৩. সুলক্ষণা

সুলক্ষণা

কাশীতে এক বনেদি বংশের এইরূপ সর্বনাশসাধন করে বাঙালি Casanova কল্যাণ কুমার সোম দেওঘরে উপনীত হলেন। তাকে নিতে এসেছিল সত্যেনবাবুর মেজো ছেলে শুভ্র আর সত্যেনবাবুদের বাড়ি আড্ডা দিয়ে থাকে একটি যুবক, তার ভালো নাম যে কী তা কেউ জানে না, ডাক নাম মাকাল।

মাকালকে সোম একদা চিনত। আই-এতে দু-বছর একসঙ্গে একঘরে বসেছিল, এই পর্যন্ত। এতদিনে উভয়েরই আকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অবস্থা হরেদরে সেই একই—দু-জনেই বেকার। মাকাল জিজ্ঞাসা করল, ‘চিনতে পারছেন?’

‘পারছি বইকী,’ সোম বলল, ‘কিন্তু আপনি’ কেন? ‘তুমির কী হয়েছে?’

মাকাল খুশি হয়ে বলল, ‘বাপরে, তোমরা হলে বিলেতফেরত। তোমাদের সঙ্গে এক রাস্তায় হাঁটতে-পারা আমাদের মতো অস্পৃশ্যদের সৌভাগ্য।’

শুভ্র ছেলেটি স্কুলে পড়ছে। সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো তার মুখমন্ডল। তার জীবনে প্রভাতকাল। শুভ্রকে দেখে সোম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইচ্ছা করলে ওই বয়সের স্ত্রী পাওয়া যায়, কিন্তু ইচ্ছা করলে ওই বয়সকে ফিরে পাওয়া যায় না। যৌবন আনে ক্ষমতা, কৈশোর দেয় শ্রী। ক্ষমতার নেশায় শ্রীকে থাকা যায় ভুলে, কিন্তু নেশার ফাঁকে হঠাৎ একদিন তার ওপর দৃষ্টি পড়লে ক্ষমতাকে নিয়ে সান্ত্বনা পাওয়া যায় না। তাই ব্রজের গোপবালক চিরদিন আমাদের প্রীতি পেয়ে আসছে, কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণকে আমরা চিনিনে। বয়ঃ কৈশোরকং বয়ঃ।

সত্যেনবাবু বাতে পঙ্গু অবস্থায় সোমকে অভ্যর্থনা করলেন। ‘তুমি এসেছ দেখে বড়ো আনন্দ পেলুম। আমাদের এ দিকে তোমার মতো কৃতী, কালচারড যুবকের আসা একটা event. বুলুকে তোমার পছন্দ হোক বা নাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না, তোমার আসাটাই আমার পক্ষে ধন্বন্তরির আগমন।’

ভদ্রলোক বলে চললেন—বলা ছাড়া তাঁর করণীয় আর কী ছিল?—‘ইয়োরোপ! ইয়োরোপের আকর্ষণ আবাল্য আমাকে অস্থির করেছে, কিন্তু এজন্মে হয়ে উঠল না, যাওয়া হয়ে উঠল না। মা বুলু, শুনে যাও তো মা।’

আঠারো-উনিশ বছর বয়সের একটি সুগঠিতা সুমধ্যমা তরুণী সোমকে নমস্কার করে বলল, ‘কী বাবা।’

‘সেই পুরোনো মোটা ছবির বই দুটো একবার আনতে পারো, মা? ইনি দেখবেন। সেই যে ১৮০৪ সালের ছাপা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় মুদ্রিত।’

‘বুঝেছি,’ বলে বুলু বই আনতে গেল।

সত্যেনবাবু নিম্নস্বরে বললেন, ‘আমার বড়ো মেয়ে সুলক্ষণা। এরই কথা তোমার বাবাকে লিখেছি।’

মোটা মোটা দু-খানা ভল্যুম বুলু একা বয়ে আনছে দেখে সোম ছুটে যেতে দ্বিধা করল না। ‘দিন, দিন, আমার জন্যে আনা বই আমাকে দিন। এ কি অবলা জাতির কর্ম!’ সুলক্ষণার মৃদু আপত্তি সোম গ্রাহ্য করল না।

সত্যেনবাবু খুব হেসে বললেন, ‘অবলাজাতিকে অবজ্ঞা কোরো না হে। তুমি নিজেই দেখে এসেছ ওঁরা সমুদ্রে সাঁতরে পার হচ্ছেন, আকাশেও ওঁরা উড্ডীন। আর আমাদের বুলুর বীণাখানি দেখবে এখন।’

১৮০৪ সালে ইংলাণ্ডে মুদ্রিত সেই গ্রন্থে পটের মতো রংচঙে ছবির ছড়াছড়ি। নানা দেশের নানা বেশভূষাধারী মানুষের প্রতিকৃতি ও বর্ণনা। সেকালের যানবাহন তৈজস আসবাব ইত্যাদির অনুকৃতিও ছিল। সত্যেনবাবু সোমের মনোযোগ ভঙ্গ করে বললেন, ‘আমার সংগ্রহে এর চেয়ে পুরাতন চিত্রপুস্তকও আছে, কল্যাণ। দেখবে তুমি ক্রমে ক্রমে। এখানে থাকা হবে তো কিছুদিন?’

‘সেটা গৃহস্বামীর ইচ্ছাধীন।’

‘বেশ, বেশ, তোমার যতদিন খুশি ততদিন থাকো। তোমাদেরই জন্যে তো এ বাড়ি করেছি। আমার স্ত্রী নেই, আমারও থাকা-না-থাকা সমান। তান শুনতে শুনতে প্রাণটা আছে বীণার তারে বাঁধা। তুমি স্পিরিচুয়ালিজম বিশ্বাস করো তো?’

‘আজ্ঞে, না।’

‘বিশ্বাস যখন করো না তখন তোমাকে বোঝানো অসম্ভব, কী পথ্যের ওপর আমি বেঁচে আছি।’

ভদ্রলোকের চলৎশক্তি নেই, কিন্তু বলৎশক্তি বিলক্ষণ। বকবক করতে ভালোবাসেন বলে, যে-কেউ একটু মন দিয়ে বা মন দেবার ভান করে তাঁর কাছে একঘণ্টা বসল সেই তাঁর বয়স্যের মতো প্রিয় হল। মাকাল এদের অন্যতম। ভদ্রলোক যৌবনে কবিতা লিখতেন। শিশুপাঠ্য পুস্তকে কবি শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া আছে, ‘কবি—যে কবিতা লেখে।’ অতএব সত্যেনবাবু ছিলেন কবি। শোনা যায় তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সতীশচন্দ্র রায় প্রভৃতির সতীর্থ। তারপরে একটি মহকুমা শহরে এম-এ বি-এল উকীল রূপে তাঁর আবির্ভাব ঘটল। বাগ্মিতা ও বিদ্যা প্রথম কয়েক বছর রজতপ্রসূ হল না। রজতের অভাবে রন্ধনগৃহে ইন্ধনের অভাব হলে গৃহিণী একদিন কবিতার খাতাগুলির দ্বারা সে অভাব দূর করলেন। এমন সময় রাজায় প্রজায় বাধল দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা। সব উকিল জমিদারের মুঠায়। একা সত্যেন রক্ষা করেন প্রজাদের স্বত্ব। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন এক কানা মোক্তার। প্রজারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা করে মামলার খরচা জোগাল আড়াই বছর। সত্যেন উকিল ও সফররাজ হোসেন মোক্তার পকেট ও জেব বোঝাই করে আর পায়েহেঁটে বাড়ি ফিরতে পারলেন না, গাড়ি কিনে ফেললেন। আর বাড়ি ফিরে কি আরাম আছে—মহকুমা শহরের বাড়ি! হোসেন চললেন হজ করতে। সত্যেন দালান দিলেন দেওঘরে। জমিদারের সঙ্গে বিবাদ করে ওকালতি করা যায় না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সংসারও তাঁর বিস্বাদ বোধ হল। আড়াই বছরে উপার্জন যা করেছিলেন তা পঞ্চাশখানা গ্রামের পঁচিশ হাজার কৃষকের সঞ্চয় ও ঋণ। তার সুদের সুদে পুরুষানুক্রমে বীণা বাজানো যায়।

যৌবনে যখন তিনি কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কন্ঠস্বর তখন থেকেই তিনি অনুকরণ করে আসছিলেন। অবশ্য সদরে। অন্দরে তাঁর কন্ঠস্বর তাঁর স্বকীয়। তবে সোমের আগমনে তাঁর সদর অন্দর একাকার হয়ে গেছে। মাকাল যা বর্ষাধিক কালের সাধনায় লাভ করতে পারল না, সোম শুধুমাত্র বিলিতি ডিগ্রির জোরে তাই দখল করল। সোমের জন্য রান্না করল স্বয়ং বুলু। পাতা পড়ল বিশেষ একটি ঘরে। পর্বতকে মহম্মদের কাছে বয়ে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে তিনি যে পথ্য গ্রহণ করলেন বলা বাহুল্য তা স্পিরিচুয়ালিজম নয়।

‘ওরে বুলু’, তিনি খেতে বসে বললেন, ‘তোর হাতের অমৃত ভুঞ্জন যে ফুরিয়ে এল আমার। বাবা কল্যাণ, আশা করি অমৃতকে তুমি অমৃত বলবে।’

সোম বলল, ‘আর একটু ঝোলামৃত পেলে মন্দ হত না।’

সত্যেনবাবু ব্যস্ত হয়ে রবীন্দ্রেতর স্বরে বললেন, ‘আর-একটু, আর-একটু ঝোল দিয়ে যা তো এঁকে।’

রাত্রে সংগীতের জলসা। হিন্দি ও বাংলা গানের ওস্তাদদের পালা সাঙ্গ হলে সুলক্ষণা শ্রোতৃমন্ডলীকে নমস্কার করে বীণা হাতে নিল। চর্তুদিকে ধ্বনিয়ে উঠল, ঝনন ঝনন ঝন। বীণাবাদনের দ্বারা সে একটি মায়াময় পরিমন্ডল সৃজন করতে থাকল। যেন আদেশ দিল, “Let there be light.”  অমনি আলোকের জন্মরহস্যে পূর্বদিকে উদ্ভাসিত হল। তারপর হুকুম করল, ‘Let there be a firmament.’ অমনি প্রকাশিত হল মহাকাশ।

গান-বাজনার ভালোমন্দ সোম বোঝে না, সংগীতে তার প্রবেশ নেই। সেই যে তার এক বন্ধু প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামের গ্যালেরিতে লম্বমান আলেখ্যরাজি সম্পর্কে বলেছিল, ‘এ আর কী দেখব? এর একটা অন্যটার মতন। হুবহু এক।’ তেমনি রাগরাগিণী সম্বন্ধে সোমেরও পার্থক্যভেদ ছিল না, ওসব হুবহু এক। তা সত্ত্বেও সংগীতের সম্মোহন সরীসৃপকে বশ করতে পারে, সোম তো মানুষ। সুলক্ষণা যেন তাকে মন্ত্র পড়ে বন্দি করল। বীণাবাদনের সঙ্গে জড়িয়ে বীণাবাদিনীকে সোম অসামান্য রূপলাবণ্যবতী অপ্সরা জ্ঞানে পুরস্কারস্বরূপ তার হৃদয় নিক্ষেপ করল। চেয়ে দেখল সত্যেনবাবু চোখ টিপে মাথা নেড়ে তারিফ করছেন, মাকাল ঢুলু ঢুলু, ফটিকবাবু প্রবোধবাবুরা হাত দিয়ে ঊরুর উপর তাল ঠুকছেন।

সুলক্ষণা বাদন সারা করে আবার একটি নমস্কার করে বীণা নামিয়ে রাখল। সকলে গর্জে উঠলেন, সাধু সাধু সাধু। প্রশংসা বাক্যের কোলাহলমুখর হট্টস্থলী ত্যাগ করে সোম বাইরে নক্ষত্র সভামন্ডলের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। তার মনে হতে লাগল সে অমন একটা ব্রত গ্রহণ না করলেই পারত, কে তাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল। এই মেয়েটিকে স্ত্রীরূপে পাবার প্রস্তাব আজই করা যায়, সত্যেনবাবু তো তাই প্রত্যাশা করছেন। বিয়ের পরে কোন মেয়ে স্বামীকে ভালো না বাসে যদি স্বামীর ভালোবাসা পায়? সোম তাকে খুব—খুব—খুব ভালোবাসবে, তার বীণা শুনে তার কোনো খুঁত মনে আনবে না।

খাবার সময় সত্যেনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হে! বুলুর তানালাপ তোমার কেমন লাগল তা তো বললে না?’

সোম শুধু বলতে পারল, ‘আমি মুগ্ধ হয়েছি।’ তার তখন একমাত্র চিন্তা তার ব্রতের কী হবে।

‘ওরে বুলু, শোন, ইনি কী বলছেন। তোর শিক্ষা সার্থক। তুমি বোধ হয় জানো না, কল্যাণ, ওকে আমি শান্তিনিকেতনে দিয়েছিলুম। কবি বড়ো স্নেহ করতেন। ওকে স্বহস্তে একটি কবিতা লিখে দিয়েছেন, দেখবে এখন।’

প্রতিভা ও সাধনা বিয়ের বাজারে না বিকেলে সার্থক হয় না, ও-কথা থেকে সোম এই সিদ্ধান্ত টেনে বার করল। তখন তার অন্তর বিষিয়ে উঠল প্রতিবাদের তীব্র তাড়নায়। ব্যাঙ্গোক্তি তার মুখের প্রান্তে টলমল করল। সে বলতে চাইল, ‘বীণা বোধ করি এত ভালো করে বাজত না যদি না তার ওপর ঘটকালির ভার থাকত।’ কিন্তু তাতে সুলক্ষণা আঘাত পাবে। আনন্দদায়িনীকে আঘাত করতে সোমের মুখ ফুটল না।

সোমের মোহ অপগত হল। সে ভাবল, মেয়েদের কলানুশীলন বিবাহান্ত। বিবাহের পরে কাব্য তোলা হয় শিকায়, বীণা জমা হয় মালগুদামে। বিবাহের দু-বছর পরে শিবানী যা সুলক্ষণাও তাই—গৃহিণী এবং জননী। ওদের যে-কোনো একজনকে নিয়ে সুখে-দুঃখে গৃহকোণে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবে কেন সুলক্ষণার বেলায় ব্রতের ব্যতিক্রম হবে? না, হবার কোনো কারণ নেই। হবে না।

পরদিন সত্যেনবাবুকে তার ব্রতের কথা বলবে-বলবে করছে এমন সময় তিনি আপনি প্রস্তাব করলেন, ‘যাও তোমরা, বুড়ো মানুষের কাছে বসে থেকো না। একটু বেড়িয়ে এসো।’

সোম, শুভ্র, সুলক্ষণা ও মাকাল বেড়াতে বেরোল। সোমের আশা হল যে মাকাল ও শুভ্র একটু দূরে দূরে হাঁটবে ও নিজেদের মধ্যে গল্প করতে থাকবে। সোম শুনতে পেল মাকাল শুভ্রকে বলছে, ‘আমি রেস খেলি তার আসল কারণ কি জানো? জীবনের সর্ববিধ প্রকাশে আমার সমান আগ্রহ।’ শুভ্র তা নিয়ে তর্ক করছে। ছেলেমানুষি তর্ক—নীতিবচন আওড়ে হিতাহিতের ভাগবাঁটোয়ারা। মাকালের সর্ববিধ প্রকাশে সমান আগ্রহ যে খাঁটি মাকাল তা প্রতিপন্ন করছে পোশাকে। তার পরনে টেনিস ট্রাউজার্স, কোটের বদলে ড্রেসিং গাউন, হ্যাটের বদলে পশমের টুপি; তার পায়ে বিদ্যাসাগরি চটি। সোমের হাসি পেল। সে সুলক্ষণাকে বলল, ‘সান্ধ্যভ্রমণের পক্ষে ওরূপ পোশাকের কোনো উপযোগিতা আছে কি?’

সুলক্ষণা মৃদু হেসে বলল, ‘ওঁর বিশ্বাস উনি রবীন্দ্রনাথের অনুবর্তন করছেন। মহাকবি জুতো ভেঙে চটির মতো করে পায়ে দেন, পরেন পায়জামা ও চড়ান আলখাল্লা। তাঁর টুপিরও মাকালদা নকল করেছেন। আপনি শুনলে অবাক হবেন যে মাকালদা ওই পোশাকে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন।’

সোম অবশ্য অবাক হল না। সবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবি তাঁর পরিচ্ছদের প্যারডি দেখে কী বললেন?’

‘কী আর বলবেন? বোধ হয় ভাবলেন যে, সব হয়েছে, দাড়িটি হয়নি।’

সোম কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনে গেছল। তখন সুলক্ষণা ওখানে ছিল কি না, থাকলে সোম তাকে দেখেছে কি না, তাই নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল, ততক্ষণে মাকালরা অনেকদূর গেছে। ইচ্ছাপূর্বক কি অন্যমনে তা কে বলবে?

‘আপনার সঙ্গে,’ সোম চলতে চলতে বলল, ‘নির্জনে আমার কিছু কথা ছিল’।

এতক্ষণ যে কথাবার্তা হচ্ছিল সেও নির্জনে, তব সেটা নির্জনে বলে সুলক্ষণার খেয়াল ছিল না। ‘নির্জনে’ শব্দটার প্রয়োগে সে সহসা সচেতন হয়ে সচকিতভাবে এদিক-ওদিক চেয়ে নিল। পুরুষমানুষের সঙ্গে সে কতবার কথা কয়েছে, কিন্তু এক ঝাঁক পাখির মধ্যে একটি পাখির মতো। শান্তিনিকেতনের মেলামেশা ঝাঁকে বন্ধ থেকে, তাই বাড়িতেও মেলামেশার সময় ঝাঁক না থাকলে ফাঁক বোধ হয়, গা ছম ছম করে।

যে-মেয়েটি এতক্ষণ বেশ সপ্রতিভ ছিল তার ব্যবহারে কেন এল আড়ষ্টভাব, সোম তা বুঝতে পারল না। কিন্তু লক্ষ করল। বক্তব্যটাকে এমন মানুষের গ্রহণযোগ্য করবার জন্যে সে নীরব থেকে নিজের মনে বহু বার মহলা দিল, মোলায়েম করল।

বলল, ‘সুলক্ষণা দেবী, আপনাদের বাড়িতে আমি কেন অতিথি হয়েছি তা হয়তো জানেন, অন্তত অনুমান করেছেন। আপনাকে আমার কেমন লাগল আপনার বাবা প্রকারান্তরে এই প্রশ্নই করেছিলেন, আমি যে উত্তর দিয়েছি আপনি তা শুনেছেন। এখন আমাকে আপনার কেমন লাগল এই আমার জিজ্ঞাস্য।’

সুলক্ষণা তার সপ্রতিভতা ফিরে পেল, কিন্তু ভাষা ফিরে পেল না। এবার শঙ্কা নয়, লজ্জা।

‘বুঝেছি, সুলক্ষণা দেবী,’ সোম বলল, ‘আপনার ছিল বীণা, সেই দিল আপনার পরিচয়। আমার তো তেমন কিছু নেই, আমি আপনার অপরিচিত। অপরিচিতকে কেমন আর লাগবে!’

সুলক্ষণার কুন্ঠিত দৃষ্টি থেকে এর অনুমোদন পেয়ে সোম বলে গেল, ‘আপনার পরিচয় বীণাতে, আমার পরিচয় বাণীতে। বীণা চেয়েছিল জনতা, বাণী চায় বিজনতা। এখন বুঝলেন তো কেন নির্জনে কিছু কথা ছিল?’

‘নির্জনে’ শুনে সুলক্ষণা আবার চমকাল। কিন্তু এবার সে ঔৎসুক্য বোধ করছিল। সোমের পরিচয় বিজ্ঞাপনে যা পড়েছিল তার বেশি কী হতে পারে শোনা যাক। সে কি শিকারি, না সে বাঁশি বাজায়, না সে খুব বেড়িয়েছে ও বেড়াতে ভালোবাসে?

সোম বলল, ‘সুলক্ষণা দেবী। আমি গুণী নই। গান-বাজনার সারেগামা ও পোর্তুগালের ভাস্কোডাগামা এদের মধ্যে কে কার মামা জানিনে। হাসছেন? তবে কেউ কারুর মামা নয়। বাঁচা গেল। গামার কথায় মনে পড়ল আমি পালোয়ান নই। পালের কথা যখন উঠল তখন বলি গোষ্ঠ পাল হয়ে থাকলে দেওঘরের বল কিক করে গিরিডিতে ফেলতুম, সেই হত আমার পরিচয়। খুব হাসছেন। তা বলে মনে করবেন না যে আমি হাস্যরসিক। লেখকও নই, অভিনেতাও না। আর হাসাতে যদিও পারি হাসতে তেমন পারিনে। ভাবছেন, হয়তো সিনিক। না, সুলক্ষণা দেবী, বিধাতা ও তাঁর বিধানের ওপর আমার আক্রোশ, কি অভিমান, কি সংশয়, কি অশ্রদ্ধা নেই।’

এই পর্যন্ত এসে সোম হঠাৎ থামল। শুধাল, ‘শুনতে আগ্রহ বোধ না করলে বলুন বন্ধ করি।’

সুলক্ষণা সলজ্জভাবে বলল, ‘না।’

সোম দুষ্টুমি করে বলল, ‘শুনবেন না? তাহলে বন্ধ করি।’

সুলক্ষণা আবার তেমনি সলজ্জভাবে বলল, ‘না।’

‘কোনটা না? শোনাটা, না বন্ধ করাটা?’

নাছোড়বান্দার হাতে পড়েছে, খুলে বলা ছাড়া গতিরন্যথা। কিন্তু কথাটা যেই তার মুখ ছেড়ে রওনা হল মনটা অমনি লজ্জায় মাটিতে মিশিয়ে গেল।

সোম হৃষ্ট হয়ে বলল, ‘বেশ, এখন আমার সাত খুন মাপ। তবে খুন আমি হিসাব করে দেখতে গেলে ছয় বার করেছি—’

সুলক্ষণা ‘উঃ’ বলে উঠে থমকে দাঁড়াল। তার পাংশু মুখে আতঙ্কের নিশান।

সোম হেসে বলল, ‘ভয় নেই, আপনাকে খুন করব না। খুন-খারাবি জীবনের মতো ত্যাগ করেছি, সুলক্ষণা দেবী।’

এতক্ষণে সুলক্ষণার ঠাহর হল যে খুন করা অর্থে অন্যকিছু বোঝায়। নিজের মূর্খতায় লজ্জিত হওয়ায় আবার তার মুখে রক্ত সঞ্চার হল। সে অস্বস্তির স্বরে বলল, ‘ওঃ!’

‘ওঃ!’ সোম বলল পরিহাসভরে। ‘আপনাকে সবই বিশ্বাস করানো যায় দেখছি। যেমন অকস্মাৎ বললেন ‘উঃ’ তেমনি অবলীলাক্রমে বললেন ‘ওঃ!’ এবার আমি যদি ঘোষণা করি যে আমি লোকটা কেবল যে নির্গুণ তাই নয় আমি রীতিমতো চরিত্রহীন তাহলে আপনি বোধ করি তৎক্ষণাৎ বলবেন ‘ইস’! কেমন?’

সুলক্ষণা নিরুত্তর।

‘কিন্তু,’ সোম গম্ভীরভাবে বলল, ‘এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা যার জন্যে করা গেল সেটা ও ছাড়া আর কিছু নয়, সুলক্ষণা দেবী!’

‘বুঝতে পারলুম না,’ সুলক্ষণা উদ্ভ্রান্ত হয়ে বলল।

‘বলছিলুম,’ সোম সভয়ে বলল, ‘আমি চরিত্রহীন।’

‘ছি,’ সুলক্ষণা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘যা তা বলবেন না।’

‘বিশ্বাস করলেন না?’ সোম কাতরস্বরে শুধাল।

‘না।’ সুলক্ষণা বলল দৃঢ়ভাবে।

‘কিন্তু,’ সোম অনুযোগের স্বরে বলল, ‘পরে আমাকে দোষ দেবেন না এই বলে যে আমি আপনার সঙ্গে সত্যাচরণ করিনি।’

সুলক্ষণা বাস্তবিক বুঝতে পারছিল না। সরোষে বলল, ‘বুঝতে পারছিনে, কল্যাণবাবু।’

সোম হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘চলুন, ফেরা যাক। বিয়ে যে আমাকে করবেন সে ভরসা আমার নেই। খামকা আপনাকে আমার বিশ্বাসভাগী করি কেন?’

সুলক্ষণা বিমনা হয়ে রইল, বাড়িতে কারুর সঙ্গে কথা কইল না সহজে। সত্যেনবাবুর মনে ধোঁকা লাগল। মাকালকে ডাকিয়ে গোপন তদন্ত করলেন। সে বলল ‘ওঁদের মধ্যে কী নিয়ে আলাপ হল, কী আলাপ একেবারে হলই না, তা তো আমি জানিনে। আমার কি স্বার্থ বলুন, কেন চরবৃত্তি করব?’

মাকালের মতো মহা ভক্তের মুখে এমন রূঢ় বিদ্রোহের কথা সত্যেনবাবু এই প্রথম শুনলেন। কিছু একটা ঘটেছে, বেশ একটা রহস্যময় ঘটনা, রোমহর্ষকও হতে পারে, এই সন্দেহ পঙ্গুকে একান্ত অসহায় বোধ করাল। এমনিতেই তিনি বিষম অভিমানী মানুষ, অভ্যস্ত ভক্তি শ্রদ্ধার এক ছটাক কম পড়লে তাঁর চক্ষু ক্রমশ জলাশয় হয়ে ওঠে, কেউ যদি তাঁর বাগ্মিতার প্রতি অমনোযোগী হল অমনি তাঁর কন্ঠস্বরে আদ্রতা উপস্থিত হয়। আর প্রতিবাদ যদি কোনো হতভাগা কোনো কথার করল তবে তিনি এক নিমেষে হুতাশন। ‘আমি মূর্খ? আমি মূঢ়? আমি অকবি? আমি অতরুণ? এই তো তোমার—না, না, আপনার—মনোগত ধারণা? এই তো? এই তো? ধিক, পিতৃবয়সি পিতৃকল্প ব্যক্তির প্রতি ঈদৃশ অনাস্থা, অশ্রদ্ধা, অশিষ্টতা, অর্বাচীনতা। গুরুদেবকে সেদিন আমি টেলিগ্রাম করে আপত্তি জানিয়েছি, জানিয়েছি যে তিনি বুদ্ধদেব বসুর প্রশংসা করে আমাদের দফাটি সেরেছেন, ওই সর্বনেশে ছোকরার সুখ্যাতিতে সর্বনেশে ছোকরাদের সংখ্যা ও প্রতিপত্তি যে কতখানি বেড়ে গেছে তার দৃষ্টান্ত তুমি—না, না, আপনি।’

মাকাল যে তার সমবয়সিদের মতো দুর্বিনীত দুর্নীত দুঃশীল নয় এর দরুন তার জন্যে সত্যেনবাবুর হৃদয়ের এক কোণে একটু জায়গা ছিল। তিনি তাকে কিছু স্নেহ করতেন। তাই তার ওই অনাত্মীয়ের মতো উক্তি যেন পাহারাওয়ালার ‘ভাগ যাও, হামকো কুছ মৎ পুছো’র মতো তাঁর কানে ও প্রাণে বাজল। তিনি মুখে রুমাল চেপে ক্রন্দনবেগ রোধ করলেন। তাঁকে প্রকৃতিস্থ করতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেল। সে-রাত্রেও বীণাবাদনের অপেক্ষাকৃত ঘরোয়া বন্দোবস্ত ছিল, তা বিগড়াল!

সত্যেনবাবু শুভ্রকে একান্তে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর দিদির সঙ্গে কল্যাণবাবুর কথাবার্তা কী হয়েছে রে?’

‘তা তো আমি,’ শুভ্র ঢোক গিলে বলল, ‘বলতে পারব না। আমি মাকালদার সঙ্গে তর্ক করতে করতে ওদের সঙ্গ ছেড়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছলুম, ফেরবার সময় ঠিক ততখানি পেছিয়ে পড়তে বাধ্য হলুম।’

বোনের বিমনাভাব, বাপের কাতরতা, সোমের বিস্ময়, মাকালদার মৌনতা—এত কান্ডের পরে শুভ্ররও মনে হতে লাগল যে কিছু একটা ঘটেছে, বেশ একটা রহস্যময় ঘটনা, রোমাঞ্চকরও হতে পারে। সে দিদিকে একাকিনী পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘দিদিভাই, কী হয়েছে?’

দিদি বলল, ‘আমিও তাই জানতে চাই তোর কাছে, যদি তুই জানিস।’

সোমের সঙ্গে তার তেমন আলাপ হয়নি। তবু সে সংকোচ কাটিয়ে সোমকে চুপটি করে বসে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কল্যাণবাবু, আপনি কি জানেন কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে?’ সোম শুভ্রর প্রশ্নের পুনরুক্তি করল।

‘আপনি জানেন না?’

‘তুমি জানালেই জানব।’

‘বা রে, আমি নিজে জানতে এলুম যে।’

‘তাই বলো। আমি এতক্ষণ ধরে ভাবছি কার কাছে জানতে চাইলে জানতে পাব। আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না? আমরা সবাই যদি সমবেত হয়ে যে যতটুকু জানি ততটুকু বলি।’

শুভ্র উৎফুল্ল হয়ে সম্মতি দিল। বলল, ‘তাহলে গ্র্যাণ্ড হয়। রাউণ্ড টেবল কনফারেন্স।’

সে গেল সভা ডাকতে।

সভা বসল।

সত্যেনবাবু প্রথম বক্তা। তিনি বললেন, ‘বুলু-মাকে কেমনতর আনমনা দেখে কী যেন একটা ভাব বেণুবনে দখিন হাওয়ার মতো আমার মর্মে গুঞ্জরিত হতে থাকল, মাকালকে ডেকে বললুম, হ্যাঁ রে কী হয়েছে বলতে পার? তা তিনি চোখ রাঙিয়ে তর্জন করে বললেন, আমি কি গুপ্তচর? অমন তাড়না পেয়ে আমি তো বেত্রাহত কুক্কুরের মতো কোঁ করে উঠলুম। অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো হয়েছিল, সামলে নিতে পেরেছি এই ঢের।’

মাকাল তাঁর ভ্রম সংশোধন করল না। মজনুর মতো দেওয়ানা হয়ে দেশে দেশে বেড়াবে কি না এই তার তখনকার চিন্তা। তার মতো বেকার যুবকের যাঁহা দেওঘর তাহা হিমালয়। তবে দেওঘর অঞ্চলে তার বাবা খানকয়েক বাড়ি করে গেছেন, সে দেওঘর ছাড়লে ভাড়াটা ঠিকমতো আদায় হবে কি না এই সন্দেহ থেকে দেওয়ানা হওয়া নিয়ে দ্বিধা।

‘দেখ মাকাল,’ সত্যেনবাবু তাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তুমি আমার পুত্রপ্রতিম, আমি তোমার পিতৃবয়সি না হই মাতৃবয়সি। অমন তেরিমেরি করে তেড়ে-আসা তোমার কাছে প্রত্যাশা করিনি। অত্যাধুনিক সাহিত্যিকদের ও-দোষ একচেটে বলে জানতুম।’

মাকাল এবার যথার্থ উত্তপ্ত হয়ে বলল, ‘অতিরঞ্জনের দ্বারা সুলক্ষণার নিকট আমাকে লঘু করবেন না। তিনি অন্যকে বিয়ে করতে পারেন কিন্তু,’ বলব কি বলব না করতে করতে বলে ফেলল, ‘আমার মানসী।’

সত্যেনবাবুর সাহিত্য ও জীবন উভয় স্বতন্ত্র ছিল। পরের বেলায় যাই হোক না কেন তাঁর ঘরের বেলায় এর ব্যত্যয় তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর মেয়ে মাকালের মানসী এ কথা শুনে তিনি পঙ্গু না হয়ে থাকলে লম্ফ দিয়ে ধৃষ্টের চুল চেপে ধরতেন। অধুনা অদৃষ্টের ওপর অভিমান করলেন, কিন্তু তাই করে ক্ষান্ত হলেন না, কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘তবু যদি ডিগ্রি থাকত, ওদেশি না হোক এদেশি। বড়ো মুখে ছোটো কথা সইতে পারা যায়, কিন্তু ছোটো মুখে বড়ো কথা!’

মাকাল বেপরোয়াভাবে বলল, ‘A man’s a man for a’ that!’

সত্যেনবাবু পরাস্ত হয়ে আর্তস্বরে বললেন, ‘কল্যাণ, তোমার সাক্ষাতে ওই মূর্খ আমার কন্যার কাছে প্রেম নিবেদন করছে তুমি সহ্য করছ! তুমি কি শিশুপাল?’

সোম বলল, ‘নিজে প্রেমিক না হলেও প্রেমিককে আমি বড়ো বলে মর্যাদা দিয়ে থাকি। মাকালের নিবেদন আমার নিবেদনের চেয়ে বড়ো। সুলক্ষণা যদি ছোটোকে অগ্রাহ্য করে বড়োকে বরণ করেন তবে আমি সাহ্লাদে বরযাত্রী হব।’

সত্যেনবাবু চোখ বুঝে শুয়ে পড়লেন। সোম সুলক্ষণার দিকে চেয়ে দেখল সে মাথা নীচু করে দুই-এক ফোঁটা চোখের জল ফেলছে। অপমানে তার কর্ণমূল আরক্ত।

পরদিন সত্যেনবাবু সোমকে কাছে বসিয়ে চাপা সুরে বললেন, ‘কাল কী ছেলেমানুষি করেছ বলো দেখি। তোমার সঙ্গে মাকালের তুলনা! ওটা যে গ্রাজুয়েটই নয়, আধখানা মানুষ।’

‘কিন্তু,’ সোম বলল, ‘ওর বিষয়-সম্পত্তি যা আছে তা অনেক গ্র্যাজুয়েটের নেই এবং হবে না।’

‘তা ছাড়া,’ সত্যেনবাবু চুপি চুপি বললেন, ‘ও রেস খেলে।’

‘রেস খেলা,’ সোম বলল, ‘ক্যানসার-সদৃশ অসাধ্য ব্যাধি নয়। সুলক্ষণার চিকিৎসায় সারতে পারে।’

‘অনিশ্চিতের মধ্যে ঝাঁপ দিতে যাব কেন? তুমি বিদ্যায় বিত্তে ও চরিত্রে কেবল মাকালের কেন দেশের সহস্র সহস্র যুবকের ঊর্ধ্বে। তোমাকে না দিয়ে ওকে মেয়ে দিতে কোন মেয়ের বাপের দুর্মতি হবে?’

‘বিদ্যার ও বিত্তের বিষয় হয়তো ঠিক। কিন্তু চরিত্রে যে আমি মাকালের তথা দেশের সহস্র সহস্র যুবকের ঊর্ধ্বে এর কি আপনি কোনো প্রমাণ পেয়েছেন? না আপনার চারিত্রিক মান কৌমার্য্যের দাবি মানে না?’

‘কী বললে?’ সত্যেনবাবু কানের গোড়া রগড়ালেন।

‘অর্থাৎ লোকে যাকে চরিত্রহীন বলে আপনি কি তাকে সচ্চরিত্র বলেন?’

সত্যেনবাবু তিক্তস্বরে বললেন, ‘ও প্রশ্ন কেন উঠল?’

সোম অকুন্ঠিতভাবে বলল, ‘এইজন্য যে আমি লৌকিক অর্থে চরিত্রহীন।’

‘যা তা বোলো না, কল্যাণ।’ সত্যেনবাবু অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন। ‘আমি জানি তোমরা অত্যাধুনিকরা আমাদের খ্যাপাবার জন্যে অযথা দুর্বৃত্ততার ভান করে থাকো। আমাদের সময় আমরা বিধবা বিবাহের ভয় দেখিয়ে গুরুজনকে জব্দ করতুম।’

সোম বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন না-করুন আমার নষ্ট কৌমার্য্যের সংবাদ আমি সময় থাকতে জানিয়ে রাখলুম, সত্যেনবাবু।’

‘ওহো!’ বলে সত্যেনবাবু যেমন ছিলেন তেমনি রইলেন, তাঁর মুখে কপাট পড়ল না, চোখে পলক পড়ল না। আকস্মিক পক্ষাঘাত যেন তাঁর সকল অঙ্গ অসাড় করে দিল।

‘ও কী!’ বলে সোম চেঁচিয়ে উঠল। শুভ্র, সুলক্ষণা ও বাড়ির চাকর-বাকর ছুটে এল। কিছুক্ষণ ঝাড়ফুঁকের পর সত্যেনবাবুর হাঁ বুজল ও চোখ বন্ধ হল। সোম এতক্ষণ ভাবছিল কাশীর দাশরথি বাবুর দোসর জুটল নাকি? সে যেখানে যায় সেখানে শনির অভিশাপ বহন করে নিয়ে যায়।

সে ওঠবার উদ্যোগ করলে সত্যেনবাবু তা দেখে ইশারায় জানালেন বোসো। ইশারায় অন্যান্যদের জানালেন ঘর থেকে যেতে।

ভাঙা গলায় বললেন, ‘চারিত্রিক আদর্শ অনুচ্চ হলে পত্নীর মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করে থাকতুম।’

সোম বিনীতভাবে বলল, ‘কিন্তু সেটা তো চরিত্রের নয় প্রেমের পরাকাষ্ঠা।’

সত্যেনবাবু খুশির ক্ষীণ হাসির সঙ্গে বললেন, ‘চরিত্র ও প্রেম ভিন্ন নয়, বাবাজী। তোমরা যতই আধুনিক বলে বড়াই করো না-কেন তোমরা এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করোনি। আমার স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ তো তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে যাবার কথা, কায়াহীনের প্রতি কীসের অনুরাগ? আর তিনি যখন এ বাড়িতে নেই ও প্রত্যাবর্তন করবেন না তখন অন্য কেউ তাঁর স্থান পূরণ করলে তাঁর আপত্তির কী হেতু থাকতে পারে?’

‘কিন্তু তাঁর স্মৃতি,’ সোম স্নিগ্ধকন্ঠে বলল, ‘আপনার মন থেকে এক দন্ড অন্তর্হিত হয়নি। অন্যকে স্পর্শ করতে গেলে সেই স্মৃতি মারবে চাবুক।’

‘ঠিক বলেছ, বাবাজী’ তিনি পৃষ্ঠপোষকের মতো বললেন, ‘কিন্তু শুধু তাই নয়। স্মৃতি লোপ পেলেও তিনি ওপারে বসে আমার প্রতীক্ষা করতে থাকবেন। আমি যে স্পিরিচুয়ালিজম মানি। ওপারে যেন তিনি বাপের বাড়িতে আছেন আর এপারে আমি অন্য-স্ত্রী-সঙ্গ করছি—হোক না সে বনিতা, নাই বা হল সে পণ্য স্ত্রী—ছি ছি ছি। না, আমার চারিত্রিক আদর্শ এত নীচ নয়।’

‘এর জন্যে,’ সোম গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমি আপনাকে সাধুবাদ দেব না, সত্যেনবাবু। যিনি ওপারে গেছেন তিনি যে ইতিমধ্যে পত্যন্তর গ্রহণ করেননি তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আমি পাইনি। যদি পাই তবুও স্বীকার করব না যে তাঁর প্রতি আপনার সেই চারিত্রিক দায়িত্ব আছে যা তাঁর প্রতি ছিল তিনি যখন বাপের বাড়ি থাকতেন। স্ত্রীর অবর্তমানে স্বামীরা সৎ থাকেন এই প্রত্যাশায় যে তাঁদের অবর্তমানে স্ত্রীরা থাকবেন সতী। আপনার সৎ থাকার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ,’ সোম অতি সন্তর্পণে বলল, ‘আপনার স্ত্রী এখন কায়াহীন।’

সত্যেনবাবু রাগ করলেন না, সোমের প্রতি করুণা প্রকট করলেন তাঁর চাউনিতে। যেন নীরবে বললেন, হায়রে পাশ্চাত্য materialist!

সোম এটা-ওটার পর এক সময় বলল, ‘তাহলে আমি কলকাতা চললুম কাল। এখানকার কাজ তো হলনা।’

সত্যেনবাবু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হলো না কীরকম?’

‘আমি যে চরিত্রহীন।’ উত্তর দিল সোম।

‘আহা।’ সত্যেনবাবু সর্বজ্ঞের মতো বললেন, ‘বিলেত জায়গাটাই অমন। সেখানে চরিত্র নিয়ে ক-জন ফিরতে পেরেছে? তুমি তো তবু স্পষ্ট কবুল করলে।’

‘আমি,’ সোম উঠতে উঠতে বলল, ‘এই কথাটাই আপনার কন্যাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বলেছিলুম।’

‘কী সর্বনাশ!’ সত্যেনবাবু চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলেন। তারপর ক্রমাগত মাথা নাড়তে থাকলেন। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করতে থাকলেন, ‘রুদ্র যত্তে দক্ষিণমুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্।’

সোম সেখানে দাঁড়াল না।

সত্যেনবাবু যে সাধু ও ভন্ডের অপরূপ সমাহার এই আবিষ্কারের পর সোমের সুলক্ষণাকে বিবাহ করবার বাসনা শিথিল হয়ে এল। কে জানে সুলক্ষণাও হয়তো তাই। সোম যাত্রার আয়োজন করল। হতভাগ্য মাকালের বিষয় তার মনে ছিল। সোম চলে গেলে মাকাল হয়তো আবার এ বাড়িতে প্রবেশ পাবে আর পাবে আদর। সে যে সচ্চরিত্র।

একবার সুলক্ষণার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্যে সোম শুভ্রর কাছে আবেদন পেশ করল। ‘তোমার দিদিকে জিজ্ঞাসা করো তো তাঁর সঙ্গে কখন দেখা হতে পারে, যদি হয়।’

শুভ্র ঘুরে এসে বলল, ‘এখনি। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’

সুলক্ষণা শুভ্রর জন্যে কি কার জন্যে একটা পুলোভার তৈরি করছিল। সেলাই রেখে সোমকে নমস্কার করল। ‘বসুন।’ শুভ্রকে মিষ্টি করে বলল, ‘তুমি গিয়ে বাবার কাছে বসতে পারো।’

সোম ইতস্তত করে বলল, ‘সেই কথাটার কী হল জানতে পারি?’

সুলক্ষণা সেলাইয়ের থেকে চোখ না-তুলে বলল, ‘অবশ্য।’ তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগল, ‘আমার মা নেই, ভাই বড়ো হলে যেখানে কাজ পাবে সেখানে যাবে, বাবার সেবার ভার আমাকেই বইতে হয়। বিয়ের দায়িত্ব কি এই অবস্থায় নেওয়া উচিত?’

সোম একটু বিস্মিত হয়ে কয়েক মিনিট চুপ করে থাকল। তারপরে বলল, ‘যদি ভেবে চিন্তে এই স্থির করে থাকেন তবে আমাকে ও প্রশ্ন করা বৃথা। আর যদি আমার উত্তর শুনলে আপনার স্থির করা সুকর হয় তবে বলি, রোগীর শুশ্রূষা নার্সের কাজ, আপনি নার্সের ট্রেনিং পাননি বোধ করি। পরধর্ম সব সময়েই ভয়াবহ।’

‘কিন্তু’ সুলক্ষণা বলল, ‘বাইরের নার্স কি আপনার লোকের মতো হবে? মমতা যে শুশ্রূষার প্রধান উপাদান।’

সোম হেসে বলল, ‘বনের পাখিও পোষ মেনে আপনার হয়, নার্স তো নারী।’

সুলক্ষণা ঠোঁট উলটিয়ে বলল, ‘তার মানে নার্স হবে এ বাড়ির গৃহিণী। এই তো?’ সোম বলল, ‘এই।’

সুলক্ষণা দৃঢ়ভাবে বলল, ‘না, তা হতে পারে না, কল্যাণবাবু। আমার মায়ের স্থান অন্যের অধিকারে আসতে পারে না।’

‘How sentimental!’ সোম বলল ঈষৎ অবজ্ঞাভরে।

সুলক্ষণা ভ্রূ কুঞ্চনপূর্বক সোমকে নিরীক্ষণ করে বলল, ‘স্ত্রী-বিয়োগের পর গুরুদেব যে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি তিনিও তাহলে সেন্টিমেন্টাল?’

সোম হাসতে হাসতে বলল, ‘গুরুদেবই দেখছি নাটের গুরু। অন্য সকলে গড্ডলিকা।’

‘দেখুন,’ সুলক্ষণা উষ্মা গোপন করে বলল, ‘গুরুদেবের নিন্দা কানে বড়ো বাজে।’

‘কিন্তু’ সোম বুঝিয়ে দিল, ‘আমি তো গুরুদেবের নিন্দা করিনি, করেছি শিষ্যবৃন্দের নিন্দা।’

‘আপনার চেয়ে,’ সুলক্ষণা উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ‘আমার বাবা বয়সে অনেক বড়ো, চরিত্রেও। তাঁর বিচার আপনি না-করলে পারতেন।’

সোম থ হয়ে রইল।

‘বিলেত ঘুরে এসে লোকে ষত্ব ণত্ব ভুলে যায়। (সোম মনে মনে বলল, ব্যাকরণ কৌমুদীখানা আরেকবার খুলে দেখতে আলস্য বোধ করে।) অহংকারে ফুলতে ফুলতে সেই গল্পের ব্যাঙের মতো হাতিকে লাখি মারতে চায়। (সোম মনে মনে বলল, গল্পে শেষের টুকু নেই।)’

‘আর কিছু বলবেন?’ সোম প্রশ্ন করল।

‘না।’ সুলক্ষণা যেন সশব্দে কপাট দিল।

‘আমি’, সোম যথেষ্ট বিনয়ের সহিত বলল, ‘এমনি বেশ ভালোমানুষ। কিন্তু কোনো মেয়ের ওপর যদি ও যখন রাগ করি তবে ও তখন আমি রাবণ। আমার ইচ্ছা করে তাকে সীতার মতো লুট করে নিয়ে যেতে।’

সুলক্ষণা এর উত্তরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে গিয়ে আলমারির একটি দেরাজ থেকে বের করলে একটি ছোরা। সোমকে দেখিয়ে বলল, ‘এই আমার উত্তর।’

সোম একটু ভড়কে গেছল। সামলে নিয়ে বলল, ‘ব্যবহার জানেন তো?’

‘সেটার পরীক্ষা নির্ভর করছে আপনার ব্যবহারের উপর।’

‘নিশ্চিন্ত থাকুন। রাবণের ব্যবহারের মূলে ছিল প্রেম। লোকটা সীতাকে এত ভালোবাসত যে অন্তঃপুরে না-পুরে অশোক বনে ছেড়ে দিয়েছিল। অন্য কারুর প্রতি এমন অনুগ্রহ করেনি। আমার নেই প্রেম। হবেও না।’ এই বলে সোম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল।

সুলক্ষণা তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। কী ভাবল সেই জানে। বলল, ‘আপনার কিছু একটা ব্যথা আছে। তা বলে আপনাকে বিশ্বাস করা যায় না, মার্জনা অবশ্য করতে পারি—কিন্তু বিবাহের প্রতিষ্ঠা মার্জনার উপর নয় বিশ্বাসের উপর।’

‘মার্জনা,’ সোম হেসে বলল, ‘কে চায়? কল্যাণকুমার সোম মার্জনার চেয়ে গঞ্জনা পছন্দ করেন।’ তারপর বলল, ‘আচ্ছা, উঠি।’

সুলক্ষণা কোনোমতে নমস্কার করল। সোমের প্রস্থানের পর চাপা কান্নার আবেগে ভেঙে পড়ল।

শুভ্র দিদির পড়ার ঘরে গিয়ে দেখল দিদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার টেবিলের উপর একখানা ছোরা। এক সেকেন্ডের জন্যে শুভ্র ভয়ে-বিস্ময়ে, দ্বিধায় থমকে দাঁড়াল। তারপর কী মনে করে ছোরাখানাকে খপ করে তুলে নিয়ে দৌড় দিল। এক নিঃশ্বাসে বাবার ঘরে পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বাবা, দিদি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল।’

সত্যেনবাবু একসঙ্গে এতগুলো চমক কোনো দু-দিনের ভিতর পাননি এর আগে। ক্রমশ তাঁর অভ্যস্ত হয়ে আসছিল। তিনি আচ্ছন্নের মতো বললেন, ‘দেখি কত কাঁদাতে পারো।’

শুভ্রর পিছু পিছু সুলক্ষণাও ছুটেছিল। সে তার বিপর্যস্ত কেশবেশ নিয়ে পাগলির মতো ঘরে ঢুকল। বলল, ‘না, বাবা, আত্মহত্যা নয়।’

‘তবে কী? তবে কী!’

‘আত্মহত্যা নয়। সত্যি বলছি।’

‘তবে কেন ওই ছোরা?’

সুলক্ষণার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আত্মরক্ষা।’

সত্যেনবাবু ও শুভ্র দু-জনেই চীৎকার করে প্রতিধ্বনি করলেন, প্রশ্নসূচক স্বরে। শুভ্রর রাগ হচ্ছিল তার অত বড়ো একটা আবিষ্কার ভেস্তে যাওয়ায়! সত্যেনবাবু তো মনে মনে প্রলয়নাচন নাচছিলেন সোম-রস পান করে।

সত্যেনবাবু হুকুম করলেন, ‘আন ওর মুন্ডুটা পেড়ে।’

শুভ্র বলল, ‘শুধু মুন্ডু কেন? ধড়টাও।’

সোম তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল। যে শুভ্র তার সঙ্গে মাথা সোজা করে কথা বলতে ভরসা পেত না, সেই গিয়ে তার গায়ে হাত রেখে বলল, ‘আসুন।’

সোম আশ্চর্য হয়ে শুধালো, ‘কী ব্যাপার?’

ফেরারি আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারায় হঠাৎ যে আনন্দ হয় শুভ্র সেই আনন্দের পীড়ন গাম্ভীর্যের দ্বারা প্রতিহত করে বলল, ‘ব্যাপার গুরুতর।’

সত্যেনবাবু ন্যায়ের সঙ্গে করুণা মিশ্রিত করে হাকিমি ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কী বলবার আছে?’

সোম কিছু বুঝতে না-পেরে সুলক্ষণার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। সুলক্ষণা ততক্ষণে লজ্জায় মরে গেছে। কেমন করে যে সমস্ত বৃত্তান্ত বাবার কাছে আবৃত্তি করবে, তাই তাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিল। সে সোমের চাউনির পথ থেকে নিজের চাউনিকে সরিয়ে নিল।

সত্যেনবাবু একটা মস্ত বক্তৃতার পাঁয়তারা কষছিলেন মনে মনে। শুভ্র ভাবছিল হুকুম পেলে সোমের পিঠে কোন লাঠিখানা ভাঙবে। ওসব অপ্রিয় কর্তব্য চাকরকে দিয়ে করাতে নেই, হাজার হোক সোম ভদ্রলোকের ছেলে—বিলেতফেরত।

সত্যেনবাবুর বক্তৃতা শুরু হল। ‘পাপিষ্ঠ’, তিনি সোমকে সম্বোধন করলেন, ‘পাপিষ্ঠ, সম্ভ্রান্ত বংশে তোমার জন্ম, শিক্ষা তোমার সাধারণের দুষ্প্রাপ্য, তুমি সেই শিক্ষার ক্ষেত্রে কৃতী। কিন্তু চরিত্রে তুমি ছাগল—(ছাগলের সংস্কৃত স্মরণ করে) হ্যাঁ, চরিত্রে তুমি ছাগ, তুমি অজ।’

এই পর্যন্ত বলে তিনি চেয়ে দেখলেন কোনো এফেক্ট উৎপন্ন হল কি না। সোম বিস্ময়বিমুঢ়ভাবে ভাবছিল সকালে সত্যেনবাবুর সঙ্গে যখন কথাবার্তা হয়েছিল তখন তো তিনি তার চরিত্রহীনতার স্বীকৃতি শুনে ক্রুদ্ধ হননি, বিলেতফেরতাদের অমন হয়ে থাকে বলে প্রকারান্তরে অনুমোদন করেছিলেন! তবে সুলক্ষণাকে ওকথা বলেছি বলায় তিনি আঘাত পেয়েছিলেন বটে। সেই অপরাধে এই দন্ড? তাকে কল্পনার অবকাশ না দিয়ে আপনি সত্যেনবাবু তার অপরাধের চার্জ তাকে শোনালেন।

বললেন, ‘আমার বাড়িতে অতিথি হয়ে আমার কন্যার ওপর প্রশস্ত দিবালোকে বলপ্রয়োগ—হে পাপিষ্ঠ, নারীধর্ষণের ইতিহাসে এমন অঘটন ঘটেছে বলে শুনিনি কিংবা পড়িনি, উকিল হিসেবে এমন মামলা পাইনি। ওরে, আন তো পিনাল কোডখানা। দেখি কোন ধারায় পড়ে—৩৫৪ কি ৩৭৬। না, পুলিশে দেব না, কেলেঙ্কারিতে কাজ নেই। বলো, তুমিই বলো, পাপিষ্ঠ প্রবর, ঘরোয়া সাজার মধ্যে কোনটা তোমার উপযুক্ত।’

সোম ইতিমধ্যে ছোরাখানাকে লক্ষ করে কতকটা আঁচতে পেরেছিল তার অপরাধ। সাজা? তার ইচ্ছা করল বলে, আপনার মেয়েটিকে আমাকে দিন, উনিই আমার শাস্তিরূপিণী, সারাজীবন অবিশ্বাসের কারাকক্ষে আমাকে কয়েদি করে রাখবেন। সুলক্ষণা যে পিতার নিকট তার নামে নালিশ করেছে এতে তার সন্দেহ ছিল না।

বলল, ‘অপার আপনার কৃপা। সত্যযুগের মহারাজ হবুচন্দ্র কলিযুগে কবি সত্যেন্দ্রচন্দ্র রূপে অবতীর্ণ। সাজা? অপরাধীকে সাজা দিতে গিয়ে স্বয়ং শূলে চড়ে সশরীরে স্বর্গে গেছলেন মনে পড়ে না কি?’

‘পাষন্ড!’ সত্যেনবাবু তর্জনী উদ্যত করে তর্জন করলেন। ‘লিখব আমি তোমার বাবা জাহ্নবীবাবুকে। তিনি যদি তোমার উপর ইচ্ছা প্রয়োগ করতে অসম্মত হন, যদি তোমাকে এই মেয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে না-দেন, তবে তোমার বল প্রয়োগের সাজা দিতে অক্ষম সেই জেলা জজকে অকর্মণ্য বলে জানব। জানব যে তিনি সেই পন্ডিতের মতো ভন্ড যিনি বলেছিলেন, আমার ছেলে মাকড় মেরেছে? মাকড় মারলে ধোকড় হয়।’

মামলার রায় শুনে সোম ফেলল হেসে। শুভ্রও হল নিরাশ—কোথায় ‘শালা হিঁয়াসে নিকলো’ বলে দু-ঘা বসিয়ে দেবে, না নিজেই বনবে শালা। সবচেয়ে বিস্মিত হল সুলক্ষণা। এত তম্বির পর এই তামাসা! তাকে সোমের কাছে এমন হাস্যাস্পদ করবার প্রয়োজনটা কী? না, তার বিবাহ। সোমের মতো পাত্র যেন আর হয় না। ‘চেষ্টা করিলে কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর?’

সব শিক্ষিতা মেয়ের মতো তারও ছিল স্তবস্তুতির ক্ষুধা। কেউ তাকে ‘মানসী’ বলুক, ‘সাকী’ বলুক, বলুক ‘Eternal Feminine’ —তবে তো সে করবে বরদান। সে কি দেবে বরণমালা? না। সে দেবে বরমাল্য। কেউ কি তার বর হবে? না। সকলে হবে তার বরপ্রার্থী, তাদের একজন হবে তার বরপ্রাপ্ত।

এমন যে সুলক্ষণা—যার বীণাবাদন একদিন দেশবিশ্রুত হতে বাধ্য—যার চরণে এখনি মাকালের মতো কত অকর্মা দুবেলা পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছে—তাকে একদিন সোমের চেয়ে নিষ্কলুষ অথচ সোমেরই মতো কৃতকর্মা কেউ কি দেবে না অর্ঘ্য? সে অপেক্ষা করবে।

সুলক্ষণা বলল, ‘আসুন, কল্যাণবাবু, আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি। অমন সাজা আপনাকে পেতে হবে না, কারণ আপনার বিরুদ্ধে ওই অভিযোগটা সম্পূর্ণ আনুমানিক। আমি যে এই প্রহসনের সূত্রধার নই তা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, কল্যাণবাবু।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *