০২.
গোটা দুনিয়ার উপর রেগে আগুন হয়ে আছে কার্লো রিটসি। কর্লিয়নি পরিবারে বিয়ে করলে কি হবে, ম্যানহাটনের অপার ইস্ট সাইডের একটা ব্যবসা গুছিয়ে দিয়ে দূরে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। মনে আশা ছিল, লং বীচের উঠানে একটা বাড়ি দেয়া হবে ওকে। জানে, ইচ্ছা করলেই বাড়িগুলো থেকে তার অনুচরদের পরিবারগুলোকে সরিয়ে দিতে পারেন ডন। একটামাত্র বাড়ি খালি করে দিলেই তো জায়গা পেয়ে যায় সে, সেই সাথে কর্লিয়নি পরিবারের সমস্ত লাভজনক ব্যাপারের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা যায়। কিন্তু ডন তা করেননি।
অবজ্ঞা আর ঘৃণার সাথে তাই ভাবছে কার্লো, ভারি তো ছাই মহামান্য ডন। নিধিরাম সর্দার। ফালতু একটা খুদে গুণ্ডা। তা না হলে রাস্তার মাঝখানে গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে? বুড়ো শালা মরল না, সেটাই দুঃখের বিষয়। এক সময় বন্ধু ছিল সনি, এখন যদি পরিবারের মাথা হয়, হয়তো কিছুটা সুযোগ-সুবিধে পাবে সে। একটু সুযোগ পেলেই হয়, কর্লিয়নি পরিবারের গহীন গভীরে নাক ডুবিয়ে দেবে সে।
কফি ঢালছে কনি, তার দিকে তাকাল কার্লো। ইস, কি ছিরির বউই না জুটেছে তার কপালে! বিয়ে হয়েছে এই তো পাঁচ মাস, এবই মধ্যে মেদ জমিয়ে কেমন হস্তিনী হয়ে উঠেছে দেখো! ইস্টসাইডের মাগীগুলো এই রকম বিশ্রী হয়, মনে পড়ে গেল তার।
হাত বাড়িয়ে কনির নরম চর্বিসর্বস্ব নিতম্ব একটু টিপে দিল কার্লো। মুখ তুলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসল কনি। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল কার্লো, একটা শুয়োরের চেয়েও হ্যাম তোমার গায়ে বেশি। কনির মুখে আহত ভাব আর চোখ ছল ছল করছে দেখে কার্লোর খুশি লাগছে। হতে পারে মহামান্য ডনের মেয়ে, কিন্তু ওর স্ত্রী তো বটে। যেভাবে ইচ্ছা ওড়াতে পারে সে কনির টাকা, যেমন খুশি আচরণ করতে পারে। কর্লিয়নিদের একজন অন্তত তার পাপোশ, কথাটা ভেবেও সুখ। নিজেকে খুব প্রতাপশালী বলেও মনে হচ্ছে তার।
বিবাহিত জীবনটা একেবারে জঘন্যভাবে শুরু করেছে কার্লো। শুরুতেই বিয়েতে উপহার পাওয়া টাকার ব্যাগটাকনির কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। কনি সেটা হাতছাড়া করতে চায়নি বলে তাকে ঘুষি পর্যন্ত মেরেছে সে। চোখের নিচে কালসিটে দাগ নিয়ে কান্নাকাটি করেছে কনি।
টাকা তো নিয়েইছে, কি করেছে সেগুলো দিয়ে তাও সে জানায়নি কাউকে। ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়লে সত্যি সত্যি একটা গণ্ডগোলের সৃষ্টি হবে। এখনও
একটু একটু বিবেকের দংশন অনুভব করে সে। ইস, প্রায় পনেরো হাজার ভাল রেস আর থিয়েটারের মেয়েমানুষদের পিছনে সেফ উড়ে গেল।
টের পাচ্ছে কার্লো, ওর চওড়া পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে কনি। হাতটাকে লম্বা করে দিয়ে টেবিলের ওদিক থেকে এক প্লেট মিষ্টি বান তুলে নেবার সময় পেশীগুলোকে তাই একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে খেলিয়ে নিল সে। এই মাত্র হ্যাম আর ডিম গিলেছে, তবে লম্বা-চওড়া মানুষ কিনা, সকালের খাবার একটু বেশিই দরকার হয়। স্ত্রী ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সেজন্যে রীতিমত গর্ব অনুভব করছে সে! ওদের চোদ্দ পুরুষ যেমন দেখে এসেছে, সেরকম তেল চকচকে কার্লোভৃত স্বামী তো আর নয় সে। চুল তার সোনালী, কাট। সোনালী লোমে ঢাকা বাহু। মস্ত দুই কাধ। কোমরটা সরু ষাড়ের শক্তি নিয়ে যেসব গুণ্ডারা ওদের হয়ে কাজ করে তাদের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি জোর তার গায়ে। ক্লেমেঞ্জা, টেসিও. রকো। ল্যাম্পনি–এদেরকে সে ঘোড়াই কেয়ার করে। আর পলি গাটো নামে ওই ছোকরা তাকে তো কে যেন খতমই করে দিয়েছে কেন, কে মারল তাকে? এর ভিতরের আসল ব্যাপারটা কি•• কে জানে! কেন যেন এর পরপরই সনির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। হাতাহাতি মারামারিতে সনির সাথে টিকে যাবে সে, তবে সনি তার চেয়ে একটু লম্বা, একটু বেশি ভারি। সনি সম্পর্কে যে কুখ্যাতিটা রয়েছে সেটাকেই আসলে ভয় করে সে। সাঙ্ঘাতিক রাগ ওর, কিন্তু রাগী হোক আর যাই হোক, ওকে তো সব সময় হাসিখুশি মুখে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে বেড়াতেই দেখে সে। অন্তত তার সাথে হেসে ছাড়া কথা বলে না। নাহ, সনিকে ভয় নেই। ও তো বন্ধুই তার। এখন শুধু বুড়ো শালা মরলেই হয় সনির যুগ শুরু হলেই কপাল খুলে যাবে তার।
প্রচুর সময় নিয়ে, ধীরেসুস্থে চুমুক দিয়ে কফিটুকু শেষ করছে সে। এই ফ্ল্যাটে থাকতে হচ্ছে তাকে, কথাটা মনে পড়লেই রাগে আর ক্ষোভে মাথায় রক্ত চড়ে যায় তার। পশ্চিমে বিশাল আকারের বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছে সে, সেগুলোর তুলনায় এটা একটা কবুতরের খোপ ছাড়া কিছু নয়। জায়গাটাও শহরের। উল্টোদিকে, দুপুরবেলার বাজির কাজ শুরু করার জন্যে এখন তাকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। আজ আবার রোববার, হপ্তার অন্যান্য দিনের চেয়ে কাজের চাপ অনেক বেশি আজ। বেসবল তো একদিকে চলছেই, ওদিকে বাস্কেটবলের মরশুম এখনও শেষ হয়নি, তারপর রাতের রেস খেলাও শুরু হলো বলে। হঠাৎ খেয়াল করুল কার্লো, ওর পিছন দিকে ঘুঘুর করছে কনি! ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল সে। সাজগোজ করছে। সেই শহুরে ঢংয়ে, রঙ মেখে ভূত সাজছে আর কি, মনে মনে চটে উঠে ভাবল! নিউ ইয়র্কের এই চকমকে ফ্যাশন একদম পছন্দ করে না সে। গাউনটা পরেছে কনি রেশমের, সেটায় আবার ফুলের নকশা রয়েছে। বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিয়েছে আটো করে। জমকার্লো কারুকাজ করা, চকচকে পাথর বসানো ব্রেসলেট, কানের দুল, শার্টের আস্তিনে কত রকমের কুঁচি আর ভাজ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কার্লোর মনে হচ্ছে, বিশ বছর বেড়ে গেছে ওর বউয়ের বয়স।
কোন চুলোয় যাওয়া হচ্ছে শুনি? বেসুরো গলায় জানতে চাইল সে।
লং বীচে, মন মুখে বলল কনি। বাবাকে দেখতে যাচ্ছি। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না এখনও, কেউ দেখতে গেলে খুশি হন!
হঠাৎ কৌতূহল বোধ করল কার্লো। অকৃত্রিম আগ্রহের সাথে জানতে চাইল এবার, খেল তাহলে সনিই চালিয়ে যাচ্ছে?
ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে কনিকে। কিসের খেল?
হঠাৎ মাথায় রক্ত চড়ে গেল কার্লোর। অ্যাই, ছেনাল মাগী তোর বাপ-ভাই কি খেল চালায় জানিস না তুই? আমার সাথে ন্যাকামি করবি তো অ্যায়সা মার মারব, পেটের ছেলে বেরিয়ে আসবে তোর। স্বামীর অগ্নিমূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেছে কনি। সেটা লক্ষ করে রাগ আরও বেড়ে গেল কার্লোর। লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল সে, চটাস করে চড় মারল কনির মুখে। নাকের পাশে পাঁচ আঙুলের দাগ ফুটে উঠল। গুণে গুণে আরও তিনটে চড় মারল কার্লো। কনির উপরের ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে, বেঢপভাবে ফুলে উঠেছে নিচের ঠোঁট। দেখতে পেয়ে নিজেকে সামলে নিল কার্লো। একটু ভয় ভয় লাগছে। মুখে দাগ ফুটে উঠবে তা সে ভাবেনি, চড়গুলো জোরে মারা হয়ে গেছে।
স্বামী থামতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ছুটতে শুরু করল কনি। শোবার ঘরে ঢুকে দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজাটা। তালায় চাবি ঘোরাচ্ছে সে, শব্দটা কানে এল কার্লোর। আপনমনে একটু হাসল সে। কনি মনে করেছে আরও মার খেতে হবে তাকে, কথাটা ভেবে নিজেকে খুব কঠোর আর জাদরেল মনে হচ্ছে কার্লোর। আরাম করে বসল চেয়ারে। কফির পেয়ালাটা তুলে নিয়ে আয়েশের সাথে চুমুক দিচ্ছে তাতে।
একটা সিগারেট শেষ করে উঠে দাঁড়াল কার্লো। বেরুবার সময় হয়েছে, কাপড় পরে তৈরি হতে হয় এবার। এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে টোকা মারল। কিন্তু দরজা খুলছে না কনি, সাড়াও দিচ্ছে না।
অ্যাই মাগী, দরজা খুলবি তত খোল, তা না হলে লাথি মেরে ভাঙব।
সাড়া নেই কনির।
এই শেষবার বলছি। খোল। কাপড় বদলাতে হবে আমাকে। প্রচণ্ড রাগে চেঁচাচ্ছে কার্লো। কনির পায়ের শব্দ পাচ্ছে সে। তালায় চাবি ঘুরছে।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল কার্লো। কনি ওর দিকে পিছন ফিরে রয়েছে। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আবার বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল ও, দেয়ালের দিকে মুখ করে।
সময় কম, দ্রুত পোশাক পাল্টাচ্ছে কার্লো। শুধু সেমিজ গায়ে শুয়ে রয়েছে। কনি, এতক্ষণে লক্ষ করল ব্যাপারটা। তবে কি মাগী বাপকে দেখতে যাচ্ছে না? ভাবছে সে। গেলে ভালই হয়, নতুন কোন খবর হয়তো পাওয়া যাবে ফিরে এলে।
কি হলো? রাগ নয়, এখন ঠাট্টার সুরে, প্রায় আদর করার টংয়ে কথা বলছে কার্লো। নাহ, আমার মত পুরুষসিংহের বউ হবার উপযুক্ত নও তুমি। দুএকটা চড়-চাপড় খেয়েই যদি তোমার দম বেরিয়ে যায়, চলে কি করে? মনে মনে ভাবছে, এক নম্বরের হারামী মাগী, দুনিয়ার কুঁড়ে।
যাব না আমি, ফুঁপিয়ে উঠে বলল কনি, শব্দগুলো কেমন ভোতা আর জড়ানো লাগল কার্লোর কানে। আবার তার মেজাজ বিগড়ে যেতে বসেছে। ঝট করে একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে, কনির কাঁধ খামচে ধরে টান মারুল নিজের দিকে। মুখ ঘোরাল কনি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দমে গেল কার্লো। বুঝতে পারছে, কেন যেতে চাইছে না কনি। নিজেও ভাবছে, না গেলেই ভাল হয়। সত্যি খুব জোরে মারা হয়ে গেছে। ঠোঁটের ক্ষতগুলো এখন আরও কুৎসিত ভাবে ফুলে উঠেছে, মুখের বাঁ দিকে পাঁচ আঙুলের দাগগুলোও কদর্য দেখাচ্ছে। ঠিক আছে। যেতে হবে না তোমাকে, বলল সে। আজ রোববার, ফিরতে দেরি হবে আমার।
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল কার্লো। পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি রেখে যায়নি, পুলিশ তাই জরিমানার টিকেট লাগিয়ে রেখে গেছে। আরও গোছাখানেক টিকেটের সাথে গ্রাভ কমপার্টমেন্টে রেখে দিল সেটাও। মেজাজের অবস্থা ভালই এখন। বউকে ধরে পিটুনি দিলেই মনটা খুশি হয়ে ওঠে তার। যাকে বলে জামাই আদর, জামাই হওয়া সত্ত্বেও কর্লিয়নিদের কাছ থেকে সেটা পাচ্ছে না সে, সেজন্যে রাগ আর ক্ষোভ জমা হয়ে থাকে তার মনে-বউকে মারধোর করলে মনের খেদ খানিকটা কমে যায়, কিছুটা ঝাল মেটে।
প্রথমবার মারধোর করে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল কার্লো। কারণ চোখের কালসিটে দেখিয়ে নালিশ জানাবার জন্যে সোজা লং বীচে, মা-বাবার কাছে ছুটে গিয়েছিল কনি। সত্যি ভয় সেধিয়ে গিয়েছিল মনে। কিন্তু ঘটল না কিছুই, বরং একেবারে লক্ষ্মী, সুবোধ বালিকা হয়ে ফিরে এল কনি। যেন ওর মত স্বামী-অন্ত প্রাণ, কর্তব্যপরায়ণা ইতালীয় বউ আর হয় না। এই ঘটনাটার পরে, বেশ কয়েক হপ্তা কার্লোও আদর্শ, সুবোধ স্বামীর অভিনয় চালিয়ে গেছে। সেবা করল বউয়ের, খুব যত্ন নিল, কত রকম বিচিত্র ভঙ্গিতে জানাল কনিকে সে ভালবাসে–এমন কি দিনে দুবার করে, সকালে একবার বিকেলে আরেকবার, বউকে নিয়ে শুলো। তার মত তো আর চালাক নয় কনি, এত খাতির যত্নের আসল উদ্দেশ্যটা টের পায়নি। শেষ পর্যন্ত নালিশ জানাতে গিয়ে বাপের বাড়িতে কি কি ঘটেছে, সবই সে বলে ফেল। স্বামীর আশ্চর্য পরিবর্তন দেখে তার ধারণা হয়েছিল, যা করার করেছে, আর কখনও গায়ে হাত তুলবে না কার্লো।
নালিশ জানাতে গিয়ে মা-বাপের কাছ থেকে এতটুকু সহানুভূতি পায়নি কনি। সব কথা শুনে মা একটু বিচলিত বোধ করেছেন বটে, কার্লোকে ডেকে পাঠিয়ে একটু বোঝাবার জন্যে অনুরোধ করেছেন স্বামীকে। কিন্তু সে-অনুরোধ রক্ষা করতে রাজী হননি ডন।
বলেছেন, হ্যাঁ, তুমি আমার মেয়ে, কিন্তু এখন তো স্বামীর হেফাজতে রয়েছ। তোমার ভালমন্দ সে বুঝবে। ইটালীর রাজার কথাই ধরো না, তিনি পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর নিজেদের ব্যাপারে নাক গলাতে সাহস পাননি। বাড়িতে ফিরে যাও, মা, ভাল ব্যবহার করো স্বামীর সাথে। ভাল স্ত্রীর গায়ে কোন স্বামী হাত চোলে না, তুমি ভাল হয়ে চললে কার্লোও তোমার গায়ে হাত তুলবে না আর।
রেগে গেছে কনি, বাপকে বলেছে, তুমি কখনও মার গায়ে হাত তুলেছ? ছেলেমেয়েদের মধ্যে কনিকেই বেশি আদর করেন ডন, সেজন্যেই এতটা বেয়াদপি করার সাহস পেল সে।
উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা কখনও আমার কথার অবাধ্য হয়নি।
স্বামীর কথায় সায় দিয়ে, একটু গর্বিত ভঙ্গিতে মাকেও মাথা দুলিয়ে হাসতে দেখল কনি।
বিয়ের উপহার পাওয়া টাকাগুলো কেড়ে নেবার সময় কার্লো কি রকম মারধোর করেছে তারও বর্ণনা দিল কনি। বলল, টাকাগুলো নিয়ে কি করেছে না করেছে তা পর্যন্ত বলছে না কার্লো।
মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডন বললেন, তোমার মত বেয়াড়া স্ত্রী হলে সব স্বামী যা করে কার্লোও তাই করেছে। আমি হলেও তাই করতাম।
মা-বাবার হাবভাব দেখে বোকা মনে গেছে কনি, মনে বেশ একটু ভয় নিয়েই ফিরে এসেছে বাড়িতে। মা-বাবার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আদর পেয়ে মানুষ হয়েছে সে, বিয়ের পর পরই হঠাৎ তাদের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এর কোন কারণই খুঁজে পায়নি কনি।
ভাবভঙ্গিতে যতটা দেখিয়েছেন, ততটা সহানুভূতিহীন নন ডন কর্লিয়নি। কনির অভিযোগ শোনার পরই তিনি খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন। বিয়ের উপহার পাওয়া কনির টাকাগুলো নিয়ে কি করেছে কার্লো সে খবর জানতে পেরেছেন তিনি। চিন্তা ভাবনা করে কিছু লোক নিযুক্ত করলেন, যারা কার্লোর বুক মেকারের ব্যবসার উপর নজর রাখবে। কার্লো কিভাবে চলাফেরা করছে, ব্যবসাটাকে কিভাবে চালাচ্ছে এইসব ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য তারা হেগেনকে জানিয়ে দেয়। গোটা ব্যাপারটা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন ডন! এসব ব্যাপারে তিনি কোন ভূমিকা নিতে পছন্দ করেন না। তার কথা হলো, জামাই যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ভয় করে, তাহলে স্বামীর কর্তব্য পালন করবে কিভাবে?
এরপর যখন কনির পেটে বাচ্চা এল, ডন ভাবলেন, ন্যায্য সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তিনি। ওদের ব্যাপারে নাক না গলানোটাই ঠিক কাজ হয়েছে। এর মাঝখানে অবশ্য আরও কয়েকবার স্বামীর নামে নালিশ করে গেছে কনি তার মায়ের কাছে, এবং মা অতিষ্ঠ হয়ে উঠে শেষ পর্যন্ত স্বামীর কানেও সে কথা তুলেছেন। মাকে আভাসে জানিয়ে দিয়েছিল কনি, স্বামীকে শ্রাগ করার কথা ভাবছে সে।
কথাটা কানে যেতে এই প্রথম মেয়ের উপর চটে গেলেন ডন। বললেন, তুমি কি ভুলে যাচ্ছ, কনি, সে তোমার সন্তানের জন্মদাতা? বাপ নেই এমন একটা শিওর জন্মে কি লাভ এ-দুনিয়ায়?
এসব কথা স্ত্রীর মুখ থেকেই শুনেছে কার্লো। শুরবাড়ির সম্পর্কে তার মনে যথেষ্ট ভয় ছিল, কিন্তু এখন ভয়-ডর থেকে মুক্ত সে। কনির সাথে ওদের আচরণের নমুনা শুনে সাহস আরও লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে তার। ব্যবসা কেন্দ্রে তার দুজন কর্মী আছে, স্যালি র্যাগস আর কোচ, এদেরকে সে গর্বের সাথে শোনায়, বউ তার সাথে বাড়াবাড়ি করতে চেষ্টা করলে অ্যায়সা উত্তম-মধ্যম দেয় যে বাপের নাম পর্যন্ত ভুলতে বসে। কর্মীরা অবাক বিস্ময়ে শোনে ওর কথা। ডন ভিটো কর্লিয়নির মেয়ের গায়ে হাত তোলে, ভাবতে গেলেও গায়ের নোম খাড়া হয়ে যায় তাদের। সেই সাথে কার্লোর উপর ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
কিন্তু একটা তথ্য কনির কাছ থেকে পায়নি কার্লো পেলে নিজেকে আর এতটা নিরাপদ বলে মনে হত না কখনোই। সে যে কনিকে মারধোর করে, কথাটা সনির কানেও গেছে। শুনে তো মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল সনির, সেই মুহূর্তে ও যদি কার্লোকে হাতের কাছে পেত, কি হত বলা যায় না। বোধহয় শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হত না, লাথি মারতে মারতে লাশের হাড়গুলোর গা থেকে মাংসের শেষ কণাটাও খসিয়ে ফেলত। কিন্তু মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ডন নিজে। তিনি তার বড় ছেলেকে এ-ব্যাপারে নাক না গলাবার জন্যে কঠোর নির্দেশ দিলেন। শুধু বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিল সনি। ডনের হুমুক অমান্য করার সাহস এবং স্পর্ধা তারও নেই। সেই ঘটনার পর থেকে তাই কার্লোকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে সনি। নিজেকেই বিশ্বাস নেই তার। কার্লোকে সামনে পেলে সে হয়তো রাগ সামলাতে পারবে না, হয়তো খুনই করে ফেলবে।
এসব কিছুই জানা নেই কার্লোর, তাই আজকের এই রোববারের সকালে স্ত্রীকে উত্তম-মধ্যম দিয়েও তার মনে আত্মবিশ্বাস আর নিরাপত্তাবোধের কোন অভাব নেই। গাড়ি নিয়ে নাইনটি-সিক্স স্ট্রীট ধরে শহরের উল্টো দিকে ইস্ট সাইডে যাচ্ছে। সে। আরেক দিক থেকে এসে ওদের বাড়ির সামনে থামল সনির গাড়িটা, কিন্তু তা চোখেই পড়ল না কার্লোর।
উঠানের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে এসে গত রাতটা শহরে লুসি ম্যানচিনির সাথে কাটিয়েছে সনি। মেয়েটাকে ভাল লাগে ওর যৌন-কামনায় এমন অধীর হয়ে থাকতে আর কোন মেয়েকে দেখেনি সনি। অথচ মেয়েটার মধ্যে রাক্ষুসী ভাব বলতে কিছুই নেই। যাকে বলে পুরুষখেকো মেয়ে, লুসি মানচিনি মোটেও তা নয়। যৌনসঙ্গমের গোটা ব্যাপারটাকে আশ্চর্য একটা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে লুসি। তার হৃদয়ের সমস্ত কোমল অনুভূতি সনিকে পাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে। সনি যেন ওর পরম পুরুষ, ওকে যেন যাদু করেছে, নিজেকে তার কাছে উজাড় করে দেবার মধ্যেই যেন ওর জীবন আর যৌবনের সার্থকতা। সনিই ওকে কামুকী করে তোলে, আর কোন পুরুষের দিকে ফিরে তাকাতেও ইচ্ছা করে না তার।
সনি এখন বাড়ি ফিরছে। চারজন বডিগার্ড রয়েছে সাথে। দুজন সামনে, দুজন পিছনে। নিজের গাড়িতে কাউকে নেয়নি সনি। কখনও নেয় না। পাশে বডিগার্ড বসিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন দেখে না সে, কেউ যদি সরাসরি আক্রমণ করে তাকে ও নিজেই ঠেকাতে পারবে। নিজেদের দুটো গাড়িতে আসা-যাওয়া করে বডিগার্ডরা। লুসি ম্যানচিনির ফ্ল্যাটের দুপাশে দুটো ফ্ল্যাটে থাকে তারা। মাঝখানের ফ্ল্যাটের উপর সজাগ নজর রাখার ব্যবস্থাও আছে। লুসির সাথে দেখা করতে যাওয়ার মধ্যে বিপদের তেমন কোন ঝুঁকি নেই, খুব বেশি না গেলেই চলে। শহরে ঢুকে সনি ভাবল যাবার পথে ছোট বোন কনিটাকে গাড়িতে তুলে লং বীচে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। ইতিমধ্যে কাজে বেরিয়ে যাবার কথা কার্লোর, শয়তানটা তো আর কনিকে গাড়ি কিনে দেবে না!
কনিদের বাড়ির কাছাকাছি এসে সনি দেখল কার্লো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ভালই হলো, ভাবল সে, ছুঁচোটার সাথে দেখা হয়ে গেলে আবার হয়তো মাথায় রক্ত চড়ে যেত তার।
বাড়িটার সামনে একটু অপেক্ষা করতে হলো সনিকে। সামনের বডিগার্ড দুজন ভিতরে ঢুকল প্রথমে। তাদের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তারপর ঢুকল সনি। ঢোকার সময় ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের বডিগার্ডদেরকে দেখে নিল একবার। ওর গাড়ির ঠিক পিছনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে তারা। নিচে নেমে সম্পূর্ণ সজাগ সতর্ক ভঙ্গিতে পাহারা দিচ্ছে রাস্তাটাকে।
নিজেও চোখকান খোলা রেখেছে সনি। ও যে শহরে এসেছে তা জানার কথা নয় শত্রুদের। জানার সম্ভাবনা একেবারে যে নেই তা নয়, দশ লাখ ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনা, তার বেশি নয়। তবু, জানে সনি, সাবধানের মার নেই কখনও। এই শিক্ষাটা পেয়েছে ও উনিশশো ত্রিশ সালের লড়াইয়ে।
কখনও, ভুলক্রমেও, লিফট বা এলিভেটরে চড়ে না সনি। জানে, এগুলো মৃত্যু ফাঁদ। প্রায় এক ছুটে আট প্রস্থ সিঁড়ি টপকে কনিদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল ও। কার্লো বেরিয়ে গেছে, তার মানে নিশ্চয়ই একা আছে কনি। কিন্তু নক করছে ও, ভিতর থেকে সাড়া দিচ্ছে না কেন কনি?
আবার নক করল সনি।
এবার সাড়া দিল বটে কনি, কিন্তু গলার আওয়াজটা কেমন যেন অস্থির, কাঁপা কাঁপা ঠেকল সনির কানে।
কে? জানতে চাইল কনি।
বোনের গলার সুরে স্পষ্ট আতঙ্ক রয়েছে, বুঝতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে গেল সনি। তার বোনটি তো চিরকালই ভারি চালবাজ, ভারি দেমাকী, কেয়ার করে না কাউকে-বাড়ির আর সবার মতই বেপরোয়া আর শক্ত, তার আবার কি হলো?
আমি সনি, বলল ও।
ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। এক ঝটকায় দরজার কপাট খুলে লাফ দিয়ে বড় ভাইয়ের বুকের উপর পড়ল কনি। তাকে জড়িয়ে ধরে অদম্য কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
একচুল নড়ছে না সনি। স্তব্ধ, পাথর হয়ে গেছে। খানিক পর বোনকে ধরে একটু সরাতেই তার মুখের উপর ফুলে ওঠা ক্ষতগুলো দেখতে পেল ও। মুহূর্তে বুঝে ফেলল কি হয়েছে।
মাথায় আগুন ধরে গেল সনির। এতক্ষণ স্থির পাথরের মত হয়ে ছিল, এখন থরথর করে কাঁপছে শরীরটা। অদম্য একটা ইচ্ছা জাগছে, এই মুহূর্তে নিচে নেমে ধাওয়া করে কার্লোকে, প্রতিশোধ নেয়।
বড় ভাইয়ের মুখের চেহারা হিংস্র, বিকৃত হয়ে উঠেছে দেখে তাকে আরও শক্ত করে ধরে থাকল কনি, কোনমতে ছাড়ল না, জোর করে টেনে নিয়ে এল ঘরের ভিতর। এখনও কাঁদছে সে, কিন্তু অভিমান যা দুঃখে নয়-এখন কাঁদছে স্রেফ ভয়ে। বড় ভাই কেমন রাগী মানুষ, জানা আছে তার। আদরের একমাত্র বোন সে, সে-ও ওকে ভয় করে যমের মত। আর সবার কাছে কার্লোর নামে নালিশ করলেও বড় ভাইয়ের কানে একটা কথাও তোলেনি সে কখনও।
এখনও সনিকে ঠাণ্ডা করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে কনি। জোর করে ঘরে টেনে নিয়ে এসে বোঝাচ্ছে। বিশ্বাস করো, আমারই দোষ। শুধু শুধু মেজাজ খারাপ করেছিলাম, কোমর বেঁধে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলাম–তবু কিছু বলেনি কার্লো। কিন্তু মাথায় ভূত চাপল আমার, ওর গায়ে হাত তুললাম-হাজার হোক পুরুষ মানুষ, আর সহ্য করতে পারল না, তাই একটু মারধোর করেছে। এত জোরে মারত না, কিন্তু আমি তো আর ছেড়ে দিইনি ওকে-জানোই তো, কারও চেয়ে রাগ আমার কম নয়।
প্রকাণ্ড কিউপিডের মত মুখটা থমথম করছে সনির। কিন্তু চেহারায় সেই হিংস্র ভাবটা এখন আর নেই। জানতে চাইল, বাবাকে আজ তুমি দেখতে যাবে নাকি?
চুপ করে আছে কনি, উত্তর দিতে পারছে না।
এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম বাবাকে হয়তো দেখতে যেতে চাইবে তুমি, তাই এসেছিলাম আর কি।
দ্রুত এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল কনি। আজ নয়। ওঁরা…ওঁরা আমাকে এই অবস্থায় দেখেন তা আমি চাই না। আরেকদিন…আগামী হপ্তায় যাব।
ঠিক আছে, বলে উঠে দাঁড়াল সনি। রান্নাঘরে ঢুকে ফোন করুল একটা। তারপর আবার কনির কাছে ফিরে এসে বলল, ডাক্তার আসছে, দেখে যাক একবার তোমাকে। এই সময়ে এখন তোমার সাবধানে থাকা একান্ত দরকার। আর কমাস বাকী ছেলে হতে?
দুমাস, বলল কনি। তার দুচোখে ব্যাকুল আবেদন ফুটে উঠল। সনি, তোমার দুটো পায়ে পড়ি-কিছু কোরো না। লক্ষ্মী দাদা, আমার মাথা খাবে, এত বড় সর্বনাশ কোরো না আমার! সনি মুখে কিছু না বললেও ওর চিন্তা-ভাবনা কোন্ খাতে বইছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে কনি। আতঙ্কে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে তার।
নিঃশব্দে হাসছে সনি। চোখের স্থির দৃষ্টিতে অদ্ভুত একটা নিষ্ঠুরতা উপচে পড়ছে। ভেব না, বোনকে আশ্বাস দিল ও। তোমার ছেলে দুনিয়াতে আসার আগেই তার বাপকে দুনিয়া থেকে বিদায় করব-অত বড় পাষণ্ড আমি নই।
সামনে একটু ঝুঁকে পড়ল সনি, বোনের মুখের অক্ষত দিকটায় আলতোভাবে চুমো খেলো একটা। তারপর সিধে হয়ে দাঁড়াল। ঘুরে, লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
.
ঈস্টসাইড, একশো বারো নম্বর স্ট্রীট। একটা মিষ্টির দোকান। দোকানটার দুপাশে লম্বা লাইন ধরে দুই সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এই দোকানটাই কার্লোর বুক মেকিং ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।
দোকানের সামনে চওড়া ফুটপাথ, সেখানে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে তাদের বাবারা বল লোফালুফি খেলছে। রোববার, ছুটির দিন, দোকানে বাজি ধরার জন্যে এসেছে বাবারা, সাথে করে বেড়াতে নিয়ে এসেছে ছেলেমেয়েদের। কার্লো আসছে দেখে, খেলা ভেঙে দিল বাবারা। ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি থামাবার জন্যে তাদেরকে আইসক্রীম কিনে দিল। নিজেদের সামনে প্রায় সবাই এরপর খবরের কাগজ মেলে ধরল, কাগজে ছাপা রয়েছে খেলা শুরু করবে যারা সেই সব পিচারদের তালিকা। দুনিয়াদারির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আজকের বেসবল খেলায় কে জিতবে না জিতবে, কার উপর বাজি ধরা যায় এই সব চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়েছে সবাই।
দোকানে ঢুকে পিছনের বড় কামরাটায় চলে এল কার্লো।
কর্মীদেরকে রাইটার বলা হয়। সংখ্যায় তারা দুজন। স্যালি র্যাগস, পাকানো দড়ির মত চেহারা। আর প্রকাণ্ডদেহী কোচ। কাজ শুরু হবে, সেজন্যে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে ওরা। লম্বা লাইন টানা প্যাড রয়েছে ওদের সামনে। এগুলোয় বাজির হিসাব লেখা হবে। কাঠের স্ট্যান্ডের মাথায় রয়েছে একটা ব্ল্যাকবোর্ড, তাতে সুপার লীগের মোলোটা বেসবল দলের নাম লেখা হয়েছে চক দিয়ে। কোন দলের সাথে কোন্ দল খেলছে তাও দেখানো হয়েছে পাশাপাশি নাম লিখে। প্রত্যেক একজোড়া নামের পাশে একটা করে খোপ আঁকা আছে। আজকের বাজির অসম সংখ্যা, যাকে বলা হয় অডস, ওই খোপে লেখা হবে।
দোকানের ফোন ট্যাপ করা আছে? কোচকে জিজ্ঞেস করল কার্লো।
মাথা নাড়ল কোচ। না, এখনও বন্ধ ট্যাপ।
এগিয়ে গিয়ে ওয়াল টেলিফোনের সামনে দাঁড়াল কার্লো। ডায়াল করল একটা। নাম্বারে। অপরপ্রান্ত থেকে শুনে দ্রুত আজকের খেলার সব অডস নোট করছে সে। চুপচাপ, গভীরভাবে তাকে লক্ষ করছে কোচ আর স্যালি র্যাগ। রিসিভার যথাস্থানে রেখে দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে এসে দাঁড়াল কার্লো। নোটবই দেখে সব কটা খোপে এক এক করে অডস লিখে রাখছে। নিঃশব্দে এখনও তাকিয়ে আছে। কর্মীরা কার্লোর দিকে। কার্লো জানে না, কিন্তু সংখ্যাগুলো আগেই পেয়ে গেছে তারা। কার্লোর লেখা সংখ্যাগুলোর সাথে নিজেদের জানা সংখ্যাগুলো মিলছে কিনা দেখে নিচ্ছে মনোযোগের সাথে।
এই ব্যবসায় ঢোকার পর প্রথম হাতেই ব্ল্যাকবোর্ডে সংখ্যা লিখতে গিয়ে মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছিল কার্লো। এর ফলে, সব জুয়াড়ীদের যা চিরকালের স্বপ্ন, সেই রকম একটা মিল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। একজনের কাছে বোর্ডে লেখা অডস দেখে বাজি ধরা, আরেকজন বুক-মেকারের কাছে আসল অডস অনুসারে বাজি ধরা–এর অর্থ মিডল। এভাবে বাজি ধরতে পারলে জুয়াড়ীর কখনও লোকসান হয় না। লোকসান যা হবার তা শুধু কার্লোর খাতার বা বুকের হয়। কার্লোর ওই একটা ভুলের জন্যে সেই হপ্তায় ছয় হাজার ডলার লোকসান খেতে হয়, তাতে জামাই সম্পর্কে ডনের ধারণাই সমর্থন পায়। যাই হোক এরপর তার তরফ থেকে হুকুম এল, কার্লোর সব কাজ আরেকবার করে যাচাই করে তার নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
এমনিতে কর্লিয়নি পরিবারের কর্তারা দৈনন্দিন কাজকর্মের এইসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কখনোই মাথা ঘামান না। এসব বিষয়ের কোন খবর ওদের কানে কেউ যদি পৌঁছেও দিতে চায় তাকে কমপক্ষে পাঁচটা স্তর এক এক করে টপকে যেতে হবে। কিন্তু বুক-মেকার ব্যবসাটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে নতুন জামাইয়ের যোগ্যতা পরিমাপের জন্যে, তাই গোটা ব্যাপারটা রাখা হয়েছে টম হেগেনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে। কার্লোর কাজের ধরন-ধারণ সম্পর্কে রোজই একটা করে রিপোর্ট পায় হেগেন!
খোপওলো ভরার কাজ শেষ হতেই জুয়াড়ীরা সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল পিছন দিকের বড় হলঘরটায়। যে যার খবরের কাগজ, খেলার তথ্যের পাশে লিখে নিচ্ছে অডসগুলো। ব্ল্যাকবোর্ড দেখার জন্যে অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েদেরকে হাত ধরে নিয়ে এসেছে। খুব বড় বড় বাজি ধরছে এক নোক, সে তার ছোট মেয়েটার হাত ধরে নাড়া দিল, জানতে চাইছে, বলো তো, লক্ষ্মী মা, আজ তোমার কাকে পছন্দ? জায়েন্ট, নাকি পাইরেটদের?
এ ধরনের রোমাঞ্চকর নাম শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল বাচ্চা মেয়েটা। বাপকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, বাবা, কাদের গায়ে জোর বেশি? জায়েন্টদের না পাইরেটদের?
মেয়ের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল বাবা।
এরপর একদল লোক লাইন দিয়ে দাঁড়াল দুই রাইটার এর সামনে। এক পৃষ্ঠা লেখা শেষ হলেই রাইটার সেটা ছিঁড়ে সংগ্রহ করা টাকাগুলো মুড়ে ফেলছে সেটা দিয়ে, তারপর তুলে দিচ্ছে কার্লোর হাতে। কাগজে মোড়া সমস্ত টাকা নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল কার্লো, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। দোকানের মালিক আর তার পরিবারের জন্যে একটা কামরা আলাদা করা আছে, সেখানে ঢুকল সে। ফোন করে সেন্টার এক্সচেঞ্জে বাজির তথ্য জানিয়ে দিল আগে, তারপর ওয়ালসেফের ভিতর রেখে দিল টাকাগুলো। পাশেই একটা জানালা; সেটার পর্দা আরেকটু টেনে দিলেই চোখের আড়ালে পড়ে যায় ওয়াল-সেফটা। মিষ্টির দোকানে আবার নেমে আসার আগে বাজির কাগজ পড়িয়ে ফেলল সে, বাথরুমের ড্রেনে ছাইগুলো ফেলে চেনটা টেনে দিল।
ব্লু ল, মানে খেলা নিয়ন্ত্রণ করার আইন বহাল থাকায় রবিবার দিন বেলা দুটোর আগে কোন খেলা শুরু হয় না। প্রথমদিকের বাজিগুলো ধরতে আসে অধিকাংশ বিবাহিত লোকেরা, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে এদেরকে, তা না হলে স্ত্রী আর বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে সাগরসৈকতে বেড়াতে যাওয়া হবে না। এর পরের দলে অবিবাহিত লোকই বেশি থাকে, তবে কিছু দায়িত্বহীন বিবাহিত লোকও এই দলে থাকে, যারা স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরকে গরম ফ্ল্যাটে ফেলে স্বার্থপরের মত একা বেরিয়ে আসে। এই অবিবাহিত বাজি ধরার দলটা পাকা জুয়াড়ী, এরা বাজিও ধরে মোটা টাকার। প্রথমবার বাজি ধরে সন্তুষ্ট হবার পাত্র নয় এরা, ঘুরেফিরে আবার চারটের দিকে ফিরে আসে, দ্বিতীয়বার বাজি ধরে। রবিবারে অতিরিক্ত খাটুনিটা এদের জন্যেই দিতে হয় কার্লোকে। তবে বিবাহিত কিছু লোকও সাগরসৈকত থেকে ফোনের সাহায্যে বাজি ধরে, প্রথমবার লোকসান হয়ে থাকলে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে দেখে সেটা পূরণ করা যায় কিনা।
বেলা দেড়টা। ভিড় পাতলা হয়ে গেছে জুয়াড়ীদের। একটু দম নেবার জন্যে স্যালি র্যাগসকে সাথে নিয়ে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল কার্লো দোকানের পাশেই উঁচু একটা বারান্দা, সেটার সিঁড়ির ধাপে বসল ওরা। একপাল উঠতি বয়সের ছেলে ডাংগুলি খেলছে রাস্তায়, সেদিকে তাকিয়ে আছে দুজন। খানিক পর ওদের সামনে দিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি.চলে গেল। সেটাকে দেখেও দেখল না ওরা। পুলিশের হেডকোয়ার্টার থেকে এই জুয়ার আস্তানাটাকে উদার প্রশ্রয় দেয়া হয়, এরা যাতে সম্পূর্ণ নিরাপদে কাজ চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে পুলিশের বড়কর্তাদের কড়া নজর আছে, তাই স্থানীয় পুলিশরা এদের ধারে কাছে ঘেষতে সাহস পায় না। দোকানে হানা দিয়ে যদি কখনও খানা-তল্লাশি করা হয়ও, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রথম সারির কর্তাদের তরফ থেকে আসতে হবে হুকুমটাকে। কিন্তু হুকুম নিঃ পুলিশের গাড়ি পৌঁছুবার আগেই খবর পেয়ে যায় এরা, ফলে সাবধান হবার সময় পায়। শেষ পর্যন্ত আপত্তিকর কিছু না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় পুলিশকে।
একটু পর দোকান থেকে কোচও বেরিয়ে এল, সিঁড়ির ধাপে বসল ওদের সাথে। বেস বল আর মেয়েমানুষ সম্পর্কে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করল ওরা। হাসছে কার্লো। বলল, আজও বৌটাকে একটু পিট্টি দিতে হলো। সংসারটা কার কথায় চলবে, সেটা ওকে শেখাচ্ছি আর কি।
কথার পিঠে কথা বলার সুরে জানতে চাইল কোচ, তার না ছেলে হবার সময় হয়ে এসেছে?
আরে না, তেমন কড়া ভোজ দিইনি, বলল কার্লো। দুগালে কটা চড় চাপড়, তার বেশি কিছু না। একটু চুপ করে থেকে ভারি গলায় আবার বলল, আমাকে ভেড়া ভেবেছে আর কি, নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে চায়–মেয়েমানুষের কথায় উঠব-বসব, আমি কি সেই পাত্র!
দোকানের সামনে আর আশপাশে এখনও ঘুর ঘুর করছে জুয়াড়ীরা। গরম পড়েছে, শার্টের বোতাম খুলে বাতাস লাগাচ্ছে গায়ে। কয়েকজন হাটাহাটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, কার্লো আর তার রাইটারদের ওপরের ধাপে এসে বসল তারা। আচমকা ডাংগুলি খেলা ছেড়ে উঠতি বয়সের ছেলেগুলো যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল, চোখের নিমেষে হাওয়া সব। বিকট শব্দে গোটা এলাকাটাকে সচকিত করে তুলে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এল একটা গাড়ি, ঘ্যাচ করে দোকানের সামনে ব্রেক কষল সেটা, টায়ারের সাথে রাস্তার ঘষা লেগে তীক্ষ্ণ কান ঝালাপালা করা শব্দ হলো। গাড়িটা এখনও পুরোপুরি থামেনি, ডাইভিং সীট থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। একজন লোক। দমকা বাতাসের মত ছুটে আসছে সে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে সবাই। একচুল নড়ার শক্তি নেই কারও।
প্রকাণ্ড কিউপিড মুখ আর বাকা ধনুক ঠোঁট প্রচণ্ড রাগে ঝুলে পড়েছে সনি কর্লিয়নির। বিকৃত, বীভৎস দেখাচ্ছে চেহারাটা। চোখের পলকে সিঁড়ির ধাপ কটা লাফ দিয়ে টপকে এল ও, লোহার মত কঠিন দুই হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল কার্লোর গলা। দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে বসেছেকার্লো,.পাঁচ থেকে সাত সেকেণ্ডের বেশি পেরোয়নি সময়। এতক্ষণেশ হলো আর সবার। সনিকে বাধা দেবার কথা কারও মনে উঁকিও দিল না, তবে কার্লোকে তারা ধরে রাখতে চেষ্টা করছে, তাও মাত্র কয়েকটা সেকেণ্ডের জন্যে। আসলে নিজেদের এই আচরণের মধ্যে দিয়ে কার্লোকে মাফ করে দেবার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছে তারা, কিন্তু মুখে কিছু বলার স্পর্ধা দেখাতে যাচ্ছে না। কার্লোকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে সনি। কোচ আর স্যালি র্যাগ বুঝল, তাদের মৌন অনুরোধ রক্ষা করতে রাজী নয় সনি কর্লিয়নি। সময় থাকতে থাকতেই কার্লোর কাছ থেকে এক পা করে পিছিয়ে এল দুজন। প্রচণ্ড শক্তি দিয়েও কার্লোকে টেনে নামাতে পারছে না সনি, বারান্দার মোটা লোহার রডের রেলিং জড়িয়ে ধরে ঝুলে আছে সে। কুঁকড়ে গেছে। তার শরীর, দুই বিশাল কাঁধের মাঝখানে মাথাটা গুঁজে রেখেছে। তার গায়ের শার্টটা ফড় ফড় করে ছিঁড়ে এল সনির হাতে।
কার্লোকে টেনে নামাতে পারবে না বুঝতে পেরে আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে সনি।
এরপর যা ঘটতে শুরু করল, চোখ মেলে দেখা যায় না। কোচ আর স্যালি র্যাগস অসুস্থ বোধ করছে, যে-কোন মুহূর্তে বমি করে ফেলতে পারে। জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা কার্লোকে মেরে ফেলছে সনি, দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে ওদের। দুই হাত এক করে প্রকাণ্ড একটা মুঠো পাকিয়ে কার্লোর কাঁধ, ঘাড় আর পিঠে দমাদম আঘাত করছে সনি। জোড়া হাতের প্রতিটি ঘুষি দূর থেকে ভেসে আসা তোপ দাগার মত দুম দুম আওয়াজ তুলছে। প্রতিটি আওয়াজের সাথে কেঁপে উঠছে। কোচ আর সালির শরীর। গরিলার মত বিশাল শরীর কার্লোর, গায়ে অসূরের মত শক্তি, কিন্তু তবু সে বাধা দিচ্ছে না সনিকে, প্রতিবাদ করছে না, একটা শব্দ উচ্চারণ করে দয়া ভিক্ষা চাইছে না। নিঃশব্দে, নিজেদের অজান্তেই আরও এক পা করে পিছিয়ে গেল কোচ আর স্যালি। কিছু বলবে সে স্পর্ধা নেই তাদের। দেখেশুনে বুঝতে পারছে সনি তার ভগ্নীপতিকে বোধহয় খুনই করে ফেলবে। কার্লোর সাথে রক্তাক্ত লাশ হয়ে কবরে নামার ইচ্ছা নেই তাদের। ডাংগুলি খেলা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো ফিরে এসেছে আবার, ইচ্ছা খেলা নষ্ট করার জন্যে গাড়ির ড্রাইভারের সাথে ঝগড়া করা। কিন্তু সেসব ভুলে গিয়ে বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তারা সনি আর কার্লোর দিকে। উঠতি বয়সের তাগড়া জোয়ান ছেলে ওরা, গায়ে শক্তি রাখে, কিন্তু তারা সবাই মিলেও সাহস পেল না এগিয়ে এসে বাধা দেয় সনিকে।
চারদিকে সচকিত করে দিয়ে ছুটে এল আরেকটা গাড়ি, ঘ্যাঁচ করে থামল সেটা সনির গাড়ির পিছুনে। লাফ দিয়ে নিচে নামল সনির দুজন বডিগার্ড। কিন্তু সনির বীভৎস আচরণ দেখে তারাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল একচুল এগোবার সাহস পেল না। সতর্ক, সজাগ হয়ে রাস্তা আর ঘটনার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে দাঁড়িয়ে আছে তারা। নির্বোধ কোন পথিক বা আর কেউ যদি কার্লোকে সাহায্য করতে বা সনির ক্ষতি করতে এগিয়ে আসে, তাদেরকে বাধা দিতে হবে যা ঘটে ঘটুক, মনিবের নিরাপত্তার দিকটা আগে দেখবে তারা।
দৃশ্যটার সবচেয়ে রোমহর্ষক বিষয় হলো, সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে আছে কার্লো। তবে সেজন্যেই বোধহয় এ-যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেল সে। লোহার মোটা রেলিংটাকে দুই হাত দিয়ে এমন শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে আছে, কোনমতে তাকে টেনে নামাতে পারল না সনি। সনির চেয়ে কম শক্তিশালী নয় সে, কিন্তু আশ্চর্য, পাল্টা আঘাত করতে রাজী হলো না। পড়ে পড়ে বেদম মার খাচ্ছে, নাক-মুখ দিয়ে বাতাসের সাথে বিদঘুঁটে শব্দ বেরিয়ে আসছে, কিন্তু রুখে দাঁড়াবার কোন চেষ্টাই নেই তার মধ্যে। তার ঘাড়ে, মাথায়, পাজরে ঘুষির পর ঘুষি মারছে সনি, বেকে যাচ্ছে কার্লোর শরীর, মোচড় খাচ্ছে, কিন্তু রেলিং তবু ছাড়ছে না সে। পাল্টা আঘাত না দিলে কতক্ষণ একতরফা আঘাত করা যায় একজনকে, ধারে ধারে রাগ পড়তে শুরু করেছে সনির। থামল সে বিশাল বৃকটা দ্রুত ওঠানামা করছে তার। নিজের জায়গা থেকে নড়ছে না এখনও। বলল, কুত্তার বাচ্চা, সাহস থাকে তো ফের আমার বোনের গায়ে হাত তুলিস। খুন করব তোকে।
হাঁফ ছেড়ে বাচল সবাই। সনির শাসানি শুনে বুঝে নিল, কার্লোকে মেরে ফেলার ইচ্ছা অন্তত এই মুহূর্তে নেই ওর। তার মানে, নতুন জীবন ফিরে পেল কার্লো। সন্দেহ নেই, এটা তার একটা পরম সৌভাগ্য। তবে সনির কণ্ঠস্বরে হতাশার সুরটা কারও কান এড়াল না। এ-থেকে এটাও বুঝে নিল সবাই, কার্লোকে খুন করার ইচ্ছাই রয়েছে সনির, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটাকে কাজে পরিণত করা যাচ্ছে না।
থর থর করে কাঁপছে কার্লোর শরীরটা। মুখ তুলে সনির দিকে একবার তাকাল না পর্যন্ত। এখনও সে দুহাতে রেলিং জড়িয়ে ধরে মাথাটাকে ঘাড়ের মাঝখানে গুঁজে বসে আছে। স্টার্ট নিল গাড়ি দুটো, গর্জন তুলে ঝড়ের বেগে চলে গেল আবার। কিন্তু তবু একটু নড়ছে না কার্লো।
স্নেহময় বাবার মত অদ্ভুত কোমল স্বরে কোচ বলল, যা হবার হয়েছে, কার্লো, ওঠো এবার। চলো, দোকানে যাই। সবাই দেখছে।
এতক্ষণে রেলিং ছেড়ে দিয়ে, সিঁড়ির ধাপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়াবার সাহস পেল কার্লো। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল সে, দেখল, ছেলে আর লোকজনদের ভিড় জমে গেছে রাস্তার উপর, সবাই তার দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরেকজন মানুষকে চরম অপমানিত হতে দেখলে প্রায় সব মানুষকেই এই রকম হতচকিত দেখায়। মাথা ঘুরছে কার্লোর। সেটা বিকট আতঙ্কের জন্যে, মার খেয়ে আহত হয়েছে বলে নয়। ধরে নিয়েছিল সে, সনি তাকে খুন করার জন্যেই এসেছে। প্রাণ রক্ষার একমাত্র খোলা পথটাই বেছে নিয়েছিল তাই। পাল্টা আঘাত করেনি, করলে সনি তাকে জীবিত রেখে ফিরে যেত না। ঘূষিগুলো গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে মেরেছে সনি, কিন্তু তাতে খুব যে একটা জখম হয়েছে কার্লো তা নয়। শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো নাগালের মধ্যে পায়নি সনি। নিরেট পেশীর উপর পড়েছে সবগুলো ঘুষি।
দোকানের পিছন দিকের কামরায় নিয়ে এল তাকে কোচ। ঘাড়, কাধ আর মুখে বরফ দিচ্ছে সে। মুখটা কোথাও কেটেকুটে যায়নি, রক্তের কোন ছাপ নেই সেখানে, শুধু এখানে সেখানে ফুলে ফেঁপে গেছে, কার্লো দাগ পড়ে গেছে। আঙ্কটা কেটে গেছে এতক্ষণে, কাপুনিটাও থেমেছে। কিন্তু যে অপমান সইতে, হয়েছে, তার কথা মনে পড়ে গেলেই গা গুলিয়ে উঠছে তার, গল গল করে বেশ খানিকটা বমিও করল। ওর মাথাটা মুখ ধোবার একটা গামলার উপর রেখে পানির কল ছেড়ে দিল কোচ। আর এক হাতে ধরে আছে ওকে, বমি করাবার সময় মাতালকে যেমন,ঠেক দিয়ে রাখতে হয়। ধরে ধরে দোতলায় নিয়ে এসে একটা কামরায় ওকে শুইয়ে দিল সে। স্যালি র্যাগস কখন এক ফাঁকে গায়েব হয়ে গেছে, জানতেই পারেনি কার্লো।
থার্ড এভিনিউয়ে চলে এসেছে স্যালি ব্যাগস। ফোন করে সমস্ত ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দিচ্ছে সে রকো ল্যাম্পনিকে। এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে সব নল রকো ন্যাম্পনি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে তখুনি সে ফোন করে গোটা ব্যাপারটা জানিয়ে দিল তার ক্যাপোরেজিমি পীট ক্লেমেঞ্জাকে।
কি সর্বনাশ! এই সনি আর তার মেজাজকে নিয়ে আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি! আঁতকে উঠে বলল ক্লেমেঞ্জা। কিন্তু কথাটা বলার সময় ফোনের কানেকশন কেটে দিল সে, একটা শব্দও শুনতে পায়নি রকো ল্যাম্পনি।
দেরি না করে সাথে সাথে লং বীচের বাড়িতে ফোন করল ক্লেমেঞ্জা। টম হেগেনকে ধরল সে। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল হেগেন, তারপর বলল, তাড়াতাড়ি, পীট! এক সেকেণ্ড দেরি না করে লং বীচের রাস্তায় তোমার কজন লোককে পাঠাও। ট্রাফিক জ্যাম কোন অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে সনি যদি আটকা পড়ে যায়! ওর এই রাগ আমার চেনা আছে, মাথায় একবার রক্ত চড়ে গেলে নিজের নিরাপত্তার কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। কিছুই বলা যায় না, আমাদের বিরোধী-পক্ষরা হয়তো জানে শহরে গেছে সনি। যদি জেনে থাকে, এ-সুযোগ তারা হাতছাড়া নাও করতে পারে।
একটু দ্বিধা করে বলল ক্লেমেঞ্জা, আমার লোকেরা রাস্তায় গিয়ে পৌঁছবার আগেই সুনি বাড়ি ফিরে যাবে। টাটাগ্লিয়ারাও তা জানে।
ধৈর্য হারাল না হেগেন, বুঝিয়ে দেবার সুরে বলল, হ্যাঁ, তোমার কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু দুর্ঘটনার কথা তো কিছুই বলা যায় না, ঠিক কিনা? সনি আটকা পড়ে যেতে পারে। যতটা পারো করো, পীট।
বিরক্তির সাথে রকো ল্যাম্পনিকে ফোন করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল ক্লেমেঞ্জা। তখুনি কয়েকজন লোক যোগাড় করে লং বীচের রাস্তার উপর নজর রাখার জন্যে বেরিয়ে পড়ল রকো ল্যাম্পনি।
ক্লেমেঞ্জাও তার প্রিয় ক্যাডিলাক গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর বাড়িতে সশস্ত্র একদল গার্ড আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মধ্যে থেকে তিনজনকে বেছে সাথে নিল সে। আটলান্টিক রিজ পেরিয়ে এল ওরা, নিউ ইয়র্ক শহরের দিকে যাচ্ছে।
.
মিষ্টির দোকানের কাছেপিঠে ঘুর ঘুর করছে যারা তাদের মধ্যে খুদে একজন জুয়াড়ীও রয়েছে, তার কাজ টাকা খেয়ে টাটাগ্লিয়াদেরকে খবর যোগান দেয়া। কার্লো যখন মার খাচ্ছে, তাড়াতাড়ি ফোন করে টাটাগ্লিয়াদের সাথে যোগাযোগ করল সে। কিন্তু টাটাগ্লিয়ারা আনুষঙ্গিক হাজারটা ঝামেলা কাটিয়ে উঠে এখনও তৈরি হয়নি যুদ্ধ করার জন্যে। জুয়াড়ী লোকটাও নাছোড়বান্দা, কর্তা ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে চায় সে, মানে তাদের কানে এই সুবর্ণ সুযোগটার কথা তুলতে চায়। অনেকগুলো মাধ্যম আর নিরাপত্তা পর্যায় টপকে তবে একজন ক্যাপোরেজিমির সাথে যোগাযোগ করা যায়। ক্যাপোরেজিমির কানে কথাটা পৌঁছুল বটে, সে পরিবারের কর্তার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনাও করল, কিন্তু ততক্ষণে নিজেদের উঠানের নিরাপদ আশ্রয়ে, বাড়িতে পৌঁছে গেছে সনি কর্লিয়নি।
এবার তাকে বাবার প্রচণ্ড রাগের মুখোমুখি হতে হবে।