৩.১০ হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ

আজ মোহনবাঁশিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রাণের আশঙ্কা আগেই কেটে গিয়েছিল। এখন মোটামুটি সুস্থ। সে। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হলেও তাকে জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া চলবে না। আপাতত মোহনবাঁশিকে কয়েকদিন পোর্টব্লেয়ারেই থাকতে হবে। ডাক্তার চট্টরাজ জানিয়েছেন, রোজ একবার তাকে হাসপাতালে চেক-আপের জন্য নিয়ে যাওয়া জরুরি। তারপর সম্পূর্ণ ফিট হলে রিফিউজি সেটলমেন্টে ফিরতে দেওয়া হবে।

ঠিক হয়েছে, এই কদিন মোহনবাঁশি বিশ্বজিতের বাংলোতেই বউছেলেমেয়ে নিয়ে থাকবে। রোজ সকাল বা বিকেলের দিকে কোনও এক সময় কেউ একজন তাকে হাসপাতালে এনে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে যাবে।

অন্য কয়েক দিনের মতো আজও সকালে নটা বাজতে না বাজতেই বিশ্বজিৎ রাহার জিপে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ আর বিনয়। ঘণ্টাদেড়েক কী দুইয়ের মধ্যে মোহনবাঁশিকে নিয়ে ফিরে আসবেন তারা। তাই আর জ্যোৎস্না এবং তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেননি।

জিপটা ফুঙ্গি চাউং পেছনে ফেলে জিমখানা আর এবারডিন মার্কেটের পাশ দিয়ে যখন সেলুলার জেলের গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে সেই সময় অনেক নিচে সেসোস্ট্রোস বের সেই ছোট জেটিটার দিকে নজর চলে গেল বিনয়ের। কদিন আগে ওখানে এস এস সাগর জাহাজটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সে। চকিতে মনে পড়ে গেল সেই জাহাজটায় উঠে মিডল আন্দামান চলে গিয়েছিল ঝিনুক। আজ সেখানেই একটা মোটর বোট দাঁড়িয়ে আছে। সি গাল। ওটা সেল কালেক্টারদের বোট। তার খুবই চেনা। এই বোটে করে নানা দ্বীপের কিনার ঘেঁষে যারা ঘুরে বেড়ায় তারা সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে দিয়ে শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাস নটিলাস ইত্যাদি আশ্চর্য ধরনের মূল্যবান শেল বা সিপি তুলে আনে। বিদেশের বাজারে সেগুলোর বিপুল চাহিদা। প্রচুর দামে এসব বিকোয়।

‘সি গাল’ বোটটার মালিক লা পোয়ে। একজন বর্মি। বহুকাল আগে বর্মার মৌলমিন থেকে সেলুলার জেলে কয়েদ খাটতে এসেছিল। ভারত স্বাধীন হবার পর আর সে বর্মায় ফিরে যায়নি, আন্দামানেই থেকে গেছে। এখানেই বিয়েটিয়ে করে পোর্টব্লেয়ারের একটা পেনাল কলোনিতে থাকে। তার কাজ হল দক্ষিণ আর মধ্য আন্দামানের দ্বীপগুলো সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে সমুদ্র থেকে সেল তোলা। তার বোটে আছে কজন বর্মি আর তামিল ডাইভার, এই ডাইভাররাই জলে নেমে শেল তোলে।

দিন পনেরো-কুড়ি আগে জেফ্রি পয়েন্টে উদ্বাস্তুদের নতুন সেটলমেন্টে পাশের উপসাগরে ওরা শেল তুলতে গিয়েছিল। সেই সময় লা পোয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে বলেছিল, পোর্টব্লেয়ারের দিকের সমুদ্রে শেল তোলা হয়ে গেলে আবার তারা জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যাবে। ওখান থেকে তাদের গন্তব্য মিডল আন্দামান। বলেছিল তাদের সঙ্গে বিনয়কে সেখানে নিয়ে যাবে।

মিডল আন্দামান! মিডল আন্দামান ওই দ্বীপের কোনও এক রিফিউজি সেটলমেন্টে রয়েছে ঝিনুক। বুকের ভেতর তুমুল আলোড়ন অনুভব করল বিনয়। ব্যগ্রভাবে জিপের ড্রাইভার কালীপদকে বলল, গাড়িটা একটু থামাও তো—

জিপ থেমে গেল। পাশ থেকে শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, কী হল বিনয়! গাড়ি থামানোয় তিনি বেশ অবাকই হয়েছেন।

বিনয় বলল, কাকা, আমি এখানে নামব। একটা কাজ সেরে পনেরো কুড়ি মিনিটের ভেতর হাসপাতালে চলে আসছি।

শেখরনাথ আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। জিপ থেকে বিনয় নেমে পড়ল। তারপর ডান পাশের ঢালু রাস্তা দিয়ে সোজা ছোট্ট জেটিটায় পৌঁছে গেল।

লা পোয়ে আর ডাইভাররা তাদের বোটে ছিল না, জেটিতে বসে গল্পসল্প করে অলস মেজাজে সময় কাটাচ্ছিল। বিনয়কে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল।

লা পোয়ে বলল, পত্রকারজি (সাংবাদিক), আপনি জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজি সেটলমেন্ট ছেড়ে কবে টাউনে এলেন?

এখানে টাউন হল পোর্টব্লেয়ার শহর। বিনয় বলল, কয়েক দিন হল এসেছি।

কোনও কাজে এসেছেন?

হ্যাঁ। পোর্টব্লেয়ারের আসার কারণটা জানিয়ে বিনয় বলল, আপনি বলেছিলেন আমাকে মিডল আন্দামানে নিয়ে যাবেন।

লা পোয়ে বলল, ইয়াদ আছে। জরুর নিয়ে যাব। লেকিন—

কী?

আমরা এখান থেকে দিন-পনেরো পর জেফ্রি পয়েন্টে ফিরব। সেখান থেকে মিডল আন্দামান যাব। লেকিন আপনি এখানে থাকলে কী করে আমাদের সঙ্গে যাবেন?

বিনয় মনে মনে ভেবে নিল। ডাক্তার চট্টরাজ যা বলেছেন, বড়জোর দিন ছয় সাত মোহনবাঁশিকে চেক-আপের জন্য হাসপাতালে যেতে হবে, তারপর সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরতে পারবে। তাকে নিয়ে শেখরনাথ আর সেও চলে যাবে।

বিনয় বলল, আপনাদের জেফ্রি পয়েন্টে যাবার আগেই আমি সেখানে পৌঁছে যাব। আমাকে ফেলে মিডল আন্দামানে যাবেন না কিন্তু।

লা পোয়ে বলল, আপনাকে জবান দিয়েছি। জরুর নিয়ে যাব। ফিকর মাত কিজিয়ে

বিনয় লা পোয়ের দুটো হাত ধরে গাঢ় গলায় বলল, অনেক ধন্যবাদ। এখন আমি চলি। জেফ্রি পয়েন্টে আবার দেখা হবে।

একটু-পর চড়াইয়ের রাস্তা বেয়ে সেলুলার জেলের দিকে উঠতে উঠতে বিনয়ের মনে হচ্ছিল, লা পোয়ে তাকে মধ্য আন্দামানে ঠিকই নিয়ে যাবে, সেখানকার উদ্বাস্তু সেটলমেন্টগুলোতে ঘুরে ঘুরে ঝিনুককে খুঁজে বের করেও ফেলতে পারবে কিন্তু যে মেয়ে তার অতীতকে জীবন থেকে প্রায় মুছে ফেলেছে, অভিমানে, অসম্মানে, তীব্র গ্লানিবোধে বিনয়ের প্রতি যে চরম উদাসীন তার সামনে গিয়ে আবার দাঁড়ালে সে কী করবে? ধিক্কারে, বিতৃষ্ণায় রূঢ়ভাবে হয়তো বলবে, তুমি চলে যাও। আর কখনও আমার কাছে এসো না৷

ঝিনুক একের পর এক তীব্র শেল হেনে যতই ক্ষত-বিক্ষত, জর্জরিত করুক, মুখ বুজে সব সইবে বিনয়। ঝিনুককে মধ্য আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। আনতেই হবে। এক অদম্য মরিয়া জেদ যেন তার মাথায় চেপে বসতে থাকে।

তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত

1 Comment
Collapse Comments
দিতিপ্রিয়া দাশগুপ্ত May 31, 2021 at 8:19 am

“ছিন্নমূলের ঘরবসত” পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *