স্বাস্থ্য
বড় হাসপাতাল, নাকি বড় রাস্তা
গোটা লন্ডন শহরের বাসিন্দাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ভার তিন দশক ধরে যাঁর কাঁধে, তাঁর কাঁধ দুটি পাতলা, কোমরটি সরু, আর সটান পা দু’টি হাই-হিল জুতোয় চটপটে। হঠাৎ মনে হয়, সদ্য কলেজ-পেরনো তরুণী বুঝি। যে বিশাল ও জটিল ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের খরচে গোটা দেশের মানুষের চিকিৎসা হয়, তার অনেকটা ভার বয়েছেন এই তন্বী, তা বিশ্বাসই হতে চায় না। কেবল মুখের দিকে নজর করলে বোঝা যায়, ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস যতবার ঢেলে সাজা হয়েছে, ততবার এক একটি রেখা বুঝি আঁকা হয়েছে ওই মুখে। নয় বারের বার বিরক্ত হয়ে ৫৬ বছর বয়সে ইস্তফা দিয়েছেন ‘ডেম’ রুথ কারনেল। এখন নানা দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে পরামর্শ দেন। ‘সবার জন্য চিকিৎসা’ নিয়ে বলতে এসেছিলেন কলকাতায়। সবার জন্য ভাল চিকিৎসা কি সম্ভব? সরকারি পয়সায়? হোটেলের লবিতে বসে চিনি-ছাড়া কফিতে চুমুক দিয়ে রুথ বললেন, ‘বেজায় বড়লোক ছাড়া ব্রিটেনে সকলেই কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাতেই চিকিৎসা করায়। আমার পরিবারকে উচ্চবিত্ত বলতে পারেন। আমাদেরও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা নেই, এনএইচএস ভরসা।’ একটু থেমে বললেন, ‘আসলে চিকিৎসায় কতটা উপকার হবে, সেটা ধনী কি গরিব, তার উপর অতটা নির্ভর করে না। করে হাসপাতাল কেমন, তার উপর। ধরুন কারও স্ট্রোক হল। যেখানে স্ট্রোকের স্পেশালাইজড কেয়ার রয়েছে, সেখানে গেলে তার দ্রুত, যথাযথ চিকিৎসা হবে। পাড়ার ছোট হাসপাতালে তা সম্ভব নয়।’
মনে হয়, এ আর কে না জানে। কিন্তু এই কথাটাকেই স্বাস্থ্যনীতির মূল কথা করতে ঢের লড়াই করতে হয়েছে রুথকে। লড়াই রাজনীতির নেতাদের সঙ্গে, ডাক্তারদের সঙ্গে, আমজনতার সঙ্গেও। ‘সবাই চান, বাড়ির কাছের হাসপাতালে সব চিকিৎসা যেন পাওয়া যায়। আসলে তার মানে দাঁড়ায়, সেরা চিকিৎসা না পাওয়া।’ স্ট্রোকের চিকিৎসারই উদাহরণ দিলেন রুথ। পাড়ার হাসপাতালগুলোতে স্ট্রোক চিকিৎসার বিশেষ ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে লন্ডনের লোকে বিরক্ত। তাঁদের বোঝানো যাচ্ছে না, স্ট্রোকের চিকিৎসা কেন্দ্রিকরণ করলে ফল হয় অনেক ভাল।
কেমন সেই ব্যবস্থা?
শহরের আটটি হাসপাতালে ‘হাইপার অ্যাকিউট স্ট্রোক ইউনিট’ তৈরি করে, ৯৯৯ ডায়াল করলেই সেখানে রোগী নিয়ে যাওয়ার নিয়ম তৈরি করেছেন রুথ। যেতে লাগে বড়জোর ৪০ মিনিট। তিন দিন পর স্থানীয় হাসপাতালে ফিরিয়ে দেওয়া হয় রোগীকে। ‘এই ব্যবস্থায় স্ট্রোকে মৃত্যুহার কমেছে ২৫ শতাংশ, টাকাও বেঁচেছে। ব্রিটেনের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় লন্ডনে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড কম খরচ হয়।’
শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার কথা। হাসপাতালে প্রসব বাড়ছে অথচ মায়ের মৃত্যু কমছে না কেন, প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, ‘তাকিয়ে দেখুন কলকাতা থেকে বারাসত যাওয়ার রাস্তাটার দিকে। প্রতি দু-আড়াই কিলোমিটার অন্তর একটা হাসপাতাল, প্রতিটিতে দু’-তিনজন গাইনোকলজিস্ট, এক-দু’জন অ্যানেস্থেটিস্ট। জেনারাল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার না থাকায় এই ডাক্তারদের সব রকম রোগী দেখতে হয়। ফলে কোনও হাসপাতালেই ২৪ ঘণ্টা সিজারিয়ান হয় না।’ এলাকার কোনও একটি হাসপাতালে যথেষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাখা হলে কলকাতায় রেফার করার হাঙ্গামা, বিলম্বের জন্য মৃত্যু এড়ানো যেত না কি?
সে-প্রশ্নটা তোলাই হয় না, কারণ প্রতিটি সাংসদ, বিধায়ক, পুরপিতা তাঁর নিজের এলাকার হাসপাতালে ‘সিজার’ চালু করবেনই করবেন। ওদের আছে, আমাদের নেই কেন, এই হল যুক্তি। স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করার দিনে বিধানসভায় সেই একই দৃশ্য দেখা যায়। কেন মহকুমা হাসপাতালে এমআরআই হবে না, কেন কার্ডিয়াক সার্জারি হবে না স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, তাই নিয়ে শোরগোল চলে। সব হাসপাতালে সব পরিষেবা চালু করা সম্ভব কি না, করা উচিত কি না, তা নিয়ে চিন্তা করে কে?
গণস্বাস্থ্যের নীতিতে জনমতকে কতটা পাত্তা দেওয়া উচিত, তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরাও। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন, নানা দেশে গরিব মানুষ সাধ্যাতিরিক্ত খরচে চিকিৎসা করান, কিন্তু টিকাকরণ, পরিশোধিত জল খাওয়া কিংবা মশারি টাঙানোর জন্য সামান্য খরচ করেন না। রোগ প্রতিরোধের বরাদ্দ কাজে না লাগিয়ে জনমত যদি ক্রমাগত আরও সস্তায় আরও ভাল চিকিৎসা চায়, সেই দাবিকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া চলে? জিষ্ণু দাশ দেখিয়েছেন, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তারের চিকিৎসার মান হাতুড়েদের চিকিৎসার চাইতে উঁচু দরের নয়। আরও, আরও বেশি পাশ-করা ডাক্তারকে গ্রামে পাঠালে গণস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এই কথা মানলে কেবল অপচয় বাড়বে, অসুখ কমবে না।
এ কথাগুলো নেতারাও বোঝেন, বললেন রুথ। ‘আমার সবচেয়ে বিরক্ত লাগে যখন নেতাদের দেখি একান্তে বলছেন, “আমার পরিবারের জন্য এমন চিকিৎসাই চাই, কিন্তু বাইরে তো আর বলতে পারি না।” কেন পারেন না? কী করলে কম খরচে বেশি রোগী নিরাময় হন, সে-বিষয়ে হাতেকলমে যা জানা গিয়েছে তা সবাইকে বোঝানোর কাজটা তো নেতাদেরই।’ আরও অনেক বড় হাসপাতাল তৈরি করার চাইতে ৯৯৯ ডায়াল করে যে-পরিষেবা পাওয়া যায় তাকে উন্নত করলে, ছোট হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সি বিভাগকে উন্নত করলে উপকার হবে অনেক বেশি, তা কে বোঝাবে ব্রিটেনের আম-ভোটারকে?
কে-ই বা বোঝাবে বাংলার নাগরিককে? কল্পচক্ষে দেখার চেষ্টা করুন, বিধানসভায় নেতারা তর্ক করছেন, কী করে নবজাতকের মৃত্যু কমানো যায়। মহকুমা কি ব্লক স্তরে নবজাতক ইউনিট তৈরি করে তার যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্স জোগান দেওয়ার জন্য বিপুল খরচ (গত এপ্রিল মাসে সরকার ১৬১ জন শিশুবিশেষজ্ঞ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কেবল সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটগুলোর জন্য) করাই কি উচিত? নাকি নিচুতলার স্বাস্থ্য কর্মীদের দিয়ে মায়ের অপুষ্টি কমালে শিশুমৃত্যু দ্রুত কমত? না, বহু চিন্তা করেও ২৯৫টা মুখের মধ্যে থেকে একটা মুখ ভাবা গেল না যিনি বলবেন, আমার এলাকার হাসপাতালে এসএনসিইউ খোলার দরকার নেই, ভাল হাসপাতালে পৌঁছনোর রাস্তা আরও ভাল করুন।
নেতারা সব দেশেই সমান। ‘টপ-ডাউন প্ল্যানিং হঠিয়ে রোগীকে বেশি “চয়েস” দেওয়া, চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ, এই বদলগুলো আনা হচ্ছে এনএইচএস-এ। শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর কাছে “চয়েস” বড় কথা নয়। বড় কথা দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত রেফারাল,’ বললেন রুথ। নতুন ব্যবস্থা মানতে না-পেরে চাকরি ছেড়েছেন তিনি।
এ রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্তা, ডাক্তার, ফিল্ডকর্মীরা চাকরি ছেড়ে দেন না, তবে গা ছেড়ে দেন। যতই কাজ করো, কাজের কাজ হবে না, তা মনে মনে জেনে নিষ্প্রাণ, নিরর্থক কাজ করে যান। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী ছিল, আর ফল কী হল, তার কোনও মূল্যায়নও হয় না, কারও জবাবদিহিও চাওয়া হয় না। কেউ প্রশ্ন করতে গেলে উলটে ধমক খান— যা বলা হয়েছে করুন, অত জানার কী দরকার? শেষে শিশুমৃত্যু, প্রসূতিমৃত্যু, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গিতে মৃত্যু নিয়ে ফের প্রবল হইচই হলে নতুন একখানা প্রকল্প ঘোষণা হয়। উপরের চেয়ারে বসানো হয় নতুন লোক। ওতেই ভোট পাওয়া যায়।
কিন্তু নবজাতক, প্রসূতি বা স্ট্রোক-আক্রান্তের প্রাণ বাঁচানো যায় না। সীমিত টাকায় কী করে সেরা ফল দেওয়া যায় সর্বাধিক রোগীকে, সেটা জনমত ঠিক করতে পারে না। নেতা-নেত্রী কিংবা তাঁদের চামচে ডাক্তাররাও নয়। তার জন্য চাই সমীক্ষা-নিষ্কাশিত, পরীক্ষাসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যনীতি। আর চাই বুকের পাটা। জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও জনস্বার্থে কাজ করে যাওয়ার সাহস।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ জুন ২০১৩
ফ্রি পেতে গেলে কত দিতে হয়?
কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নইলে অনাদীশ বাগদিকে সাত দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা কেন খরচ করতে হল সরকারি হাসপাতালে? বছর পঁয়ষট্টির এই চাষি বিপিএল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক নিয়ে। ১০ জানুয়ারি। অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় ৫০০ টাকায় গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু। তার পর স্যালাইন, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, খরচ বেড়েই চলেছে। তবু বহু অনুরোধে বর্ধমানে রেফার করা আটকেছেন তাঁর ছেলে। আরও খরচ টানতে পারতেন না তাঁরা। লিভারের অসুখে আক্রান্ত অবনী সিংহের দশা আরও খারাপ। পনেরো দিনে প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে তাঁর, ওই সিউড়ি হাসপাতালেই।
অসুখ জটিল বলেই কি খরচ করতে হচ্ছে? তা-ও মনে হয় না। দশ মাসের প্রিয়ম সাহা কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫ জানুয়ারি, নেহাতই ডায়ারিয়া নিয়ে। দু’দিন ভর্তি থাকে ওই শিশু। স্যালাইন, ওষুধ মিলিয়ে চারশো টাকা খরচ করতে হয়েছে পরিবারকে।
এরা সকলেই দরিদ্র, সকলেই ভর্তি হয়েছিল সরকারি হাসপাতালের ফ্রি বেডে। তবু যে এমন খরচ, সে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গবেষণা তা বলছে না। অর্থনীতির শিক্ষক অরিজিতা দত্ত ও দিল্লির এক গবেষণা সংস্থার গবেষক মন্টু বসু তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কেমন, তা খতিয়ে দেখেছেন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য থেকে তাঁরা বলছেন, এ রাজ্যে গ্রামের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগীরা ওষুধের জন্য গড়ে খরচ করেন সাড়ে তিনশো টাকা। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রায় ৬০০ টাকা। সেখানে তামিলনাড়ুর গ্রামে ওষুধের গড় খরচ— প্রায় অবিশ্বাস্য— চার টাকারও কম। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার খরচ ২২ টাকা ৩৫ পয়সা। এ হিসেবও হল সব রকম সংগতির রোগীর জন্য। কেবল গরিব রোগীর কথা ধরলে (মাসিক ব্যয়ের নিরিখে চারটি ভাগ করলে, ‘গরিব’ হল সবচেয়ে নীচের এক-চতুর্থাংশ) তামিলনাড়ুতে গ্রাম কিংবা শহরে বাস্তবিক ওষুধের জন্য একটি টাকাও খরচ হয় না।
সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গরিবের ওষুধের খরচ ৩০২ টাকা, আর শহরে ১৯১ টাকা।
তা হলে কি ‘ফ্রি’ কথাটার মানে বুঝতেই পশ্চিমবঙ্গে ভুল হচ্ছে? তামিলনাড়ুতে ফ্রি চিকিৎসা মানে ওষুধ, টেস্ট, রক্ত, স্যালাইন সব ফ্রি, আর এ রাজ্যে ফ্রি চিকিৎসা মানে কেবল বেডটাই ফ্রি, সঙ্গে বড়জোর স্যালাইন আর দু’-চারটে ওষুধ-ইঞ্জেকশন?
এই গবেষণার পরিসংখ্যান অবশ্য কিছু পুরনো, ২০০৪ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে নেওয়া। তার পরে সরকার চিকিৎসার খরচ কমানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তা হল ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। অনাদীশ বাগদি তাঁর কিছু ওষুধ সিউড়ি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কিনেছিলেন। না হলে তাঁর খরচ আরও খানিকটা বেশি হত, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিনা পয়সায় হত না, সেটা নিশ্চিত। নানা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ করা গেল, এখন ফ্রি বেডের রোগীদের জন্য জরায়ু বাদ (হিস্টরেকটমি) দেওয়ার খরচ চার-পাঁচ হাজার টাকা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত (হেমাচুরিয়া) চিকিৎসার খরচ সাত থেকে দশ হাজার, রেডিয়োথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করতে লাগে ২৫-৩০ হাজার। এর মধ্যে ওষুধ-ইঞ্জেকশন, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন, রক্ত, মেডিক্যাল টেস্টের খরচ আছে, বাড়তি থাকতে পারে আয়ার খরচ, কারণ দু’জন নার্স প্রায়ই দেড়শো রোগীর ওয়ার্ড সামলান। সরকারি কর্তাদের যুক্তি, এ সব চিকিৎসা বাইরে করাতে গেলে পাঁচ-দশগুণ বেশি খরচ হত। সরকারি হাসপাতাল বলেই এত কমে মিলছে। কিন্তু ডিসকাউন্ট মধ্যবিত্তের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে, গরিবের কাছে হবে কেন? তার তো শূন্য খরচে পাওয়ার কথা ছিল। যেমন তামিলনাড়ুর গরিবরা পান। যে উদ্দেশ্যে গরিবের জন্য ভর্তুকি দেওয়া, সে যাতে খরচের ভয়ে চিকিৎসা এড়িয়ে না যায়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণে ডুবে না যায়, ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিলেও সে-উদ্দেশ্য ১০০ শতাংশ ব্যর্থ হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জন্য যা মন্দের ভাল, গরিবের জন্য তা পুরোই মন্দ।
এই ভুলটা স্পষ্ট হচ্ছে না, কারণ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের খরচের তুলনা করা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট হবে যখন এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সরকারি চিকিৎসার তুলনা করা হবে। কেন এ রাজ্যের হাসপাতালে ভর্তি গরিব রোগীদের ৫৮ শতাংশ ওষুধ পায়, তামিলনাড়ুতে ৯৮ শতাংশ? আমাদের ৫৪ শতাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল টেস্ট করান, আর ওদের ৮৮ শতাংশ? অথচ সেই ২০০৪ সালেও তামিলনাড়ুর ৯৭ শতাংশ সরকারি বেড ফ্রি ছিল। এ রাজ্যে তখন ফ্রি বেড মাত্র ৫৮ শতাংশ।
এখন অবশ্য জেলায় সব বেড ফ্রি। গত অক্টোবর মাসে তেমনই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে হাসব, না কাঁদব? অরিজিতা এবং মন্টুর গবেষণা দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গরিব রোগীদের ৮০ শতাংশই ভর্তি হন সরকারি হাসপাতালে, কিন্তু হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ সুযোগসুবিধের ২২-২৫ শতাংশ জোটে তাঁদের। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী, দুই শ্রেণি মিলে পাচ্ছে ভর্তুকির ৪৪-৪৫ শতাংশ সুযোগ। এই অনুপাত যদি না বদলায়, তা হলে ফ্রি বেড বাড়লে গরিবের চাইতে বিত্তবানের জন্য ঢের বেশি খরচ হবে সরকারের। গরিবের উপকার করতে চাইলে হয়তো ফ্রি বেডের সংখ্যা কমিয়ে, সেই সব বেডের রোগীদের জন্য ওষুধ, টেস্ট-এর ব্যবস্থা বাস্তবিক ফ্রি করা বেশি দরকার ছিল।
এমন গরিব-উপযোগী ব্যবস্থা যে নেওয়া হচ্ছে না, তা কি কেবলই গরিবের শেষ সম্বলটাও কেড়ে নেওয়ার কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের জন্য? তা হয়তো নয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, গরিবকে সুবিধে না-দেওয়াতে নানা লোকের নানা ছোট ছোট সুবিধে তৈরি হয়ে আছে। যে-দালাল দুশো টাকায় জোগাড় করেন বিপিএল সার্টিফিকেট, যে-কাউন্সিলর, বিধায়ক কলমের আঁচড়ে (বা ফোনের ধমকে) পেয়িং বেডকে ফ্রি করে প্রভাব দেখান, তাঁরা গরিবের মন্দ চান না। ডাক্তারও গরিব-বিদ্বেষী নন। কিন্তু সব বেড ফ্রি হলে তাঁর সুবিধে, এক বিভাগে রোগী উপচে পড়লে সহজেই অন্য বিভাগের বেড নিতে পারবেন। অ-গরিব রোগীর আত্মীয়দের সুবিধে, বেড ফ্রি হলে খরচ কমে, হ্যাপাও কমে। পেয়িং বেড হলে রোগীর তরফে কাউকে সারাক্ষণ হাজির থাকতে হবে, স্লিপ দিলেই ওষুধ, ইঞ্জেকশন, গজ-ব্যান্ডেজ জোগাতে হবে। হাসপাতাল থেকে এগুলো দিয়ে পরে দাম নেওয়ার নিয়ম নেই। তা ছাড়া, ‘সরকারি হাসপাতালে এসেছি, ফ্রি পাব না কেন,’ এই মনোভাবটাও কাজ করে। এত লোকের এত সুবিধের চাপে এমনিতেই পেয়িং বেডের সংখ্যা কমছিল। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর জেলা স্তর পর্যন্ত হাসপাতালে পেয়িং বেড ছিল বড়জোর ১০-২৫ শতাংশ। এবার সেটুকুও ফ্রি হয়ে গেল। তাতে ঝামেলা কমল ঠিকই, কিন্তু বেড ফ্রি করার সুবিধে কে পাচ্ছে, কে দেখতে যাচ্ছে?
এ কেবল স্বাস্থ্যের ছবি নয়। স্কুলশিক্ষাতেও ছবিটা কাছাকাছি। সম্প্রতি এ নিয়ে প্রকাশিত ‘অসর ২০১৪’ সমীক্ষায় প্রকাশ, এ রাজ্যে সরকারি স্কুলের প্রাথমিকে অর্ধেকেরও বেশি পড়ুয়া, উচ্চ প্রাথমিকে ৭৬ শতাংশ পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশন নিচ্ছে। সেখানে তামিলনাড়ুতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে টিউশন নেওয়ার অনুপাত ৬-৭ শতাংশ। এবং, এ রাজ্যে টিউশন ফি সে-রাজ্যের চাইতে বেশি। খরচ বেশি করে বাড়তি লাভ কী হচ্ছে? মাতৃভাষায় রিডিং পড়তে পারার ক্ষেত্রে গ্রামের পড়ুয়ারা এ রাজ্যে একটু এগিয়ে, কিন্তু অঙ্কে ওরা গোড়ায় পিছিয়ে থাকলেও পরে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজিতে আবার আগাগোড়াই ওরা এগিয়ে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, ইস্কুলে আমাদের পড়ুয়ারা যাচ্ছেই কম। সমীক্ষার দিন মাত্র ৫৬ শতাংশ পড়ুয়াকে ক্লাসে দেখা গিয়েছে। তামিলনাড়ুতে ক্লাসে ছিল ৮৭-৮৯ শতাংশ পড়ুয়া। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, যে-কোনও কারণেই হোক, এ রাজ্যে শিক্ষকদের কাছে ক্লাসে না-পড়ানোর সুবিধেটা বড় হয়ে উঠছে। ছাত্রের কাছেও টিউশনে গিয়ে পড়া বোঝা বেশি সুবিধেজনক মনে হচ্ছে।
এর ফলে অসুবিধেয় পড়ছে গরিব। যে-সম্পদ গরিবের জন্য বরাদ্দ, সে ওষুধপত্রই হোক আর মানবসম্পদ (শিক্ষক, ডাক্তার) হোক, গরিব তা পাচ্ছে না, কিংবা সামান্যই পাচ্ছে। কিন্তু গরিবের না-পাওয়া, আর তার ফলে সরকারের অপচয়ের হিসেবটা কষার চাড় নেই কারও। নেতারা আরও ফ্রি পণ্য, ফ্রি পরিষেবা ঘোষণা করতে চান। বিরোধীরা চেঁচান, অত দেবে বলেছিলে, দিলে মোটে এত! মিডিয়া খোঁজে, অত দিতে গিয়ে কত কার পকেটে গেল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গরিবকে ফ্রি পরিষেবা দেওয়ার চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজে। অনাদীশ বাগদিদের কী হল, কতটুকু পেল তারা, খোঁজ করতে ভুল হয়ে যায়।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
এখানে সস্তায় জরায়ু বাদ দেওয়া হয়
গরিবের জন্য খরচ হচ্ছে অঢেল। কিন্তু সে-টাকা গরিবের কাজে লাগছে কি? প্রশ্নটা ফের উসকে দিচ্ছে গরিবের স্বাস্থ্যবিমা। গরিব যাতে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত না হয়, তার জন্য বছর বছর স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম (পাঁচ জনের পরিবার-পিছু ৭৫০ টাকা) মেটাচ্ছে সরকার। বছর সাতেক আগে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা’ শুরু হওয়ায় এখন সরকারি বা বেসরকারি, যে-কোনও হাসপাতালে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা বিনা খরচে করাতে পারে গরিবরা। কিন্তু বিমার সুবিধে নিয়ে হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা হচ্ছে, তার নকশাটা সন্দেহজনক। অ্যাপেনডিক্স, গল-ব্লাডার, ছানি কাটার যত কেস দেখা যাচ্ছে, তার তুলনায় ম্যালেরিয়া বা ডায়েরিয়া অনেক কম। রোগীর চাহিদার চেনা নকশার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমায় চিকিৎসা জোগানের নকশার কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনই ছবি উঠে এসেছে বীরভূম থেকে, পরপর দু’বছরের তথ্য তুলনা করে। ২০১২ সালে চারটি ব্লকে বারো হাজারেরও বেশি বাড়িতে সমীক্ষা করে দেখা হয়েছিল, কতজন কী কী কারণে গত এক বছরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরের বছর (২০১৩) ওই বাড়িগুলির মধ্যেই ১৫০টিতে গিয়ে ফের দেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা কী কী কারণে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। এই দুইয়ের নকশায় বিস্তর ফারাক উঠে আসে। সেই নকশা সম্প্রতি তুলে ধরলেন দুই গবেষক, দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এর সুমিত মজুমদার এবং পশ্চিমবঙ্গের সোসাইটি ফর হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্র্যাফিক সার্ভেইলন্স-এর অনমিত্র বারিক। ‘জনস্বাস্থ্য এবং সরকারি নীতি’ নিয়ে ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’-য় (আইডিএসকে) দু’দিনের আলোচনায় তাঁরা পেশ করেন এই গবেষণা।
কী দেখছেন গবেষকরা? স্বাস্থ্যবিমার কার্ডে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, এমন চারশোরও বেশি রোগীর বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখছেন, নব্বই শতাংশ রোগীই ভর্তি হয়েছেন অস্ত্রোপচারের জন্য। অস্ত্রোপচারগুলির মধ্যে প্রধান হল ছানি কাটা, আর তারপরেই মেয়েদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া (হিস্টরেকটমি)। আরও চিন্তার বিষয়, যে সাতান্ন জন মহিলার জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আঠারো জনেরই (৩১ শতাংশ) বয়স চল্লিশের নীচে। ডাক্তাররা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত সহজে জরায়ু কেটে বাদ দিতে চান না। ছানি কাটার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, দশ জনে এক জনের বয়স পঞ্চাশের নীচে। অন্য যে প্রধান অস্ত্রোপচার, সেগুলো যথাক্রমে গল-ব্লাডার বাদ দেওয়া, হার্নিয়া-হাইড্রোসিল, অর্শ এবং অ্যাপেনডিক্স। প্রসঙ্গত, জরায়ু, অ্যাপেনডিক্স, আর গল-ব্লাডার, এই প্রত্যঙ্গগুলিকে ‘বাদযোগ্য’ বলা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। অর্থাৎ এগুলোকে বাদ দিলে স্বাস্থ্যের খুব বড় ক্ষতি কিছু হয় না। গরিবের স্বাস্থ্যবিমা আসায় এই তিনটিকেই বাদ দেওয়া জরুরি হয়ে উঠছে।
অথচ খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আগের রোগগুলোর। ২০১২ সালে যে সব অসুস্থতার কারণে লোকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান ছিল জ্বর, টাইফয়েড, পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া। কেবল বীরভূমের সমীক্ষাতেই নয়, গোটা দেশেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রধান কারণ নানা ধরনের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, রক্তসঞ্চালনে সমস্যা, দুর্ঘটনা বা হিংসাজনিত আঘাত। নানা বছরের জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ফল থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু বিমার স্মার্টকার্ডে এগুলোর প্রায় দেখাই মিলছে না। ‘তার মানে, এগুলোর জন্য ভরসা সেই সরকারি হাসপাতালের, নইলে হাতুড়ের,’ বলছেন সুমিতবাবু।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনার পরিসংখ্যানের প্রাথমিক বিশ্লেষণ করেছে। দেখা যাচ্ছে, অস্ত্রোপচারই নব্বই শতাংশ, জরায়ু বাদ দেওয়ার সংখ্যা অত্যধিক, যে সব ভাঙা হাড় প্লাস্টার করলে সেরে যেত তারও অস্ত্রোপচার হচ্ছে। ‘ইঙ্গিত উদ্বেগজনক,’ বলেন দফতরের এক কর্তা।
এত অস্ত্রোপচার কেন? মেদিনীপুর শহরের ২০ শয্যার একটি নার্সিংহোমের মালিকের উত্তর, ‘আমাদের বেড অল্প, ইমার্জেন্সি নেই। জ্বরজারি কেস ভর্তি করা যায় না।’ উলুবেড়িয়ার একটি হাসপাতালের মালিক অবশ্য আরও সোজাসাপটা, ‘ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়ার জন্য বিমা কোম্পানি যা টাকা দেয়, তাতে ওষুধের দাম উঠবে না। তার ওপর টিপিএ বারবার প্রশ্ন করবে, কেন ভর্তি করলেন? আউটডোরেই চিকিৎসা করলেন না কেন?’ পেট খারাপ, জ্বরের জন্য হাসপাতালের পাওনা স্রেফ বেড চার্জ। পড়তায় পোষায় না।
ওই দুই হাসপাতালেই জরায়ু বাদ দেওয়া স্বাস্থ্যবিমার কার্ডে একটি প্রধান অস্ত্রোপচার। মেদিনীপুরের ডাক্তারবাবুর বক্তব্য, বিমা কোম্পানি তো ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেই অনুমতি দিচ্ছে, তা হলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের অভিযোগ ওঠে কী করে? হাওড়ার ডাক্তারবাবু অবশ্য স্পষ্টই বলে দিলেন, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব বা শ্বেতস্রাবের চিকিৎসা অন্য ভাবেও করা যায়। তবে অনেক সময়ে রোগীর তরফ থেকেও ‘ঝামেলা শেষ’ করার চাপ থাকে। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলির বিষয়ে না বোঝালে জরায়ু অপ্রয়োজনেও বাদ যেতে পারে।
তার পরিমাণ কত? শিউরে ওঠার মতো কথা বললেন কলকাতার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়। ‘কান্দির এক ডাক্তার সেদিন বড়াই করে বললেন, এক মাসে ৪৫টা জরায়ু বাদ দিয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব? এক জন ডাক্তার সাধারণত তাঁর গোটা ডাক্তারি জীবনে ৪৫টা হিস্টরেকটমি করে উঠতে পারেন না,’ বললেন এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ডাক্তার।
একে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া গেলে ভাল হত। কিন্তু অন্য রাজ্যে এমন ইতিমধ্যেই ঘটেছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালে বিহারের সমস্তিপুরে স্বাস্থ্যবিমার অধীনে মোট ১৪,৮৫১ কেসের মধ্যে ৫৫০৩ ছিল জরায়ু বাদ দেওয়া।
রাজস্থানের দাউসা জেলা থেকেও অত্যধিক হিস্টরেকটমির নালিশ আসে। পেট ব্যথা, ঋতুচক্রে গোলমাল, যে-কোনও সমস্যা নিয়ে গেলেই জরায়ু বাদ দেওয়া হচ্ছে এটা প্রকাশ পেলে ২০১৩ সালের জুনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দুই জেলাশাসকের রিপোর্ট তলব করে। এ রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী দু’জনেই মহিলা। বিষয়টি নজর করছেন কি?
তার মানে এই নয় যে, স্বাস্থ্যবিমা গরিবের কোনও কাজে লাগে না। বীরভূমের সমীক্ষা বলছে, বিমার স্মার্টকার্ড ব্যবহার করলে গরিবকে সত্যিই পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে কম, গড়ে ৩৬৩৪ টাকা কম। এটা সামান্য কথা নয়। একটি হিসেব বলছে, অতি-দরিদ্র মানুষদের এক মাসে রোজগার যত টাকা, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে গড় খরচ তার দশ গুণ, বেসরকারিতে পঁচিশ গুণ। ঋণে ডুবে যাওয়া এড়াতে গরিবরা এত দিন হাসপাতাল এড়িয়ে চলে যে, তার পর আর ডাক্তারের বিশেষ কিছু করার থাকে না। প্রাণে মরা, নইলে ভাতে মরা, এই দুই থেকে গরিবকে নিষ্কৃতি দিতে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা শুরু হয়েছিল। এ রাজ্যের বিপিএল জনসংখ্যার প্রায় ষাট শতাংশ ইতিমধ্যেই এই বিমার আওতায় এসেছে। এখনও অবধি সাড়ে আট লক্ষেরও বেশি ‘কেস’ হয়েছে বিমার স্মার্টকার্ডে। নিঃসন্দেহে এমন অনেক অস্ত্রোপচার এর মধ্যে রয়েছে, যা বিমা না থাকলে করাতেন না গরিব মানুষ। ব্যথার ওষুধ বা নানা টোটকা-মাদুলির ভরসায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে, কোনও মতে বেঁচে থাকতেন।
অথচ যে ভাবে বিমার রূপায়ণ হচ্ছে তাতে বেশ কিছু ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। এক, স্বাস্থ্য দফতর থেকে স্বাস্থ্যবিমার প্রচুর তথ্য নিয়মিত ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে সবই হল ক’জন কার্ড পেল ক’জন ভর্তি হল, কত টাকা ক্লেম করে কত পেল, তার হিসেব। রোগীরা কী কী কারণে ভর্তি হচ্ছেন, কী চিকিৎসা পাচ্ছেন, তা জানার উপায় নেই। তাই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
দুই, গরিব জেলাগুলোতে নার্সিংহোম কম। যেমন, বর্ধমানে গরিবের স্বাস্থ্যবিমার নেটওয়ার্কে রয়েছে ৬৬টি হাসপাতাল, বাঁকুড়ায় ৩১ আর পুরুলিয়ায় ৯। এ থেকেই বোঝা যায় যে স্বাস্থ্যবিমা দিয়ে গরিবকে চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়ার বিপদ কোথায়। যে জেলা যত গরিব, বিমা কাজে লাগানোর সম্ভাবনা তার তত কম।
তিন, বিপুল অপচয় হচ্ছে। গরিবকে চিকিৎসা পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে নার্সিংহোমকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল, আর তা থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে ঝাড়গ্রাম নার্সিংহোম, দুটোই স্বাস্থ্যবিমার আওতায়। সরকারি সূত্রে খবর, চলতি অর্থবর্ষে হাসপাতাল ১৬টি কেস করে বিমা কোম্পানি থেকে পেয়েছে ৪০,৯১২ টাকা (গড়ে ২৫৫৭ টাকা); ঝাড়গ্রাম নার্সিংহোম করেছে ৪৯৫টি কেস, পেয়েছে প্রায় ২৫,১৪,০০০ টাকা (গড়ে ৫০৭৮ টাকা)। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার আক্ষেপ, জেলায় জেলায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি-হওয়া রোগীকে পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন সরকারি ডাক্তার। স্বাস্থ্যবিমা আছে, রোগীর চিন্তা কী? প্রাণে যদি বা বাঁচে, ঠকে মরবেই গরিব।