৩.৫ সনাতন ও আধুনিক
আমাদের অহংকার, আমরা অত্যন্ত সহনশীল জাতি। এই সিদ্ধান্ত একেবারে ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু এর স্বপক্ষে অতি পরিচিত যুক্তিগুলির পুনরাবৃত্তি করব না; কারণ এতে আমাদের তেলে মাথাকে আরও তৈলাক্ত করা হবে মাত্র। আপাতত আমার বক্তব্য ভিন্ন, যদিও অনুমান করি যে এই ভিন্ন বক্তব্যটিকেও অনেকেই উল্লিখিত সনাতন সিদ্ধান্তের সঙ্গে অভিন্ন বিবেচনা করতে বিলম্ব করবেন না।
আমাদের চিন্তা ও ধর্মচেতনার একটা বড় দুর্বলতা এই যে, আমরা সংশয়কে জোরের সঙ্গে অনুভব করতে অভ্যস্ত নই। যত মত তত পথ একথা যদি সত্য হয় তবু মনে রাখা ভালো যে, একই ব্যক্তি যদি একাধিক মত ও পথ একই সঙ্গে অবলম্বন করেন তবে সন্দেহ করবার কিছুটা কারণ ঘটে যে এর কোনোটিকেই তিনি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করেননি। রামকৃষ্ণ, সুভাষচন্দ্র ও লেনিনকে যিনি একই মুহূর্তে গ্রহণ করেন তিনি সম্ভবত এঁদের কারও প্রতি সুবিচার করছেন না। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে। বিবেকানন্দের মত লেনিনের (এবং লেনিনের মত বিবেকানন্দের) কাছে গ্রহণযোগ্য হত না। বিভিন্ন মতেই সত্যের ভগ্নাংশ আছে বটে। কিন্তু কোন্ মতে কতটুকু সত্য আছে। তারও বিচার প্রয়োজন। যে-খণ্ডসত্য মতবিশেষে বিধৃত তার সীমা নির্ধারণ করেই তাকে সঠিক জানা যায়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ধর্ম নতুন রূপ ধারণ করেছে। মানুষের চেতনার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নব নব সংশয়ের ভিতর দিয়ে ধর্মের সত্য নতুনভাবে। উচ্চারিত হয়েছে। ধর্মের যদি কোনো সম্পূর্ণ কালোত্তীর্ণ সার থাকে তবে তা সম্ভবত অনুচ্চার্য। উচ্চারিত ধর্মকে যুগ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করা ভুল; কারণ তাতে জীবনের প্রয়োজন থেকেই তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
.
১
ধর্মের সত্য যখন একই বাক্যে প্রকাশিত হয়েছে তখনও যুগভেদে সেই বাক্যের অর্থে পৌঁছবার পথ বদলে গেছে, অতএব তার ঐতিহাসিক তাৎপর্যেরও পরিবর্তন ঘটেছে। উদাহরণত পাশ্চাত্ত্য ইতিহাসের একটি অধ্যায় অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
বিশ্বাসই মুক্তির পথ, এটা ধর্মের একটি প্রাচীন কথা। আধুনিক যুগ শুরু হবার আগে কথাটার একটা সরল অর্থ ছিল। সন্তান যেমন নিশ্চিন্তে পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল, মানুষের পক্ষে তেমনই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা সেদিন কঠিন ছিল না। আধুনিক যুগের গোড়াতেই যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হল।
এই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে গিয়ে বহু মানুষ একটি সিদ্ধান্তে নানাভাবে ফিরে এসেছেন। সিদ্ধান্তটি এই যে, ধর্মের যেটুকু গ্রহণীয় তা যুক্তির অতীত, কিন্তু যুক্তিবিরুদ্ধ নয়। যেমন খৃষ্টীয় তের শতকে সেন্ট টমাস একুইনাস বললেন যে, খৃষ্ট ধর্মের সত্য যদিও সাধারণ যুক্তিকে অতিক্রম করে যায় তবু যুক্তির সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই (“although the truth of the Christian faith surpasses the capacity of the reason, nevertheless that with truth ___ ____ ____.” এমনি করে যুক্তি ও বিশ্বাসের ভিতর সন্ধি স্থাপিত হল। বলা বাহুল্য যে, প্রাচীন বিশ্বাসের সঙ্গে এই নতুন ধারণা সমার্থক নয়।
কিন্তু এখানেও সমস্যার সর্বসম্মত সমাধান পাওয়া গেল না। তর্কের অবকাশ রইল। আমরা সংসারে প্রতিনিয়ত দেখছি যে, নিদোষ মানুষ নিগ্রহ ভোগ করছে। ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাসের সঙ্গে সংসারের এইসব প্রত্যক্ষ অন্যায়কে কিছুতেই সাধারণ যুক্তি দিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করা যায় না ভগবান কাকে যে কৃপা করবেন আর কাকে করবেন না তার কোনো ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা হয় না। যোড়শ শতকে এরাসমুসের সঙ্গে তর্কে যুক্তি ও বিশ্বাসের সন্ধিতে অনাস্থা জানিয়ে প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের নেতা লুথার বললেন “Common sense and natural reason are highly offended that God by his mere will deserts, hardens and damns. There is no use trying to get away from this by ingenious distinctions.” শুধু সৎকার্যের পুরস্কারস্বরূপ ঈশ্বরের করুণা লাভের আশা। ত্যাগ করাই উচিত। মানুষের যুক্তির পথ ধরে ভগবানের ইচ্ছা চলে না। অতএব। অহেতুক বিশ্বাসের ভিতর দিয়েই মুক্তির ইঙ্গিত আসে।
হঠাৎ মনে হতে পারে যে, আমরা প্রাচীন যুক্তিবিহীন বিশ্বাসেই আবার ফিরে এলাম। কিন্তু যে ঐতিহাসিক পরিক্রমার ভিতর দিয়ে এই প্রত্যাবর্তন তারই ফলে এই নতুন। সিদ্ধান্তের ভাবার্থও ভিন্ন। যে-যুক্তির সাহায্যে লুথার যুক্তি থেকে বিশ্বাসকে বিচ্ছিন্ন না করলেন তারই জের টেনে আবার ঈশ্বরকেই বিশ্বাস থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব। ভগবান। সর্বশক্তিমান অথচ ন্যায়বোধহীন একথা অবিশ্বাস্য; অতএব ঈশ্বর নেই।
তারপরও জীবনে বিশ্বাসের স্থান থাকে। ব্যারট্রান্ড রাসেল বাল্যে পিউরিট্যান ঐতিহ্যে লালিত হয়েছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান এবং অবশেষে এই প্রত্যয়ে আসেন যে করুণাই ধর্ম “The thing I mean is love, Christian love, or compassion…. If you have this, you have all that anybody should need in the way of religion.” (“Science and Value’) ঈশ্বর যদি নাও থাকেন তবু মানুষের প্রতি প্রেম অথবা করুণা রক্ষা করেই মানুষের মুক্তি সম্ভব।
ঈশ্বরে বিশ্বাসের মতনই এই করুণা যুক্তিকে অতিক্রম করে যায়, যদিও যুক্তির সঙ্গে এর। বিরোধ নেই। সংশয়বাদী রাসেল ইতিহাসের একটি দীর্ঘ অধ্যায়কে ব্যক্তিগত জীবনে অতিক্রম করেন।
আমরা নিঃসংশয়ে মাতৃপূজা থেকে নাস্তিক্য পর্যন্ত সবই গ্রহণ করেছি। ফলে আমাদের চিন্তা গতিহীন হয়ে পড়েছে।
.
২
গীতায় ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগের উপদেশ আছে। এই উপদেশের একটা গভীর তাৎপর্য আছে সন্দেহ নেই। কোনো বিশেষ ফললাভ অর্থাৎ স্বার্থসিদ্ধি যে-ভালোবাসার উদ্দেশ্য তাকে যেমন আদর্শ ভালবাসা বলা যায় না, ভালোবাসার শেষ লক্ষ্য যেমন মুক্তি, জীবনও তেমনই।
কিন্তু এর পরিপূরক একটি সত্যও এই সঙ্গে স্বীকার্য। যদি লোকহিতের জন্য কাজ করতে হয় তো লোকহিতরূপ ফলে আমাদের আগ্রহ থাকা বাঞ্ছনীয়; এবং এই ফল যাতে লাভ হয় কর্মকে তার উপযোগী করাও কর্তব্য। অর্থাৎ মানুষের মহত্তম প্রেরণাকে কোনো এক স্তরে ফলাকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত করেও অন্য স্তরে তাকে ফলাফলের গণনার সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। অন্তত আধুনিক যুগে ফলের দ্বারাই কর্মের বিচার হয়। এই বিচারপদ্ধতি বহু পরিমাণে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রগতির পথকে আলোকিত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে ধর্মের ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে এই দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া সে সবও বোধগম্য হয় না।
পাশ্চাত্ত্য জগতে শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মসংক্রান্ত মৌলিক ধ্যানধারণার যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে এই প্রসঙ্গে সেটা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ বিষয়ে টনি ও ম্যাক্স ওয়েবরের পুস্তকের সঙ্গে এদেশেও অনেকেই পরিচিত।
সময় যে সোজা পথে অতীত থেকে ক্রমশই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়, এ-কথাটা আজ আমাদের যতই স্বতঃসিদ্ধ মনে হোক না কেন বস্তুত এটা মোটেই সহজ কথা নয়। বরং প্রকৃতির তালে তালে ঋতু পরিবর্তনের পথ ধরে সময়ের যে-গতি স্বাভাবিকভাবে লক্ষ করা যায় তা হল পুনঃ পুনঃ আবর্তিত বৃত্তাকার গতি। অতীত যে চিরকালের মতোই অতীত, যে সময় হারালাম তা যে কখনই আর ফিরে পাওয়া যাবে না, সময় সম্বন্ধে এই সচেতনতা চিরকালীন নয়। আর পৃথিবীতে আমাদের একবারই জন্ম, প্রতি মুহূর্তে আমরা এই সীমাবদ্ধ সময়কে কশায় কলায় হারাচ্ছি, এই আর্ত অনুভূতিতে আধুনিকতার বিশেষ সুরটি তো খুবই স্পষ্ট।
কিন্তু আপাতত সময়ানুভূতির এই বেদনার্ত সূক্ষ্মতার আলোচনা নিস্প্রয়োজন। বাণিজ্যের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সময়ের গতি সম্বন্ধে মানুষ সচেতন হয়েছে একটি সহজ অর্থে। টাকা ধার নিলে অথবা জমা রাখলে তার ওপর সুদ জমে। কতটা সুদ জমবে সেটা নির্ভর করে সময়ের ওপর শতকরা হিসাবে, যেমন বছরে শতকরা পাঁচভাগ, দশভাগ। বা ঐ রকম কিছু। অতএব ব্যবসায়ী কতটা মাল বিক্রয় করলেন অথবা কি পরিমাণ লাভ করলেন সেটা জানাই যথেষ্ট নয়, কতটা সময়ের ভিতর মাল বিক্রয় হল বা লাভ হাতে এলো সেটাও হিসাব করা আবশ্যক। কোনো কাজ সম্পন্ন হল কি না সেটাই সব কথা নয়, কত শীঘ্র কাজ সম্পন্ন হল তাও বিশেষভাবে বিবেচ্য। আমাদের সমাজে সময়ানুবর্তিতা এবং কাজের গতি দ্রুত করবার দিকে-যে দৃষ্টি নেই এতেই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের জীবনের বহিরঙ্গে আধুনিকতার ছাপ যদি-বা আছে, আমাদের চেতনা এখনও আধুনিক গুণসম্পন্ন হয়নি।
ব্রহ্মচর্য অথবা ইন্দ্রিয়সংযমকে আমরা সনাতন ধর্মের অঙ্গ বলে জানি। কিন্তু এখানেও মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের গোড়ায় পৌঁছে শব্দার্থের অথবা ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যের একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। মধ্যযুগের সাধক জানতেন যে, আমরা যতদিন এই সতত পরিবর্তিত জগতের সঙ্গে আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে অভিন্ন করে দেখি, লোভে এবং ভয়ে এর সঙ্গে জড়িত হয়ে থাকি, ততদিন আমাদের মুক্তি নেই। অতএব তিনি চিত্ত থেকে ছোট ছোট বাসনাকে উম্মুল করতে চাইতেন, যাতে সেই শূন্য হৃদয়ে ভগবানের অবতরণ সম্ভব হয়।
আধুনিক যুগে ইয়োরাপে পিউরিট্যান আন্দোলনের নেতারা ইন্দ্রিয়সংযমকে ব্যবহার করেছেন জাগতিক উন্নতির প্রয়োজনে। তাঁদেরও শেষ উদ্দেশ্য আত্মিক মুক্তি। কিন্তু এই জগতে যার যেখানে স্থান সেখানে অধিষ্ঠিত থেকে সামাজিক কর্তব্য সম্পাদনের ওপর তাঁরা জোর দিলেন। বিশেষভাবে আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধির দায়িত্ব তাঁদের চিন্তায় একটা বড় স্থান লাভ করল। অর্থগৃধুতার দ্বারা একের ধন সম্ভবত অন্যে লাভ করতে পারে; কিন্তু নতুন সম্পদ সৃষ্টি করবার জন্য প্রয়োজন কঠিন পরিশ্রম, সময়ানুবর্তিতা এবং তৎসংশ্লিষ্ট সংযম। ম্যাক্স ওয়েবর তাই পিউরিট্যান ধর্মের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “worldly asceticism” কথাটি ব্যবহার করেছেন। মধ্যযুগের ইন্দ্রিয়সংযমের উদ্দেশ্য ছিল জগৎ থেকে মনকে মুক্ত করা; ক্যালভিন (বা কালভ্যা) যে-ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও পথপ্রদর্শক তার বৈশিষ্ট্য হল, জাগতিক কর্মের ভিতর দিয়ে চরিত্রগঠন। বলা বাহুল্য হিন্দুধর্মেও কর্মযোগের শিক্ষা আছে এবং অর্থকে জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে, এই কথা বলে যদি কেউ পিউরিট্যান আন্দোলনকে আমাদের সনাতন ধর্মের সঙ্গে মেলাতে চান তবে সেটা কিঞ্চিৎ ভুল হবে। সংসারের কর্ম হিন্দুর ধর্মে বর্ণ ও জাতিভেদ দ্বারা নির্ধারিত। আর ইয়োরোপে আধুনিক যুগের আন্দোলনে যে তীক্ষ্ণ সময়-সচেতনতা আছে, আমাদের সমাজে তা নেই।
এই প্রসঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে পরবর্তী রেফর্মেশন এবং বিশেষভাবে পিউরিট্যান আন্দোলনের পার্থক্যের সামান্য উল্লেখ আবশ্যক। মধ্যযুগে ইয়োরোপে ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি ছিল শিক্ষা ও উচ্চ চিন্তার অদ্বিতীয় ধারক। রেনেসাঁসের যুগে ধর্মপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে পড়ল। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকেরা যুক্তিকে মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম বলে জানতেন। রেনেসাঁসের যুগে ইয়োরোপের মনে আত্মবিশ্বাস এবং যুক্তির প্রতি আগ্রহ নতুন করে জাগ্রত হল। এই নবজাগরণের মুহূর্তে ইয়োরোপ ধর্মকে বর্জন করেনি। বরং যুক্তির আলোকে সে ধর্মকে নতুন করে চিনতে চেয়েছে এবং সেই সঙ্গে মানুষ ও প্রকৃতিকে। ফলে একদিকে বিজ্ঞানচচার অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মের অন্বেষণে উৎসাহ প্রসারিত হয়েছে; আর অন্যদিকে মানুষ সম্বন্ধে ধারণা গেছে পালটে। সমাজে ব্যক্তির একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থান আছে, এই রকম একটা ধারণা মধ্যযুগে প্রবল ছিল। রেনেসাঁসের চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, মানুষকে এখন কল্পনা করা হল অনন্তসম্ভাবনাময় অদ্বিতীয় জীব হিসাবে। মানুষের চরিত্র ক্রমশ উদঘাটিত হচ্ছে, অশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষ নিজেকে ক্রমাগত আবিষ্কার করছে। আপনাকে জানা তার কখনও ফুরোবে না।
যুক্তিতে বিশ্বাসী ও মানুষের রহস্যে মুগ্ধ রেনেসাঁসের যে-মন লেওনাদোর চিত্রে পরিস্ফুট ইয়োরোপের আধুনিক ইতিহাসে তার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আর্থিক উন্নতির জন্য চরিত্রের যে অনুশীলন প্রয়োজন তার পক্ষে রেনেসাঁসের বাণী যথেষ্ট ছিল না! শিল্পী। জানেন যে মানুষের হৃদয় রহস্যে আবৃত, তার কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই। কিন্তু কর্মের পথে যিনি নেতা তাঁকে বলতে হয় যে, ব্যক্তিকে তার নির্দিষ্ট স্থানে নিযুক্ত থেকে কর্তব্য সমাপ্ত করবার মতন আত্মসংযমের অধিকারী হতে হবে। সমাজে ব্যক্তির স্থান সম্বন্ধে মধ্যযুগীয় ধারণা ভুল; মানুষের নতুন পথে অগ্রণী হবার অধিকার স্বীকার্য। কিন্তু ব্যক্তি যদি তার অন্তহীন সম্ভাবনার দোহাই দিয়ে পদে পদে নিজের দায়িত্ব এড়াতে চায়, কোনো অবস্থারই মুখোমুখি স্থিরভাবে দাঁড়াতে না পারে, তা হলে সমাজে কোনো বড় কাজ সম্পন্ন করা যায় না।
তা ছাড়া শিল্পোন্নয়নের জন্য আবশ্যক বর্তমানের ভোগ সংকুচিত করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়। বিশেষত শিল্পোন্নয়নের প্রথম যুগে এটা অত্যন্ত প্রয়োজন। এদিক থেকে প্রাচীন আভিজাত্যের সঙ্গে বণিকবুদ্ধির একটা পার্থক্য স্পষ্ট। অভিজাতবংশীয়ের চোখে বণিকের জমাখরচের হিসাবে একটা ক্ষুদ্রতা আছে; বণিক কৃপণ। শুধু যুক্তি দিয়ে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গীর ভিতর একটিকে নির্বাচন করা যায় না। যেহেতু বর্তমানই প্রত্যক্ষ সত্য, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, অতএব ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়কে জীবনে বড় স্থান দিতে হলে এক বিশেষ ধরনের অভ্যাস ও বিশ্বাস প্রয়োজন। পিউরিট্যান আন্দোলন পাশ্চাত্ত্য জগতে শিল্পোন্নয়নের উপযোগী অভ্যাস ও বিশ্বাস সৃষ্টির কাজে সহায়ক হয়েছে। অথবা হয় তো। বলা উচিত যে রেনেসাঁস ও রেফর্মেশন একই সঙ্গে পরিপূরক ও বিরোধী। এদের। ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে ইয়োরোপের প্রগতি সম্ভব হয়েছে।
মোট কথা, ধর্ম অপরিবর্তনীয় নয়; এবং জাগতিক ফল লাভ যদিও ধর্মের শেষ উদ্দেশ্য নয়, তবু জগতের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেই ধর্মের পরিবর্তন ঘটে। নয়তো প্রাচীন ধ্যানধারণার সঙ্গে বর্তমানের অসামঞ্জস্য প্রগতির পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
.
৩
রেনেসাঁসের প্রতিতুলনায় পিউরিট্যান আন্দোলনের যে তাৎপর্য তারই কিছুটা ছায়া পড়েছে এদেশে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর পারস্পরিক বিরোধ ও পরিপূরকতায়।
শ্ৰীমতী মীরা চৌধুরীর যে-খাতাটিতে গান্ধী একবার লিখেছিলেন ‘Never make a promise in haste. Having made it fulfil it at the cost of your life.” C 1015 অন্য পাতায় কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে যোগ করেছিলেন “Surrender your pride to truth, fling away your promise if it is found to be wrong.”
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন মানুষের অন্তহীন ও বহুরূপী সম্ভাবনায়। কোনো প্রাচীন শপথ যদি ব্যক্তিত্বের নব নব অভিব্যক্তির পথে বাধা হয়, তবে সেই শপথের শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলে ব্যক্তিত্বকে মুক্তি দেওয়াই তাঁর কর্তব্য মনে হয়েছে। শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাংগঠনিক কাজ যদিও উল্লেখযোগ্য তরু তাঁর নিজের কাছে কবি পরিচয়টিই প্রধান ছিল। কবি হিসাবেই তিনি মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে এমন একটি নতুন ধারণা তাঁর সাহিত্যে ও চিন্তায় তুলে ধরেছিলেন যাকে বাদ দিয়ে আধুনিকতার দ্বার অতিক্রম করা যায় না।
গান্ধী জানতেন যে, সংকল্পের দৃঢ়তা ছাড়া মহৎ কিছু সম্পন্ন করা যায় না। আর সত্যকে বিসর্জন দিলে সামাজিক সম্পর্কের কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তিই অবশিষ্ট থাকে না। উদ্ধৃত বাক্যে কর্মযোগী হিসাবে নিজের বাক্যে অটল থাকবার প্রয়োজনের ওপরই তিনি জোর দিয়েছেন।
পিউরিট্যান অথবা সংযমী নীতিবাদের দুটি রূপ, মধ্যযুগীয় ও অপেক্ষাকৃত আধুনিক, আগে আলোচনা করেছি। এ দুয়ের ভিতর অনেক পার্থক্য। এ-দেশে স্বাবলম্বনের চেয়ে গুরুজনদের প্রতি বাধ্যতাকে বড় গুণ বিবেচনা করা হয়, অর্থাৎ, আমাদের ভিতর মধ্যযুগীয় মনোভাবেরই প্রাবল্য। সময়ের অপচয় আমাদের পীড়িত করে না। ন্যায়-অন্যায় বোধ আমাদের ক্ষীণ। নিয়ম সম্বন্ধে আমরা তখনই অতিমাত্রায় সচেতন যখন দায়িত্ব এড়াবার জন্য নিয়মটাকে কাজে লাগানো যায়। নয় তো নিয়ম সম্বন্ধে আমরা নির্বিকার।
এরই ভিতর মোহনদাস করমচাঁদের আবিভাব উল্লেখযোগ্য। গান্ধীর মতামতের কোনো কোনো অংশ আমার মধ্যযুগীয় মনে হয়; যেমন নিরামিষ, গোমাংস, অথবা যৌন সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর কিছু কিছু ধারণা। কিন্তু কয়েকটি মৌলিক ব্যাপারে তিনি ছিলেন আশ্চর্যভাবে আধুনিক। তাঁর সময়সনিষ্ঠা প্রবাদে পরিণত হবার যোগ্য; নিত্য সহচর ঘড়িটি উদ্যত তর্জনীর মতো তাঁর আদর্শের ইঙ্গিত বহন করেছে। যেমন সময়ের তেমনই অর্থের ব্যবহারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত হিসেবী মানুষ। তিনি জাতে “বেনে” এ কথাটা যেমন প্রকাশ্যে উল্লেখ করতেন, তেমনই বণিকের শ্রেষ্ঠ গুণ তাঁর কর্মে পরিস্ফুট ছিল। তাঁর নিয়মনিষ্ঠাও বিখ্যাত। তিনি নিয়মকে কর্মের সহায় জানতেন এবং সেই অর্থেই তাকে জীবনচর্যায় বিশিষ্ট স্থান দিতে চেয়েছিলেন। এটাই অবশ্য গান্ধীর পূর্ণ পরিচয় নয়। কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধে এটা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমি জীবনের কিছু অর্থ খুঁজে পাই। কিন্তু গান্ধীকে আমাদের প্রয়োজন। গান্ধীর ভিতর এমন কিছু গুণ ছিল যাকে অগ্রাহ্য করলে আমাদের সমাজের বুনিয়াদ শক্ত হবে না। আর সুস্থ সমাজ ছাড়া সংস্কৃতিকেই বা কতদিন বাঁচানো যাবে?
পাশ্চাত্তের মতো এদেশেও সম্প্রতি যুব-বিক্ষোভ প্রবল আকার ধারণ করেছে। তবে এ দু’য়ের ভিতর একটা বড় পার্থক্য আছে। পশ্চিমে শিল্পোন্নত সমাজের ভিত্তি ও নীতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর নিয়মের আতিশয্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পিউরিট্যান মতবাদের এবং আধুনিক আমলাতান্ত্রিক সমাজের একটা দিক আছে যেটা হৃদয়হীন। পাশ্চাত্ত্য দেশের তরুণেরা সমাজকে আরও হৃদয়বান করে তুলতে চাইছেন। কতটা সম্ভব। হবে সেটা পরীক্ষানিরীক্ষার প্রশ্ন। নিয়মের যেমন অত্যাচার থাকে, তরুণের প্রত্যাশায়ও তেমনই আতিশয্য আছে। এর মাঝামাঝি কোথাও রফা হবে।
এদেশের তরুণেরাও সমাজের হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তবু পার্থক্য আছে। আধুনিক সমাজের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি স্থাপন করাই আজ এদেশে বড় প্রয়োজন। আমরা যদি শিল্পোন্নত সমাজের নিয়ম আয়ত্ত করবার আগেই তাকে অতিক্রম করতে চাই, আধুনিক যুগে পৌঁছবার আগেই তাকে ছাড়িয়ে যেতে অধীর হয়ে উঠি, তবে বিপত্তি অনিবার্য। যাঁরা বিক্ষুব্ধ তাঁরা সবই ভাঙতে চাইছেন; কী গড়া প্রয়োজন এ-বিষয়ে তাঁদের ধারণা স্বপ্নের চেয়েও অস্পষ্ট ও অবাস্তব। যা অন্যায় ও যুক্তিহীন অথবা বর্তমান সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই, তার বিরোধিতা নিশ্চয়ই আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে আধুনিক সমাজ গঠনের বর্তমান পর্যায়ে এমন অনেক কিছু গড়বার আছে, যা শুধুই বিক্ষোভের ধমকে আয়ত্ত করা যাবে না।
দেহের শক্তিহীনতা আমাদের জাতি হিসাবে অতিশয় ভীতু ও শান্তিপ্রিয় করেছিল। মনের আলস্যে আমরা মেনে নিয়েছিলাম যে, যাদু ও বিজ্ঞান সমান সত্য। আলস্যের সগোত্র সাময়িক উত্তেজনা। ক্ষণিক উত্তেজনার ধাক্কায় দেশকে একটা মহৎ সাধনের তুঙ্গে তোলা যাবে, এই লোভনীয় বিশ্বাসের কাছে যদি আমরা আজ আত্মসমর্পণ করি তবে সেটা হবে অযুক্তিরই জয়। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর বৈপরীত্য সত্ত্বেও তাঁদের মিল ছিল অক্লান্ত সাধনার শক্তিতে এবং জীবনকে একটি নিত্য পরীক্ষিত সত্য হিসাবে লাভ করবার অদম্য আগ্রহে। সময় সম্বন্ধে সচেতন তবু শান্ত, অভ্যস্ত অশ্রান্ত পরিশ্রমে, সত্যের সন্ধানে আগ্রহী, বিরাট অথচ বহুলাংশে বিরোধী দুটি ব্যক্তিত্বে এই গুণ সমান প্রত্যক্ষ। একে বাদ দিয়ে আমাদের আদর্শ কল্পনা করা যায় না; একে উপেক্ষা করে এ যুগের লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনীতি, সব কিছু ব্যাপ্ত করে এক বৃহৎ আন্দোলন এদেশে একদিন শুরু হয়েছিল। আজ আমরা সেই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে এসে রাজনীতির দ্বারা সব জয় করতে চাই। কিন্তু জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে রাজনীতির সাহায্যে জয়ী হওয়া যায় না। এ জন্য আমাদের অসমাপ্ত রেনেসাঁস ও রেফর্মেশনকে পৃর্ণতর করা আশ্যক। এই দুই মহৎ আন্দোলনকে আমরা এদেশে স্থান ও কালের উপযোগী করে নিতে পারি; কিন্তু এদের বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে ভুল করা হবে। ব্যক্তি ও সমাজের চারিগঠনে প্রতিটি পর্যায়ের একটা ঐতিহাসিক অবদান থাকে। আধুনিক যুগের গুণ আয়ত্ত না করেই ভবিষ্যৎকে হাতের মুঠোয় পেতে চাইলে অতীতকে বিকৃতভাবে চিরস্থায়ী করা হয়। তাকে তখন আমরা সনাতন ব’লে যতই অহংকার করি না কেন, সেটা আমাদের বাড়ার পথে বাধা হয়েই থাকে। সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)