০৩.
হাতে কলমে না করলে চাষের মর্ম বোঝা কোনও শর্মার কর্ম নয়। চাষা যখন চষে তখন সে মাটির সঙ্গে কথা কয়, বলদের সঙ্গে কয়, লাঙলের সঙ্গে কয়, মেঘবাদল-রোদের সঙ্গে কয়, বাজঠাকুরের সঙ্গে কয়, সাপখোপের সঙ্গে কয়, নিজের কপালের সঙ্গে কয়, এমনকী ভগবানের সঙ্গেও কয়। এই সব কটা জিনিস মিলিয়ে তবে চাষ। কত তোতাই পাতাই করে, সোহাগ করে, মিতালি পাতিয়ে তবে এক একজনের সঙ্গে ভাবসাব হয়। তার চারদিকে ঝাঁ ঝাঁ করছে প্রাণ। মাটির ঢেলাটাও তার কাছে জ্যান্ত, লাঙলটা কাস্তেটা সবই জ্যান্ত। এরা সব সতীশের বন্ধু বান্ধব। ছাঁচতলায়, উঠোনে যে সব গোখরো ঘুরে বেড়ায় তারাও বাস্তুর লক্ষ্মী-সতীশ তাদেরও বন্ধু মনে করে। সেদিন চাষের মাঠে এক কেউটে সুমুখে পড়ে কোমর অবধি ফণা তুলল। শানানো কাস্তে ছিল সতীশের হাতে, এক চোপাটে কেটে ফেলতে পারত। কিন্তু কাটেনি। শুধু বিড়বিড় করে বলেছিল, ধান কাটতে গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি বাপু, মাপ করে দাও। কেউটেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফণা নামিয়ে চলে গেল। ঝড় বাদলার দিনে ভারী বাতাস আসে, চালাঘর উড়ে যেতে চায়, যায়ও। ছেলেপুলে বউ নিয়ে সতীশ জড়সড় হয়ে বসে থাকে শুধু। জানে ঝড় দুনিয়ার নিয়মে আসে, তারও বিষয়কৰ্ম আছে। ঘাসের মতো মাথা নুইয়ে থাকতে হয়, ঝড় কিছু করে না গরিবের ক্ষতি। মেঘের ওপর থেকে বাজঠাকুর যখন বজ্রের বল্লম ছুঁড়ে মারেন তখনও সতীশ নিশ্চিন্তে ক্ষেতে কাজ করে। জানে, মরার হলে কেউ কি ঠেকাতে পারবে?
প্রাণ, চারদিকে কেবল প্রাণের খেলা দেখতে পায় সতীশ। সবাই ভারী জ্যান্ত, ভারী বন্ধুর মতো।
আগে বাঁকা নদীতে জল ছিল খুব। উপচে পড়ত। আজকাল আর জল নেই। বালির ওপর বালি জমা হয়ে উঁচুতে উঠেছে নদীর খাত। একধার দিয়ে শুধু নালার মতো জল বয়ে যায়। যখন জল ছিল, তখন বাঁকা নদীর জল ঘেঁচে ক্ষেত ভাসিয়েছে সতীশ। আজকাল একটু কষ্ট, বর্ষাবাদল না হলে ক্ষেত জল পায় না। নদীকেও কেমন মানুষ-মানুষ লাগে সতীশের। সেও যেন কিছু বলে, কিছু শোনে।
ভারী ঠাণ্ডা সুস্থির সতীশের জীবন। সকাল থেকে রাত অবধি তার খাটুনির শেষ নেই। ক্ষেতে চাষ, বলদ গোরু, কুকুর বেড়াল কাক সকলের যত্নআত্তি করা, ছেলেপুলে বউ সকলের পালনপোষণ আছে, গাছপালা আর পঞ্চভূত আছেন। সকলকেই সতীশ খুশি রাখতে চেষ্টা করে। কেউ জানে না, তার দুটো হেলে বলদ কখন হাসে কখন কাঁদে। তার গোরুটা কখন উদাস হয়ে যায়। তার কুকুর চারটে, তার তিনটে বেড়াল এদেরও কি ঠিক মতো কেউ বুঝতে পারে, সতীশ ছাড়া? বাতাসে যাঁরা ঘুরে বেড়ান, রাতবিরেতে যাদের দেখলে লোকে ভিরমি খায়, তাঁদেরও টের পায় সতীশ। গভীর রাতে মাঝে মাঝে সে যখন ঘুম ভেঙে উঠে মহাবিস্ময়ে তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে তখন টের পায়, কারা যেন বাতাসের মধ্যে বাতাসের শরীর নিয়ে মিশে কাছাকাছি আসে। একটু গা শিরশির করে তার।
একদিন বেহান বেলায় ঘাড়ে ভারী লাঙ্গল আর দুটো বলদ নিয়ে মাঠে যাচ্ছে সতীশ। আলের ওপর মুখোমুখি একটা ফুটফুটে ছেলের সঙ্গে দেখা। পরনে হেঁটো ধুতি, খালি গা। কী যে সুন্দর তার মুখচোখ। সতীশ হাঁ করে দেখছিল। ছেলেটা তার কাছাকাছি এসে একগাল হেসে বলল, এই দেখ, আমি দাঁত মেজেছি। আমার হাতে দেখ একটুও ময়লা নেই। আমি আজ কোনও দুষ্টুমি করিনি।
এত সুন্দর করে বলল যে ওই সামান্য কথাতেই কেন যেন জল এল সতীশের চোখে। সে ধরা গলায় বলল, তোমার ভাল হবে বাবা, তুমি বড় ভাল ছেলে।
ছেলেটা খুশি হয়ে নদীর ধার দিয়ে কোথায় চলে গেল। সতীশ কাউকে কিছু বলেনি, বলতে নেই। মনে মনে সে জানে, সেদিনই সে ভগবানকে দেখেছে।
দুপুরবেলা দুটো তৃষ্ণার্ত বলদকে একটা মাটির গামলায় নুন মেশানো জল খাওয়াচ্ছিল সতীশ। উঠোনে একটা ছায়া এসে পড়ল।
সতীশ, আছিস নাকি রে?
মনিবকে দেখে সতীশ তটস্থ হল। বাঁকা নদীর পোল পেরিয়ে মনসাতলা দিয়ে টুকটুক করে ছাতাটি মাথায় দিয়ে উনি নিত্যই আসেন। আসেন, এসে চাষের সময় ক্ষেতের ধারে আলের ওপর বসে থাকেন। ধান ঝাড়া হলে দেখতে আসেন। ধান মাপবার সময় দেখতে আসেন। কী দেখেন তা সতীশ জানে। বিঘে প্রতি যা ন্যায্য পাওনা হয় তা সতীশ বরাবর তুলে দিয়ে আসে মনিবের গোলায়। খরা বা বান হলে কম বেশি হয়।
মেয়ে খেঁদি দৌড়ে গিয়ে একটা জলচৌকি এনে পেতে দিল দাওয়ায়। মুখের ঘামটি কোঁচায় মুছে মুনিব বসলেন। ফর্সা মুখখানা রোদের তাতে রাঙা হয়ে আছে। চুল আর গোঁফ কিছু পেকেছে, তবু মান্যিগন্যি করার মতোই চেহারা।
খেঁদির কাছে চেয়ে এক ঘটি জলের অর্ধেকটা খেয়ে নিলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ আছিস তোরা।
এ কথাটার মানে হয় না। শুনলে লজ্জা করে সতীশের। ভাল থাকা মন্দ থাকার সে কীই বা জানে। তবে মেখেজুখে আছে, মিলেমিশে আছে। চারদিকটার সঙ্গে তার ভারী ভাবসাব। মনে হয় পোকাটা মাকড়টা অবধি তাকে চেনে জানে।
সে মনিবের সামনে উঠোনে উবু হয়ে বসে বলে, দুটো ডাব পাড়ি?
ডাব! না. রে, এ দুপুরে তোকে আর গাছে উঠতে হবে না।
কিছু নয় কর্তাবাবু। হনুমানের মতো উঠব আর নামব। যাওয়ার সময় কয়েকটা গন্ধরাজ লেবু নিয়ে যাবেন। এবার মেলা ফলেছে।
ডাবটা আস্তে আস্তে খেতে খেতে মনিব বললেন, সেই শ্বশুরমশাইয়ের আমল থেকে তোকে দেখে আসছি। একই রকম রয়ে গেলি। তুই বুড়ো হস না?
সতীশ মাথা চুলকে বলে, বয়স ভাঁটিয়ে গেছে অনেক দিন। সে কি আর আজকের কথা! বুড়োও হচ্ছি নিশ্চয়ই, বয়স তো হলই।
সেইরকম পাকানো চেহারা, শক্তপোক্ত, সারাদিন রোদে জলে খাটিস, বয়স মানিস না, তোর কেমটা বুঝতে পারি না।
ওই আজ্ঞে একরকম। চাষাভুষোর শরীর তো।
ওরে, আমিও পালোয়ান কিছু কম ছিলাম না। দেখেছিস তো সেই চেহারা!
আজ্ঞে দেখিনি আবার! সব চোখের সামনে ভাসছে। যেদিন বিয়ে করতে এলেন নৌকো করে, পালকি ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়েছিলাম! বুড়োকর্তার সে কী আত্মদ কার্তিকের মতো জামাই হয়েছে।
আর লজ্জা দিস না। আজকাল নড়তে চড়তে হাঁফ ধরে যায়।
শরীর তো কিছু বেজুত দেখছি না আমি। অনেকটা সেইরকমই আছেন।
বিষ্ণুপদ উদাস চোখে মাঠঘাট পেরিয়ে কোন উধাওয়ের দিকে যেন চেয়ে থাকে। তারপর একটু ধরাধরা গলায় বলে, বিষয়-বিষয় করেই বোধহয় এরকম ধারা হল, কী বলিস!
গন্ধরাজ লেবু কটা কুয়োর জলে ধুয়ে এনে দাওয়ার ওপর রেখে সতীশ বলে, আপনার বিষয় না থাকলে আমার পেট চলত কী করে? আপনার জমিতে চাষ, আপনার ভুঁয়েই বাস।
বিষ্ণুপদ বড় বড় চোখে কেমন বিকল একরক নজরে সতীশের মুখের দিকে চেয়ে বলে, ঠিক জানিস?
কীসের কথা বলছেন?
এ জমি যে আমার, এই চাষবাস যে আমার।
তা কে না জানে! হরপ্রসন্নবাবু আপনার নামে লিখে দেননি এসব?
কর্তাবাবুর আজ বড় বড় শ্বাস পড়ছে, লক্ষ করে সতীশ। মুখখানাও ভার। আজ বাবুর মনটা ভাল নেই। মন নিয়ে কারবার নেই সতীশের। তার মন বলে কি বস্তু নেই? থাকলেও ঠাহর পায় না। সকাল না হতেই কাজে নেমে পড়তে হয়। শরীর বেটে দিতে হয়, জান চুয়াতে হয়, তবে মাঠে মাঠে ফলন্ত মা লক্ষ্মীকে দেখা যায়। তখন শরীরে কেমন একখানা ফুরফুরে হাওয়া এসে লাগে।
বিষ্ণুপদ ডাবের খোলাটা সতীশের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধুতির খুঁটে মুখ মুছে বলেন, লিখেই তো দিয়েছিলেন রে। তুই তো লেখাপড়া শিখিসনি, দলিলে কী লেখা থাকে তাও জানি না।
সতীশ গম্ভীর মাথা নেড়ে বলে, তা অবশ্য জানি না। তবে এটা মনে হয় কোন জমিটা কার তা স্পষ্ট করে বলা থাকে দলিলে।
তাও থাকে। তবে আমরা হচ্ছি ভাড়াটে। আসল জমি হল সরকার বাহাদুরের। ভোগ দখল বিক্রি, বা বিলিব্যবস্থার অধিকার আছে মাত্র। সরকার ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে।
সতীশ মাথা নেড়ে বলে, সে কথাও ঠিক নয়। এই আলো বাতাস এসব তো সরকার বাহাদুরের নয়, নাকি?
আলো বাতাস! তা কী কবে সরকারের হতে যাবে?
তা হলে জমিও নয়। দুনিয়াটা যার এসব হচ্ছে তারই জিনিস।
বিষ্ণুপদ সতীশের দিকে মায়াভরে চেয়ে থেকে বলে, তোর মধ্যে এই একটা জিনিস আছে। এটাই তোকে বুড়ো হতে দেয় না। এর জন্যই এই বয়সেও তোর গায়ে মেষের মতো জোর। তোর মতো নয়, তাহলেও শশুরমশাইয়ের মধ্যেও এরকম একটা ব্যাপার ছিল।
তিনি ছিলেন আমার অন্নদাতা দেবতা। ওরকম মানুষ হয় না।
বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, তুই তো স্বার মধ্যেই ভগবান দেখতে পাস। এ খুব ভাল। আমাকে শেখাবি কী করে সব কিছুর মধ্যে ভগবানকে দেখতে হয়?
সতীশ লজ্জায় মুখ নিচু করে হাসে, কী যে বলেন তার ঠিক নেই। আমি শেখাব কি? মুখ সুখ মানুষ আমরা। ওসব আস্পর্ধার কথা শুনতে নেই। তবে এটা জানি, জমির মালিক যদি আপনি না হন তবে সরকার বাহাদুরও গয়। আপনার যা বন্দোবস্ত সরকার বাহাদুরেরও তাই।
বুঝছি রে। আর বোঝাতে হবে না। তুই সবকিছুর মধ্যে ভগবান দেখিস, আর আমি দেখি বিষয়।
তাই দেখেন কর্তাবাবু, তাই ভাল করে দেখেন।
বিষ্ণুপদ একটু ম্লান হেসে বলে, দূর পাগল! বিষয়ের মধ্যে আছেটা কী? তাও যদি নিজের জোরে করতে পারতুম তো বলার মুখ থাকত। এ হল গিয়ে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। শ্বশুরমশাই ঘর-জামাই করতে চাইল, তখন বড় গরিব ছিলুম তো, বাপের কাছে কলকে পেতুম না, তাই নেচে উঠেছিলুম। ভাবলুম না জানি চারখানা হাত গজাবে। এসে সাজানো সংসারে ঘটের মতো বসলুম। ফকিকারিটা যদি তখনও বুঝতে পারতুম রে। আজ যেন কোথায় একটা খোঁচা টের পাচ্ছি।
মানুষকে দুঃখ পেতে দেখলে সতীশের কেমন যেন জলে-পড়া অবস্থা হয়। সে একটু ব্যগ্র হয়ে বলে, তা এর মধ্যে খারাপটা কীসের দেখলেন? আমি তো কিছু খারাপ দেখছি না!
খারাপ নয়! পাঁচজন কি আর আমাকে ভাল বলে রে? আড়ালে রঙ্গ রসিকতা করে, আমি টের পাই। সম্বন্ধীরাও ভাল চোখে দেখে না। এমন কী বউ ছেলেপুলেরাও নয়। এই তো আজ জামাই এল, তার ভাবখানা যেন লাটসাহেবের মতো, শশুর বলে যে কেউ একজন আছে তা গায়েই মাখতে চায় না।
সতীশ মাথা চুলকোয়। বাবুর সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে তা ঠিক ধরতে পারছে না সে। এই হল মুশকিল। নিজেকে বাবুটাবুদের জায়গায় বসিয়ে তো আর ভাবতে পারে না। তার তো ওসব বড় বড় সমস্যা নেই। তবু সে বলল, জামাই তো দিব্যি আপনার। এই তো সেদিন বে হল! গাড়ি চেপে জামাই এল, কাছ থেকে বেশ করে দেখলুম।
বিষ্ণুপদ ঠাট্টা করে বলে, কী দেখলি? ভগবান নাকি?
সতীশ একটু লজ্জা পেয়ে বলে, কিছু খারাপ নয় তো!
বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, খারাপ কাউকে বলি কী করে? খারাপ আমার কপাল। ভাবছি এখানে তোর কাছাকাছি একখানা ঘর তুলে থাকব। আমাকে তুই একটু চাষের কাজ শেখাবি?
কী যে বলেন তার ঠিক নেই।
তোর সঙ্গে থেকে থেকে চাষবাস শিখব, বুড়ো বয়সকে ঠেকাতে শিখব, আর ভগবান দেখতে শিখব। শেখাবি?
আজ বাবুর কথাগুলো বড় উঁচু উঁচু দিয়ে চলে যাচ্ছে। সতীশ নাগল শচ্ছে ন! কী বলতে হবে তাও মাথায় আসছে না তার।
ঠিক এই সময়ে তার বউ সুরবালা রান্নাঘর থেকে ঘোমটা ঢাকা অবস্থায় আধখানা বেরিয়ে এসে বলল, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। বাবুকে বলল এখানেই স্নান করে দুটি খেয়ে যেতে।
বিষ্ণুপদ গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে বলে, সে কথাটাও মন নয়। খাওয়াবি নাকি রে সতীশ দুটি ভাত?
সতীশ এত অবাক হল যে বলার নয়। বাবু খাবেন! তার বাড়িতে? সে উত্তেজিত হয়ে বলে, কচুচু কী রান্না হয়েছে কে জানে! এ কি আপনি মুখে দিতে পারবেন? কত ভাল খাও-F.ওয়া হয় আপনাদের।
রোজ তো নিজের মতোই খাই। আজ না হয় তোর মতোই খেয়ে দেখি। তেলটেল থাকলে দে। স্নানটা করে আসি।
এই যে দিই।
বলে সতীশ ছোটাছুটি শুরুকরল৷ তেল এনে দিল। নিজেই গিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলল। একখানা নতুন গামছা কিনেছিল হাট থেকে। সেইটি বের করে দিল। বিষ্ণুপদ যে সত্যিই তার বাড়িতে খেতে বসবে এটা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তার।
বিষ্ণুপদ সত্যিই স্নান করে এসে খেতে বসে গেল।
খেতে খেতে বলল, আমার মা এখনও বেঁচে আছে তা জানিস? গ্যাঁড়াপোতায় আমাদের বাড়ি। বহুকাল যাওয়া হয়নি। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে এমন মজে আছি যে
সতীশ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মিনমিন করে বলল, মোটা চালের ভাত, গিলতে আপনার কষ্ট হচ্ছে খুব।
ছেলেবেলায় এই মোটা চালের ভাতই জুটতে চাইত না। কষ্ট ছিল খুব, আর কষ্টে থাকলে মানুষ কত কী করে ফেলে। শ্বশুরমশাই এমন লোভানীতে ফেলে দিলেন যে সব ছেড়েছুঁড়ে একেবারে পুষ্যিপুত্তরটি হয়ে চলে এলাম। একটা বড় লাফ মেরে খানাখন্দ সব ডিঙিয়ে এলুম বটে, কিন্তু একবার ফিরে দেখা তো উচিত ছিল ভাইরা, বোনরা, আমার মা-বাবা তারা ডিঙোতে পারল কি না। উচিত ছিল না, বল?
সতীশ সুরবালার দিকে চেয়ে বলে, বাবুকে আর একটু ডাল দাও বরং। আর একটু চচ্চড়িও নিন। বাল হয়নি তো বাবু?
ঝালটাই তো ব্যঞ্জন ছিল রে। ভাত পাতে আর কীই বা জুটত! শুধু লঙ্কা। বোনগুলোর একটাও ভাল বিয়ে হয়নি শুনেছি। ভাইগুলোও বড় কেউকেটা হয়নি। বাবা দুঃখে কষ্টে গেছে। মাটা এখনও খুকখুক করে বেঁচে আছে।
সতীশ উঁচু হয়ে বসে পাতে আঁকিবুকি কাটছে। তার হল চাষাড়ে খিদে। যখন খেতে বসে তখন অন্ন ব্যঞ্জনের স্বাদ পায় না, গোগ্রাসে শুধু গিলে যায়। চোখের পলকে পাত সাফ। আজ তার ভাত যেন উঠতেই চাইছে না। পাহাড়প্রমাণ পড়ে আছে পাতে।
আর পেট ভরল না বাবু।
বিষ্ণুপদ খুব ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। আঁচিয়ে এসে বলল, এই দাওয়াতেই একটা মাদুর পেতে দে, একটু গড়িয়ে নিই। এখানে দিব্যি হাওয়া আছে।
সতীশের মেয়ে খেঁদি একটা পান সেজে এনে দিল। পান খায় না বিষ্ণুপদ। তার কোনও নেশা নেই, এক বিষয় সম্পত্তির নেশা ছাড়া। তবু আজ পানটা খেল।
আমাদের বালিশ বড় শক্ত কর্তাবাবু। তুলোর বড্ড দাম বলে পুরনো ন্যাকড়া-ট্যাকরা ভরে খোল সেলাই করে নিই। আপনার অসুবিধে হবে।
তুই অনেকক্ষণ ধরে কেবল ভদ্রতা করছিস। কাছে এসে বোস।
সতীন বসল।
আধশোয়া হয়ে অনেকক্ষণ আবার সামনের মাঠঘাটের দিকে চেয়ে চেয়ে পান চিবোয় বিষ্ণুপদ। তারপর বলে, মানুষ যে কী চায় সেটাই তো বুঝতে পারে না। তুই বুঝিস?
সতীশ ঘনঘন মাথা চুলকে বলে, ক্ষেতে কিছু লাল শাক হয়েছে। সেঁদি তুলে দেবেখন। নিয়ে যানে। মা ঠাকরুণ লাল শাক বড় ভালবাসেন।
আমাকে একটা ঘর করে দিবি? ওই ক্ষেতের মাঝখানটায় হবে। চারদিকে ধানক্ষেত থাকবে, মাঠ ময়দান থাকবে, গাছপালা থাকবে। একা একা বেশ থাকব। দিবি?
এবারও ধান ভাল হবে না। ক্ষেতে জল না হলেই বড় মুশকিল। নদীটাও শুকোল। বালিশে মাথা রেখে বিষ্ণুপদ চোখ বুজল। আপন মনে বলল, কত বয়েস হয়ে গেল রে।