৩.০৯ তিন দিগন্ত
আমরা যখন মুক্ত মন নিয়ে সত্যের অনুসন্ধান করি, তখন একটি উপলব্ধি বারবারই আমাদের স্পর্শ করে যায়। আমরা উপলব্ধি করি যে, পরস্পরবিরোধী অনেক উক্তি একই সঙ্গে সত্য, যদি বা সম্পূর্ণ নয় তবু অংশত। একথা মেনে নেবার পর বাদবিসংবাদের আর প্রয়োজন থাকে না এমন নিশ্চয়ই নয়। তবে কিছু অনাবশ্যক বাদবিতণ্ডার হাত থেকে এর। পর নিস্তার পাওয়া যায়। অনুসন্ধান করে দেখা যায়, কোন উক্তিটি চৈতন্যের কোন স্তর থেকে নিঃসৃত। চৈতন্যের এক স্তরে সত্য এক রূপে প্রকাশিত, অন্য স্তরে অন্য রূপে।
চেতনার তিনটি প্রধান স্তর আছে। কোনো স্তরকেই বাদ দিয়ে চলে না; তবে চৈতন্যের বিবর্তনে কখনও একটির প্রাধান্য, কখনও অন্যটি প্রধান। চেতনা ও বাস্তব পরস্পর সম্পৃক্ত, অতএব বাস্তবেরও বিভিন্ন স্তর আছে। প্রতি স্তরের বৈশিষ্ট্য, অথবা অন্তর্নিহিত ঝোঁক, চিহ্নিত করা কঠিন। যে-সব শব্দকে আমরা চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করি, সে সবই দ্ব্যর্থবোধক। চৈতন্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একই শব্দ অন্য অর্থ ধারণ করে। চেতনা এক একটি সঙ্গমে দ্বিভঙ্গ মূর্তিতে দেখা দেয়। তবু বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে বিষয়টি বোঝবার চেষ্টা বৃথা নয়। এতে জটিলতার ভিতরও কিছুটা পরিচ্ছন্নতা আসে।
সভ্যতার প্রত্যূষে মানুষ বাস্তবকে দেখেছে আদিম ভালোবাসা ও ভয়ের একটি মিশ্র কুটিকার ভিতর দিয়ে। এই আদিম অথবা প্রাকৃত চেতনার একটি গুণ উল্লেযোগ্য। এতে ‘আত্মপ্রেম’ ও ‘বিশ্বপ্রেম অন্ধভাবে মিলেমিশে আছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সীমারেখা এখানে অস্পষ্ট। ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে তেমন সচেতন নয়। বরং জীবিত ও মৃতদের নিয়ে গঠিত একটি বিস্তীর্ণ পারিবারিক অথবা আত্মীয়সমষ্টিতে তার অহংচেতনা নিমজ্জিত।
চেতন ও অচেতনের সীমারেখাও মানুষের এই শৈশবে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। গাছপালা নদী পাহাড়প্রস্তর মেঘবিদ্যুৎ সব কিছুর ভিতরই চেতনা ছড়িয়ে আছে। সব মিলে, কিছুটা মোহে কিছুটা ভয়ে আশ্রিত, একটা বৃহৎ ত্রিভুবনব্যাপী অনির্দেশ্য আত্মীয়তার ইঙ্গিত। প্রাচীন ধর্মে ও সাহিত্যে এর প্রতিফলন দেখি। আকাশ ও পৃথিবীর ভিতর বিবাহবন্ধন ঘটে, দেবতারা মানুষের প্রতি উদাসীন নন, সূর্যের ঔরসে মানবীর গর্ভে মহাযোদ্ধার জন্ম হয়। এই প্রাচীন কল্পনায় দিব্যতার সঙ্গে মিশে থাকে অজস্র ভয়ের বিকৃত মুখচ্ছবি। তবু এতে এমন একটি বিশ্বমুগ্ধতা ও সীমাভাঙ্গার শক্তি আছে, উপজাতীয় ক্ষুদ্রতায় খণ্ডিত তৎকালীন সমাজের প্রতিতুলনায় যেটি বিস্ময়কর এবং মানুষের মৌল প্রকৃতি সম্বন্ধে কোনো সম্পূর্ণ ধারণা থেকে যাকে বাদ দেওয়া যায় না।
প্রাকৃতচেতনার পাশে পাশে ক্রমে দেখা দেয় সংস্কৃতচেতনা।
সংস্কৃতচেতনা অনেক বেশি যুক্তিধর্মী। সমাজ বিবর্তনের এই স্তরে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের সূত্র উপজাতীয় কুটুম্বতার গণ্ডি অতিক্রম করে বহুদূর ব্যাপ্ত। ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন। ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিসুখের গণনার প্রতি ঝোঁক ক্রমশ প্রবল। যদিও ব্যাপক অর্থে মানুষ ‘যুক্তিশীল’, তবু চেতনার এই দ্বিতীয় স্তরে যেটি পাই সেটিই বিশেষ অর্থে যুক্তিধর্মিতা বা র্যাশনালিজম।
এই যুক্তিধর্মী মন প্রকৃতিকে স্বেচ্ছাচালিত নয়, বরং নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে জানে। পাহাড়প্রান্তর মেঘবিদ্যুৎ থেকে ভূতপ্রেত দেবদেবতারা ক্রমে অন্তর্হিত হন। প্রকৃতি এবার হয়ে ওঠে ‘জড় প্রকৃতি। সংস্কৃতচেতনা একদিকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তার নিয়মের ভিতর, একটি বুদ্ধিগ্রাহ্য অখণ্ড সামঞ্জস্যের ভিতর জানতে চায়। অন্যদিকে এই বিশেষ জ্ঞান, যাকে চেতনার এই স্তরে আমরা বলি বিজ্ঞান, ক্রমশ একটি নতুন অর্থ লাভ করে। ব্যক্তিসুখগণনার অভ্যাস যুক্তিধর্মিতার একটি প্রধান প্রেরক। এই বিশ্ব আত্মার দ্বারা নয়, বস্তুর দ্বারা গঠিত। বিজ্ঞানের বলে এই বস্তুময় জড়প্রকৃতিকে মানুষ দাসে পরিণত করতে সক্ষম। বিজ্ঞানের, এমন কি দর্শনেরও, সার্থকতা তার প্রয়োগে। বিজ্ঞান ও শিল্পকে সুপরিকল্পিতভাবে মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখের পরিবর্ধক হিসেবে প্রয়োগ করা। যুক্তিধর্মী চেতনার লক্ষ্য।
প্রাকৃতচেতনার ভিত্তি যেমন প্রাচীন পল্লীতে, সংস্কৃতচেতনার পরিপুষ্টি তেমনই নগরে। অর্থাৎ, রাজদরবারে ও রাজধানীতে, বাণিজ্যকেন্দ্রে, শিল্প ও বিজ্ঞানের ছায়ায়, রাষ্ট্রশাসনের আবর্তে। সংস্কৃতচেতনা তাই রাজসিক, সুখসন্ধানী, গণনাকুশলী, বৈজ্ঞানিক। ক্ষেত্র অথবা প্রসঙ্গ অনুসারে একে কখনও রাজসিক অথবা নাগর, প্রয়োগধর্মী এবং যুক্তিধর্মী নামে চিহ্নিত করা সুবিধাজনক। প্রসঙ্গত আবারও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রাকৃতচেতনায়ও যুক্তি উপস্থিত, যেমন যাদুবিদ্যায়; কিন্তু সংস্কৃতচেতনার বিচারে যুক্তির অভাবটাই সেখানে বড়।
প্রাকৃতচেতনার তলে যে মোহাবিষ্ট চরাচরব্যাপী আত্মীয় অনুভব লক্ষ করা যায়, তারই অপর পিঠে আবার আছে অজ্ঞতা এবং ভয় থেকে উদ্ভূত নানা কিম্ভুত কল্পনা ও প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি। যুক্তির বিচারে এ সবই মূঢ়তা। প্রতিতুলনায় নাগরচেতনার কেন্দ্রে আছে একটি। স্বার্থবিন্দু; বাইরের বিশ্ব সেই স্বার্থের সাধনে সম্ভাব্য উপকরণ। অর্থাৎ, প্রয়োগধর্মী চেতনার দৃষ্টিতে বাইরের বিশ্বের আত্মীয়মূল্য নেই, তার উপকরণ মূল্যটাই প্রধান।
কথাটা এবার একটু ভিন্নভাষায় বলা যাক। এ যুগে মানুষের জ্ঞান ও জাগতিক প্রয়োজনের মধ্যে একটা সচেতন সেতু স্থাপিত হয়েছে। দু’য়েরই পরিবর্তন ঘটছে, বিবর্তন চলছে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের গতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ব্যবহারিক প্রয়োজনের দ্বারা, আবার বিজ্ঞানের প্রভাবে মানুষের প্রয়োজনের রূপরেখাও বদলে চলেছে। জাগতিক উদ্যোগের সঙ্গে সন্নিবদ্ধ এই-যে যুক্তিধর্মিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় যার বিশেষ প্রকাশ, এর চর্চায় যে জাতি আগ্রহী নয়, এ যুগে সে-জাতি পিছিয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই যুক্তিধর্মিতা মানুষকে শুধু জাগতিক অর্থেই শক্তিশালী করেনি, উপরন্তু চিত্তের অনুশীলনেও এর মূল্যবান ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। যুক্তি মানুষের চিন্তায় স্বচ্ছতা এনেছে। একটি আলোকিত স্বার্থবোধ মানুষকে নিষ্ফল অভিমান, ক্রোধ ও উত্তেজনা দমনের শিক্ষা দিয়েছে। একে বিদৃপ করা সহজ। কিন্তু এরও প্রয়োজন আছে! শ্রমণেরা সাধারণের ব্যতিক্রম ছিলেন। প্রয়োগধর্মী সংস্কৃতিই। শ্রমের মূল্য সম্বন্ধে ব্যাপকভাবে সাধারণকে সচেতন করেছে। স্বার্থকে উপেক্ষা করে নয়, বরং তাকে স্বীকার করে নিয়েই, কঠোর ও নিয়মিত শ্রমের অভ্যাস শিল্পোন্নয়নে ও চরিত্রগঠনে সহায়ক হয়েছে। যুক্তিধর্মিতা যেখানে এই কঠিন পথ এড়িয়ে গেছে, সেখানে সমাজজীবনে ও ঐতিহাসিকভাবে সেই পরিমাণে সে নিষ্ফল হয়েছে। যুক্তিই আবার পারে এই নিষ্ফলতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে। প্রাকৃতচেতনা থেকে নয়, সংস্কৃতচেতনা থেকেই আসে নৈর্ব্যক্তিক ন্যায়ের আদর্শ। যে-প্রাকৃতচেতনা যুক্তিধর্মিতার ভিতর দিয়ে পরিশোধিত নয়, শিল্পীর দৃষ্টিতে তাকে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, কিন্তু মানুষের চৈতন্যের অভিব্যক্তির বিচারে কিছুতেই তাকে সম্পূর্ণ বিবেচনা করা যায় না।
অথচ যুক্তিধর্মিতাও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। যদি সে স্বয়ংসম্পূর্ণ হত তবে তার গুণগত বিবর্তনের কোনো প্রয়োজন থাকত না। আগেই বলেছি যে, জগৎকে বস্তুময় এবং বস্তুকে। উপকরণস্বরূপ চিন্তা করবার একটা ঝোঁক যুক্তিধর্মিতার ভিতর প্রবল। সামাজিক বন্ধনের। গূঢ় অর্থ প্রাকৃতচেতনায় যেভাবে ধরা পড়েছে, নাগরচেতনায় সেভাবে নয়। প্রাকৃতচেতনা মৌল সামাজিক বন্ধনগুলিকে ধর্মের ওপর স্থাপন করতে চেয়েছে। নাগরচেতনায় এটা অগ্রাহ্য। স্বাধীন মানুষ এসব বন্ধন পারস্পরিক সুবিধার প্রয়োজনে। গ্রহণ করে, আবার সুবিধার খাতিরেই ত্যাগও করে। কোনো আনুগত্যই শর্তহীন নয়, কারণ শর্তহীন আনুগত্য তো দাসত্বেরই অন্য নাম। নাগরিক স্বাধীনতার এটাই মূল কথা। এর মূল্য কম নয়। এরই ফলে আমরা সহমরণের সংস্কার থেকে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারে এসে পৌঁচেছি। কিন্তু মানুষ যখন মানুষকে মূলত প্রয়োজন অথবা স্বার্থসিদ্ধির উপকরণ মাত্র বিবেচনা করে এবং এই বিবেচনার ওপরই নিজের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করে তখন অন্য এক দিক থেকে বিপদ দেখা দেয়। কারণ অন্তরে অন্তরে সে তখন আত্মীয়হীন হয়ে ওঠে।
যেমন সমাজবন্ধনের ক্ষেত্রে তেমনই বিশ্বদৃষ্টিতেও ঘটনা একইভাবে আবর্তিত হয়। প্রাকৃতচেতনা চরাচরময় নানা দেবতা উপদেবতাকে স্থাপন করে এমন একটি জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিল যার সঙ্গে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার একটা সম্পর্ক ছিল, যার সামনে পত্রপুস্পাঞ্জলি ও প্রার্থনা নিয়ে দাঁড়ানো যেত। বিজ্ঞানের জগৎ বর্ণগন্ধহীন, গণিতের নিয়মে বাঁধা তরঙ্গ অথবা সম্ভাব্যতায় নির্মিত। এর সামনে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দাঁড়াবার কোনো অর্থ হয় না। একে, অন্তত কিয়দংশে, যান্ত্রিক দাসের মতো ব্যবহার করা যায় বটে; কিন্তু যান্ত্রিক দাসের সঙ্গে কি প্রেম অথবা মিত্রতা সম্ভব? যন্ত্রকে আমরা গড়তে পারি, ভাঙ্গতে পারি, প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারি কিন্তু তাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা যায় না, আত্মার ভিতর গ্রহণ করা যায় না।
এমনই ভাবে সমাজে এবং বৃহৎ বিশ্বে একান্ত প্রয়োগধর্মী চেতনা অথবা ব্যবহারিক বুদ্ধি মানুষকে পরবাসী করে তোলে। এর থেকে নিস্তার পাবার জন্য আমরা নানা পথে ঘুরি, ছোট কোনো গোষ্ঠীর ভিতর নিজেকে প্রাণপণে আবদ্ধ করি যেন একটি নকল উপজাতীয়তায় আত্মিক নিরাপত্তার সন্ধানে, উত্তেজনা অথবা উত্তেজক পদার্থে আশ্রয় খুঁজি, বিশেষ কোনো বহিঃশত্রুকে শেষ শত্রু কল্পনা করি, বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরিত্রাণের পরম পন্থা বলে বিশ্বাস রাখি। এতে সমস্যার সমাধান হয় না। উত্তেজনায় কিছুকাল নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যায়। কিন্তু উত্তেজনা নিস্তেজ হয়ে আসে, অবশিষ্ট থাকে শুধু অবাধ্য অভ্যাস। একটি বহিঃশত্রু বহিষ্কৃত হলে আর একটি রঙ্গমঞ্চ দখল করে দাঁড়ায়। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যুক্তিধর্মিতার স্পর্শে যা উপকরণমাত্রে পরিণত হয় না। এখানেই তার বিশেষ উপযোগিতা, আবার এখানেই তার সীমা।
এই সীমার ওপারে চেতনার তৃতীয় স্তর, যার নাম দেওয়া যেতে পারে অধ্যাত্মচেতনা। অধ্যাত্মচেতনায় বস্তুর আর একটি রূপ উদভাসিত। প্রয়োগধর্মী চেতনায় যেমন বস্তুর পরিচয় উপকরণ হিসেবে, অধ্যাত্মচেতনায় তেমনই অস্তিত্বমাত্রই, অন্য কার্যকারণ অথবা উপযযাগিতা নিরপেক্ষভাবে, শুধু তার অস্তিত্বের গুণে, বিস্ময়কর। শিশু যে-আদিম। বিস্ময়ের চোখে পৃথিবীর দিকে তাকায়, তার সঙ্গে এর একটা মিল আছে। এদিক থেকেই প্রাকৃতচেতনার সঙ্গে অধ্যাত্মচেতনার মিল। কিন্তু অমিলও আছে। শৈশব অথবা প্রাকৃতচেতনায় যে-বিস্ময়ের শক্তি দেখি, তার চারিদিকে একটা আতংকের পরিমণ্ডল অহরহ উঁকিঝুঁকি মারে। সে আতংক জৈব আতংক। আমাদের জৈব সত্তা দৃশ্য ও অদৃশ্য বহু আক্রমণকারীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। অতএব ভয় স্বাভাবিক, সাবধানীবুদ্ধি স্বাভাবিক। ভয় থেকে হিংসার উৎপত্তি। এই ভয় এবং হিংসা একদিকে আমাদের জৈব সত্তার। বৰ্মস্বরূপ। অন্যদিকে এরা আমাদের শুদ্ধ বিস্ময় ও শুদ্ধ আনন্দের অধিকার কেড়ে নেয়। অধ্যাত্মচেতনায় আমরা সেই বিস্ময় ও আনন্দে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত।
এই অধ্যাত্মচেতনা যুক্তিবিরোধী নয়, আবার যুক্তির দ্বারা সৃষ্টও নয়। যুক্তি ঠিকই বলে যে, আতংকগ্রস্ত হওয়া অযৌক্তিক, ভয় অথবা হিংসার আতিশয্যে লাভ নেই। কিন্তু কঠিন সাবধানী বুদ্ধির যে আবরণ আমাদের চেতনাকে আচ্ছাদিত করে থাকে, যুক্তি দিয়ে তাকে ছিন্ন করা কঠিন। অথচ সেই উজ্জ্বল উদ্ধারের দর্শনমাত্র যুক্তিরও পুনর্জন্ম সম্ভব। নবজাতক যুক্তির চোখে অধ্যাত্মচেতনাও বিস্ময়করভাবে কাম্য। চেতনার এই একটি নতুন দিগন্ত। এর পরও মানুষ দৈনন্দিন জীবনে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলে; অস্বীকার করে না যে সাবধানী বুদ্ধিরও প্রয়োজন আছে; কিন্তু সেই সঙ্গে সে জানে যে, এ সবই বাহ্য
অধ্যাত্মচেতনার প্রকারভেদ আছে। যে-অধ্যাত্মচেতনায় ক্ষুদ্র জৈব ভয়ের মিশ্রণ বেশি, তাকে খাঁটি বলে স্বীকার করা যায় না। যুক্তির ভিতর দিয়ে যেটা সংস্কৃত ও পরিশোধিত হয়ে আসেনি, সেটা প্রাকৃতচেতনারই নামান্তর। তাতে কুসংস্কার কাটে না, বিচার উন্মুক্ত হয় না, সমাজ সবল হয় না। অন্তত আধুনিক সমাজের উন্নতির পথে সেটা বিঘ্ন। যুক্তিধর্মিতাকে উপেক্ষা করা ভুল কিন্তু যুক্তিরও নব নব রূপ আছে, নতুন সম্ভাবনা আছে। একথা যখন আমরা ভুলি তখন যুক্তিবাদও হয়ে ওঠে একটি অসহিষ্ণুতার মন্ত্র।
মানুষের ভিতর একটি শক্তি অথবা তেজ আছে, যাকে বিশুদ্ধ রূপে অনুভব করি অহেতুকী প্রীতিতে, যার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশিত হয় অকারণ আনন্দে। এই তেজ সব কিছুকে স্পর্শ করে খুশিতে সব কিছুতে ছড়িয়ে পড়তে চায়। সংসারের প্রয়োজনে একে আমরা সংকুচিত করে আনি, ভয়ে অথবা ক্রোধে একে আমরা কখনও বা ধ্বংসাত্মক করে তুলি। কিন্তু এই সব সাময়িক প্রয়োজনের উর্ধ্বে অহেতুক প্রেম অথবা আনন্দের একটি নিজস্ব মূল্য আছে। অর্থাৎ একে প্রয়োজন এরই জন্য, অপর কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। অধ্যাত্মচেতনা যখন আসে, তখন এ কথাটাই আমাদের সে স্মরণ করিয়ে দেয়। তারপর এই পুরনো পৃথিবীকে আমরা নতুন চোখে দেখি। সেই সঙ্গে মানুষে মানুষে প্রাচীন বন্ধনও নতুন অর্থ নিয়ে দেখা দেয়।
কোনো সরলরেখায় চৈতন্য এক স্তর থেকে শুরান্তরে প্রসারিত হয় না। কখনও যুক্তিধর্মিতা আরোহী কখনও দেখি সংস্কৃতচেতনা থেকে প্রতিক্রিয়ায় প্রাকৃতচেতনার দিকে প্রত্যাবর্তন। কোথাও বিভিন্ন স্তরের ভিতর সমন্বয়ী বুদ্ধি প্রধান কোথাও আবার সংঘাতটাই প্রবল। চৈতন্যের বিভিন্ন স্তরের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব সার্থকতা আছে। প্রতি স্তর অন্য স্তরকে কিছু পরিমাণে পূর্ণ করে তোলে, কিছু পরিমাণে গ্রাস করে। কৃতচেতনা থেকে শক্তির সঞ্চার হয় সংস্কৃতচেতনায়। এই যোগাযোগ ছিন্ন হলে সংস্কৃতচেতনা বৃন্তচ্যুত পুষ্পের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অথচ প্রাকৃতের বশ্যতা যুক্তির পক্ষে মারাত্মক। শুদ্ধ প্রেমের ওপর সমাজ সম্বন্ধ স্থাপন করা যায় না নিছক স্বার্থও যথেষ্ট নয়। ব্যক্তিচিন্তায় ও যুগমানসে সমভাবে চৈতন্যের বিভিন্ন ধারা এসে মিশেছে; মিশ্রণের বৈশিষ্ট্যেই ব্যক্তি এবং যুগের বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতচেতনা ও অধ্যাত্মচেতনার দ্বন্দ্বে ও মিলনে রূপলাভ করেছে এ যুগের সূক্ষ্মতম ট্র্যাজেডিচেতনা। গান্ধী অথবা রবীন্দ্রনাথ, রুসো অথবা রাসেল, চেতনার তিন স্রোত কার ভিতর কিভাবে মিশেছে সেটা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। আমরা কেউই চেতনার কোনো শুদ্ধ স্তরে বাস করি না। আমাদের সকলের জীবনই মিশ্র রাগরাগিণীতে বাঁধা। তবু শুদ্ধ রাগগুলি কিছুটা চিনে রাখা। ভালো। এতে মানুষের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত ভাবনাচিন্তার স্বরূপ নির্ণয় করা অন্তত কিছুটা সহজ হয়। চৈতন্যের বিভিন্ন স্তরের ভিতর সমম্বয়সাধনের একটা অস্থির ও সমাপ্তিহীন প্রয়াস ইতিহাসে পরিস্ফুট।
ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)