৩.২ স্বজন ও সজ্জন
স্বজনপোষণ আজ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে এর বিরুদ্ধে আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সবাই যথাসাধ্য স্বজনপোষণ করে চলেছেন। স্বজন বলতে কেউ বোঝেন নিজ পরিবার, কেউ বা নিজের দল, অথবা স্বজাতি।
আক্ষেপ ও আচরণের এই বিরোধ থেকে একটা কথা সহজেই অনুমান করা যায়। আমরা অপরের স্বজনপোষণে বিক্ষুব্ধ, কারণ নিজের দলীয় স্বার্থে তাতে আঘাত লাগে। কিন্তু নীতিগতভাবে আমরা স্বজনপোষণের বিরোধী নই। অন্তত ঐরকম কোনো নীতিবোধ আমাদের মনের গভীরে স্থান পায়নি। সেখানে স্বজাতিপ্রীতির একমাত্র বিরোধী শক্তি স্বার্থপরতা। অতএব স্বজনপোষণকে আমরা একরকম কর্তব্যই মনে করি। যিনি স্বজনপোষণ করেন না, তিনি স্বার্থপর। এর চেয়ে বড় কোনো নীতি অথবা বিচারের কথা যদি-বা আমাদের ভাষায় স্থান পেয়েছে, আমাদের বিবেক তার দ্বারা ভারাক্রান্ত নয় এবং আচরণেও তার প্রকাশ নেই।
১৮৬১ সালে কলকাতা “হাই কোর্ট” স্থাপিত হয়। পাশ্চাত্ত্য বিচারধারার সঙ্গে এদেশের পরিচয় শুরু হয়েছে আরও আগে। কিন্তু যে ধ্যানধারণার ওপর পাশ্চাত্ত্য বিচারনীতি প্রতিষ্ঠিত তার সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যের একটা বিরাট অসামঞ্জস্য থেকেই গেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য ছোট ছোট ঘটনায় এই অসামঞ্জস্য অহরহ প্রকট। কেউ অধিকার হিসাবে কিছু দাবি করলে আমরা অসন্তুষ্ট হই। স্বজাতি হিসাবে অথবা স্নেহাকাঙ্ক্ষীরূপে চাইলে আমরা কথাটা বুঝি। আর বুঝি মারের ভয়ে। কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন উঠলে আমাদের হৃদয় হঠাৎ কঠিন হয়ে যায়। তখন যুক্তিমাত্রই আমাদের মনে হয় ‘তর্ক। তর্ক জিনিসটা যে আমরা কোনো ক্ষেত্রেই পছন্দ করি না এমন নয়। দার্শনিক তর্কে আমাদের কিঞ্চিৎ রুচি আছে। কিন্তু অধিকার নিয়ে তর্ক জিনিসটা আমাদের বড়ই অভদ্রতা ঠেকে।
গোড়ার কথাটা এবার অন্যভাবে বলা যাক। কিছুটা স্বজনপোষণ সবদেশেই আছে, অর্থাৎ অপরিহার্য। আসল সমস্যা এই যে, আমাদের সমাজে পারিবারিক কর্তব্য ও ‘পাব্লিক ডিউটি’র ভিতর সীমারেখা অস্পষ্ট। ঐ ইংরেজী শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ মনে পড়ছে না। সামাজিক কর্তব্য বলতে তো আমরা সাধারণত পরিবার ও কুটুম্বদের প্রতি কর্তব্যই বুঝি। যৌথ পরিবার যদিও আজ অটুট নেই তবুও আমাদের মনের গভীরে যে-নীতিগুলি আমরা চিনি, যৌথ পরিবারের অতি প্রাচীন আধারেই তাদের সৃষ্টি। এসব নীতি আজ সর্বক্ষেত্রে পালিত না হলেও এরা সর্বজনপরিচিত। যৌথ পরিবারের নীতির সঙ্গে স্বজনপোষণের কোনো বিরোধ নেই। যে-নীতির ওপর দাঁড়িয়ে স্বজনপোষণের সমালোচনা সম্ভব, আমাদের কাছে সেটাই বিজাতীয়। আমরা যখন পরিবার ভেঙ্গে। বেরিয়ে আসি তখনও প্রায়শ কোনো দল অথবা সমিতি আমাদের চিত্তে যৌথ পরিবারের স্থান গ্রহণ করে। উপরন্তু দলীয় আনুগত্যের একটি বিশেষ সুবিধা আছে। যেহেতু যথার্থ সমাজবোধ আমাদের চিন্তায় অনুপস্থিত, অতএব দলীয় স্বার্থকে সামাজিক হিতের সঙ্গে অভিন্ন কল্পনা করা কঠিন হয় না; এবং পারিবারিক স্বার্থের পিছনে ধাবিত হতে। বিবেকজনিত যেটুকু অস্বস্তি বোধ করার সম্ভাবনা থাকে, দলীয় ব্যাপারে ততটুকুও থাকে না। দলীয়তার উর্ধ্বে স্বাধীন বিচার অথবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলে কোনো বস্তুর সঙ্গে আমাদের অধিকাংশেরই পরিচয় নেই।
মানুষকে বুঝতে হলে তার সমাজকে বুঝতে হয়। আগেই দেখেছি যে, আমাদের সনাতন সমাজের একটা বড় ভিত্তি ছিল যৌথ পরিবার। স্নেহ, শ্রদ্ধা, আনুগত্য, আত্মত্যাগ প্রভৃতি গুণ এই প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছে। প্রাচীন সমাজসংহতির ভিত্তি এবং ধর্মের অঙ্গ হিসাবে আচারেরও একটি বিশিষ্ট স্থান অস্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া পরিবার ও সমাজকে অতিক্রম করে হিন্দুধর্মে ব্যক্তির এমন একটি নিঃসঙ্গ আত্মাকে স্বীকার করা হয়েছে যার মুক্তি সম্ভব ব্রহ্মের সঙ্গে যোগস্থাপনে।
হিন্দুর ধর্মে যেখানে মোক্ষের কথা বলা হয়েছে সেখানে সমাজসংসার গৌণ, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে সেখানে সাক্ষাৎ সম্পর্ক। এটা আমাদের বৈশিষ্ট্য। ইহুদী ধর্মে ভগবান চুক্তি স্থাপন করেছেন একটা গোটা জাতি অথবা সমাজের সঙ্গে। ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান ধর্মে বহুলোকের মিলিত উপাসনার যেমন রীতি আছে, হিন্দুধর্মে তেমন নেই। হিন্দুর ভজন নিঃসঙ্গ সাধকের গান। খৃষ্টানের জন্য আছে সম্মিলিত ধর্মসঙ্গীত। ব্যতিক্রম দেখানো কঠিন নয়; যেমন, কীর্তন। কিন্তু মোটের ওপর একটা পার্থক্য অস্বীকার করা যায় না।
সত্য সম্বন্ধে ধারণাতেও একই প্রকার সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সব ধর্মেই সত্যকে বড় স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সত্য শ্রদ্ধেয় কেন? যদি বলা হয় যে, সাধক ও ভগবানের ভিতর সত্যই যোগসূত্র তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের কাছে সত্য থাকবে এটাই প্রধান কথা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি যদি নিজের কাছে সত্য না থাকে তো আত্মবিরোধ দেখা দেয়; সেই অবস্থায় তার মুক্তি সম্ভব নয়। হিন্দুর কাছে এটাই প্রধান কথা। কিন্তু সত্যের আরও একটি গুণ আছে। সত্য এক ব্যক্তিকে অন্যের সঙ্গে আবদ্ধ করে, সত্য সমাজসংহতির ভিত্তি! সত্যকে বিসর্জন দিলে মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তি থাকে না, অতএব সমাজ উৎসম্নে যায়। বাইবেলে যে-ধর্মের ব্যাখ্যা আছে তাতে এদিকটাকে বড় করা হয়েছে। ভগবানের দশটি প্রধান আজ্ঞার ভিতর একটি হল এই যে, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে কখনও মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না।
হিন্দুর কাছে এটা অপেক্ষাকৃত সামান্য কথা মনে হবে। তার চেয়ে বড় অহিংসা, সংযম প্রভৃতি গুণের ব্যাখ্যা। এইসব গুণ আয়ত্ত করতে পারলে মিথ্যা সাক্ষ্যের মতো সামান্য ব্যাপার উল্লেখেরই প্রয়োজন হবে না। এই ধরনের কিছু চিন্তা আমাদের মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টি এইভাবে দেখা ঠিক নয়। হিন্দুর কাছে অহিংসা, সংযম ইত্যাদি হল মূলত জিতেন্দ্রিয় হয়ে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে, মোক্ষলাভের উপায়। বাইবেলের ধর্মে প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্যকে এমনই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যে, ভগবানের প্রধান আজ্ঞায় বারবারই এ বিষয়ে ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। পার্থক্যটা যদিও আপেক্ষিক তবুও এর গুরুত্ব আছে। প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে বাইবেলে যে-কথা আছে তার সঙ্গে তুলনীয় বাক্য মহাভারতেও পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব ৰাক্য যে আমাদের ঐতিহ্যে তেমন কেন্দ্রীয় স্থান লাভ করেনি যেমন করেছে স্থিতপ্রজ্ঞের আদর্শ, তার কারণ আমাদের মূল সুরটি অন্তর্মুখী। হিন্দু মনে মনে নিঃসঙ্গ।
এই বৈরাগ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রাচীন ভারতীয় সমাজকে ধারণ করে ছিল প্রধানত আচার ও পারিবারিক বন্ধন। আমাদের প্রাচীনেরা মহানুভবতার মুহূর্তে বসুধাকে কুটুম্ব চিন্তা করেছেন। এটা আত্মীয়তাবোধের বিস্তৃতি হিসেবে শ্রদ্ধেয়। কিন্তু অপরের প্রতি আমাদের কর্তব্য শুধু কুটুম্বতাবোধ দ্বারা নির্ণয় করা নিরাপদ নয়। কুটুম্বচিন্তায় ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও অধিকারের প্রশ্নটা নগণ্য। মা সন্তানকে ভালোবাসেন সেটা মায়ের ধর্ম বলে, সন্তানের অধিকার বলে নয়। স্বাভাবিক স্নেহ ভালবাসাকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজই চলে না। কিন্তু আধুনিক সমাজের পক্ষে এটা যথেষ্ট নয়। নাগরিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এমন বহু মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে হয় যাদের সঙ্গে তার কোনো আত্মীয়তার বন্ধন নেই। আধুনিক জীবনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, পরিবর্তনশীলতা। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে অনাত্মীয় ও ভিন্ন রুচির মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে-নীতিবোধ প্রয়োজন, প্রাচীন নীতিবোধের সঙ্গে তার মৌলিক পার্থক্য আছে।
আত্মীয় শব্দেরও অর্থে স্তরভেদ আছে। অনাত্মীয়ের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েই আত্মীয়তার উচ্চতর স্তরে ওঠা যায়। কথাটা তত্ত্বের আকারে বলা যাক। যেমন ব্যক্তির চেতনায় তেমনি সমাজজীবনের বিকাশে প্রেম ও যুক্তির একটা দ্বান্দ্বিক বিবর্তন লক্ষণীয়। প্রেমের দৃষ্টিতে সাধারণও বিশেষ হয়ে ওঠে। আমরা প্রত্যেকেই নিজের কাছে বিশেষ। প্রেম অপরকে নিজের অংশ করে তাকে বৈশিষ্ট্য দান করে। আর যুক্তির স্বভাব হল বিশেষকে একটি সাধারণ তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা। যাকে আমরা অক্লেশে আত্মীয় বলে চিনি, তার প্রতি সদ্ভাবের জন্য যুক্তি প্রয়োজন হয় না। কিন্তু প্রতিবেশীর কাছে তুমি। যে আচরণ আশা কর তার প্রতি তোমার আরচণও সেই রকম হওয়া উচিত, এই চিন্তায়। মানুষ আদিম আত্মীয়তাবোধকে অতিক্রম করে প্রেম ও যুক্তির একটি নতুন সমন্বয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। মনে রাখা আবশ্যক যে, এই চিন্তারই একটি ধাপে যীশুখৃষ্ট প্রতিবেশী’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করে অপরিচিতকেও তার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বৃহত্তর সমাজে পারস্পারিক কর্তব্য ও অধিকারের একটি নতুন ভিত্তি এইভাবে স্থাপিত হল।
আধুনিক জীবনের সাধারণ কাজকর্মে যে নীতিবোধ প্রয়োজন হয় তাতে অনেক সময় প্রেমের অংশটা প্রধান নয়, তাকে প্রাধান্য দেওয়া বিপজ্জনক। পরীক্ষার খাতা দেখার। সময় পরীক্ষক যে নীতিবোধ থেকে নিরপেক্ষতা রক্ষা করেন তাতে সাধারণ অর্থে প্রেম। অনুপস্থিত তার পরিবর্তে আছে ন্যায় ও মঙ্গলবোধ। অধিক গুণসম্পন্ন অপরিচিত ব্যক্তিকে চাকুরীতে অগ্রাধিকার দেবার জন্য যে ন্যায় দৃষ্টি আবশ্যক, তাতে অপরিচিতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও প্রেমদৃষ্টির সঙ্গে সেটা অভিন্ন নয়।
প্রশ্নের আরও গভীরে যাওয়া যাক। আত্মীয় ও প্রতিবেশীর ভিতরে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আত্মীয় আমাদের “অহং” থেকে পৃথক নয়। স্ত্রী যেমন স্বামীর অধাঙ্গিনী, পুত্র যেমন পিতার প্রলম্বন, পরিবারও তেমনই আমিত্বের পরিবর্ধিত সংস্করণ। আত্মীয় সম্প্রসারিত অহং-এর অংশবিশেষ। প্রতিবেশী স্বতন্ত্র ব্যক্তি; তাকে স্বতন্ত্র জেনেও তার সঙ্গে আমরা কল্যাণেরই বন্ধনে আবদ্ধ হই। আধুনিক সমাজে মানুষে মানুষে এটাই প্রতীক সম্পর্ক। অতএব এ যুগে সজ্জন হতে হলে, সদিচ্ছার দ্বারা চালিত হতে হলে, স্বজনচিন্তার অধিক কিছু প্রয়োজন। “তুমিই সে” এই শিক্ষার ভিতর দিয়ে হিন্দুধর্ম বিশ্বকে ব্যক্তির অন্তরাত্মায় স্থাপন করেছে। কিন্তু যাকে আমরা সম্পূর্ণ আপন করতে পারিনি, সেই অপর মানুষের প্রতিও আমাদের কর্তব্য আছে। এ বিষয়ে হিন্দুধর্মে আচার ভিন্ন কোনো কার্যকর নির্দেশের অভাব। প্রাচীন আচারে আমরা আজ শ্রদ্ধা হারিয়েছি। অথচ ব্যক্তির স্বাতন্ত্র ও অধিকারবোধে চিহ্নিত আধুনিক জীবনদর্শন এখনও আমাদের ধ্যানধারণায় প্রবেশ করেনি।
বলে রাখা ভালো যে, বিভিন্ন ধর্মে তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব সমস্যা আছে। কিন্তু সেটা এখানে আলোচ্য নয়। আমাদের সমাজের সমস্যা নিয়েই এই প্রবন্ধের ভাবনা। আধুনিক যুগের উপযোগী নীতিবোধ আমাদের ভিতর বিস্তার লাভ করেনি, অতএব প্রাচীন আত্মীয়-চিন্তার দুই বিপরীত মেরুর ভিতর আমরা আজও দোদুল্যমান। আমরা এক লাফে সমাজকে ডিঙিয়ে ভগবানের কাছে হাজির হই। যখন সংসারে ফিরে আসি তখন হয় স্বার্থবুদ্ধি, নয়তো স্বজনপোষণ নীতি দিয়ে চালিত হই। যে বৃহৎ সমাজবোধ অথবা বিবেক এ দুয়ের ভিতর সেতু রচনা করতে পারতো, আমাদের সংস্কৃতিতে আজ তার অস্তিত্ব প্রায় চোখে পড়ে না। এ ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে এতোই ব্যাপক যে, এর ব্যতিক্রম আমরা কদাচিৎ কল্পনা করি। কারও কাজ যদি আপাতদৃষ্টিতে নিঃস্বার্থ হয় তো অত্যন্ত গোপন উদ্দেশ্য কল্পনা করে তাঁর সম্বন্ধে আমাদের সন্দেহ আরও গম্ভীর হয়। নয়তো তাঁকে আমরা সাধুসন্ত বানাই। মোট কথা, কোনো ব্যক্তি সংসারে থেকেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ন্যায়বুদ্ধি দ্বারা চালিত হতে পারেন, এটা সচরাচর আমাদের হিসেবের মধ্যে আসে না। কারণ। নিজের চেতনার ভিতর এটা আমরা সহজে খুঁজে পাই না। অপরের সম্বন্ধে আমাদের। ধারণা আত্মজ্ঞানেরই প্রতিফলন।
যেমন প্রাচীন আত্মীয়তাবোধে ভাঙন ধরলেও নতুন ন্যায়বোধ আমাদের ধ্যানধারণায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তেমনই পুরাতন আচারের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন আচার আমাদের সমাজে এখনও গড়ে ওঠেনি। ইতিহাসের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনাত্মীয়ের প্রতি আমাদের কর্তব্য পরিবর্তিত হয় এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নতুন। আচারের প্রয়োজন হয়। আচার বস্তুটির প্রতি আধুনিক মনে একটা বিরূপতা আছে। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। আচার সংস্কৃতিকে একটা বিশেষ ছাঁচে ঢালে; ফলে পরিবর্তন কঠিন হয়। তবু ব্যক্তিগত জীবনে অভ্যাসের মতোই সমাজজীবনে আচারের একটা স্থান আছে। অভ্যাসের জোরে যেমন আমরা কিছু প্রয়োজনীয় কাজ অক্লেশে করি, আচারের গুণে তেমনই কতগুলি দায়িত্ব সহজে পালন করা যায়। দায়িত্ব পালনের সময় যদি প্রতিবার চিন্তা করতে হয় যে, এবার ওটা না করলেই নয় কি না, তা হলে কর্তব্যে অবহেলা করার পক্ষে কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় না।
এই অবহেলা আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে। চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির কথা বলছি। সেইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনাচারের কথা বলছি যার যোগফল বৃহৎ। আমাদের অনেকেই বাড়ীতে পূজাহ্নিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন, কিন্তু অফিসে আড্ডা দেন। বাড়ীতে যাঁরা এসব কিছুতে বিশ্বাস করেন না, তাঁরাও সচরাচর অপরের অনুষ্ঠানে বাধা দেন না; চক্ষুলজ্জাটা অবিশ্বাসীর। অফিসে যিনি কাজে বিশ্বাসী তিনি মনে মনে উত্যক্ত বোধ করলেও আড্ডায় বাধা দেন না; চক্ষুলজ্জাটা বিশ্বাসীর। অর্থাৎ, পুরনো আচারের। জনমানসে একটা প্রতিষ্ঠা আছে; কিন্তু পরিবারের বাইরে দৈনন্দিন ক্রিয়াকাণ্ডে যেখানে আমরা অনাত্মীয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ, সেখানে কোনো কর্মভিত্তিক নীতি গণমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানে ব্যক্তি হিসাবে আমাদের প্রত্যাশা আছে, অভিযোগ আছে, কিন্তু সমাজ হিসাবে আমাদের কোনো আচার নেই, অতএব অভিযোগ পূরণের কোনো সহজ ও নিয়মিত পথ নেই।
স্বজনপোষণের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তারপর বলেছিলাম ব্যক্তির অধিকারের কথা। সেটা আরও গোড়ার প্রশ্ন। তাই দিয়ে শেষ করছি। কর্তব্যবোধ ও অধিকারবোধের ভিতর যে নতুন সামঞ্জস্য নাগরসংস্কৃতিতে আবশ্যিক, আমাদের সমাজে সেটা এখনও অপরিচিত, অন্তত অনাদৃত। অনাত্মীয় নাগরিকের প্রতি কর্তব্যপালনে আমরা অভ্যস্ত নই; অতএব অনাত্মীয় ব্যক্তির অধিকারও এখানে উপেক্ষিত। ব্যক্তির অধিকার আমরা বুঝি না, গ্রাহ্য করি না। পরিণামে অধিকারসংক্রান্ত প্রশ্নের মীমাংসায় প্রাধান্য লাভ করে যুক্তির চেয়ে আদিম দুটি প্রবৃত্তি। আমরা দয়া বুঝি, আর বুঝি ভয়। যখন কিছু পেতে চাই, হাতজোড় করি–নয়তে মারমুখো হই। যখন কিছু দেবার প্রশ্ন ওঠে, কৃপা করি–অথবা গোলমাল এড়াবার জন্য দিই। ভয়ে আত্মসমর্পণ করি, তাকে বলি দরদ। যে বস্তুটি আজ আমাদের নেই তা হল মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড নেই, কারণ যে নীতি আমাদের সংস্কারের অঙ্গ, সেটা এ যুগের নয়; যে নীতি এ যুগের যোগ্য, মনের। গভীরে তাতে আমাদের বিশ্বাস নেই। আমাদের একটা বড় পটুত্ব আছে, সেটা হল কোনো প্রকারে বাঁচা। কোনো প্রকারে আমরা বাঁচছি, বাঁচবো তবে সেটা যুগের যোগ্য জীবন নিয়ে বাঁচা নয়।
কথাটা নৈরাশ্যবাদের মতো শোনাচ্ছে। তাহলে অন্যভাবে বলা যাক। আধুনিকতার একটা সদর্থ আছে; সেই অর্থটি যখন আমরা আবিষ্কার করতে পারব, সেটাই হবে এ যুগে। আমাদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার! কারণ রাজা উজীর কে এলেন গেলেন তাতে খুব যায় আসে না; দেশের সংস্কারেরও পরিবর্তন চাই। আধুনিকতার যেটা গভীরতর অর্থ, যার কেন্দ্রে আছে ব্যক্তি এবং যুক্তি, সেটাকে জেনে, তাকে গ্রহণ করে, তবেই তাকে সার্থকভাবে। অতিক্রম করা সম্ভব। তার অভাবকেই বলব এ যুগের প্রকৃত অপসংস্কৃতি।
ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)