০৬.
ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল সনি কর্লিয়নির মৃত্যু সংবাদ। শিউরে উঠল গোটা যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ জগৎ! নরক ভেঙে পড়বে এবার, বুঝতে বাকি থাকল না কারও। তারপর খবর এল রোগশয্যা থেকে উঠে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছেন ডন কর্লিয়নি। ইনফর্মাররা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখে এসে রিপোর্ট করল, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন ডন কর্লিয়নি, তাকে দেখে রুগ্ন বলে আর মনেই হচ্ছে না। নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবার প্রমাদ গুল এবার। সামগ্রিক যুদ্ধ যে অনিবার্য সেব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকল না কারও মনে। যার যতটুকু ক্ষমতা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল তারা। সাজ সাজ রব পড়ে গেল চারদিকে। নিকট অতীতে দূর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন ডন কর্লিয়নি, কিন্তু তাই বলে তাকে যে হেয় না, তুচ্ছ জ্ঞান করা চলে না, এটুকু বুঝতে ভুল করল না কেউ।
জীবনে খুব কম ভুলই করেছেন ডন কর্লিয়নি, য়ে কবার করেছেন, সেগুলো থেকে যথেষ্ট শিক্ষা অর্জন করেছেন।
ডনের প্রকৃত অভিপ্রায় একমাত্র হেগেন অনুমান করতে পেরেছে। শান্তি-প্রস্তাব দিয়ে পাঁচ পরিবারের কাছে যখন দূত পাঠালেন ডন, এতটুকু আশ্চর্য হলো না সে। শুধু মাত্র শান্তি-প্রস্তাব নয়, সেই সাথে নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবারের সাথে একটি আলোচনা-প্রস্তাবও করলেন তিনি। সেই সভায় যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত পারিবারিক সংগঠনকে ডাকা হলো। দেশের মধ্যে শুধু নিউ ইয়র্কের মাফিয়া পরিবারগুলোই সবচেয়ে প্রতাপশালী, তাই সবাই জানে যে তাদের মঙ্গলই দেশের মঙ্গল।
প্রথম দিকে কারও কারও মনে সন্দেহ দেখা দিল বৈকি। ফাঁদ পাতবার তালে নেই তো ডন কর্লিয়নি? শত্রুদের চোখে ধূলো দেবার চেষ্টা করছেন না তো? ছেলের মৃত্যুর বদলা নেবার জন্যে পাইকারী হত্যার বন্দোবস্ত করছেন? কিন্তু এটি যে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা অচিরেই তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন ডন কর্লিয়নি। আলোচনা সভার শুধু যে সমস্ত মাফিয়া পরিবারকে ডাকলেন তাই নয়, লড়াইয়ের জন্য নিজের লোকদের প্রস্তুত করার, কিংবা মিত্র সংগ্রহ করার কোন চেষ্টাই করলেন না। তারপর তার শেষ সদিচ্ছা প্রকাশের ব্যবস্থাও করলেন, যার ফলে তার অভিপ্রায়ের আন্তরিকতা যথার্থ এবং নির্ভেজাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। সেই সাথে মহাসভায় যারা উপস্থিত থাকবে সেই সব সদস্যদের নিরাপত্তার গ্যারান্টিও পাওয়া গেল। বোচ্চিচ্চিও পরিবারের সহযোগিতা চাইলেন তিনি।
এই বোচ্চিচ্চিও পরিবারের আশ্চর্য একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সিসিলিতে এক সময় ওরা একটা ভয়ঙ্কর হিংস্র মাফিয়া দল হিসেবে পরিচিত হলেও, আমেরিকায় এসে অবধি ঝগড়া বিবাধ মিটিয়ে দিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েমে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে আসছে। এক সময়ে যারা বুনো গোয়ার্তুমির সাহায্যে জীবিকা নির্বাহ করত, এখন তারা যাকে বলা যায় সাধু ও সৎ উপায়ে সংসার চালায়। এদের বড় একটা গুণ, পরিবারটা রক্তসম্পর্কের সুদৃঢ় ঘনিষ্ঠ বাঁধনে একজোট যে-সমাজে স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততার চেয়েও পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ততার গুরুত্ব বেশি, তাদের তুলনায়ও বোচ্চিচ্চিও পরিবারের একতা অনেক বেশি দৃঢ় আর মজবুত।
এক সময় বোচ্চিচ্চিও পরিবারের চাচাতো ফুফাতো ভাই আর তাদের নাতিদের গোণার মধ্যে ধরলে দাঁড়াত প্রায় দুশো, দক্ষিণ সিসিলির একটা ছোট্ট অংশের সমগ্র অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত তখন ওরা। গোটা পরিবারের আয়ের উৎস ছিল চার-পাঁচটি ময়দার কল, সেগুলোর মালিকানা সকলের হাতে সমান ভাবে না থাকলেও, পরিবারের কাউকেই খাওয়া চাকরি বা খানিকটা নিরাপত্তার জন্যে ভাবতে হত না। তার উপর নিজেদের মধ্যে বিয়ে-থা হওয়াতে ওরা সবাই মিলে একজোট হয়ে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করতে পারত।
সিসিলির ওই অঞ্চলে ওদের সাথে রেষারেষি করার জন্যে কাউকে ময়দার কল, কিংবা বাধ তৈরি করতে দেয়া হত না, যাতে প্রতিযোগীরা পানি না পায়, কিংবা ওদের পানি বিক্রির আয়ে কেউ ভাগ না বসায়। একবার একজন প্রতিপত্তিশালী জমিদার শুধুমাত্র নিজের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে একটা ময়দার কল বসাবার চেষ্টা করল। কলটা পুড়িয়ে ফেলা হলো। জমিদার তখন পুলিশের কাছে সাহায্য চাইল। তারা বোচ্চিচ্চিও পরিবারের তিনজনকে গ্রেফতারও করল। কিন্তু তাদের বিচার হবার আগেই জমিদারের বাড়িতে আগুন ধরে গেল। নালিশ অভিযোগ তুলে নিতে আর দেরি করেনি জমিদার। এর কয়েক মাস পরে, ইতালীয় সরকারের শ্রেষ্ঠ পদাধিকারীদের একজন সিসিলিতে এসে এই দ্বীপের বারোমেসে পানির অভাব মেটাবার জন্যে প্রকাণ্ড একটা বার তৈরির পরিকল্পনা করল। রোম থেকে স্থপতিরা এল মাটি পরীক্ষা করার জন্যে। স্থানীয় অধিবাসীরা মুখ কার্লো করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরা সবাই বোচ্চিচ্চিও পরিবারের সদস্য। বিশেষভাবে নির্মিত ব্যারাকে পুলিশের লোকদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাটাকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়ার কাজও শেষ।
সবাই ধরে নিল এবার বাধ তৈরি ঠেকাতে পারবে না কেউ। রসদ, মাল মসলা, যন্ত্রপাতি জাহাজ থেকে নামানো হলো পালার্মোতে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিমধ্যে বন্ধু মাফিয়া নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে, তাদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে রেখেছে বোচ্চিচ্চিওরা। ভারি ভারি যন্ত্রপাতি যথাসময়ে ধ্বংস করা হলো সব, আর হালকা জিনিসগুলো সব চুরি হয়ে গেল। ওদিকে ইতালীয় সংসদে মাফিয়াদের প্রতিনিধিরা বাধের প্রস্তাবকারীদের বিরুদ্ধে আমলাতান্ত্রিক প্রতি-আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে। এভাবে চলল দীর্ঘ কয়েকটা বছর। তারপর ক্ষমতাসীন হলেন মুসোলিনি। ডিক্টেটর সাহেব নির্দেশ দিলেন, বাধ তৈরি করতেই হবে। তবু করা গেল না। মুসোলিনি জানতেন মাফিয়ারা তার শাসন ব্যবস্থা বিপন্ন করার চেষ্টা চালাবে, তার রাজ্যে ওদের নিজেদের প্রভাবাধীন একটা আলাদা এলাকা সৃষ্টি করবে। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারীকে পূর্ণ ক্ষমতা দিলেন মুসোলিনি। সে লোকটি সবাইকে জেলে ভরে, নয়ফ্লো দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে সাথে সাথে সমস্যার সমাধানও করে ফেলল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মাফিয়াদের শিরদাঁড়া ভেঙে দিল সে, যাকেই মাফিয়াদের সমর্থক বলে সন্দেহ হয় তাকেই ধরে বন্দী করে। এতে অসংখ্য নিরীহ পরিবারেরও সর্বনাশ ঘটল।
এই সীমাহীন ক্ষমতার বিরুদ্ধে জোর খাটাতে যাওয়াটা উচিত হয়নি কোচ্চিচ্চিওদের। সশস্ত্র সংগ্রামে গোষ্ঠীর অর্ধেক পুরুষ প্রাণ হারাল! বাকি অর্ধেককে সাজা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো দ্বীপান্তরে। মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন বাকি থাকল তাদের জন্য বেআইনি চোরা পথে, কানাডা পৌঁছে, জাহাজ থেকে পালিয়ে, আমেরিকায় আসার বন্দোবস্ত করা হলো। টেনেটুনে প্রায় কুড়ি জন বহিরাগত ইতালীয়, নিউ ইয়র্কের অনতিদূরে, হাডসন ভ্যালির ছোট শহরে শুরু করল বসবাস। সমাজের নিম্নতম স্তরের কাজ থেকে জীবিকা অর্জন শুরু করে ক্রমে নিজেদের অবস্থা উন্নত করল ওরা। শেষ পর্যন্ত একটা আবর্জনা সংগ্রহ সংস্থার মালিক হলো। সেই সাথে নিজেদের কয়েকটা ট্রাকও হলো ওদের। প্রতিযোগিতা করার মত কেউ না থাকায় তাদের অবস্থা দিনে দিনে খুব ভাল হয়ে উঠল। প্রতিযোগিতা না থাকার কারণ হলো, কেউ প্রতিযোগিতা করতে এলেই তাদের ট্রাক পুড়ে যায়, ভেঙে যায়। একজন গোঁয়ার-গোবিন্দ গোছের লোক দাম কমিয়ে ওদের ব্যবসা হাতাবার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু তাকে দেখা গেল নিজের সংগ্রহ করা আবর্জনার স্তূপের তলায় চাপা পড়ে দম আটকে মরে রয়েছে।
ক্রমে পুরুষদের সকলের বিয়ে হলো, বলা বাহুল্য সিসিলায় মেয়েদের সাথে তাদের ছেলেপিলে হলো, তখন আবর্জনা সংগ্রহের ব্যবসা দিয়ে খাওয়া-পড়া চলে গেলেও, আমেরিকার যে-সব উন্নত বিলাসদ্রব্য কিনতে পাওয়া যায় তা কিনতে গিয়ে পয়সায় কুলোয় না। কাজেই, বাড়তি রোজগারের উদ্দেশ্যে বাচ্চিচিও পরিবার মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়ে আর জামিন হয়ে, যুদ্ধরত মাফিয়া পরিবারগুলোর মধ্যে। শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব নিল।
এই বোচ্চিচ্চিও পরিবারের মধ্যে আবার একটা নির্বুদ্ধিতার ভাব দেখা যায়। তবে সেটা ওদের আদিম স্বভাবও হতে পারে। সে যাই হোক, ওরা নিজেদের দূর্বলতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। ওরা জানে, অন্যান্য মাফিয়া পরিবারের সাথে প্রতিঘোগিতা করে, যে-সমস্ত ব্যবসাতে আরও বেশি বুদ্ধির দরকার, যেমন বেশ্যা ব্যবসা, জুয়া খেলা, মাদকদ্রব্যের ব্যবসা, জনসাধারণকে ঠকিয়ে খাওয়া, সে-সব গড়ে তোলা বা চালানো ওদের বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠবে না। ওদের স্পষ্ট কথা, এর টহলদার পুলিশের লোককে হয়তো কিছু দিয়ে খুশি করতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক দালালদের কাছে এগুতে পারবে না। শুধু দুটো গুণ আছে ওদের, সততা আর হিংস্রতা।
বোচ্চিচ্চিওরা কখনও মিথ্যা কথা বলে না। কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করেনা। জানে এসব করতে গেলে বড় বেশি জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়। তবে কেউ যদি বোচ্চিচ্চিওদের কোন অনিষ্ট করে সে-কথা তারা কখনও ভোলে না, প্রতিশোধ নিতেও ছাড়ে না, তার জন্যে যে দামই দিতে হোক না কেন। তাই একেবারে হঠাৎ করেই ওরা যে ব্যবসাটায় ঢুকে পড়ল কালক্রমে দেখা গেল সেটাতেই ওদের সবচেয়ে বেশি লাভ হচ্ছে।
যদি যুদ্ধরত পরিবারগুলো আপোস মীমাংসা করার জন্যে পরস্পরের সাথে মিলিত হতে চায়, বোচ্চিশ্চিও পরিবারকে খবর দেয় তারা। বোচ্চিচ্চিও পরিবারের কর্তা গিয়ে শান্তি-প্রস্তাবের কথা পাড়েন, জামিনের ব্যবস্থা করেন যেমন, মাইকেল যখন সলোযোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, মাইকেলের নিরাপত্তার জামিন হয়ে বোচ্চিচ্চিও পরিবারের একজন লোক কর্লিয়নিদের কাছে বসে অপেক্ষা করছিল। এই জামিনের টাকা দিয়েছিল সলোযো। সলোযো যদি মাইকেলকে মেরে ফেলত, তাহলে ওই জামিনের লোকটিকে মেরে ফেলত কর্লিয়নিরা। সেক্ষেত্রে, তাদের পরিবারের লোকের মৃত্যুর কারণ হবার জন্যে বোচ্চিচ্চিওরা সলোযোকে খুন করত। বোচ্চিচ্চিওদের মধ্যে একটা আদিম ভাব থাকার দরুন তারা প্রতিশোধ নেবার পথে কোন বাধা মানে না, কোন শাস্তিকে ডরায় না। ওরা স্বচ্ছন্দে নিজেদের প্রাণ দেয়। ওদের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাকে কেউ রক্ষা করতে পারে। বোচ্চিচ্চিওদের কাউকে জামিন রাখা সম্পূর্ণ একটা নিরাপদ জীবনবীমার মত।
শান্তি-সতায় যে সব পরিবারের নেতারা আসবেন, বোচ্চিচ্চিওরা তাদের প্রত্যেকের জামিন হবে, তার পাকাপাকি ব্যবস্থা করলেন কর্লিয়নি। সুতরাং তার আন্তরিকতা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই উঠল না। সবাই বুঝল শান্তি-সভাটি হবে বিয়ে বাড়ির মত নিরাপদ।
জামিনের সমস্ত খুঁটিনাটি দিক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর আলোচনা বৈঠক শুরু হলো ছোট একটা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডিরেক্টরদের কনফারেন্স রুমে। এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট কোন কারণে ঋণী হয়ে আছেন ডন কর্লিয়নির কাছে, তিনি ব্যাংকের কিছু শেয়ারের মালিকও বটে, যদিও শেয়ারগুলো ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের নামেই রয়েছে। ডন কর্লিয়নিকে তার শেয়ারের মালিকানার প্রমাণস্বরূপ একটা লিখিত দলিল দিতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট, যাতে তার প্রতি কোনরকম বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ না থাকে। সেই মুহূর্তটা প্রেসিডেন্টের কাছে সাঙ্ঘাতিক মূল্যবান হয়ে রয়েছে। আতকে উঠেছিলেন ডন কর্লিয়নি। বলেছিলেন, আপনাকে বিশ্বাস করে আমার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দিতে পারি। আমার নিজের জীবন, আমার সন্তানদের মঙ্গল কিছুই আপনাকে অদেয় নেই। আপনি আমাকে কখনও ঠকাতে পারেন, কিংবা আর কোনভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন, আমি কল্পনাও করতে পারি না। তাহলে যে আমার সমস্ত জগৎ, আমি মানব চরিত্র বিচার করতে পারি এই বিশ্বাস, সবই মিথ্যে হয়ে যাবে। তবে আমার নিজের টুকে রাখা হিসেবপত্র আছে বটে, যাতে হঠাৎ যদি আমার কিছু হয়, আমার ওয়ারিশরা জানতে পারবে যে আপনি অছি হয়ে ওদের কিছু সম্পত্তি রেখেছেন। কিন্তু এটা আমি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করি, আমার ছেলেমেয়েদের অধিকার রক্ষা করার জন্যে আমি যদি এই পৃথিবীতে নাও থাকি, তবু আপনি তাদের বঞ্চিত করতে পারবেন না।
ব্যাংকের সভাপতি, সিসিলীয় না হলেও, দারুণ অনুভূতিশীল। ডনের কথার মর্ম সাথে সাথে বুঝে নিয়েছিলেন। এখন গড ফাদার কিছু অনুরোধ করলে, প্রেসিডেন্টের কাছে, সেটা আদেশ স্বরূপ। তাই আজ শনিবার সকালে, নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবারের প্রয়োজনে ব্যাংকের কনফারেন্স রুমে বড় বড় চামড়া-বাঁধানো চেয়ার আঃ একান্ত নিজনার ব্যবস্থা হয়েছে!
নিরাপত্তা এবং প্রহবার দায়িত্ব দেয়া হলো বাছাই করা একদল লোককে! ব্যাংক-গার্ডদের ইউনিফর্ম পরে আছে তারা। শনিবার সকাল দশটা। সভাঘরে লোক জমা হতে শুরু করেছে। নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবার ছাড়াও এসেছে দেশের চাবদিক থেকে দশটা পরিবারের প্রতিনিধিরা। নিমন্ত্রণ করা হয়নি শুধু শিকাগোর পরিবারগুলোকে। এদের জগতে শিকাগোর লোকদেরকে কলঙ্ক বলে মনে করা হয়। ওদেরকে শিষ্টাচার শেখাবার চেষ্টাও বাকিরা ছেড়ে দিয়েছে। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে ওদেরকে ডাকার কোন মানেই হয় না, এ-ব্যাপারে সবাই একমত।
একটা বার খোলা হয়েছে মদ পরিবেশনের জন্যে। খাবার সাজানো হয়েছে বুফে টেবিলে। প্রত্যেক সদস্যকে আলোচনা সভায় একজন করে সহকার সাথে নিয়ে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সহকারী হিসাবে সব ডনই তাদের কনসিলিয়রিদের এনেছেন। তার ফলে সভায় কমবয়সী লোক নেই বললেই চলে। অল্পবয়সীদের মধ্যে টম হেগেন একজন। তাছাড়া উপস্থিত ভদ্রলোকদের মধ্যে একমাত্র সে-ই সিসিলীয় নয়। কৌতূহলের সাথে সবাই দেখেছে তাকে, সে যেন আজব কোন চিড়িয়া।
সবিনয় সৌজন্য কাকে বলে হেগেন তা ভালই জানে। সে কথাও বলছে না, হাসছেও না। রাজার প্রিয় পাত্র কোন অর্লি যে-ভাবে রাজার পরিচর্যা করে, টম হেগেনও সেভাবে গড ফাদারের পরিচর্যা করছে। তার জন্য ঠাণ্ডা পানীয় এনে দিচ্ছে, তাঁর চুরুট ধরিয়ে দিচ্ছে, তার এ্যাশট্রেটা ঠিক জায়গায় সরিয়ে রাখছে। সবটাই শ্রদ্ধার সাথে, কিন্তু স্কুল হোশামুদে চাকরের ভঙ্গিতে নয়।
গাঢ় রঙের কাঠের প্যানেল দেয়া দেয়ালে যাদের ছবি ঝুলছে, তাদের পরিচয়। একমাত্র হেগেনই জানে। দামী তেলরঙে আঁকা অর্থনৈতিক জগতের স্বনামধন্য কয়েকজন লোকের প্রতিকৃতি ওগুলো। একটি ছবি ট্রেজারী সচিব হ্যাঁমিলটনের। হেগেন জানে, একটা ব্যাংক ভবনে এ ধরনের শান্তি-সভা বসেছে জানলে খুশি হবেন না হ্যামিলটন।
উপস্থিতির সময় সকাল সাড়ে নটা থেকে দশটা পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
এক অর্থে ডন কর্লিয়নিকে এই অনুষ্ঠানের হোস্ট বলা যেতে পারে, কারণ এই শান্তি-আলোচনার প্রস্তাব তিনিই উত্থাপন করেছেন। এসেছেন তিনি সবার আগে। তার বহুবিধ গুণের মধ্যে সময়নিষ্ঠা হলো একটা। তার পরেই এলেন কার্লো ট্রামন্টি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশটাকে নিজের এলাকা বলে বেছে নিয়েছেন তিনি। ভদ্রলোক মাঝবয়সী, তাকিয়ে থাকার মত সুপুরুষ, সিসিলীয়দের পক্ষে মাথায় খুব। উঁচু, গায়ের রঙ রোদে পোড়া। পোশাক-পরিচ্ছদ, কেশ-বিন্যাস নিখুঁত। দেখে ইতালীয় মনে হয় না। পত্রিকাতে যে সব কোটিপতিদের ছবি বেরোয়, নিজেদের সৌখিন ইয়টে আরাম করে বসে মাছ ধরছে, ভদ্রলোক বরং তাদের মত দেখতে। ট্রামন্টি পরিবারের টাকা আসে জুয়া খেলা থেকে। কিন্তু তাদের ডনকে দেখলে কেউ ধারণাও করতে পারবে না কি হিংস্র, রক্তারক্তি সংগ্রাম করে রাজ্য লাভ করতে হয়েছে তাকে।
ছোট বেলায় সিসিলি থেকে চলে এসে ফ্লোরিডাতে বসবাস করেছেন। তিনি বড় হয়েছেন সেখানেই। দক্ষিণ অঞ্চলের ছোট শহরগুলোতে যারা রাজনীতি করে, তাদের একটা সংগঠন আছে, তারা জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণ করে। ট্রামন্টি তখন তাদের একজন কর্মী। ভারি শক্তিশালী লোক সব, ওখানকার ক্ষমতাশালী পুলিশ কর্মচারীরা ওদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে বিদেশ থেকে আনকোরা কঁচা আমদানী হওয়া এই হোকরা তাদের পরাস্ত করতে পারবে। তার ওই হিংস্রতার জন্য ওরা তৈরি হবারই সময় পায়নি, তাঁর সামনে ওরা দাঁড়াতেই পারেনি। কারণ ওদের মতে এত সামান্য লাভের জন্যে এত বেশি রক্তপাতের কোন মানে হয় না। বেশি করে লাভের অংশ দিয়ে ট্রামন্টি পুলিশের লোকদের দলে টেনে নিলেন। লাল মুখো গুণ্ডাগুলোর একটুও কল্পনাশক্তি নেই, এরা আবার সংগঠন চালাবে। ট্রামটি এদের সমূলে উৎখাত করলেন। কিউঃ আর বাটিস্টা সরকারের সাথে ট্রামন্টিই যোগাযোগ করলেন। হাভানাব সুখের নিবাসগুলোয় যত জুয়ার আড্ডা আর বেশ্যা বাড়ি আছে, সবখানে এলে টাকা ঢাললেন ট্রামন্টি, যাতে আমেরিকার জুয়াড়ীদের আকৃষ্ট করতে পারেন। এখন ট্রামন্টি বহু লক্ষ ডলারের মালিক, মিয়ামী বীচের সবচেয়ে সৌখিন একটা হোটেলের মালিক।
সভাঘরে এলেন ট্রামন্টি, পিছন পিছন এল তারই মত রোদে পোড়া তার কনসিলিয়রি। ঢুকেই ডন কর্লিয়নিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ট্রামন্টি, ডনের ছেলের মৃত্যুর জন্যে শোক প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে মুখে সমবেদনার ভাব ফুটিয়ে তুললেন।
অন্যান্য ডনও এসে পৌঁছুতে শুরু করেছেন। সবাই সবার পরিচিত, বহু বছরের দেখা-শোনা কখনও সামাজিক অনুষ্ঠানে, কখনও ব্যবসা ক্ষেত্রে। এরা কেউই কাউকে পেশাদারি সৌজন্য দেখাতে ভুল করেন না। এবং বয়স যখন আরও কম আর শরীর আরও, হালকা ছিল তখন পরস্পরকে নানাভাবে সাহায্যও করেছেন। ট্রামন্টির পরপরই এলেন ট্রেয়ট থেকে জোসেফ জালুচি। উপযুক্ত বেনাম ও ছদ্মবেশ নিয়ে ডেট্রয়ট অঞ্চলের একটা ঘোড়দৌড়ের মাঠের মালিক জালুচি পরিবার। তাছাড়া জুয়া খেলারও একটা বড় আয় আছে তাদের। অমায়িক চেহারা জালুচির। ডেট্রয়টের সৌখিন গ্লোস পয়েন্ট অঞ্চলে এক লাখ ডলার দামের একটা বাড়িতে বাস করেন। তার এক ছেলের বিয়ে হয়েছে একটা প্রাচীন খ্যাতনামা আমেরিকান পরিবারে। ডন কর্লিয়নির মত জালুচিও খুব কায়দাদুরস্ত। সিসিলীয় পরিবার পরিচালিত যতগুলো শহর আছে তার মধ্যে ডেট্রয়ট শহরে হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে কম। গত তিন বছরের মধ্যে মাত্র দু-জনকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনিও ড্রাগ ব্যবসা সমর্থন করেন না।
কনসিলিয়রিকে সাথে করে এনেছেন জালুচিও। দুজনেই সবার আগে ডন কর্লিয়নির কাছে এলেন, আলিঙ্গন করলেন তাকে। গলার স্বর আমেরিকানদের মত গম গম্ করে জালুচির, তাতে খুব সামান্য একটু টান আছে পোশাক-আশাকে প্রাচীনপন্থী, কট্টর ব্যবসাদারের মত হাবভাব, আবার প্রয়োজনে অমায়িক সহৃদয়তার পরিচয় দিয়ে থাকে। ডন কর্লিয়নিকে তিনি বললেন, শুধু আপনার ডাক শুনেই এসেছি আমি। মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানালেন ডন কর্লিয়নি। সমর্থনের জন্যে তিনি নির্ভর করতে পারবেন জালুচির উপর।
এরপর এলেন, পশ্চিম তীরের দুজন ডন। একসাথে এক গাড়িতেই এসেছেন তারা! কাজকর্মও করেন একসাথে। নাম, ফ্র্যাঙ্ক ফ্যালকনি আর অ্যান্টনি মলিনারি, আর সবাই যারা এই সভায় যোগ দিতে এসেছেন, তাদের চেয়ে এঁদের দুজনের বয়স কম, চল্লিশের কোঠার গোড়ার দিকে। এদের পোশাক-পরিচ্ছদ অন্যদের চেয়ে কম কেতাদুরস্ত, ধরন ধারনে কিঞ্চিৎ হলিউডি কায়দা, যতটা হলেই চলে আচার ব্যবহারে তার চেয়ে একটু বেশি অমায়িক আর বন্ধুত্বের ভাব। ফ্র্যাঙ্ক ফ্যালকনির হাড়ে আছে চলচ্চিত্র শ্রমিক সংঘগুলো। তাছাড়া আছে স্টুডিওর জুয়া খেলা আর একটা বেশ্যা ব্যবসা চালানোর সংগঠন, সেখানে থেকে সুদুর পশ্চিমেরগণিকালয়ে বেশ্যা সরবরাহ করা হয়। কোন ডনের পক্ষে শো বিজ-এ জড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়, শো বিজ হলো নাচ-গান-অভিনয় ইত্যাদি, তবু ফ্যালকনির একটু ঝোঁক আছে সেদিকে। তাই অন্যান্য ডনরা তাকে বিশ্বাস করেন না।
স্যান ফ্রান্সিস্কোর তীরভূমি পরিচালনা করেন অ্যান্টনি মলিনারি। খেলাধুলা সংক্রান্ত জুয়ায় তাঁর খুব প্রতিপত্তি। ইতালীয় জেলে বংশের ছেলে তিনি। স্যান ফ্রান্সিস্কোর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সী-ফুড রেস্তোরাঁর মালিক। সেখানে নানারকম উপাদেয় সামুদ্রিক খাবারদাবার ছাড়া আর কিছু পরিবেশন করা হয় না। লোকে বলাবলি করে যে ওই রেস্তোরাঁ নিয়ে লোকটা সাঙ্ঘাতিক গর্বিত গর্বটা এতই বেশি যে সেখানে একেবারে পানির দামে ভাল খাবার পরিবেশন করা হয়। ব্যবসাটাই লোকসান দিচ্ছে। পেশাদার জুয়াড়ীর মত ভাবলেশহীন মুখ তার। সবাই জানে, মেক্সিকোয় সীমান্তের ওপার দিয়ে আর পুব সাগরের অলিগলি দিয়ে যে সব জাহাজ যাতায়াত করে তাদের কাছ থেকে নিয়ে মলিনারি কিছু ড্রাগসের চোরা কারবারও করেন। এদের সহকারীদের বয়স বেশি নয়। বলিস্ট গড়ন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে সহকারীটারী নয়, স্রেফ বডিগার্ড। তবে, এ ধরনের সভায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আনার সাহস ওদেরও নেই। সবাই জানে, এই বডিগার্ডরা কারাতে জানে। বাপারটা আর সব ডনদের হাসির খোরাক। ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, ক্যালিফোর্নিয়ার ডনরা যদি পোপের আর্শীবাদ দেয়া মাদুলীও বেঁধে আসতেন, তার চেয়ে একটুও বেশি শঙ্কিত হতেন না কেউ। যদিও একটা লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে এদের মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত ধার্মিকও বটে, সৃষ্টিকর্তার উপর প্রবল বিশ্বাস রাখেন।
তারপর বোস্টন পরিবারের প্রতিনিধি এলেন। একমাত্র তাঁকেই অন্যরা একটুও শ্রদ্ধা করেন না। তিনি নিজের লোকদের সাথে ন্যায্য ব্যবহার করেন না বলে যথেষ্ট দুর্নাম আছে তার। তিনি তাদের নির্মমভাবে ঠকান। তাও ক্ষমা করা যায়, কেননা সব মানুষের লোভের মাত্রা তো আর সমান নয়। যেটা ক্ষমা করা যায় না সেটা হলো নিজের এলাকায় তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন না। তার এলাকা বোস্টনে বড় বেশি খুন, ক্ষমতা নিয়ে বড় বেশি স্থল ঝগড়াঝাটি, বড় বেশি স্বাধীন অনুমোদিত ক্রিয়াকলাপ, বড় বেশি বেয়াড়াভাবে আইন ভাঙাভাঙি। শিকাগোর মাফিয়ারা যদি বুনো জঙ্গলী হয়ে থাকে, বোস্টনের লোকদের বলা চলে অমার্জিত অসভ্য বর্বর। স্রেফ গুণ্ডা। বোস্টনের ডনের নাম ডনেমিক পাঞ্জা বেঁটে, গাট্টাগোট্টা চেহারা। একজন ডনের ভাষায়, স্রেফ একটা চোরের মত দেখতে।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নিছক জুয়াখেলার সংগঠন বোধ হয় ক্লীভল্যাণ্ডের সংঘটাই। তাদের প্রতিনিধি সূক্ষ্ম অনুভাবনশীল চেহারার একজন প্রৌঢ়, চোখ মুখ বসে গেছে, ধপধপে সাদা চুল। তাঁর সামনে কিছু না বললেও, পিছনে সবাই তাকে ইহুদী বলে। তার কারণ, সিসিলীয় নোক না রেখে, নিজের চারপাশে ইহুদী মোতায়েন রাখেন তিনি। এমন কি লোকমুখে এ কথাও আটকায় না যে যদি সাহসে কুলাত তাহলে উনি কনসিলিয়রির পদেও একজন ইহুদীকেই বহাল করতেন। মোট কথা, হেগেন থাকায় ডন কর্লিয়নির পরিবারকে যেমন বলা হয়, আইরিশ দঙ্গল, তেমনি আরও যুক্তিসঙ্গত কারণে ডন ভিনসেন্ট ফরলেঞ্জার পরিবারকে বলা হয় ইহুদী পরিবার। তবে তাঁর সংগঠনটি পরিচালিত হয় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। ডনের মুখের ওই সুবোধ চেহারা সত্ত্বেও, রক্ত দেখে কখনও তিনি মূৰ্ছা গেছেন বলে শোনা যায়নি। তাঁর ওই মখমলের রাষ্ট্রনৈতিক দস্তানার ভিতরে রয়েছে প্রচণ্ড লৌহমুষ্টি।
সবার শেষে এলেন নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবারের প্রতিনিধিরা। সাথে সাথে টম হেগেন লক্ষ করল, মফঃস্বল থেকে আসা ওই সব পাড়াগেঁয়ে নেতাদের চেয়ে এদের ব্যক্তিত্বের জোর কত বেশি, কত বেশি শ্রদ্ধা করার মত চেহারা প্রত্যেকের। প্রথম কথা হলো, নিউ ইয়র্কের পাঁচজন ডনই প্রাচীন সিসিলীয় ঐতিহ্যের অনুগামী। পেটওয়ালা মানুষ তারা–অর্থাৎ আলঙ্কারিক ভাষায় বলা হচ্ছে, যেমন প্রতাপ তেমনি সাহস তাদের, আর সাদামাঠা ভাষায় বলা হচ্ছে, গায়ে-পায়ে তাদের মাংস আছে। সত্যি কথা বলতে কি, সিসিলীতে ওই দুটো বৈশিষ্ট্যকে এক করেই দেখা হয়। নিউ ইয়র্কের পাঁচজন ডনের সবার চেহারা শক্ত, মেদবহুল। সিংহের মত বিশাল মাথা প্রত্যেকের, প্রকাণ্ড মুখাবয়ব, মাংসল রাজকীয় নাক, পুরু ঠোঁট। খুব একটা কায়দাদস্তুর ভাবে সাজগোজ করেননি কেউ, তাদের দেখলেই মনে হয় বাবুয়ানী-বর্জিত কাজের মানুষ সবাই, বাজে কাজে নষ্ট করার মত সময় নেই কারও।
এঁদের মধ্যে রয়েছেন অ্যান্টনি স্ট্রাচি। এঁর হাতে আছে নিউ জার্সি আর ম্যান হ্যাটনের পশ্চিম ঘাটার জাহাজি কারবার। নিউ জার্সিতে ইনি জুয়ার ব্যবসা চালান। ডেক্যাট রাজনৈতিক দলের সাথে খুব দহরম মহরম তার। একরাশ মালবাহী ট্রাক আছে, সেগুলো থেকে তাঁর লক্ষ লক্ষ ডলার আয় হয়। এত বেশি আয় হবার কারণ ট্রাকগুলোতে বে-আইনী ভাবে বেশি মাল চাপান তিনি, অথচ ওজন ইন্সপেক্টররা কেউ সেগুলোকে থামাতে, কিংবা জরিমানা করতে পারে না। এই ট্রাকগুলো আবার ভেঙে তছনছ করে দেয় রাস্তাগুলোকে, রাস্তা মেরামতের মোটা মোটা সরকারি কন্ট্রাক্ট পান অ্যান্টনি। এ ধরনের ব্যবসার কথা শুনতেও ভাল লাগে, এক ব্যবসার ভিতর থেকে কেমন বেরিয়ে আসছে আরেক ব্যবসা। স্ট্রাচিও একটু সেকেলে ধরনের মানুষ, বেশ্যা-ব্যবসা তিনি কখনও ছুঁয়েও দেখেন না। কিন্তু জাহাজঘাটার কারবার চালাতে হয় বলে ড্রাগসের ব্যবসা পরিহার করতে পারেন না। কর্লিয়নিদের বিপক্ষে যে পাঁচটি পরিবার দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে এর দলটা সব চেয়ে দুর্বল কিন্তু ইনিই আবার সব চেয়ে সুবিবেচক বলে পরিচিত।
একটা পরিবার নিউ ইয়র্ক রাজ্যের উত্তরাংশটা শাসন করে কানাডা থেকে বহিরাগত ইতালীয়দের বে-আইনীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে তারা, ও-দিককার সমস্ত জুয়ার ব্যবসা ও তাদের হাতে ঘোড়দৌড়ের মাঠ ব্যবহার করার লাইসেন্স পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে তাদের উপর। এদের নেতার নাম ওটিলিও নিও! লোকটাকে দেখলেই গলে যায় মন, গ্রাম্য মায়রার মত গোলগাল হাসিখুশি চেহারা তার! আইনসম্মত ব্যবসা আছে। দুধের কারবার। ছেলেপিলে ভালবাসেন কুনিও, পকেটে সব সময় লজেন্স নিয়ে ঘুরে বেড়ান, আশা, নিজের নাতি-নাতনি আর বন্ধু-বান্ধবদের ছোট ছেলেমেয়েদেরকে খুশি করবেন। গোল একটা ফিডরা টুপি থাকে মাথায়, মহিলাদের রোদ ঠেকাবার টুপির মত তার কার্নিশটা সব সময় নামানো থাকে। এমনিতেই মুখখানা চাঁদের মত গোল, তার উপর ওই টুপিটার জন্যে মুখটাকে আরও চওড়া দেখায়, ঠিক যেন একটা কমেডিয়ানের মুখোশ। যে অল্প কয়েকজন ডন কখনও গ্রেপ্তার হননি, ইনি তাঁদের একজন। এঁর আসল কীর্তিকলাপ সম্পর্কে কারও কোন ধারণাই নেই। এমনি তার প্রতিষ্ঠা যে তিনি বাস্তু বিভাগের সদস্য পর্যন্ত হয়েছেন, নিউ ইয়র্ক রাজ্যের চেম্বার অফ কমার্স তাকে এ বছরের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী বলে সম্মানিতও করেছে।
টাটাগ্লিয়া পরিবারের সাথে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ডন এমিলিও বার্জিনির। ব্রুকলিন আর কুইনসে কিছু কিছু জুয়াখেলাও পরিচালনা করেন বার্জিনি। কিছু বেশ্যা ব্যবসাও আছে তাঁর। গুণ্ডা বাহিনী তো আছেই। স্টেটেন আইল্যাণ্ডে সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছেন। ব্রঙ্কস আর ওয়েন্টচেস্টারে খেলাধুলা সংক্রান্ত বাজির ব্যাপারেও হাত আছে তার। ড্রাগ ব্যবসাতে জড়িত ইনি। ক্লীভল্যাণ্ড আর পশ্চিম তীরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাছাড়া অল্প কয়েকজন ব্যক্তি যারা লাস ভেগাস, রিনো আর নেভাডার শহরাঞ্চলেও নজর দেন তিনি তাদের মধ্যে একজন। মিয়ামি বীচ আর কিউবার সাথে তার কারবার আছে। নিউ ইয়র্ক শহরে, তথা গোটা দেশে, কর্লিয়নি পরিবারের পরেই তাঁর পরিবারের স্থান সিসিলি পর্যন্ত এঁর প্রতিপতি প্রসারিত যেখানে যত বে-আইনী ব্যাপার ঘটে, সবগুলোতে তার হাত আ২। এমন কি, লোকে বলে, ওয়াল স্ট্রীটেও ইনি একটা পা রাখার জায়গা করে নিয়েছেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইনি অর্থবল আর পৃষ্ঠপোষকতার সাহায্যে টাটাগ্লিয়া পরিবারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছেন।
তাঁর উচ্চাকাঙ্খা, একদিন তিনি আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর শ্রদ্ধাভাজন মাফিয়া হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে ডন কর্লিয়নিকে পদচ্যুত করবেন আর কর্লিয়নি সামাজ্যের খানিকটাকে তো হস্তগত করবেনই। তার প্রকৃতি অনেকটা ডন কর্লিয়নির মতই, তবে ইনি আরও আধুনিক, আরও কেতাদুরস্ত, আরও ব্যবসা-বুদ্ধি সম্পন্ন। একে কেউ বুড়ো গুঁফো সরদার বলে উল্লেখ করে না। যে সব আরও আধুনিক, আরও কম বয়েসী, আরও দুঃসাহসিক নেতা উন্নতির দিকে ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে তারা ওঁর ওপর আস্থা রাখে। তার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব আছে কিন্তু তাতে উত্তাপ নেই। চুন কর্লিয়নির মত সহৃদয়তা নেই। তবে বর্তমানে মাফিয়াদের মধ্যে তাকেই লোকে সবচেয়ে বেশি খাতির করে থাকে।
সবার শেষে এসে পৌঁছুলেন টাটাগ্লিয়া পরিবারের কর্তা, ডন ফিলিপ টাটাগ্লিয়া। তার পরিবারই সলোযোকে সমর্থন করে কর্লিয়নিদের ক্ষমতাকে শক্তি পরীক্ষায় ডাক দিয়েছিল এবং আরেকটু হলে জিতেও গিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অন্যেরা সবাই তাকে একটু তাচ্ছিল্য করেন। তার কারণ, সলোযোর বশ্যতা মেনে নিয়েছিলেন ইনি। সত্যি কথা বলতে কি, চতুর তুর্কী তাঁর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত। উপস্থিত হট্টগোল, এই যে ঝামেলা যার জন্যে নিউ ইয়র্কের সমস্ত মাফিয়া পরিবারের দৈনন্দিন ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার জন্যে বাকিরা সবাই দায়ী করেছেন একে। তাছাড়া, ষাট বছর বয়স লোকটার, অথচ শখের অন্ত নেই। আর এক নম্বর লম্পটও বটে। নিজের এই সব দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেবার যথেষ্ট সুযোগও তিনি পান। কারণ টাটাগ্লিয়া পরিবার মেয়েমানুষের ব্যবসা
করে। ওদের প্রধান কারবারই এটা। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ নাইট-ক্লাব রয়েছে এদের হাতে। দেশের যে-কোন অঞ্চলে এরা যে-কোন প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারে। সম্ভাবনাময় গাইয়ে কিংবা ভাড়ামির ওস্তাদদের আয়ত্ত করার জন্যে গায়ের জোর খাটাতে ফিলিপ টাটাগ্লিয়ার বাধে না, রেকর্ডের। কারবারেও হস্তক্ষেপ করেন ইনি। তবে পারিবারিক আয়ের প্রধান উৎস বেশ্যা ব্যবসা।
আর সবার কাছে তার চরিত্রটা অপ্রীতিকর। সব সময় নাকী কান্না কাঁদেন, পারিবারিক ব্যবসাটার কি ভীষণ খরচ, তার ফিরিস্তি দেন। ধোপার বিল আছে, গাদা গাদা তোয়ালে দরকার হয়, তাতে লাভের টাকা খেয়ে যায়। যদিও যে কোম্পানি কাপড় কেচে দেয়, সেটারও মালিক তিনি। বলেন, মেয়েগুলো কুঁড়ে, একটুও বিশ্বাস করা যায় না তাদেরকে কে কখন কেটে পড়ে, আত্মহত্যা করে। দালালগুলো সব বিশ্বাসঘাতক, অসৎ, এতটুকু আনুগত্য নেই মালিকের প্রতি। কাজের উপযুক্ত ভাল লোক পাওয়া দুষ্কর। সিলিণীয় ছোকরাগুলো আবার এ ধরনের। কাজ দেখলে নাক সিটকায়। তাদের ধারণা, মেয়েমানুষ নিয়ে ব্যবসা করা বা তাদেরকে গালাগালি করা অধর্মের কাজ। অথচ নচ্ছারগুলো কোটের বুকে। ইস্টারের সময় তাল পাতার বাহারে ক্রুশ ঝুলিয়ে, দিব্যি গান গাইতে গাইতে মানুষের গলা কাটে। এইভাবে বক বক করেন ফিলিপ টাটাগ্লিয়া, শ্রোতাদের না পান সহানুভূতি, না পান শ্রদ্ধা। তার সবচেয়ে রাগ কর্তৃপক্ষের উপর। নাইট ক্লাব, নাচশালা আর মদের লাইসেন্স যারা ইচ্ছামত দিতে বা কেড়ে নিতে পারে। বলে থাকেন, সরকারী সীলমোহর চোরদের পেটে যত টাকা ঢেলেছেন, তার সাহায্যে তিনি নাকি ওয়াল স্ট্রীটের চেয়েও বেশি লক্ষপতি তৈরি করতে পারতেন।
অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, কর্লিয়নিদের সাথে লড়াই করে প্রায় জিতে গিয়েও যথাযোগ্য খাতির পাননি তিনি। অন্য ডনরা জানেন, টাটাগ্লিয়ার শক্তি প্রথমদিকে সলোযোর কাছ থেকে, পরে বার্জিনির কাছ থেকে ধার করা। তাছাড়া, কর্লিয়নিদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও জয়লাভ অসম্পূর্ণ থাকার ব্যাপারটাও তার অযোগ্যতার সাক্ষ্যসরূপ। সবাই বোঝে, ওদের যদি আরেকটু দক্ষতা থাকত, বর্তমান গোলমেলে অবস্থাটা এড়িয়ে যাওয়া যেত। ডন। কর্লিয়নির মৃত্যু হলে লড়াইটাও বাধত না।
পরস্পরের সথে লড়তে গিয়ে দুজনেই ছেলে হারিয়েছেন, সেক্ষেত্রে ডন কর্লিয়নি আর ফিলিপ টাটাগ্লিয়া যে শুধু একটু মাথা নেড়ে পরস্পরের উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দেবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। ডন কর্লিয়নি আজ সকালের লক্ষ্যস্থল, আঘাত আর বিফলতা তার শরীরে কতটা অবসন্নতার ছাপ রেখে গেছে, সে-বিষয়ে। সবারই দারুণ কৌতূহল। একটা কথা ভেবে সবাই আশ্চর্য যে প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর পর কেন শান্তির প্রস্তাব করছেন ডন কর্লিয়নি। এ তো পরাজয় স্বীকারের সামিল, এর ফলে তার ক্ষমতা কমে যাবে। যাই হোক, ভারছে সবাই, শিগগিরই জানা যাবে সব।
সকলকে অভিবাদন করা হলো। পানীয় পরিবেশন করা হলো। এভাবে প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে যাবার পর পালিশ করা আখরোট কাঠের টেবিলে তার আসন নিলেন ডন কর্লিয়নি। ডনের বাঁ দিকে একটা চেয়ার একটু পিছনে সরিয়ে বসল টম হেগেন, যাতে অনধিকার প্রবেশ করা না হয়। আর সব ডনরাও ইঙ্গিত পেয়ে টেবিলের চারধারে বসলেন। সহকারীরা বলল তাদের পিছনে। একটু এগিয়ে এল কনসিলিয়রিরা, যাতে দরকার হলে উপদেশ দিতে পারে।
প্রথমে কথা বললেন ডন কর্লিয়নি। এমন ভাবে বললেন, যেন কিছুই হয়নি। যেন তিনি মর্মান্তিক আঘাত পাননি, তার বড় ছেলে মারা যায়নি, তার সামাজ্য তছনছ হয়নি, নিজের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি, মলিনারি পরিবারের নিরাপত্তাধীনে ফ্রেডি পশ্চিমে চলে যায়নি, সিসিলির বন-বাদাড়ে মাইক লুকিয়ে নেই। বলা বাহুল্য, সিসিলির ভাষাতেই কথা বলছেন ডন কর্নিয়নি।
ডন কর্লিয়নি বলছেন, আপনারা এসেছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্য, সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি মনে করি আমার ডাকে আজ এসে আপনারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দয়া করেছেন, সেজন্যে আমি আপনাদের প্রত্যেকের কাছে ঋণী। সুতরাং শুরুতেই বলে রাখছি, আমি শুধু একটু যুক্তি দেখতে চাই আর নিজে যুক্তি ভালবাসি বলে আজ এখান থেকে আমরা যাতে সবাই হাসিমুখে বিদায় নিতে পারি তার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে চাই। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে চেনেন, তারা জানেন, কথা আমি কখনও হালকাভাবে দিই না। সে যাই থোক, এখন কাজের কথায় আসা যাক। এখানে আমরা যারা সমবেত হয়েছি তারা। সবাই সজ্জন। আমরা তো আর উকিল নই যে সবার কাছে সবাই প্রতিশ্রুতি দেব।
এই বলে ডন থামলেন। কেউ কোন কথা বলছেন না। কেউ চুরুট ফুকছেন, কেউ গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। এরা সবাই আদর্শ শ্রোতা, ধৈর্য ধরে কথা শোনেন। এদের সবার আরেকটা গুণও রয়েছে। এঁদের মত মানুষ খুব বিরল, এরা কেউ সংগঠিত, প্রচলিত সমাজের অনুশাসন মানতে রাজী নন, এরা নিজেদের উপর অন্য মানুষের আধিপত্য স্বীকার করেন না। এরা স্বেচ্ছায় না করলে, কোন শক্তি কিংবা কোন মরণশীল মানুষ এদের দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করাতে পারে না এরা চাতুরি আর খুনের সাহায্যে নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা সংরক্ষণ করেন এদের স্বাধীন ইচ্ছা। নতি স্বীকার করে একমাত্র মৃধুর কাছে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন ডন কর্নিয়নি, তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার এতদূর গড়াল.কি করে? থাক সে কথা। নির্বুদ্ধিতা অনেক হয়ে গেছে। শোচনীয়ভাবে, মিছেমিছি উবু আমি যে দৃষ্টিতে বিষয়টাকে দেখেছি, সেটা বলি
আবার থামলেন ডন। তার বিবৃতি শুনতে কারও যদি আপত্তি থাকে সে যেন তা প্রকাশ করতে পারে কিন্তু কেউ তাঁকে বাধা দিচ্ছে না এখনও
সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই যে আমার শরীরটা সেরে উঠেছে। ব্যাপারটা হয়তো মিটিয়ে ফেলতে সাহায্য করতে পারব আমি। আমার ছেলে হয়তো বড় বেশি হঠকারি, বড় বেশি গোঁয়ার ছিল। সেটা আমি অস্বীকার করব না সে যাই হোক, কেন এত কিছু ঘটল সে-ব্যাপারে শুধু এইটুকু বলতে চাই যে সলযো আমার কাছে একটা ব্যবসার প্রস্তাব আনে, আমার টাকা আর পৃষ্ঠপোষকতা চায়। এ ব্যাপারে টাটাগ্লিয়া পরিবারও জড়িত। ব্যবসাটা ড্রাগসের। আমার তাতে কোন আগ্রহ নেই। আমি চুপচাপ থাকতে ভালবাসি, ওসব ব্যবসাতে অনেক রকম ঝামেলা, তাই আমার পছন্দ নয়। তাকে আর টাটাগ্লিয়া পরিবারকে আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাকে সব কথাই বুঝিয়ে বলেছিলাম আমি। বিনয় আর সৌজন্যের সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। বলেছিলাম, তার ব্যবসা আর আমার ব্যবসার মধ্যে কোন বিরোধ নেই, যে যেভাবে ইচ্ছে টাকা রোজগার করুক, তাতে আমার কোন আপত্তিও নেই। সে কিন্তু আমার কথাটাকে ভালভাবে নিল না, না নিয়ে আমাদের সবার সর্বনাশ ডেকে আনল। জানি, এরই নাম জীবন। এখানে আপনারা যারা এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই যার যার দুঃখের কথা বলতে পারেন। আমার নিজের ইচ্ছা তা নয়।
আবার থামলেন ডন কর্লিয়নি, ইশারা করে কিছু ঠাণ্ডা পানীয় আনতে বললেন হেগেনকে। তাড়াতাড়ি পানীয় এনে দিল হেগেন
ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন ডন কর্লিয়নি। বললেন, আমি শান্তি চাই। শান্তি ফিরিয়ে আনতেও রাজী আছি। একটি ছেলে গেছে টাটাগ্লিয়ার, আমারও একটি ছেলে গেছে। সব শোধবোধ হয়ে গেছে। সবাই যদি অকারণে মনে মনে বিদ্বেষ পুষে রাখে, পৃথিবীটার কি দশা হবে তাহলে? এটা কি? এটা হলো সিসিলির সেই অভিশাপ। সেখানে লোকেরা প্রতিশোধ নিতে এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের মুখে একটু রুটি দেবে, তার পয়সা রোজগার করার পর্যন্ত সময় পায় না। এর একমাত্র অর্থ মৃঢ়তা। তাই আমি বলি, আগে যেমন চলছিল সেইভাবেই সব চলুক। ফাঁদ পেতে আমার ছেলেকে কে ধরিয়ে দিল, কে মারল, তা জানবার আমি চেষ্টাও করিনি। কেন? কারণ শান্তি চাই আমি। তাতে যদি শান্তি আসে, তাহলে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবও না। আমার এক ছেলে বাড়ি ফিরে আসতে পারছে না। এ ব্যাপারে আমি আপনাদের কাছ থেকে একটা প্রতিশ্রুতি চাই। আমি যখন তার নিরাপদে ফিরে আসার ব্যবস্থা করব, তখন কেউ যেন বাধা দেবেন না, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন বিপদের সম্ভাবনা যেন না থাকে। এই প্রতিশ্রুতি চাই আমি পেলে, আমরা অন্য বিষয়ে আলোচনা করতে পারব। তাতে আমাদের সবারই সুবিধে। সবার লাভও হবে। হাত নেড়ে আবেগ আর বিনয়ের ভাব প্রকাশ করলেন ডন কর্লিয়নি, বললেন, এইটুকুই আমি বলতে চাই।
চমৎকার বললেন ইনিই তো সেই আগেকার ডন কর্লিয়নি। যুক্তি মেনে চলেন ইনি অন্যদের সুবিধে করে দেবার জন্য নিজের মত বদলান। কোমল, আপোসের সুরে কথা-বার্তা। কিন্তু উপস্থিত সবাই লক্ষ করল যে শরীর ভাল হয়ে যাবার দাবি করলেন তিনি, অর্থাৎ কর্লিয়নি পরিবারের নানান দুর্ভোগসত্ত্বেও তাকে হেয়জ্ঞান করা চলবে না এও লক্ষ করার বিষয় যে ন কর্লিয়নি বললেন, আগে শান্তি প্রস্তাবটা গ্রহণ করা হোক, তার আগে পর্যন্ত অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করে লাভ নেই এও লক্ষণীয় যে তিনি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চান, অর্থাৎ গত এক বছর ধরে নানান বিপর্যয় ভাগ করা সত্ত্বেও কোন রকম লোকসান মেনে নেবেন না।
সে যাই হোক, ডন কর্লিয়নির বক্তব্যের উত্তরে কথা বললেন এমিলিও বার্জিনি, টাটাগ্লিয়া নয়। বক্তব্য-বিষয় সোজা ও সংক্ষেপে পেশ করলেন তিনি। অবশ্য অভদ্র বা অপমানকর কিছু বললেন না।
বার্জিনি বললেন, আপনি যা বললেন তার সবই সত্যি কথা বটে, কিন্তু তাছাড়া আরও কথা আছে। আপনি, ডন কর্লিয়নি, বড়ই বিনয়ী। তবে আসল কথা। হলো আপনার সাহায্য না পেলে সলোযো আর টাটাগ্লিয়াদের পক্ষে তাদের নতুন ব্যবসা চালানো সম্ভব ছিল না। আজও সম্ভব নয়। এমন কি আপনার অস্বীকৃতি, মানেই তাদের ক্ষতি। সেটা অবশ্য আপনার অপরাধ নয় কিন্তু কথা হলো, যে সব বিচারক আর রাজনীতিবিদরা আপনার কাছ থেকে অনুগ্রহ নিতে রাজী রয়েছেন, এমন কি নেশার ওষুধপত্র সংক্রান্ত ব্যাপারেও, তারাই কিন্তু ড্রাগসের বেলায় অন্য। কারও দ্বারা প্রভাবিত হতে প্রস্তুত নন। সলোযোর লোকদের সাথে কর্তৃপক্ষ নরম ব্যবহার করবে, এই আশ্বাস না পেলে সেই বা কি করে কাজ করত? তা যে সব ছিল না, এ তো আমরা সবাই জানি। ড্রাগের ব্যবসা করতে না পারলে আমরা সবাই গরীব হয়ে যাব আজকাল শাস্তির মেয়াদও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ড্রাগ ব্যবসা চালাতে গিয়ে আমাদের কোন লোক যদি ধরা পড়ে, তাহলে বিচারক আর। অ্যাটর্নিরা বড় কঠোর আচরণ করেন। কুড়ি বছরের মেয়াদের ভয়ে সিসিলির। লোকরা পর্যন্ত তাদের ওমো অর্থাৎ নীরবতার নিয়ম ভেঙে সব কথা গড় গড় করে বলে ফেলতে পারে। তা হলে তো চলবে না। এর কলকাঠি, ডন কর্লিয়নি, আপনার হাতে। আপনি সে কলকাঠি আমাদের জন্য না নাড়লে, বন্ধুর কাজ করা হয় না। আমাদের স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের মুখ থেকে রুটি কেড়ে নেয়া হয় সময় পাল্টে গেছে, আগেকার সেই দিন আর নেই। একটা সময় ছিল যখন যার যেদিকে মন চাইত সে সেদিকে চলত। এখন যার যা খুশি করার দিন গত হয়েছে। নিউ ইয়র্কের বিচারকরা যদি কর্লিয়নিদের কেনা গোলাম হয়ে থাকে, তাহলে তাদের সেবা পাবার সুযোগ আমাদেরকেও দিতে হবে। কুয়ো থেকে পানি আমাদেরকে তুলতে দিতেই হবে। এই আমাদের এক কথা।
বার্জিনি থামলেন। সবাই চুপ করে আছেন। সীমারেখা টানা হয়ে গেছে। তার মানে আগেকার অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না আর।
অবশেষে বার্জিনির কথার উত্তর ডন কর্লিয়নিকেই দিতে হলো। বন্ধুগণ, আমার প্রত্যাখ্যানের পিছনে বিদ্বেষ ছিল না। আপনারা আমাকে চেনেন কবে আমি কার সুবিধে করে দিতে অস্বীকার করেছি? কেন করব? আমার ও রকম স্বভাবই নয়। কিন্তু এবার অস্বীকার না করে উপায় ছিল না কেন? কারণ, আমার মতে এই ড্রাগন-এর ব্যবসাই একদিন আমাদের কাল হবে, আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে। এদেশে এই ব্যবসা সম্পর্কে জনসাধারণের প্রবল আপত্তি আছে। এ তো আর হুইস্কি, কিংবা জুয়া অথবা মেয়েমানুষের ব্যাপার নয়। এগুলো বেশির ভাগ লোকেই মেনে নেয়। ড্রাগের সাথে যারাই জড়িত হবে, তাদেরই বিপদ হতে পারে। এর জন্য অন্য সব ব্যবসাও বিপন্ন হতে পারে। তাছাড়া, আমাকে একটু বলবার অনুমতি দিন যে বিচার আর আইন-বিভাগের ওপর আমার এত প্রভাব, এ কথা শুনে আমি খুশি হলেও, কথাটা সত্যি হলে আরও ভাল হত। খানিকটা প্রভাব যে নেই তা নয়, কিন্তু যারা আমার পরামর্শকে শ্রদ্ধা করে, তারা যদি জানে যে আমি ড্রাগের সাথে জড়িত, তাহলে তাদের অনেকেরই শ্রদ্ধা হারাব তারা এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়তে ভয় পায়, এর সম্পর্কে তাদের মনোভাব অত্যন্ত বিরূপ। এমন কি যে-সব পুলিশ আমাদের জুয়া খেলা ইত্যাদিতে সাহায্য করে, ড্রাগ ব্যবসায় সাহায্য করতে তারাও রাজী হবে না। সুতরাং এ বিষয়ে আপনাদেরকে সুবিধা করে দিতে বলার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাকে আমার নিজের অসুবিধে করতে বলা তবে আপনারা সবাই যদি তা সত্ত্বেও মনে করেন যে অন্যদের সমস্যা সমাধান করতে হলে এটুকু আমার করা দরকার, বেশ, তাহলে আমি তাও করব।
ডন কর্লিয়নির কথা শেষ হতেই ঘরের আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেল। সকলে আশ্বস্ত হয়ে ফিসফিস আলোচনা, কথা কাটাকাটি শুরু করে দিয়েছে : প্রধান শর্তে ডন কর্লিয়নি রাজী হয়ে গেছেন। ড্রাগসের কোন সংগঠিত ব্যবসা চললে, তিনি সেটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ সলোযোর মূল প্রস্তাবের প্রায় সবটুকুই মেনে নেবেন-যদি আজকের এই জাতীয়সভা সে-প্রস্তাব সমর্থন করে। তবে এটাও বুঝে নিতে হবে যে ব্যবসার উপর তার কোন অংশ থাকবে না, তার টাকা পয়সাও তাতে খাটবে না। তিনি শুধু আইনের সাথে সংঘর্ষ হলে তাদেরকে রক্ষা করার জন্যে প্রভাব বিস্তার করবেন কিন্তু সেটাও কিছু কম পাওয়া নয়।
এবার কথা বললেন লস অ্যাঞ্জেলেসের ডন, ফ্রাঙ্ক ফ্যালকনি, এই ব্যবসা থেকে আমার লোকদের হটাবার কোন উপায় নেই। তারা নিজেদের দায়িত্বে কাজ চালাতে লেই বিপদে পড়বে। এ ব্যবসাতে এত বেশি লাভ যে লোভ সামলানো অসম্ভব। তাই এতে না নামলে আরও বেশি বিপদ। ব্যবৰা পরিচালনার দায়িত্ব যদি আমাদের হাতে থাকে, তাহলে রক্ষণাবেক্ষণটা অন্তত আরও ভাল হবে, সংগঠনের। কাজ আরও ভাল হবে, যাতে গোলমাল কম হয় তার ব্যবস্থাও করা সম্ভব হবে। ব্যবসাটা তুলনাহীন, কিন্তু এর পরিচালনা দরকার, একে রক্ষা করা দরকার, এর। শক্তিশালী সংগঠন দরকার, এক দঙ্গল নৈরাজ্যবাদীর মত শুধু যা ইচ্ছে তাই করে। বেড়ালে তো আর চলবে না।
কর্লিয়নিদের প্রতি অন্যদের চেয়ে ডেট্রয়টের ডন একটু বেশি বন্ধু ভাবাপন্ন। কিন্তু যুক্তির খাতিরে তিনিও এখন বন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে কথা বললেন, ড্রাগসের ওপর আমার কোন আস্থা নেই। বহু বছর ধরে আমার লোকরা যাতে এই ব্যবসাটাতে না ঢোকে, সেজন্যে তাদের বেশি করে টাকা দিয়েছি আমি। কিন্তু। তাতে লাভ হয়নি কিছুই, কোন সুবিধে হয়নি। অন্য লোকরা এসে তাদের বলছে, কিছু গুঁড়ো আছে আমার কাছে, তোমরা যদি তিন চার হাজার ডলার খাটাতে পারো, তাহলে লাভের অংশ পঞ্চাশ হাজার ডলার ভাগ করে নিতে পারব আমরা। এমন লাভের প্রস্তাব কজন লোক ফিরিয়ে দিতে পারে! নিজেদের এই বাঁ হাতের ব্যবসা নিয়েই আমার লোকরা ব্যস্ত থাকে। আমার যে-কাজের জন্যে তারা মাইনে খায়, তা করার সময় পায় না। ভাগ বিজনেসে লাভ ঢের বেশি। শুধু তাই নয়, লাভের অংক ক্রমে বেড়েই চলেছে। ব্যবসাটা বন্ধ করার আসলে কোন উপায়ই নেই, সুতরাং ব্যবসাটা নিজেদের হাতে রেখে ওর মান বাঁচানোর চেষ্টা করাই উচিত। কোন স্কুলের কাছে-পিঠে ব্যবসাটা চলুক, তা আমি চাই না। সে বড় জঘন্য কাজ হবে। আমাদের শহরে, ব্যবসাটাকে আমি কার্লো মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। আশ্চর্য ভাল খদ্দের ওরা, গোলমাল বাধায় সবচেয়ে কম, এমনিতেও জানোয়ার বই তো নয়। নিজেদের, স্ত্রীদের, নিজেদের পরিবারের, কারোই সম্মান রাখে না ওরা। ড্রাগ ব্যবহার করে যাক না গোল্লায়।
ডেট্রয়টের ডনের বক্ততা থামতে না থামতেই চাপা গলায় বাহবা দিচ্ছে সবাই। ঠিক জায়গায় টোকা দিয়েছেন তিনি। টাকা দিয়েও তো লোককে ড্রাগ ব্যবসা থেকে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আর ওই যে স্কুলের ছেলেমেয়েদের কথা বললেন তিনি, ওটা তো তার সেই বিখ্যাত স্পর্শকাতরতা, তার কোমল হৃদয়ের ব্যাপার-স্যাপার। যে যাই বলুক, ছেলেপুলেদের কাছে কে আবার ড্রাগ বেচতে যাচ্ছে? ছোটরা টাকা পয়সাই বা পাবে কোথায়? আর ওই যে কার্লো মানুষদের কথা বললেন, ও তো কেউ কান পেতে শুনলই না। নিগ্রোদের কেউ কোন মূল্যই দেয় না, ওদের সেঁন শক্তিও নেই। সমাজ যে ওদেরকে মাটিতে পিষে ফেলতে পারছে, তা থেকেই তো প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে ওদের কোন মনুষ্যত্ব নেই বলেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে। ওদের কথা উত্থাপন করে ডেট্রয়টের ডন প্রমাণ করে দিলেন, ভাবছে সবাই, ওর মনটা সব সময় অবান্তর বিষয়ের দিকে ঝোঁকে। তারপর সব ডনরা কথা বলতে শুরু করলেন, সকলেই দুঃখ করতে লাগলেন এই বলে যে ডাগের ব্যবসা বড় খারাপ ব্যবসা, কিন্তু ওটা বন্ধ করার কোন উপায় নেই। এ ব্যবসায় বড় বেশি লাভ কিনা, তাই সব রকম ঝুঁকি নিয়েও এতে হাত দেবেই লোকেরা। মানুষের স্বভাব যে কি তা তো আর কারও অজানা নেই।
রফা হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। ড্রাগের ব্যবসা চলবে। পূর্বাঞ্চলে ওদেরকে কিছু আইনের আশ্রয় দেবেন ডন কর্লিয়নি। স্থির হলো, বার্জিনি আর টাটাগ্রিয়া পরিবার ব্যবসার বেশির ভাগটা হাতে রাখবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। তারপর অন্যান্য আরও ব্যাপক সুবিধে সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ হলো। কিছু জটিল সমস্যার সমাধান করা দরকার। স্থির হলো, লাস ভেগাস আর মিয়ামি হবে মুক্ত শহর, সেখানে যে কোন ব্যবসা চলতে পারবে সকলেই সায় দিয়ে বললেন, জায়গা দুটোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আরও স্থির হলো শহর দুটোয় কোন হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ চলবে না বা কোন ছোটখাট দুষ্কৃতকারীদের ওখানে যেতে উৎসাহিত করা হবে না সেই সাথে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে যে কোন গুরুপূর্ণ বড় ব্যাপারে, যাতে জনসাধারণের প্রবল আপত্তি রয়েছে বা থাকবে, কিছু করার আগে এই সভার অনুমোদন পাওয়া চাই। সকলে একমত হলেন যে সবার সমস্ত সশস্ত্র কর্মী আর সৈনিকরা কোন ব্যক্তিগত কারণে পরস্পরের উপর কোন হিংসাত্মক ব্যবস্থা কিংবা প্রতিশোধ কখনও নেবে না কোন মাফিয়া পরিবার অনুরোধ করলে অন্য পরিবারগুলো তাকে সাহায্য দেবে। যেমন ঘাতকের ব্যবস্থা করার কোন বিশেষ দায় থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে জুরিকে ঘুষ দেয়া ইত্যাদি ব্যাপারে পেশাদারি সহযোগিতা করবে। কোন কোন সময় তো এ ধরনের সাহায্যের উপর মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নির্ভর করে। এই রকম আরও অনেক বিষয়ে আলোচনা হলো বন্ধুতুপর্ণ পরিবেশে, অতি উঁচু পর্যায়ের সৎ উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে। এতে সময়ও লাগল যথেষ্ট। মাঝখানে লাঞ্চ আর বুফে বার থেকে পানীয় গ্রহণের জন্যে বিরতি।
অবশেষে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটাবার চেষ্টা করে ডন বার্জিনি বললেন, এই তো সমস্ত বিরোধ মিটে গেল। শান্তি কায়েম হয়েছে, এবার আমার শ্রদ্ধা জানাই ডন কর্লিয়নিকে। আমি অনেক বছর ধরে চিনি তাকে। কথা দিলে তিনি কথা রাখেন। এর পর যদি আবার কোন মতভেদ হয় তাহলে আমরা আবার মিলিত হতে পারি, আরও মৃঢ়তার পরিচয় দেবার কোন প্রয়োজন নেই। মীমাংসা হয়ে গেল, এর চেয়ে খুশির ব্যাপার আমার জন্যে আর কিছু হতে পারে না।
একমাত্র ফিলিপ টাটাগ্লিয়ার মনে এখনও দুশ্চিন্তা। আবার যদি লড়াই বাধে, তাহলে সান্তিনো কর্লিয়নিকে হত্যা করার জন্যে তার অবস্থাটা কাহিল হবে সবচেয়ে বেশি। শেষ পর্যন্ত এই প্রথম মুখ খুললেন তিনি।
আমি সব কিছুতে রাজী আছি। আমি নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভুলে যেতে রাজী আছি। কিন্তু ডন কর্লিয়নির কাছ থেকে আশ্বাস পেতে চাই আমি। তিনি কি ব্যক্তিগতভাবে কখনও প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবেন? আরও কিছু সময় গেলে, তাঁর অবস্থা হয়তো তখন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তখন কি তিনি ভুলে যাবেন যে আমরা বন্ধুত্বের শপথ নিয়েছি? কি করে বুঝব যে আরও তিন চার বছর পর তার মনে হবে না ওঁর সাথে অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে, জোর করে ওকে দিয়ে এই চুক্তি সই করানো হয়েছে, অতএব এসব শর্ত ভাঙার অধিকার আছে তার। আমাদেরকে কি চিরকাল পরস্পর সম্পর্কে সতর্ক হয়ে চলতে হবে? নাকি সত্যি সত্যি স্বস্তি এবং শান্তি নিয়ে এখান থেকে যেতে পারব? আমি আমার তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কর্লিয়নিও কি তার তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি দেবেন?
এবার তার সেই অবিস্মরণীয় বক্তৃতা দিলেন ডন কর্লিয়নি। উপস্থিত সকলের মধ্যে তিনিই যে সব চাইতে দূরদর্শী পলিটিশিয়ান, এই বক্তৃতায় তা প্রমাণ হয়ে গেল! এত সাধারণ অথচ গভীর বুদ্ধি, এত আন্তরিকতা আর কোথায় পাওয়া যাবে? বিষয়টার মুলে গিয়ে কে এমন আঘাত করতে পারে? এই বক্তৃতাতেই তিনি একটা বাকাংশ রচনা করলেন, সেটি পরে প্রায় চার্চিলের লৌহ যবনিকার মতই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, যদিও আরও দশ বছর পর কথাটি সাধারণ লোকের কানে পৌঁছেছিল।
এই প্রথম উঠে দাঁড়িয়ে সভাকে সম্বোধন করলেন ডন কর্লিয়নি।
কেমন মানুষ আমরা, যদি বিচার বৃদ্ধি হারাই? তাহলে বনের পশুর চেয়ে কিসে আমরা ভাল? না, বিচার বুদ্ধি আছে আমাদের। আমরা পরস্পরের সাথে যুক্তি দিয়ে আলোচনা করতে পারি। নিজেদের সাথেও পারি। কি উদ্দেশ্যে আমি আবার ওই গণ্ডগোল, ওই হিংসাত্মক কাজ কারবার, ওই অশান্তি শুরু করব? ছেলে আমার মারা গেছে, সেই বড় দুঃখ। কিন্তু সে দুঃখ আমাকে সইতে হবে, তার জন্যে আমার চারদিককার নির্দোষ জাতিটাকে কষ্ট দিলে চলবে কেন? তাই আমি বলছি, ধর্ম সাক্ষী করে বলছি, কখনও প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা আমি করব না, অতীতে যে-সব কাণ্ড হয়ে গেছে, সে-বিষয়ে কিছু জানবার চেষ্টাও করব না। নির্মল চিত্তে এখান থেকে বিদায় নেব আমি।
আমাকে এ-কথা বলতে দিন যে আমরা সব সময় নিজেদের স্বার্থটাই দেখব। আমরা কি সেই মানুষ নই, যারা বোকা বনতে রাজী হইনি? যারা ওপরওয়ালাদের হাতের সুতোয় বাঁধা পুতুলের মত নাচতে অস্বীকার করেছি? এদেশে এসে আমাদের কপাল খুলে গেছে। এরই মধ্যে আমাদের সন্তানেরা উন্নততর জীবনের আস্বাদ পেয়েছে। আমাদের ছেলেরা অধ্যাপক হয়েছে, বৈজ্ঞানিক, সঙ্গীতশিল্পী হয়েছে। আমরা সৌভাগ্যবান। হয়তো আমাদের নাতি-নাতনিরা আগামী দিনে এই দেশের কর্তাব্যক্তি হবে। আমরা কি কেউ চাই আমাদের ছেলেরাও আমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করুক? না, চাই না। এ বড় কঠিন জীবন। ওরা অন্যদের মত হতে পারে, পারে নিরাপদ, সহজ জীবনের অধিকারী হতে। ওদের পদমর্যাদা আর নিরাপত্তা আমাদের সৎসাহসের ফল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। আমার এখন নাতি নাতনি হয়েছে, আমি আশা করছি, কে জানে হয়তো একদিন তাদের ছেলেরাই গভর্নর হবে, প্রেসিডেন্ট হবে কিছুই অসম্ভব নয় এই আমেরিকায়। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। গোলাগুলি, হত্যা আর খুনের দিন গত হয়েছে। ধূর্ত হতে হবে আমাদেরকে। ব্যবসায়ীদের তাইতো হওয়া উচিত, তাতে আরও টাকা রোজগার হবে আমাদের সন্তানদের জন্যে, তাদের সন্তানদের জলেও সেটাই তো ভাল।
আর আমাদের কীর্তিকলাপের কথা যদি বলেন, ওই সব নব্বই ক্যালিবারের হোমরাচোমরাদের কাছে মোটেও আমরা দায়ী নই। তারা মনে করে, আমাদের জীবন নিয়ে আমরা কি করব না করব তা ওরা আমাদেরকে সমঝে দেবে। তারা লড়াই বাধিয়ে দিয়ে ভাবে, তাদের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্যে আমরা বুঝি লড়াই করব। কে বলেছে যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা আর আমাদের ক্ষতি করার জন্যে ওরা যে সব আইন তৈরি করেছে, আমাদেরও সে সব মানতে হবে? কক্ষনো না। আমরা আমাদের ব্যবস্থা নিজেরা করলে, তাতে ওদের কি? তারা নাক গলাতে আসে কোন অধিকারে? এ-সব আমাদের ব্যাপার, আমরা বুঝব। আমাদের জগৎটা আমাদের, এই জগৎটাকে আমরাই সামলাব। তাই বাইরে থেকে যারা অনধিকার প্রবেশ করে, তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সকলকে একজোট হয়ে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে ওরা, যে-ভাবে নেপলস আর ইতালির লক্ষ লক্ষ লোকের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে।
এই সব কারণেই আমি আমার ছেলের খুনের প্রতিশোধ নিতে চাই না। প্রতিশোধের দাবি ছেড়ে দিচ্ছি, সবার স্বার্থে, সবার কল্যাণের জন্যে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমার পরিবারের আচরণের জন্যে যতদিন দায়ী থাকব আমি, ততদিন ন্যায্য কারণ কিংবা গুরুতর প্ররোচনা ছাড়া উপস্থিত কারও বিপক্ষে আমাদের কেউ একটি আঙুল তুলবে না। সবার স্বার্থে আমর বৈষয়িক স্বার্থ পর্যন্ত আমি ছেড়ে দিতে রাজী। আমার কথা রইল, ধর্ম সাক্ষী রইল। এখানে যারা উপস্থিত রয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই জানেন, আমি কখনও কথার বা ধর্মের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করি না।
তবে আমার একটা স্বার্থপর উদ্দেশ্যও আছে বৈকি। আমার ছোট ছেলেটাকে এখান থেকে পালাতে হয়েছে, কারণ সলোযো আর একজন পুলিশ ক্যাপটেনকে খুন করার জন্যে তাকে দায়ী করা হচ্ছিল। এখন যাতে তার ওপর থেকে ওই সব মিথ্যে অভিযোগ তুলে নেয়া হয় আর সে যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসতে পারে, তার ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। হয় আল অপরাধীকে ধরে দিতে হবে, নয়তো আমার ছেলের নির্দোষিতা সম্পর্কে সরকারকে নিচ্ছিদ্র প্রমাণ দিয়ে আশ্বস্ত করতে হবে। অথবা সাক্ষী আর ইনফর্মাররা যাতে তাদের মিথ্যে কথা ফিরিয়ে নেয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু, আবার বলি, এগুলো আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে, আমার বিশ্বাস, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারব আমি।
তবু একটি কথা বাকি থেকে যায়। সেটা না বললেই নয়। কুসংস্কারে বিশ্বাস করি আমি, জানি ওটা একটা হাস্যকর দুর্বলতা, তবু কথাটা স্বীকার করতে হচ্ছে। যদি আমার ছেলের কোন আকস্মিক, অশুভ দুর্ঘটনা ঘটে, যদি কোন পুলিশ অফিসারের পিস্তল থেকে আচমকা গুলি ছুটে ওর গায়ে লাগে, যদি নিজের সেলে নিজের গলায় দড়ি দেয় ও, যদি নতুন সাক্ষী ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্যে দেখা। দেয়, স্রেফ কুসংস্কারের বশে মনে হবে আমার, এখানকার কারও কারও মনে আমার ওপর বিদ্বেষ রয়ে গেছে বলেই অমনটি হলো। আরেকটু বলি। আমার ছেলের মাথায় যদি বাজ পড়ে, তা হলেও হয়তো এখানকার কাউকে কাউকে দায়ী করব আমি। যদি ওর প্লেন সমুদ্রে পড়ে, ওর জাহাজ যদি ঢেউয়ের নিচে তলিয়ে যায়, ওর যদি কোন মারাত্মক জ্বর হয়, ওর গাড়ি যদি ট্রেনের সাথে ধাক্কা খায়-এমনি আমার কুসংস্কার যে আমি মনে করব এখানকার কারও না কারও, অশুভ ইচ্ছার জন্যেই অমন হয়েছে। ভদ্রমহোদয়গণ, সেই অশুভ ইচ্ছাকে, সেই দুর্ভাগ্যকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না আমি। শুধু এইটা বাদ দিলে, আমার নাতি-নাতনিদের। আত্মার দিব্যি, আজ যে শান্তি স্থাপন করলাম এ-শান্তি আমি কখনও ভাঙব না। যে যাই বলুক, ওই সব হোমরাচোমরা যারা আমাদের জীবনকালেই অগুণতি কোটি লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে, তাদের চেয়ে আমারা ভাল, না কি ভাল না?
কথা শেষ করে তার জায়গা থেকে উঠে টেবিলের ধারে যেখানে ডন ফিলিপ টাটাগ্লিয়া বসে রয়েছেন সেখানে এলেন ডন কর্লিয়নি। উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন করলেন টাটাগ্লিয়া। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে পরস্পরের গালে চুমো খেলেন। ঘরে অন্য ৬ন যারা উপস্থিত রয়েছেন তারা জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, উঠে পড়ে সামনে যাকে পাচ্ছেন তার সাথেই হণ্ডশেক করছেন এবং ডন কর্লিয়নিকে আর ডন টাটাগ্লিয়াকে তাদের নতুন বন্ধুত্বের জন্যে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। দুনিয়াতে হয়তো এর চেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব আরও আছে, তারা হয়তো বড় দিনের সময়। পরস্পরকে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে উপহার পাঠাবেন না, তবে পরস্পরকে খুনও করবেন না। এদের দুনিয়াতে এইটুকুকেই যথেষ্ট বন্ধুত্ব বলা যায়, এর বেশি কিছুর দরকার পড়ে না।
ডন কর্লিয়নির ছেলে ফ্রেডি পশ্চিমাঞ্চলে মলিনারি পরিবারের হেফাজতে আছে, সুতরাং সভা ভেঙে যাবার পর ডন কর্লিয়নি স্যান ফ্রান্সিস্কোর ডনকে ধন্যবাদ। জানাবার জন্যে একটু অপেক্ষা করলেন। মলিনারি ভাঁকে যতটুকু বললেন, তা থেকে ডন কর্লিয়নি বুঝলেন যে ফ্রেডি সেখানে তার উপযুক্ত কাজই খুঁজে পেয়েছে। সুখেই আছে সে, মহিলাদের সাথে তার নাকি খুব ভাব। মনে হলো হোটেল পরিচালনার ব্যাপারে তার জন্মগত প্রতিভা আছে। বিস্মিত হয়ে মাথা নাড়লেন ডন কর্লিয়নি। নিজের ছেলের মধ্যে অগত্যাশিত গুণ আছে শুনলে অনেক বাপই এভাবে মাথা নাড়েন। গউ ফাদার ৩
এ কথা কি সত্যি নয় যে মাঝে মাঝে মর্মান্তিত দুর্ভাগ্যের ফলে অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য লাভ করা যায়? এ বিষয়ে দুজনেই একমত হলেন।
এরই মধ্যে স্যান ফ্রান্সিস্কোর ডনকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ডন কর্লিয়নি যে ফ্রেডিকে আশ্রয় দিয়ে তিনি কর্লিয়নিদের যে মহৎ উপকার করেছেন সেজন্যে কর্লিয়নিরা তাঁর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে। ডন কর্লিয়নি আরও বললেন, তিনি। তার প্রভাব বিস্তার করবেন যাতে সমস্ত প্রধান ঘোড়দৌড়ের তারবার্তার সুবিধে শুধু মলিনারির লোকরাই পায়, ক্ষমতা বন্টনে যত পরিবর্তনই হোক না কেন ভবিষ্যতে। এধরনের গ্যারান্টির অনেক মূল্য আছে। কারণ এই সুবিধাটুকু নিয়ে সব সময়ই ঝগড়া বিবাদ চলে, যথেষ্ট বিদ্বেষেরও সৃষ্টি হয়। অবস্থাটা আরও জঠিল হয়ে ওঠে, কারণ শিকাগোর লোকগুলোর নোংরা হাতও এর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ওই বর্বরদের মুলুকেও একেবারে ক্ষমতাশূন্য নন ডন কর্নিয়নি সোনার চেয়েও দামা তার এই প্রতিশ্রুতি।