৩.০৮ প্রেম ও নিয়ম
আর্যদের একটি শাখা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে (গ্রীস ও নিকটবর্তী ভূখণ্ডে) উপনিবেশ স্থাপন করতে আসে, তারও আগে সেখানকার প্রাচীন অধিবাসীদের ভিতর পৃজিত হতেন বহু নামে কীর্তিত এক দেবী। দেবীর এক তরুণ প্রেমিক ছিলেন, প্রতি শীতের প্রাক্কালে যাঁর ঘটত মৃত্যু আর প্রতি বসন্তে পুনর্জন্ম। গ্রীক ভাষায় এই প্রাচীন দেবীর নামান্তর হলো হেরা। নবাগত গ্রীকদের দেবতা জিউস। (ইনি আদিতে আকাশেরই প্রতীক, যদিও কালক্রমে খানিকটা খামখেয়ালী হয়ে ওঠেন।) তিন শ বছর জিউস হেরার পাণি প্রার্থনা করবার পর এদের পরিণয় সম্পন্ন হয়।
এই কিংবদন্তী আকস্মিক নয়। পৃথিবীর নানা দেশের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় এর। বিকল্প কাহিনী খুঁজে পাওয়া যায়।
ইতিহাসের প্রথম যুগে মানুষ যখন বিস্মিত চোখে বিশ্বের দিকে তাকিয়েছে, তখন থেকেই দুটি ধারণা তাকে অভিভূত করেছে। একদিকে সে মুগ্ধ হয়েছে প্রকৃতির সঞ্জীবনী শক্তিতে, ঋতু পরিক্রমায়, শীতের পর বসন্তের আগমনে, মৃত্যুকে জয় করে জীবনের নব নব আবির্ভাবে। এই বিচিত্র, বহুরূপধারিণী, রহস্যময়ী প্রাণশক্তিকে সে কল্পনা করেছে দেবীমূর্তিতে। এরই সঙ্গে একাত্ম হয়ে সে পৃথিবীর সঙ্গে আত্মীয়তাবোধকে ফিরে ফিরে আবিষ্কার করেছে।
আবার মানুষ চোখ তুলে চেয়েছে অমলিন, নিষ্কম্প আকাশের দিকে। তখন তার বামে ভূলোক, যেখানে নিত্যবিবর্তিত প্রাণের-গুপ্ত সঞ্চার; তার দক্ষিণে দুলোক, যেখানে সকল আলোড়নের উর্ধ্বে একটি শান্ত, শাশ্বত সত্য এবং গ্রহনক্ষত্রব্যাপ্ত বিশ্বজোড়া নিয়মের আভাস।
দ্যাবাপৃথিবীর যুগ্ম প্রতাঁকের ভিত্তিতে মানুষের প্রাচীন কল্পনা ধর্ম ও সমাজকে স্থাপন করতে চেয়েছে। যে-প্রেম অসংখ্য জন্ম ও মৃত্যুকে অতিক্রম করে কালের ধারায় প্রবাহিত আর যে-শাশ্বত নিয়ম সূর্য, চন্দ্র, গ্রহনক্ষত্রকে অমোঘ বন্ধনে ধারণ করেছে, এ দুয়ের একটি বৃহৎ সমন্বয়কে সে শতাব্দীসঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মঙ্গলময় বলে চিনেছে।
.
২
পরিবারে অথবা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করা সহজ। এজন্য কোনো সচেতন সাধনার প্রয়োজন হয় না। জৈব প্রবৃত্তি থেকেই আমরা রক্তের বন্ধনকে আত্মীয়তার বন্ধন বলে অনুভব করি।
কিন্তু পরিবারের পরিধিতে মানুষের সব প্রয়োজন মেটে না। প্রয়োজনেরই তাগিদে মানুষে মানুষে সহযোগিতাকে বিস্তৃততর ক্ষেত্রে স্থাপন করতে হয়। আত্মরক্ষার জন্য। মানুষ দল গঠন করে। আর্থিক প্রয়োজনে শ্রমবিভাগ ও পণ্যবিনিময় প্রসার লাভ করে।
আর্যদের নানা উপজাতি ভারতের উত্তর-পশ্চিম ভাগ থেকে ক্রমশ অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যতদিন নতুন বসতি স্থাপনের যোগ্য খালি জমির প্রাচুর্য থাকে ততদিন স্বত্ত্বাধিকার নিয়ে বিবাদ এবং তার মীমাংসার জন্য পুঙ্ক্ষানুপুঙক্ষ নিয়মের প্রয়োজন হয় না। যখন শোনা যায়, “যুদ্ধ বিনা নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী”, তখন অনুমান করা যায় যে, বসতি অনেকটা ঘন হয়েছে। বসতি ঘন হবার সঙ্গে সঙ্গে কর্মবিভাগ বৃদ্ধি পায়, পণ্যবিনিময় ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বুদ্ধের যুগে উত্তর ভারতে দূর দূর অংশের ভিতর। বাণিজ্য চলত। অশোকের যুগে শুধু উত্তরে তাম্রলিপ্ত থেকে তক্ষশীলা নয়, দক্ষিণে উজ্জয়িনী থেকে কাঞ্চী পর্যন্ত নিয়মিত বাণিজ্য চলেছে। এই বৃহৎ ও বহু কর্মে নিযুক্ত সমাজকে ধারণ করবার জন্য যে-ধর্মের প্রয়োজন ঘটে, তা কেবল কয়েকটি সরল নীতিবাক্যেই সমাপ্ত নয়, বরং আর্থিক ও সামাজিক জীবনে প্রযোজ্য নানাবিধ নিয়ম ও অনুশাসনে পল্লবিত।
সমাজ যতই বৃহৎ ও জটিল হয়, ততই একমাত্র প্রেম অথবা আত্মীয়তাবোধের দ্বারা সামাজিক সংহিত রক্ষা করা কঠিন, এমন কি অসম্ভব হয়ে ওঠে। কল্যাণবুদ্ধিকে তখন যুক্তির সাহায্যে রূপায়িত করতে হয় নিয়মের ভিতর। নিয়মই ন্যায়ের ভিত্তি। শুধু প্রেমের উপর ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না; কারণ প্রেম চঞ্চল, প্রেম নিরপেক্ষ নয়, প্রেম বিচারে অপটু। একথাও অবশ্য সমভাবে সত্য যে, নিয়ম যখন মঙ্গলবোধ থেকে ছিন্ন, তখন সেটা শুধুই বন্ধন কিন্তু কল্যাণবুদ্ধি কোনো ওল অনুরাগবিরাগের সঙ্গে সমার্থক নয়। একই কারণে জনমতের যে-দিকটা অস্থির তার সঙ্গেও ন্যায়কে যুক্ত করা যায় না। বিচারককে ‘ধর্ম অথবা নিয়ম মান্য করে বিচার করতে হয়। ধীর চিন্তার ভিতর দিয়ে যে-সামাজিক মঙ্গলবোধ স্থিতিলাভ করেছে তাই হতে পারে ন্যায়ের বাহক। ছোট গোষ্ঠীর জীবনে যদি-বা আত্মীয়তাবোধ প্রধান, বৃহৎ সমাজে প্রেমের পরিপূরক হিসাবে নিয়ম অপরিহার্য।
আদর্শ যাই হোক না কেন, বাস্তবে অবশ্য নিয়মও ত্রুটিহীন নয়। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার।
নিয়ম যদি শ্রেয় হয়, তবু তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়। যে-সব ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী, জাতি ও সম্প্রদায় নিয়ে বৃহত্তর সমাজ গঠিত, তাদের দৃষ্টিতে সামগ্রিক স্বার্থটা প্রায়ই স্পষ্ট নয়, নিজ নিজ খণ্ড স্বার্থ অনেক বেশি বাস্তব। ব্যক্তির ন্যায়বোধ অনেক সময়েই আত্মীয়তাবোধের পরিধিকে ছাড়িয়ে যায় না। আত্মীয়তাবোধ যখন পরিবারের গণ্ডিকে অতিক্রম করে তখনও সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের সীমা ছাড়ানো তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই মানুষের ইতিহাস জুড়ে দেখতে পাই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ। সমগ্র সমাজের মঙ্গলকে এর উর্ধ্বে স্থাপন করা কঠিন।
সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে বাস্তব স্বার্থের ঘাতপ্রতিঘাত দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা শুধু আংশিকভাবেই সত্য। সংঘাত ও সহযোগিতা দুয়েরই একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে। দুটি সম্প্রদায় যখন বাস্তব জগতে প্রতিবেশী নয়, তখন তাদের ভিতর দ্বন্দ্বের সম্ভাবনাও গুরুতর নয়। যেখানে বিরোধ ও সহযোগিতা দুয়েরই সম্ভাবনা আছে, সেখানে সাম্প্রদায়িক বুদ্ধির বিচারে বিরোধের দিকটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িক চেতনায় বাস্তবের বিকৃত প্রতিফলনই দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ। এ কথাটা আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। ভারত ও পাকিস্তানের ভিতর বৈরিতার কারণ এই নয় যে, আমাদের ভিতর সহযোগিতার বাস্তব ভিত্তি অনুপস্থিত। ইজরায়েল ও আরব দেশের ভিতর সহযোগিতা স্থাপিত হলে সকলেরই মঙ্গল। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষই এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক।
একথা যদি বিগত দু’শ বছরের যুক্তিবাদী আন্দোলনের পর বিশ শতকেও সত্য হয়, তবে প্রাচীন ইতিহাসে উপজাতীয় আনুগত্য যে বৃহত্তর সমাজ গঠনের পথে বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যে-নিয়ম সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য। প্রয়োজন তাকেও খণ্ডদৃষ্টিতে মঙ্গলদায়ক বলে চিনে নেওয়া কখনও সহজ ছিল না। তা ছাড়া মানুষের ভিতর একটা বন্য প্রকৃতি আছে যার কাছে সভ্যতাকেই শৃঙ্খল মনে হয়। আর এজন্যই নিয়মের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়েছে দণ্ডের। রাজধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজদণ্ড।
অথচ শুধু দণ্ড দ্বারা দীর্ঘদিন দেশ শাসন করা যায় না। নিয়মের প্রতি একটা সাধারণ আনুগত্য সৃষ্টি হলে তার ব্যতিক্রমকে দণ্ডিত করা যায়। তা যদি না হয়, নিয়মকে যদি শুধু দণ্ডের জোরেই চাপানো যায়, তবে সেটা হয়ে ওঠে অত্যাচার। এই ভয়ের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
সমগ্র ভারতকে যুদ্ধের দ্বারা জয় করবার শক্তি অশোকের ছিল। কিন্তু তিনিও একদিন আবিষ্কার করলেন যে ‘ধর্মবিজয়’ ছাড়া গতি নেই। যে-নিয়ম সমগ্র সমাজকে ধারণ করতে সক্ষম তাকে মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ধর্মবিজয়। বৌদ্ধধর্মকে অশোক তাঁর এই বৃহৎ পরিকল্পনায় সহায়স্বরূপ পেয়েছিলেন।
নিয়মের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য সৃষ্টির পথে দুটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপে আমরা যুক্তি দ্বারা খণ্ডস্বার্থকে অতিক্রম করি; জানি, যে-নিয়ম সকলের প্রতি প্রযোজ্য হলে সকলের মঙ্গল সেটাই সুনিয়ম এবং সেই নিয়মকে মান্য করাই প্রত্যেকের কর্তব্য। সেই নিয়ম ব্যক্তির কাছে প্রেয় না হলেও তাকে শ্রেয় জ্ঞানে অনুসরণ করা উচিত। এটা যুক্তির কথা। কিন্তু যে-সত্য শুধুই যুক্তিগ্রাহ্য, হৃদয়গ্রাহ্য নয়, তার প্রতি আমাদের আনুগত্য প্রবল হয় না। তাই দ্বিতীয় ধাপে মঙ্গলবোধৰ্কে অনুভূতির সঙ্গে অর্থাৎ বৃহত্তর প্রীতির সঙ্গে যুক্ত করতে হয়। পৃথিবীর সকল মহৎ ধর্মের কেন্দ্রে যদি কোনো সত্যবস্তু থাকে তবে তা হলো যুক্তির সঙ্গে যুক্তির অতীত ‘অহেতুকী’ প্রীতি অথবা করুণার আশ্চর্য মিশ্রণ। যুক্তি দিয়ে। আত্মত্যাগ করা কঠিন। ধর্মের যেটা মহত্তর দিক তার স্পর্শে মানুষের ভিতর যে-বন্যতা আছে সেটাই আবার তাকে আত্মত্যাগী করে তোলে।
ছোট গোষ্ঠীজীবনের বাইরে জৈবিক প্রীতিভাবকে জাগ্রত রাখা কঠিন। ধর্ম যদিও বসুধাকে কুটুম্বজ্ঞান করবার আহ্বান জানিয়েছে তবুও প্রাচীন যুগে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা কর্ম প্রধানত ছোট গোষ্ঠীর ভিতরই আবদ্ধ ছিল। সেই ক্ষুদ্র আধারেই। রীতিনীতি রচিত হয়েছে। নিয়ম কঠিন হলেও সেটা বোঝা হয়ে ওঠেনি, বিবেকের দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়নি। প্রাচীন সমাজব্যবস্থার স্থায়িত্বের এটাই একটা প্রধান কারণ। এ দিক থেকে আধুনিক সমাজের সমস্যা অনেক বেশি জটিল।
.
৩
কোনো সমাজে যে-সব কর্তব্য ও অধিকার স্বীকৃতিলাভ করে তার মূলে একটা ক্ষমতার কাঠামো থাকে। অর্থাৎ যে ক্ষমতাবান তার অধিকারই প্রাধান্যলাভ করে। কথাটা অন্যভাবে রাখা যেতে পারে। সমাজে যদি কোনো সর্বস্বীকৃত কর্তব্য ও অধিকার না থাকতো, নিয়ম বলে কিছুই যদি গ্রাহ্য না হতো, তবে সেই অবস্থায় ক্ষমতাবান বেশি আদায় করে নিত এবং দুর্বল দুর্বলতার দণ্ড হিসাবেই বেশি ছাড়তে বাধ্য হতো। নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হলেও কিন্তু এই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয় না। বরং নিয়মটা এমনভাবেই তৈরি হয় যে ক্ষমতাবানেরই সুবিধা থাকে। এ যদি না হয় তবে নিয়মকে কার্যকরী করা যায় না।
এ থেকে কিন্তু অনুমান করা ভুল হবে যে, নিয়মের সঙ্গে সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলের কোনো যোগই নেই। আক্রমণকারী দস্যুর দল হয়তো দেশে একদিন রাজা হয়ে বসে। কিন্তু দস্যুর সঙ্গে দেশের সম্পর্ক আর রাজাপ্রজার আচরণবিধি এক নয়। রাজার কাছে রাজস্বের বদলে প্রজা শান্তি ফিরে পায়। অরাজকতার চেয়ে শ্রেয় জেনেই প্রজা এই ব্যবস্থা মেনে নেয়। গৃহস্থের প্রতি ডাকাতের কোনো কর্তব্য নেই; প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য আছে। ধীরে ধীরে শক্তিও প্রীতিবোধের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সে যুগে রাজাকে প্রজাবৎসল হতে বলা হয়েছে। ধর্মের এই অনুশাসনের কোনো প্রভাব ছিল না মনে করার। কারণ নেই। রাজামাত্রই সমান নিষ্ঠুর ছিলেন না। ভালো রাজা পথঘাট নির্মাণে, খাল ও সরোবর খননে, ধর্মশালা ও চিকিৎসালয় স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রজা সুখে আছে কি না দেখবার জন্য রাজা ছদ্মবেশে ভ্রমণে বেরিয়েছেন, এমন উদাহরণও তো আছে। রাজাকে ধর্মের রক্ষক বলা হয়েছে। তিনি ধর্মের বিধান অনুযায়ী রাজ্যশাসন করবেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সে যুগের রক্ষাকবচ ধর্ম। যেখানে স্বৈরাচার সেখানে শৃঙ্খলা নেই, সবই অনিশ্চিত; অতএব সেখানে প্রজার অধিকার বলেও কিছু নেই। ধর্ম রাজার অগ্রাধিকার স্বীকার করে নিয়েও তাঁর উপর কর্তব্য আরোপ করেছে; আর রাজার কর্তব্যই। প্রজার অধিকারের ভিত্তি। রাজনীতিতে এটাকেই আমরা নিয়মের রাজত্বের আরম্ভ বলে ধরতে পারি। রাজা ধর্মভ্রষ্ট হলে প্রজারা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করবে এমন কথাও প্রাচীন শাস্ত্রে আছে।
বিষয়টাকে আরও একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। সমাজে সকলের কর্তব্য ও অধিকার নিয়ম দিয়ে বেঁধে দিলেই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্ল্যাটোর আদর্শ সমাজব্যবস্থায় সাম্য ছিল না। কিন্তু গ্রীক দার্শনিক যুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। অতএব অসাম্যের সপক্ষে তাঁকে যুক্তি বিস্তার করতে হয়েছে। যে-অসাম্য নিয়মের দ্বারা স্বীকৃত তার সঙ্গে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের কোনো যোগ আছে কি না এটা বিচারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের স্থিতি ও প্রগতির জন্য অসাম্যের প্রয়োজন হতে পারে; মনে রাখা ভাল যে, শুধু প্ল্যাটো অথবা অ্যারিস্টটলই নন, মার্ক্স-এঙ্গেলসও প্রাচীন গ্রীক সমাজে ক্রীতদাস প্রথার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছিলেন। অসাম্য মাত্রই অযৌক্তিক না হতে পারে; কিন্তু যে-মুহূর্তে আমরা এই প্রশ্নটাকে যুক্তি দ্বারা বিচারের বিষয় বলে স্বীকার করে নিই সেই মুহূর্তেই প্রগতির একটা নতুন দিগন্ত উদঘাটিত হয়ে যায়। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন সমাজের স্বীকৃত নিয়ম নতুন করে বিচার্য হয়ে ওঠে; এবং যে-অগ্রাধিকার একদিন সমর্থনযোগ্য মনে হয়েছিল সেটাও নতুন পরিস্থিতিতে ত্যাজ্য মনে হওয়া সম্ভব। সমাজে যাঁরা কর্তৃস্থানীয় তাঁরাও বিশ্বাস করতে চান যে তাঁদের কর্তৃত্ব যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। শাসকগোষ্ঠী যখন যুক্তির সমর্থন হারান তখন তাঁদের নৈতিক দুর্বলতা পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আঠার শতকে ফরাসী দেশে দার্শনিক সমালোচকদের যুক্তি পুরনো সমাজব্যবস্থার ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল।
ক্ষমতার যে-কাঠামোর চারদিকে প্রতিষ্ঠিত সমাজের কর্তব্য ও অধিকার বিশেষ আকার গ্রহণ করে সেই কাঠামো অপরিবর্তনীয় নয়। কোনো এক যুগে অশ্বারোহী আক্রমণকারীরা ছিল অপ্রতিরোধ্য; অর্থবলে বলীয়ান রাজ্যও এই অশ্বারোহীদের পদানত হয়েছে। পরবর্তী যুগে অর্থবল বহুক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভ করেছে। বর্তমান যুগে সাংগঠনিক শক্তির গুরুত্ব ক্রমশ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যাঁরা শিল্প সংগঠনে, শ্রমিক সংস্থায়, প্রশাসনিক যন্ত্রে অথবা দলীয় রাজনীতিতে উচ্চস্থানের অধিকারী তাঁরাই ক্ষমতাবান। সংগঠন ও ধ্যানধারণার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিয়ম ও শাসনব্যবস্থার শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথ খোলা রাখা গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। যুক্তি ও নিয়মের শাসনের সঙ্গে গণতন্ত্রের যোগ এইখানে।
.
৪
নিয়মের শাসন চাই, আবার সেই নিয়মের পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ উপায়ও চাই। কিন্তু এইসব শর্ত যদি পূর্ণ হয়, কোনো সমাজ যদি নিয়মশাসিত হয় এবং সেই নিয়ম যদি গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিবর্তনীয় হয়, তবেই কি সমাজের কাছে আমাদের সমস্ত প্রত্যাশা। পূর্ণতা লাভ করে?
এ প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আধুনিক শিল্পপ্রধান সমাজের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্রয়োজন।
এ যুগে প্রগতি বলতে আমরা যা বুঝি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি তার অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু এই প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজজীবনে ও মানুষের মনোজগতে কয়েকটি সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এই রকম একটি সমস্যা সম্বন্ধে প্রথমে কিছু বলব। আধুনিক শিল্পের ঝোঁক বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের দিকে এর একটা সরল বিশ্লেষণ ইংলণ্ডে শিল্পবিপ্লবের প্রারম্ভে স্কট অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের লেখায় স্থান পেয়েছে। বাজার যতই প্রসার লাভ করে ততই শ্রমবিভাগের সম্ভাবনা বাড়ে। শ্রমবিভাগের সঙ্গে সঙ্গে আবার যন্ত্রের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। এরই অন্যতম ফলস্বরূপ বৃহদায়তন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিকে ঝোঁক দেখা দেয়। আধুনিক যুগে টেলিফোন ও অন্যান্য যোগাযোগের ব্যবস্থার উন্নতি এবং যান্ত্রিক গণকের ব্যবহারের ফলে একটি কেন্দ্র থেকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সুবিধা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন শিল্প প্রতিষ্ঠানে তেমনই শাসনযন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা রোধ করা কঠিন হয়ে উঠেছে।
এরই ফলে আধুনিক আমলাতন্ত্রের উদ্ভব। আধুনিক আমলাতন্ত্রের পিছনে একটা ‘গণতান্ত্রিক’ ও যুক্তিবাদী মন সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে জমান সমাজবিজ্ঞানী। ম্যাক্স ওয়েবরের ধ্যানধারণা প্রণিধানযোগ্য। আমলাতন্ত্রের মূলে আছে এক ধরনের যান্ত্রিক যুক্তিবাদ। কোনো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাকে নিয়ম দিয়ে বাঁধতে গেলেই আমলাতন্ত্র অনিবার্য হয়ে ওঠে। আমলাতন্ত্র একবার শক্তিমান হয়ে উঠলে তার আতিশয্যও রোধ করা কঠিন। বৃহৎ প্রতিষ্ঠান থাকবে অথচ আমলাতন্ত্র থাকবে না এটা আশা করাই অযৌক্তিক।
আমরা আগেই দেখেছি যে, সমাজজীবন অতীতে যে-সব নিয়ম দিয়ে বাঁধা ছিল তাতে যুক্তি ও ধর্মরহস্যের সংমিশ্রণ লক্ষণীয়। মনুর বিধানে এবং সমস্ত মধ্যযুগ ধরে ধর্মরহস্যের দিকটাই প্রধান ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যুক্তির দিকটা প্রকট। আধুনিক যুগের ঝোঁকটাও ঐ দিকে। যে-আমলাতন্ত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত তাতে প্রেমের বা ধর্মরহস্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। একটা জটিল যান্ত্রিক যুক্তির এখানে অটল আধিপত্য। ব্যতিক্রম শুধু স্বজনপোষণে।
আমলাতন্ত্র যে-সব নিয়ম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত তা যতই যুক্তিসঙ্গত, এমন কি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্ধারিত হোক না কেন, সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে তার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা কঠিন; এবং তার সঙ্গে একাত্মতা দূরে থাক, কোনো প্রকার ঈষদুষ্ণ সহানুভূতি বোধ করাও প্রায় অসম্ভব। আমলাতন্ত্রের দ্বিতীয় ফল ক্ষমতার অসাম্য। আয়ের অসাম্য দিয়ে একে মাপবার চেষ্টা বৃথা। বহুলোকের ভাগ্য নির্ধারণের শক্তি আজ অল্প কয়েকজনের হাতে যতটা কেন্দ্রীভূত এমন সম্ভবত কখনও ছিল না। অথবা কথাটা হয়তো অন্যভাবে বলা ভালো। আমলাতন্ত্রের এমন একটা প্রবল ও অনড় নৈর্ব্যক্তিক সত্তা আছে যার সামনে। আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অত্যন্ত অসহায়। এরই ফলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভিতর প্রাণের যোগ ছিন্ন হয়ে যায় এবং ব্যক্তি যন্ত্রের অর্থাৎ যান্ত্রিকতার দাসে পরিণত হয়। এই যান্ত্রিকতার সঙ্গে ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছার এমনই একটা গভীর চরিত্রগত বিরোধ আছে যে, কোনো উপায়েই এ দুয়ের ভিতর মৌলিক সামঞ্জস্যবিধান করা যায় না।
শিল্পের রাষ্ট্রীয়করণের সাহায্যে এ সমস্যা দূর হয় না। রাষ্ট্রীয়করণের ফলে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হবারই সম্ভাবনা। আর্থিক পরিকল্পনা সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয়করণের প্রয়োজন অস্বীকার না করেও একথা বলা চলে। আর্থিক পরিকল্পনার পিছনে একটা যুক্তিবাদী মন আছে সন্দেহ নেই। একটা সমগ্র দেশের সম্পদ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কি ভাবে নিয়োগ করা উচিত, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে বিকেন্দ্রিত খণ্ডদৃষ্টির চেয়ে কেন্দ্রস্থিত সার্বিক দৃষ্টিই কি শ্রেয় নয়? তবু সমস্যা থেকে যায়। নির্ভুল পরিকল্পনাও নীচের তলার কর্মকেন্দ্রগুলির কাছে অত্যন্ত দূরের জিনিস মনে হতে পারে এবং এই প্রাণস্পর্শহীন নির্ভুলতায় তাদের উৎসাহ জাগ্রত নাও হতে পারে। এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে যুগোশ্লাভিয়ার নিম্নতন উৎপাদন কেন্দ্রগুলির হাতে নিজ নিজ পরিকল্পনা রচনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে; শিল্পপরিচালনা শ্রমিকদের নির্বাচিত সংস্থার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; আঞ্চলিক স্বয়ংভরতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ সবই হয়তো সমর্থনযোগ্য। তবু ওদেশে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা আজও প্রবল।
সরকারী সোভিয়েত সাহিত্য বহুদিন যাবৎ মূল সমস্যাটাকে গায়ের জোর অস্বীকার করে সাম্যবাদী বাস্তবতার নামে এক অবাস্তব সার্ধকতার কপট বাণী প্রচার করেছে। এই কপটতার বিরুদ্ধে আজকের সোভিয়েত লেখকেরা ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে বাস্তব জীবনের অতিরঞ্জন যদি ঘটে থাকে তবে তা প্রধানত বিপরীত অর্থে। আদর্শের ভাবমুকুর সাহিত্যিক তুলে ধরেছেন ‘কুৎসিত’ বাস্তবের সামনে, জীবনের অসম্পূর্ণতার বিরুদ্ধে শিল্পীর প্রতিবাদস্বরূপ।
কবিতায় মানুষ খোঁজে নতুন ভাষা। রাজনীতিতে সে এক পা পিছিয়ে। পুরনো ধ্বনি কণ্ঠে নিয়ে মানুষ নতুন সংগ্রামে নামে। উনিশ শতকে সাম্যবাদীদের মনে হয়েছিল যে, তাঁদের সংগ্রামটা মূলত একটা বিশেষ মালিকানা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সেই ধ্বনি নিয়ে দিকে দিকে আজকেও চলছে যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রাণের প্রতিবাদ।
এ বিষয়ে গান্ধী মৌলিকতা দাবী করতে পারেন।
আধুনিক যুগে যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সবচেয়ে স্মরণীয় নেতা নিঃসন্দেহে গান্ধী। যান্ত্রিকতা বলতে যন্ত্রের ব্যবহার বোঝায় না, বরং এ যুগে যন্ত্রের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে প্রাণস্পর্শহীন যে যান্ত্রিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তারই নাম যান্ত্রিকতা। এরই বিরুদ্ধে গান্ধীর বিদ্রোহ। তিনি সমাজকে গড়তে চেয়েছেন সেই সব ছোট ছোট অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর ভিত্তিতে, যেখানে মানুষ মানুষকে প্রতিবেশী বলে চেনে। গান্ধীদর্শনে এই ছোট গোষ্ঠীজীবনেরই অন্য নাম ‘গ্রাম’। বর্তমান গ্রামীণ সমাজকে নয়, এই আদর্শ ‘গ্রাম’কেই তিনি বাঁচাতে চেয়েছেন। নেহরুকে একটি পত্রে তিনি forze colar “You must not imagine that I am envisaging our village life as it is today. The village of my dreams is still in my mind.” যন্ত্র বলেই তিনি যন্ত্রের বিরোধিতা করেননি। কিন্তু সেই যন্ত্রকেই তিনি স্থান দিতে চেয়েছেন, যাকে গ্রহণ করতে গিয়ে এই আদর্শ গ্রামের মৃত্যু হবে না। ব্যতিক্রম হিসাবে অবশ্য কখনও কখনও আরও বড় যন্ত্রকে তিনি স্থান দিতে রাজী হয়েছেন এবং সেই সব যন্ত্রকে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে রাখবার নির্দেশও দিয়েছেন; কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম বলেই গ্রাহ্য। রাষ্ট্রের প্রাধান্য তিনি কখনই মানতে চাননি। আর এ কথাও তিনি জানতেন যে, হিংসার পথে আর যেখানেই পৌঁছানো যাক, যে-সমাজ তাঁর কাম্য সেখানে যাওয়া যাবে না। অতএব সে পথ তিনি বিপথ বলেই ত্যাগ করেছেন। তিনি নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন যে, সেই নিয়মই বাঁচায়, যাকে হৃদয়ে সত্য বলে গ্রহণ করা। যায়। যান্ত্রিক সভ্যতার নিয়মকে মনে প্রাণে সত্য বলে অনুভব করা যায় না বলেই তিনি তাকে পরধর্ম বলে ত্যাগ করেছেন।
গান্ধীর ‘গ্রাম’ভিত্তিক সমাজের আদর্শকে আমরা অনেকেই অবাস্তব বলে উপহাস করেছি। আমরা বলেছি যে, এ যুগের শিল্প ও বিজ্ঞানের ঝোঁক অন্য দিকে। বলেছি, ইতিহাসের এই ধারাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। উত্তরে গান্ধীজী বলতে পারতেন যে, এই যান্ত্রিক সভ্যতাকে মেনে নিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের ভিতর, প্রেম ও নিয়মের ভিতর, সামঞ্জস্য স্থাপন করা যাবে এই আশাও সমান অবাস্তব। অথচ এই অসামঞ্জস্যকে অনপনেয় বলে স্বীকার করে নেওয়াই কি সহজ?
শিল্পোন্নত দেশগুলিতে আজ তরুণের যে-বিদ্রোহ সেটাও মূলত এই অসামঞ্জস্যেরই বিরুদ্ধে। তবে আদর্শকে রূপায়িত করার মূল শর্ত এঁরা গান্ধীর মতো গভীরভাবে ভেবে দেখেননি, অথবা সেই সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস এঁদের নেই। বর্তমান সভ্যতার উপকরণ এঁরা ত্যাগ করতে রাজী নন; কিন্তু এরই ভিতর এঁরা জটিল নিয়মের বন্ধন থেকে সেই মুক্তির সন্ধান করছেন সরল আত্মীয়তাবোধের মাঝেই শুধু যাকে লাভ করা যায়। এ আশা পূর্ণ হবার নয়, শত আক্ষেপবিক্ষেপেও নয়। তবু এই বিদ্রোহের আতিশয্যে একদিকে যদি থাকে অপরিণত বুদ্ধির প্রকাশ, অন্যদিকে আছে এ যুগের তরুণের হৃদয়ে চিরকালের মনুষ্যত্বের পরিচয়। এই টানাপড়েনেই রচিত হবে ভবিষ্যতের ইতিহাস।
আধুনিক সমাজের সংকট শুধু অর্থনীতি অথবা রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। সংশয়বাদী যুক্তি ও হৃদয়হীন আমলাতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের যে-বিস্মিত বিপন্নতাবোধ, তার। সম্পূর্ণ পরিচয় নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। কারণ জীবন ও ভালোবাসা সম্বন্ধে মানুষের গভীরতম প্রত্যয় ও প্রত্যাশা আজ আক্রান্ত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ যুগের সমস্যাকে বুঝতে হবে।
.
৫
মানুষের একটা দিক আছে যেখানে সে জগতে জয় আকাঙ্ক্ষা করে সে জয় করতে চায় জড় জগৎকে, আধিপত্য বিস্তার করতে চায় অপর মানুষের ওপর। উদ্যোগী পুরুষরূপে সে তার শৌর্য, শ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে পরিপার্শ্বকে নিত্য নতুনভাবে গড়ে গেলে।
তার আর একটা দিক আছে যেখানে সে সবাইকে এবং সবকিছুকে আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধতে চায়। যাকে সে জয় করেছে, হঠাৎ কখনও আবিষ্কার করে, তাকে আপন করতে পারেনি। যে-পৃথিবী সে সৃষ্টি করেছে, একদিন অনুভব হয় যে, তাকে গৃহ করে তোলা। হয়নি। নিজের সৃষ্টির মাঝখানে মানুষ প্রবাসী।
মানুষকে তাই বাঁচতে হয় একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন স্তরে। সে বর্তমানের মানুষ। কালের সীমাকে স্বীকার করেই তাকে চলতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তের নিয়মকে মেনে নিলেই তার মুক্তি সম্পূর্ণ হয় না। স্বপ্ন এবং বাস্তবের ঘাতপ্রতিঘাতে মানুষের ইতিহাস বিবর্তিত। পল্লী ও নগর (১৯৭৩)