৩.০৯ আবার এল বিনয়রা

অন্য সব দিনের মতো পরদিন সকালে যথারীতি আবার এল বিনয়রা।

মোহনবাঁশিকে দেখে, ডাক্তার চট্টরাজের সঙ্গে কিছুক্ষণ পেশেন্ট সম্পর্কে কথা বলে, দোতলার অলিন্দে জ্যোৎস্না আর ছেলেমেয়েদের বসিয়ে বিনয়কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ।

সংকট আগেই কেটে গিয়েছিল মোহনবাঁশির। তার মুখচোখে অসুস্থতার যে কালচে, পুরু ছোপ পড়েছিল তা প্রায় নেই বললেই হয়। সে জায়গায় সজীবতা ফিরে আসতে শুরু করেছে। ডাক্তার চট্টরাজ বলেছেন, আর চার পাঁচ দিনের মধ্যেই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

দুজনে তিন নম্বর ব্লকের সামনে চলে এসেছিল। আজ আর বিল্ডিংটার ভেতর ঢুকলেন না শেখরনাথ। বললেন, আজ অন্য কয়েদি নয়, শুধু বিপ্লবীদের কথা তোমাকে বলব। তুমি নিশ্চয়ই জানো, আঠারোশো সাতান্নর সিপয় মিউটিনি দমন করার পর ইংরেজরা কত বিদ্রোহী সিপাহিকে আন্দামানে পাঠিয়েছিল তার কোনও হিসেব নেই। তাদের অনেকের পরিচয় আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে যেটুকু হদিশ পাওয়া গেছে তাতে মনে হয়, যাদের আনা হয়েছিল, বেশিরভাগকেই নির্মমভাবে গুলি করে খুন করা হয়। তখনও সেলুলার জেল তৈরি হয়নি।

বিনয় বলল, হ্যাঁ জানি। হিস্টোরিয়ানদের লেখায় পড়েছি।

তিন নম্বর ব্লকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন না শেখরনাথ। তিন, চার এবং পাঁচ নম্বর ব্লকের পাশ দিয়ে বিনয়কে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগলেন, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির গোড়া থেকেই সারা ভারতবর্ষ জুড়েই ইংরেজদের এদেশ থেকে উৎখাত করার জন্যে সশস্ত্র বিপ্লবীদের নানা গুপ্ত সংগঠন এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড তীব্র হতে থাকে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট, জেলার বা পুলিশ অফিসারদের ওপর বিপ্লবীরা বোমা-পিস্তল নিয়ে আক্রমণ চালাতে লাগলেন। এঁদের অনেকে মারাও গেলেন। শঙ্কিত বিদেশি শক্তি হাত-পা গুটিয়ে বসে রইল না। তারা রুদ্র মূর্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপ্লবীদের ওপর। নানা কৌশলে তাদের ধরে চরম নির্যাতন চালানো হতে লাগল। দেশি মিরজাফররা ইংরেজদের এ ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য করেছে। বিপ্লবীদের অনেকের ফাঁসি– হল, বাকি সবাইকে নানা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হল নানা মেয়াদের জেলা কারওকে পাঁচ বছর, কারওকে সাত বছর, কারওকে দশ বছর। যাদের সাজা আরও বেশি হল তাদের অনেককে পাঠানো হল কালাপানিতে অর্থাৎ এই সেলুলার জেলে। কোন কোন বিপ্লবী এখানে এসেছিলেন, তুমি জানো?

বিনয় বলল, সবার নাম জানি না। দুচারজনের নাম শুনেছি বা বইয়ে পড়েছি।

শেখরনাথ সামান্য ভর্ৎসনার সুরে বললেন, একজন ভারতীয় হিসেবে জানা উচিত। দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের কথা না জানাটা অপরাধ। আমরা বাবর, হুমায়ুন, জাহাঙ্গির, চেঙ্গিস খান, মহম্মদ ঘোরি, আলেকজান্ডার কি ক্লাইভ, হেস্টিংস, ডালহৌসি, ওয়েলেসলিদের জীবনচরিত কী তাদের কীর্তিকলাপের কথা গড় গড় করে আওড়ে যেতে পারি, অথচ এই বিপ্লবীদের সম্বন্ধে কিছুই জানি না, হয়তো জানার আগ্রহই নেই। এটা গৌরবের কথা নয় বিনয়।

শেখরনাথের দিকে তাকাতে পারছিল না বিনয়। সে চুপ করে থাকে।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, তোমাকে কয়েকজনের নাম বলছি, আলিপুর বোমার মামলায় নির্বাসনের সাজা খাটতে এসেছিলেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র দাস, উল্লাসকর দত্ত, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, অবিনাশ ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র সেনরা। নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় মহারাষ্ট্র থেকে সাভারকর ভাইরা– বিনায়ক দামোদর সাভারকর আর গণেশ দামোদর সাভারকর। তাঁদের সঙ্গে নারায়ণ যোশি এমনি অনেকে। ঢাকা থেকে পুলিনবিহারী দাস, জ্যোতির্ময় রায়, খুলনা থেকে সুধীর দে, অশ্বিনীকুমার বসু, শচীন্দ্র মিত্র, ডালহৌসি স্কোয়ার মামলায় শাস্তি পাওয়া ননীগোপাল মুখার্জি। কত নাম আর বলব!

একটু নীরবতা।

তারপর ভেবে ভেবে ফের বলতে শুরু করলেন শেখরনাথ। বোমা-বন্দুক হাতে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন যাঁরা শুধু তারাই নন, দুঃসাহসী সাংবাদিক এবং রাজদ্রোহমূলক লেখালেখির জন্য যে সব খবরের কাগজের সম্পাদক অপরাধী সাব্যস্ত হতেন তাদের সেলুলার জেলে পাঠানো হত। যেমন এলাহাবাদের স্বরাজ পত্রিকার নন্দগোপাল, হোতিলাল রামহরি বা রামচরণ লাল। যেভাবেই হোক, বিপ্লবী বা কঠোর সমালোচনা করে ইংরেজ রাজত্বের কুকীর্তি, অত্যাচার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে চাইতেন তাদের বিরুদ্ধেও চরম দমননীতি নিয়েছিল সরকার। এঁদের হাত থেকে কলম কেড়ে নাও, যেভাবে হোক এদের কণ্ঠরোধ কর। তারা যেন সিডিশান ছড়াতে না পারে।

বিনয় জিগ্যেস করল, সেলুলার জেলে এইসব সাংবাদিকের ওপরও কি টরচার চালানো হত?

শেখরনাথের দুচোখ কৌতুকে ঝিকমিক করে ওঠে।–হত মানে! তোমার কি ধারণা,সম্পাদকরা সাংবাদিকরা ইংরেজদের গুরুঠাকুর? বলতে বলতে তার স্বর গম্ভীর হয়ে ওঠে- আমার ধারণা, বোমা-পিস্তলের চেয়ে কলমের শক্তি অনেক বেশি।

বিনয় উত্তর দেয় না। প্রাক্তন বিপ্লবীর দিকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে।

শেখরনাথ থামেননি। স্বদেশি ডাকাতির কথা শুনেছ নিশ্চয়ই?

শুনেছি। বিনয় মাথা নাড়ে।

 বিপ্লবীদের তো টাকাপয়সা নেই। গোপনে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে ডাকাতি না করে উপায় ছিল না। দেশের কাজের জন্যেই এসব করতে হত। তাছাড়া অত্যাচারী বা ম্যাজিষ্ট্রেট হত্যা তো ছিলই। এই ধরনের ঘটনা কাগজে প্রচার না করা হলে দেশের লোক। জানবে কী করে? মানুষের কাছে পৌঁছবার একমাত্র বাহন তো সংবাদপত্র। বেশিরভাগ পত্রিকা ছিল ইংরেজের খয়ের খাঁ। তাদের অনেকেই এসব এড়িয়ে যেত। অনেকে ছোট করে ছাপত, সেই সঙ্গে বিপ্লবীদের মুণ্ডপাতও করত। কিন্তু যাদের দুর্জয় সাহস তাঁরা কিন্তু ইংরেজের রক্তচক্ষু গ্রাহ্য করতেন না। কাগজে তো ছাপতেনই, সেই সঙ্গে ভারতের বীর সন্তান এইসব বিপ্লবীর দেশপ্রেমকে কুর্নিশ করে এডিটোরিয়াল বা নানারকম আর্টিকল লিখতেন। ইংরেজ এঁদের ভীষণ ভয় পেত। জেল, জরিমানা, কাগজের প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া– এসব তো ছিলই। যাঁদের কোনওভাবেই দমাতে পারা যেত না তাঁদের কালাপানি পাঠানো হত।

আচ্ছা—

বল—

এঁদেরও কি ঘানিটানি টানতে হত?

শেখরনাথ হেসে ফেললেন। এ হল হরিহরছত্রের মেলা। এই জেলের ভাষায় এখানকার সবাই বরাবর মানে সমান। খুনের আসামি, রেভোলিউশনারি বা কাগজের বিখ্যাত সব এডিটর জেল অথরিটির চোখে এদের মধ্যে প্রভেদ নেই। কাগজের লোক বলে বেদিতে বসিয়ে পুজো করবে তেমন বান্দাই নয় ব্রিটিশ জেলার। খুনি কয়েদিদের পাশে দাঁড়িয়ে হোতিলাল, নন্দগোপাল বা রামচরণ লালদের ঘানি ঘোরাতে, ছোবড়া পিটতে কী পাথর ভাঙতে হত। আমাদের আগে যারা এসেছিলেন তাদের কপালে একই দুর্ভোগ ছিল। শুধু. নির্যাতন, নির্যাতন আর নির্যাতন। সেলুলার জেলের ট্রাডিশন সমানে চলছিলই৷

বিনয় কোনও প্রশ্ন করল না।

শেখরনাথ বলেই যাচ্ছেন। তোমাকে রাজনাথের কথা বলেছি। সে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার আগে আলিপুর বোমার মামলায় যাঁরা কালাপানি এসেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লাসকর দত্তও ছিলেন। তিনিও উন্মাদ হয়ে যান। এঁদের মতো অসংখ্য বিপ্লবী অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে গেছেন। ইংরেজ একটা পরিকল্পনা ছকে নিয়ে সেই সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে মুক্তি সংগ্রামীদের আন্দামানে পাঠিয়েছিল। সেই অমানুষিক ছকটা ছিল এই দেশপ্রেমিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা। বিনয়, তুমি শুনলে অবাক হবে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের অর্থাৎ সিপয় মিউটিনির বীর সৈনিকদের একজনও জীবন্ত অবস্থায় ভারতের মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসেনি। তাদের কারওকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে, কারওকে গুলি করে, কারও পেছনে ডালকুত্তা লেলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল, তোরা স্বাধীনতা চেয়েছিলি তো? এবার মজাটা বোঝা কী ভয়ংকর প্রতিহিংসাপরায়ণ এই নৃশংস সাম্রাজ্যবাদীরা!

বিনয় চুপচাপ শুনতে লাগল।

শেখরনাথ থামেননি। সেলুলার জেল তৈরি হবার আগে এসেছিলেন বিদ্রোহী সিপাহিরা। জেলখানা তৈরি হলে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির গোড়ার দিক থেকে যে বিপ্লবীরা জাহাজ বোঝাই হয়ে এখানে এসেছেন তাদের ওপর কত নির্যাতন যে হয়েছে তার কিছু কিছু নমুনা তোমাকে জানিয়েছি। এই জেলের তিন আর দুনম্বর ব্লকে আর খানিক দূরে ভাইপার আইল্যান্ডে ছিল ফাঁসিঘর। কত বিপ্লবীকে যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার হিসেব নেই।

বিনয় বলল, আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে। যদি কিছু মনে না করেন, বলব?

শেখরনাথ বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মনে করার প্রশ্নই নেই।

যে সব বিপ্লবী এখানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা খাটতে এসেছিলেন তাদের তো মৃত্যুভয় ছিল না। এত নির্যাতন তারা মুখ বুজে সহ্য করেছেন!

বিপ্লবীরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, সেলের ভেতর বেশিরভাগ বন্দি থাকত। কারও কারও হাতে-পায়ে ডান্ডাবেড়ি৷ তবু তারই মধ্যে প্রতিবাদ অবশ্য করা হয়েছে। পুরানো নথিপত্র যেটুকু পেয়েছি। সেসব ঘেঁটে জেনেছি অলিপুর বোমার মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর। দত্তরা এখানে আসার পর ননীগোপাল নামে অল্পবয়সি যুবক বিপ্লবীকে সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। তার আসার আগে থেকেই বিপ্লবীদের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষ জমা হচ্ছিল। তারা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। জেলে যে অখাদ্য কুখাদ্য দেওয়া। হয় তার বদলে ভালো খাবার দিতে হবে, রাজবন্দিদের অমানুষিক খাটুনি বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি। ননীগোপাল এসেই খাওয়াদাওয়া এবং ছোবড়া পেটানো বা ঘানি টানার মতো কাজ বন্ধ করে দিল। তাকে জেলের পোশাকের বদলে চটের জাঙিয়া আর জামা পরতে দেওয়া হল, কুঠুরিতে পুরে রাখা হল, কিন্তু যে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে, দুই আঙুলে সে মৃত্যু নিয়ে খেলা করে, তাকে এসব দিয়ে কি দমানো যায়? ননীগোপালের এই প্রতিবাদ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। পরে যে বিপ্লবীরা এসেছেন তাঁরাও বারবার জেল অথরিটির বর্বর দমননীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। স্রেফ অনশন আর কাজ বন্ধ।

বিনয় বলল, গান্ধীজির মতো প্যাসিভ রেজিস্টান্স?

 শেখরনাথ মৃদু হাসলেন। তা বলতে পার।

এইসব আন্দোলনের রেজাল্ট কী হয়েছিল?

একরকম ঢোক গিলে প্রশাসনকে একটা কমিশন বসাতে হয়। কমিশনের কর্তাদের সুপারিশ ছিল রাজবন্দিদের সঙ্গে একটু মানবিক ব্যবহার করা হোক। কিন্তু সেসব সুপারিশ বস্তায় পুরে গুদামে ফেলে রাখা হয়েছে। তার ওপর ধুলোর স্তর জমেছে। কিন্তু সিস্টেম পালটায়নি। ট্র্যাডিশন সমানে চলছিলই।

একটু চুপ করলেন শেখরনাথ। তারপর ফের শুরু হল আন্দোলন, সম্পর্কে পরে তোমাকে ডিটেলে সব বলব। এখন ইতিহাসের কথা বলছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। আমরা সেলুলার জেলে আসার পর উনিশশো তিরিশে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে ভগৎ সিং, শুকদেব এবং রাজগুরুকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। জয়দেব কাপুর, বিজয় সিং, কমলনাথ তেওয়ারি, বটুকেশ্বর দত্ত এমন কয়েকজনকে ট্রান্সপোর্টেশনের শাস্তি দিয়ে আন্দামানে পাঠানো হল। এলেন চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইংরেজরা যাকে বলত চিটাগাং আর্মারি রেইড, অসমসাহসী যোদ্ধারা। দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর কেটে গেল। আমরা যারা আগে কালাপানি এসেছিলাম তাদের আর ছোবড়া পেটানোর বা ঘানি টানার মতো হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ করতে হত না, আমাদের সেলুলার জেলের বাইরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বা পি ডব্লু ডিতে ডিউটি দেওয়া হল। আমি ছিলাম পি ডব্লুতে। কয়েদিরা পাথর ভেঙে রাস্তা বানাত; আমাকে তার তদারকি করতে হত। পাছে পালিয়ে যাই, সেজন্য পাহারাদার থাকত আর্মড পুলিশরা। ডিউটি শেষ হলে আবার আমাকে জেলখানায় ফিরিয়ে আনা হত। তবে খুব বেশিদিন নয়, কী কারণে আমার ওপর জেল অথরিটি সদয় হয়েছিল জানি না। হয়তো ভেবেছিল, ব্যাটা পালাবে কোথায়? জঙ্গলে ঢুকলে জারোয়াদের তিরে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে; আর সমুদ্রে নামলে সোজা হাঙরের পেটে চলে যাবে। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল পোর্টব্লেয়ারেরই হ্যাঁডো নামে একটা এলাকায়।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।

শেখরনাথ নিজের মধ্যে যেন মগ্ন হয়ে রইলেন। পুরনো স্মৃতি তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিনয় অপেক্ষা করতে লাগল।

একসময় শেখরনাথ বলতে লাগলেন সময় উড়ে যাচ্ছিল ঝড়ের গতিতে। উনিশশো উনচল্লিশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হল। চোখের পলকে তা ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। জাপান ছিল অক্ষশক্তি অর্থাৎ অ্যাক্সিস ফোর্সের এক বিরাট শক্তি। জার্মানি আর ইতালির শরিক। তারা দুরন্ত বেগে ধেয়ে আসছে ভারতের বিশেষ করে কলকাতার দিকে। একে একে পতন হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয় এবং বার্মার। কলকাতা দখল করতে পারলে জাপানি ফৌজ হু হু করে ঢুকে যাবে সারা ভারতে। অ্যালায়েড ফোর্সের প্রধান শরিক ইংরেজরা কলকাতাসুদ্ধ সারা বাংলাদেশ ওদিকে আসামকে এমনভাবে সুরক্ষিত করে ফেলল যাতে জাপানিরা। কোনওভাবেই ঢুকতে না পারে। ইংরেজ আর আমেরিকান টমিতে ছেয়ে গেল ইস্টার্ন ইন্ডিয়া।

বিনয় বলল, কাকা, আপনি হয়তো শুনেছেন, আমরা আনডিভাইডেড বেঙ্গলের ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের বিক্রমপুরে রাজদিয়া নামে একটা জায়গায় থাকতাম। সেখানেও ইংরেজরা রাতারাতি একটা সেনা ঘাঁটি বসিয়ে ফেলল। কত যে ব্রিটিশ আর আমেরিকান নিগ্রো সোলজারকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সারাদিন, এমনকী রাতেও তারা জিপে এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াত।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, একদিকে তোজোর জাপ বাহিন, অন্যদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের দিকে এগিয়ে আসছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল মণিপুরের ভেতর দিয়ে আসামে ঢুকে পড়া এবং দেশকে স্বাধীন করা। সে যাক, ইংরেজরা চারদিক এত তো দুর্ভেদ্য করে তুলছিল কিন্তু আল্লামান দ্বীপপুঞ্জকে রক্ষা করতে পারেনি। জাপানিরা তা দখল করে নেয়। যতদূর মনে পড়ছে সেটা উনিশশো বেয়াল্লিশ সালের গোড়ার দিক। ইংরেজরা তাদের রুখতে না পেরে ভীরু কুকুরের মতো পালিয়ে যায়। ইংরেজের যত দাপট সাধারণ নিরস্ত্র ভারতীয়দের ওপর। কিন্তু ব্রিটিশ জাতটা ধুরন্ধর। এখান থেকে পালাবার আগে, সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু গুপ্তচর ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এই স্পাইরা কী করেছিল, পরে বলছি।

এদিকে জাপানিরা কিন্তু আন্দামান দখল করে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে আসেনি। জাপানের পার্লামেন্ট নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু তার মধ্যেও চাতুরি ছিল। আসল। ক্ষমতা কিন্তু ছিল জাপানিদের হাতেই।

নেতাজি খুব সম্ভব উনিশশো তেতাল্লিশের শেষাশেষি একটি বিমানে আন্দামনে এসেছিলেন। ভারতের মাটিতে সেটাই বোধহয় তার শেষ পা রাখা।

বিনয়, তুমি নিশ্চয়ই জানো, সুভাষচন্দ্র এখানে এসে জিমখানা ময়দানে মার্কেটের সামনে এক অনুষ্ঠানে তাঁর আই এন এর পতাকা তুলে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। আমরা তার সভায় গিয়েছিলাম। তার ইচ্ছা ছিল আন্দামানের নাম হোক শহিদ দ্বীপ আর নিকোবর হোক স্বরাজ দ্বীপ। দেশ স্বাধীন হবার পর সেই ইচ্ছা এখনও পূরণ হয়নি৷

নেতাজি সেলুলার জেল এবং পোর্টব্লেয়ারের চারপাশে বেশ কিছু গ্রামেও গিয়েছিলেন। জেলখানায় তখন রাজবন্দি একজনও ছিলেন না, ছিল প্রচুর সাধারণ কয়েদি। গ্রামে বা সেলুলার জেলে যেখানেই তিনি গেছেন, জাপানি সৈন্যরা তাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যাতে এখানকার মানুষের কোনও অভিযোগ বা জাপ শাসনে তাদের দিন কীভাবে কাটছে, প্রায় কিছুই জানতে পারেননি।

ওই যে গুপ্তচরদের কথা বলছিলাম, তারা গোপনে ব্রিটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে জাপানিদের সম্বন্ধে অনেক খবর দিচ্ছিল। সেই অনুযায়ী ইংরেজরা এখানে মাঝে মাঝেই বিমান হানা চালায় এবং জাপানিদের প্রচুর ক্ষতি করে। ফলে তারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের চরম হিংস্র চেহারাটি নখ দাঁত মেলে বেরিয়ে পড়ে।

জাপানিদের ধারণা হয়েছিল, এই দ্বীপের প্রতিটি মানুষ ইংরেজের গুপ্তচর। তারা যে ভয়ানক নির্যাতন চালিয়েছিল, ইংরেজদের দমননীতি তার কাছে প্রায় কিছুই না।

গুপ্তচর সন্দেহে অজস্র মানুষকে তারা ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে। একবার পোর্টব্লেয়ারের কাছাকাছি হামফ্রেগঞ্জে চুয়াল্লিশ জনকে নিয়ে গিয়ে একদিনে তাদের হত্যা করে। ইংরেজ হোক আর জাপানিই হোক, সাম্রাজ্যবাদীদের চেহারা প্রায় একইরকম।

উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থামল। মিত্রশক্তির জয় হল। অক্ষশক্তি সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। জাপানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। মারাত্মক। হিরোসিমা নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফেলে তার শিরদাঁড়া গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। জাপান আত্মসমর্পণ করে।

আন্দামান নিকোবরে তাদের আর থাকা সম্ভব ছিল না। ইংরেজদের হাতে দুই দ্বীপপুঞ্জ তুলে দিয়ে তারা চলে যায়। তার। আগে আন্দমানের বহু মানুষকে জলে ডুবিয়ে খুন করে। ইংরেজরা এখানে ফিরে আসার পর ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সেলুলার জেল চিরকালের মতো বন্ধ করে দেয়।

জাপানিরা যে কত ধূর্ত তা জানা গিয়েছিল পরে।

বিনয় উৎসুক চোখে তাকিয়ে ছিল। জিগ্যেস করল, কী জানা গিয়েছিল?

শেখরনাথ বললেন, ওরা যে মানুষের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছিল তার বিশেষ কোনও নথিপত্র পাওয়া যায়নি। প্রায় সব ডকুমেন্ট পুড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। এখানকার পেনাল সেটলমেন্টের পুরনো বাসিন্দাদের কাছে গেলে সে সব ইতিহাস জানতে পারবে। জাপানিরা যে তিন বছরের মতো এখানে ছিল, আন্দামানের ইতিহাসে সেটা কলঙ্কজনক চ্যাপ্টার।

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, পঁয়তাল্লিশে যুদ্ধ থামল। ছেচল্লিশে সারা দেশ জুড়ে দাঙ্গা, পূর্ব বাংলা থেকে সুদূর লাহোর, করাচি পর্যন্ত শুধু আগুন, ধর্ষণ আর রক্তস্রোত। কত নিরীহ মানুষ যে মারা গেল; কত তরুণীর জীবনে যে সর্বনাশ ঘটে গেল! দাঙ্গার এক বছর পর পার্টিশান। আচ্ছা বিনয়—

বিনয় বলে, কী কাকা?

সেই সিপয় মিউটিনির পর থেকে এই আন্দামান দ্বীপে কত হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীকে হত্যা করা হয়েছে তার হিসেব নেই। শুধু কী আন্দামানেই, সারা ইন্ডিয়াতেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট অগুনতি বিপ্লবীকে গুলি করে বা ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। কত যে মুক্তিযোদ্ধা দেশের শত শত কয়েদখানায় বছরের পর বছর বন্দি থেকে জীবন ক্ষয় করে ফেলেছে। এত মানুষের আত্মদানের বদলে আমরা কোন স্বাধীনতা পেয়েছি? বিকলাঙ্গ, ভাঙাচোরা, পোকায়-কাটা এক ফ্রিডম।

শেখরনাথের বুকের ভেতর কত ক্ষোভ, কত উষ্ম, কত বেদনা যে পুঞ্জীভূত হয়েছিল! সেসব ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। বিনয় নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, তাঁর মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে, কণ্ঠস্বরে তীব্র ঝাঝা পার্টিশনের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাদের কোনও অপরাধ নেই, যারা রাজনীতির ধার ধারে না, তারা সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের এপারে চলে এল। এখনও আসছে। কত বছর, কত কাল ধরে আসতে থাকবে, কেউ জানে না। যে ভূখণ্ডটি তাদের পিতৃপুরুষের বাসভূমি ছিল, ছিল তাদের জন্মস্থান, এক লহমায় সেটা আর তাদের রইল না। শিয়ালদা স্টেশনে, রিলিফ ক্যাম্পে ক্যাম্পে তারা পচে মরছে। মাথা গোঁজার একটুকরো জমির জন্যে তাদের পাঠানো হচ্ছে আন্দামানের জঙ্গলে, ওড়িশায়। শুনছি, দণ্ডকারণ্যেও রিহ্যাবিলিটেশনের জন্য একটা প্রোজেক্টের কথা ভাবা হচ্ছে। তাই নিয়েও কত রকমের দড়ি টানাটানি, কত পলিটিকস।–এর নাম স্বাধীনতা?

এর পর অনেকক্ষণ নীরবতা।

গত কয়েকদিনে সেলুলার জেলের জনশূন্য নানা ব্লকের। চত্বরগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহি বিদ্রোহের যোদ্ধাদের এখানে এই দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে এসে নির্বিচারে গণহত্যা থেকে শুরু করে এই জেলখানায় সারা ভারত এবং বর্মা থেকে অজস্র কয়েদির সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবীদের এনে চরম নির্যাতন, পাঠান, শিখ, জাঠ, বর্মি ইত্যাদি কয়েদিদের কত বিচিত্র কাহিনিই না শুনিয়েছেন শেখরনাথ। শুনিয়েছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিদের এই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেওয়া, সাধারণ মানুষের ওপর ওদের বর্বর অত্যাচার, দুদিনের জন্য সুভাষচন্দ্রের এখানে আসা–সুদূর এবং অদূর অতীতের কত যে ইতিহাস বিনয়ের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে!

অবশেষে এসেছে দাসত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্তি, যার গালভরা নাম স্বাধীনতা। সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা– কিন্তু এই স্বাধীনতার জন্য আক্ষেপের অবধি নেই শেখরনাথের। তার শেষ কথাগুলো অফুরান বিষাদের মতো যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

কতক্ষণ পর বিনয়ের খেয়াল নেই, শেখরনাথের কণ্ঠস্বর আবার কানে এল।– বিনয় চল, এবার যাওয়া যাক। দুপুরের খাবার আনতে এবারডিন মার্কেটে যেতে হবে।

নিঃশব্দে শেখরনাথের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল বিনয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *