০৮.
কিন্তু মাইকেলকে গোপনে আমেরিকায় ফিরিয়ে আনতে আরও একটা বছর লেগে গেল ডন কর্লিয়নির। এর আগে পর্যন্ত কর্লিয়নি পরিবারের সবাই একটা উপযুক্ত উপায় খুঁজতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেছে।
কিন্তু মাইকেলকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যে যত উপায় বলছে কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না ডন কর্লিয়নির। উঠানের একটা বাড়িতে কনিকে নিয়ে বাস করে এখন কার্লো। আজকাল তার কথায় পর্যন্ত কান দেয় লোকে।
শেষ পর্যন্ত নিজেদের একটা শোচনীয় করুণ ঘটনার পরিণতির সাহায্যে বোচ্চিচ্চিও পরিবারই সমাধান করে দিল সমস্যাটার। বোচ্চিচ্চিওদের নিকট আত্মীয় এক ছেলে, নাম ফলিক্স, বয়ন পচিশের মত, জন্ম আমেরিকায়, তার মাথায় যত বৃদ্ধি আছে ওদের বংশে কখনও কারও মাথায় এতটা ছিল না বা নেই। ওদের আবর্জনা ফেলার পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকতে রাজী হয়নি ফালি ভাল একটা ইংরেজ বংশের আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে নিজের পরিবারের সাথে বিচ্ছেদটা আরও পাকা করে এনেছে। উকিল হবার জন্যে, রাতের বেলা ক্লাস করে, আর দিনের বেলা করে সিভিল সার্ভিসের ভকঘরে কেরানীর চাকরি এরই মধ্যে তিনটি বাচ্চা হয়েছে কিন্তু ওর স্ত্রী খুব হিসাবী আর ভাল গৃহিণী বলে যত দিন না ফীলিক্স তার আইনের ডিগ্রী পেল তত দিন তার এই সামান্য আয়টুকু দিয়েই সংসার চালিয়ে নিয়েছে সে।
অন্যান্য যুবকদের মত ফীলিক্স বোচ্চিচ্চিও-ও ভেবেছিল, এত কষ্ট করে লেখাপড়া শেষ করে আইনের ডিগ্রীটা লাভ করা গেছে যখন, এবার নিশ্চিয়ই আপনা থেকেই এতবড় একটা গুণের পুরস্কার পাওয়া যাবে, দুই হাতে টাকা লুটবে সে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হলো না। টাকা রোজগার করা খুবই কঠিন আর কষ্টসাধ্য। নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্যে সে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য নিতে রাজী হলো না। ওর এক উকিল বন্ধু আছে, কম বয়স, ভাল পরিবারের ছেলে। বড় একটা আইন ব্যবসাতে তার কর্মজীবন সবে শুরু হতে যাচ্ছে। সেই ফীলিক্সকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তার একটা উপকার করতে রাজী করাল ব্যাপারটা ভারি জটিল, বাইরে থেকে মনে হয় এতে বেআইনী কিছু নেই একটা ব্যবসার দেউলিয়া ঘোষণা সংক্রান্ত জোচ্চুরির কেস। জোচ্চুরিটা ধরা পড়ার সম্ভাবনা দশ লাখে এক বা নেই বললেই চলে! ঝুঁকিটুকু নিল ফীলিক্স। বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আইনে যে দক্ষতা অর্জন করেছে সেটাকে ব্যবহার করে জোচ্চুরিটাকে যদি ঢাকতে পারা যায় তাতে আপত্তিকর কিছু আছে বলে মনে হয়নি তার। কাজটা অন্যায় বলেও মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, নিজের যোগ্যতা পরীক্ষা করে দেখার এইতো এক সুযোগ।
যাই হোক, সংক্ষেপে ঘটনা হলো, জোছুরিটা ধরা পড়ে গেল। উকিল বন্ধু গায়েব হয়ে গেল, এই বিপদে ফীলিক্সকে কোনভাবে সাহায্য তো করলই না, এমন কি টেলিফোন করলেও উত্তর দেয় না। জোছুরির ব্যাপারে হোতা যারা, তারা Fজন আধা-বয়সী বিচক্ষণ ব্যবসায়ী। মতলব ফেঁসে যাবার জন্যে তারা ক্ষেপে আগুন। ফলিক্সের আনাড়ীপনাকেই দায়ী করল তারা। তারপর নিজেরা অপরাধ স্বীকার করে, রাজসাক্ষী হয়ে ফীলিক্সকে আসল জোচ্চোর হিসাবে চিহ্নিত করে বলল, সে নাকি প্রাণের ভয় দেখিয়ে তাদের ব্যবসা হস্তগত করে নেবার উদ্দেশ্যে নিজের বেআইনী কীর্তিকলাপে যোগ দিতে তাদেরকে বাধ্য করেছিল। এমন সব সাক্ষীও.দাঁড় করানো হলো, যারা নানান গুণ্ডামীর জন্যে পুলিশের খাতায় নাম লেখানো বোচ্চিচ্চিও পরিবারের ভাই বেরাদারদের সাথে ফীলিক্সকেও জড়িয়ে ফেলল। এটাই হলো সর্বনাশের মূল কারণ। ব্যবসায়ী দুজনের শাস্তি র হয়ে গেল, ফালিক্স বোচ্চিচ্চিওকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়া হলো। তিন বছর মেয়াদ খাটল সে। বোছিচ্চিওরা অন্যান্য মাফিয়া পরিবারের কিংবা ডন কর্লিয়নির সাহায্য চায়নি। কারণ, ফলিক্স বোচ্চিচ্চিওদের কাছ থেকে কোন সাহায্য চায়নি। বোচ্চিচ্চিরা স্থির করল, ফালিকে এই শিক্ষা দেয়া দরকার যে একমাত্র নিজের পরিবারের কাছ থেকেই সাহায্য পাওয়া যায় এবং সমাজের চেয়ে পরিবারের উপরেই বেশি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা উচিত।
সে যাই হোক, তিন বছর মেয়াদ খাটার পর ফীলিক্স তো ছাড়া পেল। সোজা বাড়ি ফিরে স্ত্রী আর তিনটি সন্তানকে চুমো খেয়ে, বছর খানিক শান্তিতে বাস করার পর, হঠাৎ প্রমাণ করে দিল যে সেও বোচ্চিচ্চিও পরিবারের যোগ্য সন্তানই বটে। নিজের অপরাধ গোপন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না ফলিক্স। একটা পিস্তল যোগাড় করল সে। সেটা দিয়ে গুলি করে তার উকিল বন্ধুকে মেরে ফেলল। তারপর সেই দুই ব্যবসায়ীকে খুঁজে বের করল। তারা একটা রেস্তোরাঁ থেকে বেরুচ্ছে, এই সময় নির্বিকার চিত্তে দুজনের মাথায় গুলি চালিয়ে দিল রাস্তায় পড়ে রয়েছে লাশ দুটো। রেস্তোরাঁয় ঢুকে কফির অর্ডার দিয়েছে ফীলিক্স বসে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে, আর অপেক্ষা করছে, কখন এসে ওকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ।
খুব তাড়াতাড়ি বিচার হয়ে গেল ওর। রায়টা হলো নির্মম প্রকাশ পেল অপরাধ জগতের একজন সদস্য নির্দয়ভাবে দুজন সরকারী সাক্ষীকে হত্যা করেছে, কারণ তাদের সাক্ষ্যের জন্য ন্যায্য ভাবেই কারাদণ্ড হয়েছিল তার। এভাবে সামাজিক নিয়মকে তাচ্ছিল্য করা কোনমতেই মেনে নেয়া যায় না, তাই এই একবারের মত দেখা গেল জনসাধারণ, খবরের কাগজ এবং আইন সংরক্ষকেরা সবাই একবাক্যে ফীলিক্স বোচ্ছিচ্চিওর প্রাণদণ্ড দাবি করছে। রাজ্যপালের নিকটতম রাজনৈতিক সহকারীদের একজন বুলল, খোয়াড়ের প্রহরীরা যেমন কখনও পাগলা কুকুরের প্রাণরক্ষা করে না, তেমনি রাজ্যপালও কখনোই ফীলিক্স বোচ্চিচ্চিওকে ক্ষমা প্রদর্শন করবেন না বাচ্চিচ্চিও পরিবার অবশ্য উচ্চতর আদালতে আপীলের জন্য যত টাকা লাগে ঢালতে প্রস্তুত হয়ে আছে, তার কারণ এখন তারা ফীলিক্সকে নিয়ে রীতিমত গর্ববোধ করছে কিন্তু পরিণামে কি হবে তা আর জানতে বাকী নেই কারওঃ আইনের কচকচি শেষ হলে, তাতে কিছু সময় নেবে, ফলিক্স বোচিচ্চিও ইলেকট্রিক চেয়ারে মারা যাবে। এর কোন ব্যতিক্রম ঘটতে পারে না।
ঘটনাটা ডন কর্লিয়নির নজরে আনল টম হেগেন। বোচ্চিচ্চিওদের ডন আশা করছে, ডন কর্লিয়নি হয়তো হতভাগ্য যুবকের জন্যে কিছু করতে পারবেন। তিনিই হেগেনের কাছে এসেছেন। ডন কর্লিয়নি সংক্ষেপে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি তো আর জাদুকর নন। লোকে তার কাছে কেবলই অসম্ভব জিনিস চায়। কিন্তু পরদিন হেগেনকে তার অফিসে ডেকে পাঠিয়ে, ঘটনাটার খুঁটিনাটি সব কথা শুনলেন তিনি। সব কথা শুনে ডন কর্লিয়নি ওকে বললেন, বোচ্চিচ্চিও পরিবারের কর্তাকে আমার সাথে দেখা করার জন্যে উঠানে নিয়ে এসো।
এরপর যা ঘটল তাতে ডন কর্লিয়নির প্রতিভার সরলতাই প্রমাণ হয়। তিনি বোচ্চিচ্চিও নেতাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে ফলিক্স বোচ্চিচ্চিওর স্ত্রী পুত্র-পরিবারকে প্রচুর পরিমাণে মাসোহারা দেয়া হবে এবং তার জন্যে যত টাকা লাগবে তার সব এখনই বোচ্চিচ্চিও পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হবে। এর বিনিময়ে ফীলিক্সকে স্বীকার করতে হবে যে সলোযো আর পুলিশ ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কির খুনের জন্যেও সে-ই দায়ী।
এ ব্যাপারে অনেক খুটিনাটি ব্যবস্থা করতে হলো। ফীলিক্সকে এমনভাবে দোষ স্বীকার করতে হবে যাতে শ্রোতাদের মনে বিশ্বাস জন্মায়। সুতরাং হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার সমস্তই তার জানা দরকার। তাছাড়া, ক্যাপটেনকে ড্রাগসের ব্যবসার সাথে জড়াতে হবে। তারপর লুনা রেস্তোরাঁর সেই ওয়েটারকে রাজী করাতে হবে যাতে সে ফীলিক্স বৈচ্ছিচ্চিওকেই অপরাধী বলে সনাক্ত করে। খানিকটা সাহসের দরকার হবে তার। কারণ এর আগে আততায়ীর যে বর্ণনা সে দিয়েছে তার আমূল পরিবর্তন করা দরকার.এখন। ফলিক্স মাইকেলের চেয়ে অনেক বেশি বেঁটে আর মোটা। তবে সে-ব্যবস্থাও ডন কর্লিয়নিই করলেন। ফীলিক্সের ছেলেমেয়েরা সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে সেজন্যে আরও কিছু বেশি টাকা বরাদ্দ করলেন তিনি। তারপর বোচ্চিচ্চিও পরিবারকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন, আসলে তিনটে খুনের জন্যে মৃত্যুবরণ করতেই হচ্ছে ফীলিক্সকে, ক্ষমা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এই নতুন স্বীকৃতির ফলে আরও সুনিশ্চিত হবে মৃত্যুদণ্ড-এর বেশি কিছু নয়।
সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেল। আগেই দিয়ে দেয়া হলো টাকা। দণ্ডিত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হলো। নির্দেশ ও উপদেশ পেল সে। বিনা দ্বিধায় রাজী হয়ে গেল ফীলিক্স। দণ্ডিত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি সব কাগজেই ছাপা হলো বড় বড় হরফে। সমস্ত ব্যাপারটা সাফল্যমণ্ডিত হলো, কোথাও কোন খুঁত নেই। কিন্তু ডন কর্লিয়নি সবসময়ই সাআতিক হুশিয়ার মানুষ। ফালিক্স বোচ্চিচ্চিওর প্রাণদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তিনি। চার মাস কেটে গেল তারপর তিনি বাড়ি ফিরে আসার নির্দেশ পাঠালেন তার ছোট ছেলে মাইকেলকে।