দেবেন্দ্রবিজয় যখন গঙ্গার ধারে উপস্থিত হইলেন, তখন সূর্য্য অস্তোন্মুখ! অস্তোন্মুখ সূর্য্যের কনকপ্রবাহে চারিদিক্ ঝ্ল ম্ল করিতেছে। এবং সন্ধ্যার বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাত্যাবিতাড়িত তরঙ্গমালা প্রচণ্ডবেগে গঙ্গার কূলে আঘাত করিতেছে।
পশ্চিম-গগন হইতে বিকীর্ণ হইয়া কনকধারা গঙ্গার উভয় সৈকতশয্যায় স্বর্ণাস্তরণের ন্যায় বিস্তৃত রহিয়াছে। আকাশ এখনও স্বর্ণোজ্জ্বল রহিয়ছে; এবং সেখানে মেঘ বিচরণ করিতেছে। মেঘ কখনও বাঘ, কখনও হাতী, কখনও ঘোড়া, কখনও রথ, কখনও বা লাঠী কাঁধে এক বিকটাকার দৈত্যের আকৃতি ধারণ করিতেছে।
বলা বাহুল্য, সেদিকে দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টি ছিল না; তিনি আপনার কার্য্যোদ্ধারের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। কনকাস্তরণবিস্তৃত সৈকত-শয্যা, তথায় তরঙ্গের প্রচণ্ড আঘাত, অথবা আকাশে মেঘের নানারূপ মূর্ত্তিধারণ, এ সকল দেখিবার তাঁহার আদৌ অবসর ছিল না।
যথা সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী সাহেবের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুন্সী সাহেব একটী ঘরে একখানি খাটিয়ার উপরে শুইয়া আছেন। তিনি অত্যন্ত কৃশ-যেন সে শরীরে অস্থি ও ত্বক্ ছাড়া আর কিছুই নাই। চোখে মুখে কালিমা পড়িয়াছে। গণ্ডাস্থি বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এবং চোখের দৃষ্টি একান্ত নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও এখনও বুঝিতে পারা যায়, এক সময়ে এই মুখ খুব সুন্দর ছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া মোজাম সাহেব বলিলেন, “কে আপনি, মহাশয়? কোথা হইতে আসিয়াছেন? কি আবশ্যক?”
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথম প্রশ্ন দুটীর উত্তর দেওয়া প্রয়োজন দেখিলেন না। বলিলেন “আবশ্যক কিছু আছে। আমি একটা বিশেষ কাজে আপনার নিকটে আসিয়াছি। আপনার সহিত অনেক কথা আছে।”
মোজাম হোসেন বলিলেন, “অনেক কথা কহিবার সুবিধা আমার নাই। ডাক্তারের নিষেধ-খুব নির্জ্জনে থাকা দরকার। এমন কি কাহারও সঙ্গে দেখা করাও ঠিক নহে; আপনি বিদায় লইলে সুখী হইব।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যথা সময়ে বিদায় লইব, সেজন্য আপনি অকারণ উদ্বিগ্ন হইবেননা। আপনার কন্যাদের সম্বন্ধে দুই-একটী কথা জিজ্ঞাস্য আছে।”
অতিরিক্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বৃদ্ধ মোজাম হোসেন বলিলেন, “কন্যাদের! আমার একটি ভিন্ন কন্যা নাই। আপনি কি ভুল বকিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, আমার কিছু মাত্র ভুল হয় নাই। আপনার দুইটি কন্যা। একজনের নাম সৃজান, কলিঙ্গা-বাজারের মুন্সী জোহিরুদ্দীনের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইয়াছে। অপর মেয়েটির নাম মৃজান।”
রুগ্ন বৃদ্ধ কঠোর-নেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে চাহিলেন। তেমনি কঠোর-কণ্ঠে বলিলেন, “কে তুমি বেয়াদব্, ঐ সকল পারিবারিক কথায় তোমার কি প্রয়োজন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি ডিটেকটিভ-পুলিসের লোক।”
মুন্সী মোজাম হোসেন শুইয়াছিলেন-ব্যগ্রভাবে উঠিয়া বসিলেন। রোষক্ষুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “বুঝিয়াছি, মুন্সী জোহিরুদ্দীন কোন গুপ্ত অভিসন্ধিতে আপনাকে এখানে পাঠাইয়াছেন। পাঠাইয়া ভাল করেন নাই; আমি সেখানকার সকল খবর শুনিয়াছি। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের দোষেই আমার কন্যার এই অধঃপতন হইয়াছে। তিনি যদি আমার কন্যার প্রতি সদ্ব্যবহার করিতেন, তাহা হইলে কখনই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটিতে পারিত না। এমন কি তিনি, আমি শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছি জানিয়াও, আমাকে দেখিবার জন্য আমার কন্যাকে একবারও এখানে পাঠাইতেন না। দোষ আমার কন্যার নহে-দোষ তাঁহার নিজেরই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে পাঠান নাই। আমি নিজেই কোন প্রয়োজনে আসিয়াছি। আমার হাতে একটা বড় জটিল মাম্লা পড়িয়াছে।”
মোজাম হোসেন বলিলেন, “কিসের মাম্লা?”
দেবেন্দ্রবিজয় সহসা উত্তর করিলেন, “আপনার অপর কন্যার খুনের মাম্লা।”
মৃত্যুশরাহত মৃগের ন্যায় মুন্সী সাহেব চমকিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বিবর্ণ মুখ আরও শুকাইয়া গেল। কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “হা আল্লা! মৃজান খুন হইয়াছে!”
দেবেন্দ্রবিজয় ছাড়িবার পাত্র নহেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃজান আবার কে?”
“আমার কন্যা-আমার কন্যা!” বলিয়া বৃদ্ধ উভয় হস্তে মুখ আবৃত করিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই মাত্র আপনি বলিলেন, আপনার একটি ভিন্ন আর কন্যা নাই; আমিও ঠিক তাহাই মনে করিয়াছিলাম।”
বৃদ্ধ রোদনোচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “আমার দুইটি কন্যা-আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলিয়াছিলাম। আপনি যে মৃজানের কথা বলিতেছেন, সে আমীর খাঁ নামে একটা বদ্মায়েসের প্রলোভনে পড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহার আর সন্ধান পাই নাই। আমার নিজের অবস্থা দেখিতেছেন, তাহাতে সন্ধান করিবার সামর্থ্যও আর নাই। সে অবধি আমি সেই শয়তানীর নাম মুখে আনি না-সে আমার মুখে কলঙ্কের কালি দিয়া গিয়াছে; কিন্তু তথাপি সে দোষ তাহার নয়-বেইমান্ আমীর খাঁই তাঁহার সর্ব্বনাশ করিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, বৃদ্ধের মনের মধ্যে এ সময়ে একটা অদম্য বেগ আসিয়াছে। এই সময়ে বৃদ্ধের হৃদয়ের দ্বার কোন রকমে একটুখানি উদ্ঘাটন করিয়া দিতে পারিলে, তাঁহার মুখ হইতে অনেককথাই বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু কোন্ কথা দ্বারা ঠিক স্থানে আঘাত করা যাইতে পারে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহা খুঁজিতে লাগিলেন। তখনই একটা ঠিক করিয়াও ফেলিলেন। বলিলেন, “দেখুন মুন্সী সাহেব, আপনি একজন মান্য-গণ্য, মহাশয় ব্যক্তি, আপনার পারিবারিক বিষয়ে কোন কথার উত্থাপন করা আমার পক্ষে একান্ত অনুচিত, সেটুকু বুঝিবার শক্তি যে আমার নাই, এমন নহে। তবে আমার উপরে একটা দায়িত্ব রহিয়াছে, সে দায়িত্ব যে-সে দায়িত্ব নহে, একজন লোকের জীবন নিয়ে টানাটানি। যদি তাহা আমার কাছে শোনেন, আপনিও আমাকে সাধ্যমত সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইবেন। তখন আমার নিকটে আপনি অসঙ্কোচে সকল কথাই প্রকাশ করিবেন।”
জ্বলন্ত রক্তচক্ষুঃ মেলিয়া মুন্সী সাহেব একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন; তাহার পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বলুন, আমি শুনিতে প্রস্তুত আছি-আপনার বক্তব্য শেষ করুন। যদি উচিত বোধ করি, দ্বিধা করিবার কিছুই না থাকে, আমি আপনার কাছে কোন কথা গোপন করিব না।”
তখন দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের খুন ও সৃজানের গৃহত্যাগ সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতেন, বলিলেন। এবং এই খুনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগের যে কতটা সংসক্তি আছে, তাহাও বুঝাইয়া দিলেন। তাহার পর মজিদ খাঁকে যে সকল ভিত্তিহীন সন্দেহ দ্বারা কঠিনভাবে জড়াইয়া ফেলিয়া, তিনি তাহাকে একেবারে হাজতে পুরিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাও অনুক্ত রাখিলেন না।
বিশেষ মনোযোগের সহিত সকল কথা শুনিয়া মোজাম হোসেন ক্ষণকাল নতমুখে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া হস্তে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে অত্যন্ত করুণ-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “এক সময়ে আমার এমন দিন ছিল, যখন অনেকেই আমার মুখ চাহিয়া থাকিত। যাহাদের আসন নিম্নে ছিল, এখন আমাকে অবস্থা বিপাকে তাহাদের নিম্নে আসন পাতিতে হইয়াছে। এখন একটা কিছু সামান্য নিন্দাতে সকলেই আমার উপরে চাপিয়া পড়িবে, সেইজন্য আমাকে খুব সাবধানে চলিতে হয়; কলঙ্কের কথা যত গোপন থাকে, সেজন্য এখন আমার বিশেষ চেষ্টা করাই কর্ত্তব্য; কিন্তু আপনার মুখে যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে একজন নির্দ্দোষীর জীবন-সংশয়। এখন তাহাকে উদ্ধার করিবার জন্য ভদ্রব্যক্তিমাত্রেরই চেষ্টা ও সাহায্য করা উচিত। বলুন, আপনি কি জানিতে চহেন? অবক্তব্য হইলেও আমি তাহা আপনাকে বলিব।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিলজান কি আপনার কন্যা?”
প্রত্যুত্তরে মুন্সী সাহেব একখানি কেতাবের ভিতর হইতে দুইখানি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন।