সাহেব গোলাম – রাজিয়া ফসিহ্ আহমদ
নদিম যখন বাংলো ছেড়ে গাড়ির পানে রওনা হল, তখন তার আগে আগে গেল মাত্র একটা হোল্ডল আর একটা স্যুটকেস্। গাড়ির পেছনের সিটে কিছু বই-পুস্তক, পত্রিকা ছড়িয়ে রয়েছে। পুরো বাংলো তার পেছনে পড়ে থাকল খোলা অবস্থায়।
সাহেব কতদিন বাইরে থাকবেন, নানা কারণেই এ কথাটা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল বেয়ারা। কাজেই কত দূরে সাহেব যাচ্ছেন, তা অনুমান করার জন্য সে কায়দা করে প্রশ্ন করল, ‘সাব, যদি কোনো জরুরি খবর-টবর আসে, তাহলে কোথায় জানাতে হবে?’
‘কোথাও না।’ নদিমের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
চালাকিটা একেবারেই ভেস্তে যাচ্ছে দেখে বেয়ারা মরিয়া হয়ে প্রত্যক্ষভাবেই প্রশ্ন করে বসল, ‘কবে নাগাদ ফিরবেন, সাব?’
‘জানি না।’
‘তা এক মাস, দুমাস লাগতে পারে?’ বেয়ারার এ প্রশ্ন যেন সাহেবকে নয়- নিজেকেই করা।
নদিম কোনো উত্তর দিল না। বিরাট চাকর-বাহিনীর সালাম ঠোকা আরম্ভ হল। নদিম পকেট থেকে মনি-ব্যাগ বের করে একটা করে মুদ্রা তাদের হাতে হাতে ফেলে দিল। তারপর গাড়িতে এসে বসল, আর সঙ্গে সঙ্গে ভোঁ হয়ে গেল।
চাকররা উঁকি মেরে, ছাদে উঠে, রাস্তার মোড় পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে জানবার যথাসাধ্য চেষ্টা করল, সাহেবের গাড়ির গতি কোনদিকে। কিন্তু এর চাইতে বেশি কিছুই জানা গেল না যে, রাস্তাটা রাওয়ালপিণ্ডির দিকে গেছে; আর যে গাড়ি রাওয়ালপিণ্ডি গেল, সে গাড়ি ইচ্ছা করলে পেশাওয়ার পর্যন্তও যেতে পারে।
যাই হোক, সাহেবের চলে যাওয়াটা সুনিশ্চিত। কাজেই চাকররা সবাই একটা করে গভীর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তারপর, সবাই ড্রয়িং-রুমে এসে এলোপাথাড়ি হয়ে সোফার
উপর বসে পড়ল। তাদের এখনকার কর্তব্য, সাহেব কবে নাগাদ ফিরতে পারেন, তাই নিয়ে জরুরি সভায় মিলিত হওয়া।
প্রৌঢ় খানসামা প্রথমে শুরু করল, ‘সাব কয়টা কাপড় নিয়েছে?’ তার এই প্রশ্নের মধ্যে দার্শনিকতার স্পষ্ট আভাস।
‘বললেন, একটা স্যুটকেসে যয়টা কাপড় আঁটে, রেখে দে!’ উত্তর দিল বেয়ারা। ‘তবেই হয়েছে রে।’ ড্রাইভার তার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস ব্যক্ত করে দিল, ‘মনে হচ্ছে, সায়েব এক হপ্তার মধ্যেই ফিরে আসছে।’
মসলা আর ধুলো-মাটি মাখা পা দুটো সোফার উপর তুলে দিল খানসামা। ড্রাইভারের মত সে সমর্থন করতে পারে না, এমনি একটা ভাব দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘অন্যান্য বারে কয়টা কাপড় নিয়ে যান?’ তার এই প্রশ্নের অর্থ যেন এই যে, চট্ করে রায় না দিয়ে বরং আরও গবেষণা করা উচিত।
বেয়ারা বলল, ‘তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কেন, মনে পড়ছে না, সেবার এক কাপড়ে গিয়েছিল এক রাত থাকব বলে, তারপর দুই মাস কাটিয়ে এল? সঙ্গে বিছানা ছিল না, কিচ্ছু ছিল না।’
খানসামা আবার তেমনি ভারিক্কি একটা রায় ছাড়ল, ‘আজকাল টাকা থাকলে আর বিছানা লাগে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুমি যা হুকুম করবে, তাই পাবে। কী বলছ বিছানা আর কাপড়ের কথা! ছোঃ! টাকা থাকলে গোটা একটা বালাখানা পাওয়া যায় রেডিমেড বিবি সুদ্ধ।’
এ কথায় গাম্ভীর্যে খানিকটা আনন্দের আমেজ মিশ খেল। যে-যার রসবোধ অনুযায়ী হাসল। বেয়ারা বসে যোগদান দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘সেদিন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছিলাম, সায়েবের দোস্ত সায়েবকে বলছিল, এবারে যখন ফিরবে, একটা বিবি সঙ্গে নিয়ে ফিরো।
‘তাহলেই হয়েছে।’ খানসামা কৃত্রিম আতঙ্ক প্রকাশ করে বলল, ‘সায়েব সত্যি সত্যি যদি বিবি নিয়ে ফেরে, তাহলে বুঝে নিও, আমি আর নেই, বাবা। সব ঘরে তালা পড়বে বুঝেছ? কোর্মা-পোলাও আর খেতে হবে না– তখন কেবল বাইরে বাইরে হাওয়া খেয়ে বেড়িও। আমার একটা রেকট আছে, বুঝলে? যে-ঘরেই চাকরি করতে গিয়েছি, আগে বলেছি, আমি কিচেন আর প্যান্ট্রি দেখব, তারপর কথা। তারপর কোনো আলমারিতে তালা দেখলেই বলে দিয়েছি, কাল থেকে কাজ করতে আসছি। কিন্তু আর আসতে হয়নি। ব্যস্, খতম। বুঝলে?’
সামনে দূরে দাঁড়িয়ে বয় এতক্ষণ চুপ-চাপ শুনছিল। এবারে সে-ও তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে লাগল, ‘আর বল কেন! আমিও এক বেগম সায়েবের পাল্লায় পড়েছিলাম বটে। বেগম সায়েবের ছিল ইঁদুরের মতো ছোট মন। কোনোদিন যদি একটা টেডি পয়সা হাতে ধরে দিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ পরে ড্রাইভার আবার মুখ খুলল, ‘সায়েব বিয়ে করলে আমাকেও নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। পার্ট-টাইম চাকরিটা তো আর থাকবে না।’
খানসামা মুরুব্বির চালে জবাব দিল, ‘মুফতের ড্রাইভারি করছ। সবসময় তো সায়েবই গাড়ি চালায়। আর, তুমি করে বেড়াও পার্ট-টাইম। বেগম সায়েব এলে তো আর সেটি চলবে না। এদিকে মিছামিছি পেট্রলের বিল, রিপিয়ার আর এই-সেই করে আরও খানিক কামিয়ে নিচ্ছ।’
‘কী করব বল। গরিব মানুষ, আর আটটা খানেওয়ালা। কিন্তু খানসামা ভাই, তুমিই-বা আর কম যাও কার চাইতে। গোটা ঘিয়ের টিন দু-দিনেই খতম। আর আস্ত আস্ত আটার বস্তা…।’
‘এখন থামাও এসব কথা। আমরা সবাই আল্লার দেওয়া রুজি কামাই করি আর খাই। অন্যের রুজি কি আর একজনে খেতে পারে!’ এই কথা বলে খানসামা এখন সোফার উপরে হাত-পা ছড়িয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর, হাঁক ছাড়ল, ‘বয়, তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে আন্। আর, শোন, সেই সঙ্গে কিছু ঘিয়ে-ভাজা পুরি। বুঝলি? তাড়াতাড়ি।’ রীতিমতো সাহেবের অনুকরণ শুরু করে দিল খানসামা।
জমাদার এতক্ষণ মেঝের উপর বসে বসে এইসব শুনছিল। ঝাড়ুটাকে বালিশ বানিয়ে সে-ও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ফরাশের উপর।
বেয়ারা কোলের উপর একটা কুশন টেনে নিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় একটা ভারি মজার খেয়াল এসেছে।
‘কী, কী! বল, বল!’ সবাই একসঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করল।
‘আমরা সবাই মিলে একটা পার্টি দিই, এস।’
‘পার্টি! ভোজের পার্টি নাকি?’ খানসামা বিস্ময় প্রকাশ করল, ‘তোমার তো সাহস কম নয় হে! তাহলে কেমন পার্টি, বল দেখি, বাপু, শুনি।’
‘হ্যাঁ দোস্ত, ভালোই খেলেছে তোমার মাথাখানা। হয়েই যাক একটা পার্টি।’ ড্রাইভার প্রথম সায় জানাল।
‘কিন্তু সায়েব না থাকলে তো আমাদের রোজই পার্টি চলে, ফুর্তি চলে। তাহলে আর নতুন ব্যাপারটা কী হতে যাচ্ছে?’
বেয়ারা বলল, ‘সেরকম নয়, খানসামা সায়েব। এ হবে স্পেশাল ডিনার-পার্টি। আমরা স্যুট পরব। অনেক মেহমান আসবে। টেবিল জুড়ে থাকবে কোর্মা, পোলাও, জর্দা। রেডিও বাজবে। বক্তিমে হবে।’ কিছুক্ষণ থেমে আবার সে বলল, ‘কিন্তু আমি ভাবছি, পার্টিটা মিক্স হবে, না সিঙ্গেল!’
‘সেটা আবার কী জিনিস?’
‘বুঝলে না? মানে, পার্টিতে শুধু সায়েবরাই থাকবেন না, বেগম সায়েবদেরও আনা হবে?’ ড্রাইভার বলল, ‘না ভাই, বেগম সায়েবদের সঙ্গে করে আনলে আবার নানা ঝামেলা বাধবে। পর্দা কর, এই কর, সেই কর। তার চাইতে আমরা, মানে শুধু সায়েবরাই ঠিক আছি।’
‘তাহলে তো দেখছি, সব ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হবে।’ খানসামা আসল কথাটা পেড়ে বসল, ‘তা ঠিক আছে, তোমরা যখন বলছ, তখন করতে হবে বৈকি!’
‘কিন্তু খানসামা সায়েব, মনে থাকে যেন, গণ্যমান্য সব অতিথিরা আসবেন। ভালো খানা হওয়া চাই কিন্তু।’
‘সে আর তোমাকে বলতে হবে না। এমন খানাটাই খাওয়াব যে, জিন্দিগি-ভর মনে থাকবে।’
‘তাহলে একটা দিন-ক্ষণ ঠিক হয়ে যাক।’
‘কাল।’
‘বেশ, কাল রাত্রেই তাহলে হোক। ডিনারের দাওয়াত সব জায়গায় পৌঁছে দাও।’
‘আর শোনো, মেহমানরা সব হুড়দ্দুম যেন ডাইনিং-হলে ঢুকে না পড়ে। সবাই আগে ড্রেসিং-রুমে আসবে, ফিটফাট কাপড় পরবে। তারপর আবার বাইরে যাবে। বাইরে গিয়ে ওই সামনের দিক থেকে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকবে। ড্রয়িংরুম থেকে তারপর ডাইনিং-হল।’
‘আর হ্যাঁ, মালিবাবাকে ডাকো। ওকে বলে দাও, যেন চমৎকার করে কয়েকটা ফুলের তোড়া বানিয়ে রাখে।
এমন সময় বয় ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আর, গরম গরম পুরি ভাজা। বেয়ারা কোথাও থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের টিন নিয়ে এল বের করে। সবাইকে দিল একটা করে। বয় চা পরিবেশন করল। চায়ের পেয়ালায় আরও অনেকক্ষণ ধরে রাজনৈতিক এবং অন্যবিধ আলাপ-আলোচনা চলল। তারপর, সবাই একে একে যে-যার ঘরের দিকে চলে গেল। সাহেবই যখন নেই, তখন কাজেরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বেয়ারা বয়কে দিয়ে চায়ের পেয়ালা ইত্যাদি সরাল। তারপর, ঘরে তালা লাগিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।
.
পরদিন সকাল থেকেই ডিনার-পার্টির আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আগেই ঠিক হয়েছিল যে, প্রত্যেকে একজন করে ঘনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য আত্মীয় বা বন্ধুকে দাওয়াত দিতে পারবে। সে এমন হবে, যেন পার্টির কথা একটা তার মুখ থেকে বাইরে না বেরোয়।
খানসামা মহাব্যস্ত। তার চাইতে ব্যস্ত করে রেখেছে সে বয়কে। তাকে সে বাঁদর-নাচ নাচাচ্ছে। বয় আবার খুব করে খাঁটিয়ে নিচ্ছে জমাদারকে। এরাই এখন এ বাড়ির সর্বেসর্বা।
ধোপাকে ডেকে এনে সব কাপড়ে ইস্তিরি করিয়ে নেওয়া হল। তারপর, ধোপাকেও দাওয়াত দেওয়া হল ডিনার খাওয়ার।
মালিবাবা সকাল থেকে ফুলের তোড়া তৈরি করছে নিবিষ্ট মনে
জমাদার সমস্ত ঘর-দোর ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার, ফিটফাট করে তুলল।
বয় একা পেরে উঠছে না বলে খানসামা আরও একজন অ্যাসিস্টেন্ট নিয়ে এল বাইরে থেকে। বয় আর নতুন অ্যাসিস্টেন্ট মেশিনের মতো কাজ করে যাচ্ছে। একের পর এক মুরগি জবাই করে ওরা দুজন দ্রুত হাত চালিয়ে সেই মুরগি ছাড়িয়ে চলেছে। নতুন অ্যাসিস্টেন্টকেও ডিনার পার্টির দাওয়াত দেওয়া হল।
সন্ধ্যায় মেহমানদের আগমন শুরু হওয়ার আগেই খাবার টেবিলে ধপধপে সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর ডিনার সেট, চকচকে ছুরি-কাঁটা, সুন্দর করে সাজানো ফুলদানি সাজিয়ে রাখা হল। গ্লাসে গ্লাসে সাদা ন্যাপকিনের সারি লেগে গেল, যা দেখতে মনে হল সারিবদ্ধ বলাকার মতো।
টেবিলের পরিচর্যা শেষ হলে পর সবার আগে বেয়ারা কেতা-দুরস্ত পোশাকে সেজে নিল। সমস্ত মেহমানের জন্যও যার যার পদমর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে ওয়ার্ড-রোব থেকে বের করে করে এগিয়ে দেওয়া হল স্যুট, জ্যাকেট, শেরওয়ানি, চুড়িদার ইত্যাদি। বেয়ারা নিজে পরল ডিনার স্যুট– সাদা শার্টের উপর ডিনার-জ্যাকেট, গলায় কালো বো, বুক-পকেটে বের করে রাখা সাদা রুমাল, পায়ে আলো-ঠিকরানো কালো জুতো আর বাটন-হোলে সুইট-পি ফুল গুঁজে যখন সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন নিজের কাছেই সে একটা লাটসাহেব বলে বোধ হতে লাগল। আর, তাই দেখে খানসামা মন্তব্য করল, ‘যা না, একবার মালিবাবার কাছে গিয়ে দাঁড়া। তোকে যদি সায়েব মনে করে একটা সালাম না ঠোকে, তো আমায় বলিস।’
সবার যখন মোটামুটি সাজাগোজা শেষ হয়েছে, তখন ড্রেসিং-রুমের জৌলুস দেখে খানসামা একেবারে আত্মহারা। কিন্তু সেই আত্মহারা অবস্থাতেও তার মাথায় একটা বুদ্ধি গজাল। ভাবল, এমন জৌলুস, ছবি তুলে ধরে না রাখলেই নয়। পার্টির শেষ হওয়ার পর সেই ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ানো যাবে। চিরকাল সে ছবি হয়ে থাকবে সারাজীবনের একটা মনোরম স্মৃতি। কাজেই খানসামা টেলিফোন করে ফোটোগ্রাফারকে আসার জন্য ডাকতে চলে গেল।
নিজের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে মালিবাবাও এসে গেল তৈরি হতে। হাত-পায়ের কাদা ছাড়ানোর জন্য সে গোটা একটা খোশবুদার সাবান ঘষে ঘষে শেষ করল। তারপর গরম আর ঠাণ্ডা পানি মেশানো বাথটাবে শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মালিবাবার দেরি হচ্ছে দেখে বেয়ারা যখন হাঁক ছাড়ল, তখন মানুষ-সমান লম্বা তোয়ালেতে সারা শরীর ঢেকে সে বাইরে বেরিয়ে এল। চুড়িদার পাজামা আর শেরওয়ানি পরল। মাথার উপর বাঁকা করে জিন্না-টুপি চাপাল। পায়ে দিল সলিম-শাহি পাদুকা। তারপর, আয়নার সামনে যখন দাঁড়াল, তখন তাকে মনে হতে লাগল স্বপ্নপুরীর রাজপুত্র বলে। তাই-না দেখে বেরিয়ে পড়ল তার বত্রিশ-পাটি দাঁত, আর সে দাঁত সারাসন্ধ্যা বেরিয়েই থাকল– কিছুতেই ভেতরে করা গেল না। বারবার শেরওয়ানিতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার মসৃণতা অনুভব করতে লাগল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সেই আল্লার দরবারে, যিনি তাকে একদিনের সুলতান করেছেন।
ড্রাইভার মাথায় একটা সাদা পাগড়ি জড়িয়ে নবাব সাজল।
বেয়ারা মাথায় দিয়েছে তার সাহেবের ফেল্ট হ্যাটটা।
বয় বেচারা সবচাইতে বেঁটে। কোনো কাপড়ই তার গায়ে ফিট্ করে না। যেটাই পরে, সেটাতেই হারিয়ে যায় সে। তখন সবার পরামর্শে তাকে পরানো হল একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর একটা সাদা লুঙ্গি। পাঞ্জাবির আস্তিন খানিকটা গুটিয়ে দেওয়া হল আর লুঙ্গি মাজায় খানিক জড়িয়ে দেওয়া হল তবে গিয়ে সে কিছুটা মানুষ-মানুষ বোধ হতে লাগল।
মুকিল হল জমাদারকে নিয়ে। স্যুট-কোট-হ্যাট তার পছন্দ নয়। শেরওয়ানিও সে পরবে না। তার চোখ সাহেবের স্লিপিং গাউনের দিকে। তার এই ইচ্ছায় বাধা দেওয়া কারো যুক্তিসঙ্গত মনে হল না। কিন্তু মালিবাবার পরামর্শে সেই গাউনের উপর সে আবার যোগ করল একটা নতুন ফ্যাশন। দেড়শো টাকা দামের নতুন শৌখিন কম্বলটা সে জড়িয়ে নিল গাউনের উপর
ডিনার-পার্টিতে বাইরের মেহমানরা তো মেহমানই; কিন্তু ভেতরের যারা, তারাও মেহমান বলে কেউ কাউকে খাবার পরিবেশন করবে না। সুতরাং, খাদ্য-সামগ্রী আগে থেকে টেবিলে সাজিয়ে রাখা হল।
পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা সবাই বাইরে এল। ভেতরে থাকল কেবল বেয়ারা। তারপর, সামনের দরজায় একে একে বেলটিপে এমনভাবে তারা ভেতরে ঢুকল, যেমন ঢোকে যথার্থ মেহমানরা। বেয়ারা এগিয়ে এসে, করমর্দন করে তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। পকেট থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভের টিন বের করে মেলে ধরল সামনে। কুশল-বিনিময় চলতে লাগল পরিমিত ভাষায়। ব্যাগ্রাউন্ডে রেকর্ড-প্লেয়ার থেকে বাজতে লাগল স্পেনীয় সংগীত।
ডিনার শুরু হয়ে গেল। বেয়ারা বিরাট একটা গামলায় করে গরম গরম সুপ এনে রাখল। যার যার পাত্রে ঢেলে নিয়ে কেউ ঢুঁ মেরে আর কেউ নুলো ডুবিয়ে খেয়ে ফেলল সেই সুপ।
জমাদারকে দেওয়া হল প্রথম খানা তুলবার সম্মান। তারপর, প্রত্যেকে যার যার পাতে খানা তুলে নিল। প্রথম গ্রাস খানা মুখে তুলবার সম্মানও আবার দেওয়া হল জমাদারকেই তখন জমাদার কাঁটা-চামচ টেবিলের মাঝখানে সরিয়ে রাখল। রেখে হাত দিয়েই অতি দ্রুত গোগ্রাসে গিলতে আরম্ভ করে দিল। বেয়ারা মনে করল এটাকে হাভাতেপনা বলে।
ডিনার-পার্টির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা উচিত নয় ভেবে অতি অল্প পরিমাণে প্লেটে খানা নিল সে। কোলের উপর ন্যাপকিন বিছিয়ে নিল, ঠিক যেমন ভদ্রলোকদের নেওয়া উচিত, তেমনি করে। তারপর ফিশ-ফ্রাই-এ ছুরি-কাঁটা চালাতে লাগল আস্তে করে। নির্ভুল কায়দায় সে ছুরি-কাঁটা ধরেছে। কিন্তু অনভ্যস্ততা হেতু মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছে, আর পিছলে যাওয়ার জন্য মাছের টুকরো পড়ে যাচ্ছে নিচে।
বেয়ারার দেখাদেখি অন্য সবাইও কাঁটা-চামচ ধরল। কিন্তু তাদের কেউ কেউ এমনভাবে ধরল যে, ছুরি নিয়ে যেন শত্রুকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কাঁটার ঘায়ে কারও কারও জিবে লাগল খোঁচা। কেউ কেউ মাংসের টুকরো হাত দিয়ে ছিঁড়ে, চামচে রেখে বা কাঁটায় বিঁধিয়ে মুখে ঢোকাল। বলাকার ঝাঁক হয় গ্লাসেই রয়ে গেল, না হয় ছড়িয়ে পড়ল টেবিলের উপর। সারা ডাইনিং-হল জুড়ে বিরাজ করতে লাগল কাঁটা-চামচ-প্লেটের ছন্দহীন ধ্বনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চপ্চপ্, সুড়ুৎ-সাড়ুৎ ইত্যাদি শব্দ। সবাই গিলছে গোগ্রাসে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে। কথা বলার কারো ফুরসত নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে বুঝল, কাঁটা-চামচের ঝকমারি ডিনারের সমস্ত স্বাদ নষ্ট করে ফেলছে। তখন তারা অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে হাতের সদ্ব্যবহারে মনোযোগী হল। একমাত্র বেয়ারাই শেষ পর্যন্ত কৌলীন্য বজায় রাখল। এই কারণে তাকে বেশ খানিক অতৃপ্ত, অর্ধভুক্ত থাকতে হল।
একটা টানতে গিয়ে অন্যটায় ধাক্কা লেগে যাওয়ায় কিছু প্লাস, প্লেট নিচে পড়ে ভাঙল। অনেক দূরের জিনিস হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে জমাদারের কম্বলের কোনা ঝোলের স্বাদ টের পেল।
এইভাবে খাওয়া শেষ হলে ঢেকুর তোলার শব্দ উঠতে লাগল। স্পেনীয় সংগীতের সঙ্গে মিশে সেই শব্দ নতুন এক সুরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে লাগল। গ্লাসের পানি খেতে গিয়ে ন্যাকিনগুলো টেবিলের তলায় চলে গেছে। কাজেই অনেকে টেবিলের চাদরেই হাত মুছে নিল। কেউ গেল বাথরুমে হাত ধুতে। বাদবাকি সবাই কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে কাজ সম্পন্ন করে নিল।
শেষে বয় চা পরিবেশন করল। সবাই ঠোঁটের কোণায় ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট ঝোলাল। কেবল খানসামা তার পোশাকের গাম্ভীর্যের দিকে লক্ষ রেখে একটা চুরুট ধরাল।
এমন সময় বেয়ারা দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, ‘এবার খানসামা সায়েব আমাদের ডিনার-পার্টির ওপর একটা বক্তিমে দেবেন।’
খানসামা চুরুটটা হাতে নিয়ে ঠিক বক্তার মতো পোজ্ করে দাঁড়াল। তারপর একটুও চিন্তা-ভাবনা না করে বলতে শুরু করে দিল, ‘ভাইসব, আমরা বহুত দিন পর আজকে গোলাম থেকে সায়েব হয়েছি। নিজেরাই যা-খুশি রান্না করেছি– নিজেদের হাতে যেমন-করে-খুশি খেয়েছি। আহা, ইংরেজ সায়েবদের কথা আজকে আমার মনে পড়ছে। তেনারা ছিল খাঁটি সায়েব। আজকে যেমন আপনারা সায়েব হয়ে খেয়েছ, ওই সময় আমরা প্রত্যেকদিন সায়েবি খানা খেয়েছি, ভাইসব। এক মাস, দু-মাস মাত্র পরে কোট- পালুন সায়েবরা অমনি দিয়ে দিয়েছেন। মেম-সায়েবরা মুড়ি-ভাজার মতো দুহাতে পয়সা বিলিয়েছে। ফাস্টো ক্লাস বিয়ারের বোতল আমরা সাবাড় করেছি। আয়াদের সঙ্গে কত ঠাট্টা-দিল্লাগি করেছি। তারপর পাকিস্তান হলেন, আমাদের দেশ স্বাধীন হলেন। কিন্তু আমরা গোলাম হয়ে গেলাম, ভাইসব। ইংরেজ সায়েবরা কুত্তারও কত খাতির করতেন। দিশি সায়েবরা মানুষকে কুত্তার অধম ভাবলেন। একটা টেডি পয়সা এদিক-ওদিক হলে ধমক খেতে হচ্ছেন। আপনারা এখন সারা জিন্দেগিতে একদিন ছুটি পাও না। আমাদের সায়েব কিন্তু খারাব লোক নয়। ইংরেজ সায়েবদের মতো আমার সায়েব কুকুর রাখে না, ঘোড়া রাখে না, মেম রাখে না, আর…’
খানসামার বক্তৃতা তখনো চলছে, কিন্তু বেয়ারা তাতে মজা পাচ্ছে না। এসব কথা সে প্রত্যেকদিনই শোনে। এখন তার খেয়াল অন্য দিকে। দুই-দুবার ফোটোগ্রাফারকে টেলিফোন করা হল এখনো সে আসছে না কেন, এই চিন্তায় সে মনে মনে ভারি ব্যস্ত। খানসামার ভাষণ শেষ হয়ে আসছে মনে করে বেয়ারা ইঙ্গিতে তাকে জানিয়ে দিল শেষ না করতে।
ঠিক এমনি সময়ে বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। বেয়ারা বয়কে ইঙ্গিতে বলে দিল ফোটোগ্রাফারকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে আসতে। বয় চলে গেল।
খানসামা বেয়ারার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বক্তৃতার উপসংহারটাকে আর একটু লম্বা করল, ‘ভাইসব আমাদের সায়েবের জন্য আমরা দোয়া করি– আল্লা যেন তেনাকে আরও একশো বছর বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের সায়েব যে কত ভালো লোক, তা আপনারা আজকের এই খানা-পিনা থেকেই বুঝতে পারছ।…‘
এমন সময় ডাইনিং-হলের দরজার পর্দা নড়ল। খানসামা ফোটোগ্রাফারের জন্য বক্তৃতার পোজটাকে আর একটু আকর্ষণীয় করে নিল। উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীও যে-যার দৈহিক ও চেহারাগত আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু যার যেমন পোজ, তেমনিই থেকে গেল। খানাসামার বক্তৃতার শেষ শব্দটি অর্ধোচ্চারিত রয়ে গেল। মুখ হাঁ হয়েই থাকল, সে হাঁ আর বন্ধ হল না। সবাই যেন পাথরের মূর্তি– কেউ নড়ল না, কেউ নিশ্বাসটুকুও ফেলল না, যেন সবাই জমে গেছে। যে দাঁড়িয়েছিল, সে দাঁড়িয়ে থাকল। যে বসেছিল, সে বসে থাকল। যে চুলকাতে যাচ্ছিল, তার হাত থেমে গেল অর্ধপথে। সবাই স্থবির। কেবল বয় এর ব্যতিক্রম। সে নড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিল নদিমের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
নদিম ভালো করে একবার অবস্থাটা দেখে নিল। হলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত নজর বুলাল। তারপর বলল, আজ থেকে তোমাদের সবারই চাকরি নট্। বলে সে দ্রুত পায়ে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির