॥ সোমলতা ॥
শুঁটকি রাঁধছিস বুঝি? বেশ চনমনে গন্ধ!
না তো! আমরা শুঁটকি খাই না।
এঃ, নবাবনন্দিনী এলেন! শুটকি খান না! কেন, খেলেই তো পারিস। বেশ লঙ্কাবাটা, পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে মাখা-মাখো ঝাল গরগরে হবে। খাস না কেন?
গন্ধ লাগে
ইঃ, গন্ধ লাগে! শুটকির গন্ধ তবে কোথা থেকে পাচ্ছি?
পাশের বাড়িতে হচ্ছে বোধহয়।
ওরা খেতে পারলে তোর খেতে দোষ কী? অত ফুটুনি কিসের?
গন্ধটা কি আপনার ভাল লাগে?
আমি বিধবা না? ভাল লাগে বলতে আছে? পাপ হয়। তুই কী রাঁধছিস?
মাছ।
কী মাছ?
ফুলকপি দিয়ে কৈ।
কী ফোড়ন দিলি?
আমরা মাছে ফোড়ন দিই না।
তুই ছাই রান্না জানিস। পাঁচ ফোড়ন দিতে হয়।
আচ্ছা।
আর কাঁচা তেল দে, একমুঠো চিনি দে, একটু সোডা ফেলে দে। দেখবি কেমন স্বাদ হয়।
আচ্ছা।
যত পারিস মাছ টাছ খেয়ে নে। আর তো দু মাস।
আমার বুক কেঁপে উঠল। রান্নাঘরে খোলা দরজার ওপাশে পিসিমা দাঁড়িয়ে। একটু অন্ধকারমতো জায়গা। শুধু থানটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে বললাম, ওকথা কেন বললেন?
তুই যে বিধবা হবি।
আমার চোখ জ্বালা করে উঠল, বুকে ঢেউ ছিল। বললাম, পিসিমা! কেন এমন হবে?
হবে না কেন? শুধু আমিই জ্বলব, তুই জ্বলবি না?
আমি কী করেছি পিসিমা? কোন পাপ?
আমিই কোন পাপ করেছিলাম? তোর কি পেটে বাচ্চা এসেছে?
জানি না তো!
এলে সেটাও মরবে। বাচ্চার দরকার নেই। স্বামীর সঙ্গে শুবি না। আলাদা থাকবি।
আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। থানকাপড়টা অদৃশ্য হয়ে গেল। এত আনমনা ছিলাম যে মাছের ঝোলটা শুকিয়ে পুড়ে ঝামা হয়ে গেল। কেউ খেতে পারল না।
রাতে আমি আমার স্বামীকে বললাম, আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?
উনি অবাক হয়ে বললেন, ক দিন আগেও একথা জিজ্ঞেস করেছ। কেন বলো তো!
বলুন না।
না ভূত টুত কিছু নেই। তোমার কি ভূতের ভয় আছে?
কী জানি। হয়তো আছে।
তুমি তো শক্ত মেয়ে, তবে এই অদ্ভুত ভয়টা কেন?
ঠিক ভয় নয়। আপনাকে বোঝাতে পারব না।
উনি আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করে বললেন, কোনও ভয় নেই।
সেই রাতে আমরা খুব সুন্দরভাবে মিলিত হলাম। তারপর স্বামী ঘুমোলেন। আমি দুশ্চিন্তা নিয়ে ছটফট করতে লাগলাম।
উনি কখন আসবেন তার ঠিক ছিল না। তবে রাতে রান্নার সময়েই বেশি আসতেন। ভুল পরামর্শ দিতেন। মাছে বা মাংসে চুলের দলা, ছাই বা মরা টিকটিকি পাওয়া যেত প্রায়ই। বিছানায় প্রচণ্ড লাল পিঁপড়ের উৎপাত হওয়ায় কাড়তে গিয়ে দেখি, বিছানায় চিনির দানা ছড়ানো।
একদিন বললাম, এসব কী হচ্ছে পিসিমা?
হবে না কেন রে? আমি সংসারে কোন সুখটা পেয়েছি?
শুনেছি, আপনি এ সংসারের মাথায় ছিলেন!
তোর মাথা। গয়নার বাক্সখানা ছিল বলে খাতির করত। ওই জোরেই তো বাপের বাড়িতে ঠাঁই হল। নইলে ঝ্যাঁটা মেরে তাড়াত।
তাহলে আপনি এখন কী চান পিসিমা?
এখন চাই তোর স্বামী মরুক, তোর সন্তান না হোক, তুই বিধ্বা হ। তারপর তুইও মর। সবাই মরুক। দুনিয়াটা ছারখার হয়ে যাক। ঘরে ঘরে আগুন লাগুক।
মা গো!
কেন, খারাপ লাগছে শুনতে? মর মাগী, খারাপ কী রে? আমার মতো হলে বুঝবি চারদিকটা শ্মশান হয়ে না গেলে সুখ নেই।
দু মাসের মাথায় আমার স্বামী মারা গেলেন না।
পিসিমা একদিন আড়াল থেকে বললেন, কেমন লাগে রে?
আমি বললাম, কী কেমন লাগে?
পিসিমা লজ্জা মেশানো গলায় বলেন, আহা, ন্যাকা কোথাকার! বোঝে না যেন! ওই যে ওসব, যখন বরের সঙ্গে ওসব হয় টয়।
ছিঃ পিসিমা।
ইস্, একেবারে লজ্জাবতী লতা! কেন জানতে চাইলে দোষ হয় বুঝি? সাতে বিয়ে, বারোতে বিধবা। আমার কি আর তখন বোঝবার বয়স ছিল? যখন শরীর ডাকাডাকি শুরু করল তখন মাথার চুল মুড়িয়ে কেটে পাথরের থালায় একবেলা বিস্বাদ আলোচালের ভাত খাই। একাদশী করি। আমার জ্বালা তুই বুঝবি না। বল না কেমন লাগে।
ভাল।
দূর মাগী। ভাল তো সবাই জানে। খুলে বল না।
আমার লজ্জা করে পিসিমা।
তাহলে মর। মর মর মর মর।.এখনই মর।
ও মা গো! ওভাবে বলতে আছে?
একশবার বলব।
আমাদের অবস্থা পড়তির দিকে। ধীরে ধীরে পয়সার টান পড়ছে। খরচ বাড়ছে। আমার স্বামী একদিন বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এখন বোধহয় আমাদের কিছু করা উচিত। কি করব বলো তো!
ব্যবসা করুন না।
দোকানদারিই করব?
দোষ কী? আপদ্ধর্ম হিসেবে সবই করা যায়।
টাকা কোত্থেকে আসবে?
বিয়েতে আমি অনেক গয়না পেয়েছি। আপনাদের বাড়ি থেকেই পাওয়া। পিসিমা একটা হার দিয়েছিলেন, ভরি দশেক হবে। একজোড়া বালা আছে, পাঁচ ভরির কম নয়। হীরের আংটি আছে।
বলো কী? এসব বেচব?
না আপনি বেচবেন কেন? আমি বেচব। টাকা আপনাকে দেব।
তোমার কী থাকবে?
আপনি থাকবেন।
সেইদিন সন্ধেবেলা পিসিমা হাজির হলেন।
আমার আশীর্বাদী হারছরা বেচে দিলি?
হ্যাঁ পিসিমা।
কোন সাহসে? কুড়িকুষ্ঠ হয়ে পচে গলে মরবি যে।
মরতে চাই না বলেই তো বেচেছি।
বড় বউয়ের কী দশা করেছিলাম মনে আছে?
আছে।
তোরও ব্যবস্থা করব নাকি?
না পিসিমা। ক্ষমা করুন। আমাদের উপায় নেই। থাকলে কেউ সোনা বিক্রি করে?
তুই ছোটলোক বাড়ির মেয়ে, সব পারিস। বুড়ি ছুঁয়ে আছিস বলে তেমন কিছু করছি না।
বুড়ি ছুঁয়ে আছি? বুড়ি ছোঁয়া কাকে বলে?
ওরে, আমি বালবিধবা না হলে দেখতি বরকে আমিও কত ভক্তি করতুম। কিন্তু সেই অলপ্পেয়েটা তো বিয়ের সময়েই আধবুড়ো ছিল। তার ওপর কাশের রোগ। টক করে মরেই গেল।
ওরে, আমি বালবিধবা না হলে দেখতি বরকে আমিও কত ভক্তি করতুম। কিন্তু সেই অলপ্পেয়েটা তো বিয়ের সময়েই আধবুড়ো ছিল। তার ওপর কাশের রোগ। টক করে মরেই গেল।
বেঁচে থাকলে কী করতেন?
পিসিমা লজ্জা-লজ্জা গলায় বললেন, কত কী করতাম! অনেক সোহাগ করতাম, তোর মতো। সব সময়ে চোখে চোখে রাখতাম।
আমি হাসলাম।
উনি বললেন, আমার বিয়ের সময় সোনার ভরি ছিল কুড়ি টাকার মতো। এখন কত হয়েছে রে?
হাজার টাকা।
বলিস কী? তুই তো রাক্ষুসী! অত টাকা তোর সইবে? সোনার অভিশাপ আছে, তা জানিস? ও দোকান উচ্ছন্নে যাবে। এ বাড়ির ছেলেকে ব্যবসাদার বানালি? নরকে তোকে ময়লার বালতিতে চুবিয়ে রাখবে। তোর মরা ছেলে হবে, দেখিস।
আমার বুক ভীষণ কেঁপে উঠল। মাত্র কয়েক হাজার টাকা মূলধন নিয়ে আমার স্বামী দোকান দিলেন। দোকান দিতেই কত খরচ হয়ে গেল আসবাবপত্র কেনা, সাজানো গোছানোর খরচ সামলে মাল কেনার পয়সাতেই টান পড়ে গেল। কিছু ধার-দেনা করে কোনওরকমে দোকান সাজিয়ে বসলেন তিনি। কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই, হিসেবে ভুল করেন, বড়বাড়ির ছেলে হয়ে নানান ধরনের খদ্দেরের সঙ্গে বিনীতভাবে কথা বলতে তাঁর মর্যাদায় লাগে। তার ওপর চেনা লোক বা বন্ধুবান্ধবরা জিনিস নিয়ে দাম বাকি ফেলে রেখে যায়। একজন কর্মচারী রাখা হয়েছিল, সে এক মাস বাদে টাকা আর দশ-বারোখানা বেনারসী চরি করে পালিয়ে গেল।
উনি ভীষণ হতাশ হয়ে আমাকে বললেন, এ রকমভাবে চলবে না। পারছি। না।
আমি কিন্তু ভেঙে পড়লাম না। তেমন দুর্বিপাক হলে, মস্ত ক্ষতি হলে, পিসিমার একশ ভরির ওপর সোনার গয়না তো আমার কাছে আছে। দরকার হলে তাতে হাত দেব। তাতে বাঁচি মরি ক্ষতি নেই।
আমি বললাম, ব্যবসা মানেই ওঠা-পড়া। আপনি কিছু ভাববেন না। আমি তো আপনার পিছনে আছি।
তোমার সাধের গয়নাগুলো গেল।
আপনিই আমার সবচেয়ে বড় গয়না।
আমার স্বামী গম্ভীর মানুষ। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার এত বয়স অবধি ঠিক এভাবে আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমার ওপর তোমার এত ভালবাসা দেখে অবাক হই। কেন এই অপদার্থকে এত ভালবাসো বলো তো! আমার যে বড় আত্মগ্লানি হয়। আমি আজ বুঝতে পারছি, আমি কোনও কাজেরই নই, কোনও যোগ্যতাই নেই আমার।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, আপনি তবলা বাজানো তো ছেড়েই দিয়েছেন দেখছি। ওগুলোয় ধুলো পড়ছিল। আমি মুছে-টুছে রেখেছি। একটু তবলা বাজান না, মনটা ভাল হবে। আমি তানপুরা ধরছি।
এ প্রস্তাবে উনি খুব খুশি হলেন। অনেকক্ষণ তবলা বাজানোর পর ওঁর মনটা ভাল হয়ে গেল। বললেন, বেশ একটা মুষ্টিযোগ বের কঁরেছ তো!
ওঁকে ঘিরেই আমার জগৎ। আমি যে ওঁকে ভালবাসি তা ওঁর রূপের জন্যও নয়, গুণের জন্যও নয়। ভাল না বেসে থাকতে পারি না বলে বাসি। এই ভালবাসাটুকুই আমার প্রাণের পিদিমকে জ্বেলে রাখে। এসব আমি কাউকে বলতে পারব না। ওঁকেও নয়। আমার শ্বাসে-প্রশ্বাসে মিশে থাকে ওঁর চিন্তা, ওঁরই ধ্যান। আবার উনি আমার দিকে বেশি ঢলে পড়লেও আমি শঙ্কিত হয়ে উঠি। উনি যদি স্ত্রৈণ হয়ে পড়েন তা হলে পুরুষের ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হবেন। স্ত্রৈণ পুরুষকে কেউ সম্মান করে না, মূল্য দেয় না, তাদের ব্যক্তিত্বও থাকে না। এক-একদিন উনি দোকানে যেতে চান না, বলেন, আজ দোকান থাক। আজ তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে। আমি অমনি উঠে পড়ে বলি, তা হলে আমাকে গিয়ে দোকানে বসতে হবে।
এইভাবে নরমে, গরমে, শাসনে, সোহাগে মানুষটাকে নিরন্তর আমি ব্যস্ত রাখি। এঁরা বংশগতভাবে অলস, আয়েসি। একটু রাশ আলগা দিলেই নেতিয়ে পড়েন।
দোকান দেওয়ার ঘটনাটা এ বাড়ির কেউ ভাল চোখে দেখেননি। বিশেষ করে দুই শ্বশুর এবং ভাসুর। ছোটখাটো অশান্তি লেগে যেত প্রায়ই। শ্বশুরমশাই আমার স্বামীকে ডেকে বললেন, দোকান করা কোনও ভদ্রলোকের কাজ? তুই তো বংশের নাম ডুবিয়ে দিলি! ছিঃ ছি, পাঁচজনকে মুখ দেখাতে পারি না।
ভাসুরও খুব বিরক্ত। খেতে বসে প্রায়ই শোনাতেন, ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়াই কঠিন হয়েছে। বন্ধুরা টিটকিরি দিচ্ছে।
জ্যাঠাশ্বশুর খুব সরব নন, তবে মাঝে মাঝে বলেন, এ হল বৈশ্যবৃত্তি। পাতিত্য।
দোকানের পিছনে যে আমার হাত আছে এটা তাঁরা জানতেন। একদিন শাশুড়ি, আমাকে ডেকে বললেন, এঁরা তো সব তোমার ওপর খাপ্পা। কিন্তু আমি বাপু তোমাকে একটুও দোষ দিই না। ফুচু যে নড়াচড়া করছে, শরীরের আর মনের মরচে যে ঝরছে এতেই আমি খুশি। আজ বিকেলে বোধহয় তোমার সঙ্গে তোমার শ্বশুর এ নিয়ে কথা বলবেন। ঘাবড়ে যেও না।
কিন্তু ঘাবড়ে আমি গেলাম। শ্বশুর ভাসুরের সঙ্গে খুব সামান্যই কথা হয়। আমি কি বুঝিয়ে বলতে পারব?
দুপুরবেলাটা খুব আনমনা কাটছিল। একা ঘরে হঠাৎ কার উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে দেখি, ঘরের কোণে সেই থানকাপড়। অস্পষ্ট অবয়ব।
কী রে, এবার? মজা বুঝবি। তোর শ্বশুর রাগী লোক, আজ তোকে জুতোপেটা করবে।
আমি বললাম, করুক।
শোন, যা বলছি তা ঠিক ঠিক করলে বেঁচে যাবি।
কী করব?
তোর শ্বশুরের একটা গোপন খবর আছে। সেটা জানিস?
না তো!
ওর একটা রাখা মেয়েমানুষ আছে। তার নাম চামেলী। খালধারে থাকে। চামেলীর পিছনে অনেক খরচা করেছে। টাকাপয়সা সোনাদানা। শ্বশুর চোখ রাঙালে তুইও বলবি, চামেলীর কথা জানি। তা হলেই ঘাবড়ে যাবে।
আমি জানি এসব বনেদি পরিবারে কিছু বদ অভ্যাস থাকে। শ্বশুরের রক্ষিতা থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি চুপ করে রইলাম।
পিসিমা বললেন, কথাটা মানলি না বুঝি?
আমি ওসব বলতে পারব না।
তা পারবি কেন? আরও শুনবি? তোর বরেরও আছে, তার নাম কমলা। ভাবছিস তোকে নিয়ে রসে মজে থাকে? মোটেই নয়। তোর রূপেরই বা কী ছিরি, গুণেরই বা কী। ভাবছিস মাথাটা খেয়ে বসে আছিস? কচুপোড়া। ফাঁক পেলেই কমলার কাছে যায়।
আমি শিহরিত হলাম। দু চোখ জলে ভরে উঠল।
হঠাৎ শুনি পিসিমা কাঁদছেন, এ বাড়ির পুরুষরা কি কেউ কম? সব বদমাশ, সব কটা হাড়ে হারামজাদা। ওই তোর জ্যাঠাশ্বশুর, ভাসুর কেউ কম যায়? প্রত্যেকটার একটা-দুটো করে মাগী আছে, ঘরের বউ তো ডাল-ভাত। তাতে কি ওদের হয়? নিজেরা ফুর্তি করেছে, আর আমাকে গয়নার বাক্স খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে ঘরে। বোকা বলে ভুলেও থেকেছি। রামখেলাওন বলে একটা চাকর ছিল। তখন আমার সোমত্থ বয়স। শরীরে জোয়ার-ভাটা ডাক দিচ্ছে। রামখেলাওন ছিল সা-জোয়ান মানুষ। ধকধক করছে ডাকাতের মতো শরীর। শুনছিস?
বলবেন না পিসিমা, পায়ে পড়ি।
ইস, বড় সতী এসেছেন! কেন শুনবি না? ভাল করে শোন। শেষে সেই রামখেলাওনকে একদিন ইশারা করলাম। সে নিশুতরাতে এল। বিধবার সব ধর্ম ভাসিয়ে দিয়ে সেদিন ইচ্ছেমতো পাপ করার বাসনা ছিল। আগুন জ্বলছিল শরীরে। বাঘিনীর মতো বসে আছি খাপ পেতে। ঠিক সেইসময় বোকা লোকটা শেষ সিঁড়িতে পা হড়কে আছাড় খেল। তারপর সে কী কাণ্ড! তোর জ্যাঠাশ্বশুর আর শ্বশুর মিলে কী মার মারল লোকটাকে। মেরে তাড়িয়ে দিল। শুদ্ধাচারী বালবিধবা বোন উপোসী রয়ে গেল। আর ওরা পরদিনই কানে আতর গুঁজে গেল রাখা মেয়েমানুষের কাছে। শুনছিস?
শুনছি পিসিমা।
কাঁদছিস বুঝি? খুব কাঁদ, প্রাণভরে কাঁদ। তোর বুকে লঙ্কাবাটার জ্বলুনি হোক। যদি বাঁচতে চাস আজই শ্বশুরের মুখের ওপর বলবি, আমি চামেলীর কথা জানি। বুঝেছিস?
পারব না পিসিমা।
তা হলে মর, মর, মর, মর, এখনই মর। তোর কুড়িকুষ্ঠ হোক। তোর বাপ মা মরুক, ভাই বোন মরুক, বেটা-বেটি মরুক।
চোখের জলে আমি ভাসছিলাম। বুকে পাষাণভার।
জ্বলছিস তো! এবার ওদেরও মুখে নুড়ো জ্বেলে দে। রগড়ে দে। সংসারে আগুন লাগা। শ্বশুর, ভাসুর, বর সব কটাকে মুখে জুততা ঘষে দে। মরুক, ওলাউঠা হয়ে মরুক, গলিত কুষ্ঠ হোক। শুনছিস তো!
জবাব দিতে পারলাম না।
আমার মতো জ্বলুনি যেদিন হবে সেদিন বুঝবি।
সন্ধেবেলা নীচের বৈঠকখানায় সবাই বসলেন। শাশুড়ি এসে ডাকলেন আমাকে, এসো বউমা। ডাকছে। মাথা ঠাণ্ডা রেখো।
বুকটা বড় ভার ছিল সেদিন।
শ্বশুরমশাই গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ছোটো বউমা, বোসো। কথা আছে। বেশ গুরুতর কথা।
আমি বসলাম না। দরজার পাশটিতে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
শ্বশুরমশাই বললেন, এইসব দোকান-টোকান দিয়ে আমাদের যে বংশের বড় অপমান হয়ে যাচ্ছে। এটা তো মোটেই সম্মানজনক ব্যাপার হয়নি। আমাদের বংশের ছেলে সামান্য দোকানদার হবে এটা কেমন কথা?
আমি চুপ করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
জ্যাঠাশ্বশুর বললেন, আমরা এও শুনেছি বিয়ের সময়ে তোমাকে যে সব গয়না যৌতুক দেওয়া হয়েছিল সেগুলি বেচেই দোকান করা হয়েছে। গয়নাগুলো হল তোমার গুরুজনদের দেওয়া আশীর্বাদ। তুমি আশীর্বাদের মূল্য দাও না? গয়না বিক্রি করায় যে তাঁদের অপমান হল!
ভাসুর বললেন, দোকানই বা দিতে হবে কেন? অন্য সব ব্যবসা তো আছে। দোকানে ক’পয়সাই বা আয়? এই তো শুনলাম, এক মাসেই বহু টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে। কর্মচারী চুরি করে পালিয়েছে।
শ্বশুরমশাই বললেন, তোমার বক্তব্যও আমরা শুনতে চাই। যুগ পাল্টে গেছে। আগে বাড়ির বউ-ঝিদের মতামতকে মূল্য দেওয়া হত না। আজকাল কাদের মুখ ফুটেছে। তুমি বলো।
আমি কোনও কথাই বললাম না। ওঁরা এখন উত্তপ্ত হয়ে আছেন। আমার কানও কথাই ওঁদের গ্রহণযোগ্য মনে হবে না।
শ্বশুরমশাই বললেন, রসময়ীর (পিসিমার নাম) গয়নাগুলো চুরি যাওয়াতে আমরা একটু মুশকিলে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু এসব কেটে যাবে।
আমি বুঝলাম না, এ পরিবারের আর্থিক সংকট কিভাবে কাটবে বলে উনি মনে করেন। খুব মৃদুস্বরে এবার আমি বললাম, গত মাসে চালের আর তেলের দাম বেড়েছে। বাজারের বরাদ্দ কমেছে। মুদির দোকানে দু মাসের ধার জমে আছে।
ওসব জানি। পাকিস্তানে আরও কিছু জমি আর একটা পুকুর শিগগিরই বিক্রি হয়ে যাবে। ও টাকা এলে আর চিন্তা নেই।
আমি ঘরে চলে এলাম। একটু বাদে আমার স্বামীও এলেন। আমাকে বললেন, ওদের মত হল দোকানটা বিক্রি করে দেওয়া।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, কাল থেকে দোকানে আপনার বসবার দরকার নেই। আমি বসব।
তুমি! বলে তিনি হাঁ করে রইলেন।
আমি ওঁর মুখের দিকে সজল চোখে চেয়ে বললাম, আপনাকে আজ আমার আর একটা কথা বলার আছে। অভয় দিলে বলব।
উনি অবাক হয়ে বলেন, বলো না।
আপনি কি অন্য কোনও মেয়েকে ভালবাসেন?
কী বলছো?
তাঁর নাম কি কমলা?
উনি যেন কুঁকড়ে গেলেন। এত অসহায় দেখাল লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষটিকে! আমি বললাম, শুনুন, সংকোচ করবেন না। যদি কমলাকে আপনার প্রয়োজন হয় তা হলে আপনি ওঁকে বিয়ে করে ঘরে আনুন। আমি সতীন সহ্য করতে পারব।
উনি বিছানায় বসে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। লজ্জা!
আমি দু চোখে ধারা বিসর্জন করতে করতে বললাম, গোপনে তার কাছে যাওয়ার দরকার নেই। গোপন যেখানে ঘৃণা, লজ্জা, ভয়ে সেইখানেই দুর্বলতা, সেইখানেই পাপ। আপনাকে সে পাপ আমি করতে দিতে পারি না।
উনি অনেকক্ষণ মুখ ঢেকে বসে রইলেন। তারপর বিষণ্ণ, লজ্জাতুর মুখখানা তুলে বললেন, তোমাকে কমলার কথা কে বলল?
সেটা কি খুব জরুরি?
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বিয়ে করার প্রশ্ন ওঠে না। তুমি আসার পর তার কাছে আমি খুব কমই যাই।
শুনুন, অপরাধ নেবেন না। আপনি যাতে ভাল থাকেন আমি তাই চাই। সবচেয়ে বড় কথা, আপনাকে নিয়ে আমি গৌরব করতে চাই। আপনিই তো আমার অহংকার। আপনি কিছু গোপন করবেন না। এটুকু জানবেন, আপনাকে খারাপ ভাববার সাধ্যই আমার নেই।
তুমি আমাকে ঘেন্না করছ না?
একটুও না। আপনি দয়া করে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন না। নত হবেন না।
উনি বিস্ময়ভরে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, আমার বিশ্বাস হয় না।
কী বিশ্বাস হয় না?
তোমাকে রক্তমাংসের মানুষ বলে।
ওকথা বললে আমার পাপ হয়। তার চেয়েও বড় কথা আপনি নিজেকে সবসময়ে অপরাধী ভাবতে ভাবতে ছোট হয়ে পড়বেন।
উনি আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা হলে তোমাকে বলি, আমাদের দোকানের কর্মচারী ধীরেন টাকাপয়সা চুরি করে পালিয়েছে বটে, কিন্তু বেনারসীগুলো সে নেয়নি।
কে নিয়েছে? কমলা?
হ্যাঁ, একদিন দোকানে এসে নিয়ে গেল। এখন আর উদ্ধার করা যাবে কি?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। কুড়িটা বেনারসীর এমন কিছু দাম নয়। কমলা এটুকু পেতেই পারে। যদি তাকে বিয়ে করেন তা হলে সে তো আরও অনেক পাবে।
উনি জিব কাটলেন, বিয়ের কথা তুলছ কেন?
তা হলে কী ধরে নেব?
যা হয়েছে তা আর হবে না।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, পুরুষেরা চঞ্চলমতি, বহুগামী হয়। আপনি যদি আবার ও কাজ করেন তা হলেও কিছু মনে করব না। শুধু কথা দিন, আমার কাছে গোপন না থাকে।
উনি মূক বিস্ময়ে শুধু মাথা নাড়লেন। ওঁর চোখে একটা ভয় বা আতঙ্ক দেখা দিল। উনি আমাকে স্বাভাবিক স্ত্রীলোক বলে ভাবতে পারছেন না আর।
কিন্তু আমি জানি আমি খুব সাধারণ স্ত্রীলোক। আমি শুধু এই সংসার থেকে আমার পাওনাটুকুই কুড়িয়ে নিতে চাই আমার আঁচলে। বিরুদ্ধতা থাকবে, অদৃশ্য শত্রু থাকবে, দুর্বিপাক থাকবে, দৈব থাকবে, তার ভিতর দিয়েই তো যেতে হবে। বুদ্ধিভ্রংশ হলে তো চলবে না। আমি যদি কমলাকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে ঝগড়া অশান্তি করতাম তা হলে ওঁকে পেতাম কী করে? বরং আহত পৌরুষ, অপমানিত অহং আরও শক্ত হত। উনি জেদ করে কমলার কাছে আরও যেতেন। জ্বলেপুড়ে আমি খাক হতাম। তার চেয়ে আমি ওঁর দরজা খোলা রাখলাম। উনি ইচ্ছে করলেই অন্য মেয়েমানুষের কাছে যেতে পারবেন। কিন্তু ওঁর আর যাওয়ার ইচ্ছে হবে না।
সেদিন সারারাত বারবার আমার ঘুম ভাঙল, আর আমি শুনতে পেলাম, পিসিমা আমার ঘরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে কেবল বলছেন, মর, মর, মর, মর, মর, মর···বিধবা হ···বিধবা হ···কুড়িকুষ্ঠ হোক···
আমি শ্বশুর ভাসুরদের কথার প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আমি আমা স্বামীকে প্ররোচিত করতে পারলাম। বললাম, শুনুন, দোকানে আপনি না গেলে আমি যাব। সম্মান রাখতে গেলে আগে বাঁচতে হবে।
উনি বললেন, ঠিক আছে। আমিই যাচ্ছি।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনাকে একা দোকানের ভার দিলে আপনি হয়তো অস্বস্তিতে পড়বেন। আমিও থাকব আপনার সঙ্গে।
বাড়ির লোক কী বলবে?
ওঁরা কয়েকদিন বলবেন। তারপর আর বলবেন না। সয়ে নেবেন। দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে ওঁরাও তো দেখছেন। মুখে প্রতিবাদ করলেও দোকান থেকে যদি আমরা লাভ করতে থাকি তা হলে ওঁরা একদিন সমর্থনও করবেন।
তুমি বলছ! তুমি কখনও বোধহয় ভুল বলল না। ঠিক আছে, তাই হবে।
ভাবালুতা আমার নেই। আমার আছে ভয়, আছে উদ্বেগ, আছে বাস্তব জগৎ থেকে যতখানি পারা যায় বেঁচে থাকার খুঁটিগুলি খুঁটে তুলে নেওয়ার চেষ্টা। আমরা দুজনে যখন দোকান আগলে বসতে লাগলাম তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, ওঠা-পড়ায়, লাভ-লোকসানে আমাদের মধ্যে সত্যিকারের ভালবাসা হল। এল বিশ্বাস, নির্ভরতা, পরম্পরকে আরও শ্রদ্ধা করা।
উনি হিসেব রাখতে হিমসিম খান, স্টকের খোঁজ রাখেন না, ধারে মাল দিয়ে দেন। যতদিন কর্মচারী ছিল ততদিন তার ওপরেই নির্ভর করতেন। তাই মাত্র ক’দিনেই দোকানটার বড় দুর্দশা হয়েছে। হিসেব আমিও রাখতে জানি না, স্টক মেলানো কাকে বলে তাও কি জানতাম? কিন্তু সন্তান-লালনের কিছু না জেনেও একজন মেয়ে যখন প্রথম মা হয় তার কি আটকায়? দোকান ছিল আমার সন্তানের মতো। ওঁকে সেটা বোঝাতে আমার একটু সময় লেগেছিল। আরও একটু সময় লেগেছিল গা থেকে জমিদারির ধুলো ঝেড়ে ফেলে শ্রমিকের মতো পরিশ্রমী করে তুলতে। দোকান লাভ দিতে শুরু করল।
এ শহরের পাইকারদের কাছ থেকে মাল কিনলে লাভ বেশি হয় না। কিন্তু কলকাতার বড়বাজার বা মংলাহাট থেকে কিনলে অনেক বেশি লাভ হয়। আমার স্বামীকে সেটা বুঝিয়ে বলে রাজি করালাম। অলস এবং ঘরকুননা লোকটি রাজি হচ্ছিলেন না। প্রথম দুবার আমি সঙ্গে যাই। এরপর উনি একা যেতে লাগলেন।
প্রতিদিন মানুষের রুচি পাল্টায়, এক-এক বছর এক-এক রং বা ডিজাইনের ভীষণ চাহিদা হয়, বুদ্ধি করে ফাটকা খেলতে হয়। আমরা সেসব মাথায় রেখে মাল কিনতাম। লাভ বাড়তে লাগল।
একদিন শ্বশুরমশাই সন্ধের পর অপ্রত্যাশিত দোকানে হানা দিলেন। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় চাদর, হাতে ছড়ি, পায়ে নিউ কাট। চারদিকে তাচ্ছিল্যের চোখে একটু তাকিয়ে দেখলেন। দোকানে তখন খদ্দেরের বেশ ভিড়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাটা দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেলেন।
এলেন আবার কয়েকদিন বাদে। আমি বসতে চেয়ার এগিয়ে দিলাম। বসলেনও।
বেশ বিক্রি দেখছি।
আপনাদের আশীর্বাদে হয়।
আমি আশীর্বাদ করিনি তো বউমা। আমি তো অভিশাপই দিই। আমার কোনওটাই ফলে না। পাপী লোক তো।
চুপ করে রইলাম।
উনি বললেন, আমাদের কথা অমান্য করেছ, সেটা ভাল করোনি। কিন্তু তুমি যা করো তা শেষ অবধি ভালই হচ্ছে দেখছি। মাসে কত আয় হচ্ছে?
দু-চার হাজার হবে।
সে তো অনেক টাকা!
ওঁর পৌরুষে এবং আত্মসম্মানে লাগবে বলেই আমি বললাম না যে, পাকিস্তান থেকে ওঁদের জমি আর পুকুর বিক্রির টাকা আজও আসেনি, বিক্রি করার মতো সোনাও আর নেই, তবু সংসার যে চলে যাচ্ছে তা তো ম্যাজিকে নয়। বলার দরকারও ছিল না। উনি সেটা জানেন। জানেন বলেই দোকানটা দেখতে আসেন আজকাল।
ওঁর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসিটা ছিল না। ওঁর চোখের সামনেই দু হাজার টাকায় দুটো বিয়ের বেনারসী বিক্রি হয়ে গেল।
উনি নড়েচড়ে বসে বললেন, আচ্ছা বউমা, ও দুটো বেনারসী থেকে তোমাদের কত থাকল?
আমি লাজুক হাসি হেসে বললাম, বেনারসীর দাম, তার সঙ্গে গাড়িভাড়ার একটা ভগ্নাংশ, দোকানের ভাড়া, বিজলির খরচ, কর্মচারীর মাইনে এসবে এক একটা গড় করে যোগ দিয়ে তবে দাম ফেলতে হয়।
উঃ, সে তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! এত হিসেব করো কী করে? আমরা বরাবর মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়ে দিয়েছি, গুনেও দেখিনি। এটা তো দেখছি ছোটলোকের কাজ!
আমি মৃদুস্বরে বললাম, ও দুটো শাড়ি থেকে আমাদের ছশো ত্রিশ টাকা লাভ হয়েছে।
উনি যেন একটু চমকে গিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, ছশো ত্রিশ! মাত্র দুটো বেনারসীতে!
বিস্ময়টা নিয়ে উনি বেশ চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন।
আরও কয়েকদিন পর উনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সকালে তোমাকে খুব তাড়াহুড়ো করে দোকানে যেতে হয় দেখেছি। শোনো, সকালে তো আমি ফ্রি থাকি। আমিই গিয়ে ফুচুর সঙ্গে বসবখন।
শুনে আমি ভয় পেলাম। ওঁর জমিদারি মেজাজ। হয়তো খদ্দেরদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন না। বললাম, আপনি কেন কষ্ট করবেন? ওখানে আপনাকে মানায় না।
উনি একটু হাসলেন, ভয় পেও না। ব্যাপারটা আমাকে একটু বুঝতে দাও। ভেবে দেখেছি, ভগবান মগজ বলে যে জিনিসটা দিয়েছিলেন সেটা কোনও কাজেই তো লাগালাম না। বুড়ো বয়সে একটু মগজের জড়ত্ব ছাড়ানোর চেষ্টা করে দেখিই না।
আমি আর বাধা দিলাম না। উনি গেলেন। আমার স্বামী ফিরে এসে দুপুরে আমাকে বললেন, কী কাণ্ড! বাবা সব শাড়ির দাম বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছিল। দুজন খদ্দের ভেগে গেছে। বাবাকে পাঠালে কেন? উনি তো খেতে পর্যন্ত এলেন না। বললেন, তুই খেয়ে আয়, তারপর আমি যাব।
উনি জোর করে গেলেন। থাক, বাবাকে আপনি এ নিয়ে কিছু বলবেন না। উনি লাভ বাড়াতে চাইছেন। প্রথম প্রথম ওরকম হয়।
আমি আর আমার স্বামী এ নিয়ে একটু হাসাহাসি করলাম।
আমার স্বামী দোকানে ফিরে যাওয়ার পর শ্বশুর এলেন। অত্যন্ত উত্তেজিত, ঘর্মাক্ত, মুখ চোখ ঝলমল করছে। এসেই বললেন, বউমা, এসব তোমার কর্ম নয়। আমি আজ সাতটা শাড়ি বিক্রি করে এলাম। সব কটা চড়া দামে। একটা শাড়ির কোণে পেনসিলে লেখা ছিল পঞ্চাশ টাকা। কী করলাম জানো? পঞ্চাশের আগে একটা এক বসিয়ে দিলাম। সেই শাড়ি দেড়শ টাকাতেই বিক্রি হয়ে গেল। বুঝলে? বাড়তি একশ টাকা লাভ।
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। দোকানের সুনাম সবে হচ্ছে। খদ্দের যদি শাড়িটা যাচাই করে তা হলে ফিরে এসে হয় ঝগড়া করবে, নয়তো ফেরত দিতে চাইবে। ভবিষ্যতে দোকানের ছায়াও মাড়াবে না। কিন্তু শ্বশুরকে সেটা বোঝানোর সাধ্য কী? উনি নতুন খেলনা পেয়ে শিশুর মতো উৎফুল্ল উত্তেজিত। শাশুড়ির কাছে ফলাও করে দোকানদারির গল্প করতে লাগলেন। নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল।
শাশুড়ি আড়ালে ডেকে বললেন, তোমার দোকান এবার লাটে উঠবে।
আমি হাসলাম।
উনি বললেন, ভাল চাও তো শ্বশুরের দোকানের নেশা ছোটাও।
আমি বললাম, থাক। সামলে নেব।
পরদিন দুজন খদ্দেরের সঙ্গে শ্বশুরের তুমুল বচসা হয়ে গেল দাম নিয়ে। তারা দুঁদে খদ্দের। বলেছিল, কয়েকদিন আগেই তারা যে শাড়ি সত্তর টাকায় এ দোকান থেকে কিনেছে তা তিন দিনের তফাতে একশ সত্তর হয় কী করে? এ তো চোরের দোকান। শুনে শ্বশুর আস্তিন গুটিয়ে তাদের মারতে উঠলেন। আমার স্বামী মাঝখানে পড়ে ঠেকালেন।
দুপুরে শ্বশুর বাড়িতে এসে তুমুল আস্ফালন করে বললেন, এইজন্যই তো বলি দোকানদারি হল ঘোটলোকেরই কাজ। যেসব লোক আমাদের জুতো বইবার যোগ্যতা রাখে না তারাও এসে চোখ রাঙায়?
শাশুড়ি বললেন, তা হলে তোমার দোকানে যাওয়ার দরকারটা কী? চিরকাল শালগ্রাম শিলা হয়ে থেকেছ, এখনও তাই থাকে না। সংসার তো চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
উনি রেগে উঠে বললেন, কেন, আমি কি পারি না?
কোনও দোকানদার যদি তোমাকে অপমান করে তা হলে তুমি কি আর তার দোকানে যাও?
দোকানদার অপমান করবে? আমাকে? কার ঘাড়ে কটা মাথা?
তা হলেই বোঝো, দোকানদারের অপমান খদ্দের হজম করে না। তার আরও দশটা দোকান আছে।
আমারও আরও দশটা খদ্দের আছে।
না, তা নেই। একজন খদ্দের অপমান হয়ে গেলে ঠকে গেলে, আরও দশটা খদ্দেরও কেটে পড়ে। তুমি কি ভাবে দোকানদারি মানেই হল কম দামে কিনে বেশি দামে বেচা? তা হলে তো ভালই ছিল।
শ্বশুর গুম হয়ে রইলেন। কিন্তু পরদিন থেকে তিনি দোকানে যেতেন বটে, কিন্তু আর কোনও ঝামেলা করতেন না। বরং বুড়ো বয়সে তিনি নতুন করে জিনিসের দাম ফেলার হিসেব শিখতে লাগলেন মন দিয়ে।
একদিন বললেন, দেখো বউমা, লোকে দরাদরি করতে ভালবাসে। দু টাকা দাম কমাতে পারলে মনে করে মস্ত জিত হল। তোমার ফিক্সড প্রাইসের দোকানে সেই সুখ নেই। আমি বলি কী, তুমি বাঁধা দরের সিস্টেমটা তুলে দাও। দাম একটু বাড়িয়ে রাখো, দরাদরি করে খদ্দের ওটুকু কমিয়ে নেবে আর খোশমেজাজে জিনিস নিয়ে যাবে।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, সেটা তো ঠিক কথা।
উনি খুশি হয়ে বললেন, তা হলে কাল থেকে তাই করব তো?
করুন না। তবে মুশকিল হল, অনেকেই জেনে গেছে এ দোকানে বাঁধা দরে জিনিস বিক্রি হয়। কাজেই কেউ দর করবে না, দু-একজন নতুন খদ্দের ছাড়া।
উনি ভাবিত হয়ে বললেন, তাই তো! তা হলে তো সমস্যা দেখা দেবে।
উনি নিজে থেকেই পরিকল্পনাটা ত্যাগ করলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর থেকে শ্বশুর সকাল বিকেল দু বেলাই দোকানে যেতে লাগলেন। বলতে নেই, উনি চমৎকার চালাতে লাগলেন ব্যবসা। আমাকে মাঝে মাঝেই বলতে লাগলেন, না, এ কাজে বেশ থ্রিল আছে। সারাটা দিন বেশ কেটে যায়, পাঁচটা লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়, নিত্যনতুন মানুষ দেখি। নাঃ, সত্যিই একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
আমার জা ওপর থেকে নামেন না। বাতের ব্যথা, ব্লাডপ্রেশারে শয্যাশায়ী। সম্ভবত ঘটনার বছরখানেক পরেও উনি আমার সম্পর্কে ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমি তাই ওপরে যেতাম না। ভাসুর আমার জায়ের খাবার বয়ে নিয়ে দিয়ে আসতেন। আমার সঙ্গে ওঁর দেখাই হয় না।
একদিন সন্ধেবেলায় উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন।
গেলাম। উনি আমার দিকে না-তাকিয়ে দেয়ালের দিকে চোখ ফিরিয়ে রাখলেন। বললেন, অপরাধ নিও না। একটা কথা বলতে চাই। না বলে উপায় নেই।
আমি ঘরে ঢুকিনি। দরজার চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পাছে উনি ভয় খান। বললাম, বলুন।
আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। আমার স্বামীর হাতে পয়সা নেই। ঘরে সোনাদানাও নেই যে বেচব। আমাদের আর চলছে না।
আমাকে কী করতে বলেন?
তোমাকে কী আর বলব? আমাকে বাণ মেরে অকেজো করে রেখেছ। মারোনি, সে তোমার দয়া। কিন্তু এখন আর মরতে আমার ভয় নেই। বিছানায় শুয়ে বেঁচে থাকাও যা, মরাও তাই।
আমি বাণ মারতে জানি না।
উনি আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ভাতে মারোনি, সেও তোমার দয়া। তন্ত্রমন্ত্র জানো, মারণ উচাটন বশীকরণ জানো, তোমার অসাধ্য কিছু নেই। শুনেছি, নিজের শ্বশুরকে দোকানের কর্মচারী বানিয়ে রেখেছ।
ভুল শুনেছেন।
আমি তর্ক করতে চাই না। তুমি ইচ্ছে করলে আরও অনেক কিছু করতে পারো। সংসার ছারখার করতে পারো। সবই মানছি। কিন্তু ভয় পেলে আমার চলবে না। তাই বলছি।
একটু খুলে বলুন দিদি।
বলতে ভয়ও করছে। তবু জানতে চাইছি, সেই গয়নার কি সবটাই বেচে দিয়েছ?
একথা কেন?
মস্ত দোকান করেছ শুনলাম। অনেক টাকার ব্যাপার।
দোকান আমার গয়না বেচে করেছি। আমি আর কারও গয়নার কথা জানি না।
আমি তো ভাগ চাই না। রাগ করছ কেন? আমি ভিক্ষে চাইছি। যদি কিছু অবশিষ্ট থেকে থাকে তা হলে দয়া করে আমাকে কিছু দাও।
আমি জানি ভয়ের চেয়েও লোভের জোর বেশি। লোভ মানুষকে ভয় টপকাতে শেখায়, জয় করতে শেখায় না। আমার জা আমাকে যমের মতো ভয় পান, কিন্তু লোভ সামলাতে পারছেন না।
উনি চোখের জল মুছছেন বারবার। বললেন, যা করলে তার বিচার ভগবান করবেন। কিন্তু আমাদেরও কিছু পাওনা ছিল, এটা ভুলে যেও না। আমার স্বামী খুব লজ্জার মধ্যে আছেন। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না তোমাকে। ওঁর বড় অভাব। আমার চিকিৎসা অবধি বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
ওঁর বয়স তত বেশি নয়। উনি ইচ্ছে করলেই তো রোজগার করতে পারেন।
রোজগার করবে? কিভাবে করবে?
আগে ইচ্ছেটা তো হোক।
উনি হঠাৎ আমার দিকে এক পলক তাকালেন। মরিয়া হয়েই বোধহয়। সেই চোখে আমি এক পলকে গভীর ঘৃণা, বিতৃষ্ণা আর ভয় এক সঙ্গে দেখতে পেলাম।
উনি মুখটা আবার ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, উনি লেখাপড়া বিশেষ শেখেননি। ম্যাট্রিক পাশকে কে চাকরি দেবে? আমাদের গয়নার বাক্সও নেই যে দোকান দিয়ে বসব। ইচ্ছের কথা বলছ? ওঁর ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। মনমরা হয়ে থাকেন সবসময়ে। কেবল বলেন, ফুচু কেমন দাঁড়িয়ে গেল, কত পয়সা হচ্ছে ওদের, আর আমাদের শুধু কোঁচার পত্তন। তাই বলছি, আজ আমাদের কিছু ভিক্ষে দাও।
উনি কী করতে চান?
কিছু একটা করবেন। কী করবেন তা জানি না। বলে একটু চুপ করে থেকে গলাটা এক পর্দা নামিয়ে বললেন, ধুতরো বাটা খাইয়ে পিসিমাকে মেরেছ, গয়নার বাক্স নিয়েছ, তবু আমি সে কথা কাউকে বলিনি। বিষবিছের মতো চেপে রেখেছি নিজের বুকে। আমার প্রতি তোমার একটু কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত।
ধুতরো বাটা খাইয়েছি একথা কে আপনাকে বলল?
উনি যেন এ প্রশ্নে একটু ভয় খেয়ে বললেন, রাগ কোরো না। আমি তো আর থানা-পুলিশ করতে যাচ্ছি না। এমনকি তোমার ভাসুরকেও কখনও বলিনি। এই যে মুখ বন্ধ করে আছি এর কি কোনও দাম নেই? বলো!
কী বলব তা ভেবে পেলাম না। বেশির ভাগ মানুষেরই অভ্যাস হল, যেখানে বলার কথা কিছু নেই সেখানেও অকারণে কথা বলে যায়, প্রয়োজন থাক বা না থাক। ওই অভ্যাসটা আমার নেই। আমি অকারণে অযথা কথা বলি না। প্রয়োজন না থাকলে একদমই নয়। তাই এখনও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বা ওঁর সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি বৃথা চেষ্টা করলাম না। আমি জানি, যাই বলি না কেন উনি বিশ্বাস করবেন না।
উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, চলে গেছ নাকি?
না আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
তুমি কিছুই তো বললে না! কী ধরে নেব?
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি আর একবার আমার দিকে চাইলেন। চোখ জ্বলছে। বললেন, তার মানে তুমি কিছুই দেবে না আমাদের? কিছুই না?
আমি নীরবে চেয়ে রইলাম। দেখলাম, ওঁর চোখে রাগের আগুনটা দপ করে জ্বলে উঠল। উনি এমনিতেই দজ্জাল ছিলেন। অনেকদিন ধরে নিজের উগ্রতাকে ছিপি বন্ধ করে রেখেছেন। এখন কাসুন্দির বোতলের ছিপি যেমন উগ্র ঝাঁঝে ছিটকে যায় তেমনি ওঁর ছিপিটাও উড়ে গেছে।
উনি দাঁত কড়মড় করে বললেন, রাক্ষুসী! সব খাবি? সব নিজে ভোগ করবি? অনেক ভয় পেয়ে থেকেছি, অনেক আসকারা দিয়েছি! আর নয়…
বলতে বলতে নিজের অচল ব্যাধিগ্রস্ত শরীরটাকে কেবলমাত্র রাগের ইন্ধনে উনি বিছানা থেকে ছিটকে তুলে দিলেন। তারপর এলো চুল উড়িয়ে, আঁচল খসিয়ে প্রেতিনীর মতো ধেয়ে এলেন আমার দিকে। দু’হাতের আঙুল গলা টিপে ধরার জন্য উদ্যত।
আমি অবাক হয়ে লোভ, লালসা, হিংসে, বিদ্বেষ সব কিছুর একটা মানুষী রূপ চেয়ে দেখছিলাম। সরতেও পারিনি। উনি প্রায় বাঘিনীর মতো এসে পড়লেন আমার ওপর, আজ তোকে শেষ করব… শেষ করব… তারপর মরি তো মরব… আগে তোকে শেষ করব…
কে যেন আমার কানে কানে বলল, তুইও ধর না গলাটা চেপে।
আমার জায়ের গায়ে যেন এক অসুরের শক্তি ভর করেছিল। উনি আমার গলা সাঁড়াশির মতো চেপে ধরলেন।
পিসিমা আমার কানের কাছে বলতে লাগলেন, ওরে মরবি নাকি? তা মর। দুজনেই মর। ওর গলাটাও চেপে ধর না কেন। হাত দুটো তোল না মাগী। এঃ, নুলোর মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখ!
আমি শ্বাস নেওয়ার প্রাণপণ আর জায়ের হাত ছাড়ানোর জন্য টানা হ্যাঁচড়া করতে করতেও বললাম, না পিসিমা।
এই ‘না পিসিমা’ কথাটা আমার জা শুনতে পেলেন। তাঁর হাত শ্লথ হয়ে গেল। বড় বড় অস্বাভাবিক চোখে আমার দিকে চেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ডাইনী! তুই ভূতপ্রেত ডাকছিস! ভূতপ্রেত ডাকছিস! তুই সব পারিস। সব পারিস! তোকে মেরে তবে মরব আমি, তোকে মেরে…
কানে কানে পিসিমা বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়! ও যে সর্বনাশ করবে তোর। গলাটা টিপে ধর! ধর বলছি!
আমার দুচোখ দিয়ে ধারা বইছে। আমি নিশ্চেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকি।
পিসিমা বলতে লাগলেন, এই সুযোগ আর পাবি না। কেউ কোথাও নেই। গলা টিপে মাগীকে শেষ করে দে। কেউ টের পাবে না। কাকপক্ষীও জানতে পারবে না।
জা তড়পালেন বটে কিন্তু আর পারলেন না। আমার গলা টিপে ধরার জন্য হাত তুলে এগিয়ে আসছেন, হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে।
পিসিমা বললেন, তুই বুঝতে পারছিস না, ও বেঁচে থাকলে তোর বড় বিপদ। একদিন তোকে ঘুমের মধ্যে গিয়ে মেরে আসবে। এইবেলা শত্রু নিকেশ কর।
আমার জা আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না। তার আগেই অচল শরীরের সব শক্তি নিঃশেষিত হয়ে পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে। পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
আমি ধীর পায়ে নীচে নেমে এলাম।
রাত্রে আমি আমার স্বামীকে বললাম, আমার আর একটা দোকান করার ইচ্ছে।
স্বামী অবাক হয়ে বলেন, আবার দোকান! একটা নিয়ে বেসামাল হয়ে আছি। এক এক দিন এখন দশ পনেরো হাজার টাকার বিক্রি, চোখের পাতা ফেলার সময় পাই না। আবার দোকান করলে দেখবে কে?
আমি আবদারের গলায় বললাম, এখানে রেডিও টেপরেকর্ডার এসব জিনিসের ভাল দোকান নেই। খবর পেয়েছি জগু সাহার দোকানটা বিক্রি হবে। একটু দেখুন না খোঁজ নিয়ে।
স্বামী আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। হঠাৎ বললেন, তোমার গলায় ও কিসের দাগ? ইস, এ যে দাগড়া দাগড়া লাল হয়ে আছে! ছড়েও গেছে খানিকটা!
আমি মাথা নত করে বললাম, আমাকে যদি বিন্দুমাত্র স্নেহ করেন তাহলে আর জানতে চাইবেন না। পুরুষমানুষের সবকিছু জানতে নেই।
উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কিছু গোপন করতে চাও? বেশ।
চোখের জল সামাল দিতে আমার কিছু সময় লাগল। তারপর বললাম, একটা কথা বলতে চাই।
কী কথা?
মানুষ তখনই পুরোপুরি সুখী হতে পারে যখন তার কানে অন্য মানুষের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আসে না।
স্বামী অবাক হয়ে বললেন, এ তো নীতিবাক্যের মতো শোনাচ্ছে।
তবু বড় সত্যি। তাই না, বলুন!
কী বলতে চাও বলো না! আমি তো তোমার কথা কখনও ফেলি না।
আপনি আমার কাছে পুরুষশ্রেষ্ঠ।
উনি মৃদু হেসে বললেন, ওইসব বলে বলে তুমি আমার মাথাটা একদিন খাবে। শেষমেশ আমি নিজেই হয়তো নিজের সম্পর্কে ভাবতে শুরু করব।
আপনি বুঝবেন না, আমি কোথা থেকে শক্তি পাই, কেন অমঙ্গলের মধ্যেও মঙ্গল আমার হাত ধরে থাকে।
তোমার গলার দাগ সেরকমই একটা ঘটনার কথা বলছে কি? অমঙ্গলে মঙ্গল?
আমি আর একটু কাঁদলাম। তারপর বললাম, আমি অন্যের দীর্ঘশ্বাস শুনে সুখী হতে পারব না। আপনি ভাসুরঠাকুরের কথা কেন ভাবেন না? উনি যে দুরবস্থায় পড়েছেন।
দাদা! দাদা কেন দুরবস্থায় পড়বে! সংসার তো দিব্যি চলছে।
ওটা কী কথা হল! পুরুষমানুষের অহংকার নেই বুঝি? উনি কেন আপনার অন্নদাস হয়ে থাকবেন? ওঁকে কিছু করতে দিন।
ওঃ, দাদার জন্যই নতুন দোকান? কিন্তু ও কি পারবে?
আপনি বুঝি পারেননি?
উনি এবার আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়ে বললেন, আমি পেরেছি তোমার জোরে। আমার তো তুমি আছো, দাদার তো তা নেই।
দাদার আপনি আছেন। এ বাড়িতে দীর্ঘশ্বাস আর জমতে দেবেন না।
উনি আমার গলাটা ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন, আজকাল আমার কাছে কথা লুকোতে শিখছ।
আমি সাশ্রু নয়নে বললাম, না। লুকোবো না। কিন্তু সব কথারই উপযুক্ত সময় আছে। নইলে হিত কথাও বিপরীত হয়। কথারও লগ্ন আছে, দিনক্ষণ আছে। আজ নয়, সময় হলে বলব।
উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন, বেশ। আমি অপেক্ষা করব।
দোকান কেনার তোড়জোড় শুরু হওয়ার পর আমার শাশুড়ি আমাকে ডেকে একদিন বললেন, শুনছি তুমি তোমার ভাসুরের জন্য দোকান করে দিচ্ছ!
আমি মৃদু হেসে চুপ করে রইলাম।
উনি আমার মাথায় একটু হাত রেখে বললেন, তোমার মনটা বড় ভাল। কিন্তু একটা কথা আছে।
কী কথা?
তোমার ভাসুর এ বাড়ির আর পাঁচজন পুরুষমানুষের মতোই অহংকারী মানুষ। সে হয়তো আজ বিপাকে পড়ে তোমার দান নেবে। কিন্তু চিরকাল মনে একটা চিমটি থেকে যাবে। তাছাড়া তোমাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পয়সা, ও যদি ব্যবসায় মার খায়, তাহলে জলে যাবে।
সব ঠিক হয়ে যাবে মা।
তোমার কেবল ওই কথা। শোনো, এ বাড়ির ধাঁচ আমি ভালই জানি। আমার লুকোনো কিছু গয়না আর মোহর এখনও আছে। শেষ সম্বল। তবে ও দিয়ে আর আমার কোনও কাজ নেই। এ বাড়ির উড়নচণ্ডীদের হাত থেকে এতকাল রক্ষে করে এসেছি। তুমি এগুলো বেচে দোকানটা কেনো। তাতে তোমার ভাসুরের মনে আর কোনও কাঁটা থাকবে না।
কেন মা, শেষ সম্বল যখন, ওটা থাক না।
জমিয়ে রাখারও তো কোনও মানে নেই। বরং কাজে লাগুক, ফলন্ত হোক। অপব্যয় না হলেই হল। দোকানটা তোমার ভাসুরকে দেবে বটে, কিন্তু নিজে নজর রেখো। তোমার ভরসাতেই দিচ্ছি।
আমি আর আপত্তি করলাম না।
কথাটা জানতে পারার পর আমার ভাসুরও যেন স্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর মুখে অনাবিল হাসি দেখলাম।
দোকান খুলে ভাসুর বসলেন। আমি দুবেলা গিয়ে খুব বিনীতভাবে, খুব সন্তর্পণে তাঁকে কিছু কিছু পরামর্শ দিতে লাগলাম। উনি বিনা আপত্তিতে আমার কথামত চলতে লাগলেন। দোকানে বসে তিনি আনন্দও পাচ্ছিলেন। কেননা সারাক্ষণ দোকানে গ্রামোফোন আর টেপ রেকর্ডারে গান হয়, রেডিও চলে, একঘেয়েমি নেই।
দোকান ধীরে ধীরে চলা শুরু করল।
একদিন গভীর রাতে ঘুম থেকে কে ডেকে তুলল আমায়, চোর! চোর! চোর ঢুকছে ঘরে! ওঠ, ওঠ, ওঠ শিগগির। আমার সর্বস্ব নিয়ে যাবে যে রে হতভাগী। তোর যায় যাক, আমার গয়না গেলে তোকে জ্যান্ত ফেলে দেব মজা কুয়োয়…
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সত্যিই আমাদের শিয়রের জানালায় দুটি ছায়ামূর্তি দেখা গেল। তারা গরাদ কাটছিল। আমি টর্চ জ্বালাতেই লুকিয়ে পড়ল তারা। আমি স্বামীকে ডেকে তুললাম। কিছু চেঁচামেচি হৈ-চৈ হল। চোর অবশ্য ধরা পড়ল না।
স্বামী ফের ঘুমোলেন। আমার ঘুম এল না। অন্ধকারে পিসিমার থানের আভাস দেখতে পাচ্ছিলাম।
তোর এত মোষের মতো ঘুম কেন রে মাগী? গয়নাগুলো পাহারা দিতে পারিস না? খুব স্বামীর সঙ্গে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা! মর, মর, মর… তোদের লাজলজ্জা নেই? অত দেয়ালা কিসের রে? বেশ্যার মতো সেজেগুজে থাকিস সন্ধেবেলা, বরকে ভোলাতে, তোর কেন শোথ হয় না? বাত হয় না? ক্ষয়কাশ হয় না? এ বাড়ির ছেলেকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছিস! থুঃ… থু… থুঃ… অমন ভালবাসার মুখে থুঃ .. থু… থুঃ ..
সারা রাত পিসিমা ঘরের চারদিকে ঘুরলেন আর অবিরল থুঃ… থুঃ… থুঃ… থুঃ… থুঃ… করে যেতে লাগলেন। আজ উনি উত্তেজিত। আজ ওঁর বড় রাগ। আর একটু হলেই ওঁর অত সাধের গয়না চোরে নিয়ে যেত।
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল খুব। পুরোনো বাড়ি, নীচের তলায় থাকি, ঘরে একশ ভরির ওপর নিরেট সোনাদানা। বাড়িতে নতুন ঠাকুর চাকর বহাল হয়েছে। আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
পরদিনই আমি সিন্দুক আনালাম। পিসিমার গয়না রইল তার মধ্যে। চাবি রইল আমার শক্ত হেফাজতে। আমাদের টাকা হচ্ছে। এক একদিন দোকানে বিক্রির পরিমাণ বিশ হাজারও ছাড়িয়ে যায়। সিন্দুক সেদিক দিয়েও আমাদের নিশ্চিন্ত করল।
বিয়ের চার বছর পর একটু পাপ ছুঁয়ে গেল কি আমাকে। একটু কাঁপিয়ে দিয়ে গেল কি আমার ভিত ভূমিকম্পে? ঝড় এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল কি আমার খোলা জানালা দরজার ঘর?
এবার সেই কথা বলি। আমার স্বামীকে প্রায়ই কলকাতা যেতে হয়, দিল্লি বা বোম্বাইও যেতে হয়, যেতে হয় বেনারস, কাঞ্চিপুরম। আমাদের দোকান আরও বড় হয়েছে। পাঁচজন কর্মচারী খাটে। আমি এক বগ্গা এক ধরনের মাল আনা পছন্দ করি না। স্বামীকে বলি, আসল দোকান থেকে জিনিস আনা দরকার। নইলে আমরা পুরোনো আর একঘেয়ে হয়ে যাব খদ্দেরের কাছে। দামও পড়বে বেশি। আর পাইকাররাও আমাদের ঠকায়।
আমার স্বামী আগের মতো অলস নেই। তিনি সদা-প্রস্তুত, তৎপর। আমাদের মাল আসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সরাসরি তাঁতি বা মিলের সঙ্গে আমাদের কারবার। আমার স্বামীকে তাই খুব বাইরে যেতে হয় আজকাল। দূরেও। তখন সকালে দোকানে থাকেন আমার শ্বশুর, বিকেলে আমি।
সেবার আমার স্বামী গেছেন দক্ষিণ ভারতে। এক ঝড়ের রাতে একা ঘরে শুয়ে হঠাৎ খুব বিগলিত স্বর শুনতে পেলাম।
শুনছিস!
শুনছি।
তোর সঙ্গে রোজ পিছু পিছু একটা ছেলে আসে। দেখেছিস তাকে?
চমকে উঠে বলি, না তো! কে ছেলে? কখন আসে?
ন্যাকা! জানে না! রোজ রাতে যখন দোকান থেকে ফিরিস তখন পিছু পিছু ওটা কে আসে? বুঝি না নাকি?
আমি দেখিনি কাউকে।
সুন্দর ছেলে। চিবিয়ে খা। পেট পুরে খা। সাধ মিটিয়ে খা। পাপ পুণ্য বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। সতী না হাতি। সব ভাসিয়ে দে। খা।
আমার বুক ঢিবঢিব করছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ।
তোর এমন রূপ, তবু মেথরানির মতো সেজে থাকিস কেন? মাথায় চিরুনি নেই, সাজে বাহার নেই, যেন অলক্ষ্মী মূর্তি ঘরে এলেন। কেন রে বোকা মেয়ে, স্বামী ছাড়া আর বুঝি পুরুষমানুষ নেই?
চুপ করুন পিসিমা। শুনলেও পাপ হয়।
আহা, একেবারে সতী সাবিত্রী এলেন! সাজিস না কেন? ঠোঁটে একটু রং দিবি, চোখে কাজল টানবি, চুলটা পরিপাটি করে বাঁধবি, ভাল একখানা ঝলমলে শাড়ি পরবি, তবে না! যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটবি, চারদিকে ঢেউ উঠবে।
ছিঃ পিসিমা।
অত ছিছিকার করতে হবে না। অমন চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে, বঞ্চিত করবি কেন রে ভাতারখাকি? পাপ টাপ বলে কিছু আছে নাকি? বরং শরীরকে বঞ্চিত করাই তো পাপ।
আর বলবেন না, আমি আর শুনতে চাই না।
পিসিমা খিলখিল করে ঠাণ্ডা হাসিতে ঘর ভরে দিলেন। সেই হাসির শীতলতায় আমার বুক হিম হয়ে গেল।
পরদিন দোকান থেকে যখন ফিরছি তখন পথঘাট কিছুটা নির্জন। এ সময়টায় মফস্বল শহরে বেশি লোক বাইরে থাকে না। হাঁটছি সামনের দিকে চেয়ে, মনটা পিছনদিকে। কেউ আসছে? কেউ কি সত্যিই পিছু নেয় আমার?
আচমকা পিছু ফিরে চাইলাম। আর তখনই দেখতে পেলাম তাকে। লম্বা, দীঘল চেহারার একটা ছেলে। পরনে পায়জামা আর পানজাবি। এলোমেলো একরাশ চুল মাথায়। অল্প একটু দাড়ি। পাশের দোকানের উজ্জ্বল আলোর ভিতর দিয়ে আসছিল বলে তার মুখখানা স্পষ্ট দেখলাম। আমার স্বামী সুপুরুষ বটে, এরকম মায়াবী চেহারা তাঁর নয়। তাঁর চেহারায় জমিদারির আভিজাত্য প্রবল। এ যেন কবিতার মতো। কী দীঘল হরিণের মতো দুখানা চোখ। কী মিষ্টি এর দুখানা ঠোঁট! সে আমার দিকেই চেয়ে খুব ধীর পায়ে হেঁটে আসছিল।
উত্তাল বুকে আমি প্রায় ছুটে পথটা পার হয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
নিশুত রাতে পিসিমা বললেন, দেখলি?
ছিঃ পিসিমা।
ওরে শোন, ঘরের পুরুষ তো জলভাত। আটপৌরে কাপড়ের মতো। হাগো, মোতো, খাও, ভেঁড়েমুষে পরো। কিন্তু এসব পুরুষ হল বালুচরী বেনারসী। মাঝে মাঝে চাখতে হয়।
ছিঃ।
অমন রূপে কি একজনের নৈবেদ্য সাজাবি? তুই কী রে? দেব দেবীরাও কত কী করে বেড়াত। পড় না মহাভারতখানা, দেখবি। শরীর হল নদীর মতো, সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ধরা না পড়লেই হল। শরীর তো আর নালিশ করবে না।
আমার চোখে জল এল।
পরদিন আমি দোকানের একজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম একবারও পিছু ফিরে তাকাইনি। দিন তিনেক এরকম চলল। চারদিনের দিন ফের একা ফিরছিলাম। পাহারাদার নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। ছেলেটা তো আর আমাকে আক্রমণ করবে না। পিছু নিলে নেবে।
কয়েক পা যেতে না যেতেই আমি টের পেলাম, পিছনে কেউ আসছে। সে-ই কি?
ঠিক আন্দাজমতো জায়গায় আমি মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম। সে-ই। আজও তার মুখে আলো পড়েছিল। বুকের ভিতরটা এমন ধক ধক করতে লাগল কেন যে!
না, আমি আজ আর ছুটলাম না। একটু কাঁপা বুক নিয়ে স্বাভাবিক হেঁটে ফিরে এলাম।
নিশুত রাতে পিসিমার বিগলিত কণ্ঠস্বর বলল, ভাল নয়? তোকে বলেছিলাম কিনা! অত লজ্জা কিসের তোর? অত তাড়াই বা কিসের? একটু ঢং করে করে হাঁটবি, মুচকি একটু হাসবি, চোখে একটু ইশারা করবি। তুই যে কিছুই শিখিসনি বোকা মেয়ে। রোজকার ভ্যাতভ্যাতে ওই একটা মাত্র আলুনি পুরুষ তোর ভাল লাগে? ভগবান তাহলে তোকে এত দিলেন কেন? এত রূপ, এত গুণ, চোখে এত দেয়ালা। একবার ডুব দিয়ে দেখ না।
আপনি কি আমাকে ছাড়বেন না পিসিমা? আমি কী দোষ করেছি?
বড় বড় কথা বলিসনি লো সাতভাতারি। ঢের চেনা আছে।
সাত দিনের মাথায় আমি আর থাকতে পারিনি। দোকান থেকে ফিরছি। একা। যখন টের পেলাম সে আজও আসছে, তখন হঠাৎ আমার সারা শরীরে রিমঝিম করে উঠল রাগ। আমি ঝটকা মেরে ঘুরে দাঁড়ালাম। ছেলেটাও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, কী চান বলুন তো! রোজ পিছু নেন কেন?
ছেলেটা এত ঘাবড়ে গেল যে, বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল শুধু। তারপর অস্ফুট স্বরে কী একটা বলে মাথা নিচু করে দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেল।
আমার বয়স মাত্র বাইশ। ডগমগে যুবতী। কিন্তু সংসারের জন্য ভেবে ভেবে, আর নানা কাজে জড়িয়ে বয়সের কথা ভুলেই ছিলাম। যেন সাত বুড়ির এক বুড়ি। রূপের কথা ভাবি না, সাজের কথা ভাবি না, কটাক্ষ নেই। একটা মানুষকে ঘিরেই যেন আমার লতিয়ে ওঠা। কিন্তু আজ বয়স যেন ডাক দিল। ডাক দিল আমার বিস্মৃত যৌবন। আমার রূপ ফুঁসে উঠে যেন আমাকে বলল, আমরা কি বৃথা ফিরে যাব?
পিসিমা নিশুত রাতে এসে বলল আর্লাপ:করলি বুঝি?
না। আমি ওকে ধমকে দিয়েছি।
পিসিমা খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, বেশ করেছিস। প্রথম প্রথম একটু কড়া হওয়া ভাল। তাতেই হামলে পড়বে। যা হ্যাংলা হয় পুরুষেরা! আস্তে আস্তে সুতো ছাড়বি। খেলিয়ে খেলিয়ে তুলবি। তারপর ঘরে এনে কপাট বন্ধ করে চিবিয়ে খা। ছিবড়ে করে ফেল।
আমি কানে হাত চাপা দিলাম।
অনেক সতী দেখেছি লো। পেটে খিদে মুখে লাজ। কাল সবুজ রেশমের কাপড়খানা পরিস। বেশ দেখায় তোকে। অত ডগন্ডগে করে সিঁদুর দিস কেন? একটু এয়োর চিহ্ন রাখলেই হয়।
আপনি যান পিসিমা।
কেন যাব? তোর বাপেরটা খাই না পরি? ওরে শোন, শ্রীরাধিকাও তোর চেয়ে কম ছিল না। তা বলে কি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ফস্টি নস্টি করত না? দোষ হলে করত ওরকম?
আমার বুকে কেমন জ্বালা করছিল। সারা রাত আমি চেয়ে জেগে রইলাম। ছেলেটা কী চায়? কেন আসে?
পরদিনও ছেলেটা পিছু নিল। তবে অনেক দূর থেকে। তাকে আমি দেখতে পেলাম। আমার কান্না পাচ্ছিল। কেন কষ্ট করছে ছেলেটা? কেন অপমান সইতে আসে? কী লাভ ওর?
দুদিন পর একটু বৃষ্টি হল। গ্রীষ্ম শেষের প্রথম বৃষ্টি। পথঘাট ভিজল। বাতাস ঠাণ্ডা হল।
মেঘ কেটে অপরূপ এক চাঁদ উঠল আকাশে। রোজকার চাঁদ নয়। এ যেন রূপকথার জগৎ থেকে আমাদের আকাশে ভেসে এল। গাছের পাতায়, ভেজা পথে, ছোটো ছোটো জমা জলের গর্তে ছড়িয়ে দিল হাজারো টুকরো।
পথে পা দিয়েই আমি বুঝলাম, আজ বড় মাতাল দিন। আজ যেন বাঁধ মানছে না সুন্দর। আজ বড় বাড়াবাড়ি। আজ উতরোল হাওয়া। আজ কেউ বশ মানছে না যেন। আজ সব ওলটপালট। আজ কোন কারিগর পুরোনো পৃথিবীর সব মালমশলা নতুন করে ছেনে মেখে গড়েছে অন্য একটা জগৎ। আকাশে এত তারা তো থাকে না কখনও? আমি কি উড়ে যাচ্ছি হাওয়ায়, জ্যোৎস্নায়?
আমি আজ নরম করে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, পিছনের পথে কেউ নেই। সে আজ পিছু নেয়নি আমার? এই জ্যোৎস্নার পাগল রাতে সে এল না বুঝি? আজ যেন আমারও একটু প্রতীক্ষা ছিল! মনটা একটু ম্লান আর বিস্বাদ হয়ে গেল কি? অভ্যাস তো!
আমি শূন্য পথটাকে একটা অস্পষ্ট ধিক্কার দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিলাম। আস্তেই হাঁটা যাক। হয়তো সে আসবে। হয়তো সময় যায়নি।
সে পিছনে ছিল না। ছিল সামনে। হঠাৎ আমাকে আপাদমস্তক চমকে দিয়ে সে নির্জন পথে আমার পথ জুড়ে দাঁড়াল। দীঘল চেহারা, দুটি অপরূপ হরিণের চোখ, মাথায় মস্ত চাঁদ। আমি মুগ্ধ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি কখন! লজ্জাহীন চোখে তাকিয়ে আছি। দুটি চোখে কী গভীর মায়া! দুটি ঠোঁটে কী অফুরান আকুলতা!
সে আমার দিকে অপলক চেয়ে ছিল। কিছুক্ষণ স্তব্ধতাই তরঙ্গ তুলে যাতায়াত করছিল দুজনের মধ্যে।
সে হঠাৎ স্খলিত কণ্ঠে বলল, আমি… আমি তোমাকে ভালবাসি।
তারপর আর সে দাঁড়াতে পারল না। একটা ভীষণ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে দ্রুত ভীত পায়ে উধাও হয়ে গেল। জবাব চাইল না। তাকে আমার জবাব দেওয়ারও কিছু ছিল না হয়তো। কিন্তু আমার ভিতরে যে ভেঙে পড়ছে ইমারত! ধসে পড়ছে পাহাড় পর্বত! হারিয়ে যাচ্ছে পথ!
খুব ধীর পায়ে, যেন কোথাও যাচ্ছি না, কোনওদিন পৌঁছব না কোথাও, এরকমভাবে হেঁটে আমি বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির দরজাটা চিনতে পর্যন্ত সময় লাগল। এই কি আমার ঘরবাড়ি? এই কি আমার ঠিকানা?
বালিশ ভিজিয়ে কাঁদলাম রাতে।
পিসিমা প্রগাঢ় স্বরে বললেন, কাঁদ! কাঁদলে অনেক ময়লা কেটে যায়। ধর্মকর্ম বারব্রত জাত ধর্ম ওসব হল ময়লা। সব পরিষ্কার হয়ে যাক। তারপর গাঙ্ পেরিয়ে যা। কত সুখ, দেখবি।
সুখ পিসিমা! আমার যে ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে।
খাক হয়ে যাক। পুড়ে যাক জঞ্জাল।
আমি সারা রাত জ্বালা-ধরা চোখে অন্ধকারে চেয়ে রইলাম।
পরদিন ভোরবেলা উঠে সদর দরজাটি খুলতেই দেখি দরজার বাইরে চৌকাঠের পাশটিতে কে একটি বৃষ্টিভেজা রক্তগোলাপ রেখে গেছে। কয়েকটা সবুজ পাতা আর ডাঁটিশুন্ধু। তখনও ফোটেনি। আধফোটা।
আমি ফুলটা তুলে নিলাম। এনে জলে ভিজিয়ে সাজিয়ে রাখলাম ঘরে। ফুটুক। ফুলটা ফুটুক।
প্রতিদিন পিছু নিত সে। প্রতি সকালেই রেখে যেত রক্তগোলাপ। আমার কি পাপ হল? আমি কি মনে মনে আমার শক্ত বাঁধন কেটে নৌকো ভাসালাম পাগলা স্রোতে?
ভোরবেলা একদিন আমার ক্লান্ত স্বামী ফিরলেন। দরজা খুলে আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম, আপনি! কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন? কেন ছেড়ে থাকেন আমাকে?
বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেললাম। বারবার মাথা ঠুকতে লাগলাম ওঁর বুকে।
উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আরে, কী কাণ্ড! কেঁদো না, কেঁদো না। আমি তো কাজেই গিয়েছিলাম।
আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না আর।
রক্তগোলাপটি আজও রাখা ছিল চৌকাঠে। আমার স্বামী না দেখে সেটিকে পদপিষ্ট করে চৌকাঠ ডিঙিয়ে এলেন।
আজ আর আমি গোলাপটি তুলে নিলাম না।
রাতে আমি নতুন চাদর পাতলাম বিছানায়। পরিপাটি করে পেতে দিলাম বালিশ। ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিলাম। একটু সুগন্ধও।
উনি শুতে এসে বিছানার দিকে চেয়ে বললেন, আজ কি ফুলশয্যা?
আমি তৃষিতের মতো তাঁকে আলিঙ্গন করলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, আমাকে দিন।
কী কাণ্ড লতা? আমার সবই তো তোমার।
আমি আপনাকে আরও চাই। আরও চাই। আপনাকে দিন।
ঘরের চারদিকে অশান্ত এক কণ্ঠস্বর ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাপ করলি না? অভিসার হল না তোর? ওলাউঠা হয়ে মর সান্নিপাতিক হয়ে মর। আমি কালসাপ হয়ে তোর বরকে খাব। মরবি, মরবি।
আমি আমার স্বামীকে আকর্ষণ করলাম বিছানায়। আমি আর দেরি করতে পারি না। আমার চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে তাপে।
কণ্ঠস্বর অভিশাপ দিচ্ছে, খা… খা… খা… খা… খা… খা…
আমি চোখ বুজে স্বামীকে শক্ত করে ধরলাম বুকে। অধরে অধর। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, স্তব্ধ হও প্ররোচনা, শান্ত হও তাপিত হৃদয়। জন্ম নাও। জন্ম নাও জন্মের যন্ত্রণা। জন্ম নাও আমাদের ভিতর দিয়ে। শীতল হও, জুড়িয়ে যাও…
বাইরে আমাদের ঘরের চারপাশে শব্দটা ঘুরছে আর ঘুরছে, খা… খা… খা… খা… খা…
আমি বললাম, নিবে যাক বুকের আগুন, শান্ত হোক কামনার জ্বালা, আত্মদমনের যত ক্লেশ। শান্ত হও। এ তোমার জন্মের সময়। শান্ত হও, এ বড় সুন্দর মুহূর্ত। কোল জুড়ে এসো তুমি, বুক জুড়ে এসো। জন্ম নাও… জন্ম নাও… জন্ম নাও…
শব্দ মিলিয়ে গেল। চিরকালের মতো। সম্পূর্ণ হল আমাদের মিলন।
দশ মাস পর আমার মেয়ে হল। বসন্ত কালে তার জন্ম বলে আমরা তার নাম রাখলাম বসন।
বাড়ির কোথাও পিসিমার ছায়া নেই। শব্দ নেই। বাড়ি শান্ত। ভারমুক্ত।
আমি বার বার বসনকে এসে দেখি। সে যেন এক রাশি ফুলের মতো বিছানায় শুয়ে থাকে। এত তার রূপ! আমি তাকে আদর করতে করতে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি, চিনতে পারো আমায়? চেননা এই বাড়ি? মনে পড়ে না?
অবোধ শিশু চেয়ে থাকে।
অনেকদিন বাদে এ বাড়িতে একটি শিশু জন্মাল। তাকে নিয়ে যে টানাহ্যাঁচড়া তা বলার নয়। শাশুড়ি জপতপ প্রায় ছেড়েই দিয়ে নাতনী নিয়ে পড়ে থাকেন। শ্বশুরমশাই মাঝে মাঝেই দোকানে কামাই দিতে লাগলেন। জ্যাঠাশ্বশুর নীচের ঘরে বড় একটা আসতেন না। আজকাল দুবেলা ঘন ঘন যাতায়াত। ভাসুর ভাইঝি পেয়ে এত মুগ্ধ যে, খেলনায় ঘর ভরে ফেলতে লাগলেন। বসনের সময় কাটে কোলে কোলে, আদরে আদরে। তাকে কেউ এক মিনিট ছাড়তে চায় না বলে সে হামা দেওয়া শিখতে পারল না সময়মতো। হাঁটতে শিখল আরও দেরিতে।
বসনকে দেখতেও এলেন না আমার জা। তিনি নীচে নামতে পারেন না। বাত ব্লাডপ্রেশার আরও নানা উপসর্গ নিরানন্দে ঘিরে আছে তাঁকে।
বসন যখন একটু একটু হাঁটতে শিখল তখন একদিন সবার অজান্তে কোন ফাঁকে দুপুরবেলা সিঁড়ি দিয়ে টুক টুক করে ওপরে উঠে গিয়েছিল। তারপর টলোমলো পায়ে সে আমার জায়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। মুখে আঙুল পুরে পরম বিস্ময়ে দেখতে লাগল জাকে।
জা বসনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কে? কে রে?
বুঝতে বোধহয় একটু সময় লেগেছিল তাঁর। এ হল সেই ডাইনীর মেয়ে। তিনি বিছানা থেকেই হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিলেন, যা, যা, যা চলে যা এখান থেকে।
কোথায় অভিপ্রেত তারা, কোথায় নয় এটা বাচ্চারা ভালই বোঝে। বসন তাড়া খেয়ে ভয় পেয়ে ফিরে আসতে গেল। কিন্তু নামতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। সিঁড়ি থেকে হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল সে। সিঁড়ির পর সিঁড়ি।
কোথা থেকে অচল শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ এল কে জানে, জা প্রায় উড়ে এলেন তাঁর বিছানা ছেড়ে। ছয় সিঁড়ি নীচে নেমে তুলে নিলেন বসনকে। ব্যথায় নীলবর্ণ হয়ে গিয়েছিল বসন।
শব্দ পেয়ে পাঁচু যখন ওপরে গেল, তখন জা বসনকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। জলপট্টি দিচ্ছেন ব্যথার জায়গায়।
বাড়ি ছিলাম না। দুপুরে ফিরে শাশুড়ির কাছে ঘটনাটা শুনলাম। উনি মুখ চুন করে বললেন, বড্ড দামাল হয়েছে মেয়েটা। একটু চান করতে গেছি সেই ফাঁকে ওপরে গিয়েছিল। তারপর কী কাণ্ড।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, দিদির ঘরে?
হ্যাঁ মা। এখনও সেই ঘরে আছে। কী হচ্ছে কে জানে? তোমার জায়ের তো বুকে অনেক বিষ। পাঁচুকে পাঠিয়ে মেয়েটিকে আনিয়ে নাও।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললাম, থাক মা।
ঠাকুর এসে বলল, বড় বউদি বসনকে ভাত খাওয়াবেন বলে ভাত চেয়ে পাঠালেন। নিয়ে যাব?
আমি বললাম, যাও।
এর পর থেকে বসন রোজ ওপরে যেত বড়মার কাছে। কাউকে জয় করতেই সে বাকি রাখল না।
আমি তাকে একা পেলে এখনও তার মুখে চিহ্ন খুঁজি। তাকে বলি, মনে পড়ে না গয়নার বাক্স? মনে পড়ে না জ্বালা যন্ত্রণা? মনে পড়ে না তোর?
বসন দুর্বোধ্য নানা শব্দ করে কী বলে কে জানে!