সুমিত্রা যে কী খেতে ভালোবাসে, অভিজিৎ তা আজও জানে না। সকাল বেলা সে অফিস যাওয়ার সময় একলাই খায়, খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে যায়। রাত্রে অধিকাংশ দিনই তার জ্ঞান থাকে না। সুমিত্রা কখন কী খায় সে তা জানে না। ইদানীং কয়েকদিন সে তাড়াতাড়ি সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসছে, রাত্তির বেলা সুমিত্রার সঙ্গেই খেতে বসেছে, কিন্তু খাবারদাবার উপাদেয় কিছু নয়। সুমিত্রা নিজে রান্না করবে, অভিজিৎ তা আশা করে না। কিন্তু বুড়ি রাঁধুনিই বা এত খারাপ রাঁধে কেন? আর চাকরটা নিশ্চয়ই বাজারে ফাঁকি দেয়। তাই সেদিন সকাল বেলা সে ঘোষণা করল, সে নিজেই বাজারে যাবে।
সুমিত্রা হেসে ফেলল, হঠাৎ তোমার এই শখ কেন?
বাঃ, মাঝে মাঝে ভালো-মন্দ খেতে ইচ্ছে করে না? তুমি কী খেতে ভালোবাসো?
আমার সবই ভালো লাগে।
তা কখনো হয়? দোকানে তো দেখেছি, তুমি চাইনিজ খাবারই বেশি পছন্দ করো। কিন্তু বাড়িতে তো সে রান্না হয় না। কী তোমার ভালো লাগে–মাছ না মাংস? কোন মাছ, কোন মাংস, কোন তরকারি?
তোমার যা পছন্দ হয় নিয়ে এসো। আজ তাহলে আমি নিজেই রাঁধব।
না না, তোমাকে রাঁধতে হবে না। রাঁধুনিকে একটু দেখিয়ে দিয়ো—
ও বুড়োমানুষ চোখে ভালো দেখে না, ওর আর রান্নায় হাত নেই!
তাহলে ওকে ছাড়িয়ে দিচ্ছ না কেন?
বাঃ, বুড়োমানুষটাকে ছাড়িয়ে দিলে ও কোথায় যাবে এখন? আর কী কোথাও কাজ পাবে? ঠিক আছে, এখন থেকে আমিই মাঝে মাঝে রাঁধব।
বাড়ির রাঁধুনি যদি ঠিকমতন রান্না করতে না পারে তবু তাকে রাখতে হবে? সুমিত্রার মন বড়ো কোমল, সে কারুকেই চাকরি থেকে ছাড়াতে চায় না। তা বলে সুমিত্রা রোজ নিজে রান্না করতে যাবে কেন? ওর তো অভ্যেস নেই।
না, না, তোমাকে রান্নাঘরে সময় কাটাতে হবে না। একটা অন্য কিছু ব্যবস্থা করলেই হবে।
চাকরকে নিয়ে অভিজিৎ বাজারে বেরোল। ছেলেবেলা থেকেই সে কখনো বাজারের মধ্যে বিশেষ ঢোকেনি। আলু, পটল বা মাছের কোনটার কত দাম সে সম্পর্কে তার কোনো আন্দাজই নেই। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে সে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার খবর দেখে।
তবু বাজারে ঢুকে সে রীতিমতো দরাদরির অভিনয় করে একগাদা জিনিসপত্র কিনে ফেলল। অসময়ের এঁচোড় থেকে শুরু করে বড়ো কাঁকড়া পর্যন্ত।
চাকরকে দিয়ে বাজারটা আগে পাঠিয়ে দিয়ে অভিজিৎ গেল হাজরার মোড়ের দিকে। তার নিজস্ব ব্র্যাণ্ডের সিগারেটটা সব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না, মোড়ের বড়ো দোকানটায় যদি পাওয়া যায়।
বাসস্টপে একজন মহিলা একটি বাচ্চামেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির গায়ে স্কুলের পোশাক, হাতে বই-খাতার ব্যাগ। একটা ভিড়ে ভরতি দোতলা বাস এসে থামল, তার গহ্বরের মধ্যে মেয়েটিকে ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হল কোনোরকমে। অভিজিৎ ভাবল ইশ, ওইটুকু মেয়ে একা একা স্কুলে যায়? ওদের স্কুলের বাস নেই?
সিগারেটের প্যাকেট কিনে অভিজিৎ একটা ধরিয়েছে, তখন দেখল মেয়েটির মা তার দিকেই আসছে। মহিলার পরনে সাধারণ আটপৌরে শাড়ি, মুখটি বেশ সুশ্রী কিন্তু কোনো প্রসাধন নেই। মনে হয় যেন রান্নাঘর থেকে উঠে এসেছে।
মহিলাটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে সে, একটু অবাক হল। এ কে?
অভিজিৎ দাঁড়িয়ে ছিল পানের দোকানের সামনে। মহিলাটি অভিজিতের পাশ দিয়ে এসে ওই দোকানে পান কেনার জন্যে দাঁড়াল।
তারপর হঠাৎ অভিজিতের দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ভালো আছেন?
অভিজিৎ চিনতে পারল না। সে একটু থতমত খেয়ে গেল। কে রে বাবা? কোথায় দেখেছে একে? কিছুই তো মনে আসছে না।
মহিলা আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার বন্ধু চলে গেছে?
না, মানে–ইয়ে বোধহয় গেছে, আমি ঠিক জানি না।
আমি এই কাছেই থাকি।
অভিজিৎ বোকার মতন হেসে বলল, ও, আচ্ছা!
মেয়েটি পান কিনে নিয়ে চলে গেল। আর কিছু বলল না। অভিজিৎ মেয়েটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে সে মাথা খুঁড়ছে কিন্তু কিছুতেই ওর সম্পর্কে কিছু মনে করতে পারছে না। আশ্চর্য!
বাড়ি ফেরার পথটুকুও অভিজিৎ ওই মেয়েটির কথাই ভাবতে লাগল। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার, তার কী স্মৃতিশক্তি একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? একজন তাকে চেনে অথচ সে তার নামটা মনে রাখা দূরের কথা, কোথায় দেখেছে তাও মনে করতে পারছে না?
সে অভিজিৎ সেনগুপ্ত, এক সময় ছিল নামকরা ভালো ছাত্র, অঙ্ক আর ইংরেজিতে বরাবর ফার্স্ট হয়েছে, আর সে-ই এখন কিনা মানুষের মুখ মনে রাখতে পারছে না! কল্যাণদের বাড়িতে সে রাত একটায় গিয়েছিল, সে ঘটনা তার মনে নেই, সেটা এমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়, খুব বেশি মদ খাওয়ার পর এ-রকম হয়। এর নাম অ্যামনেশিয়া। মেয়েটিকে কী সেরকম মত্ত অবস্থায় দেখেছিল কোনোদিন?
বেশ্যাদের নিয়ম হচ্ছে, রাস্তায় কোনো চেনা লোককে দেখলেও কথা বলে না। এটাই ওদের পেশার রীতি। কিন্তু মেয়েটি তো তাকে চিনল এবং বলল। তা ছাড়া ওকে দেখলে তো
বাড়ির সিঁড়িতে পা দেওয়ার পর অভিজিতের মনে পড়ল। মেয়েটিকে সে দেখেছিল, রতনলাল চাড্ডার ফ্ল্যাটে। অল্প একটুক্ষণের জন্যে। সে-দিন মেয়েটির মুখখানা ছিল রং মাখা, ঠোঁটে ছিল গাঢ় লিপস্টিক, হাতে সিগারেট, হুইস্কির গ্লাসে ও চুমুক দিচ্ছিল। তাকে আজ এ রকম আটপৌরে পোশাকে দেখলে চিনবে কী করে? অভিজিতের কোনো দোষ নেই।
আজ ও নিজের মেয়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার জন্যে বাসে তুলে দিতে এসেছিল, ঠিক সাধারণ কোনো বাড়ির বউয়ের মতন। আর সে-দিন রতনলাল চাড্ডা যখন কথা বলতে বলতে ওর ঊরুতে থাপ্পড় মারছিল, তখন মেয়েটি হাসছিল খিলখিল করে। সে-দিন মেয়েটির ওপরেই রাগ হয়েছিল, আজ রাগ হল রতনলালের ওপর। টাকা আছে বলে এরা সবকিছুই কিনতে পারে।
সুমিত্রা বলল, তুমি এত সব জিনিস কিনে এনেছ! তোমার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে?
অভিজিৎ বলল, কই, বেশি জিনিস আনিনি তো!
বাজারে আর কোনো জিনিস বোধহয় বাকি নেই। অন্য লোকদের জন্যেও তো কিছু রাখতে হয়।
একদিন বাজারে গেলাম, সেদিন কি আর কিপটেমি করলে চলে?
তুমি কাঁকড়া ভালোবাসো, তা এতদিন আমাকে বলেনি কেন?
কেন, তুমি ভালোবাসো না? তোমার কথা ভেবেই তো আনলাম।
হ্যাঁ, আমিও ভালোবাসি, কিন্তু কী করে রান্না করতে হয় জানি না। ঠিক আছে, পাশের বাড়ির শান্তাদির কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি। তবে এবেলা তো এত তাড়াতাড়ি হবে না।
অভিজিৎ হেসে বলল, তোমার মাথা খারাপ! এবেলা খাব কী করে? কাঁকড়া খেতে তো এক ঘণ্টা লাগে! তাহলে আর চাকরি-বাকরি থাকবে না।
এবেলা মাছ রান্না করে দিক, ওবেলা কাঁকড়া খেয়ো।
ন-টা বাজে। খুব বেশি তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই! আজ একটু দেরি করে অফিস গেলেও চলবে।
অভিজিৎ আরাম করে সকালের অসমাপ্ত খবরের কাগজখানা কিছুক্ষণ পড়ল। তারপর স্নান করতে গেল।
খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন অফিসে বেরোচ্ছে, তখন সুমিত্রা তার বাহু ছুঁয়ে খুব আন্তরিক নরম গলায় বলল, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরবে, কথা দাও?
অভিজিৎ বলল, নিশ্চয়ই! কেন কাল ফিরিনি?
আজ তুমি নেশা করে আসবে না?
না, না, তুমি এত ভাবছ কেন? অফিসে একটু কাজ আছে।
ন-টা, সাড়ে নটার বেশি দেরি কোরো না। আমি কিন্তু বসে থাকব।
অত দেরিও হবে না!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অভিজিৎ মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগল শেয়ারের ট্যাক্সি ধরার জন্যে। দেখল, আগে আগে সেই মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছে। এবার শাড়ি বদলেছে, একটু সেজেছেও। আশ্চর্য, একই দিনে পরপর দু-বার দেখা। মেয়েটি তো তখন বলল, কাছাকাছি কোথাও থাকে। কিন্তু এত দিনের মধ্যে আর তো একবারও দেখা হয়নি। আজই দু-বার। এ-রকম হয়, কোনো নতুন ইংরেজি শব্দ শিখলে সেদিনই সেটা খবরের কাগজে দেখা যায়। আবার কোনো লোকের মুখেও শোনা যায়।
কী যেন নাম মেয়েটির? একটু অদ্ভুত ধরনের! হ্যাঁ, মনে পড়েছে শেলি দত্ত! মেয়েটির নাম শেলি, অদ্ভুত নয় তো কি? হয়তো ওটা ওই মেয়েটির আসল নাম নয়। ওসব জায়গায় কেউ আসল নাম বলে না।
চলতে চলতে মেয়েটি একবার পাশের দিকে মুখ ফেরাল। প্রায় চমকে উঠল অভিজিৎ। দারুণ বিষণ্ণ মুখখানা। যেন কত রকমের দুঃখ ওর বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। আশ্চর্য, এখন কে ওকে দেখে বিশ্বাস করবে যে সেদিন ওই মেয়েটিই রতনলাল চার ঘরে খিলখিল করে হেসেছিল। মেয়েটি বোধ হয় বাসে উঠবে! তার আগেই অভিজিৎ শেয়ারের ট্যাক্সি ধরে ফেলল।
অফিস এসে অভিজিৎ দেখল, তার টেবিলের ওপর কোম্পানির মালিকের পাঠানো একটি চিরকুট–-অভিজিৎ যেন অফিসে এসেই একবার মালিকের সঙ্গে দেখা করে।
কোম্পানির মালিক মি. বিষ্ণু রক্ষিত বেশিরভাগ সময়েই থাকেন দিল্লিতে। তাঁর অন্য ব্যবসাও আছে। এই কোম্পানিতে আরও কয়েকজনের শেয়ার থাকলেও, ইনিই ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। ইদানীং কোম্পানির অবস্থা তেমন সুবিধের নয়।
এক গেলাস জল খেয়ে, জরুরি চিঠিপত্রে একবার চোখ বুলিয়ে অভিজিৎ গেল মালিকের ঘরে।
মি. রক্ষিত মানুষটি বেশ ভদ্র। আস্তে আস্তে কথা বলেন। ভদ্রলোকের ফুলের খুব শখ। নিউ আলিপুরে ওঁর বাড়ির বাগানে খুব দামি দামি ফুলগাছ আছে। অভিজিৎকে দেখে তিনি বললেন, বসুন। আপনার ঘরে কেউ অপেক্ষা করে নেই তো? খানিকক্ষণ সময় লাগবে।
অভিজিৎ বলল, না, কেউ নেই।
উনি টেবিল থেকে একটা টাইপ করা কাগজ তুলে নিয়ে বললেন, আমি চারজনের নাম এখানে ঠিক করে রেখেছি। আপনি একবার দেখুন।
কী ব্যাপারে?
এদের ছাঁটাই করতে হবে।
অভিজিৎ আঁতকে উঠল একেবারে। ছাঁটাই? এই বাজারে? প্রাইভেট কোম্পানি, এখানে চাকরির কোনো স্থায়িত্ব নেই। এক মাসের নোটিশেই যে কারুর চাকরি যেতে পারে। এবং সেই ছাঁটাইয়ের চিঠিতে সই করতে হবে অভিজিৎকেই, কারণ সে ম্যানেজার।
নামগুলোর দিকে একবার অলসভাবে চোখ বুলিয়ে নিল অভিজিৎ।
মি. রক্ষিত ধানাইপানাই করা পছন্দ করেন না। যেকোনো ব্যাপারে স্পষ্ট সোজাসুজি মতামত দেন। যদিও উনি দিল্লিতে থাকেন বেশিরভাগ সময়, তবু এ-অফিসের প্রতিটি কর্মচারী সম্পর্কে খবরাখবর রাখেন। কার কতটা কাজ, কে কতটা যোগ্য, সবই ওঁর জানা। যে চারজনের নাম উনি লিখেছেন, কোনো সন্দেহ নেই, সেই চারজনেরই কাজ এখন সবচেয়ে কম।
মি. রক্ষিত আবার বললেন, বিজনেস এ বছরে খুব ভালো। বছর প্রায় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু গতবছর যত অর্ডার এসেছিল, এবছর এখন পর্যন্ত তার অর্ধেকও আসেনি। নানারকম ট্যাক্স বসাবার জন্যে কোম্পানিগুলো খুব শাই হয়ে গেছে। ছাঁটাই না-করে উপায় কী বলুন? সবাইকে ব্যাপারটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে। কাজকর্ম অনেক কমে গেছে। এখন শুধু শুধু কয়েকজনকে বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দেওয়া তো যায় না! তারা অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নিক আমার হিসেবমতন সাতজনকে ছাঁটাই করা উচিত। তারা সারপ্লাস। তবু আমি খুব কম করে চারজনকে ধরেছি
অভিজিৎ নাম চারটে বার বার দেখতে লাগল। প্রত্যেকেই তার বিশেষ চেনা। এরমধ্যে এক জন একটু ফাঁকিবাজ ঠিকই, বাকি তিন জন নির্ভরযোগ্য কর্মী। এদের মধ্যে অসীমকে সে নিজেই চাকরি দিয়েছে প্রায়। ছেলেটির খুবই অভাবের সংসার, যদিও সবসময় হাসিখুশি থাকার একটা ক্ষমতা আছে তার। অভিজিৎ নিজের নাম সই করা চিঠিতে এদের বরখাস্ত করবে?
ক্ষুণ্ণভাবে সে বলল, কিন্তু ছাঁটাই করতে গেলে গোলমাল হবেই।
মি. রক্ষিত বললেন, আপনাকে তো বললামই, যদি ছোটোখাটো গোলমাল হয়, তাহলে সেটা চাপা দেবার চেষ্টা করতে হবে। আর যদি বড়ো রকমের গোলমাল হয়, সহজে না থামে
মি. রক্ষিত হঠাৎ চুপ করে গেলেন। অভিজিৎ ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে রইল।
মি. রক্ষিত মুখ নীচু করে হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বললেন, সহজে যদি গোলমাল না থামে, তাহলে অফিস তুলে দিতে হবে!
অফিস তুলে দেবেন?
আর কী করা যাবে। একেই লোকসান চলছে, এরপর যদি স্টাফরা গোলমাল করে, তাহলে লোকসান আরও বাড়বে। তারপর অফিস তুলে দেওয়া ছাড়া আর উপায় কী? তখন আর আলাদা করে কারুকে ছাঁটাই করতে হবে না।
আপনি এতদূর পর্যন্ত ভেবেছেন?
ভাবতে তো হচ্ছেই। অবশ্য আমার এ কোম্পানি উঠে গেলে আপনার কোনো অসুবিধে নেই, আপনি পাবলিসিটি লাইনে নামকরা লোক। আপনার চাকরির অভাব হবে না, যেকোনো কোম্পানি আপনাকে লুফে নেবে, এর আগেও তো অনেকে আপনাকে এখান থেকে ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।
কথাটা মিথ্যে নয়। অন্য জায়গা থেকে অভিজিৎ দু-তিনটে ভালো সুযোগ পেলেও এ অফিস ছাড়তে চায়নি। কারণ, এখানে কাজের ব্যাপারে মালিকের তেমন হুকুমদারি নেই, সে ইচ্ছেমতন কাজ করতে পারে, এবং মালিক উপস্থিত না-থাকলে সে-ই সর্বেসর্বা।
অভিজিৎ বলল, কিছু নতুন অর্ডার যদি জোগাড় করা যায়, আর কারুকেই ছাঁটাই করতে হয় না।
চেষ্টা তো করছি। পাচ্ছি কোথায়? বাজার খুব খারাপ। দুর্গাপুরের যে-কাজটা পাওয়ার কথা ছিল। সেটা হল না শেষপর্যন্ত। ন্যাশনাল নিয়ে নিয়েছে।
হঠাৎ অভিজিৎ উৎসাহের সঙ্গে বলল, স্যার, আমার হাতে একটা কাজের সন্ধান এসেছে, প্রায় লাখ দুয়েকের মতন, সেটা পেলে
কোন কোম্পানির?
নতুন কোম্পানি। শিলং-এ একটা বিয়ারের কারখানা হচ্ছে, সেটার কাজ–টাকাটা আরও বেশিও হতে পারে।
মিস্টার রক্ষিত চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ও, সেই বাবুভাইয়ের কারবার?
আপনি চেনেন বাবুভাইকে?
সে তো এক ভারতবিখ্যাত চোর, তাকে না-চেনে কে? থাক, সে চোর হোক-বা নাই হোক, তা গভর্নমেন্ট বুঝবে। আমাদের কাজ পেলেই হল। দেখুন যদি কাজটা জোগাড় করতে পারেন।
আমি বাবুভাইকে চিনি না, তবে রতনলাল চাড্ডা বলে একজন ব্যবসায়ী বোধ হয় এদিককার কনট্রাক্ট নিচ্ছে।
তারও নাম শুনেছি। হাতে অনেক কাঁচা টাকা। ধরুন-না কাজটা, তবে পাবেন কি না সন্দেহ আছে।
আমাকে মাসখানেক সময় দিন। যদি কাজটা পাই, তখন তো আমাদের কাজের লোকও লাগবে? তাহলে আর এই চার জনকে ছাঁটাই করে—
মি. রক্ষিত চোখ খুলে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন অভিজিতের দিকে। তারপর বললেন, বেশ তো, দিলাম একমাস সময়। চেষ্টা করে দেখুন!..হর্টিকালচারাল গার্ডেনসে যে ফুলের প্রদর্শনী হচ্ছে, সেটা দেখেছেন? এই এত বড়ো বড়ো গোলাপ এত বড়ো-বিশ্বাসই করা যায় না…
হঠাৎ ফুলের প্রসঙ্গ আসতে অভিজিৎ একটু চমকে গেল। অবশ্য মি. রক্ষিত এক বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ কথা বলা পছন্দ করেন না। তবু কতকগুলো লোকের চাকরি যাওয়া মানে তাদের জীবন-মরণের সমস্যার মতন। তারমধ্যে হঠাৎ ফুলের কথা। মি. রক্ষিত আবার বললেন, একদিন আসুন আমাদের বাড়িতে। লোকের ধারণা গরম জায়গায় চেরি ফুল ফোটে না। আসুন, আপনাকে দেখাব, আমার বাগানে চেরি ফুল ফুটিয়েছি।
অভিজিৎ শুকনোভাবে বলল, তাই নাকি? গিয়ে দেখতে হবে তো!
একটুবাদে অভিজিৎ উঠে দাঁড়াল। মি. রক্ষিত হাতের একটা আঙুল দেখিয়ে বললেন, তাহলে ওই কথা রইল। এক মাস। আপনাকে আমি এক মাস সময় দিলাম।
অভিজিৎ নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখল অসীম নামের সেই ছেলেটি বসে আছে। এরমধ্যেই খবর পেয়ে গেছে নাকি? অফিসের যেকোনো খবরই এক নিমেষে রটে যায়।
কী খবর, অসীম?
অভিজিৎদা, আমার দিন সাতেকের ছুটি চাই।
কবে থেকে?
আজ বিকেলেই চলে যাব।
কেন হঠাৎ? কিছু হয়েছে?
বেনারসে মাকে পাঠিয়েছিলাম, আমার ছোটোকাকার কাছে, হঠাৎ সেখানে মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খবর পেলাম।
ও, তাহলে তো যেতেই হবে। ঠিক আছে, চলে যাও।
সাত দিনের মধ্যেই ফিরব আশা করছি। এখন তো কাজও বেশি নেই
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
অসীম চলে যাওয়ার পর অভিজিৎ একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলল। ও এখনও জানে না, ওর মাথার ওপর কী খাঁড়া ঝুলছে। ছুটি থেকে ফেরার কিছুদিন পরেই ছাঁটাইয়ের নোটিশ পাবে। ইতিমধ্যে ওর মায়ের যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তাতেও কি ওর ছাঁটাই আটকাবে? চিঠিতে সই থাকবে অভিজিতের। অসীম কী বুঝবে? অসীম ভাববে তার এত দুঃসময়েও অভিজিৎ তাকে ছাঁটাই করে দিল।
দুরছাই, আর ভাবতে ভালো লাগে না। মালিকের কাছে হঠাৎ সে কেন বিয়ার কোম্পানির কাজটার কথা বলতে গেল? সে তো ভেবেছিল, ওই ব্যাপারে আর মাথা ঘামাবে না। রতনলাল চাড্ডা মানুষ সুবিধের নয়, ওই ধরনের লোকের সঙ্গে সে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না। ওদের কাছাকাছি গেলেই গায়ে নোংরা লাগে।
কিন্তু এখন এই কাজটা জোগাড় করার ওপরেই অফিসের চার জনের চাকরি নির্ভর করছে। অসীম ছাড়া আর তিন জনই বিবাহিত। অসীমের আছে বিধবা মা। বাজার সত্যিই খারাপ, হঠাৎ চাকরি গেলে ওরা এ লাইনে সহজে আর কোথাও চাকরি পাবে না।
অভিজিতের পক্ষে এখন এই অফিস থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ন্যাশনাল থেকে তো তার কাছে অফার দেওয়া আছেই। যেকোনো দিন ওদের কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করলেই হল। মাইনেও কিছু বেশি পাওয়া যাবে। অবশ্য সেখানে তার মাথার ওপর আরও তিনজন থাকবে, কিন্তু তাতে কী, চাকরি হচ্ছে চাকরি। নিজের কাজটা ঠিকমতো করে গেলেই হল।
ন্যাশনালের মিত্তিরকে ফোন করতে গিয়েও থেমে রইল অভিজিৎ। কয়েক মিনিট ভেবেও মনস্থির করতে পারল না। মি. রক্ষিতকে সে কথাও দিয়ে এল দু-লাখ টাকার কাজটার জন্যে চেষ্টা করবে। এরমধ্যে হঠাৎ কেটে পড়াটা কাপুরুষতা নয়? সে চলে গেলে, ওই চার জনের ছাঁটাই হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। এটা তার বিবেকের ওপর একটা বোঝা হয়ে থাকবে সারাজীবন। কিন্তু ওই চার জনের চাকরি বাঁচাবার জন্যে তাকে রতনলাল চাড্ডার মতন নোংরা লোকের সংস্পর্শে যেতে হবে। ওই চার জন কি তা কোনোদিন জানবে?
এইরকম অবস্থায় কিছুতেই মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। অভিজিৎ ঝট করে বেরিয়ে অফিসের প্রায় উলটো দিকের বারে গিয়ে ঢুকল। এখন একটু বিয়ার না খেলে কিছু চিন্তাই করা যাবে না। সুমিত্রা তার মদ খাওয়ার জন্যে ভয় পায়। সুমিত্রা বুঝবে কী করে, পুরুষমানুষকে কতরকম ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়তে হয়। আজ অফিসে এসেই যে এইরকম একটা অদ্ভুত অবস্থায় পড়বে, সে-কথা কি সে সকালেও ভেবেছিল?
বিয়ার খেলে তো আর বেশি নেশা হয় না। তাও এখন দুপুর। সন্ধ্যের পর ঠিক অবস্থাতেই সে বাড়ি ফিরবে। সুমিত্রা রেঁধেছে, খেতে হবে ভালো করে।
ফেনা ভরতি বিয়ারের গেলাসে চুমুক দিয়ে অভিজিৎ মাথার চুল খিমচে ধরল। ভালো লাগছে না, কিছুই ভালো লাগছে না! এখন রতনলাল চাড্ডার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কী করে? সে-দিন শেষপর্যন্ত ভালো করে কিছুই কথা হয়নি। তবে লোকটা উৎসাহ দেখিয়েছিল ঠিকই।
নিখিল কি শিলং থেকে ফিরেছে? নিখিলকে দিয়েই কাজটা করাতে হবে। নিখিল আজকাল অনেক বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে মেশে। সেদিন ওর কথাবার্তা শুনে মনে হল, ও রতনলাল চাড্ডার কাছে বাবুভাইয়ের দূত হয়ে এসেছে। বাবুভাই নাকি বিখ্যাত চোর।
নিখিল কোথায় উঠেছে তার ঠিক নেই। বাদলের কাছে খবর পাওয়া যেতে পারে। বাদল এইসময় বাড়িতেই থাকে। সে তো ঘুম থেকেই ওঠে এগারোটার সময়। বার থেকেই টেলিফোন করল বাদলকে। তাকে পাওয়া গেল। বাদল বলল, কী ব্যাপার, হঠাৎ এত সকাল সকাল ফোন?
সকাল কোথায় রে, দেড়টা বাজে।
ওই হল। এরমধ্যেই কী মাল খাওয়া শুরু করব নাকি?
না, সেজন্যে নয়। নিখিল কোথায় জানিস?
শিলং গেছে, কাল-পরশু ফিরবে।
আচ্ছা, সেই যে, রতনলাল চাড্ডার সঙ্গে সে-দিন আলাপ হয়, তার সঙ্গে কী করে যোগাযোগ করা যায় বল তো?
দেখ অভিজিৎ, তোর ব্যাপারটা কী? তুই এই দুপুরে আমাকে টেলিফোন ধরার জন্যে তেতলা থেকে এক তলায় নামিয়ে শুধু নিখিল আর রতনলাল আর হ্যানো-ত্যানোদের কথা জিজ্ঞেস করবি? কেন, আমি কি ওদের দালাল?
অভিজিৎ একটু চুপ করে গেল। কোনো কারণে বাদলের মেজাজ খুব খারাপ। কিন্তু ওর সাহায্যের যে দরকার। বলল, এত রেগে আছিস কেন?
আসল কথাটা কী খুলে বল না।
একটা ব্যাপারে বড় বিপদে পড়েছি। তোর সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার।
বিয়ার খাওয়াবি?
সে আর এমন কথা কী।
ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যে বেলা কোথায় দেখা করছি বল?
অভিজিৎ আবার থমকে গেল। সন্ধ্যে বেলা? বাদলের সঙ্গে একবার বসলে সহজে ওঠা যাবে না। বাদলটা একটা মদের পিপে। বলল, বাদল, তুই এখন একটু আসতে পারবি? সন্ধ্যে বেলা আমার একটু অসুবিধে আছে।
এখন? এই দুপুর রোদ্দুরে কোনো ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরোয়?
কোনোদিন তো আর অফিসে কাজ করলি না, বেশ আরামে আছিস। একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয় না।
ঠিক আছে। ধর, এই চল্লিশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
আমি অপেক্ষা করছি। আমাদের অফিসের উলটো দিকে, কাউন্টারের পাশেই। টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে অভিজিৎ একবার চট করে অফিস থেকে ঘুরে এল। দরকারি কাজ-টাজ সম্পর্কে কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে, তার বেয়ারাকে বলে এল, মি. রক্ষিত খোঁজ করলে বলবে, জরুরি কাজে বেরিয়ে গেছি।
বাদল এল অনেক দেরি করে। কোনোদিনই সে সময়ের ঠিক রাখে না। অপেক্ষা করতে করতে অভিজিতের দু-বোতল বিয়ার খাওয়া হয়ে গেল।
বাদল এল রীতিমতন সাজগোজ করে। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, গায়ে দামি সেন্টের গন্ধ।
টেবিলের উলটো দিকে বসে বাদল বলল, রতনলাল চাড্ডার কাছে সেই পাবলিসিটির কাজটা তোর চাই, তাইনা?
ঠিক ধরেছিস।
দু-আড়াই লাখ টাকার কারবার হবে। বেশ ভালো দাঁও। কাজটা পেলে তুই কোম্পানি থেকে কত কমিশন পাবি?
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল অভিজিৎ। বাদল কি তার সমস্যাটা বুঝবে? সে কাতরভাবে বলল, কমিশন নয়, এখন অফিসটাকে বাঁচানোই আমার প্রধান কাজ। কাজটা আমায় পেতেই হবে।
সে-দিন তুই হঠাৎ উঠে চলে এলি কেন?
বলছিলাম না, আমার স্ত্রীকে আনবার কথা ছিল।
হু!
কেন, আমি চলে আসার পর কি কিছু কথা হয়েছে?
তা হয়েছে! তবে সেরকম কিছু নয়।
বিয়ারের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বাদল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অভিজিৎ অধীর হয়ে উঠেছে। আর ভালো লাগছে না। কী কুক্ষণে যে সে-দিন ট্যাক্সি খুঁজতে গিয়ে নিখিল আর বাদলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
বিয়ারটা যথেষ্ট ঠান্ডা নয় বলে বেয়ারাকে বকুনি দিয়ে অভিজিৎ আরও দু-বোতল আনতে বলল। তারপর বাদলকে জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হয় কাজটা আমি পেতে পারি?
তা পারিস।
তাহলে খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা দরকার। অন্য ফার্মগুলো মুখিয়ে আছে, কোনোক্রমে খবর পেয়ে গেলেই ছোঁক ছোঁক করবে। আজই একবার রতনলালের সঙ্গে দেখা করা যায় না?
যায়।
কখন?
রাত দশটার পর।
ওঃ, তাহলে আজ হবে না।
কেন রাত দশটায় তুই কোথায় থাকবি?
অভিজিতের মুখে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ল। সব কথা সকলকে বোঝানো যায় না। সে যদি এখন বাদলকে বলে যে, আজ রাতে সে, তার বউয়ের রান্না করা কাঁকড়া খাবে, তাহলে বাদল হাসবে না? এত বড়ো একটা কাজের তুলনায় কাঁকড়া খাওয়াই বড়ো হল? অথচ সুমিত্রাকেই বা কী বোঝাবে? সুমিত্রাকে আজও যদি সে বলে যে একটা জরুরি কাজের জন্যে সে রাত্রে ঠিক সময় ফিরতে পারবে না, তাহলে সুমিত্রা নিশ্চিত ভাববে, সে আবার মিথ্যেকথা বলছে। টেবিলের ওপর ঠক করে গেলাসটা নামিয়ে অভিজিৎ রাগের সঙ্গে বলল, রাত দশটার আগে দেখা করা যাবে না, সে এমন কী লাটসাহেব? তাকে একটা টেলিফোন করে সন্ধ্যে বেলা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা যায় না?
বাদল অভিজিতের রাগকে পাত্তা না দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বলল, না।
তাহলে দরকার নেই।
ভালো কথা। শুধু শুধু আমাকে ডেকে আনলি কেন?
তুই আর নিখিলই তো সেদিন বললি, ওই কাজটা আমি পেতে পারি।
এখনও তো বলছি, তুই পেতে পারিস।
তা বলে রাত দশটার আগে লোকটার সঙ্গে দেখা করা যাবে না? কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে কেউ অত রাতে দেখা করতে যায়?
তোকে কে বলেছে যে রতনলাল চাড্ডা ভদ্রলোক?
ভদ্রলোক নয়?
সে-কথায় তোর দরকার কী? তোর দরকার কাজ। কাজের বদলে টাকা!
দুরছাই!
তুই এত অধৈর্য হয়ে উঠছিস কেন অভিজিৎ? ব্যাপারটা কী তোর? তিন বোতল বিয়ার খেয়ে ইতিমধ্যেই অভিজিতের একটু নেশা হয়ে গেছে। সে নিজে অবশ্য তা এখনও টের পায়নি। মুখখানায় দেখা দিয়েছে লালচে আভা।
খানিকটা মুখ ঝুঁকিয়ে দুঃখিত গলায় অভিজিৎ বলল, বাদল, কাজটা আমার চাই। তুই আমাকে একটু সাহায্য কর।
করব তো বলছি। শোন, রতনলাল চাড্ডা টাইপের মানুষের সঙ্গে তো তুই মিশিসনি। ওরা একেবারে অন্য ধরনের। তোর সঙ্গে হাজার মিশলেও কখনো ভেতরের কথা জানতে দেবে না! ওরা কখন কোথায় থাকবে, সেটাও একটা গোপন ব্যাপার। আমার সঙ্গে আজ রাত দশটায় দেখা করার কথা আছে ওর। তখন তোকে নিয়ে যেতে পারি–
বেশ, ঠিক আছে, রাত দশটাতেই যাব, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকব না–কাল বা পরশুর জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে চলে আসব।
তাই করিস।
কাজটা পেতে গেলে আর কী করতে হবে রে?
রতনলালকে খুশি করতে হবে।
তার মানে কী? মেয়ে সাপ্লাই?
উঁহু! সব জায়গায় এক জিনিস চলে না। রতনলালকে কোনো জিনিসই দিতে হবে না। তুই চাস তো রতনলালই তোকে মেয়ে দেবে।
কেন?
ওর শখ। রতনলাল প্রচুর স্কচ হুইস্কি পায়, অন্যদের তা খাওয়াতে ভালোবাসে। ওর হাতে অনেক মেয়েও আছে। সুতরাং তোর কাছ থেকে ও, মদ বা মেয়ে কোনোটাই চাইবে না। তুই ওকে ঘুস দিতেও পারবি না–ওর হাতে এত কাঁচা পয়সা যে দু-পাঁচ হাজার ওর হাতের ময়লা।
তাহলে ওকে কীভাবে খুশি করা যাবে?
তোষামোদ।
শুধু তোষামোদ?
হ্যাঁ। ওর কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে হেঁ হেঁ করে হাসতে হবে। ওর কোনো কথার প্রতিবাদ করা চলবে না। ও যদি বলে জল উঁচু, তুই বলবি উঁচু।
ঠিক আছে, তাই করব। এ আর এমন শক্ত কী?
তোর অভিজ্ঞতা নেই, অভিজিৎ। তুই জানিস না, এটা কত বড়ো ধৈর্যের পরীক্ষা। তোর ব্যক্তিত্ব জিনিসটা একদিন লুকিয়ে রাখতে হবে। মদ খেয়ে একদম মাতাল হয়ে গেলেও চেঁচামেচি করা চলবে না ওর সামনে। তখনও মনে রাখতে হবে, তুই ওর মোসাহেব।
এ-রকম কতদিন চালাতে হবে?
সেটা তোর ভাগ্য।
আমি ভাগ্য বিশ্বাস করি না।
তোর আত্মবিশ্বাস আছে, এই কথা বলতে চাস তো? ঠিক আছে, দেখিস।
কী?
দিনের পর দিন একটা অশিক্ষিত লোকের সব কথায় সায় দিতে, তার সবরকম অসভ্যতা সহ্য করতে হবে। একটুও ভুল করলে চলবে না–দেখি, তারপরও তোর আত্মবিশ্বাস কতটা বজায় থাকে।
তাহলে বাদল এইরকম লোকের কাছে তুই বা নিখিল যাস কেন?
নিশ্চয়ই আমাদেরও স্বার্থ আছে। আমরা যেরকম ব্যবহার করব, আমাদের দেখাদেখি তুইও তাই করবি।
তাই সই। আমি সেসবও করতে রাজি আছি। চল, এখন উঠি।
উঠবি! কোথায়?
আমি একবার অফিস যাই, চারটে বাজে।
তুই অফিস যাবি? আমি তাহলে কী করব? আমি তো একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লে আর বাড়ি ফিরি না।
তুই আমার সঙ্গে অফিসে চল, একটু বসবি।
দু-জনে বেরোল। বিয়ার খাওয়ার পর মুখে রোদ লাগলে চিড়বিড় করে। দু-জনেই কপালের ওপর হাত রেখে রোদ আড়াল করে রাস্তা পেরিয়ে এল।
অফিসের ঠিক দরজার কাছে বাদল অভিজিতের একটা হাত চেপে ধরে বলল, তোর কি এখন অফিসে খুব কাজ আছে?
দু-একটা কাজ আছে।
দুর! এই অবস্থায় কাজ করতে ভালো লাগবে?
তুই কী করতে চাস?
চল, একটা ঠাণ্ডা জায়গায় গিয়ে বসব। খনিকটা সময় কাটাতে হবে তো।
আবার মদ খাব? তাহলে দশটা পর্যন্ত সোজা থাকতে পারব না।
না, না। ওসব কিছু নয়। তুই চল তো!