৩. হামিদ আরাবী ও রহীম গাজ্জালী

হামিদ আরাবী ও রহীম গাজ্জালী রাতেই হাজি আবদুল করীমের দেউরীতে চলে গেলো। তারা কি দেখে এসেছে তা জানালো আবদুল করীমকে।

এটা ভেল্কিবাজি হতে পারে না। ওরা দুজনে বললো।

আবদুল করীম অতি বিচক্ষণ লোক। তিনি কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুবে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি ঐ আলোর চমকই দেখেছো, না এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেছে এর আশেপাশের জায়গাটুকুও আলোকিত কিংবা আগুনের শিখার আভাও দেখা যেতে পারে।

তারা কিছু একটা চিন্তা করে জানালো, যখন আলোর চমক অদৃশ্য হয়ে গেলো তখন পরিত্যক্ত গির্জার সমনের দিকের জায়গা থেকে একটু দূরে ওদের চোখ পড়তেই সন্দেহ হয়েছিলো, এর নিচে কোথাও আগুন জ্বলছে। তারপর এক সময় এই প্রচ্ছন্ন আলোও মিলিয়ে গেলো।

এটা চরম ভাওতাবাজি ও ভেল্কিবাজি! হাজিব আবদুল করীম শতভাগ নিশ্চয়তার গলায় বললেন,

এটা কোন অলৌকিক ঘটনা নয় কিংবা জাদুরও কৃতিত্ব নয়। এর মাধ্যমে খ্রিষ্টানদেরকে আতংকিত করে আমাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদেরকেও প্রভাবান্বিত করা হচ্ছে।…..

আমি এর ব্যবস্থা করবো এবং এই ভেল্কিবাজিকে তোমরা দুজন খতম করবে। তোমরা যে দূর থকে আওয়াজ শুনেছো যে, গির্জায় যাও এবং সেখানে তোমাদেরকে বলা হবে তোমাদের ওপর কোন বিপদ আসছে। এটা এই দুনিয়ারই কোন মানুষের আওয়াজ। কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি জেনে যাবো, গির্জায় যারা যাবে তাদেরকে কি বলা হবে?

পরদিন আবদুল করীমকে চার পাঁচজন লোক এসে বললো, আজ প্রতিটি গির্জায় এত ভিড় যে, ভেতরে পা ফেলার জায়গা পাওয়া যায়নি।

পাদ্রীরা ইসলামের বিরুদ্ধে রীতি মতো বিষ উদগীরণ করেছে। আর উউন্দলুসের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এমন এমন কথা বলেছে যার অর্থ হলো, তোমরা এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। পাদ্রীরা হযরত ঈসা (আ) এর আত্মপ্রকাশকে সত্য বলে ঘোষণা করেছে এবং লোকদেরকে খুব ভয় দেখিয়েছে।

লোকরো যখন গির্জা থেকে বের হলো তখন তাদের ওপর স্তব্ধতা নেমে এসেছিলো।

পরদিন আবদুল করীম সালার আবদুর রউফের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে ঠিক করেন যে, শাহে উন্দলুসকে কোন কিছু না বলেই এই ভণ্ডামির মুখোশ ফাস করে দিতে হবে। তিনি তখনই রহীম ও হামিদকে ডেকে পাঠালেন। সালার আবদুর রউফ চারজন সেনাকে তলব করেন।

আমরা তোমাদেরকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করছি। প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম ঐ ছয়জনকে বললেন, আমরা জানতে পেরেছি হযরত ঈসা (আ)-এর এই আত্মপ্রকাশ ও অদৃশ্য থেকে আওয়াজ সম্পূর্ণ ভাওতাবাজি। এটা তখনই উৎখাত করতে হবে যখন সেখানে মানুষের ভিড় থাকবে এবং নক্ষত্রের চমক দেখা দেবে কিংবা হযরত ঈসা (আ)-কে দেখানোর নামে ভেল্কিবাজি দেখা যাবে।…..

তোমরা খেয়াল রাখবে, যেদিন জানতে পারবে, আজ রাতে আবার ঈসা (আ) এর আত্মপ্রকাশ ঘটবে সে রাতে তোমাদেরকে সে এলাকায় থাকতে হবে। কিন্তু লোকদের ভিড়ে নয়, বরং গির্জার কাছের পাহাড়ে যাবে। সেখানেই তোমরা দেখতে পাবে চমক কোথা থেকে আসে।…..

কোথাও না কোথাও অবশ্যই প্রজ্জলিত আগুন দেখতে পাবে। আর এটা এমন এক দৃষ্টির আড়াল করা জায়গায় জ্বলতে দেখবে যেখান থেকে আগুনের আভা লোকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। সেখানে একাধিক মানুষও থাকতে পারে। তাদেরকে কাবু করে আগুন নিভিয়ে দেবে।…..

তোমাদের মধ্যে দুজন গির্জার কাছে গিয়ে লুকিয়ে থেকে সতর্ক চোখে দেখবে। কাউকে উঁচু আওয়াজে কথা বলতে দেখলে সেখানে তাকে পাকড়াও করবে। তোমাদের সঙ্গে বর্শা ও খঞ্জর থাকবে। হতে পারে ওদের সঙ্গে তোমাদের লড়াই করতে হতে পারে। আর লড়াই হলে কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না। সব কয়টাকে খতম করে দিবে।…..

তারপর তোমাদের কেউ উঁচু আওয়াজে ঘোষণা করে দিবে, এসব ভাওতাবাজি। এখানে ঈসা মাসীহের আসার পশ্নই উঠে না। তারপর সকাল বেলা আমরা লোকদেরকে পরিত্যক্ত গির্জা ও অন্যান্য জায়গা দেখাবো। আর তাও দেখাবো যা গাছের ওপর থেকে চমকে উঠতো।

প্রধানমন্ত্রী হাজিব ও সালার রউফ তাদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন কখন কিভাবে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে হবে এবং এই মিশন কিভাবে জয় করবে।

তোমরা তোমাদের দ্বীন-ধর্ম ও সালতানাতে উন্দলুসের অতন্দ্র প্রহরী। এই দেশ ঐ শাহী খান্দানের নয়। তোমাদের এই দেশ। তোমাদের ঘরে ডাকাত পড়েছে এবং তোমাদের বাপ ডাকাতদেরকে ঘর লুট করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। তোমরা তো তোমাদের বাড়ি লুটপাটের হাত থেকে বাঁচাবে… এটা তোমাদের ঘর, এটা আমাদের ঘর।

আমরা সব রকম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। আমরা অবশ্যই যাবো। তাদের মধ্যে একজন বললো।

আমরা কারো কাছ থেকে কোন প্রতিদান চাইবো না।

প্রতিদান আল্লাহর কাছেও চাইবো না।

ছয় আত্মত্যাগী প্রস্তুত হয়ে গেলো।

দুদিন পরই জানা গেলো, আজ রাতে কিছু একটা দেখা যাবে। যারাই ওখানে যাবে তারা যেন ভালো করে পরিস্কার করে গোসল করে পবিত্র হয়ে যায়। মসজিদে সব মুসলমানকে সতর্ক করে দেয়া হলো, কেউ যেন ওখানে না যায়।

তবে সেই ছয়জন মুসলমান যাচ্ছিলো।

তাদের একজন রহীম গাজ্জালী আরেকজন হামিদ আরাবী। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চারজন গেরিলা দলের আত্মত্যাগী রয়েছে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ওরা সেখানে পৌঁছে গেলো। দিনের বেলা রহীম ও হামিদ এখানে বকরীচারীর বেশে এসে সবকিছু দেখে গেছে। পাহাড়ের ওপরে গিয়েও ওরা এদিক ওদিক মোটামুটি দেখে নিয়েছে।

সূর্যাস্তের পর আত্মত্যাগী দলটি অন্য দিক দিয়ে পাহাড়ে চড়লো। এই পাহাড়ের ঢাল একটাই নয়। একটি ঢাল শেষ হতেই ওপরে সামান্য কিছু জায়গা ময়দানের মতো সমতল। এখান থেকে অধিক ঢালু ঢাল ওপরে উঠে গেছে। উঁচু ঘাস ও বুনো ঝোঁপ-ঝাড় আড়াল নেয়ার দারুণ ব্যবস্থা করে রেখেছে।

ওপরের দিকে প্রথম ঢালটি শেষ হতেই সেই পরিত্যক্ত গির্জা। এর ডান দিকে চলে গেলে দেখা যাবে পাহাড়ের নিচের দিকে ঢাল নেমে গেছে। সেখানেই চোরা ও কাদায় থকথকে জায়গায় এবং বদ্ধ পানির বড় সড় একটা চৌবাচ্চাও রয়েছে। যার মধ্যে ছোটখাটো কুমীর আছে।

চোরা ভূমির এক প্রান্তে খাড়া প্রান্তর। যা গাছগাছালি ও ঝোঁপঝাড়ে আচ্ছাদিত। এই প্রান্তরের ওপর দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় শিলা পাথর।

গেরিলা দলের দুজনকে সঙ্গে নিলো হামিদ আরাবী। আর দুজনকে নিলো রহীম গাজ্জালী। ওরা আলাদা হয়ে গেলো। রহীম গাজ্জালীরা পরিত্যক্ত গির্জার কাছে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। হামিদ আরাবী তার সঙ্গীদের নিয়ে সেই গাছগুলোর কাছে চলে গেলো যার ওপর নক্ষত্রের চমক দেখা যায়।

যখন অন্ধকার এত গম্ভীর হয়ে গেলো যে, কারো হাতও নজরে পড়ে না তখন রহীম গাজ্জালীরা গির্জার একেবারে কাছ থেকে কিছু মানুষের নড়াচড়া ও ফিসফিস করে কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলো। তারপর গির্জার ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। যেটা পেছনের দিকের একটা ভাঙ্গা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো। ভেতর থেকে কয়েকজন লোক বের হলো।

জিনিসগুলো আরেকবার দেখে নাও। কেউ একজন বললো।

যা দরকার সবকিছুই নিয়েছি। তোমরা গাছে গিয়ে ওঠো। লোকজন আসতে শুরু করেছে। আরেকটি গলা শোনা গেলো।

লোকজনের চিন্তা করো না। ওরা তো আর ওপরে উঠতে যাবে না। আরেকজন বললো।

হামিদ আরাবী নক্ষত্র চমকানো গাছের কাছে সতর্ক হয়ে আছে। সে কয়েকটি পায়ের আওয়াজ পেলো। অন্ধকারে দুটি ছায়া মূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। তারপর একজন গাছে চড়তে লাগলো। নিচে দাঁড়ানো লোকটি জিজ্ঞেস করলো,

সেই জায়গাটা মনে আছে তো?

মনে আছে। ভালো করেই মনে আছে।

 দুই তিন জন হামিদ আরাবীর একেবারে কাছ ঘেঁষে চলে গেলো। তারা পাহাড়ের ঢালের নিচের প্রান্তরে নেমে গেলো। তারপর সামনের দিকের প্রান্তর থেকে নিচু সুরের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো।

লোকজন নিচে জমা হতে শুরু করেছে। তাদের শোরগোল স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

***

খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। সামনের দিকের প্রান্তর যেখানে শিলাপাথর দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সে জায়গাটা তীব্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। হামিদ আরাবী লক্ষ্য করে দেখলো, বড় সাইজের একটা ফানুস জ্বলছে। কিন্তু এর আলো শুধু সামনের দিকে যাচ্ছে। ডানে, বামে, উপরে নিচে যাচ্ছে না।

হামিদ দেখলো, যে লোকটি গাছে চড়েছিলো সে আবার নিচে নেমে আসছে। তার সঙ্গী সেখান থেকে চলে গেছে আগেই। হামিদ নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো। লোকটির নামা শেষ হতেই হামিদ আরাবী বর্শার ফলা লোকটির পাজরে ঠেকিয়ে বললো,

আবার ওপরে যাও। ওপরে যা কিছু রেখে এসেছে সেগুলো নামিয়ে আনো।

কে তুমি? সে অস্বস্তি ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলো।

আমি যা বলি তা করো। হামিদ আরাবী বললো।

বর্শা সরাও। আমি ওপরে যাচ্ছি। লোকটি বললো।

সে গাছে চড়তে লাগলো। অন্ধকারে আবছায়া মতোও কিছু দেখা যায় না। লোকটি কি করছে হামিদ সেটা দেখতে পেলো না। লোকটি খঞ্জর বের করে তারপর গাছের দিক থেকে সরে একটু ঘুরেই খঞ্জর দিয়ে আঘাত করলো হামিদকে।

হামিদ নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। খঞ্জর তার বাহু কেটে পাজরে গিয়ে লাগলো। তবে পেটে বিদ্ধ হলো না। হামিদ পেছনে সরে গিয়ে বর্শার ফলা আমূল লোকটির পেটে বিদ্ধ করে দিলো।

লোকটি উঁচু আওয়াজে কাউকে ডাকতে ডাকতে পড়ে গেলো।

হামিদ তার লোকদেরকে ডাকলো। হামিদ আছড়ে পাছড়ে সেদিকে ছুটলো যে দিকে তার লোকজন ছিলো এবং এর পাশে আলো জ্বলেছিলো।

গির্জার দিক থেকে কয়েকজন দৌড়ে আসতে লাগলো। তাদের হাতে উদ্যত তলোয়ার। হামিদ আরাবী তার লোকদেরকে লুকিয়ে পড়তে বললো এবং নিজেও ওদের সঙ্গে লুকিয়ে পড়লো।

গির্জা থেকে যারা ছুটে এসেছে তারা সংখ্যায় বেশি। ওরা ওদের আহত সঙ্গীকে দেখতে পেলো। গাছের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তেই সবাই ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে লাগলো কারা তাকে আহত করেছে।

একজন হামিদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো, হামিদ বসে বসেই তার পাজরে বর্শা ঢুকিয়ে দিলো। লোকটির মুখ দিয়ে এমন আর্তনাদ বেরিয়ে এলো যে, তার সঙ্গীরা এদিকে ছুটে এলো। তাদের মধ্যে একজন উঁচু আওয়াজে বললো,

আলো যেদিকে আছে সেদিকেই রাখো। এখানে সবকিছু দেখা যাচ্ছে।

ওরা হামিদ ও তার সঙ্গীদের দেখে ফেললো। হামিদ রহীম গাজ্জালীদেরকে ডেকে এ দিকে আসতে বললো। তারপর খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

কিন্তু সন্ত্রাসী দল সংখ্যায় বেশি হওয়াতে ওদের তিনজনকে ঘিরে ফেললো। তবে ওদিক থেকে রহীম গাজ্জালীরাও এসে গেলো।

ওদিকে হাজারো মানুষ নক্ষত্রের চমক দেখতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। আর এদিকে নক্ষত্রের চমক দেখানোর কলা-কুশলীরা জীবন-মরণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

***

রাতের শেষ প্রহর। হাজিব আবদুল করীম গভীর ঘুম থেকে হড়বড় করে উঠে বসলেন। তার কামরার দরজায় আওয়াজ হচ্ছে। তিনি দরজা খুলে দেখলেন, তার এক পরিচারক দাঁড়িয়ে আছে। সে হাজিবকে জানালো, বাইরে এক লোক এসেছে। সে এমনই আহত যে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

হাজিব ছুটে বের হয়ে পড়লেন। দারোয়ান ততক্ষণে আহত লোকটিকে এক দিকে শুইয়ে দিয়েছে। সে রহীম গাজ্জালী। ওর আপাদমস্তক রক্তাক্ত। সে যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায় রয়েছে। হাজিব দারোয়ানকে তাড়া দিয়ে বললেন, দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ও শল্য চিকিৎসককে নিয়ে এসো। কিন্তু রহীম গাজ্জালী বাধা দিয়ে বললো,

ডাক্তার বা সার্জন আসার আগ পর্যন্ত আমি জীবিত থাকবো না। রহীম গাজ্জালী কাতরাতে কাতরাতে বললো, আগে আমার কথা শুনুন। এখনো পর্যন্ত যদি আমার কোন সঙ্গী না থাকে তাহলে সবাই মারা গেছে। ওরা নিঃসন্দেহে ভণ্ড, প্রতারক, ভেল্কিবাজধারী।…..

ভেল্কিবাজদের কাউকে হয়তো আমরাও জীবিত রাখিনি। আপনি এখনই সেই পরিত্যক্ত গির্জায় চলে যান। সেখানে আমার সঙ্গীদের লাশ তো পাবেনই এবং সব ভেল্কিবাজির তথ্য উপাত্তও ওখানে পাবেন। আলামত-প্রমাণও হয়তো পেয়ে যাবেন।

থেমে থেমে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলছিলো রহীম গাজ্জালী। তাঁর নিঃশ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। ডাক্তার ও সার্জন আসতে আসতে রহীম গাজ্জালীর প্রাণটি তার পরম কর্তব্য পালনরত যখমে যখমে জর্জরিত দেহ থেকে বেরিয়ে গেলো।

হাজিব আবদুল করীম তীব্র বেগে বেরিয়ে আসা কান্না চাপা দেয়ার ব্যর্থ চেস্টা করতে করতে বললেন,

এই শহীদদের রক্ত কি বৃথা যেতে পারে? কখনোই নয়।

শিরা উপশিরায় তার রক্ত টগবগ করতে লাগলো। দাঁতে দাঁত বাড়ি খেতে লাগলো। পরিচারককে প্রায় ধমকে উঠে বললেন, এখনই সালার আবদুর রউফকে ডেকে নিয়ে এসো, সে যে অবস্থাতেই থাকুক সে অবস্থাতেই যেন চলে আসে।

আবদু ররউফের দেউরী দূরে নয়। তিনি চলে এলেন। রহীম গাজ্জালীর লাশ দেখে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হাজিব আবদুল করীম তাকে জানালেন রহীম গাজ্জালী মারা যাওয়ার আগে তাকে কি বলে গেছে।

সালার আবদুর রউফ তখন বিশ পঁচিশ জন সিপাহী ও কমান্ডারদের একটি ইউনিট প্রস্তুত করলেন এবং আবদুল করীম ও তার নেতৃত্বে গোড়সওয়ার হয়ে সবাই পরিত্যক্ত গির্জায় পৌঁছে গেলো। এখনো অন্ধকার থাকায় সঙ্গে করে মশালও নিয়ে গেলো তারা।

গির্জায় ঢুকে তারা দেখলো ভেতরে দুটি বাতি জ্বলছে। কোন মানুষজন নেই। দেয়ালের সঙ্গে কাঠের একটা তখতা পড়ে আছে। এর ওপর হযরত ঈসা (আ) এর অনক বড় কাল্পনিক একটা ছবি। এটাকেই ক্রুশের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় দেখানো হয়েছিলো। ছবিটি তৈলচিত্র। এ কারণে বেশ চকচকে।

সবাই বাইরে বের হয়ে দেখলো, একটি গাছের নিচে কয়েকটি লাশ পড়ে আছে। এর মধ্যে মুসলমান আত্মত্যাগী ইউনিটের সেই সৈনিকরাও আছে এবং খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরাও।

লাশগুলোকে সনাক্ত করার চেষ্টা করা হলো। একটি লাশ নড়ে উঠলো। এটা মুসলমানের লাশ। সালার আবদুর রউফ তার পাশে বসে পড়া আতহ লোকটিকে তার নাম ধরে ডাকলেন। এক সিপাহীকে বললেন, ওকে উঠাও। ও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

ওর পেট ফেটে গেছে। নিজের সালারকে দেখতে পেয়ে তার চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। ধীরে ধীরে সে একটি হাত উঠালো এবং ওপরে গাছের দিকে ইংগিত করলো।

আবদুর রউফ জিজ্ঞেস করলেন ওপরে কি দেখেছে? আহত জানবাযের কেবল ঠোঁট দুটো নড়লো। ওপরে উঠানো হাতটি পড়ে গেলো। তার মাথা একদিকে ঢলে পড়লো।

তারপর সবগুলো লাশ দেখা হলো, আর কেউ জীবিত নেই এখানে। গির্জার দিক থেকে কারো ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো।

সিপাহীরা সেদিকে দৌড়ে গেলো। ওরা দেখলো, দুজন লোক সেই কাঠের বড় তখতাটি- যার ওপর ঈসা (আ) এর ছবি ছিলো, উঠিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে। সিপাহীদেরকে তাদের পেছনে ছুটে আসতে দেখে দ্রুত পাহাড় থেকে নামতে লাগলো। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুজনেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো।

গির্জার ভেতর থেকে বোয়া উঠতে দেখা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে চেরাগদানগুলো থেকে উজ্জ্বল আলো বের হতে লাগলো। ছাদটা কড়িকাঠের। আর ভেতরে পুরোনো বেঞ্চ, টেবিল, খাঁটিয়া ছিলো। দ্রুত সেগুলোকে আগুনে গ্রাস করলো। এমন অগ্নিকাণ্ড নেভানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং এর কোন প্রয়োজনও ছিলো না।

***

গ্রেফতার করা দুই খ্রিষ্টানকে জ্বলন্ত গির্জার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। এখন গির্জার দরজা ও জানলাগুরো দিয়েও আগুনের শিখা বের হয়ে আসছ। বারান্দার কাঠের থামগুলোতেও আগুন ধরে গেছে। পুরো গির্জা ভয়ংকর এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।

যদি ঠিকঠাক বলে দাও, এসব ভেল্কিবাজি কি ছিলো তাহলে তোমাদেরকে ছেড়ে দেবো। প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম বললেন, আমরা তোমাদেরকে গ্রেফতার করবো না। এটা তো তোমাদের ধর্ম।

তোমরা তোমাদের ধর্মের জন্য যত প্রতারণা থোকাবাজি করো আমাদের কোন আপত্তি নেই। …..কিন্তু আমি অবশ্যই এটা জানবো যে, এটার মূলে কি ছিলো। যদি না বলো তাহলে এই জ্বলন্ত গির্জায় ফেলে দেয়া হবে। দুজনকে টেনে হেচড়ে জ্বলন্ত গির্জার এত কাছে নিয়ে যাওয়া হলো যে, আগুনের প্রচন্ড উত্তাপে ওদের চেহারা ঝলসে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।

আগুনের শো শো আওয়াজ বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার মতো। দুই খ্রিষ্টান পেছন দিকে সরে আসতে লাগলো। কেউ ওদেরকে বাধা দিলো না।

আমরা আপনাকে কখনো বলবো না এর পেছনে কার হাত রয়েছে? তাদের একজন বললো, আমরা আপনাকে কোনভাবেই বলবো না এর পেছনে কার হাত রয়েছে। যদি এর পরও জানতে চান তাহলে আমাদেরকে আগুনে ফেলে দিন। আমরা নিজেরাই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে যে, সে তার ধর্মের জন্য তারই ইবাদতখানায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে?

সে ধর্মই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে যার অনুসারীরা তাদের পবিত্র ধর্মের জন্য জীবন্ত পুড়ে মরাকে অতি সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করে।…

অন্যজন অতি দুঃসাহসিক গলায় বললো, ইসলাম মৃত্যুবরণ করছে। আর খ্রিষ্টধর্ম পুনর্জীবন লাভ করছে। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।

এ ধরনের কথা বলতে ওদেরকে তো বাধা দেয়া হলোই না; বরং তাদেরকে উৎসাহ দেয়া হলো। ওদের মধ্যে যে যথেষ্ট জযবা-আবেগ আর বিচক্ষণতা রয়েছে এতে কারো কোন সন্দেহ রইলো না। বড় বড় কথা বা অবাস্তব কোন কথা ওরা বললো না।

পরিস্কার ভাষায় ওরা জানালো, সামনের প্রান্তরের শিলা পাথরের দেয়াল আর ঘন ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে তীব্র শিখাধারী ফানুস জ্বালানো হতো। এর ওপর গোল চিমনি রাখা হতো।

চিমনির তিন দিকে কালো রঙ করা। একদিক উন্মুক্ত। এদিক দিয়ে আলো বের হয়। যে কারণে আলো কোন দিকে না ছড়িয়ে শুধু সামনের দিকের গাছ পর্যন্ত পৌঁছে।

সামনের গাছের একটি ডালে একটা কাঠের এক হাত সমান টুকরো বেঁধে রাখা আছে। এর চারপাশে আয়না লাগানো। এর ওপর আলো পড়তেই সেটা ঠিকরে আলো বের হতো। এটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে বাতাসে মৃদু হেলতে দুলতো। এ থেকে কম্পিত আলো বের হতো। দূর থেকে দর্শকরা এটাকেই মনে করতো উজ্জল নক্ষত্র।

হযরত ঈসা (আ)-এর ব্যাপারে যেহেতু ভিত্তিহীন জনশ্রুতি আছে যে, তাঁর নূর যারা দেখবে তারা সেটা কোন গাছের শাখায় নক্ষত্র চমকানোর রূপে দেখবে। মানুষের এই কুসংস্কারের পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে এই খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলটি নাটক খেলে। এই কম্পিত আলোর সাহায্যে হযরত ঈসা (আ) এর ক্রুশে ঝুলানো ছবি তুলে ধরে। লোকেরা মনে করে, সত্যিই বুঝি ঈসা (আ) আত্মপ্রকাশ করেছেন। …..

এখন ধরা খাওয়ার পর এরা গির্জায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এর আগে ঈসা (আ) এর কাল্পনিক মূর্তিটি বের করে নিয়েছিলো।

সেই আহত জানবায সৈন্যটি মৃত্যুর আগে যে হাত উঁচিয়ে গাছের দিকে ইংগিত করে গিয়েছিলো, এতে আসলে সে এই কাঠের টুকরোটি দেখাতে চেয়েছিলো; যেটা চারপাশ থেকে কাঁচ সংযুক্ত। সেটা নামানো হলো। এটা এতক্ষণ গাছের শাখায় ঝুলছিলো।

আমরা যা কিছু করেছি আমাদের ধর্মের জন্য করেছি। তাদের একজন বললো, আমাদের লোকেরা যে ভাষা ও যে ধরনের ইংগিত বুঝে আমরা তাদেরকে সে ভাষা ও ইংগিতে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি, ওরা যেন নিজেদের ধর্ম না ছাড়ে। ইসলামের প্রতি যেন ঝুঁকে না পড়ে।…..

আপনাদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। এটা দুই ধর্মের মধ্যে শক্রতা। ইসলামের বিস্তৃতি ঘটছে চারদিকে। আমরা তা রোধ করার জন্য বৈধ অবৈধ সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করবো। আমাদের দুজনকে আগুনে ফেলে দিন। আমাদের জ্বলন্ত ছাই থেকে আরো দুজন আত্মত্যগীর জন্ম হবে। যারা আমাদের পথে চলবে। এই গির্জার আগুন সারা উন্দলুসে ছড়িয়ে পড়বে।

***

সূর্যোদয় হচ্ছে। এ সময় হাজিব আবদুল করীম ও সালার রউফ আবদুর রহমানের মহলে পৌঁছলেন। তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো জানবার্য ও খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের লাশ।

হযরত ঈসা (আ) এর কাল্পনিক মূর্তি, ফানুস ও কাঁচযুক্ত কাষ্ঠখণ্ডটিও নিয়ে আসা হলো। আর গ্রেফতার করা দুই খ্রিষ্টানও সঙ্গে ছিলো।

তাদের আসার খবর শাহ উন্দলুস পেয়েছেন। তিনি এখনো শয়ন কক্ষে। সুলতানা তার সঙ্গে রয়েছে।

আবদুর রহমান তাদেরকে ডেকে পাঠালেন।

তারা দুজন সাক্ষাৎ কক্ষে গিয়ে বসলেন। আবদুর রহমান শয়ন কক্ষ থেকে বের হতেই সুলতানা তার খাস খাদেমাকে ডেকে বললো,

যারিয়াবকে গিয়ে বলল, যে অবস্থাতেই থাকুক চলে আসে যেন। আবদুল করীম ও আবদুর রউফ এসেছেন।

আবদুর রহমান সাক্ষাত কক্ষে এলেন। সুলতানাও তার সঙ্গে সঙ্গে কামরায় ঢুকলেন। এখনো তার পরনে নাইটি। দুই কাঁধ ও বাহুমূল উন্মুক্ত। রেশম কোমল ঝলমলে চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো। এ তার প্রকৃত রূপ। এর মধ্যে কোন ধরনের অপ্রাকৃতিক প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। এই নিরাভরণ সাজেই তার থেকে রূপের এক চরম উত্তাপ ঠিকরে পড়ছে।

উন্দলুসের প্রধানমন্ত্রী ও সালার দুজনে দুজনের দিকে তাকালেন। সুলতানাকে দেখে তারা যে মনে মনে ধাক্কা খেলেন সেটাই একে অপরের চোখে পড়ে ফেললেন। তাদের প্রতিক্রিয়া, চিন্তা ভাবনা এক-অভিন্ন।

দুজনের চিন্তার সার কথা এটাই, রূপের এই আগুনে সেই আবদুর রহমানই বেঁচে থাকতে পারবেন যিনি শাহে উন্দলুস ও নারী অন্ত প্রাণ। সুলতানার এমন মাখন নরম ও ঝলমলে পূর্ণ মুখাবয়ব ও চিবুক স্পর্শে আপাদমস্তক ডুবে গিয়ে সে আবদু রহমান জীবিত থাকতে পারেন না যিনি ছিলেন উন্দলুসের স্বাধীনতার গর্ব ও ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী।

আমরা আপনাকে এ সময় কষ্ট দিতাম না। প্রধানমন্ত্রী আবদুল করীম কথা বলতে শুরু করলেন, কিকু খ্রিষ্টানরা এমন ভয়াবহ এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, আমাদের রাতেও শোয়া উচিত নয়। ওরা এমন ভেল্কিবাজি ও ভাওতাবাজি শুরু করেছে যে, আমাদের ইসলাম ধর্মেও এর মন্দ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু খ্রিষ্টানদেরকেই নয়, মুসলমানদেরকেও তারা হুকুমতের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দিচ্ছে।

বিশেষ কিছু কি ঘটেছে? আবদুর রহমান হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলেন, নাকি আপনারা আপনাদের গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্ট আমাকে শোনাতে এসেছেন?

আমীরে উন্দলুস! হাজিব বললেন, রাতে বিশেষ এক ঘটনা ঘটেছে। যেটা কয়েক রাত ধরেই ঘটছে। গতরাতে আমরা ভয়ংকর ষড়যন্ত্র-অপতৎপরতা ও ভেল্কিবাজি ধ্বংস করে দিয়েছি। বাইরে আমাদের কয়েকজন সিপাহীর লাশ পড়ে আছে। আর কয়েকজন খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের,যারা এসব নাটক খেলেছে। দুজনকে আমরা জীবন্ত ধরে এনেছি।

লাশ? আবদুর রহমান চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার এতটাই সঙ্গীন ছিলো যে, খুন খারাবি পর্যন্ত ঘটে গেছে?

প্রধানমন্ত্রী আবদুল করীম ও সালার রউফ তাকে বিস্তারিত শোনালেন। পাহাড়ের ওই পরিত্যক্ত গির্জায় কি কি নাটক রচনা করে লোকদেরকে এ কয়দিন দেখানো হয়েছে।

এর মধ্যে যারিয়াবও এসে গেলো। সে মনোযোগ দিয়ে রাতের ঘটনা শুনতে লাগলো। আবদু ররহমান ঝিমুচ্ছিলেন। হাজিব ও সালার রউফ এক এক করে সব শোনালেন।

আমরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় আছি আমীরে মুহতারাম! সালার আবদুর রউফ বললেন, এই দুই কয়েদীকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। এই নাটকের আসল রচয়িতা কে? কাদের ছত্রছায়ায় এসব হচ্ছে?

এসব ছোটখাটো কয়েদীকে কারাদন্ড দেয়া কিংবা তাদেরকে জল্লাদের কাছে সোপর্দ করে দেয়া কোন প্রতিকার নয়। এদের মাথাগুলোকে আমাদের পাকড়াও করতে হবে। সে মাথাগুলোকে আমাদের থেঁতলে দিতে হবে যারা এই সন্ত্রাস আর ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা।

গোস্তাখী মাফ শাহে উন্দলুস! আবদুর রহমানের স্থলে যারিয়াব বলে উঠলো, মান্যবর প্রধানমন্ত্রী ও সালার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন এটা খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপের নামান্তর।………

ওরা যদি ধর্মীয় ব্যাপারে ভেল্কিবাজি বা কোন কৌশলের আশ্রয় নেয় সেটার অধিকার তাদের আছে। আমাদের ধর্ম-কর্ম তো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। ওদেরকে এসব নাটকীয় খেলা খেলতে দিন যাতে খ্রিষ্টানরা বুঝতে পারে, খ্রিষ্টবাদ ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য কি?

ওরা খুব দ্রুতই বুঝতে পারবে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম এবং একে ভেল্কিবাজির মাধমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।

যারিয়াব। প্রধানমন্ত্রী হাজিব গর্জে উঠে বলরেন, আমরা আমীরে উন্দলুসকে কথা বলছি, আপনাকে নয়। আমাদের হুকুম নিতে হবে আমাদের আমীরের কাছ থেকে। কোন দরবারী গায়কের কাছ থেকে নয়…..আমীরে মুহতারাম! এসব নাটকীয় তৎপরতা একমাত্র ইসলামের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে।

আবদুল করীমের গর্জন শাহে উন্দলুসকে তন্দ্রলুভাব থেকে জাগিয়ে দিলো। তিনি যারিয়াবকে মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন। সুলতানা যারিয়াবকে ডাকিয়ে এনেছে এজন্য, যাতে যারিয়াব আবদুর রহমান প্রধানমন্ত্রী ও সালারের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে।

যারিয়াব! আবদুর রহমান বললেন, তুমি নিশ্চুপ বসে থাকো। এরা ঠিকই বলছে। তাদের হুকুম আমার কাছ থেকেই নিতে হবে।

***

যারিয়াব অতি সতর্ক লোক। প্রখর মেধার অধিকারী সে। যে কোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে নিজেকে। আর মুখের জাদুর জোর তো আছেই। তার মুখে সে অপ্রস্তুতের হাসি ঝুলিয়ে নিলো।

শাহে উন্দলুসের কাছে আমি মাফ চাচ্ছি। সে বললো, আমি মুহতারাম ওযীর ও মুহতারাম সালারের কাছেও মাফ চাচ্ছি। আমার গোস্তাখী হয়ে গেছে। আপনারা যে পদক্ষেপ নিয়েছেন আমি আসলে এর বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব যা বলে তাই আপনারা পূর্ণ করেছেন। শাহে উন্দলুস আপনাদের যোগ্য প্রশংসাই করবেন।….

কিন্তু শাহে উন্দলুসকে তার প্রজাদের ধর্মীয় চেতনার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। এই সিংহাসনে আপনারা বসলে আপনাদেরও চিন্তাভাবনা বদলে যাবে। শাহে উন্দলুসকে যদি সালার বানিয়ে দেয়া হয় তাহলে দুশমনের বিরুদ্ধে তার পদক্ষেপ আপনাদের চেয়েও রক্তক্ষয়ী হবে।

যারিয়াব তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলতে লাগলো।

যেভাবে বলে সে পুরো দরবারে আধিপত্য বিস্তার করে রাখে। তার কথার মধ্যে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার ঝলকও মাঝে মধ্যে ফুটে উঠতে লাগলো। যেটা ক্রমেই শাহ উন্দলুসের ওপর প্রভাব বিস্তার করে গেলো। আরেক প্রভাব বিস্তারী হলো সুলতানা। যে আবদুর রহমানের এত কাছ ঘেঁষে বসে ছিলো যে, তার দেহের উষ্ণতাও তিনি উপভোগ করছিলেন। সুলতানার দিকে তাকালেই দুজনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস একাকার হয়ে যেতে লাগলো।

তোমাদের দুজনের নেতৃত্বে যা করা হয়েছে তা খুব ভালো করা হয়েছে। ব্যাপারটি এখানেই শেষ করে দাও। আবদুর রহমান ফয়সালা শোনালেন।

ওদের দুজনকে কি ছেড়ে দেয়া হবে না-যাদেরকে উনারা ধরে নিয়ে এসেছেন? সুলতানা বললো, অমুসলিম প্রজারা না আবার বলে যে, ইসলাম এক জালিম ধর্ম।

হ্যাঁ, ওদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। আবদুর রহমান বললেন।

হাজিব আবদুল করীম রাগে ফেটে পড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সালার আবদু ররউফও উঠলেন।

আমীরে উন্দলুস! হাজিব দরবারী আদব ও নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে বললেন, আপনি ভালো করে বিশ্রাম নিন। আমরা জীবিত আছি। ইসলামকে আমরা জীবন্ত রাখবো। ইসলামের হেফাজত করবে সেসব শহীদদের আত্মা যাদের লাশ আপনার দরজায় পড়ে আছে। আর যাদেরকে আপনি এক নজর দেখারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না।

আপনি না দেখুন আমীরে উন্দলুস! ওদেরকে আল্লাহ দেখছেন। সালার রউফ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন।

আপনারা বসুন। আবদুর রহমান এমন কণ্ঠে বললেন যাতে শাহী উত্তাপ ছিলো না, আমি আপনাদের কথা শুনছি। আমার কথাও আপনারা শুনুন।

উন্দলুস যদি আপনার জায়গীর হতো তাহলে আপনার হুকুম ছাড়া তো নিঃশ্বাসও নিতাম না। ওযীর আব্দুল করীম আবেগ-উত্তেজনায় আপ্লুত হয়ে বললেন, এটা আল্লাহর পবিত্র মাটি। ইসলাম এখনো এসে কাউকে ভয় পায়নি। কারো আক্রমণের শিকার হবে সে চাপও অনুভব করেনি। মাথা উঁচু করে রেখেছে সবসময়।…..

আমরা ইসলাম ও ইসলামী সালতানাতকে যে কোন ধরনের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবো। এমনকি সে বিপদ বা আশংকা কিংবা অনিশ্চয়তা যদি আপনার পক্ষ থেকে ও হয় তবুও আমরা এর কোন পরোয়া করবো না।

আমি অনুতপ্ত, লজ্জিত যে, আমার কথা আপনাদেরকে যারিয়াব বলতে লাগলো।

আমাদের দৃষ্টিতে তোমার তো সামান্যতম মূল্য নেই? সালার রউফ তার কথা শেষ করতে না দিয়ে চরম ঘৃণা উপচানো কণ্ঠে বররেন, খেলাফত ব্যবস্থায় তোমার মতো চামচা জাতীয় লোককে কোন মূল্যই দেয়া হয় না। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত দুর্ভাগ্য যে, তুমি অনেক কিছুই এখান থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তোমার ও এই মহিলার তো এই কামরায় থাকারও অধিকার ছিলো না। সালতানাতের বিষয়ে তোমাদের মতামতের তো কানাকড়িও মূল্য নেই।

আমরা যা ভালো মনে করেছি তাই করেছি। আমরা চলে যাচ্ছি। আমাদেরকে অপরাধী মনে করলে জল্লাদের হাওলা করে দেবেন। হাজিব বললেন।

দুজনই আবদুর রহমানের অনুমতি না দিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন।

দাঁড়াও তোমরা! আমি শহীদদের সবসময় সম্মান করি। আবদুর রহমান এবার দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।

তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন। আবদুর রহমান উঠলেন এবং তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। এখন তার পদক্ষেপে লড়াকু দীপ্তি। সুলতানা ও যারিয়াবের প্রভাবমুক্ত তিনি এখন। তার ওপর কোন নেশা সওয়ার হয়ে নেই। তার দেহ ঋজু হয়ে গেলো। মাথা উঁচু হয়ে উঠলো।

আমি তো এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। আবদুর রহমান এক হাত আবদুল করীমের কাঁধে আরেক হাত আবদুর রউফের কাঁধে রেখে বললেন, আমি এই ঘটনার ব্যাপারে ভালো করে চিন্তাও করতে পারিনি।

জেগে উঠো আমীরে উন্দলুস! জেগে উঠো। দুশমন জেগে উঠেছে। হাজিব বললেন।

দুজনে আমীরে উন্দলুসকে সেখানেই রেখে বেরিয়ে গেলেন।

****

আবদুর রহমান জানালার বহু পরতের কচি দেয়া পর্দাগুলো সামান্য সরিয়ে বাইরে তাকালেন। সে সময় হাজিব ও রউফ শহীদদের লাশ উঠাচ্ছিলেন।

খ্রিষ্টানদের লাশ ও এই দুই কয়েদী এখানেই থাকবে? প্রহরী জিজ্ঞেস করলো।

শাহে উন্দলুস যে হুকুম দেবেন তাই পালন করবে। শুধু শহীদদের লাশ এখান থেকে যাচ্ছে। সালার রউফ বললেন।

আবদুর রহমান শহীদদের লাশগুলো যেতে দেখলেন। প্রতিটি লাশ কাঠের একেকটি তখতায় রাখা হলো। প্রতিটি তখতা চারজন করে সিপাহী বহন করছিলো। শহীদদের ছোট খাটো এই মিছিলটি বড় নিঃশব্দে যাচ্ছে। চার দিকের পরিবেশ বড় বিষণ্ণ, বড় শোক স্তব্ধ।

আবদুল করীম ও আবদুর রউফ লাশের পেছন পেছন যাচ্ছেন। শহীদদের সম্মানে তারা তাদের তলোয়ার কোষমুক্ত করে তাদের সামনের দিকে সোজা করে ধরে রেখেছেন। তাদের ঘোড়া তাদের সঙ্গেই রয়েছে। কিন্তু তারা যাচ্ছেন পায়ে হেঁটে।

তাদের পেছনে কয়েকজন সিপাহীও আসছে। তারাও তাদের বর্শাগুলো সোজা করে ধরে রেখেছে। কিন্তু তাদের চলার ভঙ্গি শোকস্তব্ধ নয়। তাদের গতি তীব্র। প্রতিটি পদক্ষেপ দৃপ্ত-কঠিন সংকল্পে সুদৃঢ়। আর যারা শহীদদের লাশ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তারা এমন ঋজুভঙ্গিতে চলছে যেন ওদের কাঁধে শহীদদের বোঝাই নেই।

আবদুর রহমান একবারও সেদিক থেকে দৃষ্টি সরাননি। তার কাছে মনে হচ্ছিলো, শহীদদের এই কাফেলার শোভাযাত্রা বুঝি শেষ হবে না।

তার অনুভূতিগুলো যেন তুমুল ঝড়ের কবলে পড়লো। তার রক্ত টগবগিয়ে উঠলো ঝড়ের তাণ্ডবে। জানালার পর্দা ছেড়ে তিনি ঘুরে গেলেন। তার চোখে মুখে নেশার কোন চিহ্ন নেই। যারিয়াব ও সুলতানা এতক্ষণ ওখানেই ছিলো। যারিয়াব তার মনোভাব বুঝে ফেললো।

উনারা যা বলেছেন এবং যা করেছেন সবই ঠিক করেছেন। যারিয়াব বললো আবদুর রহমানকে,

কিন্তু তাদের আপনার শাহী মান-মর্যাদাকে এমনভাবে উপেক্ষা করা উচিত হয়নি। আমি আমার ভুল মেনে নিচ্ছি শাহে উন্দলুস! কিন্তু মুহতারাম ওযীর ও সালারের এই আচরণকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

কেন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না? আবদুর রহমান দাপুটে গলায় বললেন, তারা পূর্ণ নৈতিকতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। আমার সঙ্গে তাদের ভব্যহীন আচরণকে শুধু আমি উপেক্ষাই করছি না, আমি ওদের শতভাগ প্রশংসা করছি।…..

আর যারিয়াব! এবং সুলতানা তুমিও শুনে যাও। আমি তোমাদেরকে ভবিষ্যতে আমার ওযীর বা কোন সালারের সঙ্গে এভাবে কথা বলার অনুমতি দেবো না। এটা সালতানাতের ব্যাপার। এতে তারাই হস্তক্ষেপ করতে পারে যারা এর প্রতি দায়িত্ববান এবং যারা এ সম্পর্কে সবিশেষ অভিজ্ঞ। মনে রেখো, আমার মতোই তাদের হস্তক্ষেপের অধিকার রয়েছে।

যারিয়াব এমনভাবে ঝুঁকে পড়লো যেন আধখানা হয়ে গেছে। এটা দেখে সুলতানাও মাথা নুইয়ে ফেললো।

সুলতানা! আবদুর রহমান আঁঝালো গলায় বললেন, আমার গোসলের ব্যবস্থা করে। তার পরই দুই খ্রিষ্টানকে আমার সামনে হাজির করবে। প্রধান বিচারপতি ওদের শাস্তি দেবেন। তবে আমিও জানতে চাই, ওদের মিশন কি এবং ওরা কি চায়?

সুলতানা কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। আবদুর রহমান শয়ন কক্ষে চলে গেলেন। আর যারিয়াব বের হয়ে সিপাহীদেরকে বললেন, দুই কয়েদীকে তার হাতে ছেড়ে দিতে।

***

গোসলের পর আমীরে উন্দলুস তার সাক্ষাতের বিশেষ কামরায় গিয়ে বসলেন। তার সামনে দুই খ্রিষ্টান কয়েদী দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আছে যারিয়াব এবং প্রধান বিচারপতি ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া।

যদি সত্য না বলো তাহলে এমন শাস্তি দেবো যে, মৃত্যুর চেয়ে তা হবে জঘন্য। মরবেও না, আবার বেঁচেও থাকতে চাইবে না। আবদুর রহমান কয়েদীদেরকে বললেন, এটা কোন্ কোন্ মাথার আবিষ্কার? আমি অবশ্য সেই কুট-বুদ্ধির মাথাওয়ালাদের প্রশংসা করি। কিন্তু ওরা শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। যদি তোমরা দুজন বলে দাও তাহলে আমি তোমাদেরকে ছেড়েও দিতে পারি।

আমরা কি অপরাধ করেছি, কি পাপ করেছি? তাদের একজন এমন গলায় বললো যাতে রাগ, ক্ষোভ এবং অত্যাচারিতের আর্তনাদ ফুটে উঠলো, আমরা আপনার প্রজা। আপনার ওযীর ও সালারের বিপক্ষে তো আমাদেরকে মিথ্যাবাদীই বলবেন। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু অন্যরকম। আমাদের ঐ গির্জায় আপনার হাকিমরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। যেটা হযরত ঈসা (আ) এর যুগ থেকে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছিলো।…..

সে গির্জাকে আপনারা পরিত্যক্ত বলবেন; কিন্তু এই গির্জা আমাদের কাছে এতই পবিত্র যেমন আপনাদের কাছে কাবা শরীফ। আমরা কখনো কখনো রাতে ওখানে ইবাদত করতে যাই। আমরা যখন ইবাদত করছিলাম তখন আপনার সিপাহীরা সেখানে গিয়ে হামলা চালায়। আমাদের সবাইকে হত্যা করে দেয়া হয়েছে। আর আমাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। আমরা যেহেতু কয়েদী হয়ে এসেছি এজন্য আপনি আমাদেরকে অপরাধী মনে করবেন এটাই তো স্বাভাবিক।

ইসলাম কি কখনো অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে আগুন দেয়ার অনুমতি দেয়? অপর কয়েদী তর্ক করার ভঙ্গিতে বললো, এই যে দেখুন ঈসা মাসীহের মূর্তি এখানে পড়ে আছে। আপনার সালার ওখান থেকে ছিনিয়ে এনে এখানে ফেলেছে। আপনি যদি আশা করেন এভাবে ভয়-ভীতি দেখালে আমরা মুসলমান হয়ে যাবো তাহলে কখনো আপনার এ আশা পূর্ণ হবে না।

ইয়াহইয়া! আমি কি এটা মেনে নেবো যে, আমার প্রধানমন্ত্রী ও এক সালার মিথ্যা বলেছে? আবদুর রহমান প্রধান বিচারপতিকে জিজ্ঞেস করলেন।

ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া কী জবাব দেবেন এটা চিন্তা করছিলেন, তখনই এক কয়েদী বলে উঠলো,

ওযীর ও সালার তো আমাদের মতোই মানুষ, উনারা তো কোন ফেরেশতা নন। উনারা আমাদের ওপর যে জুলুম করেছেন সেটা উনাদের ধর্মের স্বার্থেই করেছেন। কিন্তু তারা পুরো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে যে নিজেদের বিরুদ্ধে নিয়ে গেছেন সেটা বুঝতে পারেননি।

আমরা আপনার অনুগত প্রজা। ফ্রান্সের বাদশাহ লুই ও ওদিকে আলফাসো খ্রিষ্টান। কিন্তু তাদেরকে আমরা এজন্য দুশমন মনে করি যে, তারা আপনার ও সালতানাতে উন্দলুসের দুশমন।

এদের দুজনকে বাইরে নিয়ে যাও। আমাকে কিছু একটা ভাবতে দাও। আবদুর রহমান বললেন।

***

দুই কয়েদীকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। যারিয়াবের ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ইয়াহইয়া গভীর চিন্তা-মগ্ন। আবদুর রহমান নিজেন মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।

তিনি ও ইয়াহইয়া তো জানেন না, আব্দুর রহমান যখন গোসলের জন্য চলে গেলেন, তখন দুই কয়েদীকে যারিয়াব অনেক কিছুই শিখিয়ে দেয়। এখানে যারিয়াবের শেখানো বুলিই ওরা আওড়ে যায়।

আমি কি আমার ওযীর ও সালারের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবো? আবদুর রহমান ইয়াহইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন এবং নিজেই জবাব দিলেন, না, আমি এমন কিছুই করবো না।

ওদের বিরুদ্ধে আপনার কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত হবে না শাহে উন্দলুস! যারিয়াব তার সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে এবং আবদুর রহমানের মাথায় তার ফয়সালা ঢুকিয়ে দিতে দিতে বললো, আপনি দুই সালারের শত্রুতা সামাল দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারেন না। আবদুল করীম একজন ওযীর এবং সালারও। উনারা অনেক বড় ভুল করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারটি ধামাচাপা দেয়া যাবে। আমি খ্রিষ্টান নাগরিকদেরকে শান্ত করতে পারবো। এই দুই কয়েদীর মুক্তির হুফুম দিয়ে দিন।

আপনি ওদের মুক্ত করতে চাইলে মুক্ত করতে পারেন। ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া বললেন, কিন্তু এটা ভুলবেন না, বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমি জানতে পেরেছি, যে পুরনো ও পরিত্যক্ত গির্জায় আগুন লেগেছে সেখানে কিছু সন্দেহভাজন খ্রিষ্টান রহস্যজনক কায়দায় খ্রিষ্টানদেরকে ভীত ও আতংকিত করে তুলেছে…..

এরপর তারা খ্রিষ্টান নাগরিকদেরকে হুকুমাতে উন্দলুসের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে। তবে গির্জায় কারা আগুন দিয়েছে সেটা জানা সহজ হবে না…..আমার পরামর্শ হলো, এই খ্রিষ্টান দুই কয়েদীকে ছেড়ে দিন এবং খ্রিষ্টানদের গোপন তৎপরতার ওপর নজর রাখুন। গির্জায় আগুন লাগিয়ে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে আপনি নেভাতে পারবেন না। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন।

ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়ার খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও তাদের সঙ্গে তার নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ছিলো। এজন্য তিনি ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতিতে কথা বলছিলেন। আর যারিয়াব তো খ্রিষ্টানদের এজেন্ট। কিন্তু আবদুর রহমান তার ব্যাপারে খুবই প্রভাবান্বিত ছিলেন। এজন্য তিনি তাদের পরামর্শ মতোই ফয়সালা শোনালেন, দুই কয়েদীকে মুক্ত করে দেয়া হোক।

আবদুর রহামন যখন এ ফয়সালা শোনাচ্ছেন তখন কর্ডোভার গির্জাগুলোয় ঘরা-তবলা বাজতে লাগলো। কোনটার আওয়াজ ভারি, কোনটার আওয়াজ হালকা। এক সুর তালে শৃংখলিত হয়ে ঘরা বেজে চলেছে। এসব বাজানোর সময় নয় এটা। মনে হচ্ছিলো, কোন ভয়াবহ কিছু ছুটে আসছে।

কি হলো ওদের? মনে হচ্ছে ওদের ওপর কোন আপদ নেমে এসেছে? আব্দুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন।

এটা আপদের চেয়ে কম কী যে, ওদের প্রাচীন এক গির্জায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যারিয়াব বললো, এটা শোকের বাজনা। আমরা তো কারো কান্না বা বিলাপ করতে বাধা দিতে পারি না শাহে উন্দলুস! আপনি পেরেশান হবেন না। আমি ওদেরকে সামলে নেবো।

***

আগুন লাগা গির্জায় পাহাড়ের ওপর হওয়ায় আগুনের শিখা কর্ডোভার মানুষ দেখেছে। ওদেরকেই কয়েক দিন আগে হযরত ঈসা (আ) এর আত্মপ্রকাশ দেখানো হয়েছে এবং তার পয়গামও শোনানো হয়েছে। যাতে হযরত ঈসা ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। রাতে ওরাই আবার হযরত ঈসা (আ) কে দেখতে গিয়েছিলো।

গির্জায় যখন আগুন লাগলো এমন ছুটোছুটি শুরু হলো যে, লোকজন এলেপাথারি পালাতে লাগলো। কয়েকজন তো ছুটন্ত মানুষের ধাক্কা খেয়ে পড়ে চিরাচ্যাপ্টাও হলো। এসব আতংকিত মানুষ সারা শহরেই নয়, উপশহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভয়ংকর সব গুজব ছড়িয়ে দিলো। এজন্য খ্রিষ্টানরা গির্জার ঢোলের আওয়াজ শুনে গির্জার দিকে ছুটে যেতে লাগলো।

…………আর তোমরা তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করেছো? প্রতিটি গির্জায় এসব কথার গুঞ্জরণ শোনা যাচ্ছিলো।

প্রত্যেক পাদ্রীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু একটাই,

আজ তোমাদের ঐ গির্জায় মুসলমানরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, যেখানে খোদার পুত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। এই গির্জাই তার অনেক প্রিয় ছিলো। তিনি বলেছিলেন, তোমরা তোমাদের দুশমনের হাতে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

কোন কোন গির্জা থেকে এরকমও শোনা যেতে লাগলো,

ঈসা মাসীহ তাঁর এই গির্জিাকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে চির দিনের জন্য চলে গেছেন। যাতে তিনি রাতে এসে উপাসনা করতেন।

গির্জার ঘণ্টা অনবরত বাজতেই থাকলো। যেন এখন এটা সার্বক্ষণিক বাজতেই থাকবে।

আবদুর রহমানের মন যেন এই ডন ডানাডন একঘেয়েমি শব্দে ঝিমুচ্ছিলো। আবদুর রহমান যখন দরবারে প্রবেশ করলেন তখন যেন গির্জার ঘন্টা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।

বন্ধ করো এসব! আমি তো আমার ফয়সালা দিয়ে দিয়েছি। আবদুর রহমান গর্জে উঠলেন।

দরবারী সিপাহী বরকন্দাজরা শাহে উন্দলুসের হুকুম পালন করতে ছুটাছুটি শুরু করে দিলো। বাইরে ঘোড়া ছুটানোর আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ পর ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ হয়ে গেলো।

ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ হয়ে গেছে শাহে উন্দলুস! এক দরবারী আবদুর রহমানকে জানালো।

হ্যাঁ, হা, আবদু রহমান বিরক্তিতে ফেটে পড়ে বললেন, আমার তো কান আছে।

কিন্তু আপনি এই তুফানকে কি করে বন্ধ করবেন যা গির্জা থেকে উঠছে? ওযীর হাজিব আবদুল করীম আবদুর রহমানের পাশে বসা থেকে বলে উঠলেন, আপনি সেই বিভ্রান্ত মানুষের মুখ কি করে বন্ধ করবেন যারা গির্জার জন্য আর্তনাদ করছে?…..আমীরে উন্দলুস! আমি এই মাত্র শহীদদেরকে দাফন করে এসেছি?…..

শহীদ…..শহীদ আবদুর রহমান ঝাঁঝালো গলায় বললেন, আবদুল করীম! অন্য কোন কথা বলল।…..ভাবতে দাও কিছু…..আমাকে কিছু একটা ভাবতে দাও,…..

বলতে বলতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ওযীর, মন্ত্রী, দরবারী সবাইকে দ্বিধান্বিত ও দুশ্চিন্তায় রেখে বেরিয়ে গেলেন দরবার কক্ষ থেকে।

***

সন্ধ্যায় প্রতি দিনের খবরাখবর আবদুর রহমানকে শোনানো হতো। দুজন উপদেষ্টা এসব খবর শোনাতো। তবে তারা সরাসরি সেসব আবদুর রহমানকে শোনাতে পারতো না। একজন দরবারী হাকিম ছিলো। সে তাদের কাছ থেকে শুনে কাঁটছাট করে কেবল সে খবরই শোনাতো যা শুনতে আবদুর রহমান পছন্দ করতেন।

এরপর দরবারে যারিয়াব যখন আধিপত্য বিস্তার করলো তখন থেকে যারিয়াব সে হাকিমকে যা বলে দিতো সে খবরই আবদুর রহমানকে শোনানো হতো।

লোকে তো খলীফার নাম পর্যন্ত জানে না, সেদিনের রিপোর্ট শোনানোর সময় আবদুর রহমানকে বলা হলো, লোকে শুধু শাহে উন্দলুসকেই চিনে।

কোথাও থেকে কি বিদ্রোহের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে? আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন।

বিদ্রোহ? রিপোর্ট প্রদানকারী হাকিম হয়রান হয়ে জবাব দিলো, কিসের বিদ্রোহ? কী মুসলমান, কী খ্রিষ্টান, সবাই তো আপনার নাম শুনলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। বিদ্রোহের চিন্তা করবে এত বড় দুঃসাহস কার?

প্রতিদিনই তাকে এভাবে খোদার পরের আসনে বসিয়ে দেয়া হয়। এজন্যই আমীরে উন্দলুস দরবারী তোষামোদকারীদেরই চোখে প্রজাদের দেখতেন এবং তাদের কানেই বাইরের সবকিছু শুনতেন।

যেদিন অনবরত গির্জাগুলোয় ঘন্টাধ্বনি বাজিয়ে খ্রিষ্টানদেরকে বিদ্রোহের জন্য উস্কিয়ে দেয়া হচ্ছিলো সেদিন সন্ধ্যায়ও আবদুর রহমানকে এ খবরই শোনানো হলো যে, সবকিছু ঠিক আছে। প্রজারা তার নামে সিজদায় পড়ে আছে।

এসব দরবারীদের কথায় আবদুর রহমানের মতো বিচক্ষণ, দূরদর্শী শাসক, রণকুশীল নেতা, যাকে শাহ লুই ও দ্বিতীয় আলফাঁসো পর্যন্ত ভয় পেতো সেই তিনি তোষামোদকারীদের কথায় সবসময় এতই প্রভাবান্বিত থাকেন যে, তার এই উপলব্ধিও হয়নি, তিনি যা বলছেন, যা করছেন, তাকে দিয়ে যা বলানো হচ্ছে এবং যা করানো হচ্ছে সেটা এক সময় ইতিহাস হয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে সেটা হবে ইসলামের ইতিহাস।

ইতিহাস যেমন শোকার্ত দৃষ্টান্ত হয় তেমনি আলোকবর্তিকাও হয়। পরবর্তী প্রজন্ম এতে যেমন পথভ্রষ্ট হয় তেমনি তার গন্তব্যের দিশাও পায়। পথভ্রান্ত হওয়া বা গন্তব্যের দিশা পাওয়াটা নির্ভর করে পূর্বপুরুষরা ইতিহাসের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে না সত্যবাদিতায় অটল থেকেছে।

যে জাতির ইতিহাসে তোষামোদকারী ও গাদ্দারদের হস্তক্ষেপ থাকে সে জাতির ইতিহাস অতিরঞ্জন আর মিথ্যার পসরায় কলুষিত থাকে। মানুষ মানুষকে আত্মপ্রসাদ লাভকারী বানাতে পারে, বানাতে পারে রাজা বাদশাহ, মন্ত্রী, হাকিম, আমীর উমারা। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ জবাব হয়ে থাকে বড় ভয়ংকর।

মোঘলরা উপমহাদেশের ও বনী উমাইয়ারা উন্দলুসের যে ইতিহাস লিখেছে, তা মূলত দরবারীরা লিখেছে। যা নিয়ে আজ আমরা গর্ব করে থাকি। এদিকে তাজমহল, শাহী মসজিদ, কুতুব মিনার, আর ওদিকে আলহামরা ও কর্ডোভার মসজিদকে দেখে আমরা মিথ্যা আবেগে ভেসে যাই।

সোনালী ইতিহাস নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু এটা খুব কমই চিন্তা করি যে, যারা এসব দৃষ্টি নন্দন ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নির্মাতা তারা কেন আজ ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে? তাদের কেন পতন হলো? ইসলামী বিশ্ব কেন ছোট হতে হতে আজ অস্তিত্বহীন আর কংকালসার হওয়ার পথে?

***

সেদিন সন্ধ্যায় আবদুর রহমানকে যে রিপোর্ট দেয়া হলো, তাতে গির্জার আগুনের প্রতিবাদে খ্রিষ্টানরা প্রতিটি গির্জায় কি করছে তার কোন উল্লেখই রইলো না। অবশেষে আবদুর রহমান নিজেই জিজ্ঞেস করলেন,

খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে কি কোন খবর নেই?

এমন বিশেষ কিছু ঘটেনি যে, গুরুত্ব দিয়ে সেটা আপনাকে শোনানো হবে। তাকে জবাব দেয়া হলো।

আর তখন আবদুর রহমানের পলকেই মনে হড়লো ওযীর আবদুল করীম ও সালার আবদুর রউফের শব্দগুলো, যা তারা সেদিন সকালে বলেছিলেন, আপনি বিশ্রাম করুন, আমরা বেঁচে আছি। ইসলামকে আমরা জীবন্ত রাখবো। ইসলামের অজেয় প্রহরী হয়ে থাকবে সে সব শহীদদের পবিত্র আত্মা, যাদের লাশ আপনার দরজায় পড়ে আছে।

বিশেষ কিছু যদি ঘটে না থাকে তাহলে গির্জার ঘণ্টাধ্বনি কেন বাজছিলো অনবরত? আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো সেসব শহীদদের কথা আজ একবারও উল্লেখ করলে না, যাদেরকে আজকেই মাত্র দাফন করা হয়েছে। লোকেরা নিশ্চয় তাদের জানাযায় শরীক হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো মন্তব্যও করেছে এ বিষয়ে। নিজেদের বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছে।

শাহে উন্দলুসের এত সময় থাকা উচিত নয় যে, সামান্য সামান্য কথায় তিনি পেরেশান হয়ে উঠবেন। যারিয়াব বললেন, এ ঘটনার দায়-দায়িত্ব যে মন্ত্রণালয়ের সে মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলে দেয়া হয়েছে। শাহে উন্দলুসের নিশ্চিন্ত থাকা উচিত।

গির্জার ঘটনায় যে দুই খ্রিষ্টান গ্রেফতার হয়েছিলো সে দিনই রাতে তারা কর্ডোভা থেকে পঞ্চাশ ষাট মাইল দুরে ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু, উন্দলুসের সন্ত্রাসী লিডার ইউগেলিসের কাছে অবস্থান করছিলো। মুক্তিপ্রাপ্ত দুই খ্রিষ্টান ইউগেলিসকে বলছিলো, পরিত্যক্ত সেই গির্জায় ঈসা (আ) এর আত্মপ্রকাশ নিয়ে যে নাটক খেলা হয়েছিলো সেটা ব্যর্থ হয়েছে।

তারা বিস্তারিত শোনালো, গত রাতে গির্জায় কি কি ঘটেছে এবং এতে তাদের সাময়িক ব্যর্থতা হলেও পরিণাম এমন হয়েছে যে, বলা যায় ওদের উদ্দেশ্য খুব ভালো করেই পূরণ হয়েছে। তারা আরো জানালো, গির্জার ঘটনাকে কিভাবে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে।

তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়ার দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, আবদুর রহমান এ ঘটনাকে তেমন গুত্ব দেননি? ইউগেলিস বললো, হুকুমতের কি খবর?

আপনি ঠিকই বলেছেন। এক খ্রিষ্টান বললো, শাহে উন্দলুসের সামনে আমাদের নিয়ে যাওয়ার আগে যারিয়াব আমাদেরকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে বলে দেন আমাদের কি কি করতে হবে। যারিয়াব ও সুলতানা আগেই শাহে উন্দলুসের ধ্যান ধারণা তাদের মতো করে বদলে নিয়েছে। আমরা মজলুমের অভিনয় করে বলি, আপনার মন্ত্রীদের হুকুমে আমাদের গির্জায় আগুন লাগানো হয়েছে।

শাহে উন্দলুসের হেরেমের দুই খ্রিষ্টান মেয়ে আমাদেরকে বলে দিয়েছে, আবদুর রহমানের মাথা পরিস্কার করে দেয়া হয়েছে। আরেকজন বললো, আর এ ঘটনাকে তিনি তেমন কিছু মনে করছেন না।

…. আর গির্জাগুলোয় খ্রিষ্টানদের ভিড় বাড়ছে। একজন বললো, ওদেরকে এখন উত্তেজিত করতে করতে আগুন উত্তপ্ত করে দেয়া হয়েছে।

মুসলমানদের মধ্যেও আমি এর প্রভাব দেখেছি। অনেক মুসলমানই মেনে নিয়েছে, হযরত ঈসা (আ) এর সত্যিই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। এই আগুন তারই বদদোআয় লেগেছে। দ্বিতীয় জন বললো।

এই আগুন এখন আর আমরা নিভতে দেবো না। ইউগেলিস সব কথা শুনে বললো, তোমরা কর্ডোভা ফিরে যাও। আমি মারীদা যাচ্ছি।

***

ইউগেলিস এক পাদ্রীর ঠিকানায় উঠেছিলো। পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, সে কেন মারীদা যাচ্ছে। কর্ডোভা কেন যাচ্ছে না। কারণ, বিদ্রোহের আন্দোলন তো কর্ডোভা থেকেই শুরু হয়েছ। এখন সেখান থেকেই এর তৎপরতা আরো বেগবান হওয়া উচিত।

পুরো উন্দলুস আমার চোখের সামনে রয়েছে। ইউগেলিস বললো, বর্তমানে মারীদার অবস্থা এমন হয়ে আছে যে, শুধু একটি আগুনের ফুলকি ছেড়ে দিলেই হবে। এজন্য আমার সবচেয়ে কাছের সঙ্গী ইলওয়ার ওখানে গিয়েছে।

সেখানে একজন মুসলিম হাকিম আছেন, যাকে আমরা বিদ্রোহের জন্য ব্যবহার করতে পারবো। আমি চেষ্টা করছি, বিদ্রোহের অপবাদ আমাদের ওপর আসতে না দিয়ে কোন মুসলমান নেতার ওপর চাপিয়ে দিতে।

এমন মুসলমান আপনি কি পাবেন যে নিজের হুকুমতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে? সে পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, আমার ভয় হয় কোন মুসলমান না আবার আপনার হিতাকাঙ্খী সেজে আপনাকে কয়েদখানা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আপনি না থাকলে এই আন্দোলনও এখানে শেষ হয়ে যাবে। সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে যেন কেউ তার জালে ফাঁসিয়ে ফেলতে না পারে।

নারী ও ধন সম্পদের মধ্যে এমন শক্তি আছে যে, এ শক্তি আপনি বাধ্য করতে পারবেন নিজের ইবাদতখানায় আগুন লাগিয়ে দিতে। ইউগেলিস বললো, আমি যতটা পবিত্র ইঞ্জীল বুঝেছি ততটাই কুরআন শরফি বুঝেছি। এই দুই আসমানী কিতাবেই মানুষকে খোদা তাআলা প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে বেঁচে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।……

উভয় কিতাবেই খোদা বলেছেন, যে নারীকে ভালো লাগবে তাকে বৈধ পন্থায় বিয়ে করে ফেলো। বিয়ে ছাড়া কোন নারীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কুরআন বলে, ব্যাভিচারকারী নারী পুরুষকে পাথর মেরে হত্যা করে দাও। ইঞ্জীলেও এ ধরনের হুকুম দেয়া হয়েছে।…..।

কেন? এমন কঠিন শাস্তি কেন নির্ধারণ করা হলো? কারণ, একজন রূপসী নারী পুরো একটি দেশ ও জাতিকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে লক্ষ লক্ষ সৈন্যও তা করতে পারে না।…..নারীর মধ্যে রয়েছে এক তীব্র আকর্ষণ, অপ্রতিরোধ্য এক নেশা ও অদৃশ্য এক জাদু। পৃথিবী বিখ্যাত বীর যোদ্ধাকেও রাজ সিংহাসন থেকে নামিয়ে পথের ফকির বানিয়ে দিয়েছে এই নারীই।…..

তবে এর চেয়েও ভয়ংকর নেশার জিনিস হলো ধন-সম্পদ, খ্যাতি ও ক্ষমতার। যে কাউকে ক্ষমতার লোভ দেখাবে সে তার সুন্দরী মেয়েদেরকেও নিলামে তুলতে দ্বিধা বোধ করবে না। সে মিথ্যা বলবে। নিজের ধর্ম এমনকি খোদাকেও সে থোকা দিতে চেষ্টা করবে।

একদিকে সে ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেবে। অন্যদিকে কয়েদখানার দরজা খুলে দেবে। কাউকে নজরানা আর বখশিষ দিয়ে বিত্তশালী বানিয়ে তার অনুগত করে নেবে। আবার কাউকে কয়েদখানায় ছুঁড়ে মেরে নিজের ক্ষমতা ও সিংহাসন অক্ষত রাখবে।

তারপরও আমার আশংকা হচ্ছে আপনি ধোকা খেতে পারেন। পাদ্রী বললেন, বহু পরীক্ষিত নীতি-দর্শন ও কলাকৌশলও ব্যর্থ হয়ে যায়।

যদি আবদুর রহমানের মতো বিচক্ষণ ও দূরদর্শী একজন মুমিন পুরুষ এক নারীর মায়াবী জালে পা দিয়ে এমন বেহুশ হয়ে থাকতে পারে, তাহলে তো দুনিয়ার এমন কোন মানুষ নেই যাকে আমরা মোহগ্রস্ত করে আমাদের দাবার খুঁটি বানাতে পারবো না। ইউগলিস বললো, আমি আপনার মুখে এ শব্দ শুনতে চাই না যে, আমি যা বলছি এবং যা করছি তা পাপ।…..

আমার এসব তৎপরতা আমার ধর্ম ও দেশের পবিত্রতা রক্ষার জন্য। দেশ ও ধর্মের জন্য মিথ্যা বলাকে আমি বৈধই নয়, বরং পূণ্যের কাজ বলে মনে করি। আমি নিজের জন্য শাসন ক্ষমতা চাই না, খ্যাতি চাই না। আমি আমার ব্যক্তিগত সত্তাকে মেরে ফেলেছি।…..

আমি মুসলমানদের শাহী খান্দান ও বড় বড় হাকিমদের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছি যে, তারা তাদের মানবিক ও মানসিক চাহিদাকে যেন জীবিত রাখে। প্রকাশ্যে মনে হবে ওদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওরা পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে।

কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তাদের ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে চরম বিভেদ সৃষ্টি করে দাও। ঐক্যের নাম নিশানাও মুছে দাও।…..

এমন একজন মানুষ হলেন মারীদার মুহাম্মদ ইবনে জাব্বার। যিনি কোন এক সময় অতি নীতিবান হাকিম ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাকে আমাদের ঝুলিতে পুরতে যাচ্ছি। আমাদের লোকেরা বেশ কিছুদিন ধরে তার পেছনে সময় ব্যয় করে যাচ্ছে। তাকে আমাদের মতো করে গড়ে তোলা হচ্ছে।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার আবদুর রহমানের শাসনামলে (৮২২-৮৫২ খ্রিঃ) ইতিহাসের চরম বিতর্কিত ও নিন্দিত এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। তবে তিনি নান্দনিক কোন কাজের জন্য নয়, নিন্দিত কাজের জন্যই ইতিহাসের ঘৃণিত এক ব্যক্তিত্বের পরিচিতি পান।

***

আবদুর রহমানের পিতা আল হাকামের যুগে সরকারি ব্যয়ভার এত বেশি বেড়ে যায় যে, সাধারণ নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। অজুহাত হিসেবে বলা হয়, আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা, বিদ্রোহের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য এবং সীমান্ত এলাকায় দুশমনদের হামলার মোকাবেলার জন্য যেহেতু সেনাবাহিনীকে সবসময় অভিযানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় কিংবা লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে হয়, এজন্য রাষ্ট্রীয় ব্যয়ভার বেড়ে গেছে।

বাস্তবে সরকারি বয়্যভার নয়, বেড়ে গিয়েছিলো শাহী মহলের ব্যয়ভার।

বিশেষ করে আবদুর রহমানের সময় তো সরকারি কোষাগার অর্ধেক খালি হয়ে যায়। যারিয়াব, সুলতানা ও আবদুর রহমানের রক্ষিতারা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করতে থাকে।

আবদুর রহমান নিজেও তোষামোদকারীদের সামান্য সামান্য কথায় দুহাত ভরে বখশিষ আর নজরানা দিতে থাকেন। যারিয়াব ও সুলতানাও যাকে চাইতো তাকেই এভাবে বখশিষ দিয়ে নিজেদের ক্ষমতার প্রদর্শন করতো।

রাজস্ব কর, ভূমি করের সবচেয়ে বড় বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় মারীদার লোকদের ওপর। মারীদার অবস্থান উন্দলুসের একটি প্রদেশের মর্যাদায়। সেখানকার হাকিম গভর্ণরের মর্যাদা পেতো। মারীদার হাকিম তখন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার।

বিভিন্ন খাতের কর আদায়ের জন্য যদিও সরকারিভাবে অনেক লোক নিয়োগ করা ছিলো তবুও মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারকে মারীদার বিভিন্ন শহর, উপশহর ও গ্রামে-গঞ্জে যেতে হতো। বেশ নীতিবান হাকিম হিসেবে তিনি তখন সবার কাছে পরিচিত। কর আদায়ে বেশ কঠোরতাও করতেন। লোকজন এ কারণে তাকে বেশ ভয় পেত এবং সম্মানও করতো।

সরকারি লোকজন ছাড়াও গ্রাম্য এলাকার কিছু অপরাধ জগতের লোকজনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রাখতে হয়। যারা মারপিট, লড়াই, গুন্ডামি করে বেড়াতো। এরা তাকে কর ইত্যাদি উসুলে অনেক সাহায্য করতো। এজন্য তারা পুরস্কার বা বখশিষ প্রাপ্তির অধিকারী ছিলো। কিন্তু ইবনে আবদুল জব্বার তাদেরকে করের পয়সা থেকে কিছুই দিতেন না। এটাকে জনগণের আমানত মনে করতেন।

তবে এই দলটির প্রধান নেতা এর সমাধান বের করে ফেলে। সেটা হলো, ছিনতাই-রাহাজানি। গুন্ডা দলের প্রধান তাকে বলে, তারা মাঝে মধ্যে দুএকটা কাফেলা লুট করবে। তবে মানুষ মারবে না। একেই তারা তাদের কাজের পারিশ্রমিক মনে করবে। ধরা পড়লে যেন তাদেরকে গ্রেফতার করা না হয়।

এদের ছাড়া ইবনে আবদুল জব্বারের কাজও চলতো না। তাই তিনি একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দিলেন যে, এর চেয়ে বেশি মালামাল লুট করা যাবে না। এবং বড় বড় বাণিজ্যিক কাফেলা ছাড়া সাধারণ কাফেলা লুট করা চলবে না।

গুন্ডা দল সেটা খুশি মনেই মেনে নেয়ার কিছুদিন পর একটি কাফেলা লুট করলো। লুট করা মাল থেকে ইবনে আবদুল জব্বারকে একটি তলোয়ার উপঢৌকন স্বরূপ দিয়ে গেলো। তলোয়ারের বাট অতি দুর্মূল্যের পাথর ও মোতি দিয়ে তৈরী। লক্ষ্য টাকার কম হবে না তলোয়ারের দাম।

এর দেড় দুই মাস পর লুটেরারা কোটি টাকা মূল্যর দুটি হীরা ইবনে আবদুল জব্বারকে দিলো। এভাবে একের পর এক কাফেলা লুট হতে লাগলো, আর ইবনে আবদুল জব্বারের উপঢৌকনের ঝুলিও ভরে উঠতে লাগলো। আর তিনিও সেগুলো বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করতেন। যদিও প্রথম প্রথম কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেন।

কিন্তু কিছুদিন পর সেটাই স্বস্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

***

এ ধারা চলতে লাগলো। ইবনে আবদুল জব্বার লুটেরাদের নজরানা খুশি মনেই গ্রহণ করতে লাগলেন। তবে তিনি উসুলকৃত করের পয়সায় কোন দুর্নীতি করেননি।

একদিন তিনি মারীদা শহর থেকে কিছু দূরের এক মফস্বল এলাকায় রাজস্ব আদায়ের কাজের তদারকি করতে গেলেন। দুচারদিন তাকে সেখানে থাকতে হবে। রাতে লুটেরা দলের নেতা তার বাংলোতে এসে হাজির। তার সঙ্গে অতি রূপসী দুটি মেয়ে।

এটা আপনার জন্য বিশেষ নজরানা। লুটেরা নেতা বললো, এদেরকে এক বাণিজ্যিক কাফেলা থেকে আমরা পেয়েছি। এরা আপনার সেবা করবে খুশি মনে।

এ নজরানার প্রয়োজন নেই আমার। এদেরকে নিয়ে যাও। ইবনে আবদুল জব্বার বললেন।

আপনি কমপক্ষে ওদের একজনকে রাখুন। আর দুজনকে রাখতে চাইলে রাখতে পারেন। লুটেরা নেতা বললেন।

আমি লুটের মাল থেকে যে উপঢৌকন গ্রহণ করে থাকি তাও এক ধরনের পাপ। তিনি বললেন, কিন্তু এদেরকে গ্রহণ করে আমি কবীরা গুনাহ করতে পারবো না। নিয়ে যাও এদেরকে।

তখনই একটি মেয়ে তার পায়ে পড়ে গেলো। আরেকজন হেচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।

আপনার অনেক বড় অনুগ্রহ হবে যদি আপনি আমাদেরকে গ্রহণ করেন। পায়ে পড়ে থাকা মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমাদেরকে এই হিংস্র বর্বরদের হাত থেকে বাঁচান।

মেয়েগুলো দেখলো, এই লোক বেশ চরিত্রবান। এর কাছে থাকলে এ নিশ্চয় তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

আপনি আমাদেরকে এভাবে গ্রহণ করতে না চাইলে আমরা আপনার স্ত্রী হতে প্রস্তুত। দ্বিতীয় মেয়েটি বললো, আমাদেরকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করুন।

দুজনই মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারের সামনে এমনভাবে ভেঙ্গে পড়লো আর কেঁদে কেঁদে তার কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো যে, তার মন দ্রবীভূত হয়ে গেলো।

ঠিক আছে, আমি এই উপঢৌকন গ্রহণ করছি, ইবনে আবদুল জব্বার বললেন, ওদেরকে যদি আমি ওদের মা বাবার কাছে পৌঁছে দিই তোমাদের কোন আপত্তি থাকতে পারবে না।

তাহলে আমাদেরও শর্ত আছে, আমাদেরকে যেন ধরিয়ে না দেয় মেয়ে দুজন। লুটেরা নেতা বললো।

তোমাদেরকে কেউ গ্রেফতার করবে না। তোমরা যাও। ওদের কাছে তোমরা আর এসো না। আমার কাছেই ওরা নিরাপদ থাকবে। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার বললেন।

লুটেরা নেতা চলে গেলো।

ইবনে আবদুল জব্বার মেয়েদেরকে বললেন, ওরা এখন নিরাপদ। রাতে ওদেরকে অন্য কামরায় শোয়ানো হবে। তিনি যখন নিজের কাজ থেকে অবসর হবেন তখন তাদেরকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

ওদের দুজনকে ভিন্ন কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। তাদেরকে বলা হলো, তারা চাইলে কামরার দরজা ভালো করে বন্ধ করে রাখতে পারে। তবে ইবনে আবদুল জব্বার এমন সুন্দরী খুব কমই দেখেছেন।

তবুও তিনি নিজেকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখলেন।

রাতের দুই প্রহর কেটে গেছে। ইবনে আবদুল জব্বার গভীর ঘুমে অচেতন। কামরায় টিম তালে একটি বাতি জ্বলছে। তার চোখ খুলে গেলো। তাকে কেউ মৃদুভাবে ঝাঁকাচ্ছে। তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তার ঘুম এভাবে মধ্য রাতে ভাঙ্গাতে পারে এত বড় দুঃসাহস কার?

তিনি হড়বড় করে উঠলেন এবং দ্রুত খঞ্জর বের করে ফেললেন। তবে ঘরের অস্পষ্ট আলোয় তার খাটে একটি নারী মূর্তি দেখে তিনি স্থির হয়ে গেলেন।

কেন এসেছো এখানে? কি চাও?

আপনার অনুগ্রহের সামান্য প্রতিদান দিতে? মেয়েটি মায়াবী গলায় বললো আমাকে যদি আপনার উপযুক্ত মনে না করেন তাহলে বলুন কিভাবে আপনার ঋণ আমি শোধ করবো?

মেয়েটি তার পাশে খাটে বসে পড়লো।

আমি কোন অনুগ্রহ করিনি মেয়ে! ইবনে আবদুল জব্বার বললেন, আমাকে প্রতিদান না দিয়ে বরং পেরেশান করছে। আমাকে মন্দ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছো তুমি।

মেয়েটি তার একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে চোখে চোয়ালো। তারপর হাতে চুমু খেলো। এরপর দুহাত তুলে নিজের বুকের ওপর রাখলো। ইবনে আবদুল জব্বারের যৌবনকাল এখন স্মৃতি হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও যৌবনের যে উত্তাপ ছিলে সেটা তো এখন আর নেই। কিন্তু মেয়েটি তার সেই ক্ষয়ে যাওয়া যৌবনে যেন নতুন করে পানি ঢাললো।

নির্জন রাত, উদ্ভিন্ন যৌবনা অপরূপা একটি মেয়ে। মেয়েটির তীব্র কামনার মায়াবী জাল এসব কিছুই মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারের বিবেকবোধ থেকে পরিণতির চিন্তা দুর করে দিলো।

রাত শেষে যখন ভোরের আলো ফুটলো ইবনে আবদুল জব্বারের সামন এক নতুন দুনিয়া উন্মোচিত হলো। তার এত দিনের অভ্যস্ত জীবনে যে দুনিয়ার অস্তিত্ব ছিলো, নিষ্ঠা ও চরিত্রমাধুরীময় যে জীবন পদ্ধতি ছিলো সে দুনিয়া তার পাল্টে গেলো। আজ তার দুনিয়ার সবকিছুই অপরূপ মনে হতে লাগলো।

যেখানে দুতিন দিন থাকার কথা ছিলো সেখানে তিনি দশ বার দিন রইলেন। তার তো মারীদায় ফিরে যেতেই হতো। কিন্তু মেয়েদেরকে নিয়ে যেতে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। মেয়ে দুটিকে সেখানেই রাখার বন্দোবস্ত করলেন। লুটেরা নেতাকে ডেকে বললেন, ওদেরকে যেন খুব যত্ন ও সম্মানের সঙ্গে রাখা হয়। তিনি সময় পেলেই এখানে আসবেন।

লুটেরা প্রধান ওদের জন্য দুজন লোক রেখে দিলো।

মনে হচ্ছে তোমরা বেশ সফলই হয়েছে। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার চলে যাওয়ার পর লুটেরা প্রধান মেয়েদের কাছে গিয়ে বললো।

তুমি তো বলতে এ লোক পাথরের চেয়ে কঠিন। কিন্তু একে মোমের মতো গলাতে বেশি সময় লাগেনি। এক মেয়ে বললো।

মুহম্মদের সামনে মাত্র পাপের একটি দরজা খুলেছিলো। তারপর একের পর এক দরজা খুলতেই লাগলো। যে কোন পাপের পথে একটি বিবেকের বাধা এসে দাঁড়ায়। পূণ্যবানদের জন্য তো সে বাঁধা একটি পাহাড়ের মতো এসে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতা সেই পাহাড়কে পলকের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়।

যে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার সালতানাতে উন্দলুসের রাজস্বকর থেকে একটি পয়সাও এদিক ওদিক করতে রাজি ছিলেন না, সেই তিনিই খ্রিষ্টীয় চক্রান্তকারীদের বড় মনোরম জালে ফেঁসে গেলেন।

তিনি এমন এক পাপের উড়না নিজের ওপর জড়িয়ে নিলেন, যা থেকে প্রতিটি পাপই জন্মগ্রহণ করে। কয়েকদিন পরপরই বিভিন্ন ছুতোয় সেই মফস্বল এলাকায় আসতে লাগলেন যেখানে মেয়ে দুটিকে রেখে গিয়েছিলেন।

একটি অতি পুরনো পলেস্তারা খসানো বাড়িতে মেয়েগুলোকে রেখেছিলেন। সেই জীর্ণ বাড়িটি ক্রমেই উজ্জল হতে হতে মহলের রূপ নিলো। একে একে মদ, নাচ-গানের উপকরণ সেখানে আসতে লাগলো।

রাজস্ব করের তহবিল দিন দিন শূন্য হতে লাগলো। ওদিকে লুটেরাদের দলও বড় হতে লাগলো। মুহাম্মদ বিশাল এক এলাকার মুকুটবিহীন সম্রাট বনে গেলেন।

***

অনেক দিন পর তিনি জানতে পারলেন তার চারপাশে যারা জড়ো হয়েছে। এবং যারা তার গোলাম হয়ে আছে এরা সব খ্রিষ্টান। এদের মধ্যে যারা মুসলমান তারা সব নও মুসলিম। যারা প্রকাশ্যে মুসলমান হলেও ভেতর ভেতর খ্রিষ্টান।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার যেখানেই যেতেন তার সঙ্গে একটি মুহাফিজ দল থাকতো। এরা সবাই তার নিজের বাছাই করা লোক। এদেরকে তিনি দুহাত ভরে পয়সা দিতেন এবং মদ-নারীও ভোগ করতে দিতেন।

এই মুহাফিজরা শধু তার প্রাণই নয়, তার এই রহস্যময় জীবনের কথাও হেফাজতে রাখতো।

একবার সেই দলে নতুন এক মুহাফিজ যোগ দিলো। মুহাফিজরা আসে সেনাবাহিনী থেকে। এই মুহাফিজ আসার পর তার পুরনো সঙ্গীরা তাকে শক্ত করে বলে দিলো, হাকিমের সঙ্গে মারীদার বাইরে যেখানেই যাবে সেখানে যা কিছু দেখবে তা যেন কাউকে না বলে। এর বদলে সে বিরাট বখশিষ পাবে।

হাকিম মুহাম্মদের সঙ্গে একবার সেই মুহাফিজও সেই মফস্বলে গেলো। প্রথম রাতেই সে যা দেখলো এতে তার শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেলো। নর্তকী দিয়ে নাচ গান, মদপান, অশ্লীল কর্মকাণ্ড সবই তার চোখের সামনে ঘটলো।

সে কারো সঙ্গে এ ব্যাপারে ভালো মন্দ কোন মন্তব্য করলো না।

পর দিন মুহাম্মদ সেখানে রীতি মতো দরবার সাজিয়ে বসলো। অনেক সাক্ষাৎপ্রার্থীই তার কাছে আসলো বিভিন্ন আর্জি নিয়ে। অধিকাংশই এ আর্জি নিয়ে এসেছে যে তাদের কাছে ট্যাক্স, খাজনা ও অন্যান্য কর দেয়ার মতো পয়সা নেই বা থাকলেও যথেষ্ট পরিমাণ নেই। মুহাম্মদ যে ফয়সালা করলেন, সেটা লোকদের পক্ষে গেলেও দেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধে হলো।

মুহাম্মদ কাজ শেসে করে মারীদা ফিরে এলেন। সেই মুহাফিজ এক ছুতোয় তার সালারের সঙ্গে সাক্ষাত করলো। মুহাম্মদ মারীদার বাইরে গিয়ে যা করেন তার বিস্তারিত কর্মকাণ্ড তাকে জানালো।

সেনাবাহিনীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের মধ্যে আগ থেকেই আলোচনা চলছিলো যে, মারীদার অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।

এর পরের বার মুহাম্মদের সেই মফস্বলের খাস মহলে অভিযান চালানো হলো। তাকে গ্রেফতার না করা হলেও তার পদ থেকে তাকে পদচ্যুত করা হলো। তারপর আরেক নতুন হাকিম নিয়োগ করা হলো।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার লুটেরাদের দলে চলে গেলেন। লুটেরাদের দলটি এখন সেনা ইউনিটের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দলে এখন কয়েকজন সরদার আছে।

তাদেরকে ডেকে মুহাম্মদ বললেন, পুরো এলাকায় হুকুমের মতো করে এ ঘোষণা দিয়ে দাও, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার এখন থেকে মারীদার পরিবর্তে এখানে থাকবেন। কর ইত্যাদির অফিসও এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং সেগুলো এখানে এসে আদায় করতে হবে।

ইউগেলিসের সঙ্গে তখনই তার সাক্ষাত হয়।

আপনার এটা জেনে রাখা উচিত, ইউগেলিস মুহাম্মদকে বললো, আপনার এখন কোন মূল্যই নেই। আপনাকে যে কোন সময় কতল করা যাবে। কিন্তু আমি চাই, আপনাকে আবার মারীদার আমীর বানাতে। আর মারীদা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদেশ বনে যাক।…..

আপনাকে নও মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা সাহায্য করবে। এরা আপনার ফৌজ হবে। কিন্তু আপনি যদি পূর্বের সেই সরকারি অবস্থান বা পদ বহাল করার জন্য এবং পদমর্যাদা বাগিয়ে নেয়ার জন্য আমাদেরকে ধোকা দেন তাহলে কল্পনাও করতে পারবেন না, আপনার পরিণাম কী হবে।

ইউনেলিসের পরামর্শ মতো মুহাম্মদ সবকিছু করবেন এটাই চুক্তি হলো। আর তারা মুহাম্মদকে বাদশাহ বানিয়ে রাখবে। ইউগেলিস চাচ্ছিল, বিদ্রোহের নেতৃত্ব কোন মুসলমানের হাতে থাকবে। সেই মুসলিম নেতা তারা পেয়ে গেলো।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারের এই দ্বিচারী চরিত্রের কথা জানতে পেরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার প্রতি নিন্দাবাদ জানালো এবং এই ঘৃণিত নাম তাদের মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করলো। এক সময় প্রায় ভুলেও গেলো।

মারীদা থেকে নির্বাসিত হওয়ার প্রায় পাঁচ ছয় মাস কেটে গেলো। তবে যে এলাকায় মুহাম্মদ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সে এলাকার ব্যাপারে প্রায় সময়ই খবরাখবর আসতে রাগলো, ওখানে লুটেরারা তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে। কিন্তু এরা কারা জানা ছিলো না। ওদের বাদশাহ বনে যান মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার।

নয়া হাকিমের নিয়োগ করা নতুন করপাল এবং কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও আরো দশ বারজন মুহাফিজ নিয়ে হাকিম মারীদা থেকে বের হন। উদ্দেশ্য বিভিন্ন এলাকার রাজস্ব আদায়ে তদারকি। তারা মারীদা থেকে কয়েক মাইল দূরের এক পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছলো। একটি মোড় ঘোরার সময় ডান ও বাম দিকে থেকে প্রান্তর বেয়ে এমন তীর বৃষ্টি শুরু হলো যে, একজনও বাঁচতে পারলো না।

তীর খেয়ে যারা ঘোড়া উল্টো দিকে ছুটালো তাদের কেউ বেশি দূর যেতে পারলো না। তাদের লাশগুলো গভীর এক গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর দিয়ে চাপা দেয়া হলো।

ট্যাক্স ইত্যাদি উসুল করলো মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের লোকজন। মুহাম্মদ সব ধরনের রাজস্বের পরিমাণ কমিয়ে দিলেন। এজন্য তিনি লোকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তারপর তিনি তার ঠিকানা বদলে ফেললেন। কেউ জানতেও পারলো না তার নয়া ঠিকানা কোথায়।

এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তার আস্তানা গড়ে তোলা হয়। সেখানে ইউগেলিসেরও যাতায়াত করতে বেশ সুবিধা।

যেদিন নয়া হাকিমের দলটিকে অতর্কিত হামলায় মেরে ফেললো মুহাম্মদের লোকেরা সেদিনই সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ তার সেনাদল নিয়ে কর্ডোভার পথের শেষ মনযিল অতিক্রম করছিলেন। এ সফরে এটাই তার শেষ বিশ্রাম।

যেখানে তাঁবু ফেলা হলো এর সামান্য দূরে কিছু জনবসতি গড়ে উঠেছে। উবাইদুল্লাহ ফিরতি পথের চারপাশের অবস্থা জরিপ করতে করতে আসছিলেন।

একবার তার ওপর আত্মঘাতি হামলাও হয়। এখানে তাঁবু ফেলার পর তার লোকজন আশপাশের এলাকায় গোয়েন্দা অভিযানে বেরিয়ে পড়ে। ওরা সাধারণত স্থানীয় গ্রামীন লোকদের পোষাক পড়ে যেতো।

একেবারে কাছের জনবসতিতে যে লোকটি গেলো সে ফিরে এসে উবাইদুল্লাহকে জানালো, ঐ জনবসতিতে একটি মসজিদ আছে। মসজিদের ইমাম লোকদেরকে বেশ রহস্যজনক কায়দায় ওয়াজ-নসীহত করে।

উবাইদুল্লাহ এশার নামাযের সময় ছদ্মবেশে সেই মসজিদে গিয়ে হাজির হলেন। নামাযের পর লোকজন ঘরে না গিয়ে সেখানেই বসে রইলো। জানা গেলো, নামাযের পর ইমাম সবাইকে পাঠদান করে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ইমাম শিক্ষা দেয়।

আজ আমি আপনাদেরকে বলবো জিহাদ কী? লোকদের দিকে ফিরে ইমাম পাঠদান শুরু করলো,

মুসলমানদের বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, নিজেদের শেষ পরিণতির জন্য কিছু করে যাওয়া। যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করা হোক বা মসজিদে ইবাদত করা হোক উভয়টার সওয়াব সমান। পরকালে এর পরিণামও একই হবে। তাহলে কেন নিজেদের ও অন্যদের বাচ্চাদের এতীম ও নারীদের বিধবা করা হবে? নামাযও একটি জিহাদ। যুদ্ধের ময়দান থেকে মসজিদই উত্তম।

ইমাম দুএকটি আয়াত পড়লো, কয়েকটি ভিত্তিহীন হাদীস শোনালো। কথায় কথায় বললো, রাসূরে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে কয়েকবার তো এমন হয়েছে যে, তিনি লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। একাধারে কয়েকদিন ও কয়েক রাত অনবরত নফল পড়েছেন।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *