প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৩.০৪ পুতুল – মমতাজ মুফতি

পুতুল – মমতাজ মুফতি

সাদা বাংলোর অধিবাসীদের সবাইকে যেন ভূতে ধরেছে। অথচ, এ বাড়ির আসবাবপত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। রেশমের পর্দা আগের মতোই ঝুলছে। গালিচার উজ্জ্বল রং এখনো আগের মতো আলো ঠিকরায়।

সাদা বাংলোর মানুষগুলো সবাই শো-কেসে সাজানো পুতুলের মতো। চাবি ঘুরিয়ে দিলেই সে পুতুল থপথপ্ করে হাঁটে।

কিন্তু সাদা বাংলোর পুতুলগুলো আগে যেমন করে হাসত, কথা বলত, এখন আর তেমন করে পারে না। ওদের সবাইকে যেন ভূতে ধরেছে। সন্ধ্যা হতে-না-হতেই পুতুলদের মুখে তালা-চাবি পড়ে যায়। রাত্রির নিস্তব্ধতা যত বাড়ে, ভৌতিক নীরবতা তত বাড়ে। খুট্ করে একটা কিছুর শব্দ হলেও সবাই একসঙ্গে চমকে ওঠে।

সাদা বাংলোর যে কাউকে গিয়ে জিগ্যেস করুন এর কারণ, কেউ বলবে না, বলতে পারবে না।

কাকে আপনি জিগ্যেস করবেন? ফওজিয়াকে? তার ঘোলাটে চোখ দেখলে আপনারই ভয় করবে। সে নিজেই এর কারণ হলে কী হবে– সে তো জানে না, কী সে কারণ; তাহলে কেমন করে বলবে সে!

নওয়াজিশকে জিগ্যেস করে দেখুন। গোঁফে তা দিয়ে গম্ভীর হয়ে যাবে, কিছুই বলবে না। বেশি পীড়াপীড়ি করলে গাম্ভীর্য আরও বাড়বে। এই গাম্ভীর্যের অর্থ : সে ড্রাইভার হলেও শুধু ড্রাইভার নয়– আরও অনেক কিছু, বরং সবকিছু। আরও পীড়াপীড়ি করলে কিছু একটা হয়তো বলবে, কিন্তু তার অর্থোদ্ধার করা মুশকিল। তারপর যদি বলেন, ‘তারপর?’ তাহলে নওয়াজিশ বলবে, ‘তারপর? রাত-জাগতে হয়, এই আর কি। তাতে আমার তেমন কোনো অসুবিধে নেই। সারাটা জীবনই তো রাত জেগে জেগে কাটালাম।

ফওজিয়ার মাকে জিগ্যেস করে দেখবেন একবার? তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে পালঙ্ক থেকে নামবেন– যেন শুয়ে থেকে এতক্ষণ তিনি বড় অন্যায় করেছেন। তারপর বলবেন, ‘হ্যাঁ, কিছু একটা হয়েছে বৈকি! কিন্তু কী হয়েছে, তা তো ডাক্তারেই ঠিকমতো বলতে পারে না, তা আমি কেমন করে বলব, বাপু! যাই হোক, আল্লার হাজার শুকর, জান্‌টা তো বেঁচেছে!’ ডাক্তারকে প্রশ্ন করলে বলবেন, ‘ওয়েল, ওয়েল, শি ইজ অলরাইট। সামান্য একটু শক্ পেয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।’

ছোট বোন আসিয়াকে জিগ্যেস করলে সে কিছুই বলবে না। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে শুধু কাঁদবে ডুকরে ডুকরে।

তারপর, চাকর-চাকরানিদের জিগ্যেস করে কী লাভ। তারা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বোবা বনে যাবে। কিছুই বলবে না, বলতে পারবে না।

মাঝরাত্রে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খান-খান হয়ে যায় যখন ফওজিয়ার শয়ন-কক্ষ থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসে। এমন উলঙ্গ চিৎকার কেউ কখনো শোনেনি। রেশমের কাপড় দিয়ে ঢাকা মরা পুতুল যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পুতুল চিৎকার করে ডাকছে, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ!’ ভদ্রঘরের কোনো মহিলার এইভাবে তারস্বরে ডাকা, তা-ও আবার সে বাড়ির ড্রাইভারের নাম ধরে ধরে– খুবই বেমানান। কিন্তু সেই ডাকে কেন এত কাকুতি, ভিক্ষার সুর।

ফওজিয়ার চিৎকার শুনে মা জেগে যান। মুখে কেবল বলেন, ‘আবার আজকে!’ নিচের ঠোঁটটা কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। কিন্তু একটুও নড়েন না। ফওজিয়ার শোয়ার ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। কারণ তিনি জানেন, এতক্ষণে সেখানে নওয়াজিশ চলে গেছে। মামুলি একটা ড্রাইভার নওয়াজিশ। সেই নওয়াজিশ ফওজিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছে। উফ্!

ছোট বোন আসিয়৷ ধড়ফড় করে জেগে ওঠে। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার সে চোখ বোজে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে শুধু কাঁদে ডুকরে ডুকরে।

নার্স এই চিৎকার শুনে রাত-জাগার উপন্যাস থেকে চোখ তোলে। সেখানে কাগজের চিহ্ন রেখে বইটা বন্ধ করে দেয়। তারপর, পা টিপে টিপে ফওজিয়ার শয়ন-কক্ষের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ছিটকিনি খোলে। আবার পা টিপে টিপে চেয়ারে এসে বসে। তারপর, নিশ্চিন্ত মনে আবার উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করে দেয়। ফওজিয়ার এই চিৎকারে যেন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই– নৈমিত্তিক ব্যাপার।

চিৎকারে নওয়াজিশেরও স্বাভাবিকভাবেই ঘুম ভেঙে যায়। একবার চোখ ঘষে নিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয়। ঘন, দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে অদ্ভুতভাবে হাসে। তারপর, ওভারকোটটা ফেলে নেয় কাঁধে। গোঁফে তা দিতে দিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে থাকে ফওজিয়ার ঘরের দিকে।

শয়ন-কক্ষে ভারিক্কি চালে বেগম সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে নওয়াজিশ। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে, চিন্তা করবেন না বেগম সাহেব; নওয়াজিশ আপনার কাছেই আছে; সবসময় থাকবে।’ এইটুকু বলে আবার সে গোঁফে তা দিতে আরম্ভ করে।

নওয়াজিশের কথায় ফওজিয়ার চিৎকার বন্ধ হয়। চাপা গলায় বলতে থাকে, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ, ওই যে আসছে, ওরা আসছে।’ এই বলে সে উঠবার চেষ্টা করে।

‘শুয়ে থাকুন, বেগম সাহেব, শুয়ে থাকুন!’ নওয়াজিশের কণ্ঠে এবারে আদেশের সুর। ‘নওয়াজিশ থাকতে আপনার কোনো ভয় নেই। কেউ আপনাকে কিছু বলতে পারবে না।

‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ, নওয়াজিশ…!’ বলতে বলতে ফওজিয়ার গলা নরম হয়ে আসে। আরও কী-যেন সে বলতে চায়– যেন কোনো গোপন কথা– কিন্তু বলতে পারে না। নাম উচ্চারণ করতে করতে চোখ জুড়িয়ে আসে। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। সাদা বাংলোয় ভূতের নাচ থেমে যায়। আবার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে নীরবতা, নিঃঝুম রাত্রির নিস্তব্ধতা।

নওয়াজিশ আরও কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে যেমন গম্ভীরভাবে এসেছিল, তেমনি গম্ভীরভাবে ফিরে যায়। নার্স পা টিপে টিপে এসে, দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। তারপর, নির্দিষ্ট জায়গায় পা টিপে টিপে ফিরে গিয়ে রাত-জাগবার উপন্যাস পড়তে শুরু করে দেয় আবার।

মা নিজের ঘরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। আসিয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। আর, নওয়াজিশ নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে লেপের তলায় উপুড় হয়ে শুয়ে সিগারেট ধরায়। দুই আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে, মুঠো বেঁধে, হুঁকো খাওয়ার কায়দায় জোরে জোরে টান দেয় সিগারেটে। বৃদ্ধা আর অনামিকায় চুটকি বাজিয়ে ঘন-ঘন ছাই ফেলতে থাকে, আর বায়স্কোপের গানের একটা কলি, গাইতে থাকে গুনগুন করে, ‘আব্ কওন্ তুঝে সঝায়ে…।’

সাদা বাংলোর প্রত্যেকে চিন্তিত। এমনকি, সাদা বাংলোর বাইরের লোক ডাক্তারও গভীর চিন্তামগ্ন– যদিও তাঁর কথা থেকে সেটা বুঝবার উপায় নেই। ডাক্তারের মুখে ওই এক কথা, ‘শি ইজ্ অল্রাইট। সামান্য একটু শক্ পেয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি প্রত্যেকদিন আসেন। রুগীর নাড়ি টেপেন। জিবের রং দেখেন। টেথিস্কোপ লাগান। দু-একটা প্রশ্ন করেন। তারপর ইঞ্জেকশন লাগিয়ে দিয়ে, নার্সকে উপদেশ দিয়ে, হাত-বাক্সটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।

বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায়। মা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ‘আজকে কেমন দেখলেন, ডাক্তার সাহেব?’

‘হুঁ।’ ডাক্তার যেন নতুন করে কেইসটা পরীক্ষা করছেন, এইরকম একটা ভঙ্গি। তারপর, মাথা তুলে বলেন, ‘ভালো হয়ে যাবে, ভালো হয়ে যাবে। আপনারা ঘাবড়াবেন না। এখনো শকের ইফেক্ট্ কাটেনি। কাল আবার আসব। খোদা হাফেজ।’

.

এই ঘটনার পাত্র-পাত্রী মাত্র তিনজন। সারা মুখ পাউডার দিয়ে ঢেকে রাখা একটি মেয়ে-পুতুল, নিষ্প্রাণ একটা ছেলে-পুতুল আর সজীব প্রাণবন্ত একটা ড্রাইভার।

পুতুল শুধু পাউডার ঘষে, তাই নয়– কথাও বলে। মল্ রোডের কেনা-কাটায় অহরহ যেমন অনেক পুতুল দেখতে পাওয়া যায়, সে-ও তাদেরই মতো একজন। ঠোঁটে মাখানো থাকে পুরু করে কৃত্রিম লালিমা– যেন অসংখ্য পুতুলের মধ্যে থেকে সে কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। গাড়ি থেকে নীরবে নেমে ভারিক্কি চালে এদিক-ওদিক দেখে নেয়। যারা তার ওপর চোখ ফেলে চোখ সরায় না, তাদের দিকে তাকিয়ে সে নাক-সিটকায় ঘৃণায়। সময় নষ্ট না করে অচিরে মগ্ন হয়ে যায় কেনা-কাটায়। কখনো ভেবে দেখে না, কেন সে এত আকর্ষণ করে লোকজনকে। কেনই-বা ভাববে! স্বামী বিত্তবান। নিজস্ব প্রাসাদতুল্য বাংলো। মূল্যবান আসবাবপত্র দিয়ে সে বাংলো সাজানো। গাড়ি। টেবিলে আপনা-আপনি খাবার লেগে যায়। পার্সে টাকা সবসময় গিজগিজ্ করে। মরা-মরা, ময়লা, নোংরা লোকগুলো কেন যে তার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকে। পাউডার মাখে সে চামড়া নরম রাখার জন্য। চোখে কাজল দেয় চোখের জ্যোতি বাড়ে বলে। ঠোঁটে লালিমা মাখায়– তা সে যে জন্যই হোক, তাতে কার কী! সব কাজেরই যে ব্যাখ্যা দিতে হবে, তেমন কোনো শর্তে সে আবদ্ধ নয় কারো সঙ্গে। তার ইচ্ছা, সে মাখবে।

মল্ রোডের পুতুল শুধু সামাজিকভাবে নয়– মানসিকভাবেও একটা পুতুলই। পুতুল-ঘরের শিক্ষা তার মানসিকতাকে আবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। তার দেহের রূপ আর মনের শিক্ষা শান্ত একটা বিলের মতো– তাতে ঢেউ ওঠে, কিন্তু তরঙ্গ কখনো বিক্ষুব্ধ হয় না।

শো-কেসে সাজিয়ে রাখা পুতুলের মতোই পরিবারের সবাই ওরা উঠেছে, বসেছে, চলা-ফেরা করেছে। ঠিক সময়টিতে যুৎসই কথা বলা, ঠিক সময়ে বাইরে যাওয়া, ঠিক সময়েই পুতুলের মতো শো-কেসে বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কখন কোন কথাটুকু বলতে হবে, তা যেন মুখস্থ করা। ঠিক সময়ে, ঠিকমতো সেই মুখস্থ-করা কথা ছেড়ে দিলেই পুতুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ হল।

যে পুতুল-ঘরে ফওজিয়া বড় হয়েছে, তার বাইরে দশ পা হেঁটে গেলে জীবন্ত রক্ত-মাংসের মানুষরাও ছিল। কিন্তু পুতুল-ঘরের শিক্ষা তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অনুমতি দেয়নি। তারা সব নফর-মানুষ, চৌকিদার-মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের জীবন মনোযোগ দিয়ে দেখবার মতো নয়। ‘মনোযোগ দিয়ে দেখা’ কথাটাই পুতুল-ঘরের শাস্ত্রে নেই। শুধু নফর মানুষ কেন– অন্য কাউকেও, এমনকি নিজের আত্মীয়-স্বজনদেরও মনোযোগ দিয়ে দেখা অভদ্রতা। শাস্ত্রের বাইরে কিছু বললেই সেটা হবে কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। কাজেই অন্যকে দেখার চাইতে নিজেকে দেখানোর গুরুত্ব পুতুল-ঘরে বেশি। তাই সবসময় চেষ্টা, যেন নিজেকে সুন্দর দেখায়, অন্যের কাছে নিজেকে যেন সুপ্রিয় করে তোলা যায়।

ফওজিয়া জন্ম থেকে এইসব শিক্ষাই পেয়ে এসেছে। সকাল-সকাল টবের মধ্যে গরম পানিতে স্নান করিয়ে চুলে রিবন লাগিয়ে, মুখে পাউডার ঘষে ফিটফাট ফ্রক পরিয়ে তৈরি করে দেওয়া হত। নিজেরই মতো ফুটফুটে একটা পুতুল নিয়ে সে প্যারালেটারে গিয়ে বসত। সেই বাহন ঠেলতে ঠেলতে অন্য একজনে নিয়ে যেত বাগানে। সেখানে গিয়ে বসত বিশেষভাবে তৈরি করা, কুশন-আঁটা একটা বেতের চেয়ারে। মাটিতে কখনো পা ঠেকত না।

ড্রয়িং-রুমে বলার জন্য একরকম ভাষা তাকে শেখানো হয়েছিল। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’, ‘হাউ ডু ইউ ডু’, ‘মামি, ড্যাডি’, কিংবা ইংরেজি কোনো কবিতা। ফুরফুরে বাতাসের মতো নরম করে হাঁটা। সারাদিন ভুরভুরে গন্ধ ছড়িয়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাওয়া। তারপর, রাত হলে মোলায়েম রেশমের শো-কেসে আট্‌কা পড়া। এই ছিল জীবন পুতুল-ঘরের।

তারপর, যৌবনের পদার্পণেও সে-জীবনে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন এসেছে শুধু দেহের ভাঁজে ভাঁজে। শরীর ফুলেছে, ফেঁপেছে। চুল বাঁধার স্টাইল গেছে বদলে। ছক-কাটা ভাষায় কথা বলার সীমানা কিছু প্রসারিত হয়েছে। প্রশস্ত হয়েছে ড্রয়িংরুম। যাতায়াতের পুতুলের সংখ্যাও বেড়েছে। মেয়েদের কাছে আসে পুরুষ-পুতুল, পুরুষদের কাছে যায় মেয়ে-পুতুল। তাদের হাসিতে ছুরিকার ধার।

এইভাবে একদিন এক পুরুষ-পুতুল ফওজিয়াদের ড্রয়িংরুমে এল। ফওজিয়ার দিকে তার সে কী চাহনি! প্রথম প্রথম সে ভয় পেয়েছিল এই দৃষ্টি দেখে। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে মেশানো ছিল আনন্দের দোলা। নিরিবিলিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই পুতুল এমন সব-কথা বলল, যা এর আগে ফওজিয়া কখনো শোনেনি, শেখেনি। ছকের বাইরে যেন কথাগুলো। ভারি আনন্দের, ভারি মজার। তার সামনে নতুন একটা গোটা জগৎ উন্মোচিত হয়ে গেল।

আরো অনেক পুতুলের আনাগোনা ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ফরুখের সঙ্গে ফওজিয়ার বিয়ে হয়ে গেল বলে আরও অনেক নতুন জগৎ উন্মোচিত হতে পারল না। ফররুখের মুখের কথাও অমনি ছক-কাটা পুতুলের মতো। তার দেখাও দেখবার জন্য নয়– দেখানোর জন্য। সে-ও এসব আয়ত্ত করেছে অন্য এক পুতুল-ঘরের পরিমণ্ডলে থেকে।

বিয়ের পরেও ফওজিয়ার পুতুল-জীবনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন এল না। পরিবর্তন হল কেবল এটুকুই যে, এক পুতুল-ঘর থেকে অন্য পুতুল-ঘরে গিয়ে নামল সে। সেখানেও রেশমের পর্দা, দামি দামি আসবাবপত্র, ঘুমোনার জন্য শো-কেস্ আর তেমনি বাগান। বিয়ের পরে সে একেবারে একলা হয়ে গেল। আগে যেখানে দাস-দাসীরা তার কাজ করে যেত, এখন সে জায়গায় যোগ হল আরও একজন– ফরুখ। ফরুখ তার জন্য দরজা খুলে দেয়, চেয়ার এগিয়ে দেয়, কোট পরিয়ে দেয়, পার্স তুলে দেয়। ডাক পড়লেই ‘ডার্লিং’ বলে ছুটে আসে। বিয়ের পরে নাম হয়ে গেল বেগম ফওজিয়া। কিন্তু ফররুখ ডাকে ফিজি বলে। আর, সে তার ফিজিকে এমন আগলে আগলে, ঢেকে ঢেকে রাখে, যেন অস্থাবর সম্পত্তি– কেউ টুক করে চুরি করে নিয়ে পালাবে। ফওজিয়া যেন কাঁচের জিনিস– পুট্ করে ভেঙে যাবে, তাই ফররুখ তাকে আলতো করে গাড়িতে চাপায়, আলতো করে গাড়ি থেকে নামায়। যত সাবধানতা, ভেঙে পড়ার আশঙ্কা যে ততই বেশি, সে-বোধ তার মনে জাগেনি কখনো।

নতুন পুতুল-ঘরে এসেই প্রথম ফওজিয়া নওয়াজিশকে দেখেছে। নওয়াজিশকে দেখেছে, সেটা এমন কোনো ঘটনা নয়। নেহাত দেখছে, এই যা। নওয়াজিশ হয়েছে তার কাছে শোফার মাত্র– নওয়াজিশ নয়। সে হচ্ছে নফর মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তার দিকে দেখার মতো করে তাকানো শাস্ত্রে লেখা নেই। যদি থাকত, তাহলে ফওজিয়া দেখতে পেত শোফারকে নয়– নওয়াজিশকে, দীর্ঘ শক্ত যার দেহখানা, প্রশস্ত যার ছাতি, ঘন দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে যার সবসময়ই লেগে থাকে অকৃত্রিম, স্বভাবসিদ্ধ হাসি, আর যার অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখের গভীরতা থেকে অবিরাম বিচ্ছুরিত হয় বিদ্যুতের ছটা।

সাধারণভাবে নওয়াজিশের সঙ্গে কখনো কথা বলার দরকার হয় না ফওজিয়ার। কারণ, কাজে-অকাজে সবসময় উপস্থিত থাকে ফরুখ। সেই-ই সব কাজ করে দেয় কিংবা করিয়ে দেয়। কিন্তু সম্পত্তির খবরদারি করতে মাঝে মাঝে ফরুখকে যখন করাচি চলে যেতে হয়, তখন ফওজিয়া পুতুল-ঘরে একলা থাকে। নওয়াজিশকে দরকার পড়লে বাইরে পেরির্চে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, ‘শোফা, এ শোফা!’

নওয়াজিশ এই ডাক শুনে ব্যস্ততার কোনো ভাব দেখায় না। ধীরে-সুস্থে সিগারেটে শেষ কয়টা টান দিয়ে নেয়। তারপর ওভারকোটটা কাঁধে ফেলে শিস্ কাটতে কাটতে চলে যায় গ্যারাজের দিকে। গাড়ি নিয়ে পেরির্চে এসে থামায়। অতিরিক্ত কথা দূরে থাক প্রয়োজনীয় কথাও কম বলে। যখন যা হুকুম হয়, তামিল করে যায় নীরবে, ধীরে নিরুদ্বেগে।

নওয়াজিশ স্বভাবগতভাবে ড্রাইভার। কিন্তু চিন্তায় আর মানসিকতায় সবসময় একটা বড়লোকি ভাব। তার হাঁটা দেখলে মনে হবে পবন-দেব মাটিতে নেমেছেন। তার মোটর চালানো দেখলে মনে হবে, এটা গাড়ি নয়– একটা খেলনা। সে কখনো মনে করে না, সে কোনো সাহেবের বা বেগম সাহেবের ড্রাইভার, বরং মনে করে, সে মোটরগাড়ির ড্রাইভার। তার স্বভাবের মধ্যে যে অবাধ্যতার ভাব, তা তার ঘাড় টান করে চলা দেখলেই অনুভব করা যায়। কিন্তু এই অবাধ্যতা দাম্ভিকতা নয়। এ যেন স্বাভাবিক, জন্মগত একটা অধিকার। তাই পুতুল-ঘরের বেগম সাহেবকে সে কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখেনি, দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।

ফওজিয়া তার এই নিরাভরণ অবাধ্য-ভাব লক্ষ করেনি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু লক্ষ যে করেছে, তা সে বুঝতে দেয়নি কখনো। কারণ, বুঝতে দেওয়া মানেই নফর মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়া। পুতুলদের শিক্ষায় সে জিনিসের অনুমতি নেই। সে সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিল। মারমুখো জনতা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আহমদিয়া-বিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে। রাত্রে গোলমাল আরও বেড়ে গেল। উত্তেজনাকর ধ্বনি দিয়ে বেড়াচ্ছে দাঙ্গাকারীরা আর ‘মারো মারো, কাটো কাটো’ রব উঠছে। বাহ্যত ভয়ের কোনো কারণ ছিল না, তবু এইসব দেখেশুনে ভয়কে একেবারে মন থেকে তাড়ানোও যাচ্ছিল না। ফররুখ দাঙ্গাকারীদের ‘জংলি, অসভ্য’ ইত্যাদি বলে গালাগালি দিচ্ছিল। বলছিল, ওদের গুলি মেরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু রাত্রে যখন গোলমাল খুব কাছে থেকে শোনা যাচ্ছে, তখন ভয়ে ফরুখের বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল। ফওজিয়াকে ডেকে বলল, ‘ফিজি, এদিকে এস। আর শোনো, যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে আমরা চাকরদের ঘরে চলে যাব, বুঝেছ? ওখানে ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না। ধর্মটর্ম কিছু নয়– ওরা তো আসবে লুট করতে। ছোটলোক।’

সে-রাতটা নিরাপদেই কেটে গেল। পরেরদিন জরুরি ডাক এল করাচি যাওয়ার। যাওয়ার আগে ফওজিয়াকে সে অনেক পরামর্শ দিয়ে গেল, ‘ফিজি, এইসব বদমাইশদের ভয় করার কোনো কারণ নেই। ওরা ছোটলোক– নিজেরাই ভীরু। বুঝেছ? ওরা যদি বাড়ির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে যায়, তাহলে পুলিশকে ফোন করে দিও। ওদের তেমন সাহস হবে না, তা আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। বুঝেছ, ফিজি? আর, যদি লুট করার জন্যে ঢুকেই পড়ে, তাহলে চাকরদের ঘরে চলে যেও। আমি ওদের সব বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। চৌকিদার আর শোফার বাংলোর কোনার ঘরটায় শোবে। বুঝেছ, ডার্লিং?’

ফররুখ চলে গেল। সেই রাত্রেই হাঙ্গামা আরও বাড়ল। গোলমাল শুনে ঘুম ভেঙে গেল ফওজিয়ার। আতঙ্কে চিৎকার করে ডাক দিতে লাগল, ‘চৌকিদার, চৌকিদার!’ দাঙ্গাকারীরা আরও যেন বাংলোর কাছে এসে গেছে। আরও বেশি ভয় পেয়ে, পুতুল- ঘরের সমস্ত শিক্ষা ভুলে গিয়ে সে প্রাণপণে চিৎকার করে ডাক দিল, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ!’ এই প্রথম সে নওয়াজিশকে নাম ধরে ডাকল।

আগের মতোই তেমনি নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন নওয়াজিশ কাঁধের উপর ওভারকোটটা ফেলে নিয়ে, ধীরে সুস্থে তার সেই নিজস্ব বড়লোকি চালে এসে ঢুকল বেগম সাহেবের শয়নকক্ষে। নওয়াজিশকে দেখতে পেয়ে ফওজিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই– ওই– ওই যে আসছে, ওরা আসছে।’

‘চেঁচাবেন না, বেগম সাহেব।’ শক্ত গলায় শাসিয়ে উঠল নওয়াজিশ, ‘চেঁচালে ওরা শুনতে পাবে, আর শুনতে পেলে আপনারই বিপদ।’

ধমক খেয়ে আতঙ্কটা ভয়ে রূপান্তরিত হল। ফওজিয়া এখন থিতিয়ে উঠে, সুর নামিয়ে

বলল, ‘ওরা আসছে, ওরা আসছে। আমি যাই, পুলিশকে টেলিফোন করে দিই।’ বলে সে টেলিফোনের দিকে এগুতে লাগল।

নওয়াজিশ পথ আগলে দাঁড়াল। ‘টেলিফোন করতে হবে না। দরকার নেই। তাতে কোনো লাভ হবে না।’

‘কিন্তু–’ ফওজিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ‘চুপ করুন, বেগম সাহেব, কথা বলবেন না।’ গর্জন করে উঠল নওয়াজিশ। ‘নওয়াজিশ যতক্ষণ রয়েছে, কেউ আপনার গায়ে হাত তুলতে পারবে না।’

ফওজিয়া ধমক-খাওয়া শিশুর মতো চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল থপ্ করে। আর, নওয়াজিশ তার সেই বড়লোকি ঢঙে দরজার কাছে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। সিগারেট ধরিয়ে মুঠোয় মধ্যে চেপে ধরে হুঁকো টানার মতো করে টানতে লাগল। যেন কিছুই হয়নি, এমনি একটা ভাব।

দাঙ্গাকারীরা প্রাচীর টপকে বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাদের চিৎকারে শয়ন কক্ষের জিনিসপত্র পর্যন্ত কেঁপে উঠল। তবু নওয়াজিশ নিশ্চিন্তে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ফওজিয়া পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইল। আমি চাকরদের ঘরে চলে যাচ্ছি– ‘

মুখের কথা এখনো শেষ হয়নি, নওয়াজিশ এক লাফে সেখানে গিয়ে ফওজিয়াকে ধরে ফেলল। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। ‘চুপ করে শুয়ে থাকুন, বেগম সাহেব।’ এবারে তার কণ্ঠে প্রচণ্ড ক্রোধ। ‘বললাম, নওয়াজিশ থাকতে ভয় করবেন না। ‘

নওয়াজিশের এই ব্যবহারে কী যেন একটা হয়ে গেল। কোথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। তারপর, এক মুহূর্তে সে আগুন নিভে গেল পানির মধ্যে পড়ে। বিছানায় ফওজিয়া মড়ার মতো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে থাকল। একটুও নড়ল না। প্রশান্ত বিলে এতদিন যে ঢেউটুকু ছিল, তা-ও অবশিষ্ট থাকল না আর। এখন আর আতঙ্ক নেই, ভয় নেই। দাঙ্গাকারীরা একেবারে কাছে এসে গেছে– সে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এ দেখা যেন ঠিক দেখা নয়। নওয়াজিশ তেমনি অটল পাহাড়ের মতো দরজা আগলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ঘরটাকে আড়াল করে রয়েছে সে পর্দার মতো। আর, সেই পর্দায় বায়স্কোপের ছবির মতো দাঙ্গাকারীরা যেন নড়ছে, ভাসছে। সে যা দেখছে, তা অনুভব করতে পারছে না; যা অনুভব করতে পারছে, তা যেন দেখতে পাচ্ছে না।

এমন সময় হঠাৎ নওয়াজিশ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘এখানে কী জন্যে এসেছ, তোমরা? যাও, বেরিয়ে যাও! এখানে কেউ নেই। বেরিয়ে যাও! যাও বলছি এখান থেকে! যাও!’

দাঙ্গাকারীরা চলে গেল। গোটা বাংলোয় ছড়িয়ে পড়ল মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। নওয়াজিশ আর একটা সিগারেট ধরিয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর, দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে ফওজিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগল, ‘বলেছি না, নওয়াজিশ থাকতে আপনার গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না! নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ুন। দরকার পড়লে আমাকে ডাক দেবেন। ছিটকিনি লাগিয়ে নিন।’ কণ্ঠে সেই একই আদেশের সুর। সেই একই বড়লোকি চাল।

বিছানা থেকে উঠে ফওজিয়া ঠিক যেন হুকুম তামিল করার জন্যই ছিটকিনি লাগাতে গেল। বেগম যেন হঠাৎ আজ বাঁদিতে পরিণত হয়েছে।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় পড়ে থাকল ফওজিয়া। ঘুম এল, কি এল না। আস্তে আস্তে রাত গড়িয়ে গেল। সকাল হল। বিছানা থেকে উঠে ফওজিয়া নতুন একটা অচেনা জগৎ বিছিয়ে রয়েছে দেখল তার সামনে। আর, তার পুরনো জগৎ– পুতুলের জগৎকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখল তার চারপাশে। এ কী হল! পুতুলের রাজ্যে এ কী প্রলয় কাণ্ড! মখমল, রেশম, ঝালর, কুশন, পুতুলের শাস্ত্র– সবাই একসঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে কেন?

কিন্তু না, সে ফওজিয়া, সে বেগম সাহেব। হঠাৎ তার চৈতন্য ফিরে এল। ভুলে যেতে চাইল রাত্রির ঘটনা। বাঁচতে হবে। ফিরে পেতে হবে নিজের সত্তাকে। এই তো মখমল, গালিচা। এই তো রেশম, ঝালর, কুশন, শো-কেস্। এই তো পুতুল, শাস্ত্র, পুতুলের শিক্ষা, দীক্ষা, সভ্যতা, ভব্যতা। এই তো ফওজিয়া, এই তো বেগম সাহেব।

ফরুখ ফিরে আসতে আসতে ফওজিয়ার আর কিছুই মনে থাকল না সে রাত্রির ঘটনা। কাজেই সেসব কথা ফরুখকে বলারও প্রয়োজন করছে না। থাকল বাকি নওয়াজিশ। কিন্তু নওয়াজিশ নামের কাউকে সে চেনে না। তবে হ্যাঁ, শোফারের কথা যদি বলেন, শোফার তাদের একটা রয়েছে বটে। কিন্তু এখন তার মোটরে চড়তে ভালো লাগে না। তাহলে আর কিসের শোফার, কেমন শোফার!

.

ছ-মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। পুতুল-ঘরের পুতুলরা আগেই মতোই। তেমনি মাপা মাপা হাসি, মাপা মাপা কথা। তেমনি দরজা খুলে দেওয়া, কোট পরিয়ে দেওয়া, পার্স তুলে দেওয়া।

ছ’মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফওজিয়া যেন সত্যি সত্যি ভুলে গেছে নওয়াজিশের কথা।

তারপর, একদিন ফরুখ এসে ফওজিয়াকে বলল, ‘আমরা করাচি যাচ্ছি। তুমিও সঙ্গে যাচ্ছ, ডার্লিং। এবারে অনেকদিন থাকতে হবে। শোফারকেও নিয়ে যেতে হবে।

ফওজিয়া শুনল। কেবল শেষ বাক্যটি শুনতে পেল না। শুনতে চায় না বলে।

পরের দিন তারা সেই মেলগাড়িতে চাপল, যে গাড়ি ঝিম্‌পিরে সেই বিখ্যাত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়ে গেল। প্রথম শ্রেণির দুই আসনের একটি ছোট প্রকোষ্ঠে ওরা বসে বসে মাপা মাপা হাসিতে আর মাথা মাপা কথায় সারাটা দিন কাটিয়েছে। তারপর, ওরা ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো বিকট এক শব্দে ফওজিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে কি পায়নি–চোখে দেখছে কেবল আগুন আর ধোঁয়া আর ধুলো। সেই আগুনে, ধোঁয়ায় আর ধুলোতে ফররুখের সারা শরীর জড়িয়ে রয়েছে। ফওজিয়া চিৎকার দিতে গেল, কিন্তু পারল না। সে যেন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু স্বপ্নেও তো চিৎকার দেওয়া যায়। তবু সে কেন পারছে না চেঁচাতে। তার গলা কেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। এমন সময় ঝড়ের বেগে ঢুকল নওয়াজিশ। দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফওজিয়া চিৎকার করে উঠল, ‘নওয়াজিশ–!’ সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল সে।

ফওজিয়াকে ছোট ছেলের মতো করে কোলে তুলে নিয়ে নওয়াজিশ ধ্বংসস্তূপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে ছুটে পালাল।

ফওজিয়ার যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখতে পেল, সামনে দাঁড়িয়ে নওয়াজিশ তার গোঁফে তা দিচ্ছে। নওয়াজিশ বলল, ‘কিচ্ছু ভাববেন না, বেগম সাহেব। নওয়াজিশ যতক্ষণ আপনার কাছে রয়েছে, আপনার কোনো ভয় নেই।’ কিন্তু তার মুখে কথা শেষ না হতেই ফওজিয়া অজ্ঞান হয়ে গেল আবার।

দ্বিতীয় দফা যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন সে হাসপাতালে। তখনো নওয়াজিশ কাছে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছিল।

.

মা, বোন, নার্সের উপস্থিতি সত্ত্বেও ফওজিয়া কারও সঙ্গে কথা বলে না। সারাদিন পড়ে থাকে বিছানায়। মস্ত বড় সাদা বাংলোর পুতুল-ঘরে কোন্ পুতুল কী বলছে, তা সে বুঝতে পারে না। সবাই তার কথাই বলছে : কিন্তু সে জানে না, কেন বলছে।

তারপর, রাত যখন গম্ভীর হয়, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন বিকট চিৎকারে ফওজিয়ার রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। তার চারপাশে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে থাকে রেশমের, ঝালরের, কুশনের, মখমলের, পুতুলের দুনিয়া। পাথরের মতো শক্ত, বাস্তব, কঠোর, নিষ্ঠুর দুনিয়াকে সামনে পাওয়ার জন্য সে চিৎকার করে ডাক দেয়, ‘নওয়াজিশ—।’

অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *