স্ত্রীলোকের চাতুরী
পরদিন ছয়শো যোনোতম রজনী :
শাহরাজাদ এবার নতুন গল্প শুরু করবে। শাহরাজাদ বলে জাঁহাপনা এবার একটা মজাদার কাহিনী শুনুন!
কোনও এক শহরে এক যুবক সওদাগর বাস করতো। ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষে প্রায়ই তাকে বিদেশে যেতে হতো। সওদাগরের এক বিবি ছিলো মেয়েটি নষ্ট চরিত্রের। ভীষণ কামুক।
সওদাগর যখন বিদেশে যেত বিবি কাম-কাতর হয়ে সুন্দর সুপুরুষ ছোকরা খুঁজে বেড়াতো।
একবার সওদাগর বিদেশে গেলে বিবিটা ঐ রকম একটি তরুণকে সন্ধান করে বাড়িতে নিয়ে আসে। সারা দিন রাত তার সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদ রতি রঙ্গ করে কাটাতে থাকে।
একদিন ঐ ছেলেটি এক বিকৃত-কাম শেখের পাল্লায় পড়ে। বৃদ্ধের প্রস্তাবে ছেলেটি ক্ষেপে যায়। এবং কিল চড় লাথি ঘুষি মেরে তাকে ঘায়েল করে ফেলে। বুড়োটা কোতোয়ালের কাছে নালিশ করে। কোতোয়াল ছেলেটিকে ধরে এনে ফাটকে ভরে রাখে।
সওদাগর-বিবি খবর পায়, তার নাগর কয়েদ হয়েছে। রাগে সে ফুঁসে ওঠে। সটান চলে আসে কোতোয়ালীতে।
কোতোয়াল তখন তার দপ্তরে কাজে ব্যস্ত ছিলো। সওদাগর-বিবিকে দেখে সে লোলুপ হয়ে ওঠে। মেয়েটির দেহে ঢলঢলে ভরা যৌবন। রিরংসার আগুন জ্বলে ওঠে শরীরে। জিজ্ঞেস করে, কী চাই তোমার?
সওদাগর-বিবি সালাম জানিয়ে বলে, কোতোয়াল সাহেব, আপনার ফাটকে আমার ভাই আটক হয়ে আছে। একটা বুড়ো শেখ ওর নামে মিথ্যা নালিশ করেছে আপনার কাছে। ও কিছু দোষ করেনি। মেহেরবানী করে আপনি ওকে ছেড়ে দিন। আমার বাড়ির সে-ই একমাত্র কর্তাব্যক্তি। ওকে যদি আপনি কয়েদ করে রাখেন আমার সংসার অচল হয়ে যাবে।
কোতোয়াল বললো, ঠিক আছে তোমার ভাই যাতে ছাড়া পায়, আমি দেখব। আমি এখন অন্য কাজে খুব ব্যস্ত। তুমি আমার হারেমে অপেক্ষা কর। এদিকের কাজ কাম শেষ করে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করছি।
সওদাগর-বিবি ভাবলো, বুড়োটার প্রাণে বসন্ত জেগেছে। কিন্তু সে-ও জাহাবাজ মেয়ে। – তাকে কাবু করা অত সহজ নয়। মুখে বললো, কোতোয়াল সাহেব, আপনার হারেমে ন, এসব হবে না। আপনি যদি দয়া করে আমার বাড়িতে আসেন, আমি নির্ভয়ে সব খুলে বলতে পারি আপনাকে।
-বেশ তো, কোথায় তোমার বাড়ি?
মেয়েটি বলে, চাঁদনী বাজারের পিছনে একটাই লাল রঙের বাড়ি আছে। ওইটেই এই বাঁদীর বাড়ি। ঠিক সূর্য ডোবার সময় যদি আসেন খুব ভালো হয়।
কোতোয়াল গম্ভীর হয়ে বলে, ঠিক আছে, তুমি থেকো। আমি ঐ সময়ই যাবো তোমার বাড়ি।
সওদাগর-বিবি কোতোয়ালী থেকে বেরিয়ে সোজা চলে আসে কাজীর বাড়ি। মেয়েটিকে দেখামাত্র কাজীর কামনা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এমন আপেলের মতো গাল, রতিদন্ধ অধর, উদ্ধত বক্ষ, ভারি নিতম্ব কাজীর বুকে তুফান তোলে। বৃদ্ধ প্রশ্ন করে, কী চাই তোমার? কেউ তোমার ওপর জোর-জুলুম করেছে কিছু?
সওদাগর-বিবি বলে, জী না, আমার ওপরে আবার কে জুলুম করবে। আমি এসেছি আমার নিরপরাধ ভাই-এর খালাসের জন্য।
-খালাস? কেন কী হয়েছে, সে কী কয়েদ হয়েছে নাকি?
—জী হাঁ, কোতোয়াল তাকে অন্যায় করে ফাটকে ভরে রেখেছে। একটা বুড়ো শেখ আমার ভাই-এর নামে মিথ্যে করে নালিশ করেছিলো। কয়েকটা মিথ্যে সাক্ষী জোগাড় করে এনেছিলো। কোতোয়াল দু-তরফের সব কথা না শুনেই তাকে বেড়ি পরিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে।
কাজী বলে, তোমার সব কথা শোনা দরকার। তুমি এখন আমার হারেমে যাও। তারপর দেখি, এদিকের কাজ কাম সেরে তোমার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবো। তবে নিশ্চিন্ত থেক তোমার ভাইকে আমি খালাস করে দেব।
সওদাগর-বিবি বুড়ো কাজীর মতলব বুঝতে পারে। বলে, দেখুন কাজী সাহেব, আপনার হারেমের মেয়েরা আমার অচেনা। সেখানে আমি ঠিক সহজ হতে পারব না। তার চেয়ে আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমার বাড়িতে আসেন খুব ভালো হয়।
-কোথায় তোমার বড়ি? সওদাগর-বিবি বলে, এই কাছেই চাঁদনীচকে।
বাড়ির ঠিকানা নির্দেশ করে সে বলে, সূর্য ডোবার একটু পরে আপনি আসুন, আমি আপনার জন্যে তৈরি থাকবো।
এই বলে সে আমার সেখানে দাঁড়ায় না। চলে আসে উজিরের প্রসাদে। উজির সাহেব তখন তার সাঙ্গ পাঙ্গদের নিয়ে মশগুল ছিলো। সওদাগর-বিবির কাম-জর্জর মূর্তি দেখে সে মোহিত হয়ে পড়ে।
-তোমার কী চাই?
সওদাগর-বিবি বলে, হুজুর কোতোয়াল আমার ভাইকে অন্যায় করে আটকে রেখেছে। সে আমার সংসারের একমাত্র সহায়। তাকে আপনি মুক্ত করে দিন,এই আমার আর্জি।
উজির ভারিকি চালে বলে, এইসব কোতোয়ালগুলোকে আমি শুলে দেব। তা তুমি কিচ্ছু ভেব না, তোমার ভাইকে আমি খালাস করে দেব। এখন এক কাজ করো, আমার অন্দরমহলে গিয়ে অপেক্ষা করো। এদিকের কাজকাম সেরে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি।
সওদাগর-বিবি বলে, আমি অতি সাধারণ মানুষ, আপনাদের হারেমে আমার যেতে শরম করছে। তার চেয়ে আপনি যদি মেহেরবানী করে আমার গরীবখানায় একবার পায়ের ধুলো দেন, ধন্য হবো।
এর পর সে তার বাড়ির ঠিকানাপত্র জানিয়ে বলে সূর্য ডোবার ঘন্টাখানেক পরে আপানার জন্য আমি পথ চেয়ে বসে থাকবো, হুজুর।
উজির বলে, আচ্ছা দেখি, যাবো।
এর পর সে চলে আসে সুলতানের কাছে। সুলতান তার রূপের আগুনে জ্বলে ওঠেন। সাধারণ ঘরে এমন সুন্দরী যুবতী মেয়ে!
-কী বাছা, কেন এসেছ? কেউ তোমার ওপর অত্যাচার করেছে?
-না জাঁহাপনা, সে-সব কিছু নয়। আমার সংসারের একমাত্র সহায় আমার ভাই। সে এখন ফাটকে।
—ফাটকে? কেন?
-আপনার কোতোয়াল তাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে আটক করে রেখেছে। আপনি আমার মা-বাপ-তাকে যদি ছেড়ে দেবার হুকুম না দেন তো অনাহারে মরে যাবো আমি।
এই বলে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সুলতান বলেন, আহা-হা, কেঁদো না, আমি সব সুরাহা করে দিচ্ছি। আগে মামলাটা আমাকে শুনতে হবে। তার জন্য কিছু সময় দরকার। তবে আমার কাছে ন্যায্য বিচার পাবে। অন্যায় আমি বরদাস্ত করতে পারি না। তুমি এখন আমার হারেমে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি সব খোঁজখবর নিয়ে তোমার কাছে যাচ্ছি একটু পরে।
সওদাগর বিবি বলে, জাঁহাপনা আমি অতি সাধারণ মেয়ে, সুলতানের হারেমে প্রবেশ করার স্পর্ধা আমার নাই। আপনি যদি মেহেরবানী করে এই গরীবের কুঁড়েঘরে একবার আসেন চিরজীবন আমার কাছে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সুলতান মনে মনে ভাবেন, সেই ভালো। বলেন, ঠিক আছে, তোমার ঠিকানাপত্র রেখে যাও, আমি যাবো। হ্যাঁ, কখন গেলে তোমার সুবিধে হবে?
সওদাগর-বিবি বলে, আমার ঘরের কর্তা সূর্য ডোবার ঘন্টাখানেক বাদে বাইরে যায়। আপনি তার পরে যে-কোনও সময় আসুন, আঁহাপনা। বাঁদী প্রস্তুত থাকবে।
সুলতানের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সে এক ছুতোরের দোকানে আসে। ছুতোরটা ইয়া মোটকা। গোল গোল চোখ দুটো ওর উদ্ধত বুকের ওপর গেঁথে রেখে জ্বল জ্বল করে তাকায়, আর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে থাকে।
–হ্যাঁ গো দোকানী,আজ সন্ধেবেলায় আমার রসুই ঘরের হাঁড়ি পাতিল থালাবাসন রাখার একটা বেশ বড়সড় আলমারী দরকার। বানিয়ে দিতে পারবে?
লোকটা বলে, অত তাড়াতাড়ি অত বড় একটা আলমারী কী বানানো যায়, মালকিন। তা আমার দোকানে একটা তৈরি আছে, দেখুন যদি পছন্দ হয়।
সওদাগর-বিবি বলে না ও-সব জিনিস চলবে না। আমার আলমারী প্রমাণ সাইজের হওয়া চাই। ভিতরে পাঁচখানা তাক থাকবে। এবং প্রত্যেকটা তাকের জন্য আলাদা কুলুপ থাকা চাই। দাম যা লাগে আমি দেব। চাই কি আগামও নিয়ে নিতে পার। কিন্তু সূর্য ডোবার আগে আমার চাই।
আগাম দাম পাওয়া যাবে শুনে ছুতোর উৎসাহিত হয়ে বলে, ঠিক আছে, বেকেলেই পেয়ে যাবেন। তা মাপটাপগুলো কী হবে, একবার কথা বলা দরকার। অন্য খদ্দের-পাতির ভিড় হবে, আপনি বরং আমার দোকানের পিছনের দিকের ঐ খুপরিতে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।
-হাতুড়ি বাটালি চালিয়ে চালিয়ে তোমার মাথাটা দেখছি একেবারে ভোতা হয়ে গেছে ছুতোের। দেখছো না আমার এই জমকালো সাজ-পোশাক, তোমার ঐ ময়লা নোংরা খুপরিতে বসবো কোথায়। তার চেয়ে তুমি আমার বাড়িতে চলে এসো। একটু রাত করে। তারপর সারারাত ধরে তোমাকে নিয়ে মাফ-জোকের হিসেব করবোখন। তবে হ্যাঁ আলমারীটা কিন্তু আজ বিকেলেই চাই। এবং তার মধ্যে পাঁচটা তাক থাকবে। এবং প্রত্যেকটা তাকের আলাদা আলাদা তালা থাকবে।
ছুতোর বলে, সে আপনি কিছু ভাববেন না মালকিন। আপনার ফরমাশ মতো বানিয়ে বিকেলের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব লোক দিয়ে।
সওদাগর-বিবি বলে, শুধু আলমারী পাঠিয়ে দিলেই চলবে না ছুতোর, তোমাকে নিয়ে আজ সারারাত ধরে মাফজোকের হিসেব করবো, মনে থাকে যেন। ঠিক রাত দশটায় যাবে আমার বাড়িতে। একটু কাগজ দোয়াত কলম দাও, ঠিকানাটা লিখে রেখে যাই-নইলে তুমি আবার ভুলে যেতে পার।
সূর্য ডোবার অনেক আগে দোকানের মুটেরা মাথায় করে নিয়ে এলো সেই আলমারী। সওদাগর-বিবি লোকগুলোকে বড় ঘরের ঠিক মাঝখানে বসিয়ে দিতে বললো।
তাকগুলো সব গুণে দেখলো সে। হ্যাঁ, পাঁচটাই আছে। তাকগুলো ভালো করে আর পরীক্ষা করে দেখার অবকাশ হলো না; দরজায় কড়া নড়ে উঠলো।
দরজা খুলে সওদাগর বিবি কোতোয়ালকে স্বাগত জানায়, আইয়ে—আইয়ে জনাব, বইঠিয়ে। মেঝের ওপরে বিরাট গালিচা পাতা হয়েছে। তার ওপর কাপড় পেতে নানা রকম উপাদেয় খানাপিনা শরাব থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে সওদাগর-বিবি।
কোতোয়াল তো দেখে মহা খুশি। শরাবের পেয়ালা পূর্ণ করে দেয় মেয়েটি। কোতোয়াল মৌজ করে চুমুক দেয় পেয়ালায়। নেশা একটু ধরতেই দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে যায় সওদাগর-বিবিকে। কিন্তু মেয়েটি ভীষণ সেয়ানা, কায়দা করে পাশ কাটিয়ে সরে যায়।
—আহা, অত তাড়া কিসের, ছটফট করছেন কেন? আপনার ঐ সাজ-পোশাক নষ্ট হয়ে যাবে যে। আমি আপনাকে পরার জন্য ছোটোখাটো পোশাক এনে দিচ্ছি। ওটা পরুন। তারপর সারারাত ধরে যত ইচ্ছে ফুর্তি করুন।
একটা লাল ডুরে কাটা ফতুয়া আর একটা আঁটোসাঁটো ল্যাঙোট এনে সে কোতোয়ালের হাতে দেয়।
-নিন, পরে ফেলুন। যখনকার যে-সাজ, তা না পরলে চলবে কেন।
কোতোয়াল ভাবে—মেয়েটা খানদানি বেবুশ্যা। কায়দাকেতায় একেবারে দুরন্ত। নিজের পোশাকটা খুলে ফেলে সে ঐ লাল ডুরোকাটা ফতুয়া আর ল্যাঙোট পরে পালোয়ান সেজে ফরাসে এসে বসে।
সবে আর এক পেয়ালা ভরে নিয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়েছে, এমন সময় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ আসে।
মেয়েটার চোখে মুখে কপট আতঙ্ক ফুটে ওঠে, সর্বনাশ। এ সময়ে তো তার ফেরার কথা নয়
কোতোয়াল দাঁড়িয়ে পড়ে তিড়িং তিড়িং ঘরে লাফাতে থাকে, কে? কে? কে এসেছে?
মেয়েটি ভয়ার্ত কণ্ঠে কঁকিয়ে ওঠে, আমার স্বামী—
-তা হলে কী হবে? এখন উপায়?
মেয়েটি ঝটপট আলমারীটার নিচের তাক খুলে বলে, আর দেরি করবেন না, আসুন, এই তাকটায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ুন। আমি বন্ধ করে দেব।
কোতোয়াল আর একটি কথা বলে না, তাকটার মধ্যে কুঁকড়ে শুয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সে কুলুপ এঁটে দেয়।
এদিকে কাজী সাহেব ঘন ঘন কড়া নেড়েই চলছিলো। মেয়েটা দরজা খুলে মাথা নুইয়ে সালাম জানায়, আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক।
খানাপিনার এলাহী ব্যবস্থা দেখে কাজী খুব পুলকিত হয়। মেয়েটি সুরার পেয়ালা পূর্ণ করে কাজীর সামনে রাখে। অল্পক্ষণের মধ্যে ফুরফুরে গুলাবী নেশায় চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে কাজীর। ঈষৎ জড়ানো কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, কোন কুত্তার বাচ্চা কোতোয়াল তোমার ভাইকে আটক করে রেখেছে,আমি তাকে দেখে নেব। নাও, এখন কাগজ কলম নিয়ে এসো তো দেখি, আমি বেকসুর খালাসের ফরমান লিখে দিচ্ছি। এটা দেখালেই ওকে তক্ষুনি ছেড়ে দেবে।
মেয়েটি দোয়াত কলম আর কাগজ এনে দেয়। কাজী ফাটকের হাবিলদারকে হুকুমনামা লিখে দেয়। তারপর হাত বাড়ায় মেয়েটির দিকে, এবার তাহলে আমার বুকে এসো, মেরিজান।
মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে স্বগতভাবে বলে, দাঁড়াও বুড়ো তোমার জান আজ আমি বের করে দিচ্ছি। মুখে মধু ঢেলে তেরছা নজর হেনে বলে, আহা, বয়স হলে মানুষের আর ধৈর্য-টৈ থাকে না। আমি কি এই সাঁঝ রাতেই ফুরিয়ে যাচ্ছি নাকি। দাঁড়ান, আগে আপনাকে সাজ পোশাক পরাই—তার পরে তো সুরত রঙ্গ জমবে।
কাজী অবাক হয়, সাজ-পোশাক? কেন, আমি তো বেড়ে সাজ-পোশাক পরে আছি
কথাগুলো এবার বেশ জড়ানো। মেয়েটি বলে, ওসব আমিরি পোশাক এখানে চলে না জনাব। যেখানকার যা, তাই করতে হয়। এই নিন আপনার ফতুয়া আর ল্যাঙোট, পরে পালোয়ান সাজুন। না হলে লড়বেন কী করে?
সবুজ রঙের ডুরেকাটা ফতুয়া আর ল্যাঙোট। নেশায় বুদ হয়ে টুলটুল চোখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে দেখতে থাকে।
-বাঃ, বহুৎ চমৎকার দেখতে তো? তা এ পোশাক না পরলে বুঝি এখানে কাজ কাম করা যায় না?
মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুড়োকে বক দেখায়, না কাজী সাহেব, আমাদের কাছে এলে এই পোশাকই পরতে হয়। এতোটা বয়স হলো, কেন কখনও মহল্লায় কারো ঘরে কী রাত কাটাননি কখনও? জানেন না সব কেতা-কানুন?
ওই মদের নেশাতেও বুড়ো কাজী দু-কানে আঙ্গুল গুঁজে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে—তোবা তোবা! ওসব কথা শোনাও পাপ।
এর পর সে নিজের সাজ-পোশাক খুলে ফেলে ঐ ফতুয়া আর ল্যাঙোটটা পরে নেয়।
এই সময় অপেক্ষাকৃত মৃদুভাবে কড়া নাড়ার আওয়াজ ওঠে। মুহূর্তে কাজী সাহেব সজাগ স্বাভাবিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রেখে তাকায়, কে কে এসেছে? কড়া নাড়ছে, না?
মেয়েটিও ভীত চকিত ভাব দেখায়, সর্বনাশ হয়েছে। এতে আমার স্বামীর কড়া নাড়ার শব্দ। কিন্তু এসময়ে তো তার আসার কথা নয়?
কাজী লাফিয়ে ওঠে, ওরে বাব্বা, এখন কী উপায় হবে।
মেয়েটি ওকে শান্ত করে, ধৈর্য ধরুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো আঠারতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
আলমারীর দ্বিতীয় তাকটা খুলে বলে চটপট এটার ভিতরে ঢুকে হাত পা গুটিয়ে কোনরকমে শুয়ে পড়ুন।
কাজীকে তালা বন্ধ করে সে তৃতীয় অতিথি উজিরকে স্বাগত জানাতে দরজার কাছে যায়।
–আসুন হুজুর, আমার কী পরম সৌভাগ্যের দিন আজ। আসুন, আসন গ্রহণ করে ধন্য করুন আমাকে।
—বাঃ, এতো দেখছি বহুৎ খানদানী ব্যাপার। তা কতদিন ধরে এ কারবার?
-হুজুরের কী আমাকে দেখে খুব বয়স্কা বলে মনে হচ্ছে?
উজির নিজের ভুল বুঝতে পারে, আরে না না, আমি সে-সব ইঙ্গিত করিনি, কিছু মনে করো না। তুমি তো একেবারে ডাগর ডাসা। গুলাবের কুঁড়ি। তোমাকে বয়স্কা বলবে কে?
সওদাগর-বিবি পেয়ালা ভরে উজিরের মুখে তুলে ধরে, নিন, এক চুমুক দিন, হুজুর।
উজির ওর পেয়ালা শুদ্ধ নরম হাতখানা মুঠি করে চেপে ধরে, তা চুমুকটা কোথায় দেব-পেয়ালায়, না পানিতে।
বুড়ো উজির রসিক আছে বটে। মেয়েটি বলে, আমাকে পান করে কী সুরাপানের নেশা মিটবে হুজুরের।
উজির শরাবের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলে, সুরায় কতটুকু নেশা, কতক্ষণই বা থাকে। কিন্তু তোমার নেশায় মাতাল হতে পারলে জীবনটা সুধায় সুধায় ভরে যেত, মেরি দিল!
মেয়েটি নীল রঙের ডুরে কাটা ফতুয়া আর ল্যাঙোট এনে বলে, নিন, হুজুর আপনার সাজ-পোশাক ছেড়ে এটা পরে নিন। আমাদের ঘরে এলে এই পোশাকই পরতে হয়—রেওয়াজ।
ফতুয়া আর ল্যাঙোটটা পরে সবে উজির সাহেব সওদাগর বিবিকে জড়িয়ে ধরতে যাবে এমন সময় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে দু-পা
পিছিয়ে যায়, কে? মেয়েটি বলে, বুঝতে পারছি না—এ সময় তো আমার স্বামীর ফেরার কথা নয়।
–তোমার স্বামী? সর্বনাশ, তবে উপায়?
–দাঁড়ান, আমি ব্যবস্থা করছি।
আলমারিটার তৃতীয় তাকটা সে খোলে, মেহেরবানী করে এর মধ্যে আপনি ঢুকে পড়ুন। বেশিক্ষণ থাকতে হবে না। এখুনি ওকে আমি বাজারে পাঠিয়ে দেব একটা সওদা কিনে আনার ছুতোয়।
উজির মুখ কাচুমাচু করে, এর মধ্যে আমার এই দশাসই শরীরটা ঢুকবে?
-খুব ঢুকবে। হাত পা গুটিয়ে একটু কষ্ট করে শুয়ে পড়ুন। আর দেরি করবেন না হুজুর, ওদিকে শুনছেন তো কেমন কড়া নাড়ছে সে।
উজিরকে তালা বন্ধ করে সে সুলতানকে বরণ করতে যায়। দরজা খুলেই আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানায়।
-আসতে আজ্ঞা হোক, জাঁহাপনা। আমি ভাগ্যবতী নারী। ধন্য হলাম।
সুলতান ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন। মেয়েটি বলে, গরীবখানায় যখন এলেনই,
একবার অনুগ্রহ করে আসন গ্রহণ করুন, জাঁহাপনা।
সুলতান বলেন, আহা-হা অত ব্যস্ত হবার কী আছে। বসছি। এসেছি যখন নিশ্চয়ই বসবো, খাবো, পান মৌজ করবো। আর শোনো, এটা প্রাসাদ দরবার নয়। এখানে শুধু তুমি আর আমি আছি। অত জাঁহাপনা টাহাপনা, কে কুর্নিশ করার দরকার নাই। তা হলে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে, বুঝলে?
-বুঝেছি, জাঁহাপ…প…।
হো হো হেসে ওঠেন সুলতান। হেসে ওঠে মেয়েটিও-খিল খিল করে। সেই হাসির ঝরনায় ঝরে ঝরে পড়তে থাকে আনন্দের মুক্তো।
মেয়েটি বলে, আপনি এতো সহজ সাধারণ, ভাবতে পারিনি, বড় ভালো লাগছে।
—আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে, সুন্দরী–
-খু-উ-ব।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো কুড়িতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
মদের পেয়ালা পূর্ণ করে দেয় মেয়েটি। সুলতান একচুমুকে শূন্য করে দেন। আবার সে ঢেলে দেয়, আবার শূন্য হয়। এইভাবে এক এক করে অনেক পেয়ালা উজাড় করে দেন সুলতান।
মেয়েটি তখন একটা হলুদ রঙের ডুরেকাটা ফতুয়া আর ল্যাঙোট এনে পরতে দেয় সুলতানকে। বলে, এই নিন, এটা পরুন, পরতে হয় এখানে।
সুলতান বলেন, বাঃ, বেড়ে বাহারী তো। ঠিক আছে এইটে পরেই তোমার সঙ্গে আজ মধুযামিনী যাপন করা যাবে, কেমন?
নেশার ঘোরে টলে টলে পড়তে যায় সুলতান। কিন্তু কোনও রকমে সামলে নিয়ে পোশাকটা পরতে পারেন।
এই সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা যায়! সুলতান চমকে ওঠেন। কে?
মেয়েটি না বোঝার ভান করে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না—আমার স্বামী তো এইমাত্র বাইরে গেলেন। এর মধ্যে এতো সকাল সকাল তো তার ফেরার কথা নয়। কিন্তু এ কড়া-নাড়ার আওয়াজ তো তারই।
সুলতানের নেশা জল হয়ে যায় নিমেষে।
-এখন তাহলে কী হবে?
-আপনি ভাববেন না, আমি একটা উপায় বের করছি।
আলমারীর চতুর্থ তাকটা সে খোলে।
এই তাকটায় উঠে কোনও রকমে গুটি শুটি মেরে শুয়ে পড়ুন, জাঁহাপনা। তাড়াতাড়ি করুন আর দেরি করবেন না।
সুলতানকে তালা বন্ধ করে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ছুতোর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ঘরে ঢোকে।
-বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন তো মালকিন।
মেয়েটি ঝাঝিয়ে ওঠে, কিন্তু তোমার কী আক্কেল, বলতো?
-কেন, কী হলো?
—এই কী তোমার তাক বানানো হয়েছে, একখানা থালা-বাসন ঢোকাতে পারছি না। আলমারীর কাছে গিয়ে ওপরের তাকের পাল্লাটা খুলে ফেলে সে। ছুতোরটা বলে, এতো বড় তাক, আমার মতো এই মোটকা শরীরটাও আস্ত ঢুকিয়ে দিতে পারি, আর সামান্য থালাবাসন ঢুকবে না বলছেন?
মেয়েটি মুচকি হাসে, কী বললে, তোমার এই নাদুস-নুদুস দেহটা ওর মধ্যে এঁটে যাবে? নাঃ, হাতুড়ি বাটালি পিটে পিটে তোমার মাথাটা একেবারে নিরেট হয়ে গেছে। এক ফোটা মগজে যদি থেকে থাকে, আচ্ছা ঢুকে দেখাও দেখি, কেমন করে আঁটাতে পারো তোমার এই নধর বপুটা।
নিরেট ছুতোর হাঁদার মতো উঠে বলে এই দ্যাখো।
অনায়াসেই সে ওপরের তাকে ঢুকে পড়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি কুলুপ এঁটে দেয়।
আর এক মুহূর্ত দেরি করে না সওদাগর-বিবি। কোতোয়ালের কয়েদখানায় চলে যায়। কাজীর চিঠিখানা দেখাতেই সঙ্গে সঙ্গে তার নাগরকে খালাস করে দেয় তারা।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
ছয়শো একুশতম রজনী। আবার গল্প শুরু হয় :
নাগরকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটি আবার ফিরে আসে তার নিজের ঘরে। কীভাবে ঐ পাঁচজন কামুককে আলমারীর ভিতরে পুরে ওদের মনোবাঞ্ছা পুরণ করেছে, তার মজাদার কাহিনী রসিয়ে রসিয়ে শোনাতে লাগলো তার নাগরকে।
—এই সব মাথা মোটা মানুষগুলো এমনই হাঁদা, কামের তাড়নায় একেবারে ভাদ্র মাসের কুত্তার মতো ক্ষেপে উঠেছিলো। এখন দেখ, বাছাধনরা কেমন লেজ গুটিয়ে সব শুয়ে আছে আলমারীটার মধ্যে।
ঘর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে ওরা।
তারপর মৌজ করে খানা, পিনা রতিরঙ্গ করে দু’জনে। সারারাত ধরে ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে নানারকম ব্যসন বিহারে মত্ত হয়ে ওঠে।
পরদিন সকালে মেয়েটি ঘরের সব ভারি ভারি আসবাবপত্রগুলো বিক্রি করে দেয়। এবং দামী দামী বসন আভরণগুলো একটা প্যাটরায় বোঝাই করে ঐ সুলতানের মুলুক ছেড়ে অন্য এক সুলতানের মুলুকে রওনা হয়ে যায়।
আলমারীটা কিন্তু ঐ শূন্য ঘরের মধ্যেই একলা দাঁড়িয়ে থাকে। আর তার ভিতরে পাঁচটি প্রাণী পচা গরমে সিদ্ধ হয়ে প্রায় আধমরা অবস্থায় পড়ে থাকে।
দুই দিন দুই রাত্রি কাটার পর সওদাগর ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু তার বিবি বা ঘরের সামানপত্র কিছুই দেখতে না পেয়ে অবাক হয়। ভাবে, নিশ্চয়ই ডাকাতরা জিনিসপত্রের সঙ্গে তার বিবিকে লুঠ করে নিয়ে গেছে।
এমন সময় সওদাগর আলমারীর ভেতর থেকে একটা গোঙানীর আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে! ওরে বাবা, এ আবার কী ভূতুড়ে কাণ্ড! হাঁক ডাক করে সে পাড়া-প্রতিবেশিদের সবাইকে জড় করে ফেলে।
-কী ব্যাপার? কী হয়েছে সওদাগর সাহেব?
সওদাগর ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে, কোনও রকমে বলতে পারে, জিনজিন ঢুকেছে আমার ঘরে।
-কোথায়?
সে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ঐ আলমারীটার ভেতর থেকে মানুষের গোঙানীর মতো আওয়াজ আসছে।
সকলে কান পেতে শুনলো, ঠিকই ভেতরে যেন অনেকগুলো লোক কাতরাচ্ছে।
পড়শীরা পরামর্শ দিলো, এক কাজ করো, আগুন লাগিয়ে দাও। পুড়ে সাফ হয়ে যাবে—তা সে জিন আফ্রিদি যাই থাক।
এইবার উজির চিৎকার করে ওঠে, শোনো ভাই সব, আমরা কেউ জিন দৈত্য নই, কোনও ভয় নাই। পাল্লাগুলো খুলে দাও। আমরা সকলেই মানুষ। দোহাই আমাদের পুড়িয়ে মেরো না।
এর পরের ঘটনা কী—সবিস্তারে বলার কোনও প্রয়োজন আছে জাঁহাপনা? কোতোয়াল, কাজী, উজির, সুলতান, ছুতোর সবাই লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারে না কারো দিকে।
সওদাগর যুবকটি সুলতান উজিরের এই দশা দেখে নিজেও বিশেষ লজ্জিত হয়। পড়শীদের সবাইকে বিদায় করে দিয়ে সকলকে নিজের নিজের পোশাক এনে দেয় সে।
এরপর সুলতান সওদাগর-যুবককে তার দরবারের সহকারী উজিরের পদে বহাল করেছিলেন।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।