদয় হয়।

“পালঙ্কে কেউ শায়িত?”—মালিক বিন নাবীরা জিজ্ঞাসা করে।

“না”, লায়লা জবাবে বলে—“আপনার জন্য একটি উপঢৌকন ঢেকে রেখেছি…তিনটি ফুল, কিন্তু তা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে এই যা।”

মালিক ক্ষিপ্রগতিতে চাদর ধরে টান দেয় এবং এমন ভঙ্গিতে পিছে সরে আসে যেন পালঙ্কে বিষধর সাপ দংশনের জন্য কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। সে পিছনে ফিরে লায়লার দিকে তাকায়।

‘রক্তপিপাসু হায়েনার জন্য এর চেয়ে উত্তম উপঢৌকন আর কিছু হতে পারে না”—লায়লা তীর্যক মন্তব্য করে এবং তাকে বিস্তারিতভাবে জানায় যে, নিহত শিশুদের মায়েরা কেমন সোকাহত হয়ে তার কাছে আসে এবং কি কি বলে গেছে। এরপর লায়লা তার দুগ্ধপায়ী বাচ্চা মালিকের সামনে পেশ করে বলে—“যান, নিয়ে যান। ঐ শিশুগুলো এবং নিজের এই শিশুর রক্ত পান করে কলিজা ঠাণ্ডা করুন। রক্তপিপাসা নিবারণ করুন।” লায়লা আরো বলে—“আপনি কি সেই মালিক বিন নাবীরা মানুষ যাকে সদাহাস্যময় বলে? এই কি আপনার বাহাদুরী এবং বীরত্বের পরিচয় যে, আপনি এক নারীর ফাঁদে পড়ে লুটতরাজ করে ফিরছেন? এতই বাহাদুর হলে মদীনায় গিয়ে আক্রমণ করুন। এখানকার দুর্বল ও সাদাসিদা মুসলমানদের উপর কেন হাত তুলছেন!

মালিক বিন নাবীরা সাধারণ লোক ছিলেন না। তার ব্যক্তিত্বের মাঝে এক ধরনের স্বতন্ত্র বিশেষত্ব ছিল যা অন্যদেরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করত। তার জীবন অভিধানে ভর্ৎসনার কোন শব্দ লেখা ছিল না। বিদ্রূপ কোনদিন তার কানে পড়েনি। তার মাথা কোনদিন কোন কাজে অবনত হয়নি।

“এই কি আপনার গর্ব আর গৌরবের প্রতিফলন?” লায়লা তাকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে—“এই নিষ্পাপ বাচ্চাদের লাশের উপর দাঁড়িয়ে গর্ব করবে?…জনৈক মহিলার কারণে…এক নারী আপনার গর্ব-অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আপনাকে খুনী এবং ডাকাতের কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে।

নিজের সন্তান আপনার কাছে রেখে আমি চলে যাচ্ছি। পিছন হতে আমার পিঠেও একটি তীর বসিয়ে দিও।”

“লায়লা!” মালিক বিন নাবীরা গর্জন ছোঁড়ে। কিন্তু শেষদিকে এসে তার কণ্ঠস্বর এমনিতেই নীচু হয়ে যায় এবং একজন অপরাধীর মত আওয়াজে বলে— “কোন নারীর জালে আমি ফেঁসে যাইনি।”

“মিথ্যা বলবেন না মালিক।” লায়লা বলে—“আমি চলে যাচ্ছি। সায্‌যাহকে এখানে নিয়ে আসুন…। তবে মনে রাখবেন, আপনার নেতৃত্ব, সৌন্দর্য, কাব্যচর্চা এবং অন্যায় রক্তপাত, এই নিহত বাচ্চাদের মাতাদের বুকফাটা আর্তনাদ এবং অভিযোগ থেকে বাঁচতে পারবে না।… এ তো মাত্র তিনটি লাশ। বসতির লুটতরাজ চালানোকালে না জানি কত শত বাচ্চা এভাবে আপনার ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়েছে। আপনি শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন না। আপনার রক্তও একদিন বইবে এবং আমি অন্য কারো স্ত্রী হব।”

মালিক বিন নাবীরা কিঞ্চিৎ ঝুঁকে লায়লার দিকে তাকায়। যেন তার পিঠে কেউ খঞ্জর বসিয়ে দিয়েছে। সে আস্তে আস্তে পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে যায়।

মালিক রাতে ঘরে ফেরে না। সকালের সূর্য উঁকি দেয়। রক্তরাঙা রবি বাতাহ-এর সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করত। প্রভাতের মায়াবী ঝলকে বাতাহ-এর চেহারা পাল্টে যেত। কিন্তু আজকের সূর্য যেন অন্যদিনের সূর্য নয়। নিষ্প্রভ, নিস্তেজ, ম্রিয়মাণ। সে আজ ঝলক নয়; মুঠোমুঠো বেদনা উপহার দেয়। ফ্যাকাশে-রক্তহীন দেখা যায় তার চেহারা। যে সূর্য প্রতিদিন বাতাহ-এর জন্য হাসির কাকলি আর রূপের বাহার বয়ে আনত আজ তার নিজের চেহারাই ছিল পাংশুবর্ণ এবং চোখে মৃত্যুর আতংক। সেখানকার প্রতিটি নারীর চেহারায় ছিল বেদনার ছাঁপ এবং চোখ ছিল অশ্রুসজল। এটা ছিল বনূ তামীমের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লুটতরাজের ভয়াবহ টর্নেডোর ফল। সূর্যের যে কিরণের জন্য বাতাহবাসী প্রত্যহ অপেক্ষমাণ থাকত এবং সূর্যের কিরণও সকল বাধা ডিঙিয়ে বাতাহ-এর ঘরে ঘরে এসে হাজির হত আজ সে কিরণের জন্য কাউকে অপেক্ষমাণ দেখা যায় না এবং কিরণও কেমন যেন দুরুদুরু বুকে বাতাহ-এর অলিতে-গলিতে এসে প্রবেশ করে।

সূর্য আরেকটু উপরে উঠলে নিস্তব্ধ বাতাহ হঠাৎ সরব হয়ে ওঠে। চারদিকে ছুটোছুটি আর হুলস্থুল পড়ে যায়। মায়েরা শিশুদের নিয়ে অন্তঃপুরে চলে যায়। দরজার খিল এঁটে দেয়। যুবতী কন্যার সম্ভ্রম রক্ষায় অনেককে বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে দেখা যায়। আত্মগোপনই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এলাকার বৃদ্ধরা কামান, তূণীর নিয়ে ছাদে ওঠে। যুবকরা বর্শা এবং তলোয়ার বের করে পজিশন নিয়ে দাঁড়ায়—এ সবের কারণ এই ছিল যে, কে যেন চিৎকার করে সতর্ক করে বলছে, শত্রুবাহিনী আসছে।

সকলের আতংকিত দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল দূরের গগন-পবনে। বহুদূরে ধূলোর মেঘমালা উড়তে দেখা যায়। ধূলোর এমন প্লাবন সৃষ্টি কেবল কোন সেনাবাহিনীর পক্ষেই সম্ভব। বাতাহ-এর যুবকের সংখ্যা ছিল কম। অধিকাংশই মালিক বিন নাবীরার সাথে অন্য গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। অল্প সংখ্যক যারা ছিল তারা চরম ভীতি এবং আতংকিত হয়ে পড়েছিল।

লায়লার শয়ন কক্ষের পালঙ্কে তখনও তিন শিশুর লাশ পড়েছিল। বাতাহ-এ হুলস্থুল পড়ে গেলে সেও নিজের শিশু-বাচ্চা বুকের সাথে চেপে ধরে কেল্লাসদৃশ ঘরের ছাদে এসে দাড়ায়। সে বারবার কোলের বাচ্চার দিকে তাকায় এবং চুমোয় চুমোয় সিক্ত করতে থাকে তার মুখমণ্ডল। সম্ভবত তার মাঝে এই আশংকার উদ্রেক হয় যে, আসন্ন শত্রুরা হয়ত প্রতিশোধ নিতে আসছে। আর তারা নিজেদের বাচ্চা হত্যার প্রতিশোধ তার বাচ্চাকে হত্যার মাধ্যমে নিবে।

ভূমি উৎক্ষিপ্ত ধূলো নিকটে এসে পড়ে। ধূলোর পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘোড়া এবং উট আবছা আবছা দেখা যায়।

“সাবধান, বনূ ইয়ারবু হুঁশিয়ার।” অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠ ভেসে আসে—“জীবন বাজি রাখবে। ভীত হবে না।”

আগন্তুক বাহিনী ধূলোর আস্তরণ থেকে বেরিয়ে আরো এগিয়ে আসে। এলাকার কিছু লোক ঘোড়ায় চড়ে হাতে বর্শা এবং তলোয়ার নিয়ে আগত সৈন্যদের উদ্দেশে এগিয়ে যায়। তাদের পরিণাম ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, তাদের প্রভাবে সশস্ত্র অবস্থায় এগিয়ে আসতে দেখে আগত সৈন্যদের বিন্যস্ত সারিতে কোনরূপ পরিবর্তনের আভাস দেখা যায় না। বরং তারা আরো এগিয়ে গিয়ে ঐ সৈন্যদের সাথে মিশে তাদেরই অংশ হয়ে যায়।

“আপনি!তারা শ্লোগান তোলে—“আপনি! মালিক বিন নাবীরা।…যুদ্ধ খেলা শেষ।”

অল্প সময়ের মধ্যে যখন সকলেই জানতে পারে যে, আগত সৈন্যরা কোন শত্রুবাহিনী নয়; বরং তাদেরই গোত্রের সৈন্যরা, যুদ্ধ ময়দান থেকে তারা ফিরে আসছে, তখন সর্বত্র খুশীর শ্লোগান ওঠে। চিৎকার এবং গলা ফাঁটিয়ে সবাই আনন্দ প্রকাশ করে। মৃত্যুপ্রায় বাতাহ নগরী দেহে প্রাণ ফিরে পায়। হৃদয়ের স্পন্দন পেয়েই সে জেগে ওঠে। মৃত্যুপুরী মুহূর্তে জনতার কল-কাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে। জনতা মুহুর্মুহু শ্লোগান আর বীরোচিত সংবর্ধনা দিয়ে সৈন্যদের অভ্যর্থনা জানায়। রজনীগন্ধা আর গোলাপের তোড়া দিয়ে জনতা প্রিয়জনদের বরণ করে নেয়।

মালিক বিন নাবীরা অভ্যর্থনায় যোগ দেয় না। সে এসে কোথাও দাড়ায় না। সোজা নিজের বাড়িতে আসে। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে অন্দরে চলে যায়। লায়লার দুর্বার আকর্ষণই তাকে কোথাও থামতে কিংবা অপেক্ষা করতে দেয় না। লায়লার মলিন মুখে গোলাপের হাসি না ফোটা পর্যন্ত তার হৃদয় শান্ত হয় না। যে কোন মূল্যে সে প্রাণপ্রিয়া লায়লার মুখের হাসি ধরে রাখতে চায়। তাইতো সে ঘর ছেড়ে এই পণ করে বেরিয়ে গিয়েছিল যে, লায়লার মনের ইচ্ছা পূরণ করেই তবে সে ঘরে ফিরবে। লায়লার ইচ্ছা বাস্তবেই সে অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করে। লুটতরাজের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সৈন্যদের নিয়ে ফিরে আসে। ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় লায়লা তাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাবে, ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিবে। সবচে বড় কথা, লায়লার ম্লান মুখে হাসির ফোয়ারা ছুটবে—এমনি একগুচ্ছ আশা নিয়ে সে দৌড়ে অন্দর মহলে এগিয়ে যায়। কিন্তু না; অন্দরের অবস্থা ছিল বাইরের অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাইরে আনন্দের জোয়ার উঠলেও ভিতরে তখন ভাটা চলছিল। অন্দর মহল ছিল থমথমে, নির্বাক, নিষ্পন্দন। লায়লা আঙ্গিনার এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। তার আকর্ষণীয় চেহারায় পূর্বের সেই উদাসীনতার ছাঁপ তখনো বিদ্যমান ছিল। তার ঐ হরিণটানা আঁখি এবং কাজল তোলা চোখ বুজা বুজা ছিল, যার এক একটি পলকের ইশারায় গোত্রের শত শত যুবক জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল।

“তোমার নির্দেশ আমি মান্য করেছি লায়লা!” মালিক বিন নাবীরা এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে লায়লাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে করতে বলে—“লড়াই খতম করে দিয়েছি। আমরা শীঘ্রই বন্দী বিনিময় করব। সায্‌যাহ-এর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। এই ফুল দ্বারা চেহারার মলিনতা মুছে ফেল।”

মালিকের এহেন আবেগ লায়লার মাঝে কোন অনুভূতি জাগাতে সক্ষম হয় না। তার দেহ যেন প্রাণহীন ছিল। মালিককে দেখে অন্য সময় তার শরীরে যে উষ্ণ শিহরণ বয়ে যেত তা এখন সৃষ্টি হয় না। মালিক তাকে স্বাভাবিক ও প্রাণচঞ্চল করতে অনেক চেষ্টা করে কিন্তু লায়লা পূর্ববৎ ম্রিয়মাণ ছিল। যেন ঝরে যাওয়া একটি ফুল।

“আসলে আমার অন্তরে একটি ভীতি গভীরভাবে বসে গেছে”—অনেকক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উদাস কণ্ঠে লায়লা বলে।

“কেমন ভয়?” মালিক ভ্রূ কুঁচকে জানতে চায়—“কার ভয়?”

“শাস্তির”—লায়লা বলে—“প্রতিশোধের।”

সায্‌যাহ একা হয়ে গেছে। তার অপর সহযোগী ওকীও তার সঙ্গ ছেড়ে দেয়। মালিক বিন নাবীরা ওকীকে বলেছিল, সে এক নারীর ফাঁদে পা দিয়ে নিজ গোত্রের উপর চড়াও হয়েছে। সায্‌যাহ নিজ বাহিনী নিয়ে নাবাযের দিকে চলে যায়। পূর্বে বলা হয়েছে যে, সে ইয়ামামায় আক্রমণ করতে গিয়েছিল। কিন্তু মুসাইলামার ফাঁদে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে মুসাইলামা তাকে বিবাহ করে।

মালিক বিন নাবীরার পাপের শাস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্যতম সহযোগী ওকী বিন মালিক তার সঙ্গ ছেড়ে মুসলমানদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। মালিক তাকে বাধা দিতে চেষ্টা করে।

“আমরা দু’জনও যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি তবে মুসলমানরা আমাদের পদতলে পিষ্ট করে ছাড়বে”—মালিক ওকীকে বলে—“আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাদের মোকাবিলা করতে পারব।”

“আমি জীবিত থাকতে চাই মালিক।” ওকী তার উত্তরে বলে—“মদীনা বাহিনীর সামনে আজ পর্যন্ত কেউ টিকতে পেরেছে কি? গাতফান পরাভূত। তাঈফ পরাজিত। বনু সালেম, বনু আসাদ, হাওয়াযিন কেউ মুসলমানদের মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারেনি। অতঃপর সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং উম্মে জামাল সালমাকেও তাদের সাথে যুক্ত করেছে। কিন্তু তারপরেও টিকতে পারেনি। তোমার মনে নেই, কিভাবে ওলীদের পুত্র খালিদ তাদেরকে তাড়িয়ে ও ভাগিয়ে দিয়েছে? সালমাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছি। তারা এ রক্তের প্রতিশোধ নিবেই। আমাদের ক্ষমা করবে না। সমস্ত গোত্রকে পরাজিতকারী খালিদ মদীনায় ফিরে যায়নি। সে এখন বাযাখায়। অপরদিকে মুসলমানদের আরেক প্রখ্যাত সেনাপতি উসামাও আছে। তাদের মধ্য হতে যে কেউ যে কোন মুহুর্তে এদিকে আসতে পারে। তাদের রক্তপাতের ক্ষমা এবং আমাদের প্রায়শ্চিত্তের এখন একমাত্র পথ এটাই যে, আমরা পুনরায় তাদের আনুগত্য মেনে নিয়ে এখানকার বিভিন্ন গোত্র হতে যাকাত, ট্যাক্স ইত্যাদি পূর্বের মত নিয়মিত আদায় করে যাব।”

ওকী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিলেও মালিক বিন নাবীরা তৎক্ষণাৎ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

হযরত খালিদ বিন অলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এরই মধ্যে অবগত হন যে, মালিক বিন নাবীরাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সে যাকাত, কর ইত্যাদি আদায় করে মদীনায় পাঠায়নি; বরং পুনরায় তা মালিককে ফিরিয়ে দিয়েছে। গোয়েন্দারা প্রমাণ স্বরূপ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মালিকের রচিত একটি পংক্তিও শুনায়। এ পংক্তিতে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর নিজ গোত্রকে সম্বোধন করে বলেছিল, সবাই নিজ নিজ সম্পদ নিজেদের কাছে রাখ এবং এর জন্য কোন ভয়ের আশংকা করো না। ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ হতে আমাদের উপর কোন বিপদ নেমে এলে আমরা তা এই বলে মোকাবিলা করব যে, আমরা মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করেছিলাম; আবু বকরের নয়।

মালিক বিন নাবীরা সায্‌যাহ এর সাথে মিলে মুসলমানদের উপর যে ব্যাপক গণহত্যা চালায় তার খবরও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পেয়ে যান। তিনি নিজ বাহিনীকে দ্রুত বাতাহ-এর উদ্দেশে প্রেরণ করেন। তার এ বাহিনীতে মদীনার আনসারও ছিল। তারা বাতাহ-এর উদ্দেশে সৈন্য প্রেরণের বিরোধিতা করেন।

“আল্লাহর কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আমার সৈন্যদের মাঝে এই সর্বপ্রথম এমন লোক দেখলাম, যারা নিজ আমীর এবং সেনাপতির নির্দেশ অমান্য করছে।”

“এটাকে নির্দেশ লঙ্ঘন বলুন অথবা আর যাইকিছু বলুন”—আনসারদের প্রতিনিধিত্বকারী বলে—“খলিফার নির্দেশ ছিল তোলাইহাকে অনুগত করে সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনা পুনর্বহাল করা। কেউ যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলে তার মোকাবিলা করা। অন্যথা বাযাখায় গিয়ে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকা। আমাদের জানা আছে, বাতাহ-এর উপর আক্রমণের কোন নির্দেশ মদীনার হাইকমান্ড থেকে আসেনি।”

“এটা কারো অজানা আছে কি, আমি তোমাদের আমীর এবং সিপাহসালার?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করেন এবং সকলের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকান। কোন সাড়াশব্দ না এলে পুনরায় তিনি বলেন—“আমার জানা নেই যে, খলীফার সাথে তোমরা কি চুক্তি করে এসেছ। আমি শুধু জানি যে, খলীফা আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, যেখানেই ধর্মান্তরিতের খবর পাও এবং যেখানেই মদীনার সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করা হয় সেখানে যাবে এবং ইসলামকে সুসংহত ও সমুন্নত করবে। আমি সেনাপতি। দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যদি আমাকে এমন কোন পদক্ষেপও নিতে হয় যার ব্যাপারে খলীফার পক্ষ হতে কোন নির্দেশ নেই তথাপিও তা আমি অবশ্যই করব।…খেলাফতের পক্ষ হতে আদেশ-নিষেধ আমার বরাবর আসে, তোমাদের নিকটে নয়।”

“আমরা কোন দূত আসতে দেখিনি”—জনৈক আনসার বলে।

“এর জবাব দেয়া আমি জরুরী মনে করি না”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাগতস্বরে বলেন—“আর আমি এমন কাউকে আমার বাহিনীতে দেখতে চাই না যার অন্তরে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ আছে। আমি আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির ভিখারী। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্রাত্মার সন্তুষ্টি চাই আমি। ব্যক্তিগত সন্তোষের উদ্দেশ্য কারো থাকলে সে চলে যেতে পারে। নিজেকে যথেচ্ছা পরিতুষ্ট কর। আমার অসংখ্য মুহাজির সৈন্য রয়েছে। এ ছাড়া যে সমস্ত নব মুসলিম আমার সাথে আছে তাদেরকেও আমি পর্যাপ্ত মনে করি।”

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম তবারী রাহিমাহুল্লাহ লেখেন যে, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশমালায় এ পয়েন্টও উল্লেখ ছিল যে, বনী আসাদের নেতা তোলাইহাকে শায়েস্তা করে হযরত খালিদের বাহিনী বাতাহ পর্যন্ত যাবে। কেননা, সেখানকার আমীর মালিক বিন নাবীরা যাকাত ও অন্যান্য রাজস্ব আদায় করেনি। বরং সে ইসলাম বর্জন করে তার দুশমনে পরিণত হয়েছে।

ইমাম তবারী সহ অন্যান্য ঐতিহাসিক লেখেন, আনসাররা বাযাখায় রয়ে যায় আর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের বাদ দিয়ে অন্যান্য সৈন্যদেরকে বাতাহ-এ নিয়ে যান। খালিদ অনুগত বাহিনী বাযাখা অতিক্রম করে গেলে রয়ে যাওয়া আনসাররা আপোসে আলোচনায় মিলিত হয়। তারা পরিস্থিতি ও অবস্থা এভাবে বিশ্লেষণ করে যে, আমরা এত দূর পর্যন্ত একসাথে ছিলাম। সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছি। এখন মাঝখানে এসে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। মূল বাহিনী হতে এভাবে পৃথক হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য ঠিক হয়নি।

“আমাদের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এ কারণেও ঠিক নয়”—এক আনসারী মন্তব্য করে—“যে মুহাজির আর নবমুসলিমরা কোন বিজয় হাসিল করলে তার কৃতিত্বের অংশীদার আমরা হব না। মদীনায় গিয়ে এর জন্য আমাদের লজ্জা পেতে হবে।”

“এবং এ কারণেও”—আরেকজন ভিন্ন কারণ উল্লেখ করে বলে—“যে, হযরত খালিদ কোথাও পরাজিত হলে মদীনার জনতা আমাদেরকে তিরস্কার করবে। তারা আমাদেরকে এই বলে নিন্দা করবে যে, মদীনা থেকে এত দূরের রণক্ষেত্রে এসে আমরা হযরত খালিদ ও তার সাথীদের সাথে প্রতারণা করেছি। আমাদেরকে অভিশাপ দেয়া হবে।”

আলোচনার এক পর্যায়ে সকল ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সম্মিলিতভাবে তারা খালিদ বাহিনীতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ততক্ষণ অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। তারা পরামর্শ করে এক দ্রুতগামী সওয়ার তৎক্ষণাৎ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। দ্রুতগামী সওয়ার ধুলিঝড় উড়িয়ে খালিদ বাহিনীর লক্ষ্যে ছুটে আসে এবং সোজা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে এসে ঘোড়া থামায়।

“আনসারদের মধ্য হতে যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল তুমি তাদের একজন নও?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“জি হ্যাঁ, সম্মানিত আমীর।” অশ্বারোহী জবাবে বলে—“আমি তাদেরই একজন। আপনাকে এ কথা বলার জন্য তারা আমাকে পাঠিয়েছে যে, অনুগ্রহ করে আপনি যেন তাদের জন্য অপেক্ষা করেন। তারা এক্ষুণি এসে আপনার সাথে মিলিত হবে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের থামতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকল আনসার এসে পড়ে। অতঃপর সমস্ত সৈন্য বাতাহ-এর উদ্দেশে রওয়ানা হয়।

লায়লা!” বাতাহে মালিক বিন নাবীরা নিজ স্ত্রীকে বলছে—“তুমি আমাকে ভালবাসা শিখিয়েছ। তোমার রূপ-সৌন্দর্য আর যাদুকরী চোখ আমার কাব্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। এখন আমাকে সাহস যোগাও লায়লা। আমার অন্তরে ক্রমে ভীতি জেঁকে বসছে।”

“আমি আপনাকে প্রথম দিনই বলেছিলাম অহংকার-গর্ব সম্পূর্ণ বর্জন করুন মালিক!” লায়লা বলে—“কিন্তু আপনি এত দূর এগিয়ে যান যে, মানুষকে পিঁপড়া জ্ঞান করে পায়ের নীচে ফেলে পিষে পিষে হত্যা করেন।”

“অতীতের পাপ স্মরণ করিয়ে দিও না লায়লা!” মালিক আহতস্বরে বলে—“পাপ আমার বীরত্বকে দংশন করছে।”

“আজ আবার কি হল যে, আপনি এত ভীত হয়ে পড়েছেন?” লায়লা ব্যথায় উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

‘ব্যাপার জিজ্ঞাসা করছ লায়লা?” মালিক বলে—“ব্যাপার আর কিছু নয়; মৃত্যুর ভয় মাত্র। আমার অন্তর বলছে, আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে চলেছি। আমার এবং তোমার সম্পর্ক শেষ হতে যাচ্ছে।…অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আমি গোয়েন্দা ছড়িয়ে রেখেছি। আজ এক গোয়েন্দা এসেছে। সে বলছে, মুসলিম বাহিনী দ্রুতগতিতে এদিকে ছুটে আসছে। বাহিনীর এ গতি অব্যাহত থাকলে পরশু সন্ধ্যা নাগাদ তারা এখানে পৌঁছে যাবে নিশ্চিত।”

“এতে ভয়ের কি হল? প্রস্তুতি নাও”—লায়লা বলে—“গোত্রের লোকদের সমবেত কর।”

“কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে না”—মালিক ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলে—“ওকী এবং সায্‌যাহ-এর সাথে মিলে আমি নিজ গোত্রের উপর দিয়ে যে রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছিলাম তা কেউ ক্ষমা করবে না। পরে তাদের সাথে আপোষ-নিষ্পত্তি করে নিলেও তাদের অন্তর ক্ষুব্ধ। আমার গোত্রের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসবে না।”

“তাহলে আগে চলে যান। মুসলমানদের সেনাপতিকে গিয়ে বলুন, আমি ইসলাম বর্জন করিনি”—লায়লা বলে—“হয়ত তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন।”

“ক্ষমা করবেন না”—মালিক বলে—“ক্ষমা করতে পারেন না। তারা এমন অপরাধীকে ক্ষমা করে না।”

মালিক বিন নাবীরার উদ্বেগ ও আতংক ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতোমধ্যে খবর এসে পৌঁছে যে, খালিদ বাহিনী নিকটে এসে গেছে। সে তৎক্ষণাৎ গোত্রের সকলকে জমা হওয়ার নির্দেশ দেয়।

“বনু ইয়ারবু-এর সম্মানিত জনতা।” মালিক সমবেত জনতার উদ্দেশে বলে—“আমাদের থেকে যে বড় ভুল হয়ে গেছে তা হলো, আমরা একদা মদীনার শাসন মেনে নিয়েছিলাম এবং পরে আবার তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। তারা আমাদের সামনে নয়া ধর্মমত পেশ করলে আমরা তা মেনে নিয়ে পরে আবার অবাধ্য হয়ে যাই। তারা আসছে। সকলে নিজ নিজ ঘরে চলে যাও এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখ। এতে প্রমাণ হবে যে, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করনি। তারা ডাকলে খালি হাতে সামনে এসে দাঁড়াবে। মোকাবিলায় অযথা প্রাণহানি ছাড়া কাঙ্ক্ষিত লাভ হবে না।…যাও, নিজ নিজ ঘরে যাও।”

জনতা উদ্ভূত বিপদ ও তার মাত্রা অনুভব করতে সক্ষম হয়। ফলে মোকাবিলার পক্ষে কেউ টু-শব্দ করে না। মাথা ঝুঁকিয়ে সকলে নিজ নিজ ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

৬৩২ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাতাহ এলাকায় পৌঁছে যান। তিনি সেখানে পৌঁছেই সৈন্যদেরকে অবরোধের ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে বাতাহ তার কাছে উজাড়ভূমি বলে মনে হতে থাকে। শহরের প্রতিরক্ষায় একজনকেও এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। এমনকি বেসামরিক কোন লোকজনও নজরে পড়ে না। ঘরের ছাদেও কারো মাথা দেখতে পাওয়া যায় না।

মালিক বিন নাবীরা নিজেকে এত চালু মনে করে যে, আমাকে ফাঁদে ফেলে ঘেরাও করবে?” হযরত খালিদ বাতাহের পিনপতন নিরবতায় উদ্বিগ্ন হয়ে সহ সেনাপতিদের বলেন—“অবরোধের পদ্ধতি চেঞ্জ কর এবং পিছনে সতর্ক দৃষ্টি রাখ। আমি এই বসতিতে আগুন লাগিয়ে দিব। তারা এখানে নেই। পিছনে সরে গেছে, যেন আমরা এখানে এসে পৌঁছলে অতর্কিতে পিছন থেকে এসে আক্রমণ করতে পারে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ণ সতর্ক, নির্ভীক এবং রণকুশলী ছিলেন। তার পদক্ষেপ অতি দৃঢ় এবং যৌক্তিক হত। তিনি স্বীয় বাহিনীকে দু’ধারী করে বিন্যস্ত করেন। যাতে পশ্চাৎ আক্রমণও রুখে দেয়া যায় এবং শহরের অভ্যন্তর হতে একযোগে শত্রু ছুটে এলে তারও মোকাবিলা করা যায়। মুসলমানদের যে ঘাটতি ছিল তা হলো সৈন্যের স্বল্পতা। মদীনা হতে অনেক দূরে থাকায় এ মুহূর্তে রিজার্ভ বাহিনী আসারও কোন সম্ভাবনা ছিল না। মুসলিম বাহিনী ইতোমধ্যে যে সমস্ত গোত্রকে অনুগত করতে সমর্থ হয়েছিল সে সমস্ত এলাকায় তাদের ঘাঁটি ও অবাধ অবস্থান ছিল। কিন্তু তখনও এলাকাবাসীর উপর পূর্ণ আস্থা রাখার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নাই। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসরুদ্ধকর ও দক্ষ নেতৃত্ব মুষ্টিমেয় সৈন্যদের মাঝে বিজলির মত বজ্র সৃষ্টি করে রাখত।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বসতির মাঝে একদল সৈন্য প্রবেশ করান। কিন্তু তাদের উপর একটিও তীর এসে পড়ে না। প্রত্যেকটি ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিস্ময়কর এ নীরবতা দেখে নিজেই বসতির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।

“মালিক বিন নাবীরা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কয়েকবার মালিকের নাম ধরে ডাকেন এবং বলেন—“বাইরে বেরিয়ে এস। অন্যথায় পুরো বসতিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হবে।”

“আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন”—একটি ঘরের ছাদ থেকে জনৈক ব্যক্তির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—“আমাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিবেন না। আপনি যাকে ডাকছেন সে এখানে নেই। এখানে কেউ আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তোলন করবে না।”

“ওলীদের পুত্র!” আরেক ছাদ থেকে আওয়াজ আসে—“আপনি কি দেখছেন না, আমরা ঘরের দরজা লাগিয়ে আড়ালে বসে আছি। মদীনাবাসী কি জানেনা যে, এই আলামতের অর্থ হল, নির্ভয়ে আস; আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরব না?”

“অবশ্যই এই ইশারা সম্পর্কে আমি অবগত”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন— “ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এস। বাচ্চা ও মহিলাদের ইখতিয়ার। তারা চাইলে বাইরে আসতেও পারে আবার নাও আসতে পারে।”

মানুষ নিয়ম-নীতি জানত। তারা অস্ত্র ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসে। মহিলা এবং বাচ্চারাও বেরিয়ে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের তল্লাশী করতে পাঠান, যেন কোন ঘরে কোন পুরুষ না থাকে। তিনি সৈন্যদের কঠোরভাবে নিষেধ করেন যে, গৃহস্থ কোন মাল-দ্রব্যের যেন কোনরূপ ক্ষয়ক্ষতি না হয়। আর কারো প্রতি যেন বিন্দুমাত্র কঠোরতা না করা হয়।

মালিক বিন নাবীরার কেল্লাসদৃশ ভবনে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজে যান। সেখানে শুধু গৃহস্থ আসবাবপত্র ইতস্তত পড়ে ছিল। গৃহের অভ্যন্তর বলছিল, গৃহস্থ পরিবার একটু আগে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে। বসতি পরিদর্শন শেষে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এতটুকু অনুমান করতে সক্ষম হন যে, জনতাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করার পরামর্শ দিয়ে মালিক স্ত্রী লায়লাকে সাথে নিয়ে পালিয়ে গেছে। যারা তাকে যেতে দেখেছিল তারা তার গতিপথ বলে দেয়। মালিক ঘোড়ায় এবং লায়লা উটে সওয়ার ছিল বলে তারা জানায়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আশে-পাশের বসতিতে লোক পাঠায় এবং জনতা যে পথের খোঁজ দেয় সে পথে কয়েকজন সৈন্য প্রেরণ করে। এটা ছিল মরুপথ। উট এবং ঘোড়ার পদচিহ্ন খুব স্পষ্ট ছিল। বিরতিহনি পদচিহ্ন সৈন্যদেরকে একটি বসতিতে নিয়ে যায়। এটা ছিল বনূ তামীমের একটি বসতি।

“শোন, বনু তামীমের বাসিন্দা।” হযরত খালিদের পাঠানো লোকদের একজন উচ্চকণ্ঠে বলে—“মালিক বিন নাবীরা সহ বাতাহের কোন লোক এখানে আশ্রয় ও আত্মগোপন করে থাকলে তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও। আমাদের তল্লাশীতে কাউকে পাওয়া গেলে পুরো বসতি জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া হবে।”

একটু পরেই মালিক বিন নাবীরা লায়লাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসে এবং নিজেই নিজেকে হযরত খালিদ বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে। বনূ ইয়ারবূ এর আরো কতিপয় নেতৃস্থানীয় লোক এখানে এসে আত্মগোপন করেছিল। তারাও মালিকের অনুসরণ করে আত্মসমর্পণ করে। সৈন্যরা মালিক সহ সবাইকে বাতাহে নিয়ে আসে। লায়লাও মালিকের সাথে ছিল।

“মালিক বিন নাবীরা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মালিককে সামনে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন—“এটা কি সত্য নয় যে, তুমি যাকাত কর ইত্যাদি উঠিয়ে মদীনায় প্রেরণের পরিবর্তে আবার লোকদের ফিরিয়ে দিয়েছিলে?”

“মুসলমানদের মোকাবিলা না করার পরামর্শ দিয়ে আমি এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম”—মালিক বিন নাবীরা জবাবে বলে—“আমি তাদের এ কথাও বলেছিলাম যে, তোমরা মুসলমান হয়ে যাও এবং যাকাত আদায় কর।”

“আর তোমার নিজের আত্মগোপনের কারণ এই যে, তুমি ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“এবং তুমি ইসলাম থেকে দূরেই থাকতে চাও।…তুমি কবিতার মাধ্যমে মানুষকে বলেছিলে, তারা যেন যাকাত-কর না দেয়। আর তুমি নিজেও ইসলামী হুকুমতের বিরুদ্ধাচরণ করে লোকদেরও বিরুদ্ধাচরণ করতে প্ররোচিত করেছিলে।”

‘হ্যাঁ, ওলীদের পুত্র।” মালিক বলে—“আমি এতদিন বিরুদ্ধাচরণ করেছি ঠিকই কিন্তু এখন আমি তাদেরকে ইসলামী হুকুমতের বিরুদ্ধাচরণ করা হতে নিষেধ করছি।”

“তুমি সায্‌যাহ এর মিথ্যা নবুওয়াতকেও স্বীকৃতি দিয়েছিলে।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“এবং তার সাথে মিলে জনতার প্রাণনাশ এবং তাদের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করেছ। আর মুসলমানদের উপর চালিয়েছ ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ।”

মালিক মাথা ঝুকিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে।

“এতগুলো অপরাধের পর তোমাকে হত্যা না করার কোন কারণ আছে কি?” হযরত খালিদ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জানতে চান।

“আমার বিশ্বাস, আমাকে হত্যার কোন নির্দেশ খলীফা আপনাকে দেননি”— মালিক বিন নাবীরা বলে।

“খোদার কসম!” হযরত খালিদ বলেন—“আমি তোমাকে বেঁচে থাকতে দিতে পারি না।”

মালিক বিন নাবীরা সামনে এলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চোখের সামনে ভেসে আসে ঐ উজার বসতি, যা মালিক এবং সায্‌যাহ মিলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। মালিকের প্রতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন। তার অপরাধগুলোর প্রত্যেকটি ছিল জঘন্য ও ক্ষমাহীন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অনেক দূরে ছিলেন। তিনি সেখান হতে অযথা বাতাহে ছুটে আসেননি। তাঁর কাছে রীতিমত গোয়েন্দা রিপোর্ট পৌঁছতে থাকে। মালিক যে অত্যন্ত জঘন্য ও নৃশংস পন্থায় মুসলমানদের হত্যা ও ধ্বংস করে তিনি তা ভালভাবেই জানতেন।

“তাকে এবং তার সাথে যারা আত্মগোপন করেছিল তাদের নিয়ে যাও এবং হত্যা করে ফেল”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দেন।

তাদেরকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গেলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে খবর পৌঁছে যে, লায়লা নাম্নী এক রূপবতী নারী তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। সে নিজেকে মালিক বিন নাবীরার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে স্বামীর জীবন ভিক্ষা চাইতে এসেছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে উপস্থিত করতে বলেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও ছিলেন সর্দার পুত্র। খান্দানী ও শাসক পরিবারে লালিত-পালিত হওয়ার দরুণ তার মন-মানসিকতা প্রশস্ত ছিল। উন্নত অভিরুচি, প্রফুল্লচিত্ত এবং ফুরফুরে মেজাজের লোক ছিলেন। লায়লা তার সামনে এসে দাড়ালে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুহূর্তকালীন নেত্রে তার দিকে চেয়ে থাকেন। লায়লা তখনও পূর্ণ যুবতী ছিল।

“স্বামীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে এসেছ?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“এ ছাড়া আর কিইবা উদ্দেশ্য হতে পারে আমার?” লায়লা বলে।

“যখন সে প্রতিটি বসতিকে নিজের অধিকারভুক্ত মনে করে একের পর এক অপরাধ চর্চা করছিল তখন যদি তুমি তাকে বাধা দিতে তাহলে আজ এভাবে বিধবা হতে হত না”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“সে কি তোমাকে বলেনি, তার তলোয়ার কত বধূকে বিধবা করেছে। তার জানা ছিল না যে, পাপের খেসারত তাকে একদিন দিতেই হবে।”

“তাকে রোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না”—লায়লা বলে।

“তাহলে আজও তুমি আমাকে বিরত রাখতে পারবে না”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“এটা আমার নিজের নয়; খোদ আল্লাহর নির্দেশ।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লায়লার আবেদন গ্রাহ্য করেন না। লায়লা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে থাকাকালেই খবর এসে পৌঁছে যে, মালিক বিন নাবীরা এবং তার অন্যান্য সাথীদের হত্যা করে দেয়া হয়েছে।

তের

এরপর একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালিদ বাহিনী এবং মদীনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর তা হলো, বাতাহে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লায়লাকে বিবাহ করেছিলেন।

মদীনার আনসাররা এ বিবাহে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। হযরত আবু কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু শপথ করেন যে, ভবিষ্যতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে কোন যুদ্ধে কখনো অংশগ্রহণ করবেন না। তাদের অভিযোগের ভিত্তি হল, তারা ধারণা করে যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লায়লার রূপ-সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তার স্বামী মালিক বিন নাবীরাকে হত্যা করে তাকে নিজে বিবাহ করার জন্য।

এ সম্পর্কিত যে সমস্ত বর্ণনা প্রচলিত আছে তার মধ্য একটির বিবরণ এরূপ যে, লায়লা স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে আসে এবং এক পর্যায়ে তার পায়ে পড়ে মিনতি জানায়। লায়লার মাথায় কাপড় থাকত না এবং তার চুল খোলা থাকত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পা ধরে যখন সে মাথা নিচু করে তখন তার খোলা চুলগুলো কাঁধের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষিপ্ত চুল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টিকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি চুল দেখে বড়ই মুগ্ধ হয়ে বলেন—“এখন তো তোমার স্বামীকে অবশ্যই হত্যা করব।”

শালীন রুচিসম্পন্ন এবং উন্নততর মানসিকতার দরুণ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লায়লার ভূবনমোহিনী রূপ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলেও হতে পারেন। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাস্তবে এমন উচ্চ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে, মৃত্যুশয্যায় তিনি বলেছিলেন, আমার দেহে এমন কোন স্থান আছে কি, যেখানে জিহাদের ক্ষত চিহ্ন নেই? তার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র এত দুর্বল ছিল না যে, এক নারীর কারণে নিজের পদমর্যাদা হতে অন্যায়ভাবে ফায়দা লুটবেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষ অবলম্বনকারীদের ব্যাখ্যা হল, তিনি মালিক বিন নাবীরা ও তার সাথীদেরকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেন। তিনি নিজে তাদের বিচার না করে মদীনায় পাঠাতে চান। সে সময় রাতে তীব্র শীত পড়ত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেয়াল হয় যে, হয়ত কয়েদীরা শীতে কষ্ট পাচ্ছে এবং কাঁপছে। তিনি নির্দেশ দেন—“দাফিউ আসরাকুম অর্থাৎ বন্দীদের গরমের ব্যবস্থা কর”—কেনানা ভাষায় ‘মুদাফাত’ হত্যার অর্থে ব্যবহৃত হত। দুর্ভাগ্যক্রমে বন্দীরা যাদের প্রহরাধীন ছিল তাদের সবাই ছিল কেনানার অধিবাসী। মালিক বিন নাবীরা এবং তার সাথীদের অপরাধের মাত্রাও যে ভয়ানক ছিল তাও তারা জানত। ফলে তারা “গরমের ব্যবস্থা”-এর অর্থ বুঝে হত্যা করা। যার দরুণ প্রহরীরা মালিক এবং তার সাথীদের হত্যা করে দেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন ঘটনা জানতে পারেন তখন এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন—“আল্লাহর ইচ্ছা যে কোন উপায়ে সম্পন্ন হয়েই থাকে।”

এ ছাড়া পরস্পর সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী অসংখ্য বর্ণনা ইতিহাসে ভরপুর। এর কতক হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষে যায় আর কতক যায় বিপক্ষে। বিরোধী বর্ণনাগুলোর বর্ণনাকারীদের ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে তাকালে স্পষ্ট অনুমিত হয় যে, তাদের প্রতিটি শব্দ আক্রোশ ও পক্ষপাতিত্বে ভরা। প্রতিটি শব্দ হতে যেন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অবমাননা ঝরে পড়ছে।

ইতিহাস স্ববিরোধী বর্ণনায় বড়ই সরব কিন্তু এই বিবাহে লায়লার প্রতিক্রিয়া কি ছিল সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরব। কোন ঐতিহাসিক লেখেনি যে, লায়লা বাধ্য হয়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে স্বামী হিসেবে মেনে নেয়, না কি এক ভূবন বিজয়ী বীর, নামকরা সেনাপতির সাথে তার বিবাহ হচ্ছে বলে খুব আনন্দিত হয়।

তৎকালীন যুগের সমরনীতি অনুযায়ী লায়লা গনিমতের মাল ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চাইলে তাকে বাঁদী হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিতে পারতেন। ইতিহাসের একটি বর্ণনা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষে যায়। আর তা হলো, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে নিজের বা অন্য কারো বাঁদী হওয়ার থেকে রক্ষা করেন। সে শাহজাদীর মত রূপবতী ছিল। বাঁদীর জীবন কত দুঃখ ও বঞ্চনার হয় তা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতেন। তিনি আরো অনুভব করেন যে, লায়লা নজরকাড়া সুন্দরী হওয়ার সাথে সাথে বড় বিচক্ষণ এবং জ্ঞানীও বটে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মূলত এক অসহায় নারীর সুপ্ত প্রতিভা এবং যোগ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

সুদূর মদীনাতেও এই খবর পৌঁছে যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মালিক বিন নাবীরাকে হত্যা করে তার স্ত্রীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। খবর পৌঁছে তাও সোজা খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে। সংবাদদাতা ছিলেন হযরত আবু কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত বিশিষ্ট সাহাবী। তিনি এই বিবাহে অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হয়ে যুদ্ধ ছেড়ে মদীনায় ফিরে গিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তিনি মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধি প্রদান করেছেন। তার বিরুদ্ধে তিনি কোন পদক্ষেপ নিবেন না। তিনি তো কোন জীবিত ব্যক্তির স্ত্রীকে আটকে তাকে নিজের বধূ বানাননি।

হযরত আবু কাতাদা আনসারী রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জবাবে তুষ্ট হন না। তিনি হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে যান এবং তাকে এমন ভাষায় লায়লার সাথে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিবাহের কাহিনী শোনান, যার দ্বারা প্রকাশ পায় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু একজন বিলাসপ্রিয় মানুষ এবং তার এই আয়েশী জীবন স্বীয় কর্তব্য পালনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং যুদ্ধযাত্রায় দারুণ ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বর্ণনাভঙ্গিতে হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্রোধ উথলে ওঠে। তিনি আবু কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সাথে নিয়ে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সকাশে উপস্থিত হন।

“সম্মানিত খলীফা!” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন—“খালিদের অপরাধ সামান্য নয়। বনূ ইয়ারবূর সর্দার মালিক বিন নাবীরাকে হত্যার বৈধতা সে কিভাবে প্রমাণ করবে?”

“কিন্তু তুমি কি চাও উমর?” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করেন।

“খালিদের অপসারণ!” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“কেবল অপসারণ নয়; তাকে গ্রেপ্তার করে এখানে এনে শাস্তি দেয়া হোক।”

“উমর!” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“এতটুকু তো ঠিক যে, খালিদ থেকে ভুল সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এ ভুল এতটা মারাত্মক নয় যে, তাকে অপসারণ করে রীতিমত শাস্তি দিতে হবে।”

হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিছু ছাড়েন না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই কঠোরতার কারণ তার প্রতি কোনরূপ শত্রুতা বা বিদ্বেষ নয়; বরং আসল কথা হলো, হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়ণ এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি বড়ই কঠোর ছিলেন। সেনাপতিদের মাঝে কোন অন্যায়-আচরণ ও ভূলের অনুপ্রবেশ হোক তা তিনি চাচ্ছিলেন না। বিচার সাপেক্ষে সমুচিত শাস্তি দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের জন্য সকল সেনাপতিকে শিক্ষা দিতে চান।

“না উমর!” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বারবার পীড়াপীড়ির পর বলেন—“আমি ঐ তলোয়ার খাপবদ্ধ করতে পারি না, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা কাফেরদের উপর বিজয়ী করেছেন।”

হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তুষ্ট হতে পারেন না। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অসন্তুষ্টও করতে চান না। তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদীনায় তলব করেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দীর্ঘ সফর পাড়ি দিয়ে বহুদিন পর মদীনায় পৌঁছেন এবং সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে যান। তিনি মাথার পাগড়িতে একটি তীর বিদ্ধ করে রেখেছিলেন। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু মসজিদেই ছিলেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখে তিনি রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি উঠে দাঁড়ান এবং হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাগড়ি হতে তীর টেনে বের করেন এবং তা টুকরো টুকরো করে দূরে ছুড়ে দেন।

“তুমি এক মুসলমানকে হত্যা করেছ”—হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাগতস্বরে বলেন—“এবং তার স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী বানিয়েছ। তুমি প্রস্তর বর্ষণে হত্যার যোগ্য।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিয়মানুবর্তীতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মর্যাদা ও পদাধিকার সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল ছিলেন। ফলে নিশ্চুপ থাকেন। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কোন কথার প্রতিবাদ করেন না। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রাগ পড়ে গেলে তিনি নীরবে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং সোজা খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সমীপে গিয়ে উপস্থিত হন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুই তাকে কারণ দর্শানোর জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সম্মতি পেয়ে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনপূর্বক মালিক বিন নাবীরার সমস্ত ঘটনা ও অপরাধের বিবরণ দেন। তিনি অকাট্যভাবে প্রমাণ করেন যে, মালিক বিন নাবীরা মুসলমান ছিল না; বরং উল্টো মুসলমানদের প্রাণের শত্রু ছিল।

হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তিরস্কার করেন এবং তাকে সতর্ক করে দেন যে, ভবিষ্যতে এমন কোন আচরণ যেন না করেন, যা অন্যান্য সেনাপতির মাঝে ভুলের প্রচলন ঘটায়। ইমাম তবারী এবং হাইকাল প্রমুখের বর্ণনা মুতাবিক হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিশেষে এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যে, বিজিত গোত্রের কোন নারীকে বিবাহ করা এবং ইদ্দতকাল পূর্ণ না করা আরবের প্রচলিত রীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, এ নারী পরিশেষে বাঁদীই হত। তাই মনিবের এ ইখতিয়ার রয়েছে যে, সে তাকে বাঁদীও বানাতে পারে, আবার চাইলে বিবাহ করে স্ত্রী বানিয়ে রাখতে পারে।

হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে আরো বলেন, বর্তমানে মুসলমানরা চতুর্দিক থেকে বিপদ কবলিত। গোত্রের পর গোত্র বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উঁচু করছে। এর বিপরীতে আমাদের সৈন্যসংখ্যা খুবই অপ্রতুল। এমতাবস্থায় কোন সেনাপতি শত্রু পক্ষের কোন নেতাকে ভুলক্রমে হত্যা করে ফেললেও তা কোন মারাত্মক অপরাধ নয়।

খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, ইসলামের এক ঘোরতর শত্রু মুসাইলামা বিন হানীফা নবুওয়াতের দাবী করে এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তার অধীনে কম-বেশী ৪০ হাজার সৈন্য আছে। ইকরামা বিন আবু জাহল ইতোমধ্যে তার কাছে পরাজিত হয়েছে। এখন সবার দৃষ্টি খালিদের দিকে। মুসাইলামাকে পরাস্ত না করতে পারলে ইসলাম মদীনার মাঝেই কার্যত বন্দী হয়ে পড়বে। এ সফলতার জন্য হযরত খালিদের বিকল্প নেই।

হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু চুপ থাকেন। তিনিও বিপদের গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করতে সক্ষম হন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নির্দেশ দেন, এখনি বাতাহে রওয়ানা হয়ে যাও এবং সেখান থেকে সসৈন্যে মার্চ করে গিয়ে ইয়ামামায় আক্রমণ করে উত্থিত ফেৎনার মূলোৎপাটন কর।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক এক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বাতাহে উড়াল দেন। তিনি বাতাসের বেগে এসে বাতাহে পৌঁছান এবং পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

চৌদ্দ

৬৩২ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় সপ্তাহে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মাত্র ১৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ৪০ হাজারেরও অধিক মুরতাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইয়ামামা নামক স্থানে এক ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইতিহাসে এটাই ইসলামের সর্বপ্রথম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হিসেবে বিবেচিত। এ যুদ্ধের শেষাংশ ‘হাদীকাতুর রহমান’ নামক এক বিস্তীর্ণ বাগিচায় অনুষ্ঠিত হয়। এখানে উভয় পক্ষের এত প্রাণহানি ঘটে যে, মানুষ ঐ বাগিচাকে হাদীকাতুর রহমান-এর পরিবর্তে ‘হাদীকাতুল মওত’ (মৃত্যুদানব) নামে স্মরণ করে। আজও ঐ স্থানটি ‘হাদীকাতুল মওত’ নামে পরিচিত।

মুসাইলামা সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, সে নবুওয়াতের দাবী করেছিল। তার ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা এত বৃদ্ধি পায় যে, তার সৈন্যরা মুসলিম বাহিনীর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ সময়ে মুসলমানরা এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হয় কিন্তু অপরদিকে মুসাইলামার শক্তিও বর্ধিত হতে থাকে। এটা যেমন মদীনার জন্য আশংকাজনক ছিল তেমনি ইসলামের জন্যও ছিল উদ্বেগজনক। মদীনা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের হেড কোয়ার্টার।

হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাতাহে এসে মুসাইলামার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তার জানা ছিল যে, পুরাতন দোস্ত সেনাপতি ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্র এলাকার আশে-পাশে কোথাও সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছেন। ফলে কঠিন মুহূর্তে তিনি এসে খালিদ বাহিনীকে সাহায্য করবেন।

হযরত ইকরামা বিন জাহল রাযিয়াল্লাহু আনহু ঐ ১১ সেনাপতির একজন, খলীফা যাদেরকে বিভিন্ন এলাকায় মুরতাদ এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। মুসাইলামার গোত্রের ন্যায় এত শক্তিশালী অন্য কোন গোত্র ছিল না। তাই প্রথমে এ এলাকায় হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে পাঠানো হয় এবং তার পশ্চাতে হযরত শারযীল নামে আরেক সেনাপতিকেও প্রেরণ করা হয়। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতি শারযীলকে হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সাহায্য করার নির্দেশ দিয়ে পাঠান।

হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়ামামায় চলছেন। এটা আড়াই মাস পূর্বের ঘটনা। তখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অপর ভণ্ড নবী তুলাইহার সাথে শক্তি পরীক্ষায় লিপ্ত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তুলাইহাকে তুলোধুনা করে পরাস্ত করেন। এ সংবাদ হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কানে পৌঁছলে তিনি আবেগতাড়িত হন। তখনও পর্যন্ত কোন গোত্রের সাথে তার সংঘর্ষ হয় না। এর কিছুদিন পরে ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু আবার জানতে পারেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সালমার শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করেছেন।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর এক ধরনের মানবিক দুর্বলতা প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি সাথের অন্যান্য সেনাপতিকে বলেন, হযরত খালিদ যেখানে একের পর এক রণাঙ্গনে বিজয় অর্জন করে চলেছে সেখানে তিনি এখনও কোন যুদ্ধের মুখোমুখী হননি। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হয়ত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের পূর্ব হতেই পরস্পর ঘনিষ্ঠ সাথী, এক মানের যোদ্ধা এবং রণাঙ্গনে উভয়ে দক্ষ নেতৃত্বদানে পারঙ্গম ছিলেন।

“আমরা এমন একটি বিজয় অর্জন করতে পারি না, যার সামনে খালিদের সকল বিজয় ম্লান হয়ে যায়?” হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু অধীনস্ত সেনাপতিদের লক্ষ্য করে বলেন—“আমি জানতে পেরেছি, শারযীল আমাদের সাহায্যে আসছেন। জানি না তিনি কবে নাগাদ এসে পৌঁছবেন। বেশীদিন অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মুসাইলামার উপর আক্রমণ করতে চাই।”

মুসাইলামা অর্বাচীন কিংবা নির্বোধ ছিল না। তার ভাল করেই জানা ছিল যে, মুসলমানরা তার নবুওয়াত কোনভাবেই বরদাশত করবে না। যে কোনদিন মুসলিম বাহিনী এসে তার টুটি চেপে ধরতে পারে। সে নিজ এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে রেখেছিল। চৌকস এবং গোয়েন্দা টিমও প্রস্তুত রাখে। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু সার্বিক দিক বিবেচনা না করেই অগ্রসর হন এবং ইয়ামামার নিকটে এসে পৌঁছান। আবেগ উদ্বেলিত হওয়ায় শত্রুর গতিবিধির উপর নজর রাখার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সতর্ক হতে পারেন না। তিনি শত্রুদের না দেখলেও অপর পক্ষের গোয়েন্দারা ঠিকই তার বাহিনীকে দেখে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে মুসাইলামাকে অবহিত করে।

উঁচু-নীচু টিলা ও বালিয়াড়ি এক স্থানে মূসাইলামার কতক সৈন্যের উপর হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চোখ পড়ে। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের উপর হামলা চালান। কিন্তু এটা মুসাইলামার একটি পাতা ফাঁদ বৈ ছিল না। মুসাইলামা অত্র অঞ্চলের ডানে বামে অগ্রে-পশ্চাতে বিপুল সৈন্য লুকিয়ে রেখেছিল। গুপ্ত এ বাহিনী চতুর্দিক থেকে ইকরামা বাহিনীর উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এই ধারণাতীত পরিস্থিতি সামলে উঠতে ব্যর্থ হয়। মুসাইলামার বাহিনী তাদেরকে সামলে উঠতে সুযোগ দেয় না। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে প্রখ্যাত এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি ছিল। কিন্তু রণাঙ্গন ছিল শত্রুর নিয়ন্ত্রণে। তারা মুসলমানদের কোন চাল সফল হতে দেয় না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে পিছে হটে আসতে হয়।

হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষে এই পরাজয়ের খবর গোপন করা সম্ভব ছিল না। গোপন করলে সৈন্যদের কেউ মদীনায় খবর পৌঁছে দিত। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ণ বিবরণ লিখে খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর পাঠিয়ে দেন। পত্র পাঠে তিনি ভীষণ মনঃক্ষুন্ন হন। তিনি ইতিপূর্বে স্পষ্টভাষায় হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন সেনাপতি শারযীলের পৌঁছার অপেক্ষা করেন এবং একাকী মুসাইলামার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হন। কিন্তু হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ধৈর্যধারণ করতে পারেননি। তিনি ত্বরিৎ আবেগের শিকার হন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে যে লিখিত জবাব দেন তাতে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ এভাবে ছিল যে, তিনি হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইবনে আবু জাহলের (বাপের বেটা-এর) পরিবর্তে ইবনে উম্মে ইকরামা (মায়ের বেটা) লেখেন। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা উদ্দেশ্য হলে আরবে তাকে পিতার প্রতি সম্বন্ধ না করে মাতার প্রতি সম্বন্ধ করা হত। এর দ্বারা এটা বুঝানো হত যে, তোমার জন্মের বিষয়টি বিতর্কিত অথবা তুমি স্বীয় পিতার সন্তান নও। খলীফার পত্রের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ”

“ইবনে উম্মে ইকরামা! আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। তুমি মদীনায় আস—এটাও চাই না। কারণ, তুমি এলে এখানকার জনতার মাঝে নিরাশা আর হতাশা ছড়িয়ে পড়বে। মদীনার ধারে-কাছে ভিড়বে না। তুমি ইয়ামামা এলাকা ছেড়ে হুজায়ফার সাথে গিয়ে মিলিত হবে। সম্মিলিতভাবে আম্মনবাসীদের সাথে যুদ্ধ করবে। এখানে যুদ্ধ শেষ হলে আরফাযার সাহায্যার্থে মাহরা চলে যাবে। তারপর ওখান থেকে ইয়ামান গিয়ে মুহাযির বিন আবী উমাইয়্যার সাথে গিয়ে মিলিত হবে। যতদিন তুমি সফল সেনাপতির পরিচয় দিতে সক্ষম না হবে ততদিন আমাকে তোমার মুখ দেখাবে না। আমি তোমার সাথে কথা পর্যন্ত বলব না।”

খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু অপর সেনাপতি হযরত শারযীল রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর নির্দেশ পাঠান যে, যেখানে বর্তমানে আছ সেখানেই অবস্থান করে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অপেক্ষা কর। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এলে নিজের সৈন্য তার হাওলা করে দিয়ে নিজেও তার অধীন হয়ে যাবে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জানিয়ে দেয়া হয় যে, হযরত শারযীল রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্য তিনি পেয়ে যাবেন। এতে তিনি এই চিন্তার সময়ে বেজায় খুশী হন যে, এবার তিনি অতি সহজে মুসাইলামার মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। তার আশা ছিল হযরত শারযীলের সৈন্যরা পূর্ণ তেজোদীপ্ত হবে। কিন্তু এ সৈন্য যখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লাভ করেন তখন তারা তেজোদ্যম ছিল না। অধিকাংশই হতোদ্যম এবং কতক ছিল রক্তাক্ত-আহত।

“কি হয়েছে শারযীল?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘটনার ব্যাখ্যা চান।

“একরাশ লজ্জা ছাড়া কোন জবাব আমার কাছে নেই”—শারযীল আহত স্বরে বলে—“আমি খলীফার নির্দেশ অমান্য করেছি। আমার প্রতি কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল, হযরত ইকরামাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু আমার পৌঁছার পূর্বেই ইকরামা মুসাইলামার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পিছু হটে আসে। এটা একটি আত্মপ্ররোচনা ছিল, যা আমাকে কাবু করে যে…।”

“একটি বিজয় তোমার খাতায় লেখা হয়ে যাক”—অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হযরত শারযীলের জবাব পূরণ করতে গিয়ে বলেন—“বিচ্ছিন্ন পাথরের কোন শক্তি নেই শারযীল! কিন্তু এই পাথরযোগে যখন কোন প্লাটফর্ম তৈরী হয় তখন সেটা এত শক্তিধর হয়ে ওঠে যে, যেই তার সাথে একবার মাথা ঠুকে, সে দ্বিতীয়বার মাথা ঠুকার জন্য আর জীবিত থাকে না। ব্যক্তি স্বার্থ এবং আত্মঅহমিকার পরিণাম দেখেছ তো? ইকরামার মত অভিজ্ঞ সেনাপতিও চরমভাবে পর্যদস্ত হয়েছে। আমি তোমার প্রতি এই অনুগ্রহ করছি যে, তোমার নির্বুদ্ধিতার খবর খলীফাকে জানতে দিব না।”

হযরত শারযীল বিন হাসান রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত ভুলের শিকার হয়েছিলেন। তিনিও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাজি জেতার উদ্দেশ্যে পথিমধ্যেই মুসাইলামার সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত পিছু হটে আসতে বাধ্য হন।

জাকজমকপূর্ণ দরবার। দরবারে উপচে পড়া ভীড়। মুসাইলামা মধ্যমণি। দরবারের প্রধান আকর্ষণ। তাকে ঘিরে দরবার দারুণ জমে উঠেছে। সুকৌশলে খর্বকায় এবং কুৎসিত এই লোকটি ইতোমধ্যে পুরোপুরি নবী হয়ে গিয়েছিল। তার গোত্র বনূ হানীফা প্রথম থেকেই তার নবুওয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করে। অন্যান্য গোত্রের লোকেরাও বড় আবেগ ও আগ্রহ নিয়ে তার হাতে বাইয়াত ও তাকে এক পলক দেখতে ভীষণ উদগ্রীব থাকত। মানুষ তার শক্তি এবং অলৌকিক গুণ দেখেছিল। এখন তার অনুসারীরা আরো দুটি জলজ্যান্ত মোজজা দেখে নেয়। তারা মুসলমানদের দুই প্রখ্যাত সেনাপতিকে স্বল্প সময়ে অনায়াসে রণাঙ্গন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

ধর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে মুসলমানরা রেশমের চেয়েও মোলায়েম ছিল।

কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে তারা ইস্পাতের চেয়েও শক্ত এবং বিদ্যুৎগোলকে পরিণত হত। সমর দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানরা রীতিমত ভয়ঙ্কর দানবের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এবং হযরত শারযীল রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেদের ভুল এবং বিচক্ষণতার স্বল্পতার দরুণ পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু বনু হানীফা এটাকে তাদের ভণ্ড নবীর মোজেজা এবং অলৌকিকতার খাতায় লিপিবদ্ধ করেছিল। তারা গর্বের সাথে বলত, মুসাইলামা ছাড়া মুসলমানদের পরাজিত করার মত আর কে আছে।

“নাহারুর রিযাল!” মুসাইলামা নিকটে বসা তার ডানহাতি হিসেবে পরিচিত নাহারুর রিযালকে সম্বোধন করে বলে—“এখন আমাদের মদীনামুখী হওয়ার প্রস্তুতি নেয়া দরকার। মুসলমানদের মধ্যে এখন আগের সেই শৌর্য-বীর্য নেই।”

পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, নাহারুর রিযাল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্যে থেকে পবিত্র কুরআন পড়া শিখেন এবং শরীয়তের উপর গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মুবাল্লিগ করে মুসাইলামার এলাকায় পাঠান কিন্তু তিনি মুসাইলামার যাদুর কাছে পরাস্ত হয়ে পড়েন। ফলে নিজেও তার ভক্ত হয়ে মুসাইলামার নবুওয়াতের ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। কুরআনের আয়াতের বিভিন্ন অপব্যাখ্যা করে তাদেরকেও মুসাইলামার অনুসারীর কাতারে এনে দাঁড় করায় যারা একদা খাঁটি ইসলাম কবুল করেছিল। মুসাইলামা তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে প্রধান উপদেষ্টা বানায়। এটা ছিল শরাব এবং নারী-রূপের যাদুর কারসাজী। মুসাইলামা নিজেও অত্যন্ত খর্বকায় এবং জঘন্য চেহারার হওয়া সত্ত্বেও নারী মহলে সে অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিল। ঐতিহাসিকের মন্তব্য, তার চেহারায় মহিলারা এক ধরনের বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করত। সায্‌যাহ এর মত নারী কিলোপেট্রার ন্যায় সমরশক্তি নিয়ে মুসাইলামাকে পরাস্ত করতে এসে মাত্র এক সাক্ষাতেই তার স্ত্রী হয়ে যায়।

এটা মুসাইলামার দৈহিক শক্তি এবং যাদুর নৈপুণ্য ছিল। অল্প সময়ের ব্যবধানে এক বিরাট সমরশক্তি অর্জন করেছিল। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত শারযীল রাযিয়াল্লাহু আনহু এর মত সেনাধ্যক্ষকে পিছু হটিয়ে তার এবং বাহিনীর সাহস বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে তারা এখন মদীনা হেডকোয়ার্টারের প্রতি দৃষ্টি তোলার সাহস করে। সে দরবারে উপবিষ্ট প্রধান উপদেষ্টাকে মদীনা আক্রমণের সার্বিক প্রস্তুতির কথা বলে। নাহারুর রিযাল কোন মন্তব্য করার পূর্বেই মুসাইলামাকে জানানো হয় যে, এক গোয়েন্দা আপনার শরণাপন্ন। মুসাইলামা তৎক্ষণাৎ তাকে ভিতরে নিয়ে আসতে বলে।

“মুসলমান বাহিনী এগিয়ে আসছে”—গোয়েন্দা এসেই খবর দেয়। সংখ্যায় তারা ১০ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে।

“তোমরা যখন তাদের দেখেছ তখন তারা কোথায় ছিল?” মুসাইলামা জিজ্ঞাসা করে।

“হানীফা উপত্যকার খানিকটা দূরে”—গোয়েন্দা জবাবে বলে—“এতক্ষণ আরো এগিয়ে এসে থাকবে।”

“হতভাগাদেরকে মৃত্যু হানীফা উপত্যকায় টেনে এনেছে”—মুসাইলামা অহংকারের সাথে বলে—“তাদের জানা নেই যে, মাত্র ১০/১৫ হাজার সৈন্য আমার ৪০ হাজার সিংহের হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও আহত হবে।”

সে উঠে দাঁড়ায়। দরবারের অন্য সদস্যরাও সম্মানার্থে উঠে দাড়ায়। সে নাহারুর রিযালকে সাথে নিয়ে দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। সে ঘোড়া প্রস্তুত করে নাহারুর রিযালকে সাথে নেয় এবং এক সময় ঘোড়া উভয়কে উড়িয়ে ইয়ামামা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য ছিল হানীফা উপত্যকা।

“এই উপত্যকা হতে তারা জীবন নিয়ে বের হতে পারবে না”—পথিমধ্যে মুসাইলামা নাহারুর রিযালকে বলে—“আমার এই ফাদ সম্পর্কে তারা ঘুণাক্ষরেও জানে না।”

নাহারুর রিযাল অট্টহাসি দিয়ে উঠে এবং বলে—“আজ মুহাম্মাদের ইসলাম হানীফা উপত্যকায় চিরদিনের জন্য সমাধিস্থ হয়ে যাবে।”

তারা অর্ধেক পথ এগিয়ে গেলে ওদিক থেকে এক অশ্বারোহী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। অশ্বারোহী মুসাইলামাকে দেখে থেমে যায়।

“নবীজী!” অশ্বারোহী কম্পিত কণ্ঠে বলে—“মুসলমানরা মাযা‘আ বিন মুরারাকে বন্দী করে ফেলেছে।”

“মাযা‘আকে?” মুসাইলামা বিস্ময়কণ্ঠে বলে।

“মাযা‘আকে মুসলমানরা…”—নাহারুল রিযাল ভয়ার্তস্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে।

“মাযা‘আর মত দুর্ধর্ষ এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই”—মুসাইলামা বলে—“মাযা‘আর বন্দী হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য শুভলক্ষণ নয়।

মাযা‘আ মুসাইলামার বড় ঝানু এবং বীর সেনাপতি ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তার অনেকটা মিল ছিল। ঐতিহাসিকদের অভিমত, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সমর চাল চালার যোগ্যতা একমাত্র মাযা‘আর মধ্যেই ছিল। মুসলমানদের হাতে মাযা‘আর বন্দী হওয়ার ব্যাপারটি ছিল দৈবাৎ। এটা এভাবে ঘটে যে, মাযা‘আর কোন এক নিকটবর্তী আত্মীয়কে বনী আমের এবং বনী তামীমের কিছু লোক মিলে হত্যা করেছিল। মাযা‘আ তার এই আত্মীয়ের রক্তের প্রতিশোধ নিতে মুসাইলামার কাছে ৪০ জন সৈন্য চেয়ে দরখাস্ত করে। মুসাইলামা তার এ যোগ্য সেনাপতিকে নিরাশ করতে চায় না। ফলে সে অনুমতি প্রদান করে।

মাযা‘আ দুশমনের এলাকায় যায় এবং তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে ফিরে আসছিল। তার জানা ছিল না যে, যে এলাকাকে সে নিরাপদ মনে করত তা এখন আর নিরাপদ নেই। সে সৈন্যদের শ্রান্তি দূর করতে এক স্থানে ছাউনী ফেলে। জিম্মাদারী পালন করে তারা ফিরছিল। ঘোড়ার জিন খুলে তারা শুয়ে পড়ে। ক্ষণিকের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় হারিয়ে যায়।

ঘটনাক্রমে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী এ পথ দিয়েই আসছিল। প্রভাতে মূল বাহিনীর অগ্রবর্তী বাহিনী ঐ স্থানে এসে পৌঁছে যেখানে মাযা‘আ সৈন্যদের নিয়ে গভীর নিদ্রায় শায়িত ছিল। মুজাহিদ বাহিনী তাদের জাগ্রত করে এবং তাদের অস্ত্র-শস্ত্র ও ঘোড়া নিয়ে নেয়। নজরবন্দী করে তারা তাদেরকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে নিয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতেন না যে, মাযা‘আ মুসাইলামার বিরাট মূল্যবান সেনাপতি। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্যদের সাথে তাকেও সাধারণ সেপাই বলে ধারণা করেন। তারা প্রকৃতপক্ষে এক বিরাট শিকার লাভ করেছিল।

ধৃত সৈন্যরা স্বীকার করে যে, তারা মুসাইলামার বাহিনীর সেপাই। কিন্তু মাযা‘আর পরিচয় তারা প্রকাশ হতে দেয় না।

“তোমরা আমাদের মোকাবিলার উদ্দেশে এসেছিলে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।

“না”—একজন জবাবে বলে—“আমাদের জানাই ছিল না যে, মুসলিম সৈন্যরা আসছে। বনী আমের এবং বনী তামীম হতে আমাদের এক ব্যক্তির রক্তের প্রতিশোধ নিতে আমরা গিয়েছিলাম।”

“ঠিক আছে তোমাদের কথা মেনে নিলাম”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আমি তোমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিতে পারি। তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও যে, তোমরা কাকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস কর এবং কার উপর ঈমান রাখ?”

“নিঃসন্দেহে মুসাইলামা আল্লাহর রাসূল”—ধৃত এক সৈন্য জবাব দেয়।

“খোদার কসম!” তোমরা আমাকে অপমান করলে ক্ষমা করতাম। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননা আমি কিভাবে বরদাশত করব!”

“আপনি আপনার রাসূল মানেন আমরা আমাদের নবীকে মানি”—মাযা‘আ বলে—“বাস্তব ব্যাপারও এটা যে, মুসাইলামা রেসালাতের প্রশ্নে মুহাম্মাদের সমান অংশীদার।”

“আমাদের সকলের আকীদা-বিশ্বাস এটাই”—ধৃত সৈন্যরা এক যোগে বলে—আপনাদের মাঝে এক নবীর আবির্ভাব হয়েছে, আমাদের মাঝে আরেক নবী এসেছেন।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চোখের পলকে তলোয়ার বের করেন এবং এক কোপে এক সৈন্যের মস্তক উড়িয়ে দেন। অন্যদেরও এভাবে হত্যা করার নির্দেশ দেন। অন্যদের সাথে মাযা‘আকেও হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকারী তার গলা কাটতে তরবারী উপরে তোলে। আরেকটু পরেই তরবারীর আঘাতে মাযা আর মস্তক আর দেহ দুদিকে ছিটকে পড়বে।

“থামো!” সারিয়া বিন আমের নামে এক ধৃত সৈন্য চিৎকার করে শূন্যে খোলা তরবারী থামানোর পরামর্শ দিয়ে বলে—“কমপক্ষে এ লোকটিকে জীবিত রাখ। এ তোমাদের কাজে আসতে পারে।”

এ সময় উদঘাটিত হয় যে, মাযা‘আ বনূ হানীফার একজন শীর্ষ নেতা। কিন্তু তারপরেও গোপন রাখা হয় যে, মাযা‘আ শুধু গোত্রপতিই নয়; অন্যতম সেনাপতিও বটে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চৌকস এবং দূরদর্শী ছিলেন। গোত্রের নেতারা মোটা অঙ্কের জামিন হত। তাকে যে কোন স্পর্শকাতর স্থানে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করা যেতে পারত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মাযা‘আর পায়ে বেড়ী পরিয়ে তাকে নিজের তাঁবুতে নিয়ে যান এবং স্ত্রী লায়লার হাতে তাকে সমর্পণ করেন। ধৃত অবশিষ্ট সৈন্যদের সকলকে হত্যা করা হয়।

মাযা‘আর গ্রেপ্তার মুসাইলামার জন্য কোন তুচ্ছ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু হানীফা উপত্যকা এমন ফাঁদ ছিল যা ঐ ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। তদুপরি মুসাইলামার সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪০,০০০। পক্ষান্তরে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৩,০০০। মুসাইলামার বাহিনীতে অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহীর সংখ্যা ছিল অনেক। কতিপয় ঐতিহাসিক মুসাইলামা বাহিনীর সংখ্যা ৭০ হাজার লিখেছেন। মোটকথা, মুসাইলামার সৈন্যসংখ্যা ৪০ হাজারের ঊর্ধ্বে ছিল, কম নয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এক বড় দুর্বলতা বলতে যা ছিল, তা হলো, তার সৈন্যসংখ্যা উদ্বেগজনকহারে কম ছিল। দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো, হেডকোয়ার্টার থেকে তিনি যোজন যোজন মাইল দূরে ছিলেন। ফলে প্রয়োজনীয় রসদপত্র কিংবা রিজার্ভ ফৌজ আসার কোন উপায় তার ছিল না। তবে এ বিষয়টা তাকে আশ্বস্ত করে যে, অত্র এলাকায় খাবার পানি এবং পশু-প্রাণীর খোরাকের কমতি ছিল না। ফসল এবং ফল-মূল সমৃদ্ধ ছিল গোটা এলাকা।

ফসল সমৃদ্ধ ক্ষেত-খামার এবং ফল-মূল সমৃদ্ধ বাগ-বাগিচার চিন্তা মুসাইলামাকে কুরে কুরে খায়। সে এগুলোর হেফাজতের চিন্তায় ছিল বিভোর। সে নাহারুর রিযালকে বলে যে, এমন পদ্ধতিতে সে লড়তে চায় যাতে মুসলমানদের হাতে কোন বসতি, ক্ষেত-খামার এবং বাগ-বাগিচা নষ্ট না হয়। ইতিহাস বলে, মুসাইলামা কোন প্রকার আবেগ, সিদ্ধান্তহীনতা এবং উদ্বেগের শিকার ছিল না। সে এমনভাবে কথা বলত, যেন বিজয় সম্পর্কে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। সে ভেবে-চিন্তে এবং হিসেব-নিকেশ করে কথা বলত। ৪০ হাজার সৈন্য ছিল তার উপর ভরসা। এদের প্রত্যেকেই ছিল মুসাইলামা নামের পাগল। মুসাইলামার নবুওয়াত রক্ষার্থে তারা জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ফাঁদে পা দেয়ার মত সেনানায়ক ছিলেন না। মুতা যুদ্ধে ফাঁদে পড়ে তিনি সারা জীবনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ইয়ামামা অঞ্চলের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিফহাল ছিলেন না। তিনি অবস্থা যাচাই এবং সামনে এলাকা পরখের উদ্দেশ্যে একটি টিম গঠন করেন। রাতে এ টিম যে রিপোর্ট দেয় তার আলোকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গতিপথ বদল করেন। তিনি হানীফা উপত্যকার প্রকৃতি সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হলে এখান থেকে বিপদের গন্ধ পান। ফলে তিনি এই উপত্যকা এড়িয়ে সামনে অগ্রসর হবার ইচ্ছা করেন। তিনি একটু দূর থেকে ঘুরে সামনে এগিয়ে যান।

মুসাইলামাও গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে রেখেছিল। গোয়েন্দারা তাকে জানায় যে, মদীনা বাহিনী হানীফা উপত্যকা এড়িয়ে দূরবর্তী পথ ঘুরে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়েছে। মুসাইলামা এ খবর পেয়ে সৈন্যদেরকে দ্রুত আকরাবা ময়দানে স্থানান্তর করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি এই ময়দানের উপর ছিল। কিন্তু মুসাইলামা বাহিনী পূর্বেই সেখানে পৌঁছে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সমতলভূমি থেকে উঁচু এক স্থানে এসে ছাউনী ফেলেন। এখান থেকে মুসাইলামা বাহিনীর ছাউনী স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে এবং তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখা সহজ ছিল।

মুসাইলামা এই ময়দানকে যুদ্ধের জন্য উত্তম ও উপযুক্ত মনে করে। কারণ, তার সৈন্যদের সকল রসদপত্র এবং মাল-আসবাব তাদের ছাউনীর পিছনে ছিল। দ্বিতীয়ত ক্ষেত-খামার এবং বাগ-বাগিচা তাদেরই পিছনে ছিল। ফলে এগুলো হেফাজত করা এখন তার জন্য অত্যন্ত সহজ হয়ে যায়। সে মনে মনে এ অঙ্ক কষে রাখে যে, খালিদ বাহিনী এখন থেকে ইয়ামামা অভিমুখে রওয়ানা করতে চেষ্টা করলে পশ্চাৎ হতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও কম সেয়ানা ছিলেন না। তিনিও অনুভব করেছিলেন যে, ওখান থেকে সামনে অগ্রসর হওয়া আত্মহত্যার শামিল হবে।

মুসাইলামা পুরো বাহিনীকে তিন অংশে বিভক্ত করে। ডান বাহিনীর নেতৃত্ব নাহারুর রিযালের হাতে অর্পণ করে। বাম বাহিনীর সেনাপতি ছিল মুহকাম বিন তোফাইল। আর মধ্যবর্তী বাহিনীর নেতৃত্ব নিজ হাতেই রাখে। মুসাইলামা তার পুত্র শারযীলকে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে আগুন ঝরানো ভাষণ দিতে বলে। শারযীল ঘোড়ায় আরোহণ করে এক এক করে তিন বাহিনীর সামনে গিয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলে :

বনূ হানীফার শার্দুলেরা! আজ সময় এসেছে ইজ্জত-আবরু রক্ষায় নিজেকে কুরবান করা। আল্লাহ্ তোমাদের গোত্রে নবুওয়াতের মত মহান বিষয় দান করেছেন। নিজেদের ঐতিহ্য-ইতিহাস এবং নবুওয়াত বাঁচাতে আজ এমন দুর্ধর্ষ লড়াই করবে, যেন মুসলমানরা আর কখনো তোমাদের সামনে আসার সাহস না করে। মনে রেখ, তোমরা ময়দানে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে তোমাদের স্ত্রী, বোন, কন্যা নির্ঘাত মুসলমানদের বাঁদীতে পরিণত হবে। তোমাদের এই প্রিয় ভূমিতেই তাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হবে। পারবে কি তোমরা সে দৃশ্য সহ্য করতে?”

মুসাইলামার সৈন্যদের শরীরে যেন আগুন ধরে যায়। তারা মুসাইলামার নামে উচ্চকিত নারাধ্বনি দিতে থাকে। অবলা অশ্বগুলো বারবার পদাঘাত আর হ্রেষারব তুলে সৈন্যদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসাইলামা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিলেন। সংখ্যাধিক্যের বলে মুসাইলামারই আক্রমণের সূচনা করার কথা ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকরা লেখেন, মুসাইলামা যুদ্ধজ্ঞানও রাখত। সে হামলার সূচনা করে না। সে এ অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে যে, খালিদ বাহিনী আক্রমণ করুক আর সে প্রথমত আত্মরক্ষামূলক লড়াই চালিয়ে যাবে। এভাবে খালিদ বাহিনী আক্রমণ করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন সে পূর্ণশক্তি নিয়ে চতুর্দিক হতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কচুকাটা কাটবে।

তৎকালীন যুগের পাণ্ডুলিপি প্রমাণ করে যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসাইলামার চাল ধরতে পারেন না। তিনি অধীনস্ত সেনাপতিদের এক বৈঠক ডেকে বলেন যে, মুরতাদ বাহিনীর সাথে এভাবে লড়তে হবে যে, যেন তারা সৈন্য এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দিতে না পারে এবং আত্মরক্ষামূলক লড়াই করতে বাধ্য হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ধারণা করেছিলেন, ১৩ হাজার সৈন্য দ্বারা ৪০ হাজার সৈন্যকে পরাস্ত করা কেবল এভাবেই সম্ভব যে, তাদেরকে কোন চাল চালার সুযোগ না দেয়া।

প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সৈন্যদের সাহস যোগানোরও প্রয়োজন ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাহায্যার্থে খলীফা যে বাহিনী পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক পবিত্র কুরআনের হাফেজ এবং সুমিষ্ট কারীও ছিলেন। সে সময়ে হাফেজ এবং কারীরাও তীর-তলোয়ারে সমান পারদর্শী হতেন। কেবল মসজিদে বসে থাকার মত লোক তারা ছিলেন না।

এতদ্ব্যতীত হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে এমন লোকের সংখ্যাও প্রচুর ছিল যারা একাধিক ময়দানে কয়েকগুণ বেশী সৈন্যের মোকাবিলা করে শত্রুর মাথা থেকে বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে এনেছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীতে হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ভাই যায়েদ বিন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্ রাযিয়াল্লাহু আনহুও ছিলেন। হযরত আবু দাযানা রাযিয়াল্লাহু আনহুও ছিলেন। তিনি উহুদ যুদ্ধে নিজ শরীর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঢেকে রেখেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর লক্ষ্যে যত তীর আসত তা এই হযরত আবু দাযানা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীরেই বিদ্ধ হত। খলীফা হযরত আবু বকরের পুত্র হযরত আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহুও ছিলেন। উম্মে আম্মারা নামক এক জননী তার পুত্রের সাথে এসেছিলেন। এই হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা উহুদ যুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধও করেছিলেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে হযরত ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু নামে এক সাহাবীও ছিলেন। তার বর্শার লক্ষ্য চুল বরাবর এদিক-ওদিক হত না। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উহুদ যুদ্ধে এই ওয়াহশী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিক্ষিপ্ত বর্শায় হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

মুজাহিদ বাহিনী সংখ্যার বিচারে কম থাকলেও জিহাদী জবা, হিম্মত ও মনোবলের দিক দিয়ে ছিলেন তুঙ্গে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও অগ্নিঝরা ভাষণের মাধ্যমে তাদের বীরত্বে অগ্নি সংযোগ করেছিলেন। তিনি কারী ও হাফেজ সৈন্যদের বলেছিলেন, সৈন্যদের সামনে গিয়ে পবিত্র কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে তাদের জানিয়ে দাও যে, তারা মদীনা হতে এত দূরে কোন্ অভিপ্রায়ে লড়তে এসেছে? অভীষ্ট মঞ্জিল কোথায়?

কারী ও হাফেজগণ ভাবগম্ভীর কণ্ঠে সৈন্যদের মাঝে বারবার ঐ সমস্ত আয়াত শুনাতে থাকেন, যাতে মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জিহাদের ফযিলত, শহীদের মর্তবা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা রাতভর চলতে থাকে। আল্লাহ ছাড়া এই সুদূর বিদেশ বিভুইয়ে তাদের সাহায্য করার কেউ ছিল না। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, মুসলমানরা এভাবে সারারাত ইবাদাত-বন্দেগী এবং দু’আর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।

পনের

৬৩২ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের এক প্রভাতে সূর্য উঁকি দিলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসাইলামার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তিন ভাগে পুরো বাহিনী বিন্যস্ত করেছিলেন। মধ্য বাহিনীর নেতৃত্ব ছিল তাঁর নিজের হাতে। ডানে বামে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হযরত আবু হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু। মুসলমানরা যে ক্ষিপ্তগতি ও বজ্রের মত হামলা করছিল তা দেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, এভাবে যুদ্ধ চালাতে পারলে তারা এক সময় মুরতাদ বাহিনীকে অবশ্যই নাস্তানাবুদ করতে সক্ষম হবে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও সাধারণ সৈন্যদের মত লড়ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও মুসাইলামার বাহিনী ঠিক আগের স্থানেই পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকে। অসংখ্য মুজাহিদ আক্রমণের প্রথম ভাগেই শহীদ হয়ে যান।

দিন যতই গড়িয়ে যেতে থাকে যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর্তচিৎকার, গোঙানী, আহাজারী আর ক্রন্দনে আসমান-জমিন প্রকম্পিত হচ্ছিল। মুসাইলামার বাহিনী স্থান পরিবর্তন করে করে লড়ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদেরকে বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে ফেলা। পক্ষান্তরে মুসলমানদের লক্ষ্য ছিল মুরতাদদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া এবং ইয়ামামা অধিকার করা। উভয় বাহিনী নিজ নিজ লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকে। আংশিক সফলতা বিবেচনায় আনলে তা ছিল মুরতাদ বাহিনীর দখলে।

মুসাইলামা অত্যন্ত ধূর্ত এবং সতর্ক সমর পরিচালক ছিল। সে গোপনে আঁচ করতে থাকে মুসলিম বাহিনী কখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে অর্ধেক দিন পার হয়ে যায়। ভূমি লালের পর লাল হতে থাকে। আহত সৈন্যরা পলায়নপর ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়। মুসলমানরা শুরু থেকেই প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

মুসাইলামার সতর্ক চোখে মুজাহিদ বাহিনীর এ অবসন্নতা ধরা পড়ে। সহসা সে নতুন চাল চালে। এক তেজোদ্দীপ্ত বাহিনীকে মুসলিম বাহিনীর উপর হামলার নির্দেশ দেয়। তার এ বাহিনী সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আসে এবং চোখের পলকে আক্রমণ করে সামনের বাহিনী লণ্ডভণ্ড করে দেয়। মুসাইলামা এই বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছিল যে, নবুওয়াতের খাতিরে যেই প্রাণ দিবে সে সোজা জান্নাতে যাবে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত অনুধাবন করেন যে, তার সৈন্যদের উপর তীব্র আঘাত হচ্ছে। তিনি পরিস্থিতি উত্তরণের পলিসি নিয়ে ভাবছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে সামনের বাহিনী দ্রুত পিছে হটে আসে। তাদের দেখাদেখি পিছনের বাহিনী আরো দ্রুত পিছনে হটে আসে। সেনাপতিগণ চিৎকার করে করে সৈন্যদের ডাকেন, থামাতে চেষ্টা করেন, তাকবীর ধ্বনি দেন কিন্তু মুরতাদদের নতুন এ বাহিনীর আক্রমণ এত ক্ষিপ্ত ও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল যে, মুসলমানদের পক্ষে তা বরদাশত করা সম্ভব হয় না। তাদের মাঝে অনিয়ম ও হুলস্থুল পড়ে যায়। পরস্পরের দেখাদেখি তারা ময়দান হতে এমন উর্ধ্বশ্বাসে পালায় যে, ছাউনীতেও গিয়ে থামে না, বরং অনেক দূর-দূরান্তে চলে যায়।

মুসাইলামার বাহিনী ক্ষুধার্ত নেকরের ন্যায় তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। উহুদ রণাঙ্গনেও মুসলমানরা নিজেদের বিপক্ষে এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে তারা পরাজিতও হয়েছিল। এটা ছিল তাদের দ্বিতীয় পিছু টান, যা হুলস্থূলের রূপ ধারণ করেছিল।

মুসাইলামার সৈন্যরা পশ্চাদ্ধাবন করে ছাউনীতে পৌঁছে লুটপাট শুরু করে। সেখানে তাদের বাধা দেবার মত কেউ ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং তার অধীনস্ত অন্যান্য সেনাপতি পলায়নপর সৈন্যদের থামানোর জন্য দৌড়ে চিৎকার করে ফিরছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা ছাউনী ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে থামে। মুসাইলামা বাহিনীর কতক সৈন্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাঁবুর সন্ধান পায়। তারা সেখানে ঢুকে পড়ে। অনেক বিত্ত-বৈভব তারা এখান থেকে পাবার আশা করছিল কিন্তু এখানে ঢুকে তারা এমন দুই মূল্যবান মানুষের দেখা পায় যা ছিল তাদের ধারণারও অতীত। একজন হচ্ছে তাদের সর্দার এবং সিপাহসালার মাযা‘আ। পায়ে লোহার বেড়ি বাঁধা অবস্থায় সে সেখানে পড়ে ছিল। আর দ্বিতীয়জন হচ্ছে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নতুন স্ত্রী লায়লা উরফে উম্মে তামীম। যার রূপ-সৌন্দর্যের বহু কাহিনী তারা শুনেছিল কিন্তু দেখার সুযোগ হয় নাই। মাযা‘আকে তারা দেখেই চিনে ফেলে। কিন্তু লায়লার সম্পর্কে তাদেরকে খবর দেয় মাযা‘আ। লায়লার পরিচয় পেয়েই একই সাথে দু’তিনজন তার দিকে ছুটে আসে। তারা লায়লাকে হত্যা অথবা সাথে করে নিয়ে যেতে চায়।

“থাম!” বন্দী নেতা মাযা‘আ তাদের নির্দেশ দেয়। “শত্রু সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন কর। নারীদের পিছনে পড়ার সময় এখনও আসেনি। আমি এখন তার কয়েদী নই; বরং সে আমার কয়েদী।”

তাদের সর্দারের নির্দেশ এত কঠোর ছিল যে, তারা দ্রুত তাবু থেকে বের হয়ে যায়। তাদের এতটুকু হুশ হয় না যে, নেতার পায়ের বেড়ি খুলে দিয়ে যাবে।

“এ লোকদের হাত থেকে তুমি আমাকে কেন বাঁচালে?” লায়লা মুযাআর কাছে জানতে চায়। “তুমি আমাকে নিজের মালে গনিমত মনে করছ? তোমার নিয়ম এমনটি হয়ে থাকলে কেন ভাবছ না যে, আমি তোমাকে কতল করতে পারি?”

“বন্দী থাকাকালে আপনি আমার সাথে যে সদাচরণ করেছেন তার প্রতিদানে আমি আমার জীবনও দিতে পারি।” মুযাআ বলে—“খোদার কসম! আমার পায়ের বেড়ি খুলে যদি আপনার পায়ে পড়ে তবুও আমি আপনাকে মালে গনিমত বা বাঁদী জ্ঞান করব না। আপনি আমাকে বন্দী করে নয় মেহমান বানিয়ে রেখেছেন।”

“আমি তোমার সাথে তেমন ভাল আচরণ করতে পারিনি।” লায়লা বলে। আমার বাড়িতে হলে তোমাকে আরো সুখে রাখতে পারতাম। এভাবে যে কোন বন্দীর সাথে সদাচরণ করা ইসলামের বিধান। প্রাণের শত্রুও যদি কারো ঘরে বন্দী হয়ে আসে তবে সে তাকে একজন সম্মানিত মেহমানই জ্ঞান করে।”

“লায়লা!” মাযা‘আ বলে—“আপনি এখনও অনুভব করছেন না যে, আপনার স্বামী পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছে এবং আপনি এখন আমার গোত্রের কব্জায়?”

“বিজয়-পরাজয়ের ফায়সালা আল্লাহ করবেন।” লায়লা জবাবে বলে— “আমার স্বামী এর চেয়েও মারাত্মক আঘাত সহ্য করতে অভ্যস্ত।”

“নির্বোধ নারী!” মাযা‘আ বিজয়সুলভ মুচকি হেসে বলে—“এখনও আপনি বুঝছেন না যে, খোদা মুসাইলামার সাথে আছেন, আর তিনি তাঁর সত্য নবী! মুহাম্মাদের রেসালাত সত্য হলে…”

“মাযা‘আ!” লায়লা গর্জে উঠে এবং তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে—“তুমি মুহাম্মাদের রেসালাতের বিরুদ্ধে কোন কথা বললে তোমার হত্যা আমার উপর ফরজ হয়ে যাবে। আমি জানি, আমাদের সৈন্যরা এই তাবুতে একা ফেলে পালিয়ে গেছে আর আমার ধর্মের শত্রুরা এখানে লুটতরাজও চালাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে আমি এতটুকু ভীত নই। আমার অন্তরে কোন ভয় নেই। আর ভয় না থাকার কারণ হলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র আত্মার প্রতি আমার প্রগাঢ় আস্থা রয়েছে।”

মাযা‘আ নিশ্চুপ ছিল। সে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত অপলক নেত্রে তার দিকে চেয়ে থাকে। বাইরে বিজয়ী বাহিনীর বিজয়সুলভ হৈ-হুল্লোড় চলছিল। তারা মুসলমানদের তাঁবু চিরে-ফেড়ে টুকরো করে করে ইতস্তত নিক্ষেপ করছিল। মাযা‘আ এবং লায়লার এ ধারণাই ছিল যে, এখনই মুসাইলামার পক্ষের লোকজন আসবে এবং তাদের দু’জনকে নিয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ হৈ-হুল্লোড় থেমে যায় এবং লুটেরা লুটপাট ছেড়ে দৌড়ে তাবু ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কারণ হলো, মুসাইলামার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে যে, যে যেখানে আছ এ মুহূর্তে আকরাবা ময়দানে ফিরে এস। কেননা মুসাইলামা দেখতে পায় যে, মুসলমানরা দ্রুত সমবেত হয়ে বিন্যস্ত ও সুসংগঠিত হচ্ছে। সে এ মুহূর্তে কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে চায় না। সে মুসলমানদের বীরত্ব এবং উদ্দীপনায় দারুণ প্রভাবিত ছিল।

মাযা‘আ এবং লায়লা তাঁবুতে আবার একাকী রয়ে যায়। মাযা‘আর চেহারায় যে ঝলক মাঝখানে এসেছিল তা আবার হারিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *