আপা – মমতাজ মুফতি
মাঝে মাঝে আপার কথা মনে হয়। ভাবতে চাইনে তার কথা; তবু মনে পড়ে। মনে পড়ে, আর চকচক করে ওঠে দুটি চোখের পাতা।
পষ্ট মনে পড়ে একটি সন্ধ্যার কথা। রসুইঘরে আমরা তিনজন বসেছিলাম– আমি, আম্মা আর আপা। হঠাৎ বদু সেখানে এসে হাজির ছুটতে ছুটতে। বদুর বয়স ছিল ছয়, কি বড় জোর সাত। বদু এসে আম্মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘আম্মি, আমাকে একটা বউ দিতে হবে, আমি বিয়ে করব।’
আম্মা হেসে ফেললেন, তারপর সেই হাসিমুখেই বদুকে প্রশ্ন করলেন, ‘এক্ষুনি চাই? বেশ, বদু, তোমাকে তোমার আপার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দি, কি বল!’
‘ধ্যেৎ!’ বদু মুখ ঝাঁকালো। বলল, ‘না, না, আপা নয়।’
আম্মা তাজ্জব হওয়ার ভান করে বললেন, ‘অ্যা, কেন বদু, আপা নয় কেন? তার দোষ কী?’
বদুর সমস্ত মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, ‘আমি সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব।’
আম্মার বোধ করি খুব মজা লাগছিল। আপার দিকে তিনি তাকালেন একটু মৃদু হেসে, তারপর বদুকে লক্ষ করে বললেন, ‘কিন্তু তোমার আপা ভারী ভালো মেয়ে তাই নয় বদু?’
বদু সেকথা কানেই তুলল না। বরং সে বলল, ‘শুনবে আম্মা, আপা কেমন মেয়ে?’ বলেই সে চারদিকে চোখ ফেরাতে লাগল, তারপর হঠাৎ চোখ পড়ল চুলোর পাশে ফেলে-রাখা একটা পোড়া কাঠের দিকে। বদু হঠাৎ একটা আঙুল তুলে সেটা দেখিয়ে বলে ফেলল, ‘এই যে, ঠিক ওটার মতো।’ তার পরেই সে তাকাল উপরের দিকে; মাথার উপর জ্বলছিল বিজলিবাতি। এবার জ্বলন্ত বাল্বটা দেখিয়ে সে বলতে লাগল, ‘সাজো বা’জি হচ্ছে ঠিক ওইরকম, ওই যে।’
সবাই আমরা হো হো করে হাসছি, ঠিক এই মুহূর্তে ঘরে ঢোকেন তাসাদ্দক ভাই। আম্মার ইচ্ছে হল তাসাদ্দক ভাইকেও আমাদের আনন্দের শরিক করে তুলতে; তাই তিনি হাসিমুখে তাঁকে বললেন, ‘তাসাদ্দক, বদুকে জিগ্যেস কর তো, ওর আপা কেমন?’
এদিকে তাসাদ্দক ভাই ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আপার মুখ ঘুরে গেছে উল্টো দিকে, চুলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ আপা রান্না নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
তাসাদ্দক ভাই বদুকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যাঁ, বল তো, আপার কথা কী বলছিলে?’ বদু তৈরিই ছিল। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই সে সেই পোড়া কাঠটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘দেখাচ্ছি।’ কিন্তু সেটা হাতে পাওয়ার সুযোগ ঘটল না তার। আপা খপ্ করে তার হাতটা ধরে ফেলে মুখে তার হাতচাপা দিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল, ‘ছিঃ বদু, এসব কী?’
অসহায় বদু তখন ছটফট করতে লাগল। আম্মা তখন বলে উঠলেন, ‘কী বোকা ছেলে! সত্যি বদু, ওটাতে হাত দেওয়া ঠিক নয়, বুঝলে? কে জানে, ওর ভেতরে হয়তো আগুন আছে।’
‘হুঁ, সব তো পুড়ে গেছে।’ বদু কান্নার সুরে প্রতিবাদ করল আম্মার কথার। আম্মা নরম সুরে আবার বললেন, ‘না বদু, সবসময় বোঝা যায় না। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে বটে পুড়ে গেছে; কিন্তু ভেতরে অনেক ফুলকি থাকতে পারে।’
আম্মার কথায় বদুর চোখ দুটো একটু বড় হয়ে উঠল বটে, কিন্তু মন তার সায় দিচ্ছিল না তাঁর কথায়। তাই সে আপাকেই এবার জিগ্যেস করল, ‘হ্যাঁ আপা, সত্যি ওর মধ্যে আগুন আছে? বল না!’
আপার ঠোঁট দুটো একটু যেন কেঁপে উঠল। তারপর আস্তে, খুব আস্তে কেবল এইটুকুই বলল, ‘কী করে জানব, বল।’ এইটুকু বলতেই আপা যেন ঘেমে উঠল, গলা তার বুজে এল। হঠাৎ রাশি রাশি কাঠ গুঁজে দিতে লাগল চুলোর ভেতর, যদিও তার দরকার ছিল না কিছু।
.
আজ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি আপাকে, তখন বুঝিনি। মাঝে মাঝে বলতাম, ‘আপা, সবসময় তুমি চুলোর পাশে। কেন বসে থাক?’
আপা একটু কেবল হাসত, তারপর এমন করে আমার দিকে তাকাত একবার, যেন বলতে চায়, ‘তুই একটা বোকা।’ পরমুহূর্তে আবার সে রান্নার কাজে মন দিত। সবসময় তাকে মনে হত ভারি ব্যস্ত। ব্যস্ত থাকত ঘর-গেরস্থালীর কাজ নিয়ে। সবাই তাকে কিছু না কিছু করতে দিত। এক-এক করে মেশিনের মতো তাকে সেসব কাজ করে যেতে হত। এদিকে বদু চেঁচাচ্ছে, ‘আপা, আপা, আমার নাশতা-পিরিচটা নিয়ে এসে শিগগির।’ ওদিকে আব্বা বলছেন, ‘মা সাজেদা, চা-টা কি হল না এখনো?’ আবার আম্মা এসে বলছেন, ‘সাজেদা, ধোপাটা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, কাপড়গুলো দিয়ে দাও তো!’
আপার কিন্তু বিরক্তি নেই। সবকিছুই সে এক-এক করে করে যাচ্ছে। একটা কথা নেই মুখে। আমি ভালো করেই জানতাম, আপার সে ক্ষমতা আছে, সবকিছু সে এমনি গুছিয়ে করে যেতে পারে; করেও। কিন্তু তবু আশ্চর্য, তার দিকে তাকিয়ে কেউই বুঝতে পারত না, সে আদৌ কোনো কাজ করছে। এক-এক সময় আমারই মনে হত, সে বুঝি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে, অথচ আসলে তা নয়। একদিক থেকে আর-একদিকে চোখ ফেরাতেই তার যেন এক শতাব্দী লেগে যাবে, এমনি মনে হত তার দিকে তাকিয়ে। আপা যখন হাঁটত, মনেই হত না, সে হাঁটছে।
এছাড়া আপাকে কখনো সশব্দে হাসতে দেখিনি। মাঝে মাঝে নীরবে সে হাসত, দুটো ঠোঁটের প্রান্ত একটুখানি খুলে যেত, মৃদু হাসির ঝিলিক লাগত চোখে-মুখে, এদিকে চোখের পাতা আসত বুজে। আশ্চর্য সুন্দর সে হাসি– ছোট্ট নদীর পাড় ছেয়ে লুটিয়ে পড়েছে মৃদু জ্যোৎস্না, আর সেখানে যেন গভীর সুরে বেজে চলেছে সিন্ধি ভৈরোঁ। কিন্তু আমি তখন কিই-বা বুঝতাম জ্যোৎস্নার, সিন্ধি ভৈরোরই-বা কী অর্থ ছিল আমার সে জীবনে। আমার কেবল মনে হত, বোবার মতো বসে থাকা ছাড়া আপা আর কিছুই করতে পারে না; আপা জানে না, কেমন করে হাসতে হয়। মনে হত, কেউ যেন তাকে ধাক্কা মেরে দুনিয়ার বাইরে ফেলে রেখেছে।
আর ওদিকে পাশের বাড়ির সাহেরা! কী চমৎকার নেতিয়ে নেতিয়ে চলে সে। যেন ‘দাদ্রা’ তালে নেচে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। তাছাড়া আমার চাচাতো বোন সাজোঁ বাজি! আমারও ইচ্ছে করত, সবসময়ই আমি তার পাশে পাশে থাকি। আহা, সে যখন সুন্দর করে ঘাড় বেঁকিয়ে কাউকে বলে, ‘ইয়েস্ প্লিজ্’ বা কাউকে যখন গানের সুরে সে প্রশ্ন করে, ‘ইজ্ন্ট ইট্ ডার্লিং?’– তখনো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তার পায়ে লুটিয়ে পড়তে মন চায়।
সাহেরা আর সুরাইয়া দুই বোন। হাসিতে-হুঁল্লোড়ে ওদের বাড়িটা যেন সবসময় কী মধুর বাজনা বাজিয়ে চলে। এক-এক সময় মনটা একেবারে অস্থির হয়ে উঠত, ভাবতাম, ওহ্ যদি আমাদের বাড়িটাও সবসময় অমনি হাসি-হুঁল্লোড়ে ভরে থাকত! কিন্তু আমাদের বাড়িতে… উহ্, বুড়ির মতো ঘাড় গুঁজে থাকা বোবা মেয়ে আপা, আম্মার অনবরত ফরমায়েশের ঝুক্কি আর আব্বার মুখে হুঁকোর নলে সারাদিন ধরে গড়গড় আওয়াজ, এই ছিল আমাদের আনন্দের উপকরণ। রাগে আমার গা জ্বলছিল, যেদিন আব্বা আম্মাকে বলছিলেন, ‘দেখ সাজেদার মা, আমার মনে হয়, সাহেরাদের বাড়িটা পেয়ালাবাটিতে ভর্তি, সারাদিনই তো ঝন্ঝন্ খখন্ আওয়াজ! আর নয় তো কেবল হাসি আর হাসি! আচ্ছা, বাড়িটাকে কি ওরা একটা মেলা মনে করে?’
‘কী জানি, ওসব অপরের ব্যাপারে আমাদের মাথা গলাবার দরকারটা কী শুনি?’ আম্মা বিরক্ত হয়েছেন তা বোঝা গেল। কিন্তু আব্বা তবু বললেন, ‘না, না, সেকথা আমি বলিনি। আমি বলছিলাম কী, ওরকম বয়সে মেয়েদের একটু শান্ত থাকা দরকার। সারাদিন অত হৈ হৈ করলে বাইরের লোক জানতে পারে, অমুক বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে; আর সেটা কী– বুঝতেই তো পার। তবে হ্যাঁ, আমাদের সাজেদা কিন্তু তেমন মেয়ে নয়, কী বল?’ বলতে বলতে দেখা গেল আব্বার চোখেমুখে গর্বিত পিতার আনন্দোচ্ছ্বাস।
কথাগুলো শুনে অবধি আমার কিন্তু রাগে মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল : ‘হুঁ, তা তো বটেই, একেবারে হেশতের হুর। তাঁরা তো ভাববেনই ওকথা। নিজের মেয়েকে কে আর খারাপ বলে ভাবতে পারে! কিন্তু আমিও তো তাঁদের মেয়ে!’
আমার ইচ্ছে হল এক্ষুনি রান্নাঘরে ছুটে যাই আর সেই হাবা হুরপরীটার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝগড়া করে গায়ের ঝাল মেটাই। সারাদিন কিছু খেলাম না আমি। কারো সামনে যেতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। সেদিন যেন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম : আব্বা কিছুই জানেটানে না, জানে কেবল হুঁকো টানতে, নয় তো বই খুলে বসে থাকতে- যে-সব বইয়ের ছাই এক অক্ষরও বোঝা যায় না।
ভালো লাগত এক তাসাদ্দক ভাইকে। আমাদের বাড়িতে ওই একটা মানুষই থাকতেন, যাঁর কথা শুনতে শুনতে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতাম; সত্যি, কী সুন্দর করে তাসাদ্দক ভাই কথা বলতেন। আব্বা বাড়ি না থাকলে মাঝে মঝে তিনি গানও গাইতেন। গানের কথাগুলো অবিশ্যি ভালো করে মনে পড়ে না আর। গানটা যেন কোনো একটা মেয়েকে নিয়ে লেখা, যে-মেয়েটি কথা বলত না, মজা লাগত যার ভাবভঙ্গি দেখে– কিন্তু যার চোখ দুটি ছিল ভারী কোমল, যেন আধঘুমে জড়ানো ছিল সে চোখের পাতা, আর সেই পাতায় পাতায় জড়িয়ে ছিল যেন কোনো কাহিনী– হয়তো এমনিই ছিল সে গানের কথাগুলো।
কিন্তু তাসাদ্দক ভাই যখনই গান গাইতেন, আপা তখন মৃদু মৃদু হাসত, যেমন হাসা তার স্বভাব ছিল। যে-হাসি তার মিলিয়ে যেত না সহজে, হাসবার কিছু না পেলে সে তখন বদুকে ধরে গালের উপর দু-একটা টোকা মেরে বলত, ‘হ্যাঁরে বদু, তুই আর চেঁচাচ্ছিস না কেন, আয়, চেঁচাবি?’ বলেই সে আবার হাসতে শুরু করত, সেই অনুচ্চারিত হাসি, তার নিজের জন্যে যে-হাসি।
তাসাদ্দক ভাই ছিলেন আমাদের খালাতো ভাই। হোস্টেলে থেকে তিনি পড়াশুনা করতেন। কিন্তু আম্মা যেদিন খালা-আম্মার কাছে জানতে পেলেন, তাঁর বোনপো হোস্টেলে অখ্যাদ্য খেয়ে খেয়ে শরীর নষ্ট করেছে, সেইদিনই তাসাদ্দক ভাইকে বাক্স-বিছানা গুটিয়ে চলে আসতে হল আমার বাড়িতে। আমরা তাঁকে ডাকতাম ভাইজান বলে।
আমাদের আর বদুকে নিয়ে ভাইজানের কৌতুকের সীমা ছিল না। আমরাও তাঁকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আর তিনিও বদুর হাজার জ্বালাতনেও ক্লান্ত হতেন না। কিন্তু মজা হচ্ছে, আপার সামনে পড়লেই ভাইজান কেমন গম্ভীর হয়ে যেতেন। একটা কথাও তিনি যেন বলতে পারতেন না। এদিকে ভাইজানকে দেখলেই আপার দোপাট্টাও নেমে আসত তার মাথা-মুখ ঢেকে একেবারে বুকের উপর। ভাইজান তাতে আরও বেশি ঘাবড়ে যেতেন যেন। নিজের অজ্ঞাতেই যেন আপার হাত দুটো ঘোরাফেরা করছে একাজে ওকাজে, চোখ তার নিজের পায়ের দিকে নামানো। একটা মেশিনের সঙ্গে কথা বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
ভাইজান যখন বদুকে পেতেন একা, তখনই আপার কথা জিগ্যেস করতেন, ‘হ্যাঁ বদু, তোমার আপা এখন কী করছে, বল তো?’ বদু লাফিয়ে উঠত, ‘কী ছাই করবে, হয়তো চুপ করে বসে আছে। আমি ডেকে আনছি।’ বলেই বদু হয়তো ছুটতে চাইত।
ভাইজান ঘাবড়ে যেতেন ভীষণ, ‘না, না, না, বদু, সে কী, তার কিছু দরকার নেই; এমনিই আমি জিগ্যেস করছিলাম।’ বলেই তিনি দু-হাতের মধ্যে বদুকে আটকে ফেলতেন। তার পরেই ছোট্ট ছেলের মতো আবদেরে সুরে বলতেন, ‘যাও বদু, তুমি মানুষটা ভালো নও। যা কিছু বলব, তাই নিয়েই ঢাক পেটাতে হবে?’
.
বদুকে ঠাণ্ডা করা এত সহজ ছিল না। সে বলত, ‘কী, তুমি আমাকে ঢাক বললে ভাইজান?’ ভাইজান বলতেন, ‘আরে না, না, তা কখন বললাম? এই দেখ, ঢাক তো এমনি করে বাজে।’ বলেই তিনি টেবিলের উপর দুহাতে আওয়াজ করতেন– ব্যঙ্গ — ব্যস্,– ডস্– ডস্– ‘এই যে এমনি করে তো ঢাক বাজে। তুমি কেন ঢাক হতে যাবে?’ যা-তা আওয়াজ আর কথাবার্তার তোড়ে বদুর প্রতিবাদের ভাষা ভেসে যেত, ডুবে যেত।
এদিকে ভাইজান যখনই বদুকে নিয়ে এইসব কাণ্ড করতেন, আপা তখন পাশের ঘরের দরজায় এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত, ওদের সব কথাবার্তা সে শুনত। তারপর চলে আসত রান্নাঘরে। সেখানে চুলোর পাশে বসে বসে সে হাসত, সেই চাপা মৃদু হাসি। তন্ময়তার ফাঁকে তার দোপাট্টা খসে পড়ত মাথার উপর থেকে ঘাড়ের নিচে, গালের পাশ ঘেঁষে নেমে গেছে একগোছা কালো কোঁকড়া চুল; আর তার চোখের তারা যেন নাচছে চুলোর আগুনের জ্বলন্ত শিখার তালে তালে। ঠোঁট দুটো তার বারবার কেঁপে উঠছে, যেন গানের কলি আস্তে আস্তে নেচে বেড়াচ্ছে সেখানে; কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারিত হত না। হঠাৎ আম্মা কিংবা আব্বা এসে পড়লেই তাড়াতাড়ি আপা দোপাট্টা তুলে মাথায় দিয়ে চুলোর কাছে চলে যেত।
একদিন সন্ধ্যায় আমরা লনে বসেছিলাম চুপ করে আমি, আপা আর আম্মা। একটু দূরে ভাইজান আর বদু এসে বসল। তারা টের পায়নি আমরা এদিকে বসে আছি। ভাইজান গল্প শুরু করলেন, ‘জানো বদু, আমি এমন একটি মেয়ে বিয়ে করব, যে নাকি ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে, সব বই যে পড়তে পারবে আর যে আমার সঙ্গে দাবা খেলবে, ক্যারম খেলবে আর ব্যাডমিন্টনও খেলবে। তুমি জানো বদু, শাটেল্কক্ কাকে বলে? জানো না? শাটেল্কক্ হচ্ছে পাখির পালকের তৈরি একরকম ছোট্ট বল। র্যাকেটের এক ঘায়ে সেটা উড়তে থাকে আর আওয়াজ হয়—ভর্র্র্– ডিজ্জ্জ্– টিন্ন্ন্–বুঝলে? আর হ্যাঁ, আমি যাকে বিয়ে করব, তার সবচেয়ে বড় গুণ হবে, সে চমৎকার সব রান্না জানবে।’
বদু বোধহয় নিজের বউয়ের কথাই ভাবছিল, সে বলল, ‘আমি সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব।’
‘ধ্যেৎ!’ ভাইজান তার প্রস্তাবটা তেমন পছন্দ করলেন না বলে মনে হল। এদিকে আম্মা ওদের কথার ফাঁকে আপার মুখের দিকে এক মুহূর্ত চোখ বুলিয়ে নিলেন। আপা কিন্তু দেখেও সেটা না দেখার ভান করল। সে তখন পায়ের আঙুলের নখ খুঁটছে নুয়ে নুয়ে।
ওদিকে বদু ভাইজানকে বলছে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি আমি। আপনি তো আপাকে বিয়ে করবেন, না ভাইজান?’
ভাইজান বললেন, ‘কিন্তু তোমার আপা তো এ-ও জানে না, পুডিংয়ে কতটুকু চিনি লাগে। পুডিংয়ে সবসময় চিনি কম আদৌ ভালো লাগে না।’
‘কিন্তু আব্বা যে চিনি কম চান, তাই তো আপা–।’ বদু ওকালতি করছে আপার হয়ে। ভাইজান বললেন, ‘ও, তাহলে তোমার আপা কেবল আব্বার জন্যেই করেন ওসব, আমাদের জন্যে নয়?’
বদু এবার বিরক্ত হল, ‘আচ্ছা দাঁড়ান, আপাকে আমি সব কথা বলে দেব।’
‘আরে না, না।’ ভাইজান আবার ঘাবড়ে গেলেন, ‘ধ্যেৎ! তুমি দেখছি একটা লাউডস্পিকার। আচ্ছা এস, ঢাক বাজাই– এই যে ব্যঙ্গ ব্যস্– ডগ্ ব্যস্– উহ্ বদু, তোমার বন্ধু হয়ে দেখছি জানের শেষ!’
আপা তার আনন্দের উচ্ছ্বাস আর বোধহয় নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছিল না। হঠাৎ সে উঠে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আমি ভীষণ হাসছিলাম আর আম্মাও তাঁর সশব্দ হাসি লুকোবার জন্যেই বোধহয় মুখের উপর দোপাট্টার একটা ধার চাপা দিলেন। আমার শোবার ঘরে আমি আর আপা বসে ছিলাম, আমার হাতে একটা বই। হঠাৎ ভাইজান এসে হাজির। জিগ্যেস করলেন, ‘কী পড়ছ জাহিনা?’
সত্যি কথা বলতে কি, জাহিনা নামটা শুনলেই খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করত। নূরজাহান নামটা আজকাল তো তৃতীয় শ্রেণির বলেই মনে হবে। তাছাড়া ও-নামটা শুনলেই কোনো বুড়ি দাদি বিবির চেহারাই ভেসে ওঠে চোখের ওপর– ইতিহাসের পুরনো পাতায় ভূতের মতো যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ভাইজান সেই শুকনো বাসি রুটিকে একেবারে তাজা করে তুলেছেন। আমি যে নূরজাহান থেকে জাহিনা হয়েছি, এটা তাঁরই কীর্তি। যখনই ও-নাম তাঁর মুখে শুনতে পাই, নিজেকে মনে হয় ইরানের শাজাদি বলে। ভাইজান আপাকে বলতেন সিজদা, অবশ্যি আপা যখন ছিল এই এতটুকুন। এখন তো ভাইজান আপার আসল নাম অর্থাৎ সাজেদা শব্দটাও উচ্চারণ করতে সাহস পান না। ভাইজানের প্রশ্নের জবাব দিলাম, ‘এই– ঠিক পড়া নয়, পড়বার চেষ্টা করছি।’
ভাইজান আবার প্রশ্ন করলেন, ‘বার্নার্ড শ’ পড়েছ?’
বললাম, ‘না।’
ভাইজান এবার অপাঙ্গে আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা তোমার আপা ‘হার্টব্রেক হাউস’ বইটা পড়েছেন নিশ্চয়ই?’
আপা যেদিকটায় বসেছিল, সেদিক থেকে ছোট্ট অর্ধোস্ফুট একটা ‘না’ ভেসে এল। আপার চোখের পাতা অবশ্যি মেঝের দিকেই নামানো ছিল।
প্রায় উত্তেজিত স্বরে ভাইজান বললেন, ‘ওহ্ জাহিনা, কী বলব তোমাকে, ওটা তো বই নয়, একেবারে পুরোপুরি শরাব। তোমার ওটা নিশ্চয়ই পড়া উচিত। হ্যাঁ, পরীক্ষাটা শেষ করেই পড়বে অবশ্যি, চাও তো আমিই দেবখন– খুশি হয়েই দেব।’
আমি যখন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম তাঁর প্রস্তাবে, তখন ভাইজান আবার আর-এক প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আচ্ছা জাহিনা, তোমার আপা ম্যাটরিকের পর আর পড়লেন না কেন?’ এই ধরনের প্রশ্ন আমার কখনো ভালো লাগত না। এবার আমি রেগে গিয়েই বললাম, ‘তার আমি কী জানি, আপাকেই কেন জিগ্যেস করছেন না?’
অবশ্যি আমি জানতাম, আপা কেন কলেজে গেল না– তার মতে কলেজের মেয়েরা পড়াশোনার চাইতে ফ্যাশান-প্রতিযোগিতায়ই মত্ত থাকে বেশি। সেখানে তারা লেখাপড়ার নাম করে আসলে ফ্যাশানের মেলা বসায়। আপার এই সংকীর্ণ মনোভাব আমায় ভীষণ ক্ষেপিয়ে তোলে। আসলে ও আলসে, রান্নাঘরে বসে বসে পাঁচশোরকম রান্না করাতেই ওর আনন্দ বেশি– ফু! ভাইজানকে নিয়ে এই এক জ্বালাতন! সবসময় আমাকে আপার হয়ে কথা বলতে হবে– কেন, আমি কি দোভাষী! ওদিকে শাজাদি তো ভিজে বেড়ালটির মতো চুপ করে বসে থাকবে ঠায় 1
ওইদিন সন্ধ্যায় নাশতা খেতে বসে আব্বা হঠাৎ গর্জন করে উঠলেন। ‘উহ্, একী পুডিং হয়েছে! চিনির জন্যে মুখে দেওয়া যায় না! বলি সাজেদা, চিনি কি খুব সস্তা হয়েছে না-কি?’
অন্য সময় হলে ভয়ে আপার মুখ শুকিয়ে যেত। কিন্তু আশ্চর্য, আজ তার মুখেচোখে ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। বরং চোখের মণিতে তার কৌতুকের আভাস। প্রশ্নের জবাবে সে শুধু বলল, ‘তাই বোধহয়।’ বলেই আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
আব্বা আরো রেগে গজরাতে শুরু করলেন। হঠাৎ আম্মা সেখানে হাজির। বললেন, ‘দেখ, তুমি না হয় চিনি খেতে চাও না, কিন্তু তাই বলে সবাই কেন তোমার জন্যে ভুগবে? আল্লা মেহেরবান, তাই ফেরেশতার মতো একটা সুন্দর জোয়ান ছেলে আমাদের ঘরে বাস করছে, ওর দিকে একটু দেখতে হবে না কি?’
আব্বা হঠাৎ ঢোক গিললেন, ‘তা– তা আমাকে বলতে হবে তো, নইলে– যত সব –হুঁ!’
আব্বা শান্ত হয়ে গেলেন। আম্মা তাঁর পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন– তারপর ফিস্ ফিস্ করে আলাপ শুরু হল।
পাশের বাড়ির সাহেরা প্রায়ই দেয়ালের উপর মাথা উঁচিয়ে, আপার সঙ্গে গল্প করত। আপা দু-এক কথায় জবাব দিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে পড়ত। বলত, ‘উহ্, কত কাজ পড়ে রয়েছে।’
সেই আপাকে যখন হঠাৎ দেখলাম সাহেরাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসতে, আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তাই তো, কী ব্যাপার! তক্ষুনি ছুটে গেলাম সাহেরার কাছে। জানতে চাইলাম, আপা কেন গিয়েছিল তাদের বাড়ি। সাহেরা নখে পালিশ লাগাতে লাগাতে বলল, ‘এসেছিল একটা বই নিতে– ইয়ে, এই ‘হার্টব্রেক হাউস্’ বইটা নিয়ে গেল।’ আমি তখন অন্য আলাপ জুড়ে দিলাম।
বইটা আপা সবসময় বাক্সে লুকিয়ে রাখত। রাত্রে শুয়ে শুয়ে লক্ষ করত, আমি কখন ঘুমিয়ে পড়ি। আমি ঘুমুলে বোধহয় পড়তে শুরু করত। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একদিন এক মজা করলাম আমি। শুয়ে পড়লাম ঠিক সময়ে কম্বল জড়িয়ে, কিন্তু ঘুমোলাম না। তবে ঘুমের ভান করলাম পুরোপুরি। আপা যখন নিশ্চিন্ত মনে বইটা খুলে পড়তে শুরু করেছে, হঠাৎ আমি মাথা তুলে প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘বলি আপা, এসব ‘হার্টব্রেক হাউস্’-ফাউস্ কী ব্যাপার! নিশ্চয়ই আমাদের হাউস?’
আপা চমকে উঠে জবাব দিল, ‘জানিনে।’ তারপর বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ভাইজান আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘জাহিনা, তোমার আপা ফলের সালাদ বানাতে পারে?’ আজও রেগে আমি জবাব দিলাম, ‘আপাকে গিয়ে কেন জিগ্যেস করেন না?’
‘বাপরে!’ ভাইজান চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি কারো সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছ।’
‘কী?’ আমি আরো বেশি রেগে গেলাম, ‘আমি কি ষাঁড় নাকি যে যুদ্ধ করব?’
ভাইজান হাসতে হাসতেই বললেন, ‘না, না, ষাঁড় নও নিশ্চয়ই, তবে দেখতে তুমি অ-নে-ক-টা…’
হঠাৎ কেন যেন আমার রাগ পড়ে গেল। ভাইজান বলছেন, ‘দেখ জাহিনা, আমি আবার যুদ্ধটুদ্ধ একটু বেশি পছন্দ করি। আর বিয়েও করব এমন মেয়ে, যে আমার সঙ্গে সারাদিন যুদ্ধ করে কাটাতে পারবে, কখনো ক্লান্ত হবে না।’
ভারি খুশি খুশি লাগছিল আমার। হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা ভাইজান, ফলের সালাদ কী জিনিস?’
জবাবে তিনি বললেন, ‘এই সাদা, লাল, নীল, কালো সব মিলিয়ে যেটা হয় আর কী। আমার খুব পছন্দ ওটা। কিন্তু তোমাদের এখানে তো দেখছি, জীবনভোর পুডিংই খেতে হবে। খালি পুডিং আর পুডিং।’
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আপা আমাদের সমস্ত কথাবার্তাই কোথাও লুকিয়ে থেকে শুনেছিল। কারণ সেদিন রাত্রে দেখলাম আপার হাতে একটা নতুন বই– বইটা ‘পাকপ্রণালি’। এরপর থেকে রান্নাঘরে প্রায়ই দেখতাম আপার হাতের নাগালে আলাদা করে ঢাকা একটা ট্রে। ট্রেটাতে কী থাকে আন্দাজ করেছিলাম। আপা এখন রোজ ফলের সালাদ বানাবার মহড়া দিচ্ছে। কিন্তু আপাকে ক্ষেপাবার জন্যে একদিন বদুকে লেলিয়ে দিলাম ট্রেটার পেছনে। বদু ট্রেটা লুফে নিয়ে এলে তাকে বললাম ভাইজানের কাছে নিয়ে ওটার নাম জিগ্যেস করতে; সঙ্গে সঙ্গে আপার যে কঠোর দৃষ্টি আমার মুখের ওপর এসে পড়েছিল, এর আগে আর কোনোদিন তার সেরকম দৃষ্টি আমার চোখে পড়েনি। সারাদিন আপা অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে ছিল– রাত্রে শুয়ে শুয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। আমার ভারী দুঃখ হচ্ছিল, লজ্জাও হচ্ছিল। কিন্তু আপার কাছে গিয়ে মাফ চাওয়ার সাহস হল না।
কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন আমাদের জ্ঞাতি সম্পর্কের চাচাতো বোন সাজিদা, যাকে আমরা সাজোঁ বা’জি বলতাম, সে এল আমাদের বাড়ি বেড়াতে। জানাল, কয়েকদিন এখানে থেকে যাবে সে। আমরা ভারী খুশি হলাম।
সাজোঁ বা’জি দুনিয়ার সমস্ত স্ফূর্তি যেন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল; পাশের বাড়ির সাহেরা আর সুরাইয়া এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে গল্প করে যেত। আমাদের নিষ্প্রাণ বাড়িটাও হাসি-হুঁল্লোড়ে মেতে উঠল। বদুর মুখে সবসময় লেগে আছে– ‘সাজোঁ বা’জি– সাজোঁ বা’জি! আমরা সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব।’ বা’জিও বদুকে পেয়ে বসল, ‘এই বদু, একবার আয়নার সামনে মুখখানা দেখ তো! শিগগির ভালো করে মুখ-হাত ধুয়ে এস; তারপর আমার সঙ্গে কথা বলবে, যাও।’
বড় মিষ্টি করে বকতে জানত সাজোঁ বা’জি। সাজোঁ বা’জি যখন তখন ভাইজানের দিকেও গলা বাড়াতে লাগল। ‘তাই নয় ভাইজা– আ– ন?’ অথবা– ‘ঠিক বলিনি ভাইজা– আ– ন?’
তাসাদ্দক ভাইকে আপা বলত ভাই সাহেব। বা’জি বলে ভাইজান; আর ‘জানে’র উচ্চারণটা এমন কেঁপেকেঁপে লতিয়ে লতিয়ে একটা ঝঙ্কার তুলে শেষ হত যে, ‘ভাই’টা ইতোমধ্যে তলিয়ে যেত অতলে।
বা’জি আসার পর থেকেই আপা যেন আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেল। বদু ভাইজানকে ছেড়ে দিয়ে বা’জিকে নিয়ে মেতে উঠল; এদিকে বা’জি সবসময় ভাইজানের সঙ্গে ক্যারম্ বা দাবা নিয়ে মত্ত। বা’জি সোজাসুজি বলে ফেলত, ‘আসুন ভাইজা-আ-ন, এক বোর্ড খেলা যাক।’ কিন্তু ভাইজানের স্বভাবই ছিল আলাদা। যখন টের পেতেন, আশেপাশে কাছাকাছি কোথাও রয়েছে বা’জি, তখনই বদুকে বলতেন, ‘এস তো ইয়ং-ম্যান, দাবার আসরে হেরে গিয়ে মুখ ফোলাবার ইচ্ছে যার আছে, এস বসা যাক।’ বা’জি কিন্তু ভাইজানের ইঙ্গিতে সাড়া দিতে ভুলত না! বলত, ‘কাল কে হেরেছিল স্যার, মনে নেই। তাছাড়া মাঝে মাঝে যে হারি, সে তো ইচ্ছে করে আপনার মান বাঁচাই। একটা মেয়ের কাছে হেরে গেলে লজ্জা করবে না? তাই দয়া করে– ‘ বা’জিকে কথায় হারানো অসম্ভব ছিল।
একদিন ভাইজান এক নতুন কাণ্ড করলেন। খাবারঘরে না গিয়ে তিনি এসে খেতে বসলেন রান্নাঘরে। আপা চুলোর পাশেই বসে। সাজোঁ বা’জির দোপাট্টার আঁচল ধরে বদু ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বা’জি কথা বলতে শুরু করল, ‘পেয়ারি আপা, ভাইজানকে অতগুলো রুটিই খেতে হবে নাকি? তার ওপর আবার পুডিং আছে। আর হ্যাঁ, না খেয়ে উপায়ই-বা কী? ফেলে রাখলে আবার চাচি-আম্মার বকুনি। ভাইজানকে স্বাস্থ্যবান, ধনী আর বিদ্বান করে তোলা তো চাচি-আম্মার জন্যে ফরজ্ হয়ে গেছে, তাই নয় ভাইজা-আ-ন?’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল তার কথায়।
হঠাৎ বা’জি উঠে দাঁড়াল। তারপর চারিদিকে তাকাতে তাকাতে পেয়ে গেল সেই ট্রেটা, যেটাতে ফলের সালাদ রাখা হয়েছে খুব যত্ন করে। আপা কিছু করবার বা বলতে পারার আগেই ট্রের ঢাকনা খুলে বা’জি সেটা তুলে ধরল ভাইজানের সামনে। অতি বিনয়ের ভঙ্গি করে সে বলল, ‘এই যে স্যার নিন; সাজোঁ বা’জি খাবার তৈরিতেও যে ওস্তাদ, সেটাও আপনার জানা দরকার। নিন শুরু করুন।’
ভাইজান কয়েক চামচ তুলে নিলেন। বললেন, ‘চমৎকার! খোদার কসম, এমন চমৎকার সালাদ আমি আর খাইনি। কে করল?’
বা’জি অপাঙ্গে একবার আপার দিকে তাকাল, তারপর বলে ফেলল, ‘গরিব সাজোঁ বা’জি ছাড়া কে আবার?’ বদু হঠাৎ যেন তাজ্জব হয়ে তাকিয়েছিল আপার লাল হয়ে ওঠা মুখখানার দিকে। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠল, ‘আমি বলব ভাইজান, কে করেছে?’
সঙ্গে সঙ্গে আপা পেছন থেকে বদুর মুখে হাতচাপা দিল, তারপর তার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। বা’জি এদিকে হাসিতে ফেটে পড়ল। হঠাৎ ভাইজানের একটা আশ্চর্য নতুন দৃষ্টি এসে পড়ল বা’জির মুখের ওপর। কেমন একটা ঝোঁকের মাথায় আমিও বেরিয়ে এলাম বাইরে। বাইরে পর্দার পাশে দেখলাম আপা চুপ করে দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে বা’জির গলা শোনা গেল, ‘আহ্ ছাড়ুন, যেতে দিন আমাকে, আহ্!’ তারপর আর কোনো শব্দ নেই।
পরের দিন আমরা সব লনে বসে আছি। ভাইজান তাঁর ঘরে বসে পড়েছিলেন হয়তো। হঠাৎ বা’জির গলা শুনলাম। ভাইজানের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সে বলছে, ‘আসুন স্যার, একটা চাঁটি মারি আপনাকে; কী বলেন? ‘
সঙ্গে সঙ্গে ভাইজান বললেন, ‘সাবধান বাছাধন, একটা কিক্ মাত্র দরকার, এক কিকেই উড়ে যাবে শূন্যপথে!
বোধহয় ভাইজান তার নমুনাটাও দেখাতে শুরু করেছিলেন, বা’জির অস্ফুট আর্তকণ্ঠ ভেসে এল, ‘উহ্, কী অসভ্য! সবসময় ওই গোদা পা দুটো কেন ইউজ করেন, বলুন তো?’
ভাইজানও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘তাহলে হাতই ইউজ্ করি এবার ‘ বা’জির গলা আবার গুমরে উঠল, ‘হেই, উহ্হ্, না, না, না– মাফ করুন এবারটি।’ সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল দুটো পা আছড়ানোর আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড পরেই আর কোনো শব্দ নেই।
একদিন বদু হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এল আপার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বদু বলছিল, ‘আপা, আপা, দেখ এসে, বা’জি আর ভাইজান কুস্তি লড়ছে। এস না, আহ্ এস শিগগির।
ফ্যাকাশে মুখে আপা একটা নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বদু বলল, ‘আম্মা কোথায়, আম্মাকে দেখাব!’ বলেই সে আবার ছুটে যাচ্ছিল। এবার আপা হঠাৎ খপ্ করে তার একটা হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘বদু এস, দেখ এসে, কতগুলো টফি রেখেছি তোমার জন্যে। এস নেবে।’ বদু কিছু বুঝতে পারছিল না। সে-ও আপার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল।
আমার বইয়ের আলমারিতে একদিন দেখা গেল ‘হার্টব্রেক হাউস’ অযত্নে পড়ে আছে। ফলের সালাদের ট্রেটাও দেখা গেল রান্নাঘরের এক কোণে পড়ে, সেটাও খালি। আপা আগের মতোই রান্নাঘরে কাজ করছে, কেবল তার ঠোঁট দুটো দেখলাম জড়ানো, কোনো স্পন্দন নেই সেখানে।
.
সাজোঁ বা’জি আর তাসাদ্দক ভাইয়ের বিয়ের দুবছর পর আর একবার তাঁরা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। বা’জি আর সেই আগের বা’জি ছিল না; হাসিতে তার প্রাণ ছিল না; চেহারায় সেই জ্যোতি ছিল না আর তার সেই উজ্জ্বল চকচকে কপালের উপর কালো কালো রেখা জেগেছে। ভাইজানও যেন দমে গেছেন অনেকখানি।
রাত্রের বেলা আম্মা ছাড়া আর সবাই আমরা রান্নাঘরে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ ভাইজান বদুকে প্রশ্ন করলেন, ‘বদু, সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করবে?’
‘নাহ্।’ বদু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘আমি ঠিক করেছি, বিয়েই করব না।’
সেই অনেকদিন আগেকার একটি সন্ধ্যা আমার মনে পড়ে গেল। ‘জানেন ভাইজান –আমি হঠাৎ বলতে লাগলাম, ‘অনেকদিন আগের কথা; বদু সেদিন প্রথম বলেছিল, আমি সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব। আম্মা ওকে বলেছিলেন, আপাকে বিয়ে করতে। উত্তরে বদু বলেছিল, না আপা ভালো নয়। সে হচ্ছে এই পোড়া কাঠটার মতো। আর সাজোঁ বা’জি?… হঠাৎ জ্বলন্ত বাল্বটার দিকে দেখিয়ে বলেছিল, ঠিক ওটার মতো।’
আমি সব কথা শেষ করতে পারিনি, হঠাৎ মাথার উপরকার জ্বলন্ত বাল্বটা নিভে গেল, সমস্ত ঘরটা গেল অন্ধকারে তলিয়ে। ম্লান কণ্ঠে ভাইজান বলে উঠলেন, ‘হুঁ’, মনে আছে আমারো সেকথা।’ তারপর হঠাৎ তিনি বিরক্তির সুরে বললেন, ‘আর ছাই ইলেকট্রিক্ বালবেরও যে কী হয়েছে আজকাল, যখন-তখন ফস্ করে নিভে যায়।
আপা নীরবে একটা পোড়া কাঠ ছাইয়ের গাদায় ঠেলে দিচ্ছিলেন, যাতে ছাই ঢাকা আগুনের ফুলকিগুলো ভালো করে নিভে যায়।
ভাইজান বললেন, ‘উহ্ যা ঠাণ্ডা পড়েছে আজকাল।’ তার স্বরটাও যেন বরফের স্তূপে ঢাকা। ভাইজান হঠাৎ উঠে পড়লেন, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে বসলেন চুলোর পাশে গিয়ে, যেখানে আপা বসেছিল। ভাইজান তাঁর দুটো হাত মেলে ধরলেন চুলোর উপর, তখনো একটু একটু তাপ আছে চুলোতে। আপা এইমাত্র নেড়েচেড়ে তুলেছে চুলোর ছাইগুলো।
অর্থোস্ফুট অচেনা একরকম স্বরে ভাইজান আবার কথা বললেন, ‘সেদিন খালাম্মাই ঠিক বলেছিলেন, পোড়া কাঠের ভেতরেও অনেক সময় আগুন লুকিয়ে থাকে; যদিও ওপর থেকে দেখা যায় না। তুমি কী বল সিদা?’
আপা নড়েচড়ে উঠল, সে বোধহয় পালাতে চায়। হঠাৎ হিস্ করে একটা আওয়াজ হল, কোথাও জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর এক ফোঁটা পানি পড়ল। আপার চোখের পানি, তা বোঝা গেল। ভাইজান কথা বলবার জন্যে চেষ্টা করছিলেন। অনেক চেষ্টার পরেই বোধহয় একটা আর্ত সুর তাঁর গলা থেকে ভেঙে ভেঙে বেরিয়ে এল, ‘এখনো অনেকগুলো ফুলকি আছে ছাইয়ের ভেতর। মিনতি করছি সিজদে, একেবারে নিবিয়ে দিও না, দিও না। দেখ কী অসহ্য ঠাণ্ডা!’
অনুবাদ : আহ্সান হাবীব