উৎসর্গ : তাঁদের প্রতি
যাঁদের সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়,
ইসলামের সত্যবাণী
উদ্ভাসিত হয়েছে বিশ্বময়॥
ভূমিকা
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের ঐ তলোয়ারের নাম যা কাফেরদের বিরুদ্ধে চিরদিন খোলা থাকে। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সাইফুল্লাহ্’ – ‘আল্লাহর তরবারী’– উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি নাম করা ঐ সকল সেনাপতি সাহাবীদের অন্যতম যাদের অবদানে ইসলামের আলো দূর-দূরান্তে পৌঁছতে পেরেছে। শুধু ইসলামী ইতিহাস নয়; বিশ্ব সমরেতিহাসও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের কাতারে গণ্য করে থাকে। প্রখ্যাত সমরবিদ, অভিজ্ঞ রণকুশলী এবং স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞগণও হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রণকৌশল, তুখোর নেতৃত্ব, সমরপ্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতীত্ব এবং বিচক্ষণতার স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।
প্রতিটি রণাঙ্গণে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। কাফেরদের সংখ্যা কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও তিনগুণ। ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোম সম্রাট এবং তার মিত্র গোত্রসমূহের সৈন্য ছিল ৪০ হাজারের মত। শত্রুর সৈন্য সারি সুদূর ১২ মাইল প্রলম্বিত, এর মধ্যে কোথাও ফাঁক ছিল না। অপরদিকে, মুসলমানরা (শত্রুবাহিনীর দেখাদেখি) নিজেদের সৈন্যদের ১১ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। তাও প্রতি দু’জনের মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান ছিল।
শত্রু সৈন্যের বিন্যস্ত সারিও বৃহদাকার ছিল। সৈন্যরা একের পর এক সাজানো ছিল। একজনের পিছনে আরেকজন দাঁড়ানো। যেন একটি প্রাচীরের পিছনে আরেক প্রাচীর খাঁড়া। এর বিপরীতে মুসলমানদের সৈন্য বিন্যাসের গভীরতা ছিল না বললেই চলে।
ইতিহাস মুক। সমর বিশেষজ্ঞগণ বিস্মিত। সকলের অবাক জিজ্ঞাসা– ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমীয়দের কিভাবে পরাজিত করল? রোমীয়দের সেদিন চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছিল। এ অবিশ্বাস্য ঘটনার পর বাইতুল মুকাদ্দাস পাকা ফলের মত মুসলমানদের ঝুলিতে এসে পড়েছিল।
এটা ছিল অভূতপূর্ব সমর কুশলতার ফল। ইয়ারমুক যুদ্ধে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে সফল রণ-কৌশল অবলম্বণ করেছিলেন আজকের উন্নত রাষ্ট্রের সেনা প্রশিক্ষণে গুরুত্বের সাথে তা ট্রেনিং দেয়া হয়।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এটা মানতে রাজি ছিলেন না যে, দুশমনের সৈন্যসংখ্যা বেশী হলে এবং তাদের রণসম্ভার অত্যাধুনিক ও উন্নত হলে আর মুসলমানরা সংখ্যায় কম হলে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া উদ্বেগজনক ও আত্মঘাতী হবে। এমন ঘটনাও তার বর্ণাঢ্য জীবনে ঘটেছে যে, তিনি সরকারী নির্দেশ এড়িয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করে শাসরুদ্ধকর বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এটা তাঁর প্রগাঢ় ঈমান এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের ফসল ছিল। ইসলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অগাধ ভালবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল।
এছাড়া হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। যে কোন পাঠক শ্রোতাই তাতে চমৎকৃত হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করলে তিনি এতটুকু বিচলিত কিংবা ভগ্নাহত হননি। খলিফার নির্দেশের সাথে সাথে সেনাপতির আসন থেকে নেমে গেছেন সাধারণ সৈনিকের কাতারে। সেনাপতি থাকা অবস্থায় যেমন শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করেছেন, সৈনিক অবস্থায় তার থেকে মোটেও কম করেননি। ইয়ারমুক যুদ্ধশেষে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এক অভিযোগে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদীনায় তলব করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় এসে উপস্থিত হন এবং আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সেনাপতির সাথে ‘অসেনাপতিসুলভ’ আচরণ করলেও হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতিক্রিয়া এমন শান্ত ছিল যে, হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এর জন্য একটুও চাপের সম্মুখীন হতে হয়নি। তিনি অবনত মস্তকে খলিফার নির্দেশ শিরোধার্য বলে মেনে নেন। প্রদত্ত শাস্তি অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেন।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-বরখাস্তের দরুণ দুঃখিত হন ঠিকই কিন্তু তাই বলে খলিফার বিরুদ্ধে তিনি টুশব্দটি করেননি। খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কল্পনাও মাথায় আনেননি। নিজস্ব বাহিনী তৈরী করেননি। পৃথক রণাঙ্গন সৃষ্টি করেননি। তিনি এমন কিছু করতে চাইলে পুরো সেনাবাহিনী থাকত তাঁর পক্ষে। জাতির চোখে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইতোমধ্যে দু’টি বিশাল সমরশক্তিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ায় তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এক ছিল পরাক্রমশালী ইরানী শক্তি আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অপর পরাক্রমশালী রোম শক্তি। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে চরম নাকানি-চুবানি খাইয়ে পরাজিত করে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমা ইরাক এবং সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। খেলাফতের প্রতি ছিল তার অসীম শ্রদ্ধা। তিনি খলিফার সিদ্ধান্তে রুখে দাঁড়ান না। তিনি নিজের সম্মান-মর্যাদার কথা বিবেচনা না করে মাননীয় খলিফার মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিচয়, ইসলামের প্রতি তার অবদান এবং বর্তমান মুসলমানরা তার থেকে কি আদর্শ গ্রহণ করতে পারে–বক্ষমান উপন্যাসে পাঠক তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারবেন।
ইসলামের ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার কোন কোন ঘটনায় পদস্খলনের শিকার হয়েছেন। একই ঘটনা একাধিকরূপে চিত্রিত হয়েছে। ফলে তা হতে সত্য ও বাস্তব তথ্য আহরণ পাঠকের জন্য গলদঘর্মের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।…
এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য-সঠিকরূপে পেশ করতে আমরা বহু গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। সম্ভাব্য যাচাই-বাছাই করেছি এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা লিখেছি। মাঝে মাঝে এমন স্থানে এসে হোচট খেয়েছি যে, কোনটা বাস্তবভিত্তিক আর কোনটা ধারণা নির্ভর–তা শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের উপর ভিত্তি করে বাস্তবতা উদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছি। এ কারণে মতান্তর ঘটবে; আর তা ঘটাই স্বাভাবিক। তবে এ মতবিরোধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং অপ্রসিদ্ধ ঘটনায় গিয়ে প্রকাশিত হবে মাত্র।
যে ধাঁচে এ বীরত্ব-গাঁথা রচিত, তার আলোকে এটাকে কেউ উপন্যাস বললে বলতে পারে, কিন্তু এটা ফিল্মি স্টাইল এবং মনগড়া কাহিনী ভরপুর বাজারের অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত নয়। এর পাঠক উপন্যাসের চাটনিতে ‘ঐতিহাসিকতার পথ্য’ গলধঃকরণ করবেন গোগ্রাসে। এতে ঐতিহাসিকতা বেশী, ঔপন্যাসিকতা কম।
এটা কেবল ইতিহাস নয়, ইসলামী ঐতিহ্যের অবয়ব। মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত ঝাণ্ডা। পূর্বপুরুষের গৌরব-গাঁথা এবং মুসলিম জাতির জিহাদী জযবার প্রকৃত চিত্র। পাঠক মুসলিম জাতির স্বকীয়তা জানবেন, সাহিত্যরস উপভোগ করবেন এবং রোমাঞ্চ অনুভব করবেন।
বাজারের প্রচলিত চরিত্রবিধ্বংসী উপন্যাসের পরিবর্তে সত্যনির্ভর এবং ইসলামী ঐতিহ্যজাত উপন্যাস পড়ুন। পরিবারের অপর সদস্যদের পড়তে দিন। নিকটজনদের হাতে হাতে তুলে দিন মুসলিম জাতির এ গৌরবময় উপাখ্যান।
এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ
লাহোর, পাকিস্তান
.
প্রকাশকের মিনতি
▶ সম্মানিত পাঠকবৃন্দের প্রতি এটি আমাদের একটি আনন্দঘন আয়োজন। মজাদার পরিবেশনা। ইতিহাসের উপাদান, সাহিত্যের ভাষা আর উপন্যাসের চাটনিতে ভরপুর এর প্রতিটি ছত্র। শাসরুদ্ধকর কাহিনী ঝরঝরে বর্ণনা আর রুচিশীল উপস্থাপনার অপূর্ব সমন্বয় আপনার হাতের এই নাঙ্গা তলোয়ার।
▶ পাঠক অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। লাভ করবেন অনাবিল আনন্দ। তুলবেন তৃপ্তির ঢেকুর। নাঙ্গা তলোয়ারের ১ম ও ২য় খণ্ডের আত্মপ্রকাশের এ শুভ মুহূর্তে আমরা এ ব্যাপারে গভীর আশাবাদী।
▶ শমশীরে বে-নিয়াম-এর ভাষান্তর নাঙ্গা তলোয়ার, মূল লেখক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ। পাকিস্তানের জনপ্রিয় এই লেখকের সাথে বাংলাদেশের পাঠকবৃন্দকে নতুন করে পরিচয় করানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে আমাদের মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার জ্ঞানদীপ্ত হাতের একাধিক উপন্যাস বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলার জনগণ এমন ঔপন্যাসিক পেয়ে বড়ই গর্বিত এবং আনন্দিত। এর জলন্ত প্রমাণ হলো – তার কোন উপন্যাস ছেপে বাজারে আসতে দেরী, ছাপা ফুরাতে দেরী না।
▶ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ-এর এমনি একটি অনবদ্য উপন্যাস শমশীরে বে-নিয়াম যা এখন বাংলায় অনূদিত হয়ে নাঙ্গা তলোয়ার নামে আপনার হাতে।
▶ সবটুকু মেধা, যোগ্যতা, অধ্যাবসায় সেঁচে পাঠকের রুচিসম্মত মুক্তা-মানিক্য উপহার দিতে আমরা একটুও কার্পণ্য করিনি। ভুল-ভ্রান্তি এড়িয়ে যাবার প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছি। পাঠক এ গ্রন্থ হতে জানতে পারবে মর্দে মুজাহিদ সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুম-দের ঈমানদীপ্ত চেতনা, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দুঃসাহসিক অভিযান ও বীরত্বগাঁথা। এবং লাভ করবেন মুসলিম মানসের দৃঢ়চেতা মনোবল। পাঠক সামান্যতম উপকৃত হলেও আমাদের শ্রম সার্থক হবে। অনুবাদের মূল উদ্দেশ্য পাবে বাস্তবতা। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমীন!
.
॥ এক ॥
সুন্দর-সুরম্য নগরী তায়েফ। বাগিচাঘেরা লোকালয়। সবুজ-শ্যামলিমায় ভরপুর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক। ফুরফুরে শীতল স্নিগ্ধ বায়ুরা মর্মর আওয়াজ তুলে সর্বদা সেখানে নেচে বেড়ায়। সুকণ্ঠ পাখিরা শিস দিয়ে যায়। ইথারে-পাথারে কম্পন জাগে। আকর্ষণীয় ও মোহময় হয়ে ওঠে পরিবেশ। কলোলিত এবং মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
সারি সারি কাঁদি ঝুলানো খর্জুর বিথীকায়। থোকা থোকা সুস্বাদু আঙ্গুর মাচায় মাচায়। ফুলের সৌরভ আর ফলের ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ। ঝাঁকে ঝাঁকে মক্ষিকারা উল্লাসে গুঞ্জরিত। বাতাসে বাতাসে ফুল-ফলের আকুল করা কাঁচা ঘ্রাণ। আকাশের পাখিরা উড়ার পথে এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। ব্যস্ত মুসাফিরের দৃষ্টিও এখানে এসে ক্ষণিকের জন্য আটকে যায়। কলোলিত মুকুলিত মুখরিত এই উদ্যানে এলে চরম দুঃখীও তার দুঃখ ভুলে যায়। বিরহী হৃদয়ে সান্ত্বনা পায়। বিধবা চোখে আলো দেখে। ইয়াতীমের মুখে হাসি ফোটে। হতাশা দূর হয়। বিষাদিত হৃদয়ে হর্ষের তরঙ্গ ওঠে। অশ্রুসজল চোখের পাতায় আনন্দধারা খেলা করে। মলিন ঠোঁটে জাগে হাসির আভা। চেহারার কালো আবরণ দূর হয়ে প্রফুল্লতা ঝিকমিক করে।
তৎকালে তায়েফ ছিল ভূ-স্বর্গ। মরুভূমির শোভা। চারদিকে অথৈ বালুর পাহাড় আর সারি সারি টিলা অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে তায়েফ যেন কণ্ঠাহারের লকেট। এই ভূস্বর্গটি আরবের বিখ্যাত যুদ্ধবাজদের দখলে ছিল। এখানেই ছিল দুর্ধর্ষ ছাকীফ গোত্রের হেডকোয়ার্টার। বসতির কাছেই ছিল গোত্রীয় উপাসনালয়। বনু ছাকীফ, হাওয়াযিন সহ আরো কয়েকটি গোত্রের দেবতা ‘লাত’-এর মূর্তি এখানে স্থাপিত ছিল। এটা মূলত কোন আকৃতিগত প্রতীমা ছিল না; বরং একটি প্রশস্ত চত্বর ছিল মাত্র। মানুষ এ প্রান্তরের চত্বরকেই দেবতা মনে করে তার পূজা-অর্চনা করত।
উপাসনালয়ে অত্র এলাকার সন্ন্যাসীও থাকত। মানুষ তাকে খোদা এবং দেবতা ‘লাত’-এর দূত মনে করত। সন্ন্যাসীর কাজ ছিল শুভাশুভ নির্ণয়ের মাধ্যমে অনাগত বিপদ থেকে মানুষকে সতর্ক করা। সে সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকত। কালে ভদ্রে হয়ত কেউ তার দেখা পেত। উপাসনালয়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন ছাড়া সাধারণ মানুষের সাথে তার দেখা হত না। ভাগ্যক্রমে কেউ তাকে দেখলে সে অত্যন্ত আনন্দিত হত। যেন সে স্বয়ং খোদাকেই দেখার দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছে। দেবতা তায়েফে থাকায় মানুষের দৃষ্টিতে তায়েফের এক ভিন্ন মর্যাদা ছিল। সবাই এ ভূমিকে পবিত্রভূমি বলে সম্মান করত।
মাত্র এক মাস পূর্বে তায়েফে অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান হয়েছিল। স্বাগতিক এলাকার সর্বোচ্চ নেতা মালিক বিন আওফ তার গোত্রের অনুরূপ আরেকটি শক্তিশালী গোত্র হাওয়াযিন এবং আরো কয়েকটি গোত্রের নেতৃবৃন্দকে এক বিরাট ভোজসভায় আমন্ত্রণ করেছিল। আনুষ্ঠানিক মনোজ্ঞ করতে বাছাই করা সুন্দরী নর্তকী এবং শিল্পীদের আনা হয়েছিল। তাদের নৃত্য নৈপুণ্য এবং সুর-লহরী শ্রোতাদের দারুণ মুগ্ধ ও তন্ময় করেছিল। সে রাতে মদের বোতল একের পর এক শুধু খালিই হচ্ছিল।
শ্রোতা মাতানো রাতের সে অনুষ্ঠান মালিক বিন আওফের অঙ্গুলি হেলনে থমকে গিয়েছিল। বিভিন্ন গোত্রের নেতৃবৃন্দ আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনার পর সে রাতে এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় যে, আচমকা আক্রমণ করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মক্কার মুসলমানদের চিরদিনের জন্য খতম করে দিবে। বয়োবৃদ্ধ এক নেতা দুরায়দ বিন ছম্মাহ সেদিন আহ্বান করেছিল—চল, দেবতা লাতের নামে শপথ করি যে, মক্কার মূর্তিবিনাশী মুহাম্মদ এবং তার চেলা-চামুণ্ডাদের খতম করেই তবে আমরা স্ত্রীর সামনে যাব।
ত্রিশ বছর বয়সী মালিক বিন আওফ সেদিন আবেগে ফেঁটে পড়ছিল। সে বড় দৃঢ়তার সাথে বলেছিল, এবারের বহুজাতিক বাহিনী মক্কায় মুসলমানদের অজ্ঞাতেই তাদের টুটি চেপে ধরবে।
সে রাতে মালিক বিন আওফ, দুরায়দ বিন ছম্মাহ এবং অন্যান্য গোত্রের নেতৃবৃন্দ এলাকার সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েছিল। তারা সন্ন্যাসীর কাছে দুটি বিষয় জানতে চেয়েছিল।
১. মক্কায় গিয়ে মুসলমানদের অজ্ঞাতে তাদের টুটি চেপে ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব কি-না?
২. আচমকা এবং অকল্পনীয় হামলা মুসলমানদের শির-দাঁড়া ভেঙ্গে দিবে কি-না?
সন্ন্যাসী তাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত ও অনুপ্রাণিত করেছিল যে, আপনাদের পরিকল্পনা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথার্থ। আপনারা সাহস করে এগিয়ে যান। স্বয়ং দেবতা লাতের আশীর্বাদ রয়েছে আপনাদের সাথে। সন্ন্যাসী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের এটাও জানিয়েছিল যে, “মুসলমানরা আপনাদের আগমনের খবর তখন টের পাবে যখন তারা আপনাদের তলোয়ারে কচুকাটা হতে থাকবে।”
মাত্র এক মাস পরে তায়েফের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুরো এলাকায় ভীতি ও আতঙ্ক ছেয়ে গিয়েছিল। দেবতা লাতের আশীর্বাদ নিয়ে এবং জ্যোতিষীর কথা বিশ্বাস করে হাওয়াযিন, ছাকীফ এবং অন্যান্য গোত্রের যে সমস্ত সৈন্য মক্কায় আক্রমণ করতে গিয়েছিল তারা মক্কার অদূরে হুনায়ন উপত্যকায় মুসলমানদের হাতে চরম মার এবং নাকানি-চুবানি খেয়ে ফিরে আসছিল। পলায়নপরদের অগ্রভাগে বহুজাতিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মালিক বিন আওফ ছিল। সে তায়েফের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় ও সুসংহত করতে আগেভাগে তায়েফে চলে এসেছিল। ওদিকে মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে তায়েফ অভিমুখে দ্রুত আসছিল।
“তায়েফবাসী” তায়েফের রাস্তায় রাস্তায় আতঙ্কিত আওয়াজ অনুরণিত হয়, ‘মুসলমানরা আসছে… তায়েফ অবরোধ হবে… প্রস্তুতি নাও… তরি-তরকারি এবং খেজুর যত পার মজুদ কর। পানির নিরাপদ ব্যবস্থা কর।”
মালিক বিন আওফ ছিল সবচে আতঙ্কিত। তায়েফ হাত ফস্কে যাওয়ার দৃশ্য তার চোখে ভাসতে থাকে। পরাজয় এবং পশ্চাদপসারণের আঘাত তো ছিলই। তারপরে আরো বড় আঘাত পায় শহরে প্রবেশ করার সময়। এ সময় তায়েফের নারীরা মালিকের বিজয় গাঁথা এবং বীরত্বের গীত গাওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি ঘৃণার নজরে তাকায়। বেগে আসা সৈন্যদেরকে নারীরা তীব্র ভর্ৎসনাও করছিল।
“স্ত্রী-কন্যারা কোথায় যাদেরকে তোমরা সাথে নিয়ে গিয়েছিলে?” নারীরা সৈন্যদেরকে বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল—“সন্তানদেরও কি মুসলমানদের দিয়ে এসেছ?” এটাও ছিল নারীদের একটি তীক্ষ্ণ খোচা।
মালিক বিন আওফ তায়েফ পৌঁছেই জরুরী বৈঠক আহ্বান করল। সেনাপতি, উপসেনাপতি এবং ইউনিট কমান্ডাররা এসে আসন গ্রহণ করল। মালিক বিন আওফ সভাপতির আসনে সমাসীন। কিন্তু ভীষণ উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত। কারো কোন মতামত আহ্বান ছাড়াই নিজেই নির্দেশ দিলো যে, অপরাপর গোত্রদেরও শহরে এনে রক্ষা কর। মুসলমানরা এল বলে… মালিক একটুও বিশ্রাম নেয় না। এসেই তায়েফের প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করতে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করল। সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সাথে নিজেও বিভিন্ন কাজে শরীক হল। উপসেনাপতি এবং কমান্ডাররা পিছু হটা সৈন্যদের সমবেত করার কাজে লেগে গেল।
সারাদিনের বিভিন্ন কর্মব্যস্ততায় মালিক বিন আওফ ঘর্মসিক্ত হয়ে ওঠে। ক্লান্তি আর অবসাদে ভেঙ্গে পড়ে তার শরীর। অবসন্ন দেহটাকে এক প্রকার টেনে নিয়ে শয্যায় ছুড়ে মারে। সবচে সুন্দরী এবং মায়াবী স্ত্রীকে ডেকে পাঠালো। স্ত্রী সাথে সাথে এসে হাজির হলো।
“আপনি না এই অঙ্গীকার করেছিলেন যে, মক্কার মূর্তি-বিনাশী মুহাম্মাদ এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের খতম করেই তবে স্ত্রীদের মুখ দেখাবেন?” স্ত্রী তাকে বলে, “আপনি বিজয়ের পরিবর্তে পরাজয়ের কলঙ্ক মাথায় তুলে এনেছেন। আপনার কসম এবং ওয়াদা অনুযায়ী আমার অস্তিত্বই এখন আপনার জন্য হারাম।”
“তুমি আমার স্ত্রী।” মালিক বিন আওফ রাগের স্বরে বলে—“আমার নির্দেশ অমান্যের সাহস করো না। আমি যেমনি ক্লান্ত তেমনি উদ্বিগ্নও। এখন তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। আমার সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী তুমিই।”
“আমারও আপনার প্রয়োজন।” স্ত্রী বলে—“কিন্তু আমার এ মুহূর্তে দরকার এক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন পুরুষের। আমি ঐ মালিকের প্রয়োজন অনুভব করি, যে এখান থেকে এই অঙ্গীকার করে গিয়েছিল যে, মুসলমানদেরকে মক্কার মাটিতেই খতম করে ফিরব।… সে মালিক এখন কোথায়?… সে মারা গেছে। ঐ মালিক বিন আওফকে আমি চিনি না, যে নিজ গোত্রসহ অন্যান্য মিত্রগোত্রের হাজার হাজার নারী-সন্তানকে শত্রুর তলোয়ারের নীচে রেখে অন্দর মহলে এসে বসে আছে এবং এক নারীকে ডেকে বলছে, আমি তোমাকে চাই।”
মালিকের এ সুন্দরী স্ত্রীর কণ্ঠ উচ্চ হয়ে আবেগের আতিশয্যে রীতিমত কাঁপতে থাকে। সে মালিকের পালঙ্ক থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে—“আজ রাতে আমি কেন, কোন স্ত্রীই তোমার শয্যায় আসবে না। আজ রাতে তোমার কোন স্ত্রীকে ঐ সমস্ত নারীদের করুণ ফরিয়াদ এবং বুক ফাটা আর্তনাদ স্বস্তির সাথে ঘুমাতে দিবে না। যারা মুসলমানদের হাতে বন্দী…একটু ভাব…কল্পনা কর ঐ সমস্ত বিপন্ন নারী এবং নব তরুণীদের দুর্দশার দৃশ্য, যাদেরকে তুমি মুসলমানদের হাতে উঠিয়ে দিয়ে এসেছ। এখন তাদের গর্ভে জন্ম নিবে মুসলিম সন্তান। ছোট ছোট সন্তান যারা তাদের কব্জায় রয়েছে, তারাও হয়ে যাবে মুসলমান।”
মালিক বিন আওফ পাহাড় সম বিপদ অতিক্রম করে যাওয়ার মত দুর্বার সাহসী লোক ছিল। যৌবনের উচ্ছ্বাস এবং আবেগ দমিয়ে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নেয়ার যে আহ্বান শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবং রণাঙ্গনের অভিজ্ঞ সৈনিক মান্যবর গুরু দুরায়দ বিন ছম্মাহ করেছিল তা সে সেদিন বড় অপমানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আজ সেই একই প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে মালিক বিন আওফ নিজ স্ত্রীর সামনে অবনত মস্তকে উপবিষ্ট। যেন জ্বলন্ত অঙ্গারে কেউ পানির ছিটা দিয়েছে। তার পৌরুষ আপনাতেই স্তিমিত হয়ে যায়।
“তুমি মুসলমানদের খতম করতে গিয়েছিলে মালিক!” স্ত্রী এমন ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকে, যেন এই মুহুর্তে মালিকের মত বাহাদুর এবং সাহসী স্বামীর কোন মূল্য নেই তার কাছে। সে আরো বলে, “মুসলমানদের খতম করতে গিয়ে তুমি তাদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে এসেছ।”
“সন্ন্যাসী বলেছিল…” মালিক মুখ তুলে বলে।
“কোন্ সন্ন্যাসী?” স্ত্রী তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে—“যে মন্দিরে বসে শুভাশুভ নির্ণয় করে? তোমার মত মানুষ নিজের ভাগ্য নিজের হাতে রাখে। নিজের ভাগ্য নিজ হাতে তৈরী করে আবার নষ্ট করে।…তুমি সন্ন্যাসীর কাছে কৈফিয়ত চাওনি, তার ভাগ্যশর কেন মিথ্যা বলল?
মালিক বিন আওফ উঠে দাড়ায়। নিঃশ্বাসের দ্রুত উত্থান-পতন হয়। চোখে নেমে আসে রক্তের ধারা। সে দেয়ালে ঝুলানো তলোয়ার নামিয়ে আনে এবং স্ত্রীকে কোন কিছু বলা ছাড়াই হনহন করে বাইরে বেরিয়ে আসে।
তায়েফের আকাশেও রাত এসেছিল। কিন্তু সেখানকার মানুষের তৎপরতা ও ছোটাছুটি দেখে দিনের মতোই মনে হচ্ছিল। বাইরে থেকে খবর আসছিল, মুসলমানরা তায়েফ অভিমুখে দ্রুতগতিতে আসছে। সকলে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কর্মব্যস্ত। খাদ্য এবং পানির সুব্যবস্থা ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। অনেকে পানি সংরক্ষণের জন্য হাউস তৈরী করছিল।
সকল তৎপরতা এবং হৈ চৈ মাড়িয়ে মালিক হেটে চলছিল। মানুষ অধিক কর্মব্যস্ততার দরুণ খেয়ালই করতে পারল না যে, তাদের মাঝ দিয়ে তাদেরই সেনাপতি অতিবাহিত হলেন।
॥ দুই ॥
যে সন্ন্যাসী হাওয়াযিন এবং ছাকীফদেরকে এই নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, তারা এক প্রকার অজান্তেই মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হবে, সে মন্দিরের খাস কামরায় শায়িত। গভীর নিদ্রায় বিভোর। তার নিদ্রা হরণের দুঃসাহস কারো ছিল না। অন্দরমহলের কোন এক সুরক্ষিত ও সুসজ্জিত কক্ষে সে নিদ্রা যেত। মন্দিরের অন্য কর্মচারীরা বাইরের সাইডের কোন কামরায় থাকত। কারো পদশব্দে তাদের নিদ্রা টুটে যায়। তাদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, যেন বাইরের কেউ সন্ন্যাসীর অন্দরমহলে তার অনুমতি ব্যতীত যেতে না পারে। পদশব্দ ভেসে এলে দু’তিন কর্মচারী উঠে বাইরে আসে। একজনের হাতে জ্বলন্ত ছিল মশাল।
মালিক বিন আওফ!” এক কর্মচারী মালিকের গমন পথে দাঁড়িয়ে বলে— “গোত্রপতি কি ভুলে গেছে যে, ঐ স্থান থেকে সামনে কেউ অগ্রসর হতে পারে না?…আমাদের সাথে কথা বলুন মালিক!”
“তোমরাও কি ভুলে গেছ, কোন নেতার গতিরোধ করলে তার পরিণতি কি হয়? মালিক বিন আওফ তলোয়ারের বাটে হাত রেখে বলে—“আমি সন্ন্যাসীর কাছে যেতে চাই।”
“সন্ন্যাসীর অভিশাপের কথা মনে করেন মালিক!” এক কর্মচারী বলে— “সন্ন্যাসীকে তুমি বাহ্যদৃষ্টিতে শয্যায় শায়িত দেখলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি এখন লাত দেবতার দরবারে। এমতাবস্থায় তার কাছে গেলে তোমার…।”
মালিকের মানসিক অবস্থা এত বিধ্বস্ত ছিল যে, তার অন্তরে তখন সন্ন্যাসীর কোন মান-মর্যাদা ছিল না। পূর্বেকার ভীতি এবং শ্রদ্ধাবোধও ছিল না। কারণ, একে তো শোচনীয় পরাজয় বরণ করে এসেছে। দ্বিতীয়ত, তার সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী তাকে চরম ভর্ৎসনা করেছে। মালিক খপ করে মশালধারী কর্মচারীর হাত ধরে বসে এবং চোখের পলকে মশাল ছিনিয়ে নিয়ে সোজা সন্ন্যাসীর কামরায় চলে যায়। কর্মচারীরাও তার পিছন পিছন ছুটে আসে কিন্তু ততক্ষণে সে সন্ন্যাসীর খাস কামরায় পৌঁছে যায়।
সন্ন্যাসী বাইরের চেচামেচিতে জেগে যায়। নিজের কামরায় মশালের আলো দেখে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসে। মালিক বিন আওফ কামরায় প্রবেশ করে মশাল সুনির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে।
“শ্রদ্ধেয় সন্যাসী!” মালিক বিন আওফ বলে—“আমি জানতে এসেছি যে…”
“আমাদের পরাজয়ের কারণ কী” সন্ন্যাসী তার কথা পূর্ণ করে বলে—একটি ‘হাম’ কুরবানী দেয়ার কথা বলছিলাম না?”
“হ্যাঁ, সন্ন্যাসী!” মালিক বিন আওফ বলে, “আপনি তো এ কথাও বলছিলেন যে, ‘হাম’ পাওয়া না গেলে গোত্রের লোকদের রক্ত এবং জান কুরবান করতে। আমার আরো মনে আছে, আপনি বলছিলেন, ‘হাম’ অন্বেষণে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।… মুসলমানদের এখন যুদ্ধ-প্রস্তুতি নেই’-একথাও আপনি বলছিলেন।”
“তুমি কি দেবতার কাছে কৈফিয়ত তলব করতে এসেছ, শত্রুরা কেন তোমাদের পরাজিত করল?” সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করে—“আমি বলছিলাম কেউ যেন রণাঙ্গনে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে।…তোমার সৈন্যরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেনি? তোমার সেনাদের মাঝে নিজ নিজ স্ত্রী-পরিজনদের রক্ষা করারও আত্মমর্যাদাবোধ নেই।”
“আমি জানতে চাই, আপনি কি করলেন? মালিক বিন আওফ জিজ্ঞাসা করে, ‘যদি সবকিছু আমাদেরই করতে হয়, তবে আপনার অবদান কি রইল? আপনি কেন এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মুসলমানদের ঐ সময় খবর হবে, যখন তোমাদের তলোয়ার তাদের শাহরগ স্পর্শ করবে? আপনি কি আমাদের সাথে প্রতারণা করেননি? এটা কি সত্য নয় যে, মুহাম্মাদের ধর্মই বাস্তব যিনি আপনার ভাগ্য গণনা ভুয়া প্রমাণ করে দিয়েছে। সন্ন্যাসী না হলে আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলতাম।…এখন তায়েফ পানে ভয়ঙ্কর বিপদ ধেয়ে আসছে। দেবতা অধ্যুষিত এ বসতি আপনি রক্ষা করতে সক্ষম? মুসলমানদের উপর আপনি গযব নাযিল করতে পারবেন?”
“প্রথমে একটি কথা শুনে নাও আওফের পুত্র।” সন্ন্যাসী বলে—“সন্ন্যাসীকে দুনিয়ার কোন শক্তি হত্যা করতে পারে না। সন্ন্যাসীর আয়ু শেষ হলে সে দেবতা লাতের অস্তিত্বের মাঝে একাকার হয়ে যায়। বিশ্বাস না হলে তলোয়ার চালিয়ে পরীক্ষা করতে পার।…দ্বিতীয় কথা এটাও মনে রেখ, মুসলমানরা তায়েফ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হলেও এখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।”
॥ তিন ॥
যে সময় মালিক বিন আওফ সন্ন্যাসীর কক্ষে প্রবেশ করছিল ঠিক ঐ সময় এক মানব ছায়া উপাসনালয়ের পিছনের প্রাচীরের পাশে ঘুর ঘুর করছিল। সে যেই হোক না কেন, নিজের জীবনকে চরম ঝুঁকির মুখে নিক্ষেপ করছিল। মালিক বিন আওফ কেবল নেতা হওয়ার প্রভাবে রাতে সন্ন্যাসীর কক্ষ পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। মন্দিরটি প্রায় এক শতাব্দীর প্রাচীন ছিল। পিছনের প্রাচীরে ছোট ফাটল দেখা দিয়েছিল। প্রাচীরের ও পাশে পায়চারী রত মানবরূপী ছায়া ঐ ফাটলে নিজেকে ঠেলে দিয়ে মন্দির চত্বরে ঢুকে পড়ে। মন্দিরের খাস কামরা পর্যন্ত যেতে পথিমধ্যে উঁচু উঁচু ঘাস এবং ইতস্তত ঝোপ-ঝাড় ছিল। ছায়াটি ঐ ঘাস এবং ঝোপ-ঝাড়পূর্ণ এলাকা বিড়ালের মত এমন নিঃশব্দে অতিক্রম করে যে, তার পদশব্দ কিংবা হাল্কা খসখস আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল না।
ছায়াটি যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে চলে। ঘাস এবং ঝোপ-ঝাড় অধ্যুষিত এলাকা পেরিয়ে সে ঐ চত্বরে উঠে পড়ে যেখানে মন্দিরটি শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পশ্চাৎ দিকের দরজার একটি পাল্লা উই পোকায় খাওয়া ছিল। ছায়াটি নিঃশব্দে ঐ দুর্বল পাল্লা গলিয়ে মন্দিরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। সামনে গাঢ় আঁধার কুণ্ডলী পাকিয়েছিল। মানবরূপী ছায়া এখানে এসে জুতা খুলে ফেলে এবং বিড়ালের মত পা টিপে টিপে সামনে অগ্রসর হতে থাকে।
ঘোরতর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সে এমন স্বাচ্ছন্দে চলে, যেন ইতোপূর্বে কখনও এখানে এসেছিল। ছায়াটি অন্ধকারের আড়ালে আড়ালে অগ্রসর হয়ে সন্ন্যাসীর নিকটে গিয়ে পৌঁছে। এ সময় তার কানে সন্ন্যাসী এবং আরেকজনের তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার আওয়াজ ভেসে আসে। সন্ন্যাসীর সাথে আলাপরত লোকটি ছিল মালিক বিন আওফ। ছায়াটি চমকে থেমে যায়। সন্ন্যাসীর কক্ষ হতে বের হওয়া মশালের আলো সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল।
মালিক বিন আওফ লৌহবৎ দৃঢ়তা নিয়ে গেলেও সন্ন্যাসীর কথায় এতই প্রভাবিত হয় যে, মাথা নীচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। মালিক চলে যেতেই নিকটবর্তী কোথাও লুকিয়ে থাকা ছায়াটি সামনে অগ্রসর হতে থাকে।
সন্ন্যাসী তখনও পর্যন্ত খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। সে হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। তার চোখের সামনে এক তরুণী দাড়িয়েছিল। তরুণী তার অপরিচিত ছিল না। ভাল করেই সে তাকে চিনত। যে ছায়ামূর্তিটি সন্যাসীর সামনে এসে তরুণীরূপে প্রকাশিত হয় সে ঐ ইহুদি নারী ছিল, যাকে এক বয়োবৃদ্ধ ইহুদি সন্ন্যাসীকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রদান করেছিল। সাথে সাথে স্বর্ণের দু’টি টুকরোও তাকে দিয়েছিল। এটা ছিল সন্ন্যাসীর পুরস্কার বা কাজের প্রতিদান। আর সে কাজ এই ছিল যে, যে করেই হোক হাওয়াযিন ও ছাকীকদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করা যে, তাদের হাতেই মুসলমানদের ধ্বংস নিহিত। তাদের তলোয়ারে ইসলাম এবং মুসলমান চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
বৃদ্ধ ইহুদি তরুণীকে এক রাতের জন্য সন্ন্যাসীর কাছে রেখে গিয়েছিল। এই সুসংবাদ শোনার আশায় সে তায়েফে অপেক্ষমাণ ছিল যে, হাওয়াযিন, ছাকীফ এবং তাদের মিত্রগোত্রগুলো ইসলামকে মুসলমানদের রক্তনদীতে চিরতরে ডুবিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিধি বাম! মালিক বিন আওফ নিজেই অবনত মস্তকে তায়েফে ফিরে আসে। তার পিছু পিছু হতাশ-অবসন্ন সৈন্যরাও পা টেনে টেনে দু’চারজন করে তায়েফে এসে পৌঁছতে থাকে। বৃদ্ধ ইহুদির কোমর বয়সের আধিক্যে ন্যূজ হয়ে গিয়েছিল। মালিককে পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে দেখে তার কোমর যেন পুরোপুরি ভেঙ্গে গেল। তার ভাঙ্গা কোমরের উপর শেষ ভারী পাথর ঐ ইহুদি তরুণী এনে চাপিয়ে দেয় যাকে সে উপঢৌকন স্বরূপ সন্ন্যাসীর কাছে এক রাতের জন্য রেখে এসেছিল।
“আমি এটা ভেবে বিস্মিত যে, আপনার মত অভিজ্ঞ এবং ঝানু লোক পর্যন্ত ধোঁকা খেয়েছেন?” তরুণী ইহুদিকে বলে—“নরপিশাচ সন্ন্যাসীর একটি কথার উপরেও আমার আস্থা নেই। আমি অযথা আপনার নির্দেশে আমার কুমারিত্ব বিসর্জন দিলাম।”
“আমার নির্দেশে নয় পাগলী!” বৃদ্ধ ইহুদি সান্ত্বনার স্বরে বলে—“ইহুদিবাদের খোদার নির্দেশে। তোমার কৌমার্য বিসর্জন বৃথা যাবে না।”
এ ইতিহাস ইহুদিবাদে প্রাচীনকাল থেকে সংরক্ষণ হয়ে আসছে যে, তারা সর্বদা যুদ্ধের ময়দান এড়িয়ে চলে। তারা শৌর্য-বীর্য দ্বারা কাজ নেয় না; বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থাই তাদের প্রধান কৌশল। তারা পর্দার অন্তরালে কূটচাল চালতে অত্যন্ত পারঙ্গম। তাদের কূটচাল দু’ভাইকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে তারা অগাধ ধন-দৌলতের সাথে তাদের কন্যাদের নারীত্বকে সফল যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। ইহুদি সমাজ এবং ধর্মে নারীর ইজ্জত সম্ভ্রমের কোন মূল্য ছিল না। কিন্তু এই তরুণীকে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
সে বৃদ্ধ ইহুদির প্রতি বারবার মারমুখী হয়ে উঠছিল এবং বলছিল, মুসলমানরা পরাজিত এবং পরাভূত হলে সে গর্বের সাথে বলত, সে এই বিরাট লক্ষ্য সাধনে নিজ কুমারিত্ব বিসর্জন দিয়েছে। সাথে সাথে সে এ অভিযোগও করে যে, সন্ন্যাসী তার সাথে প্রতারণা করেছে।
রাতে বৃদ্ধ ইহুদি গভীর নিদ্রায় ডুবে গেলে তরুণী উঠে পড়ে। খঞ্জর বের করে বস্ত্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে ফেলে। অতঃপর পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে আসে।
গভীর রাতে গতিরোধ করে তাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করার কেউ ছিল না যে, তার পরিচয় কী? গন্তব্য কোথায়? সে রাতে সারা তায়েফবাসী বিনিদ্র ছিল। স্ত্রীরা তাদের পরাজিত স্বামীদের ভর্ৎসনা করছিল আর যাদের স্বামী ফেরে না তারা গুণগুণ করে কাঁদছিল। অলি-গলিতে লোকের যাতায়াত ছিল অবাধ। তরুণী জনতার মাঝ দিয়ে লাতের মন্দিরে গিয়ে পৌঁছে। তার চোখে ছিল খুনের নেশা। সে তৎকালের ঐ সকল মহিলার অন্তর্গত ছিল যাদের দেহে বীরত্ব টগবগ করত। সে উপাসনালয়ের পিছনের দেয়ালের ফাটল গলিয়ে ভিতরে চলে যায়।
আমি জানতাম আমার যাদু একটি বারের জন্য হলেও তোমাকে আমার কাছে আনবে।” সন্ন্যাসী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে—“এস, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়।”
তরুণী আস্তে আস্তে এগিয়ে সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“যাদু নয়, প্রতিশোধ বল”—পূতিশোধের যাদু আমাকে এ পর্যন্ত টেনে এনেছে।
“কি আবোল-তাবোল বলছ তরুণী!” সন্ন্যাসী কান্নার চেয়েও করুণ মুচকি হেসে বলে—“মালিক বিন আওফ থেকে প্রতিশোধ নিতে চাও?…সে তো চলে গেছে। সে আমাকে হত্যা করতে এসেছিল। লাতের জ্যোতিষীকে হত্যা করার দুঃসাহস কোন মানুষের হতে পারে কি?”
‘হ্যাঁ’ তরুণী বলে—“একজন মানুষ আছে, সে লাতের সন্ন্যাসীকে হত্যা করতে পারে। লোকটি লাতের পূজারী নয়। আর সে আমিই। ইহুদিবাদের খোদা আমার পূজ্য।”
তরুণী এরপর চোখের পলকে বস্ত্রের অভ্যন্তর হতে খঞ্জর বের করে এবং সোজা সন্ন্যাসীর বক্ষে স্থাপন করে হৃদপিণ্ড এ ফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। সন্ন্যাসীর আর্তনাদ যাতে বাইরে না যায় তার জন্য তরুণী জ্যোতিষীর মুখ এঁটে ধরে। তরুণী বক্ষ থেকে খঞ্জর বের করে সন্ন্যাসীর শাহরগ কেটে দেয়। তরুণী জিঘাংসা চরিতার্থ করে স্থিরচিত্তে সন্ন্যাসীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে এবং যে পথে ভিতরে ঢুকেছিল সে পথ দিয়ে উপাসনালয়ের চত্বর থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যায়।
মালিক বিন আওফ শয্যায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসা ছিল। সর্বাধিক প্রিয়তমা স্ত্রীও ছিল তার পাশে বসা। এ সময় ভৃত্য এসে জানায় যে, এক অপরিচিত নারী এসেছে। তার পোষাক রক্ত-রঞ্জিত এবং তার হাতে খুনে ভরা একটি খঞ্জরও আছে। মালিক বিন আওফ এ সংবাদে জেগে ওঠে। সে চমকে উঠে বলে, তাকে ভিতরে নিয়ে এস। ভৃত্য চলে যায়। মালিক এবং তার স্ত্রীর দৃষ্টি দরজা মাঝে আটকে যায়।
তরুণী দরজায় এসে দাঁড়ায় এবং বলে—“যে কাজ আপনি করতে পারেন নি তা আমি করে এসেছি। আমি সন্ন্যাসীকে হত্যা করেছি।”
মালিক বিন আওফ থ মেরে যায়। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক এবং উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে ওঠে। সে মুহূর্তে তলোয়ার তুলে নেয় এবং খাঁপ ছুড়ে ফেলে তরুণীর উদ্দেশে পা বাড়ায়। তার স্ত্রী দৌড়ে উভয়ের মাঝে এসে দাঁড়ায়।
“তরুণী যা করেছে ঠিকই করেছে। স্ত্রী তার গতিরোধ করে বলে—“তোমাকে যে ভুয়া আশ্বাস দিয়েছিল এবং মিথ্যা ইশারার কথা বলেছিল সে মারা গেছে। ভালই হয়েছে।”
“তুমি জান না আমাদের দিকে কি মহাবিপদ ধেয়ে আসছে। মালিক বিন আওফ বলে।
“এর জন্য আপনাদের কোন বিপদ হবে না।” ইহুদি তরুণী বলে— “জ্যোতিষী আপনাকে বলেছিল না যে, সন্ন্যাসীকে কোন মানুষ হত্যা করতে পারে না এবং তার জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে এলে সে দেবতা লাতের অস্তিত্বের মাঝে একাকার হয়ে যায়…আপনার হিম্মত থাকলে মন্দিরের কর্মচারীদের গিয়ে বলুন, সন্ন্যাসীর লাশকে দেবতার মাঝে একাকার করে দিতে। তার শবদেহ বাইরে ফেলে রাখুন, শকুন-কুত্তা কিভাবে তার দেহ ছিঁড়ে-ফেঁড়ে খায় দেখবেন।”
মালিক বিন আওফের স্ত্রী মালিকের হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে নেয় এবং পালঙ্কে ছুড়ে ফেলে।
বাস্তবতা অনুধাবন কর আওফের পুত্র!” স্ত্রী তাকে বলে—“নিজের ভাগ্য ঐ ব্যক্তির হাতে সঁপে দিও না, এক সামান্য নারীর হাতে যে নিহত হয়েছে। এরপর সে ভৃত্যকে ডেকে বলে—“তরুণীটি আমাদের মেহমান। তার গোসল এবং আরামের ব্যবস্থা কর।”
মালিক বিন আওফের চেহারা থেকে আতঙ্কের চিহ্ন মুছে যেতে থাকে। স্ত্রী তার চিন্তা-চেতনায় বিপ্লব সৃষ্টি করে দেয়।
পর প্রভাতে মালিকের কাছে দু’টি খবর আসে। একটি হলো, রাতে সন্ন্যাসী খুন হয়েছে। মন্দির কর্মচারীরা বলছে, রাতে মালিক বিন আওফ ছাড়া আর কেউ সন্যাসীর কক্ষে যায়নি। কেউ যাওয়ার সাহসও করতে পারে না। মন্দির কর্মচারীরা এটা রাষ্ট্র করে দেয় যে, জ্যোতিষীকে মালিক বিন আওফ নিজে হত্যা করেছে, নতুবা ভাড়াটে দিয়ে সে হত্যা করিয়েছে।
মালিক বিন আওফের জন্য দ্বিতীয় খবর এই ছিল যে, মুসলমানরা তায়েফ অভিমুখে আসতে আসতে কোনদিকে যেন চলে গেছে। এ সংবাদ মালিকের ধড়ে প্রাণ এনে দেয়। সে তৎক্ষণাৎ দু’তিন অশ্বারোহীকে হুনায়ন টু তায়েফ রুটে পাঠিয়ে দেয়। এরপর সে উপাসনালয়ে গিয়ে হাজির হয়। অনেক কষ্টের পর সে উত্তেজিত লোকদের বুঝাতে সক্ষম হয় যে, শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসীকে হত্যা করার দুঃসাহস সে করতে পারে না। জনতা জানতে চায়, তাহলে হত্যাকারী কে? এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। মালিক বিন আওফ তাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে শীঘ্রই খুনীকে চিহ্নিত করা হবে। মালিক চাইলে তরুণীর কথা বলে দিয়ে নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে পারত। কিন্তু সে এখনই তরুণীকে সামনে আনতে চায় না। সে মানুষের দৃষ্টি এদিক থেকে ফিরিয়ে মুসলমানদের দিকে করে দেয়, যারা তায়েফ অবরোধ করতে দ্রুতগতিতে আসছিল। সে ক্ষণিকের জন্য মন্দিরের অভ্যন্তরে যায় এবং কর্মচারীদের সাথে দ্রুত সমঝোতা করে ফেলে।
“লাতের পূজারীগণ!” এক বৃদ্ধ কর্মচারী বাইরে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে বলে—“আমাদের শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসীকে কেউ হত্যা করেনি। যাকে তোমরা নিহত দেখতে পাচ্ছ, তিনি মূলত দেবতা লাতের অস্তিত্বের মাঝে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন। দেবতা লাতের নির্দেশে এখন থেকে আমি সন্ন্যাসী। যাও, স্বীয় ভূখণ্ডকে আসন্ন শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা কর।”
মালিক বিন আওফ মন্দিরের ঝামেলা চুকিয়ে ঘরে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর তার প্রেরিত দূতরা ফিরে আসে। তারা এসে তাকে জানায় যে, হুনায়ন থেকে তায়েফের পথে মুসলমানদের কোন নাম-গন্ধ নেই।
মালিক বিন আওফ নিজেকে ধোঁকার মাঝে রাখে না। সে অন্যান্য নেতাদের জানায় যে, মুহাম্মাদ শত্রুদের এমনিতেই ক্ষমা করে না। সে কোন পন্থায় অবশ্যই পাল্টা হামলা চালাবেই। সে ঘোষণা করে দেয়, শহর প্রতিরক্ষায় যেন বিন্দুমাত্র গাফলতি ও ক্রটি প্রদর্শন না করা হয়।
॥ চার ॥
গোয়েন্দারা মালিক বিন আওফকে সত্য সংবাদই দিয়েছিল যে, তায়েফের রাস্তায় মুসলমানদের কোন নাম-নিশানা নেই। কিন্তু মুসলমানরা তুফানের গতিতে তায়েফ অভিমুখে ঠিকই ধেয়ে আসছিল। সৈন্যরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে ভিন্ন রাস্তা ধরে চলছিল। পরিবর্তিত রাস্তা ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ। তারপরেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাস্তা এ জন্য অবলম্বন করেন যে, বিপরীত যে স্বল্পদূরত্বের রাস্তাটি ছিল তা বিভিন্ন পাহাড়, প্রান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। ছোট-বড় অনেক পাহাড়ী খাদও ছিল এ রাস্তায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কমান্ডারদের সতর্ক করে বলেছিলেন, হুনায়নের প্রথম অভিজ্ঞতা ভুলো না। মালিক বিন আওফ বড়ই দুর্ধর্ষ। তিনি আরো বলেন, তায়েফ পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই একটা ফাঁদ। শত্রুর উদ্দেশে ওঁৎ পেতে থাকার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত স্থান। মালিক বিন আওফ আবার ফাঁদ পাততে পারে, যেমনটি হুনায়ন উপত্যকায় পেতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তীর মেরে চালনী করে দিয়েছিল।
তায়েফে যেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথ ধরেন তা মুলীহ উপত্যকার মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে গিয়ে করণ উপত্যকার সাথে মিলেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যদেরকে করণ উপত্যকার মধ্য দিয়ে না নিয়ে তায়েফের উত্তর-পশ্চিমে সাত মাইল দূরে নাখিব এবং সাবেরা এলাকার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন। এলাকাটি ছিল অনেকটা সমতল এবং উন্মুক্ত। এখানে পাহাড় এবং প্রান্ত ছিল না বললেই চলে। মুজাহিদ বাহিনী ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ৮ম হিজরীর ১৫ শাওয়াল ঐ এলাকা দিয়ে তায়েফের নিকটে গিয়ে পৌঁছায়, যা ছিল তায়েফবাসীদের ধারণা ও চিন্তার বাইরে। মুজাহিদ বাহিনীর চলার গতি যথেষ্ট দ্রুত ছিল। অগ্রভাগে যথারীতি বনু সালীম ছিল। আর তাদের নেতৃত্বে ছিলেন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। আশা অনুযায়ী তায়েফের নিকট পর্যন্ত কোন শত্রুসৈন্য নজরে পড়ে না। ঐতিহাসিকদের মতে এর কারণ এই ছিল যে, উন্মুক্ত প্রান্তরে লড়ার ঝুঁকি নেয়ার সাহস মালিক বিন আওফের ছিল না।
হুনায়ন যুদ্ধে বনু হাওয়াযিন অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ছাকীফ গোত্রও লড়েছিল। কিন্তু যে ঘোরতর যুদ্ধের সম্মুখীন বনু হাওয়াযিন হলো, বনু ছাকীফ তেমনটি হলো না। তারপরেও বনু ছাকীফ পিছু হটে এসেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ ব্যাপারে পূর্ণ সতর্ক ছিলেন যে, বনু ছাকীফের মনোবল চাঙ্গা এবং তারা ক্লান্তও নয়। তারা নিজ ভূখণ্ড রক্ষার দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাবে।
এটা কার ভুল ছিল তা জানা যায় না যে, মুসলমানরা নগর প্রাচীরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে এসে দাঁড়ায়। তারা সেখানে সেনাছাউনী তৈরীরও পরিকল্পনা করে। কিন্তু হঠাৎ প্রাচীর ফেঁড়ে বনু ছাকীফের উদয় হয় এবং তারা মুসলমানদের উপর মুষলধারে তীরবর্ষণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে অনেকে আহত এবং অনেকে শহীদ হন। মুসলিম বাহিনী পিছু হটে আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অবরোধের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুরো নগরের অবরোধ সম্পন্ন করেন। যে পথে শত্রুর পলায়নের বেশী আশঙ্কা ছিল ঐ পথে তিনি অধিক সৈন্য মোতায়েন করেন।
শহরের প্রতিরক্ষা বড়ই মজবুত ছিল। ছাকীফ গোত্র ছিল পূর্ণ প্রস্তুত। তীর চালাচালি ছাড়া দুর্ভেদ্য কেল্লার বিরুদ্ধে মুসলমানদের আর কিছু করার ছিল না। মুজাহিদরা এ নির্ভীক সাহসিকতাও প্রদর্শন করে যে, তারা নগর প্রাচীরের নিকটে গিয়ে বনু ছাকীফের ঐ সমস্ত তীরন্দাজদের প্রতি তীর ছুঁড়ে, যারা প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তীর ছুড়ছিল। বনু ছাকীফ প্রাচীরের উপরে এবং নিজেদের আড়াল করার সুব্যবস্থা থাকায় তাদের তীর মুসলমানদের বেশী ক্ষতি করতে থাকে। মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে আবার পিছে ফিরে আসতে থাকে। মুসলমানদের আহতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। কমান্ডার হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বনু ছাকীফের তীরে শহীদ হয়ে যান।
৫/৬ দিন এভাবে গড়িয়ে যায়। ইসলামী ইতিহাসের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহুও সৈন্যদের সাথে ছিলেন। খন্দক যুদ্ধে যে দৈর্ঘ্য পরিখা খনন করা হয়েছিল তা হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এরই সমর বিচক্ষণতা ছিল। ইতোপূর্বে আরবরা পরিখার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে অবগত ছিল না। হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু ৫/৬ দিনেও অবরোধ কার্যকর না হতে দেখে তিনি শহরে পাথর নিক্ষেপের জন্য মিনজানিক পাথর নিক্ষেপণ যন্ত্র তৈরী করান। কিন্তু এতেও কাজ হয় না।
হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু বৃহদাকার একটি চামড়ার ঢাল তৈরী করান। কয়েকজন লোক লাগত তা নড়াচড়া করতে। এ ঢালের সুবিধা এই ছিল যে, অনেকে এর ছত্রছায়ায় নিরাপদে কেল্লার দরজা পর্যন্ত চলে যেতে পারত। হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু নির্মীত ঢালটি ছিল একটি গাভীর চামড়া দ্বারা তৈরী। একদল সৈন্য এই ঢালের ছত্রছায়ায় কেল্লার সবচে বড় দরজার দিকে এগিয়ে যায়। শত্রু পক্ষের অসংখ্য তীর এসে ঢালের পিঠে বিদ্ধ হতে থাকে। সৈন্যদের কোন ক্ষতি হয় না। এতে শত্রুরা শিউরে ওঠে। তারাও দ্রুত নব পলিসি গ্রহণ করে। মুসলমানরা চামড়ার বৃহৎ ঢাল নিয়ে যখন কেল্লার প্রাচীরের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় এ সময় বনু ছাকীফ প্রাচীরের উপর থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার, জ্বলন্ত লৌহটুকরা এত বেশি নিক্ষেপ করে যে, স্থানে স্থানে ঢালের চামড়া পুড়ে যাওয়ায় তা তীর থেকে হেফাজতের আর উপযুক্ত থাকে না। আরবদের জন্য এই চর্মঢাল নতুন আবিষ্কার হওয়ায় এবং তা প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় সৈন্যরা ঢালটি অকুস্থলে ফেলে সৈন্যশিবিরে দৌড়ে চলে আসে। বনু ছাকীফ এই সৈন্যদের উপর তীর নিক্ষেপ করলে অনেকে আহত হন।
আরো দশদিন গত হয়। অবরোধ এবং প্রতিরক্ষার ফলাফল এই এসে দাঁড়ায় যে, মুসলমানরা তীর নিক্ষেপ করতে করতে সামনে অগ্রসর হত এবং একটু পরে তীর খেতে খেতে পিছে ফিরে আসত। তবে মুসলমানদের অনমনীয় মনোভাব এবং হার না মানার দৃঢ়তা দেখে বনু ছাকীফের মাঝে এক অজানা আতঙ্ক ও ভীতি ছেয়ে গেল। আর এ কারণেই তারা বাইরে বেরিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করার সাহস করে না। পরিশেষে একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ সভা আহ্বান করেন। বিভিন্ন পর্যায়ের কমান্ডারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে, আপাতদৃষ্টিতে অবরোধের সফলতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বের করতে তিনি অভিজ্ঞ কমান্ডারদের পরামর্শ আহ্বান করেন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু অবরোধ তুলে নেয়ার ব্যাপারে অভিমত পোষণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও অবরোধ তুলে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ, মক্কার দিকে নজর দেয়ার খুবই প্রয়োজন ছিল তার। মাত্র ক’দিন আগে মক্কা বিজয় হয়। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এ সময়ে দীর্ঘদিন তায়েফে অবস্থান করলে মক্কায় শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারী। ৮ম হিজরীর ৪ জিলক্বদ। এ দিনে তায়েফের অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হয়। অবরোধ প্রত্যাহার হওয়ায় বনু ছাকীফদের মাঝে আনন্দ প্রতিক্রিয়া পড়ার দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবে হয় এর বিপরীত। তাদের মাঝে নতুন এই উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দেয় যে, মুসলমানরা এখন চলে গেলেও যে কোন সময় আবার আসতে পারে এবং তখন এমন প্রতিশোধ নিবে যে, ইট থেকে ইট পৃথক করে ফেলবে। খোদ মালিক বিন আওফের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আসে। জ্যোতিষীর মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী এবং হুনায়নে মুসলমানদের অগ্নিঝরা আক্রমণ তাকে নিজের আকীদা-বিশ্বাস দ্বিতীয়বার নিরীক্ষণ করতে বাধ্য করে।
অবরোধ তুলে মুসলমানরা ২৬ ফেব্রুয়ারী যাঅরানা নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছে। হুনায়ন যুদ্ধের গনীমতের মাল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে জমা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই যুদ্ধলব্ধের মধ্যে ৬ হাজার নারী, বাচ্চা এবং হাজার হাজার উট, বকরী ছিল। যুদ্ধ সাজ-সরঞ্জামও ছিল প্রচুর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সমস্ত নারী, বাচ্চা এবং উট, বকরী সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন।
মুজাহিদ বাহিনী যাঅরানা থেকে রওনা হওয়ার উপক্রম. এমন সময় হাওয়াযিন গোত্রের কতিপয় নেতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকাশে এসে ঘোষণা করে যে, হাওয়াযিনের সমস্ত গোত্র ইসলামের আনুগত্য স্বীকার করেছে। সাথে সাথে তারা যুদ্ধ সম্পদ হিসেবে যা ছেড়ে গিয়েছিল তা ফেরৎ দানেরও আহ্বান জানায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করেন, সহায়-সম্পদ তোমাদের বেশী প্রিয়, নাকি স্ত্রী-স্বজন? নেতারা উত্তরে জানায়, স্ত্রী-পুত্র ফেরৎ পেলেই তারা সন্তুষ্ট। সহায়-সম্পদ মুসলমানরা ভোগ করুক।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে ডেকে হাওয়াযিনদের স্ত্রী-বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে বলেন। সাহাবায়ে কেরাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ফিরিয়ে দেন।
হাওয়াযিনদের ধারণায় ছিল না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন অভাবিত উদারতা প্রকাশ করবেন কিংবা সৈন্যরা প্রাপ্ত মালে গনিমতের অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফিরিয়ে দিবেন। মুসলমানদের এই অসাধারণ উদারতার ফল এই হয় যে, হাওয়াযিনরা ইসলামকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে। হাওয়াযিন নেতারা গোত্রের নারী ও শিশুদের আজাদ করে নিয়ে যায়। মুসলমানদের বিশাল এই উদারতার ঢেউ তায়েফের কেল্লা পার হয়ে মালিক বিন আওফের খাস মহলে গিয়েও পৌঁছে। মুসলিম বাহিনী যাঅরানা ছাড়ার আগেই একদিন মালিক বিন আওফ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এসে হাজির হয় এবং কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যায়।
আরব ভূখণ্ড হতে দেবতা লাতের প্রভুত্ব এবং খোদাত্ব চিরদিনের জন্য মুছে যায়।
॥ পাঁচ ॥
ইসলাম সীমিত পরিমণ্ডলে অবস্থান করাকালীন তার শত্রুও ছিল ধারে-কাছের। মক্কায় থাকা অবস্থায় কুরাইশরা আর মদীনায় চলে গেলে মক্কাবাসী ও তার আশে-পাশের গোত্রসমূহ। মদীনার পর ইসলাম মক্কায়ও ছড়িয়ে পড়লে এবং বৃহত্তর মক্কা-মদীনার সিংহভাগ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসে গেলে অর্থাৎ ইসলাম একটি বৃহৎ শক্তি ও ধর্মে রূপ নিলে এবং আরব ভূখণ্ডে এর বিরোধিতা করার মত কেউ না থাকলে আরব ভূখণ্ডের বহু দূর-দূরান্তের রাষ্ট্রগুলো ইসলামের নতুন শত্রুতে পরিণত হয়। এর প্রধান কারণ ছিল ইসলামের ক্রম বিস্তার। ইসলামের এহেন দ্রুত প্রচার-প্রসার দেখে দূর-দূরান্তের রাজা-বাদশাহদের মসনদ কেঁপে উঠে। অবশ্য ইতোমধ্যে মুসলমানরাও বিপুল সমর শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে সমরশক্তির অবদান ছিল না; বরং খোদ ইসলামের মধ্যেই এমন এক আকর্ষণ ও সম্মোহনী শক্তি ছিল যে, যে-ই আল্লাহর কালাম শুনত মুসলমান হয়ে যেত।
মুসলমানরা তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছিল। চৌকস গোয়েন্দারা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করত। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে এক গোয়েন্দা টিম এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ রিপোর্ট প্রদান করে যে, রোমীয়রা সিরিয়ায় সৈন্য সমাবেশ করছে। যার অর্থ হচ্ছে, তারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে চায়। ক’দিন পর আরেক গোয়েন্দা জানায়, রোমীয়রা কিছু সৈন্য উরদুন অভিমুখে পাঠিয়ে দিয়েছে।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দ অক্টোবর মাস। ভরা গ্রীষ্ম মৌসুম। চামড়া দগ্ধকারী লু-হাওয়া অনবরত বয়ে চলছে। দিনের বেলায় রৌদ্রের প্রখর তাপে অল্পক্ষণ অবস্থানও অসম্ভব ছিল। এমনি প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যে, রোমক বাহিনী এখানে এসে আমাদের উপর আক্রমণ করার আগেই আমরা এগিয়ে গিয়ে তাদের গতিরোধ করব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই ঘোষণায় ইসলাম বিদ্বেষী কুচক্রী মহল স্বরূপে ময়দানে আবির্ভূত হয়। তারা বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা এবং গুজব ছড়াতে চেষ্টা করে। মুসলমানরা যাতে মদীনা হতে না বের হয় তার জন্য এই বিদ্বেষী মহল নানা অপতৎপরতায় মেতে ওঠে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল কিছু নামধারী মুসলমান। এরা বাহ্যিকভাবে নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও আসলে তারা ছিল কাফের। বিভীষণ কপটচারী। মুসলমানরা যুদ্ধ-প্রস্তুতিতে সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ করলে এই ঘৃণ্য মুনাফিক শ্রেণী তাদেরকে এই বলে হীনবল ও আতঙ্কিত করে যে, চলতি আবহাওয়ার মধ্যে যুদ্ধযাত্রা করলে প্রখর গরম এবং পানির স্বল্পতায় পথিমধ্যেই সবাই মারা পড়বে। যুদ্ধবিরোধী এ অপতৎপরতার সাথে ইহুদীবাদের গভীর যোগসাজোশ ছিল। দাবার গুটি মূলত এদের হাতেই ছিল। পর্দার অন্তরাল হতে কলকাঠি এরাই নাড়াত।’
মুনাফেক এবং ইহুদীবাদের প্রোপাগাণ্ডা সত্ত্বেও মুসলমানদের সিংহভাগ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সার্বিক প্রস্তুতি নিতে বেশী দিন ব্যয় করেন না। অক্টোবরের শেষ দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে যে সেনাবাহিনী যুদ্ধযাত্রা করার জন্য চূড়ান্তভাবে তৈরী হয় তার সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার। দশ হাজার ছিল আরোহী। এই মুজাহিদ বাহিনীতে মদীনা ছাড়াও মক্কা এবং যে সমস্ত গোত্র আন্তরিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আসন্ন যুদ্ধ ছিল মক্কা-মদীনা বনাম বিশাল রোম শক্তির অসম লড়াই। জগদ্বিখ্যাত যোদ্ধা রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামরিক বাহিনী ছিল মুজাহিদ বাহিনীর এবারের প্রতিপক্ষ।
“৬৩০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী রওনা হয়ে যায়। সূর্যের তীব্র উত্তাপে ভূ-পৃষ্ঠ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছিল। বালু এত গরম ছিল যে, উট-ঘোড়ার পা ঝলসে যাচ্ছিল। এ বছর আরবে দুর্ভিক্ষ এবং মঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যার ফলে খাদ্য রসদেও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। পানিও ছিল কম। মুজাহিদরা এই তীব্র গরমের মাঝেও শুধু এ আশঙ্কায় পানি পান করতেন না যে, না জানি পানি এখান থেকে কত দূরে। কিছুদূর গিয়েই মুসলমানদের ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে যায়। পানির অভাবে গলা শুকিয়ে কাষ্ঠ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও তাদের মুখে আল্লাহর নাম জারী ছিল এবং তারা এমন প্রত্যয়দীপ্ত ছিল যা লেখা কিংবা মৌখিক বর্ণনার ঊর্ধ্বে। কল্পনায় তার একটি নমুনাচিত্র ধারণ করা যেতে পারে মাত্র। নতুবা শব্দের গাঁথুনীতে কাগজের পিঠে তার স্বরূপ তুলে ধরা সত্যই দুরূহ, অসম্ভব। তাদের এহেন বর্ণনাতীত ত্যাগ-তিতীক্ষার প্রতিদান একমাত্র আল্লাহ পাকই দিতে পারেন। কোন মানুষের পক্ষে তার বিনিময় দেয়া সম্ভব নয়। চরম প্রতিকূল এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা সত্ত্বেও মুজাহিদ বাহিনী তীব্র প্রেরণা এবং আরাধ্য সাধনার মন্ত্রে উজ্জিবীত হয়ে আসমান-জমিনের উত্তপ্ত অঙ্গারের বুক চিরে চিরে চলতে থাকে।
দীর্ঘ প্রায় ১৪ দিন পর মুজাহিদ বাহিনী সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা তাবুকে গিয়ে পৌঁছে। ঐতিহাসিকগণ বিস্ময় প্রকাশ করে লেখেন, প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে মুজাহিদ বাহিনী যে পথ ১৪ দিনে অতিক্রম করে, স্বাভাবিক অবস্থা এবং আবহাওয়া অনুকুল থাকার সময়েই এতদিন লাগত এ পথ অতিক্রম করতে। এ পথটি ১৪ দিন সফরের হওয়ায় রসিক মুসাফিররা একে ‘চৌদ্দ মঞ্জিল’ বলত। কোন কোন ঐতিহাসিক এই চৌদ্দ মঞ্জিলকে ১৪ দিন বলে অভিহিত করেছেন। মুসলিম বাহিনী তাবুকে পৌঁছলে এক গোয়েন্দা এসে সংবাদ দেয় যে, শত্রু সেনাদের যে বাহিনীটি উরদুন অভিমুখে রওনা হয়ে যায় তারা এখন দেমাস্কে অবস্থান করছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যদেরকে তাবুকে ক্যাম্প স্থাপনের নির্দেশ দেন এবং করণীয় নির্ধারণে জরুরী পরামর্শ করতে কমান্ডারদের ডেকে পাঠান। সকলের ধারণা ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক হতে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিবেন এবং দেমাস্ক বা দেমাস্কের আশে-পাশে চূড়ান্ত লড়াই সংঘটিত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত কমান্ডারদের সামনে পরিস্থিতি তুলে ধরে পরামর্শ আহ্বান করেন। রোমকদের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য—এমন বিশ্বাস মাথায় রেখে সবাই পরামর্শ প্রদান করে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে বিস্ময়ের ঘূর্ণাবর্তে ঠেলে দিয়ে জানান যে, সৈন্য তাবুক থেকে সামনে অগ্রসর হবে না।
ঐতিহাসিকদের অভিমত, সামনে অগ্রসর না হওয়ার এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রভূত সমর-বিচক্ষণতা কাজ করেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা ত্যাগের প্রাক্কালে বলেছিলেন, রোমকদের গতিরোধ করা হবে। তিনি নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে এত দূরে এবং তীব্র গরমের মাঝে লড়াই শুরু করতে চান না। তিনি উল্টো হিরাক্লিয়াসের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন যে, সে চাইলে নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে তাবুকে এসে লড়াই করতে পারে। মুজাহিদ বাহিনী যুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে গিয়েছিল। তাদের অন্তরে কোন বিভ্রান্তি কিংবা কোন ভীতি ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ সব সময় পেশীশক্তির দাপটে হয় না। বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ এবং কুশলী নীতি অনেক সময় গ্রহণ করতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতাকে কাজে লাগান। রোমকরা যাতে মদীনায় যেতে না পারে তার জন্য এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যে, অত্র এলাকার যারা রোমকদের অধীনে ছিল তাদেরকে নিজেদের অধীনে আনতে প্রতিনিধি দল গঠন করেন। ৪টি উল্লেখযোগ্য স্থানে এই প্রতিনিধি দল পাঠানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়। আকাবা তথা ঈলা, মুকনানা, আজরুহ এবং যারবা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের পরিবর্তে বন্ধুত্বের শর্তাবলী নির্ধারণ করে এ সমস্ত স্থানে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। একটি শর্ত এই ছিল যে, যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না তাদেরকে জোরপূর্বক যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হবে না। আরেকটি শর্ত ছিল, তাদের প্রতি কেউ চড়াও হলে তাদের প্রতিরোধ করাকে মুসলমানরা দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে জ্ঞান করবে। এর বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র তাদের থেকে কর আদায় করবে।
সর্বপ্রথম ঈলার অনুগত নেতা নিজেই এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বন্ধুত্বের পয়গাম কবুল করে এবং নিয়মিত কর প্রদানের শর্ত মেনে নেয়। এর পরে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে আরো দুটি শক্তিশালী গোত্র মুসলমানদের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং করারোপের শর্তও মেনে নেয়।
‘আল যাওফ’ নামে একটি স্থান ছিল। তৎকালে তাকে ‘দাওমাতুল জানদাল’ বলা হতো। ভয়ঙ্কর মরুভূমি অধ্যুষিত ছিল এ এলাকা। সে সময়কার বর্ণনা হতে জানা যায় যে, এ স্থানে এমন বালুর টিবি এবং প্রশস্ত প্রান্তর ছিল যাকে অজেয় মনে করা হতো। দাওমাতুল জান্দালের শাসক ছিল উকায়দর বিন মালিক। তার রাষ্ট্রের অবস্থান একটি অজেয় এলাকায় থাকায় সে নিজের এলাকাকে দুর্ভেদ্য ও অজেয় মনে করত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকায়দর বিন মালিকের কাছে যে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন তিনি এ জবাব নিয়ে ফিরে আসেন যে, উকায়দর বন্ধুত্বের রাখি-বন্ধনও গ্রহণ করেনি আবার কর দিতে সম্মত নয়। বরং সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে যে, মুসলমানদেরকে সে বড় শত্রু বলে মনে করে এবং ইসলামের ক্ষতি সাধনে সে কোন ক্রটি করবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তলব করে বলেন, ৪০০ অশ্বারোহী নিয়ে যাও এবং উকায়দর বিন মালিককে জীবিত ধরে আন।
উকায়দর দরবারে সর্বোচ্চ মসনদে আসীন। তার পশ্চাতে বিবস্ত্রপ্রায় দু’তরুণী দাড়িয়ে পাখা টেনে বাতাস করছিল। অন্যান্য বাদশার মত উকায়দরের চেহারাও ঝলকিত এবং প্রতাপদীপ্ত।
“ইবনে মালিক!” এক সিনিয়র মন্ত্রী এবং সিপাহসালার দাড়িয়ে বলে— “আপনার রাজত্ব দীর্ঘজীবী হোক। ঈলা, যারবা, আজরুহ এবং মুকনানার গোত্রসমূহ মুসলমানদের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার খবর আপনি শুনেছেন কি? আজ তারা মিত্রত্ব বরণ করেছে আর ক’দিন পরে শোনা যাবে তারা কুরাইশী মুহাম্মাদের ধর্মমতও মেনে নিয়েছে।”
‘সম্মানিত মন্ত্রী কি এই পরামর্শ দিতে চাচ্ছেন যে, আমরাও মুসলমানদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে যাই?” উকায়দর বিন মালিক বলে—“এমন কোন পরামর্শ আমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই।”
“না, ইবনে মালিক! আমি সে পরামর্শ দিচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য হলো”—প্রবীণ মন্ত্রী বলে, “বয়স বেশী হওয়ায় আমার চোখ যা দেখেছে তা আপনার চোখ দেখেনি। আমি বিশ্বাস করি, আপনি মুসলমানদের সবচে বড় দুশমন। কিন্তু আমার কাছে লাগছে, আপনি শত্রুকে এত তুচ্ছ জ্ঞান করছেন যে, তারা বাস্তবে আমাদের উপর আক্রমণ করলে তাদের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে আপনি কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন না।
“পবিত্র ক্রুশের শপথ।” উকায়দর বিন মালিক বলে—“আমাদের প্রাকৃতিক অবস্থানই আমাদের রাজত্ব অক্ষুন্ন রাখবে। মুসলমানরা এখানে আসার দুঃসাহস করলে এখানকার ভয়ঙ্কর মরুর তীষ্ণার্ত বালুরাশি তাদের দেহের রক্ত চুষে নিবে। দাওমাতুল যান্দালের চারপাশে যে সমস্ত বালু ও মাটির টিলা রয়েছে খোদা এগুলোকে আমার রাজত্বের অতন্দ্র প্রহরী রূপে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। এগুলো অক্ষুন্ন থাকতে কেউ আমাদের পরাভূত করতে পারবে না।”
উকায়দারের দরবারে যখন এই আলোচনা চলছে, তখন হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চারশ জানবাজ মুজাহিদ নিয়ে অর্ধেক পথ চলে এসেছেন। পরের দিনই তারা ঐ মরুভূমিতে প্রবেশ করেন ঐতিহাসিকগণ যাকে অজেয় লিখেছেন। এখানে পা দিয়েই মুজাহিদদের চেহারা বালুর ন্যায় শুষ্ক হয়ে যায়। অশ্বের ক্ষীণ গতিই বলে দিচ্ছিল, এই পথচলা এবং তৃষ্ণা তাদের সহ্যসীমার বাইরে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্ব তাদের অন্তরে নয়াপ্রাণ সঞ্চার করেছিল।
দাওমাতুল জান্দাল অত্যন্ত মনোলোভা এবং চিত্তাকর্ষক নগরী ছিল। নগরের চতুর্দিকে সুদৃঢ় প্রাচীর ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শ্বাসরুদ্ধকর সফর শেষে এই নগর প্রাচীরের কাছে গিয়ে পৌঁছান। তিনি অশ্বারোহীদেরকে একটি প্রশস্ত নিম্নবর্তী এলাকায় লুকিয়ে রাখেন। সৈন্যদের শারীরিক অবস্থা এত নাজুক ও দুর্বল ছিল যে, কমপক্ষে একদিন একরাত তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে পুরো প্রস্তুত এবং সতর্কাবস্থায় রাখেন।
ইতোমধ্যে সূর্য অস্ত যায়। রাত ক্রমে ঘনীভূত হতে থাকে। শশী দূর আকাশের গায়ে ভেসে ভেসে পূর্ণ ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে চমকাতে থাকে। মরুভূমির চাদের আলো অত্যন্ত নির্মল, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক সৈন্যকে সাথে নিয়ে নগর প্রাচীরের দিকে অগ্রসর হন। তিনি ইতোমধ্যে হাল্কা জরিপ চালিয়ে দেখেন যে, এত বড় শহর অবরোধ করতে মাত্র ৪০০ সৈন্য যথেষ্ট নয়। ঊর্ধ্বে তাদের অন্তরীণ কিংবা নজরবন্দী করা সম্ভব মাত্র। দ্বিতীয় আরেকটি পথ ছিল সরাসরি তাদেরকে লড়ার আহ্বান জানানো।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কেল্লার ফটকের কিছু দূরে একটি উঁচু স্থানে বসে থাকেন। চাঁদের আলো এত স্বচ্ছ ছিল যে, প্রাচীরের উপর থেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখা যাবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
হঠাৎ কেল্লার ফটক নড়ে চড়ে ওঠে। দরজার পাল্লা ক্রমেই ফাক হয়ে দু’টি দু’দিকে সরে যায়। কেল্লার ফটক এখন উন্মুক্ত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ফটক উন্মুক্ত দেখে মনে করেন, হয়ত উকায়দার সসৈন্যে বেরিয়ে আসছে এবং তাদের উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু উকায়দারের পেছনে মাত্র কয়েকজন অশ্বারোহী বের হয়। তারা বেরিয়ে যেতেই ফটক বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর মনে পড়ে যায় যে, তাবুক থেকে রওয়ানার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন, “শিকাররত অবস্থায় তোমরা উকায়দারের সাক্ষাৎ পাবে।”
উকায়দার বিন মালিক অত্যন্ত শিকার প্রিয় ছিল। শিকারই ছিল তার শখ। তার এই শিকারপ্রিয়তা এত খ্যাতি লাভ করে যে, যেন তার জন্মই হয়েছে শিকারের জন্য। মরু এলাকায় শিকারের সময় ছিল রাত। দিনের বেলায় পশু-প্রাণী লোকচক্ষুর অন্তরালে এবং আত্মগোপন করে থাকত। ভরা পূর্ণিমা রাত ছিল শিকারের মোক্ষম সময়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শত্রুর আচার-আচরণ এবং অভ্যাস সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন এবং হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে উকায়দার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিলেন।
উকায়দার বিন মালিক কয়েকজন অশ্বারোহী নিয়ে বেরিয়ে গেলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার উদ্দেশ্য ও মনোভাব যাচাই করেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে, উকায়দার এখনও জানতে পারেনি যে, ৪০০ মুসলমান তার শহরের নিকটে পৌঁছে গেছে। আর সে আমোদ-প্রমোদের সাথে শিকার করতে যাচ্ছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত ক্রলিং করে করে সাথীকে নিয়ে পিছনে সরে আসেন। উকায়দার অশ্বারোহীদের নিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দৌড়ে লুকানো সৈন্যদের কাছে আসেন। তিনি তাড়াতাড়ি কিছু সৈন্য বাছাই করে নেন। অবশ্য সবাই পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। তিনি বাছাই করা এই সৈন্যদেরকে নিজের নেতৃত্বে নিয়ে উকায়দারের পথে রওনা হয়ে যান। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন যে, তিনি উকায়দারকে শহর থেকে এত দূরে যাওয়ার সুযোগ দেন যেখানে তাদের উপর আক্রমণ হলে শহরে তার আওয়াজ পৌঁছবে না।
রাতের পিনপতন নীরবতার মধ্যে এত বেশী ঘোড়ার আওয়াজ চেপে রাখা অসম্ভব ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই উকায়দার এবং তার সাথীরা টের পেয়ে যায় যে, তাদের পিছনে অশ্বারোহী আসছে। উকায়দারের ভাই হাসসানও তাদের সাথে ছিল। সে বলে, আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি, এরা কারা। সে ঘোড়া ঘুরাতেই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদেরকে একযোগে আক্রমণের নির্দেশ দেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তার সৈন্যদের হুঙ্কার থেকেই উকায়দার বুঝতে পারে যে, আক্রমণকারীরা মুসলমান। হাসসান বর্শার সাহায্যে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মারা যায়।
উকায়দার অশ্বারোহীদের থেকে কিছুটা পৃথক ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে উকায়দারের গতিরোধ করে দাঁড়ান। উকায়দার এমন হতভম্ব হয়ে যায় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর আক্রমণ করার পরিবর্তে সে রাস্তা হতে এক পাশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অস্ত্র দ্বারা তাকে আঘাত করলেন না এবং ঘোড়ার গতিও রোধ করলেন না। তিনি নিজ ঘোড়াকে উকায়দারের ঘোড়ার পাশ দিয়ে নিয়ে যান এবং পাশ অতিক্রমের সময় উকায়দারের কোমরে হাত দিয়ে শূন্যে উঁচিয়ে তাকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যান।
উকায়দার বিন মালিকের শিকার সঙ্গী এবং বডিগার্ডরা যখন দেখল যে, তাদের নেতা বন্দী এবং তার ভাই মৃত তখন তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বাহিনীর মোকাবিলার পরিবর্তে পলায়নের রাস্তা খুঁজে নিল। স্থানটি গভীর-অগভীর গর্ত এবং টিলা অধ্যুষিত হওয়ায় পলায়নের জন্য বেশ উপযোগী ছিল। ফলে কিছু লোক আহত হলেও সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। নগরে প্রবেশ করেই তারা দরজা বন্ধ করে দিলো।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উকায়দারকে আটকে রাখেন এবং কিছুদূর গিয়ে ঘোড়া থামান। তিনি উকায়দারকে জানান, তার পলায়নের সকল পথ রুদ্ধ। কোন সম্ভাবনা নেই। এরপর তিনি তাকে ঘোড়া থেকে নামান এবং নিজেও নেমে আসেন।
“তুমি নিজেকে অজেয় মনে করতে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করেন।
“হ্যাঁ, আমি নিজেকে একজন অজেয় হিসেবেই মনে করতাম।” উকায়দার বলে—“কিন্তু আপনার নামটা তো এখনও জানতে পারলাম না।
“খালিদ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন—“খালিদ বিন ওলীদ।”
“হ্যাঁ, উকায়দার বলে—“এ নামটা আমি আগেও শুনেছি।…খালিদের পক্ষেই এখানে আসা সম্ভব।”
“না উকায়দার!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় ঈমান এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অনাবিল বিশ্বাস লালন করে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই এখানে আসতে পারে।”
“আমার সাথে কেমন আচরণ করা হবে?” উকায়দার জানতে চায়।
“তোমার সাথে ঐ আচরণ করা হবে না, যা তুমি আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত দূতের সাথে করেছিলে”—হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন—“আমাদের পক্ষ হতে উত্তম ব্যবহারের ব্যাপারে নিশ্চিত থাক ইবনে মালিক! আমরা রোমীয় এবং হিরাক্লিয়াসের প্রেরিত হলে আমরা বলতাম, ধন-দৌলত, শহরের সুন্দরী যুবতী এবং শরাবের ড্রাম আমাদের হাতে তুলে দাও। প্রথমে আমোদ-প্রমোদ করতাম এরপর হিরাক্লিয়াসের নির্দেশ মান্য করতাম।”
“হ্যাঁ। উকায়দার বলে—“আপনারা রোমীয় হলে এমনই করতেন। তারা ঠিক এমনটিই করে থাকে। এমন কোন উপঢৌকন নেই যা আমি হিরাক্লিয়াসকে দেইনি। ওলীদের পুত্র! রোমীয়দের সন্তুষ্ট রাখা আমার অস্তিত্বের জন্য অনিবার্য ছিল।”
“রোমীয়রা এখন কোথায়?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন—“বিপদের মুহূর্তে এখন তাদেরকে ডাকতে পার? আমরা তোমার সাহায্য করতে আসব। বন্দী হিসেবে নয়; একজন অতিথি হিসেবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার উপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না। জোর করা হবে না।
আমরা শত্রুতা নয়; বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে এসেছি। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনের গিয়ে অবশ্যই তোমার ভুল ভাঙ্গবে যে, এতদিন তুমি যাকে শত্রু মনে করতে তিনি শত্রু নন, বন্ধুর যোগ্য।”
উকায়দার বিন মালিকের মুখ যেন বোবা হয়ে যায়। তার মুখ থেকে কোন কথা সরে না। তার ঘোড়া লক্ষ্যহীনভাবে কোথাও ঘুরছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদেরকে উকায়দারের ঘোড়া খুঁজে আনার নির্দেশ দেন। তারা ঘোড়া নিয়ে এলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উকায়দারকে তার ঘোড়ায় আরোহণ করান এবং সবাইকে তাবুক অভিমুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
তাবুক পৌঁছে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উকায়দারকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে উপস্থিত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সামনে সন্ধির শর্তসমূহ পেশ করেন। কিন্তু এমন কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শর্ত ছিল না, যার মধ্যে তার ইসলাম গ্রহণের প্রতি ইশারা ছিল না। তার সাথে মেহমানের মত আচরণ করা হয়। তার উপর কোনরূপ চাপ প্রয়োগ করা হয় না। এই শর্তটি তার খুব মনঃপুত হয় যে, মুসলমানরা তার হেফাজত করবে। উকায়দার কর প্রদানের শর্ত মেনে নিয়ে মিত্রতার সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করে। “কেবল মুসলমানরাই আমার সাহায্য করতে পারে”—চুক্তি স্বাক্ষরের পর সে মন্তব্য করেছিল।
উকায়দার বিন মালিক মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মুসলমানদের কর প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি গোত্রপতি নিজেরাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসে এবং তার বশ্যতা স্বীকার করে। এরূপভাবে অনেক দূর-দূরান্তের এলাকা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারে চলে আসে এবং সকল গোত্র মুসলমানদের মিত্রগোত্রে পরিণত হয়। এদের অধিকাংশ ইসলামও গ্রহণ করে।
এ বিপুল কুটনৈতিক বিজয়ের পর রোমীয়দের সাথে আর যুদ্ধ-বিগ্রহের কোনই প্রয়োজন ছিল না। কারণ, তাদের অগ্রযাত্রার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়; হিরাক্লিয়াসের জন্য এখন এই আশংকা সৃষ্টি হয়ে যায় যে, সে মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষের উদ্দেশ্যে মদীনা অভিমুখে রওনা হলে পথের আশে-পাশের গোত্রগুলো তাদের মদীনা পর্যন্ত পৌঁছার অনেক পূর্বেই মরু এলাকায় খতম করে দিবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুজাহিদ বাহিনীকে মদীনা প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম সৈন্যরা মদীনায় এসে উপস্থিত হন।