৩.১১ আচার বিচার আনন্দ
আচার ও ধর্মের ওপর সনাতন সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেকালে পিতার বৃত্তি পুত্র গ্রহণ করত। পিতার অভ্যস্তকুশলতার উত্তরাধিকার পুত্রের পক্ষে যথেষ্ট বিবেচিত হত। পিতার। প্রতি পুত্রের, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের, স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক কর্তব্য, এসবই পরিচিত পৌরাণিক আদর্শে ও ধর্মশস্ত্রে নির্ভুলভাবে বলা ছিল। সমাজের কোন স্তরে কোন অবস্থায় কার কি করণীয় এ বিষয়ে একটা ঐকমত্য ছিল। ভগবানের স্বরূপ অথবা ন্যায়শাস্ত্রের প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে তর্ক হত; কিন্তু বিধবার ব্রত, ব্রাহ্মণের অধিকার অথবা ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে কৃত্যাকৃত্য যেন প্রশ্নাতীত একটা নিশ্চয়তায় উত্তীর্ণ হয়েছিল।
এদেশের বৃহত্তর সমাজ বর্ণে ও জাতিতে বিভক্ত ছিল, বিভিন্ন বর্ণের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল শাস্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! অন্য দেশেও সামাজিক উচ্চ-নীচ ভেদ স্বীকৃত ছিল আচার ও ধর্মের ওপর এই ভেদাভেদের প্রতিষ্ঠা। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বেশভূষা, গতিবিধি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে ধারণা, সবই ছিল স্বীকৃত ঐতিহ্যের দ্বারা স্থিরীকৃত। এরই ভিতর কখনও কখনও অস্থিরতা দেখা দিত। বিশেষত বাইরের অচেনা শত্রু যখন পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তখন আচারের অচলায়তনও কিছুক্ষণের জন্য কেঁপে উঠত। কিন্তু এটা ছিল ব্যতিক্রম, সাময়িক ছন্দভঙ্গ।
সনাতন সমাজে ব্যক্তিকে বড় বেশি চিন্তা-ভাবনা করে পথ বেছে নিতে হত না। কোন পথ ভালো আর কোনটা মন্দ, এ নিয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশ ছিল না। মনের ভিতর তবুও যে দ্বন্দ্ব চলত, তার প্রধান কারণ ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য। শাস্ত্রের আলোতে যেটা স্পষ্টভাবেই ভালো বলে চেনা যায়, হৃদয় কখনও কখনও সেটা মানতে চাইত না। কাজেই দূর্বল চিত্তবৃত্তিকে শাসন করাটাই ছিল প্রধান সমস্যা। নয় তো বিচার অটল ও অভ্রান্ত। সনাতনী দৃষ্টিতে, নারী ও পুরুষ, এই চঞ্চল হৃদয়বৃত্তি এবং অবিচল বিচারবুদ্ধির যুগ্ম প্রতীক। দৈনন্দিন জীবনে অবশ্য নারী ছিল আচারের বিশ্বস্ত সেবিকা। প্রাচীন সমাজ এইভাবে আচারের প্রাচীরে ঘেরা একটি নিঃসংশয় আত্মিক নিরাপত্তার ভিতর ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছিল।
আধুনিক যুগের প্রান্তে এসে ভাঙ্গন দেখা দিল। প্রাচীন সমাজ ছিল পরিবারভিত্তিক। পরিবার ভেঙ্গে মানুষ যখন ক্রমশ বেশি সংখ্যায় জীবিকার উদ্দেশ্যে অথবা অন্য কোনো আকর্ষণে বাইরে বেরোতে শুরু করল, তখন থেকেই আচারের পাকাবাড়িতেও ভাঙ্গন শুরু। পিতা এবং পুত্রের বৃত্তি আর অভিন্ন রইল না। ব্যক্তির আবাল্য পরিচিত গৃহপ্রাঙ্গণের বাইরেও যে অন্য দেশ ও সমাজ আছে, ভিন্ন মানুষ যে ভিন্ন ধর্ম ও আচারকে আশ্রয় করে ভগবানের এই সৃষ্টির মধ্যেই স্বচ্ছন্দে স্থান করে নিয়েছে, এই বৈচিত্র ব্যক্তির চিন্তায় ও কল্পনায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি করল। নিজ সমাজের, এমন কি ধর্মপ্রতিষ্ঠানেরও, নানা দুর্নীতি ও কুসংস্কার ব্যক্তির আলোচিত চেতনার দৃষ্টিতে এবার অসহনীয় মনে হতে লাগল।
এমনি করে সংশয়ের শুরু। বেদ, বাইবেল, কোরান অভ্রান্ত। কিন্তু অভ্রান্ত বাণীরও নানা ব্যাখ্যা সম্ভব। কোন ব্যাখ্যাটি নির্ভুল? সনাতনপন্থীরা বললেন, শাস্ত্রকারদের ব্যাখ্যাই। গ্রাহ্য। বিদ্রোহীরা বললেন, ব্যক্তির বিবেকই হবে তার পথপ্রদর্শক। আবার মৌল সংশয়বাদীরা বললেন যে, সত্যনির্ণয়ের আসলে কোনো অভ্রান্ত উপায় নেই। তাহলে?
সত্য নির্ধারণের অভ্রান্ত উপায় থাক বা না-থাক জীবননির্বাহ করা আবশ্যক। অতএব কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এই অবস্থায় একটি সুখবাদী দর্শন ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করল, যুক্তির ওপর যার নির্ভর। সুখ ও দুঃখকে আমরা পাই প্রত্যক্ষ অনুভূতির ভিতর। সত্য সম্বন্ধে যত সংশয়ই থাক না কেন, সুখ আছে দুঃখ আছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এজন্য আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো প্রমাণের দ্বারস্থ হতে হয় না। সুখ কাম্য। অন্তত সুখবাদীদের কাছে এটাই সরল অকাট্য সত্য।
সুখ যাতে বাড়ে তাই ভালো, সুখের যাতে বিঘ্ন ঘটে তাই মন্দ। যিনি যুক্তিবান তিনি শুধু এই মুহূর্তের সুখের কথা চিন্তা করেন না। যে-সব উপায়ে সারা জীবনে সুখের যোগফলটা সবচেয়ে বড় হয়, সেই সব উপায় খুঁজে বের করাটাই যুক্তির কাজ। যুক্তি নির্লিপ্ত শুধু এই অর্থে। যুক্তি এই মুহূর্তের সুখে অন্ধের মতো লিপ্ত নয়। তবু যুক্তির দৃষ্টিতে ব্যাপকতম অর্থে সুখই কাম্য। আচারের কোনো নিজস্ব মূল্য নেই; সুখেরই নিজস্ব মূল্য আছে। এই হল বিচারনির্ভর সুখবাদের কথা।
কিন্তু এই সহজ কথাটিরও অর্থের বিস্তৃতি সম্ভব। যুক্তির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এই সহজ কথাটিও সত্যের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তীর্ণ হয়। আমরা যে সুখ দুঃখকে প্রত্যক্ষ অনুভবের ভিতর পাই, সেটা ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ। ব্যক্তিগত সুখবাদে বিশ্বাস রাখলে ব্যক্তি চাইবেন, নিজের জীবনে বৃহত্তম সুখ। অন্যের সুখ দুঃখ প্রত্যক্ষভাবে এখানে গণনার মধ্যে আসছে না। কিন্তু যুক্তির ভিতর অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের দিকে একটা। ঝোঁক আছে। সুখ নামক অভিজ্ঞতার যদি এমন কোনো নিজস্ব গুণ থাকে যাতে তাকে ভালো বলা যায়, তবে সেটা যদুর অভিজ্ঞতা হলেও ভালো, মধুর হলেও ভালো। অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের জন্যই ভালো নয়, সকলের জন্যই ভালো। যদি তাই হয়, তবে ভালোমন্দের বিচারে আমরা একটা বৃহত্তর সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছই। বহুতম মানুষের বৃহত্তম সুখটাই নীতির বিচারে শ্রেয়। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের অল্প সুখের জন্য অপরের বেশি সুখ বিসর্জন দিতে চান, তবে তাকে অন্তত নৈতিক বিচারে সমর্থন করা যায় না। ব্যক্তিগত সুখবাদ থেকে এইভাবে আমরা আবোহন করি বিশ্বজনীন সুখবাদে। এই আরোহণ একান্তই যুক্তিবাদের ওপর নির্ভরশীল। এতে ব্রহ্মবাদের কথা নেই। এই বিশ্বজনীন সুখবাদ মূলত মানবতামুখী।
বিশ্বজনীন সুখবাদে, আমার সুখও মূল্যবান, অপরের সুখও মূল্যবান; এবং বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে ধরে নেওয়া সঙ্গত যে কোনোটিই অন্যটির চেয়ে কম অথবা বেশি মূল্যবান নয়, অর্থাৎ দুটির সমান মূল্য। অথচ অপরের দুঃখ নিবারণের জন্য আমরা যে কাজ করি, তার একটি বিশেষ মূল্য সমাজে স্বীকৃত। আমাদের নিজের চেতনার ভিতরও এমন একটি স্বীকৃতি আমরা অনুভব করি। এই স্বীকৃতি কি শুধুই কুসংস্কার, না যুক্তিতে এরও একটা ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়? মোল শতকের গোড়ায় টমাস মোর ‘উটোপিয়া’ নামে যে পুস্তকটি রচনা করেছিলেন, তাতে এই প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া যায়। বইটি অতি সুপাঠ্য, চাপা কৌতুকের ভাষায় লেখা; তবু এর চিন্তায় এমন একটা আকর্ষণীয়তা আছে যে, বিশ শতকের শেষেও বইটিকে আমরা ভুলতে পারিনি।
‘উটোপিয়া’র অধিবাসীরা সুখবাদী। কিন্তু সেখানে ব্যক্তি নিজে কিছু কষ্ট স্বীকার করেও অপরের সুখ বর্ধন করতে আগ্রহী। এর একটি কারণ এই যে, এর ফলে অপরের কাছ থেকেও প্রয়োজনের সময়ে অযাচিতভাবে উপকার পাওয়া যায়, কাজেই ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের হিসেবেও শেষ পর্যন্ত সুখের ঘাটতি পড়ে না। উপরন্তু অন্যের দুঃখ লাঘব করতে গিয়ে নিজের মনে এমন একটি প্রসন্নতা লাভ করা যায় যেটা একেবারেই বাড়তি লাভ। এই যে চিত্তের প্রসন্নতা এর স্বীকৃতিমাত্রই কিন্তু সুখবাদী দর্শন গুণগত একটি ভিন্ন স্তরে পৌঁছে যায়। বস্তুত এখানেই সুখবাদের মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম। ‘উটোপিয়া’র নায়কও এইখানে একটু নীচু গলায়, সম্পূর্ণ অনুত্তেজিতভাবে, ভগবানকে স্মরণ করেন।
মনুষ্যেতর জীবেরাও পরস্পরকে সাহায্য করে। কিন্তু এই জৈব সহযোগিতার সঙ্গে পরোপকারিতার একটা পার্থক্য আছে। সাধারণ জীব আত্মসচেতন নয়। মানুষ যখন ব্যক্তিস্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন হয়েও সেই স্বার্থকে অতিক্রম করে যায়, তখনই তাকে পরোপকারী বলি। এই অতিক্রমণের ভিতর দিয়ে ব্যক্তিমানুষ নিজেকে একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করে, যোগ ঘটে তার মঙ্গলবোধের সঙ্গে। এই যোগের ভিতর দিয়ে সে সুখের অধিক কিছু একটা লাভ করে, যার নাম চরিতার্থতা, যেটা অধ্যাত্ম আনন্দের সগোত্র।
সাধারণ মানুষের জীবনে বিশেষভাবে কর্মের ভিতর দিয়েই এই যোগ সম্ভব। সনাতন সমাজে কর্ম বলতে বোঝাতে প্রধানত পরিবার ও স্বর্ণের প্রতি শাস্ত্র নির্ধারিত কৃত্যকর্ম। এটাকেই একদিন আমরা মঙ্গল বলে সহজে মেনে নিয়েছিলাম। এ-যুগের সমস্যা ভিন্ন।
আধুনিককালে, বিশেষত নাগরজীবনে, পরিবার ও কর্মপ্রতিষ্ঠানের ভিতর একটা দূরত্ব। স্থাপিত হয়েছে। কুটিরশিল্পের যুগে এমন ছিল না। গৃহ ও কর্মস্থান অভিন্ন ছিল ভৃত্য অথবা দাসকেও পরিবারভুক্ত মনে করা হত। ফলে পরিবারের প্রতি আনুগত্য এবং কর্মপ্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়িত্বের ভিতর সেকালে বিরোধ ছিল না। কৃষি ও কুটিরশিল্পের সীমানা ভেঙ্গে আধুনিক শিল্প যখন বড় আকার ধারণ করল, এদিক থেকে তখনই একটস নৈতিক সমস্যা দেখা দিল। পরিবারের প্রতি একটা স্বাভাবিক প্রীতির যোগ ও আনুগত্যবোধ স্বাভাবিক। ছেলে সমর্থ হলে কিছু না দিয়ে পরিবারের অন্ন গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ করে। পরিবারকে কিছু দিয়ে সে নিজে তৃপ্ত হয়। পরিবারের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে এই বোধটা সহজে আসে না। বাইরের প্রতিষ্ঠানকে ঠকাতে ব্যক্তি তেমন সংকোচ বোধ করে না। অথচ শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রমশই বেশি করে এমন সব প্রতিষ্ঠানে কাজের সূত্রে মিলিত হচ্ছি, যেখানে অধিকাংশের সঙ্গে আমাদের কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই। বৃহত্তর সমাজকে যা দেবার, প্রধানত এই সব প্রতিষ্ঠানের ভিতর দিয়েই আমাদের তা দিতে হবে। এই নতুন পরিস্থিতিতে তাই একটা। নতুন কর্মভিত্তিক নীতিবোধর প্রয়োজন দেখা দেয়।
কর্মকে ভিত্তি করে এই যে নীতিবোধ, জাপানে এটা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। সেখানে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও পারিবারিক আনুগত্যের একটা বিকল্প গড়ে উঠেছে, যেন কর্মের সূত্রে কর্মীরা এক পরিবারভুক্ত। এর ভিতর দিয়েই ওরা জাতিকে শক্তিশালী করছে। জাপানে জাতীয়তাবাদ ও কর্মভিত্তিক নীতিবোধের এইখানে যোগ।
পাশ্চাত্ত্য জগতে কর্মভিত্তিক নতুন নীতিবোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল, প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম। শিল্প ও ব্যবসায়ের অভ্যুত্থানের প্রথম যুগে ধর্মেরও সংস্কার ঘটল। সংস্কারকেরা বললেন যে, ব্যক্তির একটা বিশেষ ঐহিক কর্তব্য আছে, যেটা ধর্মীয় কর্তব্যেরই তুল্য। প্রাকৃতিক সম্পদ ভগবান যখন মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন, তখন এতে তাঁর কোনো অভিপ্রায় আছে। মানুষ এই সম্পদ অবহেলা করে ফেলে রাখবে, এটা ঈশ্বরের অভিপ্রায় হতে পারে না। বরং প্রত্যেকে নিজের সামর্থ্যকে ভগবানের দান বলে বিনীতভাবে গ্রহণ করবে, যে যেখানে নিযুক্ত সে সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে নিপুণভাবে কাজ করবে, আর এই জাগতিক সাধনার ভিতর দিয়ে দেহ ও মনের শক্তি হবে একাগ্র ও অনুশীলিত, এতেই ঈশ্বরের প্রতি মানুষের আনুগত্যের প্রকাশ। ওঁরা বললেন যে, কর্মই উপাসনা। সংস্কারকেরা শুরু করলেন, ক্রমে এই ভাবটা ছড়িয়ে পড়ল অনেকের মধ্যে।
যুক্তিবাদ তথা সুখবাদী দর্শনের প্রসারিত প্রান্ত ধরে আমরা এই কথাটিতে এসে পৌঁছেছিলাম যে, একটা বৃহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবেই মানুষের চিত্তবৃত্তির চরিতার্থতা। আধুনিক ইতিহাসের একটি বিশেষ যুগে শিল্পোন্নয়নই এই বৃহৎ উদ্দেশ্য রূপে দেখা দিল। পরোপকার ভালো; কিন্তু শুধু ব্যক্তিগত দানের ভিতর দিয়ে সমাজের বেশি মানুষের বেশি উপকার করা যায় না। ফরাসী দেশে স্যাঁ সিম বললেন যে পরোপকারের শ্রেষ্ঠ পথ শিল্পোন্নয়ন। আর সে জন্য চাই বিজ্ঞান ও শ্রম।
শ্রমের সঙ্গে যুক্ত আছে পারিশ্রমিকের প্রশ্নটা। দুটি নীতির এখানে উল্লেখ আবশ্যক। এক হল, শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক। শ্রমের গুণগত উৎকর্ষের দিকটাও অবশ্য এখানে ধরতে হবে। শ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের যদি একটা সদর্থক সম্পর্ক থাকে তবে শ্রমের ইচ্ছা আরো জোরালো হয়। আদর্শবোধ এবং স্বার্থবোধ, দুটোকেই কাজে লাগানো চাই। শ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের যোগ থাকলে তবেই ব্যক্তিস্বার্থকে কাজে লাগানো যায়, আর কাজের ইচ্ছা অন্যায়বোধের চাপে দুর্বল হয় না।
প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক, এই হল দ্বিতীয় নীতি। এর সঙ্গে পরিবারভিত্তিক আদর্শের একটা যোগ আছে। যার যেমন প্রয়োজন তাকে তেমন দেওয়া আত্মীয়তার। সহজ নিয়ম। কেউ হয় তো পঙ্গু অথবা অসুস্থ, শ্রমে অক্ষম অথবা অপুট। তার প্রয়োজন অনুযায়ী তবু সে পাবে, আত্মীয়তা অথবা মানবিক সহানুভূতির রায় এটাই।
বিশ্বজনীন সুখবাদী দর্শনেও সাম্যের দিকে একটা ঝোঁক আছে। যদি বলি যে, বহুতম মানুষের বৃহত্তম সুখই কাম্য, তবে ধনী নির্ধনের অসাম্য সমর্থন করা কঠিন হয়। ধনীর সামান্য সুখের পরিবর্তে যদি দরিদ্রের বেশি দুঃখ লাঘব করা সম্ভব হয়, তবে সুখবাদী বিচারে সেটাই কাম্য। ধনের বণ্টনের প্রশ্নে বিশ্বজনীন সুখবাদ এবং প্রয়োজনতত্ত্ব যেন। একই মেরুর অভিযাত্রী।
অবশ্য এখানেও কিছু তাত্ত্বিক সমস্যা আছে। আবার রোগীর চিকিৎসার প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক অথবা বার্ধক্যের প্রশ্নে। রোগীর জীবনকে উপভোগ-করবার ক্ষমতা কম, চিররুগের ক্ষেত্রে তো এই অবস্থাটাই স্থায়ী। বার্ধক্যেও ভোগশক্তি দুর্বল।
তবে কি বৃদ্ধ এবং চিররুগ্নদের যথাসম্ভব বাদ দিয়ে সুস্থসমর্থদের ভোগের আয়োজন বাড়ানোটাই সুখবাদী যুক্তি কথা? যারা মানসিকভাবে রুগ্ন তাদের ব্যাপারেও কি একই ব্যবস্থা কাম্য? অথচ অর্থের প্রয়োজন তো এদেরও আছে। প্রয়োজনবাদের সঙ্গে, মনে হতে পারে, সুখবাদের এখানেই বড় পার্থক্য। বিষয়টা কিন্তু অত সহজ নয়। প্রয়োজনের বিচার হবে কার দৃষ্টিতে? যে মানুষ রোগে শোকে আচ্ছন্ন, তার ভিতর জীবনের প্রতি আকর্ষণ অনেক সময় ক্ষীণ হয়ে আসে, কাজেই তার প্রয়োজনটা দুর্বল। প্রয়োজনটা শোকার্তের দৃষ্টিতে হয়তো ততটা নয়, যতটা প্রিয়জনের দৃষ্টিতে। রোগীর চিকিৎসা না হওয়া অবধি–এমন কি আরোগ্যের সম্ভাবনা যেখানে নেই সেখানেও শুশ্রূষার যথাসম্ভব ব্যবস্থা না হলে প্রিয়জন সুখ পায় না, শান্তি পায় না। প্রয়োজনটাকে যখন আমরা এইভাবে দেখি তখন দুই তত্ত্বের মধ্যে আবারও একটা সাযুজ্য স্থাপিত হয়। সুখেরও স্তরভেদ আছে; প্রয়োজনেরও তাই। স্তরভেদে অর্থভেদ হয়।
সুখবাদ যদিও চাবাক থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি ইতিহাসে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে, তবু আধুনিক পশ্চিমী সভ্যতায় এর একটা বিশেষ স্থান ছিল। বেন্থামের যুগে ঝোঁক পড়েছিল,। শিল্পের প্রসার এবং ধনোৎপাদন বৃদ্ধির ওপর! অসাম্য সেদিন প্রয়োজন মনে হয়েছিল, অনেকখানি অসাম্য মেনে নেওয়া হয়েছিল, ধনোৎপাদনের জন্য। ধনীরা সঞ্চয় করবে, সঞ্চিত ধন শিল্পবাণিজ্যে নিযুক্ত হবে, জাতির সম্পদ এতে বাড়বে। এই রকম একটা যুক্তির ছিল প্রাধান্য। এরই জোরে সুখবাদী দর্শনও সেদিন অনেকখানি অসাম্য সমর্থন করেছিল। ক্রমে আর্থিক সাম্যের প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠল। অর্থের বণ্টনের কথাটা প্রাধান্য। পেল। সেকালের জমিদার বিলাসী শিল্পবিপ্লবের প্রথম যুগে পুঁজিপতিরা সঞ্চয়ী এ যুগের ধনীরা আবারও বিলাসী। এ যুগে দারিদ্র্য ও বিলাসিতার অসামঞ্জস্য পীড়াদায়ক।
সমবণ্টনেও অবশ্য সমস্যার শেষ সমাধান নেই। সমস্যার নানা স্তর। কাজের ভিতর মুক্তির আস্বাদ চাই। আধুনিক শিল্প শ্রমবিভাগের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এখানেই তার। জোর; এটাই তার দূর্বলতা। আধুনিক অর্থশাস্ত্রের আদিপুরুষেরা এটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করেছিলেন। যে শিল্পী প্রতিমা গড়েন তিনি কাজের ভিতর দিয়ে নিজের কল্পনাকে রূপদান করেন, নিজেকে প্রকাশ করেন। কিন্তু যদি বলা হয় যে, কাজটাকে দশ টুকরো করে দশ জনের ভিতর ভাগ করে দেওয়া যাক, তারপর টুকরোর সঙ্গে টুকরো জুড়ে সম্পূর্ণ জিনিসটা পাওয়া যাবে, তবে কাজটা তাতে তাড়াতাড়ি হতেও পারে, কিন্তু কাজের ভিতর থেকে সৃষ্টির আনন্দ পালাই পালাই করে। কাজটা তখন হয়ে ওঠে কর্মীর পক্ষে বন্ধনদশা। আধুনিক শিল্পের যুগে, কর্মবিভাগই কর্মবন্ধন। এই বন্ধন থেকে মানুষ মুক্তি চায়, যদিও মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। শিল্পোন্নত সমাজ আজ জীবনের একটা নতুন দিগন্ত খুঁজছে।
অর্থাৎ প্রতিটি স্তরের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে, আবার নিজস্ব সার্ধকতাও আছে। কর্মবিভাগ যুক্তিরই দান। এতে শিল্পের উৎপাদিকা শক্তি বেড়েছে। সেই সঙ্গে এসেছে কাজের ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস। এই স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করতে যাদের অনীহা তারা যখন পরবর্তী স্তরের মুক্তি দাবী করে, তখন বিভ্রাট ঘটে। মুক্তিরও একটা বাস্তব পূর্বশর্ত আছে। সেটা বিচারের আলোতে চিনে নিতে পারলে এগোবার পথ সহজ হয়। আজকের বিচার কাল পথের বাধা হয়ে ওঠে। তবু আজকের যুদ্ধটাও জেতা চাই। নয় তো আমরা একই সঙ্গে হই, বর্তমানে নষ্ট এবং ভবিষ্যৎ থেকে ভ্রষ্ট।
পথের শেষ নেই। কর্মই বন্ধন, আবার কর্মই মুক্তি। আচার বিচারের মধ্য দিয়ে সে আমাদের উত্তীর্ণ করে দেয় আনন্দে। একবার নয়, বার বার। দীর্ঘপথের আমরা যে যেখানে আছি সেখানেই এই আশ্চর্য উত্তরণ সম্ভব। ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)