প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৩.০৭ মিস্ লোভিট – কৃষণ চন্দর

মিস্ লোভিট – কৃষণ চন্দর

দিন পূর্ণ হল। যেমন জীবনের দিন পূর্ণ হয় অর্থাৎ, শেষ হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আকাশে ষষ্ঠীর চাঁদ ঝুলে রয়েছে নিঃশব্দে– একটা নিঃসঙ্গ শিশুর মতো, যে খোকার সঙ্গী নেই।

শহরের রাতের অনেক রং। কিন্তু পাহাড়ে রাতের মাত্র দুটো রং– জ্যোৎস্না আর অন্ধকার। গিরিকন্দর আঁধারে ছেয়ে থাকে আর পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের ঝলমলে আলো। বন যেন জ্যোৎস্নার চাদর গায়ে ঘুমিয়ে আছে, আঁধারে আর আকাশের প্রান্তদেশে চাঁদের আলো হাসছে। ষষ্ঠীর চাঁদের জ্যোৎস্না কম, অন্ধকার বেশি। আঁধারে বৃক্ষের শাখায় তোরণের মতো চাঁদের আলো এসে পড়ে কখনো কখনো। আর কোনো উঁচু পাথরের উপর বসে চাঁদের আলো কোনো দূরযাত্রী শ্রান্ত পথিকের মতো বসে থাকে। আবার কখনো অন্ধকারে লুকোনো মুখের ঠোঁটের ওপর চাঁদের আলো ছিটকে এসে পড়ে যেন নিয়তি অন্ধকার থেকে মানুষের প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠল।

.

ক্লাবের আধো-ঢাকা আধো-খোলা লাউঞ্জে বসে সকলেই আলো-আঁধারিতে ডুবে আছে। নীরব। কারণ পাহাড়ের চরিত্রই নীরবতাপূর্ণ। ডিনারের আগ পর্যন্ত লাউঞ্জের আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে সবাই অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি লাভ করে। আর আলো- আঁধারির দাবার ছকে সবাই যাতে স্বপ্নের ঘর সাজাতে পারে। আলো নিভতেই আলাপচারীও কমে গেল। অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল আর সেই আঁধারে চাঁদের আলো সসংকোচে আঙুল দিয়ে মানুষ ও বস্তুকে স্পর্শ করতে এল। কারো চোখে পড়তেই সে চোখ কোমল নয়ন হল, কারো চুলে গিয়ে আলো ঝলমল আঁচলে রূপান্তরিত হল। মদের পেয়ালায় গিয়ে স্বপ্নের ঢেউ খেলতে লাগল– রঙিন ঠোঁটে লেগে রক্তিম রুবির রূপ নিল– আংটির পাথরে লেগে হীরের মতো চক্‌চক্ করতে লাগল– কানের ঝুমকোয় লেগে আলোর ফানুস বানিয়ে দিল।– চাঁদনি যেন বলছে– আমি থাকতে আঁধারের সংকোচ কিসের?

.

আজ চাঁদের আলো মিস্ লোভিটের হৃদয়কেও স্পর্শ করেছে। আর সবার থেকে দূরে একটা সোফার উপর খুবই সংকুচিত হয়ে সে বসে আছে। তার সমস্ত দেহ অন্ধকারে ঢাকা আর হাতের কব্জিটা শুধু টেবিলে রাখা ব্রান্ডির গ্লাস পর্যন্ত প্রসারিত। তার সেই প্রসারিত কব্জিতে পাতলা একটা সোনার কাঁকন– যা তার কুঁচকানো চামড়াকে ছুঁয়ে থরথর করে কাঁপছে। আজ বৃদ্ধা মিস লোভিটের পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি। তাই আমার আমন্ত্রণকারী বন্ধু মিস্ লোভিটকে (তার পুরনো গভর্নেস ছিল)– আজ নিমন্ত্রণ করে ক্লাবে নিয়ে এসেছে। মিস্ লোভিটের পোশাক সাদামাটা। তার কাছে যে ধরনের পোশাক আছে– এটা সেগুলোর চেয়ে উত্তম। অনেকদিন পর সে আজ হয়তো ঠোঁটে রং মেখেছে। চুল বাঁধা টানটান করে। যদিও ধনীদের মনে যতগুলো খেয়াল আছে– তার চুলের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি নয়। তবু সে তার এই সামান্যতম চুলের পুঁজিকেই সযত্নে ধুয়ে আঁচড়ে নিয়েছে। গায়ে সুগন্ধিও মেখেছে। তেমনি পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে হাতের কব্জিতে তার একমাত্র অলংকার কাঁকন পরেছে আজ। সে আমার বন্ধুর সঙ্গে ক্লাবে এসেছে। ঘাঁটি থেকে নেমে আমি আবার নতুন করে মিস্ লোভিটকে দেখলাম। তারপর সতর্কতার সঙ্গে আমার স্ত্রীর সঙ্গে যখন চোখাচোখি হল, তখন আমাদের উভয়ের চোখেই এক প্রশ্ন ছিল। বুড়ি ঘুড়ির রঙিন সাজ! আমরা দেড় সপ্তাহ যাবৎ আমাদের বন্ধুর বিরাট বাংলোয় অবস্থান করছি। কালই দিল্লি যাবার কথা। তাই আজ আমাদের সম্মানে আমার বন্ধু এই ডিনার দিচ্ছেন। দৈবাৎ এই ডিনারের সঙ্গে মিস্ লোভিটের পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানও সংযোজিত হয়ে গেছে। এক ঢিলে দু-পাখি মারা সম্ভবত একেই বলে।

এই দু-সপ্তাহে আমি মিস্ লোভিটকে ‘হ্যালো’ ছাড়া আর কোনো কথা বলার সুযোগ পাইনি। মিস্ লোভিট খাঁটি ইংরেজ মহিলা। তাকে স্বর্গীয় মহারাজা– আমার বন্ধুর পিতা– তার স্ত্রী ও সন্তানকে সুশিক্ষা দানের জন্যে গভর্নেস রেখেছিলেন। তখন ইংরেজদের আমল ছিল। তালুকদারদের শানশওকতের যুগ– জীবনের কত সুন্দর অভিজ্ঞতা কত আনন্দঘন মুহূর্ত মিস্ লোভিট উপভোগ করেছেন তা সত্যি অনুমেয়। যারা সেদিনের একটু চমক দেখেছে তারা কিছুটা আঁচ করতে পারে। কিংবা তার অবশেষ আমার ভঙ্গুর প্রাসাদোপম বাংলো দেখেও আঁচ করা যায়। এই বুড়ো বয়সেও মিস্ লোভিটের দিকে তাকালে বোঝা যায়, যৌবনে তিনি কী বিপজ্জনক সুন্দরী ছিলেন। এবং সেকালের ধনী তরুণরা তাঁর জন্যে কত না কী করতে সংকল্প করত। মিস্ লোভিটকে দেখলেই এ কথা মনে হয়। কিন্তু পতনোন্মুখ পুরাকীর্তি দূর থেকে দেখাই উচিত। কারণ একবার দেখলে আর দেখবার আগ্রহ থাকে না। সাহসও হয় না। তাই এতদিন এক বাড়িতে বাস করেও ‘হ্যালো’র বেশি কথা বলতে পারিনি। আমাদের হৈ-হল্লা, কলকাকলিতে আমরা মেতে থাকি, তবু দূর থেকে মিস্ লোভিটের অনুভূতি যেন আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে। আর সেই পাণ্ডুরবর্ণ ইংরেজ মহিলার অবস্থিতি আর নিষ্প্রাণ চেহারা যেন কোনো পোকায় কাটা পুরনো বই-এর মতো বাতাসে নড়তে থাকে। মিস্ লোভিট তার কুকুরের পশম আঁচড়ে দিচ্ছে। মিস্ লোভিট একা বসে খেলছে। নিঃসঙ্গ একাকী বিপদক্লিষ্ট, মিইয়ে যাওয়ার মতো মিস্ লোভিটের ছায়া থেমে থেমে কাঁপে, আবার কাঁপতে কাঁপতে থামে। শুধু এদিন আমি এই ছায়ার পাশে সারাক্ষণ বসে থেকে ভীতকণ্ঠে আমার বন্ধুকে জিগ্যেস করেছিলাম। জিগ্যেস করার সময় আমার কণ্ঠে তিক্ততা ছিল বেশ।

.

ইংরেজ যখন চলে গেল, তখন এই মহিলার এখানে পড়ে থাকার আর সার্থকতা কী ছিল? এমন তো নয় যে এখানকার আবহাওয়া তার জন্যে স্বাস্থ্যকর ছিল– কিংবা আমার দেশের মানুষ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ আছে। তার পোশাক-পরিচ্ছদ আলাদা। ইংরেজি কুকুরও পোষে। ইংলিশ ডিশ খায়। থাকেও আলাদা। তার কী দরকার ছিল হিন্দুস্তানে থাকার

আমার বন্ধু বলল, ‘গত ত্রিশ বছর ধরে ইনি আমাদের এখানে আছেন। শৈশবে আমি এঁর কাছেই লেখাপড়া শিখতে শুরু করি। কেননা আমার বিয়ে হয়েছিল বাল্যবয়সে। আমি তখন নিজে কাপড় পরতেও জানতাম না। ইনি আমাকে লেখাপড়া, আদব-কায়দা শিখিয়ে বড় করে তোলেন। ত্রিশ বছর একসঙ্গে থাকতে থাকতে এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে যে আমিও তাঁকে ছাড়তে চাইনে, তিনিও আমাকে ছাড়তে চান না। যদিও এখন আর আমার গভর্নেস-এর প্রয়োজন নেই। আর যে দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে…’ হঠাৎ সে থামল। তারপর হেসে বলল, ‘হয়তো একদিন আমিই কারো গভর্নেস হয়ে যাব। তবু তাঁকে নিয়েই দিন কাটিয়ে যাচ্ছি।’

কথা বলতে বলতে ক্লাবে এসে গেলাম। ভেতরে গিয়ে বসলাম আমরা।

.

মিস্ লোভিট কম্পিত হস্তে গ্লাস তুলে নিলেন। এবং এক চুমুকেই পুরোটা শেষ করে ফেললেন। তখন হঠাৎ আমার কী যেন মনে হল। আমি বেয়ারার কাছ থেকে এক পাত্র ব্রান্ডি নিয়ে সুদেহী পুরুষ ও সুবেশিনী নারীর দঙ্গল ছেড়ে গ্লাস নিয়ে সেই নিঃসঙ্গ একাকিনী বসা মিস্ লোভিটের কাছে গেলাম। গ্লাসটা তাঁর টেবিলে রেখে সোফায় তাঁর পাশে বসলাম এবং বলতে লাগলাম, ‘আমি আপনার স্বাস্থ্য পান করতে এসেছি।’

‘ওহ্! থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ…’

মিস্ লোভিটের কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল, এ যেন কান্নার সুর। আমি নীরব হয়ে গেলাম। কিছু বুঝতে পারলাম না। কী বলব, আর কী বলব না। অনেকক্ষণ নীরবেই কাটালাম। আমার মনে হল, যেন আমি কোনো একটা পরিত্যক্ত কামরায় প্রবেশ করেছি এবং একটা পুরনো জানালা খুলে বর্ষণসিক্ত দিনের ইংলিশ মোরল্যান্ডের রঙচটা অনুভূতিহীন দৃশ্য অবলোকন করছি। যদিও বৃষ্টি ছিল না– বৃদ্ধা মুখচ্ছবির ওপর নিঃশব্দে অশ্রু ঝরছিল– এ এমন অশ্রু যার কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। যা অদৃশ্যভাবে নির্গত হয় এবং কোনো অতলে গিয়ে প্রবেশ করে।

অবশেষে আমিই বললাম, ‘আপনি কাঁদছেন মিস্ লোভিট?’

তিনি কিছু বললেন না। সমস্ত লাউঞ্জ নীরব। যেন আমরা ক্লাবের বদলে কোনো বনভূমিতে বসে আছি। চারদিকই নিস্তব্ধ। প্রত্যেকেই আত্মচিন্তায় বিভোর। শুধু মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলের মাঝে ঝরনাধারার কলকল ধ্বনির মতো মেয়েদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ মিস্ লোভিট বলে উঠলেন, ‘আমার মার্কোর কথা মনে পড়ছে।

‘মার্কো কে?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘আমার ভাবী বর ছিল।’

‘সে কি ফরাসি?’

‘না, আধা-ফরাসি আর আধা-ইতালীয়। তার সুগঠিত দেহে দুটো জাতিরই পৌরুষ মিশ্রিত ছিল। তার গায়ের রং ছিল ইতালীয়দের মতো জলপাই রঙের। নাক আর ঠোঁট ছিল ফরাসিদের মতো। কপালটা ইতালীয় আর হাসিটি ছিল ফরাসিদের মতো। আর তেমনি ছিল তার স্পষ্ট ভাষণ। ক্ষণিকেই রেগে আগুন হত– সেই রাগ ইতালীয়দের স্বভাবজাত রাগ। মার্কোর মতো পুরুষ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। বুকটা ছিল খুব চওড়া– যেন জাহাজের পাল। দেহটা ঠিক মাস্তুলের মতো দীর্ঘ। চোখ দুটোয় দুনিয়ার চাঞ্চল্য আর কৌতূহল ভরা– যেন একটি শিশুর চোখ।’

বলতে বলতে মিস্ লোভিটের কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল আর মুখমণ্ডল যেন সৌন্দর্যের প্রত্যাশায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। মনে হল, বৃষ্টি থেমে রোদ এসেছে। আর এই নীরব কক্ষ খোশমেজাজি নারী-পুরুষের আলাপের গুঞ্জনে ভরে গেল।

.

সেটা ছিল বোম্বাইয়ের সমুদ্রতটে উঁচু টিলার উপরকার একটা কক্ষ। সেই দোতলা বাড়ির উপরতলার সমুদ্রের দিকের খোলা জানালা। সেই বাড়িতে মার্থা লোভিট তার বাপ-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকত। মেজর লোভিট আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং বান্দ্রার উপকূলে বারো কামরার এই বিরাট বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন। সেই বাড়িতেই একদিন মার্থা লোভিট মার্কোকে নিয়ে এসেছিল। তার কয়েকদিন আগেই মার্থার সঙ্গে মার্কোর দেখা হয় আর্মি ক্লাবে। ১৯১০ সালের কথা। একটা ইতালীয় জাহাজ ইউরোপীয় পর্যটকদের নিয়ে ভূ-প্রদক্ষিণে বেরিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে তারা বোম্বে আসে। আর্মি ক্লাবের ব্যবস্থাপকরা সেই জাহাজের সমস্ত ইউরোপীয়কে নিমন্ত্রণ জানায়। সেই জাহাজের একজন নাবিক ছিল মার্কো। সেখানেই মার্থার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ। আর দেখা মাত্রই হৃদয় অর্পণ করে বসে মার্থা। মার্থা ছিল খুবই সুন্দরী আর এই গরম দেশে থেকে মেজাজটা বেশ গরম হয়ে উঠছিল। তাই ইংরেজ সিপাই বা ভদ্রলোকদের শীতল ভদ্রতায় সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রেম করার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, এটা প্রেম না– ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা। তাই মার্থা কোনো ইংরেজ যুবকের কাছে ধরা দেয়নি। কিন্তু মার্কো ছিল তার কাছে ব্যতিক্রম।

.

মার্কোর প্রেমে মার্থা অভিভূত হল। মনে হল, কেউ যেন তাকে দুবাহু ধরে উপরে তুলে ফুলভরা ডালের উপর বসিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। সমুদ্রের পানিতে মাছের মতো সে সাঁতার কাটতে লাগল। কে যেন তার হৃদয়ের তন্ত্রীতে সুড়সুড়ি দিয়েছে যার ফলে তার সারা দেহ হাসতে শুরু করল। তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড গর্জনে সে ভীত হয়ে চোখ বুজল এবং প্রেমিকের বাহুতে গিয়ে শরণ নিল। জাহাজটা চারদিন ছিল বোম্বে বন্দরে। এই চারদিনে মার্থার আকাশ ও পৃথিবী সম্বন্ধে কোনো খেয়াল ছিল না। সে তার বাড়ি, বা-বাবা, ভাই-বোন- সব ভুলে গেল। ভুলে গেল তার জাতীয়তা, প্রকৃতি, আভিজাত্য, তার রাজকীয় গাম্ভীর্য। সে এখন একটা পুরুষের সঙ্গ চায়। চতুর্থ দিনে মার্থা মার্কোকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনল। সকলের সঙ্গে পরিচয় করার। মার্কো খুব খুশি হল তাদের সঙ্গে মিলে। কিন্তু তারা মার্কোকে দেখে মোটেও খুশি হল না। মার্কো অতিশয় বাক্-পটু চটপটে আর খোশমেজাজি ছেলে– আর এসবই ইংরেজরা পছন্দ করে না। তাই সাক্ষাৎ ও নিমন্ত্রণ ইংলিশ ডিশের মতোই পানসে আর বিস্বাদ হয়ে রইল। মার্থা বলল– নিমন্ত্রণের পর আমি মার্কোকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে গেলাম। বান্দ্রার উপকূলকে পুরোপুরি ভারতীয় উপকূল বলা যায় না, অনেকটা ওয়েল্সের উপকূল বলে মনে হয়। সেই উপকূলে উঁচু টিলার মাঝে একটা গুলমোহর গাছ আছে। এমনি চাঁদনি ছিল সেদিন, ঠিক এমনি নীরব রহস্যময়, সুগন্ধিত রাত। সেই চাঁদনি রাতে গুলমোহর গাছের নিচে মার্কো আমার হাতে চুম্বন দিয়ে বলেছিল– আমার জন্যে অপেক্ষা কর। কেউ যেন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

এর এক বছর পরেই মার্থার বাপ রিটায়ার্ড হলেন, পেনশন নিয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু মার্থা কোনোমতেই তাদের সঙ্গে ইংল্যান্ড যেতে রাজি হল না। তার মা-বাপ, ভাই-বোন অনেক সাধ্যসাধনা করল, কিন্তু মার্থা জিদ ছাড়ল না। অবশেষে বিদায়ের ক্ষণ এল। ইংল্যান্ড যাওয়ার জাহাজ নোঙর তুলে চলল। মার্থা অশ্রুসিক্ত নয়নে তীরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়িয়ে মা-বাপকে বিদায় জানাল। জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেল, আর মার্থা একাকিনী পড়ে রইল হিন্দুস্তানে। কারণ সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল– কারো জন্যে প্রতীক্ষা করছিল সে। এ সময়ে বহু ইংরেজ সম্ভ্রান্ত উচ্চপদস্থ লোক তার পাণিপ্রার্থী হয়। কিন্তু মার্থা তাদের সকলের প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে– সেই ইতালীয় নাবিকের জন্যে। তাই সে আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টেই একটা চাকরি নিল। আর সেই পরিত্যক্ত বাড়ির খোলা জানালায় বসে সমুদ্রের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে অপেক্ষা করত, যে জাহাজ পৃথিবী প্রদক্ষিণ শেষে বোম্বাই বন্দরে আসবে। অবশেষে সে বহু প্রতীক্ষিত জাহাজ ফিরে এল বন্দরে। মার্থা সেদিন বাড়ির সমস্ত জানালা হাট করে খুলে সমুদ্রের দিকে মাথা নুইয়ে দেখল, একজন ইতালীয় নাবিক সেই গুলমোহর গাছের নিচে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। আর সুগন্ধভরা কামরা থেকে ‘মার্কো মার্কো’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে দৌড়ে একেবারে সমুদ্রের বালুর উপর এসে দাঁড়াল। তারপর সেই গুলমোহর গাছের নিচে গিয়ে মার্কোর বক্ষলগ্না হল।

মার্কো বলল– আমি তোমাকে কার্নিউ দ্বীপে নিয়ে যাব। সেখানেই আমার বাড়ি। আমরা সমুদ্রে মাছ ধরি। সেখানে আমার মা-বাপ আর সাতটি বোন আছে। দ্বীপটি ক্যাপ্রির চেয়েও সুন্দর। সেখানকার মদ সারা দুনিয়ায় প্রসিদ্ধ। সেখানকার মতো এত সুস্বাদু মাছও নেই কোথাও। ইতালির সব সৎ জেলে সেই দ্বীপে বাস করে। সেই দ্বীপের পাহাড়ে সেন্ট অগাস্টাসের গির্জা। সেই গির্জায় হবে তোমার-আমার বিয়ে।

.

আমি মার্কোর সঙ্গে তার দেশের বাড়ি গেলাম। সত্যি সুন্দর দ্বীপ সেটা। তার নীল সমুদ্রে সাদা পাল তোলা জাহাজ চলে। নাবিকদের বাড়িঘর সাদা রঙের। উপত্যকায় আঙুর, কমলা, জলপাই আর পেয়ারার বাগান। তার পাশাপাশি কত সুন্দর ফুল শোভা পাচ্ছে। সেখানকার লাল রঙের মদের স্বাদ প্রেমের মতোই মধুর। সেখানকার জেলেরা পাহাড় কেটে হাজারটা সিঁড়ি তৈরি করেছে। উপর থেকে তাকালে মনে হয়, গির্জার ক্রশটা যেন আকাশ ও পৃথিবীর সংযোগ সাধন করেছে। এই গির্জার গর্বও করে তারা। হাজার সিঁড়ি ভেঙে আমরা হাত ধরাধরি করে গির্জায় মেরি মাতার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনে কসম খেলাম। বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা আমাদের দেহকে অপবিত্র করব না। কারণ কার্নিউ-এর মাটি হিন্দুস্তানের চেয়েও উত্তপ্ত। সেখানে ভালোবাসার মতো ফুল ফোটে। মদের স্বাদ যত মধুর– তত তিক্ত। তাই আমরা এই শপথ নিলাম। আমি মার্কোর ঘরে রইলাম। তার মা-বাপও আমাকে খুব পছন্দ করল। মার্কোর সাতটি বোনই খুব সুন্দরী এবং কুমারী। মার্কোর বাপ আমাকে তার নৌকোয় চড়িয়ে মাছ ধরার কৌশল শেখাতে নিয়ে গেল। রাতে মার্কোর মায়ের সঙ্গে শুয়ে থাকতাম– সে আমাকে মায়ের মতো স্নেহ করত।

কিন্তু বিয়ের কথা পাকাপাকি হচ্ছে না। ওরা নিজেরা কী যেন বলাবলি করে– আমাকে কিছু বলে না। একদিন মার্কো আমাকে তার সাদা পালের নৌকোয় তুলে দূর সমুদ্রে নিয়ে গেল। আশেপাশে আর কোনো পালের নৌকা ছিল না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি– আর দ্বীপটি যেন সেই পানির মাঝে পাহাড়ের মতো মাথা উঁচিয়ে আছে। জেলেদের বস্তি নজরে পড়ে না। শুধু উঁচুতে সেই সেন্ট অগাস্টাসের গির্জা দেখা যাচ্ছে। মার্কো নৌকা চালানো বন্ধ করে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি তার এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? আর আমাকে এত দূরেই-বা আনলে কেন?

মার্কো বেশ কিছুক্ষণ চিন্তিত থেকে বলল, ‘আমার মা-বাপ পাদরিকে জিগ্যেস করেছে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।’

‘তারপর।’

‘তিনি অসম্মতি জানিয়েছেন।’

‘কেন?’

‘তোমরা তো ক্যাথলিক নও।’

‘তারপর?’ আমি রাগের সঙ্গে বললাম।

‘তারপর আর কি! মা-বাবা বললেন যে, তুমি ক্যাথলিক হও, তাহলে বিয়ে হবে।’

‘আমি তা হব কেন? বরং তুমিই প্রোটেস্টান্ট হয়ে যাও।’ আমি অকস্মাৎ রেগে উঠলাম আমার কণ্ঠে বিরক্তি দেখে মার্কো বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে বলল, ‘আমি আমার পৈতৃক ধর্ম কী করে ছাড়ব?’

‘তাহলে আমিই-বা ছাড়ব কেন?’

‘তোমাকে ছাড়তে হবে।’ অন্তত আমার জন্যে।’ মার্কো ক্রোধের সঙ্গে বলল। তার কণ্ঠে নির্দেশের সুর। হঠাৎ সে রেগে গেছে। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। চোখের মণি

তারার মতো নাচছে।

‘কোনোমতেই তা হতে পারে না।’ আমি হাত মুঠো করে বললাম।

‘বাজে বকো না!’

‘তুমিও বাজে বকো না!’ আমিও মুখোমুখি জওয়াব দিলাম। রাগে আমার গা কাঁপছিল। আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম। মার্কো যদি আমাকে বুকে তুলে নিত, তখন আমি নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরতাম। তখন রোমান ক্যাথলিক কেন, ইহুদি বা মুসলমান হতেও আমার বাধা ছিল না। কিন্তু রাগে সে দু-হাত বুকে চেপে আমাকে বলল, ‘এই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?’

‘হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা।’ হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। একথা আমি রাগের বশেই বলেছিলাম। পরক্ষণেই মনে হল, সে যদি আমার জিবটা সাঁড়াশি দিয়ে তুলে নিত, বা আমাকে দু-হাতে তুলে অথই সাগরে ফেলে দিত তো ভালো হত।

কিন্তু কিছুই হল না। সে বসে বসে ছটফট করল– সময় অতীত হল। তারপর মুখ ফিরিয়ে নৌকা চালাতে লাগল দ্বীপের বিপরীত দিকে, যেখানে থেকে গাড়ি পাওয়া যায় নেসের।

তীরে পৌঁছে মার্কো বলল, ‘আমি তোমাকে এখান থেকে নেস্‌ আর নে থেকে প্যারিসের টিকেট করে দিচ্ছি। আর টাকাও দিচ্ছি যাতে তুমি প্যারিস থেকে লন্ডন যেতে পার।’

‘আমি লন্ডনে যাব না।’

‘তবে কোথায় যাবে?’ মার্কো আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘বোম্বে যাব।’

‘বোম্বে?’ মার্কো বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘সেখানে তোমার কে আছে যে সেখানে যাবে?’

‘কেউ নেই। তাই সেখানেই যাব।’

.

‘বোম্বে আসার পর আমি আমার পুরনো ঠিকানায় মার্কোর চিঠি পেলাম। তাতে সে অনুশোচনা প্রকাশ করেছে এবং বলেছে তার সবচেয়ে ছোট বোন যার বয়স এখন দশ বছর– ক্যাথলিক প্রথায় ওদের বিয়ে হয়ে গেলেই সে চিরদিনের জন্যে নিজ বাসভূমি ত্যাগ করবে। আমি তার চিঠির কোনো জওয়াব দিইনি। কিন্তু সে তো একবার নিশ্চয়ই বোম্বে আসবে এবং গুলমোহর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তার প্রেমিকাকে নিশ্চয়ই ডাকবে।

আমি আর কোনো চিঠিরই জওয়াব দিইনি। তবে প্রতিবছরই বড়দিনে তাকে কার্ড পাঠাতাম– যাতে কিছুই লেখা থাকত না। শুধু আমার স্বাক্ষর থাকত তাতে। প্রত্যুত্তরে আমিও একটা কার্ড পেতাম। তাতেও লেখা থাকত তোমার একান্ত– মার্কো। বোম্বে এসে আমি আবার চাকরি নিলাম। এবং সেই পরিত্যক্ত বাড়ির জানালায় বসে মার্কোর প্রতীক্ষা করতাম। প্রথম বছর মনে করলাম যে তার দ্বিতীয় বোনটার বিয়ে হল, দ্বিতীয় বছরে তৃতীয়টির, তৃতীয় বছরে চতুর্থটির– এভাবে আগামী পাঁচ বছরে আমি তার ছ-টি বোনেরই বিয়ে দিয়ে দিলাম। তারপর সাত নম্বরটির বিয়ের জন্যে তিন-চার বছর অপেক্ষা করতে হল। কারণ তার বয়স ছিল কম। এ সময়ে মহামারী রূপে প্লেগ দেখা দেয়। মনে করলাম মার্কোর সাত বোনই বোধহয় প্লেগে মারা গেছে। তারপর ইউরোপব্যাপী ইনফ্লুয়েঞ্জা শুরু হল। তখন মনে করলাম, মার্কোর বোনেরা এবার আর বাঁচবে না। কিন্তু মার্কোর চিঠি আসতে থাকল এবং বারো বছরে বারোটি চিঠি এল। বারোটি আশাবরী সংগীত। তারপর চিঠি আসা বন্ধ হল। কিন্তু প্রতি বছর আমি চিঠি লিখতাম। মার্কোর জন্যে বিশ বছর আমি বোম্বেতে অবস্থান করি। তারপর লখনৌ চলে আসি। তোমার বন্ধুর পিতা মৃত মহারাজা আমাকে তোমার বন্ধুর জন্যে গভর্নেস রাখেন। মহারাজাও মারা যান। তোমাদের দেশ স্বাধীন হল। এক যুগের অবসান হল। যুগের পরিবর্তন হল। কিন্তু মার্কো এল না।’

‘আর আপনি বিয়েও করলেন না?’

‘না।’

‘হয়তো মার্কো মারাও যেতে পারে।’

মিস্ লোভিট সাপের মতো ফুঁসে উঠে বললেন, ‘না, তা হতে পারে না। আমার মার্কো এখনো অবিবাহিত আছে।’

‘হয়তো সে মনে করেছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

‘ভালোবাসায় কখনো দেরি হয় না!’

‘হয়তো মার্কো বুড়ো হয়ে গেছে। তার পুত্র-কন্যা আছে, নাতি-নাতনিও হয়েছে– এমনও তো হতে পারে।’

‘মার্কো কোনোদিন বুড়ো হবে না।’ মার্থা লোভিট তিক্তকণ্ঠে বলল, ‘এখনো সে তেমনি যুবক আছে– আমি প্রথমদিন তাকে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমনি।’ সে জোরে আমার হাত চেপে ধরে বলল। পরক্ষণেই তার কণ্ঠ ধরে এল। আমার হাত ছেড়ে দিল ধীরে ধীরে। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘যখন তুমি আমার কাছে এলে তখন আমার সেকথাই মনে হল। আর সামনের এই ঝিলটা যেন সেই সমুদ্র– একটা পালতোলা নৌকা যেন তাতে দুলছে। ওটা যেন মার্কোর নৌকা– মার্কো ‘গান গেয়ে তরি বেয়ে’ এখানে আসবে। নৌকাটা কাঠের গুঁড়িতে বেঁধে আমার কাছে এই ক্লাবে এসে সবার সম্মুখ থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। যেখানে আমার ঘর, ঠিক সেখানে।

হঠাৎ মার্থার কণ্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে গেল আর আমার চোখ ফেটে পানি বের হল। আমি তার কাঁকন-পরা কম্পিত হাতে চুমু খেয়ে বললাম, ‘মিস্ লোভিট, সীতা-সাবিত্রী শুধু আমার দেশেই নয়– সকল দেশেই তারা আছে।’

.

হঠাৎ ক্লাবে আলো জ্বলে উঠল। ডিনারের সময় হয়ে গেছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং আদরের সঙ্গে মিস্ লোভিটকে সালাম করলাম। তাঁর হাত ধরে ডিনার হলের দিকে চললাম– যেন আমার সঙ্গে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা নয়– এক স্বপ্নলোকের রাজকুমারী হেঁটে চলেছেন।

অনুবাদ : কাজী মাসুম

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *