সন্ধ্যা উত্তীর্ণ গিয়াছে। আকাশে মেঘ, তন্নিম্নে অন্ধকার, মেঘও অন্ধকার যন একসঙ্গে মিশিয়াছে। মেঘে সনাথনক্ষত্রমালা ঢাকা পড়িয়াছে। এবং অন্ধকারে গগনতলস্পর্শী বড় বড় গাছগুলা প্রকাণ্ড দৈত্যের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।
এমন সময়ে শ্রীশচন্দ্র দীন মুসলমান বালকের বেশে বাটী হইতে বাহির হইল। একেবারে সরাসরি মজিদের বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। গোপনে খবর লইল, মজিদ খাঁ বাড়ীতে নাই-সান্ধ্য-ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। শ্রীশচন্দ্র মনে মনে বুঝিল, খাঁ সাহেব তাহা হইলে এখনই ফিরিবেন। দ্বার সম্মুখস্থ সোপানের উপরে তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়িল।
অনতিবিলম্বে মুষলধারে ভয়ানক বৃষ্টি আরম্ভ হইল। মেঘের গর্জ্জনে দিগবলয় পর্য্যন্ত কম্পিত হইতে লাগিল। এবং ঘন ঘন ক্ষণপ্রভার তীব্র দীপ্তিতে বিরাট বিশ্ব আলোকিত হইতে লাগিল। ইহাতে শ্রীশচন্দ্র সুবিধা বোধ করিল; সেইখানে শুইয়া পড়িয়া বৃষ্টিজলে ভিজিতে লাগিল এবং কাঁপিতে লাগিল।
পথে লোকের গতিবিধি নাই বলিলেই হয়; কদাচিৎ কোন পথিক ছাতা মাথায় দিয়া দ্রুতবেগে বাটী ফিরিতেছে; কদাচিৎ কোন ইতর শ্রমজীবী কর্ম্মস্থান হইতে বাটী ফিরিতেছে-ভিজিতে ভিজিতে, গায়িতে গায়িতে চলিয়াছে। শ্রীশচন্দ্রকে লক্ষ্য করিবার কাহারও অবসর নাই। পথে প্রায় এক হাঁটু জল জমিয়া গিয়াছে। কিয়ৎপরে শ্রীশচন্দ্র একটা শব্দ শুনিতে পাইল; বোধ হইল কে একটা লোক ছপ্ ছপ্ শব্দে জল ভাঙিয়া তাহারই দিকে আসিতেছে। যে হউক না কেন, মজিদ খাঁ আসিতেছেন, মনে করিয়া শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে লাগিল-কাঁপিতে লাগিল। পদশব্দে বুঝিতে পারিল, লোকটা তাহারই দিকে আসিতেছে। শ্রীশচন্দ্র একবার বক্রদৃষ্টিপাতে বিদ্যুতের আলোকে দেখিয়া লইল, তাহার অনুমান মিথ্যা নহে-মজিদ খাঁ বটে।
মজিদ অন্ধকারে আর একটু হইলেই শ্রীশচন্দ্রের ঘাড়ের উপরে পা তুলিয়া দিতেন। গেঙানি শব্দ শুনিয়া তিনি চমকিত চিত্তে একপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন। মজিদ খাঁ হউন আর যিনিই হউন, কাহারও পা তাহার ঘাড়ের উপরে পড়িয়া বেদনা প্রদান করে, এইরূপ ইচ্ছা শ্রীশচন্দ্রের আদৌ ছিল না, সুতরাং মজিদ নিকটস্থ হইলে, সে একটু জোরে জোরে গেঙাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। মজিদ সবিস্ময়ে বলিলেন, “কেরে তুই, এখানে?”
শ্রীশচন্দ্র পড়িয়া পড়িয়া গেঙাইতে লাগিল-উত্তর করিল না; বরং এবার একটু মাত্রা চড়াইয়া দিল।
মজিদ বলিলেন, “কে তুই? এমন করছিস্ কেন, কি হয়েছে?”
শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে গেঙাইতে কহিল, “আ-মি-এ-সমা-ইল, আজ-দু-দিন-খাও-য়া-হয়-নি।” পেটে হাত বুলাইতে এবং গেঙাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া মজিদের হৃদয় দয়া নামক কোন অদৃশ্য স্নৈহিক পদার্থ আর্দ্রীভূত হইল। তিনি অবনত হইয়া ছদ্মবেশী শ্রীশের গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া কহিলেন, “অসুখ করেছে না কি, কি অসুখ করছে?”
শ্রীশচন্দ্র নিজের ক্ষুদ্র উদরে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে বলিল, “যত অসুখ-এই পেটের-ভ-ত-রে। আজ-দু-দিন-খেতে-পাই-নি। পেট-জ্ব’-লে-গে-ল।”
মজিদের মন করুণাপূর্ণ। তিনি সেই অজাতশ্মত্রু বালকের ধূর্ত্ততা বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার বোধ হইল, সত্যসত্যই বালকের অত্যন্ত কষ্টভোগ হইতেছে। তিনি শ্রীশচন্দ্রকে নিজের গৃহমধ্যে লইতে ব্যস্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি উঠিতে পারিবে? এখানে পড়িয়া থাকিলে মারা পড়িবে। আমি তোমাকে খাইতে দিব। ওঠ দেখি।” বলিয়া তিনি শ্রীশের হাত ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন।
বুদ্ধিমান শ্রীশ নানারূপে নিজের যন্ত্রণা ও দৌর্ব্বল্য প্রকাশ করিয়া-টলিয়া-হেলিয়া-বসিয়া-অনেক রকম ভঙ্গি করিয়া টলিতে টলিতে উঠিল। মজিদ অনেক কষ্টে তাহাকে সোপান অতিক্রম করিয়া দ্বিতলে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। শ্রীশচন্দ্র অবসন্নভাবে সেই গৃহতলে পুনরায় শুইয়া পড়িল-পড়িয়া ভয়ানক কাঁপিতে আরম্ভ করিয়া দিল। এবং বাইন্ মৎস্যের মত ঘন ঘন পাক্ খাইতে লাগিল। কেবল গেঙানিটা একটু কম পড়িল।
মজিদ দীপ জ্বালিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, আমি এখনই গরম দুধ লইয়া আসিতেছি।” বলিয়া ব্যস্তভাবে নীচে নামিয়া গেলেন।
মজিদ চলিয়া যাইবামাত্র শ্রীশ একবার ঘরের চারিদিক্টা দেখিয়া লইল। দেখিল, কেহ কোথায় নাই, ঘর আলোকিত-একেবারে লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল।
গৃহ-প্রাচীরের পার্শ্বে একটা আল্মারী ছিল, শ্রীশ তাহা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল। দীপবর্ত্তিকা হস্তে তাড়াতাড়ি চারিদিক্ বেশ করিয়া দেখিয়া লইল। তন্মধ্যে ছুরি পাওয়া গেল না।
গবাক্ষের নিকটে একখানি টেবিল ছিল। শ্রীশ ছুটিয়া সেই টেবিলের নিকটে গেল; এবং টেবিলের উভয় পার্শ্বস্থ ড্রয়ার দুইটিই একেবারে দুই হাতে টানিয়া খুলিয়া ফেলিল; তাহার ভিতরে যে সব কাগজ-পত্র ছিল, তাহা উল্টাইয়া দেখিল-ছুরি নাই।
একপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র বিছানা ছিল। শ্রীশ সেই বিছানার গদি, বালিশ, লেপ সমুদয় তুলিয়া তুলিয়া দেখিল, সেখানেও ছুরি পাওয়া গেল না। এত পরিশ্রম সার্থক হইল না-শ্রীশ বড় হতাশ হইয়া পড়িল; কিন্তু হতাশ হইয়া বসিয়া থাকিবার এ সময় নহে-আর এক মুহূর্ত্ত ভাবিবার সময় নাই-এখনই মজিদ আসিয়া পড়িবেন। তিনি আসিয়া পড়িলে আর কিছুই হইবে না-সকল শ্রম পণ্ড হইবে। এত জলে ভেজা-এত গেঙানি-এত কাঁপুনি সকলই বৃথা হইবে। এমন কি প্রতিপালক দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে মুখ দেখানই ভার হইবে। শ্রীশচন্দ্র ব্যাকুলভাবে গৃহের চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিতে লাগিল। টেবিলের উপরে একটা কাঠের বাক্স ছিল। সেই বাক্সের উপরে শ্রীশের দৃষ্টি পড়িল। শ্রীশ বাক্স খুলিতে গেল, খুলিতে পারিল না-তাহা চাবিবন্ধ। বাক্সটা কৌশলে খুলিবার সময় ইহা নহে-ভাঙিতে গেলেও বিলম্ব হইবে-ততক্ষণে মজিদ আসিয়া পড়িবেন। শ্রীশ মনে ভাবিল, যখন ছুরি ঘরের আর কোথাও পাওয়া গেল না; তখন নিশ্চয়ই তাহা এই বাক্সের ভিতরে আছে; কিন্তু বাক্সটি চাবিবন্ধ, শ্রীশের বড় আশায় ছাই পড়িল! শ্রীশ একবার মনে করিল, বাক্সটি তুলিয়া লইয়া জানালা দিয়া পার্শ্বের গলিপথে ফেলিয়া দেবে-তাহার পর সময় মত খুলিয়া দেখিতে পারিবে। যেমন সঙ্কল্প-তেমনই কাজ-শ্রীশ দুই হাতে বাক্সটি লইয়া একটা উন্মুক্ত গবাক্ষের দিকে অগ্রসর হইল। এমন সময়ে গবাক্ষ পার্শ্ববর্ত্তী একখানি ছবির দিকে সহসা তাহার নজর পড়িল। শ্রীশ দেখিল, সেই ছবির পার্শ্বে ছুরির অগ্রভাগের মত কি একটা দেখা যাইতেছে; বাক্স রাখিয়া শ্রীশ তখনই সেটা আগে টানিয়া বাহির করিল-একখানা ছুরিই বটে-ঠিক সেই রকমের ছুরি-ঠিক এই রকমের একখানা ছুরি সে পূর্ব্বে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দেখিয়া আসিয়াছে; কিন্তু ইহার বাঁট নাই-তা’ না থাক্। শ্রীশ তাড়াতাড়ি সেই বাক্সটি যথাস্থানে রাখিয়া দিল। দীপবর্ত্তিকা লইয়া পুনরায় সেই ছবির পশ্চাদ্ভাগ অনুসন্ধান করিয়া দেখিল, সত্যসত্যই সেখানে ছুরির ভাঙা বাঁটখানা পড়িয়া রহিয়াছে। শ্রীশ তখনই ছুরিখানি ঠিক করিয়া সেই বাঁটের মধ্যে বসাইয়া দিল; তখন তাহার আর কোন সন্দেহ রহিল না, এই ছুরিই বটে।কার্যে্যাদ্ধার হইয়াছে, শ্রীশের মনে আর আনন্দ ধরে না-এমন কি আনন্দে সে লাফাইবে-কি নাচিবে-কিছুই ঠিক করিতে পারিল না; কিন্তু লাফাইবার অথবা নাচিবার সে সময় নহে- সে জ্ঞান শ্রীমান্ শ্রীশচন্দ্রের খুব ছিল। ছুরিখানা বিষাক্ত; পাছে, অসাবধানে কোথায় কাটিয়া-কুটিয়া যায়, এই ভয়ে সেই শ্রীশ একখানি ইংরাজী খবরের কাগজ ছিড়িয়া আট-দশ ভাঁজে সেই ছুরিখানা মুড়িয়া তখনই তাহা কটির বসনাভ্যন্তরে অতি সন্তর্পণে লুকাইয়া ফেলিল। শ্রীশ এত সত্বর-এত দ্রুতহস্তে এই সকল কাজ শেষ করিয়া ফেলিল যে, দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হয়।
এমন সময়ে বাহির সোপানে মজিদ খাঁর দ্রুত পদশব্দ শ্রুত হইল। ইতিপূর্ব্বে গৃহতলে যেখানে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতেছিল, পুনরায় সে ঠিক সেইস্থানে নিজের ক্ষুদ্র দেহখানা বিস্তার করিয়া দিল; এবং পূর্ব্বভাব অবলম্বন করিয়া হাত-পা ছুঁড়িতে লাগিল-এ পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। শ্রীশ বাহাদুর ছেলে!