৩.৭ পল্লী ও নগর
গ্রামের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিখ্যাত কোনো প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক লিখেছিলেন : “একই বংশে জাত সন্তানসন্ততি এবং তাদের বংশধরদের নিয়ে কয়েকটি পরিবারের ছোট একটি উপনিবেশ, এই হলো গ্রামের স্বাভাবিক রূপ।” গ্রামের এই স্বাভাবিক রূপ অক্ষুণ্ণ থাকেনি। উচ্চ নীচ বিভিন্ন জাতের মানুষের বসতি হয়েছে গ্রামে। তবু তার ভালোমন্দ সব নিয়ে পল্লীসমাজের নিকটতম উপমা মেলে একটি ঈষৎ স্মৃতিভ্রষ্ট যৌথ পরিবারে।
এর সঙ্গে নাগরিক সমাজের পার্থক্য সুস্পষ্ট। বাণিজ্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে-নগরের উৎপত্তি তারই কথা এখানে বলছি। নানা দেশ থেকে বণিকেরা মিলিত হয়েছে নগরে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অঁরি পিরেন এ ব্যাপারে একটি তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তথ্যটি ভাষাসংক্রান্ত। প্রায় হাজার বছর আগে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রুশ দেশে যে-সব নগরের প্রতিষ্ঠা হয় তাদের নামের শেষাংশে প্রায়ই “গরড” শব্দটি দেখা যায়। “gorod’-এর সঙ্গে ‘gostj’ শব্দের যোগ আছে, যার মানে হলো অচেনা বিদেশী। এই অচেনা মানুষদের মিলনকেন্দ্র হিসেবে যে-নগর, তার সঙ্গে পল্লী সমাজের জীবনপদ্ধতি ও ধ্যানধারণার একটা বড় পার্থক্য প্রথম থকেই ছিল। এই দুই ধ্যানধারণার সমন্বয়ের ওপরই সম্ভবত ভবিষ্যৎ সমাজকে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সে কথায় পরে আসা যাবে।
গ্রামের প্রধান উপজীব্য কৃষি। কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কুটিরশিল্প। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবার জন্য ছিল কুমোর, কামার ইত্যাদি। গ্রামীণ অর্থনীতির এই সাবেকি বিন্যাসটি সকলেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। কাজেই এর বিশদ বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।
তবু প্রাসঙ্গিক অন্য দুয়েকটি কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া আবশ্যক।
গতিকে বুঝতে হলে নিশ্চলতা সম্বন্ধে একটা ধারণা থাকা দরকার। আর্থিক উন্নয়নকে বোঝাবার জন্য অর্থনীতিবিদেরা নিশ্চল অর্থনীতির একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন। এর কোনো বাস্তব প্রতিকৃতি খুঁজতে গেলে প্রাচীন অথবা মধ্যযুগীয় কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার নিকট সাদৃশ্য পাওয়া যাবে।
নিশ্চল অর্থনীতিতে সবই চলেছে, কিন্তু সব মিলে কিছু বদলাচ্ছে না। জন্ম মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু মোট জনসংখ্যার না হচ্ছে বৃদ্ধি, না ক্ষয়। ব্যক্তি শৈশব থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হচ্ছে, কিন্তু সমাজে শিশু, যুবক ও বৃদ্ধের অনুপাতের পার্থক্য হচ্ছে না। যে যার কাজে যাচ্ছে নিয়মিত, তবে মোট উৎপাদন অপরিবর্তিত থাকছে; উৎপাদন পদ্ধতিও পুরুষানুক্রমে একই চলছে। এর ভিতর কখনই যে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, তাও ঠিক নয়। হঠাৎ কখনও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, মানুষ মরে কাতারে কাতারে। কখনও আবার প্রকৃতি মুক্তহস্তা হন। কিন্তু এ সবই ঢেউয়ের মতো আসে যায়। অর্থনীতির সাধারণ স্তরের এতে পরিবর্তন হয় না।
ব্যাপক দৃষ্টিতে তাকালে আরও বড় বড় ঢেউ চোখে পড়ে। সাম্রাজ্যের উত্থানপতনের সঙ্গে এর যোগ আছে। সম্রাট যদি শক্তিমান হন তো রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকে। যদি তিনি প্রজাবৎসল হন তো নতুন জলাশয় খননের কাজে মনোযোগ দেন, নতুন পথঘাট তৈরি হয়। চাষযোগ্য জমির বিস্তার ঘটে। সেই সঙ্গে শস্যের উৎপাদন বাড়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সাম্রাজ্যের পতনের সময় অরাজকতা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, জনপদও তখন জঙ্গলে ছেয়ে যায়। এমনি করে একটি উৰ্ব্ব ও একটি নিম্ন মাত্রার ভিতর প্রাচীন গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসার ও সংকোচ ঘটে।
নিশ্চল অর্থনীতির মূলে আছে পরিবর্তনহীন গতানুগতিক উৎপাদন পদ্ধতি। আবাদযোগ্য অতিরিক্ত জমি যতদিন থাকে ততদিন বসতি বেড়ে চলে, খাদ্য ও জনসংখ্যা। দুই-ই বৃদ্ধি পায়। তারপর আর প্রসার সম্ভব হয় না। খাদ্যের অনটনে জন্মমৃত্যুর হার। এমন একটা সামঞ্জস্যে এসে পৌঁছয় যাতে দীর্ঘকালের মধ্যে জনসংখ্যার আর কোনো। উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটে না। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটা অটুল ভারসাম্য স্থাপিত হয়।
এই স্থাণু সমাজের ভিতর রীতিনীতি, আচার অনুশাসন, কর্মবিভাগ ও জাতিভেদ সব কিছুই একটা অনড়তা লাভ করে। সেই অনড়–যা মানুষকে দুরাশা থেকে মুক্ত রাখে। এবং যা প্রগতির বিপরীত। যে সব নিয়ম ও নিষেধ দীর্ঘদিন যাবৎ অপরিবর্তিত থাকে, অবশেষে তাদের আর সাধারণ মানুষের রচিত নিয়ম বলে বোধ হয় না। ধীরে ধীরে তারা এক লোকাতীত মহিমার অধিকারী হয়। নিশ্চল অর্থনীতিকে বেষ্টন করে থাকে শুতি, স্মৃতি ও সনাতন ধর্ম।
অতএব মধ্যযুগীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্রাহ্মণ অথবা ধর্মাজকগোষ্ঠীর প্রভাব স্বভাবতই প্রবল। ক্ষত্রিয়দের প্রতিষ্ঠার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে অন্য দুয়েকটি কথা আনতে হয়। প্রায় কোনো দেশেরই আদিম জাতি আজ সে দেশের একমাত্র জাতি নয়। বিদেশী বিজেতার বেশে যারা এসেছে তারাও ক্রমে ক্রমে নতুন দেশের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণতি লাভ করেছে। পূর্ব ও পশ্চিমের প্রাচীন সভ্যতাগুলির এই ইতিহাস। শক হৃনেরা যেমন ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তেমনই প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যও বিদেশী। বর্বরদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে। আজ যারা আক্রমণকারী কাল তারাই নতুন। আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে দেশের রক্ষক। এমনি করে রাজন্যবর্গ সমাজে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন; তাঁরা সাধারণ মানুষ থেকে স্বতন্ত্র, কিন্তু সাধারণের রক্ষক।
ফিউডেল বা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পটভূমিকা এই। যোদ্ধা রক্ষক অথবা ভূপতির কাছে সাধারণ চাষী তার স্বাধীনতা সঁপে দিয়ে পরিবর্তে লাভ করেছে নিরাপত্তা। রক্ষককে ত্যাগ করবার স্বাধীনতা চাষীর রইল না জমির সঙ্গে সে বাঁধা পড়ে গেল। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা হলেন; অর্থাৎ, উৎপন্ন ধনের প্রধান অংশ রাজা ও সামন্তদের প্রাপ্য হলো। তবু মধ্যযুগীয় সমাজে দীন চাষী শুধু বাইরের আক্রমণ এবং লুঠতরাজের বিরুদ্ধেই ভূস্বামীর কাছে আশ্রয় আশা করেনি; বিপদে আপদে, প্রাকৃতির বিপর্যয়ে ও দুর্দিনে, সামাজিক নিরাপত্তার কিছু ব্যবস্থাও তার জন্য ছিল।
ব্রাহ্মণ অথবা ধমর্যাজক, ক্ষত্রিয় অথবা রাজন্যবর্গ এবং সাধারণ চাষী, এই নিয়েই প্রধানত মধ্যযুগীয় সমাজ। এর ভিতর বণিক শ্রেণীকে কখনই ভালোভাবে আঁটা যায়নি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে দ্রব্যের বিনিময় হতো না এমন নয়। বরং বলা চলে যে, দ্রব্যের সরাসরি বিনিময় ঐ অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত ছিল। যদি ধরে নিই যে, কয়েকটি পরিবারের সমষ্টি হলো গ্রাম, তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এইসব বিভিন্নস্ফরিবারের কোনোটিই সম্পূর্ণ স্বয়ংভর ছিল না, বরং পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ছিল–তা নইলে নিবিড় সান্নিধ্যে বসবাস করার তো কোনো হেতুই থাকত না। আর এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকেই আসে আবশ্যক মতো দেওয়া-নেওয়া। এই আদান-প্রদান গার্হস্থ্য জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এটাকেই স্বাভাবিক মনে করা হতো। গার্হস্থ্যজীবনই লক্ষ্য; সীমিত পরিমাণে দ্রব্যবিনিময় তার সহায়ক। বণিকেরস বিনিময়কে ব্যবসায়ে পরিণত করল, লাভ অথবা মুনাফা হলো তাদের লক্ষ্য। ইয়োরোপের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় দার্শনিক ও শাস্ত্ৰজ্ঞেরা এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেননি।
স্থায়ী ও স্থাণু, সুখী ও দরিদ্র গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতার সঙ্গে বাণিজ্যের বিরোধ ছিল মৌলিক। মধ্যযুগীয় সমাজে তাই বণিকের স্থান ছিল স্বাভাবিক ভাবেই অধম। অবশেষে বাণিজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যযুগীয় সমাজে ভাঙ্গন এল। ইয়োরোপের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে পরিবর্তনের এই ধারাটা স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। সেই ইতিহাসেরই দুয়েকটি কথা এবার টেনে আনা যাক।
.
২
আজ যারা ‘দস্যু’, ‘বর্বর’, কাল তারাই সভ্যতা ও সংস্কৃতির নেতা। ইতিহাসে এ ব্যাপার ঘটেছে বার বার, নানা পথে।
“রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে” যারা একদিন দেশজয় করতে এসেছিল, সমাজ সংগঠনের দিক থেকে তাদের উপজাতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্বর উপজাতীয় নেতা ও তাদের বংশধরেরাই এরপর একদিন মধ্যযুগীয় ইতিহাসের মঞ্চে রাজদরবার আলোকিত করে বসেছিল। আধুনিক যুগের গোড়াতেও প্রকারভেদে একই ব্যাপার আবারও ঘটেছে। মধ্যযুগের শেষার্ধে যে-বণিকেরা সংখ্যায় ও শক্তিতে ক্রমশ পুষ্টি লাভ করতে থাকে, তাদের সামাজিক উৎপত্তি সম্বন্ধে বিখ্যাত ঐতিহাসিক পিরেন বলেছেন যে, এরা উঠে এসেছিল সেইসব মানুষের মধ্য থেকে, যাদের জীবিকার কোনো ঠিকানা ছিল না, আইনের চোখে যারা অপরাধী, যারা ভবঘুরে এবং সমাজ থেকে পরিত্যক্ত। এরাই ক্রমশ নতুন যুগের নগরে সংহত হলেস, আর্থিক ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল, ধর্মীয় আন্দোলনে নব দিলয় রচনা করল, নতুনভাবে আইন প্রণয়ন করল, আর সভ্যতার ইতিহাসে এইভাবে একটি নতুন অধ্যায় সংযোজিত হলো।
মধ্যযুগে প্রধানত দুই ধরনের নগরী অথবা পুরী’র সন্ধান পাওয়া যায়। এক, ধর্মকে কেন্দ্র করে, যেখানে প্রায়ই মন্দিরসংলগ্ন ধমালোচনা ও শিক্ষার ব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্য। আর ছিল দুর্গ ও দরবারকে অবলম্বন করে সুরক্ষিত রাজপুরী। এইসব নগরীতে প্রাধান্য ছিল পুরোহিত সম্প্রদায়ের এবং অভিজাতবংশীয় রাজপুরুষদের। সেই সঙ্গে থাকত তাদের সেবক শ্রেণী। এই পরিচিত ব্যবস্থায় চির ধরিয়ে বাণিজ্যের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন। এক জাতীয় নগরের আবির্ভাব হলো, যেখানে প্রাধান্য বণিকের।
ইয়োরোপের ইতিহাসে এই নতুন অধ্যায়ের শুরু মোটামুটি এগারো শতকে।
খৃষ্টীয় যুগের প্রারম্ভে রোমক সাম্রাজ্য যখন তুঙ্গে, তখন ভূমধ্যসাগরকে ঘিরে রেখেছিল এই সাম্রাজ্য। ইয়োরোপের সঙ্গে এশিয়ার বাণিজ্যে এই জলপথটির গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। রোমের পতনের কিছুকাল আগে থেকেই নানা কারণে দুই মহাদেশের ভিতর বাণিজ্য ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। সপ্তম শতকে ভূমধ্যসাগরে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়, আর ইয়োরোপ আরও বেশি করে নিজের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে আনে। মধ্যযুগের প্রথমার্ধে দূরপাল্লার বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে ভেনিস ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য নগরই অবশিষ্ট থাকে না। এগারো শতকে যখন খৃষ্টানজগৎ ও মুসলমানদের ভিতর ধর্মযুদ্ধ শুরু হলো তখন তারই অন্যতম ফল হিসাবে ইয়োরোপ ও এশিয়ার ভিতর বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রশস্ত হলো। একদিকে ধর্মান্ধদের যুদ্ধ, অন্যদিকে এরই সুযোগ নিয়ে বণিকদের বাণিজ্য অভিযান! এগারো শতকের শেষ দিকে ভূমধ্যসাগরে। মুসলমানদের প্রাধান্যের অবসান ঘটল, আর ইয়োরোপের বণিকদের পক্ষে এই জলপথটি সুমে হলো।
সেকালের বণিকেরা সাধারণত সশস্ত্র এবং দলবদ্ধ হয়ে চলতো। এর কারণ ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। যুদ্ধ, দস্যুতা ও বাণিজ্যের সীমারেখা যেখানে ক্ষীণ সেখানে এটাই স্বাভাবিক, এমন কি অপরিহার্য। এমনি করে ইয়োরোপের বণিকদের ভিতর যুথবদ্ধতার ভিত্তি রচনা হলো।
বাজার ছাড়া বাণিজ্য চলে না। দূরপাল্লার বাণিজ্যের প্রসারের ফলে শহর ও গঞ্জের বৃদ্ধি হলো। পণ্য বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের পরিমাণ এবং প্রাকৃতিতেও পরিবর্তন দেখা গেল। যারা একদিন গ্রামের বাজার অথবা স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে। দ্রব্যসামগ্রী গড়ত, তারাই ক্রমে দূরের বাজারের বণিকদের জন্য তাদের আজ্ঞা অনুযায়ী। পণ্য যোগান দিতে শুরু করল। ভবঘুরে বণিকদেরও এবার কেসথাও আস্তানা গাড়া প্রয়োজন হলো।
মন্দির অথবা দুর্গকে কেন্দ্র করে যেসব নগরের কথা আগে বলেছি, তারই উপকণ্ঠে। বণিকেরা প্রথমে আস্তানা গেড়েছিল। পরে নতুন নগরের পত্তন হয়। মধ্যযুগীয় নগরের সঙ্গে এদের প্রকৃতিগত পার্থক্য ছিল। এদের আইন এবং আদর্শ, সংগঠন ও সামাজিক পরিবেশ সবই ছিল স্বতন্ত্র। বুর্জোয়া’ শব্দটির আজকাল বহুল প্রচলন দেখা যায়। ঐতিহাসিকভাবে বণিকদের নিয়ে এই যে নতুন ধরণের নগর, এরই প্রধান অধিবাসীরা হলো ‘বুর্জোয়া। ধর্মযাজক ও রাজন্যবর্গের সঙ্গে এই একটি নতুন ক্ষমতাবান শ্রেণী এইভাবে ইয়োরোপীয় সমাজে যোগ হলো।
কৃষিপ্রধান যে সমাজজীবনের সঙ্গে মধ্যযুগীয় নিয়মকানুনের যোগ ছিল তাতে বণিকসম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড ও জীবনযাত্রার প্রয়োজন মিটছিল না। অতএব নতুন আইনকানুনের প্রয়োজন হলো। দেশে এক নিয়ম; নতুন নগরগুলিতে ভিন্ন নিয়ম। এই স্বায়ত্তশাসিত নগরের প্রতিষ্ঠা ইয়োরোপের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বণিক যতদিন রাজার অধীনে ছিল ততদিন তার নিজস্ব জীবনযাত্রা ছিল সংকুচিত এবং পদে পদে বিড়ম্বিত। রাজার পক্ষে বণিকের ধন কেড়ে নেওয়াও অসম্ভব ছিল না। এখন নগরই হলো বণিকের দুর্গ, যেখানে সে অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত এবং যেখানকার নিয়ম তার নিজস্ব জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চাষীর অধিকার ছিল না যে, সে জমি ছেড়ে কোথাও যায়। দেশে দেশে দিকে দিকে যার যেথা স্থান তাকে সেটা খুঁজে নিতে দেওয়ার কথা মধ্যযুগীয় অনড় সমাজে ছিল অকল্পনীয়। বণিকের জীবনযাত্রায় কিন্তু স্বচ্ছন্দ গতিবিধির অধিকার মৌল ও অনস্বীকার্য। আজকের কোনো প্রগতিবাদী হয়তো বলবেন যে, ওটা হলো বড়লোকের অধিকার, টাকা না থাকলে মানুষ যাবে কোথায়! সেদিনের ইতিহসস একথা বলে না। বাণিজ্যিক নগর স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে বহু চাষী ভূস্বামীর কবল থেকে পালিয়ে শহরের ভিড়ে মিশে যেত। তাকে ধরবার জন্য হয়তো লোক ছুটত; কিন্তু খুঁজে পাওয়া সহজ হতো না। বারো শতকে আইন হলো যে, একটা নির্ধারিত সময় (এক বছর একদিন) পর্যন্ত যে থেকে যেতে পারবে নগরে, তাকে আর জোর করে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। প্রবচন তৈরি হলো যে, শহরের হাওয়া গায়ে লাগলে আর মানুষকে বেঁধে রাধা যায় না।
মধ্যযুগে ধর্মের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। ধমর্যাজকেরাই ছিলেন শিক্ষক। নতুন যুগে ধর্ম প্রতিষ্ঠানের বাইরেও শিক্ষার আর একটি ক্ষেত্র উন্মুক্ত হলো। ধর্মযাজকদের প্রভাব রইল। কিন্তু পাশে পাশে আর একটি ধারাও প্রবাহিত হতে থাকল। ইয়োরোপে উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চ চিন্তার বাহন ছিল একদিন লাতিন ভাষা। কিন্তু বণিকের কারবার তো শুধু পণ্ডিতের সঙ্গে নয়। তাকে সাধারণ মানুষের কাছে আসতে হয়। অতএব নগরে নগরে ক্রমশ স্থানীয় ভাষার স্থান হলো-কাজে কারবারে, চিন্তার ক্ষেত্রে, সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে শুধু অর্থনীতি ও পৌরনীতিতে নয়, সংস্কৃতির ইতিহাসেও এক নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হলো।
দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর ও উত্তরে বাল্টিক সাগরকে ঘিরে ব্যবসায়ের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যেমন নতুন ধাঁচের নগর প্রতিষ্ঠিত হলো তেমনি ইয়োরোপের অর্থনীতিতে আরও নানা পরিবর্তন দেখা দিল। এগারো থেকে তেরো শতকের মধ্যে জনসংখ্যা ও কর্ষিত জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। আর্থিক প্রসারের এই গতি কিন্তু অব্যাহত থাকেনি। চৌদ্দ শতকে এসে ইয়োরোপের অর্থনীতি যেন আর এগিয়ে যাবার দম পাচ্ছিল না। কৃষি ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবার রুদ্ধ হয়ে এলো; জনসংখ্যা অত্যধিক মনে হলো; মহামারী ও বিপত্তি দিকে দিকে দেখা দিল। তারপর ঐতিহাসিক নতুন অধ্যায়। আবারও উন্মোচিত হলো বাণিজ্যের সহায়তায়। পনের শতকের শেষ প্রান্তে কলম্বাস ও ভাস্কো ডা গামা সমুদ্র পাড়ি দিলেন। ইয়োরোপের মধ্যযুগের অন্তিম অবসান সম্বন্ধে আর। কোনো সন্দেহের অবকাশ রইল না।
.
৩
গ্রামীণ অর্থনীতির পাশে পাশে নাগরিক অর্থনীতির উদ্ভব হলে কি করে সে ইতিহাস আমরা সংক্ষেপে দেখেছি। এবার এই দুই অর্থনীতির পারস্পরিক প্রভাব এবং ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। প্রশ্নটা অন্য ভাবেও রাধা যায়। কোনো দেশেই শিল্প ও বাণিজ্য সর্বত্র সমভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কোনো অঞ্চল এগিয়ে গেছে। কোনোটি আবার পিছিয়ে পড়েছে। অগ্রসর অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চাৎপদ অঞ্চলের সম্পর্ক এখানে আলোচ্য।
জল উচ্চভূমি থেকে নীচে প্রবাহিত হয়। যদি বলা যেতো যে আর্থিক উন্নয়ন অথবা শিল্পায়ন অগ্রসর ভূমি থেকে ক্রমে অনগ্রসর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তবে ব্যাপারটা সবদিক। থেকেই বেশ সহজ হতো। প্রকৃত পক্ষে উন্নয়নের ধারাটা অত সরল নয়, বরং বেশ খানিকটা জটিল। শিল্পায়ন কোথাও ছড়িয়ে পড়ে; আবার কোথাও ছড়ায় না। কি করে ছড়ায় আর কেনই বা ছড়ায় না, দুটিই আলোচনার যোগ্য প্রশ্ন।
ধরা যাক, সাধারণভাবে অনগ্রসর একটি দেশের কোথাও কোনো ভাবে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর একটি শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হলো। যেমন ইয়োরোপে বাণিজ্যের প্রসারের প্রথম যুগে সেই পশ্চাৎপদ মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে, আজ যেখানে বেলজিয়ম, সেইখানে, নিয়মের ব্যতিক্রমের মতো দেখা দিয়েছিল একটি কর্মব্যস্ত শিল্পাঞ্চল, ফ্ল্যাণ্ডার্স নামে যার পরিচিতি। শহরে অথবা শিল্পাঞ্চলে ঘনবসতি; সেখানে খাদ্যের চাহিদা আছে, কিন্তু সেই মতো খাদ্য উৎপন্ন হয় না। খাদ্যের সঙ্গে আরও চাই শিল্পের জন্য কাঁচা মাল। অতএব শহরের সঙ্গে গ্রামের একটা সম্পর্ক গোড়া থেকেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। গ্রামের চাষীর ফসল বিক্রী হয় শহরের বাজারে। গ্রামে কারও কারও হাতে টাকা আসে। সেই টাকা আবার খরচও হয় শহরের বাজারে। নগরে যেমন কৃষিজাত দ্রব্যের চাহিদা আছে, পল্লীতেও তেমনি ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে শিল্পজাতদ্রব্যের জন্য নতুন রুচি।
অগ্রসর ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলের ভিতর পণ্য বিনিময়ের এটাই প্রাথমিক ছবি। এই ধরনটাও কিন্তু ধীরে ধীরে বদলায়। অনগ্রসর অঞ্চলে একবার যখণ শিল্পজাত দ্রব্যের জন্য। চাহিদা তৈরি হয় তখন এই প্রশ্নটা অনিবার্যভাবেই একদিন ওঠে যে, স্থানীয় প্রয়োজন মেটাবার জন্য কি স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলা যায় না? অনুন্নত অঞ্চলেরও কতকগুলি সুবিধা আছে; যেমন সেখানে জমির দাম কম, শ্রমও সেখানে মহার্ঘ নয়। অতএব কাঁচামাল অন্যত্র না পাঠিয়ে স্থানীয় ভাবে তাকে শিল্পদ্রব্যে পরিণত করা হবে না কেন? সেটাই। হয়তো অপেক্ষাকৃত লাভজনক। অনেক সময় অগ্রসর অঞ্চলের শিল্পপতিরাই এগিয়ে আসে অনুন্নত অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য। মূলধন ও কারিগরী বিদ্যা সবই প্রয়োজন মতো পাওয়া যায় বাণিজ্যের বর্ধিষ্ণু কেন্দ্রগুলি থেকে। এইভাবে অগ্রসর অঞ্চল থেকে শিল্প ছড়িয়ে পড়ে অনগ্রসর অঞ্চলে।
এটাই যে সব সময়ে ঘটে তা নয়। তবে এ রকমও ঘটে। আর এর উদাহরণেরও অভাব নেই। ফ্ল্যাণ্ডার্সে ছিল পশমের বিখ্যাত বয়নশিল্প। অতএব সেখানকার বাজারে পশমের বিরাট চাহিদা ছিল। তারই প্রভাব গিয়ে পড়ল, পনেরো ও মোল শতকে, সেদিনকার নেহাতই অনুন্নত ইংল্যাণ্ডের গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর। এর ফলে কৃষির ক্ষেত্রে দেখা দিল বড় রকমের পরিবর্তন। ইংল্যাণ্ড ঝুঁকলো বেশি করে পশম উৎপাদনের দিকে, সেই পশম বিক্রী হতো বিদেশী বাজারে। কিছুকাল পরে পশমের বয়নশিল্পও দ্রুত। প্রসারিত হতে লাগল ইংল্যাণ্ডে। ফ্ল্যাণ্ডার্স থেকে অনেক কারিগর সাগর পার হয়ে এলো। আগেও এসেছে, কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীরা পছন্দ করেনি। এবার কিন্তু রাজা বুঝতে পারলেন যে, এদের দিয়ে দেশের উপকার হবে। এই ভাবে অগ্রসর ফ্ল্যাণ্ডার্স থেকে শিল্প ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল অনুন্নত ইংল্যাণ্ডে।
ষোল শতক থেকে উনিশ শতকে আসা যাক। ইংল্যাণ্ড এবার পৃথিবীর সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ। আঠারো শতকের শেষ দিকে ম্যানচেস্টারে তুলোর বয়নশিল্পে বিপ্লব ঘটে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শিল্পের দিক থেকে তখন অপেক্ষাকৃত অনুন্নত। ইংল্যাণ্ডের চাই গম ও তুলো। উনিশ শতকে এই দু’টি বস্তুই বহু পরিমাণে আসততা কৃষিপ্রধান আমেরিকা থেকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রেও শিল্প ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। ইংল্যান্ডের অনুকরণে নিউ ইংল্যাণ্ডে আধুনিক বয়নশিল্প দ্রুত প্রসারিত হলো; দেশময় রেলপথ স্থাপিত হলো; লোহার কারখানা, যন্ত্রপাতি সবই জেগে উঠল। আর এই শিল্পায়নের জন্য সেদিন প্রচুর পরিমাণে মূলধনও এসেছিল অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলো__ থেকে।
উদাহরণ বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন। আধুনিক শিল্পায়ন পৃথিবীর ছোট একটা প্রান্তেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি, ক্রমশ এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে গত দুশো বছরের ইতিহাসের এটাই একমাত্র কথা নয়। আরও একটা বড় কথা আছে। সেটা প্রথমটির প্রায় বিপরীত। গত দু’শো বছরে পৃথিবীর উন্নত ও আর্থিকভাবে অনুন্নত দেশগুলির ভিতর তারতম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে, এমন উদাহরণেরও অভাব নেই। আঠারো শতকে ভারতবর্ষ ও পাশ্চাত্ত্য দেশের ভিতর আর্থিক তারতম্য যতটা ছিল, বিশ শতকে তার চেয়ে প্রশ্নাতীতভাবে বেশি। সাক্ষ্য-প্রমাণের জন্য বেশি দূর যেতে হয় না; আমাদের চোখের সামনেই এ ঘটনা ঘটেছে। গত পঁচিশ বছরের ইতিহাস কার জানা নেই? উন্নত দেশগুলি আরও দ্রুত এগিয়ে গেছে, পশ্চাৎপদ দেশগুলি তাল রাখতে পারেনি। কেন এমন ঘটে? এর তো একটা ব্যাধ্যা চাই।
প্রথমে চুম্বকাকারে মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। নগরে বা অগ্রসর শিল্পাঞ্চলে এমন কতগুলো সুবিধার সমম্বয় ঘটে যাতে পুঁজি বিনিয়োগ সেখানেই অপেক্ষাকৃত লাভজনক হয়। অনুন্নত অঞ্চলে যদি বা মজুরী নিম্নমান তবু ঐ সব সুবিধার অভাবে সেখানে মূলধনের প্রয়োগ বাধা পায়। একটি সাফল্য যেমন অন্য সাফল্যকে ডেকে আনে, এক শিল্পকে অন্য শিল্প তেমন কাছে টানে। এই পারস্পরিক সান্নিধ্য থেকে উভয়েই লাভবান হয়। একে আমরা বলব শিল্পের সান্নিধ্য গুণ। সান্নিধ্য গুণে অগ্রসর শিল্পাঞ্চলে প্রয়োজনীয় অনেক বস্তু সহজে লভ্য হয়। সেখানে অনায়াসে টাকা লগ্নি পাওয়া যায়। দূর বাজারের খবর সেখানে আগে এসে পৌঁছয়। নানা জাতীয় কর্মকুশলী লোক একত্র মিলিত হয়। পথঘাট, বিদ্যুতের সরবরাহ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সবই উন্নত ধরনের হয়। সেই সঙ্গে উন্নত ও অনুন্নত অঞ্চলের ভিতর একটা সাংস্কৃতিক ও জীবনযাত্রার ব্যবধানও গড়ে ওঠে যাকে অতিক্রম করা কষ্টসাধ্য। ফলে মূলধন ও কর্মকুশলতা যেখানে একবার শিকড় গেড়ে বসে সেখানেই স্তূপীকৃত হতে থাকে। তার সামান্য উচ্ছিষ্টই অনগ্রসর অঞ্চলের হাতে পড়ে। উন্নত অঞ্চলের প্রত্যক্ষ স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বাদবাকীর ভাগ্যে জোটে।
আর্থিক উন্নয়ন কি করে নগর থেকে পল্লীতে, এক অঞ্চল থেকে ভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে সে কথা আগে বলেছিলাম। আবার কেন ছড়ায় না, বরং উন্নতি এবং অনুন্নতির দুই বিপরীত মেরু সৃষ্টি হয়, সে কথা এখন সংক্ষেপে আলোচনা করছি। কোথাও উন্নয়নের প্রসারধর্মিতাই প্রবল আবার কোথাও বৈষম্যের প্রবণতটা অধিক শক্তিশালী। দুটি ছবি পাশাপাশি দেওয়া দরকার।
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের প্রধান গ্রন্থে ‘জাতীয় ধনের কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে। গ্রন্থটির একটি পরিচ্ছেদের নাম “কি করে শহুরে ব্যবসায়ে পল্লীর শ্রীবৃদ্ধি হলো”–হাউ দ্য কমার্স অব দ্য টাউনস্ কনট্রিকুটেড টু দ্য ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য কানট্রী)। স্মিথ লিখেছেন, শহরের ব্যবসায়ীরা প্রায়ই জমি কিনে গ্রামের ভদ্রলোক হতে চান। এটা গ্রামের পক্ষে ভালো কথা। এই ব্যবসায়ীরা টাকা ব্যবহার করতে জানেন, আর গ্রামের বনেদী ভদ্রলোকেরা জানেন শুধু টাকা উড়াতে। ব্যবসায়ীরা জমির উন্নতির জন্য মূলধন বিনিয়োগ করতে ভয় পান না, সাবেকী লোকদের সে অভ্যাস নেই। অ্যাড়ম স্মিথ এই। কথাগুলি একেবারে কল্পনার ওপর নির্ভর করে লেখেননি। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর যোগ আছে। গ্লাসগোকে কেন্দ্র করে যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, তাঁরাই স্কটল্যাণ্ডে কৃষির উন্নয়নে একটি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অথচ স্মিথের ঐ কথাগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচিত অভিজ্ঞতা মোটেই মেলে না। কলকাতার প্রতিষ্ঠা হলো বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে। উনিশ শতকে বাঙ্গালী ব্যবসায়ীরাও বাণিজ্যের আকর্ষণে এই মহানগরীতে এসেছেন, টাকা জমিয়েছেন, জমি কিনেছেন কিন্তু কৃষির উন্নতি কতটুকু হয়েছে? কলকাতার সঙ্গে দেশের পল্লী অঞ্চলের ব্যবধান ক্রমশ বেড়েছে। কলকাতা পল্লীর শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়তা করেনি। ঐতিহাসিক প্রতিবাদের মতো রবীন্দ্রনাথ অবশেষে কলকাতা ত্যাগ করে পল্লী অঞ্চলে আশ্রয় নিলেন। নিয়মের অপর পারে শ্রীনিকেতন দাঁড়িয়ে রইল একটি বিরল ব্যতিক্রমের মতো।
শিল্পের ক্ষেত্রেও ইতিহাসের এই তারতম্য চোখে পড়ে। রেলপথের স্থাপনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইয়োরোপের বহু দেশে শিল্পোন্নয়নের ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা। মার্ক্সের স্বদেশ জার্মানিতে রেলপথই, কারও কারও মতে, শিল্পবিপ্লবের দ্বার খুলে দিয়েছিল। পাশ্চাত্ত্য জগতে শিল্পায়নের ইতিহাসের সঙ্গে মার্ক্স সুপরিচিত ছিলেন। ভারতবর্ষে যখন রেলপথের প্রবর্তন হলো তখন, অর্থাৎ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের গোড়ায়, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন যে, এদেশের শিল্পায়ন এবার অপ্রতিরোধ্য। তারপর একটা। পুরো শতাব্দী কেটে গেল। আধুনিক শিল্প ভারতীয় অর্থনীতির একটি সংকীর্ণ প্রান্তদেশ। অতিক্রম করে অভ্যন্তরে প্রবেশের অধিকার পেল না।
শিল্পের প্রসারের জন্য প্রয়োজন ক্রমবর্ধমান বাজার বিদেশের বাজার অথবা স্বদেশের। অধিকাংশ উন্নতিশীল দেশে বাণিজ্য উন্মুক্ত করেছে বিদেশে বাজার, আর কৃষির উন্নতির ফলে প্রসারিত হয়েছে আভ্যন্তরীণ বাজার। জাপানের উদাহরণ থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। ভারতের ক্ষেত্রে একই নিয়মের প্রমাণ মেলে উল্টো দিক থেকে। বিদেশের বাজার অধিকার করে আমরা দ্রুত শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাব এমন সম্ভাবনা ছিল না। আবার নানা ঐতিহাসিক কারণে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির জড়তাও বহুদিন পর্যন্ত ভাঙ্গেনি। কাজেই আভ্যন্তরীণ বাজারও ব্যাপ্তিলাভ করতে পারেনি। স্বদেশী আন্দোলনের সাহায্যে যদি-বা এই সংকুচিত দেশীয় বাজারের আরও একটু বড় অংশ আমাদের অধিকারে আসত তবু সেটা ভারতীয় শিল্পের দ্রুত বিকাশের পক্ষে যথেষ্ট হতো না। প্রয়োজন ছিল ‘কৃষি বিপ্লব’ বা কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন। কৃষিতে অনুন্নত একটা দেশে রেলপথ বসালেই শিল্পবিপ্লব ঘাটে না।
এটা শুধু এদেশের অভিজ্ঞতার কথাই নয়। বরং এটাই আর্থিক বিবর্তনের অন্যতম প্রধান রূপ, যার উদাহরণ মেলে বহু ঔপনিবেশিক দেশে। এসব দেশের কথা মনে রেখেই কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি, যেমন, ওলন্দাজ লেখক বোয়কে, এক বিশেষ জাতীয় অর্থনীতির কথা বলেছেন, যার নাম দিয়েছেন তাঁরা “ডুএল ইকনমি” বা দ্বিখণ্ডিত অর্থনীতি। শিল্পোন্নত দেশগুলিতে আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্যের প্রভাবে সাবেকী অর্থনীতিও ক্রমশ হয়ে উঠেছে আধুনিক। দ্বিখণ্ডিত অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে এই যে, সেখানে আধুনিক ও সাবেকী অর্থনীতির দীর্ঘকালীন সহাবস্থান চলেছে, একের প্রভাবে অন্যের চরিত্রের মৌল পরিবর্তন ঘটছে না।
এই বর্ণনায় একটু ভুল আছে। যেসব দেশের কথা আমরা বলছি সেখানে আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের পাশেই পাওয়া যাবে অনুন্নত গ্রামীণ অর্থনীতি এবং প্রথমটির প্রভাবে দ্বিতীয়টির আধুনিকীকরণের ঝোঁক প্রায় অনুপস্থিত। কিন্তু তাই বলে পরস্পরের প্রভাবে এদের কোনো চরিত্রের পরিবর্তন ঘটছে না, একথা বলা যায় না। দ্বিখণ্ডিত অর্থনীতির জটিলতম সমস্যার মূলেই আছে এই পারস্পরিক প্রভাব।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক সময়ে কৃষি ও কুটিরশিল্প মিলে একটা স্বাভাবিক ভারসাম্য ছিল। আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের প্রভাবে উন্নয়নের ধারা যেসব দেশে সেই প্রাচীন অর্থনীতির অভ্যন্তরে গিয়ে পৌঁছয়নি সেখানেও প্রাচীন ভারসাম্য অচিরেই ভেঙ্গে পড়েছে। এদেশে লোকসংখ্যা গণনার হিসেবে এক সময় দেখা গিয়েছিল যে, ১৮৮১ থেকে ১৯৩১ সালের ভিতর শিল্পের ওপর নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা অনেকটা কমে গেছে। এই হিসাবগুলো অবশ্য নির্ভুল নয় বরং বড় রকমের ভুলই এতে আছে। কিন্তু প্রধান কথাটা মনে রাখা দরকার। গত শতাব্দীর শেষ দিকে এবং এ শতাব্দীর গোড়ায় যখন রেলপথ প্রবর্তনের কল্যাণে এবং অন্যান্য কোনো কোনো আধুনিক শিল্পের বিকাশের ফলে সাধারণভাবে কৃষিতে নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা হ্রাস পাবে এমন আশা করা স্বাভাবিক ছিল, তখন লোকগণনায় ঠিক উল্টো ফলটাই দেখা গেল কেন? এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, কুটিরশিল্পের ভাঙ্গনই এই অস্বাভাবিক পরিণতির একটি প্রধান কারণ।
আধুনিক শিল্পের সঙ্গে এসেছে বিজ্ঞান ও আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র। দেশের অনুন্নত অঞ্চলেও এর ফলে মৃত্যুর হার কমেছে। অতএব লোকসংখ্যার বৃদ্ধির হার বেড়েছে। অথচ এসব দেশে আধুনিক শিল্প এমন শক্তি অর্জন করতে পারেনি যে, এই দ্রুত বর্ধমান লোকসংখ্যার জন্য কর্মের সংস্থান হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একদিকে কুটিরশিল্পের অবক্ষয়, অন্যদিকে জনসংখ্যার বৃদ্ধি-এ দুয়ের প্রভাবে অর্ধবেকারদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এদের সবাই গ্রামে বসে ধুঁকতে রাজী নয়। গ্রাম ছেড়ে নগরে মানুষ এসেছে জীবিকার সন্ধানে। কিন্তু নগরে, অর্থাৎ আধুনিক শিল্পে, এদের জন্য কর্মের সুযোগ সীমাবদ্ধ। অতএব গ্রামে ছিল যারা অর্থবেকার, নগরে এসে তাদের অনেকে পূর্ণ বেকার। অথবা এখানেও শিল্পের বাইরে কোনো অপ্রয়োজনীয় কাজে তারা আবারও অর্ধবেকার। কিংবা তাদের স্থান হয় সমাজবিরোধীদের দলে।
অতএব উন্নতির ধারা যেখানে নগর থেকে পল্লীতে ছড়িয়ে পড়েনি সেখানেই যে প্রাচীন ও আধুনিক দুই অর্থনীতি পরস্পরের প্রতি পরম অনীহায় এক সহযোগহীন অথচ দ্বন্দ্বহীন সমান্তরাল জীবনযাপন করছে এমন নয়। বরং নিষ্ফল আঘাতে এরা একে অন্যকে ক্রমাগত রুগ্ন করে তুলছে।
গ্রামে পরিব্যাপ্ত দারিদ্র্য, নগরের অসম ঐশ্বর্যের প্রভাবে যা আরও অসহনীয়। মহানগরীতে বেড়ে চলেছে তাদের সংখ্যা, যারা একে ত্যাগ করতে পারে না অথচ ঘৃণা। করে। যেখানে বাস করে আজকের পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ, সেই অধোন্নত দেশগুলিতে কি-সামাজিক, কি-সাংস্কৃতিক, কি-আর্থিক, যে-সব সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে তার মূলে আছে গ্রামীণ ও নাগরিক সমাজের এক সামঞ্জস্যবিহীন সহাবস্থান। এদের ভিতর কোনো শর্তেই কি মৈত্রী সম্ভব নয়?
.
৪
নগর গ্রামের ওপর চেপে বসে; গ্রামকে শোষণ করে; মানুষের কর্মসংস্থান কেড়ে নেয়; সমাজকে রুগ্ন করে। আধুনিক শিল্পায়নের বিরুদ্ধে এই ছিল গান্ধীর অভিযোগ। নগর ও গ্রামের সম্পর্কের ভিতর তিনি ঔপনিবেশিক শোষণের আদলই খুঁজে পেয়েছিলেন। পশ্চিম ইয়োরোপে শিল্পায়নের অভিজ্ঞতার দিকে তাকিয়ে মার্ক্সের মনে হয়েছিল যে, ধনবাদী সমাজের প্রধান অন্তর্দ্বন্দ্ব পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব। গান্ধীর অভিজ্ঞতা তাঁকে অন্য এক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে গেল নগর ও গ্রামের দ্বন্দ্বই সমাজের প্রধান সমস্যা। উপনিবেশ শোষণ করে ইংল্যাণ্ডের যে উদবৃত্ত সম্পদ তাতে যেমন সে-দেশের পুঁজিপতি ও শ্রমিক উভয়েই লাভবান, গ্রাম থেকে আহৃত ধনে তেমনি নগরের সকল শ্রেণীই অংশীদার। নগরের শ্রমিক অথবা করণিকও এ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত নয়। গ্রামের দারিদ্র্যের তুলনা হয় না। অর্থ ও ক্ষমতা উভয়েরই কেন্দ্রস্থল নগর। এখান থেকেই দেশ শাসিত হয় এবং সে শাসন দেশের স্বার্থে নয়। এই অতিকেন্দ্রিকতার অত্যাচার সমাজতন্ত্রের নামেও আসতে পারে। আধুনিক শিল্পায়নের ভিতরই নগরভিত্তিক শাসন ও শোষণের ঝোঁক নিহিত আছে, এই ছিল গান্ধীর মত। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি মন্তব্য স্মরণযোগ্য নেহরু মনে করেন যে, সমাজতন্ত্র হলেই এই সমস্যা মিটে যাবে, কিন্তু আমি তা মনে করি না।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি ও কুটিরশিল্পের পারম্পর্যের ভিত্তিতে যে স্বয়ংভরতা একদিন স্থাপিত হয়েছিল, সেই দিকে গান্ধী চোখ ফেরালেন। ঐখানেই তিনি পেলেন তাঁর বাঞ্ছিত ভবিষ্যতের ঠিকানা। মরিস ফ্রিডম্যানকে গান্ধী বলেছিলেন, বৃহৎ শিল্পের ওপর নির্ভর করলে গ্রাম শোষিত হবেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এটাই অনিবার্য। অতএব আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে আত্মনির্ভর গ্রামের ওপর, যেখানে উৎপাদন হবে মুখ্যত প্রয়োজন অনুযায়ী।
গান্ধীর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কয়েকটি কথা সহজেই ভোলা যেতে পারে। ১৯৪৫ সালে গান্ধীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে নেহরু লিখেছিলেন আমার এটা অনিবার্য মনে হয় যে, আধুনিক যানবাহন এবং আরও বহু রকমের আধুনিক উদ্যোগ আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। এ ছাড়া গতি নেই। যদি তাই হয় তবে তো বেশ কিছু ভারী শিল্প এসেই গেল। বিশুদ্ধ গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে এর কতটুকু সঙ্গতি! তা ছাড়া বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে, সামরিক ও অর্থনীতিক দু-রকমের আক্রমণের বিরুদ্ধেই, আত্মরক্ষার কথাও এই প্রসঙ্গে চিন্তা করতে হবে। আমার তো মনে হয় না যে, ভারত বস্তুত স্বাধীন হতে পারবে, যদি না সে শিল্পকলার দিক থেকে উন্নত দেশ হয়।’ ভারী শিল্পের প্রয়োজন গান্ধী ও স্বীকার করেছিলেন তাঁর শেষ দিকের লেখাতে সেটা সন্দেহাতীত। কিন্তু ওটাকে যেন তিনি নিয়মের ব্যতিক্রমের মতো একবার উচ্চারণ করে তারপর ভুলে থাকতে চাইছিলেন। অথচ প্রয়োজন এখানে নিয়মটাকে নতুন করে লেখা। ভারী শিল্পকে একবার গ্রহণ করলে তাকে ভুলে থাকবার জো নেই। ওটাকে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেব, এ কথা বললেও সমস্যার সমাধান হয় না। ভারী শিল্পকে প্রবেশ করতে দেওয়া মানেই হলো নগরকে। মেনে নেওয়া। আর তা হলেই নগরের সঙ্গে গ্রামীণ সমাজের সম্পর্কের প্রশ্নটা নতুন করে ভাবতে হয়।
আরও কথা আছে। শহর আবশাক শুধু ভারী শিল্পের আশ্রয় হিসেবেই নয়। স্মরণ করা প্রয়োজন ইতিহাসের কয়েকটি গোড়ার কথা। গ্রামীণ অর্থনীতির অভ্যন্তর থেকে সেই শক্তি বড় আসে না যার জোরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। বরং গ্রামীণ। অর্থনীতির স্বাভাবিক ঝোঁক নিশ্চলতার দিকে। বাইরের ধাক্কাতেই সেই নিশ্চলতা কাটে। সেই ধাক্কা আসে নগর থেকে। আঠার-উনিশ শতকের অনেক চিন্তাবীর ও অর্থনীতিবিদই এ কথাটা বুঝেছিলেন। মার্ক্সও বুঝেছিলেন। গ্রামের ওপর শহরের আধিপত্য তিনি লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু এর ভিতর ইতিহাসের একটা অগ্রগতির আভাসই তিনি পেয়েছিলেন। আধুনিক শিল্পের আঘাতে যখন ভারতের গ্রামগুলি ভাঙ্গনের মুখে তখন। তিনি লিখেছিলেন, এ করেই তো জাতিপাঁতির বাঁধন ভাঙ্গবে। আরও শক্ত ভাষায় মন্তব্য করেছিলেন, এটা যতই কষ্টজনক হোক না কেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই গ্রাম্য সমাজই ছিল প্রাচ্য স্বৈরাচারের ভিত্তি। একে না ভেঙ্গে মানুষ তার ভবিষ্যৎকে জয় করবে কী করে? মার্ক্সের কথাগুলো হয়তো একটু অতিরিক্ত জোরালো হয়েছিল। অন্তত এ দেশে গ্রামীণ অর্থনীতি যতটা বিপর্যস্ত হয়েছে জাতিভেদ ততটা দুর্বল হয়নি, নগর থেকে সঞ্চারিত হয়নি গ্রাম্যসমাজে বাঁধন ভাঙ্গার শক্তি। তবু উনিশ শতকের প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা সত্য আছে যাকে উপেক্ষা করা ভুল
আধুনিক যুগের জ্ঞানবিজ্ঞান, বৈচিত্র্যধর্মিতা, মধ্যযুগীয় বন্ধন থেকে মুক্তি, ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার আদর্শ এবং আর্থিক উন্নয়ন সম্বন্ধে নতুন ভাবনা ও পরিকল্পনা নগরের পরিবেশেই লালিত হয়েছে। আমাদের সামনে সমস্যা এই নয় যে, গ্রামের সঙ্গে শহরের সম্পর্ক কী করে ছিন্ন করা যায়। বরং এ দুয়ের সম্পর্ক কী করে আরও অর্থপূর্ণ, আরও ফলবান করেতোলা যায় সেটাই মূল সমস্যা। ঔপনিবেশিক আধিপত্যে গান্ধীর আপত্তি ছিল, পারস্পরিক সহযোগিতায় আপত্তি ছিল না। বরং শোষক ও শোষিত দেশের ভিতর সম্পর্কের এই সংশোধনই তিনি চেয়েছিলেন। গ্রাম ও শহরের ভিতর সম্পর্কেও এই পরিবর্তন আনা যায় কিনা সেটাই বিচার্য।
এ দেশে নগর ও পল্লীর ভিতর দূরত্ব বড় বেশি। ছোট ও মাঝারি আকারের শহর নিতান্তই অপর্যাপ্ত। অথচ ছোট শহরের অথবা গঞ্জের সঙ্গেই গ্রামের সাধারণ কাজের সম্পর্ক চলে ভালো। নগরে গিয়ে গ্রামের মানুষ হারিয়ে যায়, গঞ্জে গিয়ে সে দিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরবার মুখে প্রয়োজন মতো দু-একটা জিনিস, কিছু নতুন খবর, বাইরের পৃথিবীর এক ঝিলিক সঙ্গে নিয়ে ফেরে। গ্রামের সঙ্গে বৃহত্তর পৃথিবীর। যোগাযোগের সেতু এই ছোট শহর। প্রতিটি গ্রামের কয়েক মাইলের ভিতর একটি করে মহানগরী বসানো যায় না, কিন্তু ছোট শহর এনে দেওয়া যায়। এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের অবস্থার পার্থক্যটা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশে আছে গোটা পনেরো গ্রামের জন্য একটি ছোট শহর। ও সব দেশে আমাদের তুলনায় পথঘাটও অনেক ভালো। আমাদের দেশে শহর-পিছু গ্রামের। সংখ্যা দুশো, কোথাও কোথাও আরও অনেক বেশি। কানপুর অঞ্চলের কথা ধরা যাক। মোটামুটি সতেরো হাজার বর্গ মাইলের একটি অঞ্চল এতে আছে একটি মহানগর কানপুর), ২৪টি শহর এবং ১১,২৩৯টি গ্রাম। অর্থাৎ, শহর-পিছু গ্রামের সংখ্যা ৪৬৮। এটা অবশ্য ১৯৭১-এর গণনার আগের হিসেব, কিন্তু নতুন গণনার এমন আর কি বড় পার্থক্য হবে?
গান্ধীবাদীরা কুটির শিল্পের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। তাঁরা শিল্পকে ছড়িয়ে দেবার কথা বলেন এবং এজন্য ছোট শিল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সব ছোট শিল্পের সঙ্গে কৃষির যোগাযোগ আছে, সকল ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে স্থানীয় ছোট এবং মাঝারি ধরনের শিল্প। ভবিষ্যতে এদিকে আমরা আরও মনোযোগী হব। যা আজ জমিতে ফলছে তার কথা ভাবলেই চলে না, যা ফলতে পারে তার কথাও ভাবতে হবে। আধুনিক শিল্পকে আজ দেশ থেকে তুলে দেওয়া যাবে না। সহায়ক ও প্রতিদ্বন্দ্বী দুই হিসেবেই তাকে মেনে নিয়ে তবে গ্রামীণ শিল্পকে এগোতে হবে। কুটির শিল্পকে রক্ষা করবার জন্য সরকারী সাহায্য চাওয়া আমাদের অভ্যস্ত রীতি। কিন্তু শুধু দান-অনুদানের ওপর নির্ভর করে ছোট শিল্পকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
অতএব গান্ধীবাদীরাও ছোট শিল্পের উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির প্রয়োজন স্বীকার করেন। এই প্রসঙ্গে আরও দুয়েকটা কথা এসে যায়। উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতি অবশ্যই প্রয়োজন; কিন্তু কোনো শিল্পের কার্যকুশলতা তার পরিপার্শ্বের ওপরও বহু পরিমাণে নির্ভর করে। পুরনো গ্রামীণ শিল্পে আজ আর ফিরে যাওয়া যাবে না। ক্রমশই বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে। কেনাবেচার জন্য নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এইভাবে এসে যায় পৃথঘাটের কথা, বৈদ্যুতিক শক্তির সরবরাহের কথা, শিক্ষার কথা। কোনো পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলকে তুলতে হলে শুধু কুটির শিল্পের জন্য সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন পথঘাট, শিক্ষা, সেচ ও বিদ্যুৎ, যার সাহায্যে অঞ্চলটির সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত তৈরি হয়।
গ্রামের কাছাকাছি ছোট শহরের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আগে বলা হয়েছে। শহর ও গঞ্জ জাগিয়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা চাই। এটাও উন্নয়নের ভিত তৈরি করার কাজেরই অঙ্গ। কোনো একটি অঞ্চলে এত মাইল রাস্তা হবে বলাটাই যথেষ্ট নয়। গ্রাম এবং বর্তমান ও সম্ভাব্য ছোট শহর নিয়েই আমরা সেই বিন্দুগুলো পাই, যাদের ভিতর রেখা টেনে টেনে পথঘাটের একটা রূপরেখা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর এ কথাটা শুধু পথঘাট সম্বন্ধেই প্রযোজ্য নয়। শিক্ষা, বিদ্যুৎ সব কিছু পরিকল্পনার জন্যই এই রকম কয়েকটি স্থির বিন্দু প্রয়োজন হয়। গ্রাম এবং নতুন নতুন উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়েই রচনা করা যায় আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অপরিহার্য আধার।
বিকেন্দ্রীকরণেরও একটা সীমা আছে। এবং সে সীমা যুগে যুগে বদলায়। মধ্যযুগের বিকেন্দ্রীকরণ আধুনিক যুগে সম্ভব নয়। গ্রামীণ শিল্পকেও আজ প্রয়োজন মতো অনেক সময়ে গ্রামের নিকটবর্তী কোনো উন্নয়ন কেন্দ্রের সান্নিধ্য খুঁজতে হবে। এ প্রসঙ্গে জাপানের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করা যেতে পারে। ছোট শিল্পে পারদর্শিতার জন্য জাপান গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ই. এ. জে. জনসন সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর পুস্তকে আমাদের একটি ভুল ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, মেইজি যুগে জাপানের গ্রামীণ শিল্প কৃষকের কুটিরে কুটিরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এ ধারণা ঠিক নয়; বরং এই সব শিল্প, নামে গ্রামীণ হলেও, কার্যত অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের নিকটবর্তী শহর-বাজারেরই সংলগ্ন ছিল। অবশ্য সবক্ষেত্রেই যে এমন হতো তা নয়। আগে শিল্পের যে সান্নিধ্যগুণের কথা আলোচনা করেছিলাম, ছোট শিল্পের বেলায়ও তা অল্প-বেশি প্রযোজ্য। ছোট শিল্পও পরস্পরের এবং বড় শিল্পের সান্নিধ্য থেকে বিশেষ বিশেষ সুবিধা লাভ করে। কোন শিল্পের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ কতদূর সম্ভব অথবা তাতে তার আর্থিক দক্ষতায় কতখানি ইতরবিশেষ হবে, বলা বাহুল্য সেটা তার বিশেষ গঠন প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
অতএব বিকেন্দ্রিক অর্থনীতি চাই, মাত্রা রক্ষা করে। অতিকায় নগরে ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এক কথা, আর গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব অন্য কথা। গ্রাম, ছোট ও মাঝারি শহর এবং কেন্দ্রীয় নগর, এ তিনের পারস্পরিক নির্ভরতাকে আশ্রয় করে পরিকল্পনা রচনা করা আবশ্যক। বিকেন্দ্রিক অর্থনীতির ধারণাটাকেও এই আধারেই স্থাপনা করা চাই। গঞ্জের চারদিকে ছড়ানো গ্রাম; নগরকে বেষ্টন করে ছোট ছোট শহর। গ্রামের জন্যই গঞ্জ, গঞ্জকে ছাড়া গ্রামের চলে না। গ্রামের প্রয়োজন মেটে ছোট শহরে, আবার ছোট শহরকে প্রয়োজন মেটাবার জন্য যেতে হয়। আরও বড় নগরের কাছে। কোনো কোনো শিল্পের স্বাভাবিক অবস্থান নগরে, আবার কারও স্বাভাবিক বাসভূমি গ্রামে অথবা কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্রস্থিত বাজারে। এই সব বিবিধ প্রয়োজনের কথা মনে রেখে ছোট বড় মাঝারি গ্রাম ও নগরকে হাত ধরাধরি করে চলতে
অর্থনীতিতে যদি বিকেন্দ্রীকরণ চাই, তবে সেই সঙ্গে ভেবেচিন্তে শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থারও পরিবর্তন আনতে হবে। আঞ্চলিক উন্নয়নের ওপর জোর দিতে গেলে, কেন্দ্রকে ক্ষমতা ও দায়িত্ব কিছুটা ছাড়তে হবেই। অথচ আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে শাসনের ভার ছেড়ে দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে এমনও নয়। অনুন্নত অঞ্চলকে যদি বলা হয় যে, তুমি এবার নিজের শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের ইচ্ছা মতো চল, তবে সে ক্রমাগতই পিছিয়ে থাকবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। তার সামর্থ্যই যে কম, অতএব বিশেষ সহায়তা আবশ্যক। সেটা পাওয়া যেতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। এই সহায়তার শর্ত হিসেবে যদি তাকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। হলেও আবার বিভ্রাট ঘটবে পদে পদে। প্রতিটি ব্যর্থতার জন্য যতদিন সে অন্য কাউকে। দোষ দিতে পারবে ততদিন তার আত্মশক্তি জাগরিত হবে না।
আমাদের শিক্ষা এককেন্দ্রিক; সেই কেন্দ্রটি মহানগরীতে। জ্ঞানের সঙ্গে প্রয়োজনের একটা যোগ থাকা উচিত। মহানগরীর প্রয়োজন এক, গ্রামের প্রয়োজন ভিন্ন। আমাদের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে গ্রামের প্রয়োজনের যোগ নেই। এমন কি, এ দেশের মহানগরেরও যোগ ঘনিষ্ঠ নয়। জ্ঞান উৎপাদনের কলকারখানাগুলি উন্নত দেশে; সেখান থেকে তৈরি বিদ্যা এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মারফত এ দেশের বিদ্যার্থীদের ভিতর বিতরণ করা হয়।
জ্ঞানের ব্যবসায়ে এই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা চলেছে। কোনো দেশ থেকেই অবশ্য জ্ঞান আহরণ করতে কারও লজ্জাবোধ করা উচিত নয়। কিন্তু বিদ্যার সঙ্গে বেত্তার এবং বেত্তার। সঙ্গে তার জীবনের একটা যোগ থাকা আবশ্যক। রোগশোক এ দেশের গ্রামে গ্রামে। ডাক্তার তৈরি হয় মহানগরীতে। সেই অধীত বিদ্যায় গ্রামের রোগীকে এ দেশে সহজলভ্য উপকরণে কি করে যথাসম্ভব নিরাময় করা যায় ও সুস্থ রাখা যায়, তার প্রতি দৃষ্টি কম। ফলে আমাদের ডাক্তারীর ছাত্রের বিলেতে পেশা জমাতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু স্বদেশের গ্রামে সে অসহায়। এ শুধু একটা উদাহরণ। মোট কথা, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যে, আমাদের প্রয়োজনের দ্বারা সেটা চালিত হয়। আর প্রয়োজন বলতে শুধু মহানগরীর প্রয়োজন নয়। এই বৃহৎ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রয়োজনকেই বিদ্যার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
এমন কোনো দিন আসতে পারে, যখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কাজ করবে কোনো-না-কোনো মহানগরীতে, সন্ধ্যায় কাজের শেষে ফিরে যাবে নিজ নিজ পল্লীতে। অদ্ভুত এটা সম্ভাবনার সীমার বাইরে নয়। কিন্তু এ কথাও নিশ্চিত যে, আরও বহুদিন। পর্যন্ত গ্রামই হবে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের বাসস্থল ও কর্মস্থল। অতএব নগরের জীবনধারার সঙ্গে কলহান্তরিত পল্লীর মিলন ঘটানো এ যুগের একটা বড় কাজ। শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি, সব কিছুকেই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। নয়তো কাজ সম্পূর্ণ হবে না।
এই মিলন প্রচেষ্টা দূর ভবিষ্যতেও সম্ভবত অর্থহীন মনে হয় না। গ্রামীণ সমাজের ত্রুটি যাই থাকুক না কেন, তার মূলে আছে পারিবারিক আদর্শ, সহজ প্রীতির আদর্শ। অপর পক্ষে নাগরিক সমাজে স্বাধীন ব্যক্তিমানুষ বৈচিত্র্যের মধ্যে মুক্তি খুঁজেছে। এ দুয়ের কোনোটিকেই কি মানুষ ছাড়তে পারবে? নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে উভয়ের একটা সময়ের সন্ধান তাকে করতেই হবে।
পল্লী ও নগর (১৯৭৩)