সেই সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে। তারা জমিদারী প্রথা উঠিয়ে দিল এবং জমিদারীর পেছন পেছন তালুকদারী প্রথা আপনা থেকেই উঠে গেল। বাবা খবরটা কাগজে পড়ে প্রথম দুতিন দিন- যে ভিখিরীর ছেলেরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে পুরনো মানী লোকদের বেইজ্জত করতে লেগেছে, তাদের উদ্দেশে সুশ্রাব্য নয় এমন শব্দরাজি একটানা বর্ষণ করে গেলেন।
তারপরে একেবারে অন্য মানুষ বনে গেলেন। বসলে উঠবার কথা ভুলে যেতেন। ভাতের থালা নিয়ে ঠায় বসে থাকতেন। গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে কি ভেবে শিউরে উঠতেন, হাতের গ্রাস মাটিতে পড়ে যেত। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি মোক্তার সাহেবের সঙ্গে কি প্রচণ্ড বিক্রমে লড়েছিলেন। তাঁর প্রাণশক্তি কি করে এমন থিতিয়ে এল বুঝতে পারলাম না।
তালুকদারী গেছে আমাদের কাছে সুসংবাদ বৈ এমন কিছু নয়। কিন্তু বাবার বুকে আঘাতটা বজ্ৰশেলের মতো বাজল। একটা শরিকী তালুকের সাড়ে তিন আনা অংশের মালিক ছিলেন আমার বাবা। বছরে একশ তিন টাকা বারো আনা সাত পাই খাজনা আমাদের পাওনার কথা। কিন্তু আমার বয়েসকালে কোনোদিন টাকাটা বিনা ঝাটে পেয়েছি একটুও মনে পড়ে না। বরঞ্চ কোনো কোনো বছর আদালতে তার দশগুণ ব্যয় করতে হয়েছে।
বাবার একটা প্রাণপ্রিয় স্বভাব- যাদের কাছে তিনি খাজনা পেতেন, তাদের উঠতে বসতে ছোটলোক ছাড়া ডাকতেন না। আর সেই ছোটলোকেরাই লেখাপড়া বিত্ত-বৈভবে আমাদের চাইতে অনেক বেশি সম্পন্ন ছিল। নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলেই হাতের বাঁকা লাঠিটা প্রসারিত করে গোটা গ্রামখানি দেখিয়ে বলতেন, এই যে দেখছেন চারপাশের ঘরবাড়ি এরা সবাই আমাদের সাতপুরুষের প্রজা। সাত পুরুষের প্রজারাও তাই আদালতে তালুকদার সাহেবকে না তুলে খাজনাটা কখনো হাতে হাতে পরিশোধ করত না। বাবাকে আদালতে নালিশ করতে হতো, ওরা পাল্টা জবাব দিত। এভাবে উকিল মোক্তার সাক্ষী সাবুদ পেশকার পেয়াদার পেছনে নির্ঘাত হাজারখানেক টাকা বেরিয়ে যেত। সেই তালুকদারী যাওয়াতে একটু ব্যথা পেলেও মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক মামলা মোকদ্দমা হ্যাঙ্গাম হুজ্জত পোহাতে হবে না।
বাবার শরীর দিনে দিনে ভয়ংকর রকম দুর্বল হয়ে আসছিল। তিনি ক্লোরোফর্ম করা রোগীর মতো অসাড় হয়ে পড়ে থাকতেন। যখন-তখন সে তুলোট কাগজের বংশপঞ্জিটা খুলে বসতেন। খয়েরী হয়ে আসা হরফগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন। বিড়বিড় করে বংশপঞ্জিটি আমাদের পরিবারের উত্তরণ ধারার রেখাচিত্র। কালের জল আমাদের মেদ মাংস পচিয়ে ফেলেছে একথা সত্যি, তবু কিন্তু অস্থির আড়ালে মজ্জার সঙ্গে শয়ান এক রকমের হীরকের মতো কঠিন অথচ জ্যোতিন অহংকার আমরা লালন করতাম। যতই দরিদ্র হই, সেই শিলা-দৃঢ় অহংকার ভাইবোন কেউ ভুলতে পারিনি।
এই বাঙাল মুলুকে আমাদের স্থিতি হয়েছিল সেই কবে মোগল আমলে। মোগল আমল, নবাবী আমল, ইংরেজ আমল কত কাল এল গেল । কত রাজ্য কত রাজা এসেছে আর গিয়েছে। কত যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধ্বংস-সৃষ্টি, বিপ্লব-উপবিপ্লব সবকিছুর আঘাত সহ্য করেও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পরিবার। কোনো আকস্মিক বিপদ-আপদই আমাদের পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। অখণ্ড প্রতাপ খণ্ড-খণ্ড হয়ে পড়েছে, বিশাল জমিদারী কোথায় বিলীন হয়েছে। তারপরও এক পুরুষের পর এক পুরুষ এসেছে। হৃদয়লালিত অহংকারে ভরিয়ে দিয়ে গেছে উত্তরপুরুষের বুক। বংশপঞ্জিতে তাদের আশ্চর্য সব নাম পাঠ করে আর ততধিক আশ্চর্য কীর্তি কাহিনী শ্রবণ করে আমি নিজেও তো কতবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছি। এই সম্মোহনের মধুর স্বাদ কি করে কাটাই।
বাবার অবস্থা ভয়াবহ। এই তালুকদার শব্দটার ব্যঞ্জনায় তিনি সর্বক্ষণ মোহিত হয়ে থাকতেন। ভুলে যেতে পারতেন চারপাশের বাস্তবের রূঢ় পরিবেশ। এই পাঁচটি অক্ষরে উচ্চারিত বিশেষ ধ্বনিটির মাধ্যমে তিনি পূর্বপুরুষের নৈকট্য অনুভব করতেন। সেই তালুকদার নামটাই আইনের খড়গে কাটা পড়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, বংশপঞ্জিতে তার নাম থাকার আর কোনো সার্থকতা নেই। চোখ কান খুঁচিয়ে উপলব্ধি করলেন- ঘুমের ভেতর স্বপ্নের যোগানদার, জাগরণে নেশাগ্রস্ত করার মহাজনদের হাট থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। বৈরী বিশ্বে দাঁড়িয়ে অস্তিত্বের অর্থহীনতা গভীর মর্মবেদনায় প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন। অচেতন রোগী সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর একটা হাত কিংবা পা কাটা দেখে যে রকম রিক্ততা অনুভব করে তেমনি এক ধরনের রিক্ততার ভেতর ডুবে গেলেন বাবা। তাঁকে বাতে ধরে জখম করে দিয়ে গেল। তিনি উত্থান শক্তি হারালেন।
আমার বি. এ পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। এমন সময়ে চূড়ান্ত দুঃসংবাদ শুনলাম। বাবা হাইকোর্টের মামলায় গরু হারা হেরেছেন। আবুনসর মোক্তার সাহেব মামলার খরচ ডিগ্রি পেয়েছেন। যেহেতু আমাদের ঋণ পরিশোধ করার মতো টাকা নেই, তাই মোক্তার সাহেব আদালতে জীর্ণ বাড়ি, হাজা পুকুর, জমা দিঘি সব নিজের নামে নিলাম করিয়ে নিয়েছেন। খবর শুনে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। পাগলের মতো ছুটে বাড়ি এলাম। গাঁয়ের মানুষ নানারকমের গুজব ছড়াচ্ছিল। কেউ বলছিল পুলিশ এনে আমাদের বাড়ির বের করে দেয়া হবে, কেউ বলছিল আমাদের জীর্ণ বাড়ি ভেঙে বেগুন চাষ করে মোক্তার সাহেব গায়ের ঝাল মেটাবেন। আমি, আমি কি করব। অসুস্থ জনক, বৃদ্ধা জননী এবং ছোট বোনটার হাত ধরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি বিলকুল হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ সমবেদনার কথা বলতে আসত। তখন, ঠিক তখনই আমার চোখ ফেটে ঝরঝর করে জল বেরিয়ে আসতে চাইত।
এ অকূলেও কূল পেয়ে গেলাম। পথ বাৎলে দিলেন স্বয়ং আবুনসর মোক্তার সাহেব। বাবার এই সাংঘাতিক অসুখের সময় তিনি এক সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এলেন। আগের দিনে এলে যেমন করতেন, তেমনি অত্যন্ত প্রসন্নভঙ্গিতে কথাবার্তা কইলেন। আগে কেন তাঁকে খবর দেয়া হয়নি সেজন্য মৃদু স্বরে আমাদের বকলেন। বাবার কপালে হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করলেন। চুক-চুক আফসোস করলেন। কথাবার্তার ভঙ্গিটি এরকম যেন কোনোদিন তার সঙ্গে আমাদের টু শব্দটি হয়নি। মনে হল, মার সঙ্গে তিনি আগের চাইতেও সমীহ করে কথাবার্তা বলছেন। তাঁর আগমন আমাদের বাড়িতে এতই অভাবিত যে আমরা পান তামাকটা দেয়ার কথাও ভুলে গেছি। এরই মধ্যে অর্থস্বার্থ বুদ্ধি পরামর্শের জোরে মোক্তার সাহেব একজন দেশের কেউকাটা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যে এমনভাবে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অনেকক্ষণ বসে নানা সুখ-দুঃখের কথা কইলেন।
যাওয়ার সময় মাকে উঠোনে ডেকে নিলেন। নারকেল গাছের হেলানো ছায়াটির নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চুপি চুপি কি সব কথাবার্তা কইলেন। তারপর গমিত হলেন। সন্ধ্যেটা গাঢ় হয়ে এসেছে। আমাদের জীর্ণ বাড়িতে ঝিঁঝির চিৎকার ঘনায়মান অন্ধকারকে আরো ভুতুড়ে করে তুলেছে। মা ঘরে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। মোক্তার সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি কি বলে গেলেন আমি জানতে চাইলাম না। মা তেমনি চুপ করেই রইল। ফের জিজ্ঞেস করলাম, কি বলে গেল? মা দুবার ঢোক গিলল। একবার আমার দিকে, একবার রুগ্ণ বাবার দিকে বড় করুণভাবে তাকালো। বুঝতে অসুবিধা হলো না, কথাটা বলতে মার কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে। যাহোক কথাটা বাবার গায়ের ওপর ভালো করে টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে মা বলল : আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না, পুকুর দিঘি সব আগের মতো আমাদের দখলে থাকবে। মোক্তার সাহেব নিজ ব্যয়েই বাড়িঘরের সংস্কার করিয়ে দেবেন। বাবাকে শহরে রেখে বিলেতফেরত ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। এটুকু বলে একটু থেমে মা বাবার মুখমণ্ডল আরেকবার ভালো করে দেখে নিল। আসল কথাটা বলবে কি না তখনো দ্বিধা করছিল।
কথাটা বাবা শীর্ণ হাতে মুখ থেকে সরিয়ে ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল : তারপর… তারপর কি বলল? এইবার মা বলে ফেলল। বিনিময়ে আমাকে শুধু তার বোবা মেয়েটিকে বিয়ে করতে হবে। বাবা একটিমাত্র ধ্বনি উচ্চারণ করলেন : কি? কেরোসিনের বাতিতে ঐ স্বল্পালোকিত ঘরে ঐ ছোট্ট ধ্বনিটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত যেন জ্বলতে থাকল। মা আর আমি পাশাপাশি বসে। বাবার মুখ দিয়ে সেই ছুঁছুঁলো ধ্বনিটি আবার তীরের মতো বেরিয়ে এল কি? তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পাশ ফিরে ঘুমালেন। তার বুকের গভীরে ফোঁসকা পড়ছে আর ভাঙছে।
মা কোনো বিষয়ে কোনোদিন মতামত দেয়নি। বাবা নিঃসাড়। সব জেনে সব বুঝেও হ্যাঁ বললাম আমি। কেন রাজী হয়ে গেলাম বলতে পারব না। লোভের বশীভূত করার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে। অতএব শ্রাবণ মাসের এক গুমোট দিনে আবুনসর মোক্তার সাহেবের বোবা মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বাবার অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে আসছিল। মা কেমন ঝিম মেরে গেল। মোক্তার সাহেব কথামতো বাবাকে হাসপাতালে রাখলেন। বড় ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার দেখলেন এবং ঘাড় ফেরালেন। তিনি হাসপাতালেই মারা গেলেন। বাবার পেছনে পেছনে গেলেন মা।