৩. হাউসিং কমপ্লেক্স

হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢুকতেই শ্রমিক নেতাকে দেখতে পেল ভরত। ভদ্রলোক চারজন লোককে কিছু বোঝাচ্ছিলেন এবং তারা যেন ঈশ্বরের বাণী শুনছে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। পাশ কাটিয়ে সে লিফটের দিকে এগোচ্ছিল, এইসময় ভদ্রলোক বলে উঠলেন, এই যে, শোনো!

ভরত দাঁড়াল নিস্পৃহ মুখে।

তোমার নামটা কী যেন?

ভরত।

ও। বাবা-মা ভাল আছে?

ভরত নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

 দাঁড়াও। ভদ্রলোক অন্যদিকে তাকালেন, ওই কথা রইল। কাল সকাল আটটায়। বলে ভরতের পাশে চলে এলেন, আমাকে আবার রাত নটায় বেরুতে হবে। বিদেশি ডেলিগটদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ও হ্যাঁ, তোমাদের কলেজের অভিজিতকে চেন তো?

চিনি।

ওকে তোমার কথা বলছিলাম। তুমি নাকি একটা ট্রাফিক কনস্টেবলকে ঘুষ নিতে দেখে উত্তেজিত হয়ে কলেজে ধরে নিয়ে গিয়েছিলে?

ঠিকই শুনেছেন।

কোরাপশন। চারদিকে কোরাপশন। যেখানেই হাত দাও একই ব্যাপার। পুলিশ ফোর্সটা তো শেষ হয়ে গেল। লিফটে ঢুকলেন ভদ্রলোক।

পুলিশকে কাজ করতে দেওয়া হয় না।

কে বলেছে? ফালতু কথা।

মন্ত্রীর বাড়িতে দুবৃত্ত আছে বলে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে গেলে তাদেরই পরে সাসপেন্ড করা হয়। এরপর জেনেশুনে তারা ওই কাজ করবে কেন?

দুটো ব্যাপার। প্রথমত, ওই বাড়িতে ক্রিমিন্যাল ছিল কি না তা প্রমাণিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, ওই মন্ত্রী আমাদের দলের নয়। আমাদের দলের কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেউ আজ পর্যন্ত শোনেনি। তাই না?

উনি আপনাদের সরকারে আছেন!

ঐক্য বজায় রাখতে কিছু বলতে পারছি না আমরা। এস, আমার ফ্ল্যাটে এসো। লিফটের দরজা খুলে গেল।

আজ থাক।

আহা। থাকবে কেন? তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। এসোই না।

অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা বাড়াল ভরত। ভদ্রলোক বেল বাজালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে এসে দরজা খুলল। ভদ্রলোক বললেন, দ্যাখো কে এসেছে।

আমি চিনি। ওপরে থাকে। মেয়েটা চোখ ঘোরালো।

ভদ্রলোক বললেন, আমার মেয়ে। পারমিতা। এসো বসো। পারমিতা, মা কী করছে? ভরতকে কিছু খাওয়াতে বল। আর আমি বাইরে ডিনার করব।

ভরত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, আমি কিছু খাব না। আমার পেট ভর্তি।

চা?

না।

 ঠিক আছে। জোর করব না। বসো। এই হল আমার ফ্ল্যাট। কোনও বিদেশি জিনিস দেখতে পাচ্ছ? থাকলে তো দেখবে। একেবারে সিম্পল। যা না থাকলে নয়। অথচ শুনেছি আমার বিরুদ্ধে কানাকানি চলছে শ্রমিক নেতা হয়েও এত টাকা দিয়ে কি করে ফ্ল্যাট কিনি। ফ্ল্যাটের দাম তো চার লাখ টাকা। তা আমার বাপঠাকুর্দা তো ছিলেন, তাদের কাছ থেকেও তো পেতে পারি। এইটে বাঙালিদের স্বভাব। মহারাষ্ট্রে যাও, কেউ নেতাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না।

ভরত জানে চার লাখ টাকা কাগজে কলমে হলেও নয় লাখ দিয়ে ভদ্রলোক ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। তবে হ্যাঁ, তাদের ফ্ল্যাট যেভাবে সাজানো এই ফ্ল্যাট তার ধারে কাছেও যায় না। কিন্তু ভদ্রলোক আগ বাড়িয়ে এসব বলছেন কেন?

মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল বাবার পেছনে। ঢুলুঢুলু চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। ভদ্রলোক সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। মেয়েটার শরীরের ওপর দিকটা বড্ড দৃষ্টিকটু। তার ওপর টাইট স্কার্টজামা পরায় তা আরও উগ্র হয়ে গেছে। এবাড়িতে কেউ ওর পোশাক নিয়ে কথা বলে না।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, অভিজিত বলছিল তুমি আমাদের পার্টিকে সমর্থন করো না?

 আমার এইসব রাজনীতি ভাল লাগে না।

কোন রাজনীতি ভাল লাগে? বিপ্লবের? পুলিশ ধরে খুন কর, জোতদার মারো, মূর্তি ভাঙো– এইসব? যার পেছনে কোনও প্র্যাকটিক্যাল সেন্স নেই?

না। আমি নকশাল নই।

গুড। দ্যাখো একটা পুলিশ ঘুষ নিচ্ছে দেখে মাথা গরম করে কোনও লাভ নেই। তাকে ধরে তুমি দেশে সমাজতন্ত্র আনতে পারবে না। মা পারমিতা, তোমাকে বলেছিলাম ইংরেজি শিখতে হবে। এখন ইংরেজিতে কথা বলা খুব জরুরি। ভরত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। তোমার মাকে ডাকো।

সঙ্গে সঙ্গে পারমিতা চিৎকার করল, মা। মা! তারপর বলল, লজ্জা পাচ্ছে।

পাক। ডেকে আনো।

এবার দরজায় জড়সড় হয়ে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়ালেন। রোগা, ভীতু ভীতু চেহারা। শ্রমিক নেতা বললেন, এই হল ভরত। পারমিতাকে ইংরেজি শেখাবে। বুঝলে?

ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়লেন।

 শ্রমিক নেতা জিজ্ঞাসা করলেন, কবে থেকে আরম্ভ করবে?

আমি তো এখনও মনস্থির করিনি। গম্ভীর গলা ভরত বলল।

না না। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তুমি বরং আজ দেখে নাও ওর স্ট্যান্ডার্ড কেমন। সেই বুঝে ওকে কোচ করবে। আমাকে এখন তৈরি হয়ে নিতে হবে। পারমিতা, তুমি ভরতকে তোমার পড়ার ঘরে নিয়ে যাও। ভদ্রলোক উঠে গেলেন ভেতরে। সমস্ত ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে তাজ্জব হয়ে গেল ভরত। পারমিতা ডাকল, আসুন। আমার ঘর ওইটে।

ভরত ভেতরের দরজায় তখনও দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল এই বাড়িতে ওঁর কোনও ভূমিকা নেই। পারমিতা বলল, মা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাবার কী লাগবে দ্যাখো। ভদ্রমহিলা দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেলেন।

ভরত বুঝতে পারছিল না সে কী করবে? এখনই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। যদিও তার জন্যে বাবা বিপাকে পড়বে তাতে সে কি করতে পারে। তার পরেই মনে হলো সে তো এখন টিউশনি করছেই। একটা টিউশনি ছাড়ার পর নতুন ছাত্র পায়নি। শ্রমিক নেতা যদি তাকে টাকা দেয় তাহলে পড়াতে দোষ কি! অবশ্য শ্রমিক নেতার টাকা দুনম্বরি কিনা এখনও সে জানে না কিন্তু অনুমান করতে পারে মাত্র। যে কারণে আগের টিউশনি সে ছেড়েছে সেই একই কারণ তো এখানেও রয়েছে। এইসময় পারমিতা জিজ্ঞাসা করল, কী ভাবছেন?

ভরত সিদ্ধান্ত নিল, আপাতত দেখা যাক। হয়তো টাকা চাইলে ভদ্রলোক আর পড়াতে বলবেন না। সে পারমিতাকে অনুসরণ করল।

ছোট ঘর। ঘরের দেওয়াল জুড়ে আমীর খান, শাহরুখ খানের ছবি। একদিকে জুহি চাওলা অনেকটা শরীর দেখিয়ে শুয়ে আছে। ভেতর স্টিরিও এবং তার স্পিকার কায়দা করে সাজানো। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে পারমিতা বলল, বসুন।

ভরত বসল। টেবিলে কিছু পড়ার বই।

কোন ক্লাসে পড়।

টেন।

এখন তো পড়ার চাপ খুব।

হুঁ।

এইসময় আলাদা করে ইংরেজি শিখতে পারবে?

আপনি শেখালে পারব।

শেখানোর আগে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

কেন?

আমি টিউশনি করলে টাকা নিই।

কত?

চারশো।

মাত্র। বাবার কাছে কিছু না। পারমিতা হেসে উঠল।

এসময় শ্রমিক নেতার গলা শোনা গেল, পারমিতা, আমি বেরুচ্ছি।

আচ্ছা। চেঁচিয়ে সাড়া দিল পারমিতা। ওপাশে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ হলো। পারমিতা বলল, আজ কিন্তু পড়ব না।

কী করবে?

আজ গল্প করব। আপনার আমীর খানকে ভাল লাগে?

আমি সিনেমা দেখি না।

শানুর গান শুনেছেন? এক লেড়কি কো দেখা তো এ্যায়সা লাগা।

 না। আমি শুনিনি।

শুনবেন? আমার কাছে ক্যাসেট আছে।

তুমি হিন্দি ছবি খুব দ্যাখো বুঝি?

খুব। ভি সি আরে দেখি। হাসল পারমিতা, নাইনটিন ফরটি টু দেখবেন?

এখন?

কী আছে। বাবার ফিরে আসতে অনেক দেরি আছে। আর আমি যা বলব মা তাই শুনবে।

বাঃ। শোনো, আমি এখন যাচ্ছি।

যাচ্ছি মানে, আপনি তো আমাকে পরীক্ষাই করলেন না।

পরীক্ষা?

ওই যে বাবা বলে গেল আমার স্ট্যান্ডার্ড দেখতে।

বেশ। তুমি আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলো।

মেয়েটা এবার লজ্জা পেল। মাথা নিচু করল। ভরত বলল, সঙ্কোচ করলে কোনদিন শিখতে পারবে না। যা জানো তাই বলো। হোয়াট ইজ ইওর নেম?

পারমিতা মিনমিনে গলায় জবাব এল।

না। পুরো বাক্যটা বলো।

মাই নেম পারমিতা।

লেখো তো যা বললে।

পারমিতা লিখল। তারপর জিভ বের করে বলল, ইজ হবে।

বুঝতে পেরেছি। তোমার বাবাকে বলবে আমি পরে দেখা করব।

একটা ইজ বলিনি বলে আমার ওপর রাগ করবেন?

রাগ করেছি কে বলল! হেসে ফেলল ভরত।

 সে উঠে দাঁড়াতেই পারমিতা এগিয়ে এল সামনে, না। আপনি এখন যাবেন না।

না। আমি সেই সকালে বেরিয়েছি, এবার বাড়িতে ফেরা দরকার।

একটা ফোন করে দিন না।

না। আজ চলি।

আপনি আমাকে শেখাবেন না? প্লিজ।

ঠিক আছে। আসব।

 তাহলে কাল আসবেন?

কাল? তুমি কখন স্কুল থেকে ফেরো?

চারটে। কাল তো ছুটি।

হ্যাঁ। তাহলে সকালবেলায় আসব। এই ধরো দশটা।

থ্যাঙ্ক ইউ। আপনি খুব ভাল।

ভরত বেরিয়ে এল। লিফটে না উঠে সিঁড়ি ভেঙে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দেখল দরজা বন্ধ। বেল বাজাতেই একটা অপরিচিত মুখ তাকে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?

কাউকে নয়। আমি এখানেই থাকি।

ভদ্রলোক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সরে দাঁড়াতে ও ভেতরে ঢুকল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা পাঁচেক মানুষ বসে আছেন। বাবাও ওদের মধ্যে। প্রত্যেকের হাতে হুইস্কির গ্লাস। ঘরে নেই।

কিরে! এত দেরি করলি? বাবা এমনভাবে জিজ্ঞাসা করল যে বেরুবার সময় কখন ফিরবে তা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হয়েছিল যেন।

আমি তো রোজ এই সময়েই টিউশনি সেরে ফিরি।

ওঃ, ঠিক আছে যাও। বাবার উৎসাহে হঠাৎ যেন জল পড়ল।

ভরত কথা না বাড়িয়ে ভেতরে যাচ্ছিল। একজন প্রশ্ন করল, হু ইজ হি!

পুত্র। প্রেসিডেন্সিতে পড়ে। স্বাবলম্বী হবে বলে টিউশনি করছে।

মাই গড! নকশাল নাকি?

আমার তো মনে হয় না। আমাদের বংশে কেউ কখনও রাজনীতি করেনি।

এই বয়সের ছেলেদের নিয়ে বড় বিপদ। আমার ভাগনে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ে, ভাল ছাত্র ছিল, নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করেছিল, ড্রাগ খাচ্ছে। কিছুতেই কারো কথা শুনছে না।

সর্বনাশ। কী করে হল?

আমি জানি না। কাগজে পড়ি হতাশা থেকে ওই নেশায় আক্রান্ত হয় এরা।

না না। আমার ছেলে ওই লাইনে নেই। আসলে বাবা-মায়ের উচিত ছেলের সঙ্গে একটা সময় এলে বন্ধুর মত ব্যবহার করা। বাঙালিরা সেটা পারে না বলেই। বাবা কথা শেষ করল না।

বিছানায় শুয়ে ভরত হো হো করে হাসল। বাঞ্চ অফ হিপোক্রিটস। মদ্যপান করতে করতে যা তা গুল মেরে যাচ্ছে। জীবনে কখনও তার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেনি লোকটা। সব সময় বোঝাতে চেয়েছে উনি যা বলবেন সেটাই শেষ কথা। উনি যা বোঝেন তা বাইরের কেউ কিছু বোঝে না। এখন নিজের গ্ল্যামার বাড়াচ্ছে হুইস্কি খেতে খেতে।

ভরতের খেয়াল হল ওখানে মা নেই। মা কোথায়? কিচেনে কি? এককালে বাবার বন্ধুরা এলে মা ফিসফ্রাই ভেজে দিতে ভালবাসত। বন্ধুদের সামনে মাকে হনি বলে ডাকতে বাবার খুব ভাল লাগত! সে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আজ খিদে নেই বললেই চলে। সুদেষ্ণার বাড়িতে যা খাওয়া হয়েছে তা রোজ হয় না। সুদেষ্ণার কথা মনে আসতেই মন ভাল হয়ে গেল। ওর এখন ইচ্ছা করছিল সুদেষ্ণার সঙ্গে কথা বলতে। আজ পর্যন্ত যত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই স্বস্তি সে পায়নি যা সুদেষ্ণার সঙ্গে বলার সময় পেয়েছে।

সুদেষ্ণার সঙ্গে কথা বলছিল মনে মনে, কখন ঘুম এসে গিয়েছিল ভরত জানে না। হঠাৎ বেল বাজার আওয়াজে ঘুম ভেঙে সে আবিষ্কার করল ঘর অন্ধকার। বাইরের পোশাকেই সে শুয়ে আছে। দ্বিতীয়বার বেল বাজতেই লাফ দিয়ে নিচে নামল ভরত। বসার ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। কেউ নেই। বাবার বন্ধুরা চলে গিয়েছে। এখন রাত সাড়ে এগার। বাবা কোথায়? ওদের বেডরুমের দিকে কয়েক পা এগোতে খোলা দরজা এবং পর্দার ফাঁক দিয়ে বাবাকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখতে পেল সে। অতিরিক্ত নেশা হলেই বাবা ওই ভঙ্গিতে পড়ে থাকে। তৃতীয়বার বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলল ভরত। মা দাঁড়িয়ে আছে, একা। চোখাচোখি। হতে মা পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল আর ভরতের নাকে অদ্ভুত এক মিশ্রিত গন্ধ এল। বিদেশি পারফিউমের সঙ্গে অন্য কিছুর মিশেল। সে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতে মা নিজের শোওয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। এই ঘরে তখনও ব্যবহৃত গ্লাসগুলো, টেবিলে আইস বক্স এবং জলের জাগ পড়ে আছে। তার মনে হল ওই গা গোলানো গন্ধটা এই ঘরেই ছড়িয়ে আছে।

ভরত নিজের ঘরে ফিরে না গিয়ে আধা অন্ধকারে সোফায় বসল। এখন তার খিদে খিদে পাচ্ছে। এই বাড়িতে সকালবেলা কাজের লোক আসে। সে-ই রান্না করে যা মায়ের করতে ইচ্ছে হয় না। হোলটাইমার মা আর রাখবে না। অতএব ফ্রিজে কী খাবার আছে তা সে জানে না, থাকলে গরম করে নিতে হবে গ্যাস জ্বেলে। এটা করতে একটুও ভাল লাগছিল না এখন।

ভরত মায়ের ঘরের দিকে তাকাল। ঢোকা মাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মা যে এতক্ষণ বাড়িতে ছিল না তা সে জানত না। ব্যাপারটা কী হলো? বাবা বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে এসে পার্টি করছে অথচ মা নেই। এত রাত্রে বাইরে থেকে মাকে কখনও একা বাড়িতে ফিরতে দেখেনি। মাকে আজ যথেষ্ট সুন্দরী দেখাচ্ছিল অথচ মায়ের বয়স হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে, ও যখন স্কুলে পড়ে তখন মা এবং বাবা গল্প করছিল এক সিনেমার নায়িকাকে নিয়ে। ভদ্রমহিলা নাকি বাবার সঙ্গে পড়তেন অথচ এখন এমন ফিগার এবং চোখমুখ রেখেছেন যে স্বচ্ছন্দে নায়িকা হতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। বাবার বয়সী হলে মায়ের চেয়ে বয়সে বড় এটাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। আজ এখন মনে হল মা যদি সিনেমায় অভিনয় করত তাহলে ওই রকম মনে হত। বাঙালি মায়েদের কথা ভাবতেই জবুথবু অথবা শীর্ণ যে ছবিটা ভেসে ওঠে উপন্যাসে এবং সিনেমার কল্যাণে তার সঙ্গে এখনকার মায়েদের কোন মিল নেই।

মায়ের ঘরের দরজা খুলল। মায়ের পরনে নাইটি। দ্রুত পা ফেলে বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বাবা সেই একই ভঙ্গিতে পড়ে আছে। তিনবার বেল বাজা সত্ত্বেও যার ঘুম ভাঙে নি তার এসব টের পাওয়ার কথা নয়। ভরত বুঝল সে এই ঘরেই বসে আছে তা মা লক্ষ্য করেনি।

মা এগিয়ে গেল ঘরে। বাবার পিঠে ধাক্কা দিল, এই যে! ওঠো!

বাবা সাড়া দিল না। মায়ের গলা চড়ল, উঃ, সহ্য হয় না। কপেগ গিলেছ আজ?

মা দুহাতে বাবার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগল, কাম অন। চোখ মেল, আই সে কাম ইন সেন্স! তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

এবার বাবা উঃ, আঃ বলে উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু মায়ের হাত তখনও তার চুল ধরে রাখায় উঠতে পাচ্ছিল না। সেটা বুঝতে পেরে মা হাত সরাল। বাবা নিজের মাথায় হাত চেপে বসার চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে লোকটাকে খুব অসহায় বলে মনে হচ্ছিল।

যেন কোনো প্রেক্ষাগৃহের আসনে একা বসে নাটক দেখছে এমন মনে হচ্ছিল ভরতের। সে দেখল বাবার শরীর তখন টলছে, মাকেও যেন ভাল করে চিনতে পারছে না।

মা বলল, ক পেগ গিলেছ যে একটুও সেন্স নেই!

আমি, আমি– বাবা মাথা নাড়ল,  বেশি না। মিত্তির–। থেমে গেল বাবা।

মিত্তির জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। তাই তো?

বাবা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বাথরুমে যাও। স্নান করো। আই সে, ওঠো। ওঠো তুমি। হাত ধর। বাবার হাত ধরে মা টানতে লাগল, স্নান করলে নেশা কমবে।

স্নান? এখন? বাবা যেন ভূত দেখল।

আমার তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কাল। কাল সকালে, প্লিজ!

নো। রাইট নাউ। এখনই।

বেশ। বলো। বাবা দুলছিল।

তোমার সঙ্গে এই অবস্থায় কথা বলা যাবে না। ইউ আর কমপ্লিটলি আউট। একটা ফোর্থ ক্লাস বাংলা খাওয়া পাতি মাতাল আর তুমি এখন এক। আই হেট ইউ। মা চেঁচিয়ে উঠল, তুমি স্নান করবে কিনা?

আমি বুঝতে পারছি। প্লিজ!

রাবিশ। মা হাল ছেড়ে দিল। তারপর দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভরত দেখল মায়ের মাথা পেছনে হেলে গেল। এবং তারপরেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মা। আর বাবা নিষ্কৃতি পেয়ে গেছে বোঝামাত্র শুয়ে পড়ল বিছানায়।

মা কাঁদছিল। এইভাবে মাকে কখনও কাঁদতে দ্যাখেনি ভরত। সে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে মায়ের কাছে পৌঁছে একটু ইতস্তত করে বলল, বসো। হাত ধরল ভরত।

চমকে উঠে কান্না থামাল মা। অবিশ্বাসী গলায় বলল, তুই?

আমি এ ঘরেই বসেছিলাম।

সব শুনেছিস?

ভরত উত্তর দিল না। মা যে কথাটা বলতে বাবার কাছে এসেছিল তা এখনও বলেনি। তাই সব শুনেছে দাবি করতে পারে না।

আমি আর পারছি না। কিছুতেই পারছি না।

তুমি এখন শুয়ে পড়।

খোকা, আমি এসব মেনে নিতে পারছি না।

এটা তোমাদের ব্যাপার মা।

আমাদের ব্যাপার। ঠিকই তো। তোকে বলতে যাচ্ছি কেন? ছাড়।

হাত ছেড়ে দিতেই মা ফিরে গেল নিজের ঘরে। ভরত কিচেনে ঢুকল। রান্না করে রাখা ঠান্ডা মাংস বের করে গ্যাসে চড়াল। পাউরুটির কয়েকটা পিস প্লেটে রাখল। গরম হয়ে গেলে খানিকটা মাংস প্লেটে নিয়ে বাকিটা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিল। তারপর প্লেট নিয়ে টেবিলে বসল। এই ফ্ল্যাটে এখন কোনও শব্দ নেই। সে একা খেয়ে যাচ্ছে। সে জানে কাল সকাল হলে ওই দুটো মানুষ একদম বিপরীত আচরণ করবে। তখন তাদের মত সুখী প্রাণী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বলে মনে হবে। খেতে খেতে তার শরীর গুলিয়ে উঠল।

.

আজ ছুটির দিন। এক রকম দিনেই সমস্যা হয়। অন্যদিন সকালে বেরিয়ে গেলে দুপুরের খাবার বাইরে খেয়ে নিতে অসুবিধে হয় না। ছুটির দিনে পড়াশুনা শেষ করে শুধু হোটেলে খেতে যাওয়ার জন্যে বের হওয়া বেশ অস্বস্তির ব্যাপার যেখানে বাবা মা বাড়িতে রয়েছে, তাদের রান্নাও তৈরি।

আজ সকাল দশটার সময় ভরত যখন তৈরি হয়ে বের হচ্ছিল তখন মা কিচেন থেকে তাকে ডেকে দাঁড়াতে বলল। অগত্যা দাঁড়াতে হল। বাবা এখনও বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। গত রাতের মানুষটার সঙ্গে ওর এখানকার চেহারার কোনও মিল নেই।

মা বেরিয়ে এল, কোথায় যাচ্ছিস?

কেন?

অদ্ভুত, একটা কথার জবাবও কি সরাসরি দিতে পারিস না?

তোমাদের দরকার আছে মনে হলে নিশ্চয়ই দিতাম।

আমার দরকার আছে কিনা তুই বিচার করবি?

ভরত অন্যদিকে তাকাল। তারপর বলল, পড়াতে যাচ্ছি।

আজকাল ছুটির দিনেও টিউশনি করছিস নাকি?

হ্যাঁ। এ বাড়ির মধ্যে বলেই করছি।

এ বাড়ির মধ্যেই? কোন ফ্ল্যাটে?

শ্রমিক নেতার মেয়েকে ইংরেজি শেখানোর কথা।

ও। শেষ পর্যন্ত মতি হয়েছে। তাহলে টিউশনি বলছিস কেন?

টাকা নিয়ে শেখাবো যখন তখন আর কী বলব?

 টাকা নিচ্ছিস মানে? তুই ওই ভদ্রলোকের কাছে টাকা নিবি নাকি?

অযথা পরিশ্রম করতে যাব কেন?

এই শুনছ! তোমার ছেলের কাণ্ড দ্যাখো। চিৎকারটা বাবার উদ্দেশে যে বাবার চুলের মুঠি নেড়ে গত রাত্রে মা ক্রোধ প্রকাশ করেছিল।

বাবা কোনও জবাব দিল না। কেন দিল না তা বাবাই জানে।

ভরত বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি।

নিশ্চয়ই। ওই ভদ্রলোক আমাদের কী উপকার করেছেন তা জানিস? ওঁর মেয়ে কয়েকটা ইংরেজি শব্দ শিখবে আর তুই তার জন্যে টাকা নিবি?

উনি আমার কোনও উপকার করেননি। করতে চাইলে নিতাম কিনা তাও ভাবার বিষয়। ঠিক আছে, আমি বলে দিচ্ছি যেহেতু আপনি আমার বাবা মায়ের উপকার করেছেন তাই আমি আপনার কাছে টাকা চাইলে ওরা অস্বস্তিতে পড়বে বলে আপনার মেয়েকে শেখাতে পারব না।

তুই-তুই! কত টাকা চেয়েছিস?

ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ওঁর মেয়েকে বলে এসেছি। ভরত হাসল, সে বলল তার বাবার কাছে চারশো টাকাটা কিছুই নয়।

তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। চারশো টাকা আমার কাছে নিয়ে নিও।

যা বলবে। ভরত দরজার দিকে এগোল।

বাইরে যাবি না। পড়িয়ে ফিরে আসবি। একসঙ্গে খাব।

আমি তো দুপুরে বাইরে খাই।

অন্যদিন কলেজ থাকে বলে আমি কিছু বলি না।

এর আগের ছুটির দিনগুলোতেও তো কিছু বলেনি?

আজ বললাম। ইচ্ছে হলে এসো। মায়ের এই তুই এবং তুমি দোটানায় আজকাল অভ্যস্ত হয়ে গেছে ভরত। মনে মেঘ জমলেই মা তুমিতে উঠে আসে। মেঘ সরাবার চেষ্টা করলে তুই-তে নামে।

দরজা খুলে বের হল ভরত। বাবার অস্তিত্ব আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। অথচ গত রাতে মা বারংবার তোমার সঙ্গে কথা আছে বলে বাবাকে চৈতন্য ফেরাতে চেয়েছিল। কী কথা ভরত জানে না কিন্তু সেই কথাগুলো কি মায়ের বলা হয়েছে? বাবা মেনে নিয়েছে বলে কি এখন শান্তি?

বেল টিপতেই পারমিতা। হেসে বলল, এই মাত্র বাবা বেরিয়ে গেল। মিটিং আছে।

ওহো! ভরত আফসোস করল।

ও বাবা! এমন ভঙ্গি করছেন যে বাবাকেই পড়াতে এসেছেন। আসুন।

নিজের ঘরে নিয়ে গেল পারমিতা। ওর মাকে দেখতে পেল না ভরত। চেয়ারে বসে পারমিতার দিকে তাকাল সে। তাকাতেই অস্বস্তি। হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো পোশাক পরেছে সে। কালো মিনি স্কার্ট এর ওপর হলুদ স্কিন-টাইট গেঞ্জি। গেঞ্জির বোম তিন নম্বর পর্যন্ত খোলা বলে সরাসরি তাকানো যায় না।

ভরত জিজ্ঞসা করল, তোমার বাবা কখন ফিরবেন?

বারোটার মধ্যে। অনেক দেরি আছে। পারমিতা হাসল, আমি বাবাকে বলেছি আপনি চারশো টাকা নেবেন। বাবা বলেছে, ঠিক আছে। বিনা পয়সায় কেউ শেখালে ভাল করে শেখাতে চায় না। চা খাবেন?

 না। এসো, আরম্ভ করা যাক। তুমি যে ক্লাসে পড় তাতে ইংরেজি বাক্য কীভাবে লিখতে হয় জানা উচিত। গত পরীক্ষায় ইংরেজিতে কত নম্বর পেয়েছ?

ফিফটি এইট পার্সেন্ট।

কার কাছে পড়?

দুজন মাস্টার আছে। সন্ধের পর আসেন।

তাঁরা তোমাকে ইংরেজিতে কথা বলতে শেখান না?

না। ওরা ভারবকে ক্রিয়া বলেন।

 যে সব শব্দ এবং তা সাজিয়ে বাক্য তোমার জানা তা বলতে, তোমার কী অসুবিধে হয়?

লজ্জা করে। যদি ভুল করি?

না। এই জড়তা ভাঙতে হবে। ভোর বেলার কারও সঙ্গে দেখা হলে তাকে কী বলে সম্বোধন করবে বলো তো?

গুড মর্নিং। দুপুরের পর গুড আফটারনুন, সন্ধের সময় গুড ইভনিং আর রাত্রে বিদায় নেবার সময় গুড নাইট। ঠিক তো?

ঠিক। হোয়াট ইজ ইওর নেম?

মাই নেম ইজ পারমিতা।

আর কী ভাবে বলতে পার?

পারমিতা চিন্তা করল। চোখ বন্ধ করে নিজের বাঁ হাঁটুতে হাত বোলানো বোধহয় ওর মুদ্রাদোষ। তাতে যে স্কার্টের প্রান্ত সরে যাচ্ছে, ফর্সা থাই দেখা যাচ্ছে সেদিকে একটুও হুঁস নেই। ভরত চোখ সরাল, আমি পারমিতা। আই অ্যাম পারমিতা।

এত সহজ? পারমিতা অবাক।

হ্যাঁ। কঠিন করে বলে কোনও লাভ নেই। যা সহজ তাই বললে যাকে বলছ তার বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না। ভরতের মনে হল মেয়েটা নেহাৎই বোকা নয়। একে শেখালে শিখতে পারবে। স্পোকেন ইংলিশ শেখাবার জন্যে নিশ্চয়ই বই আছে যা ভরতের পড়া নেই। ও নিজের মতো করে শেখাতে আরম্ভ করল।

হঠাৎ একসময়ে সে খানিকটা ধমকের গলায় বলল, তুমি হাত সরাও তো।

চোখ বন্ধ করেছিল পারমিতা, গলার আওয়াজ কানে যেতেই চোখ খুলল, কেন?

তারপর নিজের হাতের দিকে তাকাতেই উন্মুক্ত পা দেখতে পেল। স্কার্টটাকে টেনে ঠিক করে হেসে ফেলল সে, বাব্বা। আপনি হিন্দি সিনেমা দ্যাখেন না, তাই।

তার মানে?

হিন্দি সিনেমার হিরোইনরা তো এখন যা দেখায় তা গুরুজনরাও দ্যাখে।

আমি তোমার বাড়িতে হিন্দি সিনেমা দেখতে আসেনি।

আপনি খুব রাগী। মেয়েদের সাঁতার কাটতে দেখেছেন?

উফ। সেখানে প্রয়োজন বলে ওদের ওই কস্টুম পরতে হয়।

 আসলে আমি দেখতে খারাপ বলে আপনার ভাল লাগছে না।

আমি এখানে কী জন্যে এসেছি বলো তো? তোমাকে দেখতে না পড়াতে?

সবাই বলে আপনার খুব ডাঁট।

ডাঁট?

অহঙ্কার। এ বাড়ির দুটো মেয়ে আমাকে বলেছে। একজন বলেছে আপনার বাবা-মা কারও সঙ্গে কথা বলতে দেয় না। বাচ্চা করে রেখে দিয়েছে। পারমিতা হাসল, যাক গে, শুধু ইংরেজি বলা নয়, ইংরেজি পেপারটা আপনি আমাকে পড়াবেন?

তোমার তো মাস্টার আছে সে জন্যে।

আপনি অনেক ভাল পড়াবেন। একসঙ্গে দুটো কাজ হয়ে যাবে।

তুমি সিরিয়াসলি পড়বে?

হ্যাঁ।

ভেবে দেখব।

না। ভাবা চলবে না। সবসময় আপনার জেদ থাকবে না? আমার কথাও শুনতে হবে।

 বেশ। তাহলে তুমি এমন পোশাক পড়ার সময় পরবে না।

তাহলে কি বোরখা পড়ব? এমন পোশাক পরলে কী হয়?

আমার অস্বস্তি হয়।

ও বাব্বা! আপনার ওসব হয়? ঠিক আছে, আমি শাড়ি পড়ব। পারমিতা জিজ্ঞাসা করল, তাহলে বাবাকে বলব চারশ আর চারশ মোট আটশ দিতে হবে।

না। যা বলেছি তা দিলেই চলবে। ইংরেজি বই দেখি।

পারমিতা উঠে টেবিলে থেকে এমন ভাবে বই নিতে গেল যে ভরতের শরীরের সঙ্গে তার শরীর ঠেকল। ভরত কুঁকড়ে উঠতে সে গা করল না।

ভরতের এমন অভিজ্ঞতা আর কখনও হয়নি। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। বইটা হাতে পেয়ে সে তাড়াতাড়ি পাতায় মন দেবার চেষ্টা করল।

তোমাদের কত পর্যন্ত পড়ানো হয়ে গেছে?

চ্যাপ্টার ফাইভ পর্যন্ত।

খাতা নাও। এই বইটা তাকে কখনও পড়তে হয়নি কিন্তু বিষয়গুলো মোটামুটি জানা। পাঁচটা চ্যাপ্টার থেকে পাঁচটা প্রশ্ন লিখিয়ে সে বলল, উত্তর লিখে রাখবে। সপ্তাহে তিনদিন আসব। পরশু ছটার সময়। তার মধ্যে উত্তর লেখা চাই।

বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ল পারমিতা, ওকে!

চিটিং করো না।

তার মানে?

নকল করো না বই থেকে। ভরত হাসল, নকল করাকে চিটিং বলে।

আই অ্যাম নট এ চিটার। হয়েছে।

হুম।

আচ্ছা, ভালবাসা ইংরেজি তো লাভ। আর কিছু আছে?

আছে। তবে সেটা সরাসরি ভালবাসার ইংরেজি নয়।

পারমিতা বলল, আমি বাবাকে যদি বলি, আই লাভ ইউ তাহলে দোষের নয়?

দোষের কেন হবে?

কোন ছেলে যদি আমাকে বলে আই লাভ ইউ তাহলে?

সেই ছেলেটাকে যদি তুমি বলার সুযোগ দাও—

 সুযোগ না, এমনি বলল।

যদি তোমার ইচ্ছে করে মেনে নিতে—

 মেনে না নিলে?

 তাকে বলবে আই ডোনট নিড ইট।

ও। তাহলে আই লাভ ইউ বাবাকেও বলা যায় আবার অন্য ছেলেকেও?

হ্যাঁ। কিন্তু এখানে লাভ শব্দটা যাকে বলছ তার সঙ্গে সম্পর্কে অনুযায়ী মানে তৈরি হচ্ছে। তুমি তোমার বেড়ালকে ভালবাস। সেই ভালবাসা আর বাবাকে ভালবাসা তো এক নয়। তুমি বাবাকে ভালবাস আবার মাকেও ভালবাস। দুটো দু রকমের ভালবাসা।

বুঝলাম। যদি আমি কোনও ছেলেকে বলি আই লাভ ইউ তাহলে সেটা কী ধরনের ভালবাসা হবে? ইংরেজি সিনেমায় দেখি কোনও ছেলে একটা মেয়েকে যেই বলল আই লাভ ইউ সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা চোখ বন্ধ করে মুখটা কী রকম করে ফেলে। বাবাকে বললে বাবা তো ওরকম করে না কেন?

এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার?

আপনি উত্তরটা জানেন না তাই এড়িয়ে যাচ্ছেন।

তুমি আর একটু বড় হও বুঝতে পারবে।

আমি যথেষ্ট বড়। আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট অবস্থায় ঠাকুমা মা হয়েছিল।

তাহলে আমাকে প্রশ্ন করছ কেন? তুমি তো জানো!

জানি কিন্তু বুঝতে পারি না। এই বলছে আই লাভ ইউ আর তার পরেই ঝগড়া করছে।

ঝগড়া?

হ্যাঁ। আমার এক মাসতুতো দিদি প্রেম করে বিয়ে করেছে। সবাই আপত্তি করেছিল, ওরা বলেছিল বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করবে। বিয়ের ছয় মাস পরেই ওরা এমন ঝগড়া করেছে। বোন ফিরে এসেছে মাসির কাছে। ওরা নিশ্চয়ই বিয়ের আগে আই লাভ ইউ বলেছিল। কথাটা তাহলে সত্যিই নয়?

জানি না।

আপনি কাউকে আই লাভ ইউ বলেননি? বাংলায় বলতে কি রকম লাগে। কিন্তু ইংরেজিতে চট করে বলে ফেলা যায়। বলেছেন? উজ্জ্বল মুখে তাকাল পারমিতা।

না। উঠে দাঁড়াল ভরত।

তাহলে আপনি জানবেন কী করে। আপনাকেও কেউ বলেনি?

না।

তাহলে বলার মতো কোনও কাজ করেননি। এমনি এমনি বলবে কেন?

আমি যাচ্ছি।

ওমা! এত তাড়াতাড়ি যাবেন কেন? বাবা মাস্টামশাইদের বলে মিনিমাম দুঘণ্টা পড়াতে। আপনার তো একঘণ্টাও হয়নি।

তোমাকে প্রশ্ন দিয়ে গেলাম। উত্তর লিখে রেখ। আজ পড়াব না।

বলেছি তো রাখব। বসুন না!

ভরত বসল। হঠাৎ পারমিতাকে তার বেশ ভয় লাগছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি পড়াশুনো ছাড়া সারাদিন কী কর?

গল্পের বই পড়ি, সিনেমা দেখি আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মজা দেখি।

কী মজা?

কাছের দূরের অনেক ফ্ল্যাটের ছেলেরা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে হাসে, কেউ কেউ ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে এসে সেটা আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়। একই সঙ্গে তিন-চারজন, কেউ কাউকে দেখতে পায় না, আমি দেখি।

ওরা খামোকা তোমাকে ওসব করবে কেন?

কি জানি। হিন্দি সিনেমার ড্যান্স করি, হয়তো দূর থেকে দেখেছে।

তুমি ব্যালকনিতে যাও কেন?

বারে! আমাদের ব্যালকনিতে আমি যাব না?

ওরা তোমাকে স্কুলে যাওয়ার আসার পথে বিরক্ত করতে পারে।

করে না। গাড়িতে যাই তো। তাছাড়া বাবার কথা ওরা জানে। পারমিতা হাসল, আমার খুব মজা লাগে। অল্পবয়সী থেকে বয়সী ছেলেরা আমাকে দেখবে বলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে জানলায়, ব্যালকনিতে। একে নিশ্চয়ই লাভ বলে না।

না।

ওই তো মুশকিল। তাহলে লাভ কাকে বলে?

ইংরেজি সাহিত্যের প্রধান নাট্যকারের নাম কী?

শেক্সপীয়ার। রোমিও জুলিয়েটের গল্পের কথা বলছেন?

না। আজ চললাম।

 আচ্ছা! আমি যদি আপনাকে আই লাভ ইউ বলি আপনি রাগ করবেন?

আমাকে খামোকা বলতে যাবে কেন? গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল আবার।

ইচ্ছে করছে, খুব।

এমন সব ইচ্ছে হলে তোমার আর যাই হোক পড়াশুনা হবে না।

ভরতের মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে তত সে নিষ্কৃতি পাবে। পারমিতার পোশাক, হাবভাব তাকে কি রকম বিভ্রান্ত করে তুলছিল।

বাইরে বেরিয়ে লিফটে নিচে নামতে নামে ভরতের মনে হল মেয়েটা, যাকে বলে খারাপ, তা নয়। একা একা থাকে আর হিন্দি গান এবং সিনেমা দেখে মাথায় ওই সব ভাবনা ঢুকিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন করলে চটপট জবাব দেয়। তার অন্য ছাত্রদের থেকে পারমিতা মোটেই নিষ্প্রভ নয়। কিন্তু, ওই যে তাকে আই লাভ ইউ বলল, এটা যদি ঘন ঘন বলে তাহলে কী হবে? আজ থেকে চার বছর আগে কেউ একথা বললে ভাল লাগত। এখন শব্দ তিনটে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে হয়। পারমিতা না বুঝে খরচ করছে। নিচে নামতে নামতে ওর মনে সুদেষ্ণার কথা মনে এল। সুদেষ্ণার পাশে পারমিতা বালিকা। যদি সুদেষ্ণা তাকে আই লাভ ইউ বলত তাহলে কী রকম হত? সে কি খুশি হত না? ভরত হঠাৎ এক ধরনের আবেগে আক্রান্ত হল। তার। মনে হল পৃথিবীতে কোনও আপনজন নেই। সুদেষ্ণা যদি তার পাশে থাকে তাহলে তার মন ভাল হয়ে যাবে। হঠাৎ পৃথিবীটা জুড়ে সুদেষ্ণা ছড়িয়ে পড়ল।

লিফট থেকে নেমে হাউসিং গেটের পাশে চলে এল সে। ওখানে একটা টেলিফোন বুথ রয়েছে। সুদেষ্ণার টেলিফোন নাম্বার তার জানা নেই। জানা থাকলে এখান থেকে এখনই টেলিফোন করে জিজ্ঞাসা করত সে তাকে ভালবাসতে পারবে কিনা। বুথের সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড হতাশ হল সে। সুদেষ্ণা এই কলকাতায় রয়েছে, ওই বাড়িতে টেলিফোনও আছে শুধু নাম্বারটার না জানার জন্যে সে ওর কাছে পৌঁছেতে পারছে না।

এই সময় প্রণবকে দেখতে পেল সে। হাতে একটা প্যাকেট।

প্রণব হাসল, কেমন আছিস?

 তুই?

চলছে। ওহো, তুই মায়ের সঙ্গে কর্পোরেশনে গিয়েছিলি বলে ধন্যবাদ।

 গিয়ে তো কেস কাঁচিয়ে দিয়েছিলাম।

আমি হলেও তাই করতাম। প্রণব হাসল, তবে টাকাটার খুব দরকার ছিল। আমরা উত্তেজনার মাথায় যা করি তা সব সময় আমাদের ভাল করে না।

কাগজপত্র পেয়ে গেছিস তোরা?

হ্যাঁ। বায়নাও হয়ে গেছে। আগামিকাল রেজিস্ট্রি হবে।

 তাহলে তো আর তোদের কোনও চিন্তা নেই।

হ্যাঁ। বাবাকে আমার বিড়লাতে ভর্তি করতে পারব। আমিও চাকরি ছেড়ে দিয়ে ডে সেকসনে ট্রান্সফারের চেষ্টা করছি। প্রণব নিশ্চিন্ত গলায় বলল।

অনেক কিছু বলা যেত কিন্তু হঠাৎ ভরতের মনে হল এই মুহূর্তে প্রণবের কাছে সে সব আদৌ মুল্যবান নয়। প্রণবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে রাস্তায় নামল। পশ্চিমবাংলার প্রতিটি পরিবার যদি এভাবে সমস্যামুক্ত হয়ে থাকতে পারে। তাহলে তারা আর কিছু চাইবে না। প্রত্যেকের সংসারে অর্থাভাব নেই, যে যার কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারছে এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে। যে অল্প মাইনে পাওয়া ভদ্রলোক নিয়মিত ঘুষ নিয়ে পরিবারের সবার অর্থাভাব মেটান তাঁকে কেউ প্রশ্ন করে না মাইনের বাইরে টাকাটা তিনি কীভাবে পাচ্ছেন? এইভাবে সবাই স্বার্থ দেখছে এবং তার প্রাবল্যে দেশের অবস্থা বারোটা বেজে গেলেও কারও আক্ষেপ নেই। যার দশ টাকা ঘুষ নিলে চলে যেত সে পঞ্চাশ নিয়ে সমতা বজায় রাখবে। দেশ বড় না পরিবার বড় এই প্রশ্নের জবাব। ভারত তাকাল। একজন রোগা প্রবীণ মানুষ হেঁটে আসছেন। এঁকে সে কোনওদিন দ্যাখেনি। হাঁটার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে কোনও তাড়া নেই। তার মাথায় মতলব এল।

নমস্কার।

নমস্কার। কী ব্যাপার ভাই?

আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ি। একটা সমীক্ষার কারণে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনি জবাব দিলে খুব ভাল হয়। ভরত বিনীত গলায় বলল।

বেশ। বলো।

আপনি নিজেকে কী মনে করেন?

আমি একজন মানুষ। পি ডব্লু ডি-তে চাকরি করতাম।

সেটা আপনার প্রথম পরিচয় নয়।

ও। প্রথম পরিচয় আমি বাঙালি।

এটাতে বিভ্রান্তি থাকছে। আপনি কলকাতার বাঙালি না ঢাকার বাঙালি সেটা বোঝা যাবে না। আপনি কোন দেশের মানুষ?

ছেলেমানুষী কথা। আমি পশ্চিমবাংলার মানুষ তা তুমি জানো না?

পশ্চিমবাংলা একটা দেশ নয়। আপনি ভারতবর্ষের নাগরিক তা বলতে পারছেন না?

ও হ্যাঁ, তা ঠিক। ভদ্রলোক আকাশের দিকে তাকালেন, আসলে কি জানো ভাই, চট করে ভারতবর্ষের কথা মাথায় আসে না। নিজেকে বাঙালি ভাবা অভ্যেস ঢুকে গেছে।

আপনার পরিবারকে আপনি ভালবাসেন?

নিশ্চয়ই। আমরা খুব সুখী।

আপনার দেশকে?

হ্যাঁ। দেশকে তো ভালবাসতেই হবে। দেশ হল দ্বিতীয় জননী।

দেশের জন্যে পরিবারের মানুষদের বঞ্চিত করতে হলে আপনি সেটা করবেন?

এ আবার কি কথা? দেশ কি পরাধীন যে স্বদেশি আন্দোলনে যেতে হবে পরিবারকে ছেড়ে? সে সব আগের যুগের বিপ্লবীরা করেছেন।

আমি সে কথা বলছি না। ধরুন চাল আলুর দাম হু হু করে বেড়ে গেছে। কালোবাজারি চলছে। খোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার আপনার কাছে আবেদন করছেন যে বেশি দাম দিয়ে কালোবাজার থেকে ওসব না কেনেন। বরং রুটি খান, সবজি খান যা পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আপনার বাড়িতে ভাত আলু ছাড়া চলে না। সরকারের আবেদনে সাড়া দিলে কালোবাজার বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু আপনার পরিবারে খাওয়া নিয়ে অশান্তি হবে। আপনি কোনটা করবেন?

ভদ্রলোক বললেন, আমি যদি কালোবাজার থেকে না কিনি তাহলে অন্য লোক কিনবে। নিজের সন্তানদের কে কষ্ট দিতে চায় বল? তাছাড়া আবেদনে সাড়া দিলেও যে সরকার কালোবাজারীদের ঠান্ডা করতে পারবেন সেই নিশ্চয়তা কোথায়? আগেও তো দেখছি সরকার যেখানে হাত দেয় সেখানেই গোলমাল হয়।

তাহলে সরকারের ওপর আপনার ভরসা নেই বলে নিজের পরিবারকে যে করেই হোক ভাল রাখতে চাইবেন। তাই তো?

বলতে পার। আপনি বাঁচলে তবে বাপের নাম। এই দ্যাখো, আমি সিগারেট খাই। সরকার বিলাসকর বসাল। সিগারেটের দাম বাড়ল। দেখলাম কর বসার আগে তৈরি সিগারেট বাজারে ছেয়ে যাচ্ছে এবং বিক্রি হচ্ছে কর যোগ করে। এতে সরকার কি পাচ্ছে জানি না তবে দোকানদার লাভ করছে চুটিয়ে। পাশের প্রদেশে বিলাসকর নেই। সেখান থেকে এসে দোকান দোকানে বিক্রি হচ্ছে, সরকার পাচ্ছে লবডঙ্কা। এই তো সরকারের অবস্থা। খাটাল সরাতে চাপ দিল সরকার। সঙ্গে সঙ্গে দুধের দাম বেড়ে গেল। এই যে বাড়ল আর কমবে না। আমাদের আলু মন্ত্রী যে দামে আলু কেনেন সেই দামে কলকাতার কোথাও আলু পাওয়া যায় না।

ভরত বললে, অনেক ধন্যবাদ। আপনার নাম জানতে পারি?

কেন? নাম দিয়ে কী হবে?

আপনার বক্তব্য–!

 ক্ষেপেছ? ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি। কোথাও আমার নামে কথাগুলো ছাপা হলে বাড়িতে যদুবাহিনী চড়াও হবে। কোনো দরকার নেই নামে! ভদ্রলোক আবার হাঁটতে শুরু করলেন। ভরত তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।

এই হল ভারতবর্ষের নাগরিক। পরিবারে বাইরে আর কাউকে তারা চেনে না। আবার পরিবারের মধ্যে বিরোধ এলে নিজের পক্ষে যে তাকে নিয়ে আলাদা দল করে ভাল থাকতে চায়। এইভাবে মানুষ নিজের সীমানা ক্রমশ ছোট করে নিচ্ছে আপাত সুখের জন্যে। দেশ বড় না নিজের পরিবার বড় এই প্রশ্নে অগ্রাধিকার পাচ্ছে পরিবার, আবার পরিবার বড় না নিজে বড় এই প্রশ্নের উত্তর সব সময় অত সরল নয়। নইলে কেউ কেউ নিজের পরিবারকে বাঁচাতে নিঃশেষ হয়ে যায় এই পশ্চিমবাংলায়।

বাস ধরে ভরত সোজা সুদেষ্ণাদের বাড়িতে চলে এল। এখন প্রায় দুপুর। এই সময় কারও বাড়িতে যাওয়া শোভন নয়। কিন্তু এসব তার মাথায় ঢুকছিল না। সুদেষ্ণাকে দেখার জন্যে অদ্ভুত একটা আগ্রহ বেড়ালের মতো বুকের ভেতরটা আঁচড়ে যাচ্ছিল। গেট পেরি ভেতরে ঢুকতেই দারোয়ান গোছের লোকটা তাকে আটকাল। ভরত জানাল যে সে সুদেষ্ণার বন্ধু, গত সন্ধ্যায় এসেছিল। আজ একটা জরুরি দরকারে দেখা করতে চায়।

লোকটা তাকে সেখানে দাঁড় রেখে করিয়ে ভেতরে গেল। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ভরত নিজেই সিঁড়ি ভাঙল। ওপরে উঠতেই সুদেষ্ণার সঙ্গে দেখা, লোকটার সঙ্গে নিচে নামছিল। সুদেষ্ণা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

সুদেষ্ণা আজ সাদা পরেছে। সাদা স্কার্ট, সাদা জামা। চমৎকার শান্ত এবং সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। ভরত উত্তরটা খুঁজে পেল না। লোকটা ওদের পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে যেতেই সে বলল, ফোন নাম্বার জানতাম না। জানলে ফোনে কথা বলতাম।

কী হয়েছে? কোনো প্রব্লেম?

না। তেমন সিরিয়াস কিছু নয়।

সিরিয়াস তো বটেই নইলে তোমার মতো ছেলে এই ভরদুপুরে আসত না।

ভরত মাথা নিচু করল। কীভাবে কথাটা সামনে দাঁড়িয়ে বলা যায়। বরং ওর টেলিফোন নাম্বারটা নিয়ে ফোনেই কথাটা বলা যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, নাম্বারটা কী?

বলব। আগে বলো কী দরকার?

ভরত ঠোঁট টিপল। যা সত্যি তা বলাই ভাল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভরত বলল, আমার মনে হচ্ছে, মানে আমি ফিল করছি, আই নিড এ ফ্রেন্ড। আমার একজন বন্ধু দরকার। ভাল বন্ধু।

ও। ওয়েল, আমরা তো বন্ধুই।

হ্যাঁ। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। সাডেনলি আমি অনুভব করছি যে আমি তোমাকে ভালবাসি। আই লাভ ইউ সুদেষ্ণা।

হোয়াই? খুব আস্তে প্রশ্নটা করল সুদেষ্ণা।

আই ডোন্ট নো। সত্যি আমি জানি না। মাথা নাড়ল ভরত। সুদেষ্ণা পেছন দিকে তাকাল। ওরা দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মুখটা। পেছনের ঘরে কেউ থাকতেই পারে। সুদেষ্ণা বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

থতিয়ে গেল ভরত, কিন্তু তুমি?

আমি তো এ ব্যাপারে কিছু ভাবিনি, কখনও মনেও আসেনি। তোমার কথা শুনলাম, আমি নিশ্চয়ই ভেবে দেখব ভরত। তুমি ঘরে এসে বসবে?

তুমি ভেবে দেখবে আমাকে ভালবাসবে কিনা?

 নিশ্চয়ই। তুমি গতকাল বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে আমায় ভালবাসতে?

মনে করে দেখে ভরত মাথা নাড়ল, না।

 গতকাল এ বাড়ি থেকে যাওয়ার পর তোমার মনে ভালবাসা এল?

তাও না। সত্যি কথা বলল ভরত।

তাহলে?

আজ একটি ক্লাসে টেনের মেয়ে আমাকে আই লাভ ইউ বলে। আমি তাকে নিষেধ করি। কিন্তু তার পর থেকেই তোমার কথা বারংবার মনে আসছে। আমি আবিষ্কার করলাম তোমাকে ভালবাসি।

কি সহজ ব্যাপার।

মানে?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কাল রাতের বেলায় গান এল মোর মনে। সেই রকম আজ সকালে ভালবাসা এল তোমার মধ্যে। ওই মেয়েটি কী দোষ করেছিল?

আমার যে ওকে ভাল লাগেনি।

গুড। এটাই সত্যি। তুমি দুপুরে খেয়েছ?

না।

আমরা এখন খেতে বসব। তুমি এসো।

না। খাওয়াটা আমার কাছে খুব মূল্যবান কিছু নয়। আমি তোমাকে আমার ব্যাপারটা বলে দিলাম। তুমি ভাবো, ভেবে বলো।

নিশ্চয়ই। তবে তোমার যেমন আপনা আপনি ওই অনুভুতি এল আমার যে তেমন আসছে না। হ্যাঁ, আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে নিয়েছি। তুমি যা চাইছ সেরকম অনুভুতি কখনও যদি আমার হয় তাহলে তুমি জানতেই পারবে।

কবে?

 সুদেষ্ণা হাসল, তা আমি কী করে বলব?

 কখনও নাও হতে পারে।

আমি জ্যোতিষী নই।

এলাম। ভরত আর দাঁড়াল না। অদ্ভুত একটা বোধ ওকে আক্রমণ করে রাখল কিছুক্ষণ। নিজেকে বঞ্চিত অপমানিত বলে মনে হচ্ছিল প্রথম দিকে। সুদেষ্ণা তাকে স্পষ্টই প্রত্যাখ্যান করেছে এই জ্বালায় খুব ছোট মনে হচ্ছিল।

.

দরজা খুলে মা জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি করলি?

কেন?

আমরা তোর জন্যে বসে আছি একসঙ্গে খাব বলে। দুটো বেজে গেছে। যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি।

আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা খেয়ে নাও।

তার মানে তুমি খেয়ে এসেছ! মায়ের গলা উঠল। তুমি বলা মানে ক্রোধ বাড়ছে, আমার কথার কোনও মূল্য নেই তোমার কাছে?

ভরত মায়ের দিকে তাকাল, আমি খেয়ে আসিনি। আমার মন ভাল নেই, খেতে ইচ্ছে করছে তাই খাব না।

বাবার গলা পাওয়া গেল, ইচ্ছে নেই যখন জোর করছ কেন?

ইচ্ছে নেই? দুপুর বেলায় ভাত খেতে কার ইচ্ছে হয় না? মন খারাপ? ওই তো বয়স, এর মধ্যে এমন কী মন খারাপ হতে পারে যে খাওয়ার ইচ্ছে চলে যাবে? আসলে বদমায়েসি। আমি খেতে বলেছি তাই খাবে না। মা চেঁচিয়ে উঠল।

এবার বাবা বেরিয়ে এল, তোর কী হয়েছে?

তোমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে মাথা ঠিক নেই।

কী বলতে চাইছিস?

তুমি বন্ধুদের নিয়ে হুইস্কি খেয়ে আউট হয়ে পড়ে থাকচ্ছ। বেল বাজাতেও শব্দ কানে যাচ্ছে না। বাবা হিসেবে তোমার এই ছবি আমাকে চিরকাল মনে রাখতে হবে। রাত দুপুরে মা বাড়িতে ফিরল। তোমাকে জাগাতে চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত পাগলের মতো তোমার চুল মুঠোয় ধরে আঁকাতে আঁকাতে বলল জরুরি কথা আছে কিন্তু তাতেও তোমার হুঁশ ফিরল না। এই ছবিটাও আমি ভুলতে পারব না। ভরত ঘুরে দাঁড়াল মায়ের দিকে, মা, গত রাত্রে বাবাকে কিছু বলার জন্যে তুমি ক্ষেপে উঠেছিলে। আজ বলেছ?

মায়ের চেহারা এর মধ্যে পাল্টে গিয়েছিল। কি রকম নিরক্ত দেখাচ্ছিল ওর মুখ। মাথা নেড়ে বলল, বলেছি।

ভরত এটা আশা করেনি। ভেবেছিল সকাল হলে দুজনেই রাতের কথা ভুলে যাবে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মা জিজ্ঞাসা করল, কী কথা তা জানতে চাইবি না?

না। ওটা তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

তুই তাহলে খাবি না?

আড়ষ্ট হল ভরত। মা আবার তুই-তে নেমে এসেছে। সে মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। আসছি। ঘরে চলে এল ভরত। সোজা বাথরুমে। আয়নায় নিজেকে দেখল সে। মানুষ কত সহজে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নেয়। মনে হলো নিজের মুখটাকে।

অন্যরকম লাগছিল। একদম স্বাভাবিক নয়। সুদেষ্ণার মুখ মনে পড়ল। কি সহজ! মনে এলেই মন ভাল হয়ে যায়। কিন্তু সুদেষ্ণা তাকে বলতে পারেনি ভালবাসি। ওই একটা শব্দ উচ্চারণ করতে কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? ভালবাসি বললে কি একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিপত্রে সই করা হয়ে যায়? ভরত এসব জানে না কিন্তু সুদেষ্ণা তাকে গ্রহণও যেমন করেনি আবার প্রত্যাখ্যানও করেনি। ভাবার সময় নিয়েছে। এসব ব্যাপার কি ভেবেচিন্তে ঠিক করা যায়? মনে এলে আপনি আসে। গতকাল বিকেলে সুদেষ্ণা যদি তাকে ভালবাসার কথা বলত তাহলে সে মুখের ওপর না বলে দিত। ভাববে বলত না। পৃথিবীর যেসব নারীপুরুষ পরস্পরের প্রতি আসক্ত হয় তারা কি আগে থেকেই তৈরি থাকে? একজনের সুইচ টিপলে আর একজনের আলো জ্বলে ওঠে? রাধা গিয়ে কৃষ্ণকে বলল তোমাকে ভালবাসি কিন্তু কৃষ্ণ যদি উত্তর দিত, না মামী, আমি বাসি না। বলতেই পারত, তাহলে কী হত? এক পক্ষ চাইলেই আর এক পক্ষ হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে তার কোনও মানে নেই। এ ঈশ্বরের মত একজন নয় যাকে প্রাণভরে ভালবেসে যাও এবং সাড়া না পেলেও হতাশ হয়ো না। এইসব ভাবতে ভাবতে ভরতের মন সহজ হলো। ক্রমশ সে বুঝতে পারত, সুদেষ্ণাকে খুব সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। কাল দেখা হলে বলবে এই ব্যাপার নিয়ে তাকে কোনও রকম ভাবনা ভাবতে হবে না।

খাওয়ার টেবিলে এসে বসল সে। বাবা আগেই বসেছিল। মা খাবার দেওয়া শুরু করল। বাবা একটু ইতস্তত করে বলল, প্রত্যেক মানুষের জীবনে কখনও কখনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়, কাল আমার ঘটেছিল। ঘটনার জন্যে আমি লজ্জিত।

ভরত কিছু বলল না। বাবাকে এই গলায় কথা বলতে শোনেনি সে। খাবার দিয়ে মা এসে বসল প্লেট নিয়ে। ভরতের মনে হল অনেক অনেকদিন পরে ওরা তিনজন একসঙ্গে খাচ্ছে। বাল্যকালে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত। তারা কে কী জিনিস খেতে পছন্দ করে না তা তিনজনেরই জানা। অথচ আজ তিনজনই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। বাবা মায়ের মধ্যে সম্পর্কটা কি তা সে আজও বুঝল না। বাবা যদি প্রণবের বাবার মত অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে মা নিশ্চয়ই প্রণবের মায়ের মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। তাহলে সুস্থ অবস্থায় কেন এরা একটু শান্তিতে থাকতে চায় না। অথবা এটাই ওদের শান্তিতে থাকার ধরন যা সে ঠিক বুঝতে পারে না। তিনজনেই খাওয়া শেষ করল একসঙ্গে। হঠাৎ মা বলল, কাল রাত্রে তোর বাবার সঙ্গে যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম বলে তুই শুনেছিলি সেটা আজ বলেছি।

আমি তো বললাম ওটা তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

অবশ্যই। তবে এর সঙ্গে তুইও জড়িয়ে আছিস।

তার মানে?

আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি। মা শান্ত গলায় বলল। বাবা টেবিলের ওপর চোখ রেখেছিল।

আলাদা হয়ে যাচ্ছ? ভরত বিশ্বাস করতে পারছিল না।

আমরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছিলাম না অনেকদিন থেকে। আমাদের রুচি, মন, ব্যবহারের কোনও মিল হচ্ছিল না। তোর বাবার জন্যে আমাকে এমন কিছু করতে হচ্ছিল যা আমার মন চাইছিল না। তুই দেখেছিস আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই ছিল।

এতদিন সহ্য করছিলে কী করে?

তোর জন্যে। তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর মুখ চেয়ে আমরা কিছু করতে পারিনি। যখন দেখলাম তুই স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছিস, টিউশনি হোক আর যাই হোক, পয়সা রোজগার করে দেড়বেলা খাচ্ছিস তখন—। মা থামল।

আমাকে নিয়ে আর কোনও সমস্যা রইল না! ভরত বাকিটা বলে দিল।

হ্যাঁ। কথাটা সত্যি। যতদিন তুই আমাদের ওপর নির্ভর করেছিলি ততদিন আমাদের দায় ছিল। অসহ্য হলেও আমরা সেটা মানিয়ে নিতে চাইতাম।

তুমি যা বলছ বাবারও একই সিদ্ধান্ত?

আপত্তি থাকলে ও প্রতিবাদ করত।

তোমরা কী করবে?

আমরা আলাদা হয়ে যাব। সুখ পাইনি কিন্তু স্বস্তি পেতে দোষ কী।

এই ফ্ল্যাটে–?

আমি থাকব। তোর বাবা আর একটা প্রমোশন পাচ্ছে। কোম্পানি ওকে সানি পার্কে ভাল ফ্ল্যাট দেবে। কোনও অসুবিধে হবে না।

তুমি তো হাউসওয়াইফ। তোমার চলবে কী করে?

কাল যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে একটা ব্যবস্থা হয়েছে। একটা নামী ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিচ্ছি আমি। তোর বাবার কোনও দায় নেই।

এসব কথা তোমরা খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেছ?

মা হাসল, হ্যাঁ রে।

এবার বাবা কথা বলল, তোর মা যা বলল এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা চাই তুই যতদিন পড়াশুনা করতে চাইবি ততদিন আমরা তোর পাশে থাকব। তুই কার কাছে থাকবি, আমার কাছে না তোর মায়ের কাছে সেটা তুই ঠিক করবি।

আমি থাকলে কার অসুবিধে হবে না?

মা বলল, আমার অসুবিধে হবে কেন?

বাবা বলল, অসুবিধে হবার কোনও কারণ নেই।

আমি যদি তোমাদের দুজনের কারও কাছে না থাকি?

তুই কি হোস্টেলে থাকতে চাইছিস? বাবা জিজ্ঞাসা করল।

আমি এখনও কিছু ভাবিনি।

দ্যাখ ভেবে দ্যাখ। আমরা সামনের মাস থেকে আলাদা হব।

 তোমরা কি ডিভোর্স চাইছ?

সেটা চাইতে গেলে অনেকটা সময় আলাদা থাকতে হয়। এটা সেই প্রথম স্টেপ। বাবা উঠে গেল। বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ভরত মায়ের দিকে তাকাল, এতদিনের সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

মা নিষ্পলক তাকাল, হচ্ছে নিশ্চয়ই কিন্তু আমি টের পাচ্ছি না।

বুঝতে পারলাম না।

যে সমস্ত মোষ গাড়ি টানে তাদের কাঁধে দেখবি মস্ত কড়া পড়ে যায়। ঘাটা পড়া বলে। সেখানে কোনও অনুভূতি থাকে না। ওটা শক্ত হয় যাওয়ার পর গাড়ি টানার সময় মোষের একটুও ব্যথা লাগে না। আমারও তাই অবস্থা। সংঘাত হতে হতে মনের সব নরম ব্যাপারগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন সমস্ত মন জুড়ে ওই ঘাটা পড়ে গেছে। তাই ব্যথা লাগলেও টের পাচ্ছি না। মা বলল।

ভরত উঠল। হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ফিরল। বিছানায় শুয়ে সে অপলক তাকিয়ে থাকল ছাদের দিকে। একসময় সে ভাবত এই খেয়োখেয়ি করে ওরা একসঙ্গে আছে কী করে? কেন আলাদা হয়ে যায় না? রাত্রে যুদ্ধ করে আবার সকালে বন্ধুত্ব করে কী করে? কিন্তু এখন ওরা আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শোনার পর তার একটুও ভাল লাগছে না। এটা কি তার মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণে? মধ্যবিত্তরা ভাল বা মন্দ কোনোকিছুকেই চূড়ান্ত অবস্থায় মেনে নিতে পারে না।

বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তারপর ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। বাবা আবার বিয়ে করতে পারে। এখনও চেহারা শরীর অটুট আছে বাবার। মাকে কিন্তু একটুও প্রৌঢ়া বলে মনে হয় না তবু মা আবার কাউকে বিয়ে করছে এটা ভাবতে অস্বস্তি হয়। কী আশা নিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে? সারাজীবন একজন পুরুষের সঙ্গে যখন মিল হলো না তখন পরিণত বয়সে অচেনা আর একজনের সঙ্গে সেটা হবে এমন আশা করার কোনও কারণ আছে! ফুটন্ত কড়াই থেকে গনগনে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া হতে পারে সেটা।

হঠাৎ সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না এল ভরতের। এমনভাবে কান্না আসবে সে নিজেই জানত না। তার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। দ্রুত উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে সামাল দেবার চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণে। একান্না কার জন্যে সে নিজেই জানে না। কিন্তু আর কেউ তাকে কাঁদতে দেখুক তা সে চাইছিল না। কান্না যখন থামল তখন সব কিছু ফাঁকা হয়ে যাওয়ার বদলে ভরতের মনে কিরকম আক্রোশ দানা বাঁধতে লাগল। এই আক্রোশ কার বিরুদ্ধে কী কারণে তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কেবল মনে হচ্ছিল তার সামনে একটার পর একটা কালো দেওয়াল এবং বেঁচে থাকতে হলে ওইসব দেওয়াল ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। কাউকে কোনও কৈফিয়ত দেবার দায় তার নেই।

.

পরের দিনও এ বাড়ির আবহাওয়া স্বাভাবিক। কেউ দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর কয়েকদিন পরে একটা বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। দুটি নারীপুরুষ দীর্ঘসময় একত্রে বাস করে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছে এবং তার জন্যে কোনো তিক্ততা নেই। দুজনের মধ্যে এখন ভাল বন্ধুর সম্পর্ক। গতরাত্রে বাবা মদ খেয়েছে একাই পরিমিত। মা সময় পেলে গল্প করে গিয়েছে। যে কোনও স্বাভাবিক দম্পতির ছবি।

ওরা যদি ঝগড়া করত, কথা বন্ধ রাখত তাহলে অনেক ভাল লাগত ভরতের। উত্তেজনার মাথায় মানুষ যা করে তা সহ্য করা যায় কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে সুস্থে যদি সেই জিনিস করে তাহলে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ওরা বলেছে সে কার সঙ্গে থাকবে তা যেন ঠিক করে নেয়। কার সঙ্গে? বাবা না মা? যদি এই দুজনের সঙ্গেই না থাকে তাহলে তার থাকার জায়গা কোথায়? ভরতের মনে আত্মীয়স্বজনের ছবি এল। বাবার এক ভাই থাকেন দুর্গাপুরে। কালে ভদ্রে আসেন। এলে এ বাড়িতে ওঠেন না, কিছুক্ষণের জন্যে থেকে বেরিয়ে যান তিনি। বাবার বোন থাকে জামশেদপুরে। ছেলেবেলায় তাকে কয়েকবার দেখেছে সে। পিসি বলত। একদিন মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তোমার বোন আর কতদিন থাকবে কিছু বলেছে? বাবা জবাব দিতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল মায়ের প্রশ্নের জবাবটা সে-ই জেনে নেবে। সোজা পিসিকে গিয়ে প্রশ্নটা করেছিল। পিসি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন রে?

সে বলেছিল, মা জানতে চাইছে। পরদিনই পিসি ফিরে গিয়েছিল জামশেদপুরে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে আসেনি। মা-ও কখনও ওবাড়িতে যায় না। দার্জিলিং, পুরীতে যাওয়া যেতে পারে দুর্গাপুর জামশেদপুরে না। শুধু সে নয়, তার স্কুলের বন্ধুরাও পিসিদের চেনে না, মাসিদের চেনে। ভরতের দুর্ভাগ্য তার কোনও মাসি নেই। থাকলে না হয় আজ সেখানে যেতে পারত।

কোনও হস্টেলে অথবা মেসে গিয়ে উঠলে কেমন হয়? হোস্টেলে থাকলে ছুটির সময়। সমস্যা হবে। তখন সবাইকে বাড়িতে যেতে হয়, সে কোথায় যাবে? অতএব মেস-ই ভাল। মেসে থাকতে কত খরচ পড়ে তা সে জানে না। ওর সঙ্গে একটি মেদিনীপুরের ছেলে পড়ে যে হোস্টেলে জায়গা না পেয়ে মীর্জাপুরের মেসে উঠেছে। জায়গাটা সে চেনে। তার হাতে আপাতত নয়শো টাকা আসছে। পারমিতার বাবা দিলে বারো তেরোশ হবে। একটা মেসে নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি দিতে হবে না।

একটু হালকা হয়ে সে কলেজে চলে এল। থার্ড পিরিয়ড অফ ছিল। ভরত সেই ছেলেটাকে খুঁজে বের করল। ছেলেটা ভাল রেজাল্ট করলেও কথাবার্তায় গ্রাম্যতা কলকাতায় এসেও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। ভরতের প্রশ্ন শুনে বলল, অনেক টাকা লাগে।

কত?

হাজার টাকা খাওয়া আর দুশো টাকা সিট রেন্ট।

ভরত ঢোঁক গিলল। তার হাতে বড়জোর একশ টাকা অতিরিক্ত থাকবে। যাই থাক সে দুবেলা খাওয়া আর একটা শোওয়ার জায়গা তো পাবে। ভরত বলল, আজ তোমার সঙ্গে গেলে মেসের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে পারব?

কেন?

আমি তোমার মেসে থাকতে চাই।

ওখানে তো জায়গা নেই। সব সিট ফুল।

 যাচ্চলে!

তাছাড়া মেসের খাবার খুব খারাপ। খেতে পারবে না ভাল করে। তোমার তো এই শহরেই বাড়ি। বাড়ি ছেড়ে শখ করে কেউ মেসে গিয়ে থাকে? ছেলেটা বিজ্ঞের হাসি হাসল।

কেন থাকতে চাই সেটা আমি বুঝব। জ্ঞান দিচ্ছ কেন?

না না। আমি এমনি বললাম। আমাদের পাশের মেসে জায়গা খালি আছে।

আজ বিকেলে আমাকে নিয়ে যাবে।

বিকেলে? আমি যে তখন পড়ব।

পরে পড়ো। জোর গলায় বলতেই ছেলেটা মিইয়ে গেল। বিকেলে যখন ছেলেটির সঙ্গে বের হচ্ছে তখন সুদেষ্ণার সঙ্গে দেখা। সুদেষ্ণাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছেলেটি কুঁকড়ে একপাশে সরে গেল।

সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

ভাল নেই।

কেন, কী হয়েছে?

এক কথায় বলা যাবে না। আর অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

যেন একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সুদেষ্ণা, কাল তোমার কী হয়েছিল?

আই অ্যাম সরি। তোমাকে ওভাবে বিব্রত করার জন্যে ক্ষমা কর। আচ্ছা, চলি। সুদেষ্ণাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সে মেদিনীপুরের ছেলেটাকে সঙ্গে আসতে ইশারা করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *