৩. সিরিল গিয়েছিল নেশা করে

সিরিল গিয়েছিল নেশা করে। পা টলছে মাথা ঠিক। ট্রানজিস্টার খারাপ হয়ে যাওয়ায় হাত খালি। খালি ছিল কারখানাও। কারণ সকাল থেকেই টুপুস টাপুস করে বৃষ্টি ঝরছে। তখন ঠিক বিকেল নয় কিন্তু মেঘগুলোর জন্যে সন্ধের চেহারা চারধারে। সিরিলকে দেখে ছোটসাহেব চিৎকার করে ডাকল, কতখানি খেয়েছিস?

পুরা বোতল! সিরিল দুটো হাতের মাপে বোতলটাকে বোঝাবার চেষ্টা করল।

ব্যস? তাতেই এই অবস্থা! হাসছিল ছোটসাহেব। দেখে রাগ হয়ে গেল সিরিলের। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, এ হাঁড়িয়া না ভুটানকা ইংলিশ হুস্কি।

ও তাই বল, তাহলে তো নেশা হবেই। তারপর কী মনে করে?

 তুই বাগানকা নোকরি ছেড়ে দিলি কেন?

সবাই সব কিছু পারে না, আমিও পারছিলাম না।

ঝুটা বাত। যে মিস্ত্রি হতে পারে সে রাজার চাকরি ছাড়ে না।

ছোটসাহেব একটু টুল টেনে বসে ওকে কিছুক্ষণ দেখে বলল, ঐ বাক্সটার ওপর বোস। কাঠের বাক্সটা পাশেই ছিল, সিরিল সেটায় বসতে গিয়েও বসল না। ছোটসাহেবের সামনে এভাবে বসাটা ঠিক হবে না। বাংলোয় গেলে ওরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারে না পর্যন্ত আর এখন সমান হয়ে বসবে?

ছোটসাহেব ধমকে উঠল, কী হল বসতে বলছি না?

সিরিল বিড় বিড় করল, আমি তো কুলি–

ছোটসাহেব বলল, আমি কে? আমিও তো মিস্ত্রি। বসে পড়। নইলে যেকম পা টলছে তোর কখন আমার ঘাড়ে এসে পড়বি।

তাই তো! সিরিলের মাথায় কথাটা ঢুকল। এখন তোর আর এই লোকটা বাগানের সাহেব নয়। এর সামনে বসতে আপত্তি কী! ভাবা মাত্রই ধপাস করে বাক্সটায় বসে সে জিজ্ঞাসা করল,

তুই কি চুরি করেছিস?

চুরি? মানে? ছোটসাহেব হাঁ হয়ে গেল।

চুরি না করলে চাকরি ছাড়তে হল কেন?

বাজ পড়ল যেন। হো হো করে হাসতে লাগল ছোটসাহেব। কিছুতেই আর হাসি থামতে চায় না। কোনরকমে ঢোক গিলে বলল, তোকে যদি বলি এখানে হামাগুড়ি দিতে হবে। তুই তাই করতে গিয়ে যদি হাঁটু থেকে রক্ত বের হয় কী করবি?

আমি বলব পারব না।

আমিও তাই বলেছি। যা ভাগ, বৃষ্টি আসছে খুব, বাড়ি পৌঁছতে পারবি না।

কিছুই বুঝতে পারল না সিরিল। ছোটসাহেব চুরি না করে চাকরি ছেড়েছে। রক্ত পড়েছিল বলছে, কিন্তু সেটা কি রকম রক্ত। লোকটা যদ্দিন বাগানের সাহেব ছিল তদ্দিন অন্যরকম ছিল। কথা বলতে ভয় লাগত সেই সঙ্গে রাগও। এখন কিন্তু সেসব কিছু হচ্ছে না। আর এই সামনাসামনি বসে সিরিলের সাহসও বেড়ে যাচ্ছিল। সে বলল, বৃষ্টি তো পড়েই আর ভিজতে আমার খারাপ লাগে না। তুই চাকরি ছাড়লি কেন?

ছোটসাহেব ইতস্তত করল আরও কিছুক্ষণ। সিরিল পুরোপুরি মাতাল নয় কিন্তু এরকম নেশা হয়েছে যা মানুষকে নাছোড়বান্দা করে। চাকরি ছাড়ার পর তার এই বাগানের মধ্যেই থেকে যাওয়া বিশেষ জেদের জন্যেই। কোম্পানি কিন্তু তার চাকরি ছাড়ার কোনো কারণ কাউকে জানায়নি। অন্য ম্যানেজাররা তো বটেই বাবুরাও জেনে গেছে কিন্তু সবাই রহস্যজনকভাবে চুপচাপ। এই কদিন এসব কথা এড়িয়ে গেছে ছোটসাহেব, কিন্তু আজ এইরকম শীতল বিকেলে ওর মনে হল কুলিদের ব্যাপারটা জানানো দরকার। সিরিল দুটো হাত কোলের ওপর নিয়ে বড় বড় চোখে ছোটসাহেবকে দেখছিল। ছোটসাহেব সিগারেট ধরিয়ে বলল, শুনতে চাইছিস যখন তখন শোন। আমার বাড়ি শিলিগুড়িতে। খুব গরিব ছিলাম আমরা। বাবা নেই, দুই ভাই মায়ের কাছে থাকতাম। মা হাসপাতালের নার্স। ছোট ভাই আমার চেয়ে ছ বছরের ছোট। পড়াশুনায় ভাল ছিলাম আমি। স্কুলে পয়সা লাগত না। কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে পারল না মা। একজন বড়লোক আমাকে সেই টাকা দিলেন। তাঁরই পয়সায় আমি কলেজে পড়ি। তারই চেষ্টায় টোকলাইতে গিয়ে ট্রেনিং নিই। আর সাহেববাগানে চাকরিতে যখন সই করলাম তখন দেখলাম আমাকে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে আমি যেন আমার চেয়ে যারা নিচু ক্লাসের লোক তাদের সঙ্গে না মিশি, না আড্ডা মারি, আমার বাড়িতে আসতে না দিই। আমি মিশব আমার সমান বা উঁচু মানুষের সঙ্গে। নইলে তোরা আমাকে সাহেব বলে মানবি না। এসব মেনে নিতে হবেই চাকরি করতে গেলে। ব্রিটিশরা যে নিয়ম তৈরি করেছিল তা তো আর পাল্টায়নি। কিন্তু কোম্পানি বলল আমার মা যেন চাকরি ছেড়ে দেয় তা না হলে আমি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ না করি। মাকে লিখলাম আমার বাংলোয় এসে থাকতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে। অনেকদিন তো হলো, আর কেন! মা লিখল, তা সম্ভব নয়। যে চাকরি করে এতদিন বেঁচে আছেন তা শেষ ছুটি হওয়ার আগে ছাড়বেন না। প্রতিদিন হাসপাতালে কত গরিব মানুষের সেবা করেন তিনি, তারাই তার ছেলেমেয়ে। আমার চাকরিতে অসুবিধে হলে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দরকার নেই। খুব কষ্ট হল, মানতে পারছিলাম না কিন্তু কিছুই করার ছিল না। প্রতি শনিবার রাত্তিরে চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে শিলিগুড়িতে চলে যেতাম। চোরের মত মায়ের সঙ্গে দেখা করতাম, আবার ভোরের আগেই ষাট মাইল রাস্তা পেরিয়ে বাংলোয় ফিরে আসতাম। এই ভাবেই চলছিল মাসের পর মাস। কিন্তু সময় তো পালটায়। আমার ছোট ভাই এখন বড় হয়েছে। পার্টি করে। সে একরাত্রে আমাকে বাড়ির বাইরে ধরে শাসাল, যদি আমি দিনের বেলায় মাথা উঁচু করে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারি, তাহলেই যেন ওখানে যাই, না হলে সে আমার আসা পছন্দ করে না। ধিক্কার হল খুব। এই ছেলেটা যা বোঝে তা আমি টাকার নেশায় ভুলে যেতে চাইছিলাম? টাকার জন্যে নিজের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চাইছিলাম? আর পারলাম না। এসব কথা খোলাখুলি লিখে চাকরি ছেড়ে চলে এলাম। কিন্তু আমার তো অন্য কোন বিদ্যে জানা নেই; চাকরি দেবে কে আমাকে? গাড়ি সারানোটা এককালে শিখেছিলাম। সেটাই কাজে লাগালাম। হয়তো অন্য জায়গায় গিয়ে এই কারখানাটা খুলতে পারতাম। কিন্তু ভীষণ জেদ ধরে গেল। আমি চা-কোম্পানির মুখের সামনেই কারখানা করব যাতে ওরা দুবেলা আমাকে দ্যাখে। আর এই ভাবে দেখতে দেখতে ওরা যদি মনে করে আইনকানুনগুলো সময়ের সঙ্গে পালটে ফেলা দরকার তাহলে আমার পরে যারা আসবে তারা উপকৃত হবে। হাসল ছোটসাহেব, শুনলি তো এই হল আমার গল্প। এখন আমি ভাল আছি, খুব ভাল আছি।

ছোটসাহেবের সব কথার মানে সিরিলের মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু এটুকু সে বুঝতে পারছিল যে ছোটসাহেব মাকে ভালবাসে বলে ওই চাকরি ছেড়ে এসেছে। তার মানে লোকটা সত্যিকারের ভাল। আর এই যে ছোটসাহেব এত লোক থাকতে তাকেই এরকম দুঃখের কাহিনি শোনালো তার মানে হলো সে ছোটসাহেবের আপন লোক। তাহলে তো সেও কিছু প্রশ্ন ওকে করতে পারে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল। জিভ নিয়ে সেটা চেটে নিয়ে সিরিল বলল, আচ্ছা, একটা কথা বল্ তো, আমাদের তোরা কী ভাবিস?

ভাবি মানে?

আমরা ভদ্রলোক কি না?

ভদ্রলোক কি চেহারায় বোঝা যায়? ওটা ব্যবহারে জানা যায়।

ঠিক হ্যায়। তাহলে বল, এই দেশটা আমাদের না তোদের?

মানে? ছোটসাহেব কথাটা বুঝতে পারছিল না।

এই সোজা কথাটা বুঝছিস না! ওই চা বাগানে আমরা মদেসিয়ারা দেড় হাজার লোক আছি আর তোরা বাঙালিরা হাতগুনতি। তাহলে জায়গাটা কার? দুদিকে মাথা দোলাতে দোলাতে প্রশ্ন করল সিরিল।

দুজনেরই। এসব কথা তোদের মাথায় কে ঢোকাচ্ছে?

কেন? ঢোকাবে কেন? বিশজন বাঙালিবাবু সব সময় অর্ডার করবে, বেগার খাটাবে, আমাদের ছোটলোক বলবে আর আমরা শুনব? আমার বাপ শোনে তার বাপ শুনেছে কিন্তু আমি শুনব কেন?

অন্যায় কথা শুনতে কে বলেছে? কিন্তু তার সঙ্গে দেশের প্রশ্ন আসছে কেন? আমরা সবাই ভারতবর্ষের নাগরিক। আমরা সবাই সব জায়গায় থাকতে পারি। সব জায়গাই আমাদের দেশ। একথা তোকে কে বলেছে।

কে আবার বলবে? আমার বড়বাপ বলে এটা আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ হল টেবুয়াতে, রাঁচি হাজারীবাগ ছোটনাগপুরে। কিন্তু সে জায়গা তো আমি দেখিনি। আমি এখানে জন্মেছি; বড় হয়ে এই চা বাগান দেখছি। এটাই আমার দেশ, কি ঠিক কি না বল?

নিশ্চয়ই ঠিক। কিন্তু এ নিয়ে ভাববার কোনো কারণ আছে?

সিরিল ছোটসাহেবকে জরিপ করতে চেষ্টা করল। তারপর বলল, ফ্রান্সিসকে দেখেছিস? যেই শালা বাবু হয়ে গেল অমনি আমাদের কুলি ভাবতে লাগল। কোনো বাবু আমাদের মানুষ বলে মানে না। সাহেবরা তো সব সময় ভাবে আমরা ওদের কেনা গোলাম। তুইও ভাবতিস কদিন। আগে। আগে খড়ের ঘরে আমরা থাকতাম এখন দয়া করে পাকাবাড়ি খুপরি ঘর করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা যা ছিলাম তাই আছি। পিক্‌ করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলল সিরিল।

তোদের য়ুনিয়ন আছে, য়ুনিয়ন তো খুব জোরদার।

সব সমান। য়ুনিয়নের মাথায় কে আছে? না সেই শহরের বাঙালি বাবু। আজকাল গোলমাল কিছু হলে য়ুনিয়নের বাবুরা এসে সাহেবের বাংলোয় বসে একসঙ্গে মাল খায়, কথা বলে! আমরা গেলে বসতে পারা তো দূরের কথা, খাতিরও করবে না। সব শালা মালিকরা হাতের মধ্যে রেখে দিয়েছে। সিরিল উঠে দাঁড়াল, তুই লোকটা ভাল। এতদিন ভাল ছিলি না, এখন ভাল হয়েছিস।

ছোটসাহেব উঠল, তা না হয় হলো, কিন্তু সব সময় মনে রাখিস এই দেশ আমাদের সবার, কারো একার নয়।

পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সিরিল, আচ্ছা! তাহলে আমাদের য়ুনিয়ন যখন বলছে এবারের বোনাস বিশ পার্সেন্ট দিতে হবে বাবুরা সব চুপ কেন? কেন সাড়ে আট পার্সেন্ট মানব আমরা? বাবুরা কেন আমাদের সঙ্গে আসছে না? এটা বেইমানি নয়? কী করে সবাই এক দেশের হলাম?

ছোটসাহেব বলল, হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান হয়? কিন্তু মুঠোয় কিছু ধরতে গেলে সবাইকে একসঙ্গে নামতে হয়। তোকে আমি সোনার ভাত খেতে দেব বললেই যদি লাফিয়ে উঠিস আনন্দে তাহলে তোর মত গর্দভ আর কেউ নেই। বুঝেসুঝে কাজ কর, মাথা ঠাণ্ডা রাখ। সিরিলের মাথায় কিছু ঢুকছিল না আর। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। সে রাস্তায় পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। তারপর নিঃশব্দে ফিরে এল ছোটসাহেবের কাছে। এখন ওর চোখ, আধবোজা, ঠোঁট কুঁচকে উঠছে। ছোটসাহেব বলল, কিরে কিছু বলবি?

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেও কিছুক্ষণ থম ধরে থাকল সিরিল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, হাম শাদী করে গা।

একটু চমকে গেল ছোটসাহেব বলার ধরনে তারপরে অত্যন্ত খুশির গলায় চিৎকার করে উঠল, খুব ভাল, করে ফ্যাল।

কিন্তু আমি জানি না কি করে শাদী করতে হয়।

জানিস না? তা তোর বাপকে বল, তারাই ব্যবস্থা করবে।

না, ওরাও জানে না।

 তোর বাপ মা শাদীর নিয়ম জানে না?

না। আমি সই করে শাদী করব। সাহেবরা যেমন করে। টলতে টলতে নিজেকে সামলে নিল সিরিল।

হকচকিয়ে গেল ছোটসাহেব। ব্যাপারটা বুঝে নিতে কয়েকটা মুহূর্ত ব্যয় হল। তারপর বলল, সই করতে পারিস?

ঘাড় কাত করল সিরিল, হুঁ। টিপসই ভি সই, ঠিক কিনা?

তা ঠিক। কিন্তু এই শখ হল কেন তোর?

আমার ইচ্ছে তাই করব। একশবার করব, আলবাত করব। আমার শাদী দেবে সরকার, সাহেবদের যেমন দেয়।

ঠিক আছে ঠিক আছে। ছোটসাহেব ওর কাঁধে হাত রাখল, পাত্রী ঠিক হয়েছে?

হুঁ। তুই আমাকে নিয়মটা বাতলে দে। কী করতে হবে আমি কিছু জানি না। তুই লোকটা ভাল আছিস। এখন তো আর বাগানের সাহেব নোস, তুই বল কী করতে হবে।

ঠিক আছে, আমি ভাল করে আইনটা জেনে নিয়ে তোকে বলব।

 তুই খুশি তো ছোটাসাহেব।

হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই খুশি।

তোকে আমি মিঠাই খাওয়াবো, ভূটানকো রম্ খাওয়াবো।

বেশ বেশ।

তুই বড়া আদমি আছিস! সাহেবলোককা মুখমে লাথ মেরেছিস ওই নোকরি ছেড়ে দিয়ে। পড়তে পড়তে কোনো রকমে বেঁচে গেল সিরিল। তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে ছোটসাহেবকে কায়দা করে সেলাম জানাল কপালে হাত ছুঁইয়ে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বন্ডেমাত্র।

এটা করতেই মন প্রফুল্ল হয়ে গেল ওর। খানিক পরে যখন অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে পথ হাঁটতে লাগল তখন আর কোনো কষ্ট নেই ওর। মাথায়, শরীরের সবখানে যে শীতল জলের ধারা নামছে সেটা খেয়াল নেই। রাস্তার দুপাশে ঝকড়া ঝাকড়া শিরীষ দেবদারু গাছগুলো এখন অন্ধকারকে আরো ঘন করেছে। বাজার ছাড়িয়ে বাবুদের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে ঘোরের মধ্যে হেঁটে সে কুলি লাইনের দিকে চলল। চোখ বন্ধ করেই হেঁটে যাওয়া এখন অসম্ভব নয়। সিরিল ভাবতে চাইল, এই চা বাগানের প্রতিটি ইঞ্চি সে জানে! এই অন্ধকার বৃষ্টির রাত আর

কি বাধা হতে পারে। অদ্ভুত একটা গুনগুনানি আনন্দ বুকের মধ্যে নাচছিল। চোখ বন্ধ করলেই এখন নিরির মুখ, চোখ খুললেই এখন নিরির হাসি। হায়, হায়, কি খেল দেখাল নিরি সেদিন পঞ্চায়েতের মিটিং-এ? ওই সেই লাফাঙ্গা স্বামীর মুখ শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছিল। মার শালা লাথ, হাজারবার লাথ। ভাবতে ভাবতেই পরমানন্দে শুন্যে একটা লাথি ছুড়ল সিরিল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা বেতাল হয়ে আছড়ে পড়ল রাস্তার একপাশে দেওদার গাছের গোড়ায়! উপুড় হয়ে জলকাদায় শুয়ে শুয়ে সে কিছুটা সামনে নিলে দুহাতের বাঁধনে একটা বড় পাথর পেয়ে। অজান্তেই অমিতাভ বচ্চনের গলায় বলে উঠল, নিরি মেরা পেয়ার, মেরা জিন্দেগি, ও মেরা ডার্লিং।

পঞ্চায়েতের মানুষগুলোর মুখ কেমন হয়েছিল? বুকু সর্দার ওর বাবা মাংরা সর্দার, অন্যান্য বুড়োগুলো হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। শুধু শুকরা বুড়ো বসেছিল সেই পাথরের মত যাকে ঝরনার জল সারাদিন শব্দ করে ঠেলে যায় কিন্তু পাথরটা খেয়ালই করে না।

খুব লম্বা লম্বা বাত ঝাড়ছিল বুকু সর্দারের জামাই। যে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চায়।, দুদিন পরেই পালিয়ে আসে সে মেয়ে নষ্ট, বদ, রান্ডী। যে মেয়ে পেটে বাচ্চা ধরতে পারে না সেই মেয়ে সংসার সামলাতে পারে না। তাই সে সমবেত বয়স্কজনকে অনুরোধ করছে এ ব্যাপারে একটা বিহিত করতে।

মাচাটাকে ঘিরে পঞ্চায়েতের সদস্যরা বসেছিল। মাচার ওপর নেংটি পরে শুকরা বুড়ো গম্ভীর মুখে রয়েছে। আজ তার হাতে বিড়ির পুরো বাণ্ডিল। যে পঞ্চায়েত ডাকবে তাকে এটা খরচ করতেই হয়। সদস্যদের সামনে একদিকে বুকু সর্দার অন্যদিকে তার জামাই দাঁড়িয়ে আছে। জামাই কথা শেষ করলে মাংরা সর্দার উঠে দাঁড়াল, সব কথা শুনলাম, কথাগুলোর মোটেই ভাল নয়। বুকু সর্দার বলুক তার যা বলার আছে।

বেশ কিছুটা দূরে লাইনের তামাম মানুষ গোল হয়ে বসে পঞ্চায়েত শুনছিল। তারা দেখল বুকু খুব ঘাবড়ে গেছে। তার পা কাঁপছে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে। লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে বুকু বলল, কোনো গাছ বলে না তার ফল খারাপ। কোনো মেঘ কি বলবে তার বৃষ্টিতে নুন আছে? যে যেমন সে সেইভাবে ভেবে নেয়। আমার মেয়ে দোষ করতে পারে নাও পারে। তাকে আমি শাদীর পর চারবার জোর করে বিনাগুড়িতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দুধ দুইতে গেলে তো গরু লাথি মারবেই, তাই বলে ওই ভয়ে যে দুধ না দুয়ে গরুটাকে তাড়িয়ে দিতে চায় তার মতো মূর্খ আর কে আছে?

সঙ্গে সঙ্গে বুকু সর্দারের জামাই চিৎকার করে উঠল, বাঃ বাঃ, যে গরুর দুধ দেবার ক্ষমতা নেই তার লাথি খেতে যাব কোন দুঃখে?

পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে মাংরা সর্দার দুজনকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বুকু সর্দার কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?

জামাই দ্রুত মাথা নাড়ল, আমার ঘর তো ওকে নিয়ে নয়, ওর মেয়েকে নিয়ে। ও ভাল ব্যবহার করল কি না করল তাতে কী এসে যায়?

মাংরা সর্দার আবার জিজ্ঞাসা করল, জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও আগে!

সঙ্গে সঙ্গে জামাই বলল, না।

ওর মেয়ে করেছে?

হ্যাঁ।

কী করেছে?

সে আমার ঘরে থাকতে চায় না। আশেপাশের ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে। এসব কারণের জন্য আমি তাকে মারতেই পারি। নিজের বউকে মারার অধিকার সব স্বামীর আছে। কিন্তু সে সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসে। এমনকি শেষবার আসবার আগে আমাকেই সে মেরেছে। এখান থেকে কেউ নিশ্চয়ই মতলব দিয়েছিল। নষ্ট রাণ্ডী মেয়েছেলে হলে যেমন হয় আমার বউ তাই। বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল জামাই।

শোকটাকে মরে যেতে কিছুটা সময় দিল সবাই। পঞ্চায়েতের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে খানিকটা গুগুনাল তারপর। পাকামাথাগুলো এক হয়ে যে সিদ্ধান্ত নিল সেইমত বুধুয়া সর্দার বলল, বউ যদি বেঁকে যায় তাহলে জীবনটা মিথ্যে হয়ে যায়। তা বিনাগুড়ির জামাইকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সে কী চায়?

চোখের জল মুছে গলা পরিষ্কার করে জামাই বলল, ও আমার সঙ্গে চলুক। এই চাওয়াটার কথা সবাই জানত বলে একটু খুকখুকে হাসি উঠল দুরের শ্রোতাদের মধ্যে। কারণ এত অভিযোগের শেষে এটা কানে লাগছে সবার। মাংরা সর্দার বলল, বুকু সর্দার, তোমার কি জামাই-এর ঘরে মেয়েকে পাঠাতে এখন আপত্তি আছে?

বুকু সর্দার আবার লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াল, সব বাপই চায় মেয়ে স্বামীর ঘর করুক। কিন্তু যাবে কিনা সেটা বলতে পারে যে যাবে সে।

পঞ্চায়েতের হুকুমে লোক গিয়ে নিরিকে ডেকে নিয়ে এল। নিরি এল চুপচাপ, খুব শান্ত ভঙ্গিতে। এমনিতে আজকাল যে রকম বেপরোয়া ভাব দেখা যায় ওর হাঁটাচলায় এখন সেটা নেই। বাপ এবং স্বামীর থেকে সমান দূরত্ব রেখে দাঁড়াল সে। তাকে দেখামাত্র বিনাগুড়ির জামাই এর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বুধুয়া সর্দার জিজ্ঞাসা করল, তোর স্বামী তোকে নিয়ে যেতে এসেছে, তুই যাবি?

 কথা না বলে ঘাড় নাড়ল নিরি, না।

সঙ্গে সঙ্গে জামাই চিৎকার করে গালাগালি শুরু করল। কিন্তু তার দিকে নিরি এমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকাল যে বেচারা আস্তে আস্তে গলা নামাল।

কেন যাবি না? পঞ্চায়েতের প্রশ্ন।

ওটা মানুষ না, আমার স্বামীকে মানুষ হতে হবে। নিরির গলা পরিষ্কার, ওর কাছে ফিরে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।

কুত্তি, নষ্ট, রাণ্ডী মেয়েছেলের কথা শুনছেন সবাই? চিৎকারটা থামালো নিরি একটা হাত ওপরে তুলে, আমি যদি ওখানে ফিরে যাই তাহলেই নিজেকে রাণ্ডী ভাবব।

পঞ্চায়েত জিজ্ঞাসা করল, কেন ফিরবি না পরিষ্কার করে বল।

নিরি বলল, বললাম তো লোকটা মানুষ না। খেতে পেতাম না, মারধোর করত, সব বউ এর ভাগ্যেই থাকে, তা নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু একটা রাতও সে আমাকে সুখ দিতে পারেনি। আমি কি আরো খুলে বলব?

আবার গুঞ্জন উঠল চারধারে। সেসব ছাপিয়ে জামাই-এর গলা শুনতে পেল সবাই, এসব মিথ্যে কথা, হাজারবার মিথ্যে কথা।

মিথ্যে কথা! ফুঁসে উঠল নিরি, তাহলে এতবছর ধরে আমি মা হতে পারলাম না কেন? বল, সাহস থাকে তো বল?

একটু থমকে গিয়েও তুলল জামাই, খারাপ মেয়েরা মা হয় না। ভগবান ওদের মা হতে দেন না।

কথাটা শুনে মুখে হাত চাপা দিয়ে নিরি হাসতে লাগল।

পঞ্চায়েত বলল, ঠিক আছে, যা হবার হয়েছে, এবার দুজন ফিরে যাও।

ঘাড় নাড়ল নিরি, না, আর ফিরব না।

কেন?

ফিরলে আমি রাণ্ডী হয়ে যাব।

রাণ্ডী? স্বামীর ঘর গেলে? এ কেমন কথা?

ঠিক কথা। ও লোকটাকে আমি আর স্বামী বলে মনে করি না। আমি নষ্ট মেয়ে তাই ভগবান আমাকে বাচ্চা দেবেন না, না? স্বামীর দিকে মুখ করে গর্জে উঠল নিরি, তাহলে শোন, তোর কথা যে মিথ্যে, তুই যে একটা মানুষ নোস এর প্রমাণ হল আমার পেটে বাচ্চা এসেছে। তার মানে আমি মা হতে যাচ্ছি!

চিৎকার করে গর্বিত গলাকে থামিয়ে দিতে চাইল জামাই, আকাশ থেকে বাজ পড়ুক, মাটি ফেটে যাক, পাহাড় থেকে হাতিরা নেমে আসুক আর তা না হলে ও বলুক এসব মিথ্যে কথা।

হাসল নিরি, ওসব গল্প থাক, সত্যি কথা একদম সত্যি কথা।

পঞ্চায়েত বলল, তুই ঠিক বলেছিস?

হ্যাঁ।

 কিন্তু স্বামী থাকতে–।

ও আমার স্বামী না।

কে তোর ছেলের বাবা?

সেকথা আমি বলব না। পঞ্চায়েত রায় দিক, আমি ওর ঘরে যাব না। একজনের বাচ্চা পেটে নিয়ে আর একজনের ঘরে যে যায় সেই তো রাণ্ডী। পঞ্চায়েত কি আমাকে রাণ্ডী হতে বলছে?

পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে মাংরা সর্দার উঠে দাঁড়াল, স্বামী থাকতে যে মেয়ে অন্যের বাচ্চা পেটে ধরে সে সমাজের কলঙ্ক। তার শাস্তি পাওয়া উচিত।

জামাই বলল, ঠিক ঠিক।

 মাংরা সর্দার বলল, বুকু সর্দারের মেয়ে বলুক কে এর জন্য দায়ী!

নিরি হাসল, যাকে আমি বিয়ে করব।

জামাই ফ্যালফেলে গলায় বলল, আমার বউ না তুই!

নিরি বলল, আমি মানি না।

মাংরা সর্দার হুকুম করল, বুকু সর্দারের মেয়ে নাম বলুক সেই বদমায়েসের।

নিরি একটু ভাবল, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, নামটা বলতেই হবে?

পঞ্চায়েতের সবকটা মাথা এক সঙ্গে নড়ল, হ্যাঁ।

নিরি বলল, বেশ। আমি আর সিরিল ঠিক করেছি যে বিয়ে করব।

সিরিল! সিরিল! সিরিল! মুখে মুখে নামটা ঢেউ হয়ে গেল। মাংরা সর্দারের চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন দুলছে! কোনোরকমে বলল, মিথ্যে কথা।

পরম তৃপ্তিতে নিরি বলল, না, সূর্যের মত সত্যি।

বুকু সর্দার এবার কথা বলল, আমি পঞ্চায়েতের কাছে মিনতি করছি এ ব্যাপারে যা করার এখনই যেন করে দেওয়া হয়।

মাথাগুলো এক হল। প্রায় দশ মিনিট গুঞ্জন চলল নিজেদের মধ্যে। ওদের কথা বাইরের কেউ শুনতে পাচ্ছে না। অনেক মত বিনিময়ের পর মাংরা সর্দার মুখপাত্র হয়ে এগিয়ে গেল মাচার দিকে। সেখানে শুকরা বুড়ো দুই হাঁটুর ওপর চিবুক ফেলে দ হয়ে বসেছিল। মাংরা সর্দার তার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলল, এই পঞ্চায়েত মনে করছে যে বুকু সর্দারের মেয়ে অত্যন্ত অন্যায় করেছে। তার এবং সিরিলের শাস্তি পাওয়া দরকার। পঞ্চায়েতের নিয়ম অনুসারে পঞ্চায়েতের মাথা হিসেবে তুমি এই শাস্তি ঠিক করবে।

ঘাড় নাড়ল শুকরা বুড়ো, তারপর হাত বাড়িয়ে নাতনিকে খুঁজল। মালা যে এখন নেই সেটা বুঝতে পেরে লাঠিটা ওপরে উঁচিয়ে গলা তুলল সে, ঠিক কথা। অন্যায় হয়েছে। শাস্তি পাওয়া দরকার, ঠিক কথা।

ভেঙে পড়া শরীরটা থেকে এরকম শক্ত আওয়াজ বেরুবে তা অনেকেই ভাবতে পারেনি। শুকরা সর্দার চিন্তা করল খানিক, তারপর বলল, বুকু সর্দারের মেয়ে আর মাংরা সর্দারের ছেলে এই অন্যায় করেছে। মাংরা সর্দার নিজে বলেছে ওরা শাস্তি পাক। বাপ হয়ে ছেলেকে সে প্রশ্রয় দেয়নি। ঠিক কাজ। কিন্তু কী শাস্তি দেব? ওদের মেরে ফেলা যাবে না, আইন নেই। এখান থেকে তাড়িয়ে দিলেও কি ক্ষতি! আমার মনে হয় মানুষের সবচেয়ে বড় শাস্তি হল দুজনের মন রেখে চলা। তাই আমি ওদের এই শাস্তি দিলাম যে এক মাসের মধ্যে ওরা শাদী করুক। তখন বুঝবে কী রকম কষ্ট পেতে হয় সারা জীবন ধরে। এইটুকু বলতেই চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল চারধারে। তিরের মত ছুটে এল নিরি শুকরা বুড়োর কাছে, এসে পাগলের মত তার পায়ে মাথা ঠুকতে লাগল। একটা হাত মেয়েটার মাথায় রেখে শুকরা বুড়ো বলল, আজ থেকে আগের বিয়ে ভেঙে গেল ওর। বুকু সর্দার তিনটে খাসি, দুকুড়ি টাকা, একজোড়া ধুতি জামাইকে দিক আর আমাদের পেট ভরে হাঁড়িয়া খাইয়ে দেবে। এসবের টাকা যদি তার কাছে না থাকলে তাহলে তার নতুন জামাই দেবে। সে ছেলে কি এখানে আছে?

সঙ্গে সঙ্গে তল্লাসি শুরু হয়ে গেল। না, এই ভিড়ের মধ্যে না কুলি লাইনের কোনো বাড়িতে সিরিলকে পাওয়া গেল। খবরটা পৌঁছে দেওয়া হলে শুকরা বুড়ো শেষ কথা জানিয়ে দিল, এইসব খরচ তিনদিনের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে।

রায় শোনার পর দুজন লোক একদম চুপ মেরে গিয়েছিল। একজন বিনাগুড়ির জামাই অন্যজন মাংরা সর্দার। পঞ্চায়েত ভেঙে গেলেও লোকটা দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুকু সর্দার এগিয়ে এল। তার মনটা এখন প্রফুল্ল, মেয়েটা যদি মনের মত ঘর পায় তো আরামে চোখ বোজা যাবে। বুকু সর্দার বলল, জিনিসগুলো দুদিনের মধ্যেই পৌঁছে দিয়ে আসব, চিন্তা কোরো না।

জামাই-এর নজর তখন নিরির দিকে। চোখের দৃষ্টি ক্ষয়ে যাওয়া ভোরের চাঁদের মত। শ্বশুরের কথাটা শুনল কি না বোঝা গেল না। বুকু বলল, রাত হয়ে গেছে আজ, এখানে থেকে গেলেই ভাল হত।

জামাই-এর হুঁশ এল, বলল, আমার পা দুটো আছে কী করতে? বলে আর দাঁড়াল না, হন হন করে বিনাগুড়ির রাস্তায় চলে গেল।

পঞ্চায়েতের সদস্যরা ঠিক এরকম বিচার চায়নি! এটা কি শাস্তি দেওয়া হল? এরকম আদেশ হলে ছেলে-ছোকরারা মানবে? শুকরা বুড়োর মাথা আর কাজ করে না এটা বোঝা উচিত ছিল। মাংরা সর্দারের শরীর যেন বিছুটি পাতায় মোড়া। ধাঁ করে এগিয়ে গেল বাপের দিকে। শুকরা বুড়োর আদর খেয়ে নিরি তখন উঠে যাচ্ছে। বাপের দিকে একবার রোষ চোখে তাকাল মাংরা। সর্দার, এই সর্বনাশ কেন করলে? নিজের বংশের মুখে নিজেই চুনকালি মাখালে?

চুনকালি? সেটা কি জিনিস? বুড়ো এই মুহূর্তটির জন্য সিঁটিয়ে ছিল।

তুমি বেইমান! শালা ওই শয়তান নিশ্চয়ই কিছু খাইয়েছে তোমাকে। কী বলেছে? টেবুয়াতে নিয়ে গিয়ে মাটি খুঁড়ে শুইয়ে দিয়ে আসবে? ছাই দেবে! নিজের ছেলের চেয়ে নাতি এখন আপন হল না!

শুকরা বুড়ো নির্লিপ্তের গলায় বলতে চাইল, মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসেছে, যার বাচ্চা তারই তো স্বামীর হওয়া উচিত।

বাঃ, কি সুন্দর বিধান!

ঠিকই তো, তোর মা যদি না বলতো তাহলে আমি কি করে জানতাম যে আমি তোর বাবা! তাই এ ব্যাপারে মেয়েদের কথাই শোনা উচিত।

মাংরা সর্দারের মনে হল বুড়োটা আসল শয়তান আর ছেলেটা ওই তার স্যাঙাৎ। চেঁচিয়ে বলল সে, আজ থেকে আমি জানব যে আমার কোনো ছেলে নেই। সে যেন আমার ঘরে না ঢোকে। কথাটা সবাই শুনল, আচমকা চুপচাপ হয়ে গেল তল্লাটটা। সঙ্গে সঙ্গে একটা মিহি গলায় প্রশ্ন করল শুকরা বুড়ো, আমার কী হবে?

বাপের দিকে তাকাল মাংরা সর্দার। কিছু ভেবে নিয়ে মাথা দোলালো সে, এখানে আমি আর থাকব না। সাহেবকে বলব ছুটি দিয়ে দিতে।

বাপ জিজ্ঞাসা করল, তারপর কী করবি?

 তোমাকে নিয়ে টেবুয়াতে চলে যাব। সেখানে গেলে ওই শুয়োরটার মুখ দেখতে হবে না। আর জায়গাটা যখন মাতৃভূমি আমাদের–।

সত্যি যাবি? আমাকে নিয়ে যাবি?

যাব, নিশ্চয় যাব।

কিন্তু সেখানে চা-বাগান নেই, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট।

 তো বয়ে গেল…।

শুকরো বুড়োর শরীর আনন্দে কাঁপতে লাগল থরথরিয়ে। আহা রায় দিয়ে কি ভালই না হল। নাতি বলছে নিয়ে যাবে ছেলেও বলছে নিয়ে যাবে। এবার তার যাওয়া কে আটকায় দেখি।

বৃষ্টির জল চোখে মুখে কানে ঢুকতেই সিরিল উঠে বসল। চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিজলির ব্লেড দিয়ে যখন কেউ আকাশটাকে চিরছে তখনই সাদা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে চরাচর। সিরিল টের পেল ওর নেশা হয়েছে, জোর নেশা। জামাপ্যান্ট ভিজে কাদা হয়ে মিশে আছে শরীরে। ঠিক কোথায় এসেছে বুঝতে পারছে না অন্ধকারে। কয়েকবার চেষ্টার পর উঠল সে। টলতে টলতে লাইনের দিকে যেতে যেতে ওর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। শালা সেই পঞ্চায়েতের পর বাপটার ঘরে আর সে যাচ্ছে না। আজ এর ঘরে কাল ওর ঘরে দিন যাচ্ছে। সাহেব বলেছে তার কোয়ার্টার মিলবে সামনের মাসে। বাপটা মাইরি শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছে। মা অবশ্য দুবেলা তাকে ঘরে ডাকছে। কিন্তু সেখানে যাবে কী করে সে যদ্দিন বাপ তাকে যেতে না বলেছে! নিরি কোয়ার্টার পেলেই ঘরে উঠে আসবে। আর বেশি দেরি করা যাচ্ছে না, বাচ্চাটা নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে এরই মধ্যে। হাতি তাড়িয়ে বাপ হয়ে গেল সে, আরে ইয়ার?

লাইনে এসে পিটপিট করল সিরিল। তুমুল বৃষ্টিতে সবকটা ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ বাইরে নেই। কার কাছে যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ও যে কখন মাংরা সর্দারের ঘরের সামনে এসেছে খেয়াল ছিল না। সেটা বুঝতে পেরে পেছন ফিরল। এতক্ষণ জলে ভিজে এবং সুরার প্রতিক্রিয়ার শরীর আর খাড়া থাকতে চাইছিল না। ওর চোখ বিদ্যুতের ঝলকে শুকরা বুড়োর খালি মাচাটাকে দেখল। ওখানে শুলে কেমন হয়? সারারাত বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সকাল বেলায় মরে পড়ে থাকবে। ধ্যৎ, মরার জন্য সে জন্মেছে নাকি! সিরিল টলতে টলতে বুকু সর্দারের দরজায় গিয়ে থামল। পঞ্চায়েত রায় দেওয়ার পর সে আর এমুখো হয়নি। এখন এই গভীর বৃষ্টির রাতে তার খুব ইচ্ছে হল নিরিকে দেখতে।

দরজা ধরে নিজেকে সামলাতেই সেটা মচমচ করে উঠল। শব্দটা ভেতরে যেতেই নিরির গলা বাজল, কে?

আমি। সিরিল ফিসফিস করল।

কৌন?

সিরিল।

ঢিবরি জ্বলল ভেতরে। তারপর দরজা খুলেই মুখে হাত নিয়ে অস্ফুট শব্দ করল দৃশ্য দেখে, কী হয়েছে, কোথায় গিয়েছিলে, এ অবস্থা কেন?

সিরিল বলল, হাম দেওয়ানা হো গ্যয়া।

হাত ধরে সিরিলকে ভেতরে নিয়ে এল নিরি। ওপাশের আড়ালে বুকু সর্দার হাঁড়িয়া খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। মাথার ওপর বৃষ্টির একটানা শব্দ! শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ ছটফট করছিল নিরি। এখন এরকম রাতে বড্ড একা লাগে।

ঘরে ঢুকে নড়চড়ে হয়ে গেল সিরিল। মায়ের মত যত্নে ওকে ভেজা জামাকাপড় থেকে বের করে এনে শুকনো বিছানার উত্তাপে শুইয়ে দিল নিরি। শরীরের ভেতরে একজন শরীরের বাইরে আর একজনকে জড়িয়ে সারারাত পাতি তুলতে লাগল বুকের ঝুড়িতে।

আর সেই নরম শরীরের উত্তাপে ডুবে যেতে যেতে সিরিল বিড়বিড় করল, ইয়ে মেরে জায়গা, খাস জায়গা।

.

হাওয়া গরম হয়ে উঠল চা বাগানের। জলপাইগুড়ি থেকে য়ুনিয়নের বাবুরা ঘন ঘন আসছে এখন। যে পার্টির ওপর দেশের ভার তাদেরই য়ুনিয়ন দখলে। বাগানের কুলিদের ওপর য়ুনিয়নের প্রতাপ খুব। একটা ছোট অফিস অফিস খোলা হয়েছে। সেখানে বাগানের যে সব ছেলে য়ুনিয়ন, করে এসে গরম গরম কথাবার্তা বলছে সারাদিন। সারাবছর য়ুনিয়ন ঘুমিয়ে ছিল, এদেরও অস্তিত্ব বোঝা যেত না। এখন নেতাবাবুরা আসা মাত্রই এরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সিরিল গুদামের কাজ শেষ করে ওই অফিসে যায় রোজ। বোনাসের দাবিতে নেতারা সাহেবের বাংলোয় ঘন ঘন মিটিং করছে।

সিরিলের এখন মন মেজাজ ভাল। একঘরের একটা কোয়ার্টার তার ভাগ্যে জুটে গেছে এর মধ্যে। তেলিপাড়ার চার্চে গিয়ে বিয়ে করে এসেছে ওরা। নিরির এখন ভারী শরীর। পাতি তুলতে বাগানে যেতে কষ্ট হয়। গুদামবাবুকে বলে কয়ে ওকে গুদামের কাজে নিয়ে এসেছে সিরিল। আগে হলে এই সব অনুরোধ কেউ শুনতো না। কিন্তু য়ুনিয়ন অফিসে যাওয়া আসা করার পর তার কথা লোকে শুনছে এটা আবিষ্কার করে ওর মেজাজ খুশ। ছোটসাহেবকে অনেক বলে করেও সই করা বিয়েটা সম্ভব হল না বলে অবশ্য আফসোস হয়। নিরিটাই বিগড়ে গেল, টিপসই বিয়েতে রাজি হতে চাইল না কিছুতেই।

মিটিং ভেস্তে গেল। য়ুনিয়ন সরাসরি দাবি জানিয়েছিল বিশ পার্সেন্টের নিচে বোনাস নেওয়া হবে না। শ্রমিকদের রক্ত জল করা পরিশ্রমের বিনিময়ে কোম্পানি মুনাফা লুঠছে, এবার থেকে তাদেরও কিছুটা ভাগ দিতে হবে। মিটিং যখন ভেঙেই গেছে তখন পরবর্তী কার্যক্রম স্থির করতে যুনিয়নের বাবুরা শহরে চলে গেল। খবরটা চালু হয়ে যেতে হাওয়াটা আরো জোরালো হল। শালা সাহেব বোনাস বাড়াতে রাজি নয়। একটা বিশৃঙ্খল মেজাজ এসে গেল চা বাগানে। সিরিলদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সমস্ত শ্রমিকদের সংগঠিত করে আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে। এই বাগানের ইতিহাসে এরকম ঘটনা প্রথম। লোকজন ডেকে সিরিল বোঝাতে শুরু করল, ইয়ে বাগান হামারা হ্যায়। আমরা জন্মেই-এর চায়ের পাতা দেখি, মরবার আগেও ওই পাতার গন্ধ নাকে আসে। তাই বাগান থেকে যা লাভ হবে তার একটা মোটা অংশ আমাদের দিতে হবে। কোনো আইন দেখানো চলবে না।

প্রথম প্রথম সাধারণ মানুষ এসব কথা পরম বিস্ময়ের সঙ্গে শুনতো। এও কি কখনও হয়? সাহেবের সঙ্গে লড়াই? যারা বয়স্ক তারা কিছু বলতে চাইছে না। মাংরা সর্দার ভয় পাচ্ছে এই সব আহাম্মকির জন্যে ছেলের কপালে যে শাস্তি নাচছে তার আশঙ্কায়। ছেলে আলাদা থাকে বউকে নিয়ে কিন্তু এই রকম বেয়াদপি লড়াইতে নাক গলাচ্ছে দেখে দূরত্ব বাড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকল না।

কিন্তু একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র পেলে যেমন জলরাশি তার মাধ্যমে মুক্তি পাবার জন্য সচেষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে বিরাট সুড়ঙ্গ করে ফেলে তেমনি এক সময় সমস্ত চা বাগানের নারী-পুরুষ। উত্তাল হয়ে উঠল। ফ্যাক্টরিতে একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট কাজ সময় মতো না করায় ছোট গুদাম বাবু ফ্রান্সিস তাকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাবড়াচ্ছিল। অন্য সময় হলে ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদিতে ব্যাপারটা শেষ হতো, তাও শ্রমিকটির একদিনের বেতন কাটা যেত। কিন্তু এদিন ফ্রান্সিস ছুটে গেল বড় গুদামবাবুর কাছে। চোখ বড় এবং মুখের চেহারা বিহ্বল, ফ্রান্সিস নালিশ করল, শ্রমিকটি বলছে যা সে করেছে ঠিকই করেছে। তার যদি কিছু করার থাকে তো করুক। সব শেষে লোকটা ফ্রান্সিসকে বলেছে, সাহেবকা কুত্তা।

বড় গুদামবাবু সোজা হয়ে বসলেন। দূরের কিছু চা-বাগানে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হলেও এই বাগান ততদিন শান্ত ছিল। এই কথাটা তো খারাপ, মারাত্মক খারাপ। বোনাসের দাবিতে ওরা চেঁচামেচি করছে কাজের পর কিন্তু এ ধরনের ঔদ্ধত্য দেখাতে পারে বলে আশাই করা যায় না। তিনি লোকটিকে ডেকে পাঠালেন।

অল্পই বয়স, ওর বাপ মারা গেছে বছর তিনেক হল। হাতজোড় না করে কোনোদিন কথা বলতো না ওর বাপ। ছেলেটার নাম রেতিয়া।

বড় গুদামবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ছোট গুদামবাবুকে সাহেবের কুত্তা বলেছিস?

রেতিয়া বলল, ওটা ওর সঙ্গে আমার ব্যাপার, তুই নাক গলাচ্ছিস কেন?

এটা গুদাম, তোদের লাইন না। বলেছিস কিনা বল?

হ্যাঁ বলেছি।

তোকে আমি এখনই নোকরি থেকে ছাড়িয়ে দিতে পারি, জানিস?

ফুঁসে উঠল রেতিয়া, ইস! এটা আমাদের বাগান, ছাড়িয়ে দেব বললেই হল?

বড় গুদামবাবুর দীর্ঘকালের চাকরিজীবনে এ ধরনের বেয়াদপির মুখোমুখি কখনো হননি। স্বভাবতই তিনি উত্তেজিত হলেন। নিজের বয়স আর একটু কম হলে হয়তো মেরেই বসতেন লোকটাকে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংযত করে তিনি দ্রুত ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে সাহেবের বাংলোয় চললেন। মাথার ওপর শিরিষ গাছে পাখি ডাকছে, নদীর জলে যেখানে ফ্যাক্টরির হুইল ঘুরছে সেখানে অদ্ভুত একটানা শব্দ বেরুচ্ছে, চারধার গভীর নির্জন ছায়াময়। বড় গুদামবাবু সেই পথ ডিঙিয়ে এসে সাহেবকে সমস্যাটা নিবেদন করলেন। আজ থেকে বিশ বছর আগে হলে হার্ডসন সাহেবের চাবুকের তলায় রেতিয়ার রক্তাক্ত শরীর এরপরেই তিরতির করে নড়ত। বড় গুদামবাবু দেখলেন গুপ্তা সাহেব কথাটা শুনে বললেন, লেবার আনরেস্ট এখন চারধারে। আমরা লাকি যে এতদিন এখানে এসব হয়নি। ব্যাপারটা ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করতে হবে, ঠিক আছে ওকে পাঠিয়ে দাও।

বড় গুদামবাবু বললেন, হি শুড বি পানিশড। নইলে ওর দেখাদেখি আরো অনেক ঘটনা ঘটবে।

গুপ্ত সাহেব বলেছিলেন, নো প্রব্লেম, আমি দেখছি, ইউ গো।

বড় গুদামবাবু ফেরার পথে খুব বড় অভিমান বুকে নিয়ে হাঁটছিলেন। ওঁর মনে হচ্ছিল আর এখানে স্থির সুস্থ হয়ে কাজ করা যাবে না। যেখানে ম্যানেজারের কোনো মেরুদণ্ড নেই সেখানে কি করে শৃঙ্খলা থাকবে। এরপর হয়তো ওরা তার গায়েই হাত তুলবে একদিন।

কথাটা তিনি সেদিনই বাবুদের ক্লাবে গিয়ে তুললেন। অবশ্য একজন কুলি এ ধরনের কথাবার্তা বলেছে তা চাউর হয়ে গেছে তার আগেই। অন্যান্য কুলিরা বেশ মজা পাচ্ছে। রেতিয়া ওদের কাছে হিরো হয়ে যাচ্ছে এখন। তাই বড় গুদামবাবু বলার আগেও অন্যান্য বাবুরা একথা জেনেছেন।

মালবাবু বললেন, একি হল মশাই! ওদের বাপ-কাকারা কত ভালো লোক ছিল আর এরা তো ভাবিয়ে তুলল দেখছি।

পাতিবাবু বললেন, বুড়োরা ভাল ছিল, ছেলেছোকরাগুলোই ওদের খ্যাপাচ্ছে। সাহেব যদি এখনই স্টেপ না নেয় তাহলে আর দেখতে হবে না।

টাইপবাবু বললে, আস্পর্দা দেখে গা জ্বলে যায়। ছিলি ছোটনাগপুর হাজারীবাগে না খেয়ে, এখানে থাকতে দিয়েছি বলে মাথায় উঠবি।

মালবাবু বললেন, বাঙালি মশাই সর্বংসহা জাত। এই যে ছয়-সাত লাখ বাইরের লোক এখানে জুড়ে বসেছে তা নিয়ে কারো চিন্তা নেই। এখানে রয়েছে অথচ আমাদের সম্পর্কে কোনো ফিলিংস নেই। বাংলাদেশের কোন উপকারে লাগবে এরা? এই যে শুনি, লাখ লাখ বাঙালি ছেলে বেকার হয়ে রয়েছে। তারা যদি এসে এদের কাজ শুরু করে তাহলে তোরা কোথায় যাবি?

বড় গুদামবাবু বললেন, বাঙালিরা কখনই খাটনির কাজ করবে না, তাই এদের প্রয়োজন হবেই। কিন্তু একটা কিছু করা দরকার।

টাইপবাবু নিচু গলায় শুধোলেন, সাহেবের মতলব কী?

বড় গুদামবাবু জানালেন, বোঝা গেল না!

টাইপবাবু বললেন, আমাদের য়ুনিয়নে এই পয়েন্টটা তুলতে হবে। আসলে বোনাসের লোভ দেখিয়ে ব্যাটাদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। কি আবদার, বিশ পার্সেন্ট বোনাস চাই! কেউ দেয়? দিয়েছে কখনো। আমাদের য়ুনিয়ন অনেক লজিক্যাল, দশ পার্সেন্ট চাই।

মালবাবু বললেন, বেশি চাইলে অবশ্য ক্ষতি ছিল না কিছু।

যেটা পাওয়া যাবে না সেটা চাইলে কী লাভ? আকাশের চাঁদ চাই! কথাটা বলেই গলা নামালেন টাইপবাবু, একটু সাবধানে থাকবেন। আমরা মোটে পনেরোজন বাঙালি আর ওরা পনেরোশো।

মালবাবু বললেন, আমি ভাবছি ফ্যামিলি বাইরে পাঠিয়ে দেব।

বড় গুদামবাবু বললেন, আমরা পশ্চিম বাংলায় বসে এসব কথা বলছি, কি দুর্ভাগ্য বলুন। এরপর বাঙালি জাতুটার নাম মুছে যাবে।

পাতিবাবু চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষণ, হঠাৎ মনে পড়ে যেতে বললেন, আচ্ছা ছোটসাহেব লোকটার ব্যাপারটা কী বলুন তো, বাজারে কারখানা খুলে বসে আছে আর কুলিকামিনদের সঙ্গে গল্প করছে। বাঙালি বলেই বোধহয় এরকম অধঃপতন হয়। লোকটা যখন সাহেব ছিল তখনো কিরকম অ্যাবনরম্যাল বিহেভ করত।

এক মাসের নোটিস দিয়েছে লেবার য়ুনিয়ন। কোম্পানি যদি বোনাসের দাবি মেনে না নেয় তাহলে ধর্মঘট হবে। প্রচার চলছে লাইনে লাইনে। নেতারা এখন প্রায় সারাদিন ওদের মধ্যে রয়েছেন। সাহেব কোলকাতার সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ করেও কোনো রফায় আসতে পারছেন না। সিরিলের কথাটা এখন স্লোগান হয়ে সবার মুখে মুখে, ইয়ে বাগান হামারা হ্যায়–মালিকের লাভ আমাদেরও লাভ। এক মাসের নোটিশ কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রোডাকশান ফল করতে আরম্ভ হয়েছে। কারোরই কাজে মন নেই। যত দিন যাচ্ছে তত বাবুরা হুকুম করার মুখ সেলাই করছেন। বাবুয়ুনিয়ন ঘোষণা করেছে লেবার য়ুনিয়নের এই দাবির সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নেই। দরকার হলে তারা পৃথকভাবে আন্দোলন করবে। খবরটা শ্রমিকদের মধ্যে ছড়ানো মাত্র আগুন জ্বলল। সন্ধেবেলায় বাবুদের ক্লাব ঘেরাও করল সিরিলরা। জনা বিশেক লোককে উত্তেজিত হয়ে আসতে দেখে টাইপবাবু থরথরিয়ে কাঁপতে লাগলেন। তার বাড়ি কোলকাতায়। কোনো রকমে যে কথাটা। বললেন তা হল, বিদেশ-বিভুইয়ে চাকরি করতে এসে পৈতৃক প্রাণটা হারালাম মশাই, কী হবে!

বড় গুদামবাবু গাম্ভীর্য বজায় রেখে চাপা গলায় ধমকালেন, বিদেশ-বিভুঁই কি বলছেন, এটা তো পশ্চিম বাঙলাই।

বাইরে স্লোগান উঠছিল, মালিকদের দালাল হুঁশিয়ার, হামারা লড়াই রুটিকা লড়াই। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হলে সিরিল আর রেতিয়া ভেতরে ঢুকল। বাবুরা তখন তাস, দাবা ফেলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে রয়েছেন। সিরিল বলল, আপনাদের সঙ্গে আমাদের কথা আছে।

এদিন বড়বাবুও ক্লাবে ছিলেন। যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান মানুষ। চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুই? টাইপবাবু ফিসফিসিয়ে বললেন, মাংরা সর্দারের ছেলে সিরিল।

বড়বাবু বললেন, মাংরা সর্দার—মানে শুকরা বুড়োর নাতি! অ। তোর সঙ্গে কি কথা বলব। তোর বাপ-ঠাকুর্দাকে পাঠিয়ে দে।

এটা আমাদের ব্যাপার, ঠাকুর্দার নয়। সিরিল দাঁতে দাঁত চাপল।

তোর বাপও তো এখানে কাজ করে। বড় গুদামবাবু এবার কথা বললেন।

আমার ঠাকুর্দাকে তো আপনার চাবকাতেন, বাবাকে চোখ রাঙিয়ে পায়ের তলায় রেখেছিলেন তাই ওদের এখন আর আপনাদের সামনে আমাদের জন্যে আসতে দিতে পারি না। আমরাই কথা বলব। সিরিল একটু এগিয়ে চেয়ারে হাত রাখল। ওখানে বসবে কি বসবে না এই দোলায় দুলছিল সে।

বড়বাবু মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে, কী বলবি বল?

সিরিল বলল, আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন কি না বলতে হবে।

বড়মাবু নাক কুঁচকালেন, আমরা তো এক সঙ্গেই আছি। তোর বাপঠাকুর্দা এক সময় আমার বাড়িতে কাজ করে গেছে–এ আর নতুন কথা কী!

সিরিল চিৎকার করে উঠল, বোনাসের আন্দোলনে আপনারা বাবুরা আমাদের সঙ্গে ধর্মঘট করবেন কি না স্পষ্ট করে খুলে বলুন।

বড়বাবু বললেন, সেটা আমাদের য়ুনিয়ন যা বলবে সে-মত করব।

 রেতিয়া বলল, আপনাদের য়ুনিয়ন তো থাকবে না বলেছে।

বড়বাবু বললেন, তাহলে তো আমরা য়ুনিয়নের নির্দেশ অমান্য করতে পারি না।

সিরিল বলল, বাঃ, আপনারা সাহেবের সঙ্গে দোস্তি করবেন তাহলে?

বড়বাবু হাত তুলে কথা শেষ করতে চাইলেন, যা বলার বলা হয়ে গেছে।

সিরিল বলল, কিন্তু ব্যাপারটা একটু ভাবলে ভাল করতেন।

 বড় গুদামবাবু বললেন, কি! চোখ রাঙাচ্ছিস!

টাইপবাবু বললেন, জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতে হয় হারামজাদাদের। ছোটলোক ছোটলোকের মত থাকবি।

কথাটা গরম সীসের মতো সিরিলের কানে ঢুকতেই পাগল হয়ে গেল। একলাফে টাইপবাবুর টুটি টিপে ধরতে সে হাত বাড়াল। রেতিয়া চিৎকার করছে, বাবুরাও সমানে চেঁচাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ সিরিলকে টাইপবাবুর সামনে থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইছেন। বাইরের লোকজন আসল ব্যাপার না বুঝতে পেরে হই হই করে তেড়ে আসছিল। এই সময় একটা গাড়ি অন্ধকার হেডলাইটে চিরতে চিরতে সামনে এসে দাঁড়াল। বাবুরা কাঁপতে কাঁপতে দেখলেন ছোট সাহেব কখন ঘরে ঢুকে সিরিলের কাধ ধরে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে দিচ্ছে।

সিরিল প্রতি আক্রমণ করতে গিয়েও পারল না। ছোটসাহেব চাপা গলায় ধমকাল, কী আরম্ভ করেছিস তোরা, ছি ছি ছি। সিরিল তেড়ে উঠল, এ শালারা সাহেবের দালালি করছে আবার সেকথা বলতে আমাদের গালিগালাজ দিচ্ছে।

যাই করুক, তোর বাড়ি গিয়ে করেছে? ছোটসাহেব ওদের বের করে আনছিল। এতক্ষণে বড়বাবু একটু ধাতস্থ হয়েছেন। তার গলা শোনা গেল, একদম দৈহিক আক্রমণ, থানায় রিপোর্ট করতে হবে, ছোটসাহেব আপনি সাক্ষী থাকবেন!

ছোটসাহেব তখনও সিরিলের হাত ধরে ছিল, এসব ঝামেলা কেন করতে যাচ্ছেন।

ঝামেলা? একি কথা বলছেন স্যার! ওরা, এতবড় আস্পদা যে আমাদের গায়ে হাত তুলতে আসে? আপনি এটাকে সমর্থন করছেন? বড়বাবুর চোখ কপালে।

না। সমর্থন করিনি বলেই খবর পাওয়া মাত্র ছুটে এসেছি। প্রাইভেট প্রোপারটিতে এভাবে আমার ঢোকা উচিত নয় জেনেও এসেছি। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা উচিত, আত্মসম্মানবোধ আমাদের যেমন আছে ওদেরও আছে। সেখানে হাত দিলে এরকম হতেই পারে।

বড়বাবু হাসলেন, আপনি তো কয়েকটা বছর চা-বাগানে কাজ করেছেন। এখনও যদি চাকরিতে থাকতেন তাহলে আমি এভাবে কথা বলতে সাহস পেতাম না। সেটাই ভদ্রতা। এদের আপনি চিনবেন কোত্থেকে। দে হ্যাভ নো মর্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড। ফ্রান্সিসবাবু বাবু হয়েছে, কিন্তু এখনও বাড়িতে হাঁড়িয়া খায়।

টাইপবাবু ফোড়ন কাটলেন, উনি তো এখন লেবারদের বন্ধু, বাঙালির নাম ডুবিয়েছেন।

জ্বলে উঠল ছোটসাহেবের চোখ। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তার জন্যে গর্বিত। এই চা বাগানে আপনার মত বাবু পয়সা ফেললেই পাওয়া যায়। কিন্তু ওরা যদি হাত গোটায় তাহলে চা-ইন্ডাষ্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কথা বাদ দিন, সরলতা বস্তুটা তো উধাও হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে থেকে। সেটা এখনও এদের মধ্যেই দেখা যায়। অনুরোধ, এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবেন না।

বাইরে বেরিয়ে এসে ছোটসাহেব বললেন, তোরা এখানে এসেছিলি কেন?

রেতিয়া বলল, বাবুদের জিজ্ঞাসা করছিলাম হরতাল হলে ওঁরা আমাদের সঙ্গে আছে কিনা? তার উত্তরে যা-তা গালাগাল দিল।

ছোটসাহেব অন্যমনস্ক গলায় বলল, তোরা সত্যিই হরতাল করছিস?

সিরিল বলল, জরুর।

কেন করছিস?

বোনাসকে লিয়ে। নাফার ভাগ দিতে হবে।

কোম্পানি যদি না মেনে নেয় তাহলে কতদিন হরতাল করতে পারবি?

যব তক জিন্দা রহেগা–।

তাহলে ঠিক আছে। নিজেরা এক হ আর কে কী করল তাতে তোর কী দরকার। নিজেরা ঠিক থাকলেই হল। যা যে যার বাড়ি ফিরে যা।

ছোটসাহেব যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল বাজারের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে। বাবুদের ক্লাবের আলো জানলা দিয়ে তখনও অন্ধকারে নাচছে। সিরিলরা ঘেন্নার চোখে সেদিকে তাকিয়ে বড় রাস্তায় চলে এল। দলটা ভেঙে গেল, খেলাটা জমল না বলে অনেকেরই আফসোস হচ্ছে এখন। ছোটসাহেবটা না এলে জব্বর হত। বেশির ভাগই চলে গেল ভাটিখানার দিকে। দুপাশের লম্বা লম্বা গাছগুলোর বুকে মাঝে মাঝে আলো চলকে উঠছে। অন্ধকার রাত্তিরে এই আলোর মানে ওরা জানে। সিরিল আর রেতিয়া চুপচাপ হেঁটে এল একটা বড় দেবদারু গাছের তলায়। সেখানে হাফপ্যান্ট পরা দুটো বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে তারা অন্ধকারেই সাদা দাঁত দেখাল। তারপর একজন চট করে ওপরের ডালে টর্চের ফোকাস ফেলতেই অন্যজন দ্রুত গুলতির লক্ষ্য স্থির করল। সিরিল মাথা উঁচিয়ে দেখল। অনেক ওপরের একটা সরু ডালে বাদুড়টা ঝুলছে। তার চোখ টর্চের আলো পড়ায় তা জ্বলছে। হতভম্ব হয়ে সে নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছে। ব্যাপারটা কি এবং আলোর ঝলকানিতে কয়েক মুহূর্তের জন্যে বোধ হয় তার বোধও অসাড় হয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণেই শন করে শব্দ হওয়া মাত্র সিরিল বাদুড়ের মুখটাকে নড়বড়ে হয়ে যেতে দেখল। সুইচ টিপে টর্চের আলোর সুতো গুটিয়ে নিয়েই ছেলেটা নিচে মাটিতে আলো ফেলল। অন্যজন দ্রুত গিয়ে ধপাস করে পড়া বাদুড়টাকে তুলে নিল তার কাঁধের ঝোলায়। বেশ ভারী ওটা তা তোলার সময়েই বোঝা গেল। ছেলে দুটো নির্বিকার, পাওয়ার আনন্দ প্রকাশ না করে অন্য একটা গাছের দিকে নিঃশব্দে পা বাড়াল ওরা। রেতিয়া বলল, ফার্স্টক্লাস হাত। আধা কিলো হবে।

লাইনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিরিলের চোখে বাদুড়ের জ্বলন্ত চোখ দুটো বার বার ফিরে আসছিল। আঃ, যদি এমনি করে ওরা গুলতি দিয়ে একটিপে সব বাদুড়দের নামিয়ে আনতে পারে– তাহলে কি ভোজটাই না লাইনে হবে। মুশকিল হল সে নিজে যে এসব মাংস খায় না।

.

মাংরা সর্দারের নিশ্চিত ধারণা শুকরা বুড়োর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। বয়স হলে এরকম হয়। নইলে সে যেখানে আপত্তি করছে সেখানে তার বাপ হয়ে ওরকম রায় দেয়। সেদিন রাগের মাথায় সে বাপকে বলেছিল এ জায়গা ছেড়ে চলে যাবে টেবুয়াতে। বাপ খুশি হয়েছিল। আর তারপর থেকেই ট্যাঙস ট্যাঙস করে পেছনে লেগেই আছে, কবে যবি কবে যাবি শুনতে কান ঝালাপালা। মাংরা সর্দার মন ঠাণ্ডা হলে ভেবে দেখেছে চলে যাওয়ার কোনো মানে নেই। জন্মস্থান বা দেশ তো হয়েছেটা কী! এই পরিচিত গণ্ডি থেকে অন্য কোথাও যেতে তার ভীষণ ভয়। এখানে তার এখনও হুকুম করার ক্ষমতা আছে সেটা হারাবে কেন? ছেলেকে সে দূর করে দিয়েছে। কদিন এখানে ওখানে ঘুরঘুর করে মেয়েটাকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে সিরিল। খবর রাখে সে, বউটা যে ছেলের ঘরে যায় তাও জানে। একদিন নিরিকে দূর থেকে দেখেও ছিল, ভারী পেট নিয়ে হাঁটলেও বেশ ভালই দেখাচ্ছিল। মন নরম হতে দেয়নি মাংরা। অপমান ভোলা সম্ভব নয়, আসুক না নাতি।

অপমানের কথা উঠলেই বউটা অবশ্য তাকে তাতিয়ে দেয়। বেড়ালের থাবার নখ গজালে মাটিতে আঁচড়াবেই। আর সে মাটি নরম হয় তো বেড়ালের দোষ কী! জোয়ান ছেলে অমন সোমখ মেয়েছেলে পেলে কি আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে? লাইনে কি এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি? তার কটা বিয়ে-থা হয়েছে? অপমান যদি কেউ করে থাকে তো ওই মাটিতে যেতে বসা বুড়োটা। ওই তো যত নষ্টের গোড়া। শুকরা বুড়ো যদি ওরকম রায় না দিত তাহলে কি আর ছেলে পর হয়ে যেত। বউ বলে, নিজের বাপকে না বলে ছেলেকে শাসন করছে মাংরা সর্দার।

কথাটা যে নিজেরও মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু ওই বুড়ো মানুষটা তাকে জন্ম দিয়েছিল। তাকে বড় করেছে, হাত ধরে কাজে ঢুকিয়েছে। এই শরীরটা তাই সব দিক দিয়ে ওই মানুষটার কাছেই ঋণী। কি করে লোকটাকে সে বলবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। তাছাড়া এই তল্লাটে, জানাশোনা সব মানুষের মধ্যে ওর চেয়ে বেশি বয়স আরো কারো হয়নি। লোকে তাই ওকে চেনে, নাম বলে। সে যদি মানুষটাকে অনাদর করে তাহলে লোকে তাকেই খারাপ বলবে। তাই বউ-এর কথায় কান দেয় না মাংরা সর্দার।

কাজ হচ্ছে না বাগানে। কারণ হরতাল হবে। সাহেব বেশি বোনাস দিচ্ছে না তাই কাম বন্ধ। সেটা শুরু হওয়ার আগেই কিন্তু সবাই কাজে ঢিলে দেওয়া শুরু করেছে। প্রথম প্রথম চেঁচামেচি করেছে, ভয় দেখিয়েছে কিন্তু ক্রমশ মাংরা সর্দার বুঝে গিয়েছে এসবে আর কাজ হচ্ছে না। মানুষের মনে যদি একবার বেয়াড়াপনা ঢুকে যায় তাহলে কোনো শাসনই কাজ দেয় না। বরং উলটে তাকেই কথা শুনতে হচ্ছে। রাত হলে তাই শুকরা বুড়োকে মাংরা সর্দার ঘরে নিয়ে আসে হাত ধরে। সুস্থ থাকুক কিংবা মাতাল হোক সে এই কাজটা করবেই। অবশ্য যে দিন শরীরটা আর মাটি ছেড়ে উঠতে চায় না সেদিন আলাদা কথা। আজ ওরা দল বেঁধে এসে দা নিয়ে গেল। ঝগড়া করেও ঠেকাতে পারেনি মাংরা সর্দার। হরতাল হবে তাই পাঁচ টাকা করে চাঁদা। টাকা তুলে য়ুনিয়নের বাবুদের হাতে জমা দেবে ওরা। হরতালের সময় সাহেব তো মাইনে দেবে না তখন ওই টাকা নাকি তাদেরই সাহায্যে খরচ হবে। সরল বিশ্বাসে সবাই যখন কষ্ট করেও টাকা দিচ্ছে তখন সে একা কতক্ষণ ঝগড়া করতে পারে। পাঁচটা টাকা মানে অনেক বোতল হাঁড়িয়া। দুঃখে শোকে বুক ফেটে যাচ্ছিল তার।

শুকরা বুড়ো ঝিমুচ্ছিল। সামনের চা বাগানের ওপর ঘন অন্ধকার। হিম বাতাস বইছে। এক রাশ মশা তাকে হেঁকে ধরলেও আজকাল কোনো হুঁস নেই, মশারা বোধহয় শুকনো চামড়ায় তেমন রক্ত পায় না। খিদে পাচ্ছে কিন্তু কেউ না ডাকলে সে ওঠে কী করে। এমন সময় ছেলে এল।

বাপ, ঘর চল। মাংরা সর্দার আজ নেশা করেনি।

ঘোলা চোখে তাকাল শুকরা বুড়ো। হ্যাঁ ছেলেই তো। তারপর দু হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, মরে যাব বাপ। চা-পাতির গন্ধ পাচ্ছি না, আমি আর বাঁচব না। এখানে বসলেই আমি চা-পাতির গন্ধ পেতাম রোজ। আজ সকাল থেকে আর গন্ধটা নাকে আসছে না। সব পাচ্ছি শুধু ওটাই নেই। তুই আমাকে নিয়ে চল টেবুয়া, আর দেরি করিস না রে–। কান্নায় জড়ানো ঘড়ঘড়ে গলাটা আচমকা থেমে যেতে মাংরা সর্দার খুঁটিয়ে বাপকে দেখল। কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে, বুকটা নড়ছে ঘনঘন। হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল সে বাপকে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, দুদিন দাঁড়া বাপ। হরতালটা মিটে যাক, গোলমাল থেমে গেলে সাহেব বেশি টাকার বোনাস দেবে, তখন আমরা বেড়াতে যাব।

ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে দাঁড়িয়ে গেল শুকরা বুড়ো, হ্যাঁ। শুনলাম বটে, হরতাল হবে বাগানে। সব গেল, সর্বনাশ হয়ে গেল!

মাংরা সর্দার মাথা নাড়ল, তোমরা নাতিটা লিডার নেতা।

 দূর করে তাড়িয়ে দেবে সাহেব। কার সঙ্গে লড়ছিস তুই, ওদের বন্দুক আছে, পুলিস আছে, গায়ের চামড়া সাদা আছে। মাথা কেটে মাটিতে ফেলে দেবে।

ঘাড় নাড়তে গিয়েও থমকে গেল মাংরা সর্দার, সব ঠিক বাপ কিন্তু এখন যারা সাহেব তাদের চামড়া সাদা নয়। আমাদের চেয়ে একটু কম কালো। শুকরা বুড়ো মাথা উঁচু করে খবরটা শুনল। তারপর বিরক্তির গলায় বলল, তা হোক, তবু তো ওরা সাহেব। ওরা না থাকলে তোরা খাবার পেতিস? সাদা সাহেবেরা ওদের কাছে তোদের দিয়ে গেছে। লোভ, লোভ বড় বেড়ে গেছে মানুষের, এই করে মরবি-বাগান পুড়ে ছারখোর হয়ে যাবে।

মাংরা সর্দার ফিসফিস করে বলল, সবাই যখন এক হয়েছে তখন আর আমি কী করব বাপ; যদি পয়সা পাওয়া যায় তো কপাল বলতে হবে।

হ্যাঁ বাপ। সিরিলরা গিয়েছিল বাবুদের দলে টানতে, ওরা হটিয়ে দিয়েছে।

তো ওরা সাহস পায় না আর তোরা লড়বি। আর লড়ার দরকারই বা কী। পেট ভরে খাবার হাঁড়িয়া আর এই বাতাস নাক ভরে নিলেই তো জীবনটা বেশ কেটে যায়। না, না, এসব আর চোখে দেখতে পারব না, তুই আমাকে নিয়ে চল।

বাপের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সর্দার নিশ্চিত হলো আর এখানে থাকা যায় না। বাপ যা বলে তা যদি ঠিক হয় তাহলে টেবুয়া তো স্বর্গের মত একটা জায়গা। সেখানে গেলে শান্তি যদি পাওয়া যায় তবে সে নিশ্চয়ই যাবে। অন্তত ওই অবাধ্য ছেলেটার মুখ সেখানে গেলে দেখতে হবে না। তবে কিনা হাতে কিছু পয়সা না জমলে যায় কি করে সে। ট্রেনের খরচ আছে, সেখানে গেলে তো আর লোকে মুখে খাবার খুঁজে দেবে না। তাই টাকা জমানো দরকার। যদি হরতাল ঠিকঠাক হয় তাহলে মাংরা সর্দার বাপকে শুইয়ে দিয়ে ঠিক করল বোনাসটা নিয়েই যাওয়া যাবে।

সবরকম আলোচনা বিফল হল। বাগানের অবস্থা থমথমে। পনেরোশো মদেসিয়া শ্রমিক তো আছেই আরো কিছু লোক বাইরে থেকে যাওয়া-আসা শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত ধর্মঘট শুরু হল।

এইরকম অভিজ্ঞতা এ বাগানের মানুষের কাছে প্রথম। সকালে উঠে ভোঁ শুনতে পাচ্ছে না কেউ। লাইন দিয়ে টুকরি পিঠে নিয়ে মেয়ে পুরুষ পাতি তুলতে বেরুচ্ছে না। ফ্যক্টরিটা দীর্ঘকাল বাদে নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। সকালে উঠে লোকে আলসেমি করতে পারছে বেশ, দিনভর আড্ডা, ঠিক ছুটি ছুটি মেজাজ। কিন্তু কাজ না থাকায় নেশাটা জমকালো হল। হাঁড়িয়ার খরচ বেড়ে গেল অনেকের। বাগানের চা পাতার ওপর ধুলো জমল। দিন সাতেকের মধ্যেই অনেক গাছ ঔদ্ধত্যে মাথা তুলল এপাশ ওপাশ। ফ্যাক্টরির গেট তালা দেওয়া। ছেলে মেয়েরা এই চেহারা দেখতে যাচ্ছিল লাইন থেকে দল বেঁধে। এরকম বিস্ময় ওদের জন্যে অপেক্ষা করে ছিল তো। যেন ধারণাও বাইরে। এমনকি যে বড় হুইলটা নদীর বুকে ঘুরে ঘুরে ফ্যাক্টরিকে সচল রাখতে তার গায়ে স্রোতে ভেসে আসা আবর্জনার স্তূপ জমছে। এত বড় বাগান সর্বঅর্থেই নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ।

সুনিয়ন অফিসে এখন প্রচণ্ড কর্মতৎপরতা। হরতাল শুরু হওয়ার পরই যেন বাগানের সব। দায়িত্ব ওদের কাঁধে এসে চেপেছে। নিয়মিত শ্রমিক থেকে আর্দালি খালাসি পর্যন্ত এই ধর্মঘটের আওতায়। তারা দিনরাত ওখান ভিড় করছে সাহেব কোনো খবর দিয়েছে কিনা জানতে। এই লোকগুলোকে বুঝিয়ে ঠিক রাখতে হচ্ছে। শহরের বাবুরা সিরিলদের বলে দিয়েছেন সাধারণ শ্রমিকদের মন বড্ড নরম। অল্পেই নার্ভাস হয়ে যায়। ওদের সাহস দিয়ে সঙ্গে রাখতে হবে। তাই সিরিলদের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। এক সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই সবাই এসে হাত পাতা শুরু করল। য়ুনিয়ন যদি সাহায্য না করে তবে কারোরই হাঁড়ি চড়বে না। হপ্তার মাইনে পেলে যাদের পাঁচ দিনও চলে না তাদের পক্ষে এই অবস্থায় পড়া স্বাভাবিক। অনেক আলোচনার পর সিরিলরা ঠিক করল ব্যক্তিগতভাবে কাউকে টাকা দেওয়া হবে না। যে সংগ্রাম তহবিল ওরা সংগ্রহ করেছে তা থেকে প্রতি লাইনে দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হল। ধর্মঘট শুরু হবার পর সিরিল আবিষ্কার করল এতদিন বাদে মনে হচ্ছে এই চা-বাগান ওদের নিজেদের। এখন আর কারো হুকুম এখানে চলছে না। তারা যা বলবে তাই হবে যে জায়গায় তা কি নিজেদের দেশ নয়। ও জানে, শুকরা বুড়ো কিছুতেই এটা মানবে না। এই থুথুরে বুড়োর মাথায় যা ঢুকে আছে তার কোনো পরিবর্তন হবে না। আর এই ব্যাপারটা বাপের মাথাতেও কিছুটা আছে। ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর যারা সকালে কাজে গিয়ে বাধা পেয়ে ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে বাপটাও আছে। এর মধ্যে একদিনও য়ুনিয়ন অফিসে আসেনি মাংরা সর্দার। সহকর্মীদের কাছে এর জন্যে নানান ঠাট্টা শুনতে হয়েছে সিরিলকে। কিন্তু সেই পঞ্চায়েতের রাতের পর বাপ আর তার সঙ্গে কথা বলে না। প্রথম প্রথম কেয়ার করত না সিরিল, এখন যেন মনটা কেমন লাগে। ধর্মঘটটা মিটে যাক তারপর একদিন সে একটা ব্যবস্থা করবেই।

দিনরাত খাটতে হচ্ছে বলে বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না সিরিল। ধর্মঘট শুরু হওয়ায় নিরির ভালই হয়েছে। কিন্তু যত সময় এগিয়ে আসছে ততই ঘ্যানঘেনে হয়ে উঠছে মেয়েটা। ঘরে গেলেই সিরিলকে আটকে রাখতে চায়। শরীরটাও ভাল নয়। বাচ্চা হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে মেয়েদের সব সৌন্দর্য বোধহয় শুষে নেয় পেটের বাচ্চা। সিরিল চেয়েছিল বুকু সর্দারের বাড়িতে গিয়ে থাকুক নিরি বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু কেন যেন রাজি হয়নি মেয়েটা। জেদ ধরে আছে স্বামীর ঘরেই থাকবে সে কোথাও যাবে না আশেপাশের বুড়িদের বলে রেখেছে সিরিল কিছু হলেই খবর যেন য়ুনিয়ন অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েটার চোখের টান ভুলতে পারে না সে সময় সময়। ধর্মঘট চালু হওয়ার পরও হাসপাতাল খোলা ছিল ডাক্তারবাবু নার্স দুবেলা নিয়ম করে বসত। কিন্তু বাবুদের ব্যাপারটা ঘটতেই সেটা বন্ধ। নিরির যদি তেমন কিছু হয় তাহলে–ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় সিরিলের। শালা, এই একটা ব্যাপার কিছুতেই গায়ের জোরে সমাধান করা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *