পরদিন সকালে স্নানটান সেরে কিছু খেয়ে জ্যোৎস্না এবং তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আবার হাসপাতাল।
আজ মোহনবাঁশি অনেকটা ভালো। নাক থেকে অক্সিজেনের নল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে স্যালাইন চলছে। বিপদ প্রায় কেটেই গেছে।
ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, পুরোপুরি চিন্তামুক্ত। হাসিমুখে শেখরনাথকে বললেন, কাকা, মোহনবাঁশি বেঁচে গেল। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। আরও একটা উইক তাকে হাসপাতালে রাখব। তারপর ছুটি।
শেখরনাথ বললেন, এক উইক কেন, যতদিন তাকে রাখা দরকার ততদিন থাকবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
আজ দু-একটা কথা বলতে পারছে। ওর স্ত্রী ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় এসেছে?
হ্যাঁ
চলুন, ওদের সঙ্গে মোহনবাঁশির দেখা করিয়ে দিই। স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পারলে তার দুশ্চিন্তা কাটবে।
হ্যাঁ, চল—
বিনয় নীরবে একটা চেয়ারে বসে ছিল। মোহনবাঁশি যমের ঘর থেকে ফিরে এসে কথা বলতে পারছে, এটা বিরাট সুখবর। তার বউ ছেলেমেয়েদের পক্ষে তো বটেই, আন্দামানের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের পক্ষেও। লোকটা মরে গেলে জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজিদের সেই বিজন অরণ্যে ধরে রাখা যেত না। তারা কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়ত। আর এই খবরটা কোনওভাবে কলকাতায় পৌঁছে গেলে সেখান থেকে আর উদ্বাস্তু আনা সম্ভব হত না। এত বড় একটা পরিকল্পনা, এত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেস্তে যেত। বিনয়ের কী ভালো যে লাগছিল। সে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সঙ্গে যেন সাতপাকে জড়িয়ে গেছে। এদের ভালো হলে তার অপার আনন্দ, এদের অনিষ্ট হলে সেটা যেন তার নিজস্ব ক্ষতি।
তেতলার কেবিনেই রাখা হয়েছিল মোহনবাঁশিকে। এ কদিন সে ছিল অচৈতন্য, চোখ বোজা। আজও আচ্ছন্নতার ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। তবে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে।
জারোয়াদের তির মোহনবাঁশির বুকে বেঁধার পর থেকে জ্যোৎস্না যেন উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিল। কখনও অঝোরে কাঁদত, কখনও বা নিঝুম বসে থাকত।
আজ মোহনবাঁশিকে তাকাতে দেখে বিপুল আবেগে আনন্দে জ্যোৎস্না তার উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, সেই সঙ্গে সমানে ফুঁপিয়ে চলেছে। ডাক্তার চট্টরাজ তার দুহাত ধরে ফেললেন, না, না, ওর কাছে যেও না; দূর থেকে একটু কথা বল—
জ্যোৎস্নার চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে। সে বলল, অহন কেমুন লাগতে আছে তুমার?
নির্জীব, ভঙ্গুর একটু হাসি আবছাভাবে ফুটে ওঠে মোহনবাঁশির মুখে। –ভালা। এই যাত্রা বাইচা গেলাম।
ডাক্তার চট্টরাজ তাড়া দিলেন।—-দেখা হয়েছে, কথা বলেছ। আর নয়। সবাই নিচে চল—
আমারে হের কাছে আরেট্টু থাকতে দ্যান ডাক্তারবাবু৷ কতদিন মানুষটা কথা কইতে পারে নাই। বেহুঁশ হইয়া আছিল–জ্যোৎস্না কাকুতি মিনতি করতে লাগল।
না। বেশি কথা বললে মোহনবাঁশির ক্ষতি হবে। এখন চল। বিকেলে আবার তোমাদের ওর কাছে নিয়ে আসব।
দোতলায় নেমে একবার জ্যোৎস্না ডাক্তার চট্টারাজের পায়ে পড়ে, একবার শেখরনাথের। এমনকী বিনয়ের পায়েও। সমানে অধীরভাবে বলে যেতে থাকে, আপনেরা ভগমান। মানুষটারে বাঁচাইয়া দিলেন। আপনেগো দয়া কুনুদিন ভুলুম না। কৃতজ্ঞতা জানাতে একটি অশিক্ষিত, সরল রমণী আর কী-ই বা করতে পারে।
শেখরনাথ জ্যোৎস্নার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে সদয় কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। দেখলে তো মোহনবাঁশি আজ দু-চারটে কথা বলেছে। দেখবে ওবেলা আরও বেশিক্ষণ বলতে পারবে। সব ভয় কেটে গেছে। তোমরা শান্ত হয়ে এখানে বসে থাকো। আমরা একটু ঘুরে আসি। দুপুরে তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসব।
জ্যোৎস্না আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয়। –আইচ্ছা
শেখরনাথ এবার বিনয়ের দিকে তাকালেন। –চল, তোমাকে নিয়ে তিন নম্বর ব্লকটায় যাওয়া যাক। কাল তোমাকে সেলুলার জেলে আমার অভিজ্ঞতার কথা সামান্য একটু শুনিয়েছিলাম। আজ তারপর থেকে কিছুটা শোনাব। এত বছরের এত অজস্র ঘটনা তো দু-একদিনে বলে শেষ করা যায় না। রোজ জেলখানা দেখাতে দেখাতে কিছু কিছু শুনিয়ে যাব। তাহলে ব্রিটিশ আমলের এই সেলুলার জেল, যাকে বলা যায় ইস্টার্ন ওয়ার্ডের বাস্তিল, সম্বন্ধে তোমার মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে যাবে।
হাসপাতালের ব্লকটা পেছনে ফেলে শেখরনাথের সঙ্গে জনমানবহীন তিন নম্বর বিশাল বিল্ডিংটায় পৌঁছে গেল বিনয়।
সামনের আগাছায় ভরা মস্ত চত্বরটা পেরিয়ে কয়েকটা স্টেপ ভেঙে ওপরের টানা অলিন্দে উঠে এল দুজনে।
শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, কাল কোন অবধি যেন শুনেছিলে?
বিনয় মনে করিয়ে দিল। সেলুলার জেলের জেলর বিপ্লবী রাজনাথ চক্রবর্তীকে শাসিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই জেলখানার ভেতর কয়েদিদের, বিশেষ করে টেরোরিস্টদের শায়েস্তা করার জুন্য তিনটে ফাঁসিঘর আছে। একজন জুনিয়র অফিসারকে বলেছিলেন, সেগুলো শেখরনাথদের দেখিয়ে দিতে। তারপর তার চেম্বার থেকে সবাইকে বের করে দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এদিকে এসো–তালাবন্ধ কুঠুরির পর কুঠুরির পাশ দিয়ে উত্তর দিকের শেষ মাথায় বিনয়কে নিয়ে এলেন শেখরনাথ। এখান থেকে কোনাকুনি সমুদ্র চোখে পড়ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি শুরু করলেন, জেলরের চেম্বার থেকে সেই দুই জুনিয়র পুলিশ অফিসার জেলের অন্য একটা অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। ফেউয়ের মতো আর্মড গার্ডরাও আমাদের পিছু পিছু গেছে।
সেখানে যে অফিসারটি ছিলেন তার আকৃতি জেলরের মতো বিপুল না হলেও তাগড়াই মজবুত চেহারা। মুখটা বুনো শুয়োরের মতো। চুলের মাঝখান দিয়ে সিথি। কুতকুতে চোখের চাউনি এত তীব্র যে তার দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। রাজনাথের মতো দুঃসাহসিক ছেলেও একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।
এই চেম্বারে অফিসারটি ছাড়া আরও দুজন কেরানি ধরনের কর্মচারী ছিল। তারা ভারতীয়। তাদের একজনকে ঘোঁত ঘোঁত করে অফিসার বললেন, রেকর্ড বুক দেখে এই বাস্টার্ডদের নাম ঠিকানা মিলিয়ে নাও।
এর আগে রেগুলেশন অ্যাক্ট থ্রি আর বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-এ বারকয়েক ধরা পড়ে আলিপুর জেল, দমদম জেল, মেদিনীপুর জেল– এমনি নানা কয়েদখানায় কয়েকবছর কাটিয়েছি কিন্তু কোনও জেলর বা ডেপুটি জেলর আমাদের বেজন্মা বলে গালাগাল দেয়নি। শরীরের সব রক্ত মাথায় উঠে টগবগ করে ফুটছিল। দাঁতে দাঁত চেপে কোনওরকমে প্রচণ্ড ক্রোধটা সামলাচ্ছিলাম।
এদিকে কেরানিটা মস্ত ঢাউস বাঁধানো খাতা বের করে আমাদের নাম এবং বাড়ির ঠিকানা পড়তে পড়তে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। শেখরনাথ রাহা, রাজনাথ চক্রবর্তী, মুকুন্দ বসাক ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা সেলুলার জেলে পৌঁছুবার আগেই আমাদের নামধাম কলকাতা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকের নাম ঠিকানা বলার সঙ্গে সঙ্গে একে একে ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে যাচ্ছিলাম। অর্থাৎ কেরানি হেঁকে হেঁকে যা বলছে সব সঠিক।
এবার শূকর-মুখ অফিসার অন্য কেরানিটিকে বলল, সনস বিচদের জেলের উর্দিটুর্দি দাও–
প্রথমবার গালাগালিটা শুনেও চুপ করে থেকেছি। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর পারা গেল না। সহ্য করার শক্তিটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। বললাম, বাবা-মা তুলে গালি দিচ্ছেন কেন?
রাজনাথ আর মুকুন্দও চিৎকার করে উঠেছে, উই প্রোটেক্ট। আমাদের বাবা-মাদের এভাবে নোংরা ভাষায় অপমান করতে পারেন না। আপনারা সিভিলাইজড নেশন বলে গর্ব করেন, এই তার নমুনা?
রাজনাথ গলার স্বর আরও কয়েক পর্দা চড়িয়ে বলল, ইউ মাস্ট অ্যাপোলোজাইস-ইউ মাস্ট অ্যাপোলোজাইস সে যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। তার গালের কষ বেয়ে ফেনা বেরিয়ে আসতে লাগল। তোমার মা-বাবাকে যদি এভাবে উদ্ধার করি, কেমন লাগবে?
অফিসার প্রথমটা একেবারে থ হয়ে গেল। বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে এই সেলুলার জেলে এসে সবাই আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকে। কিন্তু তিন টেরোরিস্ট, বিশেষ করে রাজনাথের মতো একজন সদা লাপীর যে এমন সৃষ্টিছাড়া স্পর্ধা হতে পারে, কে ভাবতে পারে। উত্তেজনায় ক্রোধে মুখটা রক্তবর্ণ হয়ে উঠল অফিসারের। দুই চোখ থেকে আগুনের হলকা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। বাজ পড়ার মতো আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠল, ব্লাডি ডগস, শাট আপা তারপর সেই কেরানিটিকে বলল, এই জানোয়ারগুলোকে পাশের ঘরে নিয়ে যাও। যে দুজন যুবক ব্রিটিশ অফিসার আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তাদের বলল, পায়ে বেড়ি দিয়ে এদের সলিটারি সেলে রাখবে। আর কাল দুপুরে টিকটিকিতে চড়াবে। টেন ল্যাশেস ইচ।
টিকটিকি বস্তুটির কী মহিমা, তখনও জানি না। ল্যাশ শব্দটা অজানা নয়। সেটা হল কষাঘাত। শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল।
আমাদের পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। দুজোড়া করে নতুন উর্দি, সিলভারের থালা, গেলাস ইত্যাদি দিয়ে গলায় কালো কারে বাঁধা চৌকো লোহার পাত পরিয়ে দেওয়া হল। সেটায় খোদাই করে লেখা আছে– ২৪১। অর্থাৎ তখন থেকে আমি আর শেখরনাথ রাহা নই। আমার পরিচয় ২৪১। দুশো একচল্লিশ নম্বর কয়েদি। একই প্রক্রিয়ায় রাজনাথ হয়ে গেল ২৪২ এবং মুকুন্দ ২৪৩।
কেরানিটি তরুণ অফিসারদের কানে যাতে না যায়, এমনভাবে ফিস ফিস করল, পাশের কামরায় গ্রিনিজ সাহেবের সঙ্গে ওইরকম রাগারাগি না করলেই পারতেন।
ওই শুয়োর-মুখো অফিসারটির নাম যে গ্রিনিজ, সেই প্রথম জানা গেল। কেরানিকে বললাম, আমাদের কী বলে গালাগাল দিচ্ছিল, শুনেছেন তো?
কেরানিটি বলল, শুনেছি।
এসব শোনার পর কারও মাথার ঠিক থাকে, না থাকা উচিত?
কেরানিটি বলল, কী করবেন বলুন; ওরা রাজার জাত। যা বলবে মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে।
বাঃ, চমৎকার! একজন ভারতীয় হিসেবে আরেকজন ভারতীয়কে চরম অপমান করছে, দেখেও প্রোটেস্ট করলেন না?
কেরানিটির মুখ কালো হয়ে গেল। ক্ষীণ, ভীরু গলায় বলল, কী করব বলুন! নৌকরি করি; প্রোটেস্ট করলে নৌকরিটা তো যাবেই। টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে আমাকে ফাটকে ভরে দেবে। বাকি জীবনটা জেলের ঘানি ঘুরিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। আর আমার মা বাবা বউ বাচ্চা না খেতে পেয়ে মরে যাবে। একটু থেমে বলেছিল, আপনাদের জন্যে আমার খুব ভয় হচ্ছে।
সেই যুবক অফিসার দুটি নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। হঠাৎ তাদের নজর এসে পড়ল আমাদের ওপর। একজন বলল, অত কী বক বক করছ? চল চল
কেরানিটার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কী বিষয়ে আমাদের কথা হচ্ছিল যদি দুই অফিসার জানতে চায়, সে বিপদে পড়ে যাবে। কিন্তু অফিসাররা সে ব্যাপারে কৌতূহল দেখাল না। তারা আমাদের তিন রেভোলিউশনারিকে তাড়া দিয়ে নিয়ে চলল।
দুটো ব্লক পেরিয়ে এই তিন নম্বর ব্লকে আমাদের নিয়ে আসা হল। তখন সামনের চত্বরে লাইন দিয়ে অনেক পুরনো কয়েদি দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে সিলভারের থালা এবং গেলাস। একধারে উঁচু টেবিলের ওপর কাঠের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কড়াতে পুরু পুরু চাপাটির স্তূপ আর বড় বড় সিলভারের বালতিতে সবজি। বিরাট দুটো ড্রামে খাওয়ার জলও রয়েছে। তিন জন পেটি অফিসার আর দুজন টিল্ডালকেও দেখা গেল। তারা খাদ্যবস্তুগুলো দেওয়ার জ্য হাতা এবং মগ নিয়ে অপেক্ষা করছে। এছাড়া রয়েছে বন্দুক হাতে এক দঙ্গল পুলিশ এবং একজন। ইন্ডিয়ান পুলিশ অফিসারও।
সূর্য তখন মাউন্ট হ্যারিয়েটের পেছন দিকে নেমে গেছে। তবে সন্ধে নামতে খানিকটা দেরি ছিল। দিনের শেষ ফিকে আলো চারদিকের পাহাড়, টিলা, উপসাগর আর বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষের গায়ে আলগাভাবে লেগে আছে৷ সমুদ্রের ওপর দিয়ে। অজস্র সি-গাল পাখি ঝাঁকে ঝাকে পাড়ের গাছপালার দিকে উড়ে যাচ্ছে। সারাদিন সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকার করে খেয়েছে। পেট বোঝাই, রাতটা বিশ্রাম দরকার।
ইন্ডিয়ান সেই পুলিশ অফিসারটি– সে কোন প্রভিন্সের লোক কে জানে, কর্কশ স্বরে হুকুম দিল। –খানা চালু কর।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েদিদের লাইনটা পেটি অফিসার আর টিন্ডালরা যেখানে চাপাটিটাপাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে চলল। পেটি অফিসাররা প্রতিটি কয়েদির থালায় চারটে করে চাপাটি দিতে লাগল। চাপাটি নিয়ে তারা এগিয়ে গেল পাশের দিকে। সেখানে রয়েছে সবজির বালতিগুলো। প্রত্যেকের থালায় দুহাতা করে সবজি দেওয়া হল, তারপর সবার গেলাসে গেলাসে জল।
আমাদের অবশ্য কিউতে দাঁড়াতে হল না। যে ব্রিটিশ অফিসাররা আমাদের নিয়ে এসেছিল তাদের একজন ইন্ডিয়ান। অফিসারটিকে ডেকে বলল, এই ২৪১, ২৪২, ২৪৩ নম্বর কয়েদি আজ নতুন এসেছে, এদের আজ লাইনে দাঁড়াবার দরকার নেই। ওদের খাবার আনিয়ে দাও
শশব্যস্ত ভারতীয় অফিসারটি একজন পেটি অফিসারকে ডেকে আমাদের হাত থেকে থালা-গেলাস নিয়ে চাপাটি-সবজি এবং জল আনিয়ে দিল। এবার ব্রিটিশ অফিসারটি ইন্ডিয়ানটিকে বলল, এরা ড্রেডেড ক্রিমিনাল, টেরোরিস্ট। হায়ার অথরিটির অর্ডার, এদের পায়ে বেড়ি লাগিয়ে সলিটারি সেলে রাখতে হবে। কাল এদের টিকটিকিতে চড়িয়ে দশ ঘা করে বেতের বাড়ি। আন্ডারস্ট্যান্ড?
তক্ষুনি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল ইন্ডিয়ানটি। –ইয়েস স্যার। ব্রিটিশ অফিসারটি বলল, এই ব্লকের দোতলায় সলিটারি সেল আছে। পেটি অফিসারদের চাবি আর লোহার বেড়ি আনতে বল। এখনই ওদের ঢোকানো হবে।
ইন্ডিয়ানটি পেটি অফিসারদের ডাকল না, নিজেই দৌড়ে গিয়ে কোত্থেকে, যেন চাবির গোছা আর লোহার বেড়ি নিয়ে এল। ব্রিটিশ অফিসারটি বলল, এবার চল। একজন পেটি অফিসারকে সঙ্গে নাও।
আমাদের পাহারা দিয়ে এই তিন নম্বর ব্লকের দোতলায় নিয়ে আসা হল। মুকুন্দ, রাজনাথ আর আমাকে পাশাপাশি রাখা হয়নি। আমার জন্যে ঠিক হল সিসোস্ট্রেস বের দিকের শেষ সেলটা। তারপর পঁচিশ-তিরিশটা সেল-এর পর দোতলার মাঝামাঝি জায়গায় একটা সেল মুকুন্দর আর রাজনাথের সেলটা ওধারের শেষ প্রান্তে।
ইন্ডিয়ান অফিসারটি আমার সেলের তালা খুলে দিল। তার নির্দেশে পেটি অফিসার, পায়ে লোহার বেড়ি পরাল। ব্রিটিশ অফিসারটি পেটি অফিসারকে বলল, এক বালতি পানি আর টাট্টির জন্য প্যান এনে দে। আমাকে বলল, কাল সুবেহ হাত মুখ ধোওয়া, টাট্টি– সব কাম এই পানি দিয়ে সারতে হবে। দুপ্রহরে আর এক বালতি পানি মিলবে গোসলের জন্যে; আউর থোড়া পিনেকো পানি।
আমাকে সেলের ভেতর ঢোকানো হল। পাঁচ মিনিটের ভেতর জল, পায়খানার প্যান চলে এল। সামনের চত্বরে যে থালায় চাপাটি-টাপাটি দেওয়া হয়েছিল সেই খাবারের থালাটাও একধারে রাখল পেটি অফিসারটা। মেঝেতে একটা রোঁয়াওলা কম্বল আর তেলচিটে বালিশও রয়েছে। আমার জন্যে উত্তম। রাজশয্যা। সেগুলো থেকে বোটকা দুর্গন্ধ উঠে আসছিল। আমার আগে আরও কত কয়েদি– বাঙালি, মারাঠি, শিখ, বর্মী— যে ওটার ওপর শুয়ে রাত কাটিয়েছে, কে জানে। আমার গা গুলিয়ে উঠল।
ব্রিটিশ অফিসার, পেটি অফিসার, ইন্ডিয়ান অফিসার এবং আর্মড গার্ডরা আর দাঁড়াল না। বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রাজনাথ আর মুকুন্দকে নিয়ে চলে গেল।
দশ ফুট লম্বা আট ফুট চওড়া ছোট্ট কুঠুরির দুপাশে নিরেট দেওয়াল। পেছনের দেওয়ালে অনেকটা উঁচুতে ঘুলঘুলির চেয়ে একটু বড় জানলা, তার গায়ে লোহার মজবুত শিক বসানো। সামনের দিকে দরজা। সেই দরজায় গরাদ লাগানো। দরজাটার একধারে বেশ খানিকটা দূরে এমন কায়দায় তালা দেবার বন্দোবস্ত যে ভেতরের কয়েদি যদি কোনওভাবে চাবি জোগাড় করতে পারে, কিছুতেই গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই তালা খুলতে পারবে না। অবশ্য ভেতর থেকে পেছনের জানলা বা সামনের দরজার ফাঁক দিয়ে আকাশের একটা অংশ দেখা যায়। বহুদূর অবধি সেসোস্ট্রেস উপসাগর এবং ছোট ছোট কয়েকটা দ্বীপও চোখে পড়ে। এখন এই যে ব্লকের সামনে খোলা চত্বরটা দেখা যাচ্ছে সেখানে সেই আমলে ছিল লম্বা লম্বা শেড। সেইসব শেডের তলায় সারি সারি ঘানিঘর। ঘানিঘরের কী মহিমা, পরে টের পেয়েছিলাম।
যাই হোক, কুঠুরিতে তো ঢুকলাম। মৃত্যুকে ভয় পেতাম না। পেলে কখনওই বিপ্লবের পথে পা বাড়ালাম না। কিন্তু পায়ে বেড়ি দিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। এই আশি বর্গফুট এলাকায় সঙ্গে খাওয়া ঘুম পায়খানা পেচ্ছাপ– এসব ভাবতেই আতঙ্কে সারা শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল বাকি জীবন তো অনেকগুলো বছর, দুচার দিনও কাটবে কি না, কে জানে।
মনে পড়ে কম্বল পেতে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম। তারপর দরজার কাছে এসে গরাদ ধরে বাইরে তাকালাম। নিচের চত্বরে তখনও কয়েদিদের খাবার দেওয়া হচ্ছে।
একসময় সন্ধে নেমে গেল। মাঝখানের উঁচু ওয়াচটাওয়ারটা থেকে সাত দিকে যে সাতটা ব্লক বেরিয়ে গেছে, সর্বত্র অজস্র আলো জ্বলে উঠল। এমনকী সেলুলার জেলের শত শত কুঠুরিতেও।
সব কয়েদিকে খাবার দেওয়া শেষ হলে তারা থালা এবং জল। নিয়ে পেটি অফিসার আর আর্মড পুলিশের পাহারায় অনেকে গেল ব্লকের একতলায়, একদল দোতলায়, বাকি সবাই তেতলায়। চত্বরের ওধারে কোনাকুনি যে ব্লকটা দেখা যাচ্ছিল সেখানেও কয়েদিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কয়েদিদের সেলে ঢুকিয়ে পেটি অফিসাররা তালা লাগিয়ে দিল। প্রতিটি কয়েদির জন্য একটা করে সেল।
আমাদের ব্লকের দোতলাতেও দুড়দাড় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হইচই। বুঝতে পারছি, বাঁ দিকের সিঁড়ি দিয়ে কয়েদিরা উঠে আসছে। পুলিশ অফিসার, পেটি অফিসাররা চিৎকার করে বাছা বাছা খিস্তি দিতে দিতে তাদের থামাতে চাইছিল।—হল্লা মাত কর রেন্ডিকা বচ্চেলোগ। নেহি তো হাড়ি তোড় দুঙ্গা। বিলকুল চোপ–
পুলিশ এবং পেটি অফিসারদের শাসানিতে চেঁচামেচি সামান্য কমল ঠিকই, তবে একেবারে থেমে গেল না।
আমার কুঠুরি থেকে সামনের ব্লকের সেলগুলো দেখা যায়। কিন্তু আমাদের ব্লকের একতলা দোতলা বা তেতলার কোনও কুঠুরিই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে তালা খোলা এবং বন্ধ করার আওয়াজ কানে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম সেলে কয়েদিদের ঢোকানো হচ্ছে।
হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেল। একটি কয়েদি পাহারাদার আর পেটি অফিসারদের নজর এড়িয়ে আচমকা আমার সেলের। দরজার সামনে চলে এল। চাপা গলায় বলল, ভাইসাব, আমার নাম বৈজু। আমি এক মামুলি কয়েদি। লেকিন আপনারা যে তিনজন আজ নয়া এই কালাপানি এলেন তারা সবাই দেশকে আজাদের জন্যে লড়াই করেছেন তাদের সবাইকে ইজ্জৎ করি। নমস্তে। এখানকার পুলিশ, টিল্ডাল আর পেটি অফিসাররা বহোৎ হারামি। আপনাদের জান বরবাদ করে দিতে চাইবে। সবার জন্যে পারব না, তবে আপনাকে আমি দেখভাল করব।
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের তিন বিপ্লবীর সেলুলার জেলে আসার খবর তা হলে সাধারণ কয়েদিদের। মধ্যেও চাউর হয়ে গেছে! আমাদের ওপর যে প্রচণ্ড অত্যাচার চালানো হবে তা আগেই টের পেয়ে গেছি। কিন্তু মামুলি এই কয়েদিটি আমাকে বেছে নিয়ে কীভাবে আমার ওপর উৎপীড়ন কম হয় তার ব্যবস্থা করবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সে সম্মান করে সেজন্য লোকটাকে খুব ভালো লাগল। জিগ্যেস করলাম, তোমার নাম কী? সে বলল, বৈজু
বিনয় অপার বিস্ময়ে এক বিচিত্র জগতের ইতিহাস শুনে যাচ্ছিল। সে জিগ্যেস করল, কাল যে বৈজু আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে সেলুলার জেলে এসেছিল, এ কি সেই বৈজু?
শেখরনাথ মাথাটা সামান্য নাড়লেন হ্যাঁ। তারপর শোন– তিনি আবার পুরনো স্মৃতির ভেতর ফিরে গেলেন। বলতে লাগলেন, বৈজুকে জিগ্যেস করলাম, তুমি কত বছর আগে এখানে এসেছ? সে বলল, হোগা, লগভগ চার সাল। বাকি জিন্দেগি কালাপানিতেই কাটাতে হবে। কোন অপরাধে তাকে এই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে জানার জন্য ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু সে প্রশ্ন আর করলাম না। বেশ কয়েকটা খুন না করলে যে এখানে আসা যায় না, তা আগেই শুনেছি। তেমনই কিছু একটা করে থাকবে বৈজু।
আমি তখন অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। –আচ্ছা, বৈজু, আমাদের মতো রেভোলিউশানারি আর কেউ এখন সেলুলার জেলে আছে? সে একটু অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, রিভোলিশান কিয়া হ্যায়। বুঝলাম, রেভোলিউশানারি শব্দটা তার অজানা। বললাম, দেশের আজাদির জন্যে যারা লড়াই করছে তাদের কথা বলছি। ব্যাপারটা এবার মাথায় ঢুকল বৈজুর। সে বলল, জেলের অফিসাররা যাদের টিরোরিস (টেরোরিস্ট) বলে? আমি বললাম, হ্যাঁ। বৈজু জানাল, এই তিন নম্বর ব্লকের তেতলায়, চার নম্বর ব্লকের একতলায়, আর সাত নম্বর ব্লকের দোতলায় আরও কয়েকজন রয়েছে। বলল, যদি তাদের কাছে। আপনারদের খবর পৌঁছে দিতে বলেন তার ব্যওস্থা করতে পারি। ওদের খবরও আপনাদের কাছে পাঠাতে পারি।
শুনে আমি স্তম্ভিত। সেলুলার জেলের ভেতর চতুর্দিকে যেখানে শয়ে শয়ে সেন্ট্রি, রাইফেল উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে, ওয়াচটাওয়ার থেকে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি চালানো হচ্ছে, সেই কঠোর নিশ্চিদ্র যবনিকা ভেদ করে কীভাবে খবর চালাচালি করা সম্ভব, ভেবে পেলাম না। আমাকে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৈজু বলল, সব বন্দোবস্ত আছে। আপ বেফিকুর রহিয়ে। পরে সব জানতে পারবেন। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, শুনলাম, কাল আপনাদের তিন টিরোরিসকে টিকটিকিতে চড়ানো হবে। আমার বিস্ময়ের শেষ ছিল না। দেখা যাচ্ছে এখানে কোনও কিছুই গোপন থাকে না। সেলুলার জেলের প্রশাসন যে-সব নিরেট দেওয়াল তুলে রেখেছে তার মধ্যেও অদৃশ্য অনেক ছিদ্র রয়েছে। বৈজু বলতে লাগল, আপনার চোট যাতে কম লাগে সেটা আমি দেখব। আমি উত্তর দিলাম না। এবার কাচুমাচু মুখে বৈজু বলল, এক বাত কহুঙ্গা? বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলবে। একটু ইতস্তত করে বৈজু বলল, আমার বহুৎ ভুখ (খিদে)। সুবেহসে রাত তুক খালি। মনে হয়, পেটে আগ (আগুন) জ্বলছে। কয়েদখানা থেকে যে খানা দেওয়া হয় তাতে পেট ভরে না। আপনাকে আজ চারঠো চাপাটি দিতে দেখেছি। তামাম কয়েদিকেই। শুনেছি বঙ্গল মুল্লুকের আদমিরা বেশি খেতে পারে না। আমাকে দোঠো দেবেন?
এতক্ষণে বৈজুর সমধুর বাক্যবর্ষণের কারণটা স্পষ্ট হয়ে গেল। আমি হেসে ফেললাম। তারপর দুটো চাপাটি এনে তার হাতে দিয়ে বললাম, এখন থেকে রোজ আমার ভাগ থেকে দুটো করে চাপাটি তুমি পাঁবো হাটু অবধি মাথা ঝুঁকিয়ে বৈজু বলল, আপকা মেহেরবানি।
বৈজু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না। তার আগেই বিশাল তাকদবর এক পাঠান পেটি অফিসার অলিন্দের ওধার থেকে দৌড়ে এল। ছসাড়ে ফিটের মতো হাইট। পাথরের পাটার মতো চওড়া বুক। সারা মুখে দাড়ি। তার চোখ থেকে রাগে আগুন ছুটছে। মোটা মোটা আঙুল দিয়ে সাঁড়াশির মতো বৈজুর ঘাড় চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে সে গজরে উঠল, শালে, কুত্তার বাচ্চা, সেলে কয়েদি ঢোকাতে গিয়ে দেখি, এক হারামির পাত্তা মিলছে না। শিরে (মাথায়) বিলকুল চক্কর লেগে গেল। তারপর দেখি তুমি হারামি এখানে ভেগে এসে নয়া টিরোরিসের (টেরোরিস্টের) সাথ গপসপ (গল্প সল্প) করছ! চল শালে, চল আজ তোর হাড্ডি তুড়ে দেব। বৈজু বারকয়েক সেলাম ঠুকে কাকুতিমিনতি করতে লাগল, আমার কোঈ বুরা (খারাপ) মতলব নেহী হ্যায় আসলাম ভাই। নয়া কয়েদি এসেছে, তাই ভাবলাম দেখে যাই। দেখা করতে এসে, দো-এক বাত ভি হল– বলে আমাকে দেখিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলতে চাইল। ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তাতে কাজ হল। পরে জেনেছিলাম পেটি অফিসারটার পুরো নাম আসলাম খান। সে বৈঞ্জুর কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে ট্যারাবাকা লাল লাল দাঁত বের করে, চোখ কুঁচকে একটু হাসে। বলে, শালে হারামজাদা তারপর নিচু গলায় কথা বলতে বলতে চলে যায়। একটু পরেই পাশের কুঠুরির তালা খোলার শব্দ কানে আসে; সেই সঙ্গে আসলাম খানের কর্কশ স্বর। –ঘুষ যা কুত্তা। টের পেলাম পাশের কুঠুরিটা বৈজুর। তাকে ঢুকিয়ে ফের তালা লাগিয়ে টানা বারান্দা কাঁপিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল আসলাম খান।
.
একজন অত্যন্ত উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে সেলুলার জেলের পুরনো দিনের কথা বলতে খুব ভালো লাগছিল শেখরনাথের। কিন্তু সব দিকে তার নজর। বেলা এখন অনেকটাই চড়ে গেছে। বললেন, চল, হাসপাতালে ফেরা যাক।
বিনয়ের কৌতূহল মিটছিল না। যত শুনছিল, মনে হচ্ছে এক। আশ্চর্য, ভয়াবহ, অজানা পৃথিবীর দরজা তার সামনে খুলে যাচ্ছে। একতলার কোণের দিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। সে জিগ্যেস করল, পরদিন আপনাদের সত্যি সত্যিই টিকটিকিতে চড়ানো হয়েছিল?
শেখরনাথ বললেন, আজ আর নয়, কাল শুনো। মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েরা হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে। তাদের জন্যে ভাত ডাল তরকারি কিনতে এবারডিন মার্কেটে যেতে হবে। তবে
তবে কী?
যাবার আগে দোতলায় রাজনাথ, মুকুন্দ আর আমাকে যে সেলগুলোতে রাখা হয়েছিল, দেখিয়ে দেব। দোতলাটা অবিকল একতলার মতোই। সারি সারি তালাবন্ধ সব কুঠুরি। কোণের দিকের সিঁড়ি দিয়ে বিনয়কে সঙ্গে করে সেখানে উঠে এলেন শেখরনাথ। তাদের তিন বিপ্লবীকে কোথায় কোথায় রাখা হয়েছিল দেখিয়ে তারা ফিরে গেলেন হাসপাতালে।