উত্তরার্চিক — একাদশ অধ্যায়
এই অধ্যায়ের দেবতাগণ (সূক্তানুসারে)—১।১০ অগ্নি; ২ আদিত্য; ৩।৫।৬ ইন্দ্র; ৪।৭।৮।৯ পবমান সোম; ১১ আত্ম বা সূর্য।
ছন্দ– ১।২।৩।১১ গায়ত্রী; ৪ ত্রিষ্টুভ; ৫।৬ প্রগাথ বার্হত; ৭ অনুষ্ঠুভ; ৮ দ্বিপদা পঙক্তি; ৯ জগতী; ১০ বিরাড জগতী।
ঋষি– প্রতিটি সূক্তের শেষে উল্লিখিত।
প্রথম খণ্ড
সূক্ত ১– সুষমিদো ন আবহ দেবা অগ্নে হবিষ্মতে। হোতঃ পাবক যক্ষি চ৷৷ ১৷ মধুমন্তং তন্নপাদ যজ্ঞং দেবেষু নঃ কবে। অদ্যা কৃণুষ্যতয়ে৷৷ ২৷৷ নরাশংসমিহ প্রিয়মস্মিন্ যজ্ঞ উপ হুয়ে। মধুজিং হবিষ্কৃত৷৷ ৩৷৷ অগ্নে সুখতমে রথে দেবাঁ ঈড়িত আবহ। অসি হোতা মনুহিতঃ৷৷ ৪৷৷
সূক্ত ২– যদদ্য সুর উদিতেহনাগা মিত্রো অর্যম। সুবাতি সবিতা ভগঃ। ১। সুবীরপ্ত স ক্ষয়ঃ প্র নু যামসুদানবঃ। যো নো অংহোহতিপিপ্রতি৷৷ ২৷৷ উত স্বরাজ্যে অদিতিরদস্য ব্রতস্য যে। মহো রাজান ঈশতে৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ৩– উ জ্বা মদন্তু সোমাঃ কৃণুত্ব রাধো অদ্রিবঃ। অব ব্রহ্মদ্বিষো জহি৷৷ ১৷ পদা পণীনরাধমো নি বাধস্ব মহা অসি৷ ন হি ত্বা কশ্চন প্রতি৷৷ ২৷৷ ত্বমীশিষে সুতানামিন্দ্র মসুতানা। ত্বং রাজা জনানা৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– কর্মসিদ্ধিকারক (দেবভাবসমূহের আহ্বানকারী) পাপনাশক হে জ্ঞানদেব! স্বপ্রকাশ আপনি আমাদের দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত সকল দেবভাব প্রদান করুন; এবং কর্মকারী আমার জন্য কর্ম সম্পাদন করে দিন। (ভাব এই যে, আমার কর্মসমূহ জ্ঞানসহযুত হোক; আর যেন আমরা দেবত্বমণ্ডিত হই, তা-ই বিহিত করুন)।
১/২– হে তত্ত্বজ্ঞ! জন্মকারণনাশক বিশুদ্ধসত্ত্বভাবরক্ষক আপনি, অদ্য (নিত্যকাল) আমাদের ইহলৌকিক সুখপ্রদ কর্মকে বা কর্মফলকে নাশ করবার জন্য অর্থাৎ ভগবানে সমর্পণ করবার নিমিত্ত, শুদ্ধসত্ত্ব-সমূহের অন্তর্ভুক্ত করুন অর্থাৎ দেবভাবসমূহে লীন করে দিন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের কর্ম শুদ্ধসত্ত্বযুক্ত হোক এবং ভগবানকে প্রাপ্ত হোক; আর তার দ্বারা আমাদের কর্মকারণ নাশ পাক এবং মোক্ষ আমাদের অধিগত, হোক)। [অগ্নিদেব বা জ্ঞানদেবের কাছে কর্ম নবকলেবর প্রাপ্ত হয় বলেই তিনি তন্নপাৎ। তনু + উন + প + অৎ– এই পদাংশ চারটির সমাবেশে তিনপাৎ পদ সিদ্ধ হয়। তার অর্থ ঊন (অসম্পূর্ণ, ক্ষীণ) তনু (দেহের) প (পালক, পূর্ণতাসাধক) যে সামগ্রী, তা যিনি অৎ (ভক্ষণ) করেন, তাঁকেই তনপাৎ বলে। এই অর্থেই তন্নপাৎ শব্দে ঘৃতভোজী, অগ্নিকে বোঝায়। পরন্তু, কর্মকে বিশুদ্ধভাব দান করে, তার স্থূলভাব ক্লেদরাশি তিনি ভস্মসাৎ করেন, এখানে এই অর্থও সঙ্গত হতে পারে। দেহের পূর্ণতা কিনা স্থূলভাব, তার নাশ– কিনা তনপাৎ। তার ভাব এই যে; দেহ ইত্যাদি ধারণমূলক কর্মের নাশ। তন্নপাৎ শব্দে এখানে তাই ঘৃতভুক না বলে জন্মকারণনিবারক পক্ষান্তরে বিশুদ্ধসত্ত্বভাবরক্ষক অর্থ পরিগৃহীত হয়েছে]।
১/৩– এই কর্মে (অর্থাৎ আমাদের সকল কর্মে প্রীতিপ্রদ সুখদায়ক সত্ত্বপ্রাপক সকলের আরাধনীয় (নরাশংস) সেই জ্ঞানদেবতাকে আমি আহ্বান করি। (আমাতে জ্ঞানের সমাবেশ হোক– এই মন্ত্র এমনই আকাঙ্ক্ষামূলক)। [এই মন্ত্রে অগ্নিদেবের যে কটি বিশেষণ দেখা যায়, তাতে তাকে জড়াগ্নি বলে আদৌ মনে আসতে পারে না। ঐসব বিশেষণের দ্বারা, তিনি দেবগণের প্রীতসম্পাদক ইত্যাদি ভাবও আসতে পারে; আবার তিনি যে আমাদের সকলরকম শুভসাধক, এরকম অর্থও পরিগ্রহ করতে পারা যায়। তাকে আহ্বান করলে যজ্ঞ সুসম্পন্ন হবে, অভীষ্ট সিদ্ধ হবে, আবার তার মধ্য দিয়েই সর্বদেবগণকে প্রাপ্ত হওয়া যাবে, এখানে এ মন্ত্রে সে ভাবও গ্রহণ করা যেতে পারে। সুতরাং এ অগ্নি যে কোন্ অগ্নি (অর্থাৎ তিনি যে জ্ঞানদেব) তা অনুভব করতে পারা যায়। যেমন, নরাশংস শব্দের অর্থ– সকল মানব কর্তৃক প্রশংসিত অর্থাৎ সকলেরই আকাঙ্ক্ষিত। সে অর্থে, এ মন্ত্রে জ্ঞান-রূপ অগ্নিরই অর্চনা করা হয়েছে। অগ্নিকে এখানে যে মধুজিহ্বং অর্থাৎ মধুরভাষী বলা হয়েছে, তারও সার্থকতা– জ্ঞানের (সত্যের) মধুর-ভাষকতা, চিরপ্রত্যক্ষীভূত। এখানে জ্ঞানরূপ অগ্নিকে প্রাপ্ত হওয়ার কামনাই প্রকাশ পাচ্ছে]।
১/৪– হে জ্ঞানদেব! আপনি আরাধিত বা স্তুত হয়ে অতিশয় সুখহেতুকর আমাদের কর্মের মধ্যে বা হৃদয়ে দেবভাবসমূহকে (দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণনিবহকে) আনয়ন করুন; যেহেতু, আপনিই মনুষ্যগণের হিতসাধক এবং আমাদের মধ্যে দেবভাবের আহ্বানকারী হন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আপনিই একমাত্র দেবত্ব-বিধায়ক; আমাদের দেবত্ব প্রদান করুন। [এই মন্ত্রে অগ্নির এক নাম ঈড় (ঈল) বলে উক্ত হয়েছে। যিনি সর্বদা সর্বত্র ঈড়িত অর্থাৎ স্তুত হবার উপযুক্ত। এই জন্যই তার ঈড় নামের সার্থকতা। নিগুঢ় অনুসন্ধান করলে, এ মন্ত্রে যে অনুপম, আধ্যাত্মিক ভাব গ্রহণ করা যায়, তাতে এই অগ্নি যে প্রজ্বলন্ত অগ্নি নয়, তিনি যে জ্ঞানদেব (জ্ঞানাগ্নি) তা অনুভূত হয়। অগ্নিদেব যে সুখতম রথে দেবগণকে আরোহণ করিয়ে যজ্ঞক্ষেত্রে নিয়ে আসেন এবং মানুষের হিতসাধনপূর্বক, দেবগণকে আহ্বান করে থাকেন, তার নিগুঢ় আধ্যাত্মিক ভাব এই যে, হৃদয়ে জ্ঞানের উদয় (জ্ঞানরূপ অগ্নির সঞ্চার) হলে ভগবানের প্রতি ভক্তি আপনিই সঞ্জাত হয়, এবং ভক্তিবিমিশ্র কর্ম ভগবৎসম্বন্ধযুত হয়ে তাকে প্রাপ্ত হয়; তাতে মানুষের মঙ্গল, এবং দেবতার আহ্বান সার্থক হয়। নিজেরই জ্ঞান, নিজেরই ভক্তি, নিজেরই কর্ম নিজেরই শ্রেয়ঃসাধক। এটা বুঝে, জ্ঞানার্জনে, ভক্তির স্ফুরণে, সৎকর্মের অনুষ্ঠানে, মানুষ যেন প্রবৃত্ত হয়– তাতেই তার পরম মঙ্গল সাধিত হবে। — মন্ত্রের এটাই উপদেশ। প্রার্থনার এটাই মর্ম]। [এই সূক্তের ঋষি– মেধাতিথি কাণ্ব]।
২/১– সাধকদের হৃদয়ে জ্ঞানালোক সমুৎপন্ন হলে, পাপনাশক, মিত্রভূত, মাতৃস্থানীয়, বিশ্বের সৎকর্মের প্রেরয়িতা, ঐশ্বর্যাধিপতি দেবতা সাধকদের সেই প্রসিদ্ধ পরমধন নিত্যকাল প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — জ্ঞানসম্পন্ন সাধক পরমধন লাভ করেন)। [মিত্র– ভগবানের মিত্ৰভূত বিভূতিঃ; অর্যমা– মাতৃস্থানীয়; সবিতা– বিশ্বের সৎকর্মের প্রেরয়িতা; ভগ– ঐশ্বর্যাধিপতি দেবতা বা ভগবানের বিভূতি। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে ভগঃ অর্যমা প্রভৃতি পদ বিভিন্ন দেবতা অর্থে গৃহীত হয়েছে। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– অদ্য সূর্য উদিত হলে, পাপহন্তা মিত্র, সবিতা, অৰ্ম ও ভগ যে ধন আমাদের জন্য অপেক্ষিত তা প্রেরণ করুন। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।
২/২– যে দেবভাবসমূহ আমাদের পাপ বিনাশ করেন, যে দেবভাবসমূহ পরমধনদায়ক, পাপকবল হতে শ্রেষ্ঠ রক্ষাকারী এবং আমাদের আশ্রয়স্বরূপ, প্রকৃষ্টরূপে, আশু আমাদের হৃদয়ে তাদের আগমন হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরমধনদায়ক, পাপনাশক, দেবভাবসমূহ আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন)। [দেবত্ব অথবা দেবভাব ভগবানেরই শক্তি, বিভূতি। সুতরাং হৃদয়ে তার সাড়া জাগলে মানুষ ভগবানের স্পর্শই লাভ করে। দেবত্ব অথবা দেবভাব মানুষকে মোক্ষদান করে; তার অর্থই এই যে, সাধক হৃদয়ের দেবভাবের প্রেরণায় ক্রমশঃ ভগবানের সাথে একাত্ম হয়ে যান, জলবুদ্বুদ জলে মিশে যায়, জীবন-নদী অনন্ত প্রাণ-সমুদ্রে আত্মহারা হয়। এটাই মোক্ষ, এটাই নির্বাণ। যিনি এই অবস্থা লাভ করতে পেরেছেন, তিনি পাপের আক্রমণ থেকেও মুক্তিলাভ করে থাকেন, পাপ তার ছায়াস্পর্শও করতে পারে না। সেই জন্যই বলা হয়েছে– দেবভাব পাপ বিনাশ করেন]।
২/৩– যে দেবগণ এবং অনন্তস্বরূপ দেব হিংসারহিত সৎকর্মের অধিপতি হন, মহাধনের স্বামী। সেই দেবগণ আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [অদিতি– দিত ধাতু বন্ধনে বা খণ্ডনে বা ছেদনে। যা অখণ্ড, অছিন্ন, অসীম, তা-ই অদিতি। অদিতি অর্থে অনন্ত আকাশ বা অনন্ত প্রকৃতি। সুতরাং অদিতি সকল দেবের জনয়িত্রী এবং যাস্ক তাঁকে অদিনা দেবমাতা বলেছেন। এই মন্ত্রে অদিতি পদে অনন্তরূপ ভগবানকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। যিনি অখণ্ড, অনন্ত, অসীম, যিনি একমেবাদ্বিতীয়ং, সেই পরমপুরুষকেই অদিতিঃ পদে লক্ষ্য করে সত্য, কিন্তু সেই পূর্ণস্বরূপের সঙ্গে সঙ্গে তার অংশীভূত দেবগণ বা দেবভাবের উল্লেখ করা চলে। এখানেও তা-ই হয়েছে]। [এই সূক্তের ঋষি-বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি]।
৩/১– অদ্রির ন্যায় দৃঢ় অচঞ্চল হে ভগবন! শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ (সত্যৰ্মনিবহ) আপনাকে আনন্দিত (বিচলিত) করে; আপনি আমাদের পরমার্থরূপ ধন এবং রক্ষা প্রদান করুন; আর আমাদের রিপুশত্রুগণকে বিনাশ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আপনি আমাদের শত্রুগণকে নাশ করে আমাদের আশ্রয় দিন ও পরমার্থ প্রদান করুন)। [পর্বতের ন্যায় দৃঢ় অর্থাৎ অচঞ্চল আনন্দময় ভগবান্ কিভাবে বিচলিত হন, আনন্দের সাগরে কিভাবে কার দ্বারা আনন্দের তরঙ্গ. উত্থিত হয়? সোমা পদ তা-ই নির্দেশ করছে। সক্কর্মের অনুষ্ঠানে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব সঞ্জাত হলে সেই অবস্থা উপনীত হয়; অর্থাৎ সৎকর্ম অথবা শুদ্ধসত্ত্বভাব সেই অচঞ্চল ভগবানকেও বিচলিত করতে পারে তার পর, লক্ষণীয়, তার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, আমাদের পরমার্থ-রূপ ধন প্রদান করুন, আশ্রয় দানে রক্ষা করুন। সে পক্ষে তিনি আর কি করবেন? ব্রহ্মবিদ্বেষিদের হনন করুন। এখানে ব্রহ্মদ্বিষঃ পদে ব্রাহ্মণদের হিংসাকারী অর্থ কেন গ্রহণ করব? ভগবানের প্রতি যারা হিংসা পরায়ণ, সৎকর্মে যারা বাধা প্রদানকারী, তারাই ব্রহ্মদ্বিষ নামে অভিহিত হয় না কি? এ পক্ষে আমাদের রিপুগণের প্রতিই লক্ষ্য আসে। কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুগণই ভগবানের কার্যে (সৎকর্মে) বাধা প্রদান করে। এখানে সেই রিপুগণের প্রভাব নাশের কামনাই প্রকাশিত]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ-৯খ-৯দ-১সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৩/২– হে ভগবন! আপনি মহান্ হন, আপনার সমান কোনও ব্যক্তি নিশ্চিতই নেই; আপনি সাধনবিঘ্ন লোভ ইত্যাদি রিপুগণকে পদাঘাতে সর্বতোভাবে বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহত্ত্বপূর্ণ হন; তিনি আমাদের রিপুসমূহকে বিনাশ করুন)।
৩/৩– হে ভগবন! আপনি বিশুদ্ধহৃদয়দের স্বামী হন; আপনি পাপীদেরও স্বামী হন; অপিচ, আপনি সর্বলোকের অধিপতি হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই সর্বলোকের অধিপতি)। [তিনিই সব, সবই তিনি– সবই সেই একমেবাদ্বিতীয়ই। যদি তা-ই হয়। যদি একই এক বহুর পশ্চাতে বিদ্যমান থাকে, তবে এই বহু এল কোথা থেকে? মানুষের মনের এমন বহু প্রশ্নের সমাধানকল্পে বেদ বলছেন– ত্বং লোকানাং রাজা। কিন্তু তাতেও সকল সংশয় দূরীভূত হয় না। তিনি যদি শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং হন, তবে তিনি কি পাপীদের কৃপা করবেন? পাপীও কি তাঁর করুণালাভ করতে সমর্থ হবে? জনগণের মনের এই সন্দেহ দূর করবার জন্য বেদ বলছেন– সুতানাং অসুতানাং ঈশিষে, — তিনি পবিত্র অপবিত্র সকলের অধিপতি। তিনি সর্বলোকের– সুতরাং পাপীতাপীরও পিতা। পিতার স্নেহে তিনি পাপীকেও নিজের কোলে টেনে, তাই তো তাকে পতিতপাবন বলা হয়। [সূক্তের ঋষি প্রগাথ কাণ্ব]।
.
দ্বিতীয় খণ্ড
সূক্ত ৪– আ জাগৃবিৰ্বিপ্র ঋতং মতীনাং সোমঃ পুনানো অসদচ্চমূযু। সপন্তি যং মিথুনাসসা নিকামা অধ্বর্যুবো রথিরাসঃ সুহস্তাঃ ১। স পুনান উপ সুরে দধান ওভে অপ্রা রোদসী বী য আবঃ। প্রিয়া চিদ যস্য প্রিয়সাস উতী সততা ধনং কারিণে ন প্র যংসৎ৷৷ ২. স বর্ধিতা বর্ধনঃ পূয়মানঃ সোমো মীং অভি নো জ্যোতিষাবিৎ। _ যত্র নঃ পূর্বে পিতরঃ পদজ্ঞাঃ স্ববিদো অভি গা অদ্রিমিষ্ণ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ৫– মা চিদন্যদ বি শংসত সখায়ো মা বিষণ্যত। ইন্দ্ৰমিৎ স্তোতা বৃষণং সচা সুতে মুহূরুথা চ শংসত৷ ১৷৷ অবক্ৰক্ষিণং বৃষভং যথা জুবং গাং ন চর্ষণীসহ। বিদ্বেষণং সংবননমুভয়ঙ্করং মংহিষ্ঠমুভয়াবিন৷ ২)
সূক্ত ৬– ঊদু ত্যে মধুমত্তমা গিরঃ স্তোমাস ঈরতে। সত্রাজিততা ধনসা অক্ষিতোতয়ো বাজয়ন্তো রথা ইব৷৷ ১৷৷ কথা ইব ভূগবঃ সূর্যা ইব বিশ্বমিদ্ধীতমাশত। ইন্দ্রং স্তোমেভিহয়ন্ত আয়বঃ প্রিয়মেধাসসা অস্বর৷৷ ২৷৷
সূক্ত ৭– পর্যষু প্র ধন্ব বাজতয়ে পরি বৃত্রাণি সক্ষণিঃ। দ্বিষস্তরধ্যা ঋণয়া ন ঈরসে৷৷ ১৷
অজীজনো হি পবমান সূর্যং বিধারে শক্মনা পয়ঃ। গগাজীরয়া রংহমাণঃ পুরন্ধ্যা। ২ অনু হি ত্বা সুতং সোম মামসি মহে সমর্ষরাজ্যে। বাজাঁ অভি পবমান প্র গাহসে৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ৮– পরি প্র ধন্থ৷৷ ১। এবামৃতায় মহে ক্ষয়ায় স শুক্রো অর্ষ দিব্যঃ পীযূষঃ৷ ২৷৷ ইন্দ্ৰস্তে সোম সুতস্য পেয়াৎ ঋত্বে দক্ষায় বিশ্বে চ দেবাঃ৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ৪সূক্ত/১সাম– পরস্পরসম্মিলিত সৎকর্মপরায়ণ মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী সর্বতোভাবে কামনাকারী সাধকগণ যে শুদ্ধসত্ত্বকে হৃদয়ে উৎপাদন করেন, চৈতন্যস্বরূপ সত্যভূতস্তোত্রের জ্ঞাতা (অথবা লক্ষ্যস্থল) পবিত্রকারক সেই শুদ্ধসত্ত্ব তাদের হৃদয়পাত্রে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধনকারিগণ সর্বতোভাবে পরমমঙ্গলদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব তাদের হৃদয়ে সমুৎপাদিত করেন)। [জাগৃহিঃ পদের অর্থ জাগরণশীল, অর্থাৎ জাগরিত থাকাই যার স্বভাব। যা চিরজাগরূক, তা-ই জাগৃহিঃ, তা-ই চৈতন্যস্বরূপ। কারণ চৈতন্যের স্বভাবই জাগ্রত থাকা, চেতনা অচৈতন্য এমন ধারণা করাও যায় না। কাজেই বাক্যের মধ্যেই আত্মবিরোধ দেখা যায়। তাই এখানে জাগৃহিঃ পদে চৈতন্যস্বরূপ অর্থ গ্রহণই সঙ্গত হয়েছে]।
৪/২– পবিত্রকারক সৎকর্মসাধক প্রসিদ্ধ সেই শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানে মিলিত হন, স্বমহিমায়– দ্যুলোক ভূলোককে প্রপূরিত করেন, শুদ্ধসত্ত্ব নিশ্চিতভাবে আপন তেজে আমাদের পূরণ করুন; যে প্রীতিদায়ক সর্বত্র বিদ্যমান শুদ্ধসত্ত্বের অত্যন্ত প্রিয়তম ধারা বর্তমান আছে, সেই শুদ্ধসত্ত্ব, ভৃত্যকে যেমন পুরস্কার দেওয়া হয়, তেমন আমাদের বিশিষ্টরূপে পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানের সাথে মিলিত হন; সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [সোমরসের কোন উল্লেখ না পাওয়া গেলেও, — প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসার্থক ভাবই প্রদান করা হয়েছে]।
৪/৩– যে শুদ্ধসত্ত্বে স্থিত হয়ে ভগবানের চরণজ্ঞ, ত্রিকালজ্ঞ, আমাদের পূর্বগামী পিতৃস্থানীয় সাধকগণ পরাজ্ঞানলাভের জন্য পাষাণকঠোর সাধন করেন, সর্বদেবের বর্ধনকারী, প্রবৃদ্ধ, পবিত্রকারক, অভীষ্টবর্ষক, প্রসিদ্ধ সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের আত্মতেজের দ্বারা রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — যে শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধকেরা মোক্ষলাভ করেন, সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন)। মিন্ত্রের সূক্ষ্মভাবটিকে অস্বীকার করে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে নানারকম উপাখ্যানের অবতারণা করে ভাবের ও অর্থের সম্পূর্ণ বিপর্যয় ঘটানো হয়েছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– তিনি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে শ্রীবৃদ্ধি সম্পাদন করেন; রসসেচনকারী সোম শোধিত হয়ে নিজের জ্যোতিঃর দ্বারা আমাদের রক্ষা করলেন। তাঁর আশ্রয় পেয়ে অশেষ জ্ঞানসম্পন্ন আমাদের পূর্বপুরুষগণ পর্বত হতে গাভী আহরণ করেছিলেন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে অন্যত্রও পণিনামক অসুরের উপাখ্যান পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে সরমাই অপহৃত গাভীর সন্ধান করেছিলেন বলে কথিত। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ অবান্তরভাবে ভাষ্যকার পণির কথা উল্লেখ করে পূর্বপুরুষগণ গাভী উদ্ধার করেছেন বলে ব্যাখ্যা করেছেন]। [এই সূক্তের ঋষি-পরাশর শাক্ত। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– গৌরীবিত্ত, অশন, যজ্ঞ-যজ্ঞীয় এবং গোশৃঙ্গম]।
৫/১– মিত্রভূত হে দেবগণ বা দেবভাবসমূহ! আপনারা আমাদের চরম দশায়ও অর্থাৎ কঠোর পরীক্ষায়ও কখনও বিরুদ্ধাচারের দ্বারা আমাদের শাসন করবেন না এবং আমাদের হিংসক হবেন না অর্থাৎ আমাদের পরিত্যাগ করবেন না; (কঠোর পরীক্ষাতেও যেন আমরা সৎ-ভাব-পরিশূন্য না হই, এটাই অভিপ্রায়)। হে দেবগণ! আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করে আপনারা তার সাথে সম্মিলিত হোন এবং সর্বাভীষ্টপূরক একমেবাদ্বিতীয় ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে অর্চনা করবার জন্য আমাদের নিত্যকাল উদ্বুদ্ধ করুন; অপিচ, ভগবৎ-বিষয়ক স্তোত্রসমূহ গান করতে শিক্ষা প্রদান করুন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে যেন সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হতে পারি– এই প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে)। অথবা– মিত্রভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা কখনও ভগবৎ-সম্বন্ধ পরিশূন্য বাক্য উচ্চারণ করো না বা (তেমন) কর্ম অনুষ্ঠান করো না; এবং নিজের হিংসক হয়ো না, অর্থাৎ ভগবৎ-বিদ্বেষী চার্বাকধর্ম-অবলম্বিগণের অনুষ্ঠিত অসৎ-অনুষ্ঠানের দ্বারা নিজেদের উপক্ষয়িতা হয়ো না। (মন্ত্রাংশের মধ্যে আত্ম-উদ্বোধনা রয়েছে; ভগবানের প্রতি অবিচলিত-মন হবার জন্য এখানে সাধক নিজেকে উদ্বুদ্ধ করছেন)। আরও, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! শুদ্ধসত্ত্ব সুসংস্কৃত হলে অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয় করে, তোমরা অনন্যমন হয়ে অর্থাৎ একাগ্রভাবে সকল কামনার বর্ষক অর্থাৎ সর্বাভীষ্টপূরক চতুর্বর্গফলপ্রদাতা পরমৈশ্বর্যশালী অদ্বিতীয় ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে স্তুতি অর্থাৎ অর্চনা। করো; অপিচ, তোমরা সর্বকাল ভগবানের সম্বন্ধযুত স্তোত্ৰসমূহ সদাকাল উচ্চারণ করো। (এই মন্ত্রাংশ আত্ম-উদ্বোধক; ভগবৎসম্বন্ধমূলক কর্মের অনুষ্ঠান শুভফলপ্রদ। ভক্তিসহযুত মনে একাগ্রচিত্তে ভগবানের কর্ম সাধনের জন্য সাধক নিজেকে উদ্বোধিত করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! ভক্তির দ্বারা এবং নির্মল চিত্তের দ্বারা তোমার কর্মসম্পাদনে তোমার প্রীতি-সাধনে আমরা যেন সমর্থ হই; কৃপাপূর্বক তা বিহিত করুন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-১দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৫/২– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! শত্রুদের হিংসক, পরমাভীষ্টদায়ক, আশুমুক্তিদায়ক, জ্ঞানতুল্য শত্রুনাশক, স্তোতৃদের দ্বারা সম্যকরূপে আরাধনীয়, নিগ্রহানু গ্রহকর্তা, রিপুনাশক, পরমধনদাতা, দ্যুলোকভূলোকস্বামী ভগবানকে তোমরা পূজা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করি)। [তিনি কেবলমাত্র রিপুনাশক নন, দ্যুলোক-ভূলোকের অধিপতিও তিনি। তিনি অনুগ্রহনিগ্রহ সমর্থ। কেবলমাত্র ভক্তের প্রার্থনাই পূরণ করেন না, প্রয়োজন হলে, তার মঙ্গলের জন্য তাকে শাস্তিও প্রদান করেন। নিগ্রহের অগ্নিতে ফেলে সাধকের অন্তরের কার এ খাদ সব পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। তাই ভগবানের শাস্তিও পরমমঙ্গলধারক। অনুগ্রহ ও নিগ্রহ এই উভয় উপায়ের দ্বারা সাধকের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে তাকে পরমধন প্রদান করেন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সঙ্গে এই মন্ত্রার্থের বিশেষ মতানৈক্য ঘটেনি। যেমন, একটি অনুবাদ– বৃষভের ন্যায় শত্রুদের হিংসাকারী ও জরারহিত ও বৃষভের ন্যায় মনুষ্যবর্গের পরাভবকারী ও শত্রুদের বিদ্বেষ্টা ও স্তোতৃগণের সম্ভজনীয় এবং উভয় প্রকার ধনবিশিষ্ট দাতৃতম ইন্দ্রকেই স্তব করো। সবই ঠিক আছে; তবে আগের মন্ত্রটির মতোই, এখানেও ইন্দ্র ভিন্ন অন্য দেবতার স্তোত্র না করতে উপদেশ থাকায়, ব্যাখ্যাটি সঠিক হয়েছে বলে মনে করা যায় না। এক দেবতার প্রাধান্য খ্যাপন করে অন্য দেবতাকে অপ্রধান প্রতিপন্ন করা, বেদমন্ত্রের উদ্দেশ্য কখনও হতে পারে না। তবে এই ইন্দ্র যদি স্বতন্ত্র কোন দেবতা না হন, অর্থাৎ তিনি যদি সেই একমেবাদ্বিতীয় পরমেশ্বরই হন, তবে অন্য কথা। তথাপি বলতে হয়, বরুণ, অগ্নি, সূর্য ইত্যাদিও তো তাই। তবে তাদের স্তুতি করতেও বাধা থাকার কথা নয়]। [এই সূক্তের ঋষির নাম– প্রগাথ ঘৌর বা কাথ। এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রে একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– মৈধাতিথম]।
৬/১– হে ভগবন! ভগবৎপরায়ণ সাধকগণ অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন অতিশয় মধুর অর্থাৎ অত্যন্ত প্রীতিদায়ক বেদমন্ত্ররূপ স্তুতিসমূহ উচ্চারণ করেন; সেই স্তুতিমন্ত্রসকল, — সদা শত্রুনাশক, শ্রেষ্ঠধনসাধক অর্থাৎ শ্রেষ্ঠধনসমূহের প্রেরক, অখণ্ড-আশ্রয়দাতা অর্থাৎ সর্বদা রক্ষাকারী, শুদ্ধসত্ত্ব সংবাহক রথসমূহের ন্যায় অর্থাৎ রথ যেমন অভীষ্টকে প্রাপ্ত করায় বা আনয়ন করে, তেমনই অভীষ্ট প্রাপ্ত করায়। (এই মন্ত্রটি স্তোত্রমাহাত্ম্য-প্রকাশক। ভাবার্থ, সুবুদ্ধির এবং সৎকর্মের দ্বারা যখন আমরা ভগবানের অনুসারী হই, তখন আমাদের অশেষ শ্রেয়ঃ সাধিত হয়; তখনই আমাদের কর্মসমূহ আমাদের ভগবৎ-সামীপ্য লাভ করায়)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-২দ-৯সা) পাওয়া যায়]।
৬/২– আদিত্যরশ্মি যেমন সকল জগৎকে ব্যাপ্ত করে, তেমনই আত্ম-উৎকর্ষসাধনশীল জনতুল্য সাধনাপরায়ণ সাধকগণ বিশ্বব্যাপী, আরাধনীয় ভগবানকে ব্যাপ্ত করেন, অর্থাৎ তাতে আত্মসমর্পণ করেন; পূজাপরায়ণ তীক্ষ্ণধীসম্পন্ন মনুষ্যগণ সেই ভগবানকে স্তোত্রের দ্বারা পূজা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। মেধাসম্পন্ন সাধকেরা ভগবৎপরায়ণ হন)। [এই সূক্তের ঋষি– মেধাতিথি কাণ্ব। সূক্তান্তৰ্গত মন্ত্র দুটির একত্র-গ্রথিত গেয়গানের নাম-অভীবৰ্তম্)।
৭/১– হে ভগবন! সুষ্ঠুরূপে সৎকর্মসাধনের জন্য আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত করুন; ক্ষমাপ্রবণ আপনি সত্ত্ববরোধক অজ্ঞানতারূপ পাপসমূহ বিনাশ করুন; অপিচ, আমাদের সঞ্চিত। কর্মফলনাশক আপনি আমাদের রিপুশত্রুগণকে বিনাশ করবার জন্য প্রবৃত্ত হন। (ভাব এই যে, রিপুনাশক ভগবান্ রিপু বিনাশ করে আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চার করে দিন)। [মানুষের হৃদয়ে যে সত্ত্বভাব আছে, তা পাপ মোহ প্রভৃতির দ্বারা আবরিত থাকে বলে মানুষ নিজের চরম লক্ষ্যের দিকে সহসা অগ্রসর হতে পারে না। ভগবানের কৃপায় সেই আবরণ অপসারিত হলে, মানুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারে। তাই মন্ত্রে সেই পাপ-আবরণ বিনাশ করবার জন্য প্রার্থনা]। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৯খ-৯-২সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
৭/২– পবিত্রকারক হে দেব! আপনিই অমৃতধারণসমর্থ হৃদয়ে আত্মশক্তির দ্বারা পরাজ্ঞানকে উৎপাদন করেন; জ্ঞানকারক প্রভূত বলের দ্বারা আমাদের আশুমুক্তিদায়ক হোন। (মন্ত্রটি ও এর নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞান প্রদান করেন, তিনি আমাদের প্রতি আশুমুক্তিদায়ক হোন)।
৭/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধভাবপ্রাপক তোমাকে আমরা প্রার্থনা করছি (হৃদয়ে উৎপন্ন করি)। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — পবিত্র সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই)। অথবা– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধতাপ্রদানকারী তোমাকেই প্রাপ্তির জন্য আমরা প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা সকলে যেন সত্ত্বভাবসম্পন্ন এবং সৎকর্মসাধক হই)। [দুরকম অন্বয়েই একইরকম ভাব-পরিব্যক্ত হয়েছে। হৃদয় যখন নির্মল, পবিত্র হয়, তখনই সেই বিশুদ্ধ হৃদয় ভগবানের ধারণা করতে পারে। সৎকর্মের সাহায্যে মলিন হৃদয় পবিত্র হলে তাতে বিশুদ্ধ সৰ্বভাবের সঞ্চার হয়। তাই বলা হয়েছে, সৎকর্মের অভিমুখেই সত্ত্বভাব ধাবিত হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৯-৬সা) পরিদৃষ্ট হয়]। [এই সূক্তের ঋষি– এরুণ, ত্রৈবৃষ্ণ, সদস্যু, পৌরুকুৎস। সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– শ্যাবাশ্বম, আন্ধীগবম, বিরাটসুবামদেব্যম্, গৌরীবিত এবং ওকোনিধন]।
৮/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আমাদের হৃদয়ে সর্বতোভাবে উপজিত হও। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানকে লাভ করবার জন্য আমাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের উপজন হোক)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৯দ-১সা) পাওয়া যায়]।
৮/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! জ্যোতির্ময় অমৃতময়, দেবত্বপ্রাপক আপনিই অমৃতপ্রাপ্তির জন্য এবং মহান আশ্রয়লাভের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, অমৃতত্বপ্রাপক পরম জ্যোতির্ময় শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তুমি শুভ্রবর্ণ এবং দেবতাদের পেয় বস্তু, তুমি অমরত্ব লাভের জন্য এবং বৃহৎ বৃহৎ বাসস্থান লাভের জন্য অগ্রসর হও। ভাষ্যকার পীযূষঃ পদের অর্থ করেছেন– দেবতাগণের পানযোগ্য। এতে আপত্তি করার কিছু নেই। তবে তিনি প্রথমেই হে সোম সম্বোধন করে ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন। সুতরাং পীযুষঃ পদ বা তার অর্থ সোমরস সম্বন্ধেই প্রযুক্ত হয়েছে। এখানেই আপত্তি। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে যে সোমরসের পরিচয় পাওয়া যায়, তা দিব্য অথবা শুক্র ও নয়, পীযূষ তো নয়ই। পীযূষ শব্দে অমৃত অথবা অমৃতময় বস্তুকে লক্ষ্য করে। তা দেবতার পানযোগ্য তো নিশ্চয়ই। সেই অমৃত পান করেই দেবতা দেবত্ব পেয়েছেন; এবং মানুষের হৃদয় হতে উত্থিত এই সুধা পান করবার জন্যই ভগবান্ ইচ্ছা করেন। সেই বস্তুটি অবশ্যই সাধকের হৃদয়ের অমৃত-শুদ্ধসত্ত্ব। মন্ত্রে এই স্বর্গীয় বস্তুকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। প্রত্যেকটি বিশেষণই এই ধারণার সমর্থন করছে]।
৮/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন বিশুদ্ধ আপনার অমৃত আমাদেরই প্রজ্ঞানলাভের (অথবা সৎকর্ম-সাধনের) এবং আত্মশক্তিলাভের জন্য ইন্দ্রদেব ও সকল দেবতা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ পূজা-উপহার গ্রহণ করুন)। [এই সূক্তের ঋষির নাম– অগ্নি ধিষ্য ঈশ্বর। এর অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত সাতটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– বাঙনিন্ধনংসৌহবিষম, বারবন্তিরম, সফম, বাজদাবর্যম্, স্বর্ণিধনম, বাজজিৎ এবং পৌষ্কলম]।
.
তৃতীয় খণ্ড
সূক্ত ৯– সূর্যস্যেব রশ্ময়ো দ্রায়িত্নবো মৎসরাসঃ প্রসুতঃ সামীরতে। তন্তুং ততং পরিসর্গাস আশবো নেন্দ্রাদ ঝতে পবতে ধাম কিঞ্চন৷ ১। উপো মতিঃ পৃচ্যতে সিচ্যতে মধু মাজনী চোদ্দতে অন্তরাসনি। পবমানঃ সন্তনিঃ সুন্বতামিব মধুমান দ্রঃ পরিবারমর্ষতি। ২৷৷ উক্ষা মিমেতি প্রতি যন্তি ধেনবো দেবস্য দেবীরূপ যন্তি নিষ্কৃতম্। অত্যক্রমীদৰ্জুনং বারমব্যয়মকং ন নিক্তং পরিসোমো অব্যত৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১০– অগ্নিং নরো দীধিতিভিররণ্যেহস্তুচ্যুতং জনয়ত প্রশস্তম্। দূরেদৃশং গৃহপতিমথzং৷৷ ১। তমগ্নিমস্তে বসবো হ্যৎসুপ্রতিচক্ষমবসে কুতশ্চিৎ। দক্ষায্যো যো দম আস নিত্যঃ। ২৷৷ প্রেদ্ধো অগ্নে দীদিহি পুরো নোজস্রয়া ম্যা যবিষ্ঠ। ত্বাং শশ্বস্ত উপ যন্তি বাজাঃ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১১– আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমীদসদ মাতরং পুরঃ। পিতরং চ প্রযুৎস্বঃ ১। অন্তশ্চতি রোচনাস্য প্রাণাদপানতী। ব্যখ্য মহিষো দিব৷ ২৷ ত্রিংশদ ধাম বি রাজতি বা পতঙ্গায় ধীয়তে। প্রতি বস্তোরহদ্যুভিঃ৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ৯সূক্ত/১সাম– অগ্নির অর্থাৎ জ্ঞানদেবের কিরণতুল্য প্রবহমান আনন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব প্রভূত পরিমাণে আপনা-আপনিই সাধককে প্রাপ্ত হন; সূর্যব্যাপক, সাধকদের হৃদয়ে উপদ্যমান ই শুদ্ধসত্ত্ব ভগবান্ ভিন্ন অন্য পরমবিস্তৃতও কোন স্থানের প্রতি প্রধাবিত হয় না। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। এ ভাব এই যে, সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানকে প্রাপ্ত হয়)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, সোমরস লোকেদের মদমত্ত করে এবং তাদের নিদ্রা উপস্থিত করে দেয়। তাহলে এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হচ্ছে যে, সোম (মাদকদ্রব্য) মানুষকে যে কেবল মাতাল করে তা-ই নয়, তার দ্বারা মানুষের চৈতন্যও তিরোহিত হয়। অথচ বেদ-মন্ত্রের পদে পদে তার এত গুণগান? প্রাচীন ঋষিরাও কি তবে মাতাল ছিলেন? এমন ধারণার সৃষ্টিকারী ঐ-সব ব্যাখ্যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সোম সাধকহৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বই– এ কথা এর আগে এবং পরেও প্রমাণিত]।
৯/২– সাধকগণ কর্তৃক স্তুতি উচ্চারিত হয়, এবং পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্বের ধারা হৃদয়ে উৎপাদিত হয়; বিশুদ্ধহৃদয়দেরই অমৃতময় আশুমুক্তিদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানের প্রবাহকে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা পরমানন্দদায়ক অমৃতময় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– ইন্দ্রের উদ্দেশে স্তুতিবাক্য যোজনা করা হচ্ছে, আনন্দকর সোম সেচন করা হচ্ছে, তার মুখের মধ্যে সোমরসের আনন্দকর ধারা ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। এই সোমরস ক্ষরিত হয়ে চতুর্দিকে বিস্তৃত হন এবং যেমন উত্তম ধনুর্ধারীর হস্ত হতে বাণ নিক্ষিপ্ত হয়ে শীঘ্র যথাস্থানে গিয়ে থাকে, তেমনই এই সুমধুর সোমরস মেষলোমের দিকে যাচ্ছে। এখন যেমন বাড়ীতে অতিথি এলে চা দেওয়া হয়, তেমনভাবেই যেন বিশিষ্ট অতিথি ইন্দ্রের মুখের মধ্যে সোমরস ঢেলে দেওয়ার এই কল্পনা সত্যই অভাবনীয়। কিন্তু মন্ত্রের মধ্যে সোমরস বা তা ইন্দ্রের মুখে ঢেলে দেওয়ার কোন সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রের কোথাও ধনুর্ধারী বা বাণ প্রভৃতি সূচক কোন পদ নেই, ভাষ্যকারও এ সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করেননি। সুতরাং তথাকথিত অনুবাদক যে কিভাবে এই অর্থ গ্রহণ করলেন তা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। বস্তুতঃ, মন্ত্রে সোমরসের কোন প্রসঙ্গই নেই]।
৯/৩– অভীষ্টবর্ষক জ্ঞান প্রদান করেন; জ্ঞানকিরণসমূহ সাধকহৃদয়কে প্রাপ্ত হয়, ভগবৎ-প্রাপিকা প্রার্থনা দেবভাবের আশ্রয় প্রাপ্ত হয়; শুদ্ধসত্ত্ব সুদৃঢ় কবচতুল্য, উজ্জ্বল, নির্মল নিত্যজ্ঞানপ্রবাহের সাথে সাধকহৃদয়কে প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞানের সাথে মিলিত হয়; সাধকেরা শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত সেই পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [এই সূক্তের ঋষি-হিরণ্যপ আঙ্গিরস। এই তিনটি মন্ত্রের একত্র-গ্রথিত দুটি গেয়গানের নাম– বাজজিৎ এবং কাবম্]।
১০/১– জননায়ক শ্রেষ্ঠপুরুষগণ, সৎকর্মপ্রসূত মেধাপ্রভাবে (জ্ঞান-কিরণের সাহায্যে), দূরে দৃশ্যমান অথবা নিজের দেহরূপ গৃহেরই অধিপতিরূপে বিদ্যমান, বিচ্ছিন্নসম্বন্ধ অথবা চিরসম্বন্ধবিশিষ্ট, সেই জ্ঞানদেবতাকে ভক্তিসহযুত কর্মের মধ্যেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। (মন্ত্রের ভাব, দৃষ্টিশক্তির তারতম্য অনুসারে, কেউ বা মনে করেন, — সেই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব দূরে আছেন; কেউ বা তাকে দেহরূপ গৃহেরই অধিপতিরূপে দেখতে পান; কেউ দেখেন– তার সাথে আমাদের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; কেউ দেখেন– সেই সম্বন্ধ চির-অবিচ্ছিন্ন। এমন যে জ্ঞান-দেবতা শ্রেষ্ঠপুরুষগণ, নিজেদের সৎকর্মপ্রসূত মেধার প্রভাবে, ভক্তিসহযুত কর্মের মধ্যেই, তাকে দেখতে পান)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (১অ-৭দ-১০সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১০/২– পূজনীয় শাশ্বত যে জ্ঞান সর্বত্র বর্তমান আছেন, পরমধনার্থী (অথবা জ্ঞানার্থী) সাধকগণ সকল ভয়েরই কারণ হতে রক্ষা পাবার জন্য পরমোজ্বল প্রসিদ্ধ সেই পরাজ্ঞানকে হৃদয়ে স্থাপনকরেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা সর্ববিপদ হতে এবং শত্রুগণ হতে রক্ষালাভের জন্য তাদের হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত করেন)। [পূর্বের মন্ত্রেই অগ্নিদেব তথা জ্ঞানদেবের স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছে। সেখানে দূরেদৃশং, গৃহপতিং, হস্তচ্যুতং, অথব্যুং এই চারটি পদই যথেষ্ট ছিল। এর প্রথম ও দ্বিতীয় পদ দুটি এবং তৃতীয় ও চতুর্থ পদ দুটি পরস্পর বিপরীত ভাবদ্যোতকও ছিল। তিনি দূরেদৃশং, আবার তিনি গৃহপতিং। তিনি হস্তচ্যুতং, আবার তিনি অথব্যুং। এতে বোঝা যায়, সেখানে বলা হয়েছে, দৃষ্টিশক্তির তারতম্য অনুসারে মানুষ তাকে বিভিন্ন বিপরীত ভাবে দর্শন করে থাকে। যারা দূরে তারা দেখে তিনি দূরে আছেন; যাঁরা তার নিকটস্থ হতে পেরেছেন, তাঁরা দেখতে পান– এই তো তিনি আমাদের দেহেরই অধিপতি হয়ে আছেন। এইভাবে যাঁরা তাঁকে ধরতে পারেননি, তারা বলেন– তিনি হস্তচ্যুতং অর্থাৎ নিঃসম্বন্ধ; যাঁরা তাঁকে ধরতে পেরেছেন, তারা জানেন– তিনি অথবং, অর্থাৎ তিনি আর কোথায় যাবেন– এই তো আমাদের মধ্যেই চিরসম্বন্ধযুত হয়ে রয়েছেন। এটাই তার, অর্থাৎ জ্ঞানদেবের, স্বরূপ। যে তাকে ধরতে পারে, সে তাকেই ধরে আছে; যে তাকে ধরতে পারেনি, সে তার থেকে অনেক দূরেই থেকে গেছে। জ্ঞানকে সকলে চিনতে পারে না, জ্ঞানদেবের ভাব বা দান সকলের আয়ত্তাধীন হয় না। এখানে, এই মন্ত্রে, তাই বলা হচ্ছে, অপবিত্র বস্তু (পাপ, হিংসা ইত্যাদি) জ্ঞানদেবতার (জ্ঞানের) কাছে আসতে পারে না। জ্ঞানাগ্নির দ্বারা সকল অজ্ঞানতাই দগ্ধীভূত হয়ে যায়]।
১০/৩– নিত্যতরুণ হে জ্ঞানদেব! জ্যোতির্ময় আপনি প্রভূতপরিমাণ তেজের সাথে আমাদের হৃদয়ে সম্যকরূপে আবির্ভূত হোন; যেহেতু সর্বশক্তি আপনাকেই প্রাপ্ত হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সর্বশক্তিদায়ক পরাজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক)। [ইতিপূর্বেও অগ্নিকে যবিষ্ঠ বলা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যাকাররা বলেন– যজ্ঞকার্যের জন্য প্রত্যেকবারই নূতনভাবে অরণিকাষ্ঠ ঘর্ষণ করে অগ্নি উৎপাদন করা হয়, সেইজন্য তিনি যুবতম। অগ্নিকে স্থূল প্রজ্বলিত অগ্নি ধরে তাকে জ্ঞানাগ্নি তথা ভগবানের জ্ঞানদেবরূপ বিভূতি ধরলেও সেই একই ভাব আসে। যদিও জ্ঞান নিত্য শাশ্বত; তথাপি প্রত্যেক সাধকের হৃদয়ে নব নব ভাবে তিনি আবির্ভূত হচ্ছেন। মানুষের হৃদয়ে যে সৎকর্মরূপ অরণিকাষ্ঠ ঘর্ষিত হচ্ছে, তার দ্বারাই জ্ঞানাগ্নির উৎপন্নতা। জ্ঞান অনাদি অনন্ত, তা নিত্য বর্তমান। কিন্তু সাধকের হৃদয়ে প্রত্যেকবারেই তা নূতনভাবে দেখা দেয় বলে তাকে চিরন্তন বলা হয়েছে। [এই সূক্তের ঋষিবসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি]।
১১/১– প্রসিদ্ধ সর্বত্রগ বিচিত্রকর্মোপেত জ্ঞানসূর্য সর্বতোভাবে (সকল স্থানে) পরিভ্রমণ করেন; আমাদের মাতৃস্থানীয়া এই পৃথিবীকে তিনি প্রথমেই প্রাপ্ত হন, এবং স্বর্গে সঞ্চরণ করে আমাদের পরম আশ্রয় স্থান পিতৃলোকও তিনি প্রাপ্ত হন। (ভাবার্থ-জ্ঞানরূপে সেই ভগবান্ ইহলোকে এবং পরলোকে বিরাজ করেন)। [গৌঃ পৃশ্নি স্বঃ তিনটি পদই জ্ঞান-কিরণের স্বরূপ প্রকাশ করছে। গতি-অর্থক গ ধাতু গৌঃপদের উৎপত্তিমূল। তার দ্বারা জ্ঞানের অবাধগতির ভাব বোঝায়। স্পৃশ ধাতু পৃশ্নি পদের মূল। তাতে বৈচিত্র্যের ভাব আসে। জ্ঞান যে বিচিত্র কর্মোপেত, জ্ঞান যে সকল বৈচিত্র্যকেই স্পর্শ করে আছে, ঐ পদ তা-ই প্রকাশ করছে। স্বঃ শব্দে প্রভা বোঝায়– সূর্য বোঝায়। জ্ঞানরূপ সূর্যের প্রভা যে সর্বত্র-সঞ্চরণশীল, ঐ পদে তা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রয়ন পদ তার সেই সঞ্চরণ-শীলতা ব্যক্ত করছে। পিতৃলোক (পরমপদ) আমাদের চরম আশ্রয়স্থান; এখান থেকে সেখানে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য]। [এই মন্ত্রটি শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতাতে (৩প-৬ক-১ম) এবং ছন্দ আর্চিকেও (৪প-৬অ-৫খ-৪সা) পরিদৃষ্ট হয়]।
১১/২– এই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবের দীপ্তি, প্রাণাপান-বায়ুর প্রয়োজক হয়ে, দ্যাবাপৃথিবীর মধ্যে। (শরীরের অভ্যন্তরে) বিচরণ করছে (প্রাণব্যাপার সম্পাদন করছে); কর্মফলদাতা সেই অগ্নি, দ্যুলোককে (স্বর্গের স্বরূপতত্ত্ব) প্রকাশ করেন। (ভাব এই যে, — যে অগ্নি জ্ঞানরূপে বিদ্যমান আছেন, প্রাণ ও অপান বায়ুরূপে তিনিই সর্বত্র বিরাজিত রয়েছেন)। [এ মন্ত্রের মহিষঃ এবং প্রাণাদপানতী পদ দুটি অনুধাবনার বিষয়। মহিষঃ পদে অগ্নিকে বোঝায়। কেউ বা ঐ পদে বিদ্যুৎ অর্থ গ্রহণ করেছেন। জ্ঞানাগ্নি কর্মফল দান করেন; তাই তার নাম মহিষঃ। প্রাণবায়ু সংরক্ষণ এবং অপানবায়ু নিঃসরণ– এটাই জীবনরক্ষার মূল। যোগিগণ যোগের প্রভাবে যথেচ্ছভাবে প্রাণবায়ু ধারণ ও অপান বায়ু নিঃসরণ করতে পারেন। তাই তারা দীর্ঘায়ুঃ ও শক্তিমান্ হন। অগ্নিদেবের রোচনা (দীপ্তি বা জ্ঞান) বায়ুর ধারণায় ও পরিত্যাগে সমর্থ হন। তার দ্বারা দুলোকের তত্ত্ব অধিগত হয়। সেই জ্ঞান অর্জন করো। — এই উপদেশ এখানে গ্রহণীয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকে (৬অ-৫দ-৫সা) এবং শুক্লযজুর্বেদ সংহিতাতেও (৩অ-৭ক-১ম) পরিদৃষ্ট হয়]।
১১/৩– পরাজ্ঞান আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোক; তারপর আমাদের হৃদয়-উত্থিত স্তুতি
জ্ঞানসমন্বিত হয়ে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য উচ্চারিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করি, ভগবৎপরায়ণ হই)। [মন্ত্রের বিভিন্ন পদের বিভিন্নরকম ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। এখানে ত্রিংশদ্ধাম বিরাজতি বাপতঙ্গায় ধীয়তে-অংশের সমীচীন ও সঙ্গত অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে– সাধকগণ যাঁকে সর্বগ শব্দব্রহ্মস্বরূপ জেনে ধ্যান করেন, তিনি সকল কালে সকল স্থানেই বিদ্যমান আছে। এখন বোঝা গেল না কি– কাকে লক্ষ্য করে মন্ত্রটি উচ্চারিত হলো? আবার, মন্ত্রের শেষাংশ– প্রতি বস্তোরহ দ্যুভিঃ। ভাষ্যকার যা-ই বলুন, এখানে একটি উদ্ভাস্যতে ক্রিয়া মাত্র অধ্যাহার করেই সঙ্গত অর্থ দাঁড়িয়েছে– সেই ভগবান্ সকল কালে সকল স্থানে আপন জ্যোতিঃর দ্বারা উদ্ভাসিত হয়ে আছেন। — দ্যুভিঃ– জ্যোতিঃর দ্বারাই তিনি উদ্ভাসিত]। [এই সূক্তের ঋষি– সাপরাজ্ঞী। মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকে (৬অ-৫দ-৬সা) এবং শুক্লযজুর্বেদ সংহিতাতেও (৩অ-৮ক ১ম) পরিদৃষ্ট হয়]।
— একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত —