উত্তরার্চিক — পঞ্চম অধ্যায়
এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্তানুসারে)—১-৫, ১০-১২, ১৬-১৯, পবমান সোম; ৬/২০ অগ্নি; ৭/ মিত্র ও বরুণ; ৮, ১৩-১৫, ২১/২২ ইন্দ্র; ৯ ইন্দ্রাগ্নী।
ছন্দ– ১/৬ জগতী, ২-৫, ৭-১০, ১২, ১৬, ২০ গায়ত্রী, ১১/১৫ প্রগাথ বৃহতী ও সতোবৃহতী; ১৩ বিরাট; ১৪ (১) অতি জগতী; ১৪ (২, ৩) উপরিষ্টাৎ বৃহতী; ১৭ প্রগাথ বিষমা ককুপ, সতোবৃহতী; ১৮ উষ্ণিক; ১৯ ত্রিষ্টুপ; ২১/২২ অনুষ্ঠুভ।
ঋষি-১ আকৃষ্ট ও মাষগণ; ২ অমহীয়ু আঙ্গিরস; ৩ মেধ্যাতিথি কাণ্ব; ৪/২২ বৃহস্পতি আঙ্গিরস; ৫ ভৃগু বারুণি বা জমদগ্নি ভার্গব; ৬ সুতম্ভর আত্রেয়; ৭ গৃৎসমদ শৌনক, ৮/২১ গোতম রাহুগণ; ৯/১৩ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ১০ দৃঢ়চ্যুত আগস্ত্য; ১১ সপ্ত ঋষি (প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য); ১৪ রেভ কশ্যপ, ১৫ পুরুহন্মা আঙ্গিরস; ১৬ অসিত কাশ্যপ বা দেবল; ১৭ (১) শক্তি বাসিষ্ঠ; ১৭ (২) উরু আঙ্গিরস; ১৮ অগ্নি চাক্ষুস; ১৯ প্রতর্দন দৈবোদাসি; ২০ প্রয়োগ ভার্গব; ২২ পাবক অগ্নি বার্হস্পত্য সূক্তটি ঋগ্বেদে না থাকায় এর ঋষি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে)।
প্রথম খণ্ড
সূক্ত ১– প্র ত আশ্বিনীঃ পবমান ধেনবো দিব্যা অগ্রন্ পয়সা ধরীমণি। প্রান্তরিক্ষাৎ স্থাবিরীস্তে অসৃক্ষত যে ত্বা মৃজন্ত্যষিষাণ বেধসঃ৷৷ ১। উভয়তঃ পবমানস্য রশ্ময়ো ধ্রুবস্য সতঃ পরি যন্তি কেতবঃ। যদী পবিত্রে অধি মৃজ্যতে হরিঃ সত্তা নি যোনৌ কলশেযু সীদতি৷৷ ২৷৷ বিশ্বা ধামানি বিশ্বচক্ষ ঋভূসঃ প্রভোষ্টে সতঃ পরি যন্তি কেতবঃ। ব্যানশী পবসে সোম ধর্মণ পতির্বিশ্বস্য ভুবনস্য রাজসি৷৷ ৩৷
সূক্ত ২– পবমাননা অজীজনদ দিবশ্চিত্ৰং ন তন্যতুম। জ্যোতিবৈশ্বানরং বৃহৎ৷৷ ১৷ পবমান রসস্তব মদো রাজ্যদুছুনঃ। বি বারমব্যমতি৷৷ ২। পবমানস্য তে রসো দক্ষো বি রাজতি দ্যুমা। জ্যোতির্বিশ্বং স্বদৃশে৷ ৩৷৷
সূক্ত ৩– প্র য গাবো ন ভূৰ্ণয়স্তৃষা অযাসো অক্ৰমু। ঘন্তঃ কৃষ্ণামপ ত্বচ৷৷ ১। সুবিতস্য বনাহহেহতি সেতুং দুরায্যম্। সাহ্যাম দস্যুমব্রত৷ ২৷৷ শৃত্বে বৃষ্টেরিব স্বনঃ পবমানস্য শুষ্মিণঃ। চরন্তি বিদ্যুতো দিবি৷৷ ৩৷৷ আ পবস্য মহীমিষং গোমদিন্দো হিরণ্যবৎ। অশ্ববৎ সোম বীরবৎ। ৪। পবস্ব বিশ্বচষণ আ মহী রোদসী পৃণ। ঊষাঃ সুর্যোন রশ্মিভিঃ৷৷ ৫৷৷ পরিণঃ শমর্যন্ত্যা ধারয়া সোম বিশ্বতঃ। সরা রসেব বিষ্টপ৷৷ ৬.
মন্ত্ৰার্থ— ১সূক্ত/১সাম– পবিত্রকারক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার সর্বব্যাপক দুলোকজাত জ্ঞানকিরণসমূহ অমৃতের সাথে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোক। যে জ্ঞানিগণ সাধকলভ্য আপনাকে পরিশোধন করেন, সেই জ্ঞানিগণ দুলোকজাত অমৃতপ্রবাহ লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — জ্ঞানিগণ অমৃতলাভ করেন। আমরা যেন জ্ঞান সমন্বিত অমৃত লাভ করি)। [মন্ত্রের ভাষ্যে ধরীমণি পদে ধারকে, দ্রোণ কলশে অর্থ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতে, বর্তমান স্থলে ধরীমণি পদের ধারকে অর্থই সঙ্গত, কিন্তু তার দ্বারা দ্রোণকলশকে বোঝায় না। যাতে সত্ত্বভাব, সভাব ধারণ করা যায়, তা মানুষের হৃদয়। তাই ভাষ্যের মূল অর্থ গ্রহণ করেও আমরা শেষ পর্যন্ত তার সাথে একমত হতে পারিনি। এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকারসোম পদ অধ্যাহার করেছেন। কাজেই এই সোমরসের সঙ্গে সঙ্গতি রাখবার জন্য তাকে সেইরকমেই ব্যাখ্যা করতে হয়েছে]।
১/২– পবিত্রকারক, নিত্যস্বরূপ সত্যস্বরূপ দেবতার জ্ঞানদায়ক কিরণসমূহ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়; যখন পাপহারক সত্ত্বভাব সাধকগণ কর্তৃক তাদের পবিত্র হৃদয়ে পরিশোধিত হয়, তখন সৎস্বরূপ দেব সেই সাধকদের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব, এই যে, সাধকদের হৃদয়ে যখন এ শুদ্ধসত্ত্বের আবির্ভাব হয়, তখন তাঁরা মোক্ষলাভ করেন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোম পদ অধ্যাহার করে মন্ত্রার্থের ভিন্ন রূপ প্রদান করা হয়েছে। সেখানে সোমকে কিরণপুঞ্জ-বিতরণকর্তা বলা হয়েছে। আরও, সোম সুস্থির। মূল পদ ধ্রুবঅর্থাৎ যা কখনও বিচলিত হয় না। শুধু তাই নয়, সোমের রশ্ময়ঃ অর্থাৎ কিরণপুঞ্জ-কেতবঃ অর্থাৎ প্রজ্ঞাপক– জ্ঞানদায়ক। সোমের এই বিশেষণ একেবারেই দুর্বোধ্য। আমরা মনে করি, ভগবানের মহিমাই এই শব্দগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে ভগবানের কৃপার কথাই আলোচিত হয়েছে]।
১/৩– সর্বজ্ঞ হে শুদ্ধসত্ত্ব! জগতের অধীশ্বর সৎস্বরূপ আপনার মহান্ জ্ঞানরশ্মিসমূহ সকল দেবভাবকে প্রকাশিত করে। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বব্যাপক আপনি জগৎ-উদ্ধারণ করে জগৎকে পবিত্র করেন এবং সকল জগতের অর্থাৎ অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর আপনি জ্যোতিঃ প্রদাতা হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব দেবভাবসমূহের প্রকাশক হয়; এবং সত্ত্বভাবের দ্বারা জগতের স্থৈর্য সম্পাদিত হয়)। [প্রচলিত ভাষ্য ইত্যাদির সাথে অধিকাংশ স্থলেই শব্দগত মিল থাকলেও ভাষ্যে সোমরসের কল্পনা করায় ভাবগত বৈষম্য দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করি, সত্ত্বভাবকে লক্ষ্য করেই প্রভোঃ সতঃ প্রভৃতি বিশেষণ পদ ব্যবহৃত হয়েছে। সতঃ অর্থাৎ সৎস্বরূপস্য বিশেষণটি সোমরসের পক্ষে কিভাবে প্রযোজ্য হতে পারে? সোমরস যদি সৎ হয়, তবে জগতে অসৎ আর কি হতে পারে? শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই জগৎ পবিত্র হয়। সত্ত্বভাবের বলেই জগৎ বিধৃত আছে বিশ্ব স্থৈর্য লাভ করেছে। মানুষের অন্তরস্থিত দেবভাবগুলি শুদ্ধসত্ত্বের কল্যাণেই বিকাশ লাভ করে। মন্ত্রে তাই মাদকদ্রব্য সোমরসের নয়, শুদ্ধসত্ত্বের মহিমাই কীর্তিত হয়েছে বলে আমাদের ধারণা]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম লৌশাসূম]।
২/১– পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব দ্যুলোকসম্বন্ধীয় বিচিত্র, মহাতেজসম্পন্ন, অর্থাৎ মুক্তিপ্রদ, মহৎ, বিশ্বব্যাপক জ্ঞানের আলোক সৃষ্টি করেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ জগতের হিতের জন্য মুক্তিদায়ক জ্ঞানের আলোক জগতে বিচ্ছুরিত করেন)। [জ্ঞানের সহায়তা ব্যতীত মুক্তিলাভ সম্ভবপর নয়। ভগবান্ তাঁর সন্তানদের অধঃপতিত রাখতে পারেন না। তাই তাদের নিজের ক্রোড়ে তুলে নেবার জন্য তাদের হৃদয়ে জ্ঞানের আলোক বিচ্ছুরিত করেন। সেই জ্ঞানের আলোকের সাহায্যে মানুষ নিজের চরম গন্তব্য পথ নির্ধারণ করে মুক্তির পথে অগ্রসর হয়। মন্ত্রের মধ্যে ভগবানের এই অসীম করুণার কথাই বিবৃত হয়েছে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-২দ-৮সা) প্রাপ্তব্য]।
২/২– জ্যোতির্ময় অথবা বিশ্বাধিপতি পবিত্রকারক হে দেব! আপনার পরমানন্দদায়ক রিপুনাশক অমৃত নিত্যজ্ঞানপ্রবাহকে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ তার সাথে সম্মিলিত হোক। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, ভগবানের অমৃতপ্রবাহ পরাজ্ঞানের সাথে মিলিত হয়)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে জ্যোতির্ময় সোম! তুমি ক্ষরিত হচ্ছ, তোমার সেই আনন্দকর রস অবাধে মেষলোমের দিকে যাচ্ছে। মন্ত্রের অন্তর্গত অদুছুনঃ পদ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। ভাষ্যকার রক্ষোবর্জিত অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরাও ঐ মত পোষণ করি বটে; কিন্তু ঐ অর্থের ভাব সম্বন্ধে ভাষ্যের সাথে আমাদের মতবিরোধ আছে। আমরা মনে করি, ঐ পদে রিপুনাশক অর্থে অমৃতকে লক্ষ্য করে, এখানে সোম বা সোমরসের প্রসঙ্গ নেই। বিশেষতঃ সোমরসের পক্ষে অদুছুনঃ গ বিশেষণের কোন সার্থকতা নেই। অমৃত সম্বন্ধে তা প্রযোজ্য হতে পারে এবং ঐ দৃষ্টিতেই আমরা এ মন্ত্রের অর্থ গ্রহণ করেছি]।
২/৩– হে ভগবন! পবিত্রকারক আপনার আত্মশক্তিদায়ক জ্যোতির্ময় অমৃত সাধকহৃদয়ে প্রকাশিত হয়; আপনি কৃপাপূর্বক আপনার পূর্ণ দিব্যালোক পরাজ্ঞান লাভের জন্য আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [ভাষ্য ইত্যাদি প্রচলিত ব্যাখ্যায় সোম পদ অধ্যাহার করা হয়েছে। আমরা মনে করি এই মন্ত্রে ভগবানকেই লক্ষ্য করে। সোম পদ অধ্যাহার করায় মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দাঁড়িয়েছে, তা এই — হে সোম! তোমার অতি প্রবৃদ্ধ দীপ্তিশালী রস ক্ষরিত হয়ে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে দীপ্যমান করে দৃষ্টিগোচর করে দিচ্ছে। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, সোমরসের শক্তির দ্বারা অপ্রকাশিত জগৎ প্রকাশিত হচ্ছে, অর্থাৎ জ্ঞানের প্রকাশে অজ্ঞানতা দূরীভূত হচ্ছে। তা কি সোমরস নামক দ্রব্য দ্বারা সম্ভবপর? তাই এটাই মনে করতে হয় যে, ভাষ্যকার সোমরস-এর দ্বারা মাদকদ্রব্য ব্যতীত অন্য কোনও উচ্চতর দিব্যশক্তিসম্পন্ন বস্তুকে লক্ষ্য করছেন, নতুবা আমাদের ধারণা এই যে, ভাষ্যকার মন্ত্রার্থের ভাবসঙ্গতি রক্ষা করতে পারেননি। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম-সংহিতম, জরোধীয়ম ঔপগবোত্তরম]।
৩/১– জ্ঞানরশ্মিসমূহ যেমন জ্যোতির দ্বারা অজ্ঞহৃদয়কে উদ্ভাসিত করে, অথবা স্তুতিবাক্য যেমন ক্ষিপ্রতার সাথে ঔত্যকে প্রাপ্ত হয়, তেমন স্তোতৃদের পোষক, জ্যোতিষ্ম, আশুমুক্তিপ্রদায়ক অজ্ঞানতার অন্ধকার বিনাশকারী যে সত্ত্বভাব, সেই সত্ত্বভাব আমাদের সৎকর্মে মোক্ষপথে প্রবর্তিত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাবের সাহায্যে আমরা যেন মোক্ষলাভ করি)। [মন্ত্রের অন্তর্গত গাবঃ পদে পূর্বাপর আমরা জ্ঞানঃ অর্থ গ্রহণ করেছি। ভূৰ্ণয়ঃ পদ পোষণার্থক ভৃ ধাতু থেকে উৎপন্ন। সেই অনুসারে আমরা ঐ পদে ভরণশীলাঃ স্তোতৃণাং পোষকাঃ অর্থ গ্রহণ করেছি। অজ্ঞানতাই কৃষ্ণাং ত্বচং পদের লক্ষ্য। প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– যে সোমসকল জলের ন্যায় শীঘ্র দীপ্তিযুক্ত ও গমনশীল হয়ে কৃষ্ণত্বকদের হনন করে বিচরণ করেন তাদের স্তব করো। এই অনুবাদের টীকায় লিখিত হয়েছে যে, কৃষ্ণত্বক বলতে কৃষ্ণবর্ণ অনার্যদের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৃষ্ণত্বক বলতেই যদি অনার্যের উল্লেখ হয়, তাহলে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন, দ্রৌপদী, ভীম, এমন কি নবদূর্বাদলকান্তি রামচন্দ্রও তো অনার্য শ্রেণীভুক্ত হয়ে যান! সুতরাং ব্যাখ্যাকারের এই সিদ্ধান্ত সমীচীন বলে গ্রহণ করা অসম্ভব]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেরও ৫অ-৩দ-৫সা-তে পরিদৃষ্ট হয়]।
৩/২– ভগবানের সম্বন্ধীয় আমাদের রিপুবিনাশ আমরা প্রার্থনা করছি; (ভাব এই যে, ভগবান আমাদের রিপুনাশ করুন); তাঁর কৃপায় আমরা যেন দুর্ধর্ষ সকর্মাবিঘাতক শত্রুকে অভিভব করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় আমরা যেন রিপুজয়ী হতে : পারি)। [মন্ত্রের কোথায়ও সোমের উল্লেখ না থাকলেও প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসকে টেনে আনা হয়েছে। তাতে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে এই, ব্রতরহিত দস্যুকে অভিভব করে আমরা সুন্দর সোমের রাক্ষস-বন্ধন ও রাক্ষস-হনন ইচ্ছায় স্তব করি। এই ব্যাখ্যায় ভাষ্যেরও সম্পূর্ণ মিল নেই। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যা উভয়ের ব্যাখ্যা থেকেই পৃথক্। আমরা মনে করি, মন্ত্র ভগবানকেই লক্ষ্য করছেন]।
৩/৩–- বৃষ্টিধারার মতো পবিত্রকারক দেবতার জ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞানধারা সাধকেরা লাভ করেন; ॥, পাপনাশক (অথবা পরমশক্তিসম্পন্ন) দেবতার জ্যোতিঃ দ্যুলোকে বিদ্যমান আছে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকগণ ভগবানের সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভ করেন)। [প্রচলিত। ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভিন্ন অর্থ কম্পিত হয়েছে। যেমন, — অভিষবকালে বলবান্ সোমের দীপ্তিসকল অন্তরীক্ষে বিচরণ করে এবং বৃষ্টির ন্যায় তার শব্দ শ্রুতিগোচর হয়। সোমের সম্বন্ধে বর্ণনাটি সমীচীন না হলেও ব্যাখ্যাকার সোমরসকেই মন্ত্রের লক্ষ্যস্থল রূপে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এখানে মোটেই সোমরসের কোন প্রসঙ্গ নেই। আমরা মনে করি, মন্ত্রে ভগবৎ সম্বন্ধীয় জ্ঞানকেই লক্ষ্য করছে]।
৩/৪– হে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব! আপনি আমাদের জ্ঞানমুক্ত, আত্মশক্তিদায়ক, ব্যাপক জ্ঞানযুক্ত, হিতরমণীয়, মহৎ সিদ্ধি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের পরমসিদ্ধি প্রদান করুন)। [ভাষ্য ইত্যাদিতে মন্ত্রটিকে সোমরসের কাছে প্রার্থনামূলক বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে– হে সোম! তুমি অভিযুত হয়ে গোযুক্ত, অশ্বযুক্ত এবং বলযুক্ত মহা অন্ন আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করো। কিন্তু সোমরস নামক মাদকদ্রব্য কিভাবে আমাদের মহাঅন্ন দিতে পারে? মাদকদ্রব্য পান করলে অন্ততঃ সাময়িকভাবে একটু বলে লাভ হয়, এটা না হয় স্বীকার করা গেল; কিন্তু সেইসঙ্গে অশ্ব ও গো লাভ হবে কেমন করে? প্রকৃতপক্ষে গো এবং অশ্ব শব্দ দুটিতে কি অর্থ জ্ঞাপন করে তা পূর্বে বহুত্র আলোচনা করা হয়েছে। গোযুক্ত অর্থাৎ জ্ঞানযুক্ত, অশ্ববৎ অর্থাৎ ব্যাপক জ্ঞানযুক্ত ইত্যাদি অর্থই সঙ্গত। সোম যে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব তা আমাদের এই সম্পর্কিত প্রতিটি মন্ত্রেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে]।
৩/৫– সর্বজ্ঞ হে দেব! আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন (অথবা আমাদের হৃদয়ে অমৃত প্রদান করুন)। জ্ঞানদেব যথা জ্ঞানকিরণের দ্বারা জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবীকে পূর্ণ করেন অর্থাৎ তার সার্থকতা সম্পাদন করেন, তেমন আপনি আপনার অমৃতের দ্বারা মহান্ দ্যুলোক ভূলোককে সম্যকরূপে পূর্ণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের বিশ্বস্থিত সকলকে অমৃতের দ্বারা পূর্ণ করুন)। [আবার সেই বিশ্বজনীন মঙ্গলের প্রার্থনা। কেবল নিজের জন্য নয়, বিশ্ববাসী সকলেই যেন অমৃতত্ব লাভ করে। বেদের অন্যত্রও আমরা এই ভাবের দ্যোতনা দেখতে পেয়েছি। মন্ত্রের মধ্যে একটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে– জ্ঞানদেবের কৃপাতেই জ্ঞানের উন্মোষিকা বৃত্তির সার্থকতা সম্পাদিত হয়। মানুষের অন্তরে সব রকম বৃত্তিই আছে সত্য, কিন্তু ভগবানের কৃপা ব্যতীত তাদের বিকাশ হয় না, তাদের সার্থকতা ঘটে না। সূর্য অর্থে জ্ঞানদেব ঊষাঃ অর্থে জ্ঞান-উন্মোষিকা দেবী ইত্যাদি আমাদের পরিগৃহীত ব্যাখ্যাগুলি ইতিপূর্বে অন্যান্য মন্ত্রে বিশ্লেষিত হয়েছে]।
৩/৬– হে শুদ্ধসত্ত্ব! জল যথা ভূলোককে (অথবা অমৃত যথা বিশুদ্ধ) অভিসিঞ্চিত করে, তেমনই আপনি আপনার পরম মঙ্গলকারক প্রবাহের দ্বারা আমাদের অভিষিঞ্চিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভার এই যে, ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের পরমকল্যাণদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করুন)। মন্ত্রের মধ্যে একটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে রসেব বিষ্টপং। ভাষ্যকার এর অর্থ করেছেন রসেনেব ভূলোকং যদ্বা রসানদী স্থানং সা প্রবণরূপমিদং। তাতে রসেব পদের অর্থ দাঁড়িয়েছে নদীতুল্য অথবা নদীর মতো। কিন্তু আমরা মনে করি রস শব্দে এখানে জল অথবা অমৃত ইন অর্থ প্রকাশ করছে এবং এই উভয় মর্মানুসারে আমরা ঐ উপমাটির দুটি ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছি]।
.
দ্বিতীয় খণ্ড
সূক্ত ৪– আশুরর্ষ বৃহন্মতে পরিপ্রিয়েণ ধা। যত্র দেবা ইতি ব্রুবন্৷ ১৷৷ পরিষ্কৃথষ্কৃতং জনায় যাতন্নিষঃ। বৃষ্টিং দিবঃ পরিব৷৷ ২৷ অয়ং স যো দিবম্পরি রঘুযামা পবিত্র আ। সিন্ধোরূৰ্মা ব্যক্ষরৎ৷৷ ৩৷৷ সুত এতি পবিত্র আ জ্বিষিং দধান ওজসা। বিচক্ষাণো বিরোচয়৷ ৪৷৷ অবিবাস পরাবততা অথথা অর্বাবতঃ সূতঃ। ইন্দ্রায় সিচ্যতে মধু৷৷ ৫৷ সমীচীনা অনুষত হরিং হিন্বন্ত্যদ্রিভিঃ। ইমিন্দ্রায় পীতয়ে৷৷ ৬।
সূক্ত ৫– হিন্তি সুরমুস্রয়ঃ স্বসাররা জাময়ষ্পতি। মহামিন্দুং মহীয়ুবঃ৷৷ ১। পবমান দূচারুচা দেব দেবেভ্যঃ সুতঃ। বিশ্বা বসুন্যা বিশ৷৷ ২৷৷ আ পবমান সুষ্ঠুতিং বৃষ্টিং দেবেভ্যো দুবঃ। ইষে পবস্ব সংযতঃ৷ ৩৷৷
মন্ত্রার্থ— ৪সূক্ত/১সাম– মহামতি হে দেব! আপনি আপনার প্রিয়স্থান অর্থাৎ দেবভাবসমন্বিত সাধক হৃদয়কে নিত্যকাল প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে-ভগবান্ পবিত্র সাধকের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করেন)। যে স্থানে দেবভাব বর্তমান থাকে ( অথবা সমুদ্ভূত হয়) তা আপনি আমাদের বলুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! যেভাবে আমাদের হৃদয়ে দেবভাব সমুদ্ভূত হয়, তেমনই আমাদের উপদেশ প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথম অংশে এই সত্যই প্রকটিত হয়েছে যে, সাধকের হৃদয়ই প্রকৃত বৈকুণ্ঠ– ঈশ্বরের অবস্থান স্থল। দ্বিতীয় অংশে ভগবানের প্রেরণা লাভ করবার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।
৪/২- হে ভগবন! আপনি লোকবর্গের অবিশুদ্ধ হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে জগতের হিতের জন্য সকল লোকবর্গকে সিদ্ধি অথবা আত্মশক্তি প্রদান করুন; এবং দ্যুলোক হতে করুণাধারা বর্ষণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের সকল লোককে পরাসিদ্ধি প্রদান করুন)। ( প্রার্থনাটি বিশ্বজনীন এবং অনিষ্কৃতং পদে পাপপক্লিষ্ট মানবহৃদয় মাত্রকেই লক্ষ্য করে। বৃষ্টিং পদেরও লক্ষ্যস্থল ভগবানের করুণাধারা। তিনি স্বর্গ হতে তাঁর করুণাধারায় দুঃখতাপগ্রস্ত মানুষের হৃদয়ের সকল মলিনতা পঙ্কিলতা বিধৌত করে দেন। এই সত্যকে উপলক্ষ্য করে মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে]।
৪/৩– যে দেবতা দুলোকে শীঘ্রগামী অর্থাৎ আশুমুক্তিদায়ক, প্রসিদ্ধ সেই দেবত্তা অর্থাৎ ভগবান সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে আগমন করেন। তিনি সত্ত্বসমুদ্রের প্রবাহ লোকগণকে প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, মুক্তিদায়ক ভগবান্ সাধকদের শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করেন)। [এই মন্ত্রের প্রচলিত বঙ্গানুবাদটি এই– এই সোম দশাপবিত্রে ন্যস্ত হয়ে সিন্ধুর ঊর্মিতে ক্ষরিত হচ্ছে। ইনি স্বর্গের উপরে শীঘ্র গমন করে থাকেন। মন্ত্রে সোমরসের কোন উল্লেখ না থাকলেও অনুবাদকার : এবং ভাষ্যকার দুজনেই সোমের সম্বন্ধ কল্পনা করেছেন। আমরা মনে করি অয়ং পদে ভগবানকেই লক্ষ্য করে, তিনিই দিবস্পরি রঘুয়ামা অর্থাৎ মানুষকে তিনিই শীঘ্র স্বর্গলাভ করান, তার কৃপাতেই মানুষ স্বর্গলাভ করে অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্ত হয়। তিনিই মানুষের মঙ্গলের জন্য তাদের শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করেন। সিন্ধোরূৰ্মা ব্যক্ষরৎপদ দুটি এই সত্যকেই নির্দেশ করছে। মানুষের শুদ্ধসত্ত্বলাভের একমাত্র উপায় ভগবান। অন্য কোন উপায়েই মোক্ষলাভের উপায় নেই]।
৪/৪– পবিত্রতাস্বরূপ দেব সাধকদের পবিত্র হৃদয়ে গমন করেন; সর্বজ্ঞ জ্যোতির্ময় সেই দেবতা আপন শক্তির দ্বারা আমাদের জ্যোতিঃ প্রদান করে আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, জ্যোতিঃস্বরূপ ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন)। [পবিত্রতাস্বরূপ ভগবান্ সাধকের পবিত্র হৃদয়েই অবস্থান করেন। পবিত্রতা, পবিত্রতারই অনুগামী। তাই সহজেই ভক্ত ও ভগবানের মিলন হয়ে থাকে। সাধকের, ভক্তের সেই সৌভাগ্য দর্শন করেই যেন মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে– হে প্রভো! অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আমরা, আমাদের তোমার দিব্যজ্যোতিঃ দানে কৃতার্থ করো। আমাদের মলিন পঙ্কিল হৃদয়কে তুমি তোমার মহিমাবলে পবিত্র উন্নত করো। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটির সম্পূর্ণ ভিন্ন। অর্থ গৃহীত হয়েছে। যেমন, — অভিযুত সোম দীপ্তি ধারণ পূর্বক এবং সমস্ত পদার্থকে দর্শন ও দীপ্ত করে শীঘ্র বেগে দশাপবিত্রে গমন করেছেন। অবশ্য এই ব্যাখ্যায় সোমকে অন্য কোথাও থেকে আনা হয়েছে। তাই মন্ত্রে সোমের মাহাত্ম্য প্রখ্যাপিত হয়েছে। সোম যে শুধু নিজে জ্যোতির্ময় তা নয়, সোম অন্য পদার্থকেও জ্যোতির্ময় করে থাকেন। আমরা কিন্তু মন্ত্রে সোমরসের সন্ধান পাইনি]।
৪/৫– দূরস্থিত এবং নিকটস্থিত (অর্থাৎ সকল) দেবভাব কামনাকারী অমৃত-স্বরূপ বিশুদ্ধ– সত্ত্বভাব ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সাধকগণ কর্তৃক তাদের হৃদয়ে উৎপাদিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -সাধকগণ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য তাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সমুৎপাদিত করেন)। [পরাবতঃ এবং অর্বাবতঃ পদ দুটির সাধারণ অর্থ যথাক্রমে যারা দূরে আছে এবং যারা নিকটে আছে। পরাবতঃ পদের আর একটি অর্থ হয়– বহিঃস্থ। এই দিক দিয়ে অর্বাবতঃপদের অর্থ হয়– যা নিকটে অর্থাৎ এই পৃথিবীতে আছে। এই উভয় শব্দে ইহজীবন এবং পরজীবনকেও লক্ষ্য করতে এ পারে। অর্থাৎ একত্রে এই উভয় পদে সমগ্ৰত্ব বোঝায়। এই মন্ত্রে এই অর্থই গৃহীত হয়েছে। ভাষ্য ইত্যাদিতেও মন্ত্রটি এই ভাবেই গৃহীত হয়েছে বটে, কিন্তু মন্ত্রের অন্তর্গত পদগুলির বিভিন্ন অর্থের জন্য মন্ত্রের মুখ্য অর্থের বিকৃতি ঘটেছে। ভাষ্য ইত্যাদিতে সুতঃ পদকে সোমরসের বিশেষণরূপে গ্রহণ করা হয়েছে, সুতরাং সোমপক্ষেই মন্ত্রের অর্থ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, মন্ত্রে সত্ত্বভাব ও দেবভাবের প্রতি লক্ষ্য আছে। শুদ্ধসত্ত্ব দেবভাবের নিত্যসহচর। তাই যে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হয়, সেই হৃদয় দেবত্বের অভিমুখে পরিচালিত হয়। তাই সত্ত্বভাব দেবভাবকে আবিবাস অর্থাৎ কামনা করে বলা হয়েছে। দেবভাব ও শুদ্ধসত্ত্বের পূর্ণ সংযোগ ঘটলে মানুষ মোক্ষলাভ করে। সেইজন্যই সাধকগণ হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন করেন]।
৪/৬– জ্ঞানিব্যক্তিগণ পাপহারক দেবতাকে আরাধনা করেন। পাষাণকঠোর সাধনের দ্বারা উৎপন্ন শুদ্ধসত্ত্বকে ভগবানের গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সাধকগণ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য কঠোরসাধনের দ্বারা হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন করেন)। [এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে আমাদের বিলক্ষণ অনৈক্য আছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সম্যক মিলিত স্তোতাসকল স্তব করছেন। হরিৎ-বর্ণ সোমকে প্রস্তর সাহায্যে ইন্দ্রের পানের জন্য প্রেরণ করছেন। হরিং পদে পাপহারকং অর্থই সঙ্গত। ভাষ্যকারও অনেক স্থলে ঐ অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রে ঐ পদে হরিত্বৰ্ণংঅর্থ গ্রহণ করে তার বিশেষ্যস্বরূপ সোমং পদ অধ্যাহার করেছেন। অদ্রিভিঃ পদে পাষাণকঠোর সাধনের দ্বারা অর্থ যে কোন বিচারে সুসঙ্গত বলেই প্রমাণিত]।
৫/১– পরমশক্তিসম্পন্ন জগৎপতি দেবতাকে কামনাকারী পরস্পর বন্ধুভূত ভগিণীস্বরূপ জ্ঞানকিরণসমূহ মহান শুদ্ধসত্ত্বকে উৎপাদন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — মোপ্রাপক পরাজ্ঞান সাধকদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন করেন)। [এই মন্ত্রটির নানারকম ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। একটি — অঙ্গুলিগুলি যেন কয় ভগিনী, যেন তারা পরস্পর আপন-সম্পর্কীয় কয়েকটি স্ত্রীলোক, সোম যেন তাদের স্বামী। এই কয়েকটি স্ত্রীলোক অতিশয় কার্যকুশল, এঁরা তাঁদের বলশালী মাননীয় স্বামীকে চালাচ্ছেন, এঁদের বাসনা এই যে, সোম রস ক্ষরিত হয়। গায়ত্রীচ্ছন্দে গ্রথিত এই মন্ত্রটির এত বড় লম্বা অনুবাদ হয়েছে। ভাষ্যকারও স্বসারঃ জাময়ঃ প্রভৃতি পদের ব্যাখ্যায় অনেক গবেষণা করেছেন। বিবরণকারও অন্য এক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ভাষ্যকারও দিয়েছেন। আমরা মনে করি স্বসারঃ পদের সাধারণ ভগিন্যঃ অর্থই এখানে সঙ্গত। জাময়ঃ পদে ভাষ্যানুসরণেই বন্ধুভূতাঃ অর্থ নিষ্পন্ন হয়। ইয়ঃ পদে জ্ঞানকিরণকে লক্ষ্য করে। বিবরণকার কতকটা এই ভাবই গ্রহণ করেন বলে মনে করা যেতে পারে। তবে তিনি জ্ঞানরশ্মি স্থলে আদিত্যরশ্মি অর্থ গ্রহণ করেছেন। উপরোক্ত বঙ্গানুবাদের একটি টিপ্পনী আছে। তা এই– এই উপমাটি ঋগ্বেদের অনেকস্থলে ব্যবহার হয়েছে, কার্যপটু অঙ্গুলিগুলিকে অগ্নি বা ইন্দ্র, বা সোমদেবের স্ত্রী বলে বর্ণনা করতে ঋষিগণ ভালবাসতেন। এমন উপমা থেকে অনুমান করা যায় যে, সেই কালে ধনাঢ্য বা রাজাগণের বহুদার পরিগ্রহ করবার রীতি ছিল। বৈদিক গবেষণার একটি নমুনা প্রদর্শন করবার জন্যই এই টিপ্পনীটি উদ্ধৃত হলো]।
৫/২– পবিত্রকারক জ্যোতির্ময় হে দেব! বিশুদ্ধ আপনি দেবভাব প্রাপ্তির (অথবা ভগবৎপ্রাপ্তির) এ জন্য দিব্যজ্যোতির সাথে আমাদের সকল পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনি কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [ভগবানই জ্যোতিঃ ও পরমধনের উৎস। তার কাছ থেকেই মানুষ নিজের সকলরকম আকাঙক্ষণীয় ধন প্রাপ্ত হয়। তিনি বাঞ্ছাকল্পতরু। তাই মানুষ তাঁর চরণতলে নিজের সকল বাসনা কামনা নিবেদন করে। মন্ত্রে তাই ভগবানের কাছে পরমধনের জন্য প্রার্থনা নিবেদন করা হয়েছে। এই মন্ত্রের যে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদি আছে, তাতে নানারকম বিভিন্ন ভাব পরিগৃহীত হয়েছে। ভাষ্যকার প্রার্থনামূলক ভাব গ্রহণ করেছেন; কিন্তু ব্যাখ্যাতে সোম শব্দ অধ্যাহার করায় মূল অর্থের ব্যত্যয় ঘটেছে]।
৫/৩- পবিত্রকারক হে দেব! দেবভাবপ্রাপ্তির জন্য শোভন স্তুতিযুক্ত জ্ঞানপ্রবাহ আমাদের প্রদান: করুন। হে দেব! সিদ্ধিপ্রাপ্তির জন্য ভগবৎসেবন অর্থাৎ সেই শক্তি আমাদের সাথে সম্মিলিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান ও ভগবৎসেবার শক্তি লাভ করি)। [ভগবৎসেবার অধিকার প্রাপ্তি বড় সহজ কথা নয়। ইচ্ছা থাকলেও, চারিদিকের নানারকম বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়ে, মানুষ নিজের অভীষ্ট পথে অর্থাৎ ভগবৎ আরাধনার পথে চলতে পারে না। ভগবানের বিশেষ কৃপা লাভ না করলে তাকে স্রেতের তৃণের মতোই বিপরীত দিকে ভেসে যেতে হয়। যিনি ভাগ্যবলে অথবা ভগবানেরই কৃপায় ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, তিনিই নিজের অভীষ্ট পথে চলতে সমর্থ হন। তাই চরম অধিকার পাবার জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম বিশ্বোবিশীয়ম এবং ঐড়ানাংসংঙ্ক্ষারম্]।
.
তৃতীয় খণ্ড
সূক্ত ৬– জনস্য গোপা অনিষ্ট জাগৃবিরগ্নিঃ সুদক্ষঃ সুবিতায় নব্যসে। ঘূতপ্রতাঁকে বৃহতা দিবিশৃশা দ্যুমদবি ভাতি ভরতেভ্যঃ শুচিঃ ॥১৷৷ স্বামগে অঙ্গিরসো গুহা হিতমন্ববিঞ্ছিশ্রিয়াণং বনেবনে। — স জায়সে মথ্যমানঃ সহো মহৎ মাহুঃ সহসম্পুত্রমঙ্গিরঃ ॥২॥ যজ্ঞস্য কেতুং প্রথমঃ পুরোহিতমগিং নরখ্রিষধস্থে সমিন্ধতে। ইন্দ্রেণ দেবৈঃ সরথং স বর্হিষি সীদন্ নি হোতা যজথায় সুতুঃ ॥৩৷৷
সূক্ত ৭– অয়ং বাং মিত্রাবরুণা সুতঃ সোম ঋতাবৃধা। মমেদিহ তং হব৷৷ ১৷৷ রাজা নাবনাভিদ্রহা ধ্রুবে সদস্যুত্তমে। সহস্রস্তুণ আশাতে। ২। তা সম্রাজা ঘৃতাসূতী আদিত্য দানুনস্পতী। সচেতে অনবহুর৷৩৷৷
সূক্ত ৮– ইন্দ্রো দধীচো অভিবৃত্ৰাণ্যপ্রতিদ্ভুতঃ। জঘান নবীনব। ১. ইচ্ছন্নশ্বস্য যচ্ছিরঃ পর্বতেপশ্রিত। তদবিদচ্ছষণাবতি৷ ২অত্ৰাহ গোরমন্বত নাম ষ্টুরপীচ্যম। ইখা চন্দ্রমাসো গৃহে৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ৯– ইয়ং বামস্য মন্মন ইন্দ্রাগ্নী পূর্বস্তুতিঃ। অভ্রাদ বৃষ্টিরিবাজনি৷৷ ১৷৷ শৃণুতং জরিতুর্থবমন্দ্রাগ্নী বনতং গিরঃ। .. ঈশানা পিপ্যতং ধিয়ঃ৷৷ ২৷৷ মা পাপায় নো নরেন্দ্রাগ্নী মাভিশস্তয়ে। .. মা নো রীধতং নিদে৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ৬সূক্ত/১সাম– বিশ্বের রক্ষক, চিরপ্রবুদ্ধ পরমশক্তিসম্পন্ন জ্ঞানদেব নিত্যকল্যাণের জন্য জগতে প্রাদুর্ভূত হন; অমৃতস্বরূপ পবিত্রকারক জ্যোতির্ময়, সেই দেবতা সাধকদের মঙ্গলবিধানের জন্য মহৎ মোক্ষপ্রাপক জ্যোতিঃর সাথে তাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকগণ পরম কল্যাণদায়ক পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [জ্ঞানের পরাজ্ঞানের মহিমা কীর্তনই এই মন্ত্রের উদ্দেশ্য। মন্ত্রের অন্তর্গত অগ্নিং পদের কয়েকটি বিশেষণের প্রতি লক্ষ্য করলেই ঐ পদে কোন বস্তুকে লক্ষ্য করে, তা উপলব্ধ হবে। প্রথম বিশেষণ জনস্য গোপা– অর্থাৎ বিশ্বের রক্ষক। জ্ঞানের বলেই সৃষ্টি-স্থিতি সম্ভবপর হয়, অজ্ঞানতায় ধ্বংস। জ্ঞানই জগৎকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে সমর্থ। জাগৃবিঃ পদে জ্ঞানের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। জ্ঞান চিরপ্রবুদ্ধ অর্থাৎ চিরজাগরণশীলতাই জ্ঞানের ধর্ম। সুদক্ষঃ এবং ঘৃতপ্রতীকপদ দুটি জ্ঞানের স্বরূপ প্রকটিত করছে। জ্ঞানই প্রকৃত শক্তি, জ্ঞানই অমৃত। জ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ অমৃতত্ব লাভ করে। দিবিস্পশা পদ জ্ঞানের মোক্ষপ্রাপিকা শক্তিই পরিব্যক্ত করছে। সেই জ্ঞান জগতের হিতের জন্যই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। বিশেষতঃ সাধকের হৃদয়ের মধ্য দিয়েই ভগবানের জ্ঞানশক্তি বিশ্বমঙ্গল সাধিত করে। সাধকগণ তাদের পরমমঙ্গল সাধনের জন্য এই মোক্ষপ্রাপক জ্ঞান হৃদয়ে সঞ্চয় করে। হয় অথবা ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকের হৃদয়ে পরাজ্ঞান প্রদান করেন]।
৬/২-হে জ্ঞানদেব! সকল জ্যোতিঃতে আশ্রিত অর্থাৎ সকল জ্যোতির আশ্রয়ভূত, নিগূঢ়, ভগবানে বর্তমান, আপনাকে জ্ঞানিগণ লাভ করেন। প্রসিদ্ধ আপনি মহতী সাধনশক্তির দ্বারা আকৃষ্ট ও হয়ে সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। পরম জ্ঞানস্বরূপ হে দেব! সাধকগণ আপনাকে শক্তিপুত্র বলে থাকেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের শক্তিস্বরূপ: জগতের সকল রকম জ্যোতিঃর মূলকারণ পরাজ্ঞানকে লাভ করেন)। [এই মন্ত্রটির একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে অগ্নি! তুমি গুহামধ্যে নিগূঢ় হয়ে এবং বনে আশ্রয় গ্রহণ করে অবস্থান করছিলে, অঙ্গিরাগণ তোমাকে আবিষ্কৃত করেছেন; হে অঙ্গিরা! তুমি বিশেষ বলের সাথে মথিত হয়ে উৎপন্ন হও বলে লোকে বলের পুত্র বলে। অঙ্গিরস, পদে জ্ঞানীদের লক্ষ্য করে– তা পূর্বে বহুত্র আমরা উল্লেখ করেছি। তবে সব প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকেই একটা ভাব পাওয়া যায় যে, — অতিশয় শক্তি প্রয়োগে (অর্থাৎ অরণিকাষ্ঠ ঘর্ষণে) অগ্নির উৎপত্তি হয় এবং সেইজন্য অগ্নির অন্য এক নাম, সহসম্পুত্রং অর্থাৎ শক্তির পুত্র। আমরা মন্ত্রটির ভিন্নভাব গ্রহণ করেছি, কারণ অগ্নি বলতে আমরা জ্ঞানদেব (অর্থাৎ ঈশ্বরের জ্ঞানরূপ বিভূতি) বুঝি। আমরা মনে করি, সাধকের কঠোর সাধনার দ্বারা তাদের হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হয়, সেই জ্ঞানই সর্বত্র জ্যোতিঃরূপে বর্তমান অর্থাৎ পরাজ্ঞানই সব রকম জ্যোতিঃর মূলকারণ। বন পদে জ্যোতিঃ বোঝায়, বনে বনে পদে সব রকম জ্যোতিঃকে লক্ষ্য করে]।
৬/৩– সৎকর্মসাধক সৃষ্টির আদিভূত, লোকদের পরম মঙ্গলদায়ক জ্ঞানদেবকে সাধকগণ নিত্যকাল সম্যপ্রকারে লাভ করেন; সকল দেবভাবের সাথে সৎকর্মসাধনসামর্থ্যের উৎপাদক শোভনকর্মা সেই দেবতা সৎকর্মসাধনশক্তি দান করবার জন্য সাধকদের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা নিত্যকাল পরাজ্ঞান এবং সৎকর্ম সমন্বিত দেবভাব লাভ করেন)। [অগ্নি বলতে কোন বস্তুকে না দেবতাকে লক্ষ্য করে তা পুর্বেই আলোচিত হয়েছে। প্রচলিত একটি অনুবাদ– অগ্নি যজ্ঞের হেতুস্বরূপ, যজমানগণ অগ্নিকে সম্মুখে স্থাপন করেন, অগ্নি ইন্দ্রাদি দেবগণের সমকক্ষ; ঋত্বিকগণ সর্বাগ্রে তিন স্থানে অগ্নিতে হোম করেছিলেন। শোভনকর্মা দেবগণের আহ্বানকারী সেই অগ্নি কুশযুক্ত সেই স্থানে যজ্ঞার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই ব্যাখ্যা থেকে অনুমান হয় যে, অগ্নি যেন একজন সাধারণ দেবতা, তাকে বাড়িয়ে তোলবার জন্য বলা হয়েছে– তিনিও কম নন, তিনি ইন্দ্রের সমকক্ষ। ভাষ্যকারও সরথং পদের উপর নির্ভর করে ঐ মতই পোষণ করেছেন। কিন্তু সরথং পদের মধ্যে তুলনামূলক কোন ভাবই নেই। রথ শব্দে সৎকর্ম-রূপ যানকে লক্ষ্য করে, -যে রথের দ্বারা মানুষ মোক্ষমার্গে অগ্রসর হতে পারে। সমস্ত দেবভাবের সাথে মানুষ জ্ঞানের সাহায্যে সেই সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রাপ্ত হতে পারে– এটাই মন্ত্রাংশের তাৎপর্য]। [এই মন্ত্রটি শুক্ল যজুর্বেদের ১৫শ অধ্যায়ের ২৭শ কণ্ডিকায় পাওয়া যায়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। তার নাম– কাবম]।
৭/১– সত্যপ্রাপকৌ হে অভীষ্টপূরক ও মিত্রদেবদয়! আপনাদের প্রাপ্ত হবার জন্য আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ হোক। হে দেবদ্বয়! আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [মন্ত্রের প্রথম অংশে হৃদয়ে ভগবানের আবির্ভাবের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। অপরাংশে হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। অবশ্য সেই আকাঙ্ক্ষা অতি মহৎ– তা এ ভগবৎপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করবার শক্তি মানুষের নেই– যদি না সে ভগবানের কৃপা পায়। তাই হৃদয়ে ভগবানের অনুভূতি লাভ করবার জন্য মন্ত্রে তারই কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। যেমন, -হে মিত্রাবরুণ! তোমাদের জন্য এই সোম অভিযুত হয়েছে। হে সত্যবর্ধক! তোমরা আমার আহ্বান শ্রবণ করো। অর্থাৎ মদ্য প্রস্তুত করে দেবতাকে যেন আহ্বান করা হচ্ছে– এস হে, মদ্যপান করবে এস। আচ্ছা তা যেন করা গেল। কিন্তু মদ্যপানের জন্য আহ্বান করে দেবতাকে ঋতাবৃধা বিশেষণে বিশেষিত করা যায় কি? সে কেমন সত্য যা মদ্যপায়ীর দ্বারা বর্ধিত হয়? একমাত্র সোম পদের জন্যই ভাষ্য ইত্যাদিতে এই অসঙ্গতি দৃষ্ট হয়। কারণ প্রচলিত ব্যাখ্যায় সোম পদের অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে– সোমরস নামক মদ্য। আমরা পূর্বাপরই ঐ পদে সত্ত্বভাব অর্থ গ্রহণ করে আসছি এবং বর্তমান মন্ত্রে এই অর্থেই সঙ্গতি লক্ষিত হয়]।
৭/২– জ্যোতির্ময়, সাধকদের রিপুনাশক দেবদ্বয় প্রশান্ত শ্রেষ্ঠ বহুশক্তিযুত সাধকহৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শক্তিসম্পন্ন সাধকেরা ভগবানকে প্রাপ্ত হন)। [ভাষ্যে সহস্রস্থূণে পদের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। একখানি প্রচলিত বাংলা অনুবাদে ও একখানা হিন্দী ব্যাখ্যায় ঐ পদে সহস্ৰস্তম্ভ বিশিষ্ট অর্থ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রটিকে সমষ্টিভাবে গ্রহণ করলে ঐ অর্থের কোন সার্থকতা পরিলক্ষিত হয় না। আমাদের মতে, সহস্ৰস্কুণে সদসি পদ দুটির অর্থ হয়, বহুশক্তিযুতে সাধকহৃদয়ে। (কারণ সদসি পদে সাধকের হৃদয়কে লক্ষ্য করে এবং সহস্ৰস্থূণে পদের প্রচলিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করলেও ঐ পদে মহৎ শক্তিশালী প্রভৃতি ভাব আসে)। সাধকের হৃদয়ই অপূর্ব শক্তিসম্পন্ন। ভগবান সেই পবিত্র হৃদয়েই আগমন করেন, তার আসনের বা বাসস্থানের উপযুক্ত স্থানই মানুষের পবিত্র বিশুদ্ধ হৃদয়]।
৭/৩– লোকবর্গের অধীশ্বর অমৃত-প্রাপক অনন্তস্বরূপ (অথবা জ্যোতির্ময়) পরমধনদাতা ভক্তিজ্ঞান (অথবা প্রসিদ্ধ দেবদ্বয়) পবিত্র-অন্তঃকরণ সাধককে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। সরলপবিত্ৰ-হৃদয় সাধকেরা ভগবানকে লাভ করেন)। [মন্ত্রের মধ্যে একটি পদ বিশেষভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে– অনবরম্। যিনি সরল ও পবিত্র হৃদয়, যার মধ্যে পাপ-কুটিলতা নেই, তিনিই হৃদয়ে ভগবানের স্পর্শ লাভ করতে পারেন। হৃদয়ের পবিত্রতাই প্রকৃত পূজোপহার। ভগবান মানুষের হৃদয় দেখেন। অনবহুর পদে তা-ই সূচিত করছে। আদিত্যা পদে দুটি ভাবকে লক্ষ্য করে– অদিতির পুত্রদ্বয় এবং অনন্তস্বরূপদ্বয় বা জ্যোতির্ময়দ্বয়। আমরা আমাদের মন্ত্রার্থে দুটি ভাবকে প্রদর্শন করেছি। একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদে কিন্তু একপেশে ভাবই দেখা যায়– সম্রাট, ঘৃতান্নভোজী অদিতির পুত্র, দাতা মিত্রাবরুণ অকুটিলাচারী যজমানকে সেবা করেন। ভাষ্যকারও তা বা তৌ পদে মিত্রাবরুণ পদ অধ্যাহার করেছেন। আমরা মনে করি ঐ পদ জ্ঞান-ভক্তিকেই লক্ষ্য করে]।
৮/১– না-প্রতিশব্দরহিত সর্বাভীষ্টপূরক ভগবান্ ইন্দ্রদেব, নবনবক-কর্মপরায়ণ অর্থাৎ অশেষসৎকৰ্মকারী ভগবানে উৎসৃষ্টপ্রাণ আত্মদানশীল নিষ্কাম-কর্মপর সাধকের অস্থিসমূহের দ্বারা অর্থাৎ লুপ্তাবশেষ আদর্শের দ্বারা জ্ঞান-অবরোধকারী সকল রকম শত্রুকে নাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মপরায়ণ জনের স্মৃতিও অপরের হিতসাধক হয়)। [এই মন্ত্রের পদ-বিন্যাস সমস্যাপূর্ণ। সুতরাং মন্ত্রার্থের সাথে নানা উপাখ্যানের সমাবেশ দেখতে পাই। মন্ত্রে নবতীর্ণব পদ থেকে নবগুণ নবতিসংখ্যক (মতান্তরে নিরানব্বই) অর্থ গ্রহণ করা হয়। নবনবতি তা বলতে যে কি রকম কার্য বোঝায়, সেই পক্ষে তিনি নানারকম মতের আভাষ দিয়েছেন। তথাপি ঐ এ পদে নিরানব্বই বার অর্থই প্রচলিত রয়েছে। তারপর, দধীচঃ অস্থভিঃ পদ দুটিতে দধীচি ঋষির অস্থিসমূহের দ্বারাঅর্থই চলে আসছে। বৃত্রাণি জঘান পদ দুটিতে বৃত্রগণকে হনন করেছিলেন এমন অর্থ গৃহীত হয়ে থাকে। এইভাবে এই মন্ত্রের অর্থ প্রচলিত হয়ে গিয়েছে, — অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্র দধীচি ঋষির অস্থিসমূহের দ্বারা বৃত্রগণকে নবগুণ নবতিবার (নিরানব্বই বার) বিনাশ করেছিলেন। এ রকম অর্থের মর্ম সহসা অনুভূত হয় না। সুতরাং এর সাথে উপাখ্যান ইত্যাদির সংযোগ হয়েছে। দধীচির অস্থি নিয়ে ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, — এই সংক্রান্ত উপাখ্যান অনেকেই অবগত আছে। সায়ণ তার ভাষ্যে তা-ই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঐ সব উপাখ্যানমূলে যে কি নিগূঢ় মর্ম পাওয়া যায়, তা আমরা বুঝতে পারি না। পরন্তু সাদাসিধা-ভাবে দেখলে মন্ত্রে বেশ সৎ-অর্থই প্রাপ্ত হওয়া যায়। সে পক্ষে, আর একবার মন্ত্রের অন্তর্গত পদ কয়েকটির অনুশীলন আবশ্যক। মন্ত্রে আছে নবতীর্ণব। আমরা বলি ঐ পদে নবনবক কর্মের বিষয় দ্যোতনা করছে। নবনবক কর্ম যে কাকে বলে, সে বিষয়ে। আমরা বিভিন্নস্থানে (ঋগ্বেদ, ১ম-৩২ সূ-৪ঋ; ১ম-৫৪সূ-৬ঋ ও ১ম-৫৭-৯ঋ) খ্যাপন করেছি। ফলতঃ যে সবসৎকর্মে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-চতুর্বর্গ ফল অধিগত হয়, তা ই নবনবক কর্ম। নবতীর্ণব পদে সেই কর্মকেই লক্ষ্য করে। দধীচঃ পদে নিষ্কাম কর্মপরায়ণ, ভগবানে উৎসৃষ্টপ্রাণ সাধককে বুঝিয়ে থাকে। যদি তিনি ঋষিবিশেষ হন, তাহলে কালচক্রে তাঁর চিরবিদ্যমানতা স্বীকার করতে হয়। অন্যথা ভগবানে উৎসৃষ্টপ্রাণ সাধকই ঐ পদের দ্যোতক। অস্থভিঃ পদে অস্থিসকল, কঙ্কাল অর্থাৎ লুপ্তাবশেষ আদর্শঅর্থ আসে। বৃত্ৰাণি পদে জ্ঞানের অবরোধক অজ্ঞানতা-সহচর শত্ৰুমাত্রকে লক্ষ্য করে। বৃত্র যদি সত্যিই দেহধারী অসুরই হবে, তাহলে সে নবগুণ নবতিবার নিহত হয়েছিল, এমন উক্তির কোনই সার্থকতা থাকে না। তাছাড়া, সে যখন একই অসুর, তখন বহুবচনান্ত বৃত্ৰাণি পদ কেমন করেই বা তার সম্বন্ধে প্রযুক্ত হবে? ফলতঃ, এ মন্ত্রের যে সার্থক ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা এই যে, — যাঁরা সৎকর্মশীল ভগবৎপরায়ণ, তাদের আদর্শের অনুসরণে জ্ঞান-আবরক (বা অবরোধক) সকল বাধাই অপসৃত হয়]।
৮/২– পর্বতের ন্যায় কঠোর অর্থাৎ প্রীতিভক্তিপরিশূন্য হৃদয়ে আশ্রয়প্রাপ্ত (লুক্কায়িত) জ্ঞানকিরণের (জ্ঞানের) প্রাধান্যকে যখন মানুষ অভিলাষ করে, তখন সেই প্রাধান্য তার অনান্ধকারে বিভাত হয়– ভগবানকে জানাতে সমর্থ হয়ে থাকে। (ভাব এই যে, জ্ঞান-অমুসরণের ফলেই মানুষের কঠোর হৃদয় প্রীতিভক্তির আশ্রয় হয়ে ভগবানকে লাভ করতে সমর্থ হয়ে থাকে)। [এই মন্ত্রের সঙ্গেও নানারকম উপাখ্যান সন্নিবিষ্ট হয়েছে। সেই সব উপাখ্যানের ভাব এই যে, দধীচি ঋষির মস্তক ছেদিত হলে তিনি অশ্বমস্তকে বিরাজমান ছিলেন; পরিশেষে সেই মস্তক যখন ছেদন করা হয় পর্বতসমূহের মধ্যে তা অবস্থিত ছিল। দধীচির সেই মস্তক পাবার জন্য ইন্দ্র অনেক সন্ধান করেন। তাতে কুরুক্ষেত্রের সান্নিধ্যে শণাবৎ সরোবরে তিনি সেই মস্তক প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই রকমে এই মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে, — পর্বতে লুক্কায়িত দধীচির অশ্বমস্তক পাবার ইচ্ছা করে ইন্দ্র সেই মস্তক শণাবৎ (সরোবরে) প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মস্তক হলো একটি; তা অবস্থিত রইল বহুপর্বতে (পর্বতে); আর তা প্রাপ্ত হওয়া গেল– শর্যাবৎ সরোবরে (শর্যণাবতি)। এর রহস্য উদ্ভেদে আমাদের সাধ্য নেই। আমরা কিন্তু অন্যভাবে ও অন্য দৃষ্টিতে মন্ত্রটির অর্থ নিষ্কাশন করেছি। পর্বতেষু পদে আমরা বলি পর্বতের মতো কঠোর অর্থাৎ প্রীতিভক্তিপরিশূন্য হৃদয়সমূহে। এ অপশ্রিতং পদে আশ্রয়প্রাপ্ত বা লুক্কায়িত অর্থ প্রাপ্ত হই। অশ্বস্য পদে জ্ঞানকিরণের অর্থ আসে। শিরঃ পদে প্রাধান্য অর্থ খ্যাপন করে। শণাবতি পদে ধাতু-অর্থের অনুসরণে অর্থ পেতে পারি–অজ্ঞান-অন্ধকারে। এই রকমে মন্ত্রের পদ কয়েকটির মর্ম পরিগ্রহ করেই আমাদের মন্ত্ৰাৰ্থ গঠিত হয়েছে]।
৮/৩– চন্দ্রমণ্ডলে সূর্য যেমন প্রতিফলিত হয়, সেইরকমভাবে পরিত্রাণকারী দেবতার অজ্ঞানান্ধকারনাশক তেজঃ, জ্ঞানকিরণ হতে ইহলোকেও মানুষ প্রাপ্ত হয়। (ভাব এই যে, -রাত্রিতে অন্ধকারে স্বচ্ছ চন্দ্রমণ্ডলের সূর্যরশ্মি যেমন প্রতিভাত হয়, তেমন অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্নজনের জ্ঞানসংসর্গযুত সুতরাং অনাবিল হৃদয়ে ভগবান্ কৃপা বর্ষণ করেন)। [এই সূক্তের প্রথম মন্ত্রের প্রচলিত অর্থে প্রকাশ পেয়েছে, ইন্দ্র দধীচি ঋষির অস্থিগুলি নিয়ে নিরানব্বই বার বৃত্রগণকে হনন করেছিলেন। দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রচলিত অর্থে প্রকাশ পেয়েছে দধীচির ঋষির অশ্বমস্তক পর্বতসমূহের মধ্যে লুক্কায়িত ছিল, ইত্যাদি। আর এই তৃতীয় মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ– আদিত্যরশ্মি এই গমনশীল চন্দ্রমণ্ডলে অন্তর্হিত ত্বতেজ এইভাবে পেয়েছিল। পরপর তিনটি মন্ত্রে এমন বিচ্ছিন্ন তিনরকম ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এগুলিতে পূর্বাপর সঙ্গতি না থাকলেও ভাষ্যে নিরুক্তনির্ঘন্টুর যে প্রমাণ ইত্যাদি উদ্ধৃত হয়েছে তার দ্বারা কয়েকটি বৈজ্ঞানিক-তত্ত্বে প্রাচীন ভারতের অভিজ্ঞতা ছিল বলে নির্দিষ্ট হয়। যেমন চন্দ্রের গতি সম্পর্কিত বিষয়, সূর্যের জ্যোতিঃতেই চন্দ্রের জ্যোতিষ্মনতা। কিন্তু সে পক্ষেও মন্ত্রের যে অর্থ প্রচলিত রয়েছে, তাকে সুষ্ঠু সঙ্গত অর্থ বলে মনে করা যায় না, কারণ তাহলে গো পদে গতিশীল অর্থ পরিগৃহীত হয়ে থাকে। আমরা গোঃশব্দে পূর্বাপর জ্ঞানরশ্মি অর্থ করে আসছি এবং এখানে এটিকে পঞ্চমান্ত পদ বলে নির্দেশ করি। তাহলে ঐ পদে জ্ঞানরশ্মি থেকে অর্থ আসে। এই লোকেও– এই পৃথিবীতেও মানুষ যে পরিত্রাণকারী দেবতার কৃপা প্রাপ্ত হয়, তার কারণ– মানুষে জ্ঞানসংযোগ। পূর্ব মন্ত্রেও এই ভাবই সম্বন্ধযুত আছে দেখতে পাই। সেখানে বুঝেছি, জ্ঞান-অনুসরণের ফলে মানুষ ভগবানের অনুকম্পা লাভ করতে সমর্থ হয়। এখানে দেখছি, একটি সুষ্ঠু উপমার মধ্য দিয়ে সেই ভাবই অধিকতর পরিস্ফুট রয়েছে। চন্দ্রমণ্ডল স্বচ্ছ; যে হৃদয়ে জ্ঞানকিরণ স্থান পেয়েছে, তা-ও অনাবিল– স্বচ্ছ। স্বচ্ছ চন্দ্রমণ্ডলে সূর্যরশ্মি প্রতিভাত হয়ে চন্দ্রমণ্ডলকে যেমন স্নিগ্ধজ্যোতিঃর আধাররূপে প্রতিষ্ঠিত রেখেছে, জ্ঞানের দ্বারা নির্মল পবিত্র স্বচ্ছ হৃদয়েও তেমন ভগবানের বিভা বিভাত হয়ে– সত্ত্বগুণের আধারে সে হৃদয়কে পরিণত করে]।
৯/১– হে বলাধিপতি (ইন্দ্র) এবং জ্ঞানদেব (অগ্নি)! মেঘ হতে যেমন প্রভূতপরিমাণ বারিবর্ষণ হয়, তেমন (অর্থাৎ প্রভূতপরিমাণে) প্রার্থনাকারী আমার উচ্চাৰ্যমাণ ঐকান্তিক প্রার্থনা আপনাদের পাবার জন্য উৎপন্ন হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — — হে ভগবন! আপনাকে পাবার জন্য আমি যেন প্রার্থনা করতে পারি)। [ভগবানের কৃপা না হলে কেউই তাকে জানতে পারে না, তাকে লাভ করতে পারে না। সেই জন্যই মন্ত্রে সেই পরমপুরুষের নিকটেই প্রার্থনা করা হয়েছে। ভাষ্যে এই ভাবই পরিগৃহীত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত অনেক ব্যাখ্যাতে এই ভাব রক্ষিত হয়নি। যেমন, — হে ইন্দ্র ও অগ্নি! মেঘ হতে বৃষ্টির মতো এই স্তোতা হতে এই প্রধান স্তুতি উৎপন্ন হয়েছে। এই অনুবাদে বাং পদের ব্যাখ্যা পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু ভাষার্থে বাং অর্থাৎ যুবাভ্যাং এবং আমাদের অর্থে পদই এই মন্ত্রের কেন্দ্রশক্তি। কারণ ভগবৎপ্রাপ্তির জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে এবং ঐ (বাং) পদ বাদ দিলে মন্ত্রটির মূল ভাবই নষ্ট হয়ে যায়। অভ্রা বৃষ্টিঃ ইব (মেঘ থেকে যেমন প্রভূতপরিমাণে বারিবর্ষণ হয়, তেমনই প্রভূতপরিমাণে) পদে প্রার্থনার পরিমাণ নির্দেশ করে। এই বলে মনে করাই সঙ্গত]।
৯/২- হে বলাধিপতে ও জ্ঞানদেব! প্রার্থনাকারী আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করুন এবং আমাদের পূজা গ্রহণ করুন; হে লোকাধিপতে! আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি (অথবা কর্মসমূহকে) পরাজ্ঞান (অথবা সৎ ভাব) দ্বারা পূর্ণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পূজা গ্রহণ করে আমাদের পরাজ্ঞানযুত সৎ-ভাবসম্পন্ন করুন)। [মন্ত্রের মধ্যে দুই বা বহু দেবতার নাম দেখে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের কেউ কেউ মনে করেন যে, বাস্তবিকই বুঝি বেদে বহুদেবতার উপাসনা আছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ আবার প্রকৃত সত্যেরও আভাষ পেয়েছেন। তারা বলছেন– না, এ বহুদেবতার উপাসনা নয়, মূলতঃ বহুদেবতাবাদ থাকলেও ক্রমশঃ জ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বহুবাদ একবাদে পরিণত হচ্ছিল, তাই আমরা এক মন্ত্রে একসঙ্গে বহুদেবের নাম প্রাপ্ত হই। তারা সত্যের পথে একটু অগ্রসর হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তথাপি আমরা বলতে বাধ্য যে, বহুদেবতাবাদ বলতে পাশ্চাত্য দেশে যা বুঝিয়ে থাকে, বেদে তা আদৌ নেই]।
৯/৩– সৎকর্মনেতা হে বলাধিপতে ও জ্ঞানদেব! পাপকর্ম হতে আমাদের রক্ষা করো; রিপুর আক্রমণ হতে আমাদের পরিত্রাণ করো; অপিচ, রিপুর কবল হতে আমাদের রক্ষা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আমাদের রিপুজয়ী সৎকর্মসমন্বিত করুন)। [প্রার্থনার মূলভাব পাপের আক্রমণ থেকে, রিপুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা। অবোধ দুর্বল মানুষ অজ্ঞানতার বশে রিপুর ছলনায় ভুলে অধঃপতনের দিকে চলতে থাকে। মানুষের এই স্বাভাবিক দুর্বলতার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভগবানের শক্তি ও জ্ঞানরূপী দুই বিভূতির কাছে প্রার্থনা করা। হয়েছে]।
.
চতুর্থ খণ্ড
সূক্ত ১০– পবস্ব দক্ষসাধনো দেবেভ্যঃ পীতয়ে হরে। মরুদ্ভো বায়বে মদঃ ১ সং দেবৈঃ শোভতে বৃষা কবির্যোবধি প্রিয়। পবমাননা অদাভ্যঃ। ২। পবমান ধিয়া হিতোহভিযোনিং কদিদৎ। ধর্মণা বায়ুমারুহঃ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১১– তবাহং সোম রারণ সখ্য ইন্দো দিবেদিবে। পুরুণি বল্লো নি চরন্তি মামব পরিধী রতি তা ইহি৷ ১৷ সামবেদ-সংহিতা তবাহং নজমুত সোম তে দিবা দুহানো বভ্র উধনি। ঘৃণা তপন্তমতি সূর্যং পরঃ শকুনা ইব পপ্তিম৷ ২
সূক্ত ১২– পুনাননা অক্রমীদভি বিশ্বা মৃধো বিচৰ্ষণিঃ। শুম্ভন্তি বিপ্রং ধীতিভীঃ ১। আ যোনিমরুণো রুহদ গমদিন্দ্রো বৃষা সুতম্। ধ্রুবে সদসি সীদতু৷৷ ২৷৷ নূনো রয়িং মহামিন্দোবস্মভ্যং সোম বিশ্বতঃ।আ পবস্ব সহণিম্ ৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১০সূক্ত/১সাম– হে পাপহারক শুদ্ধসত্ত্ব! আত্মশক্তিসাধক পরমানন্দদায়ক তুমি শুদ্ধ সত্ত্বস্বরূপ বিবেকরূপী দেবগণের এবং আশুমুক্তিদায়ক দেবতার প্রীতির নিমিত্ত আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানকে লাভের জন্য সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোক)। [ভাষ্যকার পূর্বে হরিঃ পদে হরিৎবর্ণ সোম অর্থ গ্রহণ করলেও এখানে ঐ পদে হরিতবর্ণ পাপহর্তবা অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা কিন্তু পূর্বেও হরিঃ পদে পাপহারক অর্থই গ্রহণ করে আসছি। এখানেও হরিঃ পদের সম্বোধনে হরে পদে হে পাপহারক শুদ্ধসত্ত্ব অর্থ গ্রহণ করেছি। আমাদের সাথে পার্থক্যটুকু বুঝতে একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ লক্ষণীয় হে হরিত্বৰ্ণ সোম! তুমি মদকর, তুমি দেবগণের, মরুৎগণের ও বায়ুর পানাৰ্থ ক্ষরিত হও। ব্যাখ্যার হরে পদে ভাষ্যকারের অনুসরণে পাপহারক অর্থ গ্রহণ করেননি। আমরা ভাষ্যকারের পাপহারক সোম কিংবা ব্যাখ্যাকারের হরিত্বৰ্ণ সোম কোনটিকেই গ্রহণ করছি না। আমরা বলেছি হে পাপ হারক শুদ্ধসত্ত্ব। কারণ আমাদের পূর্বাপর অভিমত– সত্ত্বভাবই পাপহরণকারী। সত্ত্বভাবের সাহায্যেই মানুষ দেবসাদৃশ্য লাভ করে। সমত্বের মধ্য দিয়েই মিলন সম্ভবপর হয়– মানুষের মধ্যে দেবভাব উপজিত হলেই দেবতার সাথে মিলন হয়]। .[এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১দ-৮সা) প্রাপ্তব্য]।
১০/২– অভীষ্টপূরক সর্বজ্ঞ সকলের প্রীতিসাধক অজাতশত্রু ভগবান্ সকল দেবভাবের সাথে আমাদের হৃদয়ে সম্যকরূপে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোম পদ অধ্যাহার করে ব্যাখ্যা করায় অর্থ দাঁড়িয়েছে– এই সোম আপন স্থানে অধিষ্ঠিত অভিলাষপ্রদ, কবি, প্রিয়, বৃত্ৰহা এবং অত্যন্ত দেবাভিলাষী হয়ে শোভিত হচ্ছেন। বৃত্ৰহা পদে বৃত্ৰনামক অসুর (ভাষ্যমতে) কিংবা জ্ঞানাবরক মানবশত্রু (আমাদের ব্যাখ্যানুসারে)। যাকেই লক্ষ্য করা যাক না কেন, ঐ অর্থ সোমের সম্বন্ধে কিভাবে প্রযোজ্য হতে পারে, তা আমরা বুঝতে পারি না। সোমরস নামক মাদকদ্রব্য মানবশত্রু নিধনকারী তো নয়ই, অধিকন্তু পাপপথের সহায়। তা বৃত্র নামক অসুরকে নাশ করবেই বা কিভাবে? সুতরাং এখানে সোমরস অধ্যাহারের দ্বারা মন্ত্রের অর্থরিকৃতি ঘটান হয়েছে বলা যায়]। ১০/৩– পবিত্রকারক হে দেব! সৎকর্মের দ্বারা (অথবা সৎ-বুদ্ধির দ্বারা) উৎপন্ন হয়ে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে বায়ুর ন্যায় শীঘ্রবেগে আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমরা সৎকর্মের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব যেন লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রের দুটি ভাব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমতঃ, হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদন করা। সৎকর্মসাধনের দ্বারা সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়– যদিও এই সৌভাগ্য লাভ সকলের ভাগ্যে ঘটে না। সুতরাং এই শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করাই একটা বিশেষ সৌভাগ্যের ও সাধনার পরিচায়ক। সৎকর্মের প্রভাবে যখন হৃদয় পবিত্র হয়, তখন সাধক সত্ত্বভাব প্রাপ্তির আশা করতে পারেন এবং ভগবানের কৃপায় তা লাভও করতে পারেন। কিন্তু সত্ত্বভাব বা অন্য কোনও মহৎ বস্তু লাভ করলেই হয় না, তা রক্ষা করাও চাই। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে এই রক্ষা শক্তি লাভের জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– নিধনকামম, সত্ৰাসাহীয়ম্ ও ত্বাষ্ট্রীসাম]।
১১/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! প্রার্থনাকারী আমি তোমার সখিত্ব নিত্যকাল যেন প্রার্থনা করি; হে আশ্রিতপালক সত্ত্বভাব! রিপুগণ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি সেই শত্রুদের বিনাশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপা করে আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করুন, আমরাও যেন রিপুজয়ী হতে পারি)। [মানুষ দুর্বল, তার চারিদিকে পরাক্রমশালী শত্রুগণ তাকে অধঃপতনের দিকে অনবরত টানছে। ভগবানের ভগবৎশক্তির সাহায্য ভিন্ন সে নিজের ইচ্ছাসত্ত্বেও অগ্রসর হতে পারছেনা। তাই কাতরভাবে ভগবানের আশ্রয় ভিক্ষা করছে। আমাদের ব্যাখ্যার সাথে প্রচলিত ব্যাখ্যার অনৈক্য থাকলেও তার মধ্যে আশ্রয় প্রার্থনার সুরই ধ্বনিত হয়েছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে সোম! তোমার বন্ধুত্ব লাভের জন্য আমি প্রত্যহ তোমাকে আহ্বান করি। বিস্তর রাক্ষস আমার প্রতি অত্যাচার করছে এবং আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হে পিঙ্গলবর্ণধারী! আমাকে রক্ষা করো। রাক্ষসদের নিধন করো। অন্তর ও বাহিরের রিপু ও অসুরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবার জন্য মানুষের এটাই চিরন্তন প্রার্থনা। তবে প্রচলিত ব্যাখ্যাকার এই প্রার্থনা করছেন সোমরস নামক মাদকদ্রব্যের কাছে, আমরা করছি মানুষের অন্তরস্থায়ী শুদ্ধসত্ত্বরূপী ঈশ্বরের কাছে– এইটুকুই পার্থক্য]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-৫দ-৬সা) প্রাপ্তব্য]।
১১/২– বিশ্বপালক হে শুদ্ধসত্ত্ব! অমৃতকারক আপনার সখিত্বে আমি যেন নিত্যকাল বর্তমান। থাকি; হে দেব! ঊর্ধ্বগমনশীল সাধক স্বলোকস্থিত জ্ঞানদেবকে প্রাপ্ত হন, তেমনই আপনার জ্যোতিঃদ্বারা দীপ্ত হয়ে আমরা যেন জ্যোতির্ময় আপনাকে প্রাপ্ত হই। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে বিদ্রো পদে পিঙ্গলবর্ণ অর্থ গৃহীত হয়। আবার প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারেই সোমরসকে অন্যত্র শুভ্রবর্ণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। একই জিনিষ একবার পিঙ্গলবর্ণ, আবার শুভ্রবর্ণ হয় কেমন করে তা বোঝা আমাদের সাধ্যাতীত। আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি যে, ভৃধাতু নিষ্পন্ন বিদ্রো পদে পালক অর্থই গ্রহণীয়। ভাষ্যকার এই মন্ত্রের অন্তর্গত দুহানঃ পদের স্থলে ঋগ্বেদীয় সখ্যায় পাঠ গ্রহণ করেছেন। আমরা তা সঙ্গত বলে মনে করি না। বেদের বিভিন্ন স্থলে বিভিন্ন পাঠ দৃষ্ট হয় বটে, কিন্তু সেই বিভিন্নতার নিশ্চয়ই নিগুঢ় কারণ আছে। সুতরাং মন্ত্রে শব্দের পাঠভেদ স্বীকার করলেও যে স্থলে যে পাঠ আছে, তা অপরিবর্তনীয়ভাবে গ্রহণ করা উচিত। আমরা তাই মন্ত্রের সামবেদীয় পাঠ দুহানঃ গ (দোথুঃ অমৃতদায়কস্য) পদই গ্রহণ করেছি। — প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রের প্রার্থনার মর্মার্থ এই যে, আমরা যেন নিত্যকাল ভগবানের কৃপালাভে সমর্থ হই। আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বলাভ করতে পারি। মন্ত্রের অন্তর্গত এক শকুনা ইব উপমার দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বলাভের উপায় বিশিষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। শকুন শব্দের সাধারণ অর্থ পক্ষী। পক্ষীগণ যেমন ঊর্ধ্বে গমন করেএই অর্থে শব্দটি ঊর্ধ্বগমনশীল সাধককে লক্ষ্য করছে। তাই শকুনা ইব পদ দুটিতে আমরা ঊর্ধ্বগমনশীলাঃ সাধকাঃ যথা অর্থ গ্রহণ করেছি। তাই মন্ত্রাংশের অর্থ দাঁড়িয়েছে সাধকেরা যেমনভাবে পরাজ্ঞান লাভ করেন, আমরাও যেন তেমনইভাবে অর্থাৎ সাধনার দ্বারা বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব লাভ করতে পারি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত ষোড়শটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– আষ্টাদংষ্ট্রোত্তরম আভীশবোত্তরম, স্বপৃষ্টম, অভীবর্তম উৎসেবম, জনিত্ৰাদ্যম, সমন্তম ইত্যাদি]।
১২/১– সর্বজ্ঞ পবিত্র শুদ্ধসত্ত্ব সমস্ত রিপুকে পরাজিত করেন। (ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়গত রিপুশত্রুদের বিদূরিত করেন)। তখন ভগবান্ সম্বুদ্ধির দ্বারা সেই মেধাবী ব্যক্তিকে অলঙ্কৃত করেন। (ভাব এই যে, আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধক রিপুজয়ী হন; তিনি ভগবনক্তৃপায় শুভবুদ্ধি লাভ করেন)। .[বিশ্বমঙ্গলনীতির বিরোধী না হলে সকলের আন্তরিক প্রার্থনাই পূর্ণ হয়। যিনি সৎপথে থেকে নিজেকে পবিত্র ও উন্নত করতে চান, ভগবান্ তাকে তেমন বুদ্ধি প্রদান করে মোক্ষলাভের পথে পরিচালিত করেন। তাই এই মন্ত্রে বলা হয়েছে– মেধাবী ব্যক্তিকে ভগবান্ সৎ-বুদ্ধি প্রদানের দ্বারা অলঙ্কৃত করেন। যিনি নিজেকে পবিত্র রাখতে বদ্ধপরিকর, তিনি নিশ্চিতই রিপুজয়ের দিকে মনোনিবেশ করবেন। কারণ, তা না হলে সাধনার প্রাথমিক অংশই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর যিনি ঐকান্তিকভাবে রিপুজয়ের জন্য সচেষ্ট হন, ভগবানের মঙ্গল বিধানে তিনি তাতে কৃতকার্য হয়ে থাকেন]।
১২/২– জ্যোতির্ময় দেব আমাদের হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন; অভীষ্টবর্ষক বলাধিপতি দেবতা আমাদের বিশুদ্ধ সত্ত্বভার গ্রহণ করে প্রার্থনাপরায়ণ আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [পূর্বের মন্ত্রে সোমকে বঅর্থাৎ পিঙ্গলবর্ণ বলা হয়েছিল। বর্তমান মন্ত্রে আবার বলা হচ্ছে– অয়ং অরুণবর্ণঃ সোমঃ। সোমশব্দ মূল মন্ত্রে নেই, এটি ব্যাখ্যাকারেরা অধ্যাহার করে এনেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই অধ্যাহারের ফলে সোম বহুরূপী হয়ে উঠছে। যাই হোক, আমরা এখানে সোমকে অধ্যাহার করার প্রয়োজন দেখি না। অরুণঃ পদে জ্যোতি ও জ্যোতিসমন্বিত বস্তুকে লক্ষ্য করে। সকল জ্যোতির যিনি জ্যোতিঃ, যা থেকে বিশ্বের সকল জ্যোতিঃ ক্ষরিত হয়, সেই পরম জ্যোতির্ময় দেবকেই অরুণঃ পদ লক্ষ্য করছে। সেই পরম দেবতাই আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন-মন্ত্রের প্রার্থনার এটাই সারমর্ম]।
১২/৩– হে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব! আপনি আমাদের সম্যকরূপে মহান প্রভূতপরিমাণ পরমধন ক্ষিপ্ত প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা যেন পরমধন লাভ করি)। [এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে অন্যভাব পরিগৃহীত হয়নি। অর্থাৎ এটিকে প্রার্থনামূলকই বলা হয়েছে। তবে মন্ত্রে যে একটি সোম শব্দ আছে, ভাষ্য ইত্যাদিতে তার বিশেষ কোনও ব্যাখ্যা করা হয়নি। ঐ সোম পদের সঙ্গে সম্বন্ধযুত আপবস্বপদের অর্থ করা হয়েছে, প্রদান করো। এ ব্যতীত অন্য অর্থ করবার উপায় নেই; কারণ পবস্ব ক্রিয়াপদের গৌণকর্ম অস্মভ্যং পদ মন্ত্রে আছে। তাই অর্থ করতে হয়েছে– আমাদের প্রদান করো। কিন্তু অন্যস্থলে এই সোম পবস্ব পদ দুটি থাকলে তার অর্থ করা হতো, -হে সোমরস, তুমি ক্ষরিত হও। অর্থাৎ সোমরসকে তরল। মাদকদ্রব্যরূপে গ্রহণ করা হতো। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রে এই সোম ও পবস্ব পদ দুটিতে, সোমের প্রকৃত স্বরূপ প্রকটিত করে দিয়েছে। সোম সত্যসত্যই পরমধনদাতা, আর তার কাছে প্রার্থনা করলে তা লাভ করা যায়। সুতরাং সে কি মাদকদ্রব্য সোম হতে পারে? অবশ্যই নয়। তা অবশ্যই মানুষের অন্তরস্থায়ী সেই বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব ব্যতীত আর কিছু নয়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– সত্ৰাসাহীয়, যাম, যামোত্তর ও গৌরাঙ্গিরসস্য সাম্]।
.
পঞ্চম খণ্ড
সূক্ত ১৩– পিবা সোমমিন্দ্র মন্তু ত্বা যং তে সুষাব হর্ষাদ্রিঃ। সোতুবাহুভ্যাং সুয়ো নাবা৷৷ ১৷৷ যস্তে মদো যুজ্যশ্চারুরক্তি যেন বৃত্রাণি হর্যশ্ব হংসি৷ স ত্বামিন্দ্র প্রভুবসো মমতু৷৷ ২. বোধা সু মে মঘবন্ বাচমেমাং যাং তে বসিষ্ঠো অর্চতি প্রশস্তি। ইমা ব্ৰহ্ম সধমাদে জুষস্ব৷ ৩৷
সূক্ত ১৪– বিশ্বাঃ পৃতনা অভিভূতরং নরঃ সম্পূস্ততক্ষুরিং জজনুশ্চ রাজসে। ক্রতে বরে হেমন্যামুরীমুতোমোজিষ্ঠং তরসং তরস্বিনম্। ১৷৷ নেমিং নমন্তি চক্ষ মেষং বি, অভিস্বরে। সুদীতয়ো বো অজ্ঞহোহপি কর্ণে তস্বিনঃ সমৃভিঃ ৷৷ ২৷৷ সমুরেভাসো অস্বরনিং সসামস্য পীতয়ে। স্বঃ পতিদী বৃধে বৃন্ত্রতো হ্যোজসা সমূতিভিঃ ৷৷ ৩৷
সূক্ত ১৫– যো রাজা চর্ষণীনাং যাতা রথেভিরখ্রিঃ। বিশ্বসাং তরুতা পৃতনানাং জ্যেষ্ঠং যো বৃত্ৰহা গৃণে৷৷ ১। ইং তং শুম্ভ পুরুন্নবসে যস্য দ্বিতা বিধৰ্তরি। হস্তেন বজ্রঃ প্রতি ধায়ি দর্শতো মহা দেবো ন সূর্যঃ। ২৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১৩সূক্ত/১সাম– পরম ঐশ্বর্যশালিন্ হে দেব! আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভার গ্রহণ করুন; আপনাকে প্রাপ্ত হয়ে সেই সত্ত্বভাব আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন। জ্ঞানভক্তিদাতা হে দেব! বজ্রের দ্বারা যেমন অশ্ব সংযত হয়, তেমন সাধকের জ্ঞানভক্তির দ্বারা সংযত কঠোর তপ আপনাকে প্রাপ্তির জন্য এই সত্ত্বভাব উৎপাদন করে। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব উৎপাদন করে কৃপাপূর্বক আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৫দ-৮সা) প্রাপ্তব্য]।
১৩/২– পাপহারক জ্ঞানদাতা বলাধিপতি হে দেব! আপনার সাথে মিলনসাধক সমীচীন যে পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব আছে, যে সত্ত্বভাবের দ্বারা আপনি রিপুশত্রুদের বিনাশ করেন, পরমধনদাতা হে দেব! আমাদের হৃদয়স্থিত সেই শুদ্ধসত্ত্ব আপনাকে তৃপ্ত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে ভগবানের সাথে মিলিত হই)। [হশ্ব পদে প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সাধারণতঃ হরিনামক অশ্বযুত অশ্ব গৃহীত হয়। ব্যাখ্যার শব্দগুলির প্রতি লক্ষ্য করলে, তাতে আপত্তির বিশেষ কিছু থাকে না। তবে হশ্ব পদের প্রচলিত অর্থ দাঁড়িয়েছে– যার হরী নামক অশ্ব আছে। কিন্তু হরি পদে যে পাপহারক ভগবৎশক্তিকে লক্ষ্য করে, তা আমরা পূর্বেই বিশ্লেষিত করেছি। সুতরাং ঐ হরী পদে আমরা মনে করি– পাপহারক ভগবানকেই লক্ষ্য করে। যুজ্যপদের অর্থ– যা যোজনা করে, মিলনসাধন করে। ঐ অর্থে শুদ্ধসত্ত্বের বিশেষণরূপে ঐ পদের সার্থকতা দেখা যায়। শুদ্ধসত্ত্বেই মানুষের এবং ভগবানের মধ্যে মিলনসূত্র]।
১৩/৩– পরমধনদাতা হে দেব! জ্ঞানী সাধক আপনার যে স্তুতি উচ্চারণ করেন, সেই স্তুতি আপনি সুষ্ঠুভাবে গ্রহণ করেন। সৎকর্ম সাধনের জন, (অর্থাৎ আমি যাতে সৎকর্মপরায়ণ হই সেই হেতু) হে দেব! আমার এই স্তোত্রসমূহ গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমার প্রার্থনারূপ পূজা গ্রহণ করুন)। [মন্ত্রের প্রার্থনা মে পদকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভাষ্য ইত্যাদিতে এই পদটি পরিবর্জিত হয়েছে। আমাদের ধারণা এই যে, -সাধকদের প্রার্থনাশক্তি দেখেই যেন মন্ত্রের প্রার্থনার প্রবর্তনা, -মন্ত্রে এই ভাবই প্রকাশিত এবং সেই ভাব মে পদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বসিষ্ঠং পদে ভাষ্যকার বসিষ্ঠ নামধারী ঋষিকেই লক্ষ্য করেছেন। প্রচলিত এক হিন্দী ব্যাখ্যাকে শ্রেষ্ঠ জিতেন্দ্রিয় অর্থ গৃহীত হয়েছে। আমরা পূর্বাপর এই পদে জ্ঞানীঅর্থই গ্রহণ করেছি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম– দৈর্ঘতমসম্ এবং মরায়ম]।
১৪/১– সাধকগণ মিলিত হয়ে সর্বব্যাপী রিপুসংগ্রাম জয়কারী বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে অর্থাৎ দেবতার নিকটে প্রার্থনা করেন, এবং আত্মজ্ঞানলাভের জন্য তাকে হৃদয়ে জাগরিত করেন; সুতরাং, বিশ্বমঙ্গল সাধনের জন্য আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত, রিপুনাশক, বীর্যবন্তু, ওজস্বিতম, বলবান, আশুমুক্তিদায়ক দেবতাকে পরমধন লাভের জন্য আমরা যেন আরাধনা করি; (ভাব এই যে, -মোক্ষলাভের জন্য আমরা যেন ভগবৎ-অনুসারী হই)। [বিশ্বব্যাপী রিপুর বিনাশ করতে পারেনভগবান্। আলোর। পাশে ছায়ার মতো, সু-এর পাশে কু-এর মতো, ভগবানের মঙ্গলময় নীতির পাশে অমঙ্গলের অনুচর রিপুগণও বর্তমান আছে। এই দ্বন্দ্ব না হলে বুঝি বিশ্বসৃষ্টির একটা অংশই অপূর্ণ থাকত। আদর্শ স্থাপনের জন্য, মানুষের নৈতিক ও ধর্ম জীবনকে শক্তিশালী করবার জন্য, এই অন্ধকারের অসুরের ও প্রয়োজনীয়তা আছে বটে; কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। ভগবানের বিশ্বমঙ্গলনীতির বশে অমঙ্গল তার, এ কার্য সম্পন্ন করে অন্তর্হিত হয়। কিন্তু মানুষকে এই রিপুর সাথে সংগ্রাম করতে হয়। মোক্ষলাভের পথে পাপমোহ প্রভৃতি অসুরগণ মানুষকে আক্রমণ করে। যাঁরা সেই মোক্ষযাত্রার পথে রিপুসংগ্রামে ভগবানের চরণে শরণ নেন, তারাই সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে মোক্ষলাভের জন্য প্রার্থনা আছে। মন্ত্রের সজুঃ পদটি লক্ষণীয়। ঐ পদের ভাষ্যানুসারী ব্যাখ্যা– পরস্পরং সঙ্গতা সত্যঃ। আমাদের মতও তাই। এই ব্যাখ্যা থেকে প্রাচীনকালে সমবেতভাবে উপাসনার প্রণালী প্রচলিত ছিল বলে অনুমান করা হয়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৪অ-৩দ-১সা) পাওয়া যায়]।
১৪/২– প্রাজ্ঞ সাধকগণ ঐকান্তিকতার সাথে সর্বব্যাপক শত্রুনাশক ভগবানকে দর্শনলাভের জন্য আরাধনা করেন; হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরাও প্রার্থনার প্রভাবে জ্যোতির্ময় এবং হিংসারহিত হয়ে আশুমুক্তিদায়ক ভগবানের কর্ণে সম্যকরূপে প্রার্থনা করো অর্থাৎ ভগবান্ যেভাবে তোমাদের স্তোত্র শ্রবণ করেন, তা করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমি সাধনার প্রভাবে যেন পবিত্র জ্যোতির্ময় হই; ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন)। [মন্ত্রটি দুই অংশে বিভক্ত। প্রথম ভাগে সাধকদের ভগবৎ-আরাধনারূপ নিত্যসত্য প্রখ্যাপিত হয়েছে এবং অপর অংশে সেই সত্যের উপর নির্ভর করে আত্ম-উদ্বোধনা আছে। ….ঐকান্তিকতার সাথে প্রার্থনা করলে তিনি নিশ্চয়ই তা গ্রহণ করেন। অতএব নিজের অক্ষমতার জন্য নিরাশ না হয়ে মুক্তিলাভের উপায়স্বরূপ ভগবানের আরাধনায় অগ্রসর হওয়াই উৎকৃষ্ট পন্থা। মন্ত্রটির প্রচলিত ব্যাখ্যা মোটের উপর সর্বত্র পরিষ্কার হয়নি। ভাষ্য ইত্যাদিতে অনেক পদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে সম্পূর্ণ অনুমানের সাহায্যে। উদাহরণস্বরূপ– মেষং পদ। ঐ পদ স্পর্ধাত্মক মি ধাতু নিষ্পন্ন। তা থেকে বিজয়ী, রিপুনাশক প্রভৃতি ভাব আসে। কিন্তু ভাষ্যকার এই পদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক উপাখ্যানের সৃষ্টি করেছেন। আমরা এমন উপাখ্যানের কোনও সার্থকতা দেখি না। আমরা মনে করি মেষং পদে ভগবানের রিপুনাশক রূপকেই লক্ষ্য করা হয়েছে]।
১৪/৩– যখন স্তোত্রগণ তাঁদের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণের জন্য ভগবানকেই স্তব করেন, তখন সৎকর্মাধিপতি বিশ্বপতি ভগবান্ সাধকদের মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য নিশ্চিতই আত্মশক্তি এবং রক্ষাকর্ম সহ সম্যক্রপে সাধকবর্গকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকদের মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য তাদের আত্মশক্তি প্রদান করেন, এবং তাদের সকল বিপদ থেকে সম্যকমে রক্ষা করেন)। [এই মন্ত্রে সাধকের সাধনশক্তি এবং ভগবানের করুণার কথা বিবৃত হয়েছে। ভগবান্ তার অপার করুণায় মানুষের মোক্ষ-বিধান করে থাকেন, তাদের সকলরকম বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। সাধকেরাও তাঁদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পৎ হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব– ভগবানের চরণে নিবেদন করেন, ভগবানের চরণে নিবেদন করবার, তাঁকে পূজোপহার দেবার একমাত্র বস্তু হৃদয়ের সত্ত্বভাব। ভগবানের ও সাধকের এই কর্মের বিষয়ই মন্ত্রে বিবৃত হয়েছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– ত্রৈশোকম]।
১৫/১– যে দেবতা আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকবর্গের পালক রক্ষক হন, এবং যে দেবতা সৎকর্মরূপ যান-সমূহের দ্বারা সংবাহিত হন, এবং অপকর্মপরায়ণ জনগণের দ্বারা অপ্রাপ্য হন; আর যে দেবতা সকল রিপুরূপ শত্রুসেনাগণের তারক নাশক হন; অপিচ, যে দেবতা অজ্ঞানতা নাশকারী হন; সেই মহান্ শ্রেষ্ঠ দেবতাকে আমি স্তব করি– স্তব করতে (অনুসরণ করতে) সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি। এ (এই মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, -সাধুদের পালক পাপিগণের বিমর্দৰ্ক সেই ভগবানকে অনুসরণ করতে আমি যেন সঙ্কল্পবদ্ধ হই)। ( ভাষ্যে কিংবা প্রচলিত ব্যাখ্যায় কতকগুলি পদের যে অর্থ নিষ্কাশন করা হয়েছে, তাতে আমরা একমত নই; অর্থাৎ আমরা সেই দৃষ্টিতে মন্ত্ৰাৰ্থ গ্রহণ করি না। ভগবান্ যে আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকদের রক্ষক, সৎকর্মরূপ রথসমূহের দ্বারাই যে হৃদয়ে ভগবানের আবির্ভাব হয়, এবং কাম ইত্যাদি রিপুশত্রুদের বিমর্দন-সাধন যে ভগবানের বা দেবতার কৃপা-সাপেক্ষ, এবং তিনি যে অজ্ঞানতারূপ অসুরের সংহারকারী, — মন্ত্রের অন্তর্গত বিশেষণগুলিতে আমরা এমন ভাবই পরিগ্রহণ করি। মন্ত্রের অন্তর্গত গৃণে পদে সাধক যে নিজেকে ভগবানের নিয়োজিত করবার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, তা-ই মনে আসে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-৫দ ১সা) পাওয়া যায়]।
১৫/২– রিপুনাশক দেবের উপাসক হে আমার মন! তুমি প্রসিদ্ধ বলাধিপতি দেবতাকে পাপের কবল হতে রক্ষা পাবার জন্য আরাধনা করো। তোমার পরমাশ্রয় ভগবানে দ্বিত্বভাব-রিপুনাশ ও ভক্তরক্ষা অর্থাৎ সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতদের বিনাশরূপ গীতা-উক্তলক্ষণ বর্তমান আছে। সেই পরমদেবতা লোকবর্গের পরমাকাঙক্ষণীয় মহান্ জ্ঞানস্বরূপ হন; তার হস্ত দ্বারা রক্ষাস্ত্র ধৃত হয়, অর্থাৎ তিনি রক্ষাস্ত্রধারী। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, — ভগবান্ পাপনাশক এবং সাধকদের রক্ষাকর্তা হন; পাপকবল হতে রক্ষা পাবার জন্য আমি সেই পরমদেবতার শরণগ্রহণ করছি)। [সাধক এখানে ভগবানের রিপুনাশক বিভূতিকেই বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন– তা অবসে ও বজ্রঃ পদ দুটির দ্বারা পরিস্ফুট হয়েছে। সাধক রিপুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে, তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ভগবানের শরণাপন্ন হয়েছেন। এখানে সাধক পাপকবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য নিজেকে রিপুনাশক দেবতার উপাসক বলে ভাবছেন। মন্ত্রের অন্তর্গত দ্বিতা পদ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ভগবানের দুই ভাব– রক্ষা ও সংহার। সৎকর্মকারী সাধুজনের রক্ষা এবং পাপাত্মা অসৎকর্মকারী তথা দুষ্কৃতিদের সংহার। দ্বিতা পদে তা-ই কীর্তিত হয়েছে]।
.
ষষ্ঠ খণ্ড
সূক্ত ১৬– পরি প্রিয়া দিবঃ কবিয়াংসি নপ্ত্যোহিতঃ। স্বানৈর্যাতি কবিক্রতুঃ। ১৷৷ স সূনুর্মাতরা শুচিৰ্জাতে জাতে অবোয়ৎ। মহান মহী ঋতাবৃধা। ২৷৷ প্র প্র য়ায় পন্যসে জনায় জুষ্টো অদ্ৰহঃ। বীত্য পনিষ্টয়ে৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১৭– ত্বং হ্যাঁতঙ্গ দৈব্য পবমান জনিমানি দ্যুমত্তমঃ। অমৃতত্বায় ঘোষয়৷ ১। যেনা নবথা দধ্যপোণ্ডুতে যেন বিপ্রাস আপিরে। দেবানাং সুমে অমৃতস্য চারুণণা যেন বাংসাশত৷ ২।
সূক্ত ১৮– সোমঃ পুনান ঊর্মিণাব্যং বারং বি ধাবতি। অগ্রে বাচঃ পবমানঃ কনিক্ৰদৎ৷৷ ১৷৷ ধীভিজন্তি বাজিনং বনে ক্রীড়ন্তমত্যবিম্। অভি ত্রিপৃষ্ঠং মতয়ঃ সমস্বর৷৷ ২৷৷ অসর্জি কলশাং অভি মীবাৎসপ্তির্ন বাজয়ুঃ। পুনাননা বাচং জনয়ন্নসিষ্যদৎ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ১৯– সোমঃ পবতে জনিতা মতীনাং জনিতা দিবো জনিতা পৃথিব্যাঃ। জনিতাগ্নের্জনিতা সূর্যস্য জনিতেন্দ্রস্য জনিতোত বিষ্ণোঃ। ১৷৷ ব্রহ্মা দেবানাং পদবীঃ কবীনামৃষিবিপ্রাণাং মহিষো মৃগাণা। শ্যেনো গৃধ্রাণাং স্বধিতিনানাং সোমঃ পবিত্রমত্যেতি রেভ৷৷ ২৷৷ প্রাবীবিপঘাচ ঊর্মি ন সিন্ধুর্গিরস্তোমান্ পবমাননা মনীষাঃ। অন্তঃ পশ্যন বৃজনেমাবণ্যা তিষ্ঠতি বৃষভো গোষু জানন্৷৷ ৩৷
মন্ত্ৰার্থ— ১৬সূক্ত/১সাম– প্রজ্ঞানসম্পন্ন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সৎকর্ম সাধনের দ্বারা দ্যুলোকের প্রিয় শক্তি অর্থাৎ আত্মশক্তি নিত্যকাল প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক; ভাব এই যে, জ্ঞানী এবং সৎকর্মসাধকগণই আত্মশক্তি লাভ করেন)। অথবা– মেধাবী ক্ৰান্তপ্রজ্ঞ শুদ্ধসত্ত্ব (ভগবা) সাধকদের হৃদয়ে সর্বদা বর্তমান আছেন। হৃদয়রূপ দ্যুলোকের প্রিয়শক্তিসমূহ সৎকর্মসাধনের দ্বারাই উদ্বোধিত হয়ে থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব নিত্যকাল বিরাজিত। সাধকের হৃদয়ের সকল শক্তি সৎকর্মসাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে উদ্বোধিত হয়ে থাকে)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত ব্যাখ্য– কবি ক্রান্তদর্শী সোম অভিষবণ প্রস্তরে নিহিত এবং অভিযুত হয়ে দ্যুলোকের অত্যন্ত প্রিয় পক্ষীগণের নিকট গমন করেন। এ ব্যাখ্যা থেকে মন্ত্রের কি উচ্চভাব সূচিত হয়, বোধগম্য হয় না। যাই হোক আমাদের দুরকম অন্বয়ে মন্ত্রে যে দুরকম ভাব পাওয়া যায়, তা-ই পরিবেশিত হলো। -স্থূলদৃষ্টিতে ভাব বিভিন্ন প্রতীয়মান হলেও মূলতঃ কোনই প্রভেদ নেই। সাধকের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ চিরবিরাজমান আছেন এবং সৎকর্মসাধনের দ্বারা তাকে লাভ করবার শক্তি জাগরিত হলে ভগবান স্বয়ং এসে হৃদয়ে আবির্ভূত হন, উভয় অন্বয়ই এই ভাব প্রকাশ করছে। ভগবানের করুণাধারা বর্ষিত না হলে, হৃদয়ে তার অধিষ্ঠান না হলে, কি আর শুদ্ধসত্ত্বের অধিকারী হওয়া যায়? না, সৎকর্ম-সাধনে প্রবৃত্তি আসে? তাই, শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবানকে পেতে হলে সেই অনুরূপ গুণে গুণান্বিত হবার এবং সেই ভাবে ভাবান্বিত হবার উপদেশ মন্ত্রে দেওয়া হয়েছে]। [এই। মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১দ-১০সা) দ্রষ্টব্য]।
১৬/২– ভগবান্ হতে উৎপন্ন, মহান, বিশুদ্ধ, প্রসিদ্ধ, ভগবানের পুত্রস্থানীয় সত্ত্বভাব, মহৎ সত্যের বর্ধনকারিণী বিশ্বের জনয়িত্রী এবং মাতৃস্থানীয় জ্ঞানভক্তিকে সাধকের হৃদয়ে সম্যকরূপে প্রকাশিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা জ্ঞানভক্তি প্রবর্ধিত হয়)। [সত্ত্বভাব ভগবানেরই শক্তি, ভগবান্ হতে উৎপন্ন এবং সেই হেতু বিশুদ্ধ ও পবিত্র। ভগবাহতে উৎপন্ন বলেই তাকে সূন্যঃ অর্থাৎ ভগবানের পুত্রস্থানীয় বলা হয়েছে। ঋতাবৃধা মাতরা প্রভৃতি দ্বিবচনান্ত পদগুলি জ্ঞানভক্তিকে লক্ষ্য করে বলে আমরা মনে করি। ভাষ্যকার দ্যাবাপৃথিব্যৌ পদ অধ্যাহার করেছেন, এবং সঃ পদের অর্থ করেছেন সোমাখ্যঃ। তাতে অর্থ হয় এই যে, -সোমাখ্য পুত্র মাতৃস্থানীয়া, জগতের জনয়িত্রী দ্যাব্যাপৃথিবীকে দীপ্ত করেন। অর্থাৎ সোম এখানে দ্যাবাপৃথিবীর পুত্র। সম্পর্কটা (প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে তুলনা করলে) এখানে নূতন ধরনের। তারপর সোমরূপ পুত্র, দ্যুলোকভূলোককে কিভাবে দীপ্ত করতে পারে; তা বোঝা যায় না। এই দ্যাবাপৃথিবী আবার বিশ্বের জনয়িত্রী। কিন্তু সোম এমন মাতারও মুখ উজ্জ্বল করেন– অরোচয়ৎ– দীপয়তি। প্রচলিত এক ব্যাখ্যাতে সোমরসের উল্লেখ নেই; তা এই– জাতবিশুদ্ধ মহান্ সেই পুত্র, মহতী ও যজ্ঞের বর্ধয়িত্রী ও জনয়িত্রী মাতৃভূতা (দ্যাবাপৃথিবীকে) প্রদীপ্ত করেন। এই ব্যাখ্যার সাথে ভাষ্যের অনেক স্থলে অনৈক্য আছে। কিন্তু পুত্রটি যে কে তার উল্লেখ নেই]।
১৬/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! মোসাধক অজাতশত্রু আপনি স্তুতি প্রাপ্ত হয়ে ক্ষয়শীল পাপী প্রার্থনাকারী আমার গ্রহণের জন্য প্রকৃষ্টরূপে আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -মোক্ষলাভের জন্য বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [ভাষ্যকার এবং প্রচলিত ব্যাখ্যাকারবৃন্দও মন্ত্রটিকে প্রার্থনামূলক বলে গ্রহণ করেছেন। তবে উভয় প্রার্থনার পার্থক্য আমাদের মন্ত্রার্থের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে উপলব্ধ হবে। প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– তুমি তোমার নিবাসভূত, দ্রোহরহিত স্তুতিকারী মনুষ্যের ভক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত, তুমি অন্নবিশিষ্ট ধারা দ্বারা আগমন করো। ভাষ্যকার এই ব্যাখ্যার সাথে হে সোম সম্বোধন পদ অধ্যাহার করেছেন এবং এই প্রচলিত বঙ্গানুবাদের ভাবও তা-ই। সোমকেই ধারারূপে আগমন করবার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু সমগ্রভাবে মন্ত্রটি পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীত হয় যে, মন্ত্রের সাথে সোমরসের কোন সম্পর্ক নেই। ভাষ্যকারের একটি ত্রুটি, তিনি অহঃ পদকে চতুর্থ্যন্তরূপে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি প্রথমান্ত পদ এবং জুষ্টঃ পদের সাথে সত্ত্বভাবের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত। প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকে এই ভাব অনুমিত হয় যে, একজন মদ্যপ যেন যথেষ্ট পরিমাণ মদ্য পাবার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে। কিন্তু এমন হীন আকাঙ্ক্ষা বা প্রার্থনা বেদের পবিত্র অঙ্গে নিতান্তই অশোভন। আমরা মনে করি, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্যই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয়েছে এবং মন্ত্রের অন্তর্গত প্রতিটি পদের দ্বারা তা সমর্থিত হয়]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গান আছে এবং সেগুলির নাম, — ঔর্ণায়বোত্তরম, ঔর্ণায়বাদ্যম, বৃহদ্ভাদ্বোজম, গৌষুকম্ এবং ঈনিধনস্মার্গীয়বম্]।
১৭/১– পবিত্রকারক হে সত্ত্বভাব! পরমদীপ্তিসম্পন্ন আপনিই দেবতাদের জানেন; আপনিই শীঘ্র অমৃতলাভের জন্য লোকবর্গকে আহ্বান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাবের দ্বারা লোকগণ আশুমুক্তি লাভ করেন)। [ছন্দার্চিকে এই মন্ত্রটির বিশ্লেষণে আমরা দেখিয়েছি প্রচলিত ও ব্যাখ্যাকার তাঁর অনুবাদে সোমরসকে এনে সাংঘাতিক অর্থান্তর ঘটিয়েছেন। তিনি তার অনুবাদের টীকায় লিখেছেন, — অমৃতপান করে দেবগণের অমরত্ব লাভ করা-রূপ পৌরাণিক গল্প সোমরসের বৈদিক বর্ণনা থেকে উৎপন্ন। ব্যাখ্যাকার অমৃত ও অমরত্বকে নিছক গল্প বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। তাহলে আবারই এই কথা মানতে হয় যে, সোমরস পানে ঝুঁদ হয়ে আমি অমৃতপানে অমর হয়েছি– এটাই একমাত্র সত্য! এ সম্বন্ধে বেশী আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। বেদমন্ত্রের কেমন অর্থবিকৃতি চলে আসছে, তা প্রদর্শন করবার জন্য এটুকু উদ্ধৃত হলো]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকের ৫অ-১১দ-৬সা তেও পাওয়া যায়]।
১৭/২– ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন ধারণশীল সাধক যে শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা মোক্ষমার্গ জানেন, এবং জ্ঞানিগণ যে শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা মোক্ষপ্রাপ্ত হন; অপিচ, পরমানন্দ প্রাপ্তির জন্য সাধকগণ সকল দেবগণের (অথবা ভগবানের) কল্যাণস্বরূপ অমৃতের পরাশক্তি লাভ করেন, সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমরা যেন লাভ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন মোক্ষদায়ক ভগবৎপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রের মধ্যে প্রার্থনামূলক কোন পদ নেই সত্য, কিন্তু মন্ত্রটি সমগ্রভাবে বিচার করলে প্রার্থনার ভাব আপনিই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ভাষ্যকার যে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে মন্ত্ৰাৰ্থ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। অধিকন্তু তিনি দ্বারং একটি পদ অধ্যাহার করেছেন। তিনি অব্যবহিত পূর্ব মন্ত্রের সাথে বর্তমান মন্ত্রটিকে অন্বিত করায় মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচলিত অন্য দুএকটি ব্যাখ্যাতেও মন্ত্রটিকে নিত্যসত্যমূলক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য এই মন্ত্রের নিত্যসত্যমূলক ব্যাখ্যা যে অসঙ্গত, তা বলা যায় না; কিন্তু মন্ত্রে প্রার্থনার ভাবই অধিকতর পরিস্ফুট। কিন্তু প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে আমাদের মতভেদের কারণ আরও গভীর। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– তুমি সেই সোম, যার সাহায্যে অঙ্গিরস বংশসম্ভুত দধ্য নামক ব্যক্তি তার নিজের অপহৃত গাভীর সন্ধান পেয়েছিলেন এবং যার সাহায্যে তার মেধাবী পুত্রেরা সেই গাভী প্রাপ্ত হয়; যার সাহায্যে সুচারুরূপে যজ্ঞকার্য সম্পন্ন হয়ে দেবতারা পরিতোষ প্রাপ্ত হলে যজ্ঞকর্তা ব্যক্তিগণ অন্নলাভ করে থাকেন। এই ব্যাখ্যা থেকে পরিদৃষ্ট হবে যে, এক দধ্য শব্দকে উপলক্ষ করে ব্যাখ্যাকারগণ এক প্রকাণ্ড উপাখ্যানের সৃষ্টি করেছেন। ভাষ্যকার আবার এই ব্যাখ্যারও একধাপ উপরে গিয়ে সেই গাভীগুলি যে পণি নামক অসুর, কর্তৃক অপহৃত হয়েছিল, তা-ও বলে দিয়েছেন। কিন্তু দধ্যঙ পদের অর্থ ধারণশীল। যিনি সত্যকে, জ্ঞানকে, ধারণ করতে পারেন, তাকেই দধ্য পদে লক্ষ্য করে। এখানে পণি অঙ্গিরস প্রভৃতির অবান্তর উপাখ্যানের অবতারণা করার কোন সার্থকতা নেই]। [এই সূক্তের অন্তর্গত দুটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম—বৃহৎকম, স্বারসৌপর্ণম, শাঙ্কুম এবং সত্ৰাসাহীয়ম্]।
১৮/১– পবিত্রকারক সত্ত্বভাব ধারারূপে জ্ঞানপ্রবাহকে বিশেষভাবে প্রাপ্ত হন। পবিত্রকারক তিনি আমাদের স্তোত্র লাভ করে আমাদের জ্ঞান প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, সত্ত্বভাব ও জ্ঞানের মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বর্তমান আছে; আমরা যেন জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাব লাভ করি)। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৫অ-১০দ-৭সা) দ্রষ্টব্য]।
১৮/২– সাধকগণ স্তুতির দ্বারা আত্মশক্তিদায়ক জ্যোতির্ময় পরাজ্ঞান হৃদয়ে সমুৎপাদন করেন। নিত্যকাল সকল লোকের স্তুতি সেই পরাজ্ঞান পাবার জন্য প্রার্থনা করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সাধকগণ নিত্যকাল পরাজ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করেন)। [মন্ত্রটির প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে নানারকম কল্পনার খেলা দেখা যায়। মন্ত্রের সাথে ব্যাখ্যাগুলি একসঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে, একটি যে অন্যটির ব্যাখ্যা, তা মনে হয় না। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ-দ্রুতগামী সোম মেষলোম অতিক্রমপূর্বক জলমধ্যে ক্রীড়া করছেন, স্তুতিবাক্য সহকারে তাঁকে চালিয়ে দিচ্ছে; তিন বার নিষ্পীড়নপূর্বক তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন এবং স্তবের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হচ্ছেন। ভাষ্যকারও এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নবনীয়ে পদ বাইরে থেকে অধ্যাহার করে এনেছেন, অথচ ঐ পদ মূলে নেই। অধিকন্তু বনে পদের ব্যাখ্যা পরিত্যাগ করেছেন। এ ছাড়াও কতকগুলি পদের ভাষ্যানুগত ব্যাখ্যা সম্বন্ধেও আমরা একমত হতে পারি না। তবে বিশেষ কথা এই যে, তিনি মন্ত্রের ব্যাখ্যায় যে সোমরসকে এনেছেন, তার কোনও আবশ্যকতা ছিল না। মন্ত্রের মধ্যে একটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক হয়েছে। তার সারমর্ম এই যে, সাধকগণ নিত্যকালের পরাজ্ঞানলাভের জন্য ভগবানের নিকট প্রার্থনাপরায়ণ হন। আমরা এই ভাবই মন্ত্রটিকে গ্রহণ করেছি]।
১৮/৩– যুদ্ধাশ যেমন শীঘ্রবেগে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তেমনই শীঘ্রগতিতে, সাধকদের শক্তিদায়ক, অভীষ্টবর্ষক শুদ্ধসত্ত্ব, সাধকদের হৃদয়ে উৎপাদিত হন। পবিত্রকারক সেই সত্ত্বভাব জ্ঞান প্রদান করে তাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -অভীষ্টদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের হৃদয়ে সমুদ্ভূত হন)। [ভাষ্য ইত্যাদি প্রচলিত ব্যাখ্যাতে সোমরসের সাথে মন্ত্রের সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রে সোমরসের কোন প্রসঙ্গ আছে বলে আমরা মনে করি না। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, ভাষ্যকার কোথা থেকে সোমঃ পদ অধ্যাহার করলেন, এবং কেন করলেন বোঝা গেল না। তবে এতেই যে মন্ত্রের অর্থ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে, একথা সত্য। — মন্ত্রে একটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে– সপ্তিঃ ন। অর্থ– যুদ্ধাশ্ব যেমন….প্রবেশ করে। এই ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আমরা ভাষ্যেরই অনুসরণ করেছি। মন্ত্রের ভাবার্থ-সাধকেরা তাদের সাধনার প্রভাবে হৃদয়ে সত্ত্বভাব লাভ করে থাকেন। শুদ্ধসত্ত্বের সাথে জ্ঞানের নিত্য সম্বন্ধ। তাই হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার হলে সঙ্গে সঙ্গে পরাজ্ঞানেরও উদয় হয়। — মন্ত্রে এই সত্যই প্রখ্যাপিত হয়েছে]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– আতীষাদীয়ম, সুজ্ঞানম, শ্রুধ্যম এবং ক্রোশম]।
১৯/১– সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন হোন; তিনি বুদ্ধিবৃত্তির উৎপাদক, দেবভাবের জনক, পৃথিবীস্থ সকল লোকের সৃষ্টিকর্তা, তিনি জ্ঞানের উৎপাদক, জ্ঞানকিরণের প্রকাশক, আত্মশক্তির মূলকারণ; অপিচ, অখিল দেশের ধারণকর্তা। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — ভগবানের শক্তিস্বরূপ সত্ত্বভাব থেকে নিখিল বিশ্ব উৎপন্ন হয়েছে)। [এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– সোম ক্ষরিত হচ্ছেন। এর থেকেই স্তুতিবাক্যসমূহের উৎপত্তি, এঁর থেকেই দ্যুলোক ও ভূলোক ও অগ্নি ও সূর্য ও ইন্দ্র ও বিষ্ণুর উৎপত্তি। সায়ণ-ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রের এই অনুবাদটি আমরা সোমরসে কুঁদ হয়ে থাকা ব্যক্তির প্রলাপ বলেই মনে করতে পারি। কারণ সোমরস নামক মাদকদ্রব্য যে কিভাবে ইন্দ্ৰ বিষ্ণু প্রভৃতির জনয়িতা হতে পারে, তা সুস্থ স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বোঝা যায় না। — ভাষ্যকার জনিতা পদের বিভিন্ন অর্থ করেছেন, তা সঙ্গত বলে হয় না। আমরা এই পদের অর্থ করেছি উৎপাদক]। [ছন্দার্চিকেও (৫অ-৬দ-৫সা) এই মন্ত্রটির বিশ্লেষণ দ্রষ্টব্য]।
১৯/২– শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞান প্রদান করে পবিত্র হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। সেই শুদ্ধসত্ত্ব কেমন? তিনি সকল দেবতার রাজা (অথবা সকল দেবভাবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ) হন। প্রাজ্ঞদের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞ, জ্ঞানীদের মধ্যে সত্যদ্রষ্টা, পশুদের মধ্যে মহান পশুরাজ, পক্ষীদের মধ্যে উধ্বর্গতিসম্পন্ন পক্ষীরাজ, অস্ত্রের মধ্যে পরশু (অথবা সৎকর্মের মধ্যে ভগবৎ-আরাধনা) শ্রেষ্ঠ হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ হন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটিকে সোমরসের মহিমা-জ্ঞাপক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু যে সমস্ত বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে এটি সোমরস নামক মদ্যের মাহাত্ম্য-সূচক কিভাবে হতে পারে, তা আমরা বুঝতে পারি না। যাস্কের নিরুক্তে অন্যরকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাতে দেবানাং প্রভৃতি মন্ত্রের প্রত্যেকটি ষষ্ঠ্যন্ত পদের অর্থ করা হয়েছে আদিত্যরশ্মি। এটা আধিদৈবিক ব্যাখ্যা। অপিচ, এতে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও একটি প্রদত্ত হয়েছে। তাতে মন্ত্রের সমস্ত ষষ্ঠ্যন্ত পদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে ইন্দ্রিয়। — আমাদের ব্যাখ্যা অনেকটা ভাষ্যানুসারী। প্রচলিত ব্যাখ্যানুসারে এখানে সোমরসের সম্বন্ধ বিষয়ে পূর্ব মন্ত্রের বক্তব্য প্রযোজ্য। জগৎ সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু সত্ত্বভাব। অথবা সত্ত্বভাব ভগবৎশক্তি। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই জগৎ বিধৃত ও পরিচালিত হয়েছে। মন্ত্রের নানারকম উদাহরণের মধ্য দিয়ে তাই পরিব্যক্ত হয়েছে]।
১৯/৩– সমুদ্র যেমন তার ঊর্মি প্রেরণ করে, সেইভাবে পবিত্রকারক দেব সাধকদের হৃদয়ে প্রভূত পরিমাণ ঐকান্তিক জ্ঞানসমন্বিত প্রার্থনা এবং জ্ঞানপ্রবাহ উৎপাদন করেন। অভীষ্টবর্ষক অন্তর্যামী অবার্যা আত্মশক্তি ইত্যাদি প্রাপক সেই দেব পরাজ্ঞানে বর্তমান থাকেন অর্থাৎ পরাজ্ঞানদায়ক হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানই লোকবর্গের পরম কল্যাণপ্রদ জ্ঞানদায়ক হন)। [মন্ত্রটি বড়ই জটিল। নানা ব্যাখ্যাকার নিজের নিজের অভিরুচি অনুসারে নানারকম ব্যাখ্যা করেছেন। তাই বিভিন্ন ব্যাখ্যায় এক পদেরই বিভিন্ন অর্থ করা হয়েছে। ভাষ্যকার অন্তঃ পদের অর্থ করেছেন– অন্তৰ্হিতং বস্ত্রজাতং। এখানে বস্ত্র কোথা থেকে এল বোঝা যায় না। আবার অন্য একজন ব্যাখ্যাকার ঐ পদেরই অর্থ করেছেন– অন্তঃকরণ। তাই অন্তঃ পশ্যম পদে দুটির অর্থ হয়েছে– অন্তর্যামী। আমরাও তা সঙ্গত মনে করি এবং ঐ অর্থই গ্রহণ করেছি। অন্যান্য পদের ব্যাখ্যা সম্বন্ধেও এইরকম মতপার্থক্য দৃষ্ট হয়। তবে একবিষয়ে প্রচলিত প্রায় সব ব্যাখ্যার মধ্যে ঐক্য আছে। তা মন্ত্রে সোমের সম্বন্ধ কল্পনা। মূলে কোন সোম শব্দ নেই, এবং তা অধ্যাহার করবার কোন প্রয়োজনও মনে করি না]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত চারটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম—মহাবাৎমপ্রম, জনিত্ৰাদ্যম, যজ্ঞায়জ্ঞীয়ম এবং শ্যাবাশ্বম্]।
.
সপ্তম খণ্ড
সূক্ত ২০– অগ্নিং বো বৃধধ্বরাণাং পুরূতমম্। অচ্ছা নত্রে সহস্বতে৷৷ ১। অয়ং যথা ন আভুবৎ ত্বষ্টা রূপেব তক্ষ্যা। অস্য ক্ৰত্বা যশস্বতঃ। ২। অয়ং বিশ্বা অভি শিয়োহগ্নির্দেবেষু পত্যতে। আ বাজৈরুপ নো গমৎ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ২১– ইমমিন্দ্র সুতং পিব জ্যেষ্ঠমমং মদ। শুক্ৰস্য জ্বাভ্যক্ষর ধারা ঋতস্য সাদনে৷ ১ন কিষ্টবথীতরো হরী যদিন্দ্র যচ্ছসে। ন কিষ্টবানু মঞ্জুনা ন কিঃ স্বশ্ব আনশে৷৷ ২৷৷ ইন্দ্রায় নূনমর্চতোথানি চ ব্রবীতন। সুতা অমৎসুরিন্দবো জ্যেষ্ঠং নমম্যতা সহঃ৷৷ ৩৷৷
সূক্ত ২২– ইন্দ্র জুষস্ব প্র বহা যাহি শূর হরিহ। পিবা সুতস্য মতিন মধধাশ্চকানশ্চারুমদায়। ১। ইন্দ্র জঠরং নব্যং ন পৃণস্ব মোর্দিবোন। অস্য সুতস্য স্বাতননাপ স্বা মদাঃ সু বাচো অস্তুঃ। ২৷৷ ইন্দ্ৰস্তুরাষাণমিত্রো ন জঘান বৃত্ৰং যতিন। বিভেদ বলং ভৃগুর্ন সসাহে শত্রু মদে সোমস্য৷৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ২০সূক্ত/১সাম– হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! (আমার) পতন নিবারণের জন্য এবং উচ্চ জ্ঞান লাভের জন্য, তোমরা যজ্ঞের বর্ধক ও শ্রেষ্ঠ পূরক জ্ঞানস্বরূপ দেবতাকে আরাধনা করো। [মন্ত্রে, বঃ পদ আছে বলে, এবং কার উদ্দেশে ঐ বঃ পদটি প্রযুক্ত, তার জ্ঞাপক কোনও সম্বোধন-পদ মন্ত্রের মধ্যে না থাকায়, ভাষ্যে তা অধ্যাহার করে হে ঋত্বিজঃ এই সম্বোধন পদটি স্থান পেয়েছে। আর, সহস্বতে ও নপত্রে এই পদ দুটিতে বিভক্তি ব্যত্যয় স্বীকার করে, ঐ পদ দুটি অগ্নি পদের বিশেষণ বলে গৃহীত হয়েছে। তাতে অর্থ দাঁড়িয়েছে, — হে ঋত্বিগণ! তোমরা অহিংস্য ও বলিদের বন্ধু, বলবান, জ্বালানিচয়ে বর্ধমান ও প্রচুর অগ্নিকে সর্বতোভাবে গমন (লাভ) করো। আধুনিক ব্যাখ্যাকারগণও সায়ণভাষ্যকে অল্পবিস্তর অতিরঞ্জিত করে, প্রায় ঐ একই অর্থ স্বীকার করেছেন। কিন্তু অগ্নিকে সর্বতোভাবে গমন করো বা লাভ করো এমন উক্তিকে অর্চকের কি স্বার্থ আছে, অথবা সাধারণের পক্ষে এই নিত্য সত্য বেদমন্ত্র কি উচ্চভাব শিক্ষা দিচ্ছে, তা বোঝা যায় না]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (১অ-৩দ-১সা) প্রাপ্তব্য]।
২০/২– পরিত্রাণকারক দেব যে রকমে সাধকদের উদ্ধার করেন, তেমনভাবে পরমদেবতা আমাদের কর্তব্যের রূপ প্রদর্শন করুন, অর্থাৎ আমাদেরও উদ্ধার করুন; ভগবানের প্রজ্ঞানের দ্বারা যুক্ত হয়ে আমরা যেন যশস্বী হতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের মোক্ষমার্গ প্রদর্শন করুন এবং পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [ভগবানের কৃপায় যেন আমরা যথাবিহিত কর্তব্য সম্পাদন করে যশস্বী হতে পারি অর্থাৎ সৎকর্মসাধনজনিত আত্মতৃপ্তি ও খ্যাতি যাতে লাভ করতে পারি, মন্ত্রে তার জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে। এখানে সুখ্যাতি বলতে সাধারণ লোকের আকাঙ্ক্ষিত ধনবান ইত্যাদি জনিত প্রসিদ্ধিকে বোঝাচ্ছে না। যশ বলতে এখানে সৎকর্মসাধনজনিত বিমল আনন্দ ও তৃপ্তি এবং সৎ-জনমণ্ডলের যথোচিত শ্রদ্ধা প্রভৃতিকে লক্ষ্য করছে। — মন্ত্রটির প্রচলিত ব্যাখ্যা সম্পর্কে নানা মুনি নানা মত প্রকটিত করেছেন। একজন ব্যাখ্যাকার এটির অনুবাদ করেছেন, এই অগ্নি, আমাদের কর্তব্যের রূপ নির্মাণ করেন, আমরা অগ্নির কার্যের দ্বারা যশোবিশিষ্ট হই। ভাষ্যকার অনেক স্থলে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন, কোন কোন স্থলে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল মন্ত্রকে জটিলতর করে তুলেছেন]।
২০/৩– সকল দেবতার (অথবা দেবভাবের) মধ্যে প্রসিদ্ধ জ্ঞানদেবই (অথবা পরাজ্ঞানই) লোকবর্গকে সকল কল্যাণ প্রদান করেন। সেই দেবতা আমাদের আত্মশক্তির সাথে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রের প্রথম অংশের সারমর্ম এই যে, জ্ঞানই মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ দিতে পারে। মানুষের মধ্যে যে সমস্ত সৎ-বৃত্তি বা দেবভাব আছে, তাদের মূলে আছে– জ্ঞান। পরাজ্ঞানের বলেই মানুষ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হতে পারে। তাই মন্ত্র বলছেন, — অগ্নিঃ দেবেষু অভিপত্যতে শিয়ঃ। মন্ত্রের অপরাংশে সেই পরম কল্যাণজনক সত্ত্বভাব প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা আছে। এমন যে পরম কল্যাণজনক পরাজ্ঞান, যার দ্বারা মানুষের জীবনের চরম অভীষ্ট সাধিত হয়, সেই পরম বস্তু পাবার জন্য কে আগ্রহান্বিত হয়? মন্ত্রের শেষাংশে সেই পরাজ্ঞান লাভের জন্যই প্রার্থনা আছে। — প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির সাথে আমাদের শব্দগত ব্যাখ্যার বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু ভাবগত যথেষ্ট পার্থক্য আছে। যেমন, একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– দেবগণের মধ্যে অগ্নিই মনুষ্যগণের সমস্ত সম্পদ লাভ করেন, তিনি অন্নের সাথে আমাদের নিকটে আগমন করুন। আমরা পূর্বাপর মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রেও অগ্নি পদে জ্ঞান অথবা জ্ঞানদেব অর্থ গ্রহণ করেছি]। [এই সূক্তটির অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম-স্বারসৈঙ্কুক্ষিত এবং সত্ৰাসাহিয়]।
২১/১– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! এই প্রশংসনীয় (সকলের শ্রেষ্ঠস্থানীয়) অমারক অর্থাৎ আমাদের রক্ষাকর, আনন্দপ্রদ শুদ্ধসত্ত্বকে আপনি গ্রহণ করুন। সত্যের (সৎকর্মের) অনুষ্ঠান-স্থানে দ্যোতমান শুদ্ধসত্ত্বের ধারা (প্রবাহ) আপনাকে লক্ষ্য করে, গমন করে– আপনাকে প্রাপ্ত হয়। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের মধ্যে রক্ষাপ্রদ সেই পরমানন্দদায়ক আপনার প্রতি আপনা থেকেই প্রবাহিত শুদ্ধসত্ত্বকে সঞ্চার করে দিয়ে তা গ্রহণ করুন)। [এই মন্ত্রের প্রথম চরণে একটি সুতং এবং একটি মদং পদ আছে। এইরকম দ্বিতীয় চরণে একটি ধারাঃ ও একটি অক্ষর পদ দৃষ্ট হয়। দুই চরণের অন্তর্গত ঐ পদ-চারটি উপলক্ষ্যে মন্ত্ৰাৰ্থ বিসদৃশ ভাব ধারণ করে আছে। মন্ত্রের ভাব দাঁড়িয়ে গেছে, — হে ইন্দ্র! তুমি মদকর সোমরস পান করো; সোমরসের ধারাসমূহ যজ্ঞক্ষেত্রে ক্ষরিত হচ্ছে। এসব বিষয়ই বারংবার আলোচনা করা হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত যে সুতংপদ উপলক্ষ্যে সোমরস ও মাদকদ্রব্য পরিকল্পনা করা হয়, ঐ সুতং পদের বিশেষণ কয়েকটির প্রতি লক্ষ্য করলেই সে ভাব পরিবর্তিত হতে পারে। সুতংকেমন? বলা হয়েছে, তাজ্যেষ্ঠং। তার প্রতিবাক্য দেখি, প্রশস্যতমং। যা মাদকদ্রব্য, তা কি কখনও কোনকালে সর্বাপেক্ষা প্রশংসনীয় বস্তু হতে পারে? তারপর, আরও। বলা হয়েছে, তা অমর্তং। ঐ পদে অমারক অর্থাৎ মরণরহিত অবস্থায় কথা মনে আসে। যা মাদকদ্রব্য, তা কি কখনও অমারক মরণরহিত অবস্থার প্রদাতা হয়? এইরকম, মদং পদের প্রয়োগ বেদে যেখানেই দেখা গেছে, সেখানেই ঐ পদে আনন্দপ্রদ অর্থ পাওয়া গেছে। এই সব বিষয় বিবেচনা করলেই, সুতং পদের মর্মার্থ অধিগত হয়। তাতে কখনই মাদকদ্রব্য (সোমলতার রস) অর্থ আসে না। তারপর, দ্বিতীয় চরণের ধারাঃ পদের সাথে ঋতস্য শুক্ৰস্য পদ দুটির সম্বন্ধ রয়েছে। ঋত শব্দে সত্যকে বা সৎকর্মকে (যজ্ঞকে) বোঝায়। শুক্র শব্দে শুভ্র জ্যোতিঃঅর্থ আসে। তার যে ধারা, সে কি? তার ভাব কি এই নয়– যেখানে অবিব্রত বিশুদ্ধ সৎকর্মের অনুষ্ঠান চলেছে, সত্যের আলোকে যে স্থান পুলকিত হয়ে রয়েছে, সেই স্থানেই ভগবান্ গমন করেন! অক্ষর পদে সঞ্চলন্তি প্রতিবাক্য। ভাষ্যেই দেখা যায়। সুতরাং সোমরস মাদকদ্রব্যের ধারা যেখানে নির্গত হয়েছে, সেখানে নয়; যেখানে সৎকর্মের জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, সেখানেই, তিনি উপস্থিত থাকেন। এইভাবে বোঝা যায়, এই মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়ে ভগবানের করুণায় বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সঞ্চার হোক; আর, সেই অমরত্বদ চিরজ্যোতিষ্ম সত্ত্বভাবের সমীপে ভগবান্ এসে অধিষ্ঠিত হোন]। [এই মন্ত্রটি ছন্দার্চিকেও (৩অ-১২দ-৩সা) দেখা যায়]।
২১/২– হে ভগবন ইন্দ্রদেব! যেহেতু আপনি আমাদের কর্মে বা হৃদয়ে জ্ঞানভক্তিরূপ আপনার বাহকদ্বয়কে যোজনা করেন, সেই হেতু, আপনার অপেক্ষা অন্য কেউই প্রশস্যতর রথী অর্থাৎ আমাদের শ্রেষ্ঠ পরিচালক নেই। (ভাব এই যে, আমাদের মধ্যে জ্ঞানভক্তি সঞ্চারণের নিমিত্ত আপনি আমাদের সুপরিচালক হন)। হে ভগবন! আপনাকে লঙ্ঘন করে বলের দ্বারা আপনার সমান কেউই হতে পারে না, এবং আপনার সমকক্ষ শোভনরশ্মিযুক্ত অর্থাৎ সুষ্ঠু পথ-প্রদর্শক কেউই বিদ্যমান্ নেই। (ভাব এই যে, — সেই ভগবানের সদৃশ শক্তিশালী এবং হৃদয়ে জ্ঞানরশ্মি প্রবেশ করতে সমর্থ অপর কেউই জগতে নেই)। [হরী পদে ভাষ্য ইত্যাদিতে সেই অশ্বদ্বয় অর্থই গৃহীত হয়েছে। আমরা যথাপূর্ব জ্ঞানভক্তি-রূপ ভগবানের বাহকদ্বয় অর্থই গ্রহণ করেছি। তাতেই ভাব পরিস্ফুট হয়। প্রচলিত অর্থে এই মন্ত্রের প্রথম চরণের ভাব এই যে, হে ইন্দ্র! যেহেতু আপনি আপনার অশ্বদ্বয়কে রথে যোজনা করেন, সেই হেতু আপনার ন্যায় কেউ রথী হয়নি। এতে দেবতার যে কি মাহাত্ম্য প্রকাশ পেল, তা অন্তর্যামীই বলতে পারেন। নিজের বাহক অশ্বদ্বয়কে নিজের রথে যোজনা করতে পারলেই বড় একজন রথী হওয়া যায়। এমন অর্থের কোনও সার্থকতা নেই। কিন্তু আমাদের পরিগৃহীত অর্থ অবলম্বন করে ভাব গ্রহণ করলে দেখা যাবে কি ভগবৎ-মাহাত্ম্য জ্ঞাপক নিত্যসত্যতত্ত্বই মন্ত্রাংশে প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের হৃদয়ে বা কর্মে জ্ঞান-ভক্তির যে সংযোগ হয় সে ভগবানের কৃপা-সাপেক্ষ। আমাদের মতো সংসার-কীটের হৃদয়ে অথবা এই নিত্য অপকর্মকারীদের কর্মের মধ্যে জ্ঞান-ভক্তির সংযোগ করে দিয়ে সেই কর্মে বা সেই হৃদয়ে নিজের আসবার উপযোগী ঐরকম বাহনদ্বয়কে সংযুক্ত করে, সত্যই তিনি কি প্রশংসনীয় হননি? সেইজন্যই কি তিনি রথীতর অর্থাৎ আমাদের শ্রেষ্ঠ পরিচালক বলে অভিহিত হন না?– এই দৃষ্টিতেই বুঝতে পারা যায়, মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণে তার অসীম শক্তির এবং অচিন্তনীয় কর্মের দ্যোতনা করা হয়েছে। প্রথম ভাব– আপনার সমকক্ষ কেউই মা শক্তিশালী নেই। দ্বিতীয় অংশে তাঁর সেই শক্তির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় তিনি শোভনরশ্মিযুত এ (স্বশ্ব) হয়ে সেই রশ্মি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে ভাবে প্রবিষ্ট করেছেন (আনশে– অশ্নুতে), তেমন আর কেউই পারে না– তেমন কর্মী আর এ জগতে নেই। আমরা মনে করি এটাই তার শক্তিশালিত্ব এটাই তার অদ্বিতীয়ত্ব]।
২১/৩– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা ভগবান্ ইন্দ্রদেবের উদ্দেশে ত্বরায় পূজা করো; বিশুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ ভগবানকে আনন্দ দান করে; অতএব, অমিতবলশালী (অথবা– সেই শুদ্ধসত্ত্বের সাথে) সকলের শ্রেষ্ঠ প্রশস্যতম সেই ভগবানকে আরাধনা করো। (এই মন্ত্র আত্ম-উদ্বোধক। সাধক এখানে কালক্ষয় না করে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানের পূজায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করছেন)। [ভাষ্য ইত্যাদির অভিমত এই যে, — এখানে যজমান যেন ঋত্বিকদের সম্বোধন করছেন। কিন্তু আমরা বলি মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। অতীত অনাগত বর্তমান তিন কালেই সাধকবর্গ এই মন্ত্রে নিজেদের ভগবানের আরাধনায় উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। সে পক্ষে তাদের চিত্তবৃত্তিসমূহই এই মন্ত্রের সম্বোধ্য। মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণে সূতাঃ ইন্দবঃ অমৎসুঃ বাক্যাংশে ভাষ্য ইত্যাদিতে সেই সোমরসের পরিকল্পনা দেখতে পাই। কিন্তু এ সম্পর্কে আমরা পূর্বেও আলোচনা করেছি; এখনও বলি– ভগবানকে আনন্দ দান করে– ভগবানের প্রীতিসাধক হয় যে সামগ্রী–সূতাঃ ইন্দবঃ পদ দুটি সেই সামগ্রীর প্রতিই লক্ষ্য রয়েছে যা অন্তরের বস্তু– যা হৃদয়ের সারভূত সত্ত্বভাব। উপসংহার অংশে সহঃ পদকে এক পক্ষে দেবতার বিশেষণ বলেও মনে করা যেতে পারে। তাতে তিনি যে অমিতবলশালী, সেই ভাব মনে আসে। কিন্তু তার চেয়েও সুষ্ঠু অর্থ নিষ্কাশিত হয়– যদি আমরা ঐ পদের ভাব তেন শুদ্ধসত্ত্বেন বলে নির্দেশ করি। সেই অনুসারে মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণের প্রথমাংশের সাথে শেষাংশের বেশ অর্থ সঙ্গতি থাকে। প্রথম পক্ষে সহঃ পদে অমিতবলশালী প্রতিবাক্য-গ্রহণে তাকে নমস্কার করার সঙ্কল্প মাত্র প্রকাশ পায়। কিন্তু শেষোক্ত অর্থে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বের সাথে তাকে আরাধনা করার ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়]। [এই সূক্তান্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত তিনটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– বসিষ্ঠপ্রিয়ম, অসিতাদ্যম এবং গৌরীবিতম]।
২২/১– পাপহারক সর্বশক্তিম বলাধিপতি হে দেব! আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন; এবং আগমন করে প্রার্থনাপরায়ণ আমাদের পূজা গ্রহণ করুন। অপিচ, পরম আনন্দ দানের জন্য আমাদের হৃদয়স্থিত বিশুদ্ধ অমৃতের (অর্থাৎ অমৃতজাত) কল্যাণরূপ জ্যোতির্ময় যে স্তুতি, তা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের পূজা গ্রহণ করুন)। [ভাষ্যকার এই মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা থেকে কোন সুষ্ঠু ভাব পাওয়া যায় না। তিনি মন্ত্রটির প্রায় এক তৃতীয়াংশের কোন ব্যাখ্যাই দেননি। যাই হোক, আমাদের মন্ত্রার্থে জুষস্য পদের অর্থ গৃহীত হয়েছে– সেবকস্য, প্রার্থনাপরায়ণানাং অস্মাকং। চকানঃ পদের। জ্যোতিঃবাচক জ্যোতির্ময়ী অর্থ গৃহীত হয়েছে। মদায় পদের অর্থ– আনন্দদানায়। ভাষ্যকারও বহুস্থলে ঐ অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রে ঐ পদের ভাষ্যার্থ হলো– ভক্ষণায়। এর দ্বারা মন্ত্রের যে কি সৌষ্ঠব সাধিত হয়েছে তা বোঝা যায় না। আমরা কিন্তু পূর্বের অর্থই– পরমানন্দায়, পরমানন্দপ্রদানায়– অব্যাহত রেখেছি, এবং তাতেই মন্ত্রের প্রকৃত ভাব রক্ষিত হয় বলে মনে করি]।
২২/২– বলাধিপতে হে দেব! অমৃতের দিব্য চিরনবীন শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে পূর্ণ করুন,
আমাদের হৃদয়ের স্বর্গজাত শুদ্ধসত্ত্ব-উৎপন্ন শোভনস্ততিযুত পরমানন্দ আপনার সমীপে অবস্থিত এ হোক, অর্থাৎ আপনি আমাদের হৃদয়ের প্রার্থনা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই এই যে, — দিব্যজাত শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোক এবং সেই সত্ত্বভাবরূপ উপহার ভগবান্ গ্রহণ করে করুন)। [এই প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের– আমাদের হৃদয়কে শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা পরিপূর্ণ করুন এবং আমাদের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব থেকে সমুৎপন্ন পূজোপহার গ্রহণ করুন। — প্রথমতঃ হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উপজন। মানুষ ভগবানের কৃপা ব্যতীত সেই পরম বস্তুর অধিকারী হতে পারে না। তাই তা লাভ করবার জন্য ভগবানের চরণে প্রার্থনা করা হয়েছে। আবার সেই সত্ত্বভাবের দ্বারা হৃদয় যখন ভগবানের অভিমুখীন হয় তখন তাকে পাবার জন্য হৃদয়ে ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়। এই ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার ফলে যে প্রার্থনা জাগে তা-ই মানুষকে ভগবানের সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। — এখানে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ সম্পূর্ণভাবেই ভগবানের কৃপার উপর নির্ভর করে। তিনি দয়া করে মানুষের হৃদয়ে পবিত্রভাব সঞ্চার করেন, এবং তার ফলেই মানুষ মোক্ষলাভের জন্য সচেতন হয়। তাই বলা যায়, তিনিই দাতা, আবার তিনিই গ্রহীতা। অর্থাৎ তার দেওয়া বস্তু তিনিই গ্রহণ করেন। -মন্ত্রের অন্তর্গত জঠরং পদের অর্থ অভ্যন্তরং হৃদয়ং, হৃদি ইত্যাদিই সঙ্গত]।
২২/৩– রিপুনাশক, লোকবর্গের পরমমিত্র, বলাধিপতি হে দেব! জ্ঞান-আবরক শত্রুকে বিনাশ করেন; কামনাজয়ী সংযতচিত্ত সাধক রিপুবর্গকে নাশ করেন, এবং শুদ্ধসত্ত্বের পরম-আনন্দ লাভের জন্য আত্মশক্তি প্রাপ্ত হন। মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব, এই যে, ভগবন লোকবর্গের রিপুগণকে বিনাশ করেন; সাধকেরা রিপুজয়ী হয়ে পরমানন্দ ও আত্মশক্তি লাভ করেন)। [মন্ত্রটি দুভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে ভগবানের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় অংশে সাধকের সৌভাগ্য বর্ণিত হয়েছে। ভাষ্যকার মন্ত্রের অনেক অংশেরই ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। তাঁর মতে প্রত্যেক তিন পদের পরেই যে পদ আছে– তা উপসর্গাক্ষরাণি। (এই সূক্তের প্রথম মন্ত্রের অন্তর্গত বিশেষ পদ– মতিনৰ্মধোশ্চকানঃ অংশটিকেও তিনি উপসর্গরূপে চিহ্নিত করে ব্যাখ্যাদানে বিরত ছিলেন)। কিন্তু তাই বলে ঐ পদসমূহের কোন অর্থ নেই তা বলা যায় না। বেদ মন্ত্রে মিথ্যা প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ অথবা নিরর্থক বাক্যের কল্পনাও করা যায় না। আমরা প্রত্যেক পদেরই ব্যাখ্যা প্রদান করেছি। কোন এক প্রচলিত হিন্দী ব্যাখ্যাতেও প্রত্যেক পদের অর্থ প্রদত্ত হয়েছে। মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ– ইন্দ্রঃ বৃত্ৰং জঘানঅর্থাৎ ভগবান্ (ইন্দ্ররূপী তাঁর বলাধিপতি বিভূতিতে) জ্ঞান-আবরক শত্রুকে– অজ্ঞানতাকে বিনাশ করেন। তিনি নিজে জ্ঞানস্বরূপ, সুতরাং তাঁর পরশেই জগৎ থেকে অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়। ইন্দ্রের দুটি বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে– তুরাষাটু ও মিত্র। তুরাষা– যিনি যুদ্ধে রিপুদের বিনাশ করেন, অর্থাৎ জগতের রিপুনাশক। প্রথম বিশেষণ থেকেই দ্বিতীয় বিশেষণের ভাব আসে– মিত্রং ন– তিনি জগতের লোকের মিত্রস্বরূপ। যিনি মানুষকে অজ্ঞানতা পাপমোহ প্রভৃতি রিপুদের কবল থেকে উদ্ধার করেন, তার মতে, মানুষের এমন উপকারী বন্ধু আর কে হতে পারে? কি রকম সাধক পরমানন্দ ও আত্মশক্তি লাভ করেন, তা-ও মন্ত্রে বলা হয়েছে। তিনি ভৃগু অর্থাৎ কামনাজয়ী, তিনি যাতঃ অর্থাৎ সংযতচিত্ত। কামনার জয় না হলে মন প্রশান্ত হয় না, সুতরাং পরাশক্তি-লাভও অসম্ভব। মন্ত্রের যতিঃও ভৃগু এই দুটি পদে সেই সত্যই নির্দেশ করছে]। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র তিনটি সামবেদ ব্যতীত অন্য কোনও বেদে পাওয়া যায় না। এগুলির একত্রগ্রথিত একটি গেয়গান আছে এবং সেটি গৌরীবিত নামে অভিহিত]।
— পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত —