কয়েকদিন আগে ‘রস’ আইল্যান্ড থেকে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে মিডল আন্দামানে চলে গিয়েছিল ঝিনুক। আজ যাচ্ছে এস এস সাগর-এ। কলকাতা এবং তার চারপাশের জনারণ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই মেয়েটিকে খুঁজে বেড়িয়েছে বিনয় কিন্তু বৃথাই। তারপর একদিন ধীরে ধীরে সমস্ত আবেগ, সমস্ত উৎকণ্ঠা যখন থিতিয়ে এসেছে, তীব্র ব্যাকুলতা যখন জুড়িয়ে গিয়েছে, ঝিনুকের মুখ, তার স্মৃতি যখন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল সেই সময় তাকে স্পষ্টভাবে দেখা গেল রস আইল্যান্ডে। কিন্তু তা দূর থেকে। তখন কিছুই করার ছিল না।
আর আজ? আজ এই সেলুলার জেলের বাইরে, সমুদ্রের দিকে যাওয়ার ঢালু রাস্তায় কত আলোকবর্ষ পরে কয়েক লহমার জন্য ঝিনুককে সামনাসামনি পাওয়া গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল বিনয়ের। কিন্তু আশ্চর্য, প্রথমটা তাকে চিনতেই পারেনি ঝিনুক। কথাটা ঠিক হল না। চিনতে চায়নি। সমস্ত অতীত মুছে দিয়ে নিজের নামটাও বদলে ফেলেছে। রাজদিয়ার সেই জাপানি পুতুলের মতো মেয়েটা তার চোখের সামনে ক্রমশ কিশোরী, তারপর পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছে। কখন যে জীবনের পরতে পরতে মিশে গিয়েছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে, যা গিয়েছে তার প্রতি মুহূর্তের শ্বাসবায়ুতে, নিজেও টের পায়নি বিনয়। সেই ঝিনুক তার পুরনো জীবনটা পুরোপুরি বাতিল দিয়ে হয়ে উঠেছে সীতা। ঝিনুক বলে কেউ যেন কোনও পৃথিবীতে ছিল না।
অনেক পীড়াপীড়ির পরও সেভাবে মেনে নিতে চায়নি ঝিনুক। তবু তার কথায় সামান্য একটু স্বীকারোক্তি যে ছিল না তা নয়। বলেছে, কখনও যদি তার নাম ঝিনুক থেকে থাকে কার কী এসে যায়? এই নামটার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও লাভ বা ক্ষতি কিছুই হবে না। পৃথিবী যেমন চলছে নিজের নিয়মে তেমনই চলবে। তার আহ্নিক গতি বার্ষিক গতিতে লেশমাত্র বিঘ্ন ঘটবে না।
অথচ একদিন বিনয়কে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে পারত না ঝিনুক। তাকেই ব্যগ্রভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। সেই চিরদুঃখী, আতঙ্কগ্রস্ত মেয়েটি আজ কী নিদারুণ উদাসীন, নির্বিকার, হয়তো একটু রূঢ়ও। অথচ তার জন্য কী না করেছে বিনয়? মহা সংকটের মধ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বুকের ভিতর আগলে আগলে তাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় পৌঁছবার পর তার গায়ে এতটুকু আঁচড় না লাগে সে জন্য ঢালের মতো তাকে রেখেছে। তবু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচাতে পারেনি। হেমনলিনী, অবনীমোহন এবং অন্যান্য আত্মীয়পরিজনরা অদৃশ্য আঙুল তুলে প্রতিটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছে– তুমি ধর্ষিতা, তুমি ধর্ষিতা, তোমার মধ্যে শুচিতা নেই, তুমি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছ। এসব যারা বলেছে তাদের কতজনের মুখ চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব ছিল জড়িয়ে বিনয়ের পক্ষে? তারা কি জানে না ঝিনুকের জীবনে যে অঘটন ঘটে গিয়েছে সে জন্য তার দোষ কতটুকু?
ঝিনুককে নিয়ে বিনয় যখন দিশেহারা, চারপাশ থেকে একটা দিন এই আগুনের বলয় যখন মেয়েটাকে ঘিরে ধরছিল, তাকে বাঁচাবার জন্য সুধা আর হিরণ ছাড়া অন্য কারুকে পাশে পায়নি বিনয়। অনেকটাই করেছে বিনয়রা কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। আনন্দ আর সুনীতির ইচ্ছা থাকলেও হেমনলিনীর দাপটে তাদের মুখ বুজে থাকতে হয়েছে।
ঝিনুক অপমানে, অভিমানে, তীব্র গ্লানিবোধে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর বিনয় কতটা কষ্ট পেয়েছে, চারদিক উথালপাতাল করে তাকে কত খুঁজেছে, কতদিন কত রাত তার উদভ্রান্তের মতো কেটেছে সেসব এতকাল পর ঝিনুককে কাছে পেয়ে বলতে চেয়েছিল বিনয় কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া যায়নি। তার কোনও কথাই কানে সম্পূর্ণ তোলেনি ঝিনুক। চরম উদাসীনতায় তাকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করেছে করিয়ে সে জাহাজঘাটার দিকে চলে গিয়েছিল। তার আচরণ এতটা কঠোর, এমন আবেগহীন হবে, কে ভাবতে পেরেছে!
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল বিনয়ের। বুকের ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ঝিনুক এতটা বদলে যাবে, কোনও দিন কি তা সে কল্পনা করেছে! নিদারুণ যাতনার মধ্যে হঠাৎ খেয়াল হল যে অসুস্থ বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাটিকে নিয়ে ঝিনুক পোর্টব্লেয়ারের হাসপাতালে এসেছিল তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটল কী করে? এরা কারা? এদের খোঁজ কোথায় পেয়েছে সে? প্রথমটা এইসব প্রশ্নের তালকুল খুঁজে পাচ্ছিল না বিনয়। কেমন যেন ধন্দে পড়ে গেল। আচমকা বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল নতুন ভারত-এ রিফিউজিদের জবরদখল কলোনিগুলি নিয়ে প্রতিবেদন লেখার জন্য কলকাতার চারপাশ যখন চষে বেড়াচ্ছে সেই সময় গড়িয়ার কাছাকাছি একটি কলোনির এক আধবুড়ো উদ্বাস্তু অধর ভুঁইমালীর কাছে খবর পেয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনে সে ঝিনুককে একজন বৃদ্ধের সঙ্গে বনগাঁ কিংবা কাঁচরাপাড়া লাইনের ট্রেনে উঠতে দেখেছে। অধর রাজদিয়া অঞ্চলের লোক। ছেলেবেলা থেকেই সে ঝিনুককে চেনে।
সমস্ত ব্যাপারটা এতদিনে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল বিনয়ের কাছে। ভবানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক, রোডের বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ঝিনুক নিশ্চয়ই ঘুরতে ঘুরতে শিয়ালদহে চলে গিয়েছিল। সেখানেই খুব সম্ভব বৃদ্ধটির সঙ্গে তার দেখা হয়। বৃদ্ধটিও উদ্বাস্তু। ঝিনুক তাদের কাছে আশ্রয় পায়। তারপর পুনর্বাসনের জন্য যখন ছিন্নমূল মানুষদের আন্দামানে পাঠানো হয়, বৃদ্ধদের সঙ্গে ঝিনুকও এখানে চলে আসে।
বিনয় ঈশ্বরবিশ্বাসী কি না নিজের কাছেই সেটা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবু এই মুহূর্তে যে মেয়েটি তাকে ভেঙে খানখান করে দিয়ে চলে গেছে তার সম্বন্ধে তেত্রিশ কোটি অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশ্যে বুঝি বা নিঃশব্দে জানাল; তোমাদের অপার করুণায় ঝিনুক একটি ভালো মানুষের হাতে গিয়ে পড়েছিল। দেশভাগের পর কলকাতায় হিংস্র সরীসৃপের মতো মেয়ের দালালেরা আর লুচ্চার পাল চারদিকে ওত পেতে আছে। অরক্ষিত কোনও উদ্বাস্তু যুবতীকে দেখলেই ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে নরকের খাসতালুকে। ঝিনুকের সেই চরম দুর্ভাগ্য হয়নি। তোমরাই তাকে রক্ষা করেছ।
এদিকে বাঁ ধারে, অনেকটা দূরে, মাউন্ট হ্যারিয়েটের চুড়োটার ওপাশে সূর্য বেশ কিছুক্ষণ আগেই নেমে গিয়েছিল। দিনের শেষ মলিন আলোটুকু দ্রুত মুছে যাচ্ছে। ঝাপসা হালকা অন্ধকারের সঙ্গে নেমে আসছে ফিনফিনে কুয়াশা! আঁধারে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জ। যেটুকু আলো এখনও রয়েছে তাতে মাউন্ট হারিয়েটের মাথায় ধবধবে বিশাল ক্রশটা কিন্তু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
শয়ে শয়ে সি-গাল পাখি সারাদিন সমুদ্রের উপর চক্কর দিয়ে বেড়ায়। এখন তারা ডানা ঝাঁপটে পাড়ের দিকে চলেছে। এটা তাদের ঘরে ফেরার সময়। সেই ভোর থেকে সূর্যাস্ত অবধি উপসাগরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সার্ডিন, হাঙরের বাচ্চা কী ছোট ছোট চাদা মাছ ধারালো ঠোঁটে তুলে এনে খেয়েছে। পেট ভরতি। পরিতৃপ্ত সিন্ধুশকুনেরা নিত্যকর্ম সেরে এবার পাড়ের কোনও গাছের ডালে রাত কাটাবে। পরদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফের বেরিয়ে পড়বে উপসাগরের দিকে। সমস্ত দিন ধরে চলবে মাছ শিকার আর খাওয়া। পাখিগুলির পেটে রাহুর খিদে।
অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না বিনয়ের। সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন।
ঝিনুকদের জাহাজটা সিসোস্ট্রেস বে ছাড়িয়ে যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে সেখানে একদিকে অফুরান বঙ্গোপসাগর; অন্য দিকে ছোট-বড় অনেকগুলি দ্বীপ। স্টিমশিপ সাগর এক সময় ছোট হতে হতে একটি আবছা বিন্দুর মতো দ্বীপগুলির আড়ালে। মিলিয়ে গেল।
উপসাগরের দিক থেকে বিকালে বা সন্ধেয় প্রবল হাওয়া উঠে আসে। আজও আসছিল। ঠান্ডা, আরামদায়ক বাতাস। বিনয়ের খেয়াল হল, অনেকক্ষণ সে পাহাড়ের ঢালের এই রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে শেখরনাথ হয়তো ফিরে এসেছেন। তিনি বলে গিয়েছিলেন, বিনয় যেন আজ যতটা পারে সেলুলার জেলটা ঘুরে ঘুরে দেখে। ঘণ্টাখানেক বা ঘণ্টা দেড়েকের ভিতর বিশাল ওই বন্দিশালার কতটুকুই বা দেখা সম্ভব? পরে পুরো দু তিনটে দিন তাকে সঙ্গে নিয়ে যতগুলি ব্লক আছে সব দেখিয়ে দেবেন।
কিন্তু আজ প্রায় কিছুই দেখা হয়নি। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে জেলের থমথমে ভীতিকর চেহারার গেট পেরিয়ে বিনয়। চলে এসেছিল বাইরের রাস্তায়। আর সেখানেই দেখা হয়ে গিয়েছে ঝিনুকের সঙ্গে। কতকালের চেনা এই ঝিনুক কিন্তু আজ মনে হল কত অচেনা। সে যেন অজানা গ্রহের কোনও মানুষ। অথচ তার সঙ্গে দেখা হোক, এই তীব্র বাসনাটা মনের কোনও নিভৃত কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিল, এমনকী ঝুমা তার কাছাকাছি এসে পড়ার পরও। কত দুঃখ, কত যাতনাইনা এই মেয়েটির জন্য সে সয়েছে৷ কিন্তু এরকম একটা দেখা হবে সে জন্য সে কি আদৌ প্রস্তুত ছিল? টের পাচ্ছিল উতরোল বুকের তলদেশে অবিরল শেল বিধে যাচ্ছে৷
ক্লান্ত, বিপর্যস্ত বিনয় আর দাঁড়াল না; ঢালু রাস্তার চড়াই বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে এল। তারপর সেলুলার জেলের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে সোজা হাসপাতালের দোতলায়।
এখন চারদিকে আলো জ্বলছে।
একপাশে সারি সারি কুঠুরি; এক সময় যা ছিল কয়েদিদের সেল। সেগুলির সামনে দিয়ে টানা চওড়া রেলিংগুলি প্যাসেজ দোতলার এক মাথা থেকে বহুদূরে শেষ মাথা অবধি চলে গেছে।
প্যাসেজে খানিকটা পর পর বসার জন্য বেঞ্চি পাতা। কিছুক্ষণ আগে এখানে প্রচুর লোকজন থিক থিক করছিল। তারা ছিল ভিজিটর; হাসপাতালে ভরতি রোগীদের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব। তাদের বেশিরভাগই চলে গিয়েছে, ভিড় এখন বেশ হালকা। এখানে-ওখানে সামান্য কয়েকজনকে দেখা যায়।
বিনয় যখন শেখরনাথের সঙ্গে নিচে নেমে যায় র স্ত্রী ছেলেমেয়েরা প্যাসেজের একটি বেঞ্চে যেমন বসে ছিল ঠিক তেমনি জড়সড় হয়ে বসে আছে। পাংশু, শীর্ণ, উৎকণ্ঠিত সারি সারি মুখ। শেখরনাথকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্ট থেকে পুনর্বাসন দপ্তরের যে কর্মীরা কে ধরাধরি করে নিয়ে এসেছিল তারা শেখরনাথদের কাছাকাছি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফাঁকা বেঞ্চের উপর দুটো বড় ডেকচিতে ভঁই করা আটার রুটি আর আলু, কুমড়ো এবং নানারকম সবজি দিয়ে তৈরি ঘাট ছাড়াও রয়েছে শালপাতার একগোছা থালা।
বিনয় আন্দাজ করে নিল শেখরনাথ তার ভাইপো বিশ্বজিৎ রাহার সঙ্গে দেখা করে খাবারদাবার নিয়ে ফিরে এসেছেন। এতগুলি মানুষ সেই কোন সকালে মোহনবাঁশিকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছিল; সারাদিনে তাদের পেটে একফোঁটা জলও পড়েনি। খিদেয় নাড়ি চুঁইয়ে যাচ্ছে। একে দুর্ভাবনা, তার উপর সারাদিন না খাওয়া। ওরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে– বিরাট সমসা। দেখা যাচ্ছে, শেখরনাথের সব দিকে নজর।
বিনয় ভেবেছিল, জারোয়াদের তিরে মারাত্মক জখম হওয়ার খবরটা পেয়ে বিশ্বজিৎ তক্ষুনি চলে আসবেন। কেননা ছিন্নমূল মানুষগুলির প্রতি তার কত যে সহানুভূতি! তিনি না আসায় রীতিমতো অবাকই হল বিনয়।
ওদিকে শেখরনাথের কথামতো পুনর্বাসনের একজন কর্মী শালপাতার থালায় রুটি-তরকারি সাজিয়ে মোহন বাঁশির স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
মোহনবাঁশির স্ত্রীর কপালের আধাআধি অবধি ঘোমটা টানা। করুণ সজল দৃষ্টিতে একবার শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে তক্ষুনি চোখ নামিয়ে নিল। ছেলেমেয়েগুলি বোবার মতো তাকিয়ে রইল শুধু। তারা কেউ খাবারের থালাগুলি ধরল না। হাত গুটিয়ে সবাই বসে থাকে।
শেখরনাথ নরম গলায় বললেন, কী হল, নাও
ঢোক গিলে শুকনো গলায় মোহনবাঁশির স্ত্রী বলল, খাওনের ইচ্ছা নাই৷ জবর তরাস (ভয়) লাগতে আছে।
ছেলেমেয়েরা কিছু বলল না।
শেখরনাথ তাদের মনোভাব আঁচ করে নিয়েছেন। বললেন, ভয় পেলে চলবে? মনে জোর রাখতে হবে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, মোহনর্বাশি বেঁচে যাবে। শেষ কথাগুলি সাহস দেওয়ার জন্য। ডাক্তার চট্টরাজ ঠিক এতখানি ভরসা দেননি। তিনি বলেছেন, মোহনবাঁশির প্রাণরক্ষার জন্য তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। হয়তো লোকটা বেঁচে যাবে। তবে সবই নির্ভর করছে অপারেশনের পর। ব্যস, এটুকুই।
ডাক্তার চট্টরাজ যা বলেছেন হুবহু তা জানালে মোহনবাঁশির স্ত্রী ছেলেমেয়েরা আরও ভেঙে পড়বে। তারা কিছুতেই খাবে না; একরকম জোরজার করে নিজে তাদের হাতে খাবারের থালাগুলি ধরিয়ে দিলেন শেখরনাথখাও বলছি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও, নিঃশব্দে খাওয়া শুরু হল।
শেখরনাথ এবার পুনর্বাসন কর্মীদের দিকে ফিরলেন। সারাদিন তোমাদের যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। না খাওয়া, না চান। তার উপর পাহাড়ি রাস্তায় ট্রাকের ঝাঁকুনি। নাও নাও, রুটিটুটি তুলে নিয়ে খেতে শুরু কর।
পুনর্বাসনের কর্মীরা সামান্য ইতস্তত করে বলল, কাকা, আপনে খাইবেন না?
আমার জন্য ভেবো না। বিশুর কাছে গিয়েছিলাম। সে আমাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে আর তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। বলতে বলতে শেখরনাথের নজর এসে পড়ল বিনয়ের উপর।–আরে, তোমার কথা একেবারেই খেয়াল ছিল না। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
ঝিনুকের ব্যাপারটা না জানিয়ে ভাসা ভাসা জবাব দিল বিনয়।–আপনি সেলুলার জেলটা দেখতে বলে গিয়েছিলেন। এধারে-ওধারে ঘুরে তাই দেখছিলাম।
কী দেখেছে তা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না শেখরনাথ। তাড়া দিয়ে বললেন, সারাদিনে তোমারও তো কিছু খাওয়া হয়নি। রুটি-তরকারি খেয়ে নাও
খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে শেখরনাথ পুনর্বাসন কর্মীদের বললেন, এবার তোমরা তোমাদের আস্তানায় চলে যাও। ভালো করে বিশ্রাম নাও। আর তোমাদের হাসপাতালে আসতে হবেনা। কাল সকালে উঠে সোজা জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্টে চলে যাবে। মোহনবাঁশির ব্যাপারটা আমরা দেখব।
বিনয় আগেই জেনেছিল, পোর্টব্লেয়ারের এবারডিন মার্কেটের পাশে রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট একটা বড় বাড়ি। ভাড়া নিয়েছে! কলকাতা থেকে নতুন উদ্বাস্তুরা এলে সেখানে তারা দু-এক দিন থাকে। তারপর তাদের সাউথ আন্দামানের নানা এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুধু কলকাতা থেকে আসা উদ্বাস্তুরাই নয়, পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সুদূর সেটলমেন্টগুলি থেকে কোনও প্রয়োজনে পোর্টব্লেয়ারে এলে তারাও এখানে কাটিয়ে যায়।
জেফ্রি পয়েন্ট থেকে মোহনবাঁশিকে নিয়ে যে কর্মীরা এসেছিল তারা চলে গেল। মোহনবাঁশির স্ত্রী ছেলেমেয়েরা যেখানে বসে আছে তাদের সেখানে অপেক্ষা করতে বলে শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, চল, ডাক্তার চট্টরাজের সঙ্গে দেখা করে পেশেন্টের এখনকার হাল জেনে নিই। এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই মোহনবাঁশির ট্রিটমেন্টের সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারটি কোনাকুনি ডানধারে খানিকটা দূরে। সেদিকে যেতে যেতে বিনয় জিজ্ঞেস করল, এমন একটা মারাত্মক ঘটনার খবর পেয়েও রাহাসাহেব এলেন না কেন? ভেবেছিলাম– বাকিটা শেষ না করে থেমে গেল সে।
শেখরনাথ বললেন, ওর আসার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সন্ধেবেলায় চিফ কমিশনার রিহ্যাবিলিটেশনের কজন। অফিসারকে তার বাংলোয় ডেকেছেন। তাই আসতে পারল না। হাসপাতালের কাজ চুকলে মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়ে আর তোমাকে তার বাংলোয় নিয়ে যেতে বলেছে। যে কদিন পোর্টব্লেয়ারে আছি, তার বাংলোতেই থাকব।
বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না।
ডাক্তার চট্টরাজ তার চেম্বারেই ছিলেন। মোহনবাঁশিকে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভরতি করা হয়েছিল। ডাক্তার চট্টরাজকে দেখে মনে হল, তাকে দেখে একটু আগে ফিরে এসেছেন। চুল এলোমেলো, কেমন একটু চিন্তাগ্রস্ত, অস্থির অস্থির ভাব। লক্ষণটা ভালো লাগল না বিনয়ের।
শেখরনাথ আর বিনয়কে দেখে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার চট্টরাজ। টেবিলের এধারে সারি সারি চেয়ারগুলি দেখিয়ে বললেন, বসুন বসুন–
শেখরনাথ জিজ্ঞেস করলেন, মোহনবাঁশিকে তোমার হাতে দিয়ে আমি বিশুর কাছে গিয়েছিলাম। এক ঘণ্টার বেশি কেটে। গেছে। ওর কন্ডিশন কীরকম বুঝছ?
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইলেন ডাক্তার চট্টরাজ। তারপর সোজা শেখরনাথের দিকে তাকালেন। খুবই সিরিয়াস কাকা।
দুর্ভাবনার ছায়া পড়ল শেখরনাথের চোখেমুখে। কীরকম?
ডাক্তার চট্টরাজ জানালেন, জারোয়াদের তির মোহনবাঁশির ফুসফুসে ঢুকে গেছে। সেটা ভীষণ বিপজ্জনক। তিরটা বার করতে গিয়ে যদি ভিতরে রক্তক্ষরণ হয় লোকটাকে বাঁচানো যাবে কি না বলা মুশকিল।
নীরবে বসে রইলেন শেখরনাথ। তার উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। বিনয়েরও।
বেশ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, যে অবস্থায় মোহনবাঁশিকে নিয়ে এসেছিলেন তিরটা ঠিক সেইরকম বিধে আছে। ওটা বার না করলেই নয়। কিন্তু আজ তা সম্ভব না।
রুদ্ধশ্বাসে শেখরনাথ জানতে চাইলেন, কেন?
তিরটা বার করার জন্য আমার দুজন অ্যাসিস্টান্ট সার্জন দরকার। তেমন কেউ আপাতত হাসপাতালে নেই। ডাক্তার চট্টরাজ বলতে লাগলেন, আপনি তো জানেন কাকা, আমাদের এখানে প্রয়োজনের তুলনায় স্টাফ কম। বিশেষ করে ডাক্তার। কলকাতা বা মাদ্রাজ থেকে কোনও ডাক্তার এখানে চাকরি নিয়ে আসতে চায় না। মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে এত বড় হাসপাতাল চালাতে হচ্ছে। আমার দুজন ব্রাইট ইয়াং সহকর্মী দুসপ্তাহ আগে কার নিকোবরে গেছে। সেখানে কটা ক্রিটিকাল অপারেশন সেরে কাল সকালে তাদের ফেরার কথা। ওরা এসে পৌঁছুলেই তিরটা বার করব।
যদি কোনও কারণে ওঁদের না আসা হয়, তা হলে?
সেটা বিরাট সমস্যা। আশা করছি এসে যাবে। না এলে আমাকেই যা করার করতে হবে। রিস্ক হবে ঠিকই, কিন্তু সেটা না নিয়ে উপায় নেই।
গভীর উদ্বেগের সুরে শেখরনাথ বললেন, আজ সকালের দিকে তির বিঁধেছে। সেই অবস্থায় সারাদিন কেটেছে, রাতটাও কাটবে। আমার কিন্তু একেবারেই ভালো মনে হচ্ছে না।
ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, যাতে ইনফেকশন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য দুটো ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। রাত্তিরে আরও দুটো। দেওয়া হবে। একটাই সুলক্ষণ, ফুসফুসের ফাংশন বন্ধ হয়ে যায়নি। মোহনবাঁশি বেঁচে আছে, তবে চেষ্টা করেও জ্ঞান ফেরাতে পারিনি! ভাববেন না কাকা, আজকের রাতটা আমি হাসপাতালে মোহনবাঁশির কাছে থাকব। কোয়ার্টারে ফিরব না।
একটু চিন্তা করে শেখরনাথ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী মনে হয়, আমার হাসপাতালে থাকা দরকার? তা হলে মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়ে আর বিনয়কে বিশুর বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসব।
মোহনবাঁশি পূর্ব পাকিস্তানের একজন সামান্য উদ্বাস্তু, যার সঙ্গে লেশমাত্র সম্পর্ক নেই, সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, জেফ্রি পয়েন্টে আসার আগে তাকে কোনও দিন দেখেননি, তবু তার প্রতি কী গভীর মমতা শেখরনাথের। কতখানি তীব্র উদ্বেগ! বয়স তো কম হয়নি, তার উপর সেই সকাল থেকে শরীরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। সেসব অগ্রাহ্য করে তিনি কি না মোহনবাঁশির জন্য হাসপাতালে রাত কাটাতে চাইছেন! অগ্নিযুগের এই বিপ্লবী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা শতগুণ বেড়ে গেল বিনয়ের। অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
এদিকে ডাক্তার চট্টরাজ ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।–না না কাকা, আপনাকে এখানে এসে রাত জাগতে হবে না। হাসপাতালে তো আপনার কিছু করার নেই। বাহা সাহেবের বাংলোয় গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ুন। বয়স হয়েছে, ঘুমটা কিন্তু আপনার খুব দরকার। কাল বেলার দিকে এসে মোহনবাঁশির। খবর নেবেন।
ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, বিশুর ওখানে চলেই যাই। কিন্তু ঘুমোতে কি আর পারব? মোহনবাঁশির জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে ডাক্তার। বলতে বলতে উঠে পড়লেন।
বিনয়ও আর বসে থাকল না। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের প্যাসেজে বেরিয়ে এলেন শেখরনাথ। নিচু গলায় বললেন,ডাক্তারের সঙ্গে যা কথা হল, মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েদের কিন্তু বোলো না। শুনলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। যা বলার আমিই ওদের বলব।
বিনয় আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল। আচ্ছা।
মোহনবাঁশির পুরো পরিবারটি যেখানে বসে ছিল সেখানে আসতেই তার স্ত্রী ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। শুষ্ক, শীর্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারবাবু কী কইল? মানুষটা কেমুন আছে?
মানুষটা বলতে মোহনবাঁশি। উত্তর দিতে গিয়ে একটু যেন থেমে গেলেন শেখরনাথ। তারপর বললেন, ইঞ্জেকশন, ওষুধ সবই দেওয়া হয়েছে। ভয়ের কারণ নেই।
মোহনবাঁশির স্ত্রী গেঁয়ো মেয়েমানুষ। দেশভাগের আগে পূর্ববাংলায় তাদের নিজেদের গ্রাম এবং তার চারপাশের কয়েকটি গ্রামগঞ্জের বাইরে কোনও দিন পা বাড়ায়নি। নিরক্ষর হলেও সে নির্বোধ নয়, মুখ দেখে মনের কথা হয়তো পড়তে পারে। একদৃষ্টে সে শেখরনাথকে লক্ষ করছিল। চোখের পাতা পড়ছিল না তার। বলল, আপনে ঠিক নি কন?
শেখরনাথ ভিতরে ভিতরে খুব সম্ভব বিব্রত বোধ করলেন। লহমায় তা সামলে নিয়ে বললেন, বেঠিক বলব কেন? এখন চল
না, আমাগো যাইতে কইয়েন না। মনে বড় কুড়াক ডাকতে আছে। আমরা এহানেই থাকুম। অন্য কুনোহানে যামু না।
এখানে কোথায় থাকবে?
এই কাঠের পাটায় বেঞ্চে) বইয়া (বসে) থাকুম।
খুব দরকার না হলে রোগীর বাড়ির লোকেদের হাসপাতালে রাত্তিরে থাকতে দেয় না। তেমন বুঝলে ডাক্তারবাবু তোমাদের থাকতে বলতেন৷ বলে একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ওপর তোমাদের ভরসা আছে তো?
নিয্যস (নিশ্চয়ই)। আপনেরা ছাড়া এই দ্বীপি আমাগো আপনাজন (আপনজন) আর কে আছে?
তা হলে চল।
অনেক বোঝানোর পর প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মোহনবাঁশির স্ত্রীকে রাজি করানো গেল। শেখরনাথ বিশ্বজিতের একটি জিপ নিয়ে এসেছিলেন। দোতলা থেকে নেমে নিচের বিশাল চত্বরে এসে মোহনবাঁশির গোটা পরিবার এবং বিনয়কে নিয়ে জিপে উঠে পড়লেন শেখরনাথ।