০৯.
সনির মৃত্যুর পর একটা বছর কেটে গেছে। কিন্তু লুসি ম্যানচিনির মনে এখনও তার জন্যে হাহাকার জাগে। তার তীব্র শোকের সাথে কোন প্রাচীন কাহিনীর নায়িকার শোকের তুলনা হয় না। ওর স্বপ্নগুলি কোন স্কুল ছাত্রীর পানসে স্বপনের মত নয়। ওর বাসনা সতী-সাধ্বী স্ত্রীর বাসনার মতও নয়। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে লুসি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েনি, তার বলিষ্ঠ চরিত্রের অভাব তাকে পীড়া দিচ্ছে না। কোন আবেগময় উপহারের কোমল স্মৃতি ওর মনে কাটার মত বেঁধে না। তরুণ চিত্তের কোন বীরপূজার স্মৃতিও নয়। লুসির কোন স্নেহের কথা, রসের কথা শুনে সে মানুষটির মুখে হাসি, চোখে সরলতার আভাস ফুটে ওঠার স্মৃতিও নয়।
এসব কিছুই নয়, সনির অভাব বোধ করার প্রধান কারণ হলো, একমাত্র সে-ই যৌন-মিলনে লুসিকে পরিতৃপ্তি দিতে পারত। এই তরুণ বয়সে, অনভিজ্ঞ মনে লুসির আজ ধারণা, আর কেউ তাকে কখনও সেই পরিতৃপ্তি দিতে পারবে না।
এক বছর পর এখন লুসি নেভাডার মিষ্টি বাতাসে রোদ পোয়াচ্ছে। পায়ের কাছে শুয়ে রয়েছে ছিপছিপে শরীর, সোনালী চুল এক যুবক। ওর পায়ের আঙুল নিয়ে খেলা করছে। রোববার দুপুর। হোটেলের পাশে সুইমিং পুলের ধারে শুয়ে রয়েছে ওরা। চারদিকে এত লোকজন থাকাসত্ত্বেও যুবক ওর অনাবৃত উরুতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
জুলস, এবার থামো, বলল লুসি। আমার তো ধারণা ছিল অন্তত ডাক্তাররা আর সব পুরুষের মত বোকা হয় না।
একগাল হাসল জুলস। বলল, আমি যে লাস ভেগাসের ডাক্তার। লুসির উরুর ভিতর দিকে একটু সুড়সুড়ি দিতেই, অবাক হয়ে জুল দেখল এই সামান্য স্পর্শেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠছে মেয়েটা। গোপন করার চেষ্টা করলেও, ওর মুখ দেখেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সেটা। সত্যি মেয়েটা বড় আদিম, আর নির্দোষ। কিন্তু তবু ওকে আয়ত্ত করতে পারছে না জুলস। কেন? ভেবে দেখার মত ব্যাপার। হারানো প্রিয়তমের জায়গায় কাউকে বসানো যায় না, এসব বাজে কথা। এই তো হাতের নিচে জ্যান্ত জিনিস জ্যান্ত জিনিস.আরেকটা জ্যান্ত জিনিসকেই চায়। ভা. জুলস সীগল ঠিক করল, নিজের ফ্ল্যাটে আজ রাতে একটা মরিয়া আর মোক্ষম চেষ্টা করে দেখবে সে। জুলসের একান্ত ইচ্ছা, চালাকির সাহায্য না নিয়েই ওকে আয়ত্ত করা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি চালাকিই করতে হয়, তাতেও সে পিছপা হবে না। সাবজেক্টটা তো নির্ভেজাল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের জন্যে কি না করা যায় তা ছাড়া, এ-বেচারি তো সেটার জন্যই মরে যাচ্ছে।
জুলস, থামো, মিনতির সুরে বলল লুসি। লক্ষ্মীটি, থামো!
অনুতপ্ত হয়ে জুলস বলল, আচ্ছা। বেশ। এই থামলাম। খুশি, মানিক?
লুসির কোলে মাথা রেখে, ওর নরম উরু দুটোকে বালিশ বানিয়ে ছোট একটা ঘুম দিয়ে নিল জুলস। লুসির ছটফট করে ওঠা, লুসির কটিদেশের উত্তাপ, সব লক্ষ করে হাসি পাচ্ছে ওর। তারপর যেই লুসি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল, খেলাচ্ছলে ওর হাতের কব্জি ধরে রাখল জুল, যেন আদর করছে, আসলে কিন্তু ওর পালস পরীক্ষা করছে। ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে ওর পালস। আজ ওকে আয়ত্তে আনতেই হবে, ভেদ করতেই হবে রহস্যটা, তা যে ভাবেই হোক না কেন। এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ডা. জুলস সীগল।
সুইমিং পুলের চারদিকে তাকাচ্ছে লুসি। লোকজন দেখছে। দু বছরও তো কাটেনি, এরই মধ্যে ওর জীবনে এতটা পরিবর্তন আসবে ঘুণাক্ষরেও তা সে ভাবতে পারেনি। কনি কর্লিয়নির বিয়ের দিন ওর সেই মৃঢ়তার জন্য সে কখনও অনুশোচনা বোধ করেনি। সেদিন যা ঘটেছিল তার কোন তুলনা নেই ওর জীবনে, আর কখনও ঘটেনি। সনির সাথে সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে আজও সে পুলকিত হয়।
হপ্তায় কমপক্ষে একদিন ওর কাছে আসতই সনি। কোন কোন হপ্তায় একাধিক বার। সনিকে আবার দেখতে পাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সারা শরীরে ওরসে কি যন্ত্রণা! পরস্পরের শরীর পাবার ওদের এই কামনাটা নিতান্তই আদিম ছিল, তার মধ্যে কাব্য বা মননশীলতার ছিটেফোঁটাও ছিল না। যাকে বলা যেতে পারে। সবচেয়ে মুল ধরনের প্রেম, স্রেফ শারীরিক প্রেম, মাংসের জন্যে বিপরীত মাংসের কামনা।
যেই ফোন করে সনি বলত যে সে আসছে, অমনি লুলি দেখে রাখ বাড়িতে যথেষ্ট মদ, রাত আর সকালের জন্য যথেষ্ট খাবার ইত্যাদি আছে কিনা। কাল্প সনি সাধারণত বেশ বেলা করে বিদায় নিত। প্রাণভরে ওকে পেতে চাইত সনি,ও-ও তাকে প্রাণ-মন দিয়ে পেতে চাই নিজের চাবি ছিল সনির, সে দরজা দিয়ে ঢোকামাত্র লুসি ছুটে গিয়ে তার বিশাল আলিঙ্গনের ভিতর সেধিয়ে যেত। পশুর মত সোজাসুজি করত ওরা কাজটা জানোয়ারের আদিমতা প্রকাশ পেত ওদের আচরণে! হল ঘরে দাঁড়িয়েই প্রেম করত ওরা, যেন সেই প্রথম দিনের প্রেম করার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, তারপর লুসিকে বুকে তুলে নিয়ে শোবার ঘরে আসত সনি।
বিছানায় শুয়েও প্রেম চলত ওদের। দুজনেই বিবস্ত্র অবস্থায় ষোলো ঘণ্টা কাটাত বাড়ির ভিতর মহা ঘটা করে রান্না-বান্না করত লুলি। মাঝে মাঝে সনির টেলিফোন আসত, সব কাজের কথা হত, লুসি সে-সব কখনও কান পেতে শুনতে যায়নি। সনির শরীরটাকেই আদর করতে ব্যস্ত থাকত ও, হাত বুলিয়ে দিত, চুমু খেত, মুখ গুঁজে রাখত দু উরুর মাঝখানে। মাঝে মাঝে সনি মদ ঢালার জন্য উঠত। ওর পাশ ঘেঁষে যাবার সময় হাত বাড়িয়ে ওর নগ্ন দেহ স্পর্শ করত লুসি। ধরে রাখত, আদর করত, যেন সনির শরীরের অঙ্গগুলো ওর খেলার সামগ্রী। বিশেষভাবে শুধু যেন ওর জন্যে তৈরি; বিচিত্র, নির্দোষ খেলনা, বড় পরিচিত, তবু তার মধ্যে কত অপ্রত্যাশিত আনন্দের ভাণ্ডার। প্রথম প্রথম নিজের এই উচ্ছ্বাসের জন্য লজ্জা পোব করত লুসি, পরে দেখল এতে সনি খুশি হয়। সব কিছুর মধ্যে একটা পশুসুলভ নির্মল ভাব ছিল। দুজনে দুজনকে পেয়ে ওরা বড় সুখী হয়েছিল
সনির বাবা যখন আততায়ীর গুলি খেয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়লেন, সেই প্রথম লুসির মনে হয়েছিল বিপদ তো তাহলে সনিরও ঘটতে পারে সেদিন বাড়িতে একা বসে শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদেনি লুসি, জানোয়ারের মত গলা ছেড়ে বিলাপ করেছিল। সনি যখন তিন হপ্তার মধ্যে একবারও এল না, তখন লুলির একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠেছিল ঘুমের বড়ি, মদ, আর হৃদয়ের যাতনা। সে যন্ত্রণা ছিল সত্যিকার শারীরিক যন্ত্রণা। ওর গা ব্যথা করত। অবশেষে আবার একদিন যখন সনি এল, সারাটা সময় তাকে আঁকড়ে ধরে রাখল লুসি। এর পর প্রতি হপ্তায় অন্তত একবার আসত সনি, মারা যাবার আগের দিন পর্যন্ত।
খবরের কাগজে ওর মৃত্যুর খবর পড়েছিল লুসি। সেই রাতে আত্মহত্যা করার জন্যে একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল সে। কে জানে কেন, তবু মারা যায়নি লুসি। শুধু মনে আছে, সাজাতিক অসুস্থ অবস্থায় টলতে টলতে ফ্ল্যাটের হলঘর থেকে বেরিয়ে এসে লিফটের সামনে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কারা যেন ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সনির সাথে ওর অবৈধ সম্পর্কের কথা বিশেষ কেউ জানত না, তাই খবরের কাগজে ওর সম্পর্কে কয়েক ইঞ্চির বেশি কিছু লেখা হয়নি।
ও যখন হাসপাতালে, টম হেগেন ওকে দেখতে এসে সমবেদনা জানিয়ে গেল। লাস ভেগাসে সনির ভাই ফ্রেডি যে হোটেলটি চালায়, সেখানে টম হেগেনই ওর জন্য একটা চাকরি ঠিক করে দিল। টম হেগেন বলল, কর্লিয়নি পরিবারের কাছ থেকে একটা বার্ষিক ভাতা পাবে সে। সনি ওর জন্য এই ব্যবস্থা করে রেখে গেছে। টম জানতে চাইল; ও অন্তঃসত্ত্বা কিনা যেন, সে জন্যেই ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল লুসি। লুসি বলল, না। সেই মর্মান্তিক রাতে সনি ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল কিনা, কিংবা ফোন করে আসবার কথা বলেছিল কিনা জিজ্ঞেস করতে, নুসি জানাল, না, আসেওনি, ফোনও করেনি। কাজ শেষ হয়ে গেলে লুসি সব সময় সনির জন্যে বাড়িতে বসে অপেক্ষা করত। সত্যি কথাই বলল লুসি। একমাত্র ওকেই আমি ভালবাসতে পেরেছিলাম, আর কাউকে কখনও ওভাবে ভালবাসতে পারব না। লক্ষ করল, কথাটা শুনে হাসল হেগেন। মনে হলো, আশ্চর্য হয়েছে সে। লুসি জানতে চাইল, অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে কথাটা? তুমি যখন ছোট ছিলে, ও ই না তোমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসে আশ্রয় দিয়েছিল?
হেগেন বলল, তখন অন্য রকম মানুষ ছিল সে। বড় হয়ে সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল সনি।
আমার কাছে নয়, বলল লুসি অন্যদের কাছে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে নয়। এখনও বড় দুর্বল লুসি, ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারেনি যে সনি তার সাথে আশ্চর্য কোমল ব্যবহার ছাড়া কখনও রূঢ় ব্যবহার করেনি। রাগ করেনি কখনও, বিরক্ত হয়নি কখনও, তাকে অবিশ্বাস করেনি কখনও।
লাস ভেগাস যাবার সব ব্যবস্থা করে দিল হেগেন। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করা হলো, নিজে ওকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল হেগেন ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল, সেখানে গিয়ে নিঃসঙ্গ মনে হলে কিংবা কোন অসুবিধার কারণ ঘটলে হেগেনকে যেন অবশ্যই জানায়। যেমন করে পারে সাহায্য করবে হেগেন।
প্লেনে চড়ার আগে একটু ইতস্তত করে লুসি জানতে চাইল, তুমি যে আমার জন্যে এত সব করছ সনির বাবা তা জানেন?
আমি তার পক্ষ এবং নিজের পক্ষ থেকে এসব করছি, মৃদু হেসে বলল হেগেন। তিনি সেকেলে মানুষ, সনির বৈধ স্ত্রীর বিরুদ্ধে কখনও কিছু করবেন না। কিন্তু ওঁর ধারণা, তুমি একজন অবিবাহিত তরুণী, তাই সনির আর একটু বিবেচক হওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া তুমি যখন অতগুলো ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেললে, তোমার জন্যে আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ইচ্ছা করেই টম হেগেন লুসিকে বলল না যে কেউ কারও জন্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, এই ঘটনাটাই একেবারে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ডন কর্লিয়নির কাছে।
লাস ভেগাসে আঠারো মাস বাস করার পর লুসি এই ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে যে এখন তাকে প্রায় সুখীই বলা চলে। কোন কোন রাতে সনিকে স্বপ্নে দেখে সে এখনও। তারপর ঘোর অন্ধকার থাকতে জেগে উঠে নিজেকে নিজে আদর করে স্বপ্নটাকে আরও প্রলম্বিত করে, যতক্ষণ না আবার ঘুম আসে চোখে। সনি মারা যাবার পর থেকে কোন পুরুষ মানুষের দিকে ফিরেও তাকায়নি লুসি; কিন্তু লাস ভেগাসে মনের মত জীবন পেয়েছে সে। হোটেলের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটে, লেক মীডে.নৌকা চড়ে বেড়ায় আর ছুটির দিনে মরুভূমির মাঝখানে গাড়ি নিয়ে ঘোরে। আগের চেয়ে কিছুটা রোগা হয়ে গেছে লুসি, তাতে শরীরের গড়নটা আরও সুন্দর হয়েছে দেখতে। এখনও লুসি পুরোদস্তুর ভোগবিলাসী, কিন্তু প্রাচীন ইতালীয় কায়দায় নয়, নব্য মার্কিনী কায়দায়। হোটেলের জনসংযোগ বিভাগে.অভ্যর্থনা কর্মীর কাজ করে সে। ফ্রেডির সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, তবে দেখা হলেই ফ্রেডি থেমে ওর সাথে একটু গল্প করে যায়। ফ্রেডির এত পরিবর্তন দেখে লুসি মনে মনে আশ্চর্য না হয়ে পারে না। মহিলাদের সাথে আজকাল তার সাঙ্ঘাতিক সদভাব। ভাল কাপড়চোপড় পরে ফিটফাট বাবু হয়ে থাকে। শেখিন ক্যাসিনো চালাবার দক্ষতা সত্যিই রয়েছে তার। আবাসিক দিকটা পরিচালনা করে ফ্রেডি, ক্যাসিনোর মালিকরা কেউ একাজ সাধারণত করে না। প্রচণ্ড গরম আর হয়তো অতিরিক্ত যৌন সদ্যোগের ফলে সে-ও রোগা হয়ে গেছে। তার উপর হলিউডে তৈরি পোশাক-আশাকের জন্য ওকে মারাত্মক স্মাট আর সুন্দর লাগে দেখতে।
ছমাস পর টম হেগেন লাস ভেগাসে এল লুসির অবস্থা নিজের চোখে দেখার জন্যে! প্রত্যেক মাসে লুসি ছশো ডলারের একটা চেক পায়, বেতন ছাড়াই পায় এটা। হেগেন ব্যাখ্যা করে বলল যে ওই চেকের টাকা কোথা থেকে আসছে সেটা খাতা-পত্রে দেখানো দরকার, তাই লুসি যেন ওকে সম্পূর্ণ আমমোক্তারনামা সই করে দেয়, তাহলে হেগেনের পক্ষে টাকাটা এনে দিতে সুবিধে হবে। হেগেন তাকে আরও জানান, বিধি-মতে হোটেলের মালিকানার ফর্দে পাঁচ পার্সেন্টের অধিকারিণী হিসেবে লুসির নাম তোলা হবে। নেভাডার আইন মত ওর এই আয়ের ব্যাপারে যা কিছু করণীয় তার সবই করতে হবে। অবশ্য ওর নিজের দায়িত্ব খুব কমই থাকবে, সমস্ত কর্তব্যই ওর হয়ে করে দেয়া হবে। কিন্তু হেগেনের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে যেন কখনও কারও সাথে আলোচনা না করে লুসি সব দিক দিয়ে আইনের কবল থেকে ওকে রক্ষা করার ব্যবস্থা হবে। প্রতি মাসে নিয়মিত টাকা পেতে থাকবে সে কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন্ত আইন সংস্থার তরফ থেকে ওকে কখনও কোন প্রশ্ন যদি করা। হয়, লুসি যেন সরাসরি তার উকিলকে জানিয়ে দেয়। তাহলে ওকে আর কেউ বিরক্ত করবে না।
রাজী হলো লুসি এর ভিতরের ব্যাপারটা সবই বুঝেছে ও, এবং কর্লিয়নিদের সুবিধে করে দেবার জন্যে ওকে যেভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে তাতে ওর কোন আপত্তিও নেই। ওর মনে হচ্ছে ওদের জন্যে এটুকু ওর করাই উচিত। কিন্তু হেগেন যখন বলল, হোটেলের চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে তো খেয়াল রাখতে হবেই, তাছাড়া ফ্রেডি আর ফ্রেডির উপরওয়ালার দিকেও নজর রাখতে হবে, তখন লুসি বলল, তার মানে? ফ্রেডির ওপরেও চোখ রাখতে হবে নাকি? ফ্রেডির উপরওয়ালাটি হোটেলের অনেকগুলো শেয়ারের মালিক। হোটেলটা সেই চালায়।
লুসির কথা শুনে হাল হেগেন। ফ্রেডির বাবা ওর জন্য দুশ্চিন্তা করেন। ওর সঙ্গীটি, মো গ্রিন গভীর পানির মাছ। আমরা শুধু এইটুকুই চাই ফ্রেডি যেন কোন। বিপদে না পড়ে। লাস ভেগাসের এই মরুভূমির মাঝখানে হোটেলটা তৈরি করার জন্যে ডন কর্লিয়নি অজস্ব টাকা ঢেলেছেন, তার কারণ শুধু ছেলের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় সৃষ্টি করা নয়, আরও অনেক বড় উদ্দেশ্যের চৌকাঠ পেরোবার ইচ্ছাটাও রয়েছে তাঁর-কিন্তু এত কথা লুসিকে বুঝিয়ে বলার দরকার আছে বলে মনে করল না হেগেন।
এই সাক্ষাৎকারের কদিন পরই হোটেলের আবাসিক চিকিৎসকের পদে বহাল হয়ে এল ড. জুলস সীগল। রোগা, খুব সুদর্শন, মার্জিত চালচলন, ডাক্তার হবার পক্ষে বয়সটা যেন খুবই কম, অন্তত লুসির সেই রকম মনে হলো! ওর সাথে প্রথম দেখা হলো একটা ঠেকায় পড়ে। লুসির হাতের কব্ধির উপরে কি যেন একটা গোল হয়ে ফুলে উঠেছে। কয়েকটা দিন তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে কাটাবার পর, একদিন সকালে হোটেলের ভিতর ডাক্তারের অফিসে এসে হাজির হলো লুসি। কোরাসের দুজন নাচিয়ে গাইয়ে মেয়েও অপেক্ষা করছে ওয়েটিং রূমে। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে তারা। সোনালি চুল, পীপ ফলের মত রূপ তাদের। এরকম চেহারা দেখলে ঈর্ষা হয় লুসির। দেখতে যেন দেবীদের মত সুন্দরী। লুসি নল একজন আরেকজনকে বলছে, সত্যি বলছি, আরেক ডোজ যদি দেয় আমাকে, আমি নাচা ছেড়ে দেব।
দরজা খুলে একজন মেয়েকে ড. জুলস যখন ডেকে নিলেন, লুসির ইচ্ছা হলো চলে যায়। ড, সীগলের পরনে স্ন্যাকস আর বুক খোলা শার্ট রয়েছে। চোখে শিং এর তৈরি ফ্রেমের চশমা। তাতে শান্ত গভীর একটা ভাব ফুটে উঠেছে চেহারায়। তবু দেখে মনে হচ্ছে; মানুষটার হাবভাবে কেমন যেন একটা ঘরোয়া ভঙ্গি, লুসি মনে-প্রাণে সেকেলে, তাই ওরও বিশ্বাস, চিকিৎসকদের ভাব-ভঙ্গিতে ঘরোয়া ভাব থাকতে নেই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন ডাক্তারের খাস কামরায় পৌঁছল, লোকটার ব্যবহারের মধ্যে এমন একটা আশ্বাস টের পেল যে ভয়ভীতিগুলো সাথে সাথে দূর হয়ে গেল মন থেকে। এখনও প্রায় কিছুই বলেনি ডাক্তার, অবশ্য আচরণের মধ্যে রূঢ় ভাবও নেই। বেশ সময় নিয়ে ওকে দেখছে। লুসি জানতে চাইল, ফোলাটা কি ব্যাপার? ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে বলল ডাক্তার, ওটা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। কোষ ফুলে গেছে। এতে ক্যান্সারের কোন ভয়ই নেই, সুতরাং দুশ্চিন্তা করবেন না। তারপর মোটা একটা ডাক্তারী বই হাতে তুলে বলল, হাতটা একটু বাড়ান তো দেখি।
ভয়ে ভয়ে হাতটা বাড়াল লুসি। ওর দিকে তাকিয়ে এই প্রথম একটু হাসল ডাক্তার। একটা অপারেশনের ফী থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছি। এই বই দিয়ে একটা বাড়ি দিলেই ওটা চ্যাপ্টা হয়ে চামড়ার সাথে সমান হয়ে যাবে। পরে আবার গজাতে পারে, তা ঠিক। কিন্তু কাটাকুটি করতে গেলে, আপনার টাকাও খরচ হবে, আবার ব্যাণ্ডেজ বেঁধেও ঘুরে বেড়াতে হবে। কি করবেন, বলুন?
এখন ওর দিকে ফিরে লুসিও হাসছে। যে কারণেই হোক, প্রবল বিশ্বাস জন্মে গেছে তার ডাক্তারের উপর। বলল, বেশ।
পর মুহূর্তেই চিৎকার করে উঠল লুসি। কারণ ডাক্তার সেই ভারী বইটা দিয়ে দুম করে ওর হাতে এক ঘা বসিয়ে দিয়েছে। ফলে সাথে সাথে ফোলা জায়গাটা প্রায় সমান হয়ে গেছে।
খুব লাগল নাকি? নিরীহ ভঙ্গিতে জানতে চাইল ডাক্তার।
না, মুখ ভার করে বলল লুসি।
ডাক্তার ওর কেসের হিস্ট্রি লিখছে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে লুসি। ব্যস হয়ে গেল?
ডাক্তার মাথা দুলিয়ে জানাল, হা হয়ে গেল। ওর দিকে আর নজর দিল না সে। বিদায় নিয়ে চলে এল লুসি।
এক হপ্তা পর কফির দোকানে আবার দেখা। ডাক্তার এসে লুসির পাশে বসে জানতে চাইল, হাত কেমন আছে?
ভাল, একটু হেসে বলল লুসি। আপনার পদ্ধতিটা বিচিত্র বটে, কিন্তু কাজ দেয়।
একগাল হাল ডাক্তার। আপনি ভাবতেও পারবেন না আমি কতটুকু নিজের নিয়মে চলি। আর আমিও জানতাম না আপনি এত ধনী মানুষ। ভেগাসের সান পত্রিকাতে হোটেলের মালিকানার ফর্দ বেরিয়েছে, তাতে দেখছি দশ পয়েন্ট রয়েছে। আপনার। ওই ফোলাটাকে পুঁজি করে বেশ দুপয়সা করে নিতে পারতাম।
হঠাৎ হেগেনের সতর্কবাণীটা মনে পড়ে গেল লসির। কোন উত্তর দিল না ও। আবার দাঁত বের করে হাসল ডাক্তার। কোন চিন্তা নেই, অভয় দিয়ে বলল সে, আমি ব্যাপারটা বুঝি, আপনি যে একটা পুতুল। এই ধরনের পুতুলের কোন অভাব নেই, লাস ভেগাসে। যাবেন নাকি আমার সাথে আজ রাতে একটা শো দেখতে? ডিনার খাওয়াব আপনাকে। তারপর ক্যাসিনোতে রুলেত খেলার চিপসও কিনে দেব।
ইতস্তত করছে লুসি। কিন্তু ডাক্তার জেদাজেদি করতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত লুসি বলল, যেতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু রাতটা যে ভাবে শেষ হবে তা দেখে শেষে না আপনি হতাশ হন। আমি এখানকার আর সব মেয়ের মত যা তা করে বেড়াই না।
সেই জন্যেই তো সাথে চাইছি তোমাকে, আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে বলল ডাক্তার। সম্বোধনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আপনজনের সুর ফুটে উঠল। আমি নিজের জন্যেও একরাত বিশ্রামের প্রেসক্রিপশন লিখে রেখেছি কিনা।
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল লুসি। একটু অসহায় ভঙ্গি করে বলল, আমি কি অতটা চোখেপড়ার মত?
মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার।
লুসি বলল, বেশ। তাহলে সাপার খেতে যাব। কিন্তু রুলেতের চিপস আমি নিজেই কিনব।
সাপার খেতে আর শো দেখতে গেল ওরা। জুলস ওকে খুব এক চোট হাসাল ডাক্তারী পরিভাষায় মহিলাদের নগ্ন উরু আর বুকের বর্ণনা দিয়ে। তাই বলে তাচ্ছিল্যের সাথে কিছু বলেনি, রসিকতার সাথেই বলল। পরে ওরা রুলেত খেলে একশো ডলারের কিছু বেশি জিতল। আরও পরে চাঁদের আলোয় গাড়ি নিয়ে বোর বাধে বেড়াতে এল। এখানে ডাক্তার একটু প্রেম করার চেষ্টা চালাল বটে, কিন্তু দুটো একটা চুমো খাওয়ার পর লুঙ্গি আপত্তি জানাতেই ক্ষান্ত হলো সে, বলল, আসলে এসব সে-ও চায় না। পরাজয়টা হাসি মুখেই মেনে নিল। মুখের ভাব অপরাধীর মত করে লুসি বলল, বলেই তো ছিলাম, ওসব আমার সাথে চলবে না।
আহা, বলল জুলস, আমি একটু চেষ্টা না চালালে তুমিই তো অপমান বোধ করতে।
হেসে ফেলল লুসি।.ভাবছে, মিথ্যে বলেনি জুলস।
পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে অন্তরঙ্গ বন্ধ হয়ে উঠল ওরা তাকে ঠিক প্রেম। বলে না, কারণ ওরা কখনও শরীর ঘাটাঘাটি করে না আসলে জুলসকে কোন সুযোগই দেয় না লুসি। লক্ষ করে ডাক্তার একটু অবাক হয়, কিন্তু আর সব পুরুষের মত ক্ষুণ্ণ হয় না। তাতে ওর উপর লুসির আস্থা আরও বেড়ে গেল। আবিষ্কার করল বাইরে গুরুগম্ভীর পেশাধারী ডাক্তারী চেহারার আড়ালে ভারি কুর্তিবাজ বেপরোয়া একটা মানুষ বাস করে। শনি আর রবিবার একটা রিকন্ডিশন করা এম-জি গাড়ি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মোটর রেসে যোগ দেয় সে। ছুটি নিয়ে মেক্সিকোর ভিতর দিকে চলে যায়। লুসিকে বলে, সে বড় বুনো জংলী জায়গা, একজোড়া জুতোর লোভে ওখানকার লোকেরা বিদেশীদের খুন পর্যন্ত করতে ছাড়ে না। হাজার বছর আগের আদিম জীবন যাত্রা এখনও চলছে ওখানে। দৈবাং লুসি জানতে পারল, জুলস একজন সার্জেন, এক সময় নিউ ইয়র্কের কোন একটা বিখ্যাত হাসপাতালের সাথে জড়িত ছিল সে।
এসব শুনে আরও আশ্চর্য হয় লুসি। ভাবে, তাহলে জুলস এই হোটেলে চাকরি নিয়েছে কেন? একদিন জিজ্ঞেস করায় কলল, তোমার গোপন কথা আমাকে বললে আমারটাও তোমাকে বলতে পারি।
লাল হয়ে উঠল লসির মুখটা। প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল ও। জুলস আর কিছু বলল না। ওদের সম্পর্কটা আগের মতই রয়ে গেল। অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তার উপর লুসি যে কতটা নির্ভর করে নিজেও সে বোঝে না।