৩.০৬ নয়া ধর্মমত

॥ ছয় ॥

নয়া ধর্মমত এবং সমর শক্তির দিক থেকেও ইসলাম এমন এক মহাশক্তিতে রূপ নেয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত দূত যেখানেই যেত তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথি মনে করা হত এবং তার বয়ে আনা বার্তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৌখিক দাওয়াতের পাশাপাশি দূরদেশের রাজন্যবর্গের উদ্দেশে দাওয়াতনামা প্রেরণ করতে শুরু করেন। এদের অনেকে ছিল ঔদ্ধত্য, অহংকারী এবং অবিবেচক। তাদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্র এ অর্থের হত যে, ইসলাম গ্রহণকে এড়িয়ে যদি সে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে চায়, তবে তা পরীক্ষা করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, যুদ্ধে পরাজিত হলে তখন বিনা শর্তে মুসলমানদের পূর্ণ আনুগত্য ছাড়া দ্বিতীয় কোন গত্যন্তর থাকবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে এমনি এক প্রতিনিধি দল ইয়ামানের উত্তরে নামরানে প্রেরণ করেন। বনূ হারেছা বিন কা‘ব সেখানকার অধিবাসী ছিল। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্রের জবাব দেয় ঠাট্টা-বিদ্রুপাচ্ছলে। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিদ্রুপের সমুচিত জবাব দিতে ৬৩১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ৪০০ অশ্বারোহীর এক সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে ইয়ামান রওনা হন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লেখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে যাবার সময় বলে দেন যে, তাদেরকে আক্রমণের জন্য নয়; বরং পয়গাম দিয়ে পাঠানো হচ্ছে মাত্র। যেহেতু বনু হারেছা অবাধ্য প্রকৃতির তাই তাদেরকে পরপর তিনবার দাওয়াত দিতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিশেষভাবে বলে দেয়া হয়। এরপরও যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে; বরং রক্তপাতের পথই বেছে নেয় তখনই কেবল তাদের উপর চড়াও হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এমন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সেখানে গিয়ে পৌঁছান এবং যে অবস্থায় তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করেন তাতে বনূ হারেছা ভীষণ প্রভাবিত হয়। ফলে তারা কোনরূপ প্রতিরোধ ছাড়াই এক প্রকার বিনা বাক্য ব্যয়ে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সাথে সাথে প্রত্যাবর্তনের পরিবর্তে সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। তাদেরকে ইসলামের বিভিন্ন ধারা ও আহকাম শিক্ষা দিতে থাকেন। ইতিহাস হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কেবল সমর শাস্ত্রবিদ এবং প্রথম শ্রেণীর সেনাধ্যক্ষ হিসেবে উল্লেখ করলেও নাযরানে এসে তিনি দীর্ঘ ৬ মাস পর্যন্ত শুধু ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষায় লিপ্ত থাকেন। যখন তিনি নিশ্চিত হয়ে যান, এখানকার লোকদের অন্তরে ইসলাম বদ্ধমূল হয়ে গেছে তখন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসের দিকে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। তার সাথে বনূ হারেছার নেতৃস্থানীয় কিছু লোকও ছিল। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে হাত রেখে পুনঃ ইসলামের উপর বাইয়াত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মধ্য হতে একজনকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করেন।

ইসলামের শত্রুরা যখন মর্মে মর্মে অনুধাবন করল যে, মুসলমানদেরকে রণাঙ্গনে পরাজিত সম্ভব নয় এবং তারা এটাও হৃদয়ঙ্গম করল যে, ইসলাম মানুষের রক্ত-মাংসের সাথে মিশে গেছে তখন তারা ইসলামের বিরোধিতায় নয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে। ইসলামের ছদ্মাবরণে ইসলামের মূলোৎপাটনে এবারের নীলনক্সা প্রণীত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রেসালাত ও নবুওয়াতের সফলতা দেখে শত্রুপক্ষও বেছে নেয় এ পন্থা। কিছু লোক হুট করে নবুওয়াতের দাবী করে বসে। বনূ আসাদের ‘তুলাইহা’, বনূ হানীফার মুসায়লামা এবং ইয়ামানের আসওয়াদ আনাসী ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

মূল নাম ছিল আকীলা বিন কা‘ব। কিন্তু অত্যধিক কালো বর্ণের হওয়ায় লোকে তাকে ‘আসওয়াদ’ বলে ডাকতে থাকে। আরবিতে আসওয়াদ মানে কালো। অতঃপর এ নামেই সে পরিচিতি লাভ করে। ইয়ামানের পশ্চিম অঞ্চলে ‘আনাস’ গোত্রের নেতা ছিল সে। এ হিসেবে তাকে আসওয়াদ আনাসী’ বলা হয়। ইতিহাসেও সে এ নামে স্থান পেয়েছে। সে মন্দিরের জ্যোতিষীও ছিল। কুচকুচে কালো হওয়া সত্ত্বেও তার মাঝে এমন আকর্ষণ ছিল যে, মানুষ তার ইশারা পর্যন্ত মেনে নিত অবলীলাক্রমে। তার দেহে মুষ্টিযোদ্ধার মত বিশাল শক্তি থাকায় মহিলারা তার কৃষ্ণবর্ণকে অপ্রিয় জ্ঞান না করে বরং আরো কাছে ভিড়ত। তার সাথে অন্তরঙ্গভাবে মেশার চেষ্টা করত। মন্দিরে থাকার দরুণ সে এই বিশাল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করে। কারণ, তৎকালে মানুষ জ্যোতিষীকে দেবতার আশীর্বাদপুষ্ট এবং দূত মনে করত।

ইয়ামানের অধিকাংশ এলাকার লোক ইসলামের ছায়াতলে এসে গিয়েছিল। আসওয়াদের গোত্রেও ইসলাম ঢুকে পড়েছিল। আসওয়াদ ইসলামের বিরোধিতায় টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। যেন জনতার সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, আসওয়াদ নিজেও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।

তৎকালে ইয়ামানের শাসক ছিল হাসান নামক এক ইরানী। ইরানের সম্রাট ছিল খোসরু পারভেজ (কিসরা)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূর দেশে যাদের প্রতি ইসলামের দাওয়াত পত্র পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ইরানের সম্রাট ছিল অন্যতম। তার কাছে পত্র দিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রেরণ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইরানপতিকে পত্র হস্তান্তর করলে সে দরবারের দোভাষীকে তার অনুবাদ করে শোনাতে নির্দেশ দেয়।

পত্রের বিবরণ তাকে জানানো হলে সে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে সে পত্র টুকরো টুকরো করে বর্জ্যদানিতে নিক্ষেপ করে এবং পত্রবাহক হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দরবার থেকে বের করে দেয়। হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মদীনা ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানান যে, ইরান সম্রাট তাঁর পত্র টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে।

পত্র টুকরো করে ইরান সম্রাটের ক্রোধ প্রশমিত হয় না। ইয়ামান ছিল ইরান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত আর সেখানকার গভর্নর ছিল বাযান। ইরান সম্রাট বাযান বরাবর এ নির্দেশ প্রেরণ করে যে, হিজাজে (আরবে) মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি রয়েছে। সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে। তাকে পারলে জীবিত নতুবা তার মাথা কেটে এনে আমার সামনে পেশ কর।

বাযান পত্র পেয়েই দু’জন লোকসহ পত্র মদীনায় পাঠিয়ে দেয়। এ দু’পত্রবাহকের উদ্দেশ্য কি ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট মতান্তর রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জীবিত ধরতে কিংবা হত্যা করে তার মস্তক আনতে বাযান ঐ দু’ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছিল। কতিপয় ঐতিহাসিক বলেন, বাযান ইসলাম গ্রহণ না করলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে এতই প্রভাবিত ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ইরানপতির মতিগতি সম্পর্কে অবগত করাই ছিল বাযানের উদ্দেশ্য। তবে সকল ঐতিহাসিক এ বিষয়ে একমত যে, বাযানের প্রেরিত দু’ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যায় এবং ইরান সম্রাট যে পত্র বাযানের বরাবর লিখেছিল তা তাকে পেশ করে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পত্র পড়ে একটুও বিচলিত হন না। তিনি পত্র থেকে মুখ তুলে মুচকি হেসে বলেন, ইরান সম্রাট গতকাল রাতেই নিজ পুত্র শেরওয়াহ-এর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। আজ সকাল থেকে ইরানের সম্রাট শেরওয়াহ।

“গতরাতের হত্যার খবর এত দ্রুত এখানে কিভাবে পৌঁছল?” বাযান কর্তৃক প্রেরিত দু’জনের একজন জিজ্ঞাসা করে এবং বলে—“এটা কি আমাদের সম্রাটের সুস্পষ্ট অবমাননা নয় যে, এই ভুল খবর ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ইরান সম্রাট তার পুত্রের হাতে নিহত?”

“আমার আল্লাহই এ খবর জানিয়েছেন”—রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যাও, বাযানকে গিয়ে বল, তার সম্রাট এখন আর খসরু নয়; শেরওয়াহ”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ হতে এটা জেনেছিলেন।

বাযানের দূত ফিরে গিয়ে তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। তিন-চারদিন পর বাযান ইরান সম্রাট শেরওয়াহ-এর পত্র পায়। পত্রে লেখা ছিল, খসরুকে অমুক রাতে হত্যা করা হয়েছে। এটা ঐ রাতই ছিল, যে রাতের কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন। এর কিছুদিন পর বাযান ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত সম্বলিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্র পান। বাযান পূর্ব হতে প্রভাবিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘ইলহাম’ তাকে আরো বেশী প্রভাবান্বিত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এটাও জানান যে, ইসলাম গ্রহণের পরেও সে যথারীতি ইয়ামানের শাসক থাকবে। তার ভূখণ্ডের নিরাপত্তা মুসলমানরা নিশ্চিত করবে।

বাযান ইসলাম গ্রহণ করে এবং যথারীতি ইয়ামানের শাসক পদে অধিষ্ঠিত থাকে। অল্প কিছুদিন পরে সে মারা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপরে ইয়ামানকে কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত করে প্রত্যেক অংশের স্বতন্ত্র শাসক নির্ধারণ করেন। বাযানের পুত্র শাহারকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সানআ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন।

এই গুজব ডাল-পালা মেলে বহু শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়ে যে, আসওয়াদ আনাসী ‘মাজহাজ’ এলাকায় চলে গেছে। খবান নামক এক গুহায় বর্তমানে সে অবস্থান করছে। ক’দিন পর আবার এই গুজব ডানা মেলে সারা ইয়ামানে উড়ে বেড়ায় যে, আসওয়াদ গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং খোদা তাকে নবুওয়াত প্রদান করেছে। এখন সে আর পূর্বের আসওয়াদ আনাসী নয়; ‘রহমানুল ইয়ামান’। সংবাদদাতার কণ্ঠে কোনরূপ সন্দেহের সংমিশ্রণ ছিল না। সে পুরো দৃঢ়তার সাথে সংবাদ পরিবেশন করে ফেরে যে, আসওয়াদ নবুওয়াত লাভ করেছে। সে তাকে নবী বলে মেনে নিয়েছে।

‘গিয়ে দেখে এস”—সংবাদদাতা এ সংবাদ বলে বেড়াতে থাকে—“বিশ্বাস না হলে মাজহাজে নিজে গিয়ে দেখে এস। রহমানুল ইয়ামান মৃতকে জীবিত করেন। অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে পুষ্পে পরিণত করেন।…চল, ভাই সবাই চল। আত্মার মুক্তি লক্ষ্যে চল।”

যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের গায়েও গুজবের বাতাস লেগেছিল। সংবাদের সত্যতা যাচাই না করে তারাও ইয়ামান অভিমুখে ছুটে চলে। পূর্বে আসওয়াদ জ্যোতিষী থাকায় মানুষ প্রথম থেকেই মনে করত যে, দেবতার পক্ষ হতে সে কোন অলৌকিক শক্তিপ্রাপ্ত। ফলে সে নবুওয়াত দাবী করাতে মানুষ তৎক্ষণাৎ তার দাবী সত্য বলে মেনে নেয়।

খবান গুহার সামনে সর্বক্ষণ মানুষের প্রচণ্ড ভীড় লেগে থাকে। উপচে পড়া জনতা আসওয়াদকে এক নজর দেখার জন্য ভীষণ উদগ্রীব ছিল। সে দিনের বেলায় সামান্য সময়ের জন্য গুহা হতে বের হতো এবং গুহার নিকটবর্তী একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতাকে কুরআনের আয়াতের মত কিছু আরবি বাক্য শুনাত। সে দাবী করে জানাত যে, তার কাছে এক ফেরেশতার গমনাগমন হয়। আল্লাহর পক্ষ হতে আগত এ ফেরেশতা তাকে একটি করে আয়াত এবং সেই সাথে কিছু গোপন তথ্য জানিয়ে যায়।

আসওয়াদ উৎসুক জনতাকে কিছু অলৌকিক কারসাজিও দেখায়। জ্বলন্ত মশাল মুখে পুরে আবার জ্বলন্ত অবস্থায় তা বের করত। একটি মেয়েকে শূন্যে লটকে রাখে। এমনি আরো কতিপয় ভেল্কিবাজী দেখায় যা মানুষ দেখে তাকে মোজেযা বলত। তার ভাষা যেমন ছিল আবেগী তেমনি কণ্ঠও ছিল বেশ সুরেলা। তার কথার প্রতিটি বর্ণে আকর্ষণ ছিল, যা শ্রোতাকে দারুণ মুগ্ধ করত।

আসওয়াদ ইয়ামানবাসীদের হৃদয় এ শ্লোগানের মাধ্যমে সহজেই জয় করে নেয় যে, ইয়ামানের মালিক ইয়ামানবাসী। এটা কোন করদ রাজ্য নয়। ইতোপূর্বে ইয়ামান এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইরানীদের শাসনাধীন ছিল। ইয়ামানের শাসক বাযান ইসলাম কবুল করলে ইরানীদের প্রভাব লুপ্ত হয়ে ইয়ামান হিজাযী মুসলমানদের শাসনাধীনে চলে আসে। এ ছাড়া এখানে ইহুদি, নাসারা এবং অগ্নি-উপাসকরা বাস করত। এরা ইসলামের বিপর্যয় কামনা করত। তারা আসওয়াদ আনাসীর নবুওয়াতের দাবীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পর্দার অন্তরালে, কলকাঠি নাড়ায়।

আসওয়াদ তার নবুওয়াতের সত্যতা একটি গাধার মাধ্যমে পেশ করত। তার সামনে একটি গাধা আনা হতো। সে গাধাকে নির্দেশ দিত-“বসো”। গাধা বসে যেত। এরপর বলত—“আমার সামনে মস্তক অবনত কর”—গাধা সেজদার ভঙ্গিতে মাথা নোয়ায়ে দিত। গাধার উদ্দেশে তার তৃতীয় নির্দেশ ছিল—“আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বস”—গাধা অমনিই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ত।

ইয়ামানবাসী অতি অল্প সময়ে আসওয়াদ আনাসীকে নবী বলে মেনে নেয়। আসওয়াদ তার ভক্তবৃন্দকে সৈন্যদের মত সুসংগঠিত ও বিন্যস্ত করে ফেলে। সে এ ভক্তবাহিনীকে নিয়ে প্রথমে নাযরান অভিমুখে রওয়ানা হয়। সেখানে হযরত খালিদ বিন সাঈদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আমর ইবেন হাজম রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ হতে শাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। আসওয়াদের সাথে বিরাট বাহিনী ছিল। বিশাল এ বাহিনী নাযরানে প্রবেশ করলে সেখানকার অধিবাসীরাও তাদের দলভুক্ত হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহরূপ ধারণ করে যে, মুসলিম শাসকদের জন্য পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেখে তারা প্রশাসনিক ভবন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।

আসওয়াদ আনাসী প্রথম চোঁটেই বিজয় হাতে পেয়ে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। এদিকে তার সৈন্যসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। নাযরানে রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে সে এবার সান‘আর দিকে মনোযোগ দেয়। বাযানের পুত্র শাহার ছিল সেখানকার শাসক। সৈন্যসংখ্যা সীমিত থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

তার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় সৈন্যরা দৃঢ়তার সাথে লড়ে যায়। কিন্তু এ জন্যে শাহারকেও যেহেতু একজন সাধারণ সৈন্যের মত লড়তে হচ্ছিল তাই তিনি এক সময় শহীদ হয়ে যান। তার মৃত্যুতে সৈন্যরাও ভেঙ্গে পড়ে। আসওয়াদ যুদ্ধ জিতে নেয়।

আসওয়াদের মোকাবিলায় ঐ সকল ইয়ামানীও যোগ দেয়, যারা মুসলমান ছিল না। কিন্তু পরাজয়ের অবস্থায় কেবল মুসলমানদের জীবন হুমকির সম্মুখীন ছিল। আসওয়াদ বাহিনীর হাতে তাদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল। আসওয়াদের হাত থেকে কোন মুসলমান রেহাই পেত না। ফলে মুসলমানরা সুকৌশলে রণাঙ্গন হতে কেটে পড়ে এবং সোজা মদীনায় গিয়ে পৌঁছে।

আসওয়াদ আনাসী দুর্বারগতিতে সামনে এগুতে থাকে। হাজরে মওত, বাহরাইন, এহসা এবং আদন পর্যন্ত সমগ্র এলাকা এক এক করে অধিকার করে সে পুরো ইয়ামানের বাদশা হয়ে যায়।

ইসলামের বিরুদ্ধে এটা ছিল এক খোলা চ্যালেঞ্জ। উত্তর দিক হতে রোমীয়দের আক্রমণের আশংকা সবসময় বিদ্যমান ছিল। এদের প্রতিরোধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আযাদকৃত গোলাম হযরত যায়েদ বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাত্র ২২ বছর বয়সী পুত্র হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ইতোপূর্বে হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও সেনাধ্যক্ষ ছিলেন এবং তিনি মুতা যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

স্বঘোষিত এক ভণ্ড নবী হতে ইয়ামানকে মুক্ত করার জন্য এক বিশাল বাহিনী প্রয়োজন ছিল মুসলমানদেরও ছিল তেমন বাহিনী। কিন্তু এ বিশাল বাহিনী প্রস্তুত ছিল রোমীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। রোমীয়দের উপর হামলা স্থগিত রেখে ইয়ামানে এ বাহিনী পাঠানো হলে রোমীয়রা এটাকে অপূর্ব সুযোগ মনে করে খোদ মদীনায় হামলা করতে পারে। তাহলে এটা হবে মারাত্মক বিপর্যয় এবং ভরাডুবি। তাই এ পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়া হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিকল্প চিন্তাও করেন যে, যারা অসহায় হয়ে আসওয়াদের আনুগত্য স্বীকার করেছে, আসওয়াদকে মসনদচ্যুত করতে তাদেরকেই কৌশলে ব্যবহার করতে হবে। কমান্ডারগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বিকল্প প্রস্তাব সমর্থন করেন। এ লক্ষ্যে কয়েকজন বিচক্ষণ লোক, ইয়ামানে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তীক্ষ্ণ নির্বাচনী দৃষ্টি হযরত কায়েস বিন হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর গিয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে নিয়ে ইয়ামানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ভাল করে বুঝিয়ে দেন। সাথে সাথে এটাও বলে দেন যে, তাকে খুব সতর্ক এবং গোপনে সেখানকার মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে গোপনে একদল জানবাজ মুজাহিদ তৈরী করতে হবে, যারা ভণ্ড নবী এবং বিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবন্ত স্বঘোষিত বাদশাহকে গদীচ্যুত করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়েস বিন হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আরো বলেন যে, তাকে ইয়ামানে যাবার কথা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে এবং সুদূর ইয়ামান পর্যন্ত তাকে এমনভাবে পৌঁছতে হবে যেন কেউ না দেখতে পায়।

এই গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো পদক্ষেপ নেন। তিনি ওবার বিন ইয়াহনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একটি পত্র দিয়ে ইয়ামানে গিয়ে পত্রটি ইয়ামানের ঐ সমস্ত মুসলিম নেতৃবৃন্দকে শুনাতে বলেন, যারা পরিস্থিতির চাপে পড়ে আসওয়াদ আনাসীর বশ্যতা স্বীকার করেছে। তাকে আরো বলে দেন, পত্রটি পাঠ মাত্রই নিশ্চিহ্ন করে দিবে। বাকী যা কিছু করার তা হযরত কায়েস বিন হুরায়রা করবে।

আসওয়াদ আনাসী সান‘আতে হামলা করলে সেখানকার গভর্নর শাহার বিন বাযান মোকাবিলা করেন। কিন্তু লড়তে গিয়ে তিনি শহীদ হয়ে যান। আযাদ নামে তার এক যুবতী স্ত্রী ছিল। তার এই স্ত্রী আসওয়াদের হস্তগত হয়। আযাদ অসাধারণ রূপবতী ইরানী কন্যা ছিল। আযাদ আসওয়াদকে স্বামী হিসেবে বরণ করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু আসওয়াদ জোরপূর্বক তাকে স্ত্রী করে নেয়। আযাদ তাকে প্রচণ্ডরূপে ঘৃণা করত, যার ফলে সে বন্দী হয়ে যায়। এক দুর্বল নারীর পক্ষে কিছু করারও ছিল না। আসওয়াদ অত্যন্ত নারীমোদী ছিল। তার অন্দর মহলে কম করে হলেও বিশ রূপসী সব সময় শোভা বর্ধন করত। বিভিন্ন স্থান থেকে হাদীয়া হিসেবেও তার কাছে অসংখ্য তরুণী আসত। সে সর্বক্ষণ নারী এবং মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত হয়ে হযরত কায়েস বিন হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত সংগোপনে এবং বেশ-ভূষা বদল করে অবশেষে সান‘আ পৌঁছান। আসওয়াদ সানআ দখল করে তাকে রাজধানী করেছিল। ওদিকে ওবার বিন ইয়াহনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এক মুসলিম নেতার কাছে পত্র নিয়ে পৌঁছে যান। ঐ মুসলিম নেতা তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, যারা অন্তর থেকে আসওয়াদের আনুগত্য স্বীকার করেনি এমন কয়েকজন মুসলিম নেতাকে দলে ভিড়ানো মোটেও ব্যাপার নয়। তবে কথা হল, এতে আসওয়াদকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। কারণ, সে কেবল বাদশা নয়। ইয়ামানবাসী তাকে নবী বলে মান্য করে।

সান‘আ এসে হযরত কায়েস বিন হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু এমন এক স্থানে এসে আস্তানা গাড়েন, যেখানে রাসূল প্রেমিক মুসলমান বিদ্যমান ছিল। তারাও ঐ জবাব দেয় যা মুসলিম নেতৃবৃন্দ দিয়েছিল। তবে তারা এমন কোন কথা বলে না যে, তারা এই যোগসাজোশে শরীক হবে না। তারা পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে বলে যে, তারা সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে আস্থাভাজন মুসলমানদেরকে এক প্লাটফর্মে এনে সুসংঘবদ্ধ করে তুলবে।

“আমরা এই মিথ্যুক নবীর ভবলীলা সাঙ্গ করতে অধিক অপেক্ষা করতে পারি না।”—এক মুসলমান মন্তব্য করে। “সময় যত বয়ে যাচ্ছে তার গ্রহণযোগ্যতাও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাকে হত্যা করার কোন পরিকল্পনা করা যায় না?”

“কে হত্যা করবে?”—আরেক মুসলমান জিজ্ঞাসা করে। “আর কোথায়-ই বা তাকে হত্যা করা হবে? সে তো অন্দর মহল থেকে বের-ই হয় না। আর এটাও জানা কথা যে, তার বাসভবনের চারপাশে কড়া ও নিচ্ছিদ্র প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে।”

“আমাদের মধ্য হতে কেউ তার জীবন বাজি রাখার সংকল্প করতে পারে না?” হত্যা পরামর্শদাতা জিজ্ঞাসা করে।

যাকে হত্যা করা হবে তার কাছেই যদি না পৌঁছা যায় তবে এভাবে জীবন খোয়াবার কি অর্থ হতে পারে?”—অপর মুসলমান পাল্টা প্রশ্ন করে, অতঃপর বলে—“মোটকথা গোপনে আমাদের এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কমপক্ষে বিদ্রোহের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে তার ঝুঁকি নিতেই হবে।”

আসওয়াদ আনাসী ইয়ামান অধিকার করে সর্বপ্রথম এই পদক্ষেপ নেয় যে, ইরানের শাহী ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত বংশের যে সমস্ত লোকজনকে আসওয়াদ সানআয় পায়, সবাইকে বিভিন্ন পন্থায় লাঞ্ছিত-অপদস্ত করেছিল। তাদের অবস্থা কেনা গোলামের চেয়েও করুণ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আসওয়াদের রাজত্বে সবচে বড় যে দুর্বলতা ছিল তা হলো, তার অধীনে অভিজ্ঞ কোন সেনাপতি এবং কোন সুদক্ষ প্রশাসকও ছিল না। তারপরে এ আশংকাও তার সবসময় ছিল যে, মুসলমানরা যে কোন আক্রমণ করতে পারে। তার নিজেরও সমরজ্ঞান বলতে কিছু ছিল না। এই দুর্বলতা ও শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে তাকে বাধ্য হয়ে ইরানীদের সাহায্য নিতে হয়।

তার দপ্তরে ৩টি নাম জমা পড়ে। ১. গভর্নর বাযানের সময়কার প্রখ্যাত ইরান সেনাপতি কায়েস বিন আব্দে ইয়াগুছ। ২. ফিরোজ ও ৩. দাজওয়াহ। এ দু’জন প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ছিলো। ফিরোজ ইতোপূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সঠিক অর্থে এবং আন্তরিকভাবেই সে মুসলমান ছিল। আসওয়াদ কায়েস বিন আব্দে ইয়াগুছকে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ দেয়। আর ফিরোজ ও দাজওয়াহকে মন্ত্রী বানায়। তিনজনই আসওয়াদের সর্বাত্মক আনুগত্যের শপথ করে এবং তাকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, তারা যে কোন অবস্থায় তার অনুগত থাকবে।

একদিন ফিরোজ বাইরে কোথাও পায়চারি করছিল। ইত্যবসরে এক ভিক্ষুক এসে তার পথ আগলে ধরে এবং তার দিকে সাহায্যের আশায় হাত বাড়িয়ে দেয়।

“তোমাকে দেখে অক্ষম মনে হয় না”—ফিরোজ তাকে বলে। যদি তোমার মাঝে কোন অক্ষমতা থেকে থাকে তবে সে অক্ষমতা একমাত্র এটাই যে, তোমার মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ এবং ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু নেই।”

“তুমি ঠিকই ধরেছ”—ভিক্ষুক তার প্রসারিত হাত ধীরে সরিয়ে এনে বলে— “আমার অসহায়ত্ব এটাই যে, আমার আত্মমর্যাদা বলতে যা ছিল তা আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।…আর আমার ধারণা মিথ্যা না হলে বলবো, আমার মত তোমার মাঝে এই অসহায়ত্ব বর্তমান। ভিক্ষার জন্য আমি হাত বাড়াইনি। আমার হারানো আত্মমর্যাদাবোধ ফেরৎ চাচ্ছি মাত্র।

“তুমি পাগল না হয়ে থাকলে তোমার মনের কথা খুলে বল”—ফিরোজ ভিক্ষুকবেশীকে বলে।

“আমার অন্তরে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম রয়েছে, তুমি যার প্রেমিক”। ভিক্ষুক ফিরোজের চোখে চোখ রেখে বলে—“আসওয়াদ আনাসীর শরাব তোমার পেটে জায়গা না পেয়ে থাকলে আমার এ ধারণা মিথ্যা নয় যে, তুমি অন্তরে পাথর চাপা দিয়ে আসওয়াদের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছ।”

ফিরোজ এদিক-ওদিক চায়। সে বুঝে ফেলে ভিক্ষুকবেশী মদীনার একজন মুসলমান। কিন্তু এ আশংকাও সে উড়িয়ে দিতে পারে না যে, লোকটি আসওয়াদের ঝানু গোয়েন্দাও হতে পারে, যে কৌশলে তার মনোভাব যাচাই করছে।

ঘাবড়িয়ো না ফিরোজ।” ভিক্ষুক বলে—“আমি তোমার প্রতি আস্থাশীল। তুমিও আমার উপর আস্থা রাখ। আমি তোমাকে আমার নাম জানিয়ে দিচ্ছি…কায়েস বিন হুরায়রা…। আমাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরণ করেছেন।”

“সত্যই কি আল্লাহ্ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে আমার কাছে প্রেরণ করেছেন? ফিরোজ আবেগের সাথে জানতে চায়।

“না”, হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছিলেন যে, সেখানে গেলে আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের দেখা পেয়ে যাবে।”

“তুমি কিভাবে জানলে আমি খাঁটি মুসলমান?” ফিরোজ জিজ্ঞাসা করে।

“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম শুনে রাসূল-প্রেমিকদের চোখে যে চমক সৃষ্টি হয় তা আমি তোমার দু’চোখে দেখেছি। হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তোমার চোখে সে চমক কিছুটা বেশী দেখা যায়।”

ফিরোজ হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এখন চলে যেতে বলে। সে হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আরেক স্থানের ঠিকানা দিয়ে বলে, যেন আগামীকাল সূর্য ডোবার কিছু পূর্বে এই ঠিকানায় এসে ভিক্ষা চাইতে থাকে।

পরের দিন গোধূলী লগ্নে ফিরোজ ঐ স্থান দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। ফিরোজের ইশারায় হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু ভিক্ষুকের মত দাঁড়িয়ে ফিরোজের পিছনে পিছনে হাত লম্বা করে চলতে থাকে।

“আল্লাহ্‌র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়ে দাও যে, তাঁর নামে জীবন উৎসর্গকারী এক ব্যক্তি আসওয়াদ আনাসীর ছত্রছায়ায় রয়েছে”—ফিরোজ চলার গতি পূর্ববত রেখে কোনদিকে না তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে—“আর আমি ভেবে পাই না যে, বিশাল সমরশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামানে এখনও হামলা করছেন না কেন?”

“হিরাক্লিয়াসের বাহিনী উরদুনে আমাদের মাথার উপর দাঁড়ানো।”—হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমাদের বাহিনী রোমীয়দের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে। আমরা দু’জনই কি পুরো সৈন্যের কাজ করতে পারি না?”

তুমি ভেবে দেখেছ, আমাদের মত দু’জন আর কিইবা করতে পারে?” ফিরোজ জিজ্ঞাসা করে।

“হত্যা”—হযরত কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিয়ে বলেন, “এ প্রশ্ন না করলে খুশী হব যে, আসওয়াদকে কিভাবে হত্যা করা যেতে পারে। চাচাত বোন আযাদের কথা তুমি বেমালুম ভুলে গেছ।

ফিরোজ চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে। আচমকা তার চেহারায় ভিন্ন রংয়ের স্ফুরণ ঘটে। যেন হঠাৎ রক্ত টগবগিয়ে ওঠে।

“অমানিশার ঘোরে তুমি আমাকে আলোর ঝিলিক দেখিয়েছ”—ফিরোজ বলে, ‘হত্যা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। আমার চাচাত বোনের নাম উচ্চারণ করে তুমি আমার মিশন সহজ করে দিয়েছ। এ কাজ আমি সম্পন্ন করবই।… তুমি নিজের কাজে মনোযোগ দাও।… এখন যাও কায়েস। জীবিত থাকলে পরে আবার সাক্ষাৎ হবে ইনশাআল্লাহ।

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, ফিরোজের অন্তরে আসওয়াদের প্রতি যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল এবং যে ঘৃণা এতদিন চাপা ছিল তা উথলে ওঠে। সে আসওয়াদ আনাসীর ইরানী সেনাপতি কায়েস বিন আব্দে ইয়াগুছ এবং মন্ত্রী দাজওয়াহকে নিজের সমমনা ও সাথী বানিয়ে নেয়। আসওয়াদকে হত্যা করা এক মন্ত্রীর জন্যও সহজসাধ্য ছিল না। আসওয়াদের নিরাপত্তাকর্মী ও দেহরক্ষী বাহিনী সর্বক্ষণ তার চারপাশে থাকত। অনেক ভেবে-চিন্তে এই তিন ইরানী এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, আযাদকে এই কাজে শরীক করা হবে তবে সে নিজে হত্যা করবে না।

আযাদের সাথে যোগাযোগও সহজ ছিল না। এরই মধ্যে আসওয়াদের কেমন যেন সন্দেহ হয়ে যায় যে, তিন ইরানী তাকে অন্তর থেকে সমর্থন করে না। সে তাদের উপর আস্থা কমিয়ে দেয়। ইতোপূর্বে আযাদ আর ফিরোজের মধ্যে কখনও সাক্ষাৎ হয়নি।

আযাদ পর্যন্ত পৌঁছার জন্য প্রয়োজন ছিল একজন নারীর। একজন মন্ত্রীর জন্য একটি মেয়েলোক যোগাড় করা কোন কঠিন কাজ ছিল না। ফিরোজ মহলের আধা বয়ষ্কা এক মহিলাকে তলব করে। সেও মুসলমান ছিল। ফিরোজ তাকে নিজের বাড়িতে কাজের প্রস্তাব দেয়। সে চাইলে ফিরোজ তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে পারে। ফিরোজ তাকে কিছু টোপও দেয়। সে তাকে জানায় যে, বর্তমানে তার থেকে যত কাজ নেয়া হচ্ছে এত কাজ নেয়া হবে না। মহিলা সহজেই রাজি হয়ে যায়। ফিরোজ সেদিনই তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে।

একদা আযাদ একাকী বসা ছিল। সে সর্বক্ষণ ক্রুদ্ধ ও অগ্নিশর্মা থাকত। পরিত্রাণের কোন পথ সে খুঁজে পাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় ফিরোজের সদ্য নিয়োগকৃত বুয়া তার কাছে আসে।

“আমি কাজের বাহানায় এখানে এসেছি”—চাকরানী বলে, “কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি এসেছি আপনার কাছে।…রহমানুল ইয়ামানের বর্তমান মন্ত্রী আপনার চাচাত ভাইয়ের সাথে কখনো আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে।”

“তুমি গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছ?” আযাদ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে।

“না”—চাকরানী বলে, “আমার ব্যাপারে এই সন্দেহ রাখবেন না যে, আমি ঐ ভণ্ড নবীর গোয়েন্দা। আসওয়াদের প্রতি আমার অন্তরে ততখানি ঘৃণা যতখানি আপনার অন্তরে রয়েছে।”

“আমি বুঝতে পারছি না তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?” আযাদ বলে।

“ফিরোজ আমাকে পাঠিয়েছে”—চাকরানী বলে।

“ফিরোজের নামও আমি শুনতে চাই না”—আযাদ বলে, “তার মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছু থাকলে সে ঐ ব্যক্তির মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করত না, যে তার চাচাত বোনকে বিধবা করে তাকে জোরপূর্বক স্ত্রী বানিয়েছে।”

আযাদ শাহী খান্দানের মহিলা ছিল। চাকর-চাকরানী সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এতটুকু কথায় আযাদ নিশ্চিত হয়ে যায় যে, এই পরিচারিকা গোয়েন্দাগিরি করতে আসেনি। আযাদ তাকে জিজ্ঞাসা করে যে, ফিরোজ তার জন্য কি বার্তা প্রেরণ করেছে? পরিচারিকা জানায় যে, তিনি একবার আপনার সাথে দেখা করতে চান মাত্র। আযাদ তাকে একটি নির্দিষ্ট স্থানের কথা জানিয়ে বলে, ফিরোজকে রাতে এখানে আসতে বলবে।

“তবে আমাদের মাঝে একটি দেয়ালের পার্থক্য থাকবে।”—আযাদ বলে, “দেয়ালের এক স্থানে একটি বাতায়ন আছে। এখানে একটি খাম্বাও আছে। ফিরোজ এই খাম্বার অপর দিকে মুখ করে কথা বলতে পারে।”

পরিচারিকা আযাদের বার্তা ফিরোজকে পৌঁছে দেয়।

ঐ দিন রাতেই ফিরোজ মহলের পার্শ্বস্থ দেয়ালের ঐ স্থানে পৌঁছে যায় যেখানে খাম্বাবিশিষ্ট ছোট বাতায়ন ছিল। আযাদ ফিরোজের অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিল।

“তোমার প্রেরীত পরিচারিকার উপর আমার অগাধ আস্থা এসে যায়”—আযাদ কথা শুরু করে, “তা তোমার প্রতি কিভাবে আস্থা রাখতে পারি? আমার বিশ্বাস হয় না যে, তুমি আমাকে ঐ বর্বর-জংলী থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছ।”

“তবে কি তুমি ঐ বর্বরের সাথে সুখেই আছ।” ফিরোজ জিজ্ঞাসা করে।

“তার মত ঘৃণ্য দ্বিতীয় আর একটিও আমার চোখে পড়েনি”—আযাদ বলে, “এখানে তোমার বেশীক্ষণ থাকা উচিত নয়। তাড়াতাড়ি বল, এতদিন পর আমার কথা তোমার কেন মনে পড়ল?”

“এ মুহূর্তে আসওয়াদ এদিকে আসার আশংকা রয়েছে?” ফিরোজ জানতে চায়—“না কি সে এখনই তোমাকে…।”

“না”—আযাদ বলে, “প্রহরীদের এসে পড়ার আশংকা করছি আমি। আসওয়াদ এখন মদের নেশায় চুর হয়ে পড়ে আছে। তার অধীনে নারীর সংখ্যা কম নয়।”

“শুধু তোমাকে নয়; পুরো ইয়ামানকে আমি মুক্ত করতে চাই”—ফিরোজ বলে, “কিন্তু তোমার সাহায্য ছাড়া আমি সফল হতে পারব না।”

“খুলে বল ফিরোজ!” আযাদ বলে—“আমাকে কি করতে হবে?”

‘কোন এক রাতে আমাকে আসওয়াদ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে দাও।”—ফিরোজ বলে, “তাহলে প্রভাতে তার লাশ ওখান থেকে বের করা হবে।…বল, পারবে এ উপকারটুকু করতে?”

“আগামীকাল রাতে এই সময়ের কিছু পরে এই দেয়ালের অপর প্রান্তে ঐ স্থানে আসবে যার কথা তোমাকে বলছি”—আযাদ বলে, “আমার কক্ষ এই দেয়াল সংলগ্ন। অন্য কোন পন্থায় দেয়াল টপকানো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। রশি ফেলতে হবে। সাথে করে রশি আনবে। দেয়ালের উপর দিয়ে রশি ছুড়ে দিবে। রশির মাথা আমি এদিকে কোথাও বেঁধে দিব। তুমি রশি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠবে।”

পরবর্তী রাতে ফিরোজ চুপিসারে দেয়ালের গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলতে থাকে। তাকে থেমে থেমে চলতে হচ্ছিল। পাহারাদারদের এড়িয়ে পথ চলতে হয়। অবশেষে সে নির্ধারিত স্থানে এসে পড়ে। সে এসেই রশির একমাথা দেয়ালের উপর দিয়ে ছুড়ে দেয়। অতি সহজে রশির মাথা দেয়ালের অপর প্রান্তের গিয়ে পড়ে। আযাদ যথাস্থানে অবস্থান করছিল। সে জলদি রশির এ প্রান্ত কোথাও শক্ত করে বেঁধে দেয়। রশি বাঁধা হয়ে যেতেই ফিরোজ রশি বেয়ে বেয়ে এবং দেয়ালের সাথে পা চেপে চেপে দেয়ালের উপর উঠে যায়। এরপর রশি দেয়ালের উপর কোথাও বেঁধে রশি বেয়ে বেয়ে অনায়াসে নীচে নেমে আসে।

আযাদ তাকে নিজ কামরায় নিয়ে যায় এবং অর্ধ রাত পর্যন্ত সেখানেই তাকে লুকিয়ে রাখে। এর পূর্বে বের হলে আসওয়াদের টের পাওয়ার আশংকা ছিল।

“অর্ধেক রাতের পর সে অবচেতন এবং নেশায় বুদ হয়ে যায়”—আযাদ আসওয়াদের ব্যাপারে ফিরোজকে জানায়—“লোকটা রীতিমত মানুষরূপী দৈত্য। যে দৈত্য শুধু মদ পিপাসু এবং নারীখোর।… তুমি তার দৈহিক কাঠামো দেখেছো। এত লম্বা-চওড়া শরীরের কাছে তলোয়ারের এক-দু’ আঘাত শরাবের এক-দু’ চুমুকের মত। তাকে শেষ করা সহজসাধ্য হবে না।”

“নিজেকে শেষ করে হলেও তাকে শেষ করতেই হবে”—ফিরোজ বলে।

আযাদ কক্ষের দ্বার মৃদু উন্মোচন করে বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত করে। পারিচারিক ভবনের মাথায় এক প্রহরী দাঁড়িয়ে পাহারা দিত। এখন প্রহরীকে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ছায়া দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এখন তার মুখ দরজার অপর দিকে। আযাদ পা টিপে টিপে বের হয়ে আসওয়াদের কক্ষের দরজা খুলে। মৃদু রশ্মি ছড়িয়ে একটি ঝাড়বাতি মিটমিট করে জ্বলছিল। আসওয়াদ শয্যায় চিৎ হয়ে শুয়ে জোরে জোরে নাক ডাকছিল।

ঐতিহাসিক বালাজুরী তৎযুগের দু’হস্তলিপির উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেন, আযাদ আসওয়াদকে দেখে এত উত্তেজিত হয়ে ফেরে যে, তার চোখ-মুখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠুকরে বের হচ্ছিল। সহজেই অনুমান করা যায় যে, এটা ছিল দীর্ঘ চাপা ক্ষোভের ভয়াল বিস্ফোরণ এবং একরাশ ঘৃণার স্ফুলিঙ্গ।

“এস ফিরোজ!” সে উত্তেজনায় কম্পিত কণ্ঠে বলে—“সে অচেতন পড়ে আছে।”

ফিরোজ আযাদের সাথে কামরা থেকে বের হয় এবং পা টিপে টিপে আযাদের পিছু পিছু আসওয়াদের কামরায় গিয়ে প্রবেশ করে। আসওয়াদ জংলী পড়ের মত দীর্ঘদেহী ছিল। কক্ষ ভরপুর ছিল মদ এবং পাপাচারের বিভিন্ন সামগ্রী দ্বারা। আল্লাহই ভাল জানেন, এমনটি কেন হল! আসওয়াদ হঠাৎ জেগে যায়। মন্ত্রী এবং রূপবতী ইরানী স্ত্রীকে দেখে সে থতমত খেয়ে উঠে বসে। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, আযাদের প্রতি তার পূর্ণ আস্থা ছিল। কিন্তু ফিরোজকে দেখে তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়।

“এ সময় আবার কি মুসিবত এল?” নেশায় ঢুলুঢুলু অবস্থায় আসওয়াদ জিজ্ঞাসা করে।

ফিরোজ এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করে না। চোখের পলকে তলোয়ার কোষমুক্ত করে এবং সজোরে আসওয়াদের গর্দান লক্ষ্য করে আঘাত হানে। আসওয়াদ শেষ মুহূর্তে টের পেয়ে গর্দান বাঁচাতে সক্ষম হলেও ভরপুর আঘাত গিয়ে লাগে তার মাথায়। আসওয়াদের মুখ থেকে এক তীব্র আত্মচিৎকার বেরিয়ে যায়। সে চিৎকার দিয়েই শয্যার অন্য পাশে গড়িয়ে পড়ে।

পরিচারক ভবনে ভারী পদশব্দ শোনা যায়। আযাদ দ্রুত এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রহরী দৌড়ে আসছিল। আযাদ দ্রুত এগিয়ে এসে প্রহরীর পথ আগলে ধরে। কক্ষ থেকে তখনও আসওয়াদের গোঙানীর মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছিল।

“স্বস্থানে ফিরে যাও”—আযাদ প্রহরীকে নির্দেশের ভঙ্গিতে বলে—“রহমানুল ইয়ামানের কাছে ফেরেশতা এসেছে। বর্তমানে ওহী নাযিল হচ্ছে।…যাও, এদিকে আসার প্রয়োজন নেই।”

ঐতিহাসিক বালাজুরী লেখেন, আযাদের কথায় প্রহরী আশ্বস্ত হওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে দেয় এবং চলে যায়।

আযাদ প্রহরীকে বিদায় করে এসে দেখে আসওয়াদ নীচের কার্পেটে পড়ে রয়েছে। আর ফিরোজ দ্বিতীয় আঘাত করার জন্য সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আসওয়াদ কার্পেটে লুটিয়ে পড়ে। তবে তার মাথা পালঙ্কের সাথে লেগে ছিল এবং তা ষাড়ের মত নড়ছিল।

“তুমি তাকে মেরে ফেলতে পারবে না ফিরোজ!” আযাদ সামনে এগিয়ে এসে বলে এবং আসওয়াদের মাথার লম্বা চুল দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে নীচের দিকে টান দেয় এবং নিজে বেডে উঠে বসে। যখন আযাদের প্রচেষ্টায় আসওয়াদের গর্দান এমন পর্যায়ে আসে যে, ফিরোজ অতি সহজে তার গর্দানে আঘাত করতে পারে তখন আযাদ বলে—“এবার চালাও ফিরোজ…গর্দান দ্বিখণ্ডিত করে ফেল।”

ফিরোজ এক কোপে আসওয়াদের গলা কেটে মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফিরোজের সাথী কায়েস বিন আব্দে ইয়াগুছ এবং দাজওয়াহ এর জানা ছিল যে, আজ রাতে কি ঘটতে যাচ্ছে। ফিরোজ আসওয়াদের দেহ তুলে নেয় এবং সোজা সাথীদ্বয়ের কাছে গিয়ে পৌঁছে। আযাদ ফিরোজের সাথে সাথে মহল থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রহরীরা রহমানুল ইয়ামান-এর হত্যার সংবাদ পেয়েই পুরো মহল ঘিরে ফেলে। শান্ত মহল অল্প সময়েই অশান্ত হয়ে ওঠে। পুরো মহলে হুলস্থুল পড়ে যায়। হেরেমের নারীরা আতংকে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যায়।

ওদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত হযরত কায়েস বিন হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত ওবার বিন ইয়াহনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু নেতৃস্থানীয় মুসলমানদেরকে বিদ্রোহের পর্যায়ে রেখেছিলেন। দিন-রাত অবিরাম তৎপরতা চালিয়ে মুসলমানদের উৎসাহ-উদ্দীপনা চাঙ্গা করে রেখেছিলেন।

সোবহে সাদিকের তখনও কিছু সময় বাকী। মহলের ছাদ থেকে আযানের উচ্চকিত ধ্বনি ইথারে-পাথারে আছড়ে পড়ে। খোদ মহলে আযানের ধ্বনি উঠায় লোকজন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। জনতা মহল অভিমুখে ছুটে আসে। আসওয়াদের ফৌজ হুকুমের অপেক্ষায় ছিল। হুকুমদাতা ছিল কায়েস বিন আব্দে ইয়াগুছ। সেই সর্বাধিনায়ক। সে সৈন্যদেরকে ব্যারাক হতে বাইরে আসতে দেয় না।

আসওয়াদের কর্তিত মস্তক বাইরে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। মহলের ছাদ থেকে এ আওয়াজ ক্রমেই জোরালো হচ্ছিল—“আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্‌র সত্য রাসূল আর আসওয়াদ আনাসী মিথ্যাবাদী।”

আসওয়াদের ভক্তকুল ঘটনার আকস্মিকতায় দারুণ ভড়কে যায়। তাদের চোখে-মুখে নেমে আসে আতংকের পর্দা। ওদিকে মুসলমানরা সশস্ত্র হয়ে চতুর্দিকে বাজের মত ছড়িয়ে পড়ে। তারা ইয়ামানীদেরকে পাইকারী হারে হত্যা করতে শুরু করে।

মিসরের সাবেক মন্ত্রী মা’আরেফ মুহাম্মদ হুসাইন স্বীয় গ্রন্থ আবু বকর সিদ্দীকে আকবর এ ফিরোজের একটি জবানী তুলে ধরেছেন। ফিরোজ বলেছিল:

আসওয়াদের হত্যার পর সেখানকার সকল ব্যবস্থাপনা পূর্ববৎ রাখা হয়। যেমনটি চলছিল আসওয়াদের জীবদ্দশায়। আমরা হত্যার পর সর্বপ্রথম যে কাজ করি তা হলো, হযরত মু’আজ বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে জামাতের সাথে নামায পড়ানোর অনুরোধ করি।…ইসলামের এক বড় শত্রুকে এভাবে সহজে

নাস্তানাবুদ করতে পেরে আমরা বেজায় খুশি ছিলাম। কিন্তু এ খুশীর হিল্লোল পড়তে না পড়তে খবর আসে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকাল হয়ে গেছে। বেদনাবিধুর এ খবরে সারা ইয়ামানে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। ইয়ামানবাসী শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। তাদের আনন্দ সম্পূর্ণ উবে যায়। জনজীবনে অঘোষিত অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং চরম স্থবিরতা নেমে আসে। সব মিলিয়ে শেষ খবরের ফুৎকারে জনতার আশার প্রদীপ দপ করে নিভে যায় এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বল পাতা সহসা ফিকে হয়ে যায়।”

সান‘আবাসীর মুক্তির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক অবদান রাখায় মুসলমানরা ফিরোজকে সান’আর গভর্নরের আসনে অধিষ্ঠিত করে।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ঘটনা এটি। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তায় হযরত কায়েস বিন হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত ওবার বিন ইয়াহনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এই সুসংবাদ নিয়ে মদীনা পৌঁছে যে, ভণ্ড নবীর ভবলীলা সাঙ্গ এবং বর্তমানে পুরা ইয়ামানে ইসলামের পতাকা শোভা পাচ্ছে। কিন্তু মদীনা তখন ছিল শোকে মুহ্যমান। মাত্র ক’দিন পূর্বে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে মোতাবেক ১১ হিজরীর ১২ই রবিউল আওয়াল আল্লাহ্‌র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছেন।

সাত

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের খবর অগ্নিগোলকে রূপ নেয়। যেখানেই এই খবর পৌঁছে সেখানেই আগুনের শিখা ওঠে। এটা ছিল বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ইসলামের শত্রুরা ময়দান খালি পেয়ে সামনে চলে আসে। বিভিন্নমুখী নাশকতামূলক কাজে তৎপর হয়ে ওঠে। নেতার দেখাদেখি মুসলমান হওয়া কিছু গোত্রও নড়েচড়ে ওঠে। যারা আন্তরিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের সংখ্যা ছিল কম। শুধু মুখে মুখে বা প্রাণ বাঁচাতে যারা মুসলমান হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল বেশী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালে এ শ্রেণী কেবল ইসলামচ্যুতই হয় না; তারা মদীনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেয় এবং মদীনায় হামলা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা করতে থাকে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর সর্বসম্মতিক্রমে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামী সালতানাতের কর্ণধার ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্থলাভিষিক্ত নির্বাচিত হন। তাঁর দায়িত্বভার বুঝে নেবার পূর্বেই চারদিকে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে ওঠে। যেন আচমকা কোন ঝড়ে আগুনের উপর থেকে ছাই উড়ে গিয়ে নিচের চাপা আগুন বেরিয়ে আসে। সর্বপ্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বিদ্রোহী কবিলাগুলো বরাবর ধৈর্য ও সহনশীলতার বার্তা প্রেরণ করেন। তাদেরকে ইসলাম বর্জন না করার আহ্বান জানান। দূত সকল স্থান থেকে কেবল এই জবাব নিয়ে ফেরে যে, আমাদের ইসলাম গ্রহণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ব্যক্তিগত চুক্তির ব্যাপার ছিল মাত্র। যখন তিনি নাই তখন সে চুক্তির কার্যকারিতা অটোমেটিক বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন আমরা পূর্ণ স্বাধীন। আমাদের ভবিষ্যৎ আমরা কাদের সাথে জুড়ে দিব সে ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার কারো নেই। এটা সম্পূর্ণ আমাদের ইখতিয়ারভুক্ত। এখানে অন্যের হস্তক্ষেপ অনধিকার চর্চার শামিল।

ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করতে যে বিপর্যয় প্রবল তুফানের ন্যায় ধেয়ে আসে তা হলো ধর্মান্তরিতের ফিত্না। এক শ্রেণীর মানুষ ইসলাম ছেড়ে অন্যধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুরতাদ হয়ে যেতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাতেই এ ফিৎনা সর্বপ্রথম মাথাচাড়া দেয়। কতিপয় ভণ্ড নবুওয়াতকে সস্তা জনপ্রিয়তার বাহন মনে করে নিজেকে নবী বলে দাবী করে বসেছিল। তিন দুষ্ট চক্র-রোম, ইরান এবং ইহুদীবাদ তাদের মদদ জোগায়। তাদেরকে নিজ দাবীতে অটল এবং ভণ্ডামী জোরে সোরে অব্যাহত রাখতে তারা সাহস, শক্তি, বুদ্ধি, জনবল, প্রচারণা ইত্যাদি পর্যায়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। ভণ্ড নবীদের একেক জন ছিল একেক এলাকার। তথাপি তাদের মধ্যে একটি ব্যাপারে অপূর্ব মিল ছিল। অর্থাৎ সকলের মধ্যে একটি গুণ সমভাবে ছিল। প্রত্যেকে ভেল্কিবাজী এবং নজরবন্দীতে পটু ছিল। ইহুদীবাদ হতে সকলে এ বিদ্যাটি রপ্ত করেই তবে মাঠে নামে। কোমলমতি জনগণকে সহজে প্রভাবিত ও তাদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করতে ‘যাদুনাটক’ অব্যর্থ অস্ত্র ছিল। ইতোপূর্বে আসওয়াদ আনাসীর আলোচনা চলে গেছে। সেও ভেল্কিবাজী এবং নজরবন্দীতে পারঙ্গম ছিল। জনতাকে অভিভূত ও প্রভাবিত করতে সে অনেক ভৌতিক কারসাজি জনগণকে দেখাত।

নবুওয়াতের অপর দু’দাবীদার ছিল তোলাইহা এবং মুসাইলামা। নজরবন্দীতে মুসাইলামা যথেষ্ট দক্ষ ছিল। সে অদ্ভুত অদ্ভুত অভূতপূর্ব যাদু প্রদর্শন করত। সে পাখীর দেহ থেকে পাখনা পৃথক করে একহাতে পাখী আর অপর হাতে পাখনা নিয়ে উপরে ছুড়ে দিত। আশ্চর্যজনকভাবে পাখনা পাখীর দেহে গিয়ে স্থাপিত হতো আর পাখী দেহে পাখনা পেয়ে উড়াল দিত।

মুসাইলামা কদাকৃতির মানুষ ছিল। তার চেহারা দেখে মনে হত এটা কোন পশুর চেহারা। মুখাকৃতিও ছিল পশুর মত। দেহ খর্বাকৃতির এবং বর্ণ ছিল পীত। দেখতে কদাকার হলেও দেহে ছিল অসুরের শক্তি। চোখ ছোট ছোট এবং নাক চ্যাপ্টা। সব মিলে এত বেঢপ এবং কুৎসিত ছিল তার চেহারা যে, যে কোন কুদর্শন মানুষও তাকে অপছন্দ করত। তবে সুন্দরী ললনা হোক কিংবা বেয়ারা নারী হোক একবার তার সান্নিধ্যে এলেই তার পরশ ভক্ত হয়ে যেত এবং সে তার অঙ্গুলী হেলনে উঠা-বসা করত।

মুসাইলামা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাতেই নবুওয়াতের দাবী করেছিল এবং দু’পত্রবাহকের মাধ্যমে নিম্নোক্ত ভাষায় একটি পত্র লিখেছিল”

“মুসাইলামা রসূলুল্লাহ-এর পক্ষ হতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ এর প্রতি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। পরবার্তা এই যে, আমাকে রেসালাতের সম অংশীদার করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে অর্ধ ভূখণ্ড আমার আর বাকী অর্ধাংশ কুরাইশদের। কিন্তু দুঃখের বিষয় কুরাইশরা ইনসাফ করছে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পত্র পাঠ করে পত্র বাহকদের কাছে জানতে চান যে, মুসাইলামার এহেন বিচিত্র ও অদ্ভুত বার্তার ব্যাপারে তাদের ব্যক্তিগত অভিমত কি?

“পত্রে যা লেখা আছে আমরা তা সমর্থন ও স্বীকার করি”—এক পত্রবাহক জবাব দেয়।

“আল্লাহর কসম!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—“দূত হত্যা অপরাধ না হলে এতক্ষণ তোমাদের কর্তিত মস্তক ধূলায় গড়াগড়ি খেত।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসাইলামার এই পত্রের জবাব নিম্নরূপ ভাষায় লেখান”

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে মিথ্যুক মুসাইলামার প্রতি-

বিশ্বের সমস্ত ভূখণ্ড আল্লাহর। তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তার উত্তরাধিকারী করেন।

এরপর থেকে মুসাইলামার নামের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যোগ হয় কাজ্জাব তথা মিথ্যুক শব্দটি। ইতিহাসের পাতায়ও সে এ বিশেষণে বিশেষিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় অন্তিম পীড়ায় শায়িত ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ভূখণ্ড দাবী করতে পারে এমন দুঃসাহসী ব্যক্তির অপতৎপরতা এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তি এখনই মিটিয়ে দেয়া জরুরী মনে করেন। তাঁর দৃষ্টি নাহারুর রিযাল নামক এক সাহাবীর উপর পড়ে। লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। পবিত্র কুরআনের উপর গভীর জ্ঞান রাখতেন। জ্ঞানী এবং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে ডেকে ইয়ামামায় যেতে বলেন এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগের পরামর্শ দেন। তিনি আর রিযালকে ভালভাবে বুঝিয়ে দেন যে, ইয়ামামা থেকে যে কোন মূল্যে মুসাইলামার প্রভাব ও তৎপরতা রুখা চাই। যাতে কোনরূপ রক্তপাত ছাড়াই লোকটি জনমন থেকে হারিয়ে যায় এবং তার দাবীর অসারতাও প্রমাণিত হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ পালনে আররিযাল ইয়ামামাহ অভিমুখে রওনা হয়ে যান।

মুসাইলামা বিন হাবীব উরফে মুসাইলামা কাজ্জাব রাতে স্বীয় দরবারে আসীন। শরাব পানের জমজমাট আসর চলছিল। তার গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ দরবারে বসা। সকলেই মুসাইলামাকে আল্লাহর রাসূল বলে মানত। ইসলামই ছিল তার ধর্মমত। তবে কিছুটা ছাড় ও শিথিলতা প্রদান করেছিল। সে একটি জাল আয়াত বানিয়ে ভক্তদের শুনায় এবং বলে যে, তার উপর ওহী নাযিল হয়েছে যে, এখন থেকে মদ হালাল। এ ছাড়া অন্যান্য আমোদ-প্রমোদ ও বিলাস সামগ্রী ব্যবহারও সে বৈধ বলে ঘোষণা করেছিল।

তার দরবার জান্নাতের সাজে সজ্জিত ছিল। সুন্দরী-রূপসী তন্বী তার ডানে-বামে বসা ছিল। পিছনেও ছিল দু’জন দাঁড়িয়ে। মুসাইলামা কোন ললনার রেশমী চুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কারো নিটোল তুলতুলে রক্তাভ গালে হাত বুলিয়ে এবং কারো উরুতে হাত রেখে কথাবার্তা বলত।

এক ব্যক্তি দরবার কক্ষে প্রবেশ করে। সে না বসে দাঁড়িয়ে থাকে। সকলের দৃষ্টি তার দিকে ঘুরে যায়। মুসাইলামা তার দিকে তাকানোর আদৌ প্রয়োজন অনুভব করে না। তার জানা ছিল, কারো অনুরোধ ছাড়াই লোকটি বসে পড়বে। কিন্তু আগন্তুক দাঁড়িয়েই থাকে।

“তুমি আমাদের পাহারা দিতে এসেছ?” মুসাইলামা আগন্তুককে বলে, “নাকি আল্লাহর রাসূলের অনুমতি ব্যতিরেকে বসাকে তুমি অভদ্রতা মনে করছ।”

“আল্লাহর রাসূল!” আগন্তুক বলে—“আমি একটি খবর দিতে চাই।…মদীনা হতে একজন লোক এসেছে। সে অনেক দিন থেকে এখানে আছে। যারা ইতোপূর্বে কোন সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিল লোকটি তাদেরকে এ কথা বুঝতে চেষ্টা করছে যে, একমাত্র সত্য রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বাকী সমস্ত নবুওয়াতের দাবীদার ভণ্ড এবং মিথ্যুক। আমি নিজ কানে তার কথা শুনেছি। তার নাম নাহারুর রিযাল।”

“নাহারুর রিযাল?” দরবারে উপবিষ্ট দু’ব্যক্তি একযোগে চুমকে উঠে নামটি উচ্চারণ করে। অতঃপর একজন বলে—“সে মুসলমানদের রাসূলের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। আমি তাকে ভাল করে চিনি। লোকটি বড় বিদ্বান।

“এমন ব্যক্তিকে জীবিত রাখা ঠিক নয়”—দরবারে বসা এক ব্যক্তি গর্জে উঠে বলে।

“হে আল্লাহর রাসূল!” আরেক ব্যক্তি বসা থেকে দাড়িয়ে বলে—“আপনি অনুমতি দিলে তার মাথা কেটে এনে আপনার পায়ের কাছে রাখব।”

“না”—মুসাইলামা কাজ্জাব বলে—“সে আলেম হয়ে থাকলে এবং কুরআন সম্বন্ধে জ্ঞান রাখলে আমি তাকে দরবারে এসে আমাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে আহ্বান করব। আমি তাকে নিহত হতে দিব না।…কাল রাতে তাকে আমার কাছে আনবে। তাকে আমার পক্ষ হতে নিশ্চয়তা দিবে যে, তাকে আর যাই হোক হত্যা করা হবে না।”

আররিযালকে মুসাইলামার জনৈক ব্যক্তি জানায় যে, আল্লাহর রাসূল মুসাইলামা বিন হাবীব তার দরবারে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

“সে আমার হত্যার ব্যবস্থা এদিকে কোথাও করতে পারে না?” আররিযাল বলে—“আমি তাকে আল্লাহর রাসূল বিশ্বাস করি না। তার নির্দেশ পালন করা আমার পক্ষে জরুরী নয়।”

“সে যেখানে ইচ্ছা তোমাকে হত্যা করাতে পারে” মুসাইলামার দূত বলে—“তার এ শক্তিও রয়েছে যে, তার এক ফু-তে তোমার দেহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু তার ইচ্ছা তোমাকে হত্যা করা নয়; বরং জীবিত রাখা এবং সম্মানের সাথে বিদায় করা।”

মুসলমানরাও আররিযালকে মুসাইলামা কাজ্জাবের দরবারে না যাবার পরামর্শ দেয়।

“এটা আমার জীবন ও মৃত্যুর কোন প্রশ্ন নয়”—আররিযাল বলে—“এটা সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন। এক মিথ্যাবাদীর চোখের সামনে সত্যের পতাকা তুলে ধরতে আমার প্রাণ চলে গেলেও তা বেশী চড়া মূল্যের হবে না।”

“আমি অবশ্যই যাব”—আররিযাল দূতকে জানিয়ে দিয়ে বলে—“আজ রাতেই আসব। মুসাইলামাকে বলবে, সে সত্যবাদী হয়ে থাকলে যেন নিজ অঙ্গীকার থেকে পিছু না হটে।”

দুত মূসাইলামা কাজ্জাবকে সবকিছু জানায়। আররিযাল ইয়ামামাহ এর কেল্লাতেই থাকত। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা তাবারী রাহিমাহুল্লাহ লেখেন, মুসাইলামা তার বিশেষ মেহমানদের জন্য বড়ই চিত্তাকর্ষক তাবু স্থাপন করত। দূর থেকে এটাকে ঘর মনে হত। তাবুটি অভ্যন্তর থেকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে এবং রঙ-বেরঙের কাপড় দ্বারা সুসজ্জিত করা হত। মরুভূমির রাতে ঠাণ্ডা ঝরে পড়ত। এ কারণে তাঁবুতে দৃষ্টিনন্দন বহ্নিদানীও রাখা হত। এই বহ্নিদানীতে মুসাইলামা এমন কোন পদার্থ ছেড়ে দিত, যা একদিকে সুগন্ধির কাজ দিত অপরদিকে এ সুগন্ধিতে এমন মাদকতা মিশ্রিত ছিল যা তাঁবুতে শায়িত ব্যক্তিকে বাস্তবজগৎ থেকে কাল্পনিক জগতে নিয়ে যেত এবং তার স্বাভাবিক বাহ্যজ্ঞান ও অনুভূতি লুপ্ত করে তার মন-মানসিকতা নবচেতনা ও প্রভাব দ্বারা আচ্ছন্ন করে দিত। লোকটি বেহুঁশ কিংবা অবচেতন হত না ঠিকই কিন্তু স্বাভাবিক বোধশক্তি লুপ্ত হয়ে সে কাঠের পুতুলে পরিণত হত। তখন সে মুসাইলামার ইশারায় চলত। মুসাইলামাকে শিকার করতে এসে নিজেই তার শিকারে পরিণত হত। মুসাইলামা ছিল এক পাক্কা খেলোয়াড় ও শিকারী।

মুসাইলামা কাজ্জাব আররিযাল আসছে জেনে গতানুগতিক বিশেষ তাবু স্থাপনের নির্দেশ দেয়। পূর্বে যে পন্থায় তাঁবু সাজাত ঠিক সেভাবে সবকিছু সুসজ্জিত করে। বহ্নিদানীও সঠিক স্থানে রাখতে ভুলে না।

আররিযাল এলে মুসাইলামা এগিয়ে গিয়ে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়।

“একজন রাসূলের প্রেরিত ব্যক্তিত্ব আপনি”—মুসাইলামা তাকে বলে—“আর আমিও একজন রাসূল। ফলে আপনার সম্মান করা আমার কর্তব্য।”

“আমি কেবল তাকেই রাসূল বলে বিশ্বাস করি যিনি আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন আররিযাল বলে—“আর একথা বলতেও আমার বুক কাঁপবে না যে, তুমি একজন ভণ্ড ও মিথ্যুক বৈ নও।”

মুসাইলামা মুচকি হাসে এবং আররিযালকে সুসজ্জিত তাবুতে নিয়ে যায়।

ইতিহাস এ ব্যাপারে নিরুত্তর যে, তাঁবুর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মুসাইলামা এবং আর রিযালের মধ্যে কি আলোচনা হয়। কেমন সমঝোতা বা কোন ধরনের যাদু সে তার উপর চালায় যে, আররিযাল আগামী প্রভাতে তাবু থেকে যখন বের হয় তখন তার প্রথম মন্তব্য ছিল—“নিঃসন্দেহে মুসাইলামা আল্লাহর রাসূল। তার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়। সে একথাও বলে যে—“আমি মুহাম্মাদকেও একথা বলতে শুনেছি যে, মুসাইলামা সত্য নবী।”

আররিযাল একজন সাহাবী ছিলেন। ফলে মুসলমানরা তার কথায় সহজেই আস্থা স্থাপন করে। বনূ হানীফার সাথে আররিযালের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। আররিযালের নতুন ঘোষণা শুনে বনূ হানীফা দলে দলে মুসাইলামাকে আল্লাহ্‌র রাসূল বিশ্বাস করে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে থাকে।

ঐতিহাসিকদের অভিমত, মুসাইলামা এ কারণে আররিযালকে হত্যা করে না যে, আররিযাল যেমন প্রাজ্ঞ আলেম ছিল তেমনি সাহাবীও ছিল। ফলে তার ধারণা ছিল, এমন ব্যক্তিকে হত্যা না করে তাকে কব্জা করতে পারলে তার ভক্তকুলের সংখ্যা দারুণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে মুসাইলামা আররিযালকে হাত করতে বহ্নিদানী এবং জবানের যাদু চালায়। আররিযাল মুসাইলামার যাদুতে এমনভাবে ফেঁসে যায় যে, সে রীতিমত তার দক্ষিণ হস্তে পরিণত হয়। ভণ্ডামীর নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

আররিযালের সুবাদে মুসাইলামার মিথ্যা নবুওয়াতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়।

ভণ্ডামী নতুন গতি পায়। মুসাইলামার জনপ্রিয়তা একধাপ এগিয়ে যায়। ভণ্ডামীর ইতিহাস নতুন দিগন্তে মোড় নেয়। আররিযাল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে থাকাকালে দেখেন যে, পিতা-মাতা তাদের নবজাত সন্তানদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আনলে তিনি বাচ্চাদের মাথায় স্নেহভরে হাত বুলিয়ে দিতেন। আররিযাল মুসাইলামাকেও এভাবে বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলাতে পরামর্শ দেয়। আররিযালের এই পরামর্শ মূসাইলামার মনঃপুত হয়। সে কয়েকটি শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, শিশুকালে যাদের মাথায় মুসাইলামা হাত বুলিয়ে দেয় তারা বড় হলে তাদের মাথার চুল শীতকালের গাছের পাতার মত ঝরে যায়। চকচকে টাক পড়ে যায় সবার মাথায়। একটি চুলও সেখানে অবশিষ্ট ছিল না। মুসাইলামা ততদিনে মরে ভূত হয়ে গিয়েছিল।

আট

ইসলামের এ ক্রান্তিলগ্নে এক মহিলাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ময়দান উর্বর মনে করে সেও নবুওয়াতের দাবী করে। মহিলার নাম সায্‌যাহ। জনৈক হারেছের কন্যা। উম্মে সাদরাহ বলেও মহিলাটির পরিচিতি ছিল। তার মাতা ইরাকী এবং পিতা বনূ ইয়ারবু এর অন্তর্গত ছিল। হারেছ ছিল গোত্র প্রধান। সায্‌যাহ শৈশবকাল থেকেই নির্ভীক এবং স্বাধীনচেতা ছিল। নেতৃস্থানীয় বংশে তার জন্ম ও প্রতিপালন হওয়ায় অন্যদের উপর হুকুম চালানো তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবের অন্তর্গত ছিল। অস্বাভাবিক মেধা এবং বিচক্ষণ ছিল সে। দু’এক ঐতিহাসিকের মত হলো, সে অদৃশ্য জ্ঞানও রাখত এবং দূর ভবিষ্যতে কি ঘটবে না ঘটবে আগাম বলে দিতে পারত। তার ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন প্রসঙ্গে মতান্তর থাকলেও সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, সায্‌যাহ জন্মগতভাবে কবি ছিল। যে কোন কথা ছন্দবদ্ধ আকারে পেশ করতে পারত। তার জবান ছিল অতিশয় সুমিষ্ট এবং আকর্ষণীয়। তার মাতা খ্রিস্টান বংশের থাকায় সায্‌যাহও খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করে।

তোলাইহা এবং মুসাইলামা নবুওয়াতের দাবী করেছে শুনে এবং মানুষ দলে দলে তাদের হাতে বাইয়াত হচ্ছে জেনে সায্‌যাহও নবুওয়াতের দাবী করে। কৈশোর পেরিয়ে সে এখন টগবগে তরুণী। অন্যান্য গুণাবলীর সাথে আল্লাহ তাকে অপূর্ব সুন্দরীও করেছিল। তার আপাদমস্তক এবং চেহারায় এমন ঝলক ও দীপ্তি ছিল যে, মানুষ তাকে দেখে সম্মোহনীর মত তাকে নবী বলে মেনে নিত। অনেকে তার কাব্য প্রতিভা দেখেও মোহিত হয়।

সে নবী হয়েই কেবল বসে থাকে না। নিজ অনুসারী এবং ভক্তদের নিয়ে একটি ফৌজ তৈরী করে বনূ তামীমের কাছে যায়। এ গোত্রের নেতারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিযুক্ত ছিল। যাবারকান বিন বদর, কায়েস বিন ‘আসেম, ওকী ইবনে মালেক এবং মালিক বিন নাবীরা ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সায্‌যাহ মালিক বিন নাবীরাকে ডেকে বলে যে, সে মদীনা আক্রমণ করতে এসেছে। বনূ তামীমের সহযোগিতা তার একান্ত প্রয়োজন।

মালিক বিন নাবীরা জানায় যে, কয়েকটি গোত্র সায্‌যাহকে পছন্দ করে না। প্রথমে তাদেরকে অধীন করতে হবে। সায্‌যাহ অধীন করার অর্থ বুঝতে পারে না। তার অধীনে উল্লেখযোগ্য এবং বাছাইকরা সৈন্য ছিল। মালিক তার সৈন্যের সাথে নিজের সৈন্য মিলিয়ে দেয় এবং যারা তাকে সমর্থন করে না তাদের গোত্রে আক্রমণ করে। গোত্রগুলো এক এক করে তার সামনে হাতিয়ার সমর্পণ করে দেয়। সায্‌যাহ তাকে নবী বলে মেনে নেয়ার দাবী করার পরিবর্তে অস্ত্রসমর্পণকারীদের ঘর-বাড়িতে অবাধ লুটপাট চালায় এবং তাদের গবাদি পশু ছিনিয়ে নেয়। এই মালে গনিমত পেয়ে তার সৈন্যরা বেজায় খুশী হয়।

তার লুটপাটের খবর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সায্‌যাহ নাবায নামক এক এলাকায় পৌঁছে স্থানীয় বসতিতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যে বসতির লোকজন সুসংঘবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ায় এবং সায্‌যাহ বাহিনীকে পরাস্ত করে। সায্‌যাহ পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে চায় কিন্তু একটি দুর্বলতা তার ইচ্ছা রুখে দেয়। পরাজয়কালে তার কিছু নেতৃস্থানীয় সৈন্যকে নাবায গোত্রের লোকেরা বন্দীশালায় আটকে রেখেছিল। সায্‌যাহ তাদের মুক্ত করতে এক দূত প্রেরণ করে।

“আগে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও”, গোত্রের শীর্ষ নেতা দূতকে বলে— “এলাকা ছেড়ে গেলেই তোমাদের বন্দীদের মুক্ত দেখতে পাবে।”

সায্‌যাহ এ শর্ত মেনে নেয় এবং নেতৃস্থানীয় লোকদের মুক্ত করে ঐ এলাকা থেকে প্রস্থান করে। নেতারা সায্‌যাহ এর কাছে পরবর্তী গন্তব্য জানতে চায়।

ইয়ামামাহ”—সায্‌যাহ উত্তরে বলে—“সেখানে মুসাইলামা বিন হাবীব নামে একজন লোক আছে। সেও নবুওয়াতের দাবী করছে। তাকে তরবারীর মাথায় রাখা জরুরী।

“কিন্তু ইয়ামামাহ এর লোকজন যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে বড় পাকা”—এক নেতা সায্‌যাহকে বলে—“আর মুসাইলামাও বিরাট শক্তিধর।”

সায্‌যাহ নেতার কথায় কান না দিয়ে কিছু পংক্তি আওড়ায়। যাতে সে সৈন্যদের জানিয়ে দেয় যে, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইয়ামামাহ।

মুসাইলামা কাজ্জাবের গোয়েন্দা বহু দূর এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। চৌকস গোয়েন্দারা যথাসময়ে মুসাইলামাকে অবহিত করে যে, একটি বাহিনী ইয়ামামাহ অভিমুখে ছুটে আসছে। মুসাইলামা অতি শীঘ্র এ ধেয়ে আসা বাহিনীর পরিচয় উদ্ধার করে যে, তারা সায্‌যাহ এর লস্কর। সে আররিযালকে তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠায়।

“শুনেছ সায্‌যাহ এর লস্কর আসছে আররিযাল?” মুসাইলামা বলে—“কিন্তু তার সাথে সংঘর্ষে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। তোমার জানা আছে যে, এ এলাকায় মুসলিম বাহিনী আছে। হযরত ইকরামা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের সিপাহসালার। এ পরিকল্পনা কি যথার্থ নয় যে, সায্‌যাহ আর ইকরামা বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখী হোক। তারা যখন একে অপরের মুণ্ডুপাতে তৎপর হবে ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি আমার বাহিনী নিয়ে উভয় পক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব এবং চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হবে আমাদের।”

“তারা পরস্পরে মুখোমুখী না হলে তখন কি করবেন?” আররিযাল জিজ্ঞাসা করে।

“তখন সায্‌যাহ এর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিব”—মুসাইলামা নিরুদ্বেগে জবাব দেয়।

আররিযালের ধারণাই সঠিক হয়ে সামনে আসে। সায্‌যাহ আর ইকরামার ফৌজ পরস্পরের ব্যাপারে অনবহিত ছিল। এদিকে সায্‌যাহ আসতে আসতে ইয়ামামাহ এর কাছে চলে আসে প্রায়। মুসাইলামা এক দূত মারফৎ সায্‌যাহ এর বরাবর এই বার্তা প্রেরণ করে যে, পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সে যেন মুসাইলামার বাসভবনে আসে। সায্‌যাহ দূতকে জানায় যে, সে অচিরেই আসছে। সায্‌যাহ রওয়ানা হতেই মুসাইলামা শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জানতে পারে যে, সে স্বসৈন্যে আসছে। মুসাইলামা তৎক্ষণাৎ সায্‌যাহ-এর কাছে এ বার্তা প্রেরণ করে যে, সৈন্যদের সাথে নিয়ে এলে বুঝব তুমি মৈত্রী চুক্তির নিয়তে আসছ না। ঊর্ধ্বে কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী আনতে পার মাত্র।

“সম্মানিত রাসূল!” মুসাইলামার এক সভাষদ তাকে বলে—“শুনেছি সায্‌যাহ এর সৈন্য এত বিশাল যে, তারা ইচ্ছা করলে ইয়ামামাহর একেকটি ইট খুলে ফেলতে পারে।”

“এটাও শুনেছি, আরেক সভাষদ বলে—“যে, সে হত্যা, ত্রাস এবং লুটতরাজ করতে করতে সামনে অগ্রসর হয়। তার করাল গ্রাস থেকে সেই নিরাপদ থাকে যে তার নবুওয়াত মেনে নেয়।”

“তোমরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?” মুসাইলামা জিজ্ঞাসা করে—“তোমাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য কি আমাকে এই পরামর্শ দেয়া যে, নবুওয়াতের দাবী হতে সরে এসে আমি যেন তার নবুওয়াত স্বীকার করে নিই?”

“না, আল্লাহর রাসূল!” সভাষদের আসন থেকে জওয়াব আসে—“আমরা সতর্কতার কথা বলছি মাত্র। আমাদের অজান্তে সে যেন কোন অঘটন না ঘটিয়ে বসে।”

মুসাইলামা সভাষদের এ কথায় ফিক করে হেসে উঠে বলে—“আমার কদাকার চেহারা দেখে সম্ভবত তোমরা আমাকে এই পরামর্শ দিচ্ছ। এমন কোন নারীর কথা বলতে পার যে আমার কাছে এসেছে অথচ আমার ভক্ত হয়ে যায়নি?…সায্‌যাহকে আসতে দাও। সে আসবে কিন্তু যাবার নাম বলবে না এবং জীবিতও থাকবে।”

সায্‌যাহ সৈন্য ছাড়াই এসে পড়ে। ইয়ামামাহ্‌র জনতা তাকে এক নজর দেখে অভিভূত হয়ে যায় এবং চতুর্দিক হতে আওয়াজ ওঠে—“এত রূপসী এবং লাবণ্যময় নারী ইতোপূর্বে কখনো দেখিনি।…সৌন্দর্যের ভিত্তিতে নবুওয়াত পাওয়ার হলে এ নারী তার যথার্থ উপযুক্ত।”

সায্‌যাহ-এর সাথে চল্লিশজন দেহরক্ষী ছিল। সকলেই আরবি উন্নত জাতের তাজি ঘোড়ায় আসীন। সবাই সুদর্শন এবং টগবগে। কোমরে তরবারী ঝুলছিল সবার। হাতে শোভা পাচ্ছিল চকচকে বর্শা।

সায্‌যাহ কেল্লার প্রধান ফটকে পৌঁছলে দরজা বন্ধ ছিল। তাকে দেখেও কেউ দরজা খুলে না।

“মেহমানকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে যে ব্যক্তি সে কিভাবে আল্লাহর রাসূল হতে পারে?” সায্‌যাহ জোরকণ্ঠে বলে—“তার কি জানা নাই যে, এভাবে সে স্পষ্ট ঐ নারীকে অপমান করছে আল্লাহ্ যাকে নবুওয়াত দান করেছেন?”

“সম্মানিত অতিথিনী!” কেল্লার উপর থেকে একটি কণ্ঠ শোনা যায়—“আপনি সুখী ও দীর্ঘজীবি হউন। আমাদের রাসূল নিরাপত্তা রক্ষীদের বাইরে থাকতে এবং মেহমানদের ভেতরে যেতে বলেছেন।”

“দরজা খুলে দাও”—সায্‌যাহ নির্ভীকচিত্তে নির্দেশ দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের বলে—“তোমরা কেল্লা হতে অনেক দূরে চলে যাও।”

“কিন্তু এক অজানা ব্যক্তির উপর আমরা কিভাবে আস্থা রাখতে পারি?”—নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান বলে।

“সূর্যাস্ত নাগাদ আমি না ফিরলে এই কেল্লাকে ছাতু বানিয়ে ফেলবে”— সায্‌যাহ বলে—“নগরের একটি বাচ্চাকেও জ্যান্ত রাখবে না। মুসাইলামা এবং তার পরিবারবর্গের তাজা রক্তে আমার লাশ স্নাত করে এখানে কোথাও সমাহিত করবে।…তবে আমার বিশ্বাস, আমি কেল্লা হতে বিজয়িনীর বেশে বের হব।”

নিরাপত্তা রক্ষীরা চলে গেলে কেল্লার মুখ খুলে যায়। কিন্তু সায্‌যাহ এর অভ্যর্থনার জন্য সেখানে মুসাইলামা ছিল না। তার নির্দেশে দরজায় দাঁড়ানো দুই ঘোড় সওয়ার তাকে কেল্লার আঙ্গিনায় নিয়ে যায়। সেখানে বৃত্তকার একটি তাবু স্থাপিত ছিল। তার আশে-পাশে বড় বড় এবং চারাগাছ ছিল। নিচে ছিল সতেজ শ্যামলিমা ঘাস। সায্‌যাহকে তাঁবুতে আসন গ্রহণ করতে বলা হয়। অভ্যন্তরের সাজ-সজ্জা তাকে অভিভূত করে দেয়। তবে মুসাইলামা সেখানে ছিল না। সায্‌যাহ তাঁবুতে বসে পড়ে।

ক্ষাণিক পর মুসাইলামা তাঁবুতে প্রবেশ করে। সায্‌যাহ তাকে দেখে মুচকি হাসে। সে হাসিতে বিদ্রুপ মাখানো ছিল। মুসাইলামার মত কুৎসিত চেহারার মানুষ ইতোপূর্বে তার নজরে পড়েনি। এমন খর্বাকৃতির মানুষ কালে-ভদ্রে নজরে পড়ে থাকে।

“আপনি নবুওয়াতের দাবী করেছেন?”—সায্‌যাহ তাকে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে।

“দাবীর বিষয়টি ভিন্ন প্রসঙ্গ!”—মুসাইলামা সায্‌যাহ এর চোখে চোখ রেখে বলে—“তবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমি আল্লাহ্‌র প্রেরীত রাসূল। মুহাম্মাদকে আমি রাসূল বলে স্বীকার করি না। কিন্তু সে কৌশলে তার নবুওয়াত সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। জনতা তাকে এই জন্য রাসূল মানে যে, কুরাইশদের সংখ্যা বেশী এবং তাদের শক্তিও প্রচুর। তারা এখন অন্যান্য এলাকা অধিকার করতে শুরু করেছে।”

ঐতিহাসিক তাবারী কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে লেখেন, মুসাইলামা সায্‌যাহ-এর চোখে নিজের চোখাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ঠোঁটে নাচতে থাকে হৃদয়কাড়া মুচকি হাসি। অনেক দিন পর সায্‌যাহ মুসাইলামার ঐ দৃষ্টিপাতের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে খোলামেলা ভাষায় স্বীকার করে যে, মুসাইলামা তার ক্ষুদ্রাকৃতি চোখ আমার চোখে রাখলে আমার মনে হতে থাকে খর্বাকৃতির কোন ছায়া এবং কুৎসিত একটি চেহারা তরল পদার্থ হয়ে চোখের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ক্রমে নেমে আসছে। তার এই অদ্ভুত ও অর্থপূর্ণ চাহনী আমাকে নিশ্চিত করে এ লোক আমাকে হত্যা করবে না। আরো কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে আমার মনে হচ্ছিল নিজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে হয়ত এখনই আমি তার মাঝে বিলীন হয়ে যাব।

“আপনি নবী হয়ে থাকলে কোন ঐশী কথা বলুন”—সায্‌যাহ তাকে বলে।

“আপনার জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আপনি কখনো ভেবেছেন?” মুসাইলামা কবিতা আওড়ানোর ভঙ্গিতে বলে—“আপনি সম্ভবত এটাও ভাবেননি যে, আপনি যেভাবে সৃষ্টি হয়েছেন আপনার থেকেও এভাবে অনেকে সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আপনার একার পক্ষে তা সম্ভব নয়…। এ তথ্য আমার প্রভুই আমাকে জানিয়েছেন। মুসাইলামা তাকে কুরআনের আয়াতের মত কিছু শব্দ শোনায়।—“তিনি এক জীবিত সত্তা থেকে আরেক জীবন সৃষ্টি করেন। পেট থেকে, নাড়িভুড়ি থেকে। আল্লাহু তা’আলা আমাকে আরো জানিয়েছেন, নারীরা পাত্রের মত। যাতে কোনকিছু রেখে আবার বের করা হয়। এমনটি না হলে সে পাত্র অনর্থক।”

সায্‌যাহ অভিভূত হতে থাকে। সে সম্মোহনীর মত তার কথা গিলতে থাকে। মুসাইলামা কবির ভাষা-ভঙ্গিমায় কথা চালিয়ে যায়। সায্‌যাহ ঘুণাক্ষরেও টের পায় না যে, মুসাইলামা তার আবেগ চাঙ্গা ও উজ্জিবীত করে চলেছে। সে তার কথায় এত তন্ময় হয়ে যায় যে, কখন যে সূর্য ডুবে গেছে তার খেয়ালই করেনি।

“আমার বিশ্বাস, আপনি আজকের রাতটি এখানে থেকে যেতে চাইবেন”— মুসাইলামা বলে—“চেহারার বিচারে নিঃসন্দেহে আপনি দিন আর আমি রাত। কিন্তু ভাবা উচিত, দিনের উপর রাতের প্রাধান্য পাওয়ার কারণ কি? দিন তার বুকের ধন সূর্যকে রাতের কোলে কেন ছেড়ে দেয়। এটা প্রতিদিনের চিত্র। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ক্ষণ-সময় রয়েছে। রাতের এ শক্তি নেই যে, সে সূর্যের ঔজ্জ্বলতা আর দীপ্তিকে হজম করে ফেলবে। রাতের কোলে ঘুমিয়ে পড়া সূর্যকে বড় আদর করে জাগিয়ে সে পর প্রভাতের জন্য পূর্বাচলে রেখে আসে। যেন ঠিক সময়ে উঠে দিনের যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে।”

“ঠিক বলেছেন আপনি”—সায্‌যাহ অভিভূতের মত বলে—“আমার অন্তর চায়, আমি আপনাকে সত্য নবী মেনে নিই। এত কদাকার পুরুষ কখনো এমন সুন্দর ও বাস্তবসম্মত কথা বলতে পারে না। এটা অদৃশ্য কোন শক্তির কারবারই হবে, যে আপনার মুখ থেকে এমন সুন্দর কথা বলাচ্ছে। হঠাৎ সে চমকে উঠে বলে—“সূর্য অস্ত গেছে। এখন আমি কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আমার নিরাপত্তা বাহিনীকে যদি না জানাই যে, আমি জীবিত আছি তাহলে তারা এ বসতির অলি-গলিতে রক্তের নদী বইয়ে দিবে।”

মুসাইলামা দু’বডিগার্ড দিয়ে তাকে কেল্লার প্রাচীরে পাঠিয়ে দেয় এবং তাঁবুর বহ্নিদানী জালিয়ে দিতে খাদেমদের নির্দেশ দেয়। রঙিন ঝাড়বাতিও জ্বলে উঠে। অপরূপ আলোর ঝলকে হেসে ওঠে পুরো তাবু। তাঁবুর গাম্ভীর্য ও আকর্ষণশক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। যে কোন চোখ ধাধানো এবং হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টির জন্য তাবুটি ছিল একশভাগ সার্থক। সায্‌যাহ এর আবেগকে আরো উত্তাল এবং তাকে আরো প্রভাবিত করতে মুসাইলামা বহ্নিদানীতে ক্ষুদ্রাকৃতির কি যেন দেয়।

ক্ষণিকের মধ্যে কামরা মাতাল করা ঘ্রাণে মৌ মৌ করে ওঠে। সারা কক্ষ খুশবুতে ছাপিয়ে যায়।

সায্‌যাহ তাঁবুতে ফিরে এলে এক অবর্ণনীয় মাদকতায় তার মন মানসিকতা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে নিজ অবস্থান ভুলে সাধারণ নারীর মত আবেদনপূর্ণ কথা বলতে থাকে। তার কণ্ঠে আগের সেই দৃঢ়তা ছিল না। সেখান থেকে এখন অনুনয় ঝরে পড়ছিল। মুসাইলামা এই অবস্থা থেকে পূর্ণ ফায়দা উঠায়।

“আমাদের স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাওয়াই কি ভাল হয় না?” মুসাইলামা সায্‌যাহ এর চোখে আরেকবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে জিজ্ঞাসা করে।

“এর থেকে উত্তম প্রস্তাব আর হতে পারে না”—সায্‌যাহ বিমোহিত কণ্ঠে উত্তর দেয়।

পর প্রভাতে যখন সায্‌যাহ বের হয় তখন মনে হচ্ছিল কনে তার পছন্দের স্বামীর সাথে বাসর রাত উদযাপন করে বের হচ্ছে। সারা কেল্লায় বিয়ের শানাই বাজে। সায্‌যাহ এর বাহিনী এক সময় খবর পায় যে, সায্‌যাহ মুসাইলামার সাথে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে।

এই বিবাহ ইসলামের জন্য বিপদজনক হয়ে ওঠে। উভয় ফৌজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই ঐক্য বেশিদিন স্থায়ী থাকে না। জলদি ভেঙ্গে যায়। কারণ, মুসাইলামা সায্‌যাহ এর সাথে চরম প্রতারণা করে। ফলে সে ভগ্নহৃদয়ে পিত্রালয় এলাকা ইরাক চলে যায়। সায্‌যাহকে বিবাহ করা ছিল মুসাইলামার এক কূটনৈতিক চাল। সে শক্তিক্ষয়ের পরিবর্তে সায্‌যাহ এর হৃদয়জয়ের মাধ্যমে এক নিশ্চিত বিপদের মূলোৎপাটন করে। সায্‌যাহ মুসাইলামার কপট আচরণে মনে এত আঘাত পায় যে, নবুওয়াতের দাবী থেকেই সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। পরে সে মুসলমান হয়ে কুফায় চলে গিয়েছিল। সে দীর্ঘ জীবন লাভ করে এবং খোদাভীরু ও বিদূষী মহিলা হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে।

নয়

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালে চতুর্দিকে বিদ্রোহ এবং চুক্তিলঙ্ঘনের প্রাদুর্ভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তুফানের গতিতে এসব ফিত্না মদীনাপানে ধেয়ে আসতে থাকে। একটি তুফান সাহাবায়ে কেরামের মধ্য হতেই ওঠে। প্রথম খলীফা নির্বাচনের জটিল পথ চেয়ে এ তুফানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। খেলাফতের দাবীদাররা নিজেদের সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ খাড়া করে ইসলামের উপর তাদের অবদান তুলে ধরে। খেলাফতের দাবীতে মুহাজির এবং আনসাররা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সামনে আসে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। সমস্যা জটিল ও গুরুতর পথে মোড় নিলে প্রথম সারির প্রবীণ সাহাবায়ে কেরাম দ্রুত সমস্যা নিরসনে উদ্যোগী হন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু অনেক তর্ক-বিতর্কের পর হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ন্যস্ত করে বলেন, তারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যাকে প্রথম খলিফা নির্বাচন করেন, সবাই যেন তাকে মেনে নেয়।

“মুহাজিরদের মধ্যে আপনি সর্বোত্তম”—হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু পরস্পর আলোচনা শেষে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রথম খলীফা মনোনীত করে বলেন—“নবীজীর হিজরতের সঙ্গী আপনি। গুহায় আপনিই ছিলেন তার সাথে। রাসূলের অসুস্থকালীন সময়ে আপনিই তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে নামায পড়িয়েছেন। দ্বীনি আহকামের মাঝে নামাযের স্থান সর্বোর্ধ্বে। আমরা আপনার থেকে অধিক মর্যাদাবান আর কাউকে দেখি না। নিঃসন্দেহে আপনিই খেলাফতের সবচে উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব।”

একথা বলেই হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত বাড়িয়ে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এরপরে হযরত আবু উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু, তারপর হযরত বশীর বিন সা‘দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাইয়াত হন। এরপর সর্বসাধারণ্যে প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নাম ঘোষণা করা হলে মানুষ দলে দলে তার হাতে বাইয়াত হওয়ার জন্য ছুটে আসে। মসজিদে নববীতে চলে সাধারণ বাইয়াত অনুষ্ঠান। খেলাফত লাভ করে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এক জনগুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে ইসলামের সর্বপ্রথম খলীফা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন :

প্রিয়, দেশবাসী! আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, খেলাফতের পদে আসীন হওয়ার আগ্রহ আমার কখনো ছিল না। অন্তরে অন্তরে কিংবা প্রকাশ্যে এর জন্য কখনো আল্লাহর কাছে দু’আ করিনি। কিন্তু শুধু এ কারণে এ গুরুভার নিজ দুর্বল কাঁধে বহন করেছি যেন মতবিরোধ বিবাদের রূপ পরিগ্রহ না করে। নতুবা এটাই বাস্তব কথা যে, খেলাফত এবং শাসনকার্য উপভোগ করার মত কোন বিষয় নয়। এটা এমন এক ভারী বোঝা যা বহন করার শক্তি আমার কম। আল্লাহ পাকের সাহায্য ছাড়া এ বোঝা বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনারা আমাকে আমীর বানিয়েছেন। আমি আপনাদের থেকে উত্তম এবং মর্যাদাবান নই। কোন ভাল ও জনহিতকর কাজের উদ্যোগ নিলে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। পক্ষান্তরে কোন অন্যায় ও জনক্ষতিকর পদক্ষেপ নিলে আমাকে বাঁধা দিবেন। যারা অসহায়-নিঃস্ব তাদের ন্যায্য পাওনা আমি পূর্ণমাত্রায় আদায় করব। তাদের অসহায়ত্ব ঘুচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে। পক্ষান্তরে যারা সচ্ছল তারা ন্যায্য হক ছাড়া কিছু পাবে না। আমি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চললে আপনারা আমাকে মেনে চলবেন। কখনো বিপথগামী হলে আমাকে বর্জন করবেন।”

হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু খলীফা হয়ে সর্বপ্রথম যে নির্দেশ জারী করেন, তাতে সবাই চমকে ওঠে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে, হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী অচিরেই রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে। কারণ, মদীনার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। আশে-পাশে শত্রুরা কিলবিল করছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালে সকলের ডানা গজিয়েছিল। আর সে ডানায় ভর করে শত্রুরা উড়াল দিয়ে ইসলামের সাজানো বাগান লণ্ডভণ্ড ও তছনছ করে দিতে উন্মুখ ছিল। অপরদিকে রোমীয়দের সাথে যুদ্ধ ছিল এক বিরাট ও ঘোরতর যুদ্ধ। এরজন্য মুসলমানদের পূর্ণ শক্তি একত্রীকরণ ও বিপুল সমরায়োজনের প্রয়োজন ছিল। মুসলমানদের যথেষ্ট সমর শক্তি ছিল। ছিল সুসংঘটিত এবং দৃঢ়চেতা বিশাল এক বাহিনী। রোমীয়দের সাথে যুদ্ধের সম্ভাব্য রণাঙ্গন ছিল মদীনা হতে যোজন মাইল দূর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সমুদয় সৈন্য এত দূরে পাঠানো ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ মদীনার অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না। অনেক গোত্র বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে অনেকে সংঘটিতও হতে শুরু করে। ইহুদি-খ্রিস্টানরা অপতৎপরতায় আদাজল খেয়ে নামে। এ ছাড়া মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদাররা পৃথক পৃথক রণক্ষেত্র খুলেছিল। তোলাইহা বিশেষত মুসাইলামা কাজ্জাব রীতিমত এক উদ্বেগজনক সমরশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। মোটকথা ইসলাম স্মরণকালের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।

হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অবাক করা এ আকস্মিক নির্দেশের পটভূমি এই ছিল যে, তাবুক এবং মুতা যুদ্ধের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা জরুরী মনে করেন যে, রোমীয়দের প্রতি এখনই হামলা চালিয়ে তাদের শক্তিও নিঃশেষ করে দেয়া উচিত। ইতোপূর্বে তাবুক এবং মুতা যুদ্ধ এই সুফল বয়ে এনেছিল যে, এর মাধ্যমে ঐ সমস্ত গোত্র অনুগত হয়ে যায়, যাদের ব্যাপারে আশঙ্কা ছিল যে, তারা রোমীয়দের সাথে হাত মিলাবে। আর এভাবে একটি শক্তিশালী মুসলিম বিরোধী যুদ্ধফ্রন্ট খুলে যাবে। রোমীয়দের সম্ভাব্য সহযোগী শক্তি চূর্ণের পর এবার প্রয়োজন ছিল খোদ রোমীয়দের উত্থিত ফনা পিষ্ট করা ও বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাহসী সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা ছিল না, বরং অস্তিত্ব ও মতাদর্শ রক্ষাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ইসলামের বিরোধিতায় রোমীয়দের ক্যাম্পে গিয়ে আস্তানা গেড়েছিল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে রোমীয়দের উপর হামলার উপযোগী মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। হযরত যায়েদ বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এ বাহিনীর সিপাহসালার নিযুক্ত হন। তার বয়স তখন সর্বোচ্চ হলে কুড়ি বছর ছিল। ঐতিহাসিকদের অভিমত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি তারুণ্যের মাঝে নেতৃত্ববোধ ও উৎসাহব্যঞ্জক প্রেরণা সৃষ্টি করতে চান। মুসলিম তারুণ্য শক্তি উসামা চেতনায় উজ্জীবিত ও তার মত যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন করে রণাঙ্গনে সফল নেতৃত্ব দিতে অনুপ্রাণিত হবে—এই দৃষ্টিকোণকে সামনে রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তিম মুহূর্তে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলে টগবগে তরুণ হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে তার নেতৃত্ব সোপর্দ করেন।

হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি তাকে অত্যন্ত স্নেহ ও আদর করতেন। তাঁর পিতা হযরত যায়েদ বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু মুতা যুদ্ধে শহীদ হন। শৈশবকালেই হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাঝে সৈনিকসুলভ সকল গুণাগুণ এবং বীরত্ব এসে গিয়েছিল। ওহুদ যুদ্ধের সময় তিনি ছোট থাকায় এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। সেনাবাহিনী রওয়ানা হওয়ার পূর্বেই তিনি রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে কোথাও আত্মগোপন করে থাকেন। সেনাবাহিনী সে স্থান দিয়ে গমন করলে তিনি চুপিসারে সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে তাদের সাথে মিশে যান। তার উদ্দেশ্য ছিল যে কোন পন্থা ও মূল্যে যুদ্ধে শরীক হওয়া। কিন্তু তার এই অদম্য স্পৃহা পূরণ হয় না। ময়দানে পৌঁছে তিনি নজরে পড়ে যান। ফলে তাকে সেখান থেকেই ফেরৎ পাঠানো হয়। অবশ্য হুনায়ন যুদ্ধে তিনি দুঃসাহসিক বীরত্ব প্রদর্শন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। হার না মানা যুদ্ধ ইনিংস খেলে তিনি সকলকে দেখিয়ে দেন যে, বাহাদুরী কাকে বলে। এক তরুণ যোদ্ধা কিভাবে বজ্র হয়ে শত্রু শিবির মুহূর্তে তছনছ করে দিতে পারে।

রোমীয়দের মোকাবিলায় বিশাল বাহিনী গড়ে তুলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেতৃত্বভার হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাঁধে অর্পণ করলে কিছু লোক এই আপত্তি উত্থাপন করে যে, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত শীর্ষ মর্যাদাবান এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব যে বাহিনীতে বিদ্যমান তার নেতৃত্ব সেদিনের এক বাচ্চার হাতে অর্পণ করা মোটেও সমীচীন নয়।

মানুষের এই সমালোচনা ও অভিযোগ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কানে ঐ সময় পৌঁছে যখন তিনি মৃত্যুপীড়ায় শায়িত এবং বারবার জ্বরে মূর্ছা যাচ্ছেন। এ সময় তাঁর কথা বলার শক্তিও ছিল না। জ্বরের উপশমের জন্য তিনি স্ত্রীদেরকে গোসল করিয়ে দিতে বলেন। প্রচুর পানি দিয়ে তাকে গোসল দেয়া হলে জ্বর অনেকটা নেমে যায়। অবশ্য দুর্বলতা ছিল বেশ। তারপরেও তিনি মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানে বহু লোক সমবেত ছিল। সমালোচনাকারী এবং অভিযোগ আরোপকারীরাও সেখানে উপস্থিত ছিল।

“প্রিয় জনতা!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনতার উদ্দেশ্যে বলেন—“উসামা বাহিনীকে নির্বিবাদে যেতে দাও। তার নেতৃত্বের কারণে তোমরা সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছ। ইতোপূর্বে তার পিতার উপরেও তোমরা অভিযোগ উত্থাপন করেছিলে। আমি উসামাকে এই পদের যোগ্য মনে করি। তাঁর পিতাকেও এ পদের যোগ্য মনে করেছিলাম। তোমাদের ভাল করেই জানা আছে যে, তাকে সেনাপতি বানানো আমার ভুল পদক্ষেপ ছিল না।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষণে সমালোচনা মুখ থুবড়ে পড়ে। সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই নেতা মেনে নিয়ে রোমীয়দের উদ্দেশে উসামা বাহিনী রওনা হয়ে যায়। কিন্তু এ বাহিনী যারফ নামক স্থানে পৌঁছলে সংবাদ আসে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থা অত্যন্ত আশংকাজনক। যুবক বয়সেই হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মধ্যে বড়দের মত দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণতাগুণ সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি যারফে বাহিনী থামিয়ে নিজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে মদীনায় আসেন। এক পত্রে হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সে অবস্থার বিবরণ নিম্নরূপ পাওয়া যায় :

সংবাদ আসে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও সংকটাপন্ন। খবর পেয়েই আমি কয়েকজন সাথী নিয়ে মদীনায় আসি। আমরা সোজা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাসভবনে গিয়ে উপস্থিত হই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। মুখ ফুটে কথাও বলতে পারছিলেন না। তিনি এ অবস্থার মাঝেও হাত দু’তিন বার আকাশ পানে উঁচিয়ে আমার দিকে তাক করেন। বুঝতে পারি তিনি আমার জন্য দুআ করছেন।”

পরের দিন হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাসভবনে যান এবং তাকে বলেন—“হে আল্লাহ্‌র রাসূল। সৈন্য যারফে আমার অপেক্ষার্থী। যাবার অনুমতি প্রার্থনা করছি।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত উপরে উঠান। কিন্তু বেশী উঠাতে পারেন না। দুর্বলতা সীমাহীন বৃদ্ধি পায়। হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ভারাক্রান্ত হৃদয় আর অশ্রুসজল চোখে রওয়ানা হয়ে যান। এর একটু পরেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। হযরত উসামার উদ্দেশ্যে দূত ছুটে যায়। যারফে পৌঁছানোর পূর্বেই দূত হযরত উসামাকে পেয়ে যায়। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের খবর শুনেই দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এবং সৈন্যদের কাছে গিয়ে পৌঁছান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের খবর শুনে সৈন্যদের মাঝে বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে। সবার চোখে-মুখে বেদনার কালো পর্দা পড়ে। চোখ ছাপিয়ে যায় অশ্রুর বন্যায়। বেদনার ছুড়ি গিয়ে বিঁধে হৃদপিণ্ডে। স্বজনের বিয়োগে মুখ হয়ে যায় মূক।

স্বাভাবিক অনুভূতি লোপ পায়। নিস্তেজ-নিঃসাড় হয়ে যায় হস্তপদ। ধমনীতে রক্তের প্রবাহ থমকে দাঁড়ায়। সহসা নীরব হয়ে যায় সরব মুখগুলো। বুকফাটা আর্তনাদ সংযত করে ঠোঁট কামড়ে বজ্রাঘাত সহ্য করতে পারে না অনেকে। ভূতলে লুটিয়ে পড়ে মূর্ছা খেয়ে। কিছুক্ষণের জন্য পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে যারফে। সবাই সোকাহত। সান্ত্বনার ভাষা কেউ খুঁজে পায় না। সেনাপতি নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাটির দিকে তাকিয়ে তিনি শোক লাঘব ও অশ্রু লুকাবার বৃথা চেষ্টা করেন। শোক সাগরে ভাসমান থাকে সৈন্যরা কিছুক্ষণ। সেনাপতি আস্তে আস্তে পরিস্থিতি সামলে নেন। শোক সন্তপ্ত সৈন্যদের সান্ত্বনা দেন। সৈন্যদের হতাশা কিছুটা লাঘব হলে তিনি সেনাবাহিনী মদীনায় ফিরিয়ে আনেন। যুদ্ধযাত্রা স্থগিত হয়ে যায়।

বাইয়াত পর্ব শেষ। প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অভিষেক হলো কিছুক্ষণ মাত্র আগে। অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতেই হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে জানতে চান যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কি নির্দেশ দিয়েছিলেন।

“নির্দেশ সম্বন্ধে আপনিও সম্যক অবহিত” হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বিনয়ের সাথে জবাব দেন—“তারপরেও আমার মুখ থেকে শুনতে চাইলে আমি বলছি শুনুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফিলিস্তিনে বালকা এবং দাওয়াম সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আরো সামনে অগ্রসর হয়ে রোমীয়দের উপর আক্রমণ করতে। আর এ স্থান পর্যন্ত সৈন্য এমনভাবে নিয়ে যেতে হবে যেন আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত শত্রুপক্ষ টের না পায়।”

“রওয়ানা কর উসামা!” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“তোমার বাহিনী নিয়ে এখনি যাত্রা কর এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তিম ইচ্ছা পূরণ কর।

নাজুক মুহূর্তে যুদ্ধযাত্রার নির্দেশ দিলে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন। প্রায় সকলেই বলতে থাকে, যখন চতুর্দিক হতে বিপদের ঘনঘটা ও পদধ্বনি উঠছে ঠিক সেই মুহূর্তে এত বিরাট যুদ্ধের উদ্যোগ নেয়া তাও আবার মদীনা হতে শত-সহস্র ক্রোশ দূরে—মোটেও সমীচীন নয়। মদীনা অভিমুখে যে সমস্ত ফেৎনা ধেয়ে আসছে তা মোকাবিলার জন্য এ বাহিনীর এখানেই থাকা জরুরী।

“ঐ সত্তার কসম, যার কুদরতী হাতে আমার জীবন!”—হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “বনের হিংস্র জন্তুরাও যদি আমাকে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে খেতে আসে তবুও আমি উসামার বাহিনীকে যাত্রা বন্ধের নির্দেশ দিব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তিম মুহূর্তে যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন তার বিরুদ্ধাচরণ আমি কিছুতেই করতে পারি না। এ বাহিনী পাঠাতে যদি মদীনায় আমাকে একাও থাকতে হয় তবুও আমি তাতে পিছপা হব না।”

“আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“অভিযোগকারীরা এ কথাও বলছে যে, সৈন্য যদি একান্তই পাঠাতে হয় তবে হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিবর্তে অন্য কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হোক।”

“শোন ইবনে খাত্তাব!” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন—“তোমার কি মনে নেই স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে সেনানায়ক বানিয়েছেন। আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ উপেক্ষা করার দুঃসাহস তোমার হবে কি?”

“এমন দুঃসাহস আমি কস্মিনকালেও করব না।”—হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আমার বুকের পাঠায় এত সাহস নেই।”

“আমার কথা শোন ইবনে খাত্তাব!” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন— “জাতির অবস্থার দিকে তাকাও। সমগ্র জাতি শোকাহত, বেদনাবিধূর। শোকের সাথে সাথে একটি ভীতি সকলের অন্তরে আচ্ছন্ন হতে চলেছে। এটা বিদ্রোহভীতি, যা চতুর্দিক হতে উত্থিত হচ্ছে। প্রতিদিনের শিরোনাম, অমুক গোত্র বিদ্রোহী হয়ে গেছে। অমুক গোত্র ইসলাম থেকে সরে এসেছে। ইসলাম সংকট ও ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মদীনাও অরক্ষিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ইহুদি-খ্রিস্টানরা বিপদজনক গুজব ছড়াতে শুরু করেছে। এতে ভীতি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ মুহূর্তে রোমীয়দের উপর আক্রমণ স্থগিত করলে দ্বিবিধ ক্ষতি রয়েছে। জনতার মাঝে এ ধারণা সৃষ্টি হবে যে, আমরা দুর্বল হয়ে পড়েছি। দ্বিতীয় ক্ষতি হলো, আমাদেরকে দুর্বল প্রতিপন্ন করে রোমী এবং অগ্নি উপাসকরা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি জনতাকে দেখাতে চাই যে, আমরা দুর্বল হয়ে যাইনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পুণ্যাত্মা এবং দু’আ আমাদের সাথে আছে। আল্লাহ আমাদের সর্বাত্মক সাহায্যকারী। আমি জাতির উদ্দীপনা ও প্রেরণা পূর্বের মত দৃঢ় রাখতে চাই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করে চলা আমার জন্য ফরয।”

সৈন্য প্রেরণের সপক্ষে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর যুক্তিশীল ও নীতিপূর্ণ বক্তব্য হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শান্ত, নিশ্চিত ও আস্থাশীল করে। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কালক্ষেপণ না করে সৈন্যদের মার্চ করে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।

হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী রওয়ানা হলে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কিছু দূর পর্যন্ত তাদের সাথে সাথে যান। সেন্যাধ্যক্ষ হওয়ায় হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের সাথে ঘোড়ায় সমাসীন ছিলেন। ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা, এক তরুণ সিপাহসালার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ছিলেন আর ইসলামের খলীফা তার পাশে পাশে পায়ে হেঁটে চলছিলেন। এভাবে খলীফা জনতাকে দেখাতে চান যে, হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বয়সে তরুণ হলেও তিনি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার যোগ্য।

‘সম্মানিত খলীফা!” হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বিনীতকণ্ঠে বলেন—“আপনিও ঘোড়ায় আরোহণ করুন নতুবা আমাকে নেমে এসে আপনার সাথে পায়ে হেঁটে চলার অনুমতি দিন।”

“আমি সওয়ার হব না এবং তুমি পায়ে হেঁটেও চলবে না”—হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“আমি এ আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করছি যে, আল্লাহর রাস্তার ধুলা আমার পায়ে লাগছে।”

হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুও সৈন্যদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ পর্যায়ে এসে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মদীনায় উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

“উসামা!” খলীফা সেনাপতিকে বলেন—“তোমার সম্মতি থাকলে আমি উমরকে মদীনায় রেখে দিতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে তার সাহায্য আমার লাগতে পারে।”

হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সৈন্যদের থেকে পৃথক করে তাকে মদীনায় ফিরে যাবার অনুমতি দেন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বার্ধক্যের বয়সে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি এক স্থানে দাঁড়িয়ে যান। হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের থামার নির্দেশ দেন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু অপেক্ষাকৃত এক উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেন :

“ইসলামের হে বীর সেনানীগণ! বিদায় মুহূর্তে দশটি নসীহত করতে চাই। এগুলো মনে রেখ, সুফল পাবে। আর তা হলো—

১. খেয়ানত করবে না অর্থাৎ রক্ষক হয়ে ভক্ষক হবে না।

২. চুক্তি লঙ্ঘন করবে না। এটা জঘন্য অপরাধ।

৩. চুরি করবে না। যে কোন মূল্যে ওয়াদা ঠিক রাখবে।

৪. শত্রুর লাশের বিকৃতিসাধন কিংবা অঙ্গহানী করবে না।

৫. নাবালেগ সন্তান এবং মহিলাদের হত্যা করবে না।

৬. খেজুর ও অন্যান্য ফল-মূলের বৃক্ষ কেটে নষ্ট করবে না।

৭. আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোন পশু জবেহ করবে না।

৮. বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় তোমাদের সামনে পড়বে। সেখানে অনেক বৈরাগীদের দেখা পাবে। তাদের উত্যক্ত করবে না।

৯. চলতি পথে স্থানীয় বাসিন্দারা তোমাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য আনবে। আল্লাহর নাম নিয়ে এ খাদ্য খেয়ে নিবে। এমনও লোকের সাক্ষাৎ তোমরা পাবে যাদের মাথায় শয়তানের বাসা থাকবে। তাদের মাথার তালু টাক এবং আশে-পাশের চুল অনেক লম্বা হবে। দেখা মাত্রই তাদের হত্যা করে ফেলবে।

১০..আল্লাহর উপর আস্থা রেখে নিজেদের হেফাজত করবে। রওয়ানা কর, প্রিয় মুজাহিদ বাহিনী! পরাজয় এবং বিপদাপদ থেকে আল্লাহ তোমাদের হেফাজত করুন।”

৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন মোতাবেক ১১ হিজরীর ১লা রবিউল আওয়াল এ বাহিনী মদীনা ছেড়ে যায়।

দশ

উপন্যাসটি যেহেতু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণাঢ্য জীবনভিত্তিক তাই সমগ্র ঘটনার পূর্ণ বিবরণ এখানে সঙ্গত কারণেই সম্ভব নয়। উসামা বাহিনীর পরবর্তী বিবরণ একটু বলেই ক্ষান্ত করব যে, এ বাহিনী রোমীয়দের বিরুদ্ধে মাত্র ৪৩ দিনে ঐ সফলতা অর্জন করে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একান্তভাবে চেয়েছিলেন। হযরত উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এ যুদ্ধে পূর্ণ দক্ষতা ও সফল নেতৃত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি বিজয়ী বেশে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে যারা তার সেনাপতিত্বে বেজার ছিল তারাও এসে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে এবং আন্তরিক মোবারকবাদ জানান।

ধর্মান্তরের ফেৎনা ছিল আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমরায়োজনের ব্যবস্থা করতে হয়। সমর শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করতে হয়। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পুরো সেনাবাহিনী কয়েক অংশে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক অংশের পৃথক কমান্ডার নিযুক্ত করেন। তাদের জন্য আলাদা রণক্ষেত্রও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অর্থাৎ একেক কমান্ডারকে একেক এলাকা দেয়া হয়, হামলা করার জন্য। এ সেনা বিভক্তির ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রতিপক্ষের শক্তি ও সৈন্য বিবেচনায় রেখে মুসলিম কমান্ডার ও সৈন্য সংখ্যা নির্ধারণ করেন।

সবচেয়ে শক্তিশালী ও দাগাবাজ ছিল দু’মুরতাদ। তুলাইহা এবং মুসাইলামা। তারা উভয়ে নবুওয়াত দাবী করে নিজেদের সপক্ষে হাজার হাজার ভক্ত যোগাড় করতে সমর্থ হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এদের একজনের বিরুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত হন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে তুলাইহা এর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তুলাইহাকে শায়েস্তা করার পর তাকে বাতাহ নামক স্থানে যেতে বলেন। এখানে বনূ তামীমের সর্দার মালেক বিন নাবীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

সকল কমান্ডার নিজ নিজ রণক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনী নিয়ে উদ্দীষ্ট রণক্ষেত্রে যথারীতি এত দ্রুত গিয়ে পৌঁছান যে, দুশমনরা মোটেও টের পায় না। তিনি পৌঁছেই কালক্ষেপণ না করে কয়েকটি বসতি ঘেরাও করে ফেলেন। স্থানীয় লোকজন আতংকিত হয়ে পড়ে। নেতৃস্থানীয় কিছু লোক হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে জানায় যে, অনেক গোত্র তুলাইহার প্রতারণার শিকার। তাদের রক্ত ঝরানো ঠিক হবে না। তিনি একটু সময় দিলে তাঈফ গোত্র হতে কম-বেশী ৫০০ যোদ্ধা হযরত খালিদের বাহিনীতে যোগ দিবে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের সুযোগ দেন। অল্প সময়ের মধ্যে নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঈফ গোত্র হতে ৫০০ যোদ্ধা নিয়ে আসে। তারা তুলাইহার গোত্র এবং তাদের অধীনস্থ গোত্রের বিরুদ্ধে লড়তে অনুপ্রাণিত ছিল। তারা সশস্ত্র হয়েই আসে। যাদিলা গোত্রও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে এসে যোগ দেয়। তুলাইহা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী আসছে শুনে অত্যন্ত ঘাবড়ে যায়। কিন্তু তৎপর হয়ে ওঠে উয়াইনা নামক এক ব্যক্তি। লোকটি ফারানা গোত্রের নেতা ছিল। তার অন্তরে এত মদীনা-বিদ্বেষ ছিল যে, সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে, সে কিছুতেই মদীনা কেন্দ্রিক শাসন মানতে রাজি নয়। খন্দক যুদ্ধে যে তিন বাহিনী মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে তার এক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল এই উয়াইনা বিন হাসান। শত্রুদের উপরে আগে ঝাঁপিয়ে পড়’—এই নীতি অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা থেকে এগিয়ে এসে ঐ তিন বাহিনীর উপর আক্রমণ করেছিলেন। বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় উয়াইনার নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা। সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে ইসলাম কবুল করেছিল। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে তার অপতৎপরতা যথারীতি অব্যাহত থাকে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও যথাসময়ে জানতে পারেন যে, তুলাইহার সাথে উয়াইনাও আছে। ফলে তিনি অঙ্গীকার করেন যে, তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। শায়েস্তা করে ছাড়বেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রওনা হওয়ার পূর্বে হযরত উক্কাশা বিন মুহসিন রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত সাবেত বিন আকরাম আনসারী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গোয়েন্দাবৃত্তির উদ্দেশ্যে অগ্রে পাঠিয়ে দেন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, শত্রুর গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং তাদের থেকে যদি কোন অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পায় এবং তা মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের কাজে আসে তাহলে দ্রুত যেন তা সেনাপতিকে অবহিত করে। গোয়েন্দা সাহাবাদ্বয় রওনা হয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও সৈন্য নিয়ে এগুতে থাকেন। বহুদূর গেলেও গোয়েন্দা দু’জনের একজনকেও ফিরে আসতে দেখা যায় না।

আরো এগিয়ে গেলে রক্তরঞ্জিত তিনটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুটি লাশ হযরত উক্কাশা রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু এর। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আগে পাঠিয়েছিলেন। তৃতীয় লাশটি ছিল এক অজ্ঞাত ব্যক্তির। পরে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি এই জানা যায় যে, গোয়েন্দাদ্বয় সামনে এগিয়ে চলে। পথিমধ্যে হাবাল নামক এক ব্যক্তি তাদের সামনে পড়ে। ঐতিহাসিক ইবনুল আছীরের বর্ণনামতে হাবাল তুলাইহার ভাই ছিল। কিন্তু তাবারী এবং কামুসের মতে হাবাল ভাই ছিল না, বরং ভ্রাতুস্পুত্র ছিল। হযরত উক্কাশা এবং হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঙ্কার দিয়ে তাকে হত্যা করেন।

তুলাইহার কাছে খবর পৌঁছে যায়। সে অপর ভাই সালামাকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। ইতোমধ্যে হযরত উক্কাশা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু আরো এগিয়ে যান। তাদের আসতে দেখে তুলাইহা ও তার ভাই ঘাপটি মেরে থাকে। সাহাবাদ্বয় কাছে আসতেই তারা কোনরূপ আত্মরক্ষার সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে হত্যা করে ফেলে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্রোধে জ্বলে ওঠেন। তার রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। তিনি দ্রুত মার্চ করে তুলাইহার বসতিতে গিয়ে পৌঁছান। সংঘাত নিশ্চিত জেনে তুলাইহাও রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। দু’বাহিনী ময়দানে নেমে আসে। উয়াইনার হাতে থাকে তুলাইহা বাহিনীর সেনা কমান্ড। তুলাইহা এক নিরাপদ তাঁবুতে নবীর গাম্ভীর্য নিয়ে বসা ছিল। উয়াইনা ছিল রণাঙ্গনে। মুসলমানদের ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ চেহারা দেখে উয়াইনার পিলে চমকে যায়। তার বাহিনী ক্রমেই যে পর্যদস্ত হয়ে পড়ছে তাও উয়াইনার নজর এড়ায় না। সে সেনা কমান্ড মাঠে ফেলে তুলাইহার কাছে ছুটে যায়। তুলাইহাকে সত্য নবী বলে সে বিশ্বাস করত।

“সম্মানিত নবী!” উয়াইনা তুলাইহাকে জিজ্ঞাসা করে—“আমরা কঠিন অবস্থার সম্মুখীন। জিব্রাইল কোন ওহী নিয়ে এসেছে?”

“এখনও আসেনি”—দুলাইহা জবাবে বলে—“তুমি লড়াই অব্যাহত রাখ।”

উয়াইনা দৌড়ে ময়দানে আসে এবং কমান্ড করতে থাকে। মুসলমানদের বজ্র নিনাদ আর আক্রমণ আরো তীব্র হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রণকৌশলে ভণ্ড নবীর বাহিনীর শক্তি নিস্তেজ হয়ে আসছিল। উয়াইনা আরেকবার তুলাইহার কাছে ছুটে যায়।

“নবী!” উয়াইনা তুলাইহাকে জিজ্ঞাসা করে—“কোন ওহী এল কি?”

“এখনও নয়”—তুলাইহা বলে—“যাও, লড়াই চালিয়ে যেতে থাক।”

“ওহী আর কখন আসবে?”—উয়াইনা উদ্বেগজনক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে—“আপনি বলেছিলেন, কঠিন সময়ে ওহী নাযিল হয়।”

“আমার দোয়া আল্লাহর দরবারে পৌঁছে গেছে”—তুলাইহা বলে—“এখন শুধু ওহীর অপেক্ষা মাত্র।”

উয়াইনা ভগ্নহৃদয়ে আবার সৈন্যের কাছে ফিরে যায়। ততক্ষণ তার বাহিনী হযরত খালিদের ঘেরাওয়ের মধ্যে এসে যায়। উয়াইনা আতংকিত অবস্থায় পুনরায় তুলাইহার কাছে যায় এবং তাকে সৈন্যদের দুরবস্থার কথা বলে জিজ্ঞাসা করে যে, ওহী নাযিল হয়েছে কি না?

“হ্যাঁ”—তুলাইহা জবাবে বলে—“ওহী নাযিল হয়ে গেছে।”

“কি নাযিল হল?” উয়াইনা আশান্বিত কণ্ঠে জানতে চায়।

“তা এই যে”—তুলাইহা জবাবে বলে—“মুসলমানরাও যুদ্ধ করছে এবং তোমরাও যুদ্ধ করছ। এমন একটি সময় আসছে, যার কথা কোনদিন তোমরা ভুলবে না।”

উয়াইনার আশা ছিল ভিন্ন কিছুর। তুলাইহা তাকে নিরাশ করে। সে বুঝে ফেলে তুলাইহা মিথ্যা বলছে।

“এমনটিই হবে”—উয়াইনা রাগতস্বরে বলে—“সে ক্ষণ অতি নিকটবর্তী যার কথা সারা জীবন আপনি ভুলবেন না।”

উয়াইনা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসে এবং চিৎকার করে করে তার গোত্রের উদ্দেশে বলে—“হে বনূ ফারাযা! তুলাইহা মিথ্যাবাদী। ভণ্ড নবীর জন্য নিজ প্রাণ খুইয়াও না। পালাও! নিজ প্রাণ বাঁচাও।”

বনূ ফারাযা মুহূর্তে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। তুলাইহার গোত্রের যোদ্ধারা তুলাইহার তাঁবুর চতুর্দিকে জমা হয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের কাণ্ড দেখছিলেন। তুলাইহার তাঁবুর সাথে একটি ঘোড়া এবং একটি উট প্রস্তুত ছিল। গোত্রের লোকেরা এ মুহূর্তে করণীয় কি জানতে চায়। তাদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর না দিয়ে তুলাইহা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে। তাবুতে তার স্ত্রীও ছিল। সে উটের পিঠে আরোহণ করে।

“ভাইসব!” তুলাইহা তার গোত্রের সমবেত লোকদের উদ্দেশে বলে—“যাদের পলায়নের ব্যবস্থা আছে তারা এখনই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আমার মত পালিয়ে আত্মরক্ষা কর।”

এরপর সে আর দেরী করে না। জলদি ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। এভাবে এক মিথ্যুক ও ভণ্ড নবীর ফেৎনার পরিসমাপ্তি ঘটে। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসনামলে তুলাইহা তার বাইয়াত হয়ে মুসলমান হয়ে যায়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সফল অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি গোত্রকে অনুগত করেন এবং ধর্মান্তরের অপরাধে তাদের কঠোর শাস্তি দেন। তাদের উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। ইসলাম থেকে যারা দূরে সরে গিয়েছিল তাদের পুনর্বার ইসলামে দীক্ষিত করেন। তিনি তুলাইহার নবুওয়াতকে চিরতরে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন এবং চরম মুসলিম বিদ্বেষী উয়াইনা পালিয়ে সুদূর ইরাকে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু তার প্রেতাত্মা ঠিকই রয়ে যায়। সালমা নামে এক নারীর রূপে এ প্রেতাত্মা সামনে আসে। তার পূর্ণ নাম উম্মে জামাল সালমা বিনতে মালিক।

বনূ ফারাযার খান্দানী বংশের প্রখ্যাত মহিলা উম্মে করফার মেয়ে ছিল এই সালমা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশার একটি ঘটনা। হযরত যায়েদ বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু বনূ ফারাযার এলাকায় একবার গিয়ে হাজির হন। গোত্রটি চরম মুসলিম বিদ্বেষী এবং তাদের ঘোরতর শত্রু ছিল। ওয়াদিউল কুরা নামক স্থানে হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বনু ফারাযার কিছু লোকের সামনে পড়েন। হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে কয়েকজন মাত্র ছিল। বনু ফারাযার লোকেরা তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গুরুতর আহত হয়ে কোন রকমে মদীনায় আসতে সক্ষম হন। তিনি সুস্থ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নেতৃত্বে একটি নিয়মতান্ত্রিক সেনাবহর বনূ ফারাযাকে শিক্ষা দিতে প্রেরণ করেছিলেন।

মুসলিম কনভয় বনূ ফারাযার প্রতিরোধ শক্তি গুঁড়িয়ে দেয়। শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে তাদের অনেককে খতম এবং কতককে যুদ্ধবন্দী করে। বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে উম্মে করফা ফাতেমা বিনতে বদরও ছিল। তার এ বিষয়ে বড় খ্যাতি ছিল যে, সে নিজ গোত্র ছাড়াও অন্যান্য গোত্রদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করত। তাকে মদীনায় এনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সাথে তার নাবালেগা কন্যা উম্মে জামালও ছিল। কন্যাটিকে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর হাতে সোপর্দ করা হয়। তাকে তিনি আদর-যত্নে লালন-পালন করেন। কিন্তু সে সর্বক্ষণ উদাস ও ভারাক্রান্ত থাকত। হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা তার প্রতি দয়াদ্র হয়ে তাকে আযাদ করে দেন।

বাঁদী হিসেবে না রেখে বরং আযাদ করে দেয়ার কারণে সালমা মুসলমানদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে সে মাতৃহত্যার প্রতিশোধ স্পৃহা মনের গহীনে লালন করতে থাকে এবং এ উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিদ্যা অর্জন করতে মনোনিবেশ করে। সর্দার গোত্রের হওয়ায় অতি অল্প সময়ে সে সমর জ্ঞানে পারদর্শী হয়ে ওঠে। নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাও সে লাভ করে। সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী তৈরী করে মদীনা আক্রমণের জন্য ফুঁসতে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে মুসলিম বাহিনী এক বিরাট সমরশক্তিতে পরিণত হওয়ায় সালমা মদীনার কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। দূর থেকে লম্ফ-ঝম্ফ দিতে থাকে মাত্র।

তুলাইহা আর উয়াইনা পরাজিত হলে সালমা দৃশ্যপটে হাজির হয়। তার মাতা উয়াইনার চাচাত বোন ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে যে সকল গোত্রের সংঘর্ষ হয় তাদের চড়া মূল্য দিতে হয়। হতাহত হয় প্রচুর। যারা কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যায় তারা বিক্ষিপ্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। গাতফান, তাঈফ, বনূ সালীম এবং হাওয়াযিন গোত্রের অনেকে সালমার কাছে সমবেত হয়। তারা প্রস্তাব করে, সালমা তাদের সঙ্গ দিলে তারা মুসলমানদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে জীবন বাজি রাখবে। সালমা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে রাজি হয়ে যায়। অল্পদিনের মধ্যে নিজের বাহিনী প্রস্তুত করে সালমা মুসলিম বাহিনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সময় বাযাখায় ছিলেন। এখানের মাটিতেই তিনি তুলাইহার ভণ্ডামির যবনিকাপাত ঘটান। তিনি গোয়েন্দা মারফৎ জানতে পারেন যে, বনূ ফারাযার সৈন্যরা আবার সংঘটিত হয়ে আসছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পুনরায় বাহিনীকে রণসাজে সজ্জিত করে বিন্যস্ত করেন।

মা উটে চড়ে অগ্রভাগে থেকে চিৎকার করে করে যেরূপভাবে সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করত ঠিক তেমনি সালমাও সৈন্যদের আগে আগে ছিল। তার আশে-পাশে তলোয়ার এবং বর্শা সজ্জিত একশ উষ্ট্রারোহী ছিল। সালমার নিরাপত্তায় এরা ছিল জীবন্ত মানব ঢাল। সালমার নেতৃত্বাধীন বাহিনী অমিত বিক্রমে অগ্রসর হচ্ছিল এবং রণাঙ্গন কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুদের আরো নিকটে আসার অপেক্ষা করেন না। তার বাহিনীর সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। তিনি শত্রু বাহিনীকে বিন্যস্ত হওয়া কিংবা স্বল্প সংখ্যক মুসলমানদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করার পজিশন নিতে সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঙ্কার দিতে দিতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি জানতেন, শত্রুসৈন্য সফরের ক্লান্তিতে অবসন্ন। তিনি শত্রুর শারীরিক দৈন্যতার এ দুর্বল পয়েন্ট থেকে পুরোপুরি ফায়দা হাসেল করতে চান।

একশ দুর্ধর্ষ উষ্ট্রবাহিনীর নিপুণ প্রহরায় থেকে সালমা উত্তেজনাকর বাক্যের মাধ্যমে সৈন্যদের প্রেরণা চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করছিল। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, বনূ ফারাযা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আক্রমণ বীর বিক্রমে প্রতিহত করে। সৈন্য কম হওয়ার কারণে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অবস্থা ক্রমেই নাজুক হতে থাকে। অপরদিকে দুশমনের উদ্দীপনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সালমার হুঙ্কার আর উত্তেজনাকর শব্দ জ্বলন্ত হাড়িতে তৈল সরবরাহের কাজ করছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সালমার নেতৃত্বই যেহেতু বনূ ফারাযাকে এভাবে বীরত্বের অগ্নি ঝরাতে অনুপ্রাণিত করছিল, তাই তিনি সালমার হত্যার মাধ্যমে বনূ ফারাযার প্রেরণার মূলে কুঠারাঘাত হানতে চান। তিনি বাছাইকৃত কয়েকজন যোদ্ধাকে সালমার নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে তাকে উট থেকে ফেলে দিতে নির্দেশ দেন।

সালমার নিরাপত্তা বাহিনীও ছিল দুর্ধর্ষ। তারা খালিদ বাহিনীকে কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। মুসলিম জানবাজরা এ কৌশল অবলম্বন করে যে, তারা নিরাপত্তা বাহিনীর একেকজনকে পৃথক করে হত্যা করতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় তারা নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙ্গতে সক্ষম হয়। তারপরেও কারো পক্ষে সালমা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আহত হয়ে সবাই পিছনে ফিরে আসে।

এক সময় একশ নিরাপত্তা কর্মীর সকলেই নিহত হয়। অবশ্য এর জন্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হন। পথ নির্বিঘ্ন হয়ে গেলে মুসলিম মুজাহিদরা তরবারী দিয়ে সালমার হাওদার রশি কেটে দেয়। হাওদা (উষ্ট্রাসন) সালমাকে নিয়ে নিচে পড়ে যায়। মুজাহিদরা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য তাকায়। সালমাকে বন্দী না হত্যা করবে তা জানতে চায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত দ্বারা হত্যার ইশারা করেন। এক মুজাহিদ এক কোপে সালমার মস্তক ধড় থেকে চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দেন।

নেত্রীর এহেন মর্মান্তিক মৃত্যুতে বনূ ফারাযার মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লাফ দিয়ে তাদের বীরত্বের মিটার কাপুরুষতার গ্রেডে চলে আসে। প্রতিরোধের পথ ছেড়ে পলায়নের পথ ধরে। অগণিত লাশ আর অসংখ্য আহত রেখে তারা পালিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *