৩. হরিণডুবি বনবাংলো

১১.

আরও ঘণ্টাখানেক পরের কথা।

হরিণডুবি বনবাংলোর বারান্দায় ঘনিষ্ট হয়ে বসে আছে প্রমিত আর দ্যুতি। রাত বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত। দ্যুতির গায়ে তাই একটা হালকা পশমের চাদর। প্রমিতও জিপের পেছনের সিট থেকে উইন্ডচিটারটা এনে গায়ে চাপিয়েছে।

প্রমিতের এখনও অবধি আলিপুরদুয়ারে ফেরার কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই গড়িমসির অছিলা অবশ্য একটা রয়েছে। রূপেন শইকিয়া এখনও তার জাঙ্গল ট্যুর সেরে ফেরেননি। তার সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা হবে না?

বারান্দায় বসে ওরা তাকিয়েছিল সামনের অন্ধকারের দিকে। দুটো নাইটজার পাখি মাঝে মাঝে বাগানের বেড়ার ওপর এসে বসছিল, আবার পরমুহূর্তেই কোনও পতঙ্গকে ধাওয়া করে উড়ে যাচ্ছিল। তাদের বড় বড় গোল গোল চোখ অন্ধকারে জুলজুল করে উঠছিল। দিনকানা এই পাখিগুলো যতক্ষণ আকাশে আলো থাকে ততক্ষণ জঙ্গলের রাস্তায় ঝরা পাতার রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে মাটিতে বুক চেপে শুয়ে থাকে। তাড়া দিলেও নড়তে চায় না। তখন দেখলে কে বলবে অন্ধকার নামলে এই পাখিগুলোই এমন তড়িৎগতির নিপুন শিকারি হয়ে উঠতে পারে! প্রমিত পাখিদুটোকে দেখতে দেখতে ভাবছিল, ওই দূরের পাহাড়ের ওপর এমনই কিছু রাতশিকারি মানুষ রয়েছে, অন্ধকারেই যারা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ওদেরও কি নাইটজারের মতন অন্ধকারে চোখ জ্বলে?

একটু আগেই প্রমিত আর দ্যুতি একে অন্যের কাছে নিজেদের ভালোবাসার কথা জানিয়েছে। চরিতার্থ হয়েছে ওদের প্রেম। তবু এমন সময়ে দুই যুবক যুবতীর মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আশা করা যায় ওদের মধ্যে তা দেখা যাচ্ছে না। করণটা সহজেই বোধগম্য। বড় দুঃসময়ে ওরা একে অন্যের কাছে এসেছে।

মন হাতড়ে লঘু কথা খুঁজতে গিয়ে হঠাই প্রমিতের মনে পড়ল আজ কিছুক্ষণ আগে জঙ্গলের রাস্তায় সোনারু মাঝির সেই প্রলাপ। সে নিজের মনেই হেসে উঠল।

কী হল, হাসছ যে? তার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিগ্যেস করল দ্যুতি।

প্রমিত হাসতে হাসতেই বলল, সোনারু মাঝি কী বলছিল জানো? বলছিল বিমল বাবুয়ারা জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল। সেইজন্যে টেররিস্টরা অন্ধকারের মধ্যে ওদের দেখতে পেয়েছিল।

দ্যুতি অল্প হাসল। কোনও জবাব দিল না।

তারপর যা বলল, শুনলে তো তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। বলল, ও না কি শিরোমণির গড়ের পেছনের রাস্তায় মাঝে-মাঝেই অমন আলোমাখা বেজি কিম্বা সাপ দেখতে পায়।

প্রমিতের এই কথাটা শুনে দ্যুতি কিন্তু হাসতে পারল না, বরং ভারি অস্বস্তি নিয়ে বলল, জানো, এই কথাটা শুনে আমার কি যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছে না। এরকমই একটা গল্প যেন কোথায় শুনেছিলাম! আলোর পাখির গল্প।

কোনও রূপকথার গল্পে বোধহয়। তোমার তো ওটাই কাজ রূপকথা খোঁজা। বাদ দাও না। মনে করেই বা কী হবে? আমার দুর্দশা নিয়েই এখন অনেক গল্প লেখা যায়। আমি আর নতুন গল্প কী শুনব?

দ্যুতি চুপ করে গেল। আজই প্রথম, প্রমিত তার গত কয়েকদিনের সমস্ত উদ্বেগের কথা তার কাছে উজাড় করে দিয়েছে। তিন সহকর্মীর রহস্যময় পরিস্থিতিতে মৃত্যুর কথা, শিরোমণির গড়ের দিকে বিনতা মেহরার এগিয়ে আসা থাবার কথা, এবং শেষ অবধি সেই লোকগুলোর কথা, যারা কদিন আগেও ব্যানার্জি সাহেবকে তার বড় দিল-এর জন্যে শ্রদ্ধা করত, অথচ গুলাবি নার্জিনারির মৃত্যুর পরে যারা পাথর মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।

পাথরটা প্রমিতের কপালে লাগেনি, লেগেছে বুকের ভেতরে। আর দ্যুতি নিজেও যন্ত্রণাটা নিজের বুকের মধ্যে অনুভব করছিল। তাই সে আর এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ পালটাবার জন্যে বলল, মিস্টার শইকিয়ার কী হল বল তো? রাত নটা বাজতে চলল, এখনও উনি ফিরলেন না।

প্রমিত চট করে একবার নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তো ভাবছি.. নাঃ, আর বোধহয় ভাবতে হবে না। ওই যে তিনি এসে গেছেন।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। গাড়িটা জিগজ্যাগ রাস্তার বাঁক নিতে-নিতে এগিয়ে আসছে। একটু বাদেই গাড়িটা বনবাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল। প্রমিত এবং দ্যুতি অবাক হয়ে দেখল সেটা মোটেই রূপেন শইকিয়ার বোলেরো নয়, হরিণডুবি বিট অফিসের উইলি জিপ। জিপ থেকে লাফিয়ে নামলেন বিট-অফিসার সজল দত্ত, তারপর জোরে পা চালিয়ে বাংলোর বারান্দায় এসে উঠলেন। বললেন, স্যার আলিপুরদুয়ার পুলিশ স্টেশন থেকে কাশ্যপ সাহেব আর টি সেটে কল করেছিলেন। কি যেন একটা জরুরি ব্যাপার জানানোর জন্যে আপনাকে একবার ডাকছেন।

কথাটা শুনে প্রমিত চোখের দৃষ্টিতে দ্যুতির কাছ থেকে বিদায় নিল। তারপর লাফ মেরে বারান্দা থেকে নেমে দৌড়ল নিজের জিপসির দিকে। সজল দত্ত বাংলোয় ঢোকার ঠিক তিন মিনিট বাদে প্রমিতের জিপসি দ্রুত কয়েকটা বাঁক নিয়ে বনের পথে মিলিয়ে গেল, এবং পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় সেই জিপসিকে দেখা গেল আলিপুরদুয়ার পুলিশ স্টেশনের দরজায়।

থানার উঠোনটা পেরোনোর সময়েই প্রমিত দেখল একটা বড় দশ চাকার ট্রেলার সেখানে পুলিশ পাহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। গড়িটায় প্রায় খান আষ্টেক বিশাল গাছের গুঁড়ি, যাকে বলে লিগ, লোড করা আছে। অভ্যস্ত চোখে প্রমিত এটাও দেখে নিল যে, প্রত্যেকটা লগের গায়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হ্যাঁমারিং-এর ছাপ রয়েছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে বন থেকে যত লগ বেরোয় সবার গায়ে লোহার ধারালো ছাঁচ দিয়ে মার্কা আর নম্বর খোদাই করে দেওয়া হয়, যাতে পরিবহনের সময় মিলিয়ে দেখে নেওয়া যায় যে, বিল কিম্বা চালানে যে কাঠের কথা লেখা আছে সেই কাঠই গাড়িতে যাচ্ছে কিনা। একেই বলে হ্যামার-মার্কিং।

হ্যামারিং-এর মার্ক দেখে প্রমিত তাই একটু অবাক হল। মার্কাগুলো অরুণাচলের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। কিন্তু যাই হোক, চোরাই কাঠ তো নয়। তাহলে দেবেশ কাশ্যপ গাড়িটাকে আটকালেন কেন?

কাশ্যপ সাহেবের ঘরে ঢুকে প্রমিত দেখল দুটো লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা ওই ট্রেলারের ড্রাইভার আর খালাশি। দেবেশ কাশ্যপ, ওসি রতন বৈদ্য আর অন্য দুজন পুলিশ অফিসার মন দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা অনেকগুলো ছোট ছোট প্লাস্টিকের পাউচ নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন। প্রমিত ঘরে ঢুকতে দেবেশ কাশ্যপ বাকি তিনজন পুলিশ অফিসারকে চোখের ইশারায় বাইরে যেতে বললেন। তারা যাবার সময় ওই ড্রাইভার আর খালাশিকেও তুলে নিয়ে গেল সম্ভবত লক্-আপের দিকেই।

ওরা বেরিয়ে যাবার পরে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, ব্যানার্জি সাহেব, একটা গাড়ি সীজ করেছি দেখেছেন বোধহয়।

হ্যাঁ, দেখলাম। কিন্তু কেন করেছেন বুঝলাম না। চোরাই কাঠ নয় বলেই তো মনে হচ্ছে। না কি ফেক হ্যামার মার্ক ইউজ করেছে?

না, মার্কাগুলো জেনুইন। অরুণাচল থেকে আসছে, শিলিগুড়ি যাবে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ইস্যু করা বিল, চালান আছে। আমরা বক্সিরহাট চেকপোস্ট থেকে চেজ করতে শুরু করেছিলাম। তুফানগঞ্জে পৌঁছে ধরেছি।

প্রমিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, জেনুইন কাগজপত্র, জেনুইন কনসাইনমেন্ট–তাহলে। ধরলেন কেন?

মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কাঠ ধরিনি তো। কাঠের মধ্যে লুকিয়ে যা নিয়ে আসছিল সেইগুলো ধরেছি। এই দেখুন, এইগুলো। তিনি আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা প্যাকেটগুলোর দিকে নির্দেশ করলেন।

প্রমিত টেবিলের কাছে গিয়ে প্যাকেটগুলো দেখল। প্রত্যেকটা প্লাস্টিকের পাউচের মধ্যে সাদা সাদা একরকমের গুঁড়ো ঠেসে প্যাক করা রয়েছে। এরকম প্রায় একশো-দেড়শো প্যাকেট ছড়িয়ে আছে টেবিলের ওপর।

দেবেশ কাশ্যপ পাশ থেকে বললেন, আন্দাজ করতে পারছেন, এগুলো কী? হেরোইন। পুরোনো গাছের গুঁড়ির মাঝখান বরাবর যে ফাঁপা গর্তটা থাকে, তার মধ্যে প্যাক করে নিয়ে আসছিল। আমাদের কাছে ইনফর্মেশন ছিল, তাই ধরতে পারলাম। না হলে কার বাবার ক্ষমতা আছে ধরে?

প্রমিত এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, তার মুখ থেকে কথা সরছিল না। সে বলল, অরুণাচলে হেরোইন তৈরি হয়?

না, না, অরুণাচলে হয় না। মায়ানমার থেকে অরুণাচলে স্মাগল করা হয়। মায়ানমারে আবার পৌঁছয় চায়না থেকে। ওইসব বর্ডারগুলোয় পাহারা দেওয়া খুব কঠিন জানেন তো? ভয়ানক গভীর জঙ্গল। স্থানীয় গরিবস্য গরিব মানুষজনকে ট্রান্সপোর্টের কজে লাগানো হয়। তারা বাঘের মুখের সামনে দিয়ে, সাপের ছোবল এড়িয়ে পায়ে হেঁটে এই বর্ডার থেকে ওই বডারে মাল আনা নেওয়া করে। তারপর একবার কোনওরকমে সেই মাল শিলিগুড়ির মার্কেটে পৌঁছে গেলে ছোট ছোট ভাগে পেডলারদের কাছে ছড়িয়ে যায়। তখন এ বস্তুকে ধরা অসম্ভব।

একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে প্রমিত বলল, এগুলোর দাম কেমন হবে?

এই টেবিলে এককোটি টাকার বেশি দামের হেরোইন আছে। এ বছরে এটাই বিগেস্ট হল। নারকোটিক ডিপার্টমেন্টের লোকদেরও খবর পাঠিয়েছি। এসে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যে।

প্রমিত তার ডান হাতটা দেবেশ কাশ্যপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশনস্। সত্যি আপনার মতন অফিসাররা…

আপনাকে কেন ডেকেছি জিগ্যেস করলেন না? প্রমিতের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে জিগ্যেস করলেন কাশ্যপ সাহেব।

কোনও বিশেষ কারণ আছে না কি? অবাক হয়ে বলল প্রমিত। আমি তো ভাবলাম কাঠ টাঠের ব্যাপার, তাই।

আরে ধুর মশাই। এই সামান্য কারণে আপনাকে আর টি সেটে যোগাযোগ করব? শুনুন, আমাদের আজকে আরও বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট আছে।

ওরে বাবা! এক কোটি টাকার হেরোইন উদ্ধারের থেকেও বড় অ্যাচিভমেন্ট!

ইয়েস স্যার! সেটা বলার আগে আপনাকে ড্রাগচক্রের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিই। না হলে অ্যাচিভমেন্ট বলছি কেন বুঝতে পারবেন না।

দেখুন, ড্রাগ ট্রাগ মাঝে মাঝেই এদিকে ওদিকে ধরা পড়ে। খবরের কাগজে সেসব বিবরণ পড়েন নিশ্চয়। কিন্তু যাদের ধরতে পারা যায় না, তারা হল এই ব্যাবসার মালিক। কেন ধরা যায় না জানেন? যে সিস্টেমে বাবসাটা চলে, তার জন্যে। সেটা একটা ইউনিক সিস্টেম। নামটা শুনে থাকবেন–ড্রাগ কার্টেল। ড্রাগ চক্র।

চক্র না বলে বৃত্ত বললেই আরও অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হয় অবশ্য। একটা নয়, সমকেন্দ্রিক অনেকগুলো বৃত্ত–যেরকম বৃত্ত তৈরি হয় পুকুরে একটা ঢিল ফেললে।

এই পুরো কার্টেলের একদম বাইরের পরিধিতে কাজ করে ড্রাগ-পেডলাররা। তারা হল। সোজা বাংলায় ফেরিওয়ালা। অন্ধকার গলির মুখে, বেশ্যাপল্লীর বারান্দায়, স্টেশন প্লাটফর্মের দূরতম প্রান্তে এরা ছেঁড়া নোংরা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকে। পকেটে থাকে চরস কিম্বা হেরোইনের পুরিয়া। নেশাড়ুরা জানে ঠিক কোনখানে কখন কোন পেডলারকে পাওয়া যাবে। তারা নেশার খোঁজে ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছিয়ে যায়।

এক-একটা এরিয়ার পেডলারদের কন্ট্রোল করে দুজন বা তিন জন এজেন্ট। এরা পেডলারদের হাতে মাল পৌঁছিয়ে দেয়, আবার তাদের কাছ থেকে বিক্রির টাকাও উশুল করে। পেডলারদের এলাকা দখলের লড়াইয়ে অস্ত্র সরবরাহ করে। কাউকে পুলিশে ধরলে তার ফ্যামিলিকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচায়। এইসব কাজের জন্যে এজেন্টরা কমিশন পায়।

এর পরে বৃত্তে থাকে ম্যানেজার। বেশ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মতন শোনাচ্ছে না ব্যাপারটা? সত্যিই ড্রাগের জগৎটা কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মতন প্রফেশনালিই চালানো হয়। যাই হোক, ম্যানেজারই বিদেশ থেকে নেশার জিনিস আমদানি করে, তার জন্যে যে বিপুল পরিমাণ টাকা লাগে তার ব্যবস্থা করে এবং অস্ত্র আমদানিও করে। ম্যানেজারের অনেকসময়েই অন্য জীবিকাও থাকে–কোনো সম্মানজনক জীবিকা–যার আড়ালে থেকে সে এই কাজগুলো চালায়।

এই থানার ঘরে বসেই একটা সত্যি কথা আপনাকে বলছি– পুলিশ এবং পলিটিকাল লিডারদের হাতে না রেখে একটা কার্টেলও তৈরি হতে পারে না। এ ব্যাপারেও সিসিলি এবং শিলিগুড়িতে তফাত নেই। সেই নেতা এবং অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বটাও ম্যানেজারের।

আর সমস্ত বৃত্তের কেন্দ্রে একটা ধূর্ত মাকড়শার মতন বসে থাকে মালিক কিম্বা কিং পিন। তার অস্তিত্ব জানে শুধু ম্যানেজাররা, আর কেউ নয়। হতে পারে সেই কিং-পিন নিজে একজন বিখ্যাত সমাজসেবী, রাজনৈতিক নেতা কিম্বা পুলিশ অফিসার। মুখোশের আড়ালে তার মুখটা সাধারণ লোক কোনও দিন খুঁজেই পাবে না। খুঁজে পেলেও বিশ্বাস করতে চাইবে না। কেউ।

বুঝলেন ব্যানার্জিসাহেব, আমরা যখন ড্রাগ ধরি, তখন আমাদের হাতে ধরা পড়ে এইসব ছুটকো ছাটকা পেডলাররা, কিম্বা বড়জোর কোনও এজেন্ট। আজকে যেমন ওই লোক দুটো…ওই ড্রাইভার আর খালাশি ফেঁসেছে। ওদের কাছ থেকে কার্টেল সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারব না, কারণ ওরা নিজেরাই একেবারে বাইরের পরিধির লোক। কেন্দ্রের ধারে কাছেও কোনওদিন যায়নি। তাই ওরা আর আমাদের কী ইনফরমেশন দেবে?

তবু আমরা জেনেছি, আর সেটাকেই বলছি বড় অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু…

কিন্তু কী, মিস্টার কাশ্যপ?

আজ আমরা এরকমই একজন কিং-পিনের খোঁজ পেয়েছিলাম। কিন্তু সে বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল। দুপুর থেকে তার সবকটা ডেন-এ ছাপ্পা মেরেছি। পাখি ভাগলবা।

তবে সে আর লুকনো গর্তের বাইরে আসবে না, আপনার সঙ্গে আর কলার তুলে কথা বলবে না, লোক খ্যাপাবে না শিরোমণির গড় হাত করার জন্যে। নামটা কি আর বলবার দরকার আছে?

কঠিন হয়ে উঠল প্রমিতের মুখ। সে রুদ্ধ স্বরে বলল, মধু বর্মন?

 ইয়েস। এই নামটা শোনানোর জন্যেই আপনাকে ডেকেছিলাম।

এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রমিত বলল–মধু বর্মন সম্বন্ধে টিপ-অফটা কে দিল কাশ্যপ সাহেব?

বলতে পারব না। অ্যানোনিমাস কল ছিল, পাবলিক বুথ থেকে। তবে একদম ইনসাইডার–সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ট্রেলারের নম্বর, কখন কোথা দিয়ে ঢুকবে, কোথায় মাল লুকোনো আছে সব বলে দিয়েছিল। মধুর নামটাও সেই ইনফর্মারই বলেছিল। কথাগুলো যে মিথ্যা বলেনি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। মধুর ডেনগুলোর ঠিকানাও ঠিকঠাক দিয়েছে।

শুধু মধু সটকে গেল।

.

১২.

কটা বাজল?–পুরুষ কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল।

পাশ থেকে নারীটি রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ি দেখে উত্তর দিল নটা। তারপর যোগ করল–আমার খুব ভয় করছে।

–ভয় করছে? কিসের ভয়?

–কিসের আবার? ওয়াইল্ড অ্যানিমাল-এর। হাতি..বাঘ…।

নিশ্চিন্ত থাকো। তুমি যাদের নাম করলে, তারা নির্দিষ্ট রুটে ঘোরাফেরা করে। এই জায়গাটা সেই রুটের অনেক বাইরে।

তা ছাড়া আরও একটা ভয় রয়েছে। সেটাও তুমি ভালো করেই জানো।

– পাহাড়ের ওপাশ থেকে ছুটে আসা বুলেট?–গোপনীয়তার কথা ভেবেই নিশ্চয় চাপা স্বরে হাসল পুরুষটি। না হলে হা হা করেই হেসে উঠত। হাসি থামিয়ে বলল, এই অন্ধকারে?

–এইরকম অন্ধকারেই তো ওই লোকগুলো মরেছিল, ওই যে কী যেন নাম…?

–বিমল, বাবুয়া, সন্দীপ। বাদ দাও ওদের কথা। নিশ্চয় টর্চ জ্বেলে হাঁটছিল, কিম্বা..বিড়ি টিড়ি খাচ্ছিল। তোমার যদি অতই ভয় করছে, তা হলে এসো, বসে পড় এই ঘাসের ওপর।

–সেই ভালো। কিন্তু সাপ টাপ নেই তো?

–এই শীতে সাপ? তুমি কি বিলেত থেকে এলে? বসো বসো।

শাড়ির খসখস আওয়াজ শুনে বোঝা গেল নারীটি আজ্ঞা পালন করল।

–বেশ। এবার চট করে বলে ফেল, কী জন্যে ডেকেচ্ছ। আমার হাতে সময় বেশি নেই।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নারীটি বলল–যেটা জানতে চাইছি, সেটা হল, মধু বর্মনকে বলি চড়ালে কেন?

মধু ক্রমশ আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বিপজ্জনক পথে পা ফেলছিল। পয়সা আমিও চাই, কিন্তু অতটা রিস্ক নিতে চাই না। আমাকে এখনও অনেকদিন ধরে পয়সা রোজগার করে যেতে হবে। কেন, তা তুমি জানো। তাই আমার ছদ্মবেশ প্রয়োজন। মধু আর দুয়েকদিন বেঁচে থাকলে আমি এক্সপোজড হয়ে যেতাম। সেটা আমি গুলাবি খুন হওয়ার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর তা ছাড়া…

তা ছাড়া কী সেটা আমি জানি। মধু তোমার রাইভ্যাল হয়ে উঠছিল। ড্রাগ বিক্রির পয়সায় ও অল্পদিনেই প্রচুর ক্যাপিটাল জমিয়ে ফেলেছিল। সেই ক্যাপিটাল দিয়ে ও তোমার সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। চাকর থেকে মালিক হয়ে উঠছিল, ঠিক কি না?

আবারও চাপা স্বরে হাসল পুরুষটি। বলল–তুমি আমার সম্বন্ধে যতটা জানো, আমার স্ত্রীও অতটা জানে না।

নারীটিও হাসল। হেসে বললজগতের নিয়মই তাই। প্রেমিকা স্ত্রীয়ের থেকে এক পা এগিয়েই থাকে। তারপর একটু দ্বিধান্বিত সুরে বলল, তোমার চোরাশিকারের ব্যবসা এখন ফুলে ফেঁপে উঠবে, কারণ বনে কোনও পাহারা নেই। বাড়বে কাঠ চুরির ব্যবসাও…

বারবার চুরি, চোরা এই সব শব্দ গুলো ব্যবাহার কোরো না। শুনতে ভালো লাগে না।

–স্যরি। কিন্তু আমার কী হবে?

–মানে?

–মধু বর্মনকে তো সরিয়ে দিলে। এবার প্রমিত ব্যানার্জির ওপর চাপটা রাখবে কে? মধু এই ব্যপারটায় এত ভালো কাজ করছিল..খুব ক্ষতি হয়ে গেল আমার।

–যে তোমাকে তোমার নিজের হোটেলের ঘরে রেপ করতে গিয়েছিল, তার জন্যেও এত দরদ!

–ওটা এমন কিছু গর্হিত অপরাধ নয়। একলা ঘরে আমাকে দেখলে অনেকেই মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ওসবের সঙ্গে ব্যবসার সম্পর্ক নেই। তা না হলে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলাম কেন? ইন ফ্যাক্ট তোমাকে একটা কথা বলি–মধু যদি আমার হাতে শিরোমণির গড় তুলে দিতে পারত তাহলে আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম, ও সেদিন যা চেয়েছিল তা ওকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমিই তার উপায় রাখলে না। এখন বলো, আমার কী ব্যবস্থা করবে? এ কি, এ কি? এসব কি অসভ্যতা শুরু করলে?

উমমমম!

–আগে কাজের কথাটা শেষ করো। ব্যানার্জি সাহেবের ওপর তোমার যা ইনফ্লুয়েন্স তাতে তুমি যদি একবার বলো শিরোমণির গড়টা আমাকে দিয়ে দিতে, উনি মেনে যাবেন। কিন্তু তুমি কি সেটা বলবে?

সত্যিই আমার পক্ষে এরকম কিছু বলা মুশকিল। তা হলেই তো প্রশ্ন উঠবে, আমার কি ইন্টারেস্ট? আমার একটা প্রকৃতিপ্রেমিক ইমেজ রয়েছে, সেটা ভুলো না। এরকম প্রোপোজাল আমার মুখ থেকে বেরোনোটা সে ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়?

–তুমি তাহলে তোমার ইমেজ নিয়েই থাকো। নিজের ব্যবসা বাড়িয়ে যাও। শুধু মনে রেখ, এটা বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলে বলেই আমি এই প্রোজেক্টটার কথা ভেবেছিলাম। সরো, আমি উঠি।

প্লিজ, কতদিন পাইনি তোমাকে। আমি কথা দিচ্ছি, ব্যানার্জি সাহেবকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করব। যদি তা নাও পারি, অন্তত জঙ্গলের ল অ্যান্ড অর্ডারের বারোটা বাজানোর কাজটা তো চালিয়ে যেতে পারব। এখন একবার, একবার…

.

নিকষ অন্ধকারের মধ্যেও নারীশরীরের নগ্নতার আভা রজনীগন্ধার পাপড়ির মতন ফুটে উঠল। ঘাসজমির ওপর মিথুনরত সেই যুগলকে দেখে চিতল হরিণেরা অন্য বিচরণক্ষেত্রের দিকে পাড়ি জমালো। রাতের জঙ্গলের ফিসফাসের সঙ্গে মিশে গেল পুরুষটির ঘন শ্বাস আর রমণতৃপ্ত নারীটির শীৎকার।

একটু পরে আলিঙ্গন খুলে নারীটি বলল, সরো, উঠি। গাড়ি রয়েছে সেই রিভারবেডে। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছি।

পুরুষটি দ্বিরুক্তি না করে তার শরীরের ওপর থেকে দ্রুত গড়িয়ে সরে গেল। সরে গেল প্রয়োজনের চেয়েও অনেকটা বেশি, জঙ্গলের ভেতরেই যেন আবার।

সেইদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নারীটি প্রথমে উঠে বসল। তারপর খুলে রাখা শাড়ি সজ্জা একহাতে জড়ো করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জঙ্গলের দিকে তার মুখ, পিঠের দিকে ভুটান পাহাড়।

তারপরেই সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটির ওপরে। মৃত্যু আক্ষেপে থরথর করে কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল শরীরটা, যা তখনো নগ্ন।

ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে ফায়ারিং-এর শব্দটা এপাড়ে এসে পৌঁছল বুলেটের একটু পরে। মুচকি হেসে পুরুষটি বনের পথ ধরে হাঁটা লাগল হরিণডুবি বাংলোর দিকে।

.

১৩.

আজ আর ছাগলেরা নয়, সোনারু মাঝিই প্রথম দেখতে পেল বিনতা মেহরার মৃতদেহটাকে, কারণ আগের মৃতদেহগুলোর পরণে ছিল ঘাস মাটির সঙ্গে রং মেলানো ইউনিফর্ম, যা তার বুড়ো চোখে ধরা দেয়নি। কিন্তু আজ মেয়েটার শরীরে কিছুই ছিল না। সবুজ ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়া অনেকখানি কালো চুল, সাদা চামড়া আর এক দলা লাল রং–টকটকে লাল। না, সোনারুমাঝির একটুও অসুবিধে হয়নি দেখতে।

এবারেও বিট-অফিসার সজল দত্তই মৃতদেহটাকে আইডেন্টিফাই করলেন। কারণ তিনি এর আগে আলিপুরদুয়ারে তিন-চারবার এবং শিরোমণির গড়ে একবার বিনতা মেহরাকে দেখেছেন।

এর কিছুক্ষণ পরেই একজন গ্রামবাসী বিনতা মেহরার গাড়িটাকে নদীর চরে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখে। দেবেশ কাশ্যপ এবং অন্যান্য দুয়েকজন পুলিশ অফিসার যারা তদন্তে এসেছিলেন তারা গ্রামবাসীদের প্রশ্ন করে জানতে পারেন, ওরা কাল রাত আটটা নাগাদ ওই গাড়িটার শব্দ পেয়েছিল। অন্ধকার আকাশে ছিটকে ওঠা হেডলাইটের আলোও কেউ কেউ ঘরের দাওয়ায় বসে দেখেছিল। তবে ওরা স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল ফরেস্টের জিপ নিয়ে কেউ কাজে বেরিয়েছে। তা ছাড়া আর কী-ই বা ভাববে?

বডি পোস্টমর্টেমের জন্যে জলপাইগুড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে দেবেশ কাশ্যপ যখন আলিপুরদুয়ারে ফিরলেন, তখন দুপুর হয়ে গেছে। তবে আগে তাকে অফিসের বাইরে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের সামলাতে হল।

এবারের কাজটা তার পক্ষে কঠিন হল না। তিনি শুধু একটা ইঙ্গিত দিলেন যে ভদ্রমহিলা মৃত্যুর ঠিক আগে শারীরিকভাবে কারুর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।

তার মানে? ফোঁস করে উঠল সাংবাদিকেরা। রেপ নয়, লাভ-মেকিং?

ঠিক তাই। মিসেস মেহরার শরীরে বলপ্রয়োগের কোনও চিহ্ন পাইনি, কিন্তু ওই পরেরটার চিহ্ন ছিল।

এর পরে দেবেশ কাশ্যপ স্তম্ভিত সাংবাদিকদের দিকে চেয়ে একটা নাতিদীর্ঘ আবেগঘন বক্তৃতা দিলেন, যার মূল কথা–বিনতা মেহরা ছিলেন আপনাদের সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত। ইন ফ্যাক্ট তার আত্মীয়েরা এখনও একটা সংবাদপত্র চালাচ্ছেন। কাজেই আমার অনুরোধ, এই মুহূর্তে এমন কিছু লিখবেন না, যাতে সেই পরিবারটির সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায়। তদন্ত শেষ হতে দিন, তারপরে আমিই আপনাদের ডেকে সব কথা জানাব।

সাংবাদিকরা পত্রপাঠ তাদের টেপরেকর্ডার এবং নোটবুক ব্যাগে পুরে ফেলে প্রস্থান করলেন।

পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পরদিনই পাওয়া গেল। অবজার্ভেশনের ওপর নির্ভর করে দেবেশ কাশ্যপ যা বলেছিলেন তার সবই মিলে গেল। বিনতার শরীরের ভেতর স্পার্ম পাওয়া গেছে, অত্যাচারের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সঙ্গমের পরেই তার পিঠে বুলেট এসে বেঁধে।

রিগর মর্টিসের ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু হয়েছিল দেহটা আবিষ্কারের কয়েকঘণ্টা আগে, তার মানে গভীর রাত্রিতে।

ফরেনসিকের রিপোর্ট আগেরটারই হুবহু কপি বুলেটটা এসেছিল অন্তত আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে, কৌণিকভাবে নীচু হয়ে–সোজা কথায় আগেও যেখান থেকে এসেছিল। নদীর ওপারের পাহাড় থেকে।

ঘাসের ওপর কোনও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি। নগ্ন শরীরে কোনও আঙুলের ছাপ পাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশ কুকুর এসেছিল। কিন্তু জঙ্গলের হাজার হাজার ফুল পাতা জন্তু জানোয়ার পাখির গন্ধের মধ্যে সে বেচারা বিনতার সঙ্গীর ঘ্রান হারিয়ে ফেলে এবং রণে ভঙ্গ দেয়।

প্রমিত দেবেশ কাশ্যপের অফিসে এসে পৌঁছল সন্ধেবেলা। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, তার চুলে বহুক্ষণ চিরুনি পড়েনি, শার্টের পেছনদিকটা ট্রাউজারের কোমর থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। এমনকী দেবেশ কাশ্যপ যখন তার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন তখন সে সেটাকে উলটোদিক করে ধরিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল।

দেবেশ কাশ্যপ তার অবস্থা দেখে বেশ জোর গলাতেই হেঁকে উঠলেনকাম অন ম্যান! এত ভেঙে পড়ছেন কেন?

ভেঙে পড়ব না? কী বলছেন আপনি? আমার চাকরির জায়গাটাতো বধ্যভূমি হয়ে গেল–কিলিং-ফিল্ড! পাঁচটা মার্ডার হল গত এক মাসে!

 তো? মার্ডারগুলো আপনি করেছেন না কি? নিজেকে এত রেসপন্সিবল করবেন না তো।

প্রমিত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, কিন্তু কাশ্যপ সাহেব, একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছেন? যে দুজন মানুষকে আমরা টেররিস্টদের ডানহাত বাঁহাত ভেবেছিলাম। তারা দুজনেই শেষ হয়ে গেল। তার মধ্যে বিনতা মেহরা তো সরাসরি টেররিস্টদের গুলিতেই খুন হলেন। আর মধু বর্মন না পাত্তা।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কে সেই ইনসাইডার? বিমল বাবুয়াদের ফাঁদে ফেলার জন্যে কে সেদিন নদীর চরে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করেছিল? কে আপনাকে খবর দিয়েছিল ড্রাগ পাচারের? কে ছিল বিনতার গোপন প্রেমিক, যে বিনতাকে দূরের বন্দুকবাজদের নিশানা বানিয়ে দিল?

আর সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, যার সমাধান করতে পারলে আমার মনে হয়ে অন্য সবকটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব, সেটা হল, কেমনভাবে অন্ধকারেই সহজ হচ্ছে মানুষ মারার কাজ?

দেবেশ কাশ্যপের কাছে, বোঝাই যাচ্ছে, এর কোনওটারই উত্তর ছিল না। তিনি বললেন, বিনতার আত্মীয়েরা বোধহয় পলিটিক্যাল প্রেশার ক্রিয়েট করছে। শুনছি অপারেশন অল-ক্লিয়ারের ঢঙে ভারত ভুটান যৌথবাহিনী মিলে জয়ন্তীর ওপারের পাহাড়গুলোয় কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করবে।

প্রমিত বলল, তাতেও কিন্তু আমাদের ঘরের কাছের বিশ্বাসঘাতকটির গায়ে হাত পড়বে না। আর সে যতদিন থাকবে ততদিন এই টাইগার-রিজার্ভের পশুপাখি, গাছপালা এবং মানুষ কেউই নিরাপদ নয়। তাকে ধরার কাজটা আপনাকে আমাকেই করতে হবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমিত বলল, গত কয়েকদিনে ফ্রিঞ্জ এরিয়া একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আমি ভাবছিলাম আর দুয়েকদিন দেখে গ্রামবাসীদের জঙ্গলে যাতায়াতের পারমিশন দেব। বুঝতেই পারছেন, পাতা কুড়োনোর কিম্বা জড়িবুটি সংগ্রহের কাজ বন্ধ থাকলে ওদের পেট চলে না। ভাবছিলাম নাইট-পেট্রোলিংটাও আবার চালু করে দেব। ফরেস্ট গার্ডদের বুঝিয়েছিলাম, আমি নিজেও তাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, যে বিমল বাবুয়াদের মৃত্যু একটা স্ট্রে ইনসিডেন্ট, হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। বারবার ওরকম ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বিনতা মেহরার একইভাবে খুন হওয়াটা আমার সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল।

আমি অনির্দিষ্টকালের জন্যে নাইট-পেট্রলিং বন্ধ করে দিয়েছি।

আর জানেন, গত পনেরোদিনের মধ্যে পোচাররা একটা দাঁতাল হাতি আর তিনটে চিতাকে মেরেছে? প্রমিতের গলা ভারী হয়ে এল। সে আস্তে আস্তে দেবেশ কাশ্যপের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিল।

.

১৪.

গল্প এখানে হাওয়ায় ওড়ে, গল্প এখানে মাটির নীচ থেকে ব্যাঙের ছাতার মতন মাথা ফুড়ে ওঠে।

দ্যুতি মিনাজুড়ি গ্রামের একটা ভাঙাচোরা মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প শুনছিল। গল্প বলছিল এক খুনখুনে বুড়ি। তার বয়েস কত হবে তা সে নিজেও ঠিক বলতে পারছিল না, তবে এটা বলতে পারল যে কুচবিহারের রাজকন্যা মহারানী গায়ত্রীদেবীর বিয়ের বছরেই তারও বিয়ে হয়েছিল। নতুন বরের হাত ধরে এই জঙ্গল ভেঙে পায়ে হেঁটে সে কুচবিহার গিয়েছিল রাজকীয় বিয়ে দেখতে।

সে তো একাত্তর বছর আগের ঘটনা। বুড়ির বয়েস তাহলে আশির অনেকটাই ওপরে।

দ্যুতিকে কী গল্প শোনাচ্ছিল বুড়ি? শোনাচ্ছিল সেই একই গল্প যা একটু ওলোটপালট হয়ে এখানকার সব আদিবাসীদের মুখে মুখেই ফেরে–সেই অতীত গৌরবের গাথা, রাজা শিরোমণির অতিবিস্তৃত রাজ্যপাটের কথা।

সেল-ফোনের এমনিতে কোনও উপযোগিতা নেই এখানে, তবু দ্যুতি সেই যন্ত্রটাকে এনেছিল টেপ-রেকর্ডার হিসেবে কাজে লাগাবে বলে। কিন্তু ব্যাটারি চার্জ করার সুযোগ না থাকায় সেই কাজেও ভেবে চিন্তেই লাগাতে হয়। এই মুহূর্তেই যেমন, দ্যুতি মোবাইল অফ রেখে তার নোটবুকে বুড়ির কথার নোট নিচ্ছিল।

ঘরের আধো অন্ধকার দাওয়ায় বসে বুড়ি গল্প বলছে, আর বাইরে হেমন্তের দুপুরে নদীর চরে একজোড়া টিটিভ পাখি তীব্র স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা ব্যাপার দ্যুতি এই কদিনে বুঝে ফেলেছে, এখানকার সবকটা গ্রামই তৈরি হয়েছে একদিকে জঙ্গল আর অন্যদিকে জয়ন্তীনদীকে রেখে। বেঁচে থাকার জন্যে গ্রামবাসীদের ওই দুটিকেই প্রয়োজন।

বুড়ি একঘেয়ে সুরে বলে যাচ্ছিল রাজা শিরোমণির সঙ্গে অহম রাজার যুদ্ধের কথা, ভূটানের ভোট রাজার যুদ্ধের কথা। সেই কথকতায় সাল তারিখের বালাই নেই, সে সব দ্যুতিকে ফিরে গিয়ে ইতিহাস বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বার করতে হবে। তবে সব যুদ্ধেই রাজা শিরোমণি নিজের বীরত্বে আর দৈব অনুগ্রহে জিতেছিলেন।

রাজার পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন যেসব দেবতা অপদেবতারা তারাও দ্যুতির প্রায় অচেনা। যেমন বুড়ি বলে মাশানবাবার কথা। তার বর্ণনা থেকে দ্যুতি বোঝে সেই দেবতার সঙ্গে শিবঠাকুরের অনেক মিল–তেমনই জটাজুট, ভুড়ি, বাঘছালের কৌপিন। বাড়তির মধ্যে ওনার ডান হাঁটুর নীচে চেপে ধরা থাকে একটা বড় মাছ। তার মানে? শুনতে শুনতেই দ্যুতির মাথার মধ্যে নৃতাত্বিক প্রশ্ন পাক খায়। মাশানবাবা কি তবে তিস্তা তোর্সার ধীবরদের দেবতা?

যাই হোক, তারপরে রাজা শিরোমণির এক পত্নীর অনাচারের কারণে দেবতা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আদিবাসীদের এত বড় রাজ্যপাট ছারখারে গেল।

তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়। শেষ কথা হচ্ছে, রাজা শিরোমণি তার অভিশাপের মেয়াদ শেষ হলে আবার ফিরে আসবেন।

কোথায় ফিরবেন, তা তো দ্যুতি এতদিনে জেনেই ফেলেছে–ওই শিরোমণির গড়ে, যেখানে চালতা গাছে চালতা পাকলে বুনো হাতিদের মহোৎসব শুরু হয়। সাঁই সাঁই শব্দে বনভূমি সচকিত করে এক ডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে যায় গ্রেট হর্ণবিল। সেই শিরোমণির গড়েই না কি ফিরে আসবেন রাজা শিরোমণি। তাঁর সঙ্গে ফিরে আসবে পাইক বরকন্দাজ কামান মশাল; আলো হাসি গান; আদিবাসীদের সুসময়।

গল্পের এই জায়গাটায় পৌঁছে দ্যুতি একটু হেসে ফেলেছিল। বুড়ির সেটা চোখ এড়ায়নি। সে প্রশ্ন করল হাসছ কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

দ্যুতি এই সব গল্পের পেছনে ক্রিয়াশীল মনটাকে বুঝবার জন্যেই এখানে এসেছে। তাই বলল, না, বিশ্বাস হচ্ছে না তো। অতদিন আগে মরে যাওয়া মানুষজন ফেরে কখনও? তোমার বরও তো মরে গেছে। সে কি ফিরবে?

শোনো বেটি! রাজ্য শিরোমণির কথা আলাদা। হাত মুখ নেড়ে বলল বুড়ি। আমি নিজে দেখেছি…

কী দেখেছ?

দেখেছি রাজা শিরোমণি স্বর্গ থেকে এসে তার দুর্গবাড়িটি ঠিকঠাক আছে কি না দেখে যাচ্ছেন।

দ্যুতি আবার হেসে বলল। কীরকম দেখলে রাজা মশাইকে? গায়ে সোনার জামা? মাথায় হিরের মুকুট?

না না। সেসব এখন আসবে কোত্থেকে? তিনি এখনও শরীর ফিরে পাননি তো। অভিশাপ কাটেনি কি না।

তাহলে?

দেখলাম তার চলার পথে পায়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে–আলোয় আলোয়।

দ্যুতির শরীরটা এই কথায় মুহূর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে গেল। সে গলা নামিয়ে বলল, কী দেখলে? আলোয় আলোয় পায়ের ছাপ? কখন দেখলে? কোথায়?

কি বলব, যারেই বলি কেউই বিশ্বাস তো করে না। এই তো গতবছর শ্রাবণ মাসের ঘটনা। গিয়েছিলাম শিরোমণির গড়ে বলি চরাতে, নাতি হয়েছিল তো তাই। আমাদের এই গ্রাম থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটুখানি তো পথ, তাই দেরি করেই বেরিয়েছিলাম। তারপর ফেরার সময় কি বৃষ্টিটাই যে নামল, ভাবলাম একটু অপেক্ষাই করে যাই, বৃষ্টিটা একটু ধরুক। এই করতে করতে অন্ধকার নেমে এল। তখন দেখলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। বেরিয়ে পড়লাম।

গড়ের পেছনদিকটায় একটা খুঁড়িপথ আছে, একেবারে নদীর বুকে গিয়ে মিশেছে। ওই রাস্তাটায় গেলে পথ অনেকটা কম হয়। সমস্যা একটাই, পুরনো দিনের পাথর বাঁধানো রাস্তা তো, বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর পেছল আর এবড়ো খেবড়ো হয়ে রয়েছে। তা, যাই হোক, রাজা শিরোমণির নাম নিয়ে ওই রাস্তাতেই পা ফেললাম, আর তার একটু পরেই দেখলাম…। বুড়ি কথা থামিয়ে শিউরে উঠল।

কী দেখলে?

দেখলাম অনেকটা দূরে ওই রাস্তাতেই একটা একটা করে পরিষ্কার পায়ের ছাপ ফুটে উঠছে–যেমন জোনাকিপোকার আলো হয় না, ঠিক সেরকম আলোয় গড়া পায়ের ছাপ। একটা দুটো তিনটে…এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর পেছনের পায়ের ছাপগুলো একটু বাদে মুছে যাচ্ছে। আমি তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম….

মাসি! গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে দ্যুতি আর বুড়ি দুজনেই চমকে উঠল। রূপেন শইকিয়া কখন যে তার কাজ সেরে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ওদের দুজনের মধ্যে কেউই তা খেয়াল করেনি। তিনিই বললেন, এসব কি আজেবাজে গল্প শোনাচ্ছ দিদিমণিকে?

দ্যুতি প্রতিবাদ করল–না না। এই গল্পগুলোই তো আমি শুনতে চাই। এগুলোই আমার গবেষণার বিষয়।

ঠিক আছে, আবার পরে এসে শুনবে। আজ আমাকে অন্য এক জায়গায় যেতে হবে। তুমি এখন উঠে এস। রূপেনের এই স্বভাববিরোধী তিক্ত সুরে দ্যুতি বেশ অবাক হল। তবে সে আর তর্কও করল না। নোটবুক বন্ধ করে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রূপেনের পেছন পেছন তার গাড়িতে এসে বসল।

দ্যুতিকে হরিণডুবি বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে রূপেন আবার কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। দ্যুতি ঘড়ি দেখল, মাত্র সাড়ে তিনটে বাজে। সে ঠিক পনেরো মিনিট সময় কাটাল বারান্দায় এক কোণায় রূপেন শইকিয়ার গাছ গাছড়ার স্যাম্পেল প্যাকেটগুলো যেখানে জড়ো করা রয়েছে, সেইখানে। সেখান থেকে নিজের হ্যান্ডব্যাগটার মধ্যে একটা বড় প্যাকেট পুরে নিয়ে বাংলোর চৌহদ্দি পেরিয়ে দ্রুত পায়ে হরিণডুবি গ্রাম পেরোল। গ্রাম পেরিয়ে একেবারে হরিণডুবি বিট অফিসের দরজায় পৌঁছে দ্যুতি কড়া নাড়ল।

বিট অফিসার সজল দত্ত দ্যুতিকে দেখে বেশ অবাক হয়েই জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার ম্যাডাম, কোনও প্রবলেম হল না কি?

দ্যুতি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্ত ভাবল, যে কাজটা করতে চলেছে সেটা ঠিক হচ্ছে কি না। তার চোখে ভেসে উঠল প্রমিতের উদভ্রান্ত মুখটা, কপালে ব্যান্ডেজ। সে মনস্থির করে নিয়ে সজলবাবুকে বলল, না, প্রবলেম কিছু নয়। একবার আর টি সেটে আমাকে ব্যানার্জি সাহেবের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে হবে।

অফিসের বাইরের একজনের কথায় রেডিয়ো ট্রান্সমিটার চালু করবে কি না সে ব্যাপারে সজল দত্ত একটু ইতস্তত করছিলেন। দ্যুতি বলল, বিশ্বাস করুন ব্যাপারটা খুব জরুরি। তা না। হলে এরকম রিকোয়েস্ট করতাম না।

ঠিক আছে। ভেতরে আসুন। সজল দত্ত দ্যুতিকে পাশে বসিয়ে আলিপুরদুয়ার অফিসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলেন–

স্যার, মিস সেনগুপ্ত একটু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান, ওভার।

 হ্যাঁ, ওনাকে দিন। কী ব্যাপার দ্যুতি?

 দ্যুতি বলল, তুমি এক্ষুনি একবার আসতে পারবে?

কেন? কী ব্যাপার?

এখন কিছুই বলতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস কর, ব্যাপারটা খুব জরুরি। তুমি প্লিজ একবার এসো।

বেশ, আসছি। তুমি বাংলোতেই ওয়েট করো।

 দ্যুতি হ্যান্ডসেটটা দত্তবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। প্রমিত বলল, ঠিক আছে দত্তবাবু, ওভার।

ওভার অ্যান্ড আউট।

দত্তবাবু বড় বড় চোখ করে দ্যুতির চলে যাওয়াটা দেখলেন। ব্যানার্জি সাহেবকে তুমি তুমি করে কথা বলছেন এই ম্যাডাম! চলে আসতে বলছে ওনার সঙ্গে দ্যাখা করবার জন্যে! ইসসস ছি ছি ছি। আগেই বোঝা উচিত ছিল। উচিত ছিল এক দুটো বড় সাইজের দেশি মুরগি বাংলোর রান্নাঘরে পাঠানো। অবশ্য সেরকম কিছু করলে, আর ব্যানার্জির্সাহেব সেটা জানতে পারলে, নিশ্চয় গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিতেন। এরকম অবস্থায় কী যে করণীয়? বুঝে উঠতে পারছিলেন না সজল দত্ত।

.

ঘন্টাখানেক পরে হরিণডুবি বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রমিতও একই কথা বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

তার সামনেই দাঁড়িয়েছিল দ্যুতি। সারাদিন জঙ্গলের গ্রামে গ্রামে ঘোরার পরিষ্কার ছাপ তার চেহারায়। বোঝাই যাচ্ছে ফিরে এসে হাত মুখটা অবধি ধোয়নি। তবু প্রমিতের কথার কোনও জবাব না দিয়ে, তার হাত ধরে টানতে টানতে সে প্রমিতকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে এসে বলল, উঠে পড়ো। নিজেও এক মোচড়ে ড্রাইভিং-সিটের উলটোদিকে দরজাটা খুলে, প্রায় লাফ মেরেই গাড়িতে উঠে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, চল, চল, স্টার্ট দাও। একদম সময় নেই।

কোথায় যাব এবং কিসের সময় নেই?

যেতে যেতে সব বলেছি। তুমি আলিপুরদুয়ার চলো। কাশ্যপসাহেবের অফিসে। ওখানে গিয়েই সব বলব। তখনই বুঝবে, কেন বলছি একটুও সময় নেই।

দিন পনেরো আগে যে আত্মমগ্ন, থতোমতো খাওয়া মেয়েটাকে প্রথমবার তার অফিসের ভেতরে দেখেছিল, সেই মেয়েটাই যে কেমন করে এত বদলে গেল, তা ভেবে পায়না প্রমিত। দ্যুতিকে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। তার গলায় ফুটে বেরোচ্ছিল কর্তৃত্বের সুর। সেই সুরকে প্রমিত উপেক্ষা করতে পারেনা। সে গাড়িতে স্টর্ট দিয়েছিল। কিন্তু তখনই দ্যুতি তার হাত চেপে ধরে বলেছিল, একমিনিট। একটা ভুল হয়ে গেছে। গাড়িটা একবার থামাও।

অবাক প্রমিত গাড়ি থামাতেই দ্যুতি আবার লাফ মেরে দৌড়ে ঢুকে গিয়েছিল বাংলোর মধ্যে। একটু বাদেই ফিরে এসেছিল।

কী ভুলে গিয়েছিলে? প্রশ্ন করল প্রমিত।

বাংলোর কেয়ারটেকারকে বলে এলাম, রূপেন শইকিয়া ফিরে এলে তাকে বলতে যে আমার জ্যাঠামশাই, মানে যিনি তোমাদের বড়সাহেব, তিনি হঠাৎ কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ারে এসেছেন অফিসের কাজে, এবং আমাকে দেখতে চেয়েছেন। তুমি তাই গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে এসেছ। একটু কাঁচা মিথ্যে হয়ে গেল, কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায় এল না।

.

১৫.

দ্যুতি আর প্রমিত যখন জলপাইগুড়িতে দেবেশ কাশ্যপের বাংলোয় পৌঁছল, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। কাশ্যপ সাহেবকে রাস্তা থেকেই প্রমিত ফোন করে জানিয়েছিল যে তারা আসছে। তাই তিনি আর অন্য ভিজিটর রাখেননি।

তিস্তার বাঁধের ধারে সাহেবি আমলের বিশাল বাংলোটার বাগানে একটা মস্ত অর্জুন গাছ। তার ডাল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় উড়ে যাচ্ছিল নৈশ অভিযানে।

দ্যুতি তাড়াতাড়ি প্রমিতের সঙ্গে কাশ্যপসাহেবের ড্রইংরুম কাম অফিসে ঢুকে পড়ল।

তিনজনে সোফায় বসার পর দ্যুতি তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বার। করে দেবেশ কাশ্যপের হাতে দিল। প্যাকেটটার ভেতরে লাল আর খয়েরি মেশানো অদ্ভুতদর্শণ কিছুটা গুঁড়ো পদার্থ ছাড়া আর কিছু নেই।

কী এটা? দেবেশ কাশ্যপ হাতের তালুর ওপর সেই গুঁড়ো কিছুটা ঢেলে নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর সাবধানে গন্ধ শুঁকেও দেখলেন। শেষকালে হতাশ হয়ে বললেন, নাঃ, আমি তো বুঝতে পারছি না এটা কী।

প্রমিত হাতটা বাড়িয়েছিল। তার হাতে গুঁড়োটা চালান করে দিয়ে দেবেশ কাশ্যপ আবার বললেন, এটা কি জিনিস ম্যাডাম?

বলছি। তার আগে আপনি আমার একটা উপকার করুন।

বলুন।

আপনি বলেছিলেন মধু বর্মনের ডেনগুলোতে আপনারা রেইড করেছিলেন। আপনার লোকদের বলুন ওইসব জায়গায় যা কিছু পেয়েছে তার মধ্যে ঠিক এইরকম গুঁড়ো ভরতি প্যাকেট ছিল কি না জানাতে। যদি পেয়ে থাকে তাহলে সেটাকে যেন যত্ন করে রেখে দেয়।

সামনের কফিটেবল থেকে ল্যান্ডফোনটা তুলে নিয়ে দেবেশ কাশ্যপ কাকে যেন ঠিক সেইরকম নির্দেশ দিলেন। তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, আর?

বিমল, বাবুয়া, সন্দীপ আর মিসেস মেহরার জামাকাপড় এখনও পুলিশ কাস্টডিতেই থাকার কথা। ওগুলোকে আবার ফরেনসিক এক্সামিনেশনের জন্যে পাঠাতে হবে।

কী দেখতে হবে?

দেখতে হবে, ওই সব পোশাকে এই গুঁড়ো জিনিসটার কোনও ট্রেস পাওয়া যায় কি না।

আবারও ফোনে কিছু নির্দেশ গেল। তারপর দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতিকে বললেন, নাউ ইট ইজ ইয়োর টার্ন টু এক্সপ্লেইন! এসব কী হচ্ছে একটু বুঝিয়ে বলুন দয়া করে।

বলছি কাশ্যপসাহেব। তার আগে দুটো গল্প বলি। গল্পদুটো শুনেছিলাম কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে, বটানির পাস ক্লাসে। নন্দিনী ম্যাডাম আমাদের বটানির একটা অদ্ভুত ফেনোমেনন বোঝাতে গিয়ে এগুলো বলেছিলেন। ভাগ্যিস বলেছিলেন। তাই তো ব্যাপারটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।

সন আঠেরোশো চৌষট্টি। রাশিয়ার স্টারইয়া লাডোগার সেন্ট জর্জ চার্চের এক ব্যাভিচারী যাজক পানশালা থেকে আকণ্ঠ মদ খেয়ে চার্চে ফিরছিলেন। রাত হয়ে গেছে অনেক। চারিদিকে নিকষ অন্ধকার।

যাজকের পা টলছে। মনে তার প্রচণ্ড পাপবোধ। চার্চের প্রধান রোজই তাকে এই ব্যাভিচারের জন্যে তিরস্কার করছেন, ভয় দেখাচ্ছেন নরকবাসের, তবু তিনি কিছুতেই নেশা আর নারী থেকে দূরে থাকতে পারছেন না। ঈশ্বর তার এই জীবনধারাকে ক্ষমা করবেন?

ভাবতেই ভাবতেই তিনি যেন তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। অন্ধকার দিগন্ত থেকে একটা আগুনের গোলা নিঃশব্দে কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে সেই যাজকের দিকে ভেসে এল।

শয়তান! শয়তানই নিশ্চয় তার অনুচরকে পাঠিয়েছে তাকে টেনে হিঁচড়ে নরকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। যাজক তৎক্ষণাৎ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা শুরু করে দিলেন– হে প্রভু, রক্ষা কর, রক্ষা কর এই পাপীকে।

সেই প্রার্থনার জেরেই নিশ্চয়, আগুনের গোলাটা তাকে না ছুঁয়ে একটু দূর দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে অন্য দিগন্তে মিলিয়ে গেল। যাবার সময় খুব কাছ থেকে একবার তার চেহারাটা দেখতে পেয়েছিলেন সেই যাজক হাঁসের মূর্তি ধরে এসেছিল শয়তানের অনুচর। জ্বলন্ত এক রাজহাঁস।

দ্বিতীয় গল্পটাও অনেকটা একই রকমের। সেই রাশিয়ান যাজকের মতোই আতঙ্কে অধীর হয়ে গিয়েছিল এক ডাচ নৈশপ্রহরী। সময়টা উনবিংশ শতকের গোড়ায়। পাপুয়া নিউগিনিতে তখন ওলন্দাজরা সবে উপনিবেশ গড়ে তুলছে, আর নখে দাঁতে তাদের বাধা দিচ্ছে সেখানকার স্বাধীনতাপ্রিয় আদিবাসীরা। যখন তখন ডাচদের গড়ে তোলা ছোট শহরগুলোকে বিষাক্ত তীরধনুক নিয়ে আক্রমণ করছে তারা। তাদের ভয়েই শহরগুলোর সীমানার বাইরে সারা রাত নৈশপ্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এই গল্পের নায়ক ছিল তেমনই এক নৈশপ্রহরী।

সেই রাতটা ছিল মেঘে ঢাকা। চোখের দৃষ্টি চলে বেশি দূর। তাহলেও সেই নৈশপ্রহরীর একটুও অসুবিধে হল না পায়ের ছাপগুলো দেখতে।

কেন হবে? সেগুলো যে আগুন দিয়ে আঁকা পায়ের ছাপ। একটা একটা করে অমন জ্বলন্ত পায়ের ছাপ সমুদ্র থেকে উঠে ভিজে বালির বালিয়াড়ি পেরিয়ে আসছে শহরের দিকে। এ কোন অশরীরি সামুদ্রিক দানব তাদের শহরকে গিলে খেতে আসছে! প্রাণভয়ে চিৎকার করতে করতে প্রহরীটি শহরের লোকজনকে সতর্ক করতে দৌড়ল।

.

গল্প শেষ করে দ্যুতি মুচকি হেসে প্রমিতকে বলল, এরকম গল্প তুমি কদিন আগে একবার শোনোনি?

প্রমিত বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। সোনারু মাঝির মুখে। সে শিরোমণির গড়ের পেছনদিকের রাস্তায় কখনও কখনও আলোমাখা বেজি কিম্বা সাপকে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখেছে।

আমিও আজ এরকম একটা গল্প শুনেছি, মিনাজুড়ি গ্রামের এক বুড়ির কাছ থেকে। সে ওই একই রাস্তায় জ্বলন্ত পায়ের ছাপ দেখেছিল।

আমি বোধহয় এই গল্পগুলোর রেলেভ্যান্স একটু একটু ধরতে পারছি। জ্বলন্ত পায়ের ছাপ..জ্বলন্ত প্রাণী। জ্বলন্ত মানুষ হতে পারে না? যদি হয় তাহলে তো সে সহজ টার্গেট। রাতের টার্গেট, ইয়েস! রাতের টার্গেট। এরকম কি হতে পারে দ্যুতি? উত্তেজিত দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতির সামনে ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করলেন। কিন্তু দ্যুতি উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

কাশ্যপসাহেব উত্তর দিলেন হ্যালো। তারপর কিছুক্ষণ ওদিককার কথা মন দিয়ে শুনলেন। শেষকালে বললেন, আচ্ছা সামন্ত, তুমি নিজেই তাহলে প্যাকেটটা একবার আমার কোয়ার্টারে নিয়ে চলে এসো।

ফোনটা নামিয়ে রেখে কাশ্যপসাহেব দ্যুতির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললেন, ইনক্রেডিবল। ইনস্পেক্টর সামন্তকে বলেছিলাম, মধু বর্মনের ঘরগুলো থেকে যে সব মাল সিজ করা হয়েছে, তার মধ্যে এই ডেসক্রিপশনের গুড়ো আছে কি না দেখতে। বলছে, আছে। নিয়ে আসছে।

দ্যুতি একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ওদের পোশাকেও এই গুঁড়োর চিহ্ন পাওয়া যাবে– বিমল বাবুয়াদের শার্টের বুকে। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, সত্ত্বার করার আগে যদি বিনতা মেহরার নগ্ন পিঠটা খুঁজে দেখা হত তাহলে সেখানেও পাওয়া যেত। আই অ্যাম সিওর অফ ইট। যখন গুলি চলে, তখন উনি ন্যুড ছিলেন। তাই ওনার পোশাকে নয়, ত্বকেই থাকত এই জিনিসটার রেসিডিউ।

আই হ্যাভ গট ইয়োর পয়েন্ট। বললেন দেবেশ কাশ্যপ।

 মি টু। প্রমিত বলল তার মানে এই গুড়োটাই আলোকিত করে দিয়েছিল ওদের। কিন্তু এটা কী জিনিস দ্যুতি? কোথায় পেলে এই জিনিস?

কোথায় পেলাম? কাউকে বোলো না যেন। আজ আমাকে হরিণডুবি বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে মিস্টার শইকিয়া কোথায় যেন চলে গেলেন। সেই সময়টা কাজে লাগিয়ে আমি ওনার গাছ-গাছড়ার স্যাম্পেলের প্যাকেটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে এটা পেয়ে গেলাম আর কি। জানতাম অবশ্য, পাবো।

আর জিনিসটার পরিচয়?

 বলছি, দাঁড়াও।

আমি একটু ইন্টারাপট করছি, দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতিকে বললেন। এটাকে আমার আদেশ। বলেই ধরতে পারো। এখন থেকে যতক্ষণ না পুরো অপারেশনটা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তুমি, তুমিই বলছি, আমার মেয়ের সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকবে। ও তোমার সমবয়সি, কাজেই কোনও অসুবিধে হবে না।

এখানে থাকতে বলছি কারণ, তোমাকে এখন এক দুদিন আমাদের খুব দরকার, অথচ হরিণডুবিতে তোমার ফিরে যাওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। আর…

একবার অপাঙ্গে প্রমিতের দিকে চেয়ে দেবেশ কাশ্যপ কথাটা শেষ করলেন মিস্টার ব্যানার্জি তোমাকে যাই বোঝান, ওনার কোয়ার্টারে রাত কাটানোটাও তোমার পক্ষে ইকুয়ালি বিপজ্জনক।

ছিঃ! লজ্জায় দু-হাতে মুখ ঢাকল দ্যুতি।

.

১৬.

পরের দেড়খানা দিন প্রমিত, দ্যুতি এবং সর্বোপরি দেবেশ কাশ্যপের প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। শুধু পুলিশ নয়, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট এমনকি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে অবধি চেতিয়ে তুলে বিভিন্ন কাজে লাগানো–এটা খুব সহজ কথা নয়।

বড় সাফল্য এল মধু বর্মন ধরা পড়ায়। তাকে জয়গাঁর একটা বস্তি থেকে তুলে আনল জলপাইগুড়ি পুলিশ। ইন্টারোগেট করলেন দেবেশ কাশ্যপ নিজে।

ইতিমধ্যে হরিণডুবির জঙ্গলে মারা পড়ল একটা টাস্কার, অর্থাৎ দাঁতাল হাতি, যার দাঁত দুটো চোরাশিকারিরা কেটে নিয়ে গেছে।

দেড়দিনের মাথায়, দুপুরের দিকে একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছোকরা হরিণডুবি বনবাংলোয় এসে রূপেন শইকিয়ার খোঁজ করল। রূপেন সেই মুহূর্তে বাংলোয় ছিলেন না। ছেলেটা অপেক্ষা করে রইল। রূপেনের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। ছেলেটা তাকে দেখেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখে তার কানে কানে কি সব বলে চট করে কেটে পড়ল।

ছেলেটা চলে যাওয়ার পরে দেখা গেল রূপেন শইকিয়া কিছুক্ষণ থম হয়ে বসে রইলেন। তারপর বাংলোর বেয়ারাকে ডেকে বললেন ঘর থেকে তার জিনিসপত্রগুলো বারান্দায় বের করে দিতে। তিনি তখনই বেরিয়ে পড়বেন।

একটু পরে দেখা গেল হরিণডুবি বনবাংলোর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রূপেন শইকিয়া বোলেরোর পেছনের দরজাটা খুলে সেখানে তার সংগৃহীত গাছপালার স্যাম্পেলের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে রাখছেন।

কিছুক্ষণ ধরে একটা অন্য গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দূর থেকে জঙ্গলের পথ ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছিল গাড়িটা। রূপেন শইকিয়া, কি জানি কেন, কাজ সারতে সারতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেইদিকে তাকাচ্ছিলেন। তার ভঙ্গিতে স্পষ্ট উদ্বেগ।

একটা বাঁক ঘোরার পরেই জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে গাড়িটা উঠে এল বাংলোর সামনের সোজা রাস্তাটায়। গাড়িটা নয়, গাড়িদুটো। একটা প্রমিতের জিপসি, আরেকটা পুলিশের উইলি জিপ। দুটো গাড়ি এসে বোলেরোর দুপাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। একটা গাড়ি থেকে নেমে এল প্রমিত এবং দ্যুতি, আরেকটা থেকে দেবেশ কাশ্যপ। তাদের দেখে গাড়ির ডিকিতে মাল তোলা বন্ধ রেখে, রূপেন শইকিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তার মুখে বেশ চওড়া হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আরে কী ব্যাপার? এই বিকেলে সবাই একসঙ্গে জঙ্গলে? এটা তো পিকনিকের সময় নয়।

কেন নয়, মিস্টার শইকিয়া? জঙ্গলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা প্রমিত ব্যানার্জি যখন নিজেই উপস্থিত, তখন এনি টাইম ইজ পিকনিক টাইম। চলুন!

শেষ শব্দটার মধ্যে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে, রূপেনের ঠোঁট থেকে হাসিটা সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল। তার জায়গায় জেগে উঠল স্পষ্ট প্রতিরোধ।

কোথায় যাব? দেখছেন না, আমি এখন বাড়ি রওনা হচ্ছি? যাওয়া টাওয়া সব আবার পরের বার হবে, নেক্সট টাইম। দেবেশ কাশ্যপের প্রতি তাচ্ছিল্যটা জোরদার করতেই যেন রূপেন বাঁ-হাতের এক জোরালো ধাক্কায় বোলেরোর পেছনের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। তারপর ঘাড় উঁচু করে এগিয়ে গেল গাড়ির সামনের দিকে, ড্রাইভারের সিটের দিকে।

পেছন থেকে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বাড়ি গিয়ে এখন কি কিছু লাভ হবে মিস্টার শইকিয়া?

মানে? রূপেনের প্রত্যয়ী ভঙ্গিটা এই একটা কথাতেই বদলে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন দেবেশ কাশ্যপের দিকে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?

মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বলতে চাইছি, এখন বাড়ি ফিরে তো মোটেই শান্তি পাবেন না। শুনলাম, ওরা আপনার বাড়ির সমস্ত ফার্নিচার এদিক থেকে ওদিক করে দিয়েছে, আলমারি থেকে সমস্ত কাগজ মেঝেতে নামিয়ে ফেলেছে, এমন কি বিছানার গদিগুলো অবধি না কি মাঝখান থেকে চিরে ফেলেছে।

কারা? অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাঁসে গলায় জিগ্যেস করলেন রূপেন শইকিয়া। তার চওড়া কাঁধ দুটো এই মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে শরীরের দুপাশে ঝুলে পড়েছে। শীতের দিনেও ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে।

সে কি, আপনি এখনও জানেন না! সি বি আইয়ের গোয়েন্দারা। ওরা কাল মাঝরাত থেকে আপনার গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া আর ইটানগরের তিনটে বাড়িতেই রেইড শুরু করেছে। আপনি যে ব্যাঙ্কের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাবেন, তার উপায়ও ওরা রাখেনি। সেখানেও আপনার তিনটে ব্যাঙ্কের লকার খুলে ওরা, মানে সি বি আইয়ের লোকেরা সব গয়নাগাটি, ক্যাশ টাকা এইসবের লিস্ট বানাচ্ছে।

তাই বলছিলাম কি এখন বাড়ি না ফিরে যদি একটু আমাদের সঙ্গে পিকনিক-ই করে। আসেন, তাহলে কেমন হয়?

কাশ্যপের চোখের ইশারায় জিপ থেকে দুজন বন্দুকধারী কনস্টেবল নেমে এসে রূপেনের দুদিকে দাঁড়াল। তবে বলপ্রয়োগের দরকার পড়ল না। রূপেন নিজে থেকেই তাদের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে জিপের পেছনের সিটে বসলেন। সামনের সিটে ড্রাইভারের আসনে বসলেন দেবেশ কাশ্যপ, তার পাশে একটু ঠাসঠাসি করেই প্রমিত আর দ্যুতি। প্রমিতের আর রূপেনের গাড়িদুটো হরিণডুবি বাংলোর সামনেই দাঁড়িয়ে রইল।

জিপটা রওনা হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরে রূপেন ডাকলেন, কাশ্যপ সাহেব! দেখা গেল তার গলায় পুরোনো দাপটের অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে।

বলুন! বললেন দেবেশ কাশ্যপ।

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি এটাই যে, আমার দুটো বাড়ি আর তিনটে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে? ধনী হওয়াটা কি ক্রিমিনাল অফেন্স, যে আমাকে এইভাবে পুলিশ পাহারায় গাড়িতে তুললেন?

দেবেশ কাশ্যপ বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ক্রিমিনাল অফেন্সের অভাব কি, মিস্টার শইকিয়া? এখানে আসার আগে অবধি টেলিফোনে গুয়াহাটি থেকে যেটুকু জানতে পেরেছি, বলি। আপনার তিনসুকিয়ার বাড়ির একটা লুকনো সেলার থেকে চারটে চিতার চামড়া পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে একটা দুষ্প্রাপ্য ক্লাউডেড লেপার্ডের। সম্ভবত নামডাফা স্যাংচুয়ারি থেকে জন্তুটাকে মেরেছিল আপনার পোষা চোরাশিকারিরা। গুয়াহাটির বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে গন্ডারের খড়গ আর হরিণের শিং।

তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখা গেছে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে। দেখা গেছে ফরেস্ট প্রোডাক্ট রফতানি করে আপনার ব্যাবসায় যে পরিমান বিদেশী টাকা এসেছে অত পরিমাণ মাল আপনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে কেনেনই নি। তাহলে কিসের জন্যে টাকাটা পেলেন? জন্তুর চামড়া বিক্রি করে কি?

আবার উল্টো দিকে, ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি বহু টাকা পেমেন্ট করেছেন চীন আর প্যালেস্টাইনের কয়েকটা কোম্পানির নামে। ওই টাকা না কি আপনি দিয়েছিলেন ওদের কাছ থেকে মেশিন-পার্টর্স আমদানি করেছিলেন বলে। অথচ আপনার কোনও কারখানাই নেই।

চীন আর প্যালেস্টাইন থেকে কী নিয়ে এসেছিলেন মিস্টার শইকিয়া? এ কে ফর্টিসেভেন? ইনস্যাস?

আপনার দুপাশে পুলিশ বসিয়ে রাখাটা কি জাস্টিফাই করতে পারলাম, মিস্টার শইকিয়া? না না। আপনাকে এখনই এর কোনোটার ব্যাখ্যা দিতে হবে না। জেলখানায় বসে এসবের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর বানানোর চেষ্টা আপনি করবেন। ও, বলা হয়নি বুঝি, আপনার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আমার পকেটেই রয়েছে।

রূপেন শইকিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে অ্যারেস্ট করে কোর্টে প্রোডিউস করলেই ভালো হত না? অ্যাটলিস্ট আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা পেতাম। তা না করে, এখন কোন ছেলেখেলা করবার জন্যে আমরা নদীর দিকে যাচ্ছি? তেঁতো স্বরে জিগ্যেস করলেন রূপেন শইকিয়া।

সত্যিই ততক্ষণে গাড়িটা জঙ্গল ভেঙে সেই রাস্তাটায় এসে উঠেছে, যার শেষ মাথায়, বনের শেষে, জয়ন্তীর জলের চিকিমিকি দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। জঙ্গল জেগে উঠছে। শুরু হয়ে গেছে নাইটজারদের অবিরাম টঙ্ক টঙ্ক চিৎকার, ঝিঁঝিপোকাদের কনসার্ট। শিরোমণির গড়ের দিক থেকে একবার একটা দাঁতালের ক্রুদ্ধ চিৎকারও শুনতে পাওয়া গেল।

ওই নদীর কিনারাতেই গত পনেরোদিনে চারটে মানুষ খুন হয়েছে। এইরকম অন্ধকারের মধ্যেই।

গাড়িটা সেই কিনারা থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে দেবেশ কাশ্যপ ঘুরে তাকালেন রূপেন ইকিয়ার দিকে। তারপর বললেন, মিস্টার শ‍ইকিয়া, আরও একটা ক্রিমিনাল অফেন্সের কথা আপনাকে বলা হয়নি। সেইটা বলব বলেই এখানে নিয়ে এলাম আপনাকে। দেখুন, আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই ঘন জঙ্গলে ঢাকা টিলাটা, যার মাথায় শিরোমণির গড়ের ধ্বংসাবশেষ। আপনার সামনে কুয়াশায় মোড়া জয়ন্তী নদীর বিস্তীর্ণ চর। নদীর ওপাড়ে এক পাল প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভুটান পাহাড়ের সারি, উত্তুরে হাওয়া যেন ওদেরই নিশ্বাস। এই তো সেই রঙ্গমঞ্চ, যেখানে আপনি এক নারকীয় নাট্যপালার সূচনা করেছিলেন।

সুন্দর এগিয়ে চলেছিল সেই নাটকটা। আপনি যেমনটা ভেবেছিলেন সেইভাবেই নিশ্চয় শেষ হত। শুধু গন্ডগোলটা কোথায় হয়ে গেল জানেন? আপনার স্ক্রিপ্টে নাম ছিল না এমন একটি চরিত্র মাঝখান থেকে ঢুকে পড়ল। একটি নারী চরিত্র নাম দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত, দ্যুতি। সে আসার পরেই গল্পটা আপনার হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল।

এইখানে দাঁড়িয়ে, এই মুহূর্তেই আমরা আপনার সেই নাটকটার ওপর যবনিকা ফেলব। আর নাটকের শেষ সংলাপগুলো শুরু করার সম্মান আর কে-ই বা পেতে পারে, দ্যুতি ছাড়া?

নাও দ্যুতি শুরু কর!

.

১৭.

দ্যুতি বলল, ডক্টর শইকিয়া, আপনাকে কিছু শেখানোর স্পর্ধা আমার নেই। আপনার পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। শুধু আমার ধারণাগুলো সত্যি কি না সেটুকু জানবার জন্যেই আপনাকে এই কথাগুলো বলছিঃ

আপনিও নিশ্চয় ক্লাসরুমে আপনার ছাত্রছাত্রীদের কখনও শুনিয়েছেন স্টারইয়া লাডোগার জ্বলন্ত রাজহাঁসের গল্প, কিম্বা নিউগিনির সমুদ্রতটে জ্বলন্ত পায়ের ছাপের রহস্য। অবাক ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ক্লাসের শেষদিকে এসে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন এই আপাত অলৌকিক ব্যাপারগুলোর পেছনে কেমনভাবে কাজ করেছিল এক ন্যাচারাল ফেনোমেনন, যার নাম বায়োলুমিনিসেন্স।

বায়োলুমিনিসেন্স বা জৈবপ্রভা জীবজগতের এক আশ্চর্য ঘটনা। এই পৃথিবীতে প্রায় এগারোশো প্রাণী এবং উদ্ভিদ নিজেদের শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরণ করতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ জোনাকি।

এই ধরণের জীবদের মধ্যে সংখ্যায় যারা সবচেয়ে বেশি তাদের নাম পেরিডিনিয়ান– সমুদ্রে বসবাসকারী খুব ছোট একধরনের উদ্ভিদ। উত্তেজিত হলে পেরিডিনিয়ানের শরীর থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয়। অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে একটা জাহাজ যখন এগিয়ে যায়, তখন কখনও কখনও দেখা যায় তার দুধারে জলতল আলোয় ঝলমল করে উঠছে। এ আর কিছুই নয়, কোটি কোটি উত্তেজিত পেরিডিনিয়ানের জৈবপ্রভা। রাতের সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে ডুবুরিরা মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হয়ে দেখেন তাদের হাত পায়ের প্রত্যেকটা নড়াচড়ায় কেমন করে আলোর ঢেউ ফুলে ফেঁপে উঠছে। এ-ও ওই পেরিডিনিয়ানের ম্যাজিক।

নিউগিনির সমুদ্রতটে ঢেউয়ের সঙ্গে সেদিন অমন কোটি কোটি পেরিডিনিয়ান আছড়ে পড়েছিল। যখনই কোনও জেলে তাদের মাড়িয়ে গেছে তখনই তাদের উত্তেজিত শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে। আমাদের বেচারা নৈশ প্রহরীটি তাকেই ভেবেছে দানবের পায়ের ছাপ।

পেরিডিনিয়ানের মতনই উজ্জ্বল আলো ছড়াতে পারে নানা ধরনের ব্যাঙের ছাতা, বা ফাঙ্গাস। অন্ধকার নামার পরে অনেকসময়ে একটা পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় তার গায়ে আগুন ধরে গেছে। তা নয়, আসলে ওই গুঁড়ির গায়ে গজিয়ে ওঠা ছত্রাকরা ছড়িয়ে দিচ্ছে জৈবপ্রভা।

এমনই ছত্রাক নিশ্চয় গজিয়ে উঠেছিল যাজকের দেখা সেই রাজহাঁসটার বাসায়। সেই ছত্রাক থেকে পাখিটার পালকে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল আলো ছড়ানো গুড়ো। সাধারন বুনো হাঁসটাকেই সেই আলো যাজকের চোখে বানিয়ে দিয়েছিল যমদূত।

ডক্টর শইকিয়া, এই জঙ্গলের আদিবাসীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। আপনি তাদের ঘরের লোক। কাজেই শিরোমণির গড় সম্বন্ধে নানান অলৌকিক গল্প আপনার অজানা থাকতেই পারে না। আপনিও কখনও না কখনও নিশ্চয় শুনেছিলেন ওই ধ্বংসাবশেষের পথে ফুটে ওঠা জ্বলন্ত পায়ের ছাপ কিম্বা আলোকিত ছেটখাটো প্রাণীদের কথা।

আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছিলেন যে আলোকিত বাঘ কিম্বা হাতি দেখতে পাওয়ার কথা ওরা কেউ বলে না। বলে বেজি কিম্বা সাপের কথাযারা মাটির সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে চলাফেরা করে।

দুইয়ে দুইয়ে চার করতে আপনার সময় লাগেনি। আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিরোমণির গড়ের পেছনের ওই পরিত্যক্ত পেছল পথে নিশ্চয় এমন কোনও উদ্ভিদের আবাদ আছে যারা বায়োলুমিনিসেন্ট; উত্তেজিত হলে জোরালো আলো ছড়ায়। আপনি খুঁজে বার করেছিলেন সেই উদ্ভিদ। খুব ছোট একধরনের ফাঙ্গাস, লালে আর খয়েরিতে মেশানো রঙ। মাটিতে পড়ে থাকলে মাটির থেকে আলাদা করে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু চাপ দিয়ে যদি একে ডলে দেওয়া হয় তাহলে কিছুক্ষণের জন্যে তীব্র লাল আলো ছড়িয়ে দেয় এই কণাগুলো। আর যখন অনেক এমন ফাঙ্গাস একসঙ্গে দলে যায় তখন মনে হয় যেন আগুন ধরে গেল সেই জায়গায়।

আমার ধারণা এই প্রজাতিটি বক্সার এই অঞ্চলে ছাড়া আর কোথাও হয় না। আপনিই এর আবিষ্কারক। কিন্তু আপনি বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে একে তুলে ধরলেন না। আবিষ্কারকের সম্মানের চেয়ে বড় প্রলোভন কাজ করল আপনার মনে। আপনি একে ব্যবহার করলেন মানুষ মারার ফাঁদ পাতবার কাজে। এমন এক জায়গায় এই ছত্রাককে ছড়িয়ে দিলেন, যেখান দিয়ে ফরেস্টগার্ডরা বুকে হেঁটে যাবেই। যাতে যায় সেই ব্যবস্থাও করলেন, দুবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলেন ওই ফাঙ্গাসের আবাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আপনার ফাঁদে পা দিল বিমল বাবুয়ারা।

ওরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাবধানে এগিয়ে গেল। সামনে ফাঁকা রিভারবেড। ওখানে চারিদিক না দেখে বেরিয়ে পড়া যাবে না। ওরা শুয়ে পড়ল, ক্রল করে এগিয়ে গেল নদীর সীমানা অবধি। না, কেউ কোথাও নেই। ওরা উঠে দাঁড়াল।

ওরা অবাক হয়ে দেখল, ওদের শরীরের সামনের দিকটা আগুনের মতন উজ্জ্বল লাল আভা ছড়াচ্ছে কাঁধ থেকে পা অবধি।

উল্টোদিকের পাহাড়ে নিশ্চয় অত্যাধুনিক রাইফেল নিয়ে তৈরিই ছিল ঘাতকের দল। বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই তাদের বুলেট এসে শুইয়ে দিল তিন ফরেস্টগার্ডকে।

.

এবার আমি বলি। বললেন দেবেশ কাশ্যপ। কারণ, এই কথাগুলো আজকেই গুয়াহাটি থেকে আসা রিপোর্টে জানতে পেরেছি। দ্যুতি বা প্রমিত এখনও জানে না।

বিনতা মেহরার বিয়ের আগের নাম বিনতা বড়ুয়া। উনিও অসমের মেয়ে। বিয়ের পরেও মারমেড গ্রুপের নর্থ-ইস্টের প্রোজেক্টগুলোই উনি দেখতেন। সম্ভবত এই সময়েই আপনার সঙ্গে ওনার আলাপ, এবং আলাপ থেকে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের মধ্যে কোথাও প্রেম ছিল না, ছিল বিশুদ্ধ লেনাদেনার সম্পর্ক। শারীরিক লেনদেন এবং আর্থিক। বিনতার সুপুরুষে আসক্তি সর্বজনবিদিত, আর আপনি যে সুপুরুষ এ কথা তো অন্ধেও স্বীকার করবে। আর্থিক লেনদেনের পুরো হিসেবটা এখনও পাই নি। তবে বিনতাদের এক্সপোর্ট হাউসের মাধ্যমেই যে পশু-চামড়ার বেশ কিছু গোপন কনসাইনমেন্ট বাইরে গেছে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।

বিনতার উপকার করার জন্যে ততটা নয়, যতটা আপনি হরিণডুবির ভরাডুবি ঘটানোর জন্যে বিনতাকে এখানে টেনে এনেছিলেন। হ্যাঁ, আপনিই ওকে শিরোমণির গড়ের বর্ণনা দিয়েছিলেন; ওর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন এখানে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম গড়ে তোলার মতলব। আপনাদের সার্ভিস-প্রোভাইডারদের কাছ থেকে মোবাইলের যে কলগ পেয়েছি, তার থেকে সেরকমই জানা যাচ্ছে। আপনি চেয়েছিলেন বক্সা টাইগার রিজার্ভের আঁটোসাঁটো দেওয়ালে একটা বড় ফাটল ধরাতে। সেই ফাটলটাই হত ওই হেমিংওয়ে রিসর্ট। ভবিষ্যতে ওই পথেই আপনার চোরাকারবার আরও মসৃণ হয়ে উঠত।

একই মতলবে আপনি দলে টেনেছিলেন ড্রাগ ব্যবসায়ী মধু বর্মনকে। মধু আর বিনতার জোড়া আক্রমনের সামনে ধ্বসে যাক বক্সার প্রতিরোধ–এটাই ছিল আপনার মনোগত বাসনা।

মধুকে ইন্টারোগেট করেছি। ওই ফাঙ্গাসের গুঁড়ো মধুই আপনাকে জঙ্গল থেকে জোগাড় করে দিত। তার বিনিময়ে আপনি ওকে পয়সা দিতেন। প্রচুর পয়সা। সেরকমই এক লেনদেনের সময়ে বেচারি গুলাবি শিরোমণির গড়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে তাকে মরতে হল। এই সবই মধুকে ইন্টারোগেট করে জানতে পেরেছিলাম।

মধু যেটা ভুল করেছিল সেটা হল, ও গোঁয়ারের মতই সবই চেয়েছিল। নিজের ড্রাগের ব্যবসার জন্যে জঙ্গলের প্রহরাহীন পথ, বিনতার আর আপনার ব্যবসার হিস্যা…আর বিনতার শরীর।

তাই, আমার ধারণা মধু বর্মনকে আপনিই ফাঁসিয়েছেন। এর পেছনে শুধু ব্যবসায়িক আক্রোশ নয়, যৌন ঈর্ষাও কাজ করেছিল। মধুরও ধারণা তাই।

আর তারপর আপনি হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু মধু নয়, বিনতাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কারণ বিনতার ডানহাত মধুকে আপনি ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। অথচ শিরোমণির গড় নিয়ে প্রমিত ব্যানার্জিকে চাপে ফেলার মতন জায়গায় আপনি নিজে নেই, সেখানে আপনাকে প্রকৃতিবান্ধব ভাবমূর্তি বজায় রেখে চলতে হয়। আপনার ভয় হল, বিনতা যদি কোনোভাবে আপনার আসল রূপটা আমাদের কাছে প্রকাশ করে দেন? অবশ্য বিনতা মেহরা শুধু আপনার চোরাশিকারের ব্যবসার কথা আর টেররিস্টদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগের কথাটাই জানতেন। বিমল বাবুয়াদের আপনি কিভাবে মেরেছিলেন, তা উনি জানতেন না। জানলে নিজে মরতেন। না।

সাধারনত খুন করলে সবারই ধরা পড়ার একটা ভয় থাকে। সেটাই অনেক সময় ক্রাইমটা ঘটিয়ে ফেলার থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে। আপনি কিন্তু একেবারে নিশ্চিত ছিলেন যে, কেউ আপনাকে ধরতে পারবে না। কারণ, গুলি চলছে কোথা থেকে, আর আপনি কোথায়? অতএব আপনি নিশ্চিন্তে চতুর্থ খুনটির প্রস্তুতি নিলেন।

কিন্তু বিনতার তো কম্যান্ডো ট্রেনিং নেই। সে স্বেচ্ছায় ওই ফাঙ্গাস আবাদের ওপর বিমল বাবুয়াদের মতন বুকে হেঁটে কোথাও যাবে না। তাহলে উপায়?

এক ধরণের মাকড়শার কথা শুনেছি যাদের মধ্যে স্ত্রী-প্রাণীটি সঙ্গমের শেষে পুরুষটিকে মেরে ফেলে। আপনি কাছাকাছি একটা কাজ করলেন। এমন জায়গায় বিনতা মেহরার সঙ্গে মিলিত হলেন যাতে মিলনের শেষে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আলোয় ঝলমল করে উঠল তার আদুল পিঠ। তারপরে যা হল আমরা সকলেই জানি।

বিনতার শরীর থেকে সংগৃহীত যে স্পার্মের স্যাম্পেল আমাদের কাছে রাখা আছে, পরশু অবধি জানতাম না কোন পুরুষের স্পার্মের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখব। এখন জানি।

জঙ্গলের রাত গাঢ় হয়ে উঠছিল। জেগে উঠছিল জঙ্গল। জেগে উঠছিল ঝিঁঝির শব্দে, হাতির চিৎকারে। জেগে উঠছিল দেবেশ কাশ্যপের জিপের আশেপাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ভেসে আসা নানান নিশাচর প্রাণীর যাতায়াতের খসখসানিতে।

বিশাল বিশাল শাল সেগুনের গুঁড়িগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে নদীর চরের নীলচে কুয়াশা হুহু করে ঢুকে আসছিল অরণ্যের অন্দরে। দ্যুতি তার ওড়নাটা কান মাথা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে প্রমিত অবাক হয়ে ভাবল, এই ক্ষীণজীবী মেয়েটাই কি এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল! আশ্চর্য!

.

আপনি কিছু বলবেন না মিস্টার শইকিয়া? কোনও ফাঁক নেই, কোনও ভুল নেই আমরা এতক্ষণ যা বললাম তার মধ্যে?

রূপেন শইকিয়া উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি সেইভাবেই তাকিয়ে রইলেন। তার শরীর একটুও নড়ল না। দেবেশ কাশ্যপের এই প্রশ্নে শুধু তার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল–

আমার একটা আট বছরের মেয়ে রয়েছে জানেন? সে তার বাবাকে ভাবে সুপারম্যান। পৃথিবীর যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে একা লড়ে যেতে পারে।

আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন আমি সামান্য একজন স্কুলশিক্ষক। তবু অনুরাধা, মানে আমার স্ত্রী প্রচণ্ড গর্বিত হয়েছিল একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষের স্ত্রী হতে পেরে। আজও সে আমার ধনদৌলত নয়, আমার বিদ্যার গরবেই গরবিনী।

আমার বৃদ্ধ বাবা এখনও বেঁচে আছেন। জীবনে যত জনহিতকর কাজ করেছি, বিশ্বাস করুন, তার সবটাই ফাঁকি ছিল না। সবটাই যে নিজের ধান্দায় করেছি তা নয়। অনেকটাই করেছি বাবাকে খুশি করার জন্যে।

এমন কি বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, টেররিস্টদের সঙ্গে প্রথম যখন যোগাযোগ করি সেটাও ওদের আদর্শের প্রতি সহমর্মিতা থেকে, অন্য কিছু নয়।

কিন্তু তারপরে কী যে হয়ে গেল! পয়সার নেশা ভূতের মতন ঘাড়ে চেপে বসল। আর তার সঙ্গে ছিল আপনাদের বোকা বানাবার নেশা। এই যে নিজে আড়ালে থেকে একটা আস্ত সাম্রাজ্য শাসন করছি, পুলিশ মিলিটারি সবাইকে ঘোল খাওয়াচ্ছি–এত ভালো লাগত এই ব্যাপারটা যে কি বলব।

হ্যাটস অফ টু ইউ দ্যুতি। ইনফর্মেশন অনেকের কাছেই থাকে। কিন্তু সেই ইনফর্মেশনগুলোকে কাজে লাগাতে পারে কজন? তুমি যে এত তাড়াতাড়ি বায়োলুমিনিসেন্সের ব্যাপারটা ধরে ফেলবে বুঝিনি। তোমার চেহারার মধ্যে এমন একটা সাদামাটা ব্যাপার আছে যেটা খুব মিসলিডিং। আমি…আমি স্বীকার করছি, তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম। না হলে নিজেই কখনও তোমাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরি? সেটাই আমার একমাত্র ব্লান্ডার।

তবু তুমিও একটা খুব ভাইটাল ব্যাপার ধরতে পারোনি দ্যুতি। সেটা ধরতে পারলে তোমরা বুঝতে পারতে আমারও একজন বস রয়েছেন। তিনি তোমাদেরও বস। ডাবল-এজেন্ট কথাটা শুনেছ? তিনি সেই ডাবল-এজেন্ট।

দ্যুতি, প্রমিত এবং দেবেশ কাশ্যপ একসঙ্গে বলে উঠলেন–কে?

আমি বললেই কি বিশ্বাস করবে? প্রমাণ লাগবে না? প্রমাণ রয়েছে ওইখানে। ওই ঘাসজমির মধ্যে, যেখানে বিনতা গুলি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল। মিস্টার কাশ্যপ, অনুমতি দিন, একবার নামি। আপনি, আপনার গার্ডরাও চলুন না আমার সঙ্গে। পালাতে তো পারব না।

এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে নিয়ে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বেশ, চলুন।

ওরা সকলেই গাড়ি থেকে নামল। দুজন গার্ডকে দুদিকে নিয়ে সামনে সামনে যাচ্ছিলেন ডক্টর শইকিয়া। পেছনে দেবেশ কাশ্যপ। তারও পেছনে দ্যুতি আর প্রমিত পাশাপাশি।

হঠাৎ ঘাসজমিটার কাছাকাছি এসে বিদ্যুতের মতন সেই ঘাসজমির ওপর লাফিয়ে পড়লেন ডক্টর রূপেন শইকিয়া। তারপর ছফুটের ওপর লম্বা, ভারী শরীরটা নিয়ে বিশাল একটা মাছের মতন পিছলোতে পিছলোতে চলে গেলেন নদীর কিনারায়।

গার্ড দুজন তাকে গুলি করবার জন্যে বন্দুক উঠিয়েছিল। দেবেশ কাশ্যপ তাদের হাত ধরে থামালেন। বললেন, না। এর আর দরকার হবে না। একজন অনুতপ্ত মানুষকে আত্মহত্যার সুযোগটা দাও।

ওদের বিস্মিত চোখের সামনে জয়ন্তীর তীরে দাঁড়িয়ে উঠলেন রূপেন শইকিয়া। তার। বুকটা তখন রক্তছত্রাকের প্রভায় আগুনের মতন জ্বলছে। এক মুহূর্ত পরেই কাটা কলাগাছের মতন জমির ওপর আছড়ে পড়ল তার শরীর।

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে ভুটান পাহাড় থেকে ভেসে এল একটাই মাত্র ফায়ারিং-এর শব্দ। একটাই।

আরও একটু পরে ডক্টর শইকিয়ার বুকের ওপর থেকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল মরণবিভা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *