০৫.
কেন এমন হলো? সনির এই অকস্মাৎ মৃত্যুর জন্যে দায়ী কে? রহস্যের আঁচ পেতে হলে একটু পিছন দিকে তাকাতে হয়।
রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। শত্রুপক্ষ টের পেয়ে গেছে কর্লিয়নিদের উদ্দেশ্য! পাঁচ পরিবারের উপর মরণ আঘাত হানতে চায় সনি। এটাই হয়তো কাল হয়ে দেখা দিল ওর জন্যে। পচ পরিবারের পাঁচ প্রধানকে খুন করার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করতে গিয়েই হয়তো নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনল সে। অথবা, সম্ভবত, ওর ভিতর যে রক্ত লোলুপ হিংস্র পিশাচটা ঘুমিয়ে ছিল এতদিন সেটা হঠাৎ করে জেগে উঠে সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিতে গিয়েই ডেকে আনল নিজের সর্বনাশ যে কারণেই হোক বসন্ত আর গ্রীষ্মকালের পুরোটা সময় বিরোধীদলের সমর্থকদের উপর অর্থহীন আঘাত হানতে শুরু করে দিল সনি কর্লিয়নি।
হারলেমে টাটাগ্লিয়া পরিবারের বেশ্যা-ব্যবসা খুব জমজমাট, সেখানে ওদের দালালরা গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে। জাহাজঘাটগুলোয় নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যে পাঁচ পরিবার গুণ্ডা-বাহিনী মোতায়েন করেছে, তারাও প্রতিদিন দুএকজন করে গুম হয়ে যাচ্ছে–বুকে আর মাথায় বুলেটসহ কারও কারও লাশও পাওয়া যাচ্ছে। শ্রমিকসংঘের কর্মীরা পাঁচ পরিবারের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে জানার পর সনি তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে খবর পাঠাল তারা যেন এই যুদ্ধে কোন পক্ষ অবলম্বন না করে। কিন্তু তাতে কোন ফল হলো। কর্লিয়নিদের বুক-মেকার আর মহাজনরা জাহাজঘাটার দিকে ভিড়তেই পারে না। এ পরিস্থিতিতেও ক্লেমেঞ্জাকে তার দলবলসহ সেখানে পাঠাল সনি। ক্লেমেঞ্জার সৈনিকরা অযথা শ্রমিকদের পাইকারীভাবে খুন করে যাচ্ছেতাই কাণ্ড শুরু করে দিল।
এই রোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের কোন মানে নেই, কারণ এর উপর পাঁচ পরিবারের সাথে ওদের যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে না যুদ্ধ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে সনি কৌশলী এবং আশ্চর্য বিচক্ষণ, প্রতিটি খণ্ডযুদ্ধে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করছে সে। কিন্তু একটা জিনিসের অভাব রয়েছে ওর মধ্যে, এই মুহূর্তে সেটার দরকার সবচেয়ে বেশি। সেটা হলো, নিখুঁতভাবে দক্ষতার সাথে পরিকল্পনা করার প্রতিভা এই গুটিা। ডন কর্লিয়নির রয়েছে, কিন্তু বাপের কাছ থেকে গুণটি তার বড় ছেলে পায়নি।
গোটা ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর একটা গেরিলা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ক্ষতি কোন পক্ষকেই কম স্বীকার করতে হচ্ছে না। নদীর স্রোতের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে দুপক্ষেরই, যোদ্ধারা ও মারা যাচ্ছে অতি অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে অত্যন্ত লাভজনক কয়েকটা পুক-মেকার ঘটি বন্ধ করে দিতে হলো কর্লিয়নিদের। এগুলোর মধ্যে একটা আবার কার্লো রিটসির। এই বুক-মোর ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তাই দিয়েই সংসার চলে তার। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মদ ধরুল কার্লো, থিয়েটারের নাচিয়ে গাইয়ে ছুকরা মেয়েগুলোর পিছু নিল সে। এদিকে বাড়িতে বেচারা কনির অশান্তি আর যশার সীমা-পরিসীমা নেই
সনির হাতে উত্তমমধ্যম খাওয়ার পর থেকে কনিকে আর কখনও মারধোর করেনি কার্লো! কিন্তু তাই বলে প্রতিশোধ নিতেও ছাড়ছে না। সেই থেকে কনির সাথে শোয় না সে।
অনেকবার অনেক ভাবে স্বামীর মন গলাতে চেষ্টা করেছে কনি। শেষ পর্যন্ত কার্লোর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। মন গলেনি কার্লোর নিষ্ঠুর হেসে স্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে। নিজের বিছানায় শুতে নেয়নি কনিকে। কার্লোর ধারণা, স্ত্রীকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে এক ধরনের অভিজাত গর্ব এবং আনন্দ আছে, রোমের সম্রাটরা যা উপভোগ করতেন। ঠোঁটের কোণ বাকা করে ব্যঙ্গের সুরে কনিকে সে বলে, যাও, তোমার বড় ভাইজানকে ডেকে আনে ডেকে নিয়ে এসে বলো, তোমার সাথে আমি তে রাজী হচ্ছি না। শুনেই আমাকে পেটাতে শুরু করবে ও, মারের চোটে আমি হয়তো তখুনি তোমাকে নিয়ে শুয়ে পড়ব! যাও। ডাকো!
কিন্তু মুখে যাই বলুক, দেখা হলে যতই নিরুত্তাপ ভদ্রতা দেখাক, কার্লো যমের চেয়েও বেশি ভয় করে সনিকে। বুদ্ধি দিয়ে এটুকু অন্তত পরিষ্কার বুঝতে পারে সে যে সনি তাকে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারে। মানুষ মারা সনির জন্যে কোন সমস্যাই নয়, ছেলে-পিলেদের কাছে যেমন কোন সমস্যা নয় পিঁপড়ে মারা। চিন্তা করতে হয় না সনিকে, মনটাকে শক্ত করে নিতে হয় না-ইচ্ছা হলেই দেয় শেষ করে এবং তারপরই ভুলে যায়। কিন্তু কার্লোর পক্ষে ব্যাপারটা তা নয়। মানুষ সে খুন করতে পারবে, কিন্তু সেজন্যে তাকে মনের সবটুকু বল, শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, সঙ্কল্পে থাকতে হবে অটল। তারপর কাজটা শেষ হলে নিজেকে সামলাবার জন্যে প্রচুর মদের সাহায্য দরকার হবে তার।
এখানেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে সনি কর্লিয়নির চেয়ে মানুষ হিসেবে ভাল সে, অবশ্য এদের সম্পর্কে আদৌ যদি ভাল শব্দটা ব্যবহার করা যায়-সে যাই হোক, এ-কথাটা কিন্তু একবারও মনে হয়নি কার্লোর। সনির মধ্যে ভয়ঙ্কর পাশবিকতা লক্ষ করে মনে মনে হিংসা হয় তার। ইদানীং সনির এই পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে।
কর্লিয়নি পরিবারের কনসিলিয়রি হিসেবে সনির এই উন্মত্ত কীর্তিকলাপ অনুমোদন করে না টম হেগেন। কিন্তু তবু সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ-বিষয়ে ডুনের কাছে। অভিযোগ করবে না সে। তার কারণ, পদ্ধতিটার খারাপ দিকগুলো যতই থাকুক, এতে কিছু কিছু কাজও হচ্ছে বৈকি। দেখেশুনে তারও মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে পাঁচ পরিবার, এ-ধরনের ধ্বংসাত্মক লড়াই আরও কিছু দিন চললে ওদের পাল্টা আঘাতগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে, তারপর হয়তো একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।
শত্রুপক্ষের শান্ত হাবভাব এবং মার খেয়ে মার হজম করার প্রবণতা প্রথম দিকে সন্দেহের চোখেই দেখছিল হেগেন। কিন্তু, সনি প্রথম থেকেই খুব আশাবাদী। রাতিমত উল্লাস লক্ষ করা যায় তার মধ্যে। হেগেনকে বলে, থামছি না আমি। চালিয়ে যাচ্ছি, যাবও তাই। বেজন্মারা তাহলে আপোস করার জন্যে কেঁদে পড়বে পায়ে।
শুধু যুদ্ধ নয়, সাংসারিক বিয়েও অশান্তিতে ভুগছে সনি। ওর স্ত্রী সান্ড্রা বিগড়ে গেছে। কারণ এরই মধ্যে কারও জানতে বাকি নেই যে লুলি ম্যানচিনি প্রচণ্ড একটা নেশার মত হয়ে উঠেছে সনির কাছে। সবাই বলাবলি করে মেয়েটা নাকি যাদু করেছে সনিকে। সনির পুরুষাঙ্গ আর মিলনের ভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে প্রকাশ্যে ঠাট্টা মস্কারা করলেও সাড্রা আসলে বিছানায় স্বামার সান্নিধ্য প্রচণ্ডভাবে কামনা করে কিন্তু দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা সাড্রার সাথে এক বিছানায় ঘুমাচ্ছে না সনি। অবহেলা, অপমান আর যৌন তাড়নায় অস্থির সানড্রা খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠেছে, অতিষ্ঠ করে তুলেছে সনির জীবন।
এসব ছাড়াও, সনি জানে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ হাজার হাজার খুনী এক সেকেণ্ডের একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে শুধু, সেই সুযোগটা পাওয়ামাত্র তাকে ওরা খুন করে ফেলবে। যে লোক এ-ধরনের এই সংখ্যক ঘাতকদের লক্ষ তার একটা মানসিক ক্লেশ থাকতেই হবে। প্রতিটি কাজে, প্রতিটি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয় ওকে। লুসি ম্যানচিনির কাছে ওর যাওয়া-আসা শত্রুদের কাছে এখন আর গোপন কোন বিষয় নয়, এও জানে সনি। তবে এক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে সে। জানে, মানুষের ইতিহাস-খ্যাত দুর্বলতাটা ওখানেই, মেয়েমানুষ নিয়ে বেশি মাতামাতি ধ্বংস ডেকে আনে। সেজন্যেই এমন ব্যবস্থা করেছে যে এদিক থেকে বিপদ ঘটার প্রায় কোন ভাবনা নেই বললেই চলে। ঘুণাক্ষরেও জানে না লুসি যে সান্তিনোর বিশ্বাসী লোকেরা রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা নজর রেখেছে। তার উপর। তারপর, লুসির পাশের ফ্ল্যাটটা খালি হয়ে যেতেই কর্লিয়নিদের সবচেয়ে বিশ্বাসী লোকদের একজন সাথে সাথে সেটা ভাড়া নিয়ে নিল।
ধীরে ধীরে হলেও সেরে উঠছেন ডন কর্লিয়নি পরিবারের নেতৃত্ব কাঁধে নিতে খুব বেশি দেরি করবেন না তিনি। সবাই জানে, ডন চাঙা হয়ে উঠে হাল ধরলেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে পরিস্থিতি কর্লিয়নিদের অনুকূলে চলে আসতে বাধ্য। এ ব্যাপারে সনির মনেও কোন সন্দেহ নেই। তাই মনে মনে স্থির করেছে যতদিন না সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে পারছেন বাবা, ততদিন নিজের পদ্ধতিতেই সে তাদের পারিবারিক সামাজ্য রক্ষা করে যাবে, অর্জন করবে বাপের প্রশংসা-এবং, ডন-এর সর্বোচ্চ পদটা যেহেতু বংশপরম্পরায় নিশ্চিতভাবে পাবার মত নয়, তাই কর্লিয়নি সামাজ্যের ওয়ারিশ হবার দাবিটা পাকা করে রাখতে চাইছে সনি।
ওদিকে ওদের শত্রু পাঁচ পরিবারও চুপ করে বসে নেই, তারাও মতলব ভজছে। সমস্ত পরিস্থিতিটা বিবেচনা বিশ্লেষণ করে তারা একটামাত্র সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে: সমূহ পরাজয় এড়িয়ে যাবার একমাত্র উপায় সনি কর্লিয়নিকে সরিয়ে দেয়া। সনির পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড দেখে এতদিনে চোখ খুলেছে ওদের, এখন ওরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ডন কর্লিয়নির সাথে বোঝাপড়া বা কারবার করা তবু সম্ভব হতে পারে, কারণ সবাই জানে তিনি যুক্তি বোঝেন, মেনেও চলেন। কিন্তু সনির কাছে যুক্তি চলে না। রক্তপাত ঘটানোতেই যত আনন্দ তার। তার ধারণা সীমাহীন খুন-খারাবি করতে পারলেই সামাজ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে, শত্রুরা নতি স্বীকার করবে। শুধু এই একটা কারণেই পাঁচ পরিবারের চোখের বিষ হয়ে উঠেছে সনি। সনি বোঝে না, সে যা করছে তাতে ব্যবসা-বুদ্ধির এতটুকু পরিচয় নেই। একবারও। ভেবে দেখেনি সে যে আগেকার সেই দিন আর আজকের দিনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। হত্যাযজ্ঞে কেউ মেতে উঠতে চায় না আজ, তাতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসার ক্ষতি কিছুতেই সহ্য করতে পারে না মাফিয়া পরিবারগুলো।
একদিন সন্ধ্যাবেলার ঘটনা।
কার্লোর বাড়িতে একটা ফোন এল। এই সময় কার্লোর বাড়িতে থাকার কথা নয়, কখনও থাকে না, আজও নেই। ফোনটা করেছে একটা মেয়ে। কিন্তু নিজের নাম বলছে না। তবু আরেকবার জিজ্ঞেস করল কনি,তুমি কে কথা বলছ?
অপরপ্রান্তে খিক খিক করে অশ্লীল ভঙ্গিতে হাসছে মেয়েটা। কনির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, কার্লোকে দরকার আমার।
সে বাড়ি নেই।
আবার সেই অশ্লীল হাসি। তারপর বলল, কার্লো আমার বিছানার বন্ধু। আজ রাতে ওর সাথে আমার দেখা হবে না, শুধু এই কথাটা ওকে জানাবার জন্যে ফোন করেছি। শহরের বাইরে যাব কিনা।
বেশ্যামাগী! খানকি মাগী– রাগে অন্ধ কনি কর্লিয়নি চেঁচাতে শুরু করল। সাথে সাথে কট করে কেটে গেল কানেকশন।
ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেছে কার্লো, অনেক রাত করে ফিরল সে। রেস খেলায় প্রচুর হেরে গেছে, মেজাজ তার আজ এমনিতেই সপ্তমে চড়ে আছে। মদের বোতল। সারাক্ষণ সাথে রাখে সে, সেটা প্রায় শেষ করে আধা মাতাল অবস্থা তার দরজার চৌকাঠ টপকে ঘরে সবে পা দিচ্ছে, অমনি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করল স্বামীকে কনি।
কিন্তু স্ত্রীর গালমন গায়ে মাখছে না কার্লো। গুনেও না শোনার ভান করে বাথরুমে ঢুকল সে শাওয়ার সারার জন্যে। গোসল শেষ করে বাথরুম থেকে খালি। গায়ে বেরিয়ে এল সে। কনি দাঁড়িয়ে আছে সামনে, তুফান ছুটছে তার মুখে, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সাজগোজ করছে কার্লো-আবার বাইরে বেরুতে হবে তাকে।
দুকোমরে হাত রেখে রুখে উঠল কনি। রাগে চুঁচাল, ফাঁকাসে দেখাচ্ছে তার চেহারা। চিৎকার করে বলছে, আমাকে তুমি চেনোনি, আজ যদি আবার বাইরে বেরোও, খুন করে ফেলব তোমাকে আমি একটা বেশ্যামাগী ফোন করেছিল তোমাকে, সে আজ বাড়ি থাকবে না বলেছে। তার নাকি বিছানার বন্ধু তুমি রাগে অন্ধ হয়ে মুখে যা আসছে তাই বলছে কনি, কুকুরের বাচ্চা, বাস্টার্ড! এত বড় স্পর্ধা, একটা খানকি মাগীকে আমার টেলিফোন নম্বর দিতে বাধে না পোর। শূয়োর, আজ আমি তোকে মেরেই ফেলব… হিংস্র বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল কনি স্বামীর উপর। এলোপাতাড়ি হাত পা চালাচ্ছে। খামচাচ্ছে।
পেশীবহুল একটা হাত দিয়ে স্ত্রীকে ঠেকিয়ে রেখেছে কার্লো, নিস্তেজ গলায় বলল, আরে, তুমি কি পাগল হলে?।
কিন্তু কার্লোর ভাবভঙ্গি দেখে পরিষ্কার টের পেয়ে গেল কনি, স্বামী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। তার এ দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হতে পারে, কার্লো যে অধিপাগলা মেয়েটার সাথে যৌন খেলায় মেতে উঠেছে তার পক্ষে এ-ধরনের একটা ফাজলামি করে টেলিফোন করা মোটেও বিচিত্র কিছু নয়। কার্লোর ভাবনাটা সঠিক ধরতে পেরেছে মনে করে আরও ক্ষেপে গেল কনি।
দূর পাগলী! বলল কার্লো, ইয়ার্কি মারছিল, তাও বুঝছ না? মাথা খারাপ নাকি! ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দেখার ভান করছে কার্লো।
স্বামীর মোটা হাতের তলা দিয়ে গলে তার মুখে খাচি মারার চেষ্টা করছে কনি। কিন্তু সেই সাথে এও লক্ষ করছে, স্বামী আজ অপ্রত্যাশিত ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে। কেমন যেন খটকা লাগছে কনির। কি যেন একটা রহস্য আছে এর মধ্যে, কিন্তু নিজের বুদ্ধিতে সে রহস্যের কিনারা পাওয়া কনির পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার হোক, মেয়েমানুষ তো!
একটুও রাগছে না কার্লো। বারবার ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে স্ত্রীকে জানে, এতে আরও বেশি বাড়াবাড়ি করার সাহস পাবে স্ত্রী।
হঠাৎ রহস্যের একটা সমাধান পেয়ে গেল কনি। ওর মনে হলো পেটে বাচ্চা রয়েছে বলে কার্লো সাবধান হয়ে আছে, পাল্টা মারধোর করা থেকে বিরত রেখেছে নিজেকে। কথাটা মনে পড়ামাত্র, আরও রাগ দেখাবার সাহস পেয়ে গেল সে।
কনির আজকের এই অপ্রত্যাশিত আচরণের জন্যে শুধু সেই মেয়েটার ফোনই দায়ী নয়। আজই কনি যৌন উত্তেজনায় বেশ খানিকটা অশান্ত হয়ে পড়েছে মনে মনে চাইছে, কার্লো আজ ঠেসে ধরুক ওকে। আর তা মোটে কটা দিন বাকি আছে, তারপর আর ওসব চলবে না। ডাক্তারের নিষেধ। বাচ্চা প্রসব করার দুমাস বাকি থাকতে সব বন্ধ রাখতে হবে যাই হোক, সেই দুমাস শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই আর, তাই বাকি কটা দিন কামনা চরিতার্থ করার ইচ্ছা জেগেছে কনির। অথচ, এমন নিষ্ঠুর কার্লো, নিজের বিছানার ধারেকাছে ঘেষতে পর্যন্ত দেয় না তাকে তবে, কার্লোকে শারীরিকভাবে আহত করার অদম্য একটা প্রবৃত্তিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আজ কনির মধ্যে।
পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে কনি, খানিকটা ঘাবড়ে গেছে কার্লো তার এই ঘাবড়ানো ভাবটা আসলে যে মেকী, তা বোঝার ক্ষমতা কনির নেই। ব্যাপারটা লক্ষ করে স্বামীর প্রতি ঘৃণা আরও বেড়ে গেল তার, সেই সাথে অদ্ভুত একটা আনন্দও অনুভব করছে নিজের মধ্যে। হাঁপাচ্ছে সে, দাতে দাঁত চেপে বলল, কার বাচ্চা, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! দেখি, আমি বেঁচে থাকতে আজ তুই কিভাবে বাড়ি থেকে বের হোস।
অসীম ধৈর্যের সাথে কার্লো বলল, আচ্ছা, তাই। তোমার কথা না হয় থাকল খুশি? সিজ-ফায়ার, ঠিক আছে? এখনও কাপড়চোপড় পরা শেষ হয়নি তার, পরনে শুধু শটস রয়েছে ধু এটা পরেই বাড়ির ভিতর ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে ও। ইংরেজি ভি অক্ষরটির মত সরু কোমর, বিশাল কাব–এসব নিয়ে গর্ব কত তার। কার্লো সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করায় দৈহিক ক্ষুধা যেন চেগিয়ে উঠল কনির। গরম হয়ে উঠছে শরীরটা। ক্ষুধার্ত,পশুর মত স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে। হাসি পাচ্ছে না, তবু হাসতে চেষ্টা করে বলল কার্লো, আরে বাবা, খিদেতে চো চো করছে পেট–কিছু খেতে অন্তত দেবে তো!
অন্তত একটা কর্তব্যের কথা স্বামী ওকে মনে করিয়ে দেয়াতে রাগ পানি হয়ে গেল কনির। মায়ের কাছে খুব ভাল রান্না করতে শিখেছে সে স্বামী কিছু খেতে চাইলে সত্যি সে খুশি হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় দুপদাপ পায়ের শব্দ করে বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু তখুনি কিচেনে গিয়ে মাংস আর মিষ্টি লঙ্কা ভাজতে বসে পড়ল।
চুলোয় রান্না চড়িয়ে দিয়ে নানারকম তরি-তরকারি সহযোগে অতি যত্নের সাথে একটা সালাদ তৈরি করছে কনি। ওদিকে খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে কার্লো, আগামীকালের রেস-এর ফর্মটার উপর চোখ বুলাচ্ছে। পাশেই রেখেছে। গ্লাস ভর্তি হুইস্কি, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে তাতে।
একটু পরই এল কনি। রেডরুমে ঢুকছে না, দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, যেন স্বামীর ডাক না পেলে ভিতরে ঢুকতে পারে না। ওখান থেকেই বলল, খাবার দেয়া হয়েছে।
রেসিং ফর্মের উপর থেকে চোখ না তুলেই শান্তভাবে বলল কার্লো, খিদে পায়নি এখনও।
আবার কেমন যেন খটকা লাগল কনির। কার্লোর আজ হয়েছে কি? চোখ রাঙাচ্ছে না, মারধোর করছে না, অথচ এমন ব্যবহার করছে, এমনিতেই রাগ হয়ে যাচ্ছে কনির। আবার তার জেদ চেপে গেল। এবার ঝাঝের সাথে বলল, আমার কথা কানে যাচ্ছে না? টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।
কার্লো যেন স্ত্রীকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যেই বলল, জাহান্নামে যাও তুমি! আর খাবারগুলো নর্দমায় ফেলে দাও। গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক ঢেকে সবটুকু হুইস্কি গিলে নিল সে, তারপর বোতলটা তুলে নিয়ে আবার ভরে নিল গ্লাসটা। কনির দিকে একবার ফিরেও তাকাল না।
ঝড় তুলে কিচেনে ফিরে এল কনি। খাবার ভর্তি প্লেটগুলো এক এক করে টেবিল থেকে তুলে নিয়ে বাসন-পেয়ালা মোয়ার বেসিনের উপর আছড়ে ভাঙতে শুরু করে দিল সে। কাঁচ আর চীনামাটি ভাঙার ঝন ঝন শব্দ শুনে বেডরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে চলে এল কার্লো 1 কিচেনের দেয়ালে তেলতেলে মাংস আর মরিচ সেটে আছে দেখে রাগে মাথায় রক্ত চড়ে গেল তার। লোকটা আবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ভালবাসে। রূঢ় গলায় স্ত্রীকে বলল সে, আনাদ পেয়ে মাথায় চড়েছিস, না? অ্যাই মাগী, এক্ষুণি সব পরিষ্কার কর! একটু যদি দেরি করেছিল, পিটিয়ে পেটের ছেলে বের করব তোর আজ।
যা যা, কুত্তার বাচ্চা! দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ভেঙচে দিল স্বামীকে কনি। দুহাতের দশটা আঙুল মাথার দুপাশে তুলে হিংস্র জানোয়ারের মত কার্লোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে সে। তুই আমার সাথে যা খুশি তাই ব্যবহার করবি, আর আমি তোকে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? তোর মত পূরুষকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। তুই বড়জোর একটা বেশ্যার ভেড়া হতে পারিস, আমার স্বামী হবার যোগ্যতা তোর নেই।
একটা কথাও বলল না কার্লো। নিঃশব্দে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে শোবার ঘরে ঢুকল সে। তারপর নিজের বেল্টটাকে ডবল করে মুড়ে নিয়ে তখুনি আবার ফিরে এল কিচেনে। কনির দিকে তাকিয়ে দাতে দাঁত চাপল সে। বলল, সাফ কর! এই শেষবার বলছি–জলদি!
কার্লো কি সাঙ্ঘাতিক রেগে গেছে, বুঝতে পারছে কনি। গলার সুরে শাসানিটা অনুভব করে গায়ের নোম খাড়া হয়ে উঠছে তার। কিন্তু তবু একচুল নড়ল না সে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মত।
কনির প্রকাণ্ড, মাংসল নিতম্বে সপাং করে এসে লাগল বেল্টের বাড়ি। ব্যথায় আগুন ধরে গেল যেন জায়গাটায়। এক ছুটে আলমারির সামনে চলে এল কনি। ছো মেরে খোলা দেরাজ থেকে তুলে নিল রুটি কাটার লম্বা ছুরিটা। সেটা বাগিয়ে ধরে ঘুরে দাঁড়াল সে।
হাসতে চেষ্টা করে বলল কার্লো, আই বাপ। কি সব্বোনাশ! কর্লিয়নিদের মেয়েরাও দেখছি কম খুনী নয়! টেবিলের উপর বেল্টটা রেখে দিল সে। স্ত্রীর দিকে এগিয়ে আসছে খালি হাতে।
ছুরি দিয়ে আচমকা স্বামীকে একটা খোঁচা মারার চেষ্টা করল কনি। কিন্তু পেটে বাচ্চা, শরীরটা এমনিতেও ভারি, যথেষ্ট দ্রুততার সাথে নড়তে পারল না সে। আজ যা হবার হবে, এই ধরনের একটা দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে কার্লোর কুঁচকি লক্ষ করে ছুরিটা চালাল বটে, কিন্তু অনায়াসে আঘাতটা এড়িয়ে যেতে পারল কার্লো। ছেলেমানুষের হাত থেকে সহজেই খেলনা কেড়ে নেবার ভঙ্গিতে ছুরিটা কনির হাত থেকে ছিনিয়ে নিল সে। তারপর স্ত্রীর মুখে চড় মারল একটা খুব বেশি জোরে মারল না। চামড়ায় দাগ বা ক্ষত দেখা গেলে তো চলবে না।
ওই একটা চড় মেরে ক্ষান্ত হলো না কার্লো। তার অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই একটার পর একটা চড় মেরেই চলল সে।
খুব জোরে মারা না হলেও, প্রতিটি চড় খেয়ে মাথাটা ঝন ঝন করছে কনির, অসহ্য ব্যথায় ছটফট করছে। শেষ পর্যন্ত কার্লোর হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্যে কিচেনের চারদিকে ছুটোছুটি শুরু করে দিল সে কিন্তু কার্লো তার পথ আগলে মেরেই চলেছে। একটা সুযোগ পেয়েই কিচেন থেকে বেরিয়ে ছুট দিল.কনি। শোবার ঘরে চলে এল সে, পিছু ধাওয়া করে কার্লোও ঢুকল সেখানে! ঘুরে দাঁড়িয়ে। কার্লোর বাড়ানো হাতটা খপ করে ধরে নিজের মুখের দিকে টেনে এনে কামড় দিতে চেষ্টা করছে কনি। তার চুলের গোছা মুঠো করে ধরেছে কার্লো। এখন আর থামছে না সে।
ব্যথায়, অপমানে এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল কনি। একটু বাঁকা হেসে স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল কার্লো। খাটের পাশেই রয়েছে একটা টেবিল, টেবিলটা থেকে হুইস্কির বোতল তুলে নিয়ে আবার গলায় মদ ঢালতে শুরু করুল সে। চেহারা দেখে কনির মনে হচ্ছে মদ খেয়ে বন্ধ মাতাল হয়ে গেছে কার্লো, উজ্জল নীল চোখ দুটো কিসের এক নেশায় চকচক করছে, যেন রক্তপান করতে চাইছে কার্লো। এবার সত্যি ভয়ে, আতঙ্কে শিউরে উঠল কনি।
পা দুটো ফাঁক করে অদ্ভুত এক বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কার্লো। সরাসরি বোতল থেকে হুইস্কি ঢালছে গলায়। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল খাটের দিকে সে, কনির মোটাসোটা উরুর খানিকটা মাংস খামচে ধরে প্রচণ্ড জোরে চিমটি দিল। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করছে কনি। বাবা গো! মা গো…আর করব না…
শুয়োরের মত মোটা হয়েছিস, মাগী…চুপ! বলতে বলতে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল কার্লো।
সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়েছে কনি। চিরকাল দস্যি টাইপের মেয়ে সে, কিন্তু কার্লোর অগ্নিমূর্তি দেখে আত্মা আঁচাছাড়া হয়ে গেছে তার। ব্যথায় জ্বলছে দুই গাল, তবু একটু শব্দ করতে সাহস পাচ্ছে না। পাশের কামরায় কি করছে স্বামী উঠে গিয়ে তা দেখে আসার কথা পর্যন্ত ভাবতে পারছে না। কাঠ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। অনেকক্ষণ কেটে গেল। কি করছে কার্লো? অস্থির হয়ে ভাবছে কনি। অনেক চেষ্টা করে সাহস সঞ্চয় করল সে। নিঃশব্দে উঠে বসল। প্রচুর সময় নিয়ে। নামল খাট থেকে। এক পা এক পা করে এগোল পাশের কামরার দরজার দিকে। উঁকি দিয়ে তাকাল।
আরেকটা মদের বোতল খুলেছে কার্লো। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে নোফার উপর। আর একটু পর নেশায় হুশ থাকবে না ওর, ভাবছে কনি, তখন চুপিসারে কিচেন থেকে লং বীচে বাপের বাড়িতে ফোন করতে পারবে। মাকে একটা খবর দিলেই মা ওকে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। ভয় লাগছে..ধু একটা কথা ভেবে। ফোন যেন বড়দা সনি না ধরে। টম হেগেন অথবা মা ধরলে সবচেয়ে ভাল হয়।
রাত দশটা।
ডন কর্লিয়নির বাড়ি। কিচেনের ফোনটা ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলল কর্লিয়নিদের একজন বডিগার্ড। কনির গলা শুনে, তার যেমন কর্তব্য, বাড়ির কত্রীকে দিল রিসিভারটা।
কনি কথা বলছে কিন্তু মেয়ের কথা ভাল করে বুঝতেই পারছেন না মা। শুধু বুঝতে পারছেন, কনির সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে, হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত প্রলাপ বকছে সে, তাও এত নিচু গলায় যে তার কথার একটা বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।
কার্লোর চড় খেয়ে মুখ ফুলে গেছে কনির, ক্ষতবিক্ষত ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ বেরুচ্ছে। বসার ঘরে টম হেগেনের সাথে কথা বলছে সনি, বডিগার্ডকে ইঙ্গিত করলেন মিসেস কর্লিয়নি, সনিকে কিচেনে ডেকে নিয়ে আসতে বলছেন।
তখুনি এল সনি। মায়ের হাত থেকে নিল রিসিভারটা। জানতে চাইল, কি ব্যাপার, কনি?
ছ্যাঁৎ করে উঠল কনির বুকটা বড়দার গলা শুনে। এক দিকে স্বামীর ভয়, আরেক দিকে সনি কি না কি করে বসে সেই ভয়-দিশেহারা হয়ে পড়ল কনি, তার কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট হয়ে এল আরও। মুখের ভিতর জড়িয়ে যাচ্ছে তার কথাগুলো, বলছে, সনি, আমি যাব:••একটা গাড়ি, আর কিছু করতে হবে না তোমাকে, লক্ষ্মী ভাই, শুধু যদি একটা গাড়ি পাঠিয়ে দাও–গিয়ে সব বলব আমি তোমাকে। যীশুর কিরে, কিছু হয়নি, সনি। তোমাকে আসতে হবে না! এসো না কিন্তু, কেমন? টমকে পাঠাও, ওর সাথে যাব আমি। কিছু হয়নি, এমনি তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা হয়েছে, তাই যেতে চাইছি…
ইতিমধ্যে টম হেগেনও কিচেনে চলে এসেছে।
ঘুমের ওষুধ খেয়ে উপরতলায় নিজের কামরায় ঘুমাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি।
কোন অঘটন ঘটার লক্ষণ দেখামাত্র সাবাক্ষণ সনির উপর নজর রাখার চেষ্টা করে টম হেগেন বাড়ির গার্ডরাও বিপদের নিঃশব্দ আঁচ অনুভব করতে পেরেছে, আশপাশের ঘর থেকে সবাই তারা চলে এসেছে কিচেনে।
ফোনে বোনের সাথে কথা বলছে সনি। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ কেউ নড়ছে না একচুল।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ বা প্রশ্ন জাগতে পারে না যে সনির প্রকৃতির মধ্যে যে হিংসাত্মক প্রবৃতিগুলো রয়েছে, ওর শরীরের গভীর কোন রহস্যময় উৎস কে সেগুলোর উৎপত্তি। ওর দিকে যারা চেয়ে আছে তারা সবাই স্পষ্ট দেখতে চ্ছে ওর গলার মোটা রগ আর শিরাগুলো পর্যন্ত রক্তের স্রোতে ফুলে উঠছে। অসীম ঘৃণা আর বিদ্বেষে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখের দৃষ্টি। ওর মুখের প্রতিটি রেখা আর ভাজ জ্যান্ত, সজীব, আড়ষ্ট আর সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে প্রতি মুহূর্তে। মূমূর্ষ কোন রোগী তার শেষ প্রাণশক্তির সাহায্যে যখন মৃত্যুর সাথে লড়ে, তার মুখের অবস্থা যেমন ছাইয়ের মত হয়ে যায়, তেমনি ছাইয়ের মত হয়ে গেছে সনির চেহারা। শরীরের ভিতর। অ্যাড্রেনালিনের চাপে কাঁপছে ওর হাত। অথচ গলার আওয়াজ অস্বাভাবিক সংযত আর শান্ত। নিচু গলায় ওর একমাত্র আদরের বোনকে বলছে ও, কোন ভয় নেই তোমার। তুমি শুধু ওখানে অপেক্ষা করো। শুধু অপেক্ষা করো। আর কিছু না। কনিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিল সনি। নিজের ভিতর রাগের এমন প্রচণ্ডতা অনুভব করছে, নিজেই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে ও। বাস্টার্ড, বাস্টার্ড, বাস্টার্ড! কয়েক মুহূর্ত পর বিড় বিড় করে বলল, বাস্টার্ড, বাস্টার্ড, বাস্টার্ড! ঝড় তুলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সনি।
সনির মুখের এই বিশেষ ভাবটা খুব ভাল করে চেনা আছে টম হেগেনের। ও জানে, সনি কর্লিয়নিকে এখন বাধা দিতে পারে এমন কেউ দুনিয়ায় জন্মায়নি। এই মুহূর্তে ও সমস্ত যুক্তি-তর্কের বাইরে চলে গেছে। সব, সব করতে পারে এখন ও।
তবে হেগেন সেই সাথে এও জানে যে শহরে যাবার পথে কিছুটা ঠাণ্ডা হবে সনির রাগ, মাথায় তখন বেশি নয়, অল্প-স্বল্প যুক্তি-বুদ্ধিও ফিরে আসবে। কিন্তু তার ফলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে ও, তবে এরই সাথে নিজের অন্ধ রাগের পরিণতি থেকে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতাটাও বেড়ে যাবে ওর। গাড়ির ইঞ্জিনটা গর্জে উঠতেই বডিগার্ডদেরকে আদেশ করল হেগেন, পিছু নাও! জলদি!
দ্রুত ফোনের কাছে চলে এল হেগেন। তাড়াহুড়োর সাথে ফোন করল কয়েকটা। শহরে সনির দলের কয়েকজন লোক থাকে, তাদেরকে নির্দেশ দিল তারা যেন এই মুহূর্তে ছুটে যায় কার্লো রিটসির বাড়িতে। সনি ওখানে পৌঁছুবার আগেই সরিয়ে ফেলতে হবে কার্লোকে। সেই সাথে নির্দেশ দিল, কার্লোকে বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলার পরও যেন কয়েকজন লোক পাহারায় থাকে কনির কাছে, যতক্ষণ না পৌঁছায় সনি!
সনির সঙ্কল্পে বাধা দেয়া প্রায় অসম্ভবএকটা কাজ, এর মধ্যে একাধিক মস্ত ঝুঁকি রয়েছে-কিন্তু টম হেগেন জানে এ-কাজে ডনের সমর্থন পাবে সে।
হেগেনের এখন একটাই ভয়। হয়তো কার্লোকে সনির হাত থেকে শেষ পর্যন্ত আজ বাঁচানো যাবে না, কিন্তু কোন সাক্ষীর সামনে কার্লোকে যদি খুন করে সনি, পরে সাংঘাতিক বিপদ আর জটিলতা দেখা দিতে পারে। শত্রুপক্ষ, অর্থাৎ পাঁচ পরিবারের তরফ থেকে কোন বিপদ আশঙ্কা করছে না হেগেন। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল চুপচাপ আছে ওরা, তেমন নড়াচড়া করছে না-গেনের ধারণা, এখন হয়তো ওরা কোনরকম একটা মিটমাট করে নিতে চাইছে কর্লিয়নিদের সাথে।
ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত তীব্রগতিতে মস্ত উঠান ছেড়ে বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে এল সনির গাড়ি। এরই মধ্যে কিছুটা সুবুদ্ধি ফিরে এসেছে ওর মধ্যে; ভিউ মিররে চোখ পড়ল, দেখল দুজন বডিগার্ড ওকে অনুসরণ করার জন্যে নিজেদের একটা গাড়িতে উঠছে। মনে মনে ব্যাপারটাকে সমর্থনও করল সনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে। ওর মনে বিপদের কোন আশঙ্কা রয়েছে। জানে, পাল্টা আক্রমণ বেশ কিছুদিন। থেকে বন্ধ রেখেছে পাঁচ পরিবার। বলতে গেলে মার খেয়ে মুখটি বুজে মার হজম করে যাচ্ছে তারা, একেবারেই লড়াই করছে না। বেরোবার সময় হলঘর থেকে। নিজের কোটটা তুলে নিয়েছে ও, গাড়ির ড্যাশবোর্ডের চোরা খোপে একটা পিস্তলও আছে। গাড়িটাও ওর দলের একজন লোকের নামে রেজিস্টার করা–তার মানে, আইনের সামনে ব্যক্তিগতভাবে ওকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। তবে, এখনও ভেবে দেখছে না সনি, কি সিদ্ধান্ত নেবে ও কার্লোর ব্যাপারে!
ফাঁকা রাস্তা ধরে তীরবেগে ছুটছে গাড়ি। ভাবনা-চিন্তা করার একটু সময় পাচ্ছে এখন সনি। বুঝতে পারছে, একটা অজাত শিশুর জন্মদাতা, যে কিনা ওরই বোনের স্বামী, তাকে হুট করে খুন করে ফেলা ওর কাজ নয়। বিশেষ করে, তেমন জোরাল কোন কারণ নেই যেখানে। ব্যাপারটা স্রেফ একটা দাম্পত্য কলহ বৈ ভো নয়। আবার একটু অন্য খাতে বইতে শুরু করল সনির চিন্তা-সে এটাকে শুধুই একটা দাম্পত্য কলহ বলে মনে করছে কেন? লোক হিসেবে আসলে কোনদিক থেকেই ভাল নয় কার্লো। কর্লিয়নি পরিবারের জন্যে একটা মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে সে। তাছাড়া, মনে হচ্ছে সনির, ব্যাপারটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব ব্যাপার হলেও, এর মধ্যে ওর নিজেরও খানিকটা দায়িত্ব আছে। কারণ, ওর চেষ্টা আর মধ্বস্থতাতেই তো কনির সাথে আলাপ পরিচয়, তারপর বিয়ে হয়েছে কার্লোর।
সনির হিংস্র প্রকৃতির মধ্যে একটা পরম্পরবিরোধী ভাব আছে। যত বড় কারণই থাকুক, কোন মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলতে পারে না ও।তোলেনি কখনও। একটা শিশু বা একজন অসহায় মানুষের কাছে এত দুর্বল ও, তাদেরকে আঘাত করা তো দূরের কথা, একটা টোকা পর্যন্ত মারতে পারে না। অবোধ কোন প্রাণ ওর হিংস্র প্রকৃতির কাছে সম্পূর্ণ নিরাপদ। সেদিন কার্লো শুধু একটা কারণে বেঁচে গিয়েছিল। পাল্টা মারতে রাজী হয়নি সে, সেজন্যেই তাকে খুন করা সম্ভব হয়নি সনির পক্ষে। কেউ যদি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, কেমন যেন নির্জীব হয়ে পড়ে ওর ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রবৃতিগুলো। সবাই জানে, কথাটাও সত্যি, ছোটবেলায় আশ্চর্য কোমল ছিল ওর মনটা! পরে একজন ত্রাসসৃষ্টিকারী হত্যাকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বটে ও, কিন্তু সেটা নিতান্তই ওর নিয়তি।
কিন্তু আজ, ভাবছে সনি কর্লিয়নি, সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান করে ফেলতেই হবে। লং বীচ থেকে জলার ওপারে জোন্স বীচে যেতে হলে পথে একটা বাঁধ পড়ে, সেই বাঁধের উপর দিয়ে যেতে হবে ওকে। বুইক নিয়ে বাধটার উপর উঠল ও। ওপারে যানবাহনের ভিড় আরও কম থাকবে। ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে গেলে মনের ভিতর সাংঘাতিক যে জটটা পাকিয়েছে, সেটা হয়তো খুলে যেতে পারে। ইতিমধ্যে, অনেক আগেই, বডিগার্ডদের গাড়িটাকে পিছনে ফেলে রেখে অনেকদূর চলে এসেছে সনি। ভিউমিররে গাড়িটার চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না।
বাঁধের উপর আলো খুব কম। একটা গাড়িও নেই। এখনও অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে তোলাখানার সাদা গম্বুজ। লোকজন আছে ওখানে। পাশাপাশি আরও অনেকগুলো তোলাখানা রয়েছে, সেগুলো এখন বন্ধ, শুধু দিনের বেলাই খোলা থাকে, কারণ তখন যানবাহনের ভিড় থাকে বেশি। বেশ খানিকটা দূরে থাকতেই ব্রেক করে গাড়ির গতি কমিয়ে আনছে সনি, সেই সাথে পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুচরো পয়সা খুঁজছে, তোলাখানায় শুল্ক দিতে হবে। পকেটে খুচরো কোন পয়সা নেই, অগত্যা মানিব্যাগটা বের করে একহাতেই খুলে ফেলল সেটা বেছে বের করল এক ডলারের একটা নোট। ইতিমধ্যে তোলাখানার আলোর বৃত্তের মাঝখানে চলে এসেছে ওর বুইক এই প্রথম নজরে পড়ল, তোলাখানার সামনের ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা গাড়ি। সামান্য একটু অবাক হলো সনি। তারপর ভাবল, ড্রাইভার সম্ভবত তোলাখানার লোকটার কাছ থেকে পথ জেনে নিচ্ছে। হর্ণ বাজাল সনি। সাথে সাথে সুবোধ বালকের মত গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে সনির বুইকটাকে এগিয়ে এসে দাঁড়াবার জায়গা করে দিল ড্রাইভার।
গাড়ি থামাল সনি! তোলাখানার লোকটার হাতে ধরিয়ে দিল এক ডলারের নোটটা! বাকি পয়সা ফেরত পাবার জন্যে অপেক্ষা করছে ও। একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছে মনে মনে। গাড়ির জানালাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিতে চাইছে ও।
আটলান্টিক মহাসাগরের হু হু বাতাস ঢুকে কনকনে ঠাণ্ডা হিম হয়ে যাচ্ছে গাড়ির ভিতরটা কিন্তু তোলাখানার লোকটার হাত একেবারে চালু নয়, খুচরো পয়সা ফেরত দিতে অস্বাভাবিক দেরি করছে লক্ষ্মীছাড়া হারামজাদা, ভাবছে সনি, হাত থেকে খুচরো পয়সাগুলো সব ফেলেই দিল শেষ পর্যন্ত।
পয়সা তোলার জন্যে ঝুঁকে পড়ল লোকটা। এখন আর ওকে গাড়ির পাশে দেখতে পাচ্ছে না সনি। লোকটার শরীর, মাথা সব দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে।
ঠিক এই সময় একটা বিদঘুঁটে ব্যাপার লক্ষ্য করল সনি। সামনের গাড়িটা সরে যায়নি, মাত্র কয়েক ফুট এগিয়ে ওর বুইকের পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইচ্ছা করলেও সনি এখন গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে পারবে না। নিজের অজান্তেই ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে ডান দিকে তোলাখানার ভিতর তাকাল সনি। দেখল অন্ধকারে আরেকজন লোক রয়েছে। কিন্তু লোকটার উপস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা করার জন্যে একটা সেকেণ্ড সময়ও পেল না সনি। উইণ্ডস্ক্রীনের ভিতর দিয়ে সামনের গাড়িটার দিকে আবার তাকাতে গিয়েই দেখল সেটা থেকে নেমে পড়েছে দুজন লোক। এগিয়ে আসছে তারা। ওর দিকে।
যে লোকটা পয়সা কুড়োবার জন্যে ঝুঁকে পড়েছে তাকেও দেখতে পাচ্ছে না সনি এক সেকেন্ড আগেও তার সাড়া-শব্দ পাচ্ছিল। এখন পাচ্ছে না
এরপর, কিছু ঘটবার আগেই, এক সেকেণ্ডের একশো ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই সনি কর্লিয়নি বুঝতে পারল, মারা যাচ্ছে সে। সেই মুহূর্তে ওর মন আর অন্তরাত্মা আশ্চর্য নির্মল, কলুষমুক্ত হয়ে গেল। মন থেকে নিমেষে সাফ হয়ে গেল সমস্ত.হিংসা, বিদ্বেষ আর ঘৃণা সেই লুকিয়ে থাকা ভীতিটা, যাকে বলা হয় মৃত্যুভয়, তার পূর্ণাঙ্গ চেহারা নিয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠে যেন সনির সমস্ত অপবিত্রতা দূর করে দিল।
জীবনের উপর তবু একটা মায়া থাকে, থাকে ভালবাসা, সেই মায়া আর ভালবাসারও থাকে একটা প্রতিক্রিয়া। বিদ্যুৎগতিতে সনির প্রকাণ্ড শরীরটা গাড়ির দরজার উপর দড়াম করে আছড়ে পড়ল। অত বড় বুইক গাড়িটা তীব্র একটা ঝাঁকি খেল চাবিটা ভেঙে গেছে দরজার।
অন্ধকার তোলাখানা থেকে সেই নোকটা গুলি চালাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে সনির বিশাল শরীর। ওর গলায় আর মাথায় বুলেট লাগল। তোলাখানার লোকটা গুলি করছে না আর, কারণ সে দেখতে পাচ্ছে বুইকের পাশে চলে এসে সনির দিকে পিস্তল তাক করছে অপর দুজন লোক। মাথা, বুক, কোমর পিচ-ঢালা রাস্তার উপর পড়ে গেছে সনির, এখনও গাড়ির ভিতর রয়ে গেছে পা দুটো। দুজন একসাথে গুলি করছে এখন সনির শরীরে। তারপর ওরা সনির মুখে লাথি মারতে শুরু করল। বুট জুতোর প্রচণ্ড আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত করে দিল মুখটাকে। ব্যক্তিগত ঘৃণার নমূনা রেখে যাচ্ছে ওরা। যারা গুলি করেছে সেই তিনজন আর তোলাখানার নকল লোকটা দ্রুত উঠে পড়ল গাড়িতে। জোন্স বীচের উল্টো দিকে মিডওয়ে পার্কওয়ে, তীরবেগে সেদিকে ছুটে যাচ্ছে গাড়িটা।
রাস্তার মাঝখানে বুইক আর সনির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, ওদের পিছু ধাওয়া করার পথ একরকম বন্ধই। কয়েক মিনিট কেটে যাবার পর এসে পৌঁছুল সনির বাডগার্ডদের গাড়িটা। গাড়ি থামাল ওরা। সনিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে খুনীদেরকে অনুসরণ করার কোন ইচ্ছাই অনুভব করছে না তারা। প্রকাণ্ড একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে গাড়ির নাক ঘুরিয়ে নিল, ফিরতি পথ ধরে লং বীচের দিকে তীরবেগে ছুটছে। বাধের নিচে নেমে এসে প্রথম যে পাবলিক টেলিফোন বৃদটা চোখে পড়ল সেখানে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে গাড়ি থামাল তারা। লাফ দিয়ে নামল একজন। ছুটে গিয়ে ঢুকল বুদের ভিতর। ফোন করল সে টম হেগেনকে।
হাঁপাচ্ছে লোকটা। দ্রুত, সংক্ষেপে, এক নিঃশ্বাসে বলল সে, সনি নেই জোন্স বাচ তোলাখানার সামনে ওকে মেরে ফেলেছে ওরা।
এতটুকু চাঞ্চল্য নেই টম হেগেনের কণ্ঠস্বরে। সম্পূর্ণ শান্ত এবং সংযত সে বলল, বেশ। সোজা ক্লেমেঞ্জার বাড়ি যাও। তাকে এখানে দরকার আমার। সেই জানাবে তোমাদেরকে কি করতে হবে।
টেলিফোন মেসেজটা কিচেন থেকে রিসিভ করল টম হেগেন। এখানে কর্লিয়নি পরিবারের গৃহকত্রী উপস্থিত রয়েছেন। মেয়ে কনির জন্যে নাস্তা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে আছেন তিনি। গলা শান্ত আর মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিল হেগেন ফোনে কথা বলার সময়, কি ঘটে গেছে তার কিছুই টের পাননি বৃদ্ধা। ইচ্ছা থাকলে টের যে পেতেন না এমন নয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ডন কর্লিয়নির সাথে ঘর-সংসার করার ফলে এইটুকু জ্ঞান তার হয়েছে যে যাই ঘটুক না কেন, নিজে থেকে কিছু লক্ষ না করাই সব দিক থেকে ভাল। বেদনাদায়ক কিছু, যদি জানতেই হয়, কেউ না কেউ অচিরেই তা জানাবে তাকে। কানে তুলো আর চোখে ঠুলি পরলে সেই বেদনা ভোগ করা থেকে যদি রেহাই পাওয়া যায়, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে, সেটাই বা মন্দ কিসের! পুরুষদের বেদনা আর মানসিক অশান্তির ভাগ নিতে তিনি রাজী নন, তারা তো আর মেয়েদের বেদনার অংশ নিতে আসে না। তার চেহারায় ভাবের লেশমাত্র নেই। নির্বিকার চিত্তে কফি ফোঁটাচ্ছেন কনির মা, খাবার সাজাচ্ছেন টেবিলের উপর। ব্যথা আর ভয়তে খিদে মিটে যায় বলে বিশ্বাস করেন না তিনি, তাঁর অভিজ্ঞতা বরং উল্টো কথা বলে। তিনি জানেন, পেটে কিছু পড়লে ব্যথা জিনিসটা তবু কমে। কখনও কোন ডাক্তার যদি ব্যথা কমাবার জন্যে তাকে ওষুধ দেয়, তার। উপর ভীষণ রেগে যান তিনি। তবে একটুকরো রুটি আর এক কাপ কফি দিলে, সেটা আলাদা কথা। সন্দেহ নেই, কর্লিয়নি পরিবারের গৃহকত্রী আরও আদিম একটা সংস্কৃতি নিয়ে জন্মেছেন।
তাই তিনি কোন প্রশ্ন করে টম হেগেনকে আটকে রাখার চেষ্টা করলেন না। কোন কৌতূহল বা উদ্বেগ প্রকাশ করে তাকে মহা একটা বিপদে ফেলে দিলেন না। অনায়াসে টমকে তিনি পালিয়ে যেতে দিলেন।
কোণার সভাঘরে পালিয়ে এসেছে টমহেগেন। ঘরে ঢুকেই থরথর করে কাঁপছে সে। অদম্য কাপুনিটা কোনভাবেই চেষ্টা করে থামাতে পারছে না! দুই পা এক সাথে চেপে, ঘাড় কুঁজো করে, মাথাটা গুঁজে, দুই হাঁটুর মাঝখানে হাত দুটোকে এক সাথে শক্ত মুঠো পাকিয়ে এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে পড়ল সে, যেন খোদ শয়তানের কাছে মিনতির সাথে ক্ষমা চাইছে।
যুদ্ধরত একটা পরিবারের উপদেষ্টা হবার যোগ্যতা যে ওর নেই, তা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে টম হেগেন। পাঁচ পরিবার ওকে তাদের অভিনয়ের সাহায্যে সম্পূর্ণ বোকা বানিয়ে ছেড়েছে, ঠকিয়ে ভূত করে দিয়েছে। চুপচাপ, নিঃসাড় পড়ে থেকে, মারের উপর মার খেয়ে সমস্ত হজম করে, এই ভয়ঙ্কর ফাঁদটা পেতেছিল ওরা। ষড়যন্ত্র পাকা করে, ফন্দি এটে, ২টি বুজে ওত পেতেছিল ওরা। আহত, রক্তে ভেজা হাত মাথার উপর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তুলে রেখেছিল, এদিক থেকে শত গুতো খেয়েও সহস্র প্ররোচনাতেও পাল্টা মার দিতে রাজী হয়নি। এসবের পিছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল পাঁচ পরিবারের। মোক্ষম একটা আঘাত হেনে কর্লিয়নিদের একটা স্তম্ভকে ধ্বংস করে দেবে। তাই দিয়েছে। প্রাক্তন বুড়ো কনসিলিয়রির চোখে ওদের এই ছল অবশ্যই ধরা পড়ে যেত। এ-ভুল কখনোই হত না তার। ইঁদুরের গন্ধ আগেই এসে লাগত তার নাকে। তিনশো গুণ সতর্কতা অবলম্বন করত সে, ধোয়া দিয়ে ঠিক বের করে আনত গর্ত থেকে ইঁদুর।
নিজের সম্পর্কে এই সমস্ত ধিক্কারসূচক চিন্তার উপর প্রচণ্ড শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে টম হেগেন। ওর সত্যিকার শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু আর ভাই ছিল সনি কর্লিয়নি। ও ছিল তার ত্রাণকর্তা। সেই ছোটবেলার কথা, সনি ছিল টমের আদর্শ পুরুষ। তার সাথে কখনোই তো নীচ আচরণ করেনি সনি, জীবনে কখনও একটা কটু কথা পর্যন্ত বলেনি তাকে, সব সময় আপন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মত ব্যবহার করেছে। তাকে যখন মুক্তি দিল সালোযো, বাড়ি ফিরে আসতেই, বন্ধুকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছিল সনি দুজনের সাথে দেখা হওয়ায়, আন্তরিক আনন্দ পেয়েছিল সনি। বড় হয়ে নিছুর, রক্তলোলুপ, হিংস্র হয়ে উঠেছিল সনি–কিন্তু তাতে টম হেগেনের কি?
প্রচণ্ড আতঙ্কে কিচেন থেকে পালিয়ে এসেছে টম। জানে, মাকে কিছুতেই ছেলের মৃত্যু-সংবাদ শোনাতে পারবে না সে। ডনকে সবসময় মনে হয়েছে নিজেরই বাবা, সনিকে মনে হয়েছে নিজেরই ভাই, কিন্তু সনির মাকে তার কখনও নিজের মা বলে মনে হয় না। ফ্রেডি, কনি আর মাইকেলকে যেমন স্নেহ করে টম, তেমনি ভালবাসে ওদের মাকেও। কারও কাছ থেকে দয়া পেলে তাকে যেভাবে শ্রদ্ধা করা যায়, সেটাকে ঠিক ভালবাসা বলা যায় না। যাকে বলে অন্ধ ভালবাসা, সনির মায়ের উপর সেটা নেই টমের, তবু টম এ-খবর তাকে নিজের মুখে দিতে পারবে না। কমাসই বা হয়েছে, এই অল্প কদিনেই তিনি তার সব কটা ছেলেকে হারালেন প্রাণ নিয়ে সিসিলিতে লুকিয়ে রয়েছে মাইকেল, ফ্রেডি নেভাডায় নির্বাসিত, আর এখন সান্তিনোকেও তিনি হারালেন চিরতরে। তিন ছেলের মধ্যে কে তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র? কাকে তিনি সবচেয়ে ভালবাসেন? তা তো কখনও প্রকাশ পায়নি তার কথায় বা আচরণে!
ফোন পাবার পর এক মিনিট পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছে টম হেগেন। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে কনির নাম্বারে ডায়াল করল ও। অপরপ্রান্তে বেজেই চলেছে রেল, কেউ রিসিভার তুলছে না। অনেকক্ষণ পর তুলল, ফিসফিস করে নিজের পরিচয় দিল কনি।
আশ্চর্য নরম সুরে বলল টম হেগেন, কনি, আমি টম বলছি। কার্লোর ঘুম ভাঙিয়ে ওকে আমার কথা বলো, জরুরী একটা কথা আছে ওর সাথে আমার।
সন্ত্রস্ত, নিচু গলায় জানতে চাইল কনি, টমটম, এখানে কি আসছে সনি?
না, কনি, মৃদু কোমল সুরে বলল হেগেন। সনি তোমাদের ওখানে যাচ্ছে। কোনও ভয় নেই। কার্লোকে শুধু ডেকে দাও, আমার কথা বলো ওকে। দেরি করো না, লক্ষ্মী বোন। খুব জরুরী ব্যাপার।
টম, ভয়ঙ্করভাবে আমাকে মেরে?F ও, চাপা সুরে কেঁদে ফেলে বলল কনি। বাড়িতে ফোন করেছি জানতে পারলে কাজ আমাকে মেরেই ফেলবে।
না। আর মারবে না তোমাকে ক দিচ্ছি। আমার কথা বিশ্বাস করো, দৃঢ় কিন্তু শান্ত গলায় বলল হেগেন। ওর সাথে আমাকে শুধু কথা বলতে দাও। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বলো, খুবই জরুরী একটা প্রসঙ্গে আলাপ করতে চাই আমি। এখুনি ফোনে আমার সাথে কথা বলা খুব বেশি দরকার ওর। বুঝতে পারছ তো?
পাঁচ মিনিট অপর প্রান্তে আর কারও সাড়া নেই। তারপর ঘুম আর মদের নেশায় জড়ানো, কার্লোর গলা পেল হেগেন।
যত অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব কার্লোকে সজাগ করে ভোলার জন্যে আশ্চর্য তীব্র কণ্ঠে বলল টম হেগেন, শোনো, কার্লো। নিজেকে তৈরি করে নাও। সাঙ্ঘাতিক একটা খবর দিতে যাচ্ছি তোমাকে! খবরটা শোনার পর তোমার চেহারায় কোন রকম প্রতিক্রিয়া যেন না হয়। আমার কথা সব বুঝতে পারছ? খবরটা শোনার পর এমন ভাব দেখাবে যেন কিছুই হয়নি। কনিকে জানিয়েছি তোমার সাথে বিশেষ জরুরী একটা আলাপ আছে। বিষয়টা সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে ও।
কি বলব ওকে? জানতে চাইল কার্লো!
কার্লোর গলার স্বরটা গভীর মনোযোগের সাথে শুনল হেগেন। বিমূঢ় একটা ভাব রয়েছে তার গলার সুরে, কিন্তু এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। বিমৃঢ় ভাবটার সাথে রয়েছে একটু কৌতূহলের পরশ। এ থেকেও কিছু প্রমাণ হয় না। তার মানে, কার্লো অভিনয় করছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলার কোন উপায় নেই।
ওকে তুমি জানাবে যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বলল হেগেন, তোমাদের সংসারটাকে লং বীচের উঠানের একটা বাড়িতে তুলে নিয়ে আসা হবে। আরও বলবে যে তোমাকে একটা বড় ধরনের কোন কাজ দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ডন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তোমাদের পারিবারিক জীবনটা যাতে আরও সুখের হয় তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। সববুঝতে পারছ তো?
হ্যাঁ। ঠিক আছে। কার্লোর কণ্ঠৰূরে আশার সুর পাওয়া যাচ্ছে।
একটু পরই তোমাদের দরজায় নক করবে আমার দুজন লোক, বলল হেগেন। তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসার জন্যেই যাচ্ছে ওরা। কিন্তু ওরা পৌঁছুলেই ওদেরকে বলবে আমাকে যেন একটা ফোন করে। শুধু এই একটা কথা। আর কিছু বলবে না। ওদের আমি নির্দেশ দেব কনির সাথে ওখানেই থাকবে তুমি। সব বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ–অবশ্যই, উত্তেজিতভাবে বলল কার্লো। হেগেনের কণ্ঠস্বরে চাপা উত্তেজনা টের পেয়ে গেছে সে। এতক্ষণে সজাগ, সতর্ক হয়ে উঠেছে যেন। পরিষ্কার সব টের পাচ্ছে সে। গুরুতর কোন খবর আছে।
খবরটা দেবার সময় কোন ভূমিকা করল না হেগেন। স্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত ভাষায় বলল, এই একটু আগে মেরে ফেলেছে ওরা সনিকে। সাবধান, কিছু বলো না আমাকে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তাই জানো না, কনি ওকে ফোন করেছিল। কনির ফোন পেয়ে তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছিল সনি। কিন্তু খবরদার, এ-কথা কোনভাবেই যেন জানতে না পারে কনি-আমি তা চাই না। কিছু একটা সন্দেহ করবে, করুক–আসল কথাটা যেন কোনভাবেই টের না পায়। জানতে পারলেই ভাববে, ওর দোষেই বুঝি মারা গেছে সনি। শুধু আজকের রাতটা তুমি ওখানেই, ওর কাছেই থাকে। কিন্তু যতই জানতে চেষ্টা করুক, কিছু বলো না। ঝগড়া-বিবাদ যা হবার হয়েছে, সব মিটমাট করে নাও। আদর্শ মামীর মত ব্যবহার করো। অন্তত ওর ছেলে না হওয়া পর্যন্ত খুব ভাল ব্যবহার করে যেতে হবে ওর সাথে তোমাকে। কাল সকালে দুঃসংবাদটা শোনানো হবে ওকে। হয় তুমি, নয়তো ওর মা, কিংবা ডন নিজে ওকে বলবেন যে ওর ভাই মারা গেছে। ওর কাছ থেকে এক সেকেণ্ডের জন্যেও নড়ো না তুমি, এই আমি চাই। বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাইছি? আমার এই একটা অনুরোধ শুধু রাখো তুমি, বিনিময়ে আমিও দেখব কিসে তোমার ভবিষ্যৎ ভাল হয়। কিছু বলার আছে তোমার?
না, টম, কাঁপতে শুরু করেছে কার্লোর গলা। তোমার অনুরোধ একশোবার রাখব আমি, সে-কথা আমাকে আর তোমার মনে করিয়ে দিতে হবে না। শোনো, টম, তোমার সাথে আমার তো চিরকালই খুব ভাল সম্পর্ক, তাই না? যীশুর কিরে, তোমার প্রতি আমি সাঙ্ঘাতিক কৃতজ্ঞ আর ঋণী। বিশ্বাস করো।
করলাম, বলল হেগেন। তোমাকে সম্পূর্ণ আশ্বাস আর নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি আমি, কার্লো, কনির সাথে তুমি ঝগড়া করেছিলে বলে যা ঘটে গেছে সেজন্যে কেউ তোমাকে দায়ী করবে না। এব্যাপারে এতটুকু দুশ্চিন্তা করার কোনও দরকার নেই তোমার। যা করার আমি করব, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। একটু বিরতি নিল হেগেন, তারপর কার্লোকে উৎসাহ যোগাবার জন্যে আবার বলল, যাও এবার, কনির যত্ন নাওগে। ফোনের কানেকশন কেটে দিল টম।
ডন কর্লিয়নির কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছে টম হেগেন, তাই কাউকে হুমকি দিতে বা শাসাতে শেখেনি সে। তবে, তার কথার একমাত্ৰঅর্থটা যে কি তা বুঝতে একটুও অসুবিধে হয়নি কার্লোর। কার্লো জানে, মৃত্যুর কাছ থেকে মাত্র একচুল দূরে রয়েছে সে এখন।
এরপর টেসিওকে ফোন করল হেগেন। এই মুহূর্তে লং বীচে চলে আসতে বলল তাকে। কি দরকার, সে সম্পর্কে কোন আভাসই দিল না। টেসিও অবশ্য কিছু জানতেও চাইল না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল এবার টম হেগেনের বুক থেকে। এইবার তাকে সবচেয়ে ভয়াবহ কর্তব্যটা পালন করতে হবে।
ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি। তার ঘুম ভাঙাতে হবে। দুনিয়ায় যে মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে টম হেগেন, তাকে জানাতে হবে তিনি যে গুরুদায়িত্ব ওর কাঁধে দিয়েছিলেন সেই দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ও! তার সামাজ্য রক্ষা করতে পারেনি ও। তাঁর বড় ছেলের প্রাণ বাঁচাতে পারেনি। তাকে বলতে হবে, এটাই শেষ সুযোগ, এই শেষ মুহূর্তে বিছানা থেকে উঠে তিনি যদি যুদ্ধে নেতৃত্ব গ্রহণ না করেন, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কর্লিয়নি পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার আর কোন উপায় নেই। হেগেনের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কোন ভাবাবেগ, অন্ধবিশ্বাস বা কোন রকম ভুল-ভ্রান্তি নেই। অন্তস্তল থেকে বিশ্বাস করে সে, একমাত্র মহান ডন নিজে এখনও, এই নিদারুণ পরাজয়ের মধ্যে থেকেও, একটা মাত্র অমোঘ চাল দিয়ে উদ্ধার করে তুলে আনতে পারেন কর্লিয়নি পরিবারকে রক্ষা করতে পারেন নিজের এত কষ্টের গড়া ধ্বংসেম্মুখ সামাজ্যকে।
ডন কর্লিয়নির ব্যক্তিগত ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ পর্যন্ত করল না হেগেন। কোন লাভ নেই তাতে। ডাক্তারা এখন যে পরামর্শই দিক না কেন, এখন আর তার কোন গুরুত্ব নেই। এমন কি তারা যদি একবাক্যে জানায়, বিছানা থেকে উঠলে ডন কর্লিয়নির প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়বে, তিনি মারা যেতে পারেন-তবু তাদের কথায়। কান দেবে না টম হেগেন গড় ফাদারকে এই মুহূর্তে সব কথা জানাতে হবে। তারপর তার নির্দেশ শুনতে হবে, তাকে অনুসরণ করতে হবে, অন্ধের মত এবং ডন কর্লিয়নি এই শেষ মুহূর্তে কি করবেন না করবেন সে-বিষয়ে কোন রকম দ্বিধা বা সংশয় দেখা দিতে পারে না, উঠতে পারে না কোনও প্রশ্ন ডাক্তারদের পরামর্শ এখন অবান্তর হয়ে গেছে, সমস্ত কিছুই এখন মূল্যহীন, অবান্তর হয়ে গেছে। সব কথা জানাতে হবে ডন কর্লিয়নিকে, এটাই এই মুহূর্তের একমাত্র কাজ। সব শুনে হয় তিনি নিজ সামাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন, নয়তো পাঁচ পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে কর্লিয়নিদের সমস্ত ক্ষমতা, তাদের কাছে বিলিয়ে দিতে হবে নিজেদের সমগ্র অস্তিত্ব। এর কোন বিকল্প নেই।
এত পরিচ্ছন্নভাবে সব কিছু চিন্তা করতে পেল্পেও পরবতী একটা ঘণ্টাকে সর্বান্তঃকরণে ভীষণ ভয় পাচ্ছে টমহেগেন। নিজের ভূমিকাটা কি হবে সে ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হচ্ছে তাকে। মনে মনে একটা ছকও তৈরি করে ফেলল। হ্যাঁ অবশ্যই, নিজের অযোগ্যতার কঠিন বিচার করতে হবে তাকে যে ভুল সে করেছে। তা অস্বীকার করার কথা একবারও উদয় হলো না হেগেনের মনে তরে, বিশ্লেষণ করে এ-কথাও ভাবল সে যে নিজেকে বেশি দোষ দিতে গেলে গড ফাদারের দায়িত্বের বোঝা আরও ভারিই করা হবে শুধু। নিজের শোকের প্রচণ্ডতা প্রকাশ করতে গেলে গড ফাদারের শোকটাই তীব্র করে তোলা হবে শুধু। যুদ্ধরত একটা পরিবারের উপদেষ্টা হবার যোগ্যতা তার নেই এ-কথা সে যদি মুখ ফুটে বলে, এমন একজন অপদার্থ লোককে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পদে এতদিন বহাল রাখার জন্যে ডন নিজেও নিজেকে অপরাধী, দোষী ভাববেন। তাই এমন কিছু তাকে বলা চলবে না যাতে তার মানসিক যন্ত্রণার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।
তাই সিদ্ধান্ত নিল টম হেগেন, খবরটা আর সব সাধারণ খবরের মত করেই শোনাতে হবে গড ফাদারকে। তারপর তাকে সে জানাবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে এখন কি করতে হবে তা নির্ধারণের জন্যে সব দায়িত্ব নিতে হবে তাকে। কেন, তাও বিশ্লেষণ করে দেবে হেগেন। ব্যস, এইটুকু। এরপর চুপ করে থাকবে সে। অপেক্ষা করবে ডনের নির্দেশের জন্যে। ওর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা নির্ভর করবে ডনের ওই আদেশের উপর। গড ফাদার যদি চান সে তার অপরাধ স্বীকার করুক, অকুণ্ঠচিত্তে তাই করবে হেগেন। তিনি যদি আশা করেন সে শোক প্রকাশ করুক, অন্তর থেকে তাই করবে হেগেন।
গাড়ির শব্দ। মাথা তুলে তাকাল হেগেন। দেখল, উঠানে গাড়ি ঢুকেছে। এসে পৌঁছাচ্ছে ক্যাপোরেজিমিরা। ওদেরকে আগে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে তার, তারপর ঘুম ভাঙাবে গড ফাদারের। উঠে দাঁড়াল হেগেন। ডেস্কের পাশে কেবিনেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কেবিনেট খুলে একটা গ্রাস আর একটা মদের বোতল বের করল। সেই মুহূর্তে সেখানেই স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল হেগেন, একচুল নড়ার শক্তি নেই তার। সমগ্র অস্তিত্ব এমন সাঙ্ঘাতিকভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছে যে বোতল থেকে গ্রাসে মদ ঢালবে সে-ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই তার। হঠাৎ, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে, একটা শব্দ এল পিছন থেকে। দরজা খোলা এবং ভিতর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যাবার আওয়াজ। ধীরে ধীরে পিছন ফিরল টম হেগেন।
ডন কর্লিয়নি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। গুলি খেয়ে আহত হবার পর এই প্রথম কাপড়চোপড় পরে রোগশয্যা শ্রাগ করে উঠে এসেছেন।
বিশাল কামরার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে এলেন ডন কর্লিয়নি। তাঁর নিজের চামড়া বাঁধানো প্রকাও আরাম কেদারাটায় বসলেন ধীরে ধীরে। তার হাঁটাটা লক্ষ করল হেগেন, একটু আড়ষ্ট ভাব রয়েছে। পোশাকগুলো শরীরে দিলে হয়ে ঝুলছে। কিন্তু হেগেনের তবু মনে হলো, তাকে দেখতে বরাবর এই রকমই লাগে। এখন কে বরং আরও শক্ত বলে মনে হচ্ছে, যেন মনের জোরে শরীর থেকে সমস্ত দুর্বল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসেছেন তিনি। তবে, শরীরটা যে এখনও পুরোপুরি সারেনি তাও বোঝা যাচ্ছে মুখটা গম্ভীর। একটু অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর। সেই গাম্ভীর্যের সাথে আগের সমস্ত শক্তি আর বলিষ্ঠতা প্রকাশ পাচ্ছে। শিরদাঁড়া খাড়া করে আরাম কেদারায় বসে আছেন তিনি। কনসিলিয়রিকে বললেন, দাও, আমাকেও এক ফোঁটা অ্যানিসেট দাও।
বোতল বদল করে নিয়ে এল হেগেন। যষ্টি-মধুর গন্ধ মেশানো ঝাঝালো পানীয় ঢালল দুটো গ্লাসে। ঘরে তৈরি, এ-জিনিস দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না পুরানো এক বন্ধুর উপহার। প্রত্যেক বছর এক গাড়ি এই অ্যানিসেট পাঠিয়ে দেয় সে কর্লিয়নিদের বাড়িতে।
ঘুমুতে গিয়ে কাঁদছিলেন আমার স্ত্রী, বললেন ডন কর্লিয়নি। জানালা দিয়ে দেখলাম, আমার ক্যাপোরেজিমিরাও এল সবাই। এখন তো রাত দুপুর। তাই, হে আমার প্রিয় কনসিলিয়রি, সবাই যা জানে সেটা তোমার ডনকেও জানানো উচিত।
মাকে কিছু বলিনি আমি, শান্ত গলায় বলল হেগেন। আপনার ঘুম ভাঙিয়ে সব কথা এখুনি আপনাকেই বলতে যাচ্ছিলাম।
ভাবলেশহীন চেহারা ডন কর্লিয়নির। বললেন, কিন্তু আমাকে বলার আগে একটু মদ খেয়ে নেবার দরকার হয়েছিল।
হ্যাঁ, স্বীকার করল হেগেন।
এখন তো মদ খাওয়া হয়ে গেছে, বললেন ডন কর্লিয়নি। হেগেন দুর্বল হয়ে পড়েছে লক্ষ করে মৃদু অভিযোগের সুর ফুটল ভর কণ্ঠে। এবার আমাকে বলতে পারো।
বাঁধের ওপর গুলি করেছে ওরা সনিকে, বলল টম হেগেন। মারা গেছে সনি।
চোখ পিট পিট করছেন ডন কর্লিয়নি। মাত্র এক নিমেষের জন্যে তাঁর সমস্ত মনোবল প্রায় ধ্বসে পড়ল, তার সমস্ত জগৎ সমগ্র অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ল তার, শরীর থেকে শেষ শক্তি বিন্দুটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। চেহারা দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সব। কিন্তু তা ওই এক নিমেষের জন্যে মাত্র। তারপরই নিজেকে সামলে নিলেন গড ফাদার।
কয়েক মুহূর্ত পরই একজন বুডিগার্ড ঢুকল সভাঘরে। ক্যাপোরেজিমিদের নিয়ে এসেছে সে। ক্যাপারেজিমিরা সাথে সাথে বুঝতে পারল ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন গড় ফাদার, কারণ ওদেরকে দেখা মাত্র আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
গড ফাদারকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করছে ওরা। এটা ওদের পুরানো বন্ধুত্বের অধিকার। তারপর সবাই একটু করে অ্যানিসেট পান করল। আজ রাতের ঘটনা বর্ণনা দেবার আগে হেগেন নিজ হাতে সবাইকে ঢেলে দিল মদ
সব বলল হেগেন। শুনলেন ডন কর্লিয়নি। তারপর শুধু একটা প্রশ্ন করলেন, আমার ছেলে মারা গেছে, ঠিক জানো?
হ্যাঁ, উত্তরটা দিল ক্যাপোরেজিমি পাট ক্লেমেঞ্জা। সনির দল থেকে আমি নিজে বাছাই করে নিয়েছিলাম বডিগার্ডদের। আমার বাড়িতে যখন ফিরে এল ওরা, আমি নিজে ওদেরকে প্রশ্ন করে সব জেনে নিয়েছি। তোলাখানার আলোয় পড়ে ছিল সনি, পরিষ্কার দেখে এসেছে ওরা। ওদের বর্ণনা শুনে বুঝলাম, ও-ধরনের আঘাত নিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। সনি মারা যায়নি একথা প্রমাণ হলে নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত দিতে রাজী রয়েছে বডিগার্ডরা।
চরম বাস্তবকে নিঃশব্দে মেনে নিলেন ডন। কোনরকম ভাবাবেগ প্রকাশ করলেন না। শুধু চুপ করে আছেন।
কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি, তোমরা কেউ এই ব্যাপারটা নিয়ে ব্যস্ত হবে না। কোন প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা নয়। আমার আদেশ ছাড়া আমার ছেলের খুনীকে খুঁজে বের করার কোন তদন্ত নয়। আমি প্রকাশ্যে মুখ ফুটে না বলা পর্যন্ত আমাদের তরফ থেকে পাঁচ পরিবারের সাথে আর যুদ্ধ নয়। আমাদের পরিবারের সমস্ত ব্যবসা এই মুহূর্ত থেকে বন্ধ করে দেয়া হলো, যতক্ষণ না আমার ছেলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হচ্ছে। ধু তারপরই আবার আমরা একসাথে বসে ইতিকর্তব্য স্থির করব, তার আগে নয়। আজকের দিনটা সান্তিনোর দিন। তার জন্যে যতটা আমাদের সাধ্যে কুলায় তার সবটুকু করব আমরা, একজন খৃশ্চানের উপযুক্ত আয়োজন সম্পন্ন করে তাকে আমরা সমাধিস্থ করব। পুলিশ আর অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সাথে আমার বন্ধুরা সমস্ত ব্যবস্থা, যা যা করা দরকার, সব ঠিকঠাক করে রাখবে। ক্লেমেঞ্জা, তুমি আমার পাশে, আমার ছায়া হয়ে থাকবে সব সময় তুমি আর তোমার দল। টেসিও, তুমি। আমার গোটা পরিবারকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবে-তুমি আর তোমার দল। কনসিলিয়রির দিকে ফিরলেন ডন কর্লিয়নি, বললেন, টম, আমার ইচ্ছা তুমি একটা ফোন করে আমেরিগো বনাসেরাকে বলো যে আজ রাতে কোন এক সময় ওর। সাহায্য দরকার হবে আমার। সে যেন তার কাজের জায়গায় আমার জন্যে অপেক্ষা করে। এক, দুই, এমন কি তিন ঘণ্টাও দেরি হতে পারে আমাদের। তোমরা কেউ আমার কথা বুঝতে না পেরে থাকলে প্রশ্ন করতে পারো।
নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ওরা তিনজনই জানাল যে গড ফাদারের প্রতিটি আদেশ বুঝতে পেরেছে ওরা।
ক্লেমেঞ্জা, ডন কর্লিয়নি বললেন, কয়েকটা গাড়ি আর কিছু লোক নিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করো। তৈরি হতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না আমার। টম, ভাল কাজ করেছ তুমি কাল সকালে, ওর মায়ের কাছে নিয়ে এলো। কনস্ট্যানশিয়াকে। ও আর ওর স্বামী যাতে উঠানে থাকতে পারে তার ব্যবস্থাও করবে তুমি! সার্ভার যত বান্ধবী আছে তাদের সবাইকে ওর কাছে পাঠিয়ে দাও, তারা ওর কাছে থাকুক। আমি আমার স্ত্রীর সাথে একটু কথা বলব, তারপর তিনিও ওর কাছে যাবেন। দুঃসংবাদটা আমার স্ত্রীই শোনাবেন ওকে। তারপর মেয়েরা সবাই গির্জায় যাবে, সেখানে তারা আমার ছেলের আত্মার কল্যাণের জন্যে প্রার্থনার ব্যবস্থা করবে।
বিশাল আরাম কেদারা ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। আর সবাইও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। তাকে আবার নিজেদের বুকে জড়িয়ে ধরে। আলিঙ্গন করল ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও। কামরা থেকে বেরিয়ে যাবেন ডন, তাই দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে আছে টম হেগেন। বেরিয়ে যাবার সময় একটু থামলেন ডন, ওর মুখের দিকে তাকালেন তারপর ওর মুখে হাত বুলিয়ে তাড়াতাড়ি একটু আদর করলেন, বললেন, তুমি আমার ভাল ছেলে। তোমার কাছে এলে আমি শান্তি। পাই! কথাটার মানে হলো এই ভয়ঙ্কর সময়ে টম হেগেন তার উচিত কাজই করেছে!
নিজের বেডরুমে উঠে গেলেন ডন কর্লিয়নি। এখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে কথা বলবেন।
এই সময় আমেরিগো বনাসেরাকে ফোন করে ঈম হেগেন বলছে, কর্লিয়নিদের পাওনা উপকারটা এবার তাকে পরিশোধ করতে হবে।