1 of 2

৩.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্বকথা

ফটোগ্রাফ দুইখানি কুড়াইয়া লইয়া দেখিতে দেখিতে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এ যে দুইখানিই আপনার কন্যা দিলজানের তস্বীর দেখিতেছি।”
মুন্সী সাহেব শুষ্কমুখে শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিলেন, “কেবল আপনার নহে, এরূপ ভ্রম অনেকেরই হইয়াছে। উহা একজনের নহে, আমার দুই কন্যারই তস্বীর। এইখানি মৃজানের-আপনি যাহাকে দিলজান বলিতেছেন। আর এইখানি সৃজানের।” বলিয়া নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় ছবি দুইখানি বিশেষ মনোনিবেশপূর্ব্বক পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। দুইখানিতে অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রীমূর্ত্তি। উভয়ের মুখাকৃতির অতি সাদৃশ্য। তাহার উপর বেশভূষা একপ্রকার হওয়ায় আরও মিলিয়া গিয়াছে-চিনিবার যো নাই। এমন কি দুইজনের পৃথক্ ছবি উঠাইবার কোন আবশ্যকতা ছিল না; এবং কোন মিতব্যয়ী ইহাতে কখনই অনুমোদন করিতে পারিতেন না। যাহা হউক, সেই একমাত্র ছবি লইয়া লতিমন ও সাখিয়ার ভয়ানক গোলযোগ ঘটইবার কারণ দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে এতক্ষণে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। তিনি এখন আর তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই দেখিলেন না।
মুন্সী মোজাম হোসেন বলিতে লাগিলেন, ” আমি এখানে প্রায় আজ দশ বৎসর, এই গঙ্গার ধারে বাস করিতেছি। মেয়ে দুটি আমার কাছে থাকিত। অনেক দিন পূর্ব্বেই তাহাদিগের মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমিই তাহাদিগকে মাতৃপিতৃস্নেহে বুকে করিয়া লালন-পালন করিয়াছি।
হায়, তাহার পরিমাণ যে এমন হইবে, কে তাহা পূর্ব্বে ভাবিয়াছিল। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমীর নামে একটী যুবক আমার কাছে ফার্সী শিখিতে আসিয়াছিল। আমি উত্থান শক্তি রহিত-কোথাও যাইবার ক্ষমতা ছিল না। আমীর খাঁ আমার এইখানেই অধ্যয়ন করিতে আসিত। এইখানেই সে কোথায় একটা বাসা ভাড়া করিয়াছিল। প্রথম হইতেই আমার কন্যা মৃজানকে তাহার একান্ত অনুরাগিণী দেখিয়াছিলাম। বুঝিলাম, মনের ভিতরে একটা ঘোরতর দুরভিসন্ধি লইয়া আমীর খাঁ আমার সংসারের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। কিছুদিন পরে আমি সেই চরিত্রহীন, বেইমান্ আমীর খাঁকে এখান হইতে দূর করিয়া দিলাম। আমার কন্যা তখন সেই প্রতারকের প্রলোভনে একান্ত মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। একদিন আমার মৃজানকে লইয়া একেবারে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল-আর তাহাদের কোন সংবাদ পাইলাম না। সেই অবধি আমি সেই কলঙ্কিনী কন্যার নাম মুখে আনি না-মৃজান নামে একটা শয়তানী যে আমার এখানে এতকাল আশ্রয় করিয়াছিল, সে কথা আমি একেবারে ভুলিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছিলাম। মৃজান নামে যে কোন কালে আমার একটা মেয়ে ছিল, তাহা আমি আর মনে মনে স্থান দিতে ইচ্ছা করিতাম না। এমন কি সৃজানই যে আমার একমাত্র মেয়ে, এই ধারণাই এখন আমার মনের মধ্যে এক রকম ঠিক হইয়া গিয়াছিল। ক্রমে সেই সৃজানও তাহার ভগিনীর পথানুসরণ করিল। আমার মান-সম্ভ্রম আর কিছুই রহিল না। কিন্তু এ কাজটা ঠিক জোহিরুদ্দীনের দোষেই হইয়াছে; তিনি সৃজানকে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখিতেন-একে তাঁহার বয়স হইয়াছে, তাহার উপরে আবার তিনি অমূলক সন্দেহের বশে সৃজানের সহিত এমন সব ব্যবহার করিতেন যে, তাহাতে তাহার হৃদয় অধিকার করা দূরে থাক্, বরং তাহার হৃদয়ে যতটুকু স্থান পাইয়াছিল, নিজদোষে তাহাও নষ্ট করিয়া ফেলিলেন। এ দুনিয়ার নিয়মই এই। সে যাহা হউক, আমরাও তাই বোধ হয় যে, সৃজান ও মোনিরুদ্দীনের গুপ্ত-অভিসন্ধি মৃজান কোন রকমে টের পাইয়াছিল; পাছে, মনিরুদ্দীন তাহার যেমন সর্ব্বনাশ করিয়াছে, তাহার ভগিনীরও সেইরূপ দুর্গতি করে, এই আশঙ্কায় হয় ত সে নিজেই ভগিনীকে সাবধান করিতে রাত্রিতে জোহিরুদ্দীনের বাটীতে গিয়াছিল। সম্ভব, সৃজান মৃজানের কথায় কর্ণপাত করে নাই। তাই মৃজান আর কোন উপায় না দেখিয়া মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়, মনিরুদ্দীন তখন বাড়ীতে ছিল না- তাহার পর সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময়ে পথে হতভাগিনী খুন হইয়াছে। তেমন একজন সম্ভ্রান্ত, সদাশয় ব্যক্তির পুত্র হইয়া মনিরুদ্দীন যে এরূপে পিতৃনাম রক্ষা করিতেছে, ইহাই আশ্চর্য্য!”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনার মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আপনার কন্যা দিলজানের খুনের কি কিনারা হইল?”
বিরক্তভবে, মুন্সী মোজাম হোসেন বলিলেন, “দিলজানের নাম আমার কছে করিবেন না। আপনার কথাই ঠিক, কে মৃজানকে খুন করিয়াছে, কেমন করিয়া বলিব? আপনি যেমন বলিতেছেন, আমরাও তাহাই বোধ হয়; মজিদ খাঁর কোন দোষ নাই- সে কেন মৃজানকে খুন করিবে? কোন কারণ দেখি না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আমি তাহার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ পাইয়াছি; কিন্তু এমন কোন একটা কারণ দেখিতেছি না, যাহাতে তাহাকে খুনী বলিয়া বুঝিতে পারি। এখন আপনার কন্যা মৃজানের পূর্ব্বজীবন সম্বন্ধে দুই-একটী বিষয় আমার জানা দরকার। আমীর খাঁর পূর্ব্বে মৃজান আর কাহারও অনুরাগিনী হইয়াছিল?”
অবনতমস্তকে মোজাম হোসেন বলিলেন, “না”।
“মৃজানের কেহ অনুরাগী হইয়াছিল?”
“না।”
“একজনও না?”
“না।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মুন্সী মোজাম হোসেনের নিকট থাকিয়া আর বিশেষ কোনকাজ হইবে না; বিদায় লইয়া সুতরাং উঠিয়া পড়িলেন। কাজের মধ্যে-প্রকৃতরূপে এক্ষণে জানিতে পারা গেল, দিলজান সৃজানের সহোদরা ভগিনী। এবং উভয় ভগিনীই একজনের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী। সুতরাং দিলজানের খুনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগের যে একটা খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, সে সম্বন্ধে দেবেন্দ্রবিজয়ের আর কোন সন্দেহ রহিল না। কিন্তু কিছুতেই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না-সে সম্পর্কটি কি-এবং কেনই বা দিলজান খুন হইল-কে বা তাহাকে খুন করিল? একবার মনে হইল, সৃজানই কি ঈর্ষাবশে নিজের ভগিনীকে খুন করিয়া নিজের অধঃপতনের পথ পরিষ্কার করিয়া লইয়াছে? কে জানে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না-আরও গোলযোগে পড়িলাম। মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করিয়া এ রহস্য পরিষ্কার হওয়া দূরে থাক্, আরও গোলযোগ বাঁধিয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি গন্তব্যস্থানে পৌঁছাইবার চেষ্টা করিয়া যখন যে সূত্র অবলম্বন করিতেছেন, সামান্য দূর যাইতে-না-যাইতে তাহাই ছিঁড়িয়া গিয়া তাঁহাকে এমন অন্ধকারময় বিপথে চালিত করিতেছে যে, তিনি তথা হইতে বাহির হইবার কোন সুগম পথ খুঁজিয়া পাইতেছেন না। বুঝিলেন, এ রহস্যজালে যেরূপ বিষম জট্ ধরিয়াছে, যাহা আরও নিবিড়ভাবে পাক-খাইয়া যাইতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় তখন আপন মনে বলিলেন, “এখন একবার মুন্সী জোহিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে হইবে। যদি তাঁহার স্ত্রী সৃজান বিবি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকে? অনুচিত হইলেও আমাকে এই সকল কথা তাঁহার নিকটে তুলিতে হইবে। তাঁহার কলঙ্কিনী স্ত্রী সম্বন্ধে কোন কথা এখন তাঁহাকে বলিতে গেলে তিনি রাগ করিতে পারেন। তাহাতে ক্ষতি কি? একজন নির্দ্দোষী ব্যক্তিকে রক্ষা করিবার জন্য আমি সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব। আমার খুব বিশ্বাস-মজিদ খাঁ নির্দ্দোষী।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *