প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

৩.০১-০৫ আশ্বিনের মাঝামাঝি

কেয়াপাতার নৌকো – তৃতীয় পর্ব

৩.০১

আশ্বিনের মাঝামাঝি এ বছর পুজো শেষ হয়েছে। তখন থেকেই হিম পড়তে শুরু করেছিল। এই জলের দেশে হিমটা বেশ তাড়াতাড়ি নামে। এখন এই কার্তিকে কুয়াশাও হচ্ছে খুব। বিকেল হতে না হতেই মিহি সরের মতো কুয়াশায় আকাশ ঝাঁপসা হয়ে যায়। সূর্য পশ্চিম দিগন্তের দিকে যত হেলতে থাকে, কুয়াশার স্তরটা ক্রমশ পুরু হতে হতে সমস্ত চরাচর ঢেকে ফেলে।

সন্ধেবেলায় হেমনাথের বাড়ির পুকুরঘাট থেকে নৌকো ছেড়েছিল। সামনের দিকের গলুইতে বৈঠা হাতে বসেছে রাজেক। পেছনের গলুইতে তার চাচাতো ভাই তমিজ। তমিজের হাতেও বৈঠা।

নৌকোর মাঝখানে ছইয়ের ভেতর বিনু আর ঝিনুক। পাটাতনের একধারে রয়েছে শতরঞ্চি-জড়ানো মস্ত বিছানা এবং চামড়ার সুটকেস, যেটার মধ্যে দু’জনের জামাকাপড়, বিনুর বি.এ’র ডিগ্রি, ঝিনুকের ম্যাট্রিকুলেশনের সার্টিফিকেট আর টুকিটাকি নানা দরকারী জিনিস। আছে দক্ষিণা কালীর একটি ছোট ছবি। স্নেহলতা ওটা সঙ্গে দিয়েছেন। তার বিশ্বাস, বিপদে আপদে মা কালী বিনুদের রক্ষা করবেন। সুটকেসের পাশে বেতের বড় ঝুড়ির ভেতর রাস্তায় খাওয়ার জন্য চিড়ে, মুছি গুড়, কদমা, একফানা। পাকা মোহনবাঁশি কলা আর পাতক্ষীর। এত লটবহর সঙ্গে নিতে চায়নি বিনু। প্রথমত, ঝিনুকের ওপর দিয়ে যে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে গেছে তাতে তাকে সামলাবে, না মালপত্রের ওপর নজর রাখবে? তা ছাড়া রাস্তায় কী ঘটবে, না ঘটবে সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে এটা জানা আছে, এখন জলেস্থলে সর্বত্র মারাত্মক বিপদ ওত পেতে রয়েছে। হেমনাথ ভরসা দিয়েছেন, তারপাশার দিকে যেতে যে এলাকাগুলো পড়ে, সে সব জায়গায় বড় রকমের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু যেভাবে চারপাশে উন্মত্ততা ছড়িয়ে পড়েছে তাতে ঘটতে কতক্ষণ? নৌকো যত এগুচ্ছে, একটা তীব্র, চাপা আতঙ্ক সব দিক থেকে বিনুকে ঘিরে ধরছে।

রাজেক এবং তমিজ অত্যন্ত বিশ্বাসী, জান কবুল করে ওরা বিনুদের রক্ষা করতে চেষ্টা করবে। কিন্তু দলবদ্ধ হয়ে ঘাতকেরা হানা দিলে রাজেকদের পক্ষে কতটা বাধা দেওয়াই বা সম্ভব? বিনুদের বাঁচাতে গিয়ে ওদের প্রাণটাই হয়তো চলে যাবে।

প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বিনু অন্তহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি নির্বিঘ্নে তারপাশায় পৌঁছনোও যায়, সেখানে গিয়ে কী দেখা যাবে? বিনু শুনেছে, তারপাশা ভাগ্যকুল মুন্সিগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ কি রাজাবাড়ির স্টিমারঘাটে দিনের পর দিন হাজার হাজার মানুষ প্রচণ্ড আশঙ্কা নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।

সারাদিনে একটাই মাত্র স্টিমার। কোনও কোনও দিন দুটোও দেয়। এদিকে ভয়ার্ত মানুষের সীমাসংখ্যা নেই। নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে স্টিমার নানা ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে গোয়ালন্দে যায়। সেখানে থেকে ট্রেন ধরে বর্ডার পার হয়ে কলকাতা।

ছইয়ের পেছন দিকটা কাঁচা বাঁশের ঝাঁপ ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে তমিজরা। সামনের দিকের দু’ পাল্লার আঁপের একটা পুরোপুরি আটকানো। অন্যটা একটুখানি ভোলা। তার ফাঁক দিয়ে যতদূর চোখ যায়, নদী এবং আকাশ নিবিড় কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঠাণ্ডা, জলো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চরাচরের ওপর দিয়ে।

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পর এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। কুয়াশা এবং হিমের সঙ্গে মিশে আছে অন্ধকার।

হেমন্তের শুরুতে নদী এখন অনেক শান্ত। বর্ষার সেই উথলপাথল খ্যাপামি আর নেই। স্রোত আছে ঠিকই, ঢেউও রয়েছে, কিন্তু দু মাস আগে এই নদীই যে ফুলে ফেঁপে সর্বনাশা পাহাড়প্রমাণ চেহারা নিয়ে প্রবল আক্রোশে ছুটে যেত, তা যেন ভাবা যায় না। তখন তার শুধু খাই খাই, সামনের সমস্ত কিছু গ্রাস করার জন্য আকাশপাতাল হাঁ মেলে থাকত। দু’পাড় ভেঙে, পরম মমতায় গড়ে তোলা মানুষের বসতি, তাদের জমিজমা তছনছ করে গাঁয়ের পর গাঁ গ্রাস করার পর তবে তার শান্তি।

কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি ক্ষীণ চাঁদ হয়তো আছে, হয়তো রয়েছে অগুনতি নক্ষত্রও, কিন্তু কুয়াশার পর্দার আড়ালে সে সব ঢাকা পড়ে গেছে। দূরে দূরে রহস্যময় সংকেতের মতো কিছু আলোর ছোটাছুটি চোখে পড়ে। ওগুলো জেলে নৌকোর আলো। সারা বছরই, কী শীত কী গ্রীষ্ম, রাতভর জেলে ডিঙিগুলো নদীর বুকে ঘুরে বেড়ায়। জলের অতল স্তর থেকে মাছ তুলে আনতে না পারলে দু’বেলা পেটের ভাত জুটবে কোত্থেকে? গত দু’বছর ধরে মাঝে মাঝেই দাঙ্গা বাধছে, দেশভাগ হয়ে গেছে, চোদ্দ পুরুষের ঘর-ভদ্রাসন ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। কিন্তু যা-ই ঘটুক, গরিবের চেয়েও গরিব মাছ-ধরাদের ডিঙি আর জাল নিয়ে সন্ধের পর নদীতে না বেরিয়ে উপায় নেই। মাছই তাদের সব, মাছের সঙ্গে তাদের বাঁচা-মরা জড়ানো।

নদীর গায়ে ছলাত ছলাত ঢেউয়ের শব্দ হচ্ছে, সেই সঙ্গে তমিজ এবং রাজেকের বৈঠা দিয়ে জল কাটার আওয়াজ। হেমন্তের ঝিরঝির হাওয়া নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। ফলে চারদিক একেবারে নিঝুম।

ভেতরে একধারে একটা হেরিকেন ছইয়ের গায়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। পাছে নৌকোর দুলুনিতে সেটা পড়ে যায়, সেই কারণে। হেরিকেনটার আলোর তেজ নেই। বাইরে থেকে যাতে নজরে না পড়ে সেজন্য নিবু নিবু করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চুপিসারে রাজেকরা তাদের তারপাশা স্টিমারঘাটে পৌঁছে দিতে চায়। খোলা নদীর জলধারার তুলনায় স্টিমারঘাট অনেকটা নিরাপদ। সেখানে নাকি পুলিশ পাহারার কিছু ব্যবস্থা আছে।

ছইয়ের তলায় চাদর বিছিয়ে বিছানা পেতে দেওয়া হয়েছে। সেটার ওপর শুয়ে আছে ঝিনুক। মাথায় তেলহীন রুক্ষ চুল, চোখ দুটো বোজা, তার তলায় গাঢ় কালি, হনু চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। সমস্ত মুখে কালচে ছোপ। রোগা হাত দুটোর নীল শিরা বেরিয়ে পড়েছে। কে বলবে, কয়েক মাস আগে এই মেয়েটার সারা শরীরে কী লাবণ্যই না মাখানো ছিল! চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল ঝিনুকের। স্বভাবটা সামান্য চাপা ধরনের হলেও ভেতরে ভেতরে সে ছিল খুবই টগবগে। বাইরে তেমন একটা উচ্ছ্বাস নেই, ওর মায়ের কারণে মাঝে মাঝেই বিষণ্ণ এবং অন্যমনস্ক হয়ে থাকত। সেই কত কাল ধরে মেয়েটাকে দেখে আসছে বিনু। ওর তাকানো, কথা বলার মৃদু ভঙ্গি, পাতলা ফুরফুরে ঠোঁটের ফাঁকে হাসির চিকন রেখা, হাঁটার সময় নিঃশব্দে আলতো করে পা ফেলা–এ সবের মধ্যে তার মনের কোন প্রতিক্রিয়া ফুটে বেরোয়, মুহূর্তে বুঝে নেয় বিনু। বাইরে যেমনই হোক, বিনু এতদিন জেনে এসেছে ঝিনুকের মধ্যে গোপন এক জলপ্রপাত রয়েছে। সেটা বাইরে থেকে অন্য কেউ টের পায় না ঠিকই, কিন্তু বিনু, একমাত্র বিনুই তার খবর রাখে।

সেই ঝিনুককে এখন চেনাই যায় না। ভগ্নস্তূপের মতো সে বিছানায় পড়ে আছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের তালে তালে খুব ধীরে তার বুক ওঠানামা করছে, আর ক্ষীণ গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে তার গলা থেকে। বুকের ওই উত্থানপতন আর গোঙনিটা না থাকলে মনে হত, সে বুঝি বেঁচে নেই।

বিনু ঝিনুকের মুখের ওপর ঝুঁকে খুব আস্তে ডাকল, ঝিনুক–ঝিনুক–

সাড়া নেই।

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ঝিনুক ভীষণ ক্লান্তভাবে চোখের পাতা একটুখানি মেলল। চোখের মণিদুটো ঘোলাটে, লালচে এবং নির্জীব। মনে হয়, কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। দেখলেও বুঝতে পারছে না।

অসীম মমতায় ঝিনুকের রুক্ষ চুলে হাত বুলোত বুলোতে বিনু জিজ্ঞেস করে, খুব কষ্ট হচ্ছে?

আস্তে মাথা নাড়ে ঝিনুক–না।

এই এক অদ্ভুত মেয়ে। যত যন্ত্রণাই হোক, শতকষ্টে বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাক, মুখ ফুটে কখনও তা বলবে না।

সেই দুপুর বেলায় জোর করে মেয়েটাকে দু’চার গ্রাস ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন স্নেহলতা। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ওর পেটে এক ফোঁটা জলও পড়েনি। সেই যে ঢাকা থেকে সব কিছু খুইয়ে ভেঙেচুরে একটা ধ্বংসস্তূপের মতো ঝিনুক ফিরে এসেছিল, তখন থেকে বাঁচার কোনও ইচ্ছাই তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। খিদেতেষ্টার অনুভূতিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কেউ খাইয়ে দিলে একটু খেত। কারোর সঙ্গে কথা বলত না, কোথাও বেরুত না, সারাক্ষণ ঘরের কোণে মুখ বুজে অসাড় মূর্তির মতো পড়ে থাকত। জীবনের সব লক্ষণ তার মধ্যে থেকে যেন মুছে গেছে।

বিনু ফের বলে, খিদে পেয়েছে?

আগের মতোই মাথা নেড়ে ঝিনুক জানায়–না।

বিনু বলে, পেয়েছে। তুমি বুঝতে পারছ না।

ঝিনুক উত্তর দেয় না।

বিনু এবার বলে, সেই কখন দুটি ভাত খেয়েছিলে। তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। একটু কিছু খাও। এতক্ষণ খালি পেটে থাকতে নেই।

ঝিনুকের এক জবাব–না।

বিনু জানে, হাজার বার বললেও ঝিনুক খেতে চাইবে না। স্নেহলতা রাস্তায় খাওয়ার জন্য বেতের বড় ঝুড়ি বোঝাই করে যে খাবার দাবার দিয়েছিলেন তার থেকে খানিকটা চিড়ে, একটু পাতক্ষীর আর একটা কলা বার করে বাঁশের সাজিতে নিয়ে ঝিনুককে বলল, হাঁ কর–

একটু কী ভাবল ঝিনুক। এবার কিন্তু সে আপত্তি করল না। মুখটা সামান্য ফাঁক করল।

বিনু অল্প অল্প করে চিড়ে, কলা, ক্ষীর ঝিনুকের মুখে দিতে দিতে বলতে লাগল, অনেক দূর যেতে হবে। তারপাশা থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা। শরীর এমনিতেই তোমার দুর্বল। পেট ভরে না খেলে উঠে দাঁড়াবে কী করে? এতটা রাস্তার ধকল কিছুতেই সইতে পারবে না।

বিনুর কথা কানে গেল কিনা, কে জানে। সামান্য দু’চার মুঠো চিড়ে টিড়ে খাওয়ার পর ঝিনুক বলল, আমি আর খেতে পারব না।

বিনু বুঝতে পারে, জোরাজুরি করে কাজ হবে না। ভাবল, পরে আবার খাওয়াতে চেষ্টা করবে। বলল, চিড়ে খেয়ে নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে গেছে। জল খেয়ে নাও–

স্নেহলতার সব দিকে নজর। পোড়ামাটির কলসিতে খাওয়ার জলও সঙ্গে দিয়েছিলেন। কাঁচের গেলাসে জল ভরে ঝিনুককে খাইয়ে দিল বিনু।

জল খাওয়ার পর চোখ আবার আপনা থেকে বুজে গেল ঝিনুকের। নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মুখখানা বাইরে রেখে চাদর দিয়ে ঝিনুকের সারা গা ঢেকে দিল বিনু। তারপাশা পৌঁছতে এখনও অনেক দেরি। যতক্ষণ পারে ঘুমিয়ে নিক ঝিনুক।

অনেকটা সময় ঝিনুকের মাথায় হাত বুলোবার পর ফের সামনের খোলা ঝাঁপটার ফাঁক দিয়ে নদীর দিকে তাকায় বিনু। ধু ধু দুর্নিরীক্ষ অন্ধকার এবং কুয়াশায় জেলেডিঙির নিষ্প্রভ আলোগুলো ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছে না। কিন্তু হেমন্তের এই শান্ত নদী, ঝাঁপসা আকাশ, দু’পাড়ের গাঢ় কালির পোঁচের মতো গাছগাছালি, কৃষ্ণপক্ষের আকাশে অদৃশ্য তারাদের মেলা বা ম্রিয়মাণ চাঁদ– এ সব নিয়ে কিছুই ভাবছিল না বিনু। মনে পড়ছে, কয়েকদিন আগে অবনীমোহন সুধা আর সুনীতিকে চিঠি লিখেছিল সে, কিন্তু তার উত্তর আসেনি।

অবনীমোহন যুদ্ধের সময় ঠিকাদারির কাজে আসাম চলে গিয়েছিলেন। মিলিটারি কনট্রাক্ট নিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মজুর যোগাড় করে তিনি তখন মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীর যাতায়াতের জন্য সড়ক আর থাকার জন্য ব্যারাক তৈরি করতেন। যুদ্ধ থেমে যাবার পর সে সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছে তখন মাঝে মাঝে জরুরি কাজের ফাঁকে রাজদিয়ায় আসতেন অবনীমোহন। কয়েকদিন কাটিয়ে ফের আসাম। এরই মধ্যে সুধা সুনীতির বিয়ে হয়েছে, সুরমা মারা গেছেন।

যুদ্ধ থামলে অবনীমোহন রাজদিয়া হয়ে কলকাতায় চলে গেছেন। ইচ্ছা ছিল, বিনুকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন কিন্তু পড়াশোনার জন্য বিনুর যাওয়া হয়নি। তা ছাড়া, না যাওয়ার বড় একটা কারণ ঝিনুক। এই মেয়েটার প্রতি বড় মায়ায় তার জীবন তিল তিল করে কখন কিভাবে যে ওর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, নিজেই তা জানে না। সে রাজদিয়াতেই হেমনাথ এবং স্নেহলতার কাছে থেকে গিয়েছিল। ভবিষ্যতের কথা যে স্পষ্ট করে ভাবেনি তা নয়। বিনু জানত, ঝিনুক একদিন তার সারা জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে উঠবে। ঝিনুকের বাবা, হেমনাথ আর স্নেহলতা সেই স্বপ্নই দেখতেন। অবনীমোহন বা সুধা সুনীতির দিক থেকেও কোনও রকম আপত্তি হত না। বরং সবাই খুশিই হত। মুখ ফুটে কেউ কিছু বলেনি কিন্তু তাদের বিয়েটা অনিবার্য জাগতিক কোনও নিয়মের মতোই যেন স্থির হয়ে ছিল। যদিও ঝিনুকরা ব্রাহ্মণ, বিনুরা কায়স্থ, হেমনাথ এসব সামাজিক বাধা মানতেন না। হেমনাথের হয়তো ইচ্ছা ছিল, বিয়েটা রাজদিয়াতেই রীতিমতো ধুমধাম করে থোক। অনেকদিন তার বাড়িতে বড় রকমের কোনও অনুষ্ঠান হয়নি। যুগলের বিয়ে অবশ্য হয়েছে। তাকে হেমনাথেরা নিজেদের পরিবারের একজন ভাবতেন, তবু তার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক তো নেই, সে নেহাতই ছিল কামলা। অবশ্য সুধা সুনীতির বিয়েও এ বাড়িতেই হয়েছে। কিন্তু তারপরও ক’বছর কেটে গেল। বিনুর বিয়ে হলে অবনীমোহন আসনে, সুধা সুনীতিরা আসত, রাজদিয়াবাসীদের সবাইকে নেমন্তন্ন করা হত। বিয়েটাকে ঘিরে নগণ্য শহরটা জুড়ে বিরাট উৎসব লাগিয়ে দিতেন হেমনাথরা। তবে চিরকাল রাজদিয়ায় পড়ে থাকত না বিনু। ঝিনুককে নিয়ে একদিন না একদিন তাকে কলকাতায় চলে যেতে হত। আজ সেই যাওয়াই হচ্ছে, কিন্তু কোন ঝিনুককে সঙ্গে করে? কুয়াশাচ্ছন্ন আদিগন্ত নদীতে নৌকোর পাটাতনে ভাঙাচোরা নির্জীব মাংসপিণ্ডের মতো যে নারীটি চোখ বুজে পড়ে আছে, যার বুকের ভেতর কোনও রকমে হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করছে ঝিনুকের এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটবে, কোনও দিন কি তা ভাবতে পেরেছিল বিনু? এই ঝিনুককে সুধা সুনীতি বা অবনীমোহনরা কিভাবে গ্রহণ করবেন, জানা নেই।

অবনীমোহন এবং সুধা সুনীতিকে যদিও চিঠি লিখে কলকাতায় যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছে সে, কিন্তু সে সব চিঠি ওরা পেয়েছে কিনা, কে জানে। পাকিস্তান হবার পর দু’দেশের ভেতর ডাক চলাচল ঠিকমতো হচ্ছে না। সব কিছুই এখন অনিয়মিত, বিশৃঙ্খল। সীমান্তের এপার থেকে ওপারে চিঠি টিঠি পৌঁছতে কখনও পনের কুড়ি দিন লেগে যায়, কখনও আবার পৌঁছয়ই না। বিনু ভেবে রেখেছে, কলকাতায় গিয়ে বাবার কাছেই উঠবে। তার প্রথম কাজ হবে ঝিনুককে ডাক্তার দেখিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা। যে সর্বগ্রাসী ভয় এবং আতঙ্কে সে কুঁকড়ে আছে তার মন থেকে তা পুরোপুরি মুছে দেওয়া। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য এটা একান্ত জরুরি।

বিনু জানে না, ঝিনুকের দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটতে কত দিন, কত মাস বা কত বছর লেগে যাবে। সারা জীবনও যদি লাগে, মেয়েটাকে সারিয়ে তুলতেই হবে। ঝিনুকের যে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় ঘটে গেছে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই দুরূহ। বিনু জানে, এর জন্য অসীম ধের্য এবং যত্নের প্রয়োজন। সে জন্য নিজেকে সারাক্ষণ প্রস্তুত রাখতে হবে। কিন্তু সবার আগে যেটা দরকার তা হল কলকাতায় পৌঁছনো।

ঝাঁপসা নদীর দিকে তাকিয়ে এমন এক ভবিষ্যতের কথা বিনু ভাবছিল যা ঘোর অনিশ্চয়তায় ভরা। খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে, হঠাৎ অন্য কোনও নৌকোর জোরে জোরে বৈঠা টানার শব্দে চকিত হয়ে উঠল। হাত পঞ্চাশেক দূর দিয়ে একটা চারমাল্লাই নৌকো জল কেটে কেটে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে। ওই নৌকোটায় তাদের নৌকোর মতোই আলো দেখা যাচ্ছে না। হেরিকেন বা লণ্ঠন টণ্ঠন থাকলে নিশ্চয়ই ছইয়ের তলায় আলোর তেজ কমিয়ে রাখা হয়েছে। নৌকোটার দু’ধারে দু’জন করে যে চারজন মাঝি বৈঠা টানছে তাদের নাকমুখ চোখ আলাদা করে দেখা যায় না। মনে হচ্ছে অস্পষ্ট চারটে ছায়ামূর্তি।

বিন ভেতরে ভেতরে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। রাত্তিরে নদী দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াটা তুলনায় নিরাপদ, কিন্তু এমন খবরও পাওয়া গেছে, মাঝে মাঝে নদীতেও হামলা হয়। ঘাতকবাহিনী চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

রুদ্ধ গলায় বিনু জিজ্ঞেস করে, ওরা কারা হতে পারে?

সামনের দিকের গলুইতে বসেছে রাজেক। সে বলে, ডরের কিছু নাই ছুটোবাবু। যারা খুনখারাপি করে হেরা (তারা) বাত্তি নিবাইয়া চুপচাপ যায় না। মশাল জ্বালাইয়া, নদী তুলফাড় কইরা, চিল্লাইয়া আসমান জমিন ফাড়তে ফাড়তে আমাগো নায়ে ঝাপাইয়া পড়ত। একটু থেমে বলল, আপনেগো লাখান উই নায়ের (নৌকোর) মানুষগুলায় আওয়াজ না কইরা, আন্ধারে দ্যাশ ছাইড়া যাইতে আছে গিয়া। চিন্তা কইরেন না।

বিনু নৌকো দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। রাজেকের কথায় তার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কেটে যায়। সত্যিই তো, জল্লাদেরা এমন চুপিসারে নদী পাড়ি দিয়ে চলে যেত না। তাদের ওপর চড়াও হয়ে দা সড়কি চালিয়ে, নৌকোয় আগুন ধরিয়ে সব ছারখার করে ফেলত।

বিনু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। ওরাও বোধহয় আমাদের মতো তারপাশা স্টিমারঘাটে চলেছে।

রাজেক বলল, হেই মনে লয়।

জোরে শ্বাস টেনে বিনু বলে, কোন গ্রাম ছেড়ে ওরা চলে যাচ্ছে, কে জানে—

হগল গেরামেরই এক হাল ছুটোবাবু। চৈদ্দ পুরুষের ভিটামাটি ছাইড়া হিন্দুরা যাইতেই আছে, যাইতেই আছে।

চারমাল্লাই নৌকোটা ক্রমশ দূরে চলে যেতে লাগল। কুয়াশায় অন্ধকারে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটাকে আর দেখা গেল না।

বিনু একইভাবে ছইয়ের ভোলা পাল্লার ভেতর দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বসে আছে। রাজেকরা বৈঠা বাইছে তো বাইছেই। একটানা, ক্লান্তিহীন। সময় যেন কাটতেই চায় না। সন্ধেবেলায় ঝিনুককে নিয়ে নৌকোয় উঠেছিল সে। মনে হয়, সময় যেন সেখানেই অনড় হয়ে আছে।

সেই যে চারমাল্লাই নৌকোটা দূরে কুয়াশাবিলীন দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, তারপর সেইভাবেই আরো কয়েকটা নৌকো পাশ দিয়ে চলে গেছে।

একসময় হঠাৎ বিনুর খেয়াল হয়, সন্ধে থেকে রাজেক এবং তমিজ একনাগাড়ে বৈঠা টানছে। সেই কখন খেয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই ওদের খিদে পেয়েছে।

বিনু বলল, অনেকক্ষণ নৌকো বাইছ। রাতও হয়েছে। এবার তোমরা খেয়ে নাও।

রাজেক বলল, সন্ধ্যার আগে ঠাউরমা ঠাইসা খাওয়াইয়া দিছে। ত্যামন খিদা পায় নাই। যাউক আর কিছু সোময়, হের (তার) পার খামু-সে যে ঠাউরমার কথা বলল তিনি স্নেহলতা।

খিদে পেলে আমাকে বলো—

নিয্যস (নিশ্চয়ই) কমু।

একটু চুপচাপ।

তারপর বিনু জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন যেখান দিয়ে যাচ্ছি সে জায়গাটার নাম কী?

রাজেক বলল, আন্ধারে আর খুয়ায় (কুয়াশায়) ঠাওর পাই না। নদীর অস্পষ্ট পাড়ের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, মনে লয় (হয়), চরকান্দার কাছাকাছি আইসা পড়ছি।

একটু যেন হতাশই হয় বিনু। বলে, বাড়ি থেকে বেশিদূর তা হলে আসতে পারিনি।

পথ কি ইট্টখানি ছুটোবাবু? হেইর উপুর নদীতে নাও বাইয়া যাওন–

সকালে তারপাশায় পৌঁছতে পারব তো? দেরি হলে গোয়ালন্দের স্টিমার ছেড়ে যাবে। তখন–ঝিনুককে দেখিয়ে বিনু বলতে লাগল, একে নিয়ে ভীষণ মুশকিলে পড়ে যাব। কোথায় থাকব, কী করব–

তাকে থামিয়ে দিয়ে রাজেক ভরসা দেবার সুরে বলে, ভাইবেন না ছুটোবাবু। ভুরের (ভোরের) আলো ফুটনের আগেই তারপাশার ইস্টিমার ধরাইয়া দিমু।

বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মাঝনদী থেকে তুমুল হল্লার শব্দ ভেসে আসে। চমকে সেদিকে তাকাতেই চোখে পড়ে, দু’টো ছইহীন লম্বা ধাঁচের খোলা নৌকোয় প্রচুর আলো জ্বলছে। মনে হয় ওগুলো মশাল। আলো থাকায় বোঝা যাচ্ছে, নৌকো দু’টোয় অনেক লোকজন। তারাই হল্লা করছে। তবে কী বলছে, কোথায় কী উদ্দেশ্যে ওরা চলেছে, এত দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কুয়াশা ঢাকা নদীতে সঞ্চরমান মশালের আলো দেখে এবার আন্দাজ করা যাচ্ছে, নৌকো দু’টো এদিকেই ধেয়ে আসছে।

বিনুদের নৌকোটা নদীর পাড় থেকে একশ’ হাত তফাত দিয়ে যাচ্ছিল। দূরের নৌকো দু’টো যেভাবে আসছে, তাতে ভয়ঙ্কর একটা ইঙ্গিত রয়েছে। বিনুর হৃৎপিন্ডের উত্থানপতন থমকে গেল যেন।

ওদিকে ছইয়ের দু’ধারে রাজেক এবং তমিজের শিরদাঁড়াও টান টান হয়ে গেছে। নৌকো দু’টোয় যে লোকগুলো উন্মাদের মত চিৎকার করছে তাদের মতলব যে ভাল নয়, মারাত্মক কোনও অভিসন্ধি মাথায় নিয়ে তারা এধারে আসছে, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটা ব্যাপার রাজেকরা ভেবে পায় না, তাদের নৌকোয় বাইরের পাটাতনে আলো নেই, নিবন্ত একটা হেরিকেন রয়েছে ছইয়ের ভেতরে। দূর থেকে তা বোঝার উপায় নেই। তবু গাঢ় কুয়াশা এবং অন্ধকার ভেদ করে কিভাবে ওরা তাদের দেখতে পেয়েছে, কে জানে। ইবলিশের চোখ। বিনুর মতো রাজেকদের কাছেও একই সাঙ্ঘাতিক সংকেত পৌঁছে গেছে।

রাজেক চাপা গলায় বলল, ছুটোবাবু, গতিক ভালা বুঝি না।

নদীতেও আজকাল ঘাতকেরা হানা দিচ্ছে, এটা আগেই কানে এসেছিল বিনুর। আশঙ্কা থাকলেও ভেবেছিল, নিরাপদেই তারপাশায় পৌঁছে যেতে পারবে, কিন্তু সেটা বোধহয় আর সম্ভব হল না। হেমন্তের এই ঠান্ডা, খোলা নদীতে নৌকোয় বসে থাকতে থাকতে তার সারা গা ঘামে ভিজে যেতে লাগল। কাঁপা গলায় হতবুদ্ধির মতো বিনু জিজ্ঞেস করে, এখন কী করা যায়?

রাজেক দূরের নৌকা দু’টোর দিকে নজর রাখছিল। বলল, হুমুন্দির পুতেরা ঝামেলা পাকাইব মনে লয় (হয়)। এক কাম করি ছুটোবাবু–

কী?

নাও পারে ভিড়াইয়া হগলে (সবাই) উপুরে উইঠা গাছগাছালির আবডালে লুকাইয়া থাকি। অরা আইসা কী করে দেখি। হেইর পর অবোস্তা বুইঝা ব্যবোস্তা করন যাইব।

যা ভাল বোঝো, কর। বিনু এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত যে ভেবে চিন্তে নিজে থেকে কোনও রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তার মাথার ভেতর সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।

রাজেক চেঁচিয়ে ছইয়ের ওধারের গলুইতে বসা তমিজকে বলল, পারে নাও ভিড়ামু। তরাতরি বৈঠা চালা–

নদীর ওপর দিয়ে নৌকোটাকে প্রায় উড়িয়ে কিনারে এনে কাছি দিয়ে একটা মোটা গাব গাছের গুঁড়িতে বেঁধে ফেলল রাজেক। ওদিকে সেই নৌকা দুটো ঝড়ের গতিতে ধেয়ে আসছে। ত্রস্তভাবে সে বলল, ছুটোবাবু, ঝিনুক বইনেরে লইয়া উপুরে ওঠেন—

ঝিনুক কাত হয়ে শুয়ে ছিল। তার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে প্রায় পাঁজাকোলা করে পাড়ের মাটিতে তুলে আনল বিনু। নির্জীব গলায় ঝিনুক শুধু বলল, আমরা তো স্টিমারঘাটে যাব। এখানে নামলে কেন?

বিনু বলল, পরে শুনো–

ঝিনুক আর কোনও প্রশ্ন করল না।

বিনুরা নেমে যাবার পর রাজেক আর তমিজও পাড়ে উঠল। চারদিক ভাল করে তাকিয়ে খানিক দূরে ঘন বেতঝোপ আর আগাছার জঙ্গল দেখতে পেল রাজেক। বলল, ছুটোবাবু, আপনেগো এইখানে  থাকন ঠিক অইব না। শালার পুতেগো চৌখে পড়লে কী করব ক্যাঠা (কে) জানে। উই ব্যাত ঝোপড়ার পিছে গিয়া বইয়া থাকেন। একেবারে মুখ বুইজা থাকবেন। অরা য্যান ট্যার না পায়।

আর তোমরা?

আমরাও আপনেগো কাছাকাছি থাকুম। খালি নাও দেইখা অরা (রা) হ্যাঙ্গাম (হাঙ্গামা) না কইরা চইলা যাইব। আমরা নায়ে থাকলে নিয্যস জিগাইব নাও কুনখানের, কই থিকা (কোত্থেকে) আসতে আছি, সোয়ারি আছিল কিনা, থাকলে হেরা (তারা) কারা, এই হগল। কী কইতে কী কমু, শ্যাষে আমরা বিপদে পইড়া যামু। চাইর জনের জানই চইলা যাইব।

ঝিনুককে নিয়ে বেতঝোপের পেছন দিকে গেল বিনু। রাজেক আর তমিজও ডান পাশে ঘন আগাছার জঙ্গলের ভেতর ঢুকল।

নদীর কিনার থেকে বেতঝোপ টোপগুলো প্রায় তিনশ’ হাত তফাতে। একে ঝোপ জঙ্গলের আড়াল, তার ওপর কুয়াশা আর অন্ধকারের দুর্ভেদ্য পর্দা চারদিক ঢেকে রেখেছে। বিনুরা যেখানে রয়েছে সেখান থেকে তাদের নৌকোটা দেখতে পাবার কথা নয়। কিন্তু এতক্ষণে তুমুল হইচই করতে করতে সেই মশালওলা নৌকো দুটো ওটার কাছে চলে এসেছে। মশালের আলোয় সব কিছু পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও দেখা যাচ্ছে। মাঝনদী থেকে আসা নৌকো দুটো ছ’মাল্লাই, ছই নেই। দুই নৌকোয় কম করে পনের ষোলটা লোক। তারা সবাই সশস্ত্র, প্রত্যেকের হাতে দা সড়কি বল্লম বা মজবুত বাঁশের লাঠি।

দুর্বোধ্য গলায় উত্তেজিতভাবে কিছু বলতে বলতে মাঝে মাঝে কুয়াশাচ্ছন্ন চরাচর চৌচির করে তারা চিৎকার করে উঠছিল, আল্লা হো আকবর

তিন চারজন তাদের নৌকো থেকে লাফ দিয়ে রাজেকদের নৌকোয় চলে এল। ছইয়ের ভেতর ঢুকে গেল দু’জন। বাকি যারা চেঁচাচ্ছিল তাদের সবার ওপর দিয়ে গলা চড়িয়ে একজন বলল, আমাগো দেইখা এই নাওয়ের হুমুন্দির পুতেরা কিনারে আইসা নাও বানছে (বেঁধেছে)।

যারা ছইয়ের তলায় ঢুকেছিল তারা খানিক পর হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে আরও সোরগোল বাধিয়ে দিল, এই নাওয়ে হিন্দু আছিল। অগো মালপত্তরের ভিতরে কালীর ফুটো (ফোটো) রইছে।

ওদিকে আরেক জন গলা অনেক উঁচুতে তুলে বলে, হালারা কাছাকাছিই আছে। বেশি দূর যাইতে পারে নাই। উপুরে উইঠা বিচরাইয়া (খুঁজে) দেখি–

কথাগুলো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। বেতঝোপের আড়ালে বসে থাকতে থাকতে বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডের উত্থানপতন মুহূর্তে থমকে গেল বিনুর। অথৈ নদীতে ভাসতে ভাসতে কলকাতার দিকে এই বিপজ্জনক যাত্রাপথে যে কালীর ছবিটাকে বড় ভরসা মনে হয়েছিল, সেটাই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে কিনা, কে বলবে।

ওধার থেকে রাজেক চাপা গলায় বলল, অরা (রা) গোন্ধ পাইছে। কী হইব ছুটোবাবু?

কী হবে, বিনুর জানা নেই। তবে রাজেক যে ভয় পেয়েছে, সেটা তার গলার স্বর শুনে আন্দাজ করা যাচ্ছে। উত্তর না দিয়ে উদভ্রান্তের মতো সেই উন্মত্ত, উত্তেজিত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

একটু পর দু’তিনজন একসঙ্গে হেঁকে ওঠে, নাও কার? কার নাও?

রাজেক সতর্ক করে দেয়, হুমৈর (সাড়া) দিয়েন না ছুটোবাবু।তার গলা এবার আরও চাপা শোনায়।

বিনু বলে, জানি।

ওধারে নৌকো থেকে সমানে হুমকি ভেসে আসছে, রাও (শব্দ) না কইরা বাচবি না হুমুন্দিরা। খাড়, দেখি কুন গাদে (কোন গর্তে) সাইন্ধা (চুকে) আছস–

তারপরেই দেখা গেল, মশাল আর দাবল্লম নিয়ে চার পাঁচ জন পাড়ের মাটিতে লাফিয়ে পড়ল। বাকি সবাই নৌকোর পাটাতনে দাঁড়িয়ে সমানে হল্লা করে চলেছে।

এদিকে যারা পাড়ে নেমেছিল, তারা গাছগাছালির ভেতর মশালের আলো ফেলে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে।

নিবিড় বেতঝোপের পেছনে বিনুকে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে ভয়ার্ত, বিহ্বল চোখে হিংস্র লোকগুলোকে দেখছিল ঝিনুক। কিছুকাল আগে ঢাকার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলি মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। এমনই একটা হিংস্র বাহিনী সড়কি ল্যাজা নিয়ে শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল। ঘরের এক কোণে আলমারির। আড়ালে নিজের শরীরটাকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল সে, আর তীব্র আতঙ্কে সমানে কাঁপছিল। কিন্তু এত করেও রেহাই পাওয়া যায়নি। জন্তুরা তাকে টেনে বার করতে করতে আদিম উল্লাসে ফেটে পড়েছিল।

দৃশ্যটা স্মৃতির স্তর ঠেলে চোখের সামনে ভেসে উঠতেই নিজের অজান্তে ঝিনুকের গলা থেকে কাতর, শীর্ণ একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। তার মনে হল, ঢাকার মারাত্মক ঘটনার মতো এখনই কিছু। একটা ঘটে যাবে। সেদিনের মতোই তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত থরথর কাঁপছে। চোখ দুটো ঠেলে। বেরিয়ে আসবে যেন।

লোকগুলো ঝিনুকের গলা শুনতে পেলে তার পরিণতি কী হতে পারে, ভাবতেই আতঙ্কগ্রস্তের মতো তার মুখটা চেপে ধরল বিনু। হেমন্তের হিমঝরা রাত্তিরে তার শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে ঠান্ডা কনকনে বরফের স্রোত বয়ে চলেছে। ঝিনুক তাকে প্রাণপণে জাপটে ধরল। বিনু টের পাচ্ছে, জোরে জোরে বুক তোলপাড় করে শ্বাস ফেলছে ঝিনুক। তার রোগা শরীরটা ভয়ে দুমড়ে, বেঁকে যাচ্ছে।

মুখ চেপে ধরার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ঝিনুকের। হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য মাথা ঝাঁকাতে থাকে সে। বিনু জানে, ঝিনুকের মুখ থেকে হাত সরে গেলেই চিৎকার করে উঠবে, কিন্তু কোনওভাবেই তা হতে দেওয়া যায় না।

একসময় ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে চারদিকে মশালের আলো ফেলতে ফেলতে দূরে চলে গেল লোকগুলো। খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে নদীর দিকে ফিরে যেতে লাগল।

কুত্তার পুতেরা কুনখানে যে পলাইল–

দিনের বেইল (বেলা) হইলে ঠিক বিচরাইয়া বাইর করতাম। শিকার ফসকে যাওয়ায় লোকগুলোকে হতাশ মনে হল। ওরা চলে যাবার পর ঝিনুকের মুখ থেকে হাত সরাল বিনু। এতক্ষণ স্নায়ুমন্ডলী কষে বাঁধা তারের মতো টান করে নিজেও শ্বাসরুদ্ধের মতো বসে ছিল সে। এখন ফুসফুস ভরে অনেকখানি বাতাস টেনে নিল। তাদের রাজদিয়ার আশেপাশে এর মধ্যে খুনখারাপি, রক্তপাত শুরু হয়েছে। ঘটেছে ধর্ষণ, বহু বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনাও। কিন্তু রাজদিয়ায় তেমন কিছু ঘটেনি। তবে প্রবল উত্তেজনা রয়েছে। প্রচন্ড উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটালেও, আজ এই প্রথম বিনু জানলো, মৃত্যুভয় কাকে বলে। বেতবঝাপের আড়াল থেকে প্রায় সামনাসামনি ঘাতকদের দেখে তার সারা গা বেয়ে ঘামের স্রোত তো বয়ে যাচ্ছিলই, হৃৎপিন্ড থেকে শুরু করে হাত-পা, স্নায়ু, চিন্তা করার শক্তি, সমস্ত কিছু আসাড় হয়ে যাচ্ছিল। পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠছিল, কপালের দুপাশের শিরা উপশিরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছিল। আপাতত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। যে আতঙ্ক পাথরের চাঁইয়ের মতো তার ওপর চেপে বসেছিল, সেটা অনেকখানি সরে গেছে। কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করছে বিনু।

ঝিনুক ভীষণ হাঁপাচ্ছিল। আতঙ্ক কেটে যাবার পর সে খুব কাহিল হয়ে পড়েছে। যে হাত দিয়ে বিনুকে জাপটে ধরেছিল, সে দুটো আলগা হয়ে ঝুলছে। চোখ বুজে আসছে। দুই ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। তার গলা চিরে দুর্বল, কাতর কান্না বেরিয়ে আসছিল।

ওধারে বিনুর মতোই কাঠ হয়ে দমবন্ধ করে বসে ছিল রাজেকরা। ধীরে ধীরে লম্বা নিশ্বাস ফেলে রাজেক ডাকল, ছুটোবাবু–

শরীর আর মনের ওপর দিয়ে তীব্র ঝড় বয়ে গিয়েছে বিনুর। নিজেকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছিল। নিজীব গলায় সে সাড়া দিল, বল–

তরাসে বুকের ভিরে উয়াস (শ্বাস) আটকাইয়া গেছিল।

বিনু উত্তর দিল না। তারপাশায় পৌঁছনো পর্যন্ত রাজেক এবং তমিজের বাঁচা বা মরা তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সে জানে, এই বিশ্বাসী, নিরক্ষর মানুষ দুটি প্রাণ গেলেও কোনও অবস্থাতেই তাদের ফেলে পালিয়ে যাবে না। তাদের দায়িত্ববোধই পালাতে দেবে না।

রাজেক বলল, ইবলিশগুলান গ্যাছে গিয়া। আর ডর নাই—

হঠাৎ কী মনে পড়ায় বিনু বলল, কিন্তু–

কী ছুটোবাবু?

ভয় কিছুটা কেটে গেলেও নতুন করে একটা দূর্ভাবনা বিনুকে অস্থির এবং চকিত করে তোলে। এই হানাদারেরা তাদের খুঁজে পায়নি ঠিকই, কিন্তু নদীতে ওরা টহলদারি থামিয়ে দেবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা, শুধু বিনুরাই না, দেশ ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ চলে যাচ্ছে। শিকার এখন খুবই সুলভ। নৌকোয় করেই বিনুদের তারপাশায় যেতে হবে। তখন যে ফের ওদের পাল্লায় পড়বে না, জোর দিয়ে তা বলা যায় না।

রাজেক আর তমিজ আগাছার জঙ্গল থেকে এর ভিতর বিনুদের কাছে চলে এসেছে। বিনুর দুশ্চিন্তার কারণ জানার পর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে রাজেক। ঘোর আশঙ্কা তাদের মধ্যেও চারিয়ে যেতে থাকে। কুয়াশায় অন্ধকারে রাজেকের মুখ ঝাঁপসা দেখাচ্ছে, তবু বোঝা যায়, সে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত।

রাজেক বলে, বিপদের কথা ছুটোবাবু। এই দিকটা আমি ভাইবা দেখি নাই। শালারা গাঙ (নদী) ছাইড়া চইলা যাইব বইলা মনে লয় (হয়) না।

সন্ত্রস্ত বিনু বলে, তা হলে কী করে তারপাশায় পৌঁছব?

রাজেক একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, এট্টা উপায় আছে ছুটোবাবু। গাঙের মইদ্যে (মধ্যে) বেশি দূর নাও লইয়া যামু না। কিনার ঘেইষা ঘেইষা যাইতে থাকুম। তভু যদিন–

যদি কী?

ইবলিশের ছাওগুলান দেইখা ফেলাইলে অখনকার লাখান পারে উইঠা ঝোপড়া কি জঙ্গলে লুকাইয়া থাকুম।

রাজেক যত সহজে সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রেহাই পাবার উপায় জলের মতো বুঝিয়ে দিল, বিনু জানে সমস্যাটা তত সরল নয়। খানিক আগে ঘাতকেরা নদীর দিকে চলে যাবার পর বুকের ভেতরটা অনেকখানি চাপমুক্ত মনে হয়েছিল। এখন সে টের পেল, নতুন করে অন্তহীন দুশ্চিন্তা ফিরে আসছে। উদ্বিগ্ন মুখে বলল, বার বার কি ওদের ফাঁকি দিতে পারব? একবার না একবার ঠিক ধরা পড়ে যাব। তখন?

রাজেক কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখে পড়ল, গাব গাছের গা থেকে বাঁধন খুলে হানাদারেরা তাদের নৌকোটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার গলা চিরে কাতর শব্দ বেরিয়ে এল, হা আল্লা

দৃশ্যটা বিনুর চোখেও পড়েছিল। বিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইল সে। বোঝা যায়, সওয়ারির সন্ধান না পাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওরা নৌকোটা নিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে প্রাথমিক ভীতি কাটিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়েছে রাজেক। নৌকোটা হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনার জন্য চিৎকার করতে করতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো সে নদীর দিকে ছুটতে যাবে, বিনুর আকস্মিক বিহ্বলতা কেটে গেল। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে রাজেককে ধরে ফেলল সে। বলল, ওরা অনেক দূর চলে গেছে। ধরতে পারবে না। তা ছাড়া—

রাজেক জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। উদ্ভ্রান্তের মতো বলল, আমারে আটকাইয়েন না ছুটোবাবু। হানাদারদের উদ্দেশে কুৎসিত গালাগাল দিয়ে বলতে লাগল, ধরতে পারুম। গাঙ হাতইরা (সাঁতরে) ঠিকই শালাগো লাগুর (নাগাল) পামু–

বিনু রাজেককে ছাড়ল না, তার হাত আরও শক্ত করে ধরে থাকল। বলল, সর্বনাশ ডেকে এনো রাজেক। ওরা ষোল সতের জন, সবার হাতে দা লাঠি বর্শা রয়েছে। যদি ওদের কাছে পৌঁছতেও পার, ওরা জেনে যাবে তুমি হিন্দু সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছিলে। তার ফল কী হবে, মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবো।

এদিকটা একেবারেই খেয়াল করে দেখেনি রাজেক। চোখের সামনে তার নৌকোটা নিয়ে যাচ্ছে দেখে মাথার ভেতর আগুন ধরে গিয়েছিল। কিভাবে ওটা ফিরিয়ে আনবে, সেটাই ছিল একমাত্র চিন্তা। বিনুর কথা শোনার পর তার মনে হল, ঠিকই বলেছে ছোটবাবু। সশস্ত্র ওই বাহিনীর হাত থেকে নৌকোটা উদ্ধার করে আনার চেষ্টা নেহাতই গোঁয়ার্তুমি। সে নদীতে ঝাঁপ দিলে তমিজও তার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু দু’জন নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে অতগুলো খুনীর সঙ্গে যুঝে ওঠা অসম্ভব। নিজেদের প্রাণ তো যেতই, হিংস্র শিকারি জন্তুর মতো গন্ধ শুকে খুঁকে ওরা বিনু এবং ঝিনুককেও নিশ্চয়ই খুঁজে বার করত।

রাগে এবং হতাশায় ধীরে ধীরে বসে পড়ে রাজেক। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দু’হাতে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। বলে, চাইর বচ্ছর ধইরা এট্টা দুইটা কইরা ট্যাকা জমাইয়া নাওখান কিনছিলাম। অ্যামন দিনও গ্যাছে, বৌ-পোলাপান লইয়া উপাস দিয়া থাকছি। তভু জমাইনা ট্যাকায় হাত দেই নাই। হেই নাও পুঙ্গির পুতেরা লইয়া গেল! এক্কেরে শ্যাষ হইয়া গ্যালাম ছুটোবাবু। নাও নাই, অহন (এখন) কী খামু, ক্যামনে সোংসার চলব!

নৌকো খোয়া যাওয়ায় উন্মাদ হয়ে গেছে রাজেক। এটাই স্বাভাবিক। সওয়ারি নিয়ে শীতগ্রীষ্ম বার মাস যাদের পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরী পাড়ি দিয়ে পেটের ভাত জোটাতে হয়, নৌকোই তাদের সর্বস্ব। রাজেককে দেখতে দেখতে বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব করতে থাকে বিনু। তীব্র অপরাধবোধে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়। রাজেকের এত বড় সর্বনাশটা যে হয়ে গেল সেজন্য নিজেও কি সে কম দায়ী? তারপাশার স্টিমারঘাটে যাবার জন্য ঝিনুককে নিয়ে রাজেকের নৌকোয় যদি না উঠত, আর লুটেরারা তার নৌকোটা নিয়ে যেত না।

কিভাবে রাজেকের ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব, ভেবে পাচ্ছিল না বিনু। হঠাৎ আলোর চিকন একটা রেখা যেন তার চোখে পড়ে। রাজেক অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল, তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, কেঁদো না, কেঁদো না। আমার কথা শোন। রাজদিয়ায় ফিরে গিয়ে দাদুর সঙ্গে দেখা করে সব বলো। তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।

দাদু অর্থাৎ হেমনাথ। রাজদিয়াবাসীদের তো বটেই, চারপাশের বিশ পঁচিশখানা গ্রামের লোকজনেরও তিনি হেমকত্তা বা হ্যামকত্তা। ওই অঞ্চলের সব চাইতে শ্রদ্ধেয়, সব চাইতে সম্মানিত ব্যক্তি। পাকিস্তান হয়ে গেছে, অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে, তবু এখনও সকলে তাকে যথেষ্ট খাতির করে। মনে কারও যদি বিদ্বেষ কিংবা আক্রোশ থাকেও, সামনাসামনি কেউ এমন কিছু করে না বা বলে না, যাতে তিনি কষ্ট পান অথবা তার মর্যাদার হানি হয়।

বিনুর কথায় হতাশার শেষ প্রান্ত থেকে যেন উঠে আসে রাজেক। চকিতে মুখ থেকে হাত সরায়। আশার সংকেত সেও পেয়ে গেছে। হেমনাথের কাছে কোনও আর্জি নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি পারতপক্ষে কাউকে ফেরান না, এটা সবাই জানে। রাজেক নিশ্চিত, বিহিত একটা হবেই। রাজেকের দুই গাল চোখের জলে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। হাতের পিঠ দিয়ে গাল মুছতে মুছতে সে বলে, হ, রাইজদায় (রাজদিয়ায়) ফিরা আগে হ্যামকত্তার কাছে যামু। পরক্ষণে কিছু খেয়াল হতে সচকিত হয়ে ওঠে, কিন্তুক ছুটোবাবু–

কী?

তারপাশায় আপনেগো পৌঁছাইয়া দিমু ক্যামনে?

বিনু চমকে ওঠে। রাজেকের নৌকো খোয়া গেছে, হেমনাথ নিশ্চয়ই তার ব্যবস্থা করে দেবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে যে সমস্যা বিশাল ভীতিকর আকার নিয়ে সমস্ত আকাশপাতাল জুড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তা হল, নৌকো ছাড়া কিভাবে তারপাশার স্টিমারঘাটে পৌঁছবে? সে একা থাকলেও না হয় ঝুঁকি নিয়ে একটা চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু সঙ্গে রয়েছে ঝিনুক। রুগ্ণ, কৃশ, অস্থিসার। জীবনীশক্তি তার প্রায় ফুরিয়ে গেছে। এক সঙ্গে দশ পা হাঁটলে সে হাঁপিয়ে পড়ে। এই ঝিনুককে নিয়ে তারপাশা পর্যন্ত নিরাপদে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব হবে?

অন্ধকার এবং কুয়াশা ক্রমশ আরও ঘন হচ্ছে। নদীর পাড়ে ওই অঞ্চলটা যে ঠিক কোথায় এবং জায়গাটার কী নাম, কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে এখানে আগুন লাগানো, খুনখারাপি, ধর্ষণের মতো বড় রকমের ঘটনা ঘটে গেছে কিনা, এখানকার মানুষজন কতটা বিদ্বেষ এবং আক্রোশ পুষে রেখেছে, সবই অজানা। একটা দমবন্ধ করা সর্বগ্রাসী আতঙ্ক প্রকাণ্ড হাঁ মেলে বিনুকে যেন গিলে ফেলতে চাইছে। এখন কী করা উচিত, সে ভাবতে পারছে না। তার বোধ বুদ্ধি এবং চিন্তাশক্তি, সমস্ত কিছু লোপ পেয়ে যাচ্ছে। ঝাঁপসা গলায় বিনু শুধু বলতে পারল, এখন কী করা?

রাজেকের মাথাতেও খবু সম্ভব একই চিন্তা ঘুরছিল। সে বলল, ছুটোবাবু, এই আন্ধারে আর খুয়ায় কিছুই করন যাইব না। বিহান (সকাল) হউক, রইদ (রোদ) ফুটুক। হেরপর (তারপর) চাইর দিকের গতিক বুইঝা ব্যবোস্তা করুম।

নিঝুম নদীতীরে, কুয়াশামগ্ন আকাশের নিচে হেমন্তের এই রাতটা বেতঝোপের আড়ালে বসে কাটানো ছাড়া অন্য উপায় নেই। কাল ভোর হলে, আলো ফুটলে, কী ঘটবে তা আর ভাবা যাচ্ছে না। অনিবার্য, অজানা নিয়তির কাছে নিজেকে সঁপে দিল বিনু।

অনেকটা সময় তারপর কেটে গেছে।

চারপাশের ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিরা একটানা ডেকে যাচ্ছে। এই এক পতঙ্গ যাদের ক্লান্তি নেই। মাটির নিচে, নাকি গাছের পাতায় বা ডালে নিজেদের লুকিয়ে রেখে দিবারাত্রি ডেকে যায়। এধারে ওধারে অপার্থিব সবুজ আলো জ্বেলে ঝাকে ঝাকে জোনাকি উড়ছে। কাছে দূরে সর সর করে অদৃশ্য সরীসৃপেরা পেট টেনে টেনে ঘাসের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো সাপ কিংবা গিরগিটি জাতীয় নিশাচর কোনও প্রাণী। কত যে পোকামাকড় আর মশা বিনুদের হেঁকে ধরেছে তার হিসেব নেই। অনেক দূরে একপাল শিয়াল ডেকে উঠল, পরক্ষণে তাদের চিরশত্রু কুকুরেরা রাগে গজরাতে গজরাতে খুব সম্ভব ওদের তাড়া করে কোন দিকে যেন দৌড়ে গেল।

হঠাৎ বিনুর মনে পড়ল, নৌকোটায় তাদের সুটকে বিছানা খাবার দাবার এবং টুকিটাকি নানা দরকারী জিনিস ছিল। হানাদারেরা নৌকোর সঙ্গে সর্ব নিয়ে গেছে। নিজের অজান্তে তার একটা হাত কোমরের কাছে চলে এল। সেখানে ধুতির নিচে, কাপড়ের সরু থলিতে হাজার খানেক টাকা পুরে ফিতে বেঁধে নিয়ে এসেছিল। টাকাগুলো জায়গামতোই রয়েছে। এখন এই নগদ টাকাটাই যা ভরসা। শেষ পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকে, ওটা কাজে লাগবে।

বিনু ডাকল, রজেক—

রাজেক সাড়া দিল, ক’ন ছুটোবাবু—

তোমাদের কিছুই খাওয়া হল না। কত খাবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। সব গেল–

আপনেরাও তো খান নাই। একটা রাইত আমাগো নসিবে উপাস দেওয়া আছে। কী আর করুম? বিহান হইলে দেখি, যদিন চিড়া মুড়ি জুটাইতে পারি–

বিনু আর কিছু বলল না।

মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেবার পর ঝিনুক অনেকক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস টেনেছিল। তারপর তার গলা থেকে ক্ষীণ, কাতর কান্নার মতো আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল। এখন ঘাসের ওপর পা দুটো অনেকখানি গুটিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছে সে। অসাড় ও নিস্পন্দ। তার কান্না কখন থেমে গেছে, খেয়াল করেনি বিনু। ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এবং বুনো পোকামাকড় তার মুখে, হাতে পায়ে এবং শরীরের খোলা জায়গাগুলোতে অনবরত হুল ফুটিয়ে চলেছে, কিন্তু কিছুই সে টের পাচ্ছে না। গাঢ় কুয়াশায় মনে হয়, একটা অনুভূতিহীন দেহের ঝাঁপসা কাঠামো।

বিনু ধুতির খুঁট জোরে জোরে নেড়ে ঝিনুকের গা থেকে মশা এবং পোকা তাড়াতে তাড়াতে ব্যগ্রভাবে, ডাকতে লাগল, ঝিনুক-ঝিনুক–

সাড়াশব্দ নেই।

বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনুর, দম বন্ধ হয়ে আসে। মশা আর বুনো পোকা তাড়ানো থামিয়ে দ্রুত একটা হাত ঝিনুকের নাকের নিচে নিয়ে এল সে। না, বেঁচে আছে। ত্রি তির করে নিশ্বাস পড়ছে। ফুসফুস থেকে ধীরে ধীরে আবদ্ধ বাতাস বেরিয়ে এল তার। অনেকখানি ঝুঁকে নরম গলায় ফের ডাকল, ঝিনুক–

ঝিনুক উত্তর দেয় না। হানাদারেরা নদীর দিকে চলে যাবার পর কিছুক্ষণ ক্ষীণ শব্দ করে কেঁদেছিল। আতঙ্ক বা মৃত্যুভয় এমনই প্রবল, এতই পরাক্রান্ত যে তার সঙ্গে দুর্বল শরীরে যুঝতে বুঝতে অসীম ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে।

বিনু আর ডাকাডাকি করল না। ঘাসের ওপর থেকে ঝিনুকের মাথাটা সযত্নে কোলে তুলে নিয়ে কাপড়ের খুট নেড়ে মুখচোখ হাত-পা থেকে আবার পোকামাকড় আর মশা তাড়াতে লাগল। বাকি রাতটা না ঘুমিয়ে এভাবেই তাকে কাটিয়ে দিতে হবে।

.

৩.০২

বিনু ভেবেছিল, সারা রাত জেগে থাকবে। কিন্তু কখন সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে, জানে না।

ভোরের দিকে আবছাভাবে তার কানে পাখিদের কিচিরমিচির, ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ আর নদীর একটানা কলকলানি ভেসে আসতে লাগল। আস্তে আস্তে চোখ মেলল বিনু। চারপাশে উঁচু উঁচু সব গাছ, বেতবন, ঝোপঝাড়। গাছপালার ফাঁক দিয়ে খানিক দূরে নদীর জলস্রোত দেখা যাচ্ছে। বিরাট বিরাট গাছগুলোর মাথায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি চঞ্চল ডানা মেলে উড়ছে আর সমানে চেঁচামেচি করে। চলেছে।

কুয়াশার পাতলা একটা স্তর এখনও আকাশের গায়ে জড়িয়ে আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। অনেক দূরে দিগন্তের তলা থেকে সূর্য একটুখানি মাথা তুলেছে। রোদ সেভাবে ওঠেনি। তবে নরম আলো সমস্ত চরাচরের ওপর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা জলে হাওয়া উঠে আসছে নদীর দিক থেকে।

বিনু ভেবে পেল না, নদীর পাড়ে এমন একটা প্রায়-নিঝুম জংলা জায়গায় সে কিভাবে এসে পড়ল। ঘুমের মধ্যে কেউ কি তাকে এখানে ফেলে রেখে গেছে? পরক্ষণে স্মৃতির কোনও অনালোকিত পর্দায় টুকরো টুকরো, খাপছাড়া কিছু দৃশ্য আবছাভাবে ফুটে উঠতে লাগল। মশাল জ্বালিয়ে ঘাতকদের হানা, নৌকোয় সুটকেস, বেতের ডালা ইত্যাদি ফেলে ঝিনুককে কোলে করে রুদ্ধশ্বাসে নদীর পাড়ে উঠে। আসা, ইত্যাদি। ক্রমশ স্পষ্টভাবে সব মনে পড়ে গেল।

ঘুম ভাঙার পর এই প্রথম বিনুর খেয়াল হল, সে প্রায় চিত হয়ে শুয়ে আছে, আর ডান উরুর ওপর ভারী কিছুর চাপ অনুভব করছে। আস্তে আস্তে উঠে বসল বিনু। কাল যেভাবে ঘুমন্ত ঝিনুকের মাথা কোলের ওপর রেখে শুইয়ে দিয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই এখনও সে ঘুমোচ্ছে। পা দুটো বুকের কাছে গুটনো, ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার রোগা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

ঝিনুকের দিকে ভাল করে তাকিয়ে চমকে উঠল বিনু। ওর গালে গলায় কপালে হাতে পায়ে, শরীরের খোলা জায়গাগুলোতে কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। চামড়ায় চাকা চাকা অসংখ্য লাল দাগ। সমস্ত রাত মেয়েটাকে মশা এবং বুনো পোকারা ছিঁড়ে খেয়েছে। রাজদিয়া থেকে আসার সময় স্নেহলতা খোঁপা বেঁধে দিয়েছিলেন। খোঁপা ভেঙে রুক্ষ চুল এখন উড়ছে।

খানিক দূরে রাজেক এবং তমিজকে দেখা গেল অসাড়ে ঘুমোচ্ছ। কাল তাদের ওপর দিয়েও কম ধকল যায় নি। তার ওপর একনাগাড়ে কয়েক ঘন্টা নৌকো বেয়েছে। সারা রাত এক ফোঁটা জলও পেটে পড়ে নি।

এইভাবে বেতবনের আড়ালে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বাঁচার একটা মরিয়া চেষ্টা তো করতেই হবে। কাল মৃত্যুভয়ে সব অনুভূতি ভোতা হয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধ ছিল না। এখন পেটের ভেতর খিদে হাজারটা উঁচ বিঁধিয়ে চলেছে। কাছাকাছি হাটবাজার বা মানুষের বসতি আছে কিনা, কে জানে। থাকলে চিড়ে মুড়ি টুড়ি যোগাড় করা যেতে পারে।

পর মুহূর্তেই নিদারুণ ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে বরফের মতো কনকনে স্রোত বয়ে গেল বিনুর। রাত্তিরে গাঢ় কুয়াশা এবং অন্ধকারের আড়াল ছিল। তারা লুকিয়ে থাকতে পেরেছে। কিন্তু সূর্যোদয় মানেই আতঙ্ক। দিনের আলোয় কারোর না কারোর চোখে পড়ে যাবার একশ’ ভাগ সম্ভাবনা। তার পরিণতি কী হতে পারে, বিনুর পরিষ্কার ধারণা আছে। চারপাশের পরিস্থিতি না জেনে, না বুঝে, কোথাও পা বাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা হবে চূড়ান্ত হঠকারিতা।

কুয়াশা ছিঁড়েখুঁড়ে এতক্ষণে রোদ উঠে গেছে। মাসখানেক আগেও রোদে গলানো গিনির মতো যে উজ্জ্বলতা ছিল, এখন আর তা নেই। কেমন যেন ম্লান, নিষ্প্রভ। হেমন্ত যত শীতের দিকে গড়াবে, সূর্যালোক ততই মলিন হতে থাকবে।

খুব আলগোছে, ঝিনুকের ঘুম যাতে ভেঙে না যায়, ওর মাথাটা নিচে ঘাসের ওপর নামিয়ে দিল বিনু। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল, পারছে না। হাতের ভর দিয়ে শরীর সামান্য তোলার পর কাত হয়ে বসে পড়ল। পায়ে সাড়া নেই। সারা রাত উরুর ওপর ঝিনুকের মাথা থাকায় তার চাপে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বসে বসেই বেশ কয়েক বার দুই পা দ্রুত মুড়ে, ঝাড়া দিয়ে এবং টান টান করে রক্তের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনল। অবশ ভাবটা প্রায় কেটে গেছে। এবার দাঁড়াতে পারল বিনু। এখান থেকেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে এধারে ওধারে তাকাতে লাগল। কাল রাতেও সে চারপাশে কী আছে না-আছে দেখতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘন কুয়াশা এবং অন্ধকার ভেদ করে নজর দশ হাত দূরেও পৌঁছয়নি। ডাইনে বাঁয়ে সামনে, সমস্ত কিছুর ওপর কেউ গাঢ় কালি লেপে রেখেছিল। কাছাকাছি কোথাও গ্রাম আছে কিনা, আজও বোঝা যাচ্ছে না। মানুষজন চোখে পড়ছে না। পাখিদের চেঁচামেচি এবং নদীর অশ্রান্ত জলস্রোতের শব্দ ছাড়া যত দূরে চোখ যায়, শুধুই অপার স্তব্ধতা।

হঠাৎ বিনু দেখতে পায়, পঞ্চাশ ষাট হাত দূরে একটা পায়ে-চলা কাঁচা রাস্তা নদীর দিক থেকে। এসে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে এঁকে বেঁকে, পাক খেয়ে খেয়ে ডান পাশে অদৃশ্য হয়েছে। অর্থাৎ খুব কাছে না হলেও এধারে কোথাও মানুষের বসতি আছে। সেখান থেকে লোকজন ওই পথ দিয়ে নদীর দিকে যাতায়াত করে। রাস্তাটা দেখতে দেখতে আশা এবং তীব্র উৎকণ্ঠার মিশ্র একটা অনুভূতি তার শিরায়ুতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আশা, কেননা এ অঞ্চলে মানুষ থাকলে তাদের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। উৎকণ্ঠার কারণ সেই মানুষগুলোর মতিগতি কেমন, জানা নেই। ওই কথাগুলোই কাল রাত্তিরে খাপছাড়া ভাবে তার মনে হয়েছিল।

রাজেকের গলা কানে এল, ছুটোবাবু–

মুখ ফিরিয়ে বিনু দেখতে পেল, রাজেক এবং তমিজ তার দিকে এগিয়ে আসছে। কখন ওদের ঘুম ভেঙেছে, টের পাওয়া যায় নি। একবার ঝিনুককেও দেখে নিল সে। মেয়েটা সেইভাবেই হাঁটু মুড়ে ঘাসের ওপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

কাছে এসে রাজেক বলল, রাইত পুয়াইছে, রইদ উঠছে। অহন তো কিছু করন লাগে—

বিনু লক্ষ করল, মশা আর পোকার কামড়ে রাজেক এবং তমিজের হাত-পা মুখ ফুলে দাগড়া দাগড়া হয়ে আছে। সে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

কাঁচা রাস্তাটা রাজেকের চোখেও পড়েছিল। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে সে বলে, পথ যহন আছে, মনে লয় খোঁজ করলে কাছেপিঠে গেরামও মিলব।

হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম।

লগে ট্যাকাপ আছে, না বেবাক নায়ে চামের বাক্সে (সুটকেসে) থুইয়া আইছিলেন? তাইলে কিন্তুক বড় বিপদ–

বিনু জানায়, না, টাকা তার সঙ্গেই রয়েছে।

রাজেকের দুশ্চিন্তা কিছুটা কাটে। বলে, যাউক, আল্লার দোয়ায় ট্যাকাটা বাইচা গ্যাছে। অহন আমাগো যা অবোস্তা, পহা ছাড়া একটা কাইকও (এক পাও) ফেলান যাইব না। দুইটা ট্যাকা দ্যান। দেখি খাওনের জিনিস কিছু মিলে কিনা। আর হেই লগে এই জায়গার মাইনষের ভাবগতিক বুইঝা আসি। আপনেরা এইখান থিকা (থেকে) অন্য কুনোখানে লইডেন (নড়বেন) না। তমিজকে বলল, তুই এইহানে থাক। ছুটোবাবুগো পরি (পাহারা) দিবি।

বিনু কোমরের গোপন থলি থেকে দুটো টাকা বার করে রাজেককে দিল। রাজেক দূরের রাস্তাটার দিকে পা বাড়াতে যাবে, মানুষজনের গলা ভেসে এল। চকিতে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, নদীর দিক থেকে নানা বয়সের দশ বারটি লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে কাঁচা পথটা ধরে এগিয়ে আসছে। নদীর কিনার ঘেঁষে একটা বড় ছইওলা নৌকোও দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভব, ওই নৌকোয় গাঙ পাড়ি দিয়ে তারা এসেছে।

রাজেক এস্তভাবে বলে, বইসা পড়েন ছুটোবাবু, তরাতরি (তাড়াতাড়ি) বইসা পড়েন। তার ভয়ের কারণ, বিনু দাঁড়িয়ে থাকলে ওই লোকগুলোর চোখে পড়ে যেতে পারে।

বিনুকে তাড়া দিতে দিতে নিজেও বসে পড়ে রাজেক, তার দেখাদেখি তমিজও।

বিনুর হাত পায়ের জোড় হঠাৎ আলগা হয়ে যায়। হুড়মুড় করে সে ঝিনুকের পাশে ভেঙে পড়ে। লোকগুলো ডাইনে বাঁয়ে, কোনও দিকে না তাকিয়ে রাস্তা ধরে দূরে উঁচু উঁচু গাছের জটলার আড়ালে মিলিয়ে যায়।

রাজেক তীক্ষ্ণ চোখে নজর রেখেছিল। সে বলল, আর ডর নাই ছুটোবাবু। অরা গ্যাছে গিয়া। এইবার– কথাটা শেষ না করে সে থমকে যায়।

বিনুর সাহস কিছুটা ফিরে এসেছিল। সে বলে, এবার কী?

চাপা গলায় রাজেক বলে, উই দ্যাখেন—

নদীর ধার থেকে ওপাশের রাস্তা দিয়ে সবাই চলে যায়নি। আরও একজনকে আসতে দেখা যাচ্ছে।

লোকটা মধ্যবয়সী। খুব একটা লম্বা নয়, মাঝারি মাপের মজবুত চেহারা, মুখময় কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথার মাঝখানে গোল জালিকাটা টুপি, গায়ে চেক চেক দামী লুঙ্গি, আর বোম-ঘরগুলোর পাশে কাজকরা গোলাপি পাঞ্জাবি। পায়ে পাম্প শু। দেখে মনে হয়, পয়সাওলা সচ্ছল পরিবারের কর্তা।

রাজেক আগের মতোই গলার স্বর নিচু করে বলল, উই মিঞাছাব আগে যাউক গিয়া। হেরপর (তারপর) আমি যামু—

লোকটার তাড়াহুড়ো নেই, ধীরেসুস্থে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী ভেবে এধারে তাকাল। বেতঝোপের আড়াল থাকলেও সে আবছাভাবে বিনুদের দেখতে পেয়েছে। লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল, এবং তীক্ষ্ণ সন্দিগ্ধ চোখে লক্ষ করতে লাগল। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এল।

কাল রাতে নিবিড় কুয়াশা আর অন্ধকারে ঘাতক বাহিনীর নজর এড়ানো গিয়েছিল, কিন্তু হেমন্তের এই সকালে চারদিকে যখন রোদের ঢল নেমেছে, বিনুরা ধরা পড়ে গেল। কাল ঠিক এই আশঙ্কাই করেছিল সে।

লোকটা বিনুদের কাছে এসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এদিকে ঝিনুকের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জেগে উঠেই সামনে লোকটাকে দেখে আতঙ্কে বিনুর একটা হাঁটু আঁকড়ে ধরে সে, এবং চোখ বুজে ফেলে।

বিনুর পরনে ধুতি। লোকটা নিশ্চয়ই তার পরিচয় জেনে গেছে। সে টের পেল, ভয়ে পেটের ভেতরটা পাক দিয়ে উঠছে, গলার কাছে খুব শক্ত কী যেন ডেলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মনে হল, হেমন্তের স্নিগ্ধ সকালে নদীর পাড়ে এই অঞ্চলটা হঠাৎ বায়ুশূন্য হয়ে গেছে। শ্বাস টানতে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল তার।

রাজেক লোকটার ডান পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। শঙ্কিত এবং ত্রস্ত। হাত কপালে ঠেকিয়ে করুণা ভিক্ষার সুরে বলতে লাগল, সালাম মিঞাছাব, এনি (ইনি) ছুটোবাবু, রাইজদার হ্যামকত্তার নাতি। বি.এ, এম. এ পাস। দুনিয়ায় হ্যামকত্তার লাখান (মতো) মানুষ হয় না। তেনার কাছে গ্যালে কেওইরে (কাউকে)। বৈমুখ করে না। আমাগো বল-ভরসা হামকত্তা। আর উই যে ঝিনুকদিদি, বড় দুঃখী মাইয়া। তেনার কথা শুনলে পাষাণেরও বুক ফাইটা যাইব। ছুটোবাবু আর ঝিনুকদিদি কইলকাতায় যাইতে আছিল। কিন্তুক কাইল রাইতে–

গুছিয়ে ঠিকমতো বলতে পারছিল না রাজেক। তার কথাগুলো অসংলগ্ন, আগোছাল। তবে এটুকু বোঝা যায়, লোকটার মনে বিনু আর ঝিনুক সম্বন্ধে যাতে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়, প্রাণপণে সেই চেষ্টাই। করে চলেছে সে। তার হয়তো ধারণা, লোকটা ইচ্ছা করলে বিনুদের বাঁচাতেও পারে।

বিনু ভয়বিহ্বল চোখে লোকটাকে দেখছিল। চেহারায় একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। মনে হয়, এই এলাকার মান্যগণ্য কেউ হবে। তাদের রক্ষা করার ক্ষমতা তার আছে কিনা, থাকলেও তেমন সদিচ্ছা বা মহানুভবতা তার কাছে আশা করা যায় কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। কতখানি আক্রোশ সে নিজের মধ্যে ঠেসে রেখেছে, তা-ই বা কে জানে। সাহায্য করতে পারুক আর না-ই পারুক, মারাত্মক ক্ষতি করতেই পারে। চারপাশের গ্রাম ট্রামে বিনুদের খবর জানিয়ে দিলে ঝাঁকে ঝাঁকে হানাদার লাঠি বর্শা নিয়ে ছুটে আসবে।

রাজেক একনাগাড়ে লোকটার ভেতর মহত্ত্ব জাগিয়ে তুলতে চাইছিল, ছুটোবাবু বড় ভালা মানুষ। আমাগো রাইজদার চাইর দিকে রায়ট হইছে, কিন্তুক কুনোদিন তেনি কেওর (কারোর) গায়ে এট্টা টুকাও (টোকা) মারে নাই। হ্যামকত্তারে তো চিনেন, তেনার নাতি তো–

লোকটা এতক্ষণ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। এই প্রথম কথা বলল, হামকত্তা নামে কেওইরে (কারোকে) চিনি না– তার গলার স্বর রীতিমতো গম্ভীর এবং মোটা ধরনের।

রাজেক তাজ্জব হয়ে যায়। রাজদিয়ার হেমকর্তাকে চেনে না বা তার নাম শোনে নি, এই দুনিয়ার এমন কেউ থাকতে পারে, ভাবতেই পারে না সে। বলে, কনি কী মিঞাছাব, হ্যামকত্তা হইল আমাগো–

হাত তুলে রাজেককে থামিয়ে দিয়ে লোকটা বিনুকে জিজ্ঞেস করে, আপনেরা কারা? কী নাম আপনের? নদীর পাড়ে বেতঝাপের আড়ালে দূর থেকে বিনুদের আবছাভাবে দেখে সে কিছুটা ধন্দে পড়ে গিয়েছিল। ওইরকম জায়গায় ক’টি মানুষ, তারা পুরুষ না মেয়েলোক, বুঝতে পারছিল না। কী উদ্দেশ্যেই বা ওরা ওখানে লুকিয়ে আছে, বোধগম্য হয়নি। খানিকটা সংশয় আর খানিকটা কৌতূহল নিয়ে তাই এগিয়ে এসেছিল। বিনুদের সামনাসামনি দেখার পর সে স্তম্ভিত। ভাবতে পারেনি, একটি অচেনা হিন্দু যুবক এবং রুগণ, কৃশ চেহারার একটি তরুণীর সঙ্গে অতি সাধারণ দু’জন আধবয়সী মুসলমানকে দেখতে পাবে।

বিনু উত্তর দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু প্রথমটা গলায় স্বর ফুটল না। তারপর কোনও রকমে নিজের নাম বলল।

লোকটা রাজেককে দেখিয়ে বলে, এই মিঞা তো কইল, আপনে রাইজদার হ্যামকত্তার নাতি। রাইজদায় তাইলে (তা হলে) আপনেগো বাড়ি?

আস্তে মাথা নাড়ে বিনু।

লোকটা এবার জিজ্ঞেস করে, এইখানে আসলেন ক্যামনে?

ভয়ে ভয়ে, মাঝে মাঝে থেমে, কঁপা শুকনো গলায় কাল সন্ধেয় নৌকোয় ওঠার পর যা ঘটেছে, সমস্ত বলে গেল বিনু। রাজেক এবং তমিজের পরিচয়ও দিল।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল লোকটা। তাকে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে, কপালৈ গভীর কটী রেখা ফুটে বেরিয়েছে। একসময় সে বলল, এইখানে নাইমা নেমে) ভালা করেন নাই। পরক্ষণে কী মনে পড়ে যাওয়ায় বলে, তয় (তবে) না নাইমা উপায়ও আছিল না, জান চইলা যাইত।

বিনু কী বলবে, ভেবে পেল না। নিজেকে দিশেহারা, বিপর্যস্ত লাগছিল। তারই ভেতর খুব সামান্য হলেও একটু ভরসা যেন সে পেয়েছে। লোকটাকে উগ্র, হিংস্র মনে হচ্ছে না। বরং ধৈর্য ধরে সে কাল রাতের যাবতীয় ঘটনার বিবরণ শুনেছে। হয়তো মানুষটা ভাল, সহৃদয়, তার মধ্যে মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকলেও থাকতে পারে।

লোকটা ফের বলল, কিন্তুক এইখানে বিশখান গেরাম চৈদ্দ পনর দিন ধইরা জবর গরম হইয়া আছে। খুন হইছে, ঘরে আগুন লাগছে। মেলা (অনেক) মানুষ দ্যাশের ভিটামাটি ছাইড়া কইলকাতা

আসাম, কুন দিকে জানি চইলা গ্যাছে। এই অবোস্তায় (অবস্থায়)–বলতে বলতে চুপ করে গেল।

ইঙ্গিতটা অত্যন্ত পরিষ্কার। এই অঞ্চলের আবহাওয়া ভীষণ উত্তেজক। এমন পরিস্থিতিতে বিনুদের যে কোনও মুহূর্তে প্রচণ্ড বিপদে পড়ার সম্ভাবনা।

লোকটা এধারে ওধারে তাকিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে ফের বলল, কেও (কেউ) আপনেগো দেইখা ফেলাইলে মুশকিল হইয়া যাইব। যত তরাতরি পারেন এইখান থিকা চইলা যান।

লোকটাকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরল বিনু। সে এখন নিশ্চিত, লোকটা তাদের আদৌ অনিষ্ট করতে চায় না। দু’টি নির্দোষ অসহায় যুবক যুবতী যাতে প্রাণে বেঁচে যায়, সে জন্য সঠিক পরামর্শই দিয়েছে। বিনু হাতজোড় করে ব্যাকুলভাবে বলে, যাব কী করে? দয়া করে আপনি তারপাশায় যাবার ব্যবস্থা করে দিন। আমার সঙ্গে কিছু টাকা আছে। নৌকো ভাড়া দিতে পারব।

রাজেক ও তমিজ মিনতির সুরে একটানা বলে যায়, মেহেরবানি কইরা ছুটোবাবু আর ঝিনুকদিদিরে রক্ষা করেন মিঞাছাব। আল্লার দোয়ায় আপনের ভালা হইব।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে লোকটা বিনুকে বলল, আমি যদিন আপনেগো লেইগা কিছু করতে যাই, তাফালে (ঝামেলায়) পইড়া যামু। মানুষ আর অহন মানুষ নাই। হগল সোময় তাগো মাথায় খুন চইড়া থাকে। অগো গুসা (ওদের রাগ) আইসা পড়ব আমার উপুর।

যে অবলম্বনটুকু ধরে বিনু এই দুঃসহ মৃত্যুপুরীর সীমানা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল সেটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। টের পেল, পারাপারহীন হতাশা চারদিক থেকে তাকে জাপটে ধরছে। চোখের সামনে হেমন্তের এই সকাল ক্রমশ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।

লোকটা নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুঝে হঠাৎ দ্বিধান্বিত ভাবটা কাটিয়ে নিল। তারপর মনস্থির করে ফেলল, যা হওনের হইব, আপনেগো লেইগা কিছু এট্টা না করলে মনে লয় গুনা (পাপ) লাগব। আল্লায় আমারে মাপ করব না। এক কাম করেন।

ভেতরে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যেতে যেতে বিনুর মধ্যে আবার ক্ষীণ একটু আশা জেগে ওঠে। কাল রাত থেকে এই একটা ব্যাপার ক্রমান্বয়ে চলছে–কখনও সামান্য আশার সংকেত, পরক্ষণে অপার নৈরাশ্য এবং আতঙ্ক। কলকাতা তো কম দূরের পথ নয়। সেখানে পৌঁছবার আগে, যদি আদৌ পৌঁছতে পারে, এইভাবেই তাদের চলবে। জীবন যে কত দুর্যোগের সমষ্টি, রাজদিয়া থেকে বেরুবার পর এই প্রথম জানতে পারছে বিনু। জোরে শ্বাস টেনে ব্যগ্র স্বরে সে বলে, কী করতে হবে বলুন–

লোকটা বলল, দিনের বেইলে (বেলায়) কিছু করন যাইব না। রাইতে আন্ধার নামলে এট্টা চ্যাষ্টা করুম। তমস্ত (সারা) দিন আপনেগো লুকাইয়া থাকতে হইব। চারদিক খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, না, গাঙের এত কিনারে থাকন ঠিক না। কাছেই নৌকাঘাটা। বেইল চড়লে রাইজের কেরায়া নাও, গয়নার নাও আইসা ওইখানে ভিড় জমাইব। সুমখের (সামনের) পথ দিয়া মাইনষের চলাচল বাইড়া যাইব। কেওইর না কেওইর (কারোর না কাহোর) নজরে পইড়া যাইবেন। আসেন আমার লগে–

লোকটা বিনুদের নিয়ে বাঁ ধারে বেশ খানিকটা দূরে গভীর জঙ্গলের ভেতর চলে গেল। এখানে অনেকখানি এলাকা জুড়ে বনতুলসী আর মুত্রার ঝড় উদ্দাম হয়ে আছে। আর আছে উঁচু উঁচু সব গাছ, সেগুলোর ডালপালা ঘন পাতায় ছাওয়া। ফলে সূর্যালোক ভেতরে ঢুকতে পারে না। জায়গাটা দিনের বেলাতেও ছায়াচ্ছন্ন এবং স্যাঁতসেঁতে।

লোকটা জানাল, মানুষজন পারতপক্ষে এদিকে তেমন একটা আসে না। আপাতত বিনুরা এখানে থাক। তারপর গ্রামের ভাবগতিক বুঝে সে ওদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাবে। দিনের বেলাটা যে করেই হোক নিরাপত্তার কারণে মানুষের নজরের বাইরে ওদের থাকতেই হবে।

রাজেক ভয়ে ভয়ে চারপাশে লক্ষ করছিল। বলল, সাপখোপ নাই তো?

লোকটা বলল, জঙ্গলে সাপ থাকব না, হেইটা কি হয় মিঞা? আছে, মেলাই আছে। হুইশার (হুঁশিয়ার) হইয়া এইখানে থাকতে হইব। তুমি আমার লগে আসো–

রাজেক বিনুদের ফেলে যেতে চাইছিল না। না বললে লোকটা হয়তো চটে যাবে। এখন পর্যন্ত তার কথাবার্তা বা আচরণে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি, বরং তাকে হিতাকাঙ্ক্ষী বলেই মনে হয়েছে। তবু মানুষের মনে কী থাকে, সবসময় কি বাইরে থেকে বোঝা যায়? ঢোক গিলে রাজেক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, কুনখানে যাইতে কন?

লোকটা ধমকে উঠল, গ্যালেই দেখতে পাইবা।

রাজেকের আর কোনও প্রশ্ন করতে সাহসে হয় না। সে তমিজকে বলে, গাছের একখান ডাইল (ডাল) ভাইঙ্গা চাইর দিকে নজর রাখিস। তার মাথায় সাপের চিন্তাটা ঘুরছিল।

মুত্রাবনের পাশে ঘাসের জমি। রোদ না লাগায় এখানকার ঘাস সতেজ নয়, কেমন যেন মরা মরা, হলদেটে। ঝিনুককে হাত ধরে বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসল বিনু। তমিজ ততক্ষণে গাছের মাঝারি একটা ডাল ভেঙে নিয়ে চনমনে চোখে চারপাশে লক্ষ রাখতে শুরু করেছে।

কাল রাতে যেমন শুনেছিল, এই দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিদের একনাগাড়ে গলা সাধা চলছে। মাঝে মাঝে কোথায় যেন ডাহুক চেঁচিয়ে উঠছে, কাঠ ঠোকরারা শক্ত ধারাল ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মেরে মেরে গাছের গুঁড়ি এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে চলেছে। কাছাকাছি এক পাল শিয়াল ডেকে উঠল। মশা এবং পোকা মাকড়েরা চারদিকের ঝোপঝাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসে বিনুদের হেঁকে ধরতে লাগল।

মশা টশা তাড়াতে তাড়াতে এই নিঝুম বনভূমিতে বসে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল বিনুর। মানুষের ভয়ে তারা এখানে লুকিয়ে আছে, কিন্তু এখানেও রয়েছে মৃত্যুভয়। বিষধর সাপেরা আচমকা কোন গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ছোবল হানবে, কে জানে।

রাজেক সেই লোকটির সঙ্গে চলে যাবার পর অনেকটা সময় কেটে গেছে। মাথার ওপর ডালপালার যে ঘন আচ্ছাদন, তার ফাঁক দিয়ে সরু সরু রোদের ফালি এসে পড়েছে নিচে। আন্দাজ করা যায়, বেশ বেলা হয়েছে।

সকালে ঘুম ভাঙার পর মুখ ধোওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। সেই লোকটা নদীর দিক থেকে হঠাৎ কাছে চলে এসেছিল। বিনু টের পাচ্ছে, বাসি মুখ আর নিশ্বাস থেকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছে। গা গুলিয়ে উঠতে লাগল তার।

পাশ থেকে ঝিনুক বলল, মুখ একেবারে পচে গেছে। একটু যদি জল পাওয়া যেত–

বিনু উত্তর দেবার আগেই তমিজ বলে ওঠে, বদনা কি ঘটি উটি থাকলে গাঙ থিকা পানি আইনা দিতাম। কিন্তুক শালার পুতেরা কাইল রাইতে নাও সুদ্ধা (নৌকো সুদ্ধ) বেবাক লইয়া গ্যাছে। দেখি যদিন এই জঙ্গলের ভিতরে খাল উল থাকে। তাইলে আপনেগো দুই জনারে হেইখানে মুখ ধোওনের (ধোওয়ার) লেইগা লইয়া যামু।

অনেক জায়গায় নদী পাড় ভেঙে বিল বা খালের আকারে গ্রাম কি ঝোপজঙ্গল বা ধান খেতের ভেতর দিয়ে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ে। তমিজ এধারে ওধারে বেশ খানিক দূরে গিয়ে তেমন কোনও জলের ধারা খোঁজ করে এল। কিন্তু না, এখানে খাল বিল কিছুই নেই।

এই সময় রাজেক আর সেই লোকটি ফিরে এল। রাজেকের এক হাতে টিনের জলভর্তি বড় বালতি, আরেক হাতে বেতের বড় ডালায় মুড়ি, মুছি গুড়, কদমা এবং এক ছড়া সবরি কলা। আর লোকটার হাতে কাগজে মোড়া মোটা একটা প্যাকেট।

লোকটা বিনুকে বলল, রাজেক মিঞারে খাওয়াইয়া আনছি। আপনেগো লেইগা পানি আর সবিরের (সকালের) খাওনেরটা (খাবার) লইয়া আইছি। মুখ ধুইয়া আগে খাইয়া লন। তমস্ত রাইত তো প্যাটে কিছু পড়ে নাই।

লোকটার সব দিকে নজর। অসীম কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায় বিনুর। বুকের অতল স্তর থেকে দুরন্ত আবেগ উথলে উথলে এসে গলার কাছে জমা হতে থাকে। কিছুক্ষণ আগেও ওই লোকটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ ছিল না বিনু। আকাশের গায়ে পেঁজা পেঁজা কালো মেঘের টুকরোর মতো তার মনে সংশয় ভেসে বেড়াচ্ছিল। এ এমন এক নিদারুণ সময় যে কারোকে বিশ্বাস করা যায় না। ওই লোকটা তত সম্পূর্ণ অচেনা। তাকে অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু তাদের রাজদিয়া এবং তার চারপাশের বহু চেনা মানুষ এই ক’বছরে আগাগোড়া বদলে গেছে। তাদের কারোর ওপরেই ইদানীং আর আস্থা রাখা যাচ্ছিল না। সামনাসামনি তারা অবশ্য খারাপ ব্যবহার করেনি। কিন্তু টের পাওয়া যেত, ভেতরে ভেতরে তীব্র আক্রোশ এবং ঘৃণা পুষে রেখেছে।

সমস্ত আবহাওয়া যখন দূষিত এবং বিষাক্ত, উত্তেজনা আর বিদ্বেষ যখন বায়ুস্তরে ভেসে বেড়াচ্ছে, ওই লোকটাকে আশ্চর্য রকমের ব্যতিক্রম মনে হয়। তার কোনও রকম দুরভিসন্ধি থাকলে সকাল বেলা বিনুদের দেখামাত্র তুমুল হইচই বাধিয়ে লোকজন জড়ো করতে পারত। কিন্তু সে সব কিছুই করেনি সে। বরং ওদের বাঁচাবার জন্য গভীর জঙ্গলে এনে লুকিয়ে রেখেছে। এখন আবার জল আর খাবার নিয়ে এসেছে। পুরনো কথাটা ফের মনে হল বিনুর, পৃথিবীর সবাই খারাপ হয়ে যায়নি, কারোর কারোর ওপর ভরসা রাখা যায়।

মুখ ধোওয়া এবং খাওয়া শেষ হলে লোকটা বলল, তমস্ত দিন এই জঙ্গলে থাকন ঠিক হইব। সাপখোপ আছে, বাঘডাসা আছে, বুনা (বুনো) শুয়োর আর বড় বড় বিছা আছে। কখন কী বিপদ ঘইটা যাইব! আসেন আমার লগে–

কোথায় যেতে হবে, বিনু জানে না। তবে সে নিশ্চিত, ওই লোকটার সঙ্গে গেলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সে কোনও প্রশ্ন করল না।

লোকটা এবার তার হাতে যে কাগজে-মোড়া প্যাকেট ছিল সেটা খুলে একটা লুঙ্গি এবং একটা বোরখা বার করে বিনুকে দিতে দিতে বলল, ধুতি ছাইড়া আপনে লুঙ্গিখান পরেন, আর বিবিসাবরে বুরখা পরতে কন–

বিবিসাব! বিনু চমকে উঠল। লোকটা ঝিনুককে নিশ্চয়ই তার স্ত্রী ভেবে নিয়েছে। অথচ তাদের যে এখনও বিয়ে হয়নি সেটা বলতে গিয়ে থমকে গেল সে। বললে নানারকম জবাবদিহি করতে হবে। ঝিনুক কে, কেন অনাত্মীয় একটি যুবতাঁকে সঙ্গে করে সে কলকাতায় চলেছে, ইত্যাদি। চোখের কোণ। দিয়ে দ্রুত রাজেক আর তমিজের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল বিনু। তারা যেন বিয়ের ব্যাপারে ফস। করে কিছু বলে না বসে। তমিজরা ইঙ্গিতটা বুঝল। ওই লোকটাকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে মাথা নাড়ল।

বিনু একটা মোটা গাছের আড়ালে গিয়ে লুঙ্গি পরে, ধুতিটা ভাজ করে নিয়ে ফিরে এল। তারপর বোরখাটা ঝিনুককে পরিয়ে দিল।

লোকটার হাতে প্যাকেটের কাগজ ছিল। সেটা বিনুকে দিয়ে সে বলল, ধুতিখান এইটা দিয়া জড়াইয়া লন।

বিনু তাই করল। তার হাত থেকে রাজেক ধুতির পোঁটলাটা নিল। খালি জলের বালতি এবং বেতের ডালাটা নিল তমিজ।

লোকটা এবার বলল, ক্যান আপনেগো লুঙ্গি আর বুরখা পরতে কইলাম, বুঝতে পারছেন?

হঠাৎ কারোর চোখে পড়লে তাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে যাবে, তার পরিণতি মারাত্মক। নিরাপত্তার কারণে তাই লুঙ্গি আর বোরখার ব্যবস্থা। লোকটা কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চায় না। বিনু আস্তে মাথা নাড়ল–বুঝতে পেরেছে।

লোকটা বিষণ্ণভাবে, খানিকটা আক্ষেপের সুরে বলল, কী দিনকাল যে পড়ছে।

.

৩.০৩

নদীর কিনার থেকে যে পায়ে-চলা কাঁচা রাস্তাটা পাক খেয়ে খেয়ে অজানা জনপদের দিকে চলে গেছে, লোকটা বিনুদের সঙ্গে করে সেদিকে গেল না। নিঝুম বনভূমির ভেতর দিয়ে দিয়ে ঘুরপথে এগিয়ে চলল।

লোকটা যেন রহস্যময় পথ-প্রদর্শক। কতদূরে সে বিনুদের নিয়ে যাবে, কে জানে।

লোকটার পাশাপশি হাঁটছে বিনু আর ঝিনুক। ঝিনুকের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। পা-মাথা টলছিল। সে যাতে পড়ে না যায়, তাই তার কাঁধে হাতের বেড় দিয়ে ধরে রেখেছে বিনু। তাদের পেছন পেছন চলেছে রাজেক এবং তমিজ।

মাথার ওপর নানা রঙের অজস্র পাখি এখনও উড়ছে। মনে হয়, হলুদ কালো সাদা সবুজ নীল, ইত্যাদি টুকরো টুকরো রঙিন কাগজ কেউ বাতসে ছড়িয়ে দিয়েছে। পাখিদের অবিশ্রান্ত কিচিরমিচির, ডানা ঝাঁপটানি, থেকে থেকেই ডাহুকদের তীক্ষ্ণ চিৎকার, ঝিঁঝির ডাক জঙ্গলের জমাট স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছেল।

চলতে চলতে লোকটা নিজের থেকেই কথা বলছিল। জানা গেল, তার নাম আফজল হোসেন। এই জায়গাটার নাম মামুদপুর। চারপাশে যে গ্রামগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো হল গাবতলি, চরচিকন্দি, সোনাদীঘি, এমনি অনেক। আফজল হোসেন বড় ধানী গৃহস্থ, প্রায় নব্বই কানি দোফসলা জমির মালিক। স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। স্ত্রী, দুই ছেলে, এক ছেলের বৌ এবং তিন মেয়ে নিয়ে তার জমজমাট সংসার। মেয়েদের নামকরা বংশে, শিক্ষিত সৎ পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তিন মেয়ের ঘরে মোট এগারটি নাতি-নাতনী। তাদের কেউ না কেউ সারা বছরই বাপজানের বাড়িতে এসে থাকে। বড় ছেলের বিয়ে হলেও এখনও তার ছেলেপুলে হয়নি। ছোট ছেলে এ বছরই মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ থেকে বি.এ পাস করেছে। আফজলের ইচ্ছা, দু’চার মাসের মধ্যে তার বিয়ে দেয়, কিন্তু ছেলেটা একেবারেই রাজি নয়। ঘাড় টেড়া করে রয়েছে।

নিজের সংসার সম্বন্ধে সাতকাহন ফাদার সময় এটা নয়। তবু যে আফজল এত কথা বলছে তার কারণ আন্দাজ করা যায়। এখানকার আবহাওয়া তো সহজ, স্বাভাবিক নয়। কেমন দমবন্ধ করা। খুব সম্ভব সেজন্য বিনুদের যতখানি পারা যায়, অন্যমনস্ক করে রাখতে চাইছে।

একসময় জঙ্গল পেরিয়ে আফজল বিনুদের যেখানে নিয়ে এল সেটা কোনও গ্রামের একটা অংশ। সেখানে ছাড়া ছাড়া ভাবে অনেক বাড়িঘর চোখে পড়ছে। এক একটা বাড়িতে ছ’সাত হাত উঁচু ভিতের ওপর তিন চার খানা করে ঘর। সেগুলোর কোনওটা পঁচিশের বন্দের, কোনওটা সাতাশের বন্দের। মাথায় ঢেউটিনের চাল, চারপাশে কাঁচা বাঁশের দেওয়াল। বাড়িগুলোর সামনের দিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঢালাও উঠোন। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো পাতা। রয়েছে।

এখন অবশ্য টানের সময়। সব উঠোনই শুকনো, খটখটে। তবু যে সাঁকোগুলো রয়েছে তার কারণ বর্ষায় নদীতীরের এই নাবাল অঞ্চল নিশ্চয়ই ডুবে যায়। জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠোনগুলোতে এক মানুষ জল জমে থাকে। তাই ঘরগুলোর ভিত অত উঁচু, তাই সাঁকোর ব্যবস্থা। আশ্বিনের গোড়ায় জল নেমে যাবার পরও সাঁকোগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেননা, বছরের পর বছর বর্ষা আসে, কে আর ওগুলো খুলে ক’মাস বাদে আবার কষ্ট করে বানায়। পাঁচ সাত বছর পর জলে সাঁকোর খুঁটি হেজে পচে গেলে তখন অবশ্য না বানিয়ে উপায় কী। এই জলের দেশে যেখানে জমি নিচু, সেখানেই প্রতিটি বাড়িতে সাঁকো চোখে পড়বে।

একটানা আফজল হোসেনই কথা বলে যাচ্ছিল, আর নিঃশব্দে শুনছিল বিনু। হঠাৎ তার খেয়াল হল, গ্রামের ভেতর চলে এলেও জায়গাটা অদ্ভুত রকমের স্তব্ধ আর নির্জন। কোথাও মানুষজন চোখে পড়ছে না।

চারদিক ভাল করে লক্ষ করে চমকে উঠল বিনু। কিছু কিছু বাড়ি অক্ষত আছে ঠিকই। কিন্তু বেশির ভাগেরই টিনের চাল আর জানালা কপাট খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোনওটা আধপোড়া, কোনওটা পুড়ে ঝুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে নিঝুম, পরিত্যক্ত, বিধ্বস্ত এক জনপদ। এখানকার বাসিন্দাদের ওপর যে অল্প কিছুদিন আগেই হামলা চালানো হয়েছিল তার ছাপ স্পষ্ট।

আফজল হোসেন বলল, এই জাগাখান (জায়গাটা) আমাগো মামুদপুর গেরামের পুব দিক। এইহানে যুগীরা, নাপিতরা, কুমার বামন আর সদগোপেরা থাকত। দ্যাশভাগের পর কেও কেও ভিটামাটি ছাইড়া চইলা গেছিল। যেই কয় ঘর আছিল, দিন পনর বিশেক আগে হেরাও গ্যাছে গিয়া। একটু থেমে, ভারী গলায় ফের বলল, কত কাল ধইরা, হেই বাপ-দাদা, দাদার বাপ, তাগো বাপের আমল থিকা এক লগে থাকছি। এই মানুষগুলার লগে আর দেখা হইব না।

হিন্দুরা মামুদপুর থেকে সাত পুরুষের ভদ্রাসন ছেড়ে চলে গেছে, সেজন্য আফজল হোসেনের আক্ষেপটা যথেষ্ট আন্তরিক মনে হল বিনুর। যখন পাকিস্তানের বেশির ভাগ লোকই চায়, হিন্দুরা দেশ ছাড়ক, এই লোকটা সেদিক থেকে আশ্চর্য রকমের ব্যতিক্রম। বহু পুরুষ ধরে যারা সুখে দুঃখে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, তাদের এভাবে চলে যাওয়াটা তার কাছে খুবই শোকাবহ ঘটনা।

বিনু উত্তর দিল না। আস্তে মাথা নাড়ল শুধু। নিঝুম জঙ্গলের ভেতর বনতুলসী এবং মুত্রা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকার সময় ভীষণ উৎকণ্ঠা হচ্ছিল তার। এখন মামুদপুর গ্রামের পরিত্যক্ত, জনশূন্য এলাকায় পা দিয়ে আরেক ধরনের উৎকণ্ঠা হচ্ছে। এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু কেউ যে হুট করে এধারে চলে আসবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বুকের ভেতর যে আশঙ্কাটা দ্রুত জমাট বাঁধছে তা মুখ ফুটে বলতে পারল না বিনু।

আফজল হোসেন শেষ পর্যন্ত একটা বাড়িতে ওদের নিয়ে এল। এখানে চৌকো মস্ত উঠোনের চারধারে চারখানা পঁচিশের বন্দের ঘর। চালের ঝকঝকে নতুন টিনগুলো দেখে মনে হয়, খুব বেশিদিন আগে ওগুলো লাগানো হয়নি। অন্য সব বাড়ির মতো এখানেও বর্ষায় এঘর থেকে ওঘরে যাবার জন্য সাঁকো পাতা আছে। উঠোনের এক কোণে বাঁধানো মঞ্চে অনেকগুলো সতেজ তুলসী গাছ। আর। আছে ধান রাখার জন্য মস্ত মস্ত গোলাকার পাঁচটা বেতের ডোল। সেগুলোর গায়ে গাবের আঠা লাগিয়ে রীতিমতো শক্তপোক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ডোলে কম করে পনের ষোল মণ ধান রাখা যায়। ডোলগুলো যেখানে, তার উলটো দিকে বড় একটা বাতাবি লেবুর গাছ প্রচুর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেটার গুঁড়িতে কম করে আট দশটা লাঙল দাঁড় করানো। বাতাবি গাছটা থেকে খানিক দূরে ক’টা মোটা কাঠের খুঁটি পোঁতা। সেগুলোর গায়ে দশ বারটা বৈঠা পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে।

উঠোনটা মোটামুটি পরিষ্কার। ধুলোবালি তেমন জমেনি। হাওয়ায় হাওয়ায় খড়কুটো, বা গাছের শুকনো সরু ডাল বা মরা পাতা উড়ে এসে জমে নেই। বোঝা যায়, খুব অল্প দিন হল, এ বাড়ির বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আরও যা মনে হল, তারা ছিল বেশ সচ্ছল, ধানী গৃহস্থ।

আফজল হোসেন বলল, এই বাড়িখান আছিল ধনঞ্জয় বারইর। পঞ্চাশ কানি সরস জমিন, হালহালুটি, চৈদ্দ পনেরটা গাই আর বলদ, ছয়খান নাও (নৌকো), নগদ পহা। কুনো অভাব আছিল না। কিন্তু কী যে হইয়া গেল!

কোনাকুনি উঠোন পেরিয়ে দক্ষিণদুয়ারী ঘরখানার সামনে চলে এল ওরা। ভিত উঁচু বলে উঠোন থেকে নারকেল গাছের গুঁড়ি কেটে দশ ধাপ সিঁড়ি বসানো রয়েছে।

আফজল হোসেন ফের বলে, ধনা বারই আছিল আমার পোলাপান কালের বন্দু। জিলা বোডের ইস্কুলে কয় বচ্ছর একলগে পড়ছি, এক লগে দুই জনে গাঙ হাতইরা (সাঁতরে) পারাপার করছি, বাইচ খেলছি। রাইতে পলাইয়া গিয়া গাবতলির গঞ্জে যাত্রা শুনছি। একই বচ্ছর দুই জনের বিয়া হইছিল। হে যে কী আনন্দ আর মাতামাতি! পাকিস্থান হওনের পর পরই ধনারা কইলকাতায় চইলা যাইতে চাইছিল। আমি তারে বুঝাইয়া সুঝাইয়া আটকাইছি। কিন্তুক দিন বিশেক আগে এইখানে যা ঘটল, আর ভরসা পাইলাম না। ধনারা হগল (সব) ফেলাইয়া গেল গিয়া। যাওনের সময় বাড়িঘর জমিজেরাত আমারে দেখতে কইয়া গ্যাছে। যদিন সুদিন ফিরে, অরা আবার দ্যাশে আইব। কিন্তুক

নিজের অজান্তেই বিনু জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কী?

সুদিন আর ফিরব কিনা, জানি না।

একটু চুপচাপ।

তারপর আফজল হোসেন ফের বলল, ধনার ছাড়া-বাড়িতেই দিনের বেইলটা আপনেগো থাকতে হইব।

গ্রামের জনহীন এলাকায় কেন তাদের নিয়ে আসা হয়েছে, এবার খানিকটা আঁচ করতে পারল বিনু। জঙ্গলে সাপখোপ, বিছে বা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভেতর বসে থাকার চেয়ে নির্জন বাড়িতে দিনটা কাটানো অনেক নিরাপদ। তা ছাড়া, গ্রামের এই অংশে অন্য এলাকার লোকজন খুব সম্ভব তেমন আসে না। যদি আসত, আফজল হোসেন নিশ্চয়ই তাদের এখানে টেনে আনত না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আফজল কী যেন ভাবে। তারপর কিছুটা কুণ্ঠার সুরে বলে, আপনেগো আমার বাড়ি লইয়া যাইতে পারলে ভালা লাগত। কিন্তুক’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সে।

উৎসুক চোখে আফজলের দিকে তাকাল বিন, তবে কোনও প্রশ্ন করল না।

আগের কথার খেই ধরে আফজল এবার বাকিটা বলল, কিন্তুক আমার পোলা দুইটার মনের গতিক ভালা না। উই যে বাড়িখান দ্যাখেন– আঙুল বাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে একটা পোড়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখাতে লাগল সে, উইটা আছিল গোসাইগো (গোস্বামীদের)। দ্যাশভাগের আগে। কী যে দাপট আছিল তাগো, ভাবতে পারবেন না। হিন্দু হইলেও কামার কুমার যুগী ঋষি (চর্মকার) জাউলাগা মানুষ বইলা মনে করত না। মুসলমানরা তাগো চৌখে পুকা-মাকড়ের থিকাও খারাপ। মুসলমানগো ছাওয়া (ছায়া) গায়ে লাগলে তাগো নিকি দোজখে (নরকে) যাইতে হইত। হেই বার, তহন যুজ্যু চলতে আছে, আমার বড় পোলা কামাল মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে আই.এ পড়ে, গরমের ছুটিতে গেরামে আইসা জুতা পায়ে গোসাইগো বাড়ির হাতায় ঢুকছিল। গোসাইগো কী গুসা (রাগ)! লোক দিয়া ধইরা খুটিতে বাইন্ধা ব্যাতের বাড়ি মারতে মারতে কামালরে বেহুশ কইরা ফেলাইছিল। হেই থিকা কামাল আর আমার দুটো পোলা শোভান হিন্দুগো উপুর রাগ পুইষা রাখছে। আমি বুঝাই, হগল হিন্দু তো গোসাইগো লাখান না। তাগো কী দুষ? পোলারা বোঝে না। তাগো লাখান গেরামের আরও মেলা (অনেক) মানুষ আছে–জবর মাথাগরম। এইর লেইগা আপনেগো বাড়ি লইয়া গ্যালাম না। আসেন–

নারকেল গুঁড়ির পইঠা ভেঙে আগে আগে ওপরে উঠতে লাগল আফজল হোসেন। তাদের পেছনে বিনুরা।

ঘরটা বাইরে থেকে শেকল তুলে বন্ধ করে রাখা ছিল। শেকল খুলে বিনুদের নিয়ে ভেতরে ঢুকল আফজল। ঘরটায় দুটো বড় তক্তপোষ রয়েছে, আছে বেশ কিছু বাক্সপেটরা। দুটো তক্তপোষেই লেপ কথা তোষক বালিশ মশারি ডাঁই হয়ে আছে। বোঝা যায়, বহুদিন ধরে তিল তিল করে সযত্নে গড়ে ভোলা সাজানো সংসার ফেলে ধনঞ্জয় বারুইরা চলে গেছে।

আফজল হোসেন বিনুকে বলল, আপনে বিবিজানরে লইয়া এই ঘরে জিরাইয়া লন (বিশ্রাম করুন)। উঠোনের ওধারের একটা ঘর দেখিয়ে বলল, আপনেগো দুই মাঝি সুমখের (সামনের) উই ঘরে দিনের বেইলটা (বেলাটা) থাকব। সে আগেই ধরে নিয়েছে বিনু এবং ঝিনুক স্বামী-স্ত্রী। তারা যখন বিশ্রাম করবে তখন একই ঘরে অন্য কারোর থাকা ঠিক নয়। তাই রাজেক এবং তমিজের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে দিল।

বিনু আস্তে মাথা নাড়ল।

আফজল এবার বলে, যতখানি সোময় এইখানে থাকবেন, সুমখের দিকের জানলা কপাট খুলবেন না। গেরামের হগলে জানে, ধনা বারই হেগো (তাদের) জমিজেরাত আমার হাতে দিয়া গ্যাছে। কেও এই বাড়িতে আসে না, তভু ধরেন হটাৎ কইরা আইসা পড়ল। সাবধানে থাকন ভাল। রাজেক এবং তমিজকেও একই পরামর্শ দিল সে। কেননা, এই অঞ্চলে কেউ তাদের চেনে না। দৈবাৎ কারোর চোখে পড়ে গেলে হয়তো জেরা করে করে বিনুদের খবর বার করে ফেলবে। ঝুঁকি নেওয়া কোনওভাবেই উচিত নয়।

বিনু এবং রাজেক জানায়, তারা দরজা জানালা খুলবে না।

একটু কী ভেবে আফজল বলল, এট্টা কথা জিগাই, কিছু মনে কইরেন না।

বিনু বলল, না, মনে করব না। কী জানতে চান বলুন—

আপনেরা কি বামন?

এমন একটা অদ্ভুত পরিবেশে, প্রাণ বাঁচানোর জন্য যখন তারা অজানা গ্রামের পরিত্যক্ত ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ঘিরে যখন শুধুই অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্ক, সেই সময় জাতপাতের প্রশ্নটা কেন। উঠল, বিনুর বোধগম্য হয় না। চমকে উঠে সে বলে, না–কায়স্থ। কেন?

প্রশ্ন করার কারণটা এবার বুঝিয়ে দিল আফজল হোসেন। কাল কখন দুটি ভাত খেয়ে তারা নৌকোয় উঠেছিল। আজ কিছুক্ষণ আগে সামান্য মুড়িটুড়ি খেয়েছে। এখন বাকি দিনটা বারুইদের ছাড়া বাড়িতে কাটাতে হবে। পেটে ভাত না পড়লে ভীষণ কাহিল হয়ে পড়বে বিনুরা। আফজল হোসেন জানে, হিন্দুরা, বিশেষ করে বামুনরা তাদের হাতের রান্না খায় না। বামুনদের জাতবিচার আর ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে ভীষণ কড়াকড়ি।

আফজল জিজ্ঞেস করল, আমাগো ভাত কি আপনেরা খাইবেন?

জাতপাত যে মানে না তা জানিয়ে বিনু বলল, আমার বাবার এক মসুলমান বন্ধু আছেন কেতুগঞ্জে। তার বাড়িতে আমরা অনেকবার খেয়েছি।

আপনেরা কুন খাইদ্য খান আর কুনটা খান না, আমি জানি। আপনেগো লেইগা দুফারে ভাত, ডাইল, ভাজাভুজি আর মাছের ঝোল লইয়া আসুম। গোস্ত আনুম না।

গোস্ত বলতে আফজল কী ইঙ্গিত করল, বুঝতে অসুবিধা হয় না বিনুর। সে কিছু বলল না।

আফজল বলল, অহন যাই। বাইরে থিকা কপাটে শিকল তুইলা দিয়া যামু। ঘরে মানুষ আছে, কেও য্যান ট্যার না পায়। রাজেক এবং তমিজকে সঙ্গে করে বেরিয়ে গেল সে।

একটু পর দরজায় শেকল লাগাবার আওয়াজ ভেসে এল।

.

৩.০৪

আফজল হোসেনরা চলে যাবার পর বোরখা খুলে ফেলল ঝিনুক। তাকে ধরে আস্তে আস্তে একটা তক্তপোষে বসিয়ে দিল বিনু।

মানুষ বাস করলে বাড়িঘরে তরতাজা একটা ভাব থাকে। বেশ কিছুদিন বারুইদের এই বাড়িতে লোকজন নেই। তা ছাড়া, দরজা জানালাও বন্ধ রয়েছে। আলোবাতাস না খেললে যেমন হয়, ঘর জুড়ে অন্ধকার, চারপাশ থেকে ভ্যাপসা গন্ধ উঠে আসছে। কেমন যেন গা ছমছম করে।

ঝিনুক নির্জীব গলায় বলল, কিছু দেখতে পাচ্ছি না। একটু থেমে বলল, দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আফজল হোসেনের নিষেধাজ্ঞাটা মাথায় রয়েছে বিনুর। নিরাপত্তার কারণে সামনের দিকের জানালাগুলো খোলা চলবে না। দরজা খোলার প্রশ্নই নেই। বাইরে থেকে সেটা বন্ধ রয়েছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, পেছন দিকের জানালাগুলো সম্বন্ধে আফজল কিছু বলে যায় নি। হয়তো ওগুলো খুললে তেমন ভয়ের কারণ নেই।

একটু ইতস্তত করল বিনু। তারপর পেছনের কাঁচা বাঁশের দেওয়ালের কাছে চলে গেল। খুব সতর্কভাবে একটা জানালার ছিটকিনি খুলে পাল্লা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকাল। বারুইদের বাড়ির চৌহদ্দি ঘিরে পোত্ত বাঁশের খুঁটি পুঁতে পুঁতে বুক-সমান উঁচু বেড়া বসানো। তারের বাঁধন দিয়ে সেটা মজবুত করা হয়েছে। সীমানার পর নলখাগড়া জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে অগুনতি বইন্যা আর হিজল গাছ বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কচুরিপানায় বোঝাই একটা খাল। খালটার ওধার থেকে যতদূর চোখ যায়, ধানের খেত। কার্তিক মাস পড়তেই খেতগুলোতে আমন ধান পাকতে শুরু করেছে। এখনও পুরোটা সোনার রং ধরেনি। ধানের দানাগুলোর কিছুটা সবুজ, কিছুটা সোনালি।

বারুই বাড়ির এই পেছন দিকটা একেবারে নিস্তব্ধ। মানুষজন চোখে পড়ছে না। খুব সম্ভব এধারে। কেউ আসে না। তাই হয়তো আফজল হোসেন এ পাশের জানালা খুলতে বারণ করে যায়নি।

বউন্যা আর হিজল গাছগুলোর মাথায় পাখপাখালি চোখে পড়ছে না। হয়তো দিনের আলো ফোঁটার পর তারা খাদ্যের খোঁজে দূরে কোথাও চলে গেছে। শুধু খালের ধার ঘেঁষে যে দু’চারটি হিজল গাছ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলোর ডালে ক’টা মাছরাঙা জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে। আর দেখা যাচ্ছে, খালে হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে বকেরা ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছে।

অপার নৈঃশব্দের ভেতর নলখাগড়ার জঙ্গল থেকে শুধু ঝিঁঝিদের অশ্রান্ত বিলাপ আর মাঝে মাঝে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। এই জল-বাংলার যেখানেই জংলা জায়গা সেখানেই ডাহুক আর ঝিঁঝি। এই প্রাণী দু’টো কখনও চুপচাপ থাকতে পারে না, সারাক্ষণ জানান দিয়ে যায়, তারা আছে।

কিছুক্ষণ সতর্কভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকার পর জানালার পাল্লা পুরোপুরি খুলে দেয় বিনু। হেমন্তের এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস এবং রোদ ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে।

হঠাৎ আধফোঁটা কাতর শব্দ কানে আসতে চমকে পেছন ফিরে তাকায় বিনু। তক্তপোষের ওপর ঝিনুকের রুগ্ণ শরীরটা ক্রমশ হেলে যাচ্ছে। সে আর সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছে না।

উৎকণ্ঠিত বিনু দৌড়ে এসে ঝিনুককে ধরে ফেলে। জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে ঝিনুক?

ঝিনুক ক্ষীণ গলায় বলে, মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা। আমি আর পারছি না।

ভয়, আতঙ্ক, প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা–ঝিনুকের দুর্বল স্নায়ু এ সবের চাপ আর নিতে পারছে না। তার চোখ বুজে আসছে। বিনু ধীরে ধীরে তাকে শুইয়ে দিতে দিতে বলল, সারা রাত ভাল করে ঘুমোত পার নি। এখন কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। ঘুমোলে শরীরটা ঝরঝরে হয়ে যাবে।

ঝিনুকের ঠোঁটদুটো সামান্য নড়ল। অস্ফুট গলায় সে বলল, তোমার কী মনে হয়?

প্রশ্নটা ঠিকমতো বুঝতে না পেরে বিনু জিজ্ঞেস করে, কোন ব্যাপারে?

ঝিনুক বলে, আমরা কি কোনওদিন বর্ডার পেরিয়ে ওপারে যেতে পারব?

কাল থেকে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে পাকিস্তান সীমান্তের ওপারে সুদূর কলকাতায় পৌঁছনো আদৌ সম্ভব হবে কিনা, সে সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েছে মেয়েটা। বিনুও যে পুরোপুরি নিশ্চিত তা কিন্তু নয়। আফজল হোসেন ভাল মানুষ, তার মহানুভবতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া গেছে। অনেকখানি ঝুঁকি নিয়ে সে তাদের সাহায্য করতেও চেষ্টা করছে। একবার মনে হয়, সে নিরাপদে তাদের তারপাশায় নিয়ে যেতে পারবে। পরক্ষণে সংশয়ে মন ভরে যায় বিনুর। সমস্ত আবহাওয়া যেখানে ঘৃণায় বিদ্বেষে অবিশ্বাসে বিষাক্ত হয়ে আছে, শেষ পর্যন্ত সেখানে আফজল হোসেন কতটা কী করে উঠতে পারবে, কে জানে। ঝিনুককে ভরসা দেবার জন্য জোর দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই কলকাতায় যেতে পারব। মিঞাসাহেবের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কাত হয়ে শুয়ে আছে ঝিনুক, চোখ এখন সম্পূর্ণ বোজা। খুব আস্তে আস্তে শ্বাস টানছে সে।

একটু চুপচাপ।

তারপর ঝিনুক ফিস ফিস করে বলে, আমি তোমাকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছি।

বিনু চকিত হয়ে ওঠে, কী বলছ তুমি!

ঠিকই তো বলছি। আমার জন্যেই তোমার এত কষ্ট, এত ভোগান্তি। পুরুষমানুষ–একা থাকলে একটা না একটা উপায় করে চলে যেতে পারতে। আমি তোমার ওপর বোঝার মতো চেপে আছি। আমার জন্যে কখন যে তোমার কী ক্ষতি হয়ে যাবে!

এই সব বাজে চিন্তা ছাড়। এখন ঘুমোও।

বিনু গভীর মমতায় ঝিনুকের রুক্ষ চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আর কোনও কথা বলে না ঝিনুক। গাঢ় ঘুমে ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

কতক্ষণ কেটে গেছে, বিনুর খেয়াল নেই। ঝিনুকের চুলে দূরমনস্কর মতো আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছিল সে।

খোলা জানালাটার বাইরে রোদের তেজ বেশ বেড়েছে। সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না, তবে বোঝা যায়, সেটা আকাশের অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছে। এতক্ষণ নলখাগড়ার বনে ডাহুক আর ঝিঁঝি ডাকছিল। এখন তাদের সঙ্গে ঘুঘুরা গলা মিলিয়েছে। এই সমবেত কণ্ঠস্বর চারপাশের স্তব্ধতাকে আরও নিবিড়, আরও ঘনীভূত করে তুলেছে যেন।

হঠাৎ পাখি এবং পতঙ্গের ডাকাডাকি ছাপিয়ে উঠোনের দিক থেকে মানুষের গলা ভেসে এল। আফজল হোসেনই কি ফিরে এসেছে? কিন্তু তার তো দুপুরের আগে ফেরার কথা নয়। সূর্যটাকে দেখা গেলেও, বাইরের রোদের রং দেখে বোঝা যায় না, এখনও সেটা খাড়া মাথার ওপর উঠে আসেনি।

বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনুর। চকিতে ঝিনুকের শিয়রের কাছ থেকে উঠে গিয়ে খোলা জানালাটা বন্ধ করে দেয় সে। যারা উঠোনে কথা বলছে তাদের ভেতর যদি আফজল হোসেন না থাকে, আর কোনও কারণে ওরা বাড়ির পেছন দিকে চলে আসে তার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা। ভাবতেই শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল বিনুর।

জানালার কাছ থেকে বিনু সামনের দরজার পাশে এসে কাঠের পাল্লায় কান রেখে, স্নায়ুমণ্ডলী টান টান করে দাঁড়িয়ে রইল। গলার স্বর এবার স্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে, দুজন লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সে।

একজন বলল, ধনা বারইর ছাড়া-বাড়িটার উপুর আমার চৌখ আছিল। কী বাহারের ঘরগুলা! নয়া টিনের চাল, উচা ভিত।

দ্বিতীয় জন বলল, ঘরদুয়ার লইয়া আমি ভাবি না। কানির পর কানি জমিন ধনা বারইর। বীজধান ফালাও, ফনফনাইয়া চারা বাইর হয়, সার দেওন লাগে না। এক এক কানিতে পঁচিশ তিরিশ মোণ ধান ফলবই। হেয়া ছাড়া, ধর গা (ধর গিয়ে), রবি ফসলের খন্দে তিল, কলই, সউরষা (সর্ষে) তো আছেই। দুই চাইর কানি যদিন পাইতাম-–

প্রথম জন বলল, হুদা (শুধু তর আর আমারই রে হাসমা, ধনা বারই আর গোসাইগো জমিজেরাত ভিটামাটির উপুর গেরামের মেলা মাইনষের নজর। গোসইগো বাড়িঘর পুইড়া ছাই। তাগো দ্যাড় শ’ কানি জমিনে খুটি কুইপা (পুঁতে) চিলবিলা কইরা বছির হালিম তালাতরা ভাগ কইরা নিছে। আমরা দূরে খাড়ইয়া বুইড়া আঙ্গুল চোষলাম। বছিররা যা ডাকাইত, কাছেই ঘেষতে দিল না।

হাসমা, অর্থাৎ হাসেম নামের লোকটা বলল, ঠিকই কইছ মতিনচাচা, আমাগো নসিবে ঠনঠনঠন। একখান কথা খালি ভাবতে আছি, গোসাইগো দুই পোলা কইলকাতায় থাকে। হেরা (তারা) যদিন গেরামে আইসা জমিন বুইঝা লইতে দারোগা পুলিশের কাছে যায়, তহন কী হইব?

দেখতে না পেলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে, মতিন যার নাম সে বয়স্ক লোক, আর হাসেম অল্পবয়সী।

মতিন বলল, পরে কী হইব, ক্যাঠা জানে। যুগীগো, বামনগো, কুমারগো কেওর কেওর (কারোর কারোর জমিন বেদখল হইয়া গ্যাছে। আবার মেলা (অনেক) ছাড়া-বাড়ি আর জমিন অ্যামনেই পইড়া আছে। হেই দিকে অহন তরি (এখনও পর্যন্ত) কেও হাত বাড়ায় নাই।

হাসেম বলল, আইজ বাড়ায় নাই। দুই চাইর মাস দেইখা হাত যে বাড়াইব না, ক্যাঠা কইব (কে বলবে)?

মতিন এবং হাসেমের কথা শুনে মনে হচ্ছে, মামুদপুর গ্রামের যে বাসিন্দারা সীমান্তের ওপারে চলে গেছে তাদের অনেকেরই ছেড়ে-যাওয়া জমিজমা অন্যেরা দখল করে নিয়েছে। মামুদপুরেরই শুধু নয়, নানা জায়গায় এমন বেদখল হবার খবর আগেই শুনেছে বিনু।

মতিন বলল, ধনা বারইর বাড়িখান মাঝেমইদ্যে আইসা দেইখা যাই। কিন্তুক এইহানে হাত ছোঁয়ানের উপায় নাই।

হাসেম বলে, হ, জানি। ধনা বারই জবর চতুর। দ্যাশ ছাড়নের আগে বিষয় আশয় বড় মিঞার হাতে দিয়া গ্যাছে। বড় মিঞা হইল এহানকার পিছিডাং (এখানকার প্রেসিডেন্ট)। তেনার হিপাজতে, যে সোম্পত্তি আছে, কেওর ঘেটিতে (কাবোর ঘাড়ে) এমুন মাথা নাই যে হের (তার) থিকা এক বিঘত জমিনও দখল করে। এইখানে আসি আর উয়াস (দীর্ঘশ্বাস ফেলাইয়া চইলা যাই।

বড় মিঞা অর্থাৎ আফজল হোসেন। তার দাপট এতটাই যে ধনঞ্জয় বারুইর বাড়িঘর জমিজমায় হাত ঠেকাতে কারোর সাহস হয়নি। ধনঞ্জয়ের বরাত ভাল।

মতিন বলল, এইহানে খাড়ইয়া থাইকা আর কী হইব?

লও যাই, রাজেন শীলের বাড়ি গিয়া দেখি। এই বচ্ছর জষ্টি মাসে অরাও নয়া টিন দিয়া ঘর ছাইছিল। আমারে দিয়াই ছাওয়াইছিল। যদিন চালের দুইখান টিন খুইলা লইয়া যাইতে পারি, গুঞ্জে (গঞ্জে) গিয়া বেচলে কয়টা ট্যাকা পামু। হাতে কামকাইজ (কাজকর্ম) নাই, পহার বড় আকাল।

হ। গেরামে ভাঙ্গন লাগনের পর কামকাইজ জবর কইমা গ্যাছে। আগে সারা বছর বামনগো কায়েতগো জমিনে হাল দিতাম, ধান পাট রুইতাম, ফসল পাকলে কাইটা আনতাম। বাড়ির কামও কম আচ্ছিল না। নয়া ঘর বানাও, পাটের রশি পাকাওসুপারি নাইকল (নারকেল) পাড়, বাগ বাগিচায় ফলের গাছ রোও (বোনো)। কত যে কাম! অহন মাসে পাঁচ দিনও কেও ডাকে না।

হ। ক্যামনে যে সোংসার চলব, উপরআলাই জানে। অতগুলা প্যাট (এতগুলো পেট)।

হাসেমদের কথা শুনে বিনুর মনে হচ্ছে, ওরা কামলা শ্রেণীর মানুষ, হদ্দ গরিব। গ্রামের বড় ধানী গৃহস্থদের, বিশেষ করে বামন কায়েতদের বাড়ি এবং জমিতে কাজ করে পেটের ভাত জোটাত। পয়সাওলা। হিন্দুরা চলে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়ে গেছে।

কপাটে কান রেখে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে ছিল বিনু। না, ওই লোকদুটোর দিক থেকে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। আফজল হোসেনের ভয়ে তারা অন্তত এই বাড়িতে আঙুল ছোঁয়াতে সাহস করবে না। শেকল খুলে এই ঘরে তাদের ঢোকারও সম্ভাবনা নেই। ধনঞ্জয় বারুইর পরিত্যক্ত বাস্তুভিটাতে দাঁড়িয়ে তারা শুধু আক্ষেপই করতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।

কথা বলতে বলতে মতিন এবং হাসেম একসময় চলে যায়। তাদের গলার স্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। এই মুহূর্তে, অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে জীবনমৃত্যুর মাঝখানের সূক্ষ্ম সীমারেখায় যখন তারা দাঁড়িয়ে আছে, ওই দুটো গরিবের চাইতেও গরিব মানুষের প্রতি সহানুভূতিই বোধ করে বিনু। ঘরের সব জানালাকপাট বন্ধ। হাসেম আর মতিনকে দেখার উপায় ছিল না, তবু হতদরিদ্র লোকদুটো তার মনে ছাপ রেখে যায়।

দরজার পাশ থেকে ঝিনুকের কাছে চলে আসে বিনু। মেয়েটা গভীর ঘুমে ডুবে আছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের তালে তালে তার বুক খুব ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে। কয়েক পলক ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ফের পেছনের সেই জানালাটার কাছে চলে আসে সে। যতক্ষণ পারে ঝিনুক ঘুমোক। ঘুম কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মস্তিষ্ক থেকে দুর্ভাবনা, ভয়, আতঙ্ক মুছে দেয়।

সাবধানে জানালার পাল্লা খুলে নলখাগড়ার ঝোপ, খাল, খালের ওধারে আদিগন্ত ধানের খেতগুলের দিকে তাকাল বিনু। এই জানালাটাই এই মুহূর্তে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগের একমাত্র পথ।

কতকাল ধরে হেমন্ত ঋতুর জল-বাংলাকে দেখে আসছে বিনু। সোনালি-সবুজে ভরা ধানের খেত, ঠাণ্ডা নরম রোদ, আকাশের এ কোণে ও কোণে ছন্নছাড়া নিরীহ কিছু মেঘ, হালকা কুয়াশা, আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসমান শঙ্খচিল, বসুন্ধরার এই প্রান্তে প্রকৃতির সমস্ত কিছু আগের মতোই রয়েছে। কোথাও এতটুকু হেরফের নেই। কিন্তু মানুষ? আগাগোড়া প্রায় সবাই বদলে গেছে। কী প্রচণ্ড রিষ, কী তীব্র শক্রতা তাদের মনে! চোখেমুখে কী ভয়ঙ্কর আক্রোশ! আবহমান কালের নিসর্গ ঋতুতে ঋতুতে একই নিয়মে পাক খেয়ে যায়। গ্রীষ্মের পর বর্ষা আসে, বর্ষার পর শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত। হাজার বছর আগে হেমন্ত যা ছিল, আজও তা-ই আছে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর আগের মানুষ আর তেমনটি নেই। মানুষের মতো অন্য কিছুই বুঝি বদলে যায় না।

যতক্ষণ না আফজল হোসেন তাদের তারপাশায় পৌঁছনোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, এই ঘরে আটকে থাকতে হবে। অনবরত আতঙ্কের মধ্যে থাকলে তার উগ্রতা বোধহয় কমে আসে। অনুভূতিগুলো কেমন। যেন ভোতা হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভরা, কিন্তু তা নিয়ে এখন সেভাবে ভাবেছ না বিনু। দু’চোখে অপার শূন্যতা নিয়ে অনেক দূরে হেমন্তের শস্যক্ষেত্রগুলোর ওধারে ঝাঁপসা দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

হঠাৎ একটানা তীক্ষ্ণ ধাতব আওয়াজ কানে আসে। বিনু চমকে ওঠে। চোখ দুটো জানালার খুব কাছে নিয়ে বাইরের দিকটা ভাল করে দেখতে চেষ্টা করে। কিন্তু এধারে জঙ্গল টঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু নেই। নোকজন বা বাড়িঘর চোখে পড়ছে না। মামুদপুর গ্রামের বাড়ি টাড়ি সবই সামনের দিকে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর উঠোনের দিকের একটা জানালার কাছে চলে এল বিনু। কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করল, শব্দটা ঠিক কোত্থেকে আসছে। মনে হল, খুব কাছে নয়, বেশ খানিকটা দূরে কেউ লোহা বা ওই জাতীয় কোনও ধাতুর ওপর শক্ত ভারী কিছু দিয়ে ক্রমাগত ঘা মারছে।

আফজল হোসেন সাবধান করে দিয়েছিল, তবু ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে বিনুর। খুব সন্তর্পণে জানালাটা খুলে এক আঙুলের মতো ফাঁক করল সে। না, উঠোনে কেউ নেই। সাহস করে জানালাটা আরও একটু খুলল। উঠোনের ওধারে রাজেক এবং তমিজ যে ঘরটায় আছে, সেটার দরজা জানালা বন্ধ। অর্থাৎ আফজল হোসেনের নিষেধাজ্ঞা তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে।

জানালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ধাতব শব্দটা আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এবার হদিস পাওয়া গেল। এই ঘর থেকে কোনাকুনি প্রায় শ’পাঁচেক হাত দূরে দু’টো লোক একটা ঘরের চালে বসে আছে। একজন হাতুড়ি জাতীয় কিছু দিয়ে সামনে বাড়ি মারছে। আরেকজন অন্য কোনও যন্ত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন খুলবার চেষ্টা করছে। খুব সম্ভব দুই টিনের জোড়ের মুখের ভ্রু বা পেরেক।

চট করে সেই লোক দুটোকে মনে পড়ে গেল। খানিকক্ষণ আগে এ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছিল। অবশ্য তখন বন্ধ দরজার এধার থেকে তাদের দেখা সম্ভব ছিল না। নিশ্চয়ই ওরা হাসেম এবং মতিন, আর দূরের ওই ঘরটা কোনও এক রাজেন শীলের। বিনু আগেই শুনেছিল, হাসেমরা রাজেন শীলের ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাবে। এখন সেই কাজটাই করছে।

একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে বিনু। হাসেম এবং মতিনকে দেখতে দেখতে হঠাৎ রাজেন শীলের জন্য অদ্ভুত বিষাদে তার মন ভরে যায়। লোকটাকে সে দেখে নি, কোনওদিন দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। পিতৃপুরুষের বাসস্থানে নতুন টিন দিয়ে ঘর ছেয়েছিল রাজেন। এই বাড়ির সঙ্গে কত মায়ায় জড়িয়ে ছিল সে। হয়তো ভেবেছিল, বাপ-ঠাকুরদার মতো সন্তানসন্ততি নিয়ে আজীবন এখানেই কাটিয়ে যাবে। ভেবেছিল, মামুদপুর গ্রামের ভিটেমাটির সঙ্গে তাদের বন্ধন অচ্ছেদ্য। গভীর মমতা দিয়ে পুরুষানুক্রমে যা তারা গড়ে তুলেছিল, কে ভাবতে পেরেছে, একদিন সেখান থেকে অস্তিত্বের সবগুলো শেকড় উপড়ে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে চলে যেতে হবে?

আধ ঘন্টাও লাগল না, বিনুর চোখের সামনে হাসেম এবং মতিন দুখানা নতুন টিন খুলে মাথায় চাপিয়ে আরও দূরে ঘন গাছগাছালির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিনু আন্দাজ করে নিল, দু’চারদিনের মধ্যে শুধু ওই ঘরটারই না, রাজেন শীলের বাড়ির অন্য ঘরগুলোর চালের টিন, দরজা জানালা খুলে নিয়ে যাবে মতিন, হাসেম বা গ্রামের আর কেউ। অন্য যারা সাত পুরুষের ভদ্রাসন ছেড়ে চলে গেছে, তাদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির হালও ওইরকমই হবে। বিনুর মনে হল, যুগীরা কুমোররা বামুন কায়েতরা যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে বাস করে গেছে, হয়তো একদিন তার সামান্য চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না। হঠাৎ হেমনাথের কথা মনে পড়ল। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। অসীম মনোবল তার, দেশের প্রতি অফুরান আবেগ। কিন্তু তিনিও কি শেষ পর্যন্ত রাজদিয়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারবেন? কে জানে।

মতিনরা রাজেন শীলের ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাবার পর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বিনু। এখন চারদিক একেবারে সুনসান। শুধু পাখির ডাক, ঝিঁঝির ডাক এবং গাছের গুঁড়িতে কাঠঠোকরাদের ঠোঁটের অবিরত ঠক ঠক ছাড়া যতদূর চোখ যায়, সব নিস্তব্ধ।

খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বিনু। সূর্য যখন আকাশের ঠিক মাঝামাঝি থেকে পশ্চিম দিকে খানিকটা হেলে গেছে, সেই সময় ফের কাদের গলা শোনা গেল। বিনু ত্রস্তভাবে জানালার পাল্লা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, দেখতে পেল, আফজল হোসেন এবং রাজেক সামনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে এদিকে আসছে। আফজলের হাতে কলাপাতা ঢাকা দেওয়া একটা বড় ডেকচি। রাজেকের ডান হাতে ওই মাপেরই আরেকটা ডেকচি, সেটার ওপরও কলাপাতা। তার বাঁ হাতে জল ভর্তি টিনের বালতি। জানালা খোলা দেখলে আফজল হোসেন হয়তো অসন্তুষ্ট হবে, তাই সেটা আস্তে টেনে বন্ধ করে দিল বিনু।

একটু পর সিঁড়ির ধাপে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজেক ডাকল, কপাট খোলেন ছুটোবাবু–

বিনু দরজা খুলে দিতেই রাজেক আর আফজাল হোসেন ঘরে ঢুকে পড়ল। আফজল রাজেককে বলল, পানির বালতিখান এহানে নামাইয়া কান্ধের ডেচকি (ডেকচি) লইয়া উই ঘরে গিয়া দুইজনে খাইয়া লও–বলে উঠোনের ওধারের ঘরটা দেখিয়ে দিল। বিনু জানত না, ধনা বারুইর ছাড়া-বাড়ির এই ঘরখানায় তাদের পৌঁছে দেবার পর রাজেককে সঙ্গে করে মামুদপুর গ্রামের ভেতর দিকে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিল আফজল হোসেন। ভাত তরকারি জলটল বয়ে আনার জন্য। বাড়ির লোকজন বা গ্রামের কাউকে দিয়ে আনালে তাদের খবরটা মুহূর্তে চারদিকে চাউর হয়ে যেত। রাজেককেই শুধু নিয়ে গিয়েছিল আফজল। তমিজ নিশ্চয়ই উলটো দিকের ঘরে জানালা কপাট বন্ধ করে বসে আছে।

রাজেক দরজার দিকে পা বাড়াতে যাবে, আফজল হোসেন বলল, তরাতরি খাইয়া ডেচকি নিয়া আইসো। এনাগো খাওন হইলে খালি বালতি ডেচকি নিয়া আমার লগে আমাগো বাড়ি যাইবা। বলতে বলতে নিজের হাতের ডেকচিটা মেঝেতে নামিয়ে রাখল।

আইচ্ছা- মাথা হেলিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল রাজেক।

পেছনের খোলা জানালার দিকে এবার নজর পড়ল আফজল হোসেনের। সে জিজ্ঞেস করল, উইটা তো বন্ধ আছিল। ঘরে ঢুইকা বুঝিন খুইলা দিছিলেন?

বিনু বেশ ঘাবড়ে যায়। জানালাটা খোলার কারণে আফজল হোসেন কতটা অসন্তুট হয়েছে, বুঝবার জন্য তার মুখের দিকে তাকায়। ভয়ে ভয়ে বলে, ঘরটা খুব অন্ধকার। তাই–

ঠিক আছে। উই দিকে মানুষজন বড় এট্টা আসে না। বলতে বলতে তক্তপোষের দিকে তাকাল আফজল, বিবিসাবে ঘুমাইতে আছে। অহন জাগাইলে কথা শেষ না করে কুণ্ঠিতভাবে থেমে গেল।

পেছনের জানালা খোলার জন্য মারাত্মক অপরাধ যে হয়ে যায়নি, ব্যাপারটা হালকাভাবেই নিয়েছে আফজল হোসেন, এতে স্বস্তিবোধ করে বিনু। সে জানায়, শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে ঝিনুক এমনই বিপর্যস্ত যে বসে থাকতে পারছিল না। শুইয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সহানুভূতির সুরে আফজল হোসেন বলে,হ, শরীলের আর দোষ কী। অ্যামনেই বিবিসাবু রোগা মাইয়া, গায়ে জোর-বল নাই। হের (তার) উপুর যা তাফাল যাইতে আছে। কিন্তুক

উৎসুক চোখে তাকাল বিনু, কোনও প্রশ্ন করল না।

আফজল হোসেন বলতে লাগল, মেলা বেইল (অনেক বেলা) হইয়া গ্যাছে। উনার ঘুম। ভাঙ্গাইয়া খাইতে কন। প্যাটে ভাত পড়লে শরীলে তাকত আইব।

বিনু তক্তপোষের কাছে গিয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল, ঝিনুক-–ঝিনুক–

ঘুমের ঘোরে বারকয়েক হুঁ হাঁ করার পর উঠে বসল ঝিনুক। চোখ আধখোলা, লালচে। মাথা অল্প অল্প দুলছে। কপালের দুপাশের শিরা দপদপ করছে। জড়ানো গলায় সে বলল, ডাকছ কেন?

বিনু উত্তর দেবার আগে আফজল হোসেন বলল, আগে চৌখে পানি দ্যান। ঘুমের চটকা দুইটা যাইব। হের পর দু’গা (দুটি) খাইয়া লন।

অন্য লোকের গলা শুনে পুরোপুরি চোখ মেলে তাকায় ঝিনুক। আফজল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।

আফজল হোসেন ঝিনুককে বোঝায়, খেতে ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে। এখান থেকে তারপাশা, তারপাশা থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা। পথ তো একটুখানি নয়। তা ছাড়া, দিনকাল আগের মতো সহজ, স্বাভাবিক নেই। এখন পদে পদে সংকট, সমস্ত কিছুই ঘোর অনিশ্চয়তায় ভরা। শরীরে শক্তি থাকলে তবু খানিকটা যোঝা যায়।

ঝিনুক আর আপত্তি করল না, তক্তপোষ থেকে নেমে পড়ল। জলের বালতির গায়ে একটা সিলভারের মগ আটকানো ছিল। সেটা খুলে নিয়ে বালতি থেকে জল তুলে বাধ্য মেয়ের মতো পেছনের জানালার কাছে গিয়ে কয়েক আঁজলা চোখেমুখে ছিটলো। তারপর কুলকুচি করে মুখের জল জানালার বাইরে ফোয়ারার মতো ছুঁড়ে দিল।

জলের স্পর্শে মুখটা এখন বেশ নরম লাগছে। কপালের শিরাগুলোর দপদপানি আর নেই। ঘুমটাও কেটে গেছে।

বিনুও মুখ ধুয়ে এল। ঘরের কোণে ক’টা কাঠের পিঁড়ি এবং জলচৌকি উঁই হয়ে পড়ে আছে। অফজল হোসেন একটা জলচৌকি টেনে বসতে বসতে বলল, তরাতরিতে বেশি কিছু আনতে পারি। মাই। ন্যান (নিন), খান। ডেচকিতে থাল (থালা), গ্যালাস, চাইমচা (চামচ), হগল আছে।

অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি ভালই ব্যবস্থা করেছে আফজল হোসেন। সরু চালের ধবধবে ভাত, বেগুন ভর্তা, নানারকম আনাজ দিয়ে পাঁচমেশালি তরকারি, টাটকিনি মাছের পাতুরি আর রসগোল্লা।

ডেকচির কোনা থেকে চিনা মাটির নকশা-করা থালা গেলাস ইত্যাদি বার করে ভাত তরকারি মাছ টাছ সাজিয়ে ঝিনুককে দিল বিনু। নিজেও নিল।

খেতে খেতে বিনুর মস্তিষ্কে অদ্ভুত একটা চিন্তা পাক খায়। যাদের প্রতি অপার বিদ্বেষ এবং ঘৃণা নিয়ে সে এ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাদেরই একজন, যাকে সে আগে কোনও দিন দেখেনি পর্যন্ত, এমন এক পরিত্যক্ত নিঝুম বাড়িতে, কাছে বসে ঘনিষ্ঠ পরিজনের মতো তাকে আর ঝিনুককে খাওয়াচ্ছে–এটা যেন সত্যি নয়। খাপছাড়া স্বপ্নের মতো মনে হয়।

আফজল হোসেন হঠাৎ বলল, জানেন, আরেটু হইলে ধরা পইড়া যাইতাম। উপুরআলার দোয়ায় জবর বাইচা গেছি।

থালা থেকে ভাতের গ্রাস তুলতে গিয়ে থমকে যায় বিনু। ভীরু গলায় জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল?

আফজল হোসেন জানায়, তোকজনের চোখে যাতে না পড়ে সে জন্য গ্রামের বাইরে ধানখেতের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে রাজেককে নিয়ে এখানে আসছিল সে। ঘুরপথে আসার কারণ, কেউ দেখে ফেললে, ডেকচি আর জলের বালতি নিয়ে কোথায় চলেছে, গ্রামের ভেতর সিধা রাস্তা থাকতে ধানখেতে কেন, এমনি হাজার গণ্ডা জবাবদিহি করতে হবে। খানিকটা আসার পর চোখে পড়ল, উলটো দিক থেকে আলপথ ধরে রহিম মাস্টার আসছে। নির্বিঘ্নে কিছু কি হবার যো আছে! সামান্য জেলে জোলা চাষী টাষী হলে ধমকধামক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যায়। কিন্তু রহিম মাস্টার মান্যগণ্য লোক, স্থানীয় আপার প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। সে কোনও প্রশ্ন করলে জবাব দিতেই হয়। অগত্যা রাজেককে নিয়ে আল থেকে ধানখেতের অনেকখানি ভেতরে গিয়ে চুপচাপ লুকিয়ে ছিল আফজল হোসেন। রহিম মাস্টার ধানখেত পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে যাবার পর তারা ফের আলপথে ফিরে আসে, তারপর সোজা এখান না, রহিম ছাড়া আর কারোর সঙ্গে তাদের দেখা হয়নি।

দমবন্ধ করে শুনে যাচ্ছিল বিনু। এবার তার বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল। পরক্ষণে অন্য একটা দুশ্চিন্তা তার মাথায় ভর করে।

বিনু বলল, এত ভাত তরকারি মাছ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, আপনার বাড়ির লোকেরা জানতে চাননি?

আফজল হোসেন বলল, চাইছিল। তাগো কইছি পরে জানামু। হের পর কেউ আর কিছু জিগায় নাই।

বিনু আন্দাজ করে নিল, নিজের বাড়িতে লোকটার প্রচণ্ড দাপট। পরে জানাবে বলার পর কেউ দ্বিতীয় বার কৌতূহল প্রকাশ করতে সাহস পায়নি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বিনু সঙ্কোচের সুরে বলে, আফজল সাহেব, সেই সকাল থেকে আমাদের। জন্যে কী কষ্টই না করছেন! এত ছোটাছুটি! তা ছাড়া, লোকে আমাদের খবরটা পেয়ে গেলে আপনার। বিপদও কম হবে না। কিন্তু যে অবস্থায় আমরা

হাত তুলে বিনুকে থামিয়ে দিয়ে আফজল হোসেন বলে, কষ্টের কথা কইতে আছেন! মাইনষের লেইগা মাইনষের এইটুক তো করতেই হয়। আর বিপদের কথা কন? এই লইয়া ভাবি না। উপরআলা আছে, তেনিই (তিনিই) ভরসা। অহন ভালায় ভালায় আপনেগো তারপাশায় পৌঁছাইয়া দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হইতে পারি।

এই মুহূর্তে তাদের জন্য আফজল হোসেন কী মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে, সেটাই ভাবছিল বিনু। তারপাশায় পৌঁছনোর চিন্তাটা ফের তার মাথায় ফিরে এসে অসহ্য চাপ দিতে থাকে। উদ্বিগ্ন মুখে সে জিজ্ঞেস করে, স্টিমারঘাটে যাবার কিছু ব্যবস্থা হল?

না। মাথা নাড়তে নাড়তে আফজল হোসেন বলে, ইট্ট সোময় লাগব

সময়? আজ কি তা হলে এই মামুদপুর গ্রাম থেকে তাদের যাওয়া হচ্ছে না? ধনা বারুইর ছেড়ে যাওয়া বাড়িতেই আটকে থাকতে হবে? বিনুর উৎকণ্ঠা লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকখানি চড়ে যায়। শুকনো গলায় জিজেস করে, কতটা সময় লাগবে?

আফজল হোসেন বলে, ক্যামনে কই? গাঙ পাড়ি দিয়া তারপাশায় যাওনের নাও তো মেলাই (নৌকো তো অনেকই আছে। কিন্তুক বিশ্বাসী মাঝি পাওন দরকার। কার মনে কী বিষ রইছে, বাইরে থিকা তো ট্যার পাওন যায় না। বুইঝা শুইনা বন্দবস্ত করতে হইব। দেখা যাউক।

অর্থাৎ, যতক্ষণ না এমন মাঝি পাওয়া যাচ্ছে যে সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য, যে কোনও রকম ক্ষতি করবে না, বিনুদের পরিচয় জানতে পারলেও টু শব্দটি করবে না, আফজল হোসেন খুব সম্ভব এমন কারোর খোঁজে আছে। বিনুদের ব্যাপারে সামান্য ঝুঁকিও সে নিতে চাইছে না।

বিনু অস্পষ্ট গলায় বলে, হ্যাঁ।

বিপন্ন যুবকটির শঙ্কাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো মায়াই হয় আফজল হোসেনের। আশ্বাস দেবার সুরে বলে, ডরাইয়েন না, য্যামন কইরা পারি আপনেগো তারপাশায় লইয়া যামুই।

চরম বিপদে এই মানুষটাই একমাত্র অবলম্বন। দৈবপ্রেরিতের মতো সে সকালবেলায় তাদের কাছে। এসেছিল। তারপর নদীর পাড়ের জঙ্গল থেকে মামুদপুর গ্রামের এই ঘরে এনে আশ্রয় দিয়েছে। যখনই বিনুর মনোবল ধূলিসাৎ হতে থাকে, সাহস যুগিয়ে সে তার স্নায়ুগুলোকে চাঙ্গা করে রাখে। আশা নষ্ট হলে সবই গেল। সকাল থেকে এই কয়েক ঘন্টায় বিনু বুঝে গেছে, আফজল হোসেন এক কথার মানুষ। যখন বলেছে তারপাশায় পৌঁছে দেবে, নিশ্চয়ই দেবে।

ঝিনুক বরাবরই খুব স্বল্পাহারী। দু’চার গ্রাস খেয়ে জানালার কাছে গিয়ে আঁচিয়ে এল। বিনুরও খাওয়া শেষ। সেও মুখ ধুয়ে আসে। আফজল হোসেন ডাল ভাত মাছ তরকারি যা এনেছিল দুজনে তার অর্ধেকও খেতে পারেনি। ওদিকে রাজেক খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে তাদের খালি ডেকচি নিয়ে এ ঘরে এল। আফজল হোসেন তাকে বলল, এইখানের ডেচকি, পানির বালতি, বাসনকোসন লইয়া আমার লগে চল–

সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিতে লাগল রাজেক।

বিনুকে খুব সতর্ক হয়ে থাকতে বলে খানিক বাদে রাজেককে সঙ্গে করে চলে গেল আফজল হোসেন।

.

৩.০৫

ঝিনুক আঁচিয়ে এসে ফের শুয়ে পড়েছিল। শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। অপার ক্লান্তি, অসীম দুর্বলতা। চোখ মেলে বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না সে। মেয়েটার জীবনীশক্তি প্রায় শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে।

আফজল হোসেনরা চলে যাবার পর অনেকক্ষণ ঝিনুকের শিয়রের কাছে বসে রইল বিনু। মাথায় একবার হাত রাখল। সাড় নেই। রোগা, রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হাতটা তুলে নিল। ঝিনুক টেরই পেল না। তার সারা শরীর ঘিরে এমন এক আচ্ছন্নতা, যা মোটেই স্বস্তি দেয় না।

সামনের দিকের দরজা জানালা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল বিনু। আফজল হোসেন বাইরের শেকলও তুলে দিয়ে গেছে। একসময় বিনু ঝিনুকের তক্তপোষ থেকে উঠে এসে পেছনের খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

পশ্চিম দিকটা বোধহয় এধারে। দিন ফুরিয়ে এসেছে। খালের ওপারে ধানখেতগুলোর ওপর নিস্তেজ, মরা রোদ গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। সূর্যটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ধানখেতের শেষ মাথায় যেখানে গাছপালার ধ্যাবড়া রেখা দিগন্তের গায়ে লেপটে আছে, সূর্য নিশ্চয়ই তার ওধারে নেমে গেছে।

বেলা হেলতেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। প্রথমে ছিল মিহি। ক্রমশ গাঢ় হয়ে সমস্ত চরাচর ঢেকে দিচ্ছে। আগের মতোই ঝিঁঝি ডাকছে, কাঠঠোকরারা গাছের গুঁড়িতে সমানে তুরপুন চালিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যেন একটা তক্ষক অদ্ভুত শব্দ করে উঠল।

লম্বা পায়ে সন্ধে ধেয়ে আসছিল। দেখতে দেখতে হেমন্তের দিনটা শেষবেলার রোদটুকু গুটিয়ে নিয়ে উধাও হল। কুয়াশায় আর অন্ধকারে মেশামেশি হয়ে চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যেতে লাগল। জোনাকিরা কোথায় যেন গা-ঢাকা দিয়ে ছিল। সন্ধে নামতেই বেরিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে আলোর ফেঁড় তুলে তুলে নেচে বেড়াচ্ছে।

মশাদের হিংস্র একটা বাহিনী মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়ে জানালা দিয়ে ঝড়ের গতিতে ঢুকে পড়ে। বিনুর ওপর তো বটেই, ঝিনুকের চোখেমুখেও তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

ঘরে আলো নেই। বিনু সিগরেট খায় না যে পকেটে দেশলাই থাকবে। রাজেকের নৌকোয় বেতের ঝুড়িতে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ ছিল। হানাদারেরা নৌকোসুদ্ধ টর্চ ফর্চ সব নিয়ে চলে গেছে। রাত্তিরে যে বিনুদের এখানে থাকতে হতে পারে, আফজল হোসেন খেয়াল করেনি। করলে নিশ্চয়ই লণ্ঠন বা কুপি দিয়ে যেত।

ক্ষিপ্র হাতে জানালা বন্ধ করে ঝিনুকের কাছে চলে এল বিনু। মশারা মেয়েটার গালে কপালে সমানে উঁচ বিধিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝিনুকের গলা থেকে ক্ষীণ, কাতর আওয়াজ বেরিয়ে আসছে, উঁ অ্যাঁ–। কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত মশারা মেয়েটার গা থেকে কতটা রক্ত শুষে নিয়েছে, কে জানে।

এই ঘরে ঢোকার পর বোরখা খুলে ফেলেছিল ঝিনুক। সেটা তুলে নিয়ে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে মশা তাড়াতে লাগল বিনু। কিন্তু মশাগুলো খুবই ধুরন্ধর, ফাঁক দিয়ে দিয়ে ঢুকে কামড় বসাতে লাগল।

কতক্ষণ মশা তাড়িয়েছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ বাইরে শেকল খোলার শব্দ শোনা গেল। তারপরই আফজল হোসেনের স্ত, চাপা গলা কানে আসে, তরাতরি কপাট খোলেন–

রাজেকও একই সুরে ডাকাডাকি করছে, দেরি কইরেন না ছুটোবাবু, জবর বিপদ–

দু’জনেরই কণ্ঠস্বরে যা আছে তা হল অস্বাভাবিক আতঙ্ক এবং কাপুনি। হঠাৎ রাজেকদের এত ভয়ের কারণ কী হতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না। বিনু আন্দাজ করল, তাদের নিয়েই মারাত্মক কিছু ঘটেছে। পলকে ঠান্ডা, কনকনে ত্রাস তার মধ্যেও চারিয়ে গেল।

আফজল হোসেন শেকল খুলে দিলেও ভেতরে খিল আটকে রেখেছিল বিনু। তার হাত-পা ভীষণ থরথর করছে। সেই অবস্থাতেই খিল খুলল সে। সঙ্গে সঙ্গে আফজল হোসেন এবং রাজেক প্রায় ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ল।

আফজলের হাতে বড় টর্চ ছিল, সেটা জ্বালতেই জোরালো আলোয় ঘর ভরে গেল। ব্যগ্র গলায় সে বলল, অখনই আপনেগো এখান থিকা চইলা যাইতে হইব। এই কি, বিবিসাব ঘুমায় দেখি! ওনারে। তোলেন। দেরি করনের সোময় নাই।

খোলা দরজা দিয়ে বাইরের উঠোনে পাঁচজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কুয়াশা মাখা অন্ধকারে পাঁচটি ঝাঁপসা ছায়ামূর্তি। শরীরের কাঠামো থেকে চেনা গেল, এদের একজন তমিজ। বাকি চারজন অচেনা। ওরা কারা, কে জানে। তবে আফজল হোসেন যখন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, ওদের দিক থেকে দুর্ভাবনার কিছু নেই।

বিনুর শ্বাস আটকে আসছিল। কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আফজল সাহেব?

পরে শুইনেন (শুনবেন)। দেরি করলে হগলটির জান চইলা যাইব। বিবিসাবরে আগে জাগান–

আফজল হোসেনের বলার ভঙ্গিতে এমন এক কঠোরতা আর তাড়া ছিল যে এক টানে ঝিনুককে তুলে ফেলল বিনু। আচমকা ঘুম ভাঙানোয় হকচকিয়ে যায় ঝিনুক। ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, কী—কী–

আফজল হোসেন বিনুকে বলল, বিবিসাবরে বুরখাখান পরাইয়া বাইরে লইয়া চলেন। আপনে লুঙ্গি পইরাই আসেন।

ঝিনুককে তড়িৎগতিতে বোরখা পরাল বিনু। আফজল হোসেনের লুঙ্গিটা পরেই আছে সে। তার ধুতিটা তক্তপোষের এক ধারে দলা পাকানো হয়ে পড়ে আছে। ধুতি তুলে নিয়ে ঝিনুকের একটা হাত ধরল বিনু। তারপর ঘর থেকে বাইরের উঠোনে। আফজল হোসেন এবং রাজেকও তাদের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে।

দূরে হইচই শোনা গেল। সচকিত বিনুর চোখে পড়ল, মশাল জ্বালিয়ে কারা যেন ডান দিক থেকে হল্লা করতে করতে এধারে ছুটে আসছে।

আফজল হোসেন হঠাৎ কেন ধনা বারুইর বাড়ি এসে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাড়া দিয়েছে, এবার খানিকটা আন্দাজ করা যাচ্ছে।

রাজেক থর থর, নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, অহন উপায়? অরা এইদিকেই আসতে আছে নিদারুণ সংকটের মধ্যেও আফজল হোসেনের মাথাটা খুব ঠাণ্ডা। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বলল, ডাইনে যাওন যাইব না। অগো সুমখে পইড়া যামু। বাও (বা) দিকে লৌড়াও (দৌড়ও)–

ডান দিকে গ্রামের রাস্তা। ধনা বারুইর বাড়ির হাতা ছাড়িয়ে বাঁ পাশে খানিকটা গেলে ঝোপঝাড়, জঙ্গল। সে সবের ভেতর দিয়ে উৰ্দ্ধশ্বাস দৌড় শুরু হল। আগে আগে টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে ছুটছে। আফজল হোসেন। বাকিরা তার পেছনে। অপরিচিত সেই ছায়ামূর্তিগুলোও সঙ্গে রয়েছে। বিনু সেই যে ঝিনুকের হাত ধরেছিল, আর ছাড়েনি। প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলেছে।

আচমকা ঘুম থেকে তুলে এভাবে অন্ধকারে কুয়াশায় ঝোপ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড় করানো হবে, ভাবতে পারেনি ঝিনুক। সে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে মুখ থেকে একটি শব্দও বেরুচ্ছে না।

অনেকক্ষণ ছোটার পর সবাই নদীর পাড়ে এসে থামে। আফজল হোসেন বিনুদের যেখানে নিয়ে এসেছে, নৌকোঘাট সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সমস্ত কিছু ঝাঁপসা, তবু বোঝা যায়, বার চোদ্দটা নৌকো ওখানে গা জড়াজড়ি করে রয়েছে। সেগুলোতে মিট মিট করে হেরিকেন কি কুপি জ্বলছে।

এতটা দৌড়ের ধকলে সবাই ভীষণ হাঁপাচ্ছিল। জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাস টেনে আফজল হোসেন বলল, যাউক, আর ডরের কিছু নাই। অহন আমরা নিচ্চিন্ত।

ক্রমে জানা গেল, দুপুরে বিনুদের খাইয়ে যাবার পর আফজল হোসেন মামুদপুরের পাশের গ্রাম সোনাদীঘিতে লোক পাঠিয়ে চারজন মাঝিকে ডাকিয়ে এনে বিনুদের তারপাশায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে। অনেকদিন ধরে এই মাঝিদের চেনে সে। লোকগুলো খুবই বিশ্বাসযোগ্য এবং ইমানদার। ঠিক হয়েছিল, বেলা থাকতে থাকতে ওরা ওদের চারমাল্লাই নৌকো নৌকোঘাট থেকে দূরে মুত্রাবনের আড়ালে লুকিয়ে রেখে আফজল হোসেনের বাড়ি গিয়ে খবর দেবে। সন্ধের পর চরাচর জুড়ে কুয়াশা এবং অন্ধকার নামলে সে মাঝিদের সঙ্গে করে ধনা বারুইয়ের বাড়ি এসে বিনুদের নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে নৌকোয় উঠবে। নদীর ধারের মুত্রাবনে নৌকো বেঁধে রেখে মাঝিরা আফজলের বাড়ি চলেও গিয়েছিল।

সবই ঠিকমতো চলছিল, কিন্তু সন্ধের মুখে মুখে কিভাবে যেন বিনুদের খবরটা মামুদপুরে ছড়িয়ে পড়ে। সারা গ্রাম মুহূর্তে গরম হয়ে ওঠে। হামলাবাজেরা যখন ধনা বারুইর বাড়িতে চড়াও হবার জন্য তৈরি হচ্ছে, আফজল মাঝিদের নিয়ে বিনুদের বাঁচাতে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসে।

এক দমে সমস্ত জানিয়ে সেই অচেনা চারটি লোককে দেখিয়ে আফজল হোসেন বিনুকে বলে, এয়ারাই হেই মাঝি। অগো নাওয়েই তারপাশা যাইবেন।

অভিভূত, কৃতজ্ঞ বিনু কী বলবে, কী করবে, ভেবে পায় না। সে শুধু আফজল হোসেনের একটা হাত তুলে দুহাতে জড়িয়ে ধরে।

বিনুর স্পর্শে এমন কিছু রয়েছে যা আফজল হোসেনের বুকের ভেতর আলোড়ন তুলে যায়। গাঢ় গলায় সে বলে, আপনেরে তো কইছিই, মাইনষের লেইগা মাইনষে এইটুক করেই।

বিনু উত্তর দেয় না।

একটা লম্বা, সাই জোয়ান মাঝিকে আফজল হোসেন এবার বলে, হামিদ, তোমার নাও কই?

পাশেই অনেকখানি জায়গা জুড়ে মুত্রা ঝোপ। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে হামিদ বলে, উই ঝোপড়ার আবডালে।

আর সোময় নষ্ট করনের কাম নাই। নাও লইয়া আসো। অহনই ছাড়তে হইব।

নৌকো বার করে নিয়ে এলে আফজল হোসেন সবাইকে নিয়ে ওপরে উঠল। মাঝখানে বড়, উঁচু ছই। সামনে পেছনে গলুইয়ের পর থেকে ছই পর্যন্ত টানা, খোলা ডোেরার ওপর কাঠের পোত্ত পাটাতন। দুই মাঝি বৈঠা নিয়ে পেছনে বসল। তাদের কাছাকাছি পাটাতনে বসল রাজেক আর তমিজ। সামনের গলুইতে বসেছে অন্য দুই মাঝি। বিনু এবং ঝিনুককে ছইয়ের ভেতর যেতে বলে নিজে সামনের দিকের পাটাতনে পা ভাজ করে বসল আফজল হোসেন।

বিনু অবাক হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাদের সঙ্গে তারপাশা যাবেন?

আফজল হোসেন বলল, হ। গাঙ দিয়া গ্যালেও বিপদ কম না। কাইল রাইতেই তো আল্লার দোয়ায় পরানে বাইচা গ্যাছেন। আমারে সামনের পাটাতনে বইসা থাকতে দেখলে কেও সন্দ করব না’

অর্থাৎ এ নৌকোয় মুসলমান যাত্রী ছাড়া আর কেউ আছে, নদীর হানাদারেরা ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না। এখন আকাশে বিষ, বায়ুস্তরে বিষ, চারদিকে মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি ঘৃণা আর আক্রোশ। বিনু জানে, আফজল হোসেন এই যে তাদের তারপাশায় পৌঁছে দেবার ঝুঁকি নিয়েছে সেটা কতখানি বিপজ্জনক। ছইয়ের তলায় কারা লুকিয়ে আছে, জানাজানি হলে কী ঘটবে, সেটা খুবই স্পষ্ট। বিনুদের চাইতেও অনেক বেশি সঙ্কটে পড়বে আফজল হোসেন। এই দুঃসাহসী মানুষটি তাদের শেষ অবলম্বন। সে সঙ্গে থাকলে অনেকখানি ভরসা পাবে বিনুরা। সেই সকাল থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য কতভাবেই না আগলে আগলে রেখেছে আফজল। তারপরও তাকে নতুন করে বিপন্ন করতে মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে গিয়েও থেমে গেল বিনু। মানুষ বড় স্বার্থপর জীব। তার যা কিছু, সবই নিজেকে বাঁচিয়ে। রাতের অন্ধকারে নদী পাড়ি দিয়ে তারপাশায় যাবার সময় এই মানুষটা যদি ঢালের মতো সামনে থাকে, মনের জোর যথেষ্ট বেড়ে যাবে। আজ সকাল থেকে সন্ধে, মাত্র দশ এগার ঘন্টার মতো আফজল হোসেনকে দেখছে বিনু। তার সাহস, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, বিপদ এড়াবার জন্য দ্রুত কৌশল সৃষ্টির ক্ষমতা, সব মিলিয়ে এমন একজন লোককে যাত্রাসঙ্গী হিসেবে যখন অযাচিতভাবেই পাওয়া যাচ্ছে, তখন তাকে ছাড়া ঠিক হবে না।

দিনের বেলা উত্তুরে হাওয়ায় তেমন তেজ ছিল না; ঢিমে চালে সেটা বয়ে যাচ্ছিল। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে তার জোর অনেক বেড়েছে। হিমও পড়ছে নিবিড় হয়ে। সেই বিকেল থেকে আকাশের গায়ে কুয়াশা জমছিল। ক্রমশ তা ঘন হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলছিল। কুয়াশার সঙ্গে আঁধার মিশে এখন বিশ হাত দূরেও নজর চলে না। ঠিক কালকের মতোই চোখের সামনের সমস্ত কিছু ঝাঁপসা।

আফজল হোসেন মাঝিদের বলল, নাও ছাইড়া দ্যাও। কেরায়া নাওয়ের ঘাটের সুমুখ দিয়া যাইও না। বলে আঙুল বাড়িয়ে কাছাকাছি নৌকোঘাটটা দেখিয়ে দিল।

হামিদ বেশ চালাকচতুর। নৌকোঘাটের পাশ দিয়ে না যাবার কারণটা চট করে ধরে ফেলে। বলে, হ, উই ধার দিয়া যাওনের কাম নাই। রাইতে আপনেরে নাওয়ে দেখলে হগলে জিগাইব, কই যান, ক্যান যান। মেলা ফৈজত।

আফজল হোসেন এই অঞ্চলের একজন মান্যগণ্য মানুষ। সবাই তাকে চেনে। এত রাতে সে কোথায় চলেছে, পরিচিত লোকজনের তেমন কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। সে বলল, নাও লইয়া সিধা মইদ্য গাঙে যাইবা। বাতাসের গতিক ভালা বুঝলে বাদাম খাটইয়া দিবা। কাইল সুরুয ওঠনের (ওঠার) আগে আগে তারপাশা পৌঁছাইয়া যামু–

হামিদ বলল, তেমুনডাই ভাইবা রাখছি। বলে বরাবর মাঝনদীর দিকে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল। জবর ওস (কুয়াশা)। দেইখো, দিক য্যান ভুল না হইয়া যায়। আফজল হুঁশিয়ার করে দিল। হামিদের আত্মবিশ্বাসে সামান্য খোঁচা লাগে। গলায় ঈষৎ জোর দিয়ে সে বলে, বড় মিঞাছাব, মোচের ব্যাখ (রেখা) যহন উঠে নাই হেই সোময় থিকা পদ্ম-ম্যাঘনা-ধলেশ্বরীতে নাও বাইতে আছি। ওসে তো খুয়া খুয়া (আবছা) দ্যাখন যায়। চৌখে কাপড় বাইন্ধা জাগার (জায়গার) নাম ক’ন। ঠিক পৌঁছাইয়া দিমু।

জানি তুমি উস্তাদ মাঝি, তভু মনে করাইয়া দিলাম।

কালকের তুলনায় আজ বাতাস অনেক জোরালো তো বটেই, সমস্ত নদী জুড়ে উঁচু উঁচু ঢেউও উঠছে। জল থেকে ঠাণ্ডা বাষ্প বেরিয়ে এসে কুয়াশায় আর অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে।

নদীর পাড় থেকে নৌকো বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছিল। ওধারের মাঝিঘাট এখন আরও অস্পষ্ট। শুধু পুরু কুয়াশার পর্দার ওধারে ওখানকার নৌকোগুলোর ডিবে কি লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো কেমন যেন অলৌকিক মনে হয়।

রাজেকদের নৌকোর ছইয়ের দু’দিকেই কাঁচা বাঁশের ঝাঁপ ছিল। এই নৌকোটার ছইয়ের দুই মুখই খোলা। হু হু করে হেমন্তের বাতাস সারা গায়ে হিম মেখে ভেতরে ঢুকে পড়ছে।

নৌকোয় উঠেই শুয়ে পড়েছিল ঝিনুক। হেরিকেন কি কুপি থাকলেও হামিদরা তা জ্বালিয়ে দেয়নি। রাজেকদের মতো তারাও রাতের আঁধারে আঁধারে হানাদারদের নজর এড়িয়ে নদী পাড়ি দিয়ে তারপাশায় যেতে চায়।

ঝিনুকের পাশে বসে আছে বিনু। স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যায়, বোরখায় সারা শরীর ঢেকে মেয়েটা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আছে। সে ডাকল, ঝিনুক—

ঝিনুক ঘুমোয়নি। মৃদু গলায় সাড়া দিল, উঁ–

আফজল সাহেব আমাদের সঙ্গে আছে। এবার আর ভয় নেই।

কাল রাজেকদের নৌকোয় ওঠার পর এমন অভয় কত বার যে বিনু দিয়েছে তার ঠিক নেই। ঝিনুক কতটা আশ্বস্ত হল, কে জানে। সে উত্তর দিল না।

বিনুর আর কিছু বলার ছিল না। কী-ই বা বলবে? ছইয়ের ফাঁক দিয়ে দুনিরীক্ষ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। আফজল হোসেন তাদের সঙ্গে আছে। ঠিক। যেটুকু পরিচয় পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয় লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। সেটাও ঠিক। তবু যতক্ষণ না তারপাশায় গিয়ে স্টিমারে উঠছে, দুর্ভাবনা পিছু ছাড়ছে না। কিভাবে, কোন অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে সেটা বার বার মাথায় ঢুকে পড়ে, হদিস পাওয়া যায় না।

নৌকোর এ-মাথায় ও-মাথায় অন্ধকারে জিনের মতো চার মাঝি একটানা বৈঠা টানছে। তার আওয়াজ তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে নদীর বড় বড় ঢেউ নৌকোর গায়ে আছড়ে পড়ে অনবরত যে ধ্বনি সৃষ্টি করছে, এছাড়া সারা পৃথিবীতে আর কোনও শব্দ নেই। কালকের মতো আজও আকাশ চাঁদ বা নক্ষত্রের মেলা, কিছুই চোখে পড়ছে না। কুয়াশা আর অন্ধকার মিলে গিয়ে দিগন্তজোড়া ধূসরতায় সে সব পুরোপুরি মুছে গেছে।

বিনুরা অনেক দূর চলে এসেছিল। খুব সম্ভব মাঝনদীতে। মামুদপুরের নৌকোঘাটের আলোগুলো এখন আর দেখা যাচ্ছে না। আঁধারে কুয়াশায় নদীর ওপারটা বিলীন হয়ে গেছে।

হঠাৎ একটা কথা ভেবে নিজের কাছেই নিজে ভীষণ ছোট হয়ে গেল বিনু। শুধু ছোটই নয়, মনে হল, সে বড় বেশি স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। ঝিনুকের আর নিজের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনও দিকে তার নজর নেই। মাত্র সাত হাত দূরে বসে হিমে ভিজে যাচ্ছে আফজল হোসেন। হেমন্তের ঠাণ্ডা হাওয়া তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আকাশের নিচে ভোলা পাটাতনে সারা রাত এভাবে বসে থাকলে লোকটা শক্ত অসুখে পড়ে যাবে। ছইয়ের ভেতর তাকে এসে বসার কথা বলতে গিয়েও থেমে যায় বিনু। সে জানে, তারপাশা অব্দি লোকটা ঠায় ওখানে বসে থাকবে। কারণটাও তার অজানা নয়।

আফজল হোসেন হামিদকে জিজ্ঞেস করে, কি মাঝি, নাওয়ে বাদাম খাটাইবা? হামিদ বলল, না বড় মিঞাছাব, হাউরা (ঝড়ো) বাতাস ছাড়ছে। একবার এই মুখী লৌড়ায়, আবার উই মুখী। গাঙও উথালপাথাল। বাদাম খাটাইলে নাও সামাল দিতে পারুম না। হেইর থিকা বৈঠাই বাই।

যা ভালা মনে লয় হেই কর।

অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল, আশপাশ দিয়ে বেশ কিছু নৌকো চলে যাচ্ছে। কোনওটায় আলো জ্বলে, কোনওটায় জ্বলে না। সবগুলো নৌকোর যাত্রীই যে সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে তারপাশায় স্টিমার ধরতে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। কত মানুষকে কত দরকারে রাত বিরেতে নদী পাড়ি দিতে হয় তার কি কিছু ঠিক আছে? যে. নৌকোগুলো পাশ দিয়ে গেছে তাদের দিক থেকে বিপদের কারণ ঘটেনি।

মাঝরাতে বাতাস আর জলস্রোতের দাপট অনেকটা কমে যায়। বিনুর চোখে চুল লাগে। সেই সময় হঠাৎ জোরাল টর্চবাতির আলো এসে পড়ে তাদের নৌকোয়। একটা ভারী, কর্কশ গলা কানে আসে, কাগো নাও? যায় কই?

কখন যে তাদের গা ঘেঁষে একটা লম্বা ধাঁচের নৌকো পাশাপাশি চলতে শুরু করেছে, খেয়াল করেনি বিনু। তার হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি স্তব্ধ হয়ে যায় যেন। ঝাঁপসা অন্ধকারেও পাশের নৌকোয় কারা বসে আছে, তাদের কী অভিসন্ধি, বুঝতে অসুবিধা হয় না। মধ্যরাতেও ঘাতক বাহিনীর কী অফুরন্ত উদ্যম।

আফজল হোসেনও খুব সম্ভব বসে বসে ঢুলছিল। টর্চের তীব্র আলো চোখে লাগতে ধড়মড় করে ওঠে। ভুরুর ওপর হাতের আড়াল দিয়ে প্রবল ধমকানির সুরে বলে, দেখতে পাও না কাগো নাও? বাত্তি সরাও–

টর্চের মুখ অন্য দিকে সামান্য সরে যায়। সেই লোকটা ফের জিজ্ঞেস করে, কুনখানে চললেন মিঞাছাব?

হেয়া (তা) দিয়া তোমার কুন কাম? আফজল হোসেন রুখে ওঠে।

তার চোটপাট শুনে পাশের নৌকোর লোকটা সামান্য দমে যায়। বলে, ওসের (হিমের) মইদ্যে খুলা পাটাতনে বইসা আছেন ক্যান?

আফজল হোসেন বলে, ওসের মইদ্যে বইসা যামু, না গাঙ হাতইরা (সাঁতরে) যামু, হেইটা আমার ইচ্ছা। ঝট না কইরা তোমরা অহন যাও–

টর্চের আলো বিনুদের নৌকোর ওপর আগাপাশতলা পাক খেয়ে চলেছে। ঝপহীন ছইয়ের তলায় আলোটা হঠাৎ স্থির হয়ে যায়।

লোকটা জিজ্ঞেস করে, হেরা (রা) কারা?

তার মনে কি কোনও রকম খটকা দেখা দিয়েছে? দমে গিয়ে মিন মিন করে জবাব দিলে লোকটা পেয়ে বসবে। তার সন্দেহ বহুগুণ বেড়ে যাবে। গলার স্বর অনেক উঁচুতে তুলে চড়া মেজাজে আফজল হোসেন বলে, হেই খবরে কী হইব?

লোকটা শাসানির সুরে বলে, যা জিগাই তার জবাব দ্যান। বেশি তেড়িমড়ি কইরেন না।

বিনু কাঠ হয়ে বসে আছে। আফজল হোসেন কী উত্তর দেবে, কিভাবে এই নতুন সমস্যাটা সামাল দেবে, বোঝা যাচ্ছে না। তার সামান্য ভুলচুক হয়ে গেলে, পরিণতি কী হবে ভাবতে সাহস হয় না।

আফজল হোসেন গলার স্বর আগের জায়গাতেই রেখে বলে, তেড়িমমড়ি! জবানের লাগাম নাই দেখি। কার লগে ক্যামন কইরা কথা কইতে হয়, শিখ নাই! আমি মামুদপুরের ইউনান বোডের প্রেছিডাং (প্রেসিডেন্ট)। ছইয়ের তলে আমার পোলা আর হের (তার) বিবি রইছে। শুনলা তো? এইবার আমাগো ছইড়া অন্যখানে যাও–

লোকটা এবার অনেক নরম হয়। বলে, মিঞাছাব, আপনে কি জানেন, মেলা (বহু) হুমুন্দির পুতে রাইতের আন্ধারে হিন্দুগগা লইয়া গিয়া গোয়ালন্দর ইস্টিমারে তুইলা দিতে আছে। পাছে কেও দেইখা ফালায়, হেইর লেইগা বাত্তি জ্বালে না।

কে কী করতে আছে, আমার জাননের কাম নাই।

একখান পরামশ্য দেই–

কী?

কুপি কি হেরিক্যান আঙ্গাইয়া (জ্বালিয়ে) রাখেন। আমাগো লাখান আরও মেলা নাও গাঙ্গে ঘুরতে আছে। বাত্তি দেখলে হেরা (তারা) সন্দ করব না।

তুমার পরামশ্যখান মনে রাখুম। অহন মেহেরবানি কইরা যাও—

লম্বা নৌকোটা পাশ থেকে দূর কুয়াশায় আর অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

দাঁতে দাঁত ঘষে গজরাতে থাকে আফজল হোসেন, ইবলিশের ছাওরা–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *